কুড়ি মিনিট পরে লছমন একটি সুন্দর দোতলা বাড়ির সামনে রিকশা থামিয়ে বলল, এইটা ভোম্বলদার বাড়ি।
পাশেই জেলা স্কুল। ছেলেবেলায় এই পাড়াটায় দোতলা বাড়ি দেখেনি অনিমেষ। বোঝাই যাচ্ছে পরে চেহারা বদলেছে। লছমনের সাহায্যে সে রিকশা থেকে নেমে গেট খুলে বাগানের ভেতরে ঢুকল। দোতলার বারান্দা থেকে একজন মহিলা জিজ্ঞাসা করলেন, কাকে চাই?
ভোম্বলবাবু আছেন?
এখন বিশ্রাম নিচ্ছেন। পরে আসুন।
অনিমেষ ইতস্তত করছিল, এই সময় একজন বৃদ্ধ গেট খুলে ভেতরে ঢুকলেন। বয়স বাড়লেও মুখটা বদলায়নি। অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কমলবাবু–?
হ্যাঁ। আপনি?
আমি অনিমেষ মিত্র। জেলাস্কুলের ছাত্র ছিলাম।
অনিমেষ, অনিমেষ, নাঃ, মনে পড়ছে না। ডোম্বলের কাছে এসেছেন?
হ্যাঁ। কিন্তু উনি বিশ্রাম নিচ্ছেন।
আসুন। নীচের একটি ঘরে অনিমেষকে বসিয়ে কমলবাবু চলে গেলেন। তার মিনিট পাঁচেক বাদে টাক মাথা, লম্বা যে লোকটি ঘরে এলেন তিনি পান চিবোচ্ছেন। চেয়ারে বসে চোখ ছোট করে বললেন, আরে কী খবর? কেমন আছেন?
আপনি আমাকে চিনতে পারছেন? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।
হে হে। এতবছর রাজনীতি করছি ব্রেনটা তো এমনি এমনি স্ট্রং হয়নি। আমাদের এই পাড়ার কাউকে ক্রাচ হাতে চলতে দেখিনি। গতকালই শুনলাম এক ভদ্রলোক এসেছেন যাকে ওইটের ওপর নির্ভর করে হাঁটতে হয়। কে ভদ্রলোক? না, তিনি আমাদের পাড়ার মিত্তির বাড়িতে উঠেছেন। তখনই মনে পড়ে গেল। আমাদের বঙ্কিমদার মুখে শুনেছিলাম, মিত্তিরবাড়ির একজন আমাদের পার্টি করতেন, পরে নকশাল হয়ে গিয়ে জেলে যান, পুলিশের অত্যাচারে একটা পা খোয়া যায়। সেটা অবশ্য সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের আমল। আমরা ক্ষমতায় এসে আপনাদের জেল থেকে ছেড়ে দিই। কী? ঠিকঠাক বলছি কি না? ভোম্বলবাবু হাসলেন।
তথ্যে একটু ভুল থেকে গেল!
কীরকম? কীরকম?
বামফ্রন্ট আমাদের ছেড়ে দেয় বন্দিমুক্তি আন্দোলন হয়েছিল বলে!
দুর মশাই। আন্দোলন ফান্দোলন করে কিছু পাওয়া যায় নাকি? সরকার যদি বলে আমি রাজি নই, কোনও আন্দোলনই তাকে রাজি করাতে পারবে না। ভোম্বলবাবু বললেন।
কী আশ্চর্য। আপনি কমিউনিস্ট হয়েও এমন কথা বলছেন?
না না ভুল কথা। আমি কমিউনিস্ট নই। আমি পার্টির একজন সাধারণ কর্মী। যাক গে, নকশাল আন্দোলন করে জেল থেকে বের হওয়ার পর আপনি বসে গিয়েছেন?
আমি এখন আর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নই।
কেন? শরীরের জন্যে?
না। মন নিতে পারছে না।
যাক। কেন এসেছেন সেটা শোনা যাক।
এখানকার বাড়িতে আমার মা ছাড়া আর কেউ থাকেন না। তার বয়স হচ্ছে, আর একা থাকা সম্ভব হচ্ছে না। অবশ্য একটি পরিবার ভাড়াটে হিসেবে আছে, তাতে কোনও সুরাহা হচ্ছে না। আপনি বোধহয় জানেন, উনি বাড়িটা বিক্রি করে দিতে চান। অনিমেষ যতটা সম্ভব সবিনয়ে জানাল।
বিলক্ষণ জানি। আমি তো গিয়েছিলাম মাসিমার কাছে, বলেছিলাম, আপনার থাকা-খাওয়ার সব দায়িত্ব আমার। প্রতিদিন দুবেলা আমার লোক এসে জেনে নেবে আপনার কী কী দরকার। এ পাড়ার কোনও মা একা থাকতে পারছেন না বলে বাড়ি বিক্রি করে চলে যাবেন, এ তো আমারই লজ্জা। তা উনি রাজি হলেন না। ভোম্বলবাবু আপশোসের ভঙ্গি করলেন।
অনিমেষ বলল, কীভাবে বাড়িটা বিক্রি করা যায়?
ডিফিকাল্ট। গম্ভীর হলেন ভোম্বলবাবু।
কেন?
মিউনিসিপ্যালিটির কমিশনার হিসেবে আমি জানি, গত বারো বছর ধরে আপনারা বাড়ির ট্যাক্স দেননি। জমতে জমতে সুদে আসলে ঠিক কী পরিমাণে পৌঁছেছে তা খোঁজ নিয়ে জানতে হবে। এতদিন দেননি বলে মিউনিসিপ্যালিটি পেনাল্টিও করতে পারে। এই অবস্থায় কে বাড়ি কিনবে বলুন?
এই ব্যাপারটা আমি জানতাম না।
ঠিক আছে, আপনি আমার বাড়িতে এসেছেন, আমি খোঁজ নিয়ে দেখছি।
বাড়ির ট্যাক্স কি খুব বেশি?
না, না। সামান্য। ওটা আমার ওপর ছেড়ে দিন।
তা হলে–!
শুনুন। আমাদের পাড়ায় মা-কালীর কোনও মন্দির নেই। মানুষকে এখনও অনেকটা হেঁটে যোগমায়া কালীবাড়িতে যেতে হয়। তাই সবাই চাইছে একটা মন্দির তৈরি করতে। এর জন্যে আমার বাড়ির কাছাকাছি একটা জমিও পেয়ে গেছি। কিন্তু শুধু জমি পেলেই তো মন্দির হয় না। বলুন হয়?
নীরবে মাথা নাড়ল অনিমেষ।
আর চারটে দেওয়ালের ওপর ছাদ করে তার মধ্যে তো মাকে ঢুকিয়ে দিতে পারি না। লোকে বলবে ভোম্বলবাবু দায়সারা কাজ সারল। এমন একটা মন্দির তৈরি করতে হবে যার প্রশংসা পুরো নর্থ বেঙ্গলের মানুষের মুখে মুখে ছড়াবে। আর শুধু মন্দির করলেই তো হল না, মায়ের মূর্তিটাও ফাটাফাটি হওয়া চাই। প্রচুর খরচ। লোকে অবশ্য চাঁদা দিচ্ছে। তা, আপনি যদি সাহায্য করেন। ভোম্বলবাবু হাত জোড় করলেন।
আপনি বললেন কমিউনিস্ট পার্টিকে সমর্থন করেন, পার্টির কর্মী। আপনি কী করে কালীমন্দির তৈরির সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন? অনিমেষ জিজ্ঞাসা না করে পারল না।
কিছু মনে করবেন না অনিমেষবাবু, অনিমেষই তো, হা, দুঃখ হয় যখন দেখি আপনারা এখনও একশো বছর পিছিয়ে আছেন। গঙ্গা দিয়ে কত জল বয়ে গেল, কিন্তু আপনাদের কোনও পরিবর্তন হল না। আপনারা বলেছিলেন, চিনের চেয়ারম্যান নাকি আপনাদের চেয়ারম্যান। পাবলিক আপনাদের অ্যাকসেপ্ট করেনি। কিন্তু যদি বলতেন, চৈতন্যদেব আপনাদের চেয়ারম্যান– বাংলা-ওড়িশা আপনাদের মাথায় করে রাখত। মার্কস সাহেব তার দেশে বসে কমিউনিজম নিয়ে ভেবেছেন, সেটা যেসব দেশ আঁকড়ে বসে ছিল সেখান থেকে কমিউনিজম হাওয়া হয়ে গিয়েছে। প্রত্যেক দেশের নিজস্ব পরিমণ্ডল আছে, মানুষের মানসিকতাও আলাদা। আমি আপনি রাতারাতি বদলাতে পারব? পারব না। তাই আমাদের আদর্শকে সেই মাটির সঙ্গে মিশিয়ে তৈরি করতে হবে। তা ছাড়া একটা মন্দিরকে আপনি অন্ধ সংস্কারের প্রতীক হিসেবে দেখছেন কেন? তাকে ঘিরে হাজার হাজার মানুষ জমায়েত হবে, তাদের কাছে পৌঁছোবার জন্যেও তো আমরা মন্দিরটাকে ব্যবহার করতে পারি।
ভোম্বলবাবু এতক্ষণ বক্তৃতার ঢঙে বলে যাচ্ছিলেন। তারপর একগাল হেসে বললেন, আপনি আমার সঙ্গে সহযোগিতা করুন, আমি অল আউট করব।
কীভাবে?
আপনাদের বাড়িটা বিক্রি করলে কত পাবেন? অনেকটা জমিও তো আছে!
আমার কোনও ধারণা নেই। অনিমেষ বলল।
চোখ বন্ধ করে একটু ভাবলেন ভোম্বল রায়, অ্যারাউন্ড টোয়েন্টি। আঠারো তো পাবেনই। একটা কথা জিজ্ঞাসা করছি। এই টাকা কীভাবে খরচ হবে?
মায়ের নামে ব্যাঙ্কে থাকবে, ওঁর যা ইচ্ছে তাই করবেন।
উনি থাকবেন কোথায়?
এখনও জিজ্ঞাসা করিনি। ইচ্ছে হলে আমাদের সঙ্গে থাকতে পারেন। নইলে সুদের টাকায় স্বচ্ছন্দে একটা ছোট ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে থাকবেন।
খুব ভাল কথা। উনি তো সন্তানহীনা। ওঁর যা কিছু তা আপনিই পাবেন। দেখুন অনিমেষবাবু, এই বাড়ি বিক্রি না হলে আপনি কিছুই পেতেন না। আর একটা সমস্যা আছে। শুনেছি বাড়ি বানিয়েছিলেন আপনার ঠাকুরদা। তিনি আপনার বাবাকে আইনসম্মতভাবে দিয়ে গিয়েছেন? আপনার বাবা কি কোনও উইল করে মাসিমাকে বাড়ি জমি দিয়েছেন? ভোম্বলবাবু তাকালেন।
আমি ঠিক জানি না। অনিমেষ মাথা নাড়ল।
তা হলে খোঁজ করুন, কোনও উইল আছে কিনা? না থাকলে মাসিমা এবং আপনি উত্তরাধিকারী হবেন। অবশ্য সেটা আইনসম্মত করে নিতে হবে। এমন কিছু সমস্যা নয়। কিন্তু উইলে যদি আপনার বাবা আপনাকে বঞ্চিত করে যান তা হলে মাসিমার অবর্তমানে তার সম্পত্তি আপনি পেতে পারেন না। আশা করি তা হয়নি। হ্যাঁ, প্রায় পড়ে পাওয়া চৌদ্দো আনার মতো আপনি লক্ষ লক্ষ টাকা পেয়ে যাচ্ছেন। আমার অনুরোধ, তার অতি সামান্য অংশ দিয়ে মায়ের মূর্তিটি আপনি কিনে দিন। খাস ফেললেন ভোম্বলবাবু।
মায়ের মূর্তি? অনিমেষ অবাক।
হ্যাঁ, মন্দিরের ভেতরে যে মা কালীর মূর্তি থাকবে, যাঁকে লক্ষ লক্ষ মানুষ পুজো করবে, তা আপনি দিয়ে পুণ্য অর্জন করুন। মাথায় দুটো হাত ঠেকালেন ভোম্বলবাবু।
অনিমেষ কী বলবে বুঝতে পারছিল না। খরচ এমন কিছু বেশি নয়। অষ্টধাতুর মূর্তি। একটু বড় না হলে তো চোখে পড়বে না। মায়ের পায়ের মল আর রুপোর খাড়া। লাখ পাঁচেক আমাকে দিলে আমি কিনে নেব। আরে মশাই, আপনি যা পাচ্ছেন তার টোয়েন্টি পার্সেন্টে জনগণের সেবা করবেন। ঠিক আছে? আপনার স্ত্রী এসেছেন তো? তার সঙ্গে কথা বলে জানাবেন। আমি সব ব্যবস্থা করে খদ্দের নিয়ে আসব। আচ্ছা, আমাকে একটু পার্টি অফিসে যেতে হবে। উঠে দাঁড়ালেন ভোম্বলবাবু।
অনিমেষ উঠে দাঁড়াল, আপনি যে এসব করছেন, তা আপনার পার্টি জানে?
দেখুন মশাই, আমি কি চুরি করছি যে লুকিয়ে করব? নৃপেনদাকে মনে আছে? ছেলেবেলা থেকে সিপিআই করতেন, পরে সিপিএমে। জেলা সম্পাদক হয়ে আছেন বহু বছর। তাঁকে নিয়ে এসে মন্দিরের জমিটাকে দেখিয়েছি। পার্টি থেকে কোনও সাহায্য নেব না বলেই তো আপনাদের কাছে হাত পাতছি। মন্দিরের গায়ে শ্বেতপাথরের ফলকে মাসিমার নাম লিখে জানিয়ে দিতে পারি তিনিই দান করেছেন। চলুন। বাইরে বেরিয়ে রিকশাটাকে দেখলেন ভোম্বলবাবু। চেঁচিয়ে বললেন, অ্যাই, দাঁড়িয়ে আছিস বলে ওয়েটিং চার্জ নিবি না। আমার লোক।
লছমন সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল। অনিমেষ রিকশায় না ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা না করে মোটরবাইকে চেপে বেরিয়ে গেলেন ভোম্বলবাবু।
রিকশা চালাতে চালাতে লছমন বলল, উনি বাইক চালান, গাড়িতে ওঠেন না। গাড়ি চড়েন ওঁর ছেলে, বউ।
অনিমেষ গম্ভীর হয়ে বসে ছিল।
.
বাড়িতে ঢুকে অনিমেষ দেখল ছোটমা বারান্দায় বসে একটি বালকের সঙ্গে বেশ হাসিমুখে গল্প করছেন। অনিমেষকে দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, কী হল? মুখ গম্ভীর কেন?
অনিমেষ মাথা নাড়ল। পেছন পেছন আসছিল লছমন। চেঁচিয়ে বলল, বাবা, বাবুকে প্রণাম কর।
বালক এগিয়ে এসে প্রণাম করতে চাইলে অনিমেষ তাকে বাধা দিল, না না। প্রণাম করতে হবে না। তুমি কে?
লছমন পাশে এসে বলল, আমার ছেলে। মাসিমা ওকে খুব ভালবাসেন।
ছোটমা বললেন, লক্ষ্মী ছেলে। আমার কথা খুব শোনে। আয় বাবা।
তোমার নাম কী?
অর্জুন। ডাকনাম, বাবা। বালক বলল।
বাঃ। এরকম ডাকনাম তো কখনও শুনিনি।
জন্মাবার পরে ওকে বাবা বলে ডাকা শুরু হয়। সেটাই ওর ডাকনাম হয়ে গেছে। লছমন বলল। আঁচলের খুঁট থেকে এক টাকার কয়েন বের করে বাবার হাতে দিয়ে ছোটমা বললেন, লজেন্স কিনে খাস।
আপত্তি করল লছমন, না না দেবেন না। অভ্যেস খারাপ হবে।
তুমি চুপ করো। ধমক দিলেন ছোটমা, যা বাবা। সন্ধে হয়ে আসছে। বাড়ি গিয়ে পড়তে বস। লছমন, অন্ধকার হয়ে আসছে, তুমি ওর সঙ্গে যাও।
লছমন ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে চলে গেলে মাধবীলতা ঘর থেকে বেরিয়ে এল, কী হল?
সংক্ষেপে ভোম্বলবাবুর বক্তব্য জানাল অনিমেষ।
মাধবীলতা বলল, সেকী? পার্টির অবস্থা এখানে এইরকম হয়েছে?
এখানে? রেগে গেল অনিমেষ, কোথায় নয়? কলকাতায় দেখোনি? আমাদের পাড়ায় ভোম্বলবাবু নেই?
কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির হয়ে যিনি ভোটে লড়াই করেন তিনি কালীবাড়ির জন্যে চাপ দিয়ে টাকা তুলবেন? এক পয়সা দেবে না ওঁকে। বেশ জোরে কথাগুলো বলল মাধবীলতা।
আমি কি দিতে চাইছি? কিন্তু এমনভাবে জাল বিছিয়ে রেখেছে যে তা কেটে বাড়ি বিক্রি করা কতটা সম্ভব হবে তা জানি না। অনিমেষ বলল।
এই যে পার্টির জেলা সম্পাদক, একে তুমি চেনো?
এককালে চিনতাম। বারীনদার স্টুডিয়োতে আসতেন।
ওঁর সঙ্গে কথা বলবে?
দেখি, ওঁর মদত না পেলে ভোম্বলবাবু এত সাহস পাবে?
তোমার সঙ্গে কথা বললে ভদ্রলোকের মন বদলাতে পারে।
কী জানি! ছোটমা এতক্ষণ শুনছিলেন, বললেন, থাক। এত ঝামেলা হচ্ছে যখন তখন বাড়ি আর বিক্রি করতে হবে না। আমি এখানেই মরব। ওই লছমন আছে, বাবাও আসে, ওরা নিশ্চয়ই আমাকে শ্মশানে নিয়ে যাবে।
মাধবীলতা ধমক দিল, পাগলের মতো কী যা তা বলছেন?
মা, তুমি এখানে আমার মতো মাস দুয়েক থেকে দেখো, তুমিও পাগল হয়ে যাবে। ছোটমা আঁচলে মুখ মুছলেন।
অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, এই বাড়ির মিউনিসিপ্যাল ট্যাক্স দেওয়া হয় না?
হত। তোমার বাবা বেঁচে থাকতে নতুন করে ট্যাক্স চাইল। তোমার বাবা প্রতিবাদ করলেন, অন্যায়ভাবে বেশি ট্যাক্স চাওয়া হয়েছে। না কমালে ট্যাক্স দেবেন না। সেই যে বন্ধ হল, আর দেওয়া হয়নি। ছোটমা বললেন।
আগের রশিদগুলো আছে?
সব একটা ফাইলে তোমার বাবা রেখে গেছেন। প্রতিবাদের চিঠিও ওখানে আছে।
আমাকে দেখতে হবে।
মাধবীলতার মনে পড়ে গেল, ওহো! অর্ক ফোন করেছিল।
কী বলল?
আমরা এখানে কতদিন আছি জানতে চাইল।
কতদিন থাকব তা বলা সম্ভব নয়। আমি এর শেষ দেখতে চাই।
আমিও আন্দাজে বললাম, এখনই ফিরছি না। শুনে বলল, ও ছুটি নিয়ে কয়েকদিনের জন্যে এখানে আসতে পারে। মাধবীলতা বলল।
ছোটমা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ওকে আসতে বলেছ তো?
মাধবীলতা হেসে উঠল, হ্যাঁ।
অনিমেষ ভিতরের ঘরে চলে গেলে ছোটমা বললেন, একটু বসো। মাধবীলতা একটা মোড়া টেনে বসল, কিছু বলবেন? হ্যাঁ। তোমরা তো বিয়ে করোনি, না সই করে, না মন্ত্র পড়ে। তাই তো?
হ্যাঁ। মাধবীলতা বলল।
ছেলে তো জানে।
জানে। কিন্তু মেনে নিয়েছে।
আমিও এর মধ্যে অন্যায় দেখিনি। তুমি অনির জন্যে যা করেছ তা কটা মন্ত্র পড়া, সই করা বউ স্বামীর জন্যে করে থাকে। কিন্তু! ছোটমা থামলেন।
কিন্তু কী?
তোমার শ্বশুরমশাই মানতে পারেননি। আমি তাকে অনেক বুঝিয়েছিলাম কিন্তু তিনি গোঁ ছাড়েননি। আর সেইজন্যে একটা অন্যায় করে গেছেন।
কী অন্যায়?
ছোটমা উঠে মাধবীলতার হাত ধরে বললেন, এসো। নিজের ঘরে ঢুকে আলমারি খুললেন ছোটমা। তারপর লকার থেকে একটা বড় খাম টেনে এনে স্ট্যাম্প পেপার সমেত তিনটি কাগজ বের করলেন। বললেন, যক্ষের মতো পাহারা দিয়ে যাচ্ছি। আজ মুক্তি চাই। এই উইলে তোমার শ্বশুর তার যাবতীয় সম্পত্তি আমাকে দিয়ে গেছেন। শর্ত দিয়েছেন, অনিকে কিছু দিতে পারব না। দেখো।
মাধবীলতা পড়ল। পড়ে হেসে ফেরত দিতেই ছোটমা দ্রুত উইলটাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করতে লাগলেন। মাধবীলতা চেঁচিয়ে উঠল, একী! কী করছেন আপনি?
.
১২.
উইলের ছোঁড়া টুকরোর কয়েকটা মেঝেতে পড়ে গিয়েছিল, মাধবীলতা সেগুলো তুলে ছোটমায়ের সামনে ধরতে তিনি সবগুলোই তার হাতে দিয়ে দিলেন।
মাধবীলতা বললেন, কাজটা আপনি ঠিক করলেন না।
এটা করতে চাই বলেই তোমাদের আসতে বলেছিলাম। আমি ঠিকই করেছি। করেননি তোমার শ্বশুরমশাই। আমি কে? ওঁর দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী হিসেবে এই বাড়িতে এসেছিলাম। তারপর থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসে
আছি। একটুও ভাল লাগত না। ছোটমা বললেন।
এখন এগুলো নিয়ে কী করব?
পুড়িয়ে ফেলো, ছাই হয়ে যাক। বলেই তার মনে পড়ল, আর একটা কাজ করতে হবে। তিনি তো শুধু উইল করেই চুপ করে যাননি। উকিলকে দিয়ে কী সব করিয়েছেন। আমাকে কপি দিয়েছেন। আসলটা আছে উকিলের কাছে। অনিকে ডাকো তো! ছোটমা ঘরের বাইরে এসে বারান্দার আলো জ্বেলে মোড়ায় বসলেন।
মাধবীলতা শঙ্কিত হল, আমার মনে হয় উইল ছেঁড়ার কথা ওকে না বলাই ভালো।
কেন? ছোটমা তাকালেন।
ও মানতে পারবে বলে মনে হয় না।
আমি যা ভাল মনে করেছি তাই করেছি। বেশ জোরে কথাগুলো বললেন।
ডাকতে হল না মাধবীলতাকে, অনিমেষ বেরিয়ে এল ঘর থেকে। জিজ্ঞাসা করল, নেলকাটার আনোনি?
মাধবীলতা কিছু বলার আগেই ছোটমা বললেন, সন্ধের পর নখ কাটতে হবে না। কাল সকালে কেটো। তুমি একটু এখানে এসো, কথা আছে।
কাছে এসে অনিমেষ মাধবীলতার দিকে তাকাতেই লক্ষ করল তার দুটো হাত একত্রিত, সেখানে কিছু কাগজের টুকরো রয়েছে। সে ইশারায় জিজ্ঞাসা করল, ওসব কী? মাধবীলতা মাথা নাড়ল, ঠিক কী বোঝাতে চাইল তা বোঝা গেল না।
অনি। তুমি কি রায়বাবুকে চিনতে? ছোটমা জিজ্ঞাসা করলেন।
কোন রায়বাবু?
ওকালতি করেন। বাবুপাড়ায় থাকেন। তার বাবাও ওকালতি করতেন।
অনিমেষ মনে করার চেষ্টা করল। ঝাপসা মনে পড়ল যাঁর কথা, তার মুখ অস্পষ্ট। সে জিজ্ঞাসা করল, ঠিক কোথায় থাকেন?
আমি জানি না। তোমার বাবা যেতেন। তিনি যখন বেঁচে ছিলেন তখন ভদ্রলোক একবার এই বাড়িতে এসেছিলেন। ছোটমা বললেন।
কোনও দরকার আছে তার সঙ্গে?
হ্যাঁ, ছোটমা বললেন, তোমার বাবার করা উইলের কপিটা তার কাছ থেকে নিয়ে আসবে। বাবুপাড়ার সবাই রায় উকিলকে চেনে।
অনিমেষ হাসল, তিনি আমাকে দেবেন কেন?
আমি একটা চিঠি লিখে দেব। সেটা তাকে দিলে না দেওয়ার তো কোনও কারণ নেই। তোমার বাবা বলতেন ওঁর কাছে সকাল আটটায় যেতে হয়। তারপর নাকি কোর্টের জন্যে তৈরি হন। তুমি ওই সময়েই যেয়ো।
.
কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ালেন ছোটমা।
কিন্তু উইলটা কী জন্যে দরকার?
আমার দরকার আছে। তুমি যেতে না পারলে আমাকেই যেতে হবে। ছোটমা নিজের ঘরে চলে গেলে মাধবীলতা বলল, ঘরে চলো।
ঘরে ঢুকে অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল, কী ব্যাপার বলো তো?
মাধবীলতা উইলের টুকরো কাগজগুলো টেবিলের ওপর রাখল।
ওগুলো কী?
এখন বাতিল কাগজ।
আঃ, হেঁয়ালি করছ কেন? মাধবীলতা ঘুরে দাঁড়াল, তোমার বাবা নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী একটা উইল করে গিয়েছেন। তাতে তিনি যাঁকে তার সম্পত্তি দিতে চান তাঁকেই দিয়ে গেছেন। কিন্তু যাঁকে দিয়েছিলেন তিনি ওটা মেনে নিতে পারেননি। তিনি সেই উইলটা ছিঁড়ে ফেলেছেন, এগুলো তার টুকরো।
ছোটমা তোমার সামনে কাজটা করলেন?
হ্যাঁ। মাধবীলতা মাথা নাড়ল।
আর তুমি সেটা চেয়ে চেয়ে দেখলে?
আমি আপত্তি করেছিলাম, উনি শোনেননি। ওঁর মনে হয়েছে এই সম্পত্তির অধিকার পাওয়ার যোগ্যতা ওঁর নেই। আমি অবাক হয়ে গিয়েছি। গোটা পৃথিবী জুড়ে যখন মানুষ কিছু পাওয়ার জন্যে লালায়িত হয়ে আছে তখন এই অসহায় মহিলা কী অবলীলায় অন্তত কুড়ি লাখ টাকার সম্পত্তি প্রত্যাখ্যান করলেন। ওঁর সম্পর্কে আমার শ্রদ্ধা অনেক বেড়ে গেল। মাধবীলতা খাটের ওপর বসল।
বাবা যদি আমাকে কিছু দিতে না চেয়ে থাকেন তো ঠিক মনে করেই করেছেন।
হ্যাঁ। কিন্তু তার কারণ তুমি নও, আমি।
তুমি?
আমাকে তোমার স্ত্রী হিসেবে তিনি গ্রহণ করতে পারেননি।
তাতে আমাদের তো কিছু এসে যায়নি!
যায়নি। কিন্তু ছোটমার মন মানেনি। উনি আমাদের এখানে আসার জন্যে অপেক্ষা করছিলেন। মাধবীলতা বলল।
এখন কী চাইছেন ছোটমা?
আমাকে স্পষ্ট করে কিছু বলেননি।
আমি কিন্তু এসবের মধ্যে নেই। অনিমেষ মাথা নাড়ল।
আমার কিছু বলার নেই। তোমার যেটা করতে ইচ্ছে হবে সেটাই করবে। কিন্তু কাল মিস্টার রায়ের বাড়িতে যেয়ো। মাধবীলতা বলল।
আমার যেতে ইচ্ছে করছে না লতা।
ভেবে দেখো। ওঁর যা শরীরের অবস্থা–!
বেশ। যাব। উইলটা যদি ভদ্রলোক দেন, এনে দেব। কিন্তু আমি যে এসবের মধ্যে নেই তা ওঁকে জানিয়ে দেব। অনিমেষ বলল।
.
লছমনের দেখা পাওয়া গেল না। টাউন ক্লাবের মোড় থেকে অন্য একজনের রিকশা নিল অনিমেষ। এখন সকাল পৌনে আটটা। আজ বাজারে যাওয়ার ঝামেলা নেই।
আগে করলা নদীর ওপর ঝুলনা ব্রিজ ছিল। সেটা ভেঙে অনেকদিন আগেই কংক্রিটের সেতু তৈরি হয়েছে। সেই সেতুর ওপর রিকশা উঠতেই মন খারাপ হয়ে গেল অনিমেষের। এখন করলাকে আর নদী বলা যাবে না। এমনকী খালও নয়। মজে গিয়ে জল না থাকলে নয় এমন অবস্থায় স্থির হয়ে আছে। আগে মানুষ জাল ফেলে মাছ ধরত, করলার বুকে নৌকো চলত, বিজয়াদশমীর রাত্রে তো প্রতিমা নিয়ে প্রচুর নৌকো উৎসবটাকে আরও সুন্দর করে তুলত। এখন সেসব উধাও। দেখলেই মন খারাপ হয়ে যায়। করলার পাশ ধরে থানাকে ডানদিকে রেখে অনিমেষ বাঁদিকে ঘুরতেই লম্বা লোকটিকে দেখতে পেল। বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
এই মানুষটির চেহারার পরিবর্তন তেমন হয়নি। শুধু বয়সের ছাপ পড়েছে। অনিমেষ চিনতে পারল। সে যখন স্কুলের শেষ ধাপে এবং তারপরে কলেজের ছাত্র তখন এই মানুষটি টাউন ক্লাব দলের গোলকিপার ছিলেন। দারুণ খেলতেন তখন।
রিকশাওয়ালাকে একটু থামতে বলে অর্জুন গলা তুলল, কেমন আছেন সন্তুদা?
ভদ্রলোক তাকালেন। বোঝাই যাচ্ছিল, চিনতে পারছেন না। বললেন, ঠিক–!
আপনার সঙ্গে বহু বছর আগে কয়েকবার কথা হয়েছিল। আপনার খেলা দেখতে খুব ভাল লাগত তখন। আমি অনিমেষ, অনিমেষ মিত্র, একসময় হাকিমপাড়ায় থাকতাম। অনেকদিন ধরে কলকাতায় আছি। অনিমেষ বলল।
অনিমেষ! দাঁড়ান দাঁড়ান, আপনি কি রাজনীতি করতেন? নকশাল রাজনীতি? সন্তুবাবু মনে পড়ার ভঙ্গিতে জিজ্ঞাসা করলেন।
কিছুদিন ওই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত ছিলাম। তারপর পুলিশ। হেসে নিজের পা দেখিয়ে দিল অনিমেষ।
আমি আপনার কথা শুনেছি। কোথায় কার কাছে শুনেছি জানেন? চৌধুরী মেডিক্যাল স্টোর্সের রামবাবুর কাছ থেকে। উনি আপনাকে খুব স্নেহ করেন।
ঠিকই।
কবে এসেছেন?
এই তো সবে।
আপনাদের বাড়ি তো হাকিমপাড়ায়-?
হ্যাঁ।
আচ্ছা, শুনেছি এখন যাঁরা সিপিএমের মন্ত্রী, নেতা তারা একসময় আপনার খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আপনিও তখন সিপিএম করতেন। এখন আপশোস হয় না?
কীসের আপশোস? কোনও আপশোস নেই। আচ্ছা, আপনাদের পাড়ায় মিস্টার রায়, যিনি ওকালতি করেন, কোথায় থাকেন? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।
বলাইদা। সোজা যান। এস পি রায়ের বাড়ির আগে ডান দিকের গলিতে ঢুকে দেখবেন গেটে ওঁর নাম লেখা আছে। সন্তুবাবু বললেন।
থ্যাঙ্ক ইউ। মাথা নেড়ে অনিমেষ রিকশাওয়ালাকে চলতে বলল।
বাড়িটাকে খুঁজে পেতে এবার আর অসুবিধে হল না। রিকশাওয়ালার সাহায্য নিয়ে অনিমেষ রিকশা থেকে নেমে গেট খুলে এগিয়ে গেল ক্রাচ নিয়ে। বাইরের ঘরে অন্তত জনা আটেক মানুষ অপেক্ষা করছেন। পাশের ঘরের দরজায় পরদা রয়েছে। অতএব অনিমেষকে বসতে হল। সাড়ে আটটার মধ্যে যাঁরা ভেতরে যেতে পেলেন তার সমান সংখ্যার মানুষ বাইরে বসে থাকলেন। সাড়ে আটটায় বেরিয়ে এলেন শ্রীযুক্ত বলাই রায়। মাথায় টাক, আশির আশেপাশে বয়স। সামনে দাঁড়িয়ে বলাইবাবু বললেন, জরুরি দরকার মনে করলে কোর্টে আসুন। আজ একটা থেকে দেড়টা ফাঁকা আছি। এখন আর কথা বলতে পারছি না।
বাকিরা মাথা নেড়ে মেনে নিলেও অনিমেষ বলল, একটা কথা বলতে পারি?
নিশ্চয়ই, বলুন।
অনিমেষ ছোটমায়ের লেখা চিঠি এগিয়ে দিল। ভদ্রলোক সেটা খুলে পড়লেন, আপনি অনিমেষবাবু, মহীতোষবাবুর ছেলে?
হ্যাঁ।
এই চিঠি মহীতোষবাবুর স্ত্রী লিখেছেন?
হ্যাঁ, চিঠিতে তিনি সেটা জানিয়েছেন।
কিছু মনে করবেন না। মহীতোষবাবুর স্ত্রীর হাতের লেখা আমি চিনি না। এই চিঠি যে তিনিই লিখেছেন তা বুঝব কী করে? বলাইবাবু হাসলেন।
মুশকিল হল, ওঁর পক্ষে আসা বেশ কষ্টকর ব্যাপার।
বুঝলাম। কিন্তু উইল নিয়ে তিনি কী করতে চান?
আমার জানা নেই।
দেখুন ভাই, মহীতোষবাবুর মৃত্যুর পরে আমি তার কাছে খবর পাঠিয়েছিলাম যাতে তিনি উইলের প্রবেট নিয়ে নেন। কিন্তু তখন তিনি রেসপন্ড করেননি।
আমি এসব কিছুই জানি না।
ঘড়ি দেখলেন বলাইবাবু, যদি ধরে নিই, চিঠিটা তিনিই লিখেছেন, তা হলে আপনাকে আমার কাছে পাঠানোটা বিস্ময়কর। কেন তা আপনাকে বলছি না। সেই জন্যে আমার মনে চিঠির জেনুইনিটি নিয়ে সন্দেহ জাগছে। মহীতোষবাবুর সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক ছিল। তাই আজ কোর্ট থেকে ফেরার সময় আমি নিজে ওঁর সঙ্গে দেখা করে কথা বলব। আচ্ছা, নমস্কার। একটানা কথাগুলো বলে বলাইবাবু ভেতরে চলে গেলেন। কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকল অনিমেষ। তবে মনে হচ্ছিল বলাইবাবু যা বলেছেন তাতে একটুও অন্যায় নেই। যাকে উইলে কিছু দিতে নিষেধ করে যাওয়া হয়েছে তাকেই কেন উইলের অরিজিন্যাল কপি নিতে পাঠাবেন ছোটমা? বিশ্বাস করাটা তো সত্যি স্বাভাবিক নয়। রিকশাওয়ালাকে সিপিএমের জেলা সম্পাদক নৃপেনবাবুর কথা বলতেই সে মাথা নাড়ল, হ্যাঁ চিনি, চলুন। তবে ওখানে পৌঁছে ছেড়ে দেবেন।
কেন?
আপনি কখন ওঁর সঙ্গে কথা বলতে পারবেন তা ভগবানও জানেন না। আমি যদি ওয়েটিং চার্জ চাই তা হলে আপনি আর কত দেবেন। রিকশাওয়ালা বলল।
কদমতলা হয়ে শিল্পসমিতি পাড়ায় পৌঁছে একটি তিনতলা বাড়ির সামনে রিকশা পঁড় করিয়ে লোকটা বলল, আসুন বাবু, নামিয়ে দিচ্ছি।
ভাড়া নিয়ে রিকশাওয়ালা চলে গেলে বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বেশ অবাক হল। অন্তত জনা পঁচিশেক মানুষ বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এরা যে সবাই নৃপেনবাবুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সে এগিয়ে কাছে যেতেই একটি ছেলে সামনে এসে বলল, এই নিন, আপনার নম্বর।
একটা কাগজ হাতে ধরিয়ে দিল ছেলেটা, তাতে লেখা সাতাশ।
আমার নম্বর সাতাশ? অনিমেষ জিজ্ঞাসা করল।
হ্যাঁ, আপনি হ্যাঁন্ডিক্যাপড লোক, তাই বলি, আজ চলে যান, দাদা ঘণ্টাখানেক পরে শিলিগুড়িতে চলে যাবেন, কলকাতা থেকে মন্ত্রী আসছেন।
তা হলে?
বুঝতেই পারছেন, এক ঘণ্টার মধ্যে আপনি চান্স পাবেন না।
ও। অনিমেষ ইতস্তত করল।
ছেলেটা বলল, এক কাজ করুন। কাল ভোর পাঁচটায় এসে লাইন দিন। তা হলে প্রথম দশজনের মধ্যে থাকতে পারবেন।
অনিমেষ মাথা নেড়ে ফিরে যাওয়ার জন্যে গেটের দিকে এগোতেই এক বৃদ্ধ গেট দিয়ে ঢুকে বললেন, চেনা লাগছে, অনিমেষ না?
হ্যাঁ। কিন্তু–!
আরে! আমাকে চিনতে পারছিস না? বারীনদার আড্ডায় যেতাম। তোর মনে নেই? এসি কলেজে পড়ার সময় নান্দীমুখ নামে একটা কাগজ বের করতাম। বারীনদা কভার আঁকতেন। তুই তো নকশাল হয়ে গিয়েছিলি, আমি ভাই তখন থেকেই সিপিএমেই আছি। আমি স্বপন।
যাক! তুই সিপিএমে এতদিন থেকেও আমাকে চিনতে পারছিস?
হাসল স্বপন, খোঁচা দিলি। আমি কিন্তু কোনওদিন কোনও পদে যাইনি। তাই সব জায়গায় যেতে পারি। নৃপেনদার সঙ্গে দেখা হয়েছে?
না। আজ আমার সাতাশ নম্বর। এরা বলছে কাল ভোর পাঁচটায় আসতে। অনিমেষ বলল।
তুই আয় আমার সঙ্গে।
স্বপন সাবলীলভাবে অনিমেষকে ভেতরে নিয়ে গেল। একেবারে নৃপেনবাবুর সামনে। তিনি তখন একজনকে বলছিলেন, না না, পুলিশের কাজে আমি ইন্টারফেয়ার করি না। আপনি দরকার হলে আদালতে যান।
স্বপন বলল, নৃপেনদা, একে চিনতে পারছেন? নৃপেনবাবুর যথেষ্ট বয়েস। হয়েছে কিন্তু চুল এখনও কালো। অনিমেষের মনে হল কালো রং ব্যবহার করেন উনি।
কে ভাই? আগে দেখেছি? নৃপেনবাবু বললেন।
আমি অনিমেষ মিত্র। অনিমেষ নমস্কার করল।
কিছুই স্বচ্ছ হল না। নৃপেনবাবু বললেন।
স্বপন বলল, অনিমেষ আগে আমাদের পার্টি করত। পরে নকশাল হয়।
ওরে বাব্বা। আপনি? আমার কাছে? নৃপেনবাবু চমকে উঠলেন।
.
১৩.
নৃপেনদার যথেষ্ট বয়স হয়েছে কিন্তু দেখে বোঝা যায় না। অনিমেষ যখন স্কুলের শেষ পরীক্ষা দিচ্ছে তখন উনি কলেজ শেষ করে বেশ কয়েক বছর ধরে রাজনীতি করছেন। যেহেতু ওঁর বাবা কংগ্রেসের সমর্থক ছিলেন এবং নৃপেনদা তখন সিপিআই করতেন তাই তাকে নিয়ে শহরে আলোচনা হত।
আজ নৃপেনদার চেহারা দেখে অনিমেষের মনে হল উনি এখন বেশ ভাল আছেন।
অনিমেষ বলল, আপনার কাছে খুব জরুরি প্রয়োজনে এসেছি।
তা তো বুঝতেই পারছি। দেখো অনিমেষ, তুমি এককালে আমাদের সঙ্গে ছিলে, কী যে মতিভ্রম হল তোমার! শুনেছি জেল থেকে বেরুবার সময় তোমাকে আবার দলে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল যা তুমি প্রত্যাখ্যান করেছিলে। আরে, কত নকশাল তাত্ত্বিক আটাত্তর সালের পরে আমাদের সৌজন্যে সরকারি কলেজে চাকরি করেছে অথচ তুমি! যাক গে, প্রয়োজনটা কী, বলো!
এই শহরে আমাদের একটা বাড়ি আছে।
আরে বাবা জানি! তোমার দাদু আমার বাবার কাছে আসত।
ওই বাড়িটা আমরা বিক্রি করে দিতে চাইছি।
আমরা মানে?
আমার মা আর আমি।
তোমার আসল মা তো মারা গিয়েছেন?
অনিমেষ অবাক হল, নৃপেনদার স্মৃতিশক্তি দেখে। সে বলল, হ্যাঁ। ইনি খুব অসুস্থ, আর একা থাকতে পারছেন না। আমাদের পক্ষেও জলপাইগুড়িতে পার্মানেন্টলি থাকা সম্ভব নয়।
স্বাভাবিক। অসুবিধে হচ্ছে যখন তখন বিক্রি করে দাও।
দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
কেন?
আমাদের পাড়ার ভোম্বলবাবু বলছেন বিক্রি করতে হলে উনি যে কালীবাড়ি বানাবেন তার ফান্ডে বেশ কয়েক লক্ষ টাকা চাঁদা দিতে হবে।
অ। চোখ বন্ধ করলেন নৃপেনদা।
উনি একথাও বললেন, যে জমিতে মন্দির হবে সেখানে আপনাকে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছেন।
হ্যাঁ হ্যাঁ এত করে বলল যে না গিয়ে পারিনি। আফটার অল, আমাদের পার্টির ছেলে!
আমার প্রশ্ন, মার্কসবাদী পার্টির সদস্য বা সমর্থক হয়ে কালীমন্দিরের জন্যে এত চাঁদা চাইছেন তা হলে আদর্শ বলে কি কিছু নেই?
প্রশ্ন শুনে খেপে গেলেন নৃপেনদা, আদর্শ? আদর্শ মানে কী? যার নড়ন চড়ন নেই? যুগ যুগ ধরে যাকে এক জায়গায় মাথায় নিয়ে থাকতে হবে? পরিবর্তিত পরিস্থিতি, বদলে যাওয়া সমাজব্যবস্থার সঙ্গে যদি আদর্শকে না মিশিয়ে দেওয়া হবে তা হলে তার জায়গা হবে ওয়েস্ট পেপার বক্সে। তা ছাড়া ওই কালীমন্দির হলে জনতাকে আরও কাছে পাওয়া যাবে। তাই না?
অবাক হওয়ার সীমা আর নেই, অনিমেষ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকল। তার দিকে তাকিয়ে নৃপেনদা বললেন, দেখো অনিমেষ আমিও তো প্রথম দিকে ক্লাস করেছি। যা শিখতাম তাই বক্তৃতায় বলতাম। কিন্তু একথাও তো
সত্যি, সাধারণ মানুষ আমাদের শিখে বলা অনেক শব্দের মানেই বুঝতে পারত না। আচ্ছা, ধরো বুর্জোয়া শব্দটির কথা। কজন সাধারণ কৃষক, শ্রমজীবী মানুষ এই শব্দটির মানে জানে? আমাদের মুখে শুনে শুনে তারা ভেবে নিয়েছে খুব খারাপ মানুষদের বুর্জোয়া বলা হয়। অর্থাৎ আমরা সাধারণ মানুষের কাছে যতই যেতে চাই, যতই তাদের হয়ে কাজ করি তারা আমাদের ভাষা পুরো বুঝতে পারে না। অন্তত অনেক কথা তো বটেই। সেটা কি উচিত? তাই মানুষের সহজ ভাষায় কথা বলাই উচিত। তাদের ভালোগার, তারা যাকে শ্রদ্ধা করে তাদের সম্মান জানালে ক্ষতির বদলে লাভ বেশি।
একটু চুপ করে থেকে নৃপেনদা বললেন, আমি ডোম্বলের সঙ্গে কথা বলব। কত টাকা চাঁদা দিতে বলেছে?
অঙ্কটা বলল অনিমেষ।
কততে তোমাদের বাড়ি বিক্রি হবে?
কুড়ি লাখ টাকার বেশি পাওয়া যাবে কিনা জানি না।
মাথা নাড়লেন নৃপেনদা, একটু বেশি চাইছে। ও কী বলছে?
এই টাকা শেষপর্যন্ত আমি পাব আর আমার টাকাটা পাওয়ার কথা নয়। তিরিশ বছর যখন আমার সঙ্গে বাড়ির কোনও সম্পর্ক নেই–।
অনিমেষকে থামিয়ে দিলেন নৃপেনদা। বাড়ি তুমি পাচ্ছ উত্তরাধিকারী হিসেবে। কিন্তু এটাও সত্যি তিরিশ বছর ধরে তুমি বাড়িটাকে যত্ন করা দূরের কথা কতটা দেখেছ তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। অবশ্য তুমি একা নও, তোমার সৎমাও সমানভাবে পাবেন। ঠিক আছে। আমি তোম্বলের সঙ্গে কথা বলব। ও যেন কোনও চাপ না দেয় তা দেখব। তবে তোমাদের সাধ্যমতো চাঁদা দিলে মন্দিরের কাজ দ্রুত শেষ হবে, মানুষের উপকারে লাগবে। ঠিক আছে?
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
আমাকে এখনই উঠতে হবে। ডি এম সাহেবের সঙ্গে মিটিং আছে। কোনও প্রয়োজন হলেই চলে এসো।
অনিমেষ উঠে দাঁড়াল, আজকে কপাল ভাল ছিল ওর সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল, তাই আপনার কাছে পৌঁছাতে পারলাম। শুনলাম ভোর পাঁচটার
সময় লাইন না দিলে আপনার সঙ্গে কথা বলা যাবে না।
কী করি বলো! শহরের মানুষের নানান সমস্যা, তারা দেখা করতে আসে। আমি যথেষ্ট কো-অপারেট করি! এক কাজ করো। সামনের টেবিল থেকে খবরের কাগজ টেনে নিয়ে তার একপাশের সাদা অংশে কিছু লিখে এগিয়ে দিলেন। অনিমেষ দেখল, ওটা টেলিফোন নাম্বার।
নৃপেনদা বললেন, খুব জরুরি হলে আমাকে ওই নাম্বারে ফোন কোরো। সকালে সাড়ে সাতটা থেকে আটটা আর রাত দশটা থেকে সাড়ে দশটার মধ্যে ফোন এলে কথা বলতে অসুবিধে হবে না আমার। আচ্ছা!
.
নৃপেনদার বাড়ি থেকে রিকশা নিয়ে কদমতলার মোড়ে আসতেই একটা দোকানের সামনে জগদীশবাবুকে দেখতে পেল অনিমেষ। দোকান বন্ধ করছে। কর্মচারী, তিনি লক্ষ রাখছেন। রিকশা দাঁড় করিয়ে অনিমেষ চেঁচিয়ে ডাকতেই তিনি দেখতে পেয়ে কাছে এলেন, ও আপনি! বলুন?
এবার খদ্দের এনে দিন। অনিমেষ বলল।
মানে? আপনাকে যে বলেছিলাম–।
মনে হচ্ছে সেই সমস্যার সমাধান হয়েছে। ভোম্বলবাবু মোটা টাকা চাদা চেয়েছিলেন, নৃপেনদা সেটা যাতে না দিতে হয় তা দেখবেন।
ওঁদের সঙ্গে কথা হয়েছে?
হ্যাঁ, আমি এখন নৃপেনবাবুর বাড়ি থেকেই আসছি।
আপনি তো কামাল করে দিলেন! একদিনের মধ্যে এই শহরে এই সাফল্য কেউ পায়নি। আপনি শিয়োর তো?
সেরকম আশ্বাস পেয়েছি।
তা হলে ঠিক আছে। ঘড়ি দেখলেন জগদীশবাবু। তারপর জিজ্ঞাসা করলেন, আপনি কি বাড়ি ফিরছেন?
হ্যাঁ।
আমি যদি মিনিট দশেকের জন্যে এখন যাই, মানে, বাড়িটাকে ভাল করে দেখে আসি তা হলে আপত্তি নেই তো? খদ্দেরদের তো বর্ণনা দিতে হবে।
জগদীশবাবু বললেন।
চলে আসুন, কোনও অসুবিধে নেই। রিকশায় উঠবেন?
না না। আমার দুচাকা আছে। সাইকেল।
জগদীশবাবু রিকশার পেছন পেছন সাইকেলে চেপে এলেন। বাড়ির ভিতর ঢুকে বাগান দেখে বললেন, বাঃ, প্রচুর গাছগাছালি, বেশ পরিষ্কার করে রাখা আছে। কতটা জমি?
বোধহয় এক বিঘে। অনিমেষ বলল, কাগজ দেখে ঠিক বলব।
ওতেই হবে। ওপাশেও তো বাড়ি আছে দেখছি!
আমাদের ভাড়াটেরা থাকেন।
উঠবেন তো?
মানে?
ভাড়াটে সমেত বাড়ি অনেকেই কিনতে চায় না। কিনলে দাম যথেষ্ট কমে যায়। পার্টি করে নাকি?
আমি জানি না। কথা বলতে হবে ওঁদের সঙ্গে।
বলুন। এটা জরুরি।
মাধবীলতা এসে দাঁড়িয়েছিল ভেতরের বারান্দায়। সদ্য স্নান সেরেছে। অনিমেষ অবাক হল, বহুকাল পরে মাধবীলতা হলুদ শাড়ি পরেছে। মাথায় হাতখোঁপা।
অনিমেষ জগদীশবাবুকে বলল, আমার স্ত্রী।
ও। নমস্কার, নমস্কার। এই অসময়ে কেউ বাড়িতে এলে যে বেশ অসুবিধে হয় তা আমি জানি। কটা ঘর আছে? জগদীশ জিজ্ঞাসা করলেন।
একটা বিশাল হলঘর ছাড়া সাতটা। বেশিরভাগ ঘরই তালাবন্দি। মাধবীলতা স্মিত মুখে বলল।
ব্যস। এতেই হবে। কোনও ফোন নাম্বার আছে?
মাধবীলতা নাম্বারটা বললে জগদীশবাবু নোট করে নিয়ে বললেন, আমিই ফোন করব। এই ধরুন, দিন তিনেকের মধ্যে। আচ্ছা, চলি।
জগদীশবাবুকে এগিয়ে দিয়ে এল অনিমেষ। বারান্দায় উঠতেই দেখল ছোটমা দাঁড়িয়ে আছেন মাধবীলতার পাশে। মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কী হল?
অনিমেষ বিরক্ত গলায় বলল, এখন পার্টি কালীপূজা করবে, বলিও দেবে। কারণ পশ্চিমবাংলার মানুষ সেটাই চায়।
কী উলটোপালটা বলছ। উনি কী বললেন? মাধবীলতার কপালে ভাঁজ।
আমার অনুরোধ শোনার পর অনেক কথা বললেন নৃপেনবাবু। তারপর যেন একটু সদয় হলেন। বললেন, ভোম্বলবাবুকে বলে দেবেন যেন আমাদের ওপর চাপ না দেন। অনিমেষ জানাল।
যাক বাবা! ছোটমা কপালে দুটো হাত জোড় করে ঠেকালেন।
অনিমেষ হাসল, শুনে কী মনে হল জানো?
মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, কী?
হরিণের অনুরোধে বাঘ কথা দিয়েছে কয়েকদিন অম্বুবাচী করবে ফল খেয়ে। আমার খুব খিদে পেয়েছে। স্নান করে আসছি।
মাধবীলতার স্থির চোখের সামনে দিয়ে অনিমেষ চলে গেল।
.
বিকেলে ভাড়াটেদের সঙ্গে কথা বলতে গেল অনিমেষ। তাদের বাইরের ঘরের দরজায় পৌঁছাতেই বৃদ্ধ বেরিয়ে এলেন। অনিমেষ বলল, ছোটমার কাছে জানলাম আপনার নাম নিবারণবাবু। আমি অনিমেষ।
আচ্ছা, আসুন। বসুন। বসার ঘরের চেয়ার দেখিয়ে দিলেন তিনি।
চেয়ারে বসে অনিমেষ বলল, আমরা কয়েকদিন হল এসেছি।
হ্যাঁ। শুনলাম। কী করে পা ভাঙল? বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন।
পুলিশের কল্যাণে।
সে কী! পুলিশ মেরেছে? কেন মারল?
এমন কিছু বড় ঘটনা নয়। আমি আপনার কাছে এসেছি একটি জরুরি কথা বলতে। আপনি জানেন এই বাড়িতে আমার মা একাই থাকেন। কিন্তু তার বয়স হচ্ছে। শরীরও খারাপ। আর তার পক্ষে একা থাকা সম্ভব নয়।
আপনারা এসে থাকবেন?
সেটাও তো আমাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। যত্ন নেওয়ার কেউ না থাকায় বাড়ির অবস্থাও ভাল নেই। অনিমেষ বলল।
হ্যাঁ। আমাদের রান্নাঘরে জল পড়ছিল, সারিয়ে নিতে হয়েছে। বৃদ্ধ বললেন।
ও। মা চাইছেন, আমরাও একমত, বাড়িটা বিক্রি করে দিতে। এর জন্যে তাড়াহুড়ো করার দরকার নেই। তিনমাস সময় পাবেন। এর মধ্যে যদি অন্য বাড়িতে উঠে যান তা হলে ভাল হয়। অনিমেষ বলল।
অন্য কোথায় উঠে যাব ভাই! এতদিন এই বাড়িতে ভাড়া নিয়ে আছি। এখন নতুন জায়গায় ভাড়া নিতে গেলে যে টাকা চাইবে তা দেওয়ার সামর্থ্য তো আমাদের নেই। বৃদ্ধ বললেন।
কিন্তু ভাড়াটে হয়ে কারও বাড়িতে সারাজীবন কি থাকা যায়?
একথা কখনও ভাবিনি। তা ছাড়া আপনার মাকে জিজ্ঞাসা করে দেখুন, প্রতি মাসের ঠিক সময়ে তাঁকে ভাড়া দিয়ে গেছি কিনা! উনি একবার খুব অসুস্থ হয়ে ঘরেই পড়ে ছিলেন, আমার ছোটবউমা গিয়ে দিনরাত সেবা করে তাকে দাঁড় করিয়েছে। এসবের কোনও মূল্য নেই ভাই? বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন।
নিশ্চয়ই আছে। কিন্তু বাড়ি বিক্রি করার সময় এই অংশ তো বাদ যাবে না। যিনি কিনবেন তিনি পুরোটাই নেবেন। অনিমেষ বলল।
আপনি তাদের বলুন ভাড়াটে হিসেবে আমাদের রেখে দিতে।
নিশ্চয়ই বলব। কিন্তু তিনি যদি রাজি না হন–!
তা হলে আপনি আমাদের এরকম বাড়ি এই ভাড়ায় দেখে দিন। উঠে যাব।
আমি কোথায় যাব বাড়ি খুঁজতে?
আপনি আমাদের এই অংশের জন্যে টাকা পাবেন, পাবেন তো?
হ্যাঁ।
নিজে খুঁজে দিতে না পারেন, এই অংশের মূল্য থেকে কিছু আমাদের দিন, আমরা তার সঙ্গে বাড়তি ভাড়া দিয়ে অন্যত্র উঠে যাব। বৃদ্ধ বললেন।
ঠিক আছে। ভেবে দেখি। অনিমেষ উঠে দাঁড়াল ক্রাচে ভর রেখে।
আচ্ছা, উঠছেন কেন? চা খাবেন না?
না।
এই প্রথম এখানে এলেন–!
এই প্রথম নয়। এই অংশের বাড়িতে আমি বাল্যকালে এসে থেকে গিয়েছিলাম। এর প্রতিটি ইট আমার চেনা। অনিমেষ বেরিয়ে এল।
.
১৪.
গেটের কাছে আসতেই বাইকের আওয়াজ কানে এল। অনিমেষ বাঁদিক থেকে একটি মোটরবাইককে এগিয়ে আসতে দেখল। পাড়ায় দুদিকে যাওয়ার জন্যে অনেকেই শর্টকাট হিসেবে ব্যবহার করে এই রাস্তাটাকে কিন্তু বাইকটা সামনে এসে থামলে হেলমেট খুললেন চালক, অনিমেষ দেখল ভোম্বলবাবু হাসছেন।
আপনি? অনিমেষের মুখ থেকে বেরিয়ে এল।
আরে মশাই, আপনি কি নাবালক? রসিকতা বোঝেন না? হাসিমুখে জিজ্ঞাসা করলেন ভোম্বলবাবু।
অনিমেষ দেখল কথা বলতে বলতে ভোম্বলবাবু গেট খুলে ভেতরে ঢুকলেন। তার বাইক বাইরেই রইল। কাছে এসে বললেন, আরে, আমি আপনার সঙ্গে রসিকতা করেছিলাম। আপনি সেটা সিরিয়াসলি নিয়ে নৃপেনদার কানে তুললেন। তার ফলে নৃপেনদা আমাকে ডেকে পাঠিয়ে হেভি ধমক দিলেন। অনিমেষের মুখ থেকে একটি আওয়াজ বের হল, ও!
মাসিমা আছেন তো? ভোম্বলবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।
আছেন।
চলুন, এলাম যখন, তখন দেখা করে যাই।
দুই পা এগোতেই নিবারণবাবু বেরিয়ে এলেন বাইরে, দুটো হাত নমস্কারের ভঙ্গিতে ওপরে তুলে চেঁচিয়ে বললেন, এক মিনিট দাঁড়ান ভোম্বলবাবু–।
আবার কী হল? ভোম্বলবাবু চোখ ছোট করলেন। নিবারণবাবু কাছে এসে বললেন, এই ভদ্রলোক আমাদের খুব বিপদে ফেলে দিয়েছেন। বলছেন, বাড়ি বিক্রি করে দেবেন, তাই আমাদের উঠে যেতে হবে। এতদিন এখানে থাকলাম, হুট করে চলে যেতে বলাটা কি অত্যাচার নয়?
হুট করে চলে যাবেন কেন? এ তো আলু পটল বিক্রির মতো নয়। সময় লাগবে। ততদিনে বাড়ি খুঁজে নিন। ভোম্বলবাবু বললেন।
নতুন বাড়ি ভাড়া চাইলে এখন যা দিচ্ছি তার তিনগুণ দিতে হবে। কোথায় পাব অত টাকা! নিবারণবাবু হাত জোড় করেই থাকলেন।
আপনার ছেলে তো ডি এম-এর অফিসে চাকরি করে।
হ্যাঁ। সে আর কত মাইনে পায়। আমার পেনশনের টাকা দিয়ে–!
আপনাদের ফ্যামিলি মেম্বার কত?
সাতজন। ছোট ছেলের বিধবা বউটা তো বাপের বাড়ি ফিরে যায়নি।
বেশ করেছে। ভোম্বলবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, কত ভাড়া দেন?
দেড় হাজার টাকা।
হাসলেন ভোম্বলবাবু, বেশ সুখেই আছেন দেখছি।
ভোম্বলবাবু, আপনি আমাদের পাড়ার নেতা। বাড়ির সবাই আপনার পার্টিকেই ভোট দিই। আপনি যদি আমাদের না দেখেন কে দেখবে বলুন?
ভোম্বলবাবু কোনও কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকলেন।
নিবারণবাবু বললেন, আমার ছেলে বলছিল, সেনপাড়ার শেষে এরকম বাড়ির ভাড়া প্রায় চার হাজার টাকা। আমরা দেড় দিচ্ছি বাকিটা যদি ইনি দেন!
মানে? ভোম্বলবাবুও অবাক হলেন, কী বলতে চাইছেন?
উনি যদি বাড়ি বিক্রির টাকা থেকে তিন লক্ষ টাকা আমার নামে ব্যাঙ্কে ফিক্সড করে দেন তা হলে মাসে আড়াই হাজার সুদ পেয়ে যাব। তা হলে আর চিন্তা থাকবে না। দেড় প্লাস আড়াই মানে চার হয়ে যাবে।
আপনি তো ভাল অঙ্ক জানেন। ভোম্বলবাবু বললেন।
হেঁ হেঁ। স্কুল ফাইনালে লেটার পেয়েছিলাম।
ঠিক আছে আমরা পার্টিতে আলোচনা করে আপনাকে জানাব। চলুন অনিমেষবাবু।
ভেতরের বাগানের কাছে এসে ভোম্বলবাবু বললেন, লোকটা আপনাকে সমস্যায় ফেলবে। ম্যানেজ করবেন কীভাবে?
এখনও ভাবিনি। প্রস্তাবটা একটু আগে শুনলাম।
মুশকিল হল, পাবলিক সিমপ্যাথি পেয়ে যাবে তোকটা। তা ছাড়া পার্টি থেকে বলা হয়েছে, বাড়িওয়ালা ভাড়াটের ঝগড়ায় আমরা যেন না ঢুকি। ব্যাপারটা আপনার পক্ষে কঠিন হয়ে গেল। দেখুন, কেউ ভাড়াটে সমেত বাড়িটাকে কেনে কি না। তারপর তার হেডেক। বলতে বলতে বারান্দায় উঠে পড়লেন ভোম্বলবাবু। চারপাশে তাকিয়ে চেঁচিয়ে ডাকলেন, মাসিমা, ও মাসিমা, কোথায়?
ছোটমা বেরিয়ে এলেন তার ঘর থেকে, অর্ধেক মাথা ঘোমটায় ঢাকা।
নমস্কারের ভঙ্গিতে দুটো হাত এক করে ভোম্বলবাবু বললেন, আমাকে চিনতে পারছেন তো? আমি ভোম্বল।
ছোটমা মাথা নেড়ে নিঃশব্দে হ্যাঁ বললেন।
আপনার তো আর কোনও চিন্তা নেই। ছেলে, ছেলের বউ এসে গিয়েছে। কিন্তু আমার একটা দুঃখ হচ্ছে।
দুঃখ! ছোটমার মুখ থেকে শব্দটা বের হল।
হ্যাঁ। আপনারা তো বাড়ি বিক্রি করে আমাদের পাড়া ছেড়ে চলে যাবেন। অথচ এই পাড়ায় অনেক কষ্ট করে আমরা কালীবাড়ি করছি, আপনার মতো ধর্মপ্রাণ মানুষকে সঙ্গে পেলে জোর বাড়ত। দুঃখ সেই কারণে।
ভোম্বলবাবুর কথা শুনে অনিমেষের মনে হল একটি আধবুড়ো দামড়া খোকা সাজতে চাইছে।
তা আমি অনিমেষবাবুকে রসিকতা করে বলেছিলাম চাদা দিতে। উনি যা ইচ্ছে দেবেন আমরা মাথা পেতে নেব। চাদা তো জোরজুলুম করে চাওয়ার ব্যাপার নয়। শুনেছি আপনি রোজ পুজো করেন। আপনি ব্যাপারটা বুঝবেন। তা আপনার বউমা কোথায়? তার সঙ্গে একটু কথা বলে যাই। ভোম্বলবাবু অকারণে হাসলেন।
অনিমেষের মনে হল কোনও প্রাণী এত দ্রুত রং পালটাতে পারে না।
মাধবীলতা অনেকক্ষণ তাদের ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সংলাপ শুনছিল। ছোটমা তাকে বললেন, ইনি আমাদের পাড়ার জনপ্রতিনিধি।
ভোম্বলবাবু ঘুরে তাকিয়ে মাধবীলতাকে দেখে বললেন, নমস্কার, নমস্কার। আপনি আর একবার এই বাড়িতে এসেছিলেন, তাই তো?
হ্যাঁ।
সব শুনেছি। খুব স্যাক্রিফাইস করেছেন। তা আপনিও কি নকশাল ছিলেন? ভোম্বলবাবু জিজ্ঞাসা করলেন।
না।
তা হলে? সিপিএম না কংগ্রেস? আমি রাজনীতি করিনি।
ভোট দেন তো? না।
সে কী। কেন?
ওটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
তা বটে। এখন তো একজন মহিলা পশ্চিমবাংলার নেত্রী হওয়ার জন্যে ছটফট করছেন। ভাবছেন, সব মেয়েরাই ওঁকে সমর্থন করবে। কোনও আদর্শ নেই, শুধু আমাদের গালাগালি দিয়ে পাবলিককে ভোলাতে চাইছেন। হাস্যকর ব্যাপার। তা আপনি জলপাইগুড়ির দ্রষ্টব্যস্থানগুলো ঘুরে দেখেছেন?
সুযোগ এবং সময় হয়নি।
সময় বের করুন, আমি সুযোগ করে দেব। গোরুমারা, চাপড়ামারি, হলং ফরেস্ট দেখলে মন ভরে যাবে। আচ্ছা, চলি। মাসিমা, ভাল থাকবেন। চলি অনিমেষবাবু, কোনও চিন্তা করবেন না। একটা কথা জানবেন, সোজা আঙুলে ঘি না উঠলে আঙুলটাকে একটু বেঁকা করতে হয়। সব বলে দেব। ভোম্বলবাবু নিজেই বেরিয়ে গেলেন। একটু পরেই বাইকের আওয়াজ কানে এল।
মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল, লোকটা কেন এসেছিল?
জানি না, বলল মাসিমার সঙ্গে দেখা করে যাই।
এই লোক সুরেনবাবুর চেয়ে অনেক বেশি শয়তান। তোমাকে কাল টাকা দিতে বলেছিল যে সে আজ বলছে রসিকতা করেছে।
নৃপেনদার জন্যে।
ছোটমা বললেন, তিনিও যে অভিনয় করছেন না তা কে বলতে পারে। কিন্তু একটা কথা ঠিক, তুমি তো কোথাও বেড়াতে যাওনি। যাও না, নিজেরাই ঘুরে এসো।
মাধবীলতা হাসল, আপনি যদি সঙ্গে যান তা হলে যেতে পারি!
আমি? এই শরীর নিয়ে? মাথা নাড়লেন, আমার তো সব দেখা।
কী কী দেখেছেন?
ছোটমায়ের মুখটা করুণ হয়ে গেল। মাধবীলতা এগিয়ে এল, বাড়িটার বিক্রির ব্যবস্থা হয়ে যাক, তারপর আমরা সবাই বেড়াতে যাব। এর মধ্যে অর্কও এসে যাবে। ও তো কিছু দেখেনি।
ছোটমা কিছু না বলে ভেতরে চলে গেলেন।
অনিমেষ বলল, আমার তো মনে হয় বিয়ের পর স্বৰ্গছেঁড়ার কোয়ার্টার্সে ঢুকেছিলেন, বেড়াতে আসা বলতে এই জলপাইগুড়ির বাড়িতে। এর বাইরের কোনও কিছুই ওঁর দেখা হয়নি।
তুমি তো বলেছিলে ওঁর বাপের বাড়ি এই শহরেই?
হ্যাঁ।
তারা কেন ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি?
তাঁদের কেউ আছেন কি না তাই জানি না। ওঁকে জিজ্ঞাসা করো।
না। উনি নিজের থেকে বলেননি যখন তখন জানতে চাওয়া ঠিক হবে না। ঘরে যাও, আমি চা করছি। মাধবীলতা রান্নাঘরে চলে গেল।
.
দুদিন বাদে বাজার থেকে বের হওয়ার সময় দেবেশের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সাইকেল থেকে নেমে দেবেশ বুঝিয়ে দিল কীভাবে ওর ডেরায় পৌঁছোতে হবে। নিজের মোবাইল নাম্বার দিয়ে বলল, যেদিন যাবি তার আগে আমাকে ফোন করবি। সকালের দিকে আয়, দুপুরে একসঙ্গে ভাত খাব।
সঙ্গে যদি মাধবীলতা যায়?
কুছ পরোয়া নেই। আমরা তো ডাল ভাত তরকারি খাই। হয়ে যাবে।
দেবেশ, তুই বেশ ভাল আছিস। না?
হো হো করে হাসল দেবেশ। তারপর সাইকেলে উঠে চলে গেল।
.
বাড়িতে ফেরামাত্র মাধবীলতা বলল, শোনো, জগদীশবাবু ফোন করেছিলেন।
কী বললেন?
উনি ঘণ্টাখানেকের মধ্যে একজনকে নিয়ে আসছেন বাড়ি দেখাতে।
বেশ করিতকর্মা লোক তো!
কিন্তু ওঁর সঙ্গে তোমার কথা বলে নেওয়া উচিত। মাধবীলতা বলল।
কী ব্যাপারে?
আশ্চর্য মানুষ তুমি! ওঁকে পারিশ্রমিক দেবে না?
ওহো! অনিমেষ হেসে ফেলল।
হাসছ যে!
তুমি দালালি না বলে পারিশ্রমিক বললে, তাই। তা ওঁদের নিশ্চয়ই ফিক্সড রেট থাকে। বাড়িভাড়া পেতে গেলে দালালকে একমাসের ভাড়া দিতে হয়। কিন্তু ওঁকে এত কিছু জিজ্ঞাসা করব কী করে? দেখি, রামদা কী বলেন, উনি নিশ্চয়ই জানেন। অনিমেষ বলল।
কেন? তুমি ওঁকেই জিজ্ঞাসা করো কত দিতে হবে? মাধবীলতা বলল, তুমি যদি না পারো আমি ওঁকে জিজ্ঞাসা করতে পারি।
.
জগদীশবাবু যাঁকে সঙ্গে নিয়ে এলেন তার বয়স বেশি নয়। পঞ্চাশের এপাশেই। সাদা পাজামা পাঞ্জাবি পরনে। নমস্কার করে বললেন, আমি স্বপ্নেন্দু দত্ত। জগদীশবাবু বললেন, আপনারা বাড়ি বিক্রি করবেন!
হ্যাঁ।
বাড়ির মালিক কে?
আমার ঠাকুরদা বাড়িটা বানিয়েছেন। তার কাছ থেকে আমার বাবা বাড়িটা পেয়েছিলেন। এখন আমার মা এখানে থাকেন। তিনিই মালিক বলতে পারেন।
কেন? ছেলে হিসেবে আপনারও তত অর্ধেক পাওয়ার কথা। কোর্টে গিয়ে আইনসম্মত করে নেননি? স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করলেন।
জগদীশবাবু বললেন, অনিমেষবাবু কলকাতায় থাকেন বলে ওসব করা হয়নি। এখন হবে। কয়েকদিনের মধ্যেই হয়ে যাবে।
আপনার আর কোনও ভাইবোন নেই?
জগদীশবাবু মাথা নাড়েন, না, উনিই একমাত্র ছেলে।
গুড। চলুন, দেখা যাক। স্বপ্নেন্দু বললেন।
প্রায় আধঘণ্টা ধরে স্বপ্নেন্দু দত্ত জগদীশবাবুকে নিয়ে পুরো বাড়িটা ঘুরে দেখলেন। এমনকী ভাড়াটের দিকটাও।
জগদীশবাবু অনিমেষকে বলেছিলেন, আপনি বসুন। আমিই ওঁর সঙ্গে আছি।
বাড়ি দেখার পর সবাই বারান্দার চেয়ারে বসল ওরা। স্বপ্নেন্দু দত্ত কোনও ভণিতা না করে বললেন, আপনারা এই বাড়ির কোনও যত্ন করেননি। মনে হয় বহু বছর মেরামত করা হয়নি।
হ্যাঁ। কথাটা ঠিক।
আমি যদি কিনি তা হলে এই বাড়ি ভেঙে ফেলব।
ভেঙে ফেলবেন? প্রশ্নটা মুখ থেকে বেরিয়ে এল।
দেখুন, এই বাড়ি তৈরি হয়েছে পরিকল্পনা ছাড়াই। যিনি তৈরি করেছেন তার ইচ্ছে ছিল পরিবারের সবাই একসঙ্গে থাকবে। এখন অত বড় পরিবার কোথায়? থাকলেও একসঙ্গে থাকে না। আমাকে মাল্টিস্টোরিড তৈরি করে ফ্ল্যাট বিক্রি করতে হবে। ওপাশে অনেকটা জায়গা ছাড়তে হবে রাস্তার জন্যে। কিন্তু দুটো কথা জানতে চাইব। আপনার ভাড়াটে কি উঠে যাবেন?
সবে কথা শুরু হয়েছে। উনি তিন লক্ষ টাকা চেয়েছেন।
সেটা আপনার হেডেক। আমি চাইব ভাড়াটেহীন বাড়ি কিনতে। আমি কিনে তুলতে গেলে অনেক ঝামেলা হবে। স্বপ্নেন্দু বললেন।
অনিমেষ চুপ করে থাকল।
দুই নম্বর, লোকাল সরকারি পার্টি কি আপনাকে বাড়ি বিক্রির ব্যাপারে গ্রিন সিগন্যাল দিয়েছেন? স্বপ্নেন্দু তাকালেন।
হ্যাঁ। জগদীশবাবু বলায় আমি ওঁদের সঙ্গে কথা বলেছি। নৃপেনবাবু এবং ভোম্বলবাবু সম্মতি দিয়েছেন। অনিমেষ বলল।
আপনি ভাগ্যবান। খুব ভাল খবর। এখন বলুন, এই বাড়ি জমির জন্যে আমাকে কত টাকা দিতে হবে? স্বপ্নেন্দু জিজ্ঞাসা করলেন।
অনিমেষ জগদীশবাবুর দিকে তাকাল, আপনি বলুন। জগদীশবাবু বললেন, এই পাড়ার জমির কাঠা যে দামে বিক্রি হয় সেই দামের সঙ্গে বাড়ির দাম যোগ করলেই অঙ্কটা বের হতে পারে।
স্বপ্নেন্দু বললেন, বাড়ির দাম তত ঠিক করাই যাবে না। জমির দামই আসল ব্যাপার। ঠিক আছে। আপনি ভাড়াটের ব্যাপারটা দেখুন। আমি কেনার ব্যাপারে ইন্টারেস্টেড। আপনাকে কোনও ফ্ল্যাট দেব না। স্রেফ আন্দাজে লাখ কুড়ির অফার দিচ্ছি। আর হ্যাঁ, বাড়ির প্ল্যানের একটা কপি আমার চাই আর কোর্ট থেকে মালিকানা আইনসম্মত করে নিন। উইল থাকলে কোনও সমস্যা হবে না।
স্বপ্নেন্দুকে নিয়ে ফিরে যাচ্ছিলেন জগদীশবাবু, অনিমেষ তাকে বলল, আপনি একটু পরে গেলে অসুবিধে হবে?
না না। ঠিক আছে, স্বপ্নেন্দুবাবু, আপনি যান, আমি পরে আসছি।
.
১৫.
গাড়ি চলে গেলে জগদীশবাবু কাছে এলেন, বলুন।
অনিমেষ সরাসরি জিজ্ঞাসা করল, আপনার পারিশ্রমিক নিয়ে আমরা কথা বলিনি। আমি কি রামদার কাছে জেনে নেব?
কী কাণ্ড! আমি কী নিই তা তিনি জানবেন কী করে? তার সঙ্গে তো কোনও কাজ করিনি। হাসলেন জগদীশবাবু, এসব নিয়ে একটুও ভাববেন না। অলিখিত একটা কমিশনের কথা যাঁরা কেনাবেচা করেন তাদের সবাই জানেন। স্বপ্নেন্দু দত্ত যে দাম দিতে চাইছেন তা তো জানা হল, যদি অন্য কেউ ওঁর চেয়ে বেশি দাম দিতে রাজি হন তার জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। এতে আপনাদের যেমন লাভ, তেমনি আমারও।
অনিমেষ বলল, আমি এসব ব্যাপারে নিতান্তই অজ্ঞ। কমিশনের ব্যাপারটা যদি বলেন।
সিম্পল। আমি মাত্র পাঁচ পার্সেন্ট নিই। তাও ভাগাভাগি করে। যিনি কিনছেন তিনি আড়াই, যিনি বিক্রি করছেন তিনি বাকি আড়াই। আপনি না হয় দুই দেবেন, আমি বায়ারের কাছ থেকে তিন চেয়ে নেব। আমাকে বিক্রির ব্যাপারটা একটু প্রচার করতে হবে। জগদীশবাবু মাথা নেড়ে বললেন।
প্রচার করবেন? কীভাবে?
লোকাল কাগজগুলোতে বিজ্ঞাপন ছাপব। এর জন্যে আপনাকে কিছু দিতে হবে না। খরচ যা হবে তা আমিই দেব। আপনি কোর্টের ব্যাপারটার ফয়সালা করে ফেলুন। এখানকার কোনও উকিলকে চেনেন? জগদীশবাবু তাকালেন।
মিস্টার রায়ের মুখ মনে পড়ায় অনিমেষ মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ।
গুড। তা হলে চলি। প্রয়োজন হলেই ফোন করব। জগদীশবাবু চলে গেলেন।
.
ফিরে এসে বারান্দায় দাঁড়াতেই মাধবীলতা এগিয়ে এল, কী কথা হল? অনিমেষ স্বপ্নের কথাগুলো জানালে মাধবীলতা বলল, বাব্বা। খুব খুঁতখুঁতে লোক তো। অবশ্য টাকা দিয়ে যে কিনবে সে তো সব দিক দেখে নেবেই।
তিনটে সমস্যার সমাধান করতে হবে। অনিমেষ বলল।
মাধবীলতা মাথা নাড়ল, একটা হল মালিকানা ঠিক করে নেওয়া, দ্বিতীয়টা ভাড়াটেদের তুলে দেওয়া। তৃতীয়টা কী?
দাদুর বানানো এই বাড়ি ভদ্রলোক ভেঙে ফ্ল্যাটবাড়ি বানাবেন। ছেলেবেলায় চোখের ওপর বাড়িটাকে তৈরি হতে দেখেছি। শোনার পর কেমন লাগছে? অনিমেষ বলল।
এই সময় পেছন থেকে ছোটমার গলা শোনা গেল, তা হলে থাক।
মাধবীলতা হাসল, আচ্ছা, তোমার যদি একটা মেয়ে থাকত এতদিনে তার অনেকদিন আগে বিয়ে হয়ে যেত। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়িতে গিয়ে তাকে তাদের নিয়ম অনুযায়ী চলতে হবে। তাকে যদি বিকেল চারটের সময় ভাত খেতে হয় তুমি কী বলবে, ওই বাড়িতে থাকিস না?
দুটো এককথা হল? অনিমেষ বিরক্ত।
প্রায়। যে বাড়ি কিনবে সে কী করবে তা বিক্রেতা ঠিক করবে? মাধবীলতা বলল, এটা কোনও সমস্যা নয়। আমরা বাধ্য হয়ে বাড়ি বিক্রি করতে চাইছি আর ওরা তাজমহল কিনছে না যে ভেঙে ফেলতে পারবে না।
ছোটমা বললেন, ঠিক কথা। কিন্তু ভাড়াটেদের কি ভোলা যাবে? ওদের ছোট বউটা খুব বিপদে পড়ে যাবে।
অনিমেষ অবাক হল, কেন? তার কী হল?
ছোটমা বলল, বাপ মা ভাই নেই। স্বামী যাওয়ার পর ভাশুরের সংসারে থাকতে পারছে দিনরাত কাজ করে বলে। রান্নাঘরটা বেশ বড় বলে ওখানেই রাত্রে শোয়। ওরা যদি ছোট বাড়িতে ভাড়া নিয়ে চলে যায় তা হলে ওর নিশ্চয়ই জায়গা হবে না।
যিনি তোমার সেবা করেছিলেন?
হ্যাঁ। খুব ভাল মেয়ে।
তাকে নিয়ে চিন্তা আমাদের করার কথা নয়। অনিমেষ বলল।
ছোটমা বললেন, ওরা যা চাইছে তা দিয়ে দিলে যদি ভাল বাড়ি ভাড়া পায়, যেখানে মেয়েটা থাকতে পারবে, তাই দেওয়া উচিত। কুড়ি লক্ষ টাকা থেকে কিছু কমলে কি খুব অসুবিধে হবে মাধবীলতা?
আপনি চাইলে নিশ্চয়ই দেওয়া যেতে পারে। মাধবীলতা বলল।
ওহো, একটা কথা, অনিমেষ বলল, মিস্টার রায়, মানে বাবার উকিল, বলেছিলেন কোর্ট থেকে ফেরার পথে আমাদের বাড়িতে আসবেন। সেদিন তো আসেননি। পরে আমি যখন বাইরে গিয়েছি তখন কি এসেছেন?
তোমার কী হয়েছে বলো তো? মাধবীলতা জিজ্ঞাসা করল।
কেন? অনিমেষ তাকাল।
ভদ্রলোক এলে আমরা কি তোমাকে জানাতাম না?
তা বটে।
এরপরে ভাত খেয়ে উঠে বলবে খাইনি তো! মাধবীলতা হেসে ফেলল।
ছোটমা যোগ করলেন, ওর বাবাও এই একই কথা বলত।
.
বিকেলে মিস্টার রায়ের বাড়িতে রিকশা নিয়ে গেল অনিমেষ। জলপাইগুড়িতে আসার পর বেরোলেই রিকশাভাড়া দিতে হচ্ছে। খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এরপর থেকে একটু একটু করে হাঁটার চেষ্টা করতে হবে। ক্রাচ নিয়ে টানা মিনিট দশেক তো সে হাঁটতে পারে। চেম্বার খোলা ছিল। একটি তরুণ, সম্ভবত মিস্টার রায়ের সহকারী, বললেন, কদিন ধরে স্যার কোর্টে যাচ্ছেন না।
প্রেশার বেড়ে গিয়েছিল। কী দরকার?
উনি আমার বাবার উইল করেছেন। বাবার নাম মহীতোষ মিত্র। সেই ব্যাপারে কিছু বলার ছিল। উনি বলেছিলেন, আমাদের বাড়িতে যাবেন। অনিমেষ বলল।
জানি। সেদিন উনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। দাঁড়ান, দেখছি। তরুণ ভেতরে চলে গেল। ফিরে এল কয়েক মিনিটের মধ্যে, বসুন। স্যার আসছেন।
মিস্টার রায়কে বেশ দুর্বল দেখাচ্ছিল। চেয়ারে বসে বললেন, আমি খুব দুঃখিত, হঠাৎই প্রেশারটা–।
ঠিক আছে। এখন কেমন আছেন?
কিছুটা ভাল। সারাজীবন এত টেনশন–। যাক গে, উইলটা নিয়ে মিসেস মিত্র কী করবেন বলেছেন? মিস্টার রায় বললেন।
না। আমি চাই বাবার শেষ ইচ্ছে অনুযায়ী উইলটা আইনসম্মত হোক। অনিমেষ পরিষ্কার বলল।
তা হলে সেটা তো আমিই করব। হাসলেন ভদ্রলোক, নাকি অন্য কোনও ল-ইয়ারের কাছে উনি যেতে চাইছেন?
আপনি ছাড়া এই শহরের অন্য কোনও ল-ইয়ারকে উনি বোধহয় জানেন না।
তা হলে?
উনি উইলটা ফেরত চাইছেন কেন তা আমি জানি না।
মিস্টার রায় একটু চিন্তা করলেন। তারপর তরুণ সহকারীকে বললেন, দেখো তো, বাহাদুর এখনও আছে কি না!
আছে। একটু আগে দেখেছি। তরুণ বলল।
তা হলে গাড়ি বের করতে বলল।
সে কী! আপনি এই শরীর নিয়ে বাইরে যাবেন?
শরীর এখন ভাল আছে। তা ছাড়া আমি তো মহীতোষবাবুর স্ত্রীকে আমার কাছে আসতে বলতে পারি না। মিস্টার রায় বললেন।
একটা বড় খাম নিয়ে তরুণ সহকারী সামনে বসেছিল। অনিমেষ পেছনে, মিস্টার রায়ের পাশে।
হাঁটাচলা করতে কি খুব কষ্ট হয়?
বেশিক্ষণ হাঁটলে হয়।
এখন কি মনে হয় না, কী বিরাট ভুল করেছেন?
অনিমেষ হাসল, মানুষের অগ্রগতি হয়েছে যেসব আবিষ্কারের জন্যে তা করতে অনেকবার ব্যর্থতা এসেছে। সেই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়েই শেষপর্যন্ত সফল হয়েছেন আবিষ্কারকরা। তাই না?
মিস্টার রায় আর কথা বাড়ালেন না।
বাড়ির মেইন গেটে গাড়ি না রেখে পেছনের দিকে গাড়িটাকে পার্ক করতে বলল অনিমেষ। ভেতরে ঢুকে মিস্টার রায় বললেন, বাঃ, বাগানটা বেশ পরিষ্কার রেখেছেন দেখছি। কত বছরের বাড়ি?
পঞ্চাশ পেরিয়ে গেছে। অনিমেষ বলল, আসুন।
গাড়ির শব্দ পেয়ে মাধবীলতা বারান্দায় এসেছিল। অনিমেষ তাকে বলল, মিস্টার রায় অসুস্থ শরীর নিয়ে এসেছেন। ওঁকে বলো।
মাধবীলতা দ্রুত চলে গেল ভেতরে।
মিস্টার রায় বললেন, ইনি আপনার–! থেমে গেলেন তিনি।
আমার স্ত্রী।
আচ্ছা! আপনারা যে বিয়ে করেছেন তা মহীতোষবাবু জানতেন?
আমরা মন্ত্র পড়ে বা সই করে বিয়ে করিনি।
ও। তাই বলুন। আমি মহীতোষবাবুকে বলেছিলাম উইলে ছেলেকে বঞ্চিত করছেন কেন? তিনি আপনাদের মেনে নিতে পারেননি। চলুন।
বারান্দার চেয়ারে বসলেন মিস্টার রায়। আরও দুটো চেয়ার এনে দিল মাধবীলতা। অনিমেষের ইচ্ছে করল না মিস্টার রায়ের সঙ্গে ওর আলাপ করিয়ে দিতে। কিন্তু মাধবীলতা বলল, উনি এখনই আসছেন। আমি চা করছি। আপনি নর্মাল চা খাবেন তো?
অ্যাঁ? না, আমি চা খাই না। মিস্টার রায় বললেন।
আপনি? তরুণ সহকারীর দিকে তাকাল মাধবীলতা।
না না। আমি একটু আগেই চা খেয়েছি। তরুণ জানাল।
মিস্টার রায় অনিমেষকে জিজ্ঞাসা করলেন, আপনারা কি উইলটা দেখেছেন?
মাধবীলতা বলল, ওর পক্ষে দেখা সম্ভব ছিল না। আমি পড়েছি। কিন্তু ও দেখার আগেই উনি ছিঁড়ে ফেলেছিলেন।
ছিড়ে ফেলেছিলেন? মিস্টার রায় অবাক।
হ্যাঁ?
ওটা অবশ্য মূল উইলের কপি। ছিড়লেও কোনও অসুবিধে হবে না। মাথা নাড়লেন মিস্টার রায়, কিন্তু–।
মাধবীলতা বলল, উনি আসছেন।
দুটো চেয়ার খালি ছিল। অনিমেষ এবং তরুণ সহকারী বসেনি। একটা চেয়ার মাধবীলতা তুলে মিস্টার রায়ের মুখোমুখি কিছুটা দূরত্বে রাখল।
ছোটমা সামনে এসে হাত জোড় করলেন, নীরবে।
মিস্টার রায় বললেন, হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ায় আসতে পারিনি। আপনার চিঠি পেয়েছি। আপনি উইলের মূল কপি ফেরত চেয়েছেন। কারণটা জানতে পারি?
ওটা আমার দরকার। ছোটমা বসলেন না, নিচু গলায় বললেন।
কী করতে চান? উইলের প্রবেট নিতে চাইছেন?
না।
তা হলে?
ওই উইল আমার দরকার নেই।
আপনার স্বামীর শেষ ইচ্ছে–!
আমারও তো ইচ্ছে অনিচ্ছে আছে। বেশ জোর দিয়ে বললেন ছোটমা।
আপনি ভেবেচিন্তে বলছেন তো? কোনও প্রেশার নেই?
আমি ছেলেমানুষ নই।
বেশ, ওঁকে খামটা দিয়ে দাও। সহকারী তরুণকে বললেন মিস্টার রায়।
তরুণ এগিয়ে এসে খামটা দিল ছোটমাকে। তিনি খাম খুলে স্ট্যাম্প পেপারের ওপর টাইপ করা উইল বের করলেন। তারপর চারটি বিস্মিত চোখের সামনে খুব যত্ন করে ছিঁড়ে ফেললেন। টুকরোগুলো খামের মধ্যে ঢুকিয়ে মাধবীলতার দিকে এগিয়ে ধরলেন তিনি, এগুলো পুড়িয়ে ফেলো তো!
মিস্টার রায় মাথা নাড়লেন, এমন ঘটনা আমি আগে কখনও দেখা দূরের কথা, শুনিওনি। মানুষ সম্পত্তি পাওয়ার জন্যে মামলা করে, আপনি স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলেন।
ছোটমা বললেন, আমি আর কদিন! ধরুন, তিনি যদি কোনও উইল না করে যেতেন তা হলে এই বাড়ির ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নিতে হত?
আদালতে গিয়ে ওঁর প্রকৃত উত্তরাধিকারীরা নিজেদের দাবির সপক্ষে প্রমাণ দিতে পারলে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিতে হবে। তারপর কোর্ট অর্ডার দেবেন।
তবে তাই করুন।
বেশ। নামগুলো বলুন।
আপনি অনিমেষের নামেই আবেদন করুন।
ছোটমা কথাগুলো বলতেই অনিমেষের মুখ থেকে ছিটকে বের হল, অসম্ভব।
মিস্টার রায় অবাক হয়ে তাকালে অনিমেষ বলল, আমি এই বাড়ির মালিকানা পেতে একদম রাজি নই।
আপনি তো মহীতোষবাবুর একমাত্র ছেলে। মিস্টার রায় বললেন।
হতে পারি। কিন্তু আমাকে তিনি বঞ্চিত করেছেন ভেবেচিন্তে। তার শেষ ইচ্ছে ছিল আমাকে কিছু না দিতে চাওয়া। আর ছেলে হিসেবে আমি তো কখনওই এই বাড়ির জন্যে কিছু করিনি। দীর্ঘকাল এই বাড়ির ছায়াও মাড়াইনি। তাই এই বাড়ি পাওয়ার কোনও অধিকার আমার নেই। অনিমেষ বলল।
মিস্টার রায় মাথা নাড়লেন, সত্যি কথা।
মাধবীলতা বলল, তা হলে এই বাড়ি বিক্রি হবে কী করে?
বাড়ি বিক্রির কথা ভাবা হয়েছে? মিস্টার রায় জিজ্ঞাসা করলেন।
হ্যাঁ। ওঁর পক্ষে আর একা থাকা সম্ভব হচ্ছে না। ওঁর বয়স বাড়ছে, শরীরও খারাপ হচ্ছে। তাই বাড়ি বিক্রি করে যে টাকা পাওয়া যাবে তা ওঁর নামে ব্যাঙ্কে রেখে একটা ভাল ফ্ল্যাট ভাড়া করে ওঁর থাকার ব্যবস্থা করার কথা ভাবা হয়েছে। মাধবীলতা বলল।
সেখানেও তো ওঁকে একা থাকতে হবে? মিস্টার রায় জিজ্ঞাসা করলেন।
এত বড় বাড়িতে একা থাকা যায় না, যেটা ফ্ল্যাটে সম্ভব।
ওর মৃত্যুর পরে টাকাটার কী হবে?
উনিই ঠিক করবেন।
কী আশ্চর্য! উনি তো বাড়ির মালিকানা নিতে রাজি হননি। বাড়ি বিক্রি করার টাকার মালিকানা নেবেন কী করে?
মাধবীলতা চুপ করে গেল। ছোটমা বললেন, অনি যখন রাজি হচ্ছে না তখন ওর ছেলে অর্ককে এই সবকিছু দিয়ে দেওয়া হোক।
তার বয়স কত?
প্রায় চল্লিশ। ছোটমাই জবাব দিলেন।
অ। তিনি এখানে এসেছেন?
না। কিন্তু আসবে।
বেশ, তিনি এলে এবং রাজি হলে তো কোনও সমস্যাই নেই। মিস্টার রায় উঠে দাঁড়ালেন, আচ্ছা, আমি চলি।
অনিমেষ তাঁকে গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে এল। গাড়িতে ওঠার আগে মিস্টার রায় জিজ্ঞাসা করলেন, আপনার ছেলে অর্ক কী করেন?
চাকরি। কলকাতায়। অনিমেষ জবাব দিল।