১১-১৫. রবিনসন স্ট্রিট

রবিনসন স্ট্রিটের চোদ্দ নম্বর বাড়ির ফোন নাম্বারটা কিভাবে জানা যায়, ঠিক করতে পারছিল না রণিতা। একবার ভেবেছিল লালবাজারে রণজয়কে ফোন করে। পুলিশের বিপুল ক্ষমতা, ইচ্ছা করলে কয়েক মিনিটের ভেতর ওটা বার করে ফেলবে। পরক্ষণে তার মনে হয়েছে, না, পুলিশকে আপাতত জানাবে না।

প্রথমে সে নিজের মতো করে চেষ্টা করবে। না পারলে তখন দেখা যাবে। তার এক পিসতুতো দাদা অবনীশ ক্যালকাটা টেলিফোনের বিরাট অফিসার। আজ সকালে চাটা খাবার পর তাকে ফোন করল রণিতা।

ওধার থেকে অবনীশের ঘুম-জড়ানো ভারি গলা ভেসে এল, কে? তিনি বেশ লেট-লতিফ ধরনের মানুষ। অনেক রাত করে ঘুমোন, তাই উঠতে উঠতে দেরি হয়ে যায়।

রণিতা বলে আমি ছোট খুকি মণিদা–ওরা ভাইবোনরা অবনীশকে মণিদা বলে ডাকে।

অবনীশের ঘুমের শেষ রেশটুকু মুহূর্তে ছুটে যায়। তিনি দারুণ মজার গলায় বলেন, মাউন্ট হিমালয়া কি আজ ইন্ডিয়ার উত্তর থেকে দক্ষিণে সরে গেল নাকি?

রণিতা বলে, মানে?

নইলে ছোট খুকি নিজের থেকে আমাদের ফোন করে? কী সৌভাগ্য! দাঁড়া দাঁড়া, তোর বৌদিকে ডাকি–

রণিতা কিছু বলার আগেই ফোনে অবনীশের গলা ভেসে আসতে থাকে, শ্যামলী শুনছ, এদিকে এস, কুইক এরপর স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কী কথা হয় সেটা আর বোঝা যায় না। একটু পর শ্যামলী বৌদির গলা শুনতে পায় রণিতা, বড় ডিরেক্টর হয়ে আমাদের কথা ভুলেই গেছ। কতদিন আমাদের এখানে ফোন কর নি, আস নি-বল তো?

কথাটাঠিকই বলেছে শ্যামলী। বছরখানেকের ভেতর ওদের বাড়িযাওয়া তো বটেই, ফোনও করা হয় নি। বিব্রতভাবে রণিতা বলে, স্যরি বৌদি, খুব অন্যায় হয়ে গেছে। এবার থেকে দেখবে উইকে একবার করে তোমাদের ওখানে যাচ্ছি।

প্রমিস?

প্রমিস।

এরপর বাড়ির সবাই কে কেমন আছে, শ্যামলীর শাশুড়ি অর্থাৎ রণিতার আপন বড় পিসিমার বাতের কষ্টটা বেড়েছে কিনা, ওদের দুই ছেলে সানি আর বনির পড়াশোনা কেমন চলছে, ইত্যাদি নানা খবর নিয়ে রণিতা বলে, মণিদাকে আবার ফোনটা দাও

অবনীশ বলেন, হ্যাঁ, বল—

রণিতা বলে, একটা ব্যাপারে আমাকে হেল্প করতে হবে মণিদা–

আই সি। য়ু আর টকিং শপ নাউ। ভেবেছিলাম আমাদের জন্যে প্রাণ কেঁদে উঠেছে তাই ছোট খুকি এই সাতসকালে ফোন করেছে। এখন দেখা যাচ্ছে–

ইয়ার্কি কোরো না মণিদা—

অবনীশ বলেন, আচ্ছা আচ্ছা, বল কী করতে হবে?

রণিতা বলে, আমি একটা বাড়ির ঠিকানা জানি কিন্তু ফোন নাম্বার জানি না। ফোন নাম্বারটা আমার ভীষণ দরকার। ঠিকানা বললে তোমরা কি ওটা বার করে দিতে পারবে?

কলকাতার ফোন তো?

তা না হলে তোমাকে বলব কেন?

অবনীশ বলেন, কোনো অসুবিধে হবে না। কবে চাই?

রণিতা বলে, অ্যাজ আর্লি অ্যাজ পসিবল–

আজ দুপুরে, ধর একটা নাগাদ আমার অফিসে একটা ফোন করতে পারবি?

নিশ্চয়ই পারব।

দেখি তখন নাম্বারটা দিতে পারি কিনা। ঠিকানাটা বল।

লিখে নাও–

ঠিকানা জানিয়ে টেলিফোন নামিয়ে রাখে রণিতা। তারপর সোজা বাথরুমে চলে যায়। নটায় বিন্দুবাসিনীর কাছে পৌঁছুতে হবে। দিন তিনেক সে আর অমিতেশ ও বাড়িতে যাচ্ছে কিন্তু চোদ্দ নম্বর রবিনসন স্ট্রিটে বার দুই একটি কাজের মেয়েকে ছাড়া আর কাউকে দেখা যায়নি।

অবনীশের সঙ্গে ফোনে কথা বলার পর স্নান টান সেরে বেরিয়ে পড়ে রণিতা কিন্তু মেট্রো রেলের কালিঘাট স্টেশনের কাছে এসে অমিতেশের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল তাকে। রোজ এখানে যে আগে আসে সে অনোর জন্য দাঁড়িয়ে থাকে। তারপর একসঙ্গে বিন্দুবাসিনীদের বাড়ি চলে যায়।

চল্লিশ মিনিট দাঁড়াবার পর রণিতা যখন অধৈর্য হয়ে উঠেছে সেই সময় অমিতেশ এল। রণিতা মুখ খোলার আগেই সে বলে ওঠে, মায়ের সকাল থেকে শরীরটা খারাপ। ডাক্তারের কাছে গেলাম, তাই দেরি হয়ে গেল।

বিরক্তিটা মুহূর্তে কেটে যায়, চোখেমুখে উদ্বেগ ফুটে ওঠে রণিতার, হঠাৎ শরীর খারাপ হল?

হঠাৎ আর কোথায়? তুমি তো জানোই, মায়ের ইস্কিমিয়ার একটা ট্রাবল আছে। মাঝে মাঝে বুকের ব্যথাটা বেড়ে ওঠে। কদিন ওষুধ খেলে আর ডাক্তারের কথামতো চললে কমে যায়।

আজ না এলেই পারতে।

তুমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকবে, তাই আসতে হল।

আমাকে একটা ফোন করলে না কেন?

করেছিলাম, তখন তুমি বেরিয়ে এসেছ।

রণিতা বলে, ঠিক আছে, তুমি বাড়ি চলে যাও। আমি আজ একাই বিন্দুবাসিনী মাসিমার বাড়ি যাব। বিন্দুবাসিনীকে তারা মাসিমা বলতে শুরু করেছে।

অমিতেশ বলে, একটা ইঞ্জেকসান দেবার পর মা এখন স্টেডি আছেন। কোনো ভয় নেই। তাছাড়া ছোট মাসিমাকে খবর দিয়ে আনিয়েছি, তিনিই মাকে দেখাশোনা করবেন। চল–

বানো নম্বর রবিনসন স্ট্রিটে এসে দেখা গেল বিন্দুবাসিনী পশ্চিমের ব্যালকনিতে চোখে দূরবীন লাগিয়ে বসে আছেন। অন্য দিন তিনি দক্ষিণ দিকে বসে থাকেন, রণিতারা এলে ব্রেকফাস্ট করে ওদের নিয়ে পশ্চিম দিকে চলে যান।

চোখ থেকে বাইনোকুলার নামিয়ে বিন্দুবাসিনী বলেন, কী ব্যাপার, তোমরা তো ব্রিটিশ পাংচুয়ালিটি মেনে চল। আজ এত দেরি হল যে?

কারণটা জানিয়ে দেয় অমিতেশ।

বিন্দুবাসিনী বলেন, ও, আচ্ছা। এখানেও কলিং বেলের ব্যবস্থা আছে। সুইচ টিপে তিনি তিনজনের ব্রেকফাস্ট আনিয়ে নেন। কর্নফ্লেকসে দুধ ঢালতে ঢালতে বলেন, আজ ও বাড়িতে একটা লোককে দেখলাম। এতদিন কাজের মেয়ে, দারোয়ান আর বার কয়েক ওই মহিলাকে ছাড়া অন্য কাউকে দেখি নি। এই লোকটি নতুন।

রণিতা উৎসকু সুরে জিজ্ঞেস করে, কখন দেখেছেন?

ধরো নটা দশ টশে। তোমাদের জন্যে নটা পর্যন্ত ওধারে অপেক্ষা করেছিলাম। তারপর এখানে এসে বসবার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ও বাড়ির ও ধারের ব্যালকনিতে ভদ্রলোককে দেখলাম। একটু থেমে বলেন, বেশ বয়েস হয়েছে, ছেষট্টি সাতষট্টির মতো। তবে স্বাস্থ্য খুব ভাল। এর বেশি এতদূর থেকে আর কিছু বোঝা যায় নি।

এই ভদ্রলোককে ধরতে পারলে মহিলা সম্পর্কে হয়তো কিন্তু জানা যেতে পারে।

তা হয়তো পারে কিন্তু ওঁকে ধরবে কী করে?

একটু ভেবে রণিতা বলে, একটা কাজ করলে কেমন হয়?

কী? বিন্দুবাসিনী জিজ্ঞাসু চোখে তাকান।

ভাবছি এখনই একটা চান্স নেব।

কিসের চান্স?

ওঁদের বাড়িতে ঢোকার। ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হল তো হল। নইলে মহিলাটির সঙ্গে যোগাযোগ করা যায় কিনা, একবার চেষ্টা করে দেখব।

বিন্দুবাসিনী দ্বিধান্বিতভাবে বলেন, দেখ। কিন্তু–

তার দ্বিধার কারণটা আন্দাজ করতে পারছিল রণিতা। এর আগেই বিন্দুবাসিনী জানিয়ে দিয়েছিলেন, চোদ্দ নম্বর রবিনসন স্ট্রিটে বাইরের লোকজনের প্রবেশ নিষিদ্ধ, ওখানে গিয়ে সুবিধা হবে না। রণিতা বলে, ওরা ঢুকতে না দিলে কী আর করা যাবে। মিনিমাম এটুকু কনসোলেসান থাকবে যে আমরা চেষ্টা করেছিলাম।

বিন্দুবাসিনী এবার আর বাধা দেন না। বলেন, দেখ তা হলে–

রণিতা উঠে পড়ে। অমিতেশও উঠতে যাচ্ছিল, তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, আমি একাই যাব। একটা মেয়েকে দেখলে ওরা দরজা খুলে দিতে পারে কিন্তু দল বেঁধে গেলে সে আশা নেই। তুমি আর মাসিমা এখানে বসে বাড়িটা ওয়াচ করতে থাকো। আমি ঘুরে আসছি।

রণিতার কথায় সায় দেন বিন্দুবাসিনী, সেই ভাল।

রণিতা চলে যায়।

.

১২.

চোদ্দ নম্বর রবিনসন স্ট্রিটের গেটের পাল্লাটা আগাগোড়া দু ইঞ্চি পুরু ইস্পাত দিয়ে তৈরি। খাড়াই বারো তেরো ফুট, চওড়ায় কম করে দশ ফুট তো হবেই।

বাড়ির সামনে ঝকঝকে রাস্তা, তার ওধারে ছোট একটা পার্ক। সেখানে প্রচুর গাছপালার ফাঁকে বাচ্চাদের জন্য দোলনা, নাগরদোলা, স্লিপ ইত্যাদি।

এখন দশটার মতো বাজে। কিন্তু রাস্তায় লোজন অক্সই চোখে পড়ছে। তবে ঝাঁকে ঝাঁকে মারুতি, অ্যাম্বাসাডর কি কনটেসা বা বিদেশি ইমপোর্টেড কার প্রায় নিঃশব্দে মসৃণ গতিতে বেরিয়ে যাচ্ছে। এ পাড়ার বাসিন্দাদের মধ্যে পদাতিক খুব কমই আছে, মাটিতে তারা কেউ পা ফেলতে চায় না।

নিরেট ইস্পাতের বিশাল গেটটার সামনে এসে প্রথমটা হতাশাই বোধ করে রণিতা। এই জবরদস্ত ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢোকা কি তার পক্ষে আদৌ সম্ভব হবে।

গেটটা এত উঁচু যে রাস্তার দিক থেকে ভেতরের প্রায় কিছুই চোখে পড়ে । দারোয়ান টারোয়ান কেউ আশেপাশে আছে কিনা কে জানে।

পিছিয়ে রাস্তার ওধারে পার্কের কাছে গিয়ে বাড়ির ভেতরটা দেখার চেষ্টা করল রণিতা। দূরে আসার জন্য গেটের মাথা টপকে দৃষ্টি ভেতর পর্যন্ত গেল বটে, তবে দোতলার খানিকটা অংশ আর বড় বড় গাছের ঝাঁকড়া ডালপালা ছাড়া আর কিছু দেখা গেল না।

ফের রণিতা গেটের কাছে ফিরে এল। ইস্পাতের পাল্লায় যখন সে ধাক্কা মারতে যাবে, সেই সময় পাশের কমপাউন্ড ওয়ালে চোখ গেল তার। সেখানে দেওয়াল কেটে লেটার বক্স, আর তার গায়ে একটা কলিং বেল। রণিতা এক মুহূর্ত দেরি না করে বেল টিপল। কিন্তু ভেতর থেকে কোনো সাড়া নেই।

পর পর আরো কয়েক বার বেল বাজালো রণিতা। ভেতরে যে টুং টাং আওয়াজ হচ্ছে এখান থেকে স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে কিন্তু গেট খোলার বিন্দুমাত্র লক্ষণ নেই, এমন কি কারো গলা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে না।

হঠাৎ রণিতার মনে হল, বেল বাজালেও ইচ্ছা করেই খুব সম্ভব সাড়া দেওয়া হয় না। দর্শনপ্রার্থী তখন হয়তো ক্লান্ত হয়ে চলে যায় কিন্তু এ বাড়ির লোকেরা রণিতাকে চেনে না। সে যেমন একবোখা তেমনি জেদি, কিছু একটা মাথায় চাপলে তার শেষ না দেখে ছাড়ে না।

কাজেই অনবরত বেল বাজাতে লাগল রণিতা। দেখা যাক, কতক্ষণ ওরা সাড়া না দিয়ে পারে।

মিনিট দশেক পর ঘটাং করে ধাতব শব্দ হল। দেখা গেল ইস্পাতের গেটটার গায়ে ঘোট একটা পাল্লা খুলে গেছে আর সেই ফোকরে দেখা দিয়েছে একটি মোঙ্গলিয় মুখ। লোকটা নেপালি ভূটানি বা সিকিমি হতে পারে। আধবোজা ছোট ছোট চেরা চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে, কিসকো চাহিয়ে?

রণিতা বলে, গেটটা তো আগে খোল।

হুকুম নেহি হ্যায়। ভাবলেশহীন গলায় জানিয়ে দেয় দারোয়ান।

একটু চিন্তা করে রণিতা জিজ্ঞেস করে, বাড়িতে কে আছে?

কোঈ নেহি।

বোঝা যাচ্ছে, বাড়িতে কেউ নেই, গেট খোলা বারণ– এ সব দারোয়ানকে শেখানো আছে। রণিতা বলে, কিন্তু একটু আগে তোমাদের দোতলায় একজনকে যে দেখলাম মিথ্যেটা উচ্চারণ করতে তার গলার স্বর মুহূর্তের জন্যও কাঁপে না। লোকটার প্রতিক্রিয়া দেখার জন্য সে স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে।

দারোয়ান পলকের জন্য থতিয়ে যায়। তারপর বলে, আপ ভুল দেকা। মেমসাব–

রণিতা বুঝতে পারে, বাড়ির ভেতর কেউ থাকলে দারোয়ান কিছুতেই কবুল করবে না। এ নিয়ে আর টানাহ্যাঁচড়া করে লাভ নেই। সে জিজ্ঞেস করে, সকালে তোমাদের বাড়িতে তো এক ভদ্রলোক এসেছিলেন। তিনিও কি নেই?

দারোয়ান চমকে ওঠে। তার চোখেমুখে চকিতের জন্য দুশ্চিন্তার ছায়া পড়ে। মিলিয়ে যায়। দ্রুত শ্বাস টেনে সে বলে, নেহি, কোঈ নেহি আয়া হ্যায়।

লোকটা ভালমানুষের মতো মুখ করে ডাহা মিথ্যে বলছে। যে প্রতিজ্ঞা করেছে সত্যি বলবে না তার পেট থেকে আসল কথাটা বার করা মুশকিল। রণিতা এবার একেবারে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়, তোমাদের এই বাড়ির মালিক কে?

এমন একটা প্রশ্ন বোধহয় আশা করে নি দারোয়ানটা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকার পর সে বলে, মালিক নেহি, মালকিন। মেরা মেমসাব–

নাম কী তোমার মেমসাহেবের?

মালুম নেহি—

কখন ফিরবেন?

মালুম নেহি –

রণিতা জিজ্ঞেস করে, কখন এলে মেমসাহেবের সঙ্গে দেখা হতে পারে?

দারোয়ান বলে, মালুম নেহি।

যদি সকালে আসি, উনি থাকবেন?

মালুম নেহি।

দুপুরে, বিকেলে, সন্ধ্যায়–রণিতা যখনকার কথাই বলে সেই একই উত্তর। লোকটাব ভেতর মালুম নেহির একটা ক্যাসেট পুরে স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে যেন চালু করে রাখা হয়েছে। কিছু জিজ্ঞেস করলেই ওটা শোনা যাবে।

রণিতা ভেতরে ভেতরে খেপে যাচ্ছিল, তবে মনোভাবটা বাইরে ফুটে বেরুতে দেয় না। এমন তো নয় যে সে আর আসবে না। বার বার এসে দারোয়ানটাকে তোয়াজ করলে হয়তো একদিন না একদিন এ বাড়ির গেট খুলে যাবে। কিন্তু প্রথম ক্লিই চটিয়ে দিলে সে আশা আর নেই।

রণিতা বলে, তার মানে যখনই আসি না কেন, তোমার মেমসাহেবের সঙ্গে দেখা হবে না, এই তো?

যত নরম করেই বলার চেষ্টা করুক না, রণিতার গলা থেকে খানিকটা আঁঝ বেরিয়ে আসে। কিন্তু সেটা গায়ে মাখে না দারোয়ানটা, নিরাসক্ত মুখে বলে, জি–

রণিতা বলে, তোমাকে বুঝি এসব বলার জন্যে শিখিয়ে দেওয়া হয়েছে?

দারোয়ান কিছু বলে না, শুধু আধবোজা ঘুমন্ত চোখ দুটো সামান্য কুঁচকে তাকিয়ে থাকে।

রণিতা জিজ্ঞেস করে, তোমাদের বাড়িতে লোকজন আসে?

দারোয়ান চুপ।

রণিতা এবার বলে, তাদেরও নিশ্চয়ই বলে দাও মেমসাহেব বাড়ি নেই।

দারোয়ান জবাব দেয় না।

রণিতা বলে, তোমার মেমসাহেব যখন ফিরবেন একটা খবর দিতে পারবে?

দারোয়ানের ঠোঁটদুটো সামান্য ফাঁক হয়, জি–

বলবে, খুব শিগগিরই আমি সকাল থেকে রাত পর্যন্ত এই বাড়ির সামনে বসে থাকব। দেখব তোমার মেমসাহেব কখন বেরোন আর কখন ফিরে আসেন।

রণিতার কথা শেষ হতে না হতেই ঝড়াং করে গেটের গায়ের ছোট চৌকো পাল্লাটা বন্ধ হয়ে যায়।

.

বিন্দুবাসিনী আর অমিতেশ পশ্চিমের ব্যালকনিতে উদগ্রীব বসে ছিল। রণিতা ফিরে আসতেই দুজন জানতে চাইল, কাজ কিছু হল?

দারোয়ানের সঙ্গে যা যা কথাবার্তা হয়েছে, তার লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে রণিতা বলে, ভেরি হার্ড নাট টু ক্র্যাক। তবে আমিও আল্টিমেটাম দিয়ে এসেছি।

কিসের আল্টিমেটাম?

দু-চারদিনের মধ্যে ওদের বাড়ির সামনে দিনরাত পিকেটিং শুরু করব।

বিন্দুবাসিনী আর অমিতেশ হেসে ফেলে।

অনেকটা বেলা হয়ে গিয়েছিল। সূর্য মাথার ওপর থেকে পশ্চিম আকাশের ঢালু পাড় বেয়ে নিচে নামতে শুরু করেছে। এধারে ওধারে ছন্নছাড়া ভবঘুরে কিছু মেঘ এলোমেলো ভেসে বেড়াচ্ছে। চারপাশের গাছগাছালির মাথায় পাখি উড়ছিল। কোথায় ডালপালার আড়ালে বসে ঘুঘু ডাকছে একনাগাড়ে।

বিন্দুবাসিনী বললেন, চল, দুপুরের খাওয়াটা সেরে আসি।

লাঞ্চের পর আবার তিনজনে পশ্চিমের ব্যালকনিতে ফিরে আসে। আর তখনই অবনীশের কথা মনে পড়ে যায় রণিতার। আজ দুপুরে তিনি ওকে ফোন করতে বলেছিলেন।

রণিতা বলে, আমি একটা ফোন করব মাসিমা।

নিশ্চয়ই করবে। টেলিফোনটা আনিয়ে দিচ্ছি।

বিন্দুবাসিনী বেল বাজিয়ে কাজের লোককে ডাকতে যাবেন, রণিতা বলে, আমিই নিয়ে আসছি।

দক্ষিণ দিকে যেখানে সারাটা দিন বিন্দুবাসিনী বসে বসে কাটিয়ে দেন সেখানে একটা টেবলের ওপর টেলিফোনটা থাকে। ফোন আর বাইনোকুলার এই দুটো দিয়েই বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে তাঁর যেটুকু যোগাযোগ।

ফোনটা নিয়ে আসে রণিতা। দোতলার এই ব্যালকনিতে নানা জায়গায় প্লাগ পয়েন্ট রয়েছে। সেখানে প্লাগ লাগিয়ে একবার ডায়াল করেই অবনীশকে ধরে ফেলে সে।

অবনীশ বলেন, নাম্বারটা পেয়ে গেছি রে ছোট খুকি। ওটা প্রাইভেট নাম্বার, টেলিফোন ডাইরেক্টরিতে ছাপা হয় না। টুকে নে–

অমিতেশের পকেটে সব সময় একটা ছোট নোট-বই আর ডট পেন থাকে। রণিতা অবনীশের কাছ থেকে ফোন নাম্বারটা জেনে নিয়ে অমিতেশকে বলে, লেখো–

অমিতেশ লিখে নেয়।

রণিতা এবার অবনীশকে বলে, কার নামে এই ফোনটা নেওয়া হয়েছে জানো?

অবনীশ বলেন,  নিশ্চয়ই। মমতা রায় নামে এক ভদ্রমহিলার নামে।

রণিতা বেশ দমে যায়, ঠিক দেখেছ? অন্য কারো নামে নেই তো? সে নিশ্চিত ছিল নয়নতারা রায়ের নামটা শুনতে পাবে, ফলে রীতিমতো হতাশই হতে হয়।

অবনীশ বলেন, আরে বাবা, অত ভুল আমার হয় না, তিন চার বার আমি রেকর্ডটা খুঁটিয়ে দেখেছি। একটু থেমে জিজ্ঞেস করেন, তা হ্যাঁ রে, তুই কি অন্য কারো নাম এক্সপেক্ট করেছিলি?

নয়নতারার নামটা মুখ থেকে প্রায় বেরিয়ে যাচ্ছিল, মুহূর্তে সামলে নেয় রণিতা। আপাতত ব্যাপারটা জানাজানি হোক, সেটা চায় না সে। দ্রুত বলে ওঠে, না না, ঠিক আছে। তুমি আমার জন্যে এত করলে। মেনি মেনি থ্যাংকস।

শুকনো থ্যাংকসে চিড়ে ভিজবে না, একদিন তোর বৌদি আর আমাকে ভাল রেস্তোরাঁয় ফার্স্ট ক্লাস একখান লাঞ্চ খাওয়াতে হবে।

নিশ্চয়ই খাওয়াব। কবে তোমাদের সময় হবে আগে জানিও। এখন ছাড়ছি মণিদা–

হঠাৎ কিছু মনে পড়ায় ব্যস্তভাবে অবনীশ বলে ওঠেন, আরে আসল কথাটাই সকালে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গিয়েছিলাম।

রণিতা বলে, কী কথা?

চোদ্দ নম্বর রবিনসন স্ট্রিটের ফোন নাম্বারটার জন্যে এত অস্থির হয়ে উঠেছিস কেন?

পরে শুনো।

মনে হচ্ছে ব্যাপারটা মিস্টিরিয়াস।

এখন কিছু জানতে চেও না মণিদা–অবনীশকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে ফোন নামিয়ে রাখে রণিতা।

বিন্দুবাসিনী আর অমিতেশ অসীম কৌতূহল নিয়ে তাকিয়ে ছিলেন। বিন্দুবাসিনী জিজ্ঞেস করেন, কার সঙ্গে কথা বলছিলে?

রণিতা বলে, আমার এক পিসতুতো দাদার সঙ্গে। ও ক্যালকাটা টেলিফোনসের বিরাট অফিসার।

কার ফোন নাম্বার নিলে? বিন্দুবাসিনী জানতে চাইলেন।

মজাদার একটু হেসে রণিতা বলে, মমতা রায়ের।

সে কে?

চোদ্দ নম্বর রবিনসন স্ট্রিটে যিনি থাকেন।

বিমূঢ়ের মতো বিন্দুবাসিনী বলেন, কিন্তু–

রণিতা বলে, ও বাড়িতে নয়নতারা থাকেন, এটাই বলবেন তো?

আস্তে মাথা নাড়েন বিন্দুবাসিনী।

রণিতা বলে, কিন্তু ফোনটা রয়েছে মমতা রায়ের নামে।

বিন্দুবাসিনী বলেন, সব গুলিয়ে যাচ্ছে।

যে নামেই থাক, আমি কিন্তু মহিলাকে দেখে তাঁর সঙ্গে কথা না বলে ছাড়ছি না।

বিন্দুবাসিনী আর রণিতা যখন কথা বলছিল, সেই সময় অমিতেশ চোখে বাইনোকুলার লাগিয়ে চোদ্দ নম্বর বাড়ির দিকে তাকিয়ে ছিল। হঠাৎ সে উত্তেজিত গলায় প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে, দারোয়ানটা তোমাকে স্রেফ ধোঁকা দিয়েছে। ওই যে, ও বাড়ির ব্যালকনিতে একজন মিডল-এজেড ভদ্রলোককে দেখা যাচ্ছে

কোথায় কোথায়– অমিতেশের হাত থেকে বাইনোকুলারটা একরকম কেড়ে নিয়ে নিজের চোখে লাগায় রণিতা। বলে, রাইট, রাইট। এই তো। না না অমিত, মিডল-এজেড নয়, হি মাস্ট বি অ্যারাউন্ড সেভেনটি। সাদা চুল, সাদা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি, সাদা হুইস্কার–এই যাঃ, ডান পাশের ঘরটায় ঢুকে যাচ্ছেন।

বিন্দুবাসিনী জিজ্ঞেস করেন, এখন তা হলে কী করবে? ফের ও বাড়ির গেটের কাছে গিয়ে দাঁড়াবে?

রণিতা বলে, লাভ কিছু হবে না। দারোয়ানটা কিছুতেই স্বীকার করবে না যে ভদ্রলোক বাড়ির ভেতর আছেন। আর আমি যতক্ষণ গেটের কাছে থাকব উনি বেরুবেন না। পিকেটিংয়ের ভয় দেখিয়ে এসেছি বটে, কিন্তু সারাদিন থাকলেও সত্যি সত্যিই তো আর রাত্তিরে রাস্তায় বসে থাকা যাবে না। একটু ভেবে বলে, একটা কাজ অবশ্য করা যায়।

কী?

একবার ও বাড়িতে ফোন করে দেখি–

অমিতেশ বলে, গুড আইডিয়া। আগেই করা উচিত ছিল–

রণিতা ডায়াল করে চোদ্দ নম্বরের লাইন ধরে ফেলে। হালো বলতেই ওদার থেকে একটি মহিলা আকাট পূর্ববঙ্গীয় সুরে বলে ওঠে, কারে চাইতে আছেন দিদিমণি?

গলাটা শুনে মনে হল বাড়ির কাজের লোক। রণিতা বলে, তোমার মেমসাহেবের সঙ্গে ।

ম্যামসাহেব বাড়িত্‌ নাই।

আছেন। ভাল করে দেখে এসে বল–

নাই। বিশ্বাস করেন দিদিমণি। মা কালীর কিরা (দিব্যি)।

ঠিক আছে, আমি আবার ফোন করব।

পরাণে য্যাত বার চায় ত্যাত বার কইরেন। অখন ফুন (ফোন) রাখি। পন্নাম (প্রণাম)।

না, কোনোভাবেই চোদ্দ নম্বর বাড়ির স্বত্বাধিকারিণীকে ধরা যাচ্ছে না। দারোয়ান থেকে কাজের মেয়ে পর্যন্ত সবাইকে শেখানো আছে, অচেনা কেউ ফোন করলেই তারা তোতাপাখির মতো একই বুলি আউডে যাবে, মেমসাহেব বাড়ি নেই। এভাবে কিছুতেই নয়নতারার কাছে, যদি চোদ্দ নম্বর রবিনসন স্ট্রিটের মহিলাটি সত্যিই নয়নতারা হন, আদৌ পোঁছনো যাবে না। তার জন্য অন্য পদ্ধতি ভেবে বার করতে হবে।

.

১৩.

নয়নতারাকে নিয়ে ডকু-ফিচারের পরিকল্পনা যেদিন নেওয়া হয় সেই শুরু থেকেই ইন্দ্রনাথ যথেষ্ট উৎসুক হয়ে আছেন। রোজ রাতেই খাবার টেবলে বসে খোঁজ নেন, রণিতার কাজ কতদূর এগুলো কিংবা মায়াকাননের অলীক পরীর মতো তাঁর যৌবনকালের সুপারস্টারটির সঙ্গে যোগাযোগ করা আদৌ সম্ভব হয়েছে কিনা।

।রণিতাও বিন্দুবাসিনীদের পশ্চিমের ব্যালকনিতে বসে সারাদিন কী করল, বাবাকে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিররণ দিয়ে যায়। টেবলের অন্য প্রান্তে সারা মুখে পৃথিবীর সবটুকু গাম্ভীর্য মাখিয়ে নিঃশব্দে খেয়ে যান সুধাময়ী। নয়নতারা সম্পর্কে তাঁর বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।

ইন্দ্রনাথ প্রায়ই বলেন, আমার কী মনে হয় জানিস ছোট খুকি—

রণিতা জিজ্ঞেস করে, কী?

নয়নতারা ওই চোদ্দ নম্বর বাড়িতেই আছে। ওখানে নজর রেখে যা।

তা তো রাখছিই কিন্তু একদিনও মহিলাটিকে দেখতে পাই নি। বিন্দুবাসিনী মাসিমাদের বাড়ির দিকে ওঁদের যে ব্যালকনি সেখানে একবারও উনি আসেন না। আমরা যে ওয়াচ করছি সেটা বোধ হয় উনি টের পেয়ে গেছেন।

তা হলে কী করা?

সেটাই তো বুঝতে পারছি না।

একটু চুপচাপ।

তারপর ইন্দ্রনাথ বলেন, তোকে নজর রাখতে বলেছি ঠিকই কিন্তু অনন্ত কাল তো এভাবে তাকিয়ে থাকা যায় না। ডেসপারেট কিছু করা দরকার।

মনে মনে একটা দুঃসাহসী বেপরোয়া সিদ্ধান্তের কথা আবছাভাবে চিন্তা করেছে রণিতা কিন্তু সেটা তার কাছে এখনও খুব পরিষ্কার নয়। সে জিজ্ঞেস করে, কী করতে বল?

এখনও ভেবে উঠতে পারি নি। কিছু মাথায় এলে তোকে বলব।

মণিময় চ্যাটার্জি, রমেন লাহা, রণজয়, এমনকি ফোটোগ্রাফার কেষ্টপদও মাঝে মাঝে জানতে চেয়েছেন কতদুর কী হল। রণিতা সবাইকে জানিয়ে দিয়েছে, বলার মতো তেমন কিছু হয় নি। হওয়া মাত্র খবর দেওয়া হবে।

এর মধ্যে বক্স নাম্বারে একটা বেনামা চিঠি এল।

মহাশয় / মহাশয়া,

খবরের কাগজে আপনাদের বিজ্ঞপ্তিটি গত এক মাসে দু বার আমার চোখে পড়েছে। আপনারা একজন বিখ্যাত নটীকে নিয়ে একটি প্রামাণ্য তথ্যচিত্র তৈরি করতে যাচ্ছেন, এতে চিত্র ও মঞ্চপ্রেমিক হিসেবে আহ্লাদিত হবার কথা। কিন্তু আমার বিন্দুমাত্র আনন্দ বা আহাদ হয়নি। আমি বিজ্ঞপ্তিটি উপেক্ষাই করতে চেয়েছিলাম, ভেবেছিলাম নিরাসক্ত থাকব।

পরে ভেবে দেখেছি চুপচাপ বসে থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। আমি আপনাদের কতটা তথ্য দিতে পারব জানি না। তবে এমন একটি খবর দিতে পারি যা কারো পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়।

অভিনয়ে যত নামডাকই থাক, আসলে নয়নতারা ঘোর মায়াবিনী, তাকে ডাকিনীও বলতে পারেন। সে আমার সুখশান্তি, ঘর সংসার, সব ছারখার করে দিয়েছে।

আপনারা লক্ষ করেছেন কিনা জানি না। আট বছর আগে নয়নতারা যখন নিরুদ্দেশ হয়, সেই সময় নর্থ বেঙ্গলের একজন চা-বাগানের মালিক সমরেশ ভৌমিকও নিখোঁজ হয়ে যায়। কাগজে খুব ছোট করে এই খবরটি ছাপা হয়েছিল। এই সমরেশ ভৌমিক আমার স্বামী।

আমরা থাকতাম জলপাইগুড়িতে। ওখানকার এক সিনেমা হলে নয়নতারার প্রথম ফিল্মটি দেখার পর থেকেই সমরেশ তার ফ্যান হয়ে যায়। ক্রমশ তার অনুরাগটা মাত্রাছাড়া হয়ে ওঠে। গোড়ার দিকে সে নয়নতারাকে চিঠি লিখত, তাড়া তাড়া চিঠি। সেগুলো শুধু উচ্ছ্বাস আর স্তুতিতে বোঝাই। তার ছবি দেখে সমরেশ যে কতটা আলোড়িত কতটা মুগ্ধ, পাতার পর পাতা জুড়ে তারই বর্ণনা।

প্রথম প্রথম নয়নতারা জবাব দিত না। কিন্তু চাটুবাদের অপার মহিমা। বছরখানেক পর নয়নতারার উত্তর আসতে লাগল। চিঠিপত্রের আদান-প্রদান চলল বেশ কিছুদিন। তারপর নয়নতারা একদিন আমার স্বামীকে কলকাতায় যেতে লিখল, এমন একজন একনিষ্ঠ স্তাবকের সঙ্গে দেখা করার জন্য সে খুবই উৎসুক। সমরেশ কলকাতায় ছুটল। সেই শুরু। তারপর স্ত্রী-ছেলেমেয়ে-সংসার-চা বাগান, সব মাথায় উঠল। কাজের ছুতো করে মাসের বেশির ভাগ কলকাতায় কাটাত সে।

প্রথম প্রথম আমি এ ব্যাপারটা ধরতে পারিনি। সমরেশ নয়নতারার ফ্যান, মাঝে মাঝে সে তাকে চিঠি লেখে, এটুকুই শুধু জানা ছিল। তলায় তলায় নদী যে পাড় ভাঙার কাজটা গোপনে অনেক দূর এগিয়ে রেখেছে, সেটা জানা যায় নি। যখন জানতে পারলাম, অনেক দেরি হয়ে গেছে। তখন আর বিশেষ কিছু করার ছিল না। তবু স্বামীকে বোঝাতে চেষ্টা করলাম। তার মন সংসারের দিকে যাতে ফেরে তার জন্য কী করেছি, কিন্তু বৃথাই। আফ্রিকায় এক ধরনের ভারি সুন্দর ফুল আছে, পোকা মাকড় পাখি প্রজাপতি যাই তার ওপর এসে বসুক না, সঙ্গে সঙ্গে গিলে ফেলে। আমার স্বামীর অবস্থা হল তাই। নয়নতারা তাকে পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলেছিল। কুহকিনীর মোহ কাটাবার শক্তি তার ছিল না।

এদিকে চা-বাগানের হাল খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল। নিজেরা দেখাশোনা না করলে যা হয়, কর্মচারীরা লুটেপুটে শেষ করে দিচ্ছিল। শেষ পর্যন্ত বাগানটা বিক্রিই করে দিতে হল।

তারপর একদিন নয়নতারার সঙ্গে যে আমার স্বামী নিরুদ্দেশ হল সে কথা আগেই জানিয়েছি।

তিনটি ছেলেমেয়ে নিয়ে আমার অবস্থাটা একবার চিন্তা করুন। ব্রণ দেখলে মাছির ঝাঁক যেমন এসে ঘেঁকে ধরে তেমনি চারপাশের লোকজন, এমন কি আত্মীয়স্বজনরা পর্যন্ত চটচটে কেচ্ছার গন্ধ পেয়ে ছুটে এল। তাদের মুখে যথেষ্ট সহানুভূতি কিন্তু চোখে মিচকে চতুর হাসিটা গোপন রইল না। এতে তাদের বিন্দুমাত্র স্বার্থ নেই, তবু তারা ভীষণ খুশি। মানুষের চরিত্রই বোধ হয় এই।

হাওয়ায় তখন এত কুৎসা উড়ছে, চারদিকে এত ফিসফাস আর গুঞ্জন যে মাসখানেক একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়েছিলাম। তারপরই অবশ্য মনকে শক্ত করে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। যে মানুষ স্ত্রীর মর্যাদা রক্ষা করে না, সন্তানদের প্রতি কর্তব্য পালন করে না, তার সঙ্গেও কোনো সম্পর্ক নয়। অনেকে বাধা দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু আমি কারো কথা না শুনে সোজা আদালতে চলে গেলাম এবং ছমাসের ভেতর একতরফা ডিভোর্সও পেলাম।

বর্তমানে উত্তরবঙ্গেই একটা স্কুলে আমি অ্যাসিস্টান্ট হেড মিস্ট্রেস। বড় ছেলে ইঞ্জিনিয়ার, ছোট ছেলের এবার এম.এ ফাইনাল ইয়ার। গ্র্যাজুয়েট হবার পর একমাত্র মেয়ের বিয়ে দিয়েছি। আসছে বছর আমার রিটায়ারমেন্ট।

আপনারা যে তথ্যচিত্রটিতে হাত দিয়েছেন তাতে তথ্যর ওপর নিশ্চয়ই জোর দেবেন। দেখবেন, নয়নতারার জীবনী নিয়ে কাজ করতে গিয়ে কোনো রকম ভাবালুতাকে যেন প্রশ্রয় দেওয়া না হয়। তার উজ্জ্বল দিকের পাশাপাশি এই নোংরা দিকটাও তুলে ধরবেন আশা করি। আমার একান্ত অনুরোধ সত্যের প্রতি আপনারা অবিচল থাকুন।

আপনারা নয়নতারার সন্ধান পেয়েছেন কিনা জানি না। তবে যদি আমার প্রাক্তন স্বামী সমরেশ ভৌমিককে খুঁজে বার করতে পারেন, নয়নতারার হদিস পেতে অসুবিধা হবে না। দুজনের একসঙ্গে থাকার সম্ভাবনাই বেশি।

সমরেশের চেহারার একটু বর্ণনা এখানে দিচ্ছি। খুবই সুপুরুষ সে। নিরুদ্দেশ হবার আগে তার সব চুল পাকে নি, ফ্রেঞ্চ কাট দাড়ি ছিল, ছিল চওড়া জুলপি আর শৌখিন গোঁফ। গায়ের রং ফর্সা, হাইট ছফিটের মত।

স্বাক্ষরহীন চিঠিটি এখানেই শেষ।

বিন্দুবাসিনীর বাড়ি থেকে পাঁচটা নাগাদ বেরিয়ে বক্স নাম্বারের চিঠির জন্য মাঝে মাঝেই দিনকাল অফিসে চলে আসে রণিতা আর অমিতেশ। আজও এসেছিল।

লাইব্রেরিতে বসে দুজনে বেনামা চিঠিটা বার তিনেক করে পড়ল। তারপর অমিতেশ বলে, দারুণ ইন্টারেস্টিং লেটার। নয়নতারাকে ঘিরে কত টাইপের যে মানুষ জমা হয়েছিল, ভাবা যায় না।

রণিতা বলে, আমি অন্য একটা কথা ভাবছি।

কী?

বিন্দুবাসিনী মাসিমা যে ভদ্রলোককে চোদ্দ নম্বর রবিনসন স্ট্রিটের ব্যালকনিতে দেখেছিলেন, আমরাও তাঁকে এক ঝলক সেদিন দেখেছি। তাঁর চেহারাটা মনে পড়ছে?

হ্যাঁ, পড়ছে—

ভাল করে ভেবে বল।

কিছুক্ষণ চোখ দুটো আধবোজা করে থাকে অমিতেশ। তারপর বলে, বয়েস হলেও বেশ হ্যাঁণ্ডসাম।

রণিতা বলে, ওরকম সাদামাটা ডেসক্রিপশানে হবে না, ডিটেলে বল।

অমিতেশ চোখ দুটো আগের মতো অর্ধেক বুজে রেখেই বলে, লম্বায় অ্যাবাউট সিক্স ফিট, কমপ্লেকসান ফেয়ার–

গুড। বলে যাও—

সাদা চুল, লম্বাটে মুখ, চওড়া হুইস্কার, ফ্রেঞ্চকাটি দাড়ি–

ফাইন।

দাড়ি, জুলপি চুলের মতোই ধবধবে।

গ্রেট। এবার চিঠিতে যে সমরেশ ভৌমিকের ডেসক্রিপশান আছে তাঁর সঙ্গে ওই ভদ্রলোকের সিমিলারিটি আছে কিনা, মনে মনে মিলিয়ে নাও।

প্রায় লাফিয়ে ওঠে অমিতেশ, একজাক্টলি। ওই ভদ্রলোকই সমরেশ ভৌমিক। এ ব্যাপারে আমার কোনোরকম সন্দেহ নেই।

রণিতা বলে, নেই তো?

নো, নো। নট অ্যাট অল।

তা হলে আমরা ঠিক জায়গাতেই পৌঁছে গেছি বল। এই ভদ্রলোক সমরেশ ভৌমিক হলে দ্যাট লেডি মাস্ট বি নয়নতারা।

একটু চুপচাপ।

তারপর অমিতেশ জিজ্ঞেস করে, এবার কী করতে চাও?

রণিতা বলে, চোদ্দ নম্বর রবিনসন স্ট্রিটে যেভাবেই হোক ঢুকে পড়তে হবে।

সেটা তো আগেও বলেছিলে। কিন্তু কোন কৌশলে? মোডাস অপারেন্ডিটা কী?

সেটা এখনও ভেবে উঠতে পারিনি। আজ সারারাত চিন্তা করে কিছু একটা বার করতে হবে। তুমিও ভেবো। কাল বিন্দুবাসিনী মাসিমার বাড়িতে এই নিয়ে আলোচনার পর কাজে নেমে পড়ব। ওকে?

ওকে মেমসাহেব।

পরদিন কাঁটায় কাঁটায় নটায় বিন্দুবাসিনীদের বাড়ির পশ্চিমের ব্যালকনিতে হাজির হয়ে যায় অমিতেশ আর রণিতা। বিন্দুবাসিনী তাদের জন্য অন্য দিনের মতোই অপেক্ষা করছিলেন। কালকের সেই চিঠিটা রণিতা তাঁকে দিতে এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললেন, উত্তেজনায় তাঁর চোখ চকচক করতে লাগল। বললেন, বয়েস হলেও মানুষ চিনতে আমার ভুল হয় নি।

চোদ্দ নম্বর বাড়ির মহিলাটি যে নয়নতারা, সে সম্পর্কে কারো আর সংশয় নেই।

রণিতা বলে, কাল সারারাত ভেবে আমি ঠিক করেছি, ও বাড়িতে ঢুকে পড়ব। নইলে কাজ কিছুতেই এগুচ্ছে না।

বিন্দুবাসিনী বলেন, ঢুকবে কী করে? ওদের দারোয়ান ভেতরে একটা মাছিও গলতে দেয় না।

রণিতা বলে, সে কথা আমার ভালই জানা আছে।

তা হলে?

বারো আর চোদ্দ নম্বর বাড়ির মাঝখানে বাউন্ডারি ওয়ালের ধার ঘেঁষে বিন্দুবাসিনীদের একটা ডালপালাও প্রকাণ্ড কালোজামের গাছ অনেকখানি জায়গা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার কয়েকটা ডাল পাঁচিলের ওধারে চলে গেছে। সেদিকে আঙুল বাড়িয়ে রণিতা বলে, ওই যে–

বুঝতে না পেরে বিন্দুবাসিনী জিজ্ঞেস করেন, মানে?

ওই গাছটা সমস্যার সমাধান করে দেবে। বলে চোখ কুঁচকে হাসতে থাকে রণিতা।

বিন্দুবাসিনী কী বলতে যাচ্ছিলেন, তার আগেই প্রায় চেঁচিয়ে ওঠে অমিতেশ, তুমি ওই গাছ বেয়ে ওপারে যেতে চাও নাকি?

একজাক্টলি। আস্তে আস্তে মাথা দোলায় রণিতা।

তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে। উদ্বিগ্ন মুখে অমিতেশ বলে, অত উঁচু থেকে পড়লে হাড়গোড় ভেঙে চুরমার হয়ে যাবে।

বিন্দুবাসিনী বলেন, না না, এভাবে রিস্ক নেওয়াটা উচিত হবে না।

রণিতা বলে, মাসিমা, আপনি জানেন না কিন্তু অমিত তো জানে, গ্র্যাজুয়েশনের পর আমি কয়েক মাস মাউন্টেনিয়ারিংয়ে ট্রেনিং নিয়েছিলাম। আমার কাছে নাইলনের মোটা দড়ি আর হুক আছে। গাছের ডালে আটকে উঠে পড়তে পারব। ওধারে নামতেও অসুবিধে হবে না। চিন্তার কিছু নেই।

একটু চুপচাপ।

তারপর অমিতেশ বলে, আমিও তোমার সঙ্গে যাব।

নো। জোরে মাথা নাড়ে রণিতা, আমি একলাই যাব।

চিন্তিতভাবে অমিতেশ বলে, কিন্তু–

তাকে থামিয়ে দিয়ে রণিতা বলে, আমি যা করতে যাচ্ছি সেটা পুরোপুরি ট্রেসপাসিং–অনধিকার প্রবেশ। ওরা পুলিশ ডাকলে মেয়ে বলে আমি পার পেয়েও যেতে পারি কিন্তু তুমি বিপদে পড়বে। একটু থেমে ফের বলে, ভেতরে গিয়ে আমি আগে অবস্থাটা বোঝার চেষ্টা করি। যদি দেখি সব কিছু ফেভারেবল তখন তোমাকে যেতে বলব।

প্রথমে অমিতেশরা রাজি হয় না। অনেক তর্কাতর্কির পর শেষ পর্যন্ত অবশ্য রণিতার কথাটা মেনে নেয়।

বিন্দুবাসিনী জিজ্ঞেস করেন, কবে ও বাড়িতে যেতে চাও?

রণিতা বলে, আজই।

কখন যাবে?

দিনের বেলা কিছুতেই নয়। দেখে ফেললে এমন হইচই বাধিয়ে দেবে যে আমাদের সমস্ত প্ল্যানটাই ভেস্তে যাবে। ঢুকব কাল ভোরে অন্ধকার থাকতে থাকতে, কেউ জেগে ওঠার আগে। মাঝরাতে ও বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও ঢুকতে পারি, তাতে বাকি রাতটা মশার কামড় খেয়ে কাটাতে হবে।

পরিকল্পনাটা পছন্দ হয় বিন্দুবাসিনীর। বলেন, সেই ভাল।

অমিতেশ কিছু ভাবছিল। বলে, কিন্তু একটা প্রবলেম থেকে যাচ্ছে। অত ভোরে তুমি এখানে আসবে কী করে?

রণিতা বলে, সেটাও ভেবে রেখেছি। বিন্দুবাসিনী মাসিমা আজকের রাতটা এখানে যদি থাকতে দেন, তা হলে আর সমস্যা থাকে না। ভোরবেলা বর্ডার ক্রস করে আনিসে ওপারে চলে যেতে পারব। একটু রগড় করার জন্য গলার স্বরে ঢেউ খেলিয়ে হিন্দি শব্দটা উচ্চারণ করল সে।

বিন্দুবাসিনী তক্ষুনি বলে ওঠেন, নিশ্চয়ই থাকবে। আমি বলি কী আজ আর বাড়ি গিয়ে দরকার নেই। মা-বাবাকে ফোনে জানিয়ে দাও কাল ফিরবে।

রণিতা বলে, না, বাড়িতে একবার যেতে হবে। দড়ি, হুক, টেপ রেকর্ডার, এগুলো আনা দরকার।

টেপ রেকর্ডার কেন?

যদি নয়নতারা কথা বলতে রাজি হন তার একটা রেকর্ড তো রাখতে হবে।

তবে একটা ক্যামেরাও নিয়ে যেও।

স্টিল ফোটো দিয়ে কাজ হবে না। নয়নতারা রাজি হলে পরে মুভি ক্যামেরা নিয়ে যাব।

অমিতেশ বলে, এর মধ্যে আমার রোলটা কী?

রণিতা বলে, আপাতত পর্যবেক্ষকের। তুমি শুধু দেখে যাবে, তারপর আমার সিগনাল পেলে ঝাঁপিয়ে পড়বে, বুঝলে?

বুঝলাম।

রণিতা বিন্দুবাসিনীকে বলে, মাসিমা, অমিত আর আমি এখন যাচ্ছি। কয়েকটা কাজ আছে, সেগুলো সেরে সন্ধের পর আমি আসব। অমিত আসবে কাল সকালে। ও আর আপনি এই ব্যালকনিতে বসে ও বাড়িতে আমার অ্যাক্টিভিটি ওয়াচ করে যাবেন।

বিন্দুবাসিনী জিজ্ঞেস করেন, আজ তা হলে ও বাড়ির ওপর নজর রাখা। হবে না?

রণিতা বলে, কী দরকার? কাল থেকেই তো অপারেশন শুরু হয়ে যাচ্ছে।

.

১৪.

এখনও ভোর হয়নি, গাছপালার মাথায় থোকা থোকা অন্ধকার জমে আছে, আলিপুরের এই এলাকাটা একেবারে নিঝুম। কোথাও এতটুকু সাড়া শব্দ নেই, সব ঘুমের আরকে ডুবে রয়েছে।

এই সময়ে রণিতা বেড়ালের মতো পা টিপে টিপে বাউন্ডারি ওয়ালের পাশে সেই কালো জাম গাছটার তলায় এসে দাঁড়ায়। তার সঙ্গে ক্রাচে ভর দিয়ে এসেছেন বিন্দুবাসিনী। রণিতার হাতে লম্বা নাইলনের দড়ি, তার মাথায় আংটা লাগান। পিঠে বাঁধা রয়েছে একটা মোটা পলিথিনের ব্যাগ, তার ভেতর ম্যাকিনটশ, নোটবুক, পেন, টেপ রেকর্ডার ইত্যাদি টুকিটাকি জিনিস।

বিন্দুবাসিনীর ডান হাতে ক্ৰাচসুষ্ঠু একটা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ। গাছের উঁচু দিকের একটা ডাল লক্ষ করে তিনি বোতাম টিপলেন। আলোকিত অংশটায় দড়ি ছুঁড়ে আংটা আটকে দিল রণিতা। তারপর দড়িটা ধরে গাছের গুঁড়িতে পায়ের চাপ দিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে ওপরে উঠে চাপা গলায় বলল, টর্চ নিভিয়ে আপনি বাড়ি চলে যান।

বিন্দুবাসিনী বলেন, ওধারে নামতে পারবে তো?

পারব।

খুব সাবধান।

আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।

তুমি ওধারে না নামা পর্যন্ত আমি যাচ্ছি না। নেমেই কিন্তু জানিয়ে দেবে।

মিনিট তিনেক বাদে পাঁচিলের ওধার থেকে রণিতার চাপা গলা শোনা যায়, মাসিমা নেমেছি।

বিন্দুবাসিনী আর দাঁড়ান না, ক্রাচের ওপর ভর দিয়ে বাড়িতে এসে সোজা পশ্চিমের ব্যালকনিতে গিয়ে তাঁর হুইল চেয়ারে বসেন।

রণিতা ওপারে নেমে এধারে ওধারে তাকিয়ে নেয়, কেউ কোথাও নেই। চারদিকে অজস্র ফুলের গাছ, মাঝে মাঝে মসৃণ ঘাসের গালিচা। দূরে সামার ভিলার মতো নয়নতারাদের ছবির মতো দোতলা বাড়ি।

কেউ জেগে না থাকলেও বাড়িটার চারপাশে পুরনো আমলের গ্যাস লাইটের আদলে কটা ল্যাম্প পোস্টে আলো জ্বলছে। সতর্কতার কারণে সারারাতই ওগুলো জ্বলে।

রণিতা ব্যাগ থেকে ম্যাকিনটশ বার করে একটা গাছের পাশে পেতে তার ওপর বসে পড়ে। মুখ ফিরিয়ে বারো নম্বর বাড়িটার দিকে তাকায়। পশ্চিমের ব্যালকনিতে আবছা সিলুয়েট ছবির মতো দেখাচ্ছে বিন্দুবাসিনীকে। কয়েক পলক দেখেই এবার তার চোখ চলে যায় নয়নতারার বাড়িটার দিকে।

চারপাশে গাছগাছালির ফাঁকে ফাঁকে অজস্র জোনাকি জ্বলছে, নিভছে। কোনো অদৃশ্য পাতাল থেকে উঠে আসছে ঝিঁঝিদের একটানা বিলাপ, আলিপুরের এই নিস্তব্ধ ভোরে ছড়িয়ে যাচ্ছে আশ্চর্য বিষাদ। অনেকদিন পর জোনাকি দেখল রণিতা, ঝিঁঝির ডাক শুনল। কলকাতায় এই সব পতঙ্গরা যে এখনও টিকে আছে, এখানে না এলে জানা যেত না।

আকাশ যদিও ঝাপসা, তবু বোঝা যায় মেঘে ঢেকে আছে। যে কোনো মুহর্তে বৃষ্টি নামতে পারে। কবজি উলটে একবার ইলেকট্রনিক ঘড়িটা দেখে নিল রণিতা, এখনও চারটে বাজেনি, দশ মিনিট বাকি। এই আগস্ট মাসটায় সাড়ে পাঁচটার আগে সকাল হয় না। এখনও দেড়টি ঘন্টা মেঘাচ্ছন্ন আকাশের নিচে বসে থাকতে হবে।

প্রচণ্ড সাহস আর জেদের বশেই এ বাড়িতে অনধিকার প্রবেশ করেছে রণিতা। এরপর কোন কৌশলে নয়নতারার কাছে পৌঁছুবে কিংবা পোঁছনোর আগেই তাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বাড়ি থেকে বার করে দেওয়া হবে কিনা সেটা আন্দাজ করা যাচ্ছে না। রণিতা মোটামুটি এটুকু বুঝতে পারছে, একটা বড় রকমের হার্ডল পেরুতে পেরেছে কিন্তু সামনে আরো কত উঁচু উঁচু বাধা মাথা তুলে রয়েছে, কে জানে। এ বড়িতে ঢোকার পর সে সব ভেবে আর লাভ নেই, যা হবার হবে, এমন একটা বেপরোয়া মনোভাব নিয়ে সে দিনের আলো ফোঁটার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে।

কিন্তু কয়েক মিনিট কাটতে না কাটতেই রণিতার দুচোখ জুড়ে আসে। বিন্দুবাসিনীদের বাড়িতে সে এসেছিল সাড়ে আটটা নাগাদ। পাঁচিল টপকানোর ..ছকটা আরো নিশ্চিদ্র, আরো নিখুঁত করার জন্য আরেক দফা আলোচনাও করে নিয়েছে। তারপর দশটায় শুয়ে পড়েছিল কিন্তু কিছুতেই ঘুম আসে নি। ভোরে কালোজাম গাছটা থেকে ওধারে নামার সময় ও বাড়ির কারো চোখে পড়ে যাবে কিনা, পড়লে তার প্রতিক্রিয়া কী হবে, এই টেনসানে তার স্নায়ু টান টান হয়ে ছিল। এমন মানসিক চাপ নিয়ে ঘুমনো যায় না। পাচিল ডিভোবার পর এখন স্নায়ুগুলো আলগা হয়ে হয়ে শরীরে প্রচণ্ড ক্লান্তি নেমে এসেছে।

হঠাৎ বৃষ্টি নামতে ঘুম ছুটে যায়। আকাশ থেকে সীসার ফলার মতো নেমে আসা বড় বড় জলের ফোঁটাগুলো তার সারা গা ভিজিয়ে দিয়েছে। ধড়মড় করে উঠে ম্যাকিনটশটা দিয়ে পা থেকে মাথা পর্যন্ত নিজেকে মুড়ে ফেলে রণিতা।

বৃষ্টিটা যেমন আচমকা নেমেছিল তেমনি মিনিট দশ পনেরো বাদে হঠাৎই থেমে গেল। শরঙ্কালের বৃষ্টির চালটাই এরকম, কখন নামবে কখন থামবে আগে থেকে বলা মুশকিল।

যে ঘুমটা ভেঙে গিয়েছিল, রণিতার চোখের পাতায় ফের সেটা ফিরে আসে। গাছের গায়ে হেলান দিয়ে বসে থাকতে থাকতে ঘুমের আরকে সে ডুবে যায়।

কতক্ষণ পর রণিতা জনেনা একটা কণ্ঠস্বর তার কানে ভেসেআসে,মেমসাব, এ মেমসাব– প্রথমে আবছা, তারপর ধীরে ধীরে ডাকটা স্পষ্ট হতে থাকে।

চোখ মেলেই চমকে ওঠে রণিতা, একটা মঙ্গোলিয়ান মুখ তার ওপর ঝুঁকে আছে। মুখটা তার চেনা কিন্তু আগে কোথায় দেখেছে, মনে পড়ল না। তেমনি ভেবে পেল না এই বাগানটার ভেতর সে এল কী করে?

কিন্তু কয়েক সেকেন্ডের ভেতর ঘুমের রেশটা পুরোপুরি কেটে গেলে সব মনে পড়ে যায় রণিতার। মঙ্গোলিয়ান মুখটা দেখেছে এ বাড়ির গেটের একটা চৌকো ফোকরে। অর্থাৎ যে উদ্দেশ্যে সে এখানে এসেছে সে ব্যাপারে কিছু করার আগেই দারোয়ানের কাছে ধরা পড়ে গেছে। এমনিতে রণিতা খুবই সাহসী, কিছুটা বেপরোয়া ধরনের, কোনো বিপজ্জনক অবস্থাতেই সে বিহ্বল বা দিশেহারা হয়ে পড়ে না। মনের জোর তার অপরিসীম। কিন্তু এই মুহূর্তে রণিতার বুকের ভেতর অদ্ভুত এক শিহরন খেলে যায়। সেটা কি ভয়ে?

ভেতরে ভেতরে সে যে অস্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিল সেটা অবশ্য বাইরে বেরিয়ে আসতে দেয় না। রণিতা জানে তার এতটুকু দুর্বলতা দেখলে দারোয়ানটা গোলমাল শুরু করে দেবে। কোনোভাবেই মাথায় ওকে চড়তে দেওয়া যায় না। প্রবল ব্যক্তিতে তাকে দমিয়ে রাখতেই হবে।

ধীরে ধীরে গা থেকে ম্যাকিনটশটা খুলে ভাঁজ করে ব্যাগের ভেতর পুরতে থাকে রণিতা।

রোদ উঠে গিয়েছিল। গলানন গিনির মতো শরতের মায়াবী আলোয় চারদিক ভেসে যাচ্ছে। কাল আকাশ জুড়ে যে ঘন কালো মেঘ ছিল তার চিহ্নমাত্র নেই, জোরালো একগুয়ে হাওয়া ঠেলে ঠেলে তাদের দিগন্ত পার করে দিয়েছে। আকাশটা আজ পালিশ-করা আয়নার মতো ঝকঝকে।

দারোয়ান এবার ডাকে, এ মেমসাব– এবার তার কণ্ঠস্বর রীতিমত রুক্ষ।

রণিতা গম্ভীর মুখে বলে, কী বলছ?

আপলোগ চুরায়া ইয়ে কোটিমে গুসা! চলিয়ে চলিয়ে—

কাঁহা।

কোটিকা বাহার–

রণিতা তাকে বোঝাতে চেষ্টা করে, কোনো বদ মতলব নিয়ে সে এখানে আসে নি, শুধু নয়নতারার সঙ্গে একবার দেখা করেই চলে যাবে কিন্তু তার কথায় কর্ণপাত করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই দারোয়ানটার। এক নাগাড়ে কর্কশ গলায় বলে যায়, চলিয়ে চলিয়ে প্রায় ঘাড় ধাক্কা দিতে দিতেই রণিতাকে বাড়ি থেকে বার করে দিয়ে গেট বন্ধ করে দেয় সে।

রণিতা যেমনই একরোখা তেমনি প্রচণ্ড তার ধৈর্য। একটা কিছু মাথায় চাপলে তার শেষ না দেখে ছাড়ে না। কাজেই পরদিন রাতেও ফের কালো জামগাছের ডালে আংটা আটকে চোদ্দ নম্বর বাড়িতে ঢুকে পড়ে এবং পরদিন সকালে দারোয়ান আবার তাকে বাইরে বার করে দেয়।

পর পর চারদিন একই ব্যাপার ঘটে যায়। তবু হাল ছাড়ে না রণিতা। পঞ্চম দিন সকালে দারোয়ানের আচরণ পুরোপরি বদলে যায়। সে ডাকে, এ দিদিজি—দিদিজি–

মেমসাব থেকে দিদিজি। রণিতা বেশ অবাকই হয়। তার মনে হয়েছিল দারোয়ানটা অন্যদিনের মতোই তাকে বাড়ি থেকে বার করে দেবে। তা নয়, রীতিমত মোলায়েম সুরেই ডাকাডাকি করছে। এটা কোনো চতুর চাল কিনা বোঝা যাচ্ছে না। সতর্ক ভঙ্গিতে রণিতা বলে, কী বলছ?

আপ আইয়ে মেরা সাত (সাথ)।

কোথায়?

দারোয়ান বলে, কোটিমে–তার হিন্দি উচ্চারণটা বাচ্চাদের মত আধো আধো, নেপালি বা ভুটিয়ারা যেভাবে বলে থাকে অবিকল সেই রকম।

শিরদাঁড়া পলকে টান টান হয়ে যায় রণিতার। কিসের একটা সংকেত সে পেয়েছে আবছাভাবে। দারোয়ানটিকে বাজিয়ে নেবার জন্য বলে, বাড়ির ভেতর যাবার কথা বলছ?

জি।

কিন্তু—

গাবড়াইয়ে মাত। মেমসাব নিয়ে যেতে বলেছেন–

ফুসফুসের ভেতর দিয়ে চকিতে বিদ্যুৎ প্রবাহ খেলে যায়। দারোয়ানটা কার কথা বলছে, বুঝতে পেরেও রণিতা জিজ্ঞেস করে, কোন মেমসাহেব?

সোজাসুজি উত্তর না দিয়ে দারোয়ান ভাবলেশহীন মুখে জানায়, রণিতা তার সঙ্গে গেলেই প্রশ্নের উত্তরটা পেয়ে যাবে।

রণিতা আর কিছু বলে না, ব্যাগটা কাঁধে ফেলে কোনো স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে একবার পেছন ফিরে তাকায়। বারো নম্বর বাড়ির পশ্চিমের ব্যালকনিতে দেখা যাচ্ছে বিন্দুবাসিনীকে। ভোর রাতে চারটে থেকে আগের পাঁচদিনের মতোই ঐ একই জায়গায় একই ভঙ্গিতে, পিঠ সোজা করে অনড় মূর্তির মতো নিচু দড়ির চেয়ারে বসে আছেন তিনি। আটাশ বছরের সতেজ দৃষ্টি দিয়েও এতদূর থেকে তাঁর মুখটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, তবে সেই মুখে যে প্রচণ্ড উৎকণ্ঠা মাখানো সেটা অনুমান করা যায়।

দারোয়ান আস্তে তাড়া লাগায়, চলিয়ে দিদিজি–

হাঁ চল–মুখ ফিরিয়ে দারোয়ানের পাশাপাশি রণিতা হাঁটতে শুরু করে। সে বুঝতে পারছিল নয়নতারা তাকে গাছে হেলান দিয়ে ঘুমোত দেখে দারোয়ানকে দিয়ে ডেকে পাঠিয়েছেন কিংবা দারোয়ানটাই তাকে দেখে নয়নতারাকে আজ খবর দিয়ে থাকতে পারে। যিনি দীর্ঘ আট বছর আত্মগোপন করে আছেন, কোনোভাবেই বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে চান না, তাঁর পক্ষে এভাবে ডাকিয়ে নিয়ে যাওয়াটা প্রায় অভাবনীয়। দারোয়ানের ঘাড় ধাক্কা খাওয়াটা এই কদিনে গা-সওয়া হয়ে গিয়েছিল। হঠাৎ বাড়ির ভেতর ডাক পড়ায় দস্তুরমতো অবাকই হয় রণিতা। নয়নতারার উদ্দেশ্যটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। তিনি কি স্বেচ্ছা নির্বাসন থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছেন?

বাগান পেরিয়ে যেতে যেতে রণিতা টের পায়, হৃৎপিণ্ডের উত্থান পতন দ্রুততর হয়ে উঠেছে, তার শব্দও যেন শুনতে পাচ্ছে সে। কয়েক মিনিটের ভেতর ভারতীয় স্টেজ এবং স্ক্রিনের এক সুপারস্টারের সঙ্গে, যাঁকে বলা হয় লিভিং লিজেন্ড, দেখা হতে যাচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যে সারা দেশ জেনে যাবে নয়নতারাকে তাঁর রহস্যময় অজ্ঞাতবাস থেকে সে-ই বার করে এনেছে। তীব্র এক উত্তেজনা দ্রুত তার মধ্যে চারিয়ে যেতে থাকে।

বাগানের পর নুড়ির রাস্তা, তারপর চওড়া চওড়া আটটা স্টেপ ওপরে উঠে কারুকাজ-করা প্রকাণ্ড দরজার ভেতর দিয়ে দুজনে একটা বড় হল-ঘরে চলে আসে। হল-টা দামি লাল, কার্পেট ঢাকা, তার একধারে নানা আকারের পেতলের সুদৃশ্য টবে অশখ, মহুয়া, আম, কাঁঠাল, দেবদারু, ঝাউ ইত্যাদি নানা গাছের বনসাই। আরেক দিকে দেওয়ালের গা ঘেঁষে কোমরসমান হাইটের! ক্যাবিনেটের ওপর ব্রোঞ্জ, কাঁসা, পেতল, লোহা ইত্যাদি নানা ধাতুর আশ্চর্য সব ভাস্কর্য। এগুলোর কোনোটা নটরাজ, কোনোটা ওড়িষার কোনো মন্দিরের যক্ষী, কোনোটা আফ্রিকার বা উপজাতির নারীমূর্তি। মাঝখানে চার সেট সোফা।

হল-ঘরের এক পাশ দিয়ে দোতলায় ওঠার সিঁড়ি, সিঁড়িগুলো আগাগোড়া জুটের ম্যাট দিয়ে মোড়া। দারোয়ান রণিতাকে সেদিকে নিয়ে গেল, বলল, উপর চলিয়ে–

গুনে গুনে তিরিশটা সিঁড়ি পেরিয়ে রণিতা দারোয়ানের পিছু পিছু দোতলায় উঠে আসে। একতলার মতো অবিকল একই রকমের আরেকটা হল, পেতলের টবে তেমনই সব বনসাই, তবে দুটো দেওয়ালের গায়ে কাঁচের পাল্লা-দেওয়া বুক কেসগুলিতে অজস্র বই। এক দেওয়ালে চার্লি চ্যাপলিন, গ্রেটা গার্বো আর সোফিয়া লোরেনের বড় ছবি। বোঝা যায়, এ বাড়ির স্বত্বাধিকারিণী ঐ তিন মহান শিল্পীর অনুরাগিণী। অন্য একটি দেওয়ালে রবীন্দ্রনাথের বিরাট অয়েল পেন্টিং। হল ঘরটাকে ঘিরে রয়েছে বেশ কটি বেডরুম, সেগুলোর দরজায় পেস্তা রঙের পর্দা ঝুলছে।

দারোয়ান বলে, বৈঠিয়ে দিদিজি। মেমসাব আববি ইহা আ যায়েঙ্গি।

সে আর দাঁড়ায় না, সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে নিচে নেমে যায়।

কিছুক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে রণিতা। তারপর ব্যাগটা কাঁধ থেকে কার্পেটে নামিয়ে আস্তে আস্তে একটা সোফায় বসে পড়ে। তার মতো সাহসী, অ্যাডভেঞ্চার-প্রিয় মেয়ের কেমন যেন নার্ভাস লাগছে।

মিনিট দশেকও কাটল না, দক্ষিণ দিকের একটা বেডরুমের পর্দা সরিয়ে হল-এ এসে দাঁড়ালেন নয়নতারা। প্রথমটা রণিতার মনে হল বিভ্রম, এই সকালবেলায় সে যেন অলীক কোনো স্বপ্ন দেখছে। মায়াকাননের যে পরী পঁয়ত্রিশটি বছর সারা দেশকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন, তিনি এখন তার মাত্র দশ ফুট দূরে– ভাবা যায়!

কে বলবে ষাট পেরিয়েছেন নয়নতারা। সময়ের মেকআপম্যান কপালের দিকের চুলে হালকা সাদা রং মাখিয়ে দেওয়া ছাড়া আর প্রায় কিছুই করে নি, লক্ষ করলে মুখের মসৃণ ত্বকে মিহি সুতোর মতো দু-চারটে সরু দাগ হয়তো খুঁজে বার করা যাবে। ব্যস, ঐ পর্যন্ত।

নয়নতারার পরনে এই মুহূর্তে গোলাপি সিল্কের শাড়ি এবং ঐ রঙেরই হাতায় সুতোর কাজ-করা জামা, পায়ে ফোমের হালকা স্লিপার।

সবে আশ্বিনের শুরু। গোটা হল-ঘরটায় দরজা-জানলা দিয়ে অজস্র মায়াবী আলো এসে পড়েছে। নয়নতারা আসায় সেই আলোর দ্যুতি যেন হঠাৎ কয়েক গুণ বেড়ে গেছে।

মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল রণিতা। নয়নতারা তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন। এই হাসিটির মধ্যে এমন এক পরমাশ্চর্য জাদু মেশানো যা তিনটি দশক ভারতীয় সিনেমা আর স্টেজকে রমণীয় লাবণ্যে ভরে দিয়েছে।

নয়নতারা সোফা দেখিয়ে বলেন, বসো।

রণিতা যেন ঘরের ভেতর থেকে উঠে এল। বলে, আপনি আগে বসুন–

ঠিক আছে।

দুজনে মুখোমুখি বসে।

নয়নতারা বলেন, তোমার নামটা জানলে কথা বলতে সুবিধে হবে। পরক্ষণে কিছু মনে পড়তে সামান্য অপ্রস্তুত হলেন যেন, ঐ যাঃ, তোমাকে তুমি করে বলছি কিন্তু।

রণিতা টের পাচ্ছিল তার বুকের ভেতর তীব্র নিখাদে কোনো অপার্থিব অর্কেস্ট্রা বেজে যাচ্ছে। সে ব্যস্তভাবে বলে ওঠে, তুমি করে না বললে আমার অস্বস্তি হবে। তারপর নিজের নাম বলে।

নয়নতারা বলেন, ফাইন। এবার বল তো তুমি চতুর না বুদ্ধিমতী?

ভেতরে ভেতরে থমকে যায় রণিতা। নয়নতারার কথাটার একটা চাপা ইঙ্গিত আছে। সে সতর্কভাবে বলে, মানে–

উত্তর না দিয়ে নয়নতারা বলেন, তার আগে এক কাজ কর, সোজা বাথরুমে চলে যাও। মুখটুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে এস, তারপর কথা হবে। বাথরুমে নতুন পেস্ট, ব্রাশ, টাওয়েল, সব রয়েছে। বলে ডান দিকের পদা-ঢাকা দরজা দেখিয়ে দেন।

রণিতা বিমূঢ়ের মতো তাকিয়েই থাকে। তার যে সকালে টয়লেটে যাওয়া হয়নি, গাছে হেলান দিয়ে বাগানে রাতের শেষ দিকটা কেটেছে, নয়নতারা জানলেন কী করে? কিন্তু বসে থাকা সম্ভব হয় না, নয়নতারা তাকে তাড়া দিয়ে বাথরুমে পাঠিয়ে দেন।

প্রায় আড়াইশ স্কোয়ার ফিটের বাথরুমটা ধবধবে বাথটাব, কমোড, শাওয়ার, ওয়াল-মিরর ইত্যাদি দিয়ে চমৎকার সাজানো। একধারে সুদৃশ্য ক্যাবিনেটে নতুন ভোয়ালে, ব্রাশ পেস্টও রয়েছে।

ভোরের দিকের ঘণ্টা দেড়েক বাদ দিলে কাল সারা রাত গেল পাঁচদিনের মতো একেবারেই ঘুম হয়নি। নয়নতারাকে দেখার পর একটা ঘোরের মধ্যে ছিল রণিতা। এখন বোঝা যাচ্ছে, চোখ জ্বালা জ্বালা করছে, কপালের দুধারে শিরাগুলো সমানে লাফাচ্ছে। অনেকক্ষণ চোখে মুখে ঠাণ্ডা জলের ঝাঁপটা দিয়ে দাঁত ব্রাশ ট্রাশ করে যখন সে বেরিয়ে এল নিজেকে বেশ টাটকা লাগছে। চোখের জ্বালা এবং কপালের দপদপানিটা আর নেই।

নয়নতারা একই জায়গায় বসে ছিলেন। হাসিমুখে বলেন, এস।

রণিতা গিয়ে তার সোফাটায় বসতে না বসতেই একটি বয়স্কা কাজের মেয়ে চাকাওলা ট্রলিতে ব্রেকফাস্ট সাজিয়ে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এল। সেন্টার টেবলে ফল, কণফ্লেকস, দুধ, টোস্ট, মাখন, সুগার কিউব, জেলি, অমলেট, টি-পট, মিল্কপট, খালি কাপপ্লেট নামিয়ে রেখে ট্রলি নিয়ে হল-ঘর থেকে সে নিঃশব্দে অদৃশ্য হয়ে গেল। একেই বিন্দুবাসিনীদের ব্যালকনি থেকে দু-একবার দেখেছে রণিতা। অনুমান করা যায়, সে যখন টয়লেটে সেই সময় নয়নতারা কাজের মেয়েটিকে ব্রেকফাস্টের কথা বলে দিয়েছিলেন।

নয়নতারা বলেন, শুরু কর।

এমন রাজকীয় অভ্যর্থনা পাবে, ভাবে নি রণিতা। কুণ্ঠিতভাবে বলে, কিন্তু–

তোমার মতো স্মার্ট মেয়ের কাছে এমনসঙ্কোচ আশা করি নি।প্লিজ স্টার্ট–

রণিতা লক্ষ করল, একজনের মতো খাদ্যবস্তু আনা হয়েছে। সে জিজ্ঞেস করে, আপনার ব্রেকফাস্ট?

নয়নতারা বলেন, দুকাপ বেড টি ছাড়া সকালে আমি আর কিছু খাই না। সাড়ে পাঁচটায় আমার চা খাওয়া হয়ে গেছে।

রণিতা আর কোনো প্রশ্ন করে না। তার ব্রেকফাস্ট শেষ হলে নয়নতারা টি-পট থেকে একটা কাপে সোনালি লিকার ঢেলে তাতে দুধ মিশিয়ে জিজ্ঞেস করেন, কটা সুগার কিউব দেব?

নয়নতারা নিজের হাতে তাকে চা করে খাওয়াবেন, এটা ছিল অকল্পনীয়। অভিভূতের মতো রণিতা বসে থাকে। বলে, একটা–

চামচে করে সুগার কিউব তুলে চায়ে মিশিয়ে রণিতাকে কাপটা দিতে দিতে নয়নতারা বলেন, এবার আমার সেই প্রশ্নটার উত্তর দাও।

সঙ্গে সঙ্গে কিছু বলে না রণিতা। চায়ে একটা হালকা চুমুক দিয়ে আস্তে আস্তে শুরু করে, চতুর শব্দটা ভাল না।

বুদ্ধিমতীটাই পছন্দ তোমার?

অল্প হেসে মাথা হেলিয়ে দেয় রণিতা।

নয়নতারা সোজা তার চোখের দিকে তাকিয়ে এবার বলেন, কিন্তু তুমি যেভাবে আমাদের বাড়িতে ঢুকেছ তাতে বুদ্ধির পরিচয় নেই। যা রয়েছে তা হল ঝুঁকি, মারাত্মক ধরনের রিস্ক। এভাবে পর পর পাঁচদিন ঢোকাটা ঠিক হয় নি।

রণিতা হকচকিয়ে যায়, কিভাবে ঢুকেছি?

নয়নতারা হঠাৎ উঠে দাঁড়ান। কয়েক পা গিয়ে পুব দিকের একটা জানালা খুলে দিয়ে আঙুল বাড়িয়ে বলেন, ঐ দেখ–

রণিতার চোখে পড়ে জামগাছের ডাল থেকে নাইলনের সেই দড়িটা আংটাসুদ্ধ এখনও ঝুলছে। কাল ভোরে এপারে নামার পর ওটা খুলে নিতে ভুলে গিয়েছিল। কিন্তু নয়নতারা যে ওটা লক্ষ করবেন, কে ভাবতে পেরেছে! রণিতার মুখে বোকাটে নাভাস একটু হাসি ফোটে। পাঁচদিনের কথা বলেছেন নয়নতারা। তার মানে ওঁর চোখকে একদিনও ফাঁকি দিতে পারে নি সে।

জানালাটা বন্ধ করে নয়নতারা ফিরে আসেন। বসতে বসতে বলেন, কাল ঠিক কটায় এ বাড়িতে ঢুকেছ?

রণিতা তাঁর দিকে তাকিয়ে থাকতে পারছিল না। মুখ নামিয়ে বলে, ভোর চারটেয়–

নয়নতারা বলেন, তার মানে তখনও বেশ অন্ধকার ছিল।

ছিল।

অন্ধকারে পড়ে গিয়ে হাত-পা ভাঙার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল, না কী বল?

না।

একটু অবাকই হন নয়নতারা, না!

বিন্দুবাসিনীকে যা বলেছিল, নয়নতারাকেও তা-ই বলে রণিতা। অর্থাৎ মাউন্টেনিয়ারিং-এ ট্রেনিং নেবার ফলে নিজেকে বাঁচিয়ে উঁচুতে ওঠার বা নিচে নামার কায়দাটা সে ভালই রপ্ত করেছে।

নয়নতারা ধীরে ধীরে মাথা দুলিয়ে বলেন, আই সি, আই সি। আর কত বাড়িতে এভাবে ঢুকেছ?

আর কোথাও চুকিনি। আপনার বাড়িতেই প্রথম এবং খুব সম্ভব আপনার বাড়িতেই শেষ।

এবার সেকেন্ড ঝুঁকিটার কথা বলি।

রণিতা মুখ তুলে উগ্রীব তাকিয়ে থাকে।

নয়নতারার চোখেমুখে হঠাৎ কঠোরতা ফুটে বেরোয়, কিছুটা রূঢ় গলায় বলেন, ট্রেসপাসিংয়ের জন্যে আমি তোমাকে পুলিশের হাতে এখনই তুলে দিতে পারি জানো?

রণিতা কিন্তু ভয় পায় না। তার ভেতরকার সাহসী, ঝকঝকে, সপ্রতিভ তরুণীটি সক্রিয় হয়ে ওঠে। বলে, পারেন কিন্তু তা করবেন না।

নয়নতারার ফর্সা মসৃণ কপাল সামান্য কুঁচকে যায়। জিজ্ঞেস করেন, কী বলতে চাইছ?

পুলিশকে খবর দিলে তক্ষুনি সারা দেশ জেনে যাবে নয়নতারা দেবী কোথায় আছেন।

নয়নতারা সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দেন না, ঠোঁট টিপে চোখ বুজে কিছু ভাবতে থাকেন। নিঃশব্দে তাঁর প্রতিক্রিয়া লক্ষ করে যায় রণিতা।

একসময় চোখ মেলে নয়নতারা বলেন, পুলিশকে ফোন না করলেও সে ভয়টা তো এখনও আছে।

রণিতা জানতে চায়, কিরকম?

তুমি আমাকে খুঁজে বার করেছ, তুমিই তো ঢাক ঢোল পিটিয়ে সারা পৃথিবীকে সেটা জানিয়ে দিতে পার।

নো নো নেভার। আমি আগে থেকেই ঠিক করে রেখেছি, আপনার পারমিসান না পাওয়া পর্যন্ত কাউকে কিছু বলব না। আপনার শান্তি নষ্ট হয়, আপনি অসন্তুষ্ট হন, এমন কাজ কি করতে পারি?

নয়নতারার মুখ এবার কোমল দেখায়, যেন বেশ আশ্বস্ত হয়েছেন এমনভাবে বলেন, ওয়ার্ড অফ অনার?

ওয়ার্ড অফ অনার। রণিতা বলে, আপনি আমাকে আজ প্রথম দেখলেন, তবু বলছি আমাকে বিশ্বাস করতে পারেন।

করলাম। নয়নতারা হাসলেন। একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ সামনের দিকে ঝুঁকে জিজ্ঞেস করেন, তুমি একলা বার্লিন ওয়াল ডিভেলে যে? সেই ছোকরা কোথায়?

রণিতা চকিত হয়ে ওঠে, কার কথা বলছেন?

ঐ যে পাশের বাড়ির ব্যালকনিতে বসে বিন্দুবাসিনী দেবী, তুমি আর যে যুবা পুরুষটি সকাল-সন্ধে চোখে দূরবীন লাগিয়ে ষড়যন্ত্র করতে আমি তার কথা বলছি। মজাদার হাসিটা দ্রুত রং পালটে ফিচেল হয়ে নয়নতারার সারা মুখে। ছড়িয়ে পড়ে।

চোখেমুখে যার কথার খই ফোটে সেই রণিতা দুবার আপনি-আপনি করে থেমে যায়।

নয়নতারা আরো ঝুঁকে আসেন, আমি কী?

আপনি আমাদের লক্ষ করেছেন?

বা রে, তোমরাই শুধু আমার ওপর নজর রাখবে আর আমি চুপ করে হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকব, তাই কখনও হয়? একটু ওয়েট কর।

নয়নতারা আরেক বার উঠে পড়েন, ডান পাশের একটা ঘর থেকে একটা বাইনোকুলার হাতে ঝুলিয়ে ফিরে এসে বলেন, তোমাদের মতো আমারও একটা পাওয়ারফুল দূরবীন আছে। এটা দিয়ে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে আমিও কিছুটা যোগাযোগ রাখতে চেষ্টা করি।

চুরি ধরা পড়ার পর মানুষের যা হয়, রণিতার হাল অনেকটা সেইরকম। কারো বাড়ির ওপর নজরদারি করার সন্তোষজনক এবং বিশ্বাসযোগ্য কী কৈফিয়ত তৈরি করা যায়, মনে মনে সে যখন ভাবছে সেই সময় ফোন বেজে ওঠে।

হল-ঘরে সোফার পাশে একটা নিচু স্ট্যান্ডে যে টেলিফোন রয়েছে, আগে লক্ষ করেনি রণিতা। নয়নতারা ফোনটা তুলে নিয়ে খাঁটি ঢাকাইয়া উচ্চারণে গেঁয়ো মেয়েদের মতো কথোপকথন চালিয়ে যান।

ওধারের কথা কিছুই শোনা যাচ্ছে না। নয়নতারা বলছেন, কারে চাইতে আছেন?… নাই, বাড়িতে নাই… মেমসাব কহন (কখন) বাইর হন, কহন ফিরেন তেনিই জানেন.. আর জানেন মা কালী… আইজ্ঞা.. যহন ইচ্ছা ফোন কইরেন… পাইবেন না তেনারে…আইজ্ঞা তেনার নাম?… নয়নতারা বইলা কারোরে চিনি ..যিনি আছেন তেনারেই চাই?… আইচ্ছা যহন ইচ্ছা ফোন কইরেন… পাইবেন না তেনারে.. কুনোদিনই পাইবেন না… পন্নাম (প্রণাম)। রাখি…

প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, সফিস্টিকেটেড, গ্ল্যামারাস নয়নতারা যে এত দ্রুত একটি গ্রাম্য মেয়ের ভূমিকায় নেমে আসতে পারেন, কে ভাবতে পেরেছিল। চমৎকৃত, মুগ্ধ রণিতা তাকিয়ে তাকিয়ে নয়নতারাকে দেখছিল। তিনি ফোনটা নামিয়ে রাখতেই সে বলে ওঠে, আপনার ঐ গলার স্বর আর লাংগুয়েজ আমার খুব চেনা।

নয়নতারা অবাক হন না। বলেন, তার মানে তুমিও ফোনে আমাকে ধরতে চেয়েছ?

দু-তিন বার। আর প্রতি বারই ঐ কথাগুলো শুনতে পেয়েছি।

কী করি বল, আমি তো নিবাসনই বেছে নিয়েছি। কারো সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে চাই না, তবু কেউ যদি জোর করে গায়ে এসে পড়ে তাকে তো এভাবেই অ্যাভয়েড করতে হয়। এড়িয়ে যাবার আর কোনো মেকানিজম আমার জানা নেই।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

তারপর নয়নতারা বলেন, এবার বল ঐ ছেলেটি তোমার সঙ্গে এল না কেন?

অমিতেশকে আনার অসুবিধাটা কোথায় ছিল বুঝিয়ে দেয় রণিতা। ট্রেসপাসিংয়ের জন্য মেয়ে বলে সে পার পেতেও পারে কিন্তু একজন পুরুষের পক্ষে বিপদটা অনেক বেশি।

নয়নতারা বলেন, তা অবশ্য ঠিক। ছেলেটির কী নাম?

রণিতা অমিতেশের পুরো নামটা পদবিসুন্ধু জানিয়ে দেয়।

নয়নতারার দুই চোখে দুষ্টুমি নাচানাচি করতে থাকে। গলার স্বর আচমকা অনেকখানি খাদে নামিয়ে জিজ্ঞেস করেন, অমিতেশের সঙ্গে তোমার রিলেশানটা কী? বয়ফ্রেন্ড?

লজ্জা পায় রণিতা, জড়ানো আবছা গলায় কিছু একটা বলে যায় যার একটি বর্ণও বোঝা যায় না।

নয়নতারা এবার বলেন, তবে কি লাভার? প্রেমিক?

রণিতার মুখে রক্তোচ্ছাস খেলে যায়।

নয়নতারা বলেন, বুঝেছি। কিছু বলতে হবে না। একটু থেমে ফের বলেন, একটা ব্যাপারে আমার খুব কৌতূহল হচ্ছে রণিতা।

কী?

আমার এই বাড়িটা তোমরা খুঁজে বার করলে কী করে?

কিভাবে খুঁজে পেয়েছে তার অনুপুঙ্খ বিবরণ দিয়ে যায় রণিতা, শুধু খোঁজার কারণটা আপাতত জানায় না। সুযোগ এবং নয়নতারার মুড বুঝে সেই প্রসঙ্গটা তুলবে।

ঘন পালকে-ঘেরা নয়নতারার টানা চোখ দুটি বিস্ময়ে গোল হয়ে যায় বলেন, আরে বাবা, এ যে বিরাট এক্সপিডিশান! বাংলায় কী একটা দারুণ গজা কথা আছে না- ও হ্যাঁ, অধ্যবসায়। তোমাদের দেখছি সেটা যথেষ্ট পরিমাণেই রয়েছে। আমি হলে কিন্তু কিছুতেই পারতাম না।

রণিতা বলে, আপনার মতো একজন শিল্পীর জন্য আমি পৃথিবীর শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যেতে পারি।

ফ্ল্যাটারি?

বিশ্বাস করুন, একেবারেই না।

রণিতার বলার মধ্যে এমন এক আন্তরিকতা রয়েছে যা নয়নতারার বুকের ভেতরকার সূক্ষ্ম তারে আলতো ঝঙ্কার তুলে যায়। মেয়েটিকে তাঁর ভাল লাগতে শুরু করে। হাসিমুখে বলেন, ঠিক আছে, বিশ্বাস করলাম।

একটু চুপচাপ।

তারপর নয়নতারা বলেন, এবার তোমাকে আমি সবচেয়ে ভাইটাল প্রশ্নটা করব।

রণিতা উৎসুক চোখে তাকায়। ভেতরে ভেতরে একটু উৎকণ্ঠাও বোধ করে, যদিও এখন পর্যন্ত নয়নতারাকে যেটুকু দেখেছে তাতে মনে হয়েছে এই কিংবদন্তির নায়িকা রহস্যময় সুদূর নীহারিকায় ভাসমান রঙিন কোনো ফানুস নন, একান্তভাবে চেনা পৃথিবীরই মানুষ–সহৃদয়, সহানুভূতিশীল, স্নেহপ্রবণ। তিনি নিশ্চয়ই তাকে বিপাকে ফেলবেন না।

নয়নতারা বলেন, তোমাকে যেটুকু দেখলাম, কথা বলে যা বুঝলাম, তাতে উন্মাদের মত ফিল্মস্টারের পেছনে তুমি ছুটবে না। তেমন রুচি বা শিক্ষাদীক্ষাও তোমার নয়।

রণিতা তাকিয়েই থাকে।

নয়নতারা থামেন নি, তা হলে এতটা ঝুঁকি নিয়ে রাতের অন্ধকারে এ বাড়িতে ঢুকেছ কেন? উদ্দেশ্য কী তোমার?

দ্বিধান্বিতভাবে রণিতা বলে, আজ বলতে সাহস হচ্ছে না। আমাকে দু একটা দিন সময় দিন।

নয়নতারা সোজাসুজি রণিতার চোখের দিকে তাকান, অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। বলেন, তুমি শুধু ইনটেলিজেন্টই নও, অসম্ভব ধুরন্ধর। আরেক দিন এ বাড়িতে ঢোকার ব্যবস্থা করে রাখতে চাইছ?

শুধু আরেক দিন কেন, আপনার অনুমতি পেলে আরো অনেক, অনেক দিন আমাকে এখানে আসতে হবে।

রেগে উঠতে গিয়ে হেসে ফেলেন নয়নতারা, নটি গার্ল। ভীষণ খলিফা তুমি।

নয়নতারার মুখে খলিফা কথাটা শুনবে ভাবতে পারেনি রণিতা। এসব শব্দ তোত অল্প বয়সের ছেলেমেয়েরা নিজেদের মধ্যে ব্যবহার করে থাকে। দৈখা যাচ্ছে বাড়ির ভেতর নির্বাসন বেছে নিলেও বাইরের অনেক কিছুই তিনি জানেন।

নয়নতারা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একবার তাকে বলেছেন চতুর, একবার ধুরন্ধর, একবার নটি গার্ল এবং খলিফা। পাঁচিল ডিঙোবার জন্য তিনি যে খেপে যান নি তা তো আগেই বুঝে গেছে রণিতা। বরং বেশ মজা পাচ্ছেন, সেটাও তার কাছে আর অস্পষ্ট নেই।

নয়নতারা কিছুক্ষণ ভেবে বলেন, তুমি প্রমিস করেছ আমার কথা বাইরের কাউকে জানাবে না।

রণিতা বলে, করেছি।

সেই শর্তেই তোমাকে আরেক দিন এ বাড়িতে ঢোকার পারমিসান দেব। যদি দেখি শর্ত ভাঙো নি, এখানকার দরজা চিরকালের মতো হয়তো তোমার কাছে খুলেও যেতে পারে।

ধন্যবাদ। আপনাকে কী বলে যে কৃতজ্ঞতা জানাব–

হাত তুলে রণিতাকে থামিয়ে দিতে দিতে নয়নতারা বলেন, ধন্যবাদ বা কৃতজ্ঞতার দরকার নেই। আট বছর স্টেজ আর সিনেমা ওয়ার্ল্ডের বাইরে রয়েছি আমি। তবু এখনও আমাদের দেশের তো বটেই–পাকিস্তান, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কার বহু মানুষ আমাকে দেখতে চায়, অনেকেই ফোন করে। টেলিফোন ডাইরেক্টরিতে আমার নাম ছাপা হয় না, ওটা আনলিস্টেড। তবু কী করে যে লোকে জানতে পেরেছে কে জানে!

রণিতা বলে, মনে হয় আমি যেভাবে জেনেছি সেইভাবেই—

আরে তাই তো। তোমার কে এক আত্মীয়ের কথা বলছিলে না, টেলিফোনের বড় অফিসার। কিরকম আত্মীয় হন?

সম্পর্কে দাদা হন।

এইরকম সব সোর্স থেকেই জানাজানি হয়েছে। তবে আমি ধরা দিই না। পরিষ্কার বলি নয়নতারা নামে এ বাড়িতে কেউ থাকে না।

সে তো এখন নিজের চোখেই দেখলাম। আগে কানেও শুনেছি।

নয়নতারা একটু হাসেন, একটা সুবিধে হয়েছে, এই গোপন টেলিফোনটি নয়নতারার নামে নেই। ফলে অনেকেই ধাঁধায় পড়ে যায়–

রণিতা বলে, আমিও পড়েছিলাম। মমতা রায় কে?

আমিই মমতা রায়। ওটা আমার বাবার দেওয়া নাম। আরো একটা নাম আছে আমার– লক্ষ্মী। নয়নতারা আমার স্ক্রিন নেম।

একটু চুপচাপ।

তারপর নয়নতারা ফের শুরু করেন, সে যাক, অন্য যারা ফোন করে বা আমাকে দেখতে চায় তুমি যে তাদের মধ্যে পড় না, সেটা বুঝতে পেরেছি। কেন এত কষ্ট করে এ বাড়িতে ঢুকেছ জানার জন্যে যথেষ্ট কৌতূহল হচ্ছে কিন্তু তুমি তো আজ মুখ খুলবে না। কবে আসতে চাও?

রণিতা বলে, যেদিন আপনি সময় দেবেন।

খানিকক্ষণ চিন্তা করে নয়নতারা বলেন, নেক্সট উইকের বুধবার, সকাল নটায়। অসুবিধে হবে?

একেবারেই না। আপনি যদি মাঝরাতে আসতে বলেন, তাই আসব।

নয়নতারা শুধু হাসেন।

রণিতা বলে, আজ তা হলে আমি যাই?

নয়নতারা বলেন, আচ্ছা। বুধবার পাঁচিল টপকে আসার দরকার নেই, সোজা গেট দিয়ে ঢুকবে। আর–

আর কী? উৎসুক সুরে জানতে চায় রণিতা।

নয়নতারা বলেন, যদি ইচ্ছে হয়, তোমার সেই বয়ফ্রেন্ড বা প্রেমিক ছোকরাটিকেও সঙ্গে আনতে পার। তবে তাকে আমার শর্তটা জানিয়ে দিও। তাঁর চোখের তারায় দুষ্টুমির মতো কিছু একটা নেচে যায়।

.

১৫.

পর পর পাঁচদিন ভোরে জামগাছ থেকে ঝুলে নামতে হয়েছে বটে, লু এত সহজে নয়নতারার কাছে পৌঁছনো যাবে, ভাবতে পারে নি রণিতা। একরকম অযাচিতভাবেই সুযোগটা এসে গেছে। এখন সেটা সুকৌশলে কাজে লাগিয়ে আদৌ ওঁকে ডকু-ফিচারের ব্যাপারে রাজি করানো যাবে কিনা কে জানে। তবে রণিতা শেষ পর্যন্ত চেষ্টা করে যাবে।

নয়নতারার সঙ্গে সেদিন তার কী কথাবার্তা হয়েছে, কেমন ব্যবহার তাঁর কাছে পাওয়া গেছে, সব কিছু সেদিনই রণিতা জানিয়ে দিয়েছিল বিন্দুবাসিনী, অমিতেশ আর ইন্দ্রনাথকে। তিনজনই দারুণ উৎসাহিত। ওঁদের স্থির বিশ্বাস ডকু ফিচারটা করা যাবে এবং সাংস্কৃতিক জগতের সেটা হবে বিরাট এক ঘটনা।

রণিতা তিনজনকেই বার বার নয়নতাবার শর্তের কথাটা মনে করিয়ে দিয়েছে। তাঁর সঙ্গে যে যোগাযোগ হয়েছে সেটা যেন কোনোভাবেই চাউর হয়ে, না যায়। তা হলে চোদ্দ নম্বর রবিনসন স্ট্রিটে আর ঢোকার সম্ভাবনা থাকবে না।

পরের সপ্তাহের বুধবার সকাল নটায় অমিতেশকে সঙ্গে করে রণিত নয়নতারার বাড়ির সামনে এসে কলিং বেল বাজায়। আজও একটা ব্যাগে পুরে ক্যামেরা আর টেপ রেকর্ডার এনেছে সে। যদি কোনোভাবে নয়নতারাকে রাঙি করানো যায়, আজই তাঁর ছবিটবি তুলে, কথাবার্ত রেকর্ড করে প্রাথমিক কাজ শুরু করে দেবে।

গেটের সেই চৌকো জানালাটা খুলে দারোয়ান রণিতাদের দেখে নিঃশব্দে একমুখ হাসে। তারপর গেটটা খুলে দেয়। দুজনে ভেতরে ঢুকে পড়ে।

রণিতাদের কথা নিশ্চয়ই দারোয়ানকে জানিয়ে রেখেছিলেন নয়নতারা নইলে এমন মধুর হাসি তার মুখে দেখা দিত না।

দারোয়ান বলে, মেমসাব উপরমে হ্যায়। যাইয়ে–

রণিতা আর অমিতেশ বাগান ডান দিকে রেখে নুড়ির রাস্তার ওপর দিয়ে বাড়িতে চলে আসে। সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে রণিতা লক্ষ করে, উত্তেজনায় প্রায় কাঁপছে অমিতেশ। চারদিন আগে এই সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে অবিকল এইরকমই কিছু একটা তারও হয়েছিল।

নয়নতারা তাদের জন্য দোতলার হল-ঘরে একটা সোফায় বসে অপেক্ষা করছিলেন। বোঝা যায়, এর মধ্যে তাঁর স্নান হয়ে গেছে। পরনে ধবধবে সাদা চিকনের কারুকাজ-করা শাড়ি আর তসরের ব্লাউজ। স্নানের পর সব মেয়েকেই। ভারি পবিত্র দেখায়। নয়নতারাকে আলৌকিক কোনো দেবী মনে হচ্ছিল।

নয়নতারা হেসে বললেন, এস এস–বস–রণিতারা বসলে সকৌতুকে অমিতেশের দিকে তাকিয়ে বলেন, তোমার কাজটা কিন্তু কাপুরুষের মতো হয়েছে।

অমিতেশ হকচকিয়ে যায়। বুঝতে না পেরে বলে, মানে—আমি–

বান্ধবীকে পাঁচদিন ভোরে একা একা পাঁচিলের এপারে পাঠিয়ে নিজে হাত-পা গুটিয়ে বসে রইলে। স্ট্রেঞ্জ! বলে চোখ সামান্য কুঁচকে অমিতেশকে লক্ষ করতে থাকেন নয়নতারা।

হতচকিত ভাবটা দ্রুত কাটিয়ে ওঠে অমিতেশ। বলে, ওর সঙ্গে আমারও পাঁচিল টপকানো উচিত ছিল, তাই বলছেন?

রাইট।

আপনার মধ্যে এতটা গ্রেটননস আছে ভাবতে পারি নি, আগে জানলে রণির সঙ্গে প্রথম দিনই পাঁচিল টপকাতাম।

গম্ভীর ভারি গলায় নয়নতারা বলেন, কী ভেবেছিলে, আমার ভেতর যা আছে সবটাই মীননেস–নীচতা?

হতচকিত অমিতেশ সজোরে দু হাত নাড়তে নাড়তে বলে, না না, এ আপনি কী বলছেন।

ঠিক আছে, ঠিক আছে, তোমাকে অত বিব্রত হতে হবে না। ফিল ফ্রি। নয়নতারা কপালে সামান্য ভাঁজ ফেলে হাসেন।

সমস্ত ব্যাপারটাই যে তাঁর মজা, বুঝতে পেরে আরাম বোধ করে অমিতেশ। বলে, আমাকে এমন ঘাবড়ে দিয়েছিলেন–

হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিতে দিতে নয়নতারা বলেন, তোমাদের দুজনের নাম ছাড়া আর কিছুই প্রায় জানি না। কী কর তোমরা?

অমিতেশ দ্রুত একবার রণিতার দিকে তাকায়। অর্থাৎ এক্ষুনি নিজেদের আসল পরিচয়টা দেওয়া ঠিক হবে কিনা, সেটা ওর কাছ থেকে বুঝে নিতে চাইছে। কিন্তু সে কিছু বোঝার আগেই খুব সহজভাবে রণিতা নয়নতারাকে বলে, অমিতেশ সম্পর্কে আপনাকে সেদিন বলেছিলাম। ও একটা কাগজে কাজ করে–রোভিং রিপোটার। মনে পড়ছে?

নয়নতারা বলেন, হ্যাঁ হ্যাঁ, এরকম কী যেন বলেছিলে। আর তুমি?

আমি পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউট থেকে চার বছর আগে পাস করে বেরিয়েছি। আমার সাবজেক্ট ছিল ফিল্ম ডিরেকশান। এখন শর্ট ফিল্ম মানে ডকুমেন্টারি ধরনের ছবি করছি। বলে সোজাসুজি নয়নতারার দিকে তাকায় রণিতা।

নয়নতারা কিছু মনে করার চেষ্টা করেন। তারপর বলেন, দিন পনেরো আগে আসামের মিকির ট্রাইবকে নিয়ে তোমার একটা ডকুমেন্টারি কি টিভিতে দেখানো হয়েছিল?

আপনি দেখেছেন! রণিতার চোখমুখ উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।

নিশ্চয়ই। নয়নতারা বলেন, এখন তো আমার প্রচুর অবসর। টিভি দেখে দেখে অনেকটা সময় কাটিয়ে দিই। একটু থেমে বলেন, আজকাল মেয়েরা ফিল্ম ডিরেকশনে আসছে, এটা খুব ভাল ব্যাপার। এই ফিল্ডটাতেও পুরুষদের মনোপলি ভাঙছে। মেয়েরা আর কোনো দিকেই পিছিয়ে থাকছে না। বলে সকৌতুকে অমিতেশের দিকে তাকান। বিশাল হলঘরটায় পুরুষ জাতির একমাত্র প্রতিনিধি অমিতেশ, দেখা গেল, মেয়েদের এই অগ্রগতিতে তার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। নয়নতারার বলার ভঙ্গিতে সেও হেসে ফেলে।

নিজের ডকুমেন্টারিটা সম্পর্কে নয়নতারার মন্তব্য শোনার জন্য ভেতরে ভেতরে উদগ্রীব হয়ে উঠছিল রণিতা। সে জিজ্ঞেস করে, আমার ছবিটা কেমন লাগল?

নয়নতারা বলেন, চমৎকার। ওটা করার জন্যে তোমাকে বেশ রিসার্চ করতে হয়েছে, তাই না?

রণিতা জানায়, ছমাস মিকিরদের নিয়ে লেখা নানা বইপত্র পড়েছে সে, লামডিংয়ে গিয়ে একটা মিকির গ্রামে তিন মাস কাটিয়ে ওদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা খুঁটিয়ে লক্ষ করেছে, তারপর ছবির কাজে হাত দিয়েছে।

সেই জন্যেই ছবিটা এত টাচিং, ডিটেলের কাজ এত ভাল।

একটু চুপচাপ।

তারপর নয়নতারা রণিতাকে বলেন, আশা করি এ কদিনে তোমার নাভাসনেস কেটে গেছে। আমার বাড়িতে হানা দেবার কারণটা আজ নিশ্চয়ই জানাবে।

রণিতা বলে, হ্যাঁ। নয়নতারাকে নিয়ে ডকু-ফিচারের যে পরিকল্পনাটা করেছে সেটা জানিয়ে সে বলে, আমার ধারণা, আপনি আমাকে সাহায্য করবেন।

নয়নতারার চেহারাটা পলকে আদ্যোপান্ত বদলে যায়। লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে কণ্ঠস্বর অনেকটা উঁচুতে তুলে রুক্ষভাবে তিনি বলেন, অসম্ভব–

রণিতা ভয় পেয়ে যায়। বলে, আপনার মতো একজন গ্রেট আর্টিস্ট–

আঙুল তুলে তাকে থামিয়ে দিয়ে নয়নতারা বলেন, স্টপ ইট, প্লিজ স্টপ। আট বছর আমি দূরে সরে নিজের মতো করে বেঁচে আছি। বাইরের ওয়ার্ল্ডের সঙ্গে আমার কোনোরকম যোগাযোগ নেই। বিশেষ করে প্রিন্ট আর অডিও ভিসুয়াল মিডিয়ার লোকেদের আমি অপছন্দ করি। আমি চাই না তারা আমার শান্তিভঙ্গ করুক।

রণিতা কিছু বলার চেষ্টা করে কিন্তু তার সুযোগ পায় না। তার আগে ফের একই সুরে নয়নতারা বলে যান, তোমরা বিন্দুবাসিনী দেবীদের বাড়ি থেকে চোখে দূরবীন লাগিয়ে দিনের পর দিন আমাকে খুঁজতে, সে জন্যে একটু কৌতূহল হয়েছিল, তাই এ বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছিলাম। কিন্তু তোমাদের এরকম একটা ইনটেনসান রয়েছে, তখন জানতাম না।

জানলে কি ঢুকতে দিতেন না?

আমার জবাব–অবশ্যই না। তোমরা মিডিয়ার লোকেরা আমার প্রচুর ক্ষতি করেছ। তোমাদের সঙ্গে আমি কোনোরকম সম্পর্ক বাখতে চাই না।

রণিতা বুঝতে পারছিল, যে কোনো কারণেই হোক, মিডিয়ার ওপর নয়নতারা খুবই অসন্তুষ্ট। হয়তো সেখান থেকে তিনি কোনো আঘাত পেয়েছেন আর সেটা তাঁর মাথায় চেপে বসে আছে, কিছুতেই ভুলতে পারছেন না। যেভাবে তিনি ক্ষিপ্ত হয়ে আছেন তাতে ডকু-ফিচারটার আশা আর নেই। রণিতা প্রায় মরিয়া হয়ে ওঠে, আপনি মিডিয়াকে ঘৃণা করেন?

থমথমে মুখে নয়নতারা বলেন, ইয়েস, আই ডু।

কিন্তু–

আবার কী? তোমকে তো পরিষ্কার বলে দিলাম–আই হেট, আই হেট, আই হেট–

রণিতা উঠে দাঁড়ায়। বলে, একটা কথা ভেবে দেখেছেন?

নয়নতারা বলেন, কী ভাবার কথা বলছ?

আপনি আজ যা, তার সবটুকুই মিডিয়ার তৈরি। দিনের পর দিন কাগজে আপনার সম্বন্ধে লিখে, অজস্র ছবি ছেপে, টিভিতে অনবরত আপনার ফিল্ম দেখিয়ে, রেডিওতে আপনার সম্পর্কে বলে বলে একটা লিজেন্ড বানিয়ে দিয়েছে। আপনাকে ঘিরে আজ এত যে মিথ সেটা মিডিয়ারই জন্যে। ইউ আর মিডিয়া ক্রিয়েটেড। আর বলছেন কিনা আপনি আমাদের ঘৃণা করেন!

রণিতা যে এভাবে বলতে পারে, ভাবতে পারেন নি নয়নতারা, একটু থমকে যান তিনি। পরক্ষণে বলে ওঠেন, কে চেয়েছিল ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে মিথ বানিয়ে আমাকে সুপার হিউম্যান করে তুলতে? আসলে কাগজ যাতে বেশি কাটে, রেডিও আর টিভির যাতে আকর্ষণ বাড়ে সেই জন্যে আমাকে লিজেন্ড তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু আমি তা চাই নি।

কী চেয়েছিলেন আপনি?

একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকতে।

এরপর কী বলা উচিত, রণিতা ঠিক করতে পারছিল না। এত গ্ল্যামার, এত মিথ, কোটি কোটি মানুষের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে দিনের পর দিন থেকে যাওয়া–একজন চিত্রতারকার কাছে এসব যে সেভাবে কাম্য নয়, এই প্রথম জানতে পারল রণিতা। অবাক চোখে সে নয়নতারার দিকে তাকিয়ে থাকে।

নয়নতারা বলে যাচ্ছিলেন, মিডিয়া আমার কী করেছে ভাবতে পার? আট বছর আগে আমি কোথাও বেরুতে পারতাম না, কারো সঙ্গে মিশতে পারতাম না। লক্ষ লক্ষ মানুষের চোখ তখন আমার দিকে, হাজার হাজার ক্যামেরা আমাকে ফলো করে যাচ্ছে। ফ্রিলি নিশ্বাস নিতে পারি না, স্বাভাবিক জীবনযাপন বলতে আমার কিছুই নেই। বানিয়ে বানিয়ে অসংখ্য স্ক্যান্ডাল বানিয়ে মদের চাটের মতো বিলানো হচ্ছে। আমার প্রাইভেসি বলতে কিছু নেই। ঘরের ভেতর কী করি, ঘরের বাইরে কোথায় যাই, সব পরদিন খবরের কাগজের প্রথম পাতায় ছাপা হয়ে যায়। এমন সব কুৎসাও বেরোয় যার সঙ্গে আমার কোনো সংস্রব নেই। তোমরা আমার নিজস্ব ওয়ার্ল্ড বলতে কিছু রাখো নি, বাইরের ওয়ার্ল্ডও কেড়ে নিয়েছ।

ঝোঁকের মাথায় বলতে বলতে হঠাৎ সচেতন হয়ে থমকে যান নয়নতারা। হয়তো তাঁর মনে হয়, অনেক বেশি বলা হয়ে গেছে। এতটা বিস্ফোরণের প্রয়োজন ছিল না। নিজেকে অনেকটা সামলে নিয়ে বলেন, তোমরা এখন যেতে পার।

রণিতা হতাশ গলায় বলে, ডকু-ফিচারটার কী হবে?

কিছুই হবে না, আমি রাজি নই।

কিন্তু দেশের মানুষের আপনার সম্বন্ধে কতটা আগ্রহ, কতটা শ্রদ্ধা তা বোধহয় আপনার জানা নেই। এসব উপেক্ষার জিনিস নয়। আপনি কি একবার ভেবে দেখবেন? আমরা না হয় অন্য দিন এসে জেনে যাব।

নয়নতারা বলেন, না। আট বছর সবার সামনে থেকে দূরে সরে এসে নিজের মত করে আমি বেঁচে আছি। ডকু-ফিচার মানেই নতুন করে মানুষের নজর আবার আমার ওপর এসে পড়বে। আবার খবরের কাগজ, টিভি, রেডিওর ঝাট। আমার শান্তি নষ্ট হোক, এটা আমি কিছুতেই হতে দেব না। প্লিজ কুইট।

পকেট থেকে একটা কার্ড বার করে সেন্টার টেবলে রেখে রণিতা বলে, এটা থাকল। যদি ডকু-ফিচারের ব্যাপারে কখনও আপনার সিদ্ধান্ত পালটায় দয়া করে ফোন করবেন।

পালটাবে না।

কিছুক্ষণ চুপচাপ।

তারপর নয়নতারা বলেন, তোমরা হয়তো আমার ওপর রেগে গেলে। তবু একটা অনুরোধ করব।

রণিতা বলে, রাগ করব কেন? আপনার অনুরোধটা কী?

এই সময় টেলিফোন বেজে ওঠে।

নয়নতারা বলেন, এক মিনিট–কপা এগিয়ে সেই নিচু স্ট্যান্ডটা থেকে ফোন তুলে জিজ্ঞেস করেন, কাকে চান–ও সমরেশ–

চকিতে রণিতা আর অমিতেশ পরস্পরের দিকে তাকায়। ঐ নামটা তাদের অজানা নয়। সেদিন যে বেনামা চিঠিটা এসেছিল তাতে নয়নতারার প্রিয় বন্ধু এবং অন্ধ অনুরাগী সমরেশ ভৌমিকের কথা সাতকাহন করে লেখা ছিল। নিজেদের অজান্তেই তাদের সমস্ত স্নায়ু টান টান হয়ে যায়। যে লোকটি আট বছর আগে ঘর সংসার ফেলে রেখে অদ্ভুত এক নেশার ঘোরে নয়নতারার সঙ্গে নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছিল, এতকাল বাদে তাদের দুজনের সম্পর্কটা কতখানি বজায় রয়েছে সেটা বোঝার জন্য টেলিফোনের দিকে কান খাড়া করে রাখে। অবশ্য রণিতারা বাইনোকুলার দিয়ে এ বাড়িতে আগেই সমরেশ ভৌমিককে একবার দেখেছে। সম্পর্কটা ভাল না থাকলে নয়নতারা কি তাঁকে বাড়িতে ঢুকতে দিতেন?

নয়নতারা বলছিলেন, কসবার কোন জমিটা?.. আঠারো নম্বর রজনী দত্ত রোডেরটা কি?….ও পাঁচ কাঠা… চারতলা বাড়ি করতে হবে…বত্রিশটি মেয়ের শেলটার ওর কমে কুলোবে না…বায়না করে নাও..জমির টাকাটা আমিই দিতে পারব…কিন্তু বাড়ি করার মতো অত টাকা আমার নেই..হাঁ, কিছু একটা করতেই হবে….অতগুলো হেল্পলেস মেয়ে….কবে আসছ?…. কাল বিকেলে.ঠিক আছে, ঠিক আছে…কাল সকালে তোমার ফ্ল্যাটে ফোন করব…আর কী…ও হ্যাঁ হ্যাঁ…ওখানে ওষুধ কিনে দিও…তোমার কাছে হাজার দুই টাকা আছে তো..পরে দেখা যাবে…।

কসবায় জমি কিনে একটা বাড়ি করতে চান নয়নতারা, এটুকু বোঝা গেল। আর জানা গেল, সমরেশ ভৌমিক আঁর সঙ্গে এ বাড়িতে থাকেন না। সমরেশের আলাদা ফ্ল্যাট আছে। যে বত্রিশটি সহায়সম্বলহীন মেয়ের জন্য একটা বাড়ি করার উদ্যোগ নিয়েছেন নয়নতারা তারা কারা? সেটা ধরা গেল না। কথাবার্তা শেষ করে ফোন নামিয়ে রণিতাদের কাছে ফিরে আসেন নয়নতারা। বলেন, তোমাদের অনেকক্ষণ আটকে রাখলাম। হঠাৎ ফোনটা এসে গেল কিনা–

রণিতা বলে, ঠিক আছে। আপনার কী একটা অনুরোধ আছে–

নয়নতারা বলেন, হ্যাঁ। আমি যে এখানে আছি সেটা জানাজানি যেন না হয়। তোমাদের পোপোজালে রাজি হই নি। আশা করি মনের ক্ষোভে এমন কিছু করবে না যাতে আমি বিপন্ন হয়ে পড়ি।

আপনাকে তো সেদিনই বলে গেছি আমাদের ওপর আস্থা রাখতে পারেন, আমরা বিট্রে করব না। আচ্ছা নমস্কার।

নমস্কার।

বাড়িটা থেকে বেরিয়ে রাস্তায় এসে হতাশ ভঙ্গিতে অমিতেশ বলে, তিনটে মাস এত খাটুনি আর চারদিকে ছোটাছুটিই সার হল।

অমিতেশের পাশাপাশি হাঁটতে হাঁটতে রণিতা কিছু ভাবছিল। অন্যমনস্কর মতো বলে, হুঁ–

এবার কী করবে?

দেখি। 

মান্ডি হাউসকে তো জানিয়ে দিয়েছিলে ডকু-ফিচারটা করতে পারবে এখন ওদের কী বলবে?

কটা দিন ওয়েট করি। যদি নয়নতারার মত বদলায়, ফাইন। নইলে চিঠি লিখে জানিয়ে দেব, আমার পক্ষে সম্ভব হল না।

অমিতেশের মনে প্রচুর ক্ষোভ জমা হচ্ছিল। সে বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল নয়নতারা ডকু-ফিচারের ব্যাপারে আপত্তি তো করবেনই না, বরং তাঁর কাছ থেকে সবরকম সহযোগিতা পাওয়া যাবে। কিন্তু তিনি তাদের আন্তরিকতা এবং এতদিনের পরিশ্রমকে একেবারেই মর্যাদা দিলেন না।

অমিতেশ একটু ইতস্তত করে বলে, তোমাকে না জানিয়ে একটা কাজ করেছি।

কী? রণিতা জানতে চায়।

পকেটে একটা ছোট পাওয়ারফুল টেপ রেকর্ডার নিয়ে গিয়েছিলাম। ওটা চালিয়ে নয়নতারার কথাগুলো রেকর্ড করে নিয়েছি। তার ওপর বেস করে ওঁর সাক্ষাৎকার ছেপে দেব নাকি? ফার্স্ট ইন্টারভিউ অফ নয়নতারা আফটার এইট ইয়ারস অফ সাইলেন্স–

রণিতা চমকে ওঠে, না না। ওঁকে কথা দিয়েছি, বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না। না জানিয়ে ওঁর কথা টেপ করে খুব অনায় করেছ। দিস ইজ আনএথিক্যাল।–

অমিতেশ তাকে বোঝাতে চেষ্টা করে, আরে বাবা, আমরা কাগজের লোক, যে কোনো ভাবেই খবর জোগাড় করাটা আমাদের কাজ। অত এথিকসের ধার ধারলে কাগজ বন্ধ করে দিতে হবে। একটু থেমে ফের বলে, ইন্টারভিউটা ছাপা হলে অন্তত নিজেকে বোঝাতে পারব, আমাদের এতদিনের লেবারটা একেবারে মিনিংলেস হয়ে যায় নি।

স্থির চোখে দু-এক পলক অমিতেশের দিকে তাকিয়ে থাকে রণিতা। তারপর তাড়া দিতে দিতে বলে, টেপটা আমাকে দাও–

অবাক হয়ে অমিতেশ জিজ্ঞেস করে, কেন?

ওটা আমার কাছে থাকবে।

আমার কাছে থাকলে অসুবিধাটা কী?

কখন নয়নতারার ওপর রাগ করে ইন্টারভিউটা ছেপে দেবে তার কি কিছু ঠিক আছে? এমন একটা লোভনীয় মেটিরিয়াল হাতের মুঠোয় থাকলে কোনো জার্নালিস্ট কি মাথা ঠিক রাখতে পারে? দিয়ে দাও বলছি–

একরকম জোর করেই টেপ রেকর্ডারটা কেড়ে নেয় রণিতা।

টেপটা হাতছাড়া হওয়ায় গুম হয়ে গিয়েছিল অমিতেশ। তার বেজার মুখ দেখে রণিতা এবার বলে, তোমাদের জানলিস্টদের এই এক দোষ, ধৈটা বড্ড কম। কিছু একটা পেলে টাটকা টাটকা সেটা ইউজ করে সেনসেসন ক্রিয়েট করতে চাও। টেপের মেটিরিয়ালটা ধরে রাখলে ভবিষ্যতে আরো অনেক বড় ব্যাপারে কাজে লাগানো যেতে পারে।

অমিতেশের এবার মনেহয় ঠিকই বলেছে রণিতা।ধরা যাক,হঠাৎনয়নতারার মৃত্যু হল কিংবা তিনি নতুন করে ফের অভিনয়ের জগতে ফিরে এলেন, তখন এই টেপটা যে কী মূল্যবান হয়ে উঠবে ভাবা যায় না। এখন ছাপলে কিছুটা চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হবে ঠিকই কিন্তু তার রেশ খুব বেশিদিন থাকবে না। নয়নতারাকে ঘিরে ভবিষ্যতে যদি বড় মাপের ঘটনা ঘটে তখন এই টেপটার এফেক্ট হবে সুদূরপ্রসারী।

অমিতেশ বলে, ঠিক আছে, তোমার কথামতো লোভটা এখন সামলেই রাখি।

কথায় কথায় ওরা একটা মোড়ের মাথায় চলে এসেছিল। এখান থেকে একটা রাস্তা চলে গেছে নিউ আলিপুরের দিকে, একটা রাজা সন্তোষ রোডের দিকে, আরেকটা রাসবিহারীতে। দু মিনিটও দাঁড়াতে হল না, রণিতারা ফাঁকা অটো পেয়ে যায়। রাসবিহারীর দিকে যেতে যেতে রণিতা বলে, এই যা, দারুণ একটা ভুল হয়ে গেল তো।

অমিতেশ বলে, কী?

ডকু-ফিচারটা যে করা যাবে না, বিন্দুবাসিনী মাসিমাকে সেটা জানিয়ে আসা উচিত ছিল।

বাড়ি গিয়ে একটা ফোন করে দিও।

তা তো দিতেই হব। তবে ওঁর সঙ্গে দেখা না করে আসার জন্যে খুব ক্ষুব্ধ হবেন।

অমিতেশ আস্তে আস্তে মাথা নাড়ে, তা হবেন।

আসলে নয়নতারাকে মাঝখানে রেখে প্রীতি স্নেহ বন্ধুত্ব শ্রদ্ধা–সব মিলিয়ে বিন্দুবাসিনীর সঙ্গে তারা জড়িয়ে গেছে। নয়নতারাকে খুঁজে বার করা, তাঁকে নিয়ে ডকু-ফিচারের পরিকল্পনা–এ সবের জন্য যে টিমটা তৈরি হয়েছে তিনি তার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মেম্বার।

রণিতা বলে, ফোন তো আজ করবই, কাল তুমি আর আমি এসে একবার ওঁর সঙ্গে দেখাও করে যাব।

সব শুনলে উনি ভীষণ শকড হবেন।

হুঁ।

চেতলা ব্রিজ পার হয়ে অটোটা কেওড়াতলার মুখে এসে ট্রাফিক জ্যামের ফাঁদে আটকে যায়। চারদিকে অজস্র গাড়ি এমনভাবে জট পাকিয়ে গেছে যে আধ ঘণ্টার আগে রাস্তা ফাঁকা পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ। এখান থেকে রাসবিহারীর মোড় পর্যন্ত হেঁটে গেলে তিন চার মিনিট লাগবে। ভ্যাপসা গরমে অটোর ভেতর বসে থাকার মানে হয় না। ওরা ভাড়া মিটিয়ে নেমে পড়ে।

চলতে চলতে রণিতা বলে, আমি একটা কথা ভাবছিলাম।

জিজ্ঞাসু চোখে তাকায় অমিতেশ, কী?

রণিতা বলে, দু-একদিনের ভেতর কসবায় গিয়ে আঠারো নম্বর রজনী দত্ত রোডের জায়গাটা সম্পর্কে খোঁজ নেব।

অমিতেশ চকিত হয়ে ওঠে, যেটা নয়নতারা কিনে নেবার জন্যে সমরেশ ভৌমিককে ফোনে বায়না করতে বললেন?

হ্যাঁ।

শুধু শুধু এর পেছনে সময় নষ্ট করার দরকার কী?

ধর নিছক কৌতূহল।

অমিতেশ রণিতাকে লক্ষ করতে করতে বলে, বিশুদ্ধ কৌতূহলের জন্যে তুমি কসবায় ছুটবে, তা কিন্তু আমার মনে হয় না।

কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে রণিতা। তারপর যা বলে তা এইরকম। নয়নতারার মতো একজন সুপারস্টার সম্পর্কে প্রচুর তথ্য জোগাড় করেছে সে, তার বিস্তর ছবি দেখেছে, একটা নাটকের ভিডিও ক্যাসেটও। তবু তাঁর জীবনের নানা দিক এবং নানা রহস্য এখনও অজানাই থেকে গেছে। গ্ল্যামার জগতের মক্ষিরানী বত্রিশটি মেয়ের থাকার জন্য কেন গোপনে একটা বাড়ি বানিয়ে দিতে চাইছেন সেটা জানার খুব ইচ্ছা রণিতার। এই মেয়েরা কারা, সম্ভব হলে তাদেরও খুঁজে বার করবে।

রণিতা বলে, ব্যাপারটা হল, একজন লিজেন্ডারি নায়িকার জীবনের খানিকটা আমরা জেনেছি। বাকিটা জানতে না পারলে ওঁর সম্পর্কে আমাদের ধারণাটা ইনকমপ্লিট থেকে যাবে।

আর জেনে কী হবে? কোনো লাভ তো নেই।

আর্থিক লাভের কথা আমি ভাবছি না। ধর এটা আমার স্যাটিসফ্যাকশান।

একসময় ওরা রাসবিহারীর মোড়ে এসে পড়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *