১১.
সূর্যাস্তের প্রায় এক ঘণ্টা আগে, অবশেষে জলাভূমির প্রান্তে পৌঁছুনো গেল। তারপরই মাটি ধীরে ধীরে উঁচু হতে হতে ঢেউ খেলানো পাহাড়ের চেহারা নিয়েছে। প্রথম ঢেউয়ের গোড়ায় পৌঁছে রাত কাটানোর জন্যে থামলাম আমরা। পালুকি থেকে নেমেই ছুটে গেলার্ম লিওর কাছে। আরো খারাপ হয়েছে ওর অবস্থা। নতুন উপসর্গ দেখা দিয়েছে-বমি করছে ঘন ঘন। সারারাত চললো এই ভাবে। বেচারা উস্তেন সাধ্য মতো শুশ্রুষা করছে ওর। একটু কম অসুস্থ জবেরও দেখাশোনা করছে। সত্যি উস্তেনের মতো অক্লান্ত সেবিকা জীবনে আর দেখিনি আমি।
জলাভূমি পেয়োনোর পরই আকাশ-পাতাল পরিবর্তন এসেছে আবহাওয়ায়। দুর্গন্ধ বিদায় নিয়েছে, না শীত না গরম একটা অবস্থা, মশাও নেই বললেই চলে। বেশ কদিন পর একটু ঘুম হলো রাতে।
ভোরে উঠে দেখলাম আরো খারাপ হয়েছে লিওর অবস্থা। এক রাতেই শুকিয়ে প্রায় অর্ধেক হয়ে গেছে। এমন সময় বিলালি এলো। বললো, এখনি রওনা হওয়া দরকার। কারণ, আর আধ দিনের ভেতর যদি শান্ত কোনো জায়গায় পৌঁছে উপযুক্ত শুশ্রুষার ব্যবস্থা না করা হয় তাহলে লিওকে আর বাঁচানো যাবে না।
সুতরাং আবার রওনা হলাম আমরা। জ্বরের ঘোরে যেন না পড়ে যায় সেজন্যে লিওর পালকির পাশে পাশে হেঁটে চললো উস্তেন।
সূর্য ওঠার আধ ঘণ্টার ভেতর নিচু পাহাড়টার চূড়ায় পৌঁছলাম আমরা। সামনে সবুজ ঘাসে ছাওয়া পাহাড়ী ভূমি। এখানে ওখানে ছোট ছোট ঝোপ-ঝাড়। নানা রঙের অগুনতি ফুল ফুটে আছে তাতে। বহু দূরে—আন্দাজ করলাম মাইল আঠারো হবে-মাথা তুলেছে বিরাট একটা পাহাড়। চেহারা দেখে মনে হয়, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের ফলে সৃষ্টি হয়েছিলো। প্রায় গোল দেখতে। চূড়াটা ক্রমশ সরু হতে হতে আকাশের গায়ে মিশেছে। মেঘের দল ঘুরে ফিরে বেড়াচ্ছে চূড়ার এপাশে ওপাশে। একটু কম উঁচু একটা পাহাড়ী দেয়াল ঘিরে রেখেছে গোল পাহাড়টাকে।
পালকিতে বসে অপূর্ব এই দৃশ্য দেখছি, এমন সময় বিলালির পালকিটা পিছিয়ে চলে এলো আমারটার পাশে।
ওখানে থাকে সে! বললো বৃদ্ধ। আর কোনো রানীর এমন সিংহাসন দেখেছো?
সত্যিই অপূর্ব, পিতা। কিন্তু, আমরা ঢুকবো কি করে ওর ভেতর?
সময় হলেই দেখতে পাবে, বেবুন। নিচে পথের দিকে তাকাও, তোমরা তো বুদ্ধিমান মানুষ, কি বুঝতে পারছো?
তাকিয়ে দেখলাম, ঘাসে ছাওয়া একটা রাস্তা মতো, সোজা এগিয়ে গেছে পাহাড়টার পাদদেশ পর্যন্ত। পথের দু’পাশে খাড়া উঁচু পাড়। হুবহু খালের মতো। পার্থক্য একটাই-পানি নেই এতে।
রাস্তার মতোই মনে হচ্ছে বটে, বললাম আমি। তবে রাস্তার চেয়ে শুকনো খাল বা নদীর সঙ্গেই সাদৃশ্য বেশি এটার।
ঠিক বলেছো, পুত্র। ওটা খালই। আমাদের আগে যারা এ এলাকায় বাস করতো তারা কেটেছিলো। অনেক আগে ঐ পাহাড়ের কাছে একটা হ্রদ ছিলো। ওখান থেকে পানি নিয়ে আসার জন্যে অনেক বুদ্ধি খাঁটিয়ে খালটা তৈরি করেছিলো ওরা। পরিশ্রমও করেছিলো প্রচণ্ড। পাহাড়ের উঁচু দেয়ালে সুড়ঙ্গ কেটে প্রথমে পানি বাইরে আনতে হয়েছে তারপর খাল কেটে তা নিয়ে গেছে দূরে। পরে হ্রদটা শুকিয়ে গেছিলো—কি কারণে জানি না। তখন ওরা ঐ শুকনো হ্রদের তলায় বিশাল একটা নগর তৈরি করে। কালক্রমে সেই নগরও ধ্বংস হয়ে ঐ পাহাড়ের চেহারা নেয়। নগরের কোর নামটাই কেবল টিকে আছে এখনো।
হুঁ, বুঝলাম, কিন্তু বৃষ্টির পানিতে আবার কেন ভরে গেল না হ্রদটা?
না, পুত্র, ওরা বুদ্ধিমান ছিলো। বিরাট একটা নালা কেটে দিয়েছিলো, বৃষ্টির পানি চলে যেতো ঐ নালা দিয়ে। ঐ যে সেই নালাটা। ডান দিকে ইশারা করলো বিলালি। দেখলাম প্রায় চার মাইল দূর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে একটা জলধারা। প্রথমে বোধহয় এই খাল দিয়েই পানি বয়ে যেতো। পরে এটাকে রাস্তা হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত নেয় ওরা। তখন ঐ খালটা কাটায়।
এই নালা ছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই পাহাড়ে ঢোকার?
আছে। তবে গোপন সেটা। অনেক পরিশ্রম করতে হয় ঐ পথে যেতে হলে।
সে সবসময় ওখানেই থাকেন? বাইরে আসেন না কখনো?
না, পুত্র, যেখানে আছেন সবসময় সেখানেই থাকেন তিনি।
.
সন্ধ্যার ঘণ্টা দেড়েক আগে সেই বিশাল আগ্নেয় পাহাড়ের ছায়ায় পৌঁছুলাম আমরা। প্রাচীন শুকনো খাল-পথ ধরে এগিয়ে চলেছে বেহারারা। সামনেই পাহাড়ী দেয়ালটা। কাছাকাছি পৌঁছে এখন দেখছি, একটা নয়, অনেকগুলো খাড়া খাড়া চূড়া। একটা ছাড়িয়ে উঠে গেছে অন্যটা। যত কাছে এগোচ্ছি তত স্পষ্ট হয়ে উঠছে প্রাচীন কোর নগরী যারা তৈরি করেছিলো তাদের শিল্প এবং কারিগরি নৈপুণ্যের পরিচয়। কি অসামান্য দক্ষতার সাথে পাহাড় কেটে সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। সামনেই দেখতে পাচ্ছি তার অন্ধকারা গহ্বর। কি বিপুল সংখ্যক লোক নিয়োগ করতে হয়েছিলো এ কাজে কে বলবে? কোথা থেকে ধরে আনা হয়েছিলো তাদের তা-ই বা কে জানে?
সুড়ঙ্গের মুখে এসে থেমে দাঁড়ালো আমাদের দলটা। রক্ষীদের দু’একজন প্রদীপ জ্বালার ব্যবস্থা করতে লাগলো। বিলালি তার পালকি থেকে নেমে এসে বিনীতভাবে জানালো, এখান থেকে চোখ বেঁধে নিয়ে যাওয়া হবে আমাদের। সে নাকি তেমনই নির্দেশ দিয়েছে।
আমি আপত্তি করলাম না। আপত্তি করার মতো শারীরিক অবস্থা নয় লিওর। কেবল জব-এখন একটু ভালো ওর শরীরের অবস্থা-খানিকটা গাঁইগুই করলো। কিন্তু ওর আপত্তিতে কান দিলো না কেউ। প্রদীপগুলো জ্বলে ওঠার পরপরই চোখ বেঁধে ফেলা হলো আমাদের। উস্তেনও বাদ গেল না। তারপর আবার চললো কাফেলা। এবার আর কিছু দেখতে পাচ্ছি না। পালকির মৃদু দুলুনি অনুভব করছি আর বেহারাদের পদশব্দের প্রতিধ্বনি শুনছি শুধু। একটু পরেই শুরু হলো একঘেয়ে জল পড়ার শব্দ। চোখ ছাড়া বাকি সব কটা ইন্দ্রিয় তীক্ষ্ণ্ণ করে বুঝতে চেষ্টা করছি, কোন্পথে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আমাদের।
কিছুক্ষণ পরেই বাতাস ভারি হয়ে উঠতে শুরু করলো। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। কিছু দেখতে পাচ্ছি না, তবে বুঝতে পারছি, এভাবে আর কিছুক্ষণ চললে দম বন্ধ হয়ে মারা যাবো। জোরে জোরে শ্বাস টেনেও ফুসফুস ভরাতে পারছি না, এমন সময় তীক্ষ্ণ্ণ একটা বাঁক নিলো পাকি। তারপর আরেকটা এবং আরেকটা। জল পড়ার শব্দ মিলিয়ে গেল। বাতাস আবার তাজা হয়ে উঠলো। কিন্তু বাঁক নেয়া চলছে সমানে। প্রথম কয়েকটা খেয়াল করতে পারলাম, কোন্ দিকে কোন্ দিকে মোড়া নিলো, পরেরগুলো গুলিয়ে ফেললাম।
আধ ঘণ্টা চললো এভাবে। তারপর হঠাৎ আলোর আভাস দেখতে পেলাম চোখের ফেটির ভেতর দিয়ে। আরো কয়েক মিনিট এগোলো পালকি। তারপর থেমে পড়লো। বিলালির গলা শুনলাম। উস্তেনকে নিজের চোখের বাঁধন খুলে আমাদেরগুলো খুলে দিতে বললো। উস্তেনের অপেক্ষায় না থেকে আমি নিজেই আমার বাঁধন খুলে চোখ মেলে তাকালাম।
যা ভেবেছিলাম তাই, পাহাড়ী দেয়ালটার অন্যপাশে এসে পড়েছি আমরা। গোল পাহাড়ের চূড়াটা তত উঁচু নয় এখান থেকে, শপাঁচেক ফুট হবে। তার মানে শুকিয়ে যাওয়া হ্রদের তলা অর্থাৎ বিশাল প্রাচীন জ্বালা মুখটা বাইরের মাটি থেকে বেশ উঁচুতে। বিলালিদের ওখানে যেটা দেখেছিলাম সেটার মতো বিশাল পেয়ালার আকৃতি এটারও, আয়তনে অন্তত দশগুণ বড়—এই যা তফাৎ। প্রাকৃতিক দেয়াল ঘেরা জায়গাটার এক বিরাট অংশে চাষাবাদ হয়। কয়েক জায়গায় গরু, ছাগল ও এই ধরনের আরো গৃহপালিত পশুর পাল ঘুরে বেড়াচ্ছে। যাতে ফসলের খেত নষ্ট করতে না পারে সেজন্যে পাথরের দেয়াল তুলে ঘিরে রাখা হয়েছে তাদের। বেশ দূরে, জায়গাটার প্রায় কেন্দ্রের কাছাকাছি বিশাল এক নগরীর ধ্বংসাবশেষ।
আপাতত আর কিছু দেখার সুযোগ পেলাম না, দলে দলে আমাহ্যাগাররা এসে ঘিরে ধরেছে আমাদের। গত কয়েকটা দিন যাদের মাঝে কাটিয়েছি হুবহু তাদের মতো, কি স্বভাবে কি চেহারায়। গায়ে গায়ে দাঁড়িয়ে অবাক চোখে দেখছে আমাদের। তারপর হঠাৎ একদল সশস্ত্র লোক দ্রুতপায়ে ছুটে এলো আমাদের দিকে। একেবারে সামনে কয়েকজন নেতৃস্থানীয় সৈনিক, প্রত্যেকের হাতে হাতির দাঁত দিয়ে তৈরি লাঠি। চিতার চামড়া ছাড়াও এদের পরনে রয়েছে লিনেনের আলখাল্লা। সম্ভবত সে-যাকে-মানতেই-হবের দেহরক্ষী বাহিনীর সৈনিক এরা।
বিলালির দিকে এগিয়ে এলো তাদের দলনেতা। হাতির দাঁতের দণ্ডটা আড়াআড়ি ভাবে কপালের সামনে ধরে অভিবাদন জানালো। তারপর কয়েকটা প্রশ্ন করলো। জবাব দিলো বিলালি। প্রশ্ন বা উত্তর কোনোটাই বুঝতে পারলাম না আমি। বিলালির জবাব শোনার সঙ্গে সঙ্গে ঘুরে দাঁড়ালো দলটা। চলতে শুরু করলো পাহাড়ী দেয়ালের ধার ঘেঁষে। আমাদের পালকি কাফেলাও রওনা হলো ওদের পেছন পেছন।
আধ মাইল যাওয়ার পর প্রকাণ্ড এক গুহামুখের সামনে থামলাম আমরা। প্রায় ষাট ফুট উঁচু হবে গুহাটা, চওড়ায় আশি ফুট। পালকি থেকে নামলো লিলালি। জব এবং আমাকেও অনুরোধ করলো নামতে। লিওকে কিছু বলার প্রশ্নই উঠলো না, কারণ এখনও ও অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে ওর পালকিতে। লিওকে ধরাধরি করে নিয়ে বিরাট গুহাটার ভেতর ঢুকলাম আমরা। কিছুদূরের একটা ফোকর দিয়ে অস্তায়মান সূর্যের স্নান আলো আসছে গুহায়। সূর্য ডুবে গেলে যেন ভেতরটা অন্ধকার না হয়ে যায় সেজন্যে অনেকগুলো প্রদীপ জ্বালানো হয়েছে। গুহার দেয়ালগুলো খোদাই করা ভাস্কর্যে মোড়া। বিলালিদের ওখানে পানীয়ের পাত্রে যে ধরনের কাজ দেখেছি অনেকটা সেরকম-প্রেমের দৃশ্য সবচেয়ে বেশি, তারপর শিকারের ছবি, প্রাণদণ্ড কার্যকর করার দৃশ্য, উত্তপ্ত লাল পাত্র মাথায় বসিয়ে অপরাধীদের শাস্তি দেয়ার দৃশ্য। যুদ্ধের দৃশ্য খুব কম দেখলাম। তাতে আমার ধারণা হলো, বাইরের শত্রুর দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা খুব বেশি নেই এদের। ভাস্কর্যগুলোর সাথে প্রাচীন কোনো জনগোষ্ঠীর কাজের সাদৃশ্য খুঁজে পেলাম না-না গ্রীক, না মিসরীয়, না হিব্রু, না আসিরীয়। সামান্য সাদৃশ্য যেটুকু, পেলাম তা চৈনিক ভাস্কর্যের সাথে। কালের গ্রাসে অনেক কাজই ক্ষয়ে গেছে। অনেকগুলো এখনো সম্পূর্ণ অক্ষত আছে।
সশস্ত্র রক্ষীরা দাঁড়িয়ে রইলো গুহার মুখে। এক এক করে আমরা ঢুকলাম ভেতরে। সাদা আলখাল্লা পরা এক লোক এগিয়ে এসে বিনীত ভাবে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালো। কিন্তু মুখে একটা শব্দও করলো না। লোকটা রানীর বোবা কালা পরিচারকদের একজন।
প্রবেশ পথ থেকে সমকোণে এগিয়ে গেলে ফুট বিশেক দূরে আরেকটা ছোট্ট গুহা মূলগুহার মেঝে ফুঁড়ে বেরিয়েছেন। ডান এবং বাঁ-দুদিকে দুটো মুখ সেটার। বাঁ দিকের মুখে দাঁড়িয়ে আছে দুজন রক্ষী। ধারণা করলাম সে থাকে ওটার ভেতরে। ডান দিকের মুখটায় কেউ নেই। বোবা লোকটা ইশারায় জানালো, ওটার ভেতরে যেতে হবে আমাদের। তারপর সে নিজেই পথ দেখিয়ে চললো।
এক জাতীয় ঘাসের আঁশে তৈরি পর্দা ঝুলছে ছোট গুহাটার মুখে। বোবা লোকটা হাত দিয়ে পর্দা উঠিয়ে একপাশে সরে দাঁড়ালো। ভেতরে ঢুকলাম আমরা। বেশ বড়সড় একটা কামরা বলা যেতে পারে, যথারীতি পাথর খোদাই করে বানানো। পরম স্বস্তির সাথে লক্ষ করলাম, আলো বাতাস আসার জন্যে একটা গর্ত আছে গুহাটার দেয়ালে। আরো আছে শোয়ার জন্যে পাথরের চৌকি, হাত-মুখ ধোয়ার জন্যে বড় পাত্র ভর্তি পানি, গায়ে দেয়ার জন্যে চিতার চামড়ার চমৎকার কম্বল।
চৌকির ওপর শুইয়ে দিলাম অচেতন লিওকে। উস্তেন বসলো ওর পাশে। এরপর বোবা নোকটা একই রকম আরেকটা কামরায় নিয়ে গেল আমাদের। জব নিলো এ ঘরটা। তারপর আরো দুটো কামরায়–একটা দখল করলো বিলালি একটা আমি।
.
১২.
প্রথমেই লিওর চিকিৎসার যথাসাধ্য বন্দোবস্ত করলাম। তারপর হাতমুখ ধুয়ে নিলাম আমি আর জব। আমাদের সব জিনিসপত্র এখন পর্যন্ত বয়ে এনেছে। বিলালির লোকজন। ফলে গায়ের নোংরা কাপড়গুলো বদলে নতুন একপ্রস্থ পোশাক পরে নিতে পারলাম। বেশ ঝরঝরে বোধ করছি এখন, সেই সাথে ক্ষুধার্তও। তাই একটু পরে যখন কোনোরকম আগাম ঘোষণা ছাড়াই গুহা মুখের পর্দা সরে গেল এবং নতুন একজন বোবা-কালা ঢুকলো তখন বিরক্ত হলাম না মোটেই। এবারের জন যুবতী। মুখ হাঁ করে আর হাত নেড়ে সে যা বোঝাতে চাইলো তার একটাই অর্থ হতে পারে-খাবার তৈরি, খেতে চলুন।
মেয়েটার পেছন পেছন আরেকটা গুহায় গিয়ে ঢুকলাম। শোয়ার কুঠুরিগুলোর প্রায় দ্বিগুণ এটা। অন্য একটা মেয়ের সঙ্গে জব আগেই পৌঁছে গেছে সেখানে। বেশ আড়ষ্ট দেখলাম ওকে। দুশ্চিন্তায় আছে সম্ভবত—যদি এই মেয়েটাও প্রেম নিবেদন করে বসে?
এই গুহার দেয়ালেও খোদাই করা সূক্ষ্ম ভাস্কর্য। বিষয়বস্তু মৃত্যু, মৃতদেহের সংরক্ষণ এবং সকার। গুহার প্রতি পাশে একটা করে পাথর কেটে বানানো টেবিল। চওড়ায় প্রায় তিন ফুট, উঁচু তিন ফুট ছয় ইঞ্চি। টেবিলের পাশে দেয়াল ঘেঁষে একটা করে ছোট বেঞ্চ মতো বেঞ্চ এবং টেবিল–সবগুলোই আটকানো গুহার মেঝের সাথে। অর্থাৎ পাহাড় কুঁদে যখন গুহা তৈরি করা হয়েছিলো আসবাবপত্রগুলোও সে সময়ই তৈরি করা হয়েছিলো। টেবিলের ওপর খাবার সাজানো—পরিষ্কার কাঠের থালায় সেদ্ধ ছাগলের মাংস, সদ্য দোয়ানো দুধ এবং ছাতুর তৈরি পিঠা।
খাওয়া শেষ করে লিওর কাছে ফিরে এলাম আমরা। এইটুকু সময়ের ভেতর আরো খারাপ হয়েছে ওর শরীর। অনবরত হাত-পা ছুঁড়ছে আর ভুল বকছে। ওকে জড়িয়ে ধরে শান্ত করার চেষ্টা করছে উস্তেন। কিন্তু পারছে না। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে বসলাম ওর পাশে। আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর একটু শান্ত হলো লিও। ভুলিয়ে ভালিয়ে একমাত্র কুইনাইন খাইয়ে দিলাম ওকে।
এক ঘণ্টার ওপর হয়ে গেছে, বসে আছি লিওর পাশে। ক্রমশ অন্ধকার হয়ে আসছে গুহার ভেতরটা। এমন সময় বিলালি এসে হাজির। ব্যস্তসমস্ত ভঙ্গি। জানালো, রানী নিজে আমার সাথে দেখা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। আমার জন্যে যে এটা দুর্লভ সম্মানের ব্যাপার তা-ও জানাতে ভুললো না।
খবরটা শুনে খুব একটা উৎফুল্ল হতে পারলাম না আমি। অসুস্থ লিওর জন্যে দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে মন। এর ভেতর কোথাকার কোন রানী দেখা করতে চাইলো কি না চাইলে তাতে কি এসে গেল? তবু বিলালির অনুরোধে তার সঙ্গে যাওয়ার জন্যে উঠে দাঁড়ালাম। সঙ্গে সঙ্গে মেঝেতে পড়ে থাকা উজ্জ্বল কিছু একটার ওপর চোখ পড়লো আমার। তুলে নিলাম জিনিসটা।
পাঠকের নিশ্চয়ই স্মরণ আছে, সূক্ষ্ম কারুকাজ করা রূপার বাক্সে একটা ছোট্ট গোল মোহর ছিলো। একটা সোনার আংটির ওপর সেটা বসিয়ে নিয়েছিলো লিও। মোহরটা এত ছোট যে আংটির ওপর সেটা বসাতে কোনো অসুবিধাই হয়নি। সব সময় ওটা পরে থাকতো লিও। সেই আংটিটাই এইমাত্র কুড়িয়ে নিলাম আমি। জ্বরের ঘোরে লিও যখন অস্থির ভাবে হাত-পা ছুঁড়ছিলো তখন বোধহয় খুলে পড়ে গেছিলো ওটা। রেখে গেলে হারিয়ে যেতে পারে ভেবে আংটিটা আমি হাতে পরে নিলাম।
বিলালির সঙ্গে লিওর গুহা থেকে মূল গুহায় বেরিয়ে এলাম। আমার দিকে তাকিয়ে চোখে চোখে ইশারা করলো বৃদ্ধ গোত্রপতি। ছোট গুহার বাঁ দিকের মুখটা দেখাল। তারপর এগোলে সেদিক আমিও এগোলাম পেছন পেছন। গুহাটার মুখে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে দুই রক্ষী। আমাদের দেখে মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালো তারা। এরপর হাতের লম্বা বর্শা দুটো আড়াআড়ি ভাবে কপালের সামনে ধরে দাঁড়িয়ে রইলো। মাথা নিচু করে সেগুলোর নিচ দিয়ে এগোলাম আমরা। কয়েক পা যেতেই আমাদেরকে যে ধরনের কামরায় থাকতে দেয়া হয়েছে হুবহু সেরকম একটা কামরায় আবিষ্কার করলাম নিজেকে। পার্থক্য একটাই, যে পথে আমরা ঢুকেছি সেটা ছাড়াও ঢোকা বা বেরোনোর আর একটা পথ আছে এটায়। অত্যন্ত উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত কুঠরিটা। দুজন পুরুষ এবং দুজন বোবা-কালা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালো এরাও, তারপর পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো। মেয়ে দুটো সামনে, পুরুষ দুজন পেছনে, আমি আর বিলালি মাঝখানে। অনেকগুলো পর্দাটানা গুহামুখ পেরিয়ে, ছোট বড় গুহার ভেতর দিয়ে এগিয়ে চললো আমাদের ছোট্ট মিছিল। অবশেষে আর একটা গুহামুখের সামনে পৌঁছুলাম আমরা। এখানেও দেখলাম, হলদেটে আলখাল্লা পরা দুজন রক্ষী পাহারা দিচ্ছে গুহামুখ। এরাও মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানালো। কপালের কাছে অস্ত্র তুলে ভেতরে ঢোকার পথ করে দিলো।
ভারি পর্দা সরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম আমরা। বিরাট একটা গুহা। লম্বায় প্রায় চল্লিশ ফুট, চওড়ায়ও একই রকম। অনেকগুলো প্রদীপের আলোয় আলোকিত। আট দশ জন মহিলা, বেশির ভাগই যুবতী এবং সুন্দরী, গদির ওপর বসে হাতির দাঁতের সুঁই দিয়ে সেলাইয়ের কাজ করছে। এই মেয়েগুলোও যথারীতি বোবা কালা। গুহার শেষ মাথায় আর একটা প্রবেশ পথ। সুন্দর প্রাচ্যদেশীয় কারুকাজ করা ভারি পর্দা দিয়ে ঢাকা। আগের গুহামুখগুলোয় যত পর্দা দেখেছি তার একটাও এটার মতো নয়। অত্যন্ত রূপসী দুই বোবা সুন্দরী দাঁড়িয়ে প্রবেশ পথের দুপাশে। আমরা এগিয়ে যেতে বুক পর্যন্ত মাথা নুইয়ে সম্মান জানালো তারা। সোজা হয়ে দুদিক থেকে দুজনে হাত বাড়িয়ে তুলে ধরলো পর্দা। এর পরই অদ্ভুত এক আচরণ করলো বিলালি। হামাগুড়ি দেয়ার ভঙ্গিতে বসে পড়লো। মাটিতে। বৃদ্ধের চেহারায় যে সৌম্য সম্রান্ত ভাব তার সাথে এ আচরণকে কিছুতেই মেলাতে পারলাম না। হাঁটু আর হাতে ভর দিয়ে গুড়ি মেরে ঢুকছে নতুন গুহাটায়। আমি এখনো সোজা দাঁড়িয়ে অনুসরণ করছি তাকে। গুড়ি মারা অবস্থায়ই ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে তাকালো বিলালি।
বসে পড়ো, পুত্র; বসে পড়ো, বেবুন, হাঁটু আর হাতে ভর দাও। সের সামনে যাচ্ছি আমরা। যথাযোগ্য সম্মান না দেখালে মুহূর্তে ছাই হয়ে যাবে!
থেমে পড়লাম আমি। হাঁটু দুটো নিজের অজান্তেই ভাঁজ হয়ে যেতে চাইলো। পরমুহূর্তে সচেতন হলাম আমি—কেন এমন অপমানজনক আচরণ করবো? আমি ইংরেজ, কেন জংলী এক মহিলার সামনে বানরের মতো হাঁটু গেড়ে বসবো, হলোই বা বিলালির ভাষায় আমার চেহারা বেলুনের মতো? উঁহু, কিছুতেই না। পরে যদি জীবন-মরণ সমস্যা দেখা দেয় তখন দেখা যাবে। বিলালির কথায় কান না দিয়ে দৃঢ় পায়ে হেঁটে চললাম আমি।
অদ্ভুত প্রাচুর্যের সমাহার এই গুহায়। দেয়ালগুলো জমকালো পর্দায় ঢাকা। এমন মনোমুগ্ধকর কাজ পর্দাগুলোয়, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। মেঝেতে পাতা গালিচার মতো ভারি শতরঞ্চি। গুহার এখানে ওখানে ছড়িয়ে আছে অনেকগুলো কালো আবলুস কাঠের ওপর হাতির দাঁতের কাজ করা গদিমোড়া আসন। প্রত্যেকটা আসনেই ঠেস দেয়ার ব্যবস্থা। গুহার শেষ প্রান্তে খানিকটা জায়গা আলাদা পর্দা দিয়ে ঘেরা। ভেতরে আলো থাকায় বাইরে থেকে ঝকঝকে দেখাচ্ছে। আমি আর বিলালি ছাড়া কোনো লোক নেই গুহায়।
অবশেষে গুহার মাঝামাঝি জায়গায় পৌঁছুলাম আমরা। হামাগুড়িতেও আর চললো না এবার। উপুড় হয়ে শুয়ে পড়তে হলো বিলালিকে। হাত দুটো এমন। ভাবে ছড়িয়ে দিয়েছে যেন মারা গেছে। অল্প কিছুক্ষণের ভেতর দ্বিতীয় বারের মতো হতভম্ব হলাম আমি। কি করবো বুঝতে না পেরে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলাম। সঙ্গে সঙ্গে কেমন একটা অনুভূতি হলো, আমি আর বিলালি শুধু নয়, আরো কেউ আছে এই কুঠরিতে—সামনের ঐ পর্দা ঘেরা জায়গার ভেতর থেকে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে। আমি তাকে দেখতে পাচ্ছি না, কিন্তু সে ঠিকই দেখতে পাচ্ছে আমাকে। কেন জানি না, সন্ত্রস্ত বোধ করতে লাগলাম আমি। সন্দেহ নেই জায়গাটা অদ্ভুত। চারদিকে কারুকাজ করা পর্দা, তার ওপর প্রদীপের ম্লান আলো পড়ে রহস্যময় একটা পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এমন গা শির শির করা অনুভূতি হওয়ার মতো কিছু তো নয়! নাকি বিলালির মতো একজন দুদে গোত্রপতি ভয়ে আধমরা হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়েছে দেখে এমন লাগছে?
অপেক্ষার দীর্ঘ সেকেণ্ডগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে এক এক করে। মিনিটে পরিণত হচ্ছে। তারপর আরও মিনিট। এখনো প্রাণের কোনো চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না। কোনো পর্দার একটা প্রান্তও একটু কাঁপেনি এখনো। অজানা এক ভয় ক্রমশ গ্রাস করছে আমাকে। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠেছে ভুরুর ওপর।
অবশেষে-কতক্ষণ পর জানি না-ধীরে ধীরে নড়তে শুরু করলো সামনের একটা পর্দা। চমকে সচেতন হলাম, আমি। কে আছে পর্দার পেছনে?—কোনো নগ্ন জংলী রানী? অপরূপা কোনো প্রাচ্যদেশীয় সুন্দরী? না চায়ের কাপ হাতে উনিশ শতকীয় কোনো যুবতী? কোনো ধারণা নেই আমার।. স্থির চোখে তাকিয়ে আছি সদ্য নড়ে ওঠা পর্দার দিকে।
সামান্য ফাঁক হলো পর্দা। তারপর হঠাৎ সেটার আড়াল থেকে বেরিয়ে এলো সুন্দর সুগোল একটা সাদা হাত। তুষারের মতো সাদা। আঙুলগুলো লম্বা, ক্রমে সরু হয়ে এসেছে ডগার দিকে, শেষ হয়েছে গোলাপী নখ দিয়ে আলতো করে পর্দার প্রান্ত ধরলো হাতটা। সামান্য টেনে আনলো এক পাশে। তার পরই একটা কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, বিদেশী!
মনে হলো এমন কোমল মিষ্টি কণ্ঠ আর কখনো শুনিনি আমি। ঝরনার মৃদু কল্লোলের কথা মনে পড়ে গেল আমার। আমাহ্যাগাররা যে ধরনের আরবী বলে তার চেয়ে অনেক সুন্দর এবং শুদ্ধ আরবীতে বললো, বিদেশী, এত ভয় পেয়েছো কেন?
আচমকা এই প্রশ্ন শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম আমি। ভয় পেয়েছি সত্যি, কিন্তু ও তা জানলে কি করে? এখনো তো আমাকে দেখেনি ও। প্রশ্নটার জবাব কি, দেবো ঠিক করে ওঠার আগেই পুরো সরে গেল পর্দা। দীর্ঘ এক নারীর অবয়ব দেখতে পেলাম সামনে। অবয়ব বলছি, কারণ শুধু শরীর নয় মুখটাও তার ঢাকা। সাদা প্রায় স্বচ্ছ রেশমী কাপড় দিয়ে কাফন পরানো লাশের কথা মনে পড়ে গেল আমার। নিজের অজান্তেই শিউরে উঠলাম একবার। প্রায় স্বচ্ছ কাপড়ের ভেতর দিয়ে তার গোলাপী শরীর দেখতে পাচ্ছি, সে শরীরের সৌন্দর্যও অনুভব করতে পারছি, তবু কেন যে এমন একটা উপমা মনে এলো ভেবে পেলাম না।
এত ভয় পেয়েছো কেন, বিদেশী? সেই মিষ্টি ঝরনার মতো গলা আবার জিজ্ঞেস করলো। আমার ভেতর এমন কি আছে যা দেখে ভয় পেতে পারে একজন পুরুষ? তাহলে বলতে হবে আগের চেয়ে অনেক বদলে গেছে পুরুষ জাত! এরপর হঠাৎই শরীরে মৃদু দোলা দিয়ে ঘুরে দাঁড়ালো সে, উত্তেজক ভঙ্গিতে উঁচু করলো একটা হাত, যেন তার সৌন্দর্যের সমস্তটাই দেখাতে চাইলো আমাকে।
কি বলবো বুঝতে পারছি না। মনে হচ্ছে কিছু একটা বলা দরকার।
আপনার সৌন্দর্যই আমাকে ভয় পাইয়ে দিচ্ছে, মহামান্য রানী, অবশেষে বিনীত ভঙ্গিতে বললাম আমি।
হুঁ, মিথ্যে চাটুকারি করে মেয়েদের ভোলানোর কৌশল তাহলে এখনো জানে পুরুষরা! হাসলো সে। কিসের সঙ্গে তুলনা করবো সে হাসির? আমার মনে হলো, দূর থেকে ভেসে আসা রূপোর ঘণ্টার মৃদু ধ্বনি যেন শুনলাম। তারপর আবার বললো, আহ, বিদেশী, মিথ্যে বোলো না! স্বীকার করো আমার অন্তর্ভেদী দৃষ্টি দেখে তুমি ভয় পেয়েছিলে। অবশ্য, মিথ্যে হলেও কথাটা তুমি বলেছিলে বেশ কায়দা করে, এবারের মতো ক্ষমা করা গেল তোমাকে। যত যা-ই হোক, মেয়ে তো আমি!
এবার বলো, ঐ বিশাল জলাভূমি পেরিয়ে গুহাবাসীদের এই দেশে এলে কি করে? কি দেখতে এসেছো? তোমাদের প্রাণ কি এতই সস্তা যে তা হিয়ার হাতে—সে—যাকে মানতেই-হবের হাতে তুলে দিতে না পারলে স্বস্তি পাচ্ছিলে না? আমার ভাষাই বা জানলে কি করে? এই প্রাচীন ভাষা কি এখনও প্রচলিত আছে পৃথিবীতে?
এক মুহূর্ত থামলো সে। তারপর আবার বললো, দেখতেই পাচ্ছে, গুহা আর ধ্বংসস্তূপের মাঝে আমার বাস, দুনিয়ার আর কোনো কিছু সম্পর্কে জানি না আমি, জানার ইচ্ছেও নেই। আমি বেঁচে আছি, হে বিদেশী, কেবল আমার স্মৃতি নিয়ে, আর সে স্মৃতিও এমন এক কবরে প্রােথিত যার অর্চনা করে আমার হাত। কারণ, সত্যি কথা বলতে কি, মানুষের মন কখনোই সত্য-সুন্দরের পথে থাকতে চায় না। শেষ দিকে এসে মৃদু হতে হতে, এক সময় মিলিয়ে গেল তার গলা। হঠাৎ চোখ গেল মেঝেতে উপুড় হয়ে থাকা বিলালির দিকে। সংবিৎ ফিরে পেলো যেন সে। সঙ্গে সঙ্গে আগুন জ্বলে উঠলো তার চোখে।
হুঁ! তুমি, বুড়ো; আছে এখানে! তোমার গোত্রে ঐ সব উল্টোপাল্টা ঘটনা ঘটলো কি করে? আমার নিষেধ সত্ত্বেও তোমার সন্তানরা আমার অতিথিদের একজনকে গরম পাত্র করে খেলে কোন সাহসে? ওরা জানে না; দেহ থেকে প্রাণ একবার বেরিয়ে গেলে আমিও আর ফিরিয়ে আনতে পারি না? এ সবের মানে কি, বুড়ো? আমি যদি এখন চরম প্রতিশোধ নিতে চাই, কি করবে তুমি?
ও হিয়া! ও সে! মেঝে থেকে মাথা না তুলেই ডুকরে উঠলো বৃদ্ধ। ও সে, আপনি মহানু, দয়া করুন আমাকে। আমি কোনো দোষ করিনি। আমি এখনো আপনার দাস, কীটানুকীট। ও সে আপনি যাদের আমার সন্তান বলছেন, তাদের চেয়ে খারাপ লোক হয় না। এক বেটি আপনার অতিথি শূকরছানার গলায় মালা দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়। স্বভাবতই সে খেপে ওঠে এবং অন্যদের সাথে দল পাকিয়ে আপনার অতিথি বেবুন এবং সিংহের সাথে আসা। কালো অতিথিকে গরম পাত্র করে খাওয়ার চেষ্টা করে। কালো লোকটা সম্পর্কে তো আপনি কিছু বলেননি, বোধহয় সেজন্যেই. অতখানি সাহস পেয়েছিলো ওরা। কিন্তু বেবুন আর সিংহ ব্যর্থ করে দিয়েছে ওদের সে চেষ্টা। কি ভয়ানক লড়াই না লড়তে হয়েছে আমার বেবুন, সিংহ আর শূকরছানাকে! ও হিয়া, অপরাধীদের আমি সাথে করে নিয়ে এসেছি। আপনি আপনার মহত্ত্ব দিয়ে যা বিবেচনা হয়, করবেন।
হু, বুড়ো, সব জানি আমি। ভয় পেও না। কাল বড় কামরায় বসবে, বিচার হবে ওদের। আর তোমাকে ক্ষমা করে দিলাম এবারের মতো। তবে সাবধান, ভবিষ্যতে আর যেন কোনো গড়বড় না হয় তোমার গোত্রে!
মাথা তুললো বিলালি। চোখে সকৃতজ্ঞ বিম্ময়। পর পর তিনবার মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করলো সে। তারপর যেমন এসেছিলো তেমনি হামাগুড়ি দিয়ে পিছিয়ে। বেরিয়ে গেল কুঠুরি থেকে। আমি একা দাঁড়িয়ে রইলাম সেই ভয়ঙ্কর অথচ অদ্ভুত মোহিনী মূর্তির সামনে।
.
১৩.
গেছে বুড়ো হাবড়াটা, বললো সে। ওহ্, জীবনে কি সামান্য জ্ঞানই না সঞ্চয় করে মানুষ! জলের মতো সগ্রহ করে, জলের মতোই বেরিয়ে যায় আঙুলের ফাঁক গলে। ভেবেছো লোকটা জ্ঞানী, তাই না? কিন্তু কি বলে ও ডাকে তোমাকে। বেবুন, একটু হাসলো সে, অসভ্যদের কল্পনা শক্তি ঐ পর্যন্তই-একটা নাম রাখবে, তা-ও পশু-পাখির কাছে ছুটে যায়। তোমার দেশের লোকরা তোমাকে কি বলে ডাকে, বিদেশী?
হলি, মহারাণী, বললাম আমি।
হলি, অনেক কষ্টে সে উচ্চারণ করলো শব্দটা। হলি মানে কি?
হলি এক ধরনের কাঁটাওয়ালা গাছ।
আচ্ছা! তা যাই-বলো না কেন, দেখতে তুমি কিন্তু কাঁটাওয়ালা গাছের মতোই। দৃঢ় এবং কুৎসিত। তবে, আমার জ্ঞান যদি ত্রুটিপূর্ণ না হয়ে থাকে তাহলে বলবো, হাড়ে মজ্জায় সৎ তুমি, দুনিয়াদারি সম্পর্কে ভাবনা চিন্তা করারও প্রবণতা আছে তোমার ভেতর। কিন্তু, হলি, অমুন গাছের মতো দাঁড়িয়ে থেকো না তো, এসো, বসবে আমার সাথে। আমি চাই না, ঐ দাসনুদাসগুলোর মতো হামাগুড়ি দাও তুমি। আমি যাতে ওপাশে যেতে পারি সেজন্যে পর্দা ঘেরা অংশের একটা পর্দা এক পাশে উঁচু করে ধরলো সে।
কম্পিত পায়ে ঢুকলাম আমি। তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় অদ্ভুত এক সুগন্ধ এসে লাগলো আমার নাকে। একি তার গায়েরই সুগন্ধ না কিছু মেখেছে। বুঝতে পারলাম না।
পর্দা ঘেরা জায়গাটা লম্বায় হবে বারো ফুট, চওড়ায় দশ। হেলান দেয়ার ব্যবস্থাওয়ালা একটা আসন আর একটা টেবিল এক পাশে। টেবিলের ওপর একটা পাত্রে টলটলে পানি আর নানান রকম ফল। পাশেই গোল একটা পাথরের বাটি। এটাও পানি ভর্তি। প্রদীপের মৃদু আলোয় জায়গাটা কোমল ভাবে আলোকিত। সেই আলোর ভেতর অনিশ্চিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলাম আমি।
বসো, আসনটার দিকে ইঙ্গিত করে বুঝলো সে। এখনো ভয় পাওয়ার মতো কিছু করোনি তুমি। করলে অবশ্য খুব বেশিক্ষণ ভয় পাওয়ার সুযোগ পাবে না, তার আগেই আমি তোমাকে হত্যা কর্বো। সুতরাং গোমড়া মুখটাকে প্রফুল্ল করে ভোলো।
আসনটার এক প্রান্তে বসলাম আমি। অন্য প্রান্তে গা এলিয়ে দিলো সে।
এবার, হলি, বলো, আরবী বলতে শিখলে কি করে? আমার প্রিয় ভাষা এটা। জানো জন্মসূত্রে আমি একজন আরব?—আল আরাব আল আরিবা, অর্থাৎ আরবের-ও আরব। কাহতানের পুত্র ইয়ারাব আমার পিতা। ইয়ামান অর্থাৎ সুখী প্রদেশের প্রাচীন নগরী ওজাল-এ আমার জন্ম। অবশ্য একেবারে আমাদের মতো করে তুমি বলতে পারো না ভাষাটা। হামিয়ার উপজাতির কথায় যে মিষ্টি সাংগীতিক টান, তা নেই তোমার কথায়। কিছু কিছু শব্দও যেন বদলে গেছে। এই আমাহ্যাগারগুলো তো আরো দুরবস্থা করে ছেড়েছে আমার ভাষার। ওদের সাথে কথা বলার সময় মনে হয় আলাদা কোনো ভাষায় কথা বলছি। যাক, বলো কি করে শিখলে আরবী।
চেষ্টা করে শিখেছি, বললাম আমি। মিসর এবং আরো কিছু জায়গায় প্রচলিত এ ভাষা।
তার মানে আরবীতে এখনো কথা বলে মানুষ? মিসর নামের দেশটাও টিকে আছে এখনো? সিংহাসনে এখন কোন্ ফারাও? পারস্যের ওকাস বা তার আণ্ডাবাচ্চারাই কি এখনো শাসন করছে দেশটা?
না, পারসিয়ানরা অনেক আগেই বিতাড়িত হয়েছে মিসর থেকে প্রায় দুহাজার বছর আগে। তারপরে টলেমীয়, রোমান এবং আরো অনেক জাতি পারসিয়ানদের মত অমন গৌরবের শিখরে উঠেছে, দোর্দণ্ড প্রতাপে ঘুরে বেরিয়েছে নীলনদের ওপর দিয়ে। অবশেষে সময় ফুরিয়ে গেলে টুপ করে ঝরে পড়েছে। পারসিয়ান আর্তাজেরজেস সম্পর্কে কি জানেন আপনি?
হাসলো সে, কোনো জবাব দিলো না। তার হাসির রিনরিনে শব্দ আবার ঠাণ্ডা একটা স্রোত বইয়ে দিলো আমার শরীরের ভেতর দিয়ে।
এবং গ্রীস? জিজ্ঞেস করলো সে। গ্রীস নামের দেশটা কি আছে এখনো? আহ্, গ্রীকদের কি পছন্দই না করতাম আমি। দিনের মতো সুন্দর উজ্জ্বল লোকগুলো, বুদ্ধিমান, কিন্তু হৃদয় বলে কিছু ছিলো না।
হ্যাঁ, একটা গ্রীস এখনো আছে বটে। লোকও আছে সেদেশে। তবে আজকের গ্রীক জাতি আর প্রাচীন সেই গ্রীক জাতির ভেতর আকাশ পাতাল তফাৎ।
তাই নাকি! আচ্ছা হিব্রুদের খবর কি? এখনো কি ওরা জেরুজালেমে বাস করে? আর সেই মন্দিরটা? জ্ঞানী রাজা যেটা তৈরি করিয়েছিলো? ওখানে এখন কোন্ দেবতার পূজা হয়? ওদের মেসায়া (যীশু খ্রীষ্ট) কি এসেছিলো?
ইহুদি জাতি ছিন্নভিন্ন হয়ে ছড়িয়ে পড়েছে দুনিয়ার আনাচে কানাচে। ওদের সেই জেরুজালেম আর নেই। আর হেরোডের তৈরি সেই মন্দিরটা—
হেরোড! হেরোডকে তো আমি চিনি না। আচ্ছা বলে যাও।
রোমানরা পুড়িয়ে ফেলে মন্দিরটা। এখন সে জায়গায় মরুভূমি।
আচ্ছা, আচ্ছা! মহান জাতি ছিলো ওরা, ঐ রোমানরা—একেবারে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল!
Solitudiem faciunt pacem appellant, বললাম আমি।
আরে আরে, তুমি দেখছি ল্যাটিনও জানো! উহ! কতদিন পরে শুনলাম ল্যাটিন কথা! তবে তোমার উচ্চারণ কিন্তু রোমানদের মতো হয়নি। মনে হচ্ছে বহুদিন পর একজন পণ্ডিত লোকের সাক্ষাৎ পেয়েছি। গ্রীকও জানো নাকি?
হ্যাঁ, মহামান্য রানী, সমান্য হিব্রুও, তবে কথা বলতে পারি না। ওগুলো এখন মৃত ভাষা।
বাচ্চা মেয়ের মতো হাত তালি দিয়ে উঠলো সে। সত্যিই, হলি, ফলবান গাছ তুমি। দূর থেকে মনে হয় কদাকার কুৎসিত, কাছে গিয়ে ভালো করে তাকালে দেখা যায় ফল, জ্ঞানের ফল। কিন্তু, ইহুদীরা…আহ্ কি ভীষণ ঘেন্না করতাম এই ইহুদীদের! ওদেরকে আমার দর্শন শোনাতে গিয়েছিলাম, ওরা আমাকে পৌত্তলিক বলে গাল দিয়েছিলো। ওদের মেসায়া কি এসেছিলো শেষ পর্যন্ত? সারা দুনিয়া নিজের শাসনেনিতে পেরেছিলো?
হ্যাঁ, তিনি এসেছিলেন। তবে বড় দীনহীনভাবে। ওরা তাঁকে ক্রুশবিদ্ধ করে মেরেছে। কিন্তু এখনো তার বাণী বেঁচে আছে, কারণ তিনি ছিলেন ঈশ্বরের পুত্র। এখন, সত্যি কথা বলতে কি, অর্ধেক দুনিয়া শাসন করছেন তিনি, যদিও একটা মাত্র সাম্রাজ্যের মাধ্যমে নয়।
আহ্, নিষ্ঠুর নেকড়ের দল। যে এসেছিলো ত্রাণ করতে তাকেই কিনা মেরে ফেললি! জেরুজালেমে মন্দিরের সামনে আমার গায়েও পাথর ছুঁড়ে মেরেছিলো। আমিও গিয়েছিলাম ধর্মের কথা শোনাতে। এই দেখ, এখনো দাগ আছে! সুগোল হাতের ওপর থেকে কাপড় সরিয়ে ফেললো সে। ধবধবে সাদা বাহুর ওপর ছোট্ট একটা লাল দাগ দেখতে পেলাম।
আবার শিরশির করে উঠলো আমার শরীর। বললাম, বেয়াদবি মাফ করবেন মহামান্য রানী, আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না, প্রায় দুহাজার বছর আগে মেসায়াকে ক্রুশবিদ্ধ করে হত্যা করেছে ইহুদীরা, তারও আগে কি করে ওদের ধর্মের কথা শোনাতে গিয়েছিলেন আপনি? আপনি তো রক্তমাংসের মানুষ, অশরীরী আত্মা নন। কি করে দুহাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে বেঁচে থাকে একজন মানুষ?
আসনে হেলান দিলো সে। প্রায় স্বচ্ছ মুখাবরণের নিচে অদ্ভুত একজোড়া চোখের অন্তর্ভেদী দৃষ্টি আবার আমি অনুভব করলাম আমার শরীরে।
মনে হচ্ছে, অবশেষে ধীরে ধীরে বললো সে। দুনিয়ার অনেক কিছু সম্পর্কেই কিছু জানো না তোমরা। ইহুদীদের মতো তোমরাও কি বিশ্বাস করো, সব কিছু মরে যায়? আমি বলছি, শোনো, কিছুই মরে না। মৃত্যু বলে কিছু নেই পৃথিবীতে, পরিবর্তন বলে একটা ব্যাপার অবশ্য আছে। দেখ, পাথুরে দেয়ালের ওপর কিছু ভাস্কর্যের দিকে ইশারা করলো সে, এই ছবিগুলো যারা খোদাই করেছিলো, মহামারীর বিষনিঃশ্বাসে ধ্বংস হয়ে গেছে তারা। তিনবার দুহাজার বছর করে পেরিয়ে গেছে তারপর। কিন্তু ওরা মরেনি, হয়তো এমুহূর্তে তাদের আত্মা চলে এসেছে এখানে, চারপাশে একবার তাকালো সে। সত্যিই মাঝে মাঝে মনে হয়, আমার চোখগুলো দেখতে পাবে তাদের।
হ্যাঁ, কিন্তু পৃথিবীর কাছে তো তারা মৃত।
আঁ, হয়তো একটা বিশেষ সময়ের জন্যে, সেই সময় পরিধি শেষ হলে আবার তারা নতুন করে জন্ম নিয়ে পৃথিবীতে আসে। আমি, হ্যাঁ আমি, আয়শা–এটা আমার নাম, বিদেশী-আমি নিজে অপেক্ষা করে আছি একজনের জন্যে। তাকে আমি ভালোবাসি। নিশ্চিত জানি, সে আসবে, এবং আসবে এখানেই। এখানেই সে গ্রহণ করবে আমার ভালোবাসার অর্ঘ্য, যে অর্ঘ্য নিয়ে এখনো আমি অপেক্ষা করে আছি। কেন? বললে বিশ্বাস করবে না, আমি সর্বশক্তিমান, আমার সৌন্দর্য গ্রীসের হেলেনের সৌন্দর্যকেও হার মানায়, আমার জ্ঞান জ্ঞানী বাদশাহ সলোমনের জ্ঞানের চেয়েও গভীর, তোমরা যাকে মৃত্যু বলো সেই পার্থিব পরিবর্তনকে আমি কিছু দিনের জন্যে হলেও অতিক্রম করতে পেরেছি; তবু কেন আমি এই অসভ্য বর্বরদের মাঝে পড়ে আছি, জানো?
না, বিনীতভাবে বললাম আমি।
কারণ আমি আমার ভালোবাসার পাত্রের জন্যে অপেক্ষা করছি। প্রয়োজন হলে আরো পাঁচ হাজার বছর অপেক্ষা করবো। আমাকে খুঁজতে খুঁজতে সে আসবে এখানে। তার সঙ্গে খুব খারাপ আচরণ করেছিলাম সেবার। তবু আমার বিশ্বাস, এবার ওর মন গলবে। আমার সৌন্দর্যের খাতিরে হলেও গলবে।
কয়েক মুহূর্ত হতবুদ্ধির মতো বসে রইলাম আমি। আমার সব জ্ঞান বুদ্ধি গুলিয়ে যেতে চাইছে।
কিন্তু মহামান্য রানী, অবশেষে কথা ফুটলো আমার মুখে, আমরা মানুষরা যদি যুগে যুগে নতুন করে জন্ম নিই-ও, আপনার ক্ষেত্রে তো তা হচ্ছে না, আবার সেই অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। আপনি তো, তাড়াতাড়িওয়াগ করলাম আমি, একবারও মরেননি।
ঠিক, বললো সে, এবং সম্ভব হয়েছে অর্ধেকটা ভাগ্যক্রমে আর অর্ধেকটা জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে। বিশ্বের সবচে বড় রহস্যগুলোর একটার সমাধান করেছি আমি। বলো, বিদেশী, জীবন যখছে, কেন তাকে একটু দীর্ঘায়িত করা যাবে না? জীবনকে ধরে রাখার সেই কৌশলই আমি আয়ত্ত করেছি। যদি মন মেজাজ ভালো থাকে তাহলে ভবিষ্যতে এ সম্পর্কে আরো আলাপ করা যাবে। এখন বলো দেখি, কি করে আমি টের পেলাম তোমরা আসছো এবং গরম পাত্রের হাত থেকে বাঁচালাম তোমাদের, একবারও ভেবেছো?
জ্বি, অবাক হয়েছি, কিন্তু কোনো উত্তর পাইনি।
তাহলে এসো, ঐ পানির ওপর তাকাও, গোল গামলার মতো পাত্রটার দিকে ইশারা করলো সে।
উঠে টেবিলের কাছে গিয়ে তাকালাম আমি। সঙ্গে সঙ্গে কালো হয়ে গেল পানিটুকু। একটু পরেই আবার স্বচ্ছ। যা দেখার কথা জীবনে কল্পনা করিনি তা-ই দেখলাম এবার স্পষ্ট দেখলাম, আমাদের নৌকা সেই ভয়ঙ্কর খালের জলে ভাসছে। খোলর ভেতর শুয়ে ঘুমাচ্ছে লিও, মুখ দেখা যাচ্ছে না। মশার কামড় থেকে বাঁচার জন্যে একটা কোট মুড়ি দিয়ে আছে। আমি, জব আর মাহমুদ পাড়ের ওপর দিয়ে গুণ টেনে চলেছি। হুবহু যেমন ঘটেছিলো তেমন।
চমকে চিৎকার করে উঠলাম আমি, জাদু! এ জাদু!
না, না, হলি, জাদু নয়, এ হলো অজ্ঞতার স্বপ্ন। জাদু বলতে কিছু নেই পৃথিবীতে। প্রকৃতিতে এমন অনেক রহস্য আছে যার সমাধান হলে মনে হবে জাদু দেখছি। এই পানি আমার বীক্ষণ কাচ। ইচ্ছে করলেই আমি আমার জানা কোনো জায়গায় অতীতে কি ঘটেছে, বা বর্তমানে কি ঘটছে, জানতে পারি। তবে হ্যাঁ, ভবিষ্যতের ব্যাপারে কোনো ক্ষমতা নেই আমার কাচের। সেদিন হঠাৎই আমার ইচ্ছে হয়েছিলো, যে দুর্গম খাল পেরিয়ে একদিন এ জায়গায় এসেছিলাম সে খালের চেহারা এখন কেমন হয়েছে একটু দেখি। মনে মনে কথাটা ভাবতেই কাচে ফুটে উঠলো দৃশ্য। তখনই প্রথম দেখি তোমাদের নৌকা। একজন শুয়ে আছে ভেতরে বাকিরা সবাই গুণ টানছে। এখানকার জংলীগুলোর রীতি তো জানি, সঙ্গে সঙ্গে তোমাদের বাঁচানোর জন্যে খবর পাঠিয়ে দিয়েছিলাম বিলালির কাছে। আচ্ছা, এখন তোমার যুবক সঙ্গীর কথা বলো, বুড়ো যাকে সিংহ বলে ডাকছিলো। ওর সঙ্গেও দেখা করতাম, কিন্তু ও তো অসুস্থ। মারামারির সময় আহতও হয়েছে।
ও ভীষণ অসুস্থ, ভারাক্রান্ত গলায় বললাম আমি। আপনি কিছু করতে পারেন না ওর জন্যে? আপনি এতকিছু জানেন!
নিশ্চয়ই পারি। এক্ষুণি ওকে সুস্থ করে তুলতে পারি। কিন্তু ওর কথা উঠতেই এত বিমর্ষ হয়ে পড়লে কেন? যুবককে তুর্কি ভালোবাসো? ও কি তোমার ছেলে?
পালিত ছেলে, মহামান্য রানী! ওকে কি নিয়ে আসবো আপনার কাছে?
না। কদিন হলো ওর অসুখ?
আজ তৃতীয় দিন।
আর একদিন থাক তাহলে, দেখা যাক এর ভেতর নিজের শক্তিতেই সেরে ওঠে কিনা। ওষুধ দিলে এক্ষুণি ভালো হয়ে যাবে, কিন্তু তা আমি চাই না। আমার ওষুধের যা ক্ষমতা, তাতে ওর শরীরের ভেতরটা পুরো নাড়া খেয়ে যাবে। কাল রাতের ভেতর যদি ঠিক না হয়, তাহলে আমি যাবো ওর কাছে। ওর সেবা করছে কে?
আমাদের শ্বেতাঙ্গ ভূত। বিলালি ওর নাম দিয়েছে শূকরছানা। আর…একটু ইতস্তত করে শেষে যোগ করলাম, আর একটা মেয়ে, নাম উস্তেন। এদেশেরই মেয়ে। আমরা ওদের ওখানে পৌঁছার পরই ও আলিঙ্গন করে লিওকে। আপনাদের জাতির বিয়ের রীতি সম্পর্কে ঐ সময়ই প্রথম জানতে পারি আমরা।
আমাদের জাতি! আমার জাতি সম্পর্কে কিছু বোলো না! এই ক্রীতদাসগুলো আমার জাতির কেউ নয়। কুকুর ছাড়া কিছু মনে করি না ওদের। আর হ্যাঁ, আমাকে অত রানী রানী করবে না, খোশামুদি আমি একদম পছন্দ করি না, আয়শা বলে ডাকবে আমাকে। নামটা খুব মিষ্টি লাগে আমার কানে। আর এই উস্তেনটা কে? যার সম্পর্কে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছিলো আমাকে, সে-ই না
তো? শেষ কথা কটা যেন নিজেকেই শোনালো সে। তারপর শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করলো, দেখ তো, এই মেয়ে কিনা?
পানির দিকে তাকালাম আমি। অস্পষ্ট ভাবে উস্তেনের মুখটা দেখতে পেলাম। ঝুঁকে আবেগঘন চোখে দেখছে লিওকে।
এ-ই সে, মৃদুস্বরে বললাম আমি। ঘুমন্ত লিওর দিকে তাকিয়ে আছে।
লিও! আপন মনে উচ্চারণ করলো আয়শা। তার মানে ল্যাটিন ভাষায় সিংহ। এক বারের জন্যে হলেও ঠিক ঠিক নাম দিয়েছে তাহলে বুড়ো। আশ্চর্য, নিজে নিজে বলে চললো সে, খুবই আশ্চর্য! এত সাদৃশ্য—কিন্তু এ সম্ভব নয়। অস্থির ভাবে আবার একটা হাত পানির ওপর দিয়ে নিয়ে গেল সে। কালো হয়ে গেল জল। তাকিয়ে রইলো আয়শা। মুহূর্ত পরেই আবার স্বচ্ছ হয়ে গেল পানি। মুখ তুললো সে।
যাওয়ার আগে আর কিছু জিজ্ঞেস করবে, হলি? এখানে থাকতে খুব কষ্ট হবে তোমাদের, আমি নিজে তো নরক যন্ত্রণা ভোগ করছি। এই যে ফল দেখছো, কি। সুন্দর! কিন্তু বিস্বাদ লাগে আমার কাছে। কেবল ভাবি, কবে আমার অপেক্ষার পালা শেষ হবে। যাহোক, আমার মেয়েরা মেদের দেখাশোনা করবে।—জানো তো ওরা বোবা-কালা? চাকর হিসেবে এমন লোকই ভালো, তাই না? আমি অমন ভাবেই প্রজনন ঘটিয়েছি ওদের। কয়েক শতাব্দী কঠোর পরিশ্রম করতে হয়েছে। তারপরে এসেছে সাফল্য। আগেও একবার সফল হয়েছিলাম, কিন্তু চেহারা এমন কুৎসিত হয়েছিলো যে সব ক’টাকে মেরে ফেলতে বাধ্য হয়েছিলাম। একবার দৈত্যাকৃতি মানুষের এক প্রজাতিও তৈরি করেছিলাম। বেশিদিন টেকেনি ওরা। যাকগে, আর কিছু জানতে চাও তুমি?
হ্যাঁ, একটা ব্যাপার, আয়শা, দৃঢ় গলায় বললাম। টের পাচ্ছি, গলায়, চেহারায় যত দৃঢ়তাই ফুটিয়ে তুলি না কেন, মনে মনে মোটেই তত দৃঢ়তা অনুভব করতে পারছি না। আমি আপনার মুখ দেখতে চাই।
নির্ঝরের আওয়াজ তুলে হাসলো সে। ভেবে দেখ, হলি। ভালো করে ভেবে দেখ। গ্রীসের সেই পুরাণ কাহিনী তোমার জানা আছে নিশ্চয়ই? অ্যাতিওন, নামের সেই লোকটা মারা গেছিলো, তার পক্ষে সহ্য করা সম্ভব নয় এত বেশি সৌন্দর্য দেখে ফেলেছিলো সে। আমার মুখ দেখলে তোমারও হয়তো তেমন শোচনীয় পরিণতি হবে। অক্ষম বাসনায় জ্বলে পুড়ে হয়তো নিজের হৃৎপিণ্ড নিজে ছিঁড়ে খাবে। আমি তোমার জন্যে নই-একজন ছাড়া কোনো মানুষের জন্যেই নই।
আপনি ঠিকই বলেছিলেন, আয়শা, আমি আপনার সৌন্দর্যকে ভয় করি না। কোনো মহিলার সৌন্দর্যই আমাকে মুগ্ধ করে না কারণ, জানি, সব সৌন্দর্যহ একদিন ঝরে যাবে ফুলের মতো।
না, তুমি ভুল করছো, সব সৌন্দর্যই ঝরে যায় না। আমি যতদিন বেঁচে থাকবো আমার সৌন্দর্যও ততদিন অক্ষুণ্ণ থাকবে। একবার কারো সামনে আমার সৌন্দর্য উন্মোচিত হলে সে আর তা ভুলতে পারে না। বন্যার তোড়ের মতো সব ডুবিয়ে ধেয়ে আসতে চায় আমার দিকে। সেজন্যেই এই অসভ্যদের ভেতরে গেলেও আমি ঘোমটা টেনে যাই। বলো, এখনো দেখতে চাও তুমি?
হ্যাঁ, চাই! অদম্য হয়ে উঠেছে আমার কৌতূহল।
সাদা সুগোল একটা বাহু উঁচু করলো সে—এমন হাত জীবনে কখনো দেখিনি আমি! আস্তে, খুব আস্তে, চুলের নিচে হাত চালিয়ে একটা বাঁধন খুললো। তারপর হঠাৎ সেই লম্বা কাফনের মতো কাপড়টা খুলে পড়ে গেল তার শরীর থেকে। আমার চোখজোড়া উঠতে শুরু করলো তার গা বেয়ে। ধবধবে সাদা প্রায় স্বচ্ছ একটা ঝুলপোশাক এখন তার পরনে! নিখুঁত রাজকীয় দেহটার ভাঁজগুলো আড়াল করার চেয়ে প্রকট করে তোলার দায়িত্বই যেন পালন করছে সে পোশাক। ছোট ছোট সুন্দর পা দুটোয় চটি, সোনার পেরেক লাঞ্চনা। তারপর গোড়ালি, দুনিয়ার সেরা ভাস্কর স্বপ্নেও কখনো এমন নিখুঁত গোড়ালি দেখেনি। নিরেট সোনার তৈরি একটা দুই মাথাওয়ালা সাপ কোমরের সাথে এঁটে রেখেছে সাদা আলখাল্লাটা। এর ওপর থেকেই তার অপরূপ দেহসুষমা ঢেউয়ের মতো রেখায় ক্রমশ স্ফীত হয়ে উঠেছে। সে সৌন্দর্যের কথা বর্ণনা করে বোঝানো সম্ভব নয়। তুষার ধবল স্তন দুটোর উপর যেখানে ভাঁজ হয়ে আছে তার বাহু যুগল সেখানে শেষ হয়েছে আলখাল্লার প্রান্ত। আরো ওপরে তার মুখের দিকে তাকালাম আমি। সঙ্গে সঙ্গে কুঁকড়ে গেলাম ভেতরে ভেতরে। স্বর্গবাসী দেবীদের সৌন্দর্যের কথা শুনেছিলাম, এখন দেখলাম। এই নিখাদ সৌন্দর্যের তুলনা চলে কেবল আগুনের সঙ্গে, যা মনকে বিন্দুমাত্র শান্তি দেয় না, পোড়ায়, পুড়িয়ে ছারখার করে দেয়। কি করে এর বর্ণনা দেবো আমি জানি না, সত্যিই জানি না। দুনিয়ার কোনো কিছুর সঙ্গে এর তুলনা চলে না। বিশাল কালো একজোড়া চোখের কথা বলতে পারি, বাঁকানো ধনুকের মতো ভুরুর কথা বলতে পারি, উজ্জ্বল ত্বকের কথা বলতে পারি, কিন্তু তাতে কি কিছু বোঝা গেল? সৌন্দর্যের স্বরূপ কি উন্মোচন করতে পারলাম পাঠকের সামনে? স্তম্ভিতের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম আমি। অদৃশ্য কোনো চৌম্বক শক্তির প্রভাবে যেন আমার চোখ দুটো সেঁটে আছে তার মুখের ওপর। ফেরাতে পারছি না।
আমার দুরবস্থা দেখে হেসে উঠলো সে। পাগল করা সঙ্গীতের মতো সেই হাসি!
মূর্খ মানুষ? বললো সে। অ্যাকতিওনের মতো জেদ করেছিলে তুমি। সাবধান, অ্যাকতিওনের মতো শোচনীয় পরিণতি তোমারও হতে পারে। কারণ, ও হলি, আমিও একজন কুমারী দেবী। একজন ছাড়া আর কোনো পুরুষ আমাকে পাবে না। বলো, এখনো কি যথেষ্ট দেখনি?
মনে হচ্ছে, আমি অন্ধ হয়ে গেছি, কর্কশ গলায় কথাটা বলে হাত দিয়ে চোখ ঢাকলাম আমি।
আগেই তো বলেছিলাম, হলি, দেখতে চেও না। আমার সৌন্দর্য বিদ্যুতের মতো। সুন্দর, কিন্তু ধ্বংস করে—বিশেষ করে গাছ, আবার মাথা ঝাকিয়ে হাসলো সে।
হাসতে হাসতেই আমার হাত ঢাকা মুখের দিকে তাকালো আয়শা। অমনি হাসি মিলিয়ে গেল তার মুখ থেকে। আঙুলের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছি, কঠোর হয়ে উঠেছে তার চেহারা। চোয়ালগুলো দৃঢ় হয়ে গেছে। প্রাণের সব লক্ষণ দূর হয়ে গেছে মুখ থেকে। ছোবল দেয়ার আগে সাপ যেমন করে তেমনি মাথাটা পেছন দিকে হেলিয়ে বললো, তোমার হাতের ঐ গোল মোহরটা কোথায় পেয়েছো? বলো, না হলে এইমুহূর্তে তোমাকে ধুলার সঙ্গে মিশিয়ে দেবো, এক পা সামনে এগিয়ে এলো সে। ভয়ানক এক দ্যুতি দেখতে পাচ্ছি তার চোখে। থর থর করে কেঁপে উঠলো আমার ভেতরটা।
আমি কিছু বলার আগেই আবার সে বলে উঠলো, শান্ত হও, হলি! আবার আগের মতো কোমল হয়ে গেছে তার গলা। তোমাকে খুব ভয় পাইয়ে দিয়েছি, ক্ষমা করো। সীমাবদ্ধের জড়তা দেখে অসীম মন হঠাৎ হঠাৎ এমন অস্থির হয়ে ওঠে যে কি বলবো। যাকগে, যা জানতে চাইছিলাম, গোল মোহরটা—কোথায় পেয়েছো?
কুড়িয়ে, কোনো মতে উচ্চারণ করলাম।
আশ্চর্য! কাঁপা কাঁপা গলায় বললো আয়শা, হঠাৎ যেন নিছক একটা মেয়ে মানুষে পরিণত হয়েছে সে। হুবহু ওরকম একটা গোল মোহর আমি একজনের গলায় দেখেছিলাম। লোকটাকে আমি ভালোবেসেছিলাম। হঠাৎ যেন একটু ফুঁপিয়ে উঠলো সে। তাহলে, এটা না, একই রকম দেখতে অন্য কোনোটা হবে। সেটা তো এরকম আংটির ওপর লাগানো ছিলো না! ঠিক আছে, হলি, এখন তুমি যাও। আর হ্যাঁ, আয়শার সৌন্দর্য দেখেছো, কথাটা ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করো। ঘুরে দাঁড়িয়ে দুহাতে মুখ ঢাকলো সে।।
.
১৪.
রাত দশটার দিকে টলতে টলতে কোনোরকমে বিছানায় গিয়ে পড়লাম। গুছিয়ে ভাবতে পারছি না কিছু। এতক্ষণ যা শুনলাম, যা দেখলাম সব সত্যি না স্বপ্ন? দুহাজার বছরেরও বেশি বয়সের এক যুবতীর সাথে এইমাত্র কথা বলে এলাম, এ-ও কি সম্ভব? আর তার সেই ভয়ানক সৌন্দর্য? রক্তমাংসের কোনো মানুষ এত রূপসী হতে পারে? তাহলে কি ভৌতিক কোনো ব্যাপার? অসম্ভব, আমার বিজ্ঞানমনস্ক মন ভূতপ্রেতে কখনোই আস্থা আনতে পারে না। তাহলে যা দেখে এলাম তা কি বাস্তব? পাগল হয়ে যাবো নাকি?
মাথার চুল খামচে ধরে লাফিয়ে উঠলাম বিছানা ছেড়ে। সত্যি পাগল হয়ে যাবো, নাকি ইতিমধ্যেই গেছি? গোল মোহরটার কথা কি বলছিলো সে? জিনিসটা লিওর। ভিনসি দিয়ে গিয়েছিলো। ভিনসি পেয়েছিলো কোথায়? তার পূর্ব পুরুষদের কাছে। তাহলে কি সব সত্যি? যদি তা-ই হয়, আয়শা যার জন্যে অপেক্ষা করে আছে সে কি লিও? অসম্ভব! কে কবে কোথায় শুনেছে মানুষ মৃত্যুর পর জন্ম নেয় আবার?
কিন্তু কোনো মহিলার পক্ষে যদি দু’হাজার বছরেরও বেশি বেঁচে থাকা সম্ভব হয় তাহলে পুনর্জন্ম অসম্ভব হবে কেন?
হঠাৎ করেই আমার মনে পড়লে লিওর কথা। অনেকক্ষণ কোনো খবর জানি ওর। আশ্চর্য! আমার এত অধঃপতন হয়েছে, প্রাণপ্রিয় লিওর খোঁজ পর্যন্ত নিতে ভুলে গেছি! তাড়াতাড়ি বিছানার পাশে রাখা জ্বলন্ত প্রদীপটা তুলে নিয়ে খালি পায়ে নিঃশব্দে এগোলাম ওর গুহার দিকে। রাতের মৃদু বাতাসে পর্দা দুলছে। পা টিপে টিপে ঢুকে পড়লাম লিওর কামরায়। এখানেও একটা প্রদীপ জ্বলছে বিছানার পাশে শুয়ে আছে লিও। যদিও ঘুমিয়ে আছে কিন্তু জ্বরের ঘোরে এপাশ ওপাশ করছে। পাথরের একটা আসনে হেলান দিয়ে ঝিমোচ্ছে উস্তেন।
বেচারা লিও! গালটা ওর টকটকে লাল হয়ে উঠেছে। চোখের কোলে কালি। ঘন ঘন পড়ছে ভারি নিঃশ্বাস। আবার কথাটা আমার মনে হলো, বাচবে তো লিও? যদি বেঁচে যায়, নিশ্চয়ই আয়শার ব্যাপারে আমার প্রতিদ্বন্দী হয়ে উঠবে ও। ও যুবক, তার ওপর সুপুরুষ—অসম্ভব সুপুরষ; আর আমি মধ্যবয়সী প্রৌঢ়, কুৎসিত। কোনো আশা নেই আমার। ছি! কি ভাবছি আমি এসব! লিওর সঙ্গে প্রতিদ্বন্দিতায় নামবো আমি তা-ও আবার প্রেমের ব্যাপারে! ধিক আমাকে!
যাক, ধন্যবাদ ঈশ্বরকে, আমার ভালোমন্দের বোধ এখনো লুপ্ত হয়নি। সে তার সৌন্দর্য দিয়ে এখনো খুন করতে পারেনি আমার এই বোধকে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আমি প্রার্থনা করলাম—কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করলাম, আমার ছেলে, ছেলের চেয়েও বেশি, যেন ভালো হয়ে ওঠে।
যেভাবে এসেছিলাম তেমনি নিঃশব্দে ফিরে এলাম নিজের গুহায়। প্রদীপটা নামিয়ে রাখলাম মাথার কাছে। ঘুম আসছে না এখনো। পায়চারি করতে লাগলাম গুহার এমাথা ওমাথা। হঠাৎ দেখলাম পাথরের দেয়ালে সরু একটা ফাটল, আগে কখনো খেয়াল করিনি। প্রদীপ তুলে নিয়ে পরীক্ষা করলাম ফাটলটা। একজন। মানুষ কোনোমতে ঢুকতে পারে। ওপাশে নিকষ অন্ধকার। একটু ভয় পেলাম মনে মনে। যত অস্থিরই হই না কেন, এটুকু বোঝার মতো বুদ্ধি এখনো লোপ পায়নি যে, এরকম রহস্যময় জায়গায় শোয়ার কুঠুরি থেকে অজানা গোপন পথ বেরোনোটা খুব স্বস্তিজনক ব্যাপার নয়। যদি এখানে কোনো গুপ্তপথ থেকেই থাকে তাহলে জানতে হবে, কোথায় গিয়ে শেষ হয়েছে তা।
ঢুকে পড়লাম ফাটলটায়। এগিয়ে চললাম। কিছু দূর যাওয়ার পর দেখলাম এক প্রস্থ সিঁড়ি নিচে নেমে গেছে। সিঁড়ি বেয়ে নামতে লাগলাম আমি। আরেকটা সরু পথ, আরো নিখুঁত ভাবে বললে, সুড়ঙ্গে এসে পড়লাম। আগের মতো পাহাড় কেটে বানানো। এগিয়ে চললাম সুড়ঙ্গ ধরে।
কবরের মতো নিস্তব্ধতা। গা ছমছম করছে। তবু যেন কিসের অদম্য আকর্ষণে এগিয়ে চলেছি আমি। প্রায় পঞ্চাশ গজ মতো চলার পর সমকোণে এগিয়ে যাওয়া আরেকটা সুড়ঙ্গের মুখে এলাম। নতুন সুড়ঙ্গটায় মাত্র ঢুকেছি এ সময় ভয়ানক এক ব্যাপার ঘটলো। জোরে হাঁটছি বলে, না কি কারণে জানি না, নিবে গেল প্রদীপটা। নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের ভেতর দাঁড়িয়ে পড়লাম আমি। ভীষণ ভয় পেয়ে গেলাম। এই অন্ধকারে ফিরবো কি করে? হোঁচট খেয়ে নাক-মুখ ভাঙবে নির্ঘাৎ! সঙ্গে দেশলাই নেই যে নতুন করে জ্বালিয়ে নেবো প্রদীপ। ঘাড় ফিরিয়ে তাকালাম। নিরেট অন্ধকারের দেয়াল ছাড়া কিছু চোখে পড়লো না। সামনে তাকালাম—একই রকম অন্ধকার। কিন্তু না! বহু দূরে অস্পষ্ট একটা আলোর রেখা যেন দেখা যাচ্ছে! নিশ্চয়ই আলোকিত কোনো গুহা ওটা। ওখানে গিয়ে জ্বেলে নিতে পারবো প্রদীপ।
সুড়ঙ্গের গা হাতড়ে অনেক কষ্টে এগিয়ে চললাম। পা দিয়ে অনুভব করার। চেষ্টা করছি সুড়ঙ্গের মেঝে। যদি কোনো গর্ত থাকে তাহলেই হয়েছে। না মরলেও হাত-পা কিছু একটা যে ভাঙবেই তাতে সন্দেহ নেই। আলোর উৎসটা এখন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। একটা গুহার মুখে টানানো পর্দা ভেদ করে আসছে সুড়ঙ্গে। আর কয়েক পা গেলেই পৌঁছে যাবো গুহামুখে। কিন্তু, ও কি? ও ঈশ্বর!
বেশি বড় নয় গুহাটা! দেখে মনে হচ্ছে কোনো সমাধিকক্ষ। মাঝামাঝি জায়গায় জ্বলছে একটা অগ্নিকুণ্ড। আশ্চর্য, আগুন জ্বলছে কিন্তু ধোঁয়া উঠছে না! সেই আগুনের আলোয় আলোকিত গুহাটা। বাঁ পাশে দেয়াল ঘেঁষে পাথরের একটা তাক। তার ওপর পড়ে আছে যে জিনিসটা তাকে লাশ ছাড়া আর কিছু বলার উপায় নেই। অন্তত দেখে সে-রকমই মনে হচ্ছে। সাদা কাপড়ের মতো কিছু একটা বিছানো তার ওপর। ডান দিকে একই রকম আরেকটা তাক। কারুকাজ করা একটা কাপড় বিছানো সেটার ওপর। মাটিতে আগুনের সামনে একটু ঝুঁকে বসে আছে একটা নারীমূর্তি। লাশটার দিকে মুখ করে আছে সে। আগুনের লকলকে শিখার দিকে চোখ। আমি তার পাশটা কেবল দেখতে পাচ্ছি। কালো একটা দীর্ঘ আংরাখা তার পরনে। সবে মাত্র আমি সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছি, কি কুরবো, এমন সময় হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো নারীমূর্তি। গায়ের আংরাখাটা খুলে ছুঁড়ে দিলো এক পাশে।
নারীমূর্তি আর কেউ নয়, সে নিজে!
সন্ধ্যায় আমার পীড়াপীড়িতে কাফনের মতো আলখাল্লাটা খুলে ফেলার পর যে পোশাক ছিলো সেই পোশাক এখন তার গায়ে। ধবধবে সাদা, বুকের কাছে অনেকখানি নামানো, কোমরে আঁটা দুই মাথাওয়ালা সোনার সাপ। তার বিশাল চুলের রাশি এখনো তেমনি ছাড়া রয়েছে। নেমে এসেছে প্রায় গোড়ালি পর্যন্ত। কিন্তু এবার যে জিনিসটা আমার সবচেয়ে বেশি করে চোখে পড়লো তা তার সৌন্দর্য নয়। সৌন্দর্য এখনো আছে, কিন্তু তা ছাপিয়ে অব্যক্ত এক যন্ত্রণা, অন্ধ এক আবেগ আর ভীষণ এক প্রতিশোধ স্পৃহা ফুটে উঠেছে তার চেহরায়।
এক মুহূর্ত স্থির দাঁড়িয়ে রইলো সে। তারপর ধীরে ধীরে হাত দুটো তুললো উপরে। ঠিক সেই সময় তার পোশাকের ঊধ্বাংশটুকু পিছলে নেমে এলো সোনালি কটিবন্ধের কাছে। উন্মুক্ত হয়ে গেল তার নিটোল শরীরের উপরের অংশ। দাঁড়িয়ে রইলো সে। মুঠো পাকিয়ে উঠেছে হাতদুটো। আরো হিংস্র হয়েছে মুখের ভাব।
হঠাৎ আমার মনে হলো, এখন যদি ও আমাকে এখানে এভাবে দেখে, তাহলে কি হবে? কথাটা মনে হতেই অসুস্থ বোধ করতে লাগলাম আমি। কিন্তু তবু, কি যেন এক অমোঘ আকর্ষণে নড়তে পারলাম না সেখান থেকে।
মুঠো পাকানো হাত দুটো নেমে এলো পাশে। আবার উঠলো। অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, হাত উঁচু করার সাথে সাথে আগুনের শিখাও লকলকিয়ে বেড়ে উঠে প্রায় ছাদের কাছে পৌঁছালো। তীব্র আলোয় ভরে উঠলো গুহা।
আবার নেমে এলো হাত দুটো। তারপর সে কথা বলে উঠলো, বলা যায় হিসহিসিয়ে উঠলো আরবীতে। এমন একটা ভঙ্গি তার গলার স্বরে, আমার রক্ত হিম হয়ে যেতে চাইলো।
অভিশাপ পড়ক ওর ওপরে, অনন্ত অভিশাপ।
বাহু দুটো আবার উপরে তুললো সে। অমনি আগুনের শিখা লকলকিয়ে পৌঁছুলো ছাদের কাছে। নেমে এলো বাহু দুটো। সঙ্গে সঙ্গে স্তিমিত হয়ে এলো আগুনের শিখা।
অভিশপ্ত হোক ওর স্মৃতি-সেই মিসরীয়ের স্মৃতির মতো অভিশপ্ত।
আবার উঁচু হলো হাত, আবার লকলকিয়ে উঠলো আগুনের জিহ্বা। আবার নেমে এলো।
অভিশপ্ত হোক নীলনদের কন্যা, কারণ ও সুন্দরী।
আবার উপরে উঠলো হাত, আবার নেমে এলো।
অভিশপ্ত হোক ও, কারণ ওর জাদুর কাছে পরাভূত হয়েছিলাম আমি।
অভিশাপ পড়ুক ওর ওপর, কারণ, আমার প্রিয়তমকে ও আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছিলো।
আবার হাত উঁচু করে নামিয়ে আনলো সে। আবার লকলকিয়ে উঠে স্তিমিত হলো আগুনের শিখা। আর চাপা ক্রোধ মেশানো কণ্ঠে নয়, দুহাতে এবার চোখ ঢেকে চিৎকার করে উঠলো সে:
এখন আর অভিশাপ দিয়ে লাভ কি?—জয়ী হয়ে চলে গেছে সে।
তারপর আরো তীব্র গলায় সে বললো, যেখানে আছে সেখানেই ওর ওপর অভিশাপ পড়ুক। আমার অভিশাপ ওর শান্তি নষ্ট করে দিক। ওর ছায়াও অভিশপ্ত হোক।
আমার শক্তি সেখানেও ওকে তাড়া করে ফিরুক।
যেখানে আছে সেখানে বসেই যেন আমার কথা শুনতে পায় ও। ভয়ে যেন আঁধারের আড়ালে লুকায়।
নৈরাশ্যের অসীম গহ্বরে নিমজ্জিত হোক ও, একদিন ওকে আমি খুঁজে বের করবোই।
আবার স্তিমিত হয়ে এলো আগুন। আবার সে চোখ ঢাকলো হাত দিয়ে।
লাভ নেই—কোনো লাভ নেই, আর্তনাদ করে উঠলো সে। যে ঘুমিয়ে আছে তার কাছে কে পৌঁছুতে পারে? এমন কি আমিও না।
আবার সে শুরু করলো জঘন্য শাপশাপান্ত।
আবার যখন ও জন্ম নেবে, তখন যেন ওর ওপর অভিশাপ পড়ে। অভিশপ্ত হয়েই যেন সে জন্মায়।
হ্যাঁ, অভিশাপ নিয়েই যেন ও জন্মায়, তখন আমি ওর ওপর আমার প্রতিশোধ চরিতার্থ করতে পারবো। শেষ করে দেবো ওকে, নিশ্চিহ্ন করে দেবো।
এভাবে চললো আরো কিছুক্ষণ। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়লো সে। ঘন মেঘের মতো কালো চুল ঢেকে ফেললো তার মুখ, বুক। বসে বসে ফোপাতে লাগলো সে।
দুহাজার বছর, কান্নাভেজা করুণ স্বরে বললো সে। দুই হাজার বছর ধরে আমি অপেক্ষা করে আছি। শতাব্দীর পর শতাব্দী নিঃশব্দে পার হয়ে গেছে, কিন্তু আমার মনের জ্বালা তো একটুও কমেনি!
ওহ্, প্রিয়তম! প্রিয়তম! প্রিয়তম! এই বিদেশী কেন এভাবে তোমার কথা আমাকে মনে করিয়ে দিলো? গত পাঁচশো বছরে তো এমন কষ্ট আর পাইনি। যে পাপ আমি করেছিলাম তোমার কাছে, তার প্রায়শ্চিত্ত কি এখনো হয়নি? কেন আমি তোমার সঙ্গেই মরে গেলাম না? আমি তোমাকে মারলাম, আমি কেন মরলাম না? হায়, আমি মরতে পারি না! মাটিতে লুটিয়ে পড়ে গুমরে গুমরে কাঁদতে লাগলো সে।
অনেকক্ষণ পর হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো আবার। দ্রুত হাতে ঊর্ধ্বাঙ্গের কাপড় ঠিক করে এগিয়ে গেল পাথরের ওপর শোয়ানো মূর্তিটার দিকে।
ও ক্যালিক্রেটিস! চিৎকার করে উঠলো সে। নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে কেঁপে উঠলাম আমি। আবার আমি দেখতে তোমার মুখ। জানি আরো কষ্ট পাবো, তবু দেখবো। কম্পিত হাতে মৃতদেহ ঢেকে রাখা কাপড়টার এক কোনা ধরলো সে। কি মনে হতেই ছেড়ে দিলো আবার।
তুলবো তোমাকে? বললো সে। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে। আমি তা পারি। দুহাত বাড়িয়ে দিলো সে কাপড়টাকা দেহটার ওপর। দুচোখ ভরা আতঙ্ক নিয়ে আমি পেছন থেকে দেখলাম, কাপড়ের নিচের স্থির মূর্তিটা নড়তে শুরু করেছে। হঠাৎই হাত দুটো সরিয়ে আনলো সে। নড়াচড়া থেমে গেল মূর্তির।
কি লাভ? করুণ হয়ে উঠলো তার গলা। জীবন্তের সাদৃশ্য দিতে পারবো তোমাকে, কিন্তু আত্মা তো দিতে পারবো না। আমার সামনে দাঁড়িয়ে থাকলেও তুমি আমাকে চিনতে পারবে না। আমার প্রাণই তোমার ভেতরে ঢুকে তোমাকে সচল করবে। কি লাভ তাতে, ক্যালিক্রেটিস, কি লাভ?
কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইলো সে। তারপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়লো মূর্তিটার পাশে। আবার কাঁদতে শুরু করেছে। আর দাঁড়িয়ে থাকা সমীচীন মনে করলাম না আমি। টলতে টলতে ফিরে চললাম অন্ধকার সুড়ঙ্গ ধরে। ঐ নিচ্ছিদ্র অন্ধকারের ভেতর দিয়ে কি করে এগোলাম জানি না। শুধু মনে আছে দুবার আমি হোঁচট খেয়ে পড়ে গেছি। একবার দুই সুড়ঙ্গের সংযোগস্থলে পৌঁছে, আরেকবার সিঁড়ির মুখে। দ্বিতীয়বার পড়ে যাওয়ার পর আর উঠতে পারলাম না। ওখানেই বসে রইলাম। বেশ অনেকক্ষণ পর সংবিৎ ফিরতে পেছন ফিরে দেখলাম বহুদূরে সুড়ঙ্গের শেষ মাথায় ভোরের আলো দেখা যাচ্ছে। এবার আর পথ চলতে অসুবিধা হলো না। নিরাপদেই পৌঁছুলাম, আমার গুহায়। কোনোমতে গিয়ে শুলাম বিছানায়। সঙ্গে সঙ্গে ঘুম।
.
১৫.
ঘুম ভাঙতেই জবের ওপর চোখ পড়লো আমার। কাপড়-চোপড় সব গোছগাছ করে রেখে হাত-মুখ ধোয়ার জায়গায় পানির পাত্রটার সামনে গিয়ে গজ গজ করছে:
একটু যদি গরম পানি পাওয়া যেতো এই জংলীর দেশে!
কি ব্যাপার, জব?
ও, স্যার, আপনি জেগে? আমি ভেবেছিলাম বুঝি ঘুমিয়ে আছেন এখনো।
লিও কেমন আছে?
একই রকম, স্যার। শিগগির শিগগির কিছু একটা না করতে পারলে ওকে বাঁচানো যাবে বলে মনে হয় না। ঐ জংলী উস্তেন, স্যার, যথেষ্ট করছে ওর জন্যে। সারাক্ষণ আছে ওকে নিয়ে। আমাকে পর্য্নত ধারে ঘেঁষতে দিচ্ছে না। আপনি কি এখন উঠবেন, স্যার? নটা বেজে গেছে।
এমনিতেই কাল রাতের ঘটনায় এখনো বিকল হয়ে আছে মন, তার ওপর লিওর এই খবর। ঝটপট উঠে হাত-মুখ ধুয়ে কাপড় পরে নিলাম। খাওয়ার কুঠুরিতে গিয়ে অনিচ্ছাসত্ত্বেও কিছু মুখে দিলাম। তারপর গেলাম লিওর কাছে। উস্তেনকে জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছে ও। জবাবে নিঃশব্দে মাথা নেড়ে একটু কাঁদলো মেয়েটা। বিলালি ঢুকলো এই সময়। সে-ও মাথা নাড়লো। বললো, রাত নাগাদ মারা যাবে ও।
ঈশ্বর না করুন। ওকথা বলবেন না, পিতা, শঙ্কিত কণ্ঠে বললাম আমি।
সে তোমাকে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, বেবুন, লিওর ঘরের বাইরে আসার সঙ্গে সঙ্গে বললো বৃদ্ধ। কিন্তু সাবধান, পুত্র, কাল তুমি শুয়ে পড়ে সম্মান দেখাওনি তাকে। আজ তিনি বড় কামরায় বসবেন। সিংহ আর তোমার ওপর যারা হামলা করেছিলো তাদের বিচার হবে। আজও যেন কালকের মতো। কোরো না। এখন এসো, তাড়াতাড়ি।
বৃদ্ধের পেছন পেছন এগোলাম আমি। বিশাল বড় কামরায় পৌঁছে দেখলাম, অনেক কজন আমাহ্যাগার জড়ো হয়েছে সেখানে। দু’একজনের গায়ে লিনেনের আলখাল্লা, বাকিরা কেবল চিতার চামড়া পরে আছে। এই গুহারও দেয়ালে ভাস্কর্য খোদাই করা। এবং প্রতি বিশ বা বাইশ পা পর পর একটা করে মুখ, সমকোণে বেরিয়ে গেছে বাইরের দিকে।
অবশেষে গুহার শেষ প্রান্তে পৌঁছুলাম আমরা। সামনে পাথরের একটা বেদী মতো। কালো কাঠের ওপর হাতির দাঁতের কাজ করা একটা গদিমোড়া আসন। তার ওপর। বেদীর দুপাশে দুটো প্রবেশ পথ। বিলালি জানালো, দুটো পথই দুটো গুহায় গিয়ে শেষ হয়েছে। গুহা দুটো মৃতদেহে পূর্ণ। সত্যি কথা বলতে কি, যোগ করলো সে, পুরো পাহাড়টাই মৃতদেহে ভর্তি, এবং প্রায় সবগুলোই এখনো অবিকৃত রয়েছে।
প্রচুর লোক জড়ো হয়েছে বেদীর সামনে। নারী,পুরুষ দুরকমই। স্বভাবসুলভ গম্ভীর মুখে দাঁড়িয়ে আছে সবাই।
হঠাৎ সমবেত কণ্ঠে একটা গুঞ্জন উঠলো, হিয়া! হিয়া! (সে! সে!). পরমুহূর্তে সব কজন লোক সটান শুয়ে পড়লো মাটিতে। স্থির হয়ে পড়ে রইলো, যেন অজ্ঞাত কোনো কারণে একসাথে মারা গেছে সবাই। আমি কেবল, দাঁড়িয়ে রইলাম-একা। এর পরই বা দিকের একটা মুখ দিয়ে সারি বেঁধে একদল রক্ষী ঢুকলো। বেদীর দুপাশে অবস্থান নিলো তারা কাদের পেছন পেছন এলো এক কুড়ি বাবা-কালা পুরুষ। তারপর সমান সংখ্যক মহিলা বোবা-কালা, প্রত্যেকের হাতে প্রদীপ। অবশেষে সাদা আলখাল্লায় আবৃত দীর্ঘ এক নারীমূর্তি। সে। বেদীর ওপর উঠে আসনে বসলো আয়শা। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে গ্রীক ভাষায় বললো, এখানে এসো, হলি। আমার পায়ের কাছে বোসো। দেখ, যারা তোমাদের হত্যা করতে চেয়েছিলো তাদের কি বিচার করি।
মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করলাম আমি। কথা মতো বেদীর ওপর উঠে তার পায়ের কাছে বসলাম।
রাতে ঘুম কেমন হয়েছে, হলি? জিজ্ঞেস করলো সে।
সত্যি কথাই বললাম, খুব ভালো না, আয়শা!
একটু হাসলো সে। আমিও ভালো ঘুমোতে পারিনি কাল রাতে। স্বপ্ন দেখেছি। আমার ধারণা তুমিই স্বপ্নগুলো টেনে এনেছো আমার মনে।
কি স্বপ্ন, আয়শা?
একজনকে দেখেছি, তাকে আমি ঘৃণা করি; আর একজনকে দেখেছি, তাকে ভালোবাসি। এরপরই প্রসঙ্গ বদলালো সে। রক্ষীদের দলনেতার দিকে তাকিয়ে আরবীতে নির্দেশ দিলো, নিয়ে এসো লোকগুলোকে!
মাথা প্রায় মাটিতে ছুঁইয়ে সম্মান জানালো দলনেতা। তারপর অধীনস্তদের নিয়ে বেরিয়ে গেল ডানদিকের একটা পথ দিয়ে।
নীরবতা নেমে এলো গুহায়। কাপড়ে ঢাকা মুখটা হাতে ভর দিয়ে গভীর চিন্তায় ডুবে গেল আয়শা। কিছুক্ষণ পর অনেক মানুষের সম্মিলিত পায়ের আওয়াজ পাওয়া গেল ডান দিকের সেই পথে। একটু পরেই এক এক করে ঢুকতে লাগলো তারা। প্রথমে কয়েকজন রক্ষী। তারপর অপরাধীরা। জনাবিশেক হবে। বিষণ্ণ চেহারা প্রত্যেকের। তারপর আরো কয়েকজন রক্ষী। বেদীর সামনে পৌঁছেই দর্শকদের মতো মাটিতে শুয়ে পড়তে গেল অপরাধীরা। কিন্তু সে বাধা দিলো ওদের।
না, কোমল গলায় বললো আয়শা। দাঁড়িয়ে থাকো। আমি মিনতি করছি, দাঁড়িয়ে থাকো। শিগগিরই হয়তো এমন সময় আসবে যখন শুয়ে থাকতে থাকতে ক্লান্ত হয়ে পড়বে তোমরা। বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো সে।
বিমর্ষ মুখগুলোয় আতঙ্কের ছায়া পড়লো। সেদিন আমাদের সাথে যে আচরণই করে থাকুক না কেন, এ মুহূর্তে আমি ওদের জন্যে দুঃখ বোধ না করে পারলাম না।
আবার নীরবতা নেমে এসেছে গুহায়। এক এক করে প্রতিটা হতভাগার মুখ দেখছে আয়শা। অবশেষে, প্রায় দুতিন মিনিট পর কথা বললো সে।
এদের চোনো, অতিথি?
হ্যাঁ, মহামান্য রানী, প্রায় সবাইকে, জবাব দিলাম আমি। শোনার সঙ্গে সঙ্গে আরো করুণ হয়ে উঠলো লোকগুলোর চেহারা।
তাহলে বলো ঘটনাটা। যদিও, আমি আগেই শুনেছি, তবু আবার শুনবো, উপস্থিত এরাও শুনবে।
সংক্ষেপে আমি বললাম সেই বর্বর ভোজের কাহিনি। নিঃশব্দে শুনলো সবাই। আমি শেষ করতেই বিলালিকে ডাকলো আয়শা। যেমন শুয়ে ছিলো তেমনি শুয়ে রইলো বৃদ্ধ। কেবল মাথাটা সামান্য উঁচু করে সমর্থন করলো আমার বক্তব্য। আর কোনো প্রমাণ বা সাক্ষী হাজির করা হলো না।
আমরা সবাই শুনলাম, অনেকক্ষণ পর বললো সে। স্পষ্ট করে, মেপে মেপে উচ্চারণ করছে প্রতিটা শব্দ। কি বলার আছে তোমাদের, অবাধ্য সন্তানরা? বলো, কেন তোমাদের শাস্তি দেয়া হবে না?
কিছুক্ষণ কোনো জবাব শোনা গেল না। অবশেষে দশাসই চেহারার এক লোক, মাঝবয়সী, জবাব দিলো। সে জানালো, তারা যে নির্দেশ পেয়েছিলো, তাতে বলা হয়েছিলো, সাদা মানুষদের যেন কিছু না করা হয়। কালো চাকরটা সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। সেজন্যেই প্রথা অনুযায়ী তারা তাকে গরম পাত্র করে খাওয়ার সাহস দেখিয়েছিলো। সে-সময় আমরা বাধা দেয়ায় তারা খেপে গিয়ে আমাদের ওপর হামলা চালিয়েছিলো। সেজন্যে তারা অত্যন্ত দুঃখিত এবং মর্মাহত। এমনিতে আমাদের কোনো ক্ষতি করার ইচ্ছে তাদের ছিলো না। সবশেষে তাদেরকে এবারের মতো মাফ করে দেয়ার বিনীত আবেদন জানালো লোকটা। অবশ্য তার মুখ দেখেই আমি বুঝলাম ক্ষমা পাবার আশা সে বিশেষ একটা করছে না।
আবার অখণ্ড নীরবতা গুহায়। দর্শকরা মুখ গুঁজে পড়ে আছে। রক্ষীরা দাঁড়িয়ে আছে, নির্বিকার। প্রত্যেকের হাতে বর্শা, ছোরা। আসামীরাও দাঁড়িয়ে আছে মুখ নিচু করে। আর আমাকে পায়ের কাছে নিয়ে বসে আছে আয়শা। মুখ তুলে একবার দেখার চেষ্টা করলাম তার মুখের ভাব। কিন্তু ঘোমটার জন্যে দেখতে পেলাম না কিছু। তবু কেন জানি না মনে হচ্ছে, ভয়ানক কিছু ঘটবে এবার।
শেয়াল কুকুরের দল, নিচু গলায় শুরু করলো সে। তারপর ক্রমশ উঁচু গ্রামে চড়তে লাগলো তার গলা। অদ্ভুত এক শক্তির প্রকাশ শুনতে পাচ্ছি সে স্বরে। মানুষখেকোর দল, দুটো অপরাধ করেছিস তোরা। প্রথমত, সাদা মানুষ। হওয়া সত্ত্বেও এই বিদেশীদের আক্রমণ করেছিস, দ্বিতীয়ত, এদের চাকরকে হত্যা করেছিস। শুধু এই অপরাধেই তোদের মুত্যুদণ্ড হওয়া উচিত। সবচেয়ে বড় কথা, আমাকে অমান্য করার সাহস দেখিয়েছিস তোরা। তোদের গোত্রপিতা বিলালির মাধ্যমে আমার নির্দেশ পাঠাইনি তোদর কাছে? বলিনি যতের সঙ্গে গ্রহণ করতে হবে এই বিদেশীদের? তবু কেন ওদের গায়ে হাত তুলেছিস? ছোটবেলা থেকে তোদের শেখানো হয়নি, সের আইন অলংঘনীয়? তোরা কি জানিস না, আমার কথাই আইন? আর তা অমান্য করলে পাহাড় ভেঙে পড়তে পারে মাথার ওপর?
ভালো করেই জানতি তোরা দুরাচারের দল। তোদর হাড়ে, মজ্জায় দুর্মতি, তাই তোরা আমার আদেশ অমান্য করার সাহস দেখিয়েছিস। এর জন্যে অবশ্যই শাস্তি পেতে হবে তাদের। শাস্তি-গুহায় নিয়ে গিয়ে জল্লাদের হাতে ছেড়ে দেয়া হবে। আগামী কাল সূর্যাস্ত পর্যন্ত চলবে শাস্তি। তারপরও যারা বেঁচে থাকবে তাদের হত্যা করা হবে।
থামলো সে। আতঙ্কের একটা গুঞ্জন উঠলো গুহা জুড়ে। অপরাধীরা বুঝতে পেরেছে, নিস্তার নেই। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে কেঁদে কেঁদে ক্ষমা ভিক্ষা করতে লাগলো তারা। মায়া হলো আমার। আয়শাকে অনুরোধ করলাম, যেন ক্ষমা করা হয় ওদের। অন্তত কম যন্ত্রণাদায়ক কোনো উপায়ে, যেন শাস্তি দেয়া হয় লোকগুলোকে। কিন্তু অনমনীয় রইলো সে। গ্রীক ভাষায় বললো:
শোনো, হলি, এ হতে পারে না। এই নেকড়েগুলোকে যদি ক্ষমা করি, তাহলে আর একদিনও এদের ভেতরে নিরাপদ বুইবে না তোমাদের প্রাণ। এদের তুমি চেনো না। বাঘের চেয়ে হিংস্র এরা। রক্তের গন্ধ পেলে কিছুতেই মাথা ঠিক রাখতে পারে না। কিভাবে এদের শাসনে রাখি জানো? আমার রক্ষীদল দেখে হয়তো ভাবছো শক্তি দিয়ে। কিন্তু আসলে তা নয়, ভয় দেখিয়েই এদেরকে পথে
রেখেছি এখনো। এই বিশটা লোককে যন্ত্রণা দিয়ে মেরে কি লাভ আমার? কিছুই না। তবু আমার হুকুমের কোনো নড়চড় হবে না। কারণ, তাহলেই এরা নরম ভেবে বসবে আমাকে। তারপর আর কিছুতেই এদের বশে রাখা যাবে না। না, হলি, না, মরতেই হবে ওদের, এবং যেভাবে বলেছি সেভাবেই। তারপর হঠাৎ রক্ষীদের দলনেতার দিকে ফিরে যোগ করলো, যেভাবে বলেছি ঠিক সেইভাবেই!