১১-১৫. কেন ওসব ছুতানাতা

১১.

কেন ওসব ছুতানাতা নিয়ে পেরেশান হও? তার চেয়ে চল তিন নম্বরের কথাবার্তাটা পাকা করে ফেলি রামদয়ালের সাথে। রমজানের নালিশটা আমলে নিতে চায় না ফেলু মিঞা।

সবই তো শুনেছে ফেলু মিঞা। ক্ষতবিক্ষত গাইটাও রমজান দেখিয়েছে। তবু এমন কথা ফেলু মিঞার? তা হলে বিচার কোথায় পাবে গাঁয়ের মানুষ! অবশ্য নিজ হাতেই বিচারটা করতে পারে রমজান। কিন্তু ফেলু মিঞা না তার মুনিব, বাকুলিয়ার মিঞা? মুনিব থাকতে কেমন করে বিচারের দণ্ড নিজের হাতে তুলে নেবে রমজান?

মিঞা আভিজাত্যে একটু ঘা দিয়ে, সাথে সাথে তোয়াজ করে নানা ভাবে কথা বলতে জানে রমজান। এ যে ওর বিদেশে শিক্ষা। ওর ক্ষেতে গরু ছেড়েছ তুমি। সে মেরে তাড়িয়ে দিয়েছে। ওরও ফসলের ক্ষতি হয়েছে, তোমারও গাইটি জখমী হয়েছে। অতএব শোধবোধ, দু পক্ষই সমান, আমি বলি চেপে যাও। বিচার-ফিচার করতে গেলেই হ্যাঙ্গাম-মজলিশ ডাক, সাক্ষী আন, কম ঝামেলা নাকি?

মুনিবের নিস্পৃহতায় ক্ষুণ্ণ হয় রমজান। এ যেন ইচ্ছে করেই একান্ত অনুগতকে উপেক্ষা করা, অ-খুশি করা। তবে কী রমজানকে ওই লেকু কসির চাষাভূষোদের সাথে একই কাতারে ফেলে বিচার করে ফেলু মিঞা? একক করে, পৃথক করে রমজানের কোনো মূল্য নেই তার কাছে? রমজানের মনের হিসাবগুলো কেমন যেন গুলিয়ে যায়। বিরস মুখে জমা খরচের খাতাটা টেনে নেয় রমজান। মাঝে মাঝে আড় চোখে লক্ষ করে মুনিবের মুখ চোখের হাবভাবটা। ইংলন্ডেশ্বর ভারত সম্রাটের খাস কর্মচারীদের তৈরি করা নক্সাগুলোর মাঝে ডুবে আছে ফেলু মিঞা। চারিদিকে তার যেন একটি ব্যুহ, কত সব নক্সা-খতিয়ান আর মানচিত্রের সযত্ন মোড়ক, কত বোস্তানী দলিল-দস্তাবেজের স্তূপ। এটা খুলছে ওটা মুড়ে রাখছে, কোনোটা বা প্রচণ্ড বিরক্তিতে ছুঁড়ে ফেলছে। এ বান্ডিল সে বান্ডিল তন্ন তন্ন করে কী যেন খুঁজছে ফেলু মিঞা। হঠাৎ একটা আলো এবং লাল রেখাঙ্কিত কাগজের উপর যেন হুড়মুড় করে পড়ে ফেলু মিঞা। কী এক আগ্রহে চোখজোড়া তার চিক চিক করে ওঠে। পেয়েছি পেয়েছি, সহসা আনন্দ আতিশয্যে চেঁচিয়ে ওঠে ফেলু মিয়া। নক্সাটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসে দলিল দস্তাবেজের ব্যুহ থেকে। রমজানের সুমুখে নক্সাটি বিছিয়ে দিয়ে বলে : পেয়েছি, দেখ, এই যে মেঘনার মোহনা, ছোট ছোট দ্বীপগুলো দেখছ? ওই সব দ্বীপ বড় বড় চর আর গোটা উপকুলটা তো আমাদেরই ছিল। তারপর ওই যে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর বাবুর্চি না বেয়ারা ছিল একটা সাহেব, কার্জন নাম, সে একশো বছরেরও আগের কথা হে। সেই ব্যাটা সাহেব, নিজের ঘাড়ে একটা বন্দুক আর দুটো ভাড়াটে বন্দুকধারী পেয়াদা নিয়ে একদিন কোত্থেকে হাজির হল বলল এ আমার জমিদারী তখনকার দিনে ওই দুটো বন্দুক আর সাহেবের সাদা চামড়া, এর উপর আবার কথা? ব্যাস রাতারাতি গোটা তল্লাটটা হয়ে গেল কার্জনের জমিদারী। সেই বছরই তো আমার আব্বাজানের দাদা এক রকম বিনা যুদ্ধেই কার্জনের হাতে ওই তল্লাটটা তুলে দিয়ে চলে গিয়েছিলেন হজ্বে। এইটুকু বলে নক্সাটার উপর ঝুঁকে পড়ে আবার কী যেন দেখতে থাকে ফেলু মিঞা। তন্ময় হয়ে যায়। ডুবে যায়। আঙ্গুলের নখ দিয়ে এখানে সেখানে দাগ কাটে। এক মনে দাগ কাটে ফেলু মিঞা।

মুহূর্তের জন্য নিজের অভিযোগটা যেন ভুলে যায় রমজান। রমজানেরও হাসি পায়। চেপে রাখতে পারে না হাসি। মুখ ঘুরিয়ে দাখিলা মুসাবিদার কাজে মন দেয় ও।

আল্লার কী কেরামতি জান? কয়েক বছর বাদেই তিন চারটে দ্বীপ রীতিমতো পুরনো আর অরণ্যময় দ্বীপ, কার্জন ব্যাটা কাঠের ব্যবসা ফেঁদেছিল সে সব দ্বীপে, একদিন সব ডুবে গেল স্রোতের তলায়। সে সব দ্বীপ আবার জেগে উঠেছে। আবার ভেসে উঠেছে পানির উপর। বুঝলে রমজান? সমস্ত কাগজপত্র আমার তৈরি। জলদি জলদি সদরে যাবার ব্যবস্থাটা করে ফেল। কার্জন ব্যাটা কবে মরে ভূত হয়ে গেছে। ও সব সম্পত্তির আমরাই তো হক মালিক। সরকারকে সমস্ত অবস্থাটা জানিয়ে ফেরত চাইতে হবে আমাদের প্রাচীন সম্পত্তি। হঠাৎ থেমে যায় ফেলু মিঞার কথার তোড়। তার মনে হল রমজান যেন মন লাগিয়ে শুনছে না। একটু তীক্ষ্ণ ভাবে ওকে নিরীক্ষণ করে বলল আবার : ও বিশ্বাস হচ্ছে না তোমার? আরে রমজান। মুনিব তোমার! স্কুল কলেজ পাস না দিলে কী হবে, এলেম রাখে হে। ওই তোমার ব্রিটিশ গভর্নমেন্টেরও ক্ষমতা নেই ফাঁকি দিয়ে যায় এই ফেলু মিঞাকে! আত্মগর্বে স্ফীত হয়ে আসে ফেলু মিঞা! চাবির গোছাটা নিয়ে উঠে যায়। নিজেই সিন্দুক খুলে বের করে আনে সাদা লাল সবুজ কাপড়ে বাঁধা নানা আকারের কতগুলো দলিলের পোঁটলা। আলবোলার নলটা মুখে পুরে নতুন দলিলে আবার মন দেয় ফেলু মিঞা। হিসেবের খাতাটা বন্ধ করে রমজান লক্ষ করে মুনিবের কাণ্ড-কারখানা। এই রাগ এই আনন্দ আতিশয্য, মুনিবের বিচিত্র স্বভাবটার থৈ পায় না রমজান। কর্ন ওয়ালিসকে ছেড়ে আবার কোত্থেকে কোন কার্জন সাহেবকে নিয়ে পড়ল ফেলু মিঞা। রমজানের বুদ্ধিতে ধরে না এ রহস্য। তাও দুটোই মরা সাহেব, জ্যান্ত হলে না হয় একটা বোধগম্য হেতু পেত রমজান।

কালু কালু, ডেকে ওঠে ফেলু মিঞা।

কালু দৌড়ে এসে কলকিটা তুলে নেয় হুঁকো থেকে। নতুন তামাক সাজাতে শুরু করে।

আরে ব্যাটা তামাক না। আমাদের নতুন বিয়ানের গাইটা পৌঁছে দিবি রমজানের বাড়ি। ওর গাইটা বোধ হয় বাঁচবে না। চকিতে একবার রমজানকে দেখেই আবার দলিলের স্তূপে ডুব দেয় ফেলু মিঞা।

এ হল গিয়ে মিঞার বেটা ফেলু মিঞা। দিল তার দরাজ। এ দিলের পরিচয় আগেও পেয়েছে রমজান। কিন্তু এতে কী অপরাধীর সাজা হল না ন্যায় বিচার হল? রমজানের মাথার গরম ঠাণ্ডা হয় না। পাল্টা প্রতিশোধ না নিয়ে কেমন করে ঠাণ্ডা হবে রমজান! তবু প্রত্যক্ষ পাওয়াটা উপেক্ষণীয় নয়। মুনিবকে খুশি করার জন্য উঠে আসে রমজান, বলে স্যার তিন নম্বর তালুকটার ব্যাপারে তা হলে রামদয়ালের সাথে বসে একটা কবালার মুসাবিদা করে ফেলি?

হ্যাঁ হ্যাঁ। নিশ্চয় নিশ্চয়। তুমি পারবে তো না কী আমাকেও যেতে হবে? খোলা দলিলগুলো বন্ধ করে বলে ফেলু মিঞা।

তা আপনাদের দোয়ায় অ আ ক খ টা তো শিখেছিলাম ছোট বেলায়, তারপর তো সব দেখে শেখা দেশে আর বিদেশে। আপনার কাজে কোনোদিন গলতি পেয়েছেন স্যার? মাটির সাথে যেন মিশে যায় রমজান।

আরে কী যে বল, ওই দেখে শেখাটাই তো আসল শেখা। দেখছো না আমাকে? তুমি তো আমার যোগ্য সাকরেদ।

সাকরেদ না স্যার, অধম গোলাম আপনার। বিনীত নম্রতায় আর এক ধাপ নেবে আসে রমজান। অধম শব্দটা ছোটবেলায় মক্তবের মৌলভী সাহেবকে একবার ব্যবহার করতে শুনেছিল রমজান। শব্দটা কেন যেন খুব পছন্দ হয়েছিল ওর। তাই মনে রেখেছিল। আজ সেই শব্দটার এমন সার্থক প্রয়োগে খুশি হয়ে উঠল রমজান। ভাগ্যিস সৈয়দদের মক্তবে বসে বাংলা বর্ণমালাটার সাথে একটু পরিচয় করে নিয়েছিল রমজান। সে জন্য আজ আল্লার দরবারে তার হাজার শোকরগুজার।

এবার ফেলু মিঞা পরগনা আমিরাবাদ আর দখিন ক্ষেতের নক্সাটাই খুলে ধরল চোখের সামনে। সেই সুলতানপুরের জেলে পাড়া, তালতলির একশো ঘর তাঁতী, চাটখিলের যুগিরা, সব ওই তিন নম্বর তালুকের প্রজা। মুহূর্তের মাঝে কার্জনের কল্পিত চেহারাটা অদৃশ্য হয়ে ফেলু মিঞার চোখের সামনে ভেসে উঠে রামদয়ালের মুখখানি। আর সঙ্গে সঙ্গেই সেই দরাজ দিলটা যেন সহস্র সাপের ছোবল খেয়ে বিষিয়ে উঠল। ফেলু মিঞার চোখে ঘৃণা আর প্রতিহিংসা। মিঞা আভিজাত্যের কলঙ্ক সেই তিন আর চৌদ্দ নম্বর তালুক, পুনরুদ্ধারের জন্য এখনো টাকার ব্যবস্থা নেই ফেলু মিঞার। একমাত্র আগামের টাকাটারই ব্যবস্থা হয়েছে। স্ত্রী হালিমার কয়েক ছড়া অলংকার সরিয়ে রেখেছে ফেলু মিঞা।

স্ত্রী হালিমার কথাটা মনে হতেই ছ্যাপরা খেল ফেলু মিঞা। কী এক ভয় এসে যেন গ্রাস করল ওকে।

কাকুতি মিনতি করেও যখন কিছু হয়নি, সোজা হুকুম দিয়েছিল, ধমক ছেড়েছিল ফেলু মিঞা। তাতেও কাজ হয়নি, উল্টো বলেছিল বউটি, গায়ের সোনা ঘরের লক্ষ্মী। গা থেকে এক রত্তি সোনাও খুলব না। ওসব কুসংস্কারের বালাই রাখে না ফেলু মিঞা। ঝট করে বউয়ের গলার মফ চেইনটা খুলে নিয়েছিল। আর খপ করে হাত দুটো ধরে চুড়িগুলো টেনে বের করেছিল। সেই সাথে বিবি হালিমার হাতের একটুখানি চামড়াও হয়ত উঠে এসেছিল। অভিসম্পাত দিয়েছিল হালিমা : কুষ্ঠ হবে কুষ্ঠ হবে ওই হাতে! খোদার কহর পড়বে, লানত পড়বে!

ফেলু মিঞার মনে হয়েছিল কুলবধূর অভিসম্পাতে দালানের ইটগুলোও বুঝি সত্যি কেঁপে উঠল। মনে হয়েছিল যে হাতটার চুড়ি কয়টা ধরেছিল ফেলু মিঞা চুড়িশুদ্ধ সেই হাতখানি বুঝি তখখুনি খসে পড়বে। এমন সাংঘাতিক কহর দিল বৌটি? তাও মাত্র কয়েক ভরি সোনার জন্য? অভিসম্পাতকে বড় ভয় ফেলু মিঞার। তাই তো সেদিনের সেই দৃশ্যটা মনে জাগলেই ছাপরা খায়, চমকে ওঠে ফেলু মিঞা। কিন্তু ফেলু মিঞা তো এটাই জানতো–বান্দীর মেয়ে, ছোট লোকের বউ, ওরাই মুখ খারাপ করে, চেঁচামেচি করে, গালি দেয়, কহর দেয়। কিন্তু মিঞা বাড়ির বৌ বা মেয়েকে কে কবে উঁচু গলায় কথা বলতে শুনেছে? সেই মিঞা বাড়ির বৌ কিনা কমজাত ছোট লোকদের মতো চেঁচাল? কহর দিল? ছিঃ ছিঃ। ফেলু মিঞার গাটা ঘিন ঘিন করে ওঠে। স্ত্রী হালিমাকে সত্যি সত্যিই ঘৃণা করতে শুরু করেছে ফেলু মিঞা।

চারদিকে রাষ্ট্র হয়ে গেছে খবরটা। সবাই জেনেছে সাত নম্বর তালুক ফিরে এসেছে মিঞাদের। প্রজারা এসে সেলাম দিয়ে যাচ্ছে কাচারিতে। কেউ বা নিয়ে আসছে নজরানা।

কিন্তু আনন্দ কোথায় ফেলু মিঞার? অর্ধেক আনন্দই তো কেড়ে নিয়েছে স্ত্রী হালিমা।

তাছাড়া আর একটা ভয় এত ব্যস্ততা আর চিন্তার মাঝেও ধুক ধুক করছে ওর মনের ভেতর। বিছে হার, বাজুবন্দ, নোলক আর গলার নারকেল ফুলগুলোর খবর তো এখনো হালিমার অজানা। স্ত্রীর অজান্তেই বাক্স থেকে অলংকারগুলো সরিয়েছে ফেলু মিঞা। যথা সময় ব্যাঙ্কে বন্ধক রেখে টাকাও এনেছে। যখন জেনে যাবে হালিমা আরও কী কঠিন অভিশাপ দেবে সে কে জানে! জমিজিরাত ঘরবাড়ি ফেলে সোনার প্রতি কেন যে মেয়েদের এত লোভ আজও বুঝতে পারল না ফেলু মিঞা। অদ্ভুত এই মেয়ের জাত।

সংস্কার বা কুসংস্কার কোনোটাকেই তেমন আমলে আনে না ফেলু মিঞা। তবু স্ত্রী হালিমার অভিশাপকে এত ভয় কেন ওর? এ প্রশ্নেরও কোনো সদুত্তর খুঁজে পায় না ফেলু মিঞা।

এত প্রশ্ন, এত দ্বন্দ্ব, এত দুশ্চিন্তা। কপালের রেখাগুলো কুঁচকে আসে। চোখ দুটো দপ দপ করে জ্বলে ওঠে। ফেলু মিঞা মাথার চুল ছেড়ে দু হাতের তালুতে মাথাটাকে চেপে ধরে। ফেলু মিঞা কী পাগল হবে? তা হলে আজ বিকেলেই তালতলিটা ঘুরে আসি স্যার। দলিলের বোঁচকায় সুতো প্যাঁচাতে প্যাঁচাতে বলল রমজান।

ফেলু মিঞা বুঝি সম্বিৎ ফিরে পায়।

আলবত আলবত। শুধু ঘুরে আসা নয়, একেবারে পাকা করে আসবে।

নক্সাটার উপর আবার ঝুঁকে পড়ে ফেলু মিঞা।

রমজানের সেই ছোট ছোট গোল গোল চোখ দুটি কেন যেন লাল হয়ে থাকে সারাক্ষণ, চকচকিয়ে ওঠে সে চোখ। সেই পাঁচশো টাকার নোটের তোড়াগুলো, কামিজের নিচের দিকে ভারী পকেটটায় এখনো যেন অনুভব করছে রমজান। তিন নম্বরে আরো বড় দাঁও। আহ্, রমজানের গায়ের লোমগুলো কী এক নাচন দিয়ে গেল। একটু আগে মুনিবের উপেক্ষায় যে ক্ষোভ জমেছিল ওর মনের ভেতর মুহূর্তে উবে গেল সে ক্ষোভ।

শোন। নক্সা থেকে মুখ তুলে রমজানের দিকে তাকাল ফেলু মিঞা। বাকী বকেয়া আদায়, সে তো আছেই। তা ছাড়া…। থামল ফেলু মিঞা। কী যেন ভাবল। বলল আবার, আমি ভাবছি কিছু জমি বিক্রী করে দেব। আজকাল জমির বেশ দাম আছে।

মুনিবকে সত্যিই বোঝে না রমজান। লোকে আজকাল তালুক বেচে জমি কিনছে। কেননা জমিতেই এখন টাকা, ফসল বিক্রীর নগদ মুনাফা। একটু বুদ্ধি খরচ করলেই তো ব্যাপারটা বুঝতে পারে ফেলু মিঞা। কিন্তু ফেলু মিঞা বুঝবে না। ফেলু মিঞা জমি বেচে তালুক কিনবে।

কেমন একটা ধূর্ত হাসি ঝিলিক তুলে যায় রমজানের ঠোঁটের কোণে।

বলল রমজান তা তিন নম্বরের জন্য দরকার পড়লে জমি কিছু বেচতে হবে বই কী?

ততক্ষণে নক্সাটার আঁকাবাঁকা টানের বিচিত্র মায়ায় আবার হারিয়ে গেছে ফেলু মিঞা। সব রাগ, সব ক্ষোভ, স্ত্রীর অভিমান ভুলে গেছে ফেলু মিঞা। এখন শুধু ওই আঁকাবাঁকা টানের নক্সা, ডিসিমলের হিসাব। ওই নক্সা। ধন গৌরব আভিজাত্য আর মর্যাদার কিংখাব মোড়া সেই অতীত যেন বন্দী ওই নক্সার গোলক ধাঁধায়। উদ্ধার করতে হবে তাকে, মুক্ত করতে হবে তার পুনরুজ্জীবনের পথ। কঠিন সংকল্পের মুখে ভেঙে যাচ্ছে সব বাধা-বিপত্তি ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিত পদক্ষেপেই এগিয়ে চলেছে ফেলু মিঞা। কী এক রোমাঞ্চে দুলে দুলে যায় তার সারা অঙ্গ।

১২.

সেলামালাইকুম।

ওয়ালাইকুম। নক্সাটা গুটিয়ে রেখে ওদের দেখল ফেলু মিঞা। ওরা সবাই এসেছে, কসির, বুড়ো ট্যান্ডল, সারেংদের বড় হিস্যার মজু সারেং, ফজর আলী। আরো অনেকে।

ওদের মতলবটা আঁচ করে আগেভাগেই সিদা কথাটা শুনিয়ে দেয় ফেলু মিঞা। শুনেছি সব। মাফটাফ হবে না। বকেয়া মিটিয়ে দাও। তারপর অন্য কথা। নইলে।

নইলে কী, সে বলার অপেক্ষা রাখে না। ওরা জানে।

কোত্থেকে দেব? সেই পুরনো কথা কসিরের।

কো-থেকে দেব? ভেংচি কাটে ফেলু মিঞা। আপনার হাজারো অসহায় অপদার্থতার ক্ষোভে অহর্নিশ জ্বলে চলেছে ফেলু মিঞা। তাই কসিরের হতাশ কান্নার মতো ঝরে পড়া কথাটা যেন বারুদের স্তূপে আগুন ধরিয়ে দেয়। দাঁত মুখ খিঁচিয়ে অশ্লীল হয় ফেলু মিঞা! দুই মাগীরে দুই পাশে নিয়ে শোবার সময় জিজ্ঞেস করিস আমাকে? কোত্থেকে দিবি সে আমি জানি?

থামে না ফেলু মিঞা। একটি কথার সূত্র ধরে বলে চলে অনেক কথা। মুসলমান, তার উপর ছোট লোক। ওদের স্বভাবটাই তো ওই। কামাই নেই রোজগার নেই। কিন্তু শাদী? মাশাল্লাহ্, এক গণ্ডা, কমসে আধ গণ্ডা। এই জন্যই তো গোটা জাতটার এই দুরবস্থা।

কসির অবশ্য তেমন গায়ে মাখে না কথাটা। দুই বউ নিয়ে সে নিজেও পস্তায় এখন। খেতে দিতে পারে না। তার উপর দুই সতীনে খিটিমিটি চুলোচুলি লেগেই আছে হরদম।

মুখ নীচু করে ফজর আলি। ওর দু বউর সংসারে এতটুকু কোঁদল নেই। তা নিয়ে ওর অনেক গর্ব।

কিন্তু উসখুস করে রমজান। হঠাৎ সরাশরিয়তের খেলাপ বলতে শুরু করল কেন ফেলু মিঞা? মুসলমানের শাদী হল ফরজ কাম। যে শাদী করবে না বেহেশত তার হারাম। দুই বৌ চার বৌ সে তো সুন্নত, পুণ্যের কাজ। একপত্নীক হলেও মিঞার কথাটায় ধর্মের দিক দিয়ে যেন সায় নিতে পারে না রমজান। তবু মিঞার কথা তো? ভালো হোক মন্দ হোক শুনে যেতে হবে। লেখাপড়া আমাদের নেই কিনা! তাই–। জাহাজে নানা দেশের নানা লোকের রুচির সাথে পরিচয় ঘটেছে মজু সারেংয়ের। তাই ওর চিন্তাটা অন্য ধরনের।

লেখাপড়ার কথায় আবার খিঁচিয়ে ওঠে ফেলু মিঞা; ঝাঁটা মার লেখাপড়ার কপালে। দেখছ না আমার দিগগজ ভাইগুলোকে! হ্যাঁ যদি বল ওই মিত্তিরদের মতো, দুটো ছেলে জজিয়তি করে, মাস মাস টাকা পাঠায় গ্রামে। সে টাকায় শুধু কী মিত্তিরদের উন্নতি? কত কাজে লাগে সে টাকা। একটা ডিসপেন্সরী চলে আর ওই মেয়েদের স্কুলটা তো সম্পূর্ণ মিত্তিরদের টাকাতেই চলে। এমন লেখা পড়ার দাম আছে, বুঝি।

বিলকুল ঠিক। বিলকুল ঠিক। এবার সবাই ফেলু মিঞার সাথে সায় না দিয়ে পারে না। মিঞা বাড়ির চাকুরে ছেলেরা কিছু টাকা পাঠালে বাকুলিয়ার অভাগারাও তার কিছু উপকার হয়তো পেতো। সে কথাটাই ভাবে ওরা। আর দেখ ওর রামদয়ালকে। পাস সেও তো একটা করেছে। গোটা বাড়িতে ঝুড়ি ঝুড়ি বি.এ. পাস। তবু দেখ সুদী কারবার, তেজারতি, চাষ–সবটাতেই আছে ওরা। তাই তো এত উন্নতি ওদের।

আশ্চর্য হয় রমজান। উঠতে বসতে হিন্দুদের বিশেষ করে ওই রামদয়ালের আর ওই মিত্তিরদের চৌদ্দ পুরুষের মুণ্ডপাত করা যার অভ্যাস তার মুখেই আজ হিন্দু প্রশস্তি?

এত কথার মাঝে আসল কথা বুঝি চাপা পড়ে যায়। হাঁটুর উপর ভর রেখে একটু নড়েচড়ে বসে কসির, ফজর আলি।

কসিরের হয়ে সুপারিশ করে ফজর আলি।

হুজুর… সেই ভীরু ভীরু স্বর কসিরের।

আবার হুজুর? তিন দিনের সময় দিলাম। যা, ভাগ।

আপনি হলেন মিঞা, গেরামের মাথা, আপনি দয়া করলে বাঁচি, নইলে মরি।

দেখেছ রমজান? রামদয়ালের সাথে থেকে থেকে কেমন কথা বলতে শিখেছে ফজর আলি। ফেলু মিঞার খানদানী মেজাজটা সত্যি খুশি হয়ে উঠে।

পুরনো খতিয়ানের বোঁচকাগুলো তাকে তুলতে তুলতে আড় চোখে কসিরের দিকেই তাকায় রমজান। ভেসে উঠে ওর চোখের সুমুখে সেই লেকুর বাউলা খেতের ছবিটি। ইস দুই বদমাশ মিলে কী নিষ্ঠুর মারটাই না মারল গাই গরুটাকে। হঠাৎ কেউটের ছোবল খেয়ে যেন সচকিত হল রমজান। বিষের জ্বালাটা কী এক অস্থিরতা চড়িয়ে চলেছে ওর স্নায়ু শিরায়। এত বড় মারটা কী রমজানকে নীরবেই হজম করতে হবে?

দরিয়ার মতো দরাজ হয়েছে আজ ফেলু মিঞার দিলটা। নতুন বিয়ানো গাই গরু দান করে দিল রমজানকে। তিন নম্বর তালুক কেনার হকুমটা দিয়ে দিল। এতগুলো খুশিতে কিছুক্ষণের জন্য বুঝি হারিয়ে গেছিল রমজান। কসির বা ফজর আলি যে ওই কমজাত লেকুটারই দোসর কথাটা মনে হতে হয়ত তাই একটু দেরি হল।

শা-লা। দুই বৌর সোয়াদ তোদের আচ্ছা করেই মিটাচ্ছি আমি। আলমারির তালাটা টিপতে টিপতে বিড় বিড় করে রমজান। নিজের জায়গাটায় এসে বসে। সোজা করে তাকায় ওদের দিকে আজ। বুঝি অনেক কেউটের অনেক ছোবল জ্বালা ধরিয়েছে ওর সর্বাঙ্গে। হৃৎপিণ্ড তার বিষের মন্থনে ক্রমাগত পাক খেয়ে চলেছে। মনটা তার তড়পায় বোশেখের শেষে শুকিয়ে যাওয়া ডোবার মাছগুলোর মতো। হ্যাঁ, মুনিবের মদদ থাক বা না থাক প্রতিশোধ সে নিবেই। সে যে কছম খেয়েছে দাদ না তুলতে পারলে বাপের ব্যাটা নয় সে। সে কছম ভুলেনি রমজান।

আরে মাস্টার এস, এস। ডাকল ফেলু মিঞা। নিজের পাশেই বসবার জায়গা করে দিল।

আজকের কাগজে খবরটা দেখেছ?

জী না কাগজ তো স্কুলে গিয়ে দেখি। কী খবর? শুধাল সেকান্দর।

আবার বেধেছে গোলমাল। এবার ইউ, পিতে।

কিসের গোলমাল? জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সেকান্দর।

কিসের আবার গোলমাল! হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা রায়ট রায়ট। বলে ওর দিকে কাগজটা বাড়িয়ে দিল ফেলু মিঞা।

তা-ই তো। খবরটা পড়ে আস্তে আস্তে মাথা নাড়ল সেকান্দর। যেন নিজের কাছেই ছোট্ট একটা প্রতিবাদ জানিয়ে রাখল।

শোন মাস্টার। এই ফেলু মিঞা একটা কথা বলে রাখছে–ওই হিন্দুরা একটা একটা করে সব মুসলমান খতম করবে এ দেশ থেকে। এখন তো রায়ট হচ্ছে কালে ভদ্রে! কিন্তু আমি তো স্পষ্ট দেখছি, এমন দিন আসছে প্রতি মাস, প্রতি দিনই রায়ট হবে! মনে রেখ কথাটা।

আলবোলায় ঘন ঘন কয়েকটা টান মারে ফেলু মিঞা। ধোঁয়াগুলোকে একেবারে তলপেট অবধি টেনে নেয়। তারপর একটা লম্বা হাঁ মেলে উঁচিয়ে রাখে মুখটা, কুণ্ডুলি পাকানো ধোঁয়া মিছিল করে বেরিয়ে যায়।

ইংরেজ থাকতেই এই অবস্থা? ইংরেজ চলে গেলে, হিন্দুদের হাতে স্বরাজ এলে কী অবস্থাটা হবে, ভেবে দেখ তো? একটা মুসলমানেরও অস্তিত্ব খুঁজে পাবে না এ দেশে। একটাও না। সব মুসলমান, ধনী নির্ধন, আমীর ফকির সবাই যদি আজ একট্টা না হতে পারি আমরা তবে এই, এই আমাদের ভবিষ্যৎ। জেনে রেখো মাস্টার। একদিন নিজের চোখেই এ সব দেখবে আর বলবে-হা বলেছিল বটে ফেলু মিঞা।

তা কেন হবে! ছোট্ট একটা প্রতিবাদ জানায় সেকান্দর। যে আর্জি নিয়ে এসেছে সেটা পেশ করার জন্য একটু ঝুঁকে আসে সুমুখে।

হুজুর, গরিবের দিকে একটু দেখবেন না? সেকান্দরের আগেই মজু আর কসির প্রায় এক সাথেই বলে উঠল।

এই তো, এই তো আমাদের মুসলমান। দেখ, চেয়ে দেখ। খাজনা দেবার পয়সা নেই। পরনে কাপড় নেই। পেটে ভাত নেই। শুধু জানে হাত পাততে। শুধু জানে নফরদারী। বেহায়া বেসরম বেল্লিক। ওদের দিকে আঙ্গুল উঁচিয়ে আর সেকান্দরের দিকে মুখ করে বলল ফেলু মিঞা। আবার লাল হয়ে এসেছে তার মুখ। আবার সেই ক্ষোভ আর ঘৃণা যেন একটানা ঝাঁকুনি দিয়ে চলেছে তার শরীরে।

মুসলমান তো নয়, কাঙ্গালের জাত, ভিক্ষুকের জাত–এ কথাটা চিৎকার করেই বলে ফেলু মিঞা। আর সেই, কাঙ্গালের জাতটার কথা যখন ভাবতে বসে ফেলু মিঞা তখন এমনি ক্ষুব্ধ রাগে দিশে হারায়, চোখ মুখ তার লাল হয়ে আসে, ঠিক যেমনটি হয় মিঞাদের লুপ্ত আভিজাত্যের কথা ভাবতে গেলে।

এই এই এখনো বসে আছিস তোরা? এখনো গেলিনা আমার সমুখ থেকে? এই কালু, কুঁড়ের বাদশা।

কালুকে আসতে হয় না। তার আগেই ওরা উঠে যায়। শুধু অন্যায়ের কাতর চোখগুলো একবার সেকান্দরের দিকে তুলে ধরে। বেরিয়ে যাবার আগে ওদের অনুক্ত আবেদনটা যেন রেখে যায় ওরই হাতে। সে যেন কিছু করে ওদের জন্য।

কী বলবে সেকান্দর! সে-ই তো পাঠিয়েছিল ওদের বলেছিল, আমার একলার কথায় তো হল না কিছু। তোমরা সবাই মিলে ধর্না দাও মিঞার কাচারিতে। কিন্তু ফলে বুঝি বিপরীত হল।

উত্তেজনাটা চচ্চড় করে বেড়ে চলেছে, উঠে দাঁড়িয়েছে ফেলু মিঞা। আলবোলাটা সরাতে গিয়ে ফেলেই দিল মেঝেতে। কলকিটা ভেঙে দু টুকরো হল, ছাইগুলো ফরাসময় ছড়িয়ে পড়ল।

কী হবে কী হবে এই ভিখিরীর জাতের, বলতে পার মাস্টার? তুমি কী ভাবো, দিলে আমার রহম নেই? দুঃখে আমারও বুক ফেটে যায় মাস্টার। কিন্তু কী করব? মিঞা বাড়ির ইজ্জত, মিঞা বাড়ির নাম নিশানা মুছে ফেলতে চায় তালতলির ওই মালাউনের গোষ্ঠীটা। টাকা যে আমার চাই, যেমন করে হোক। নইলে শুধু আমার হার নয়, বাকুলিয়ার, ওই সুলতানপুরের, গোটা পরগনার মুসলমানের হার। কোনোদিন কোনোদিন ওরা মাথা উঁচিয়ে দাঁড়াতে পারবে না। পারবে না।

নিজের উত্তেজনায় নিজেই যেন বেহুঁশ ফেলু মিঞা। খালি পায়েই পায়চারি শুরু করেছে মেঝের উপর।

কিন্তু…

না না তোমার কথা আলাদা, তুমি যখন খুশি দিও, তবে ওই ব্যাটাদের বলে দাও টাকা চাই আমার, টাকা নগদ টাকা নতুবা জমি। চটিতে পা ঢুকিয়ে চট চট শব্দ তুলে অন্দর মহলের দিকে চলে যায় ফেলু মিঞা।

১৩.

আম্বরি আম্বরি। তোর খুব লেগেছে না রে? দেখি? আম্বরির মুখের উপর ঝুঁকে পড়ে লেকু।

কপাল থেকে কান অবধি ন্যাকড়ার পট্টিটা টেনে টেনে আল্গা করার চেষ্টা করছে আম্বরি। কচু ডগার কষ ভেজানা তেনা, শুকিয়ে চিমসে গেছে ক্ষতের সাথে। ও শুয়ে আছে, ঘরের একমাত্র আসবাব, ওদের জাম চৌকিটায়। আম্বরির শ্বশুরের নিজের ব্যবহার করা শখের চৌকিখানা। সেই লেকুর বিয়ের সময় বুড়ো ছেলেবৌকে খুশি হয়ে ছেড়ে দিয়েছিল বাড়ির প্রাচীন জাম গাছটা ফেড়ে তৈরি করা এই চৌকিখানা।

উ উ আহ। কঁকিয়ে ওঠে আম্বরি। ওর অসাবধানে কখন লেকু হাত বাড়িয়ে টান মেরেছে পট্টিতে, চচ্চড় করে উঠে এসেছে ন্যাকড়া। বেশ শুকিয়ে এসেছে ক্ষতটা, যতটা মারাত্মক ভেবেছিল লেকু, তেমন কিছু নয়। মাগো! কী ডাকাত। আম্বরি বলে আর আঙ্গুল বুলোয় আধশুকনো ঘা-টার উপর। লেগেছে ওর। পানি এসে পড়েছে চোখে। আর সেই ফাঁকে ওই ডাকাতটা যে কখন ওর পলকা শরীরটাকে নিবিড় বেষ্টনে ধরে নিয়েছে বুঝি টেরই পায়নি ও।

পাটার মতো চওড়া বুকটার উপর মাথা রেখে নিথর পড়ে থাকে আম্বরি।

তুই এ রকম কেনরে আম্বরি?

কী রকম?

জানিস তো আমার শুয়রের মতো রাগ। যখন রাগি তখন হাতের মুখে না থেকে পালিয়ে গেলেই পারিস!

আম্বরি চুপ। ওই হাতগুলো যখন আদর দেয় ওকে তখন কেমন যেন বোবা বনে যায় ও। বলার থাকলেও বলতে ইচ্ছে করে না কথা। ছোট ছোট আঙ্গুল দিয়ে টিপে টিপে ও যেন পরখ করে মানুষটার হাত, বুক, হাতের পেশী। সোহাগ ভরা হাত। কে বলবে এই হাতের আঙ্গুলগুলোই এক সময় লোহার মতো শক্ত হয়ে যায়, লোহার শলার মতো দাগ কেটে কেটে বসে যায় আম্বরির পিঠে। দুটো হাত কী একই মানুষের? সে হাতের আদরে বুঝি মট মট করে ভেঙে যায় আম্বরির কাঠির মতো শরীরটা। কোনো গহিন সায়রের পানি যেন ধেয়ে আসে ওর দু চোখ ঠেলে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে আম্বরি।

মানুষটার বুকে মুখ রেখে কাঁদতে কত যে সুখ আম্বরির! মানুষটা কী বোঝে সে কথা?

আস্তে আস্তে শাড়িটা সরিয়ে ওর পিঠে হাত রাখে লেকু। পিঠটা স্পর্শ করেই যেন চমকে ওঠে লেকু। ওর হাতের বাঁধনটা যায় আল্গা হয়ে। ওর বুকের উপর থেকে ঢলে পড়ে আম্বরি। মুখ তুলে আম্বরির পিঠটা দেখে লেকু। নীল আর কালো দাগে একাকার ওর পিঠ, একটুও ফাঁক নেই বুঝি। আর কেমন অমসৃণ প্রথম চাষ দেওয়া জমিটার মতো। ইস্ এমন করে ওকে পিটিয়েছে লেকু? এ দাগ কী শুধু পিঠে? লেকুর মনে হল এই নিষ্ঠুর নির্যাতনের দাগ আম্বরির সারা অঙ্গে। চামড়ার নিচে যে মাংস আর মাংস ঢাকা যে সব হাড়, সেই হাড়গুলোও বুঝি এমনি কালো আর নীল হয়ে গেছে। সেখানেও দাগ ধরেছে।

 শোন্ আম্বরি। অনেকক্ষণ পর বলল লেকু।

আম্বরি শোনে। কিন্তু, জবাব দেয় না। পিঠের উপর লেকুর খরখরে হাতের স্পর্শটা অদ্ভুত মোলায়েম লাগছে ওর।

আমি পাহাড়ে যাচ্ছি। একটা খেপ নিয়ে আসি। তারপর চল্ দুজনাই চলে যাই রঙ্গম।

রঙ্গম? আম্বরির বুকের ভেতর হঠাৎ বুঝি একটা খুশির লহর দৌড়ে এসে নেচে নেচে যায়। কিন্তু পরমুহূর্তেই উবে যায় ওর আনন্দটা। বলে সে কী গো? জমিজিরাত ঘরবাড়ি ফেলে রঙ্গম যাবে?

জমিজিরাতের ভাবনা আর ভাবতে হবে না রে আম্বরি। জমি রেহান দিয়েছি দয়াল কাকার কাছে।

রেহান? বুঝি বিশ্বাস করতে চায় না আম্বরি।

হ্যাঁ রে হ্যাঁ।

কেন গো? উঠে বসে আম্বরি।

চট করে কোনো উত্তর দেয় না লেকু। কী যেন ভাবে। কেমন অন্যমনস্ক চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে আম্বরির শাড়ি পরা। তারপর আচমকা ধাক্কার মতো মুখের ভেতর থেকে ঠেলে দেয় কথাগুলো : আমি যাব ফেলু মিঞার পায়ে ধরতে? ওই বদমাশ রমজানটার মোজাত হতে? আমি মরদ না? এই যে মুগুরের মতো হাত দেখছিস দুটো, এ হাত দিয়ে এখনো বহুত কামাই করতে পারি আমি। জমি বন্ধক রেখে ফেলু মিঞার সব বকেয়া শোধ দিয়ে এসেছি। কারো ধারি না আমি, কারো খাই না। কামাই করব, আবার ফিরিয়ে আনব আমার জমি। উত্তরে যদি কামাই ভালো না হয় যাব রঙ্গম। তোকে নিয়ে যাব আম্বরি। তুই যাবি?

 মানুষটার দিকে ভয়-ভয় চোখে চেয়ে থাকে আম্বরি। এতো বছর ঘর করেও যেন চিনতে পারল না মানুষটাকে। কেমন ফুলছে, ফুঁসছে মানুষটা, কী ক্ষোভে, কী রাগে। বুকটা তার হাঁপরের মতো উঠছে আর নামছে, ঘাড়ের পেশীগুলো ফুলে ফুলে কেবলি যেন পাক খেয়ে চলেছে।

আমাদের জমি নেই? লোক যে তোমায় ফকিরা বলবে গো? কী এক ব্যাকুলতায় লেকুর হাতখানা আঁকড়ে ধরে আম্বরি।

হ্যাঁ, আর তোকে বলবে ফকিরার বৌ, ফকিরনী। ঘাবড়াসনে আম্বরি, এই গতর যখন আছে তখন অনেক হবে। অনেক হবে আমাদের।

হবে কী? সেই পাটার মতো চওড়া বুকের আশ্রয়ে মুখ লুকিয়ে অস্ফুটে শুধায় আম্বরি।

১৪.

মস্তবড় ধনী। অগুনতি তাঁর রায়ত প্রজা। কত যে লয়লস্কর। ঘোড়া-শালে ঘোড়া, হাতিশালে হাতি। কাচারিবাড়ি, কোঠাবাড়ি, তেতলা দালান। ধন দৌলতের শেষ নেই তার।

তেতলার একটি ছোট্ট ঘরে থাকেন তিনি।

খালাম্মা, কী নাম তাঁর? ফস করে প্রশ্নটা বেরিয়ে আসে মালুর মুখ থেকে। সঙ্গে সঙ্গে গুম করে একটা কিলও নেবে আসে ওর পিঠে। কিলটা রাবুর। তাই চুপ মেরে যেতে হয় মালুকে।

বারান্দায় পাটি পেতে ওরা সব গোল হয়ে বসেছে। পীর পয়গম্বরের কিস্সা শোনাচ্ছেন সৈয়দগিন্নী। রাবু, আরিফা ছাড়াও হুরমতি, আম্বরি, সেকান্দরের মা; ট্যান্ডলদের বৌ মাথায় আঁচল দিয়ে বসেছে ওরা। বড়রা শুনতে শুনতে পান চিবোচ্ছে। ছোটরা জোড়া হাঁটুর উপর মুখ রেখে তন্ময় হয়েছে।

এক লক্ষ চব্বিশ হাজার পয়গম্বর, তিন লক্ষ আওলিয়া, পীর দরবেশ। সবার নাম কী মনে রাখা যায় রে! স্মিত হেসে মালুর প্রশ্নের জবাব দেন সৈয়দ-গিন্নী।

ধনী হলেও পরহেজগার নেকবক্ত লোক। চব্বিশ ঘণ্টার মাঝে ষোল ঘন্টাই তাঁর কাটে এবাদত বন্দেগিতে। এত ধন দৌলত নিয়েও কিন্তু সুখ নেই তাঁর। জীবনের একমাত্র সাধ তাঁর আল্লাকে দেখবেন। তাই দিনে দিনে এবাদত যায় বেড়ে, ঘণ্টার পর ঘণ্টা পড়ে থাকেন সেজদায়। রাতে এশার নামাজ সেরে তাহাজ্জত পড়েন সেই রাত অবধি। বুঝিবা একটু চোখ বোজেন, কিন্তু উঠে পড়েন মোরগ ডাকারও আগে। সোবে সাদেকের সময় যিকির করেন, ফজরের নামাজ সারেন। তারপর কোরান তেলাওয়াত করেন সেই বেলা অবধি। এ ভাবেই দিন যায়। মাস যায়। বছর গিয়ে আবার ঘুরে আসে।

কত বছর যে কেটে যায়। তবু আল্লার সাক্ষাৎ পান না তিনি।

নামাজ এবাদত আরো বাড়িয়ে দিলেন তিনি। খোদার ধ্যানেই মগ্ন রইলেন সারাদিন। এক একটা সেজদা দেন, ঘণ্টা যায় কেটে, মাথা তোলেন না। যে ঘরে খাওয়া সেই ঘরেই এবাদত সেই ঘরেই শোয়া, ঘর ছেড়ে বের হন না তিনি। এক রাত, সোবে সাদেকের একটুখানি আগে ঘুমিয়ে পড়েছেন তিনি, ঘুমের ঘোরেই শুনতে পেলেন ছাদের উপর কারা যেন চলে বেড়াচ্ছে। শব্দ হচ্ছে ধুপধাপ খুটখাট। ঘুম তার ভেঙে গেল। অমনি শব্দটাও থেমে গেল।

দ্বিতীর রাত।

তৃতীয় রাত।

চতুর্থ রাত।

একই শব্দ ধুপধাপ খুটখাট। ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই মিলিয়ে যায় সব রকমের শব্দ। এ কী ব্যাপার? কিসের শব্দ? মানুষই যদি হবে তবে তাঁর ঘুম ভাঙতে না ভাঙতেই ধুপধাপটা থেমে যাবে কেন?

তিনি ছাড়া আর কেউ থাকেন না তেতলায়। ছাদে উঠবার সিঁড়িটাও তাই ঘরের ভিতর দিয়ে। সে সিঁড়িতে মস্ত বড় তালা। তবু শব্দ হয় প্রতি রাতে, কারা যেন চলে বেড়ায়। ইয়া আল্লা। এ কী তোমার লীলা! আল্লার দরবারে কেঁদে পড়েন সাধক পুরুষ। কেঁদে কেঁদে জায়নামাযটা ভিজিয়ে ফেললেন। সে রাতে আল্লার নাম করে শুলেন তিনি। শোবার আগে সেই পুরাতন প্রার্থনাটিও করলেন, আল্লা, তোমার দর্শন চাই। কী আশ্চর্য। সেই একই ধুপধাপ খুটখাট শব্দ শুনলেন। সঙ্গে সঙ্গে শুধালেন–তুমি যেই হও ওখানে কর কী? উত্তর এল–গরু ঘোড়াকে খাওয়াই।

অবাক হলেন সাধক পুরুষ। এ কী তাজ্জব ব্যাপার। আমার তেতলার ছাদে গরু ঘোড়া কখন আর কেমন করেই বা উঠবে! আর সেখানে গরু ঘোড়াকে ঘাস খাওয়াবার স্পর্ধাই বা কার? পরের রাতে আবার একই শব্দ। শুধালেন, যেই হও জবাব দাও, গরু ঘোড়ার ঘাস কী আমার তেতলার উপর? অমনি উত্তর এল–খোদা কী তেতলায় থাকেন?

গায়ে যেন কাঁটা বিঁধল সাধক পুরুষের। চমকে উঠলেন তিনি। ভাবলেন দিন ভর, রাত ভর। দিলে তাঁর সদমা এল, ছটফটিয়ে সময় কাটে তার। বুঝলেন এ হচ্ছে খোদারই গায়েবী আওয়াজ। ডাকলেন ছেলেদের, বললেন, বাবারা, তোমাদের বিষয় সম্পত্তি তোমরাই বুঝে নাও, আমি চললাম খোদার রাহে।

কিছু খানা আর সামান্য বিছানাপত্র নিয়ে রওয়ানা হলেন তিনি, যে দিকে দুচোখ যায়।

যেতে যেতে দেখলেন একটা লোক পুকুরের ঘাটে নেমে আঁজলা ভরে পানি খাচ্ছে। প্রশ্ন এল সাধকের মনে, আমি চলেছি খোদার সন্ধানে, আর থালা বাটি গেলাস না হলে খাওয়া চলে না আমার? থালা বাটি গ্লাস ওই পুকুরেই ছুঁড়ে ফেলে দিলেন তিনি।

চলতে চলতে এবার দেখলেন, পথের পাশে গাছতলায় শিকড়ে শিথান দিয়ে দিব্যি আরামে ঘুমুচ্ছে একটি লোক। ঘুমন্ত লোকটার দিকে তাকিয়ে ভাবলেন সাধক; তোষক চাদর বিছানা কিছু নেই লোকটার অথচ কী নিশ্চিন্ত আরামে ঘুমুচ্ছে : আর আমি চলেছি খোদার অন্বেষণে বিছানা বালিশের গাঁটরি লয়ে? গাছতলায় ওই নিদ্রিত লোকটার পাশেই বিছানা বালিশগুলো রেখে এগিয়ে চললেন সাধক।

পথ চলেন সাধক। পথের যেন শেষ নেই। খোদারও সাক্ষাৎ নেই। তবু তিনি চলেন। বৃষ্টিতে ভেজেন। রোদে গা শুকিয়ে নেন। তবু বিরতি আসে না তার চলার।

এক জায়গায় দেখলেন রাস্তার উপর একেবারেই উলঙ্গ একটি লোক নামায পড়ছে। তাঁর সন্দেহ হল লোকটা নিশ্চয়ই পাগল। তবু জিজ্ঞেস করলেন ল্যাংটা যে নামাজ পড়ছ বড়, ল্যাংটা কী নামাজ হয়? ত্বরিতে জবাব এল লোকটির–আমি ল্যাংটাই এসেছি পৃথিবীতে, সেই ল্যাংটা ভাবেই ডাকি খোদাকে।

উত্তর শুনে স্তম্ভিত হয়ে গেলেন খোদা-অন্বেষী সাধক। নিঃসন্দেহ হলেন তিনি, পাগল নয় লোকটি, হয়ত কোনো আওলিয়া দরবেশ। প্রশ্ন জাগল সাধকের মনে, তবে আমিইবা কেন এত কামিজ, জামা-জোব্বা আলখাল্লা পরে রয়েছি? গায়ের বাহুল্য লেবাসে তিনি ছুঁড়ে ফেললেন পথের ধূলোয়।

দিন যায়, মাস যায়, খাবার গিয়েছে ফুরিয়ে। পথে পথে চেয়ে মেঙ্গে খান। না পেলে উপোস দেন। উপোস চলে কখনো দিনের পর দিন। তবু সাধক পথ চলেন আর একমনে ডাকেন খোদাকে। গ্রীষ্মের খরতাপে, শান্তিতে তৃষ্ণায় বুকের ছাতি তার ফেটে যেতে চায় তবু মুখ থেকে আল্লার নাম পড়ে না। সম্পূর্ণ রিক্ত, সর্ব লোভ সর্ব বিলাস মুক্ত কামিল পুরুষ তিনি। তাঁর ডাকে কেঁপে ওঠে খোদার আরশ। এবার সাড়া না দিয়ে পারেন না খোদা। খোদা হুকুম দিলেন জিব্রাইলকে; যাও দুনিয়াতে। দেখ, কী চায় আমার ওই ভক্ত বান্দা।

জিব্রাইল তীরের বেগে নেমে এসে শুধাল, কী চাও সাধক?

আমি চাই খোদাকে দেখতে, অকুতোভয়ে বললেন সাধক।

ফিরে গিয়ে জিব্রাইল খোদার নিকট পেশ করল সাধকের আর্জি। শুনে খোদা বললেন তুমিই খোদা, সেই পরিচয় দাও তার সামনে।

তথাস্তু।

জিব্রাইল সাধকের কাছে এসে বলল আমিই খোদা।

কেন যেন সায় দেয় না সাধকের মন। জিজ্ঞেস করেন, খোদাতালাই কী তোমায় পাঠিয়েছেন?

মিথ্যে বলতে পারল না জিব্রাইল, বলল, খোদাই আমাকে পাঠিয়েছেন। ক্ষোভে অভিমানে কান্না এসে যায় সাধকের চোখে। সর্বস্ব ত্যাগ করেছেন তিনি, গায়ের শেষ বস্ত্রটিও পথের ধারে নিক্ষেপ করে নিঃস্বের মতো ছুটে বেড়াচ্ছেন। এক ধ্যান, এক জপ তাঁর–আল্লা আল্লা। তবু কী আল্লার দর্শন পাবেন না তিনি? চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে বললেন সাধক, জিব্রাইল, খোদাকে বল আমি যে তাঁরই দর্শনপ্রার্থী।

উত্তর নিয়ে ফিরে এল জিব্রাইল। না, খোদা বলেছেন, কোনো আদম সন্তান তাঁকে দেখতে পায় না, দেখতে পাবে না।

হা আল্লা, এত পরীক্ষার পর এই তোমার কথা? কিন্তু ধৈর্য হারালেন না সাধক, শান্ত আর দৃঢ় স্বরে বললেন : জিব্রাইল, আবার যাও তুমি। বিশাল অদৃশ্য এই সৃষ্টির মালিক সেই পরোয়ারদেগারকে আমি দেখবই।

অদৃশ্য ডানায় ভর দিয়ে উড়ে যায় জিব্রাইল। চক্ষের নিমেষেই ফিরে আসে। একই উত্তর খোদার। কিন্তু স্বীয় প্রার্থনা থেকে এক ইঞ্চিও টললেন না সাধক। ব্যর্থ যাবে তাঁর আজন্ম এবাদতবন্দেগী সাধনা? তিনি বলেন, যাও জিব্রাইল, আবার যাও।

কতবার যে জিব্রাইল যায় আর আসে তার বুঝি কোনো ঠিক ঠিকানা থাকে না। অমন যে ফেরেশতা জিব্রাইল সেও বুঝি দৌড়াদৌড়িতে হয়রান পেরেশান হয়ে ওঠে। শেষবার জিব্রাইল এসে বলল : হে রসুলের উন্মত। প্রস্তুত হও! সর্বশক্তিমান প্রভু তোমাকে দর্শন দেবেন।

জিব্রাইলের কথাটা ফুরোতে না ফুরোতেই কোত্থেকে যেন কোটি তারা আর লক্ষ চাঁদ নেবে এল পৃথিবীর বুকে, আলোয় আলোয় ভরে গেল পৃথিবী। অপূর্ব সে আলো, সেই আলোর ছটায় উদ্ভাসিত দিগদিগন্ত। সাধককে ঘিরে যেন লক্ষ আলোক শিখার নাচন। ঝলসে গেল সাধকের চোখ। বেহুঁশ তিনি লুটিয়ে পড়লেন মাটিতে।

কাহিনী শেষ করে চোখের পানি মুছলেন সৈয়দগিন্নী, তসবির ছড়াটা কোল থেকে জায়নামাযের উপর রেখে মুনাজাত করলেন। তার দেখাদেখি শ্রোতারাও হাত তুলল আকাশের দিকে, ওদেরও চোখ অশ্রুসজল। আ-মি-ন। আমিন সবার আগে সশব্দে এবং টেনে টেনে দুবার উচ্চারণ করল মালু। তারপর উঠে এল পড়ার টেবিলে।

বসে আছে সেকান্দর, কখন গল্প শেষ হবে, উঠে আসবে ওর ছাত্র-ছাত্রীরা। ধর্মকর্মের কথা তেমন করে ও ভাবে না। ভাববার ফুরসুতই বা কোথায়? তবু সৈয়দগিন্নীর কাহিনীটা শুনে মনটা ওর ভিজে যায় আর কেমন অবাক হয় ও। ইহলোক আর পরলোকের সুস্পষ্ট সমন্বয় যে ধর্মে সেখানে কেমন যেন বেখাপ্পা এই কাহিনী। দীনে আর দুনিয়ায়, আখেরাত আর বাস্তবের পৃথিবী, এ দুয়ের মাঝে প্রত্যক্ষ সমন্বয় সৈয়দবাড়ি। চল্লিশের ওপারের পুরুষ মহিলারা সবাই হজ্জ সেরে এসেছেন। কর্তা সৈয়দ দুদুবার হজ্জ করেছেন। নিজের ইংরেজি ডিগ্রী আর ইংরেজের আপিসে বড় চাকুরিটার সাথে লম্বা দাড়ি, লম্বা কোর্তা আর মদিনা শরীফের গোল টুপীর লেবাসটাকে অতি সহজে মানিয়ে নিয়েছেন তিনি। সেই সৈয়দ বাড়ির কর্ত্রীর মুখে ত্যাগী সাধকের কাহিনীটি কেমন যেন বেমানান মনে হয় সেকান্দরের কাছে। এ বুঝি একান্ত দেশজ উপাদান, বাংলার মাটিতে লালিত নারীমন, ত্যাগব্ৰতী সাধকের পায়ে যেমন অর্ঘ্য ঢেলেছে যুগে যুগে।

আখেরাতের নেয়ামত পেতে হলে ছাড়তে হবে দুনিয়ার লালসা। যিনি সেই নির্লোভ এবাদতী, খোদার নেয়ামত তাঁরই জন্য। তিনিই পাবেন খোদার সান্নিধ্য। মোনাজাত শেষ করে কাহিনীর চুম্বকটি শোনালেন সৈয়দগিন্নী। কাহিনীর রেশ এখনো বুঝি আচ্ছন্ন করে রেখেছে ওদের। ফ্যাচ ফ্যাচ করে নাক ঝাড়ছে হুরমতি। দূরে রাখা হ্যারিকেনের টিমটিমে আলোটা ওর মুখের কাছটিতে এসে কী যেন ঔজ্জ্বল্যের সন্ধান পেয়ে চিকচিকিয়ে উঠছে। মাথায় ঘোমটা নেই ওর। সেকান্দরের দৃষ্টিটা অজানতেই হুরমতির কপালের উপর স্থির হয়ে থাকে। ক্ষতটা শুকিয়ে গেছে। দূর থেকে নজরে পড়ে একটি গোল কালচে মতো দাগ, যেন বড় রকমের একটা টিপ পরেছে হুরমতি। ওকে যতই দেখছে অবাক হয়ে যাচ্ছে সেকান্দর মাস্টার। এত যে ঝড় বয়ে গেল মেয়েটার উপর দিয়ে, একটুও দমাতে পারেনি ওর উদ্ধত বেপরোয়া স্বভাবটাকে। পঞ্চায়েতের নিষেধ কোনো বাড়িতেই বন্ধ করতে পারেনি ওর যাতায়াত। বন্ধ করতে পারেনি প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রামের পথ দিয়ে ওর চলা। সেকান্দরের চোখটা কেমন নির্লজ্জের মতো পড়ে থাকে হুরমতির মুখের উপর। আরিফার পাশেই, বসে আছে ও, একই কাঁচা হলুদ গায়ের রং, টিকোল নাক, টলটলে চোখ; সাদা শাড়ির শুভ্র মোড়কে ধরা নিখুঁত প্রতিমার মতো। মেয়েটির দিকে তাকিয়ে কে বলবে এ বাড়ির মেয়ে নয় ও!

ভেঙে গেল আসর। মাথার কাপড় টেনে পড়তে এল রাবু আর আরিফা। কাহিনীটি থেকে কী শিখলে বল তো? জিজ্ঞেস করল সেকান্দর। ওদের বিমূঢ় মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে নিজেই উত্তরটা দিয়ে গেল ও! অসম্ভবও সম্ভব হয় যদি থাকে নিষ্ঠা, সুদৃঢ় মনোবল আর ত্যাগের স্পৃহা। দেখলে না কত দুঃখ কত ক্লেশ পদে পদে মাড়িয়ে এগুলেন ওই মহাসাধক, এক মুহূর্তের জন্যও দ্বিধা আসেনি, সংশয় আসেনি তার মনে। এক মুহূর্তের জন্যও দুর্বল হয়নি, হতাশায় ঢলে পড়েননি তিনি। এমন সাধনায় কখনো সিদ্ধি না এসে পারে? এই সাধনা কী শুধু ওই মহাসাধকের? সত্য দর্শনের এই সাধনা সকল মানুষের। সমস্ত পৃথিবীর, যুগে যুগে মানব সভ্যতার অগ্রগতির ভিত গড়েছে অজেয় মনের এই অক্লান্ত সাধনা। শ্রোতাদের চেয়েও নিজেকে শোনাবার জন্যই যেন কথাগুলো বলে গেল সেকান্দর, কী এক আবেগ ঢেলে, গভীর কোনো অনুভূতির রস নিঙড়িয়ে। আর ওর কচি শ্রোতারা হাঁ করে গিলে গেল মূল্যবান উপদেশগুলো।

কিন্তু, একি? রাবুর চোখে পানি কেন?

সেই তখন থেকে কাঁদছে ও, চাচাজানের কথা মনে পড়েছে হয়ত, বলল আরিফা।

না ছিঃ কেঁদো না। আচ্ছা যাও, আজ আর পড়তে হবে না। সুমুখে খোলা বইটা বন্ধ করে দিল সেকান্দর। মালুর খাতাটা টেনে নিয়ে মন দিল ওর হাতের লেখায়।

আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে উঠে যায় রাবু। বুঝি অনেক কিছুই মনে পড়ছে ওর। কোনো ঝাপসা স্মৃতি, অস্পষ্ট কোনো মুখ, মুখের আদল। হয়ত টুকরো কোনো কথা সেই মৃতা মায়ের কোলে বসে শোনা। এখন সে সবের কিছুই মনে নেই ওর। তবু কী যেন মনে পড়ে আর চোখ ফেটে কান্না আসে।

দশের উপর তিন বসিয়ে অর্থাৎ মালুকে ফেল করিয়ে খাতাটা ওকে ফেরত দেয় সেকান্দর। একটা দীর্ঘশ্বাস পাক খেয়ে খেয়ে উঠে আসে ওর বুক ঠেলে। কবে দেখেছে রাবুর আব্বাকে মনে করতে পারে না সেকান্দর। সৈয়দবাড়ির বুজুর্গ এলেমদার পুরুষ। দেশি বিদেশি, ইংরেজি আরবি ফারসি, কত বিদ্যে তাঁর। সেই মানুষ, হঠাৎ কী যেন হয়ে গেল, তাজা বউ আর তিন মাসের মেয়েটিকে ছেড়ে বেরিয়ে গেল ঘর ছেড়ে। সে তো প্রায় তের-চৌদ্দ বৎসর আগের কথা। কোথায় কোথায় যে ভেসে বেড়াচ্ছে লোকটা, আজ যদি খবর আসে নোঙ্গর ফেলেছে বেরিলীতে তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, চলে গেছে দেওবন্দে। হঠাৎ হয়ত খবর পাওয়া গেল বড় পীর সাহেবের মাজার জিয়ারতে গেছে বাগদাদে, সেখান থেকে কারবালায়। মাঝে দুএকবার বাড়ি এসেছিল, কয়েক ঘণ্টা, বড়জোর একদিনের জন্য। শেষবার এসেছিল বোধ হয় বছর পাঁচ ছয় আগে। মহাসাধকের গল্প শুনে সেই দেওয়ানা বাপটির কথাই কী মনে পড়ে গেছে রাবুর।

কী ঠিক করলে, বাবা? পাশে এসে শুধালেন সৈয়দগিন্নী।

জী, এখনো যে বুঝতে পারছি না! আমতা আমতা করে কানের উপরকার চুলগুলো টানতে টানতে বলে সেকান্দর।

এতে আবার বুঝাবুঝির কী আছে, বাবা? লোক রাখবে, তারা তদারক করবে, তুমি শুধু দেখবে যাতে নষ্ট না হয় কিছু। তাতে সময় লাগবে তোমার। এটা ঠিক। কিন্তু সেটা তো আমি পুষিয়ে দেব, বাবা? বুঝি এখুনি ওর মুখের হাঁ-টা শোনার জন্য তাকিয়ে থাকেন সৈয়দগিন্নী।

গরিব স্কুল মাস্টারের মনে কেন এত দ্বিধা, কেন এত সংশয়, সৈয়দগিন্নী কী কখনো বুঝবেন? সেকান্দর মাস্টার নিজেও তো বুঝতে পারছে না সৈয়দগিন্নীর অযাচিত অনুগ্রহদানের এই উগ্র ইচ্ছাটাকে। হয়ত উপকারের ইচ্ছে আদৌ নেই সৈয়দগিন্নীর। সৎ আর বিশ্বাসযোগ্য লোকের হাতে আপন সম্পত্তির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসে তিনি নিশ্চিন্ত হতে চান মাত্র। আর কিছু নয়।

নিরুত্তর সেকান্দর মাথা চুলকায়। স্যান্ডেলের উচ্চ শব্দে অসন্তোষ জানিয়ে রসুই ঘরের দিকে চলে যান সৈয়দগিন্নী।

১৫.

গ্রামের চাঁদনিটা মনকে বুঝি উন্মনা করে, নিভৃত কোণ থেকে টেনে নেয় বাইরের জগতে। বাইরের বিশাল প্রকৃতিটার সাথে মিলিয়ে মিশিয়ে একাকার করে দেয় মনের নিজস্ব কোনো অস্তিত্বের জগৎকে। মনটা পাখা মেলে, জোছনার তরঙ্গে দোল খেয়ে খেয়ে গলে পড়া রাতের রহস্যে উধাও হতে চায়। সেই চাঁদজাগা রাতে সৈয়দবাড়ি থেকে ফেরার সময় এত কথা মনে হয়নি সেকান্দরের, কিন্তু মনে আছে, কেমন ভালো লেগেছিল ওর।

আজকের রাতটা অন্ধকার। জমাট ঘন এই অন্ধকারের রূপ। খোলামেলা বিস্তীর্ণ পৃথিবীটাকে সে যেন মুঠোর মাঝে একটুকু করে নিয়েছে। চেতন-অচেতনের দূরত্ব ঘুচিয়ে দিয়ে বস্তুটাকেই করে তুলছে মুখ্য।

মনের চিন্তাগুলোকেও যেন সমস্ত অস্বচ্ছতা আর দ্বিধামুক্ত করে স্পষ্ট ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য করে তুলেছে। এই বুঝি অন্ধকার রাতের প্রকৃতি। পথ ঠাওর করে হাঁটতে হাঁটতে ভাবে সেকান্দর, সত্য আর অপরাধকে গোপন করার জন্যই নাকি অন্ধকারের সৃষ্টি। সজাগকে ঘুমের অচৈতন্যে বিলীন করাই নাকি অন্ধকারের কাজ। অথচ কথাটাকে ঘুরিয়ে বললেই যেন সত্য বলা হয়। অন্তত সেকান্দরের তাই মনে হল। অন্ধকার ওর বিক্ষিপ্ত চেতনাকে এদিক ওদিক থেকে কুড়িয়ে এনে সুষ্ঠু এক সংহতির রূপ দিয়ে গেল। ওর মনের সুপ্ত অথবা জাগ্রত চিন্তাগুলোকে অবয়ব দিয়ে স্পষ্ট করে তুলে ধরল ওরই চোখের সুমুখে! সহসা কী এক তীক্ষ্ণতায় আপনাকে অনুভব করল সেকান্দর। এমন করে নিজেকে কখনো অনুভব করেনি ও। সেই চকিত অনুভবটাই বুঝি একটি প্রশ্নের আকারে এই অন্ধকার রাতে ঘিরে ধরল ওকে। অখ্যাত গ্রাম্য জীবনে, গরিব শিক্ষকের বিড়ম্বিত প্রাত্যহিকতার মাঝেও কোনো সাধনার ধন কী খুঁজে পাওয়া যায় না? সাধকের গল্পটি মনে মনে নাড়াচাড়া করতে গিয়ে এ কী প্রশ্ন উঠে আসে! চঞ্চল আর দ্রুত হয় সেকান্দরের পদক্ষেপ। বিদ্যায় বুদ্ধিতে মানুষ করতে হবে ভাইটিকে, নিজের যত অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষা তারই মাঝে রূপায়িত হবে, এতদিন এটাকেই তো এক মাত্র সাধনা বলে জেনে এসেছে সেকান্দর। আজকের অন্ধকারে মনে হলো ওটা আরো হাজারটি স্বার্থবোধের মতোই একটি সংকীর্ণ স্বার্থ চিন্তা। যে স্বার্থ জ্ঞানে ফেলু মিঞা উন্মাদ, রমজান হিংস্র, রামদয়াল নিষ্ঠুর সৈয়দগিন্নী চতুরা, সেকান্দর মাস্টারও তেমনি একটা স্বার্থপর বুঝি। তবে…?

সহসা মনের মাঝে গজানো অনেক আগাছা যেন ছেঁটে ফেলে দেয় সেকান্দর। না সৈয়দগিন্নীর অনুগ্রহটা গ্রহণ করবে না ও। ওতে ছোট করা হবে নিজেকে, নিজের শিক্ষকতার পবিত্র ব্রতকে। গ্রাম্য কোন্দলে জড়িয়ে পড়ে শুধু ঝন-ঝাট আর নোংরামিই ডেকে আনবে নিজের উপর। আর ছোট ভাই সুলতান? নিজের আয়ে নিজের শ্রমেই ওকে মানুষ করবে সেকান্দর।

সুঁচ চলে না এমনি ঘন আর নিরেট অন্ধকারে কী যেন আলোর সন্ধান পেয়ে গেল সেকান্দর মাস্টার। এমনিই বুঝি হয়। আচম্বিতেই ঘুরে যায় জীবনের মোড়।

কিন্তু, লেকুটার হল কী? কতদিন ধরে সেকান্দরের ধারে কাছে ঘেঁষছে না ও। সবাই মিলে গেল ফেলু মিঞার কাছে, লেকু যায়নি। নিজেকেই অপরাধী মনে হয় সেকান্দরের। সেদিনকার সেই সকাল বেলায় কেমন ঘৃণা আর খেদ মিশিয়ে বলেছিল লেকু, আমরা তো অমানুষের জাত। সেই কথা আর ক্রুদ্ধ লেকুর সেই মুখটা মনে পড়ল সেকান্দরের। ওর এতটুকু ভরসা নেই সেকান্দরের উপর। তাই নিজের পথেই বুঝি চলেছে ও। রামদয়ালের কাছে জমি রেহান দিয়ে টাকা এনেছে লেকু। মিঞার বকেয়া পাওনা শোধ দিয়েছে। ইস্ কী বিষ মিশিয়েই না রমজান সেকান্দরকে শুনিয়ে গেল কথাটা। এত বিষ ওর হিংসায়? গতরাতে নিজের ঘর থেকেই চেঁচিয়েছিল রমজান : হল তো এখন? জোট বাঁধ ওই ছোট লোকদের নিয়ে? কেমন সটকে পড়ল জোটের পালোয়ানটা। জ্ঞাতি ভাইয়ের দুশমনি করলে এমনিই হয়। আরো দুর্ভোগ আরো অপমান সেকান্দরের নসিবে আছে এটা হলফ করেই বলে দিতে পারে রমজান।

অবশ্য রমজানের ক্রোধের হেতুটা অন্য। তলে তলে একটু আধটু সুদী কারবার করছে ও, সবাই জানে। সেটা জানা সত্ত্বেও বাকুলিয়ায় ওর স্বধর্মী ভাই বেরাদাররা ছুটে যাবে বিধর্মী রামদয়ালের কাছে, এটা ওর পক্ষে অসহ্য। রামদয়ালের কাছে জমি বন্ধক রেখেছে লেকু, এ খবরটা পেয়ে তাই গোটা শরীরে আবার আগুন ধরেছিল রমজানের। তেতে উঠেছিল ওর মাথার ঘিলুটা। শুধু তো একটা দাঁও ফসকে গেল না, আরও একটা প্রতিশোধ নিল লেকু, আচ্ছা রকম জব্দ করল রমজানকে। গাই গরুটাকে জখমী করেও বুঝি ওকে এতটা বেচাইন করতে পারেনি লেকু।

সহসা মুসলমান জাত সম্পর্কে দিব্যজ্ঞান লাভ করল রমজান। মুনিব ফেলু মিঞার সাথে আজ একমত হল ও।

মুসলমান–তায় আবার কমজাত, ছোট লোকের বাচ্চা। কী হবে এই জাতের? মুনিব ফেলু মিঞার অনুকরণে মনে মনেই আফসোস করে রমজান। ফেলু মিঞার এই উক্তিটা বিশেষ ভাবেই আজ ভালো লেগে গেল রমজানের। শালা কমজাত কমিনা; কী ক্ষতি হত জমিটা রমজানের কাছে বন্ধক দিলে? টাকা কী কম পেত লেকু, নাকি কম দিত রমজান? গ্রামের জিনিস গ্রামেই থাকত, তারই জাত ভাইয়ের জিম্মায়। হাজার শত্রুতা থাকুক, রমজান তো মুসলমান, রামদয়াল হিন্দু–মুসলমানের শত্রু। শালা যদি মরিস এখন, কে যাবে তোর গোর খুঁড়তে? ওই রামদয়াল, না তোর পড়শী জাত ভাইরা? ফেলু মিঞার দুর্বোধ্য সেই বিক্ষোভের উৎসটা এমনি করে দিনের মতো পরিষ্কার হয়েছিল রমজানের কাছে। মুনিবের প্রতি মনে মনে সালাম জানিয়েছিল রমজান। আর রাত্রে খেতে বসে মনের জ্বালা ঝেড়েছিল জ্ঞাতি দুশমন সেকান্দরকে উপলক্ষ করে।

কিন্তু বলা নেই কওয়া নেই, জমিগুলো রেহান দিয়ে দিল কেন লেকু? দরজার হুড়কোটা টেনে দিয়ে বিছানায় গাটা এলিয়ে দিতে দিতে ভাবে সেকান্দর মাস্টার। পাশের চৌকিতে অঘোরে ঘুমুচ্ছে ছোট ভাই সুলতান। ওর নিশ্বাসের বাতাসটা সেকান্দরের গায়ে এসে লাগছে। অন্ধকারেই ওর দিকে একটা সস্নেহ দৃষ্টি পাঠিয়ে পাশ ফেরে সেকান্দর।

হয়ত ঘুমিয়ে পড়েছিল ও। হঠাৎ দরজার বেড়ার উপর কী যেন খস খস করে ওঠে। বেড়ার উপর কোনো ছোট হাতের কয়েকটা ধাক্কাও পড়ল বুঝি। ঘুমটা ভেঙে গেল সেকান্দরের। কানটা খাড়া করে ও শুনতে পেল নীচু মেয়েলী কণ্ঠস্বর–মাস্টার সাব, মাস্টার সাব।

ওকেই ডাকছে। কিন্তু, এত রাতে কে-ই বা ডাকবে ওকে! তার উপর মেয়েলী স্বরে? অন্ধকারেই পায়ের ইশারায় এগিয়ে এসে দরজায় হুড়কোটা খুলে ফেলল সেকান্দর।

হুরমতি? কী হল হুরমতির? এই গভীর রাতে সেকান্দর মাস্টারের কাছে কী প্রয়োজন পড়ল ওর? হুরমতির সঙ্গে মালু। সেকান্দর কোনো কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই হড় হড় করে লম্বা এক বৃত্তান্ত দিয়ে গেল মালু যার সবটা বুঝে নেওয়া দুঃসাধ্য। ঘরে ফিরে পিরানটা গায়ে চাপিয়ে বেরিয়ে এল সেকান্দর।

রাস্তায় পড়ে ওর ভুলটা ভেঙে গেল। রাত গভীর নয়, শেষ প্রহরটা যাই যাই করছে। চাঁদটা মরার আগে ম্লান আর বিমর্ষ মুখে চেয়ে আছে পৃথিবীর দিকে। কয়েকটা বাদুড় ফর ফর বাতাস কেটে উড়ে গেল মাথার উপর দিয়ে। এই রাতের বেলা কোত্থেকে একটা বাজপাখি ডেকে উঠল। কী বিশ্রী আর কর্কশ গলাটা।

শীতটা ফুরিয়ে আসছে। মাঝে মাঝে ঠাণ্ডা হাওয়ার দমক কামড়ে যাচ্ছে গাটা। পায়ের তলায় শিশির ভেজা মাটিটা কেমন মৃদুল কোমল। মাঝে মাঝে সিক্ত ঘাসের শীর্ষ পায়ে পায়ে কী যেন আদর বুলিয়ে দিচ্ছে। সব মিলিয়ে কেমন এক ভালো লাগা জড়িয়ে থাকে সেকান্দরকে ঘিরে। আর যেন অনেক বিস্ময় সহসা আঘাত করেছে ওর দুয়ারে তেমনি করে ও তাকায় পাণ্ডুর চাঁদটার দিকে, শেষ রাতের ফিকে জামায় আবৃত গাছের ঝোঁপগুলোর দিকে। বাকুলিয়ার শেষ রাত যে সুন্দর, এ কথাটা এতদিন কেমন করে অজানা থেকে গেল ওর কাছে। কী এক স্নিগ্ধতার পরশে গাটা ওর জুড়িয়ে যায়। মিষ্টি একটা স্বাদে ভরে যায় মুখটা। এমনি আরো অনেক স্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়েই বুঝি কেটে গেছে জীবনের আটাশটি বছর। চিন চিন করে জেগে ওঠা কোনো ব্যথার মতোই কথাটা মনে এল সেকান্দরের। বাতাসে কেমন থকথকে হয়ে লেগে রয়েছে হুরমতির ফুলেল তেলের গন্ধটা। কী এক উদ্বেগে কাতর ওর মুখটা। কিসের যেন ব্যাকুলতায় দ্রুত, আর এলোমেলো ওর পদক্ষেপ। ওকে ঘিরে শেষ রাতের রহস্য। মনে পড়ল সেকান্দরের এই রাতেই প্রথম প্রহরে দেখেছিল ভক্তির রসে উদ্বেল হৃদয়টা ভাসিয়ে কাঁদছিল মেয়েটি। আর এই শেষ প্রহরের রহস্য মোড়া মেয়েটির বুকে কত দুর্ভাবনার দুরু দুরু কম্পন কে জানে!

হুরমতির খবরে আর মালুর বয়ানে এতটুকু অতিরঞ্জন নেই। কসিররা চলে যাচ্ছে।

ওদের দোচালা ঘরটির সামনে সাদা উঠোনটুকু ফিকে জোছনায়ও কেমন ধবধবে। দু বউ এক ছেলের সংসারে যা কিছু সম্পত্তি উঠোনে নামিয়ে গাঁটরি বাঁধছে কসির। কী-ই বা সম্পত্তি। খান তিনেক কাঁথা, মাটির হাঁড়ি, মাটির বাসনখোরা, একটা এলমিনিয়ামের বাটি, দুটো এনামেলের ছড়া-ওঠা গামলা, পিঁড়ি। কথাগুলোর আলাদা একটা গাটরি করে ওর ভেতর দা কাস্তে আর কুঠারটা সেঁদিয়ে দেয় কসির। একটা কোরায় হাড়ি পাতিলগুলো ভরে মাছ ধরার কোঁচটা হাতে নেয়, তারপর বউদের ডাকে–চল্। লম্বা ঘোমটা টেনে কাঁদছে বউরা। আঁচলের খুঁটে চোখ মুছছে ঘন ঘন। ভিটির প্রতি মেয়েদেরই বুঝি টান বেশি। নীড় রচনায় হৃদয়ের অবদানটা পুরুষদের চেয়ে ওদেরই বেশি, তাই নীড়ের প্রতি এত মমতা ওদের। কসির ঘর গড়েছে আবার গড়বে। তাই ভাঙতেও বুঝি দ্বিধা নেই ওর। কিন্তু বউরা? তৈরি করা ঘর ফেলে যেতে কলজেটা ওদের ছিঁড়ে যাচ্ছে।

এই খবরদার। ফ্যাঁস ফ্যাঁস করবি তবে চোখের উপর বসিয়ে দেব এই কোঁচ। খেঁকিয়ে ওঠে কসির। ওর হাতের চাপে ঝনঝনিয়ে ওঠে কোঁচের শলা। কাঁথার গাঁটরিটা কাঁধে নিয়ে বলল লেকু, হয়েছে বউদের উপর আর মরদগিরি ফলিয়ে কাম নেই, এগোও তুমি।

সত্যি কী চলে যাচ্ছে কসির? রাত্রির আবরণ নিয়ে সকলের অলক্ষে ফেলু মিঞার বকেয়া খাজনা আর রামদয়ালের ঋণ ফাঁকি দিয়ে? ওকে কেমন করে ঠেকাবে সেকান্দর? ওর কাঁধে হাত রাখল সেকান্দর, বুঝি বলতে চাইল যাসনে ভাই কসির, সুখ দুঃখ আহার অনাহার সবই আমরা সমানভাবে ভাগ করে নেব। ছাড়িসনে বাপ-দাদার ভিটিটা। ঠিক এ কথাগুলো বলার জন্যই তো হুরমতি ঘুম ভাঙিয়ে তুলে এনেছে ওকে। কিন্তু, বলতে পারল না সেকান্দর। কিসের ভরসায় ওকে থেকে যেতে বলবে সেকান্দর।

ফজর আলী যেন একেবারে ছিপি এঁটে দিয়েছে মুখে। মনমরা হয়ে চলেছে। সবার পেছনে। অথচ সেদিন ও-ই-তো পয়লা মনে করিয়ে দিয়েছিল বাপ-দাদার ভিটির কথা। আজ সে-ও বুঝি খুঁজে পায় না কোনো কথা।

ভাড়া-করা নৌকাটা বাঁধা আছে বড় খালে। লেকু আর কসির বোঝাগুলো নামিয়ে রাখল। তারপর কসিরের হাত ধরে বাচ্চা কোলে বড় বউ আর ছোট বউ উঠে গেল। এক পা পাটাতনে আর এক পা কাদায় রেখে কসির বিদায় নিল ওদের কাছ থেকে। সেকান্দরের হাতে হাত রেখে। অকস্মাৎ ডুকরে কেঁদে উঠল ও–মাস্টারসাব মানুষ হয়ে লই, মানুষ হয়ে আবার আসব!

মানুষ হবে কসির? তাই ঠিক। তাই ঠিক। কসির, মানুষ হয়েই ফিরে এস তুমি। পানিতে ভরে গেল সেকান্দরের চোখ।

কলকলিয়ে চলেছে জোয়ারের পানি। জোয়ারের টানে যেন উড়ে চলল নৌকোটা। পাড় থেকে চেয়ে থাকে ওরা, যতক্ষণ না মিলিয়ে যায় নৌকোটা। ছইয়ের বাইরে মাথাটা উঁচিয়ে কসিরও বুঝি জন্মভূমির শেষ ছবিটা দেখে নিচ্ছে, বুক ভরে টানছে বড় খালের চেনা বাতাস। আর আজন্ম চেনা মানুষের ছায়াগুলোও যখন হারিয়ে যাবে দৃষ্টির বাইরে তখন হয়ত ওদের মুখগুলোই সে ভাসিয়ে তুলবে আপন মনের পটে।

কোথায় যাবে কসির? হয়ত আসামের গহিন অরণ্যে। পূর্ববঙ্গের কত কৃষক সেখানে নীড় বেঁধেছে, ভয়ঙ্কর নিস্তব্ধ অরণ্য অঞ্চলকে মানুষের কাকলিতে মুখর করে তুলেছে। তাদেরই সাথে নতুন করে ঘর বাঁধবে কসির। ওর কুঠারের আঘাতে পায়ে পায়ে পিছু হটবে জঙ্গল। হিংস্র পশুর দেহ খণ্ড বিখণ্ড হবে ওর বর্শাফলকের মুখে। বশ মানবে বিরোধী প্রকৃতি। তারপর সবল দুটি হাতের সঞ্চালনে লতাগুল্মের ঘন আগাছা, ছিন্নকাণ্ড উপরে ফেলবে ও, বের করবে তুলতুলে নরম মাটি। সে মাটিতে ফসল বুনবে। মাটি আর ফসলের সে-ই হবে অধীশ্বর।

কিন্তু, সেখানেও কী সুখের মুখ দেখবে কসির? আরো কত ফেলু মিঞা আরো কত রামদয়ালের পাওনার হাত কী হন্যে হয়ে পিছু পিছু তাড়া করবে না ওকে?

নাঃ, কসির ফিরবে না। বুঝি অসাবধানেই সেকান্দরের মনের চিন্তাটা মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।

ওরা চমকে উঠল। সত্যিই তো, যারা গেছে তারা ফিরেছে কেউ? কেউ ফেরেনি। ষোল ঘর লোক নিয়ে কেমন জম-জমাট থাকত মাঝি বাড়িটা। আজ মোটে তিন ঘর, তিনটি পরিবার। মৃধা বাড়িটা তো বিরানাই হয়ে গেল। একমাত্র রহমত বুড়ো বুঝি তার চেয়েও বয়সে বড় ভাঙাচোরা গরুর গাড়িটা নিয়ে টিম টিম করছে অতবড় বাড়িটাতে। পরিত্যক্ত ভিটিগুলোতে এখন শুধু আগাছার জঙ্গল।

নাঃ কসির ফিরবে না, ভরা গাঙ্গের কুলকুল জোয়ারেও বুঝি সেই একই প্রতিধ্বনি।

চল ফিরি।

ওরা বসে পড়েছিল। সেকান্দরের ডাক শুনে বুঝি চমকে উঠে শেষ বারের মতো বড়খালের দূরতম বাঁকটির উপর অন্বেষা দৃষ্টি বুলিয়ে আনে। বড় খালের কোলে কী যেন চিরদিনের জন্য বিসর্জন দিয়ে গেল ওরা।

চাঁদটা যে কখন ডুবে গেছে টের পায়নি কেউ। যে ঈষৎ ভেজা হিমটা এতক্ষণ লেগেছিল পায়ের ডগায় সেটা উঠে এসেছে হাঁটু অবধি। একটু পরেই, বুঝি ফর্সা হয়ে যাবে। এখনকার আকাশটা দেখা না দেখার কেমন এক রহস্য আর দখিন ক্ষেতের বুক চিরে মাটির রাস্তাটা অস্পষ্ট ইশারা।

বইয়ে পড়া, ছোট বেলায় কিছুটা বুঝি চোখেও দেখা সোনার বাংলা সোনার গ্রাম। ভেঙে যাচ্ছে সেই গ্রাম বাংলার গাঁথুনি।

এদিক ওদিক ছিটকে পড়ছে মানুষগুলো। ঘুঘু চড়ছে শূন্য ভিটায়। কে রুখবে, কেমন করে রুখবে এ ভাঙন?

কেমন মুঠো হয়ে আসে সেকান্দরের হাতজোড়া। বুঝি অস্বাভাবিক রকমের শব্দ করেই বেরিয়ে আসে ওর মনের বিক্ষোভটা। হকচকিয়ে তাকিয়ে থাকে বাকুলিয়ার লেকু আর ফজর আলী, কলঙ্কিনী হুরমতি আর মায়ের মার খাওয়া ছেলে মালু : কী হল সেকান্দর মাস্টারের?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *