গাড়িটাকে অরাদের বাড়িতেই পাঠিয়ে দিয়েছে অগ্নিভ। রুরুকে ডেকে কয়েকদিন আগেই বলে দিয়েছিল। আণ্ডার গ্রাউণ্ড গ্যারাজটা ধুয়েমুছে রাখতে। একজন ড্রাইভারও ঠিক করে ফেলেছে অগ্নি। সে সকালে আসে। তৃষার অফিস বন্দেল রোডে। তৃষাকে সেখানে নামিয়ে রুরুকে নিয়ে যাদবপুরেযায় ইউনিভার্সিটিতে। তারপর আবার চলে যায় তৃষার কাছে। তৃষার ঘুরে ঘুরে কাজ। অফিস থেকে মোটা ট্রান্সপোর্ট অ্যালাউন্স পায় তৃষা। তা থেকে অনেক বেঁচে যায়। তৃষা বলেছিল, অগ্নিকাকা, পেট্রোলের খরচ এবং সার্ভিসিং-টার্ভিসিং-এর খরচ আমিই দেব।
অগ্নি বলেছিল, একদম নয়। তোর বাবা থাকলে কি তোর কাছ থেকে ওসব নিত? একদম বাজে কথা বলবি না।
ওরা ভাইবোনেই বেশি ব্যবহার করে গাড়ি। অরা কিন্তু একদিনও গাড়ি ব্যবহার করে না। মিনিতেই স্কুলে যায় মিনিতেই ফিরে আসে।
এ নিয়ে অভিযোগ করেছিল অগ্নি কিন্তু অরা কান দেয়নি। বলেছিল, তোমার কাছে আর ঋণ বাড়াতে চাই না। এমনিতেই অনেকই ঋণী হয়ে আছি। বলেছিল যে, অভ্যেস খারাপ করতে চাই না। প্রয়োজন বাড়ালেই বাড়ে। আজকালকার ছেলেমেয়েদের দ্যাখোনা? তাদের কী যে, প্রয়োজন নেই, তাই ভেবে পাই না আমি। সবকিছুই তাদের চাই। ওয়েস্ট সাইড আর প্যান্টালুনে গিয়ে যে দামে ওরা জামাকাপড় কেনে তাতে আমার সারাবছরের শাড়ি হয়ে যায়। তৃষা হাজার পঁচিশ মতো মাইনে পায়। কিন্তু ওর এক-একটা সালোয়ার কামিজের যা দাম, তা শুনলে মাথা ঘুরে যায়। মিথ্যে প্রয়োজনের ভারে ওরা একদিন চাপা পড়ে মারা যাবে। এখন বুঝছে না।
ঠিক-ই বলেছ তুমি। আর তেমন-ই হয়েছে আজকালকার ব্যাঙ্কগুলো। জোর করেই ধার দেবে। কত যে, ফোন আসে। বলে দু-লাখ টাকা দিচ্ছি, নিন-না। কোনো সিকিয়োরিটি, ওয়ারান্টি কিছুই লাগবে না। নমিনাল ইন্টারেস্ট।
তারপর অরা বলল, আমার বাবা শিখিয়েছিলেন, থাকলে খাবে, না থাকলে না খেয়ে থাকবে কিন্তু ধার নেবে না কারও কাছ থেকে। এদের পুরো প্রজন্মটাই অধমর্ণর প্রজন্ম হয়ে গেল। নিত্য নতুন মোবাইল, সিডি প্লেয়ার, ডি ভি ডি প্লেয়ার, হ্যাঁণ্ডিক্যাম–কত্ত যে, প্রয়োজন এদের। নীরব দর্শক হয়ে দেখে যাই। ওরা ওরা, আমরা আমরা। তুমি গাড়ি কিনেছ, তুমি অ্যাফোর্ড করতে পারো। আমি পারি না, তাই চড়ি না।
অগ্নি শুধু শনিবারে গাড়িটা নেয়। রবিবার ড্রাইভারের ছুটি। অন্য সবদিন গাড়ি ছেলেমেয়েদের-ইকাছে থাকে।
এক শনিবার সকালে অগ্নির ফোন এল। শনিবার অরার স্কুল ছুটি থাকে। অগ্নি বলল, আজ এগারোটাতে গাড়িটা নিয়ে আমার কাছে এসো। কচুর শাক আর ইলিশ মাছ আনিয়েছি। চন্দন এসব রাঁধতে পারে না। তুমি এসে রাঁধে। ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে কচুর শাক রাঁধবে, সরষে-ইলিশ, ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে টক। রাতের বেলা তৃষা, রুরু আর অপালাকেও আসতে বলো। ওরাও খাবে, গানটান হবে। অনেকদিন জমায়েত হয় না। দুপুরে আমি আর তুমি একা খাব। একটু একা থাকব। গল্প করব। আসবে প্লিজ?
-রাতে অপালাকে বলব আর ঘোষ সাহেবকে বলব না?
অরা একটু ভেবে বলল। সরি সরি খুব ভুল হয়ে গেছে। অবশ্যই বলবে। তুমি ফোন করে ওদের বললেই কি ভালো দেখাবে-না? ঠিক আছে।
তারপর বলল, ঠিক-ই বলেছ। তাই-ই বলব।
একটু চুপ করে থেকে অরা বলল, রুরু তোমার কাছে গেছিল? কিছু কি বলেছে?
-হ্যাঁ। বলছিল বটে। তবে আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না।
–তবে খুব-ই রিপেট্যান্ট মনে হল। কোনো অন্যায় করেছে কি?
–অন্যায় অবশ্যই করেছে। খুব প্ল্যান করে করেছে। রীতিমতো ক্রিমিনালের মতো প্ল্যান করে। আমি গিয়ে বলব। ওকে তুমি একটু শাসন কোরো। ব্যাপারটা আমার পক্ষে একটু ডেলিকেট। তুমি বললেই ভালো হয়।
–এসো। শুনব। আমি কি আজ-ই অপালাকে বলব নিজে ফোন করে? শনিবার ঘোষ সাহেব, মানে ব্যারিস্টারদের তো অনেক-ই কাজ। অপালার স্বামীও কি আসতে পারবেন?
–শুক্রবার সন্ধেবেলা হলে হয়তো পারতেন।
অরা বলল। কোনো ব্যারিস্টার-ই শুক্রবার সন্ধেবেলা কাজ করেন না।
-তাই বুঝি?
–হ্যাঁ। তুমি জানতে না?
–তাহলে শুক্রবার-ই করা যাবে। তবে সেদিন তুমি স্কুল থেকে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে আমার কাছে চলে এসো গাড়ি নিয়ে। সেদিন দয়া করে গাড়িটা নিয়েই স্কুলে গিয়ে আমাকে ধন্য কোরো।
–বাড়ি থেকে রান্না করে নিয়ে গেলে হয় না?
–তাহলে তোমাকে একটু একা পাওয়া হবে না। গল্পও করা হবে না। তোমার জন্যে তোমাকে ভালোবেসে একজীবনে তো কম কষ্ট পেলাম না। আমাকে একটু আনন্দ দিতে তোমার এতই আপত্তি? আমি কবে মরে যাব কে বলতে পারে? এ মাসের ‘ই সি জি’ ভালো বেরোয়নি। আমার বন্ধুবান্ধবেরাও তো টপাটপ মরে যাচ্ছে। তা ছাড়া ডিমেশনিয়া মহোও হয়েছে। কোথায় যে, কী রাখি মনে থাকে না। মানুষের নাম মনে থাকে না। কারও সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করলে তাও মনে থাকে না আজকাল। কেউ নিমন্ত্রণ করলে একদিন আগে অথবা একদিন পরে গিয়ে পৌঁছেই সেখানে, ভয় করে। শেষে অ্যালঝাইমারে না দাঁড়ায়। আমি তোমাদের কারও কাছেই বোঝা হতে চাই না। অ্যালঝাইমার যদি সত্যিই হয় তবে আত্মহত্যা করে মরে যাব। অমন বাঁচা বাঁচব না।
–কিছু হবে না। তুমি যতদিন গান গাইতে পারবে ততদিন তোমার কিছুই হবে না। তোমার মতো মানুষের কি এত তাড়াতাড়ি যাওয়া চলে? এত মানুষকে তুমি আনন্দ দাও। তোমাকে ঈশ্বর ঠিক বাঁচিয়ে রাখবেন।
–তাহলে অপালা আর ঘোষ সাহেবকেও আসতে বলছি শুক্রবারে। তুমি এলে দুপুরে ড্রাইভারকে পাঠিয়ে চাইনিজ আনিয়ে নেব। খাওয়া-দাওয়ার পরে তুমি ধীরেসুস্থে রান্না কোরো। বিকেলে একটু রাবড়ি নিয়ে আসতে বলব ড্রাইভারকে।
–’শর্মা’ থেকে?
–না না শর্মা থেকে নয়, মে-ফেয়ার রোড-এর নেপালের দোকান থেকে।
–রাবড়ি তুলে নিয়ে রুরুকে নিয়ে আসবে ড্রাইভার।
–রুরুর জন্যে গাড়ি লাগবে না। তুমি বরং তৃষার অফিসে গাড়ি পাঠিয়ে দিয়ো। ওর-ই তো দেরি হয়।
–আর চুমকিকে বলব না?
–তোমার ইচ্ছে হলে বোলো।
তবে এইকথাই রইল। আমি নিজে সকালে বাজারে যাব। গড়িয়াহাট বাজারে সনাতনের দোকান থেকে বড়ো ইলিশ নিয়ে আসব আর কচুর শাক। আগের দিন সনাতনকে বলে রাখব। কত মাছ আনব? তিন কেজি,?
–অত কে খাবে? আমরা কি রাক্ষস? যা মাছ ইতিমধ্যেই আনিয়েছ তার কী হবে?
–ও চন্দন যেমন করে পারে রাঁধবে। আমার বন্ধুদের ডেকে নেব। ওরা সেসবের সৎকার করবে। তুমি যেদিন রাঁধবে সেদিন হবে স্পেশাল ট্রিট।
–গড়িয়াহাট বাজারে তোমার গৌর-এর কী হল?
–গৌর এখন খুব বড়ো হয়ে গেছে। আমার মতো ছোটোখাটো খদ্দেরকে ও পাত্তা দেয় না। তাই ওকে ছেড়েছি। তা ছাড়া ওর লোকেরা দাম ও ওজনেও গোলমাল করে।
–তিন কেজি মাছ আনবে কেন? নষ্ট হবে না?
–থাকলে, ফ্রিজে থাকবে। পরদিনও খাব। আর বিস্পতির জন্যেও নিয়ে যাবে বাড়িতে সব রান্না। ও আমাকে কত কী রান্না করে খাওয়ায়।
অরা চুপ করে থাকলেন।
–চিতল মাছ আনব নাকি? খুব বড়োপেটি পাওয়া যায় সনাতনের দোকানে।
-ইচ্ছে করলে আনতে পারো, পেটি রাঁধতে আর অসুবিধে কী? মুইঠ্যা করতেই ঝামেলা।
–তাহলে চিতলও আনব। কালোজিরে, কাঁচালঙ্কা, ধনেপাতা দিয়ে রাঁধবে। তুমি কিন্তু বারোটা নাগাদ চলে এসো। গাড়ি নিয়েই স্কুলে যেয়ো। শুক্রবারে সাড়ে এগারোটার সময় ড্রাইভার যেন, গাড়ি নিয়ে স্কুলে পৌঁছে যায় তা বলে দিয়ো।
তারপর বলল, ছাড়ছি। সঙ্গে চেঞ্জ নিয়ে এসো। রান্নার পরে চানটান করে ফ্রেশ হয়ে নিয়ে সুন্দর করে সাজতে হবে তো। আমি অবশ্য তোমাকে সবসময়েই সুন্দর দেখি। এবারে নববর্ষে, মানে পয়লা বৈশাখে তোমাকে একটা দারুণ সুন্দর শাড়ি দেব। একদিন শাড়িটা পরে আমাকে দেখিয়ো। আর একদিন না-পরে।
অরা অনেকক্ষণ টেলিফোনের অন্যপ্রান্তে চুপ করে থাকল। তারপর বলল, তুমি বড়ো প্রগলভ হয়ে গেছ। আগে তো এমন ছিলে না।
–রুরুদের সঙ্গে মিশে মিশে আমিও নবযৌবনের দলের একজন হয়ে গেছি।
–আমার কিছু বলার নেই।
অগ্নি বলল, রামকুমার বাবুর কাছে একটা গান শুনেছিলাম।
–কে রামকুমার বাবু?
–রামকুমার চট্টোপাধ্যায়।
–কী গান?
একদিন তোমায় বুকের মাঝে ধরেছিলাম প্রাণ
তখন তোমার মন ছিল না, তাই আমায় করলে অপমান।
এখন প্রেমনদীতে ভাটা যে গো নেই যোবনের টান,
একদিন তোমার বুকের মাঝে ধরেছিলেম প্রাণ।
তারা গান শুনে বলল, কিছু আছেও তোমার স্টকে! ধন্যি তুমি।
.
১২.
ফ্ল্যাটের বেলটা বাজতেই অগ্নি গিয়ে দরজা খুলল।
বলল, কী সৌভাগ্য আমার।
অরা একটা ফলসা রঙা শাড়ি পরেছিল তাঁতের, গাঢ় বেগুনি ব্লাউজের সঙ্গে। হাতে চামড়ার হালকা বেগুনি ব্যাগ।
–তোমাকে ‘জ্যাকারাণ্ডা’ বলে ডাকতে ইচ্ছে করছে।
–যা খুশি বলে ডাকো। কিন্তু তার আগে একটা কোল্ড ড্রিঙ্কস দাও।
–চন্দন।
বলে, ডাকল অগ্নি।
চন্দন এলে বলল, মেমসাহেবকে গ্লাসে ম্যাঙ্গো-পান্না দে, বেশি করে বরফ দিয়ে।
–ম্যাঙ্গো-পান্না? সেটা আবার কী জিনিস?
–খাওনি কখনো? ভুটানে তৈরি হয়। খেয়ে দ্যাখো। আর তা না খেতে চাও তো ‘রিয়্যাল’–এর ফুট জুসও খেতে পারো। টোম্যাটো অরেঞ্জ আর গুয়াভা আছে।
–না, তোমার ম্যাঙ্গো পান্না খেয়েই একটু অ্যাডভেঞ্চার করি। রিয়্যাল-এর জুস তো খাই-ই।
–সঙ্গে একটু ভদকা বা জিন মিশিয়ে দিই?
–না। একদম না। রান্না করতে হবে না? নেশা টেশা হয়ে গেলে মুশকিল হবে। এত মানুষে খাবেন।
–আরে টেনশান কোরো না। আমার চন্দনও খারাপ রান্না করে না। তুমি শুধু একটু সুপারভাইজ করে ফিনিশিং টাচ দিয়ে দেবে, তাহলেই হবে। তোমার ড্রিঙ্কটা আমি নিজে বানিয়ে দিচ্ছি তার আগে কিচেনে যাও একবার, মাছগুলো ঠিক এনেছি কি না দেখে নাও।
চলো, বলে, অরা চন্দনের সঙ্গে কিচেনে গেল।
ফিরে এসে বলল, খুব ভালোই মাছ এনেছ। চন্দন তো ইলিশ মাছগুলো কেমন, গাদা পেটি আলাদা করে কেটেও ফেলেছে। বেশ মোটা মোটা পিস করেছে। আর চিতলের পেটিও বোধ হয় মাছওয়ালাই কেটে দিয়েছে।
–হ্যাঁ। গড়িয়াহাট বাজারের সনাতন।
–খুব ভালো কেটেছে। পাতলাও নয় আবার খুব মোটাও নয়। আর পেটিগুলো সত্যিই খুব বড়ো বড়ো। তবে আজকালকার ছেলেমেয়েরা মুঠা খেতেই ভালোবাসে পেটির চেয়ে।
–তাদের কথা ছাড়া। তারা তো কাঁটাঅলা মাছ খেতেই পারে না। খেলেও একটা কাঁটাঅলা মাছ খায়, যেমন পাবদা। নইলে রুই কী চিংড়ি অবশ্য খায়।
–সত্যি। বাঙালির ছেলেমেয়ে পুঁটি, পারশে, বাটা, খয়রা, ইলিশ মাছ খেতে চায় না এ অভাবনীয়। শুধু ইন্টারনেট মোবাইল-ই নয়, এদের খাদ্যাভ্যাসেও আমূল পরিবর্তন এসেছে। হঠাৎ দেশসুদু ছেলেমেয়ে সাহেব-মেম হয়ে গেল। বোনলেস ছাড়া মাছ নাকি খাওয়াই যায় না।
–এই বদলটা বড়ো হঠাৎ-ই হল। তাই না? গত দশবছরে। দশবছর নয়, আমি বলব পাঁচবছরে। নিজেদের ওদের প্রেক্ষিতে কেমন বুড়ো বুড়ো, আউট অফ প্লেস বলে মনে হয়। মনে হয় এবারে ছুটি হয়ে গেলেই ভালো।
অরা বলল।
–তা কেন হবে। উই মাস্ট মুভ উইথ দ্যা টাইম। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পারলেই আমরা বাতিল হয়ে যাব। চলতেই হবে।
–এই বয়সে এসে নিজেদের বদলানো বড়ো কষ্টকর।
–কষ্ট হয়তো হবে একটু। কিন্তু আমরা নিরুপায়। নিজেদের বদলাতে হবেই।
অগ্নি নিজে হাতে ম্যাঙ্গো পান্নার গ্লাস নিয়ে এল অরার জন্যে। তারপর সেলারের দিকে গিয়ে বলল, একটু জিন বা ভদকা মিশিয়ে দিই?
না, বললাম না। অরা বলল, আমার ওসব ভালো লাগে না।
–ভালো না লাগলে খেয়ো না।
চন্দনকে ডেকে বলল অগ্নি, ড্রাইভারকে ডাক চন্দন। চাইনিজ খাবারটা আনিয়ে রাখি। তোর কী খেতে ইচ্ছে?
চন্দন মুখ নামিয়ে বলল, আপনারা যা খাবেন আমিও তাই খাব।
-তা কেন? তোর কী ভালো লাগে বল না।
-বাড়িতে তো চাওমিয়েন, ফ্রাইড রাইস এসব আমরাই বানিয়ে খাই। সেই একদিন হাঁসের মাংস আনিয়েছিলেন, ভালো খেয়েছিলাম।
অগ্নি হেসে উঠল।
অরাও হাসল চন্দনের কথা বলার ধরনে।
অগ্নি বলল, বেশ তাই হবে। যা ড্রাইভারকে ডেকে নিয়ে আয়। কী কী আনবে কাগজে লিখে দেব। টাকা এখন দিতে হবে না। দোকানে আমার অ্যাকাউন্ট আছে।
চন্দন চলে গেলে অরা বলল, একা থাকো, বেশি লাই দিয়ো না, কোনদিন গলা কেটে সব নিয়ে চলে যাবে।
–আমার সর্বস্ব নেবে বলছ?
–হ্যাঁ।
–আমার সর্বস্ব তো এ বাড়িতে নেই।
–মানে?
–সে তো অন্য জায়গাতে আছে।
–সে কী? কোথায়?
অবাক হয়ে, গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, অরা।
–যোধপুর পোস্ট অফিসের রাস্তা দিয়ে ঢুকে, সেকেণ্ড রাইট তারপর সেকেণ্ড লেফট-এ গিয়ে সে বাড়ি।
কথা শুনে হেসে ফেলল অরা। অগ্নি নাগপুর থেকে অবসর নিয়ে আসার পর ভবানীপুরে ওর দিদির বাড়ি থেকে আসতে যোধপুর পার্কের ফ্ল্যাটের ডিরেকশন জানতে চেয়েছিল যখন তখন এইভাবেই ডিরেকশন দিয়েছিল অরা।
অগ্নির কথার জবাব না দিয়ে, মুখ নীচু করে শরবত খেতে লাগল সে। তার মুখে এক নিরক্ত খুশির উচ্ছ্বাস আভাসিত হল।
অগ্নি বলল, নরেশ আর ব্রতীনকেও বলেছি। তুমি রাগ করবে না তো? ওরা অনেক-ই খাওয়ায় আমাকে। আজ এমনিতেই ব্রতীনের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল। পল কক্স-এর একটা ছবির সিডি জোগাড় করেছে ও। “দ্যা আইল্যাণ্ড”। একটি শ্রীলঙ্কান মেয়ে নায়িকা। ওই ছবিতে ঋতু গুহর গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত “মাঝে মাঝে তব দেখা পাই বারেবারে কেন পাই না” গানটিকে থিম মিউজিক হিসেবে ব্যবহার করেছেন ডিরেক্টর।
–ইংরেজি ছবিতে বাংলা গান?
–অপর্ণা সেনও তার ৩৬, চৌরঙ্গি লেন-এ ঋতু গুহ-র গাওয়া “এ কী লাবণ্য পূর্ণ। প্রাণে” গানটির কিছুটা একটা পার্টি সিন-এ ব্যবহার করেছিলেন, মনে আছে?
–আছে।
–পল কক্স-এর ছবিটি দেখার আগ্রহর সেটাও একটা কারণ।
তারপর-ই অগ্নি বলল, ওরা কিন্তু হুইস্কি-টুইস্কি খাবে। তোমার আপত্তি নেই তো?
হুইস্কি খাওয়ার মধ্যে তো দোষ নেই। তুমি আর আশিস তো কতই খেতে। হুইস্কি কারওকে খেলেই বিপদ। তাছাড়া, তুমি অপালার স্বামী উজ্জ্বল ঘোষ সাহেবকেও বলেছ। তিনি তো রোজ-ই খান! হুইস্কি না খেলে খাবারের স্বাদ-ই পাবেন না।
বড়ো বড়ো উকিল-ব্যারিস্টারদের মধ্যে অধিকাংশরাই খান। বাবার মুখে শুনেছিলাম, শচীন চৌধুরী সাহেব কনফারেন্সের সময়ে নিজে তো খেতেন-ই সব মক্কেলদেরও খাওয়াতেন। রাত নটা বেজে গেলেই একজন বেয়ারা স্কচ, হুইস্কি আর সোডার গ্লাসে ভরা ট্রে নিয়ে সবাইকে দেখাত আর অন্যজন ‘ফাইভ-ফাইভ-ফাইভ’ আর ‘স্টেট এক্সপ্রেস’ সিগারেটের প্যাকেট আর দেশলাই ট্রেতে করে নিয়ে ঘুরত।
–আচ্ছা তখন তো স্মোকিং আর প্যাসিভ স্মোকিং নিয়ে এত হইচই হত না। তাঁরা তো নিজেদের জীবন পুরোপুরি উপভোগ করে গেছেন।
–করেছেন-ই তো। শচীন চৌধুরী সাহেব শিকারও করতেন। পরিমিতি’ বোধ ছিল সেসব মানুষদের। তা ছাড়া ব্যাপারটা কী জান এসব টাবু পশ্চিমি দেশে বা জাপান সিঙ্গাপুরেই মানায়। গড়িয়াহাটের মোড়ে দশ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকলে একজন মানুষের যতখানি ক্ষতি হয় ততখানি চার প্যাকেট সিগারেট বা চার পেগ হুইস্কি খেলেও হয় না। শহরের পরিবেশ আগে দূষণমুক্ত করতে হবে, নইলে এসব বাড়াবাড়ি আমাদের দেশে মানায় না। সরকারের যা করণীয় তা না করে এমন করে আমাদের ব্যক্তিস্বাধীনতায় হাত দেওয়াটা সমর্থনযোগ্য নয়।
-তা অবশ্য ঠিক-ই বলেছ।
তারপর ড্রাইভার ওপরে এলে অগ্নি ওর নাম লেখা স্নিপ-প্যাড-এ খাবারের সব আইটেম লিখে দিল।
–বেশি আনিয়ো না, নষ্ট হবে।
–না। চন্দন আর আমাদের দুজনের মতোই অর্ডার দিলাম। আর চার প্লেট ফ্রায়েড প্রন লিখে দিলাম। রেখে দেবে। সকলে এলে মাইক্রো-ওভেন-এ গরম করে দেবে চন্দন হুইস্কির সঙ্গে খাওয়ার জন্যে।
ড্রাইভারকে তারপরে বলল, এগুলো এনে দিয়ে তুমি তোমার বাবাতে খেয়ে নিয়ে তৃষা দিদির অফিসে চলে যেয়ো।
ড্রাইভার চলে গেলে বলল, রাতে সবসুদ্ধ ক-জন হবে তাহলে? আমরা দু-জন, রুরু আর চুমুকি, অপালা আর ঘোষ সাহেব, নরেশ আর ব্রতীন আর চন্দন? ক-জন হল?
-তৃষাকে বাদ দিলে।
–ও হ্যাঁ।
–দশজন হল সব মিলে।
তারপর-ই বলল, দেখেছ। বিস্পতিকে ধরা হয়নি। তার খাবার তো পাঠাতে হবে ড্রাইভারকে দিয়ে বাড়িতে।
–খাওয়ার কম পড়বে না তো?
–না, না। এত এত কেজি করে মাছ এনেছ। সবাই কি রাক্ষস?
–পোলাট হবে? না ভাত?
-–ভাত-ই করতে বলো চন্দনকে। চিতলের পেটি আর ভাপা ইলিশ পোলাও দিয়ে ঠিক জমবে না। তা ছাড়া, হুইস্কি যারা খাবে তারা খাবার বেশি খাবেও না।
-তুমিই জানো। শুনেছিলাম হুইস্কি খেলে খিদে বেড়ে যায়।
–অনেকের হয়তো বাড়ে। সকলের নয়।
–খাবারটা এলে, খেয়ে নিয়েই রান্না শুরু করতে হবে। নইলে সময়মতো সব করে ওঠা হবে না। তোমার চাইনিজ রেস্তরাঁ কত দূরে?
–আরে কাছেই। আধ ঘণ্টার মধ্যে চলে আসবে। আজকাল যোধপুর পার্ক তো লানডান এর অক্সফোর্ড স্ট্রিট হয়ে গেছে।
বলেই বলল, তোমার চেঞ্জ আনোনি? সন্ধেবেলা এই শাড়ি পরেই থাকবে? স্নান করবে না?
-এনেছি তো। কিন্তু ওহহ! চেঞ্জ তো ছোটো স্যুটকেসে গাড়িতেই আছে। চন্দনকে বলে রাখো ড্রাইভার ফিরলেই ওটাকে ওপরে নিয়ে আসবে। নইলে ড্রাইভার সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। হয়তো বুঝতে না পেরে।
-এখুনি বলে রাখছি।
–আমি দুটো ভদকা খাব লেবু আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে–উইথ প্লেন্টি অফ আইস। তোমার আপত্তি আছে?
অগ্নি বলল।
–আমার কি কোনোদিনও আপত্তি ছিল? আশিস আর তুমি তো এসব দেখা হলেই খেতে। আর অ্যাকসিডেন্টটাও তো হল বেশি খেয়ে গাড়ি চালাবার জন্যেই।
তারপর একটু চুপ করে থেকে বলল, এখন বয়স হচ্ছে। এসব কমাও এবারে।
-আরে এই বয়সেই তো একটু পিপ-আপ-এর দরকার। আমার বউ নেই, সংসার নেই, ছেলেমেয়ে নেই, এমনকী একটা কুকুর পর্যন্ত নেই। এই তো একমাত্র শখ। উজ্জীবনী।
–তোমার নিজের সংসার করোনি ঠিকই কিন্তু অন্যের বোঝা তো শখ করে সব নিজের কাঁধেই বয়ে বেড়াচ্ছ প্রতিদানে কিছুমাত্র না পেয়েই।
–শখ করে নিয়েছি বা দৈবাদেশে নিয়েছি, কে বলতে পারে! তা ছাড়া, কী পেয়েছি আর কী পাইনি তা আমিই জানি। আমাদের ছেলেবেলাতে পঙ্কজ মল্লিকের একটা গান খুব জনপ্রিয় হয়েছিল না? একটা রবীন্দ্রসংগীত?
-কোন গান?
–”কী পাইনি তার হিসাব মিলাতে মন মোর নহে রাজি।”
–হুঁ।
তুমিই তো আমার ছেলেমেয়েদের বাবার মতো।
অরা বলল, মুখ নীচু করে।
–‘বাবার মতো’ আর বাবাতে তফাত আছে।
অগ্নি বলল।
অরা চুপ করে রইল। ভাবছিল, এই বাক্যটিই তার ছেলেমেয়েদের অরা নিজে বহুবার বলেছে। আশ্চর্য! আজ অগ্নিও সে কথা বলল। তবে অগ্নির গলাতে দুঃখের রেশ ছিল। অগ্নির সেই দুঃখ অরার বুকে নিরুপায়তার ‘অবলিগাটো হয়ে বাজল যেন।
অগ্নি তারপরে বলল, তুমি এবং তোমার ছেলেমেয়েরা কেউই যে, আসলে আমার কেউই নয় তা আমার মতো আর কে জানে! তবে এই আমার আনন্দ। নিজের সংসারের জন্যে তো সবাই-ইসবকিছুই করে। পরের সংসারের জন্যে করাটার মধ্যে একটা অন্য আনন্দ আছে। তোমাদের জীবনে আশিস-এর অভাব কিছুটা যে, মোচন করতে পেরেছি এই আমার মস্ত আনন্দ। বন্ধু আমার অনেক-ই ছিল কিন্তু আশিসের মতো বন্ধু কেউই ছিল না।
-আমার এখানকার দুই বন্ধু নরেশ আর ব্রতীনের সঙ্গে আলাপ তো হয়েছে। তাদের বেশ কয়েকবার নেমন্তন্নও খাইয়েছ কিন্তু তেমন ঘনিষ্ঠভাবে জানোনি ওদের। তোমাকে নিয়ে ওদের ঔৎসুক্যেরও শেষ নেই। আমাদের সম্পর্ক নিয়েও ওদের ঔৎসুক্য কম নয়। আজ ওদের সেই ঔৎসুক্যের আরও একটু নিরসন হবে।
–ওঁরা যদি হতাশ হন। আমাকে আরও কাছ থেকে দেখে?
-তা যে হবে না, তা তুমি ভালো করেই জানো। ওরা দুজনেই গান-পাগল। তাই তো তোমাকে ওরা এত ভালোবাসে। আজ তোমার গান শুনে ওদের খুবই ভালো লাগবে। তোমার নিজের বাড়িতে তুমি কিন্তু ওদের একদিনও গান শোনাওনি। তা ছাড়া, তোমাকে খারাপ লাগবে এমন পুরুষ কি এই ধরাধামে আছে?
–রুরু তোমাকে সেদিন কী বলেছিল?
প্রসঙ্গান্তরে গিয়ে অরা বলল। অগ্নির মুখে অরার নিজের প্রশংসা একঘেয়ে লাগছিল।
–কোনদিন?
–তোমার কাছে যেদিন পাঠিয়েছিলাম আমি। তোমাকে কনফেশানাল করতে।
–ও হ্যাঁ। এসেছিল তা রুরু কিন্তু কী যে, বলল ঠিক বুঝতে পারলাম না।
গ্লাসটা টেবিল-এর ওপরে নামিয়ে রেখে অরা বলল, সাংঘাতিক কান্ড হতে পারত সেদিন।
-কীরকম?
–আমার স্কুলের পিকনিকে যাওয়ার কথা ছিল। তৃষা মুম্বাই গেছিল অফিসের কাজে, সেখান থেকে হর্ষদের কাছে যাওয়ার কথা।
-তারপর?
-তারপর আর কী? রুরু বিস্পতিকে নিজে টিকিট কেটে ‘প্রিয়া’ সিনেমাতে একটা হিন্দি ছবি দেখতে পাঠিয়ে ফ্ল্যাট ভেতর থেকে বন্ধ করে চুমকিকে নিয়ে বেডরুমে ঢুকেছিল। এদিকে স্কুলের একজন অল্পবয়েসি টিচার হঠাৎ হার্ট অ্যাটাকে স্কুলেই মারা যাওয়াতে পিকনিক ক্যানসেল হয়ে গেল। আমি যে-অসময়ে ফিরে আসব তা তো জানত না ও।
-বলো কী? দারুণ ইন্টারেষ্টিং ব্যাপার।
–ইন্টারেস্টিং বলছ তুমি? কী বিপদ যে, হতে পারত।
রাগের গলাতে বলল অরা।–তারপর কী হল বলো? অরা হেসে বলল, আমি যখন চুমকিকে বললাম, তোরা বেডরুমে কী করছিলি? ও প্রায়। কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, রুরু বহুদিন হল আমাকে দেখবে বলে ঘ্যান ঘ্যান করছিল।
-দেখবে মানে? ওকে তো প্রায় রোজ-ই দেখছে।
–না, দেখা মানে ওর Nakedness দেখা।
-বলো কী?
হ্যাঁ। বলল, রুরু আমাকে আঙ্গাপাঙ্গা দেখতে চেয়েছিল।
–আঙ্গাপাঙ্গা মানে? কোন দেশি শব্দ সেটা?
–শব্দটা বাংলাই। চুমকির মা নাকি ওর ছোটোবেলায় চান করাবার আগে বলতেন, আঙ্গাপাঙ্গা হও। তাই আঙ্গাপাঙ্গা।
–মানে ন্যাংটো হওয়া বলছ?
অরা মুখ টিপে হেসে বলল, ওই।
–শুধু দেখতেই চেয়েছিল?
–ওরা দুজনেই তাই তো বলল।
অগ্নি খুব জোরে হেসে উঠে বলল, হাউ সুইট অফ দেম। ব্যাপারটা দারুণ রোমান্টিকও। ভাবা যায়? এ তো দেবশিশু-দেবকন্যার প্লেটোনিক ব্যাপার।
–কী বলছ তুমি। আগুন নিয়ে খেলতে গেছিল।
–হাত তো আর পোড়ায়নি। কী দারুণ স্বর্গীয় একটা ব্যাপার বলো তো! আমাদের সময়ে এমন রোমান্টিসিজম-এর কথা আমরা ভাবতে পর্যন্ত পারতাম না। ওরা এক অন্য প্রজন্মের ছেলেমেয়ে। ওদের দুজনের প্রতিই আমার শ্রদ্ধা বেড়ে গেল। ওরা আগুনের মধ্যে বাস করেও পোড়ে না। আমার হাজারিবাগের গুরু একটি শের আওড়াতেন।
–শেরটা কী?
আগ চালোতরফ দহকতি হ্যায়,
জিনা ইস বিচ কিতনা মুশকিল হ্যায়
ফিরভি জাঁবাজ খে লেঁতে হ্যায়
উনকো আহসান হরেক মঞ্জিল হ্যায়।
মানেটা ইংরেজিতেই বলতেন উনি “The valiant takes delight in danger and face fires and floods with joy. Indeed no difficulty seems too great for them.”
বলেই বলল, ওদের সংযমটার কথাও ভাব একবার। শরীরকে ওরা মন্দিরের মতো দেখতে যে, পারে এটা একটা কত বড়োব্যাপার একবার ভাবো তো! গ্রে-এ-এ-ট। সকলকে তো এ ঘটনার কথা বলা যাবে না। সব মানুষের মন সমান উদার নয়–বেশিরভাগেরই অনুদার–। তবে এই “আঙ্গাপাঙ্গা’ শব্দটা চালু করে দেব আমি। শব্দটা উচ্চারণ করতেই কেমন রোমাঞ্চ বোধ করছি।
-তুমি অদ্ভুত! চিন্তাতে আমার রাতের ঘুম চলে গেছে। সেদিন তো দশ মিলিগ্রাম ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমিয়েছিলাম আমি। কবে যে, কী বিপদ ঘটে যাবে।
–কোনো বিপদ-ই ঘটবে না। ওরা আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ম্যাচিয়োরড। ওদের ‘আই-কিউ’ যেমন, আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ওদের মানসিকতাও অন্যরকম। ওরাই টেনিস-এর উলিসিসের মতো বলতে পারে, I will drink life to the lees” সত্যিই গ্রেট ব্যাপার ঘটিয়েছে রুরু আর চুমকি একটা। আমার কাছে এসে কী আঙ্গাপাঙ্গা করছিল চোরের মতো মুখ করে, এখন বুঝছি তোমার কাছে তাড়া খেয়ে–আমি কিছু বুঝতে তো পারিইনি, বোঝার চেষ্টাও করিনি।
অরা বলল যাই এবার কিচেনে। আর গল্প করলে চলবে না। ভাতটা শুধু সবাই আসার পরে করব। ভাত চন্দন-ই করে নিতে পারবে। গোবিন্দভোগ চাল আছে তো বাড়িতে?
–গোবিন্দভোগ নেই, বাসমতি আছে।
-তাহলেই হবে। তবে বাসমতির পোলাওই ভালো হয়। ইলিশ মাছ আর চিতল মাছ বাসমতি দিয়ে খেতে কি ভালো লাগবে? তার চেয়ে এমনি সেদ্ধ চাল দিয়েই ভাত করুক।
–তুমি যা বলবে।
.
১৩.
দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পরে যখন অরা কিচেনে গেল তখন অগ্নিও গেল তার সঙ্গে।
–তুমি কী করতে এলে?
–তোমাকে দেখতে।
–পাগলামি না করে বসার ঘরে গিয়ে বোসো।
–এখানেই থাকি। তোমাকে তো দেখতেই পাই না আজকাল। তুমি রান্না করো, আমি মোড়া পেতে বসে গল্প করি।
–ফোনে তো কথা প্রায় রোজ-ই হয়।
–তা হয়। দেখা তো হয় না।
–যতো বুড়ো হচ্ছ তত পাগল হচ্ছ।
–ভাগ্যিস বুড়ো হয়েছি। রুরুর মতো ছেলেমানুষ থাকলে তো আঙ্গাপাঙ্গা দেখার বায়না ধরতাম।
অরা হেসে ফেলে বলল, চন্দন এখুনি এসে ঢুকবে। তুমি যাও তো। গিয়ে বোসো বসার ঘরে।
বসার ঘরে গিয়ে রাশিদ খাঁর একটি সিডি চালিয়ে দিয়ে ইজিচেয়ারে বসল অগ্নি। ভলিউমটা একটু বাড়িয়ে দিল যাতে রান্না করতে করতে কিচেন থেকেও শুনতে পারে অরা। গান শুনতে শুনতে চোখ জুড়ে এল অগ্নির। সকালে ব্ৰতীনের সঙ্গে বেশি টেনিস খেলার ক্লান্তিতে এবং ভালো লাগায়ও, অরা যে, তার-ই কিচেনে রান্না করছে এই ভাবনাটাই তাকে বড়ো সুখী করে তুলেছিল।
সিডি-টা শেষ হয়ে যাওয়াতে বন্ধ হয়ে গেছিল। অগ্নি ইজিচেয়ারে বসেই ঘুমিয়ে পড়েছিল। ষাট পেরোলে, নিজের অজানতে কিছু ক্লান্তি এসে জমা হয় মস্তিষ্কে। মানসিকতাতে সে খুব-ই তরুণ, কিন্তু শরীরটা এখন মাঝে মাঝে মনের সঙ্গে তাল মেলাতে পারে না। যদিও ষাটে এখনও পৌঁছোয়নি।
চোখ খুলে দেখলেন, অরা বসার ঘরে সোফাতে গা এলিয়ে বসে আছে।
–বাজল ক-টা?
চোখ খুলেই বলল, অগ্নি।
–চারটে।
–তাই? দেখেছ কেমন বুড়ো হয়ে যাচ্ছি। দুপুরে খাওয়ার পরে ঘণ্টা দেড়েক শোয়া এখন অভ্যেস হয়ে গেছে। আমার ডাক্তার তো বলেছেন, খাওয়ার পরে ফোনেও কথা না বলতে। ড. বিধান রায় কিন্তু বলতেন, দুপুরে খাওয়ার পরে কিছুক্ষণ ঘুমোনো খুবই ভালো, বিশেষ করে একটু বয়স হলে।
–ভালোই তো। রিটায়ার যখন করেছ তখন রিটায়ার্ড লাইফ-ই লিড করা উচিত। লাফিয়ে বেড়াবার দরকার-ই বা কী?
–তা ঠিক। আমি এবারে স্নানে যাই। তাড়াহুড়ো আমি করতেও পারি না আজকাল। কোন বাথরুমে যাব? গেস্টরুমের?
অরা বলল।
–কেন? তুমি আমার বাথরুমেই যাও। তোমার স্যুটকেসটা নিয়ে যাও। ঘরের দরজা বন্ধ করে একটু শুয়েও নিতে পারো। তারপর স্নান করে চেঞ্জ করো। আমার ঘরের ড্রেসিং টেবিলের আয়নাটা বড়ো। তোমার সুবিধে হবে। দাঁড়াও, এ সি-টা চালিয়ে দিই নইলে স্নান করে উঠে তোমার গরম লাগবে।
তারপর বলল, একদিন তোমার স্নান দেখার বড়ো ইচ্ছে ছিল। বিশেষ করে বয়স যখন কম ছিল।
-ইচ্ছেকে দমন করাটাই বড়ো মানুষের লক্ষণ। তোমার মনুষ্যত্বের মাপ তো মস্তবড়ো। এমন সস্তা ইচ্ছে তোমাকে মানায় না।
-জানি! “মনকে মারো, ভাবনাগুলি মাড়িয়ো না, পাবে না, যা, না পাওয়াটাই সভ্যতা।”
–কার কবিতা এটি?
–আমার।
–আমি স্নানে চললাম।
বলে, অরা চলে গেল।
অরার মুখে জয়ীর অভিব্যক্তি নয়, অগ্নির মনে হল, এক দারুণ সহমর্মিতার ভাব মাখামাখি হয়ে গেল বৈজয়ন্তীর কথার সঙ্গে। সম্ভবত জীবনে অরা কারওকেই হারাতে চায়নি। সহজ জয়ে ও কখনোই বিশ্বাস করেনি। সকলের সঙ্গে হাতে হাত ধরে বাঁচতে চেয়েছে সে চিরটাকাল। তাই তো অরাকে এত ভালোবাসে অগ্নি।
অগ্নি ভাবছিল, বিস্পতিও অগ্নিকে ‘আগুনবাবু’ বলে ডাকে। বিস্পতিও খুব ভালোবাসে অগ্নিকে তার মতন করে, বৈজয়ন্তীও বাসত, অরাও বাসে–প্রত্যেকেই আলাদা আলাদা রকম। সব ভালোবাসার রকম-ই বোধ হয় আলাদা আলাদা।
-তাই? তুমি আজকাল কবিতাও লিখছ নাকি?
–আজকাল কেন? কবিতা তো লিখি সেই ছেলেবেলা থেকেই। এমন কোনো শিক্ষিত বাঙালি আছে কি যে, কৈশোরে এবং প্রথমজীবনে কবিতা লেখেনি? আমার সতেরো বছর বয়সে একটি কবিতার বইও বেরিয়েছিল। তার প্রচ্ছদও আমিই এঁকেছিলাম। তার নাম ‘জলজ।
–কে ছিল? প্রেরণা?
–সে ছিল, পাড়ার-ই একটি মেয়ে। খুব উজ্জ্বল, পুঁইডাঁটার মতো কালচে-সবজে সতেজ ছিপছিপে।
–নাম কী ছিল?
–বৈজয়ন্তী।
–এখনও যোগাযোগ আছে?
–না। সে তো তোমার কাছে হেরে গেছে। তার নাম এখন পরাজিতা। তবে মাস ছয়েক আগে হঠাৎ দেখা হয়েছিল গড়িয়াহাট বাজারে। প্রচন্ড মোটা হয়েছে, খুঁড়িয়ে চলে, পানবাহার’ খায়, সঙ্গে স্কুলে-পড়া নাতি। বলল, আগুনদাদা, এসো নাগো একবার আমরা এগডালিয়াতে থাকি।
–ওনার স্বামী কী করেন?
–রাইটার্স-এর কেরানি ছিল। রিটায়ার করেছে। এখন সিপিএম করে। হোল টাইমার।
.
১৪.
সন্ধে হয়ে গেছে ঘণ্টাখানেক হল। অরা একটি কচিকলাপাতা রঙা সিল্কের শাড়ি পরেছিল। গলাতে ও কানে সবুজ পান্নার হার ও দুল। একটা বটল-গ্রিন রঙের ব্লাউজ। মুখে হালকা প্রসাধন। অগ্নি ওকে ‘ফিরদৌস’ আতর দিয়েছিল মাখতে। বগলতলিতে, ঘাড়ে, কানের লতিতে ও স্তনসন্ধিতে আতর মেখেছে অরা।
সাড়ে সাতটা নাগাদ অতিথিরা সকলেই এসে গেলেন। ব্রতীন সব সময়ে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে আর নরেশ ফেডেড জিনস ও কলারঅলা গেঞ্জি। রুরু এসেছে চুমকির সঙ্গে। দু-জনেই জিনস পরেছে। রুরু কলারঅলা গেঞ্জি আর চুমকি একটি হালকা গোলাপি টপ-কটন-এর। অপালা কাঞ্জিভরম সিল্কের একটি শাড়ি পরে এসেছে। ঘোষ সাহেব আদ্দির গিলে-করা পাঞ্জাবি ও ধুতি, পায়ে বিদ্যাসাগরি চটি।
রুরু আর চুমকি একটু অপরাধী অপরাধী মুখ করে বসেছিল। অগ্নি তাদের স্বাভাবিক করার জন্যে বলল, রুরু, তুই একটা ব্যাণ্ডের গান দিয়ে আজ সন্ধের ম্যায়ফিল শুরু কর।
–আমি?
–হ্যাঁ তুই-ই।
–তোর পরে ঘোষ সাহেব একটি গান গাইবেন।
–অপালা হেসে বলল, ঘোষ সাহেব? গান গাইবেন?
–হ্যাঁ। ঘোষ সাহেব-ই।
অগ্নি বলল।
ঘোষ সাহেব, মানে, উজ্জ্বল ঘোষ কিন্তু সপ্রতিভভাবে বললেন, গেয়ে দেব। গান গাওয়া আর কী কঠিন কাজ! গান কি তোমাদের অগ্নিদাদাই শুধু গাইতে পারেন?
ঘোষ সাহেবের এই কথাতে ঘরের সকলেই হেসে উঠলেন। ঘোষ সাহেব নিজেও সেই হাসিতে যোগ দিলেন।
অপালার যেন টেনশান হতে শুরু করল, ঘোষ সাহেবের এই ননশালান্ট অ্যাটিচ্যুড দেখে।
রুরু বলল, এখুনি মনে পড়ছে না কোনো জুতসই গান। অন্য সকলের গান শুনতে শুনতে মনে পড়ে যাবে। আমি পরে গাইব।
–তাহলে অপালাই একটা গান শোনাও।
তারপর-ই বলল, ঘোষ সাহেবের হাতের গ্লাসের দিকে চেয়ে, কী ঘোষ সাহেব? আপনি তো শুধু জল-ই খাচ্ছেন? এত কম হুইস্কি? কীরে ব্রতীন? তোর ওপরে বার-এর ভার দিলাম আর আমার অতিথিদের জল খাওয়াচ্ছিস?
ঘোষ সাহেব বললেন, না, না, উনি তো বড়োই দিয়েছিলেন, আমিই কমিয়ে নিয়েছি। অনেকগুলোখাইত, তাই ছোটো ছোটো করে খাই।
–অনেকগুলো মানে? ক-টা খান আপনি?
তারপরই অগ্নি বলল, যারা গুনে গুনে হুইস্কি খায় তারা মানুষ খুন করতে পারে, সুদের কারবার করতে পারে।
অগ্নির এই কথাতে সকলেই হেসে উঠলেন।
অগ্নি এবারে বলল, অপালা, তাহলে শুরু হোক একটা অতুলপ্রসাদের গান। তোমাকে বিয়ার দেয়নি বুঝি ব্রতীন? ব্রতীন মিসেস ঘোষকে এক গ্লাস বিয়ার দে। শ্যাণ্ডি নয় কিন্তু প্রপার বিয়ার। উনি অরার মতো বেরসিকা নন।
–বিয়ার খেলেই রসিকা আর না খেলেই বেরসিকা এর কোনো মানে নেই।
অপালা বললেন।
–এবারে গানটা।
ব্রতীন বিয়ার এনে দিলে, বিয়ারের গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে শুরু করল অপালা।
অতুলপ্রসাদের একটি ক্কচিৎ-শ্রুত গান গাইল অপালা। “বিফল সুখ আশে জীবন কি যাবে?”
গান শেষ হলে সকলেই বাঃ। বাঃ করে উঠল।
নরেশ বলল, এবারে ঘোষ সাহেবের টার্ন।
ঘোষ সাহেব বললেন, সে ভয়ে কম্পিত নয় আমার হৃদয়, আমি কি ডরাই সখি ভিখারি রাঘবে?”
তারপর বললেন কিন্তু আমি নিদেনপক্ষে চারটি না খেলে গাইতে পারি না। বন্দুকে গুলি পুরলে না ট্রিগার টানলে গুলি বেরুবে। আমি পরে।
ব্রতীন বলল, অগ্নি, তুই-ই তাহলে একটা গেয়ে দে।
অগ্নি বলল, একটা অতুলপ্রসাদের গান গাই? ফর আ চেঞ্জ। সন্তোষ সেনগুপ্ত, মানে সন্তোষদা খালি গলাতে এই গানটি রেকর্ড করেছিলেন। অনেকদিন আগে শোনা, ভুল-ভাল হতে পারে। তোমরা কেউ গানটি জানলে ক্ষমা-ঘেন্না করে শুনো।
বলেই, ওর হুইস্কির গ্লাসে একটি চুমুক দিয়ে অগ্নি গান ধরল:
আমি বাঁধিনু তোমার তীরে তরণী আমার
একাকী বাহিতে তারে পারি না যে আর… ইত্যাদি।
গান শেষ হলে ঘর বেশ কিছুক্ষণের নিস্তব্ধতাতে ভরে রইল। শ্রোতাদের প্রত্যেকের মুখেই মুগ্ধতা।
এমন সময় ডোরবেলটা বাজল। অগ্নির বন্ধু নরেশ মিত্র গিয়ে দরজা খুলল। তৃষা এল। মনে হল, বাড়ি গিয়ে চেঞ্জ করে এসেছে। একটা সি-গ্রিন সালোয়ার কামিজ পরে এসেছে ও। হাতে মোবাইল ফোন। সবুজ প্লাস্টিকের বালা, সবুজ রঙা টিপ, সবুজ রঙা চটি।
অরা বললেন, মোবাইলটাকে অফ করে দাও।
–দিচ্ছি মা।
অরার এই কথাতে অন্য যাদের কাছে মোবাইল ছিল তাঁরাও সকলেই অফ করে দিলেন।
অপালা বলল, অরা, এবারে তুই একটা গান শোনা। কতদিন হয়ে গেছে তোর গান শুনি না।
অরা বলল, কতদিন গানটান গাই না। অভ্যেস-ই চলে গেছে।
নরেশ বলল, গান গাওয়া, সাইকেল চড়া আর সাঁতার কাটা একবার শিখলে কেউই আর ভোলে না।
ব্রতীন বলল, আমার ঠাকুমা বলতেন, লজ্জা নারীর ভূষণ, কিন্তু গানের বেলা নয়।
অগ্নি বলল, গাও গাও, একটা গান গাও।
অরা একটু গলা খাঁকরে নিয়ে ধরে দিল একটি রবীন্দ্রসংগীত—
ষাটে বসে আছি আনমনা, যেতেছে বহিয়া, সুসময়আমি সে হাওয়াতে তরী ভাসাব না, যাহা তোমা পানে নাহি বয়।
ব্রতীন বলল, আহা। কী ভাব আপনার গলাতে।
ঘোষ সাহেব বললেন, “ভাব ভাব কদমের ফুল।”
ব্রতীন বলল, এ নামে রাজলক্ষ্মী দেবীর একটি কবিতার সংকলন আছে। দারুণ সুন্দর সব কবিতা।
–রাজলক্ষ্মী দেবীর কবিতা তো বিশেষ দেখতে পাই না। তিনি কোথায় থাকেন? ওঁর কবিতা রমাপদ চৌধুরী আনন্দবাজারের বিশেষ সংখ্যাগুলিতে নিয়মিত ছাপতেন।
–উনি একজন আর্মি অফিসারের স্ত্রী পুণেতে থাকতেন। সম্ভবত সেখানেই সেটল করেছেন।
–ওঁর কবিতা একটা শোনা ব্ৰতীন। আগে বললে বইটা নিয়ে আসতাম। আমার মুখস্থ থাকে না। তাহলে নরেশ তোর তো মুখস্থ থাকে, আবৃত্তিও ভালোই করিস, তোর প্রিয় কোনো কবির একটি কবিতা শোনা। শক্তি চট্টোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ অথবা অমিতাভ দাশগুপ্তর।
–দাঁড়া। গানটান হোক আগে তারপর শোনানো যাবে। কলরোল স্তিমিত হয়ে এল।
ইতিমধ্যে ঘোষ সাহেব কালি-পটকা ফাটাবার-ই মতো হঠাৎ করে গান ধরলেন, গেলাসটা সাইড টেবিল-এ ‘টাক’ শব্দ করে নামিয়ে রেখে।
দুটো ঘুঘু পাখি দেখিয়ে আঁখি
জাল ফেলেছে পদ্মার জলে।
দুটো ছাগল এসে হেসে হেসে
খাচ্ছে চুমু বাঘের গালে।
দু-বার রিপিট করলেন গানটা।
সকলেই গান শুনে হাসতে হাসতে হইহই করে হাততালি দিয়ে উঠলেন।
তারপর অপালা, নরেশ এবং ব্রতীনও একসঙ্গে বলে উঠলেন অগ্নিকে, এবারে অগ্নির। একটা টপ্পা শোনা যাক।
চুমকি, রুরু এবং তৃষাও তাল মেলাল সেই অনুরোধে।
সকলেই অনেক কথা বলছেন ও বলছে। অরাই শুধু চুপচাপ। অরা চোখ দিয়ে কথা বলে। তবে সন্ধেটা যে, উপভোগ করছে সেও তা তার চোখমুখ-ই বলে দিচ্ছে। ও যে, ওর চেহারাতে, কথাবার্তায়, মানসিকতাতে সকলের চেয়েই আলাদা, এ কথা কারওকে বলে দিতে হয় না।
–গাইতে কি হবেই?
অগ্নি বলল।
তারপর বলল, নিন্দুকে বলতে পারে যে, নিজের বাড়িতে নিমন্ত্রণ খাইয়ে গাজোয়ারি করে গান শোনাচ্ছে।
–কেউই যে, তা বলবে না এ-কথা আপনি ভালো করেই জানেন।
অপালা বলল।
অগ্নি একটু চুপ করে থেকে বলল, গাইছি একটি গান। তবে এটি নিধুবাবুর নয়।
–তবে কার?
–শ্রীধর কথকের।
নরেশ বলল, নে শুরু কর।
অগ্নি ধরল, “যে যাতনা যতনে, মনে মনে আমার মন-ই জানে।”
এককলি গেয়েই গান থামিয়ে বলল, ‘যতন’ শব্দটির মানে, এখানে ভালোবাসা। বুঝেছ?
ব্রতীন বলল, বুঝলাম। এবারে গাও।
যে যাতনা, যতনে, আমার মনে মনে মন-ই জানে।
পাছে লোকে হাসে শুনে আমি লাজে প্রকাশ করিনে।
প্রথম মিলনাবধি, আমি যেন কত অপরাধী,
সাধি প্রাণপণে,তবু তো সে নাহি তোষে,
আমায় আরও দোষে অকারণে,
যে যাতনা যতনে…
সকলেই অনেকক্ষণ নীরব থেকে গানটা যে, তাদের প্রাণে বেজেছে তাই বোঝালেন।
চন্দন বরফের বাকেটে করে ফ্রিজ থেকে বরফ এনে ফুরিয়ে যাওয়া বাকেটটা নিয়ে যেতে এসেছিল।
অগ্নি বলল, ওরে, চন্দনবাবু বিস্পতিদিদির খাবারটা হটকেস-এ করে দিয়ে দিতে ভুলিস না যেন, অরা মায়েরা যখন বাড়ি যাবেন।
–না বাবু। ভুলব না।
ড্রাইভারকেও ওপরে ডেকে খাইয়ে দিস। ও তো টালিগঞ্জেই গাড়ি রেখে চাবি দিয়ে ওখান থেকেই বাড়ি চলে যাবে।
–হ্যাঁ বাবু।
ঘোষ সাহেব বললেন, ও তো আগেই চলে যেতে পারে। ওঁরা তো আমাদের সঙ্গেও ফিরতে পারেন। আমার তো কালিস গাড়ি। অনেক জায়গা।
–এত তাড়াতাড়ি তো ওর খিদে পাবে না। তা ছাড়া, আমাদের খাওয়া না হলে কি খাবে ও? চন্দনবাবুই দেবেন না খেতে। প্রোটোকল-এর ব্যাপার আছে না!
হাসলেন ঘোষ সাহেব। বললেন, যা বলেন।
অগ্নি বলল, ওর খাওয়া হয়ে গেলে ও যেতেই পারে।
.
১৫.
আজ শনিবার। অরার স্কুল ছুটি।
তৃষা আর অরা বসার ঘরে বসেছিলেন।
অরা বললেন, তুই কি কোথাও বেরুবি?
–কোথাও না। কী যে ছাতার চাকরি। কুকুরির মতো খাটায় মা। শনিবার রবিবারেও তো রেহাই নেই। আর যে উইকএণ্ডে কাজ থাকে না, তখন এত ক্লান্ত লাগে যে, মনে হয় পড়ে পড়ে ঘুমোই। কতদিন যে, কোনো ডিসকোতে যাইনি।
–কার সঙ্গে যাবি? হর্ষদ থাকলে না হয় যেতিস।
–হর্ষদ তো আমার বয়ফ্রেণ্ড মা। এমনি বন্ধুবান্ধবী কত আছে আমার। আজকাল আমার কাজের জন্যে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে।
–তোদের বন্ধুত্বের বয়স তোরাই জানিস। হর্ষদকেও তো ‘তুই তুই’ করে বলিস। যাকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করা যায় তার সঙ্গে প্রেম কী করে হয় এ তো আমি ভেবে পাই না।
এমন সময়ে ডোরবেল বাজল। তৃষা উঠে দরজা খোলাতে অপালা এল হাতে একটা ক্যাসারোল।
–কী ব্যাপার অপালামাসি?
তোর মেসোমশায়ের এক ভেড়িওয়ালা মক্কেল অনেকখানি ভেটকি মাছ, প্রায় পাঁচ কেজি হবে ফিলে করে পাঠিয়েছিলেন। আমরা মানুষ তো মাত্র দু-জন। তোদের জন্যে কিছু নিয়ে এলাম আর কিছু পাঠিয়ে দিলাম অগ্নিভদার বাড়িতে। সেদিন কত খাওয়ালেন আমাদের। যদিও রান্নাটা তুমিই করেছিলে। সত্যি চেতলের পেটিগুলো যেমন ভালো ছিল, ইলিশ মাছটাও। আর তেমন-ই বেঁধেছিলে তুমি। আমার কর্তার তো আর কোনো খাবার রুচছেই না তারপর থেকে। বলছেন, রান্নাটাও তো ভালো করে শিখতে পারতে–গানটা না হয় অরার মতো ভালোই নাই গাইতে পারলে।
-–ছাড়ো তো। বিবাহিত পুরুষেরা সবাই-ই ওইরকম-ই হয়। পরস্ত্রীর সব-ই ভালো দেখে।
–আর অগ্নিভর মতো অবিবাহিত পুরুষেরা?
অপালার রসিকতাতে হেসে ফেলল অরা। বলল, তাদের তো পরস্ত্রীর ব্যাপার নেই– নিজের স্ত্রী যাদের নেই, তাদের পক্ষে তুলনা করার কোনো প্রয়োজন-ই নেই। তাদের কাছে আমরা সকলেই তুলনাহীনা।
-মা মেয়েতে কী গল্প হচ্ছিল?
–আসলে তৃষা বসে আছে হর্ষদের ফোনের জন্যে।
–ও হ্যাঁ তাইতো! ও তো প্রতি শনিবারেই এই সময়ে ফোন করে!
-হ্যাঁ। এমনিতে তো ইন্টারনেটেই কথাবার্তা হয়। তবু সপ্তাহে একবার করে ফোন করে।
তৃষা ক্যাসারোলটা কিচেনে বৃহস্পতিকে দিয়ে এল। বলল, বৃহস্পতিদিকে বলে এসেছি– খালি করে তোমারটা দিয়ে দেবে।
–ওমা। তার কী দরকার? ওতেই থাকুক। খাবার সময়ে গরম গরম বের করে খাবি। আমি তো কিউ ইয়র্ক থেকে নিয়ে আসিনি। ক্যাসারোলটা কাল সকালে দিলেই হবে।
–তা অগ্নিকে যে পাঠালে, সে কি তোমাকে ধন্যবাদ দিল ফোন করে?
সঙ্গে দুই লাইনের চিঠি দিয়েও পাঠিয়েছিলাম। আমার ড্রাইভার বলল, সাহেব বাড়ি নেই। চন্দনের কাছে দিয়ে এসেছে।
-তোমার ফোন নাম্বার জানে কি ও?
–জানে তো! মাঝে মাঝে ফোনও তো করে। আমিও করি কখনো-কখনো একা লাগলে।
–বাঃ। খুব-ই ভালো করে। মানুষটাও যে, একা তাতে তো কোনো সন্দেহ নেই।
অরা বলল।
তৃষা বলল, মা বলছিল, আমরা তুই-তোকারি করতে করতে তাদের-ই সঙ্গে প্রেম কী করে করি?
–সত্যিই। আমারও একথা ভেবে অবাক লাগে। তুই’ বললে কি প্রেম থাকে?
–তোমাদের সময়ের প্রেম তো আর এখন নেই। আমরা তোমাদের মতো রোমান্টিক নই। রোমান্স করার সময়ও আমাদের নেই। জীবনটাই কেরিয়ারের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে। কেরিয়ারে আর জীবনে কোনো তফাত নেই, সে কেরিয়ার যাই হোক না কেন। বিয়ে যেখানে হচ্ছে, যদিও বিয়ে ব্যাপারটা আর কতদিন টিকে থাকবে, তা নিয়ে ঘোর সংশয় দেখা দিয়েছে, সেখানে সেটা একটা প্রয়োজন বলেই হচ্ছে। রোমান্সের কোনো জায়গা নেই।
–হাই সোসাইটিতে হতে পারে। আমার মনে হয় না এই কথা সকলের বেলাতে সত্যি। তোরা তো প্রেম করিস না, ভালো গান শুনিস না, ভালো সাহিত্য পড়িস না–কিন্তু এসব করে এমন অগণ্য মেয়ে আছে, মধ্যবিত্ত সমাজে যারা আজও পুরোপুরি ‘বাঙালি’। সবকিছু বাঙালিআনা তারাই বাঁচিয়ে রেখেছে। তারা সবাই তাদের প্রেমিককে ‘তুই’ বলে না, দু একজন বললেও বলতে পারে।
তৃষা বলল, জানো মা, সেদিন আমার এক কলিগের বিয়ে হল, অন্য এক কলিগের সঙ্গে। দু-জনেই তুমুল ‘তুই-তোকারি’ করতে করতেই বিয়ের ডিসিশনটা নিয়ে ফেলল। মেয়েটির নাম ঝিনুক। তার বড়োমামা তাকে একটা লাল গোলাপ ফুল আঁকা টিনের তোরঙ্গ দিয়েছেন, উপহার হিসেবে, অন্য অনেক উপহারের সঙ্গে। সেই কালো ট্রাঙ্কের ওপরে সাদা রং দিয়ে বড়ো বড়ো করে লিখিয়ে দিয়েছেন “সুখে শান্তিতে ঘর করো, তুই-তোকারি বন্ধ করো।”
অপালা আর অরা দুজনেই জোরে হেসে উঠল তৃষার কথা শুনে।
অপালা বলল, দারুণ তো। গল্প করতে হবে সবাইকে।
অরা বলল, ঘোষ সাহেবকেও নিয়ে এলি না কেন, আড্ডা মারা যেত। তবে হুইস্কি তো আমার কাছে নেই।
–হুইস্কি না হয় সে নিজেই নিয়ে আসত কিন্তু নীচে একবার উঁকি মেরে দ্যাখোনা গাড়ির লাইন। বলেছি না, শুক্রবার রাত ছাড়া একদিন রাতেও ছুটি নেই। ছেলেমেয়ে নেই, তেমন প্রয়োজনও নেই, তবু কাজ, কাজ করেই মানুষটা গেল।
–কাজ কি শুধু টাকার জন্যেই করে কেউ অপালামাসি? সফল মানুষদের কাছে কাজ’ একটা নেশা। এই যে, এত মানুষ তাঁর ওপরে নির্ভর করছে, তিনি নইলে চলবে না– এইকথা বারে বারে বলছে, এর একটা নেশা নেই? সফল একবার হতে পারলে টাকা দৌড়ে এসে তাঁর পকেটে ঢোকে। তখন “না” করার উপায় থাকে না।
অপালা বললেন, আর শুধুই কী টাকা? মান সম্মান, নানারকম উপহার, শ্রদ্ধা এসবের একটা ইনটক্সিকেটিং এফেক্ট হয়, সব সফল মানুষের ওপরেই। কাজ-ই তাঁদের কাছে এক নম্বর প্রায়োরিটি হয়ে যায়। এ-কথা ওঁরা সকলেই মানেন যে, work comes first in a person’s life’ সে কাজ ওকালতিই হোক, চাকরিই হোক, লেখালেখি বা অভিনয়ই হোক। কাজের মতো বড়ো ‘নেশা’ আর নেই। কথায় বলে-না ‘workholic’ অ্যালকোহলের চেয়েও বড়োনেশা কাজের নেশা। মক্কেলরা ভালো ভালো হুইস্কিই কি কম এনে দেয়? আমার জন্যে গয়না, পারফিউম, শাড়ি, বাংলাদেশ থেকে ইলিশ মাছ, লইট্যা, শুঁটকি, ঢাকাই শাড়ি। এমন ভাব করেন যেন, তাঁরা সব দিয়ে ধন্য হচ্ছেন।
অরা বলল, তবু আমার মনে হয় এই ভাবনাটা ভুল তৃষা।
–কেন মা? ভুল বলছ কেন?
–প্রত্যেক মানুষের-ই জীবিকা একটা থাকেই। কিন্তু সব জীবিকাই জীবনের-ই জন্যে। জীবিকার দ্বারা উপার্জন করে, সেই উপার্জিত অর্থ সুন্দর, সুস্থ, আনন্দময় জীবনের জন্যে ব্যয় করা উচিত। জীবনে যদি একটুও সময় না থাকে, মানে সুন্দর জীবনযাপনের জন্যে, জীবিকাই যদি জীবনকে গ্রাস করে নেয় তাহলে তো বেঁচে থাকাই অর্থহীন। তোর অগ্নিকাকা কিন্তু এ কথাটা বোঝেন। তোর বাবাও বুঝতেন। অগ্নির রিটায়ারমেন্টের পরে মুম্বই-র একটি অত্যন্ত নামি প্রাইভেট সেক্টর কোম্পানি ওকে তিনগুণ মাইনা আর অঢেল পার্কস দিয়ে রিটেইনার নিয়োগ করতে চেয়েছিল। কিন্তু ও রিফিউজ করে দিয়ে কলকাতা চলে এল।
–হয়তো সে তোমাদের-ই জন্যে।
অপালা বলল।
তৃষা বলল, হয়তো আমাদের-ই জন্যে। কিন্তু ওঁর এক বিশেষ ফিলজফি অফ লাইফ ছিল। হি ডিডনট বিলঙ টু দ্যান রান অফ দ্যা মিলস।
–অপালা বলল, জানো তোমাদের ঘোষ সাহেব যে, এত সাকসেসফুল, ওঁর এত নাম, যশ, টাকা। কিন্তু মানুষটা টোটালি ফ্রাস্ট্রেটেড।
অরা বলল, জানো অপালা, শুধু ব্যর্থতা থেকেই ফ্রাষ্ট্রেশান আসে না, সাফল্য থেকেও আসে। আমি এমন অনেককে দেখেছি, এ-জীবনে যাঁদের ফ্রাস্ট্রেশানের মূলে তাঁদের প্রচন্ড সাফল্য।
–ব্যাপারটা খুব-ই কম্পলিকেটেড মা। তবে একথা হয়তো ঠিক যে, প্রত্যেক মানুষের জীবনেই কিছু অপূর্ণ চাওয়া থাকা প্রয়োজন। সবকিছু পেয়ে গেলেই কি মানুষ তৃপ্ত হয়?
তৃষা বলল।
–সে কথা ঠিক। নইলে রবীন্দ্রনাথের মতো অমন সফল মানুষ অত-অল্প বয়সে লিখতে পারতেন– “কিছুই তো হলো না সেই সব, সেই সব, সেই অশ্রু সেই হাহাকার রব।” এই গানটা অগ্নিকাকার গলাতে শুনেছ অপালামাসি কখনো? না শুনলে একবার শুননা। চোখের জল ধরে রাখা যায় না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকল সবাই।
অপালা বলল, রুরুকে দেখছি না।
–সে ফেস্ট-এ গেছে। সেখানে তাদের ব্যাণ্ডের গান আছে। ফিরতে রাত হবে।
তৃষা বলল।
–কী যে, করবে আমার ছেলে, কে জানে? ওকে নিয়ে আমার বড়োচিন্তা হয়।
–কেন? পড়াশুনোতে তো ও ব্রিলিয়ান্ট।
–পড়াশুনাই জীবনের ভালোত্বর একমাত্র ক্ষেত্র নয় অপালা। তোমার যে, ছেলেমেয়ে নেই একদিক দিয়ে তুমি বেঁচে গেছ। মা-বাবার জীবনে নিজেদের আনন্দ বলে আর কিছু থাকে না। ছেলেমেয়ের ভালোত্ব-খারাপত্ব তাদের সুখ-দুঃখ-ই, নিজেদের কাছে প্রধান হয়ে ওঠে। এ এক বড়ো পরনির্ভর অবস্থা। মুখে বলে ঠিক বোঝাতে পারব না।
ল্যাণ্ডলাইনের ফোনটা বাজল।
তৃষা উঠে ধরল।
বলল হাই! অগ্নিকাকা! হ্যাঁ আছেন। নাও কথা বলো।
অপালার দিকে কর্ডলেসটা এগিয়ে দিয়ে বলল, অগ্নিকাকা তোমাকে চাইছেন।
অপালার মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে গেল। বলল, সামান্য একটু ফিশফ্রাই তারজন্য আবার এতকথা।
উত্তরে অগ্নি কী বলল, তা তত শোনা গেল না তবে অপালা ব্লাশ করল।
অরা কৌতুকের সঙ্গে কিন্তু গভীর মনোযোগের সঙ্গেও অপালার মুখের অভিব্যক্তি লক্ষ করছিল।
কিছুক্ষণ কথা বলার পরে অপালা বলল, ঠিক আছে। পরে কথা বলব। আপনি কি অরার সঙ্গে কথা বলবেন? না? ঠিক আছে। গুড ডে, বলে, কর্ডলেসটা ক্র্যাডল-এ নামিয়ে রাখল অপালা।
এমন সময়ে তৃষার মোবাইলটা বাজল।
তৃষার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল।
বলল, মা হর্ষদ। পুণে থেকে।
তারপর অপালাকে বলল, এক্সকিউজ মি, অপালামাসি। আমি একটু আমার ঘরে যাচ্ছি।
অপালা ওর চলে যাওয়া দেখল। স্বগতোক্তির মতো বলল, প্রেমে পড়লে মানুষ, মানুষী সবাই খুব সুন্দর হয়ে যায়-না?
–কী করে জানব বলো। একটু আগেই বলছিল-না তৃষা যে, ওদের প্রেম নেই।
–বাজে কথা।
অপালা বলল, তারপর বলল “প্রেমের ফাঁদ পাতা ভুবনে, কে কোথা ধরা পড়ে কে জানে।”
এমন সময়ে ফোনটা আবার বাজল।
অরা উঠে গিয়ে রিসিভারটাই তুলল। বলল, বলছি।
অপালা বুঝল যে, সম্ভবত অগ্নির ফোন। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ফ্রাইগুলো খেয়ো। কড়া করে ভেজেছে, মাস্টার্ড দিয়ে খেতে ভালো লাগবে। কানে ফোন লাগানো অরা মুখে কথা না বলে, নীরবে মাথা হেলাল।