আমি যে লেখক না–এই বিষয়টি আমেরিকায় যাবার পর স্পষ্ট হয়ে গেল। টানা পাঁচ বছর আমেরিকায় ছিলাম। Ph.D করেছি, পোস্ট ডক করেছি। এই পাঁচ বছরে এক লাইনও লিখি নি। গল্প-উপন্যাসের তো প্রশ্নই ওঠে না।
একজন সত্যিকার লেখক না লিখে থাকতে পারবেন না। তাকে কিছু না কিছু লিখতেই হবে। একজন তবলাবাদক তবলী না পেলে টেবিলে বা চেয়ারে বোল তোলেন। একজন গায়ককে গুনগুন করতেই হয়। সেখানে আমি কীভাবে না লিখে পারছি? আমার সমস্যাটা কী?
প্রচণ্ড পড়াশোনার চাপ। লেখার সময় নেই —এইসব ভুয়া কথা। একজন লেখক প্রচণ্ড কাজের চাপের ভেতর থেকেও লেখার সময় বের করে নেবেন। তাহলে আমি কেন পারছি না? সমস্যাটা কি পরিবেশ? বাংলাদেশের আলো-বাতাস গায়ে লাগছে না বলেই বাংলা ভাষার লেখকের বলপয়েন্ট দিয়ে কালি বের হচ্ছে না? বৃষ্টির ঝমঝম শব্দ শুনছি না, ব্যাঙের ডাক শুনছি না—এটাই কি সমস্যা?
মা’কে চিঠি লিখলাম তিনি যেন ক্যাসেটে ব্যাঙের ডাক এবং বৃষ্টির শব্দ রেকর্ড করে পাঠান। আমার সর্বকনিষ্ঠ ভ্রাতা আহসান হাবীব ক্যাসেট রেকর্ডার নিয়ে বৃষ্টির দিনে বনবাদাড়ে ঘুরতে লাগল। যথাসময়ে বর্ষা এবং ব্যাঙের ডাকের ক্যাসেট চলে এল।
আমি তখন ইউনিভার্সিটি হাউজিং-এ চমৎকার বাড়ি পেয়েছি। ডুপলেক্স বাড়ি। একতলায় রান্নাঘর, বসার ঘর এবং স্টাডি রুম। দোতলায় দু’টা শোবার ঘর। গুলতেকিন তার কন্যাকে (নোভা) নিয়ে চলে এসেছে। মেয়ের বয়সও দেখতে দেখতে তিন বছর হয়ে গেছে। নিখুঁত বাংলা এবং নিখুঁত ইংরেজিতে। হড়বড় করে কথা বলে। উইকএন্ডে আশেপাশের সব বাঙালি চলে আসে। খিচুড়ি মাংস রান্না হয় এবং ক্যাসেটে বৃষ্টির শব্দ ও ব্যাঙের ডাক বাজে। বাঙালি ছেলেগুলির চোখ ছলছল করতে থাকে।
বাদলা দিনে মনে পড়ে
ছেলেবেলার গান
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর
নদেয় এল বান।
আমার জীবনচর্যা সম্পর্কে বলি। সামারে দুই মাস কাজের চাপ থাকে না। সবাই ভ্যাকেশনে যায়। আমার ভ্যাকেশনে যাবার ডলার নেই। আমি ইউনিভার্সিটি থেকে কিছু জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ শুরু করে দিলাম। চাষি হুমায়ূন। আমার সঙ্গী মেয়ে নোভা। পিতা-কন্যা দু’জনের হাতেই খুরপা। আমরা মাটি কোপাই! বীজ বুনি। গাছে পানি দেই। এই সময়টায় মেয়ের সঙ্গে নানা গল্প করি। সবই বাংলাদেশের গল্প। বাংলাদেশের বিশাল নদী, বাঁশবাগানে জোছনা, রয়েল বেঙ্গল টাইগার এবং হরিণে ভর্তি সুন্দরবন, বিশাল সমুদ্র, সিলেটের ডিঙ্গিপোতা হাওর যেখানে সমুদ্রের মতো বড় বড় ঢেউ ওঠে।
নোভা চোখ বড় বড় করে শোনে। একদিন সে বলল, আমাদের দেশটা “a piece of paradise”, তাই না বাবা?
আমি বললাম, অবশ্যই তাই। তবে একটু ভুল করেছ। আমি নিশ্চিত Paradiseও এত সুন্দর না।
আমি অতি ভাগ্যবান, আমি আমার জীবন Paradise-এ কাটিয়ে দিতে পারছি। আমার মেয়েটা ভাগ্যবতী না। তার জীবন কাটছে আমেরিকায়। সে এবং তার স্বামী না-কি ঐ দেশের নাগরিকত্বও পেয়েছে। মেয়েটির কি কখনো তার বাবার সঙ্গে কথোপকথন মনে পড়ে? জানি না। আমার সঙ্গে দীর্ঘদিন তার কোনো যোগাযোগ নেই।
.
শুরুতে যে তথ্য দিয়েছি, লেখালেখি কিছুই করি নি, সেখানে সামান্য ভুল আছে। চিঠি লিখতাম। মাকে, ভাইবোনদের। আমি ভালো আছি। তুমি কেমন আছ? এর বাইরে চিঠিতে তেমন কিছু লেখার থাকে না। দেশের সবাই চায় অনেকক্ষণ ধরে চিঠি পড়তে। কাজেই আমি বানিয়ে বানিয়ে অনেক কিছু লিখতাম যা মোটেই সত্যি না। যেমন একবার টর্নেডোর বর্ণনা দিলাম। একবার লিখলাম ব্লিজার্ডে কীভাবে আটকা পড়েছিলাম। Frost bite হয়ে গেছে।
এইসব কি সাহিত্যের আওতায় পড়বে? Vladimir Nabokov (বিখ্যাত রাশিয়ান লেখক এবং সমালোচক-এর মতে এইসবও সাহিত্যের মধ্যে পড়বে। তিনি বলছেন, Neanderthal যুগে একটি বালক গুহা থেকে চিৎকার করতে করতে বের হলো—নেকড়ে বাঘ! নেকড়ে বাঘ! দেখা গেল তার পেছনে পেছনে ছুটে আসছে নেকড়ে বাঘ। তখন কিন্তু সাহিত্যের জন্ম হলো না। সাহিত্যের জন্ম হলো তখনি যখন একটা বালক চিৎকার করতে করতে আসছে—নেকড়ে বাঘ! নেকড়ে বাঘ! অথচ তার আশেপাশে কোনো নেকড়ে বাঘ নেই।
আমেরিকায় শুরুতে বেশ অর্থকষ্টে ছিলাম। নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা। একটা উদাহরণ দিয়ে পরিষ্কার করি। বড় মেয়ের প্রথম জন্মদিন। তারিখটা বেকায়দা ধরনের, ২৮ আগস্ট মাসের শেষদিকে। বেতনের চেক পেতে আরো তিনদিন লাগবে। হাতের সব ডলার শেষ। মেয়ের মা’র মেয়ের প্রথম জন্মদিন নিয়ে নানান পরিকল্পনা। আমি উপহার কিনে নিয়ে এলাম দুই কেজি ময়দা। মেয়ে ময়দা ছানতে পছন্দ করে। আমি প্যাকেট খুলে মেয়ের চারপাশে ময়দা বিছিয়ে দিলাম। সে মহানন্দে দুই হাতে ময়দা ছানাছানি করতে লাগল। সে আনন্দে যতই হাসে, তার মা দুঃখে ততই কাঁদে। মেয়ের প্রথম জন্মদিনে দুই কেজি ময়দা!
তার কষ্ট দেখে আমি বলেছিলাম, দোয়া করছি যেন তোমার সব ছেলেমেয়ে থাকে দুধেভাতে। যেন তারা কখনো অর্থকষ্টে না পড়ে। পরম করুণাময় আমার প্রার্থনা শুনেছেন।
গুলতেকিন আমার অর্থকষ্ট লাঘবের জন্যে কাজে নেমে পড়ল। বেবি সিটিং করে। পত্রিকার অ্যাড দেখে কাপড় এনে রিফু করে দেয়। এইসব বিষয় অন্য বইগুলিতে বিস্তারিত লিখেছি বলে এখানে আর লিখলাম না।
এই সময় একটা ঘটনা ঘটল। আমার প্রফেসর একদিন আমাকে ডেকে বললেন, তোমার কর্মকাণ্ডে আমি যথেষ্ট অসুখী (Very unhappy). তোমার টিচিং অ্যাসিসটেন্সশিপ বাতিল করা হলো।
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। এই লোক বলে কী? আমি খাব কী?
প্রফেসর বললেন, যাও Mail fox চেক কর। আমাকে Blank took দেবে না। Studentদের Blank look আমার একেবারেই পছন্দ না।
আমি মেইল বক্স চেক করতে গেলাম। সবার জন্যে আলাদা আলাদা মেইল বক্স। আমারটা খুলে একটা চিঠি পেলাম, তাতে লেখা তোমার Performance এ আমরা খুশি। তুমি যাতে মনেপ্রাণে Ph.D ডিগ্রির জন্যে কাজ করতে পার তার জন্যে তোমাকে স্কলারশিপ দেয়া হলো। তোমাকে এখন আর টিচিং অ্যাসিসটেন্সশিপ করতে হবে না।
স্কলারশিপের পরিমাণ ৫৫০ ডলার। টিচিং অ্যাসিসটেন্ট হিসেবে আগে পেতাম ৪৫০ ভলার।
আমেরিকানরা মজা করতে পছন্দ করে। আমার প্রফেসর আমার সঙ্গে একটু মজা করলেন। এখানে যার কথা লিখছি তার নাম প্রফেসর Jeno Wicks. তিনি আমার Ph.D Guide ছিলেন না। তিনি ছিলেন বিভাগের চেয়ারম্যান। ফার্গো শহরে তাঁর ছবির মতো সুন্দর একটা বাড়ি ছিল। বাড়ির পেছনে ছিল সুইমিং পুল। তিনি আমেরিকান সব উৎসবে বিদেশী ছাত্রদের তার বাড়িতে দাওয়াত করতেন। প্রচুর আয়োজন থাকত। তার যুক্তি-বিদেশী ছেলেমেয়েগুলি নিজের দেশ ছেড়ে এখানে একা একা বাস করছে। তারা উৎসব উপলক্ষে কিছুক্ষণ আনন্দ করুক।
গত বত্সর প্রফেসর জেনো উইকস মারা গেছেন। নর্থ ডেকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি তাদের বুলেটিনের মাধ্যমে জানিয়েছে, প্রফেসর জেনো উইকস তাঁর সমস্ত বিষয়সম্পত্তি ইউনিভার্সিটিকে দান করে গেছেন।
আমি আমার এক জীবনে অনেক মহাপ্রাণ মানুষের সংস্পর্শে এসেছি। জীবনের এই সঞ্চয় তুচ্ছ করার মতো নয়।
প্রফেসর জেনো উইকস আমার প্রফেসরদের মধ্যে একমাত্র ব্যক্তি, যাকে আমি আমার লেখক পরিচয় দিয়েছিলাম। গুলতেকিন তার সঙ্গে দেশ থেকে আমার প্রতিটি বইয়ের কয়েকটা করে কপি নিয়ে এসেছিল। আমি তাঁকে বইগুলি দেখালাম। তিনি বললেন, কোন ভাষায় লেখা?
আমি বললাম, বাংলা।
তিনি বললেন, তোমাদের অক্ষরগুলি তো চায়নিজদের চেয়েও জটিল। বসো আমার সামনে। আমি বসলাম। তিনি ল্যাবরেটরির সব ছাত্রছাত্রীকে ডেকে পাঠালেন। আমাকে লজ্জায় ফেলে আমার লেখক পরিচয় দিলেন। তারপর গম্ভীর গলায় বললেন, পড়ে শোনাও।
আমি বললাম, স্যার, কেউ তো কিছু বুঝবে না।
প্রফেসর বললেন, না বুঝলে নাই। তোমাকে পড়তে বলছি তুমি পড়।
আমি শঙ্খনীল কারাগার উপন্যাসের কয়েক পৃষ্ঠা পড়লাম। আমার প্রফেসরের দিকে তাকিয়ে মনে হলো তিনি খুবই আনন্দ পাচ্ছেন। পাঠ শেষ হলে প্রফেসর ছাত্রদের দিকে তাকিয়ে বললেন, কেমন লাগল?
কেউ কিছু বলল না, সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। শুধু কোরিয়ান ছাত্র ‘হান’ বলল—মনে হচ্ছে মাথার ভেতর কিছু ছোট ছোট পোকা ঢুকে কিলবিল করছিল।
প্রফেসর বললেন, এই লেখক সপরিবারে আজ রাতে আমার বাসায় ডিনার করবে। তোমাদের নিমন্ত্রণ। A special night with a writer.
.
দেশে ফিরে আমি আমার একটা বই উৎসর্গ করলাম প্রফেসর জেনো উইকসকে। সেই বই তাঁকে পাঠাই নি এবং খবরটাও জানাই নি। আমি আমার শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা আমার পাঠক-পাঠিকাদের জানিয়েছি। এটাই যথেষ্ট।
১২.
যারা বিদেশে পড়াশোনা করতে যায়, তারা দেশে ফিরে ডিগ্রি নিয়ে। কেউ M.S কেউ Ph.D. আমি একটা Ph.D এবং সঙ্গে নতুন দুটি মেয়ে নিয়ে দেশে ফিরলাম। শীলা এবং বিপাশা। বিপাশার তখনো জন্ম হয় নি। সে তার মায়ের পেটে। শীলার মা দেশে ফেরাটা নিতে পারছিল না। তার কথা, দেশে আমি যা বেতন পাব তা দিয়ে সবাইকে তিনবেলা খাওয়াবার সামর্থ্যও থাকবে না। আমার একটাই যুক্তি, বিদেশে পড়াশোনা করতে এসেছি। পড়াশোনা শেষ–এখন দেশে ফিরব। অন্যদের মতো বিদেশে স্থায়ী হব না। যে দেশের স্বাধীনতার জন্যে আমার বাবা শহীদ হয়েছেন, সে দেশকে অস্বীকার করে অন্যদেশের নাগরিকত্ব আমি নিতে পারব না।
খুব খারাপ অবস্থায় দেশে ফিরলাম। পকেটে আমেরিকার দীর্ঘ প্রবাস জীবনের সঞ্চয় দুশ ইউএস ডলার। একটা ফ্রিজও কিনেছিলাম। সেই ফ্রিজ জাহাজে করে দেশে পাঠিয়ে দেয়া হলো। যে সময়ের কথা বলছি তখন বিদেশফেরতরা ফ্রিজ এবং টেলিভিশন আনতেন। টেলিভিশন কেনার টাকা ছিল না বলে শুধুই ফ্রিজ।
দেশে ফিরে আমার বড় মেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হলো। যা দেখে তাতেই মুগ্ধ হয়। শুধু থালা হাতে নিরন্ন মানুষের দল বাড়িতে আসছে ভাতের জন্যে এই দৃশ্য সে নিতে পারল না। তার ক্ষুদ্র জীবনে এই দৃশ্য সে দেখে নি। তার একটাই প্রশ্ন, এদের ফুড নেই কেন?
বাসায় কোনো ভিখিরি এলেই নোভা দৌড়ে যেত রান্নাঘরে। যা পেত একটা থালায় সাজিয়ে ছুটে যেত নিচে। আমাকে যে প্রশ্ন করত এই প্রশ্ন সে ভিখিরিদেরও করত। আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইত, তোমাদের বাসায় ফুড নেই কেন?
বড় মেয়েটির এই কাণ্ড তার দাদি খুব পছন্দ করতেন। তিনি তাকে ডাকতেন মাদার তেরেসা নামে।
আমেরিকা থেকে ফিরে নুরজাহান রোডের একটা বাসায় উঠলাম। একটা ঘরে আমার পরিবার। অন্য ঘরে আমার মা, শাহীন এবং ছোটবোন মনি।
আমার ঘরে একটা খাট পাতার পর আর জায়গা হয় না। সেই খাটে আমার পরিবারের সবার জায়গা হয় না। আমরা ঘুমাই আড়াআড়ি (ময়মনসিংহের ভাষায় ফাত্তাইরা হয়ে)।
বাসায় কোনো টেলিভিশন নেই। নোভা-শীলা টেলিভিশন দেখার জন্যে পাশের ফ্ল্যাটে যায়! টেলিভিশনে বাংলাদেশ প্রোগ্রাম দেখতে তাদের না-কি খুব ভালো লাগে। তখন এত চ্যানেল হয় নি। বিটিভি সবেধন নীলমণি।
এক রাতের কথা। মেয়েরা খুব আগ্রহ করে টিভি দেখতে গিয়েছে। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা ফিরে এসে জানালো, ঐ ফ্ল্যাটে মেহমান এসেছে। কাজেই তাদেরকে আজ টিভি দেখতে দেয়া হবে না। বাচ্চারা খুবই মন খারাপ করল। তাদের চেয়েও মন খারাপ করল বাচ্চাদের মা। কেন বাংলাদেশে এসেছি? কী পাচ্ছি বাংলাদেশে? একটা টিভি কেনার সামর্থ্য নেই। ইত্যাদি ইত্যাদি।
রাতে ভাত খাবার সময় বড় মেয়ে বলল, বাবা, তুমি আমাদের একটা টিভি কিনে দেবে?
আমি বললাম, দেব।
রঙিন টিভি?
আমি বললাম, অবশ্যই রঙিন টিভি।
কবে কিনে দেবে?
এই প্রশ্নের জবাব দিতে পারলাম না। তবে একটা রঙিন টিভি যেভাবেই হোক কিনতে হবে এটা মাথায় ঢুকে গেল।
বিটিভির নওয়াজীশ আলি খান সাহেবের সঙ্গে তখন আমার সামান্য পরিচয় হয়েছে। আমার একটি নাটক তিনি বিটিভিতে প্রচার করেছেন। নাম খুব সম্ভব ‘প্রথম প্রহর’। তিনি আমাকে একটি ধারাবাহিক নাটক লিখতে বলছেন। আমি ধারাবাহিক নাটক লিখতে রাজি হলাম। ঠিক করলাম, একটি রঙিন টিভি কিনতে যত টাকা লাগে তত টাকার ধারাবাহিক নাটক লেখা হবে। যে নাটকটি লিখলাম তার নাম ‘এইসব দিনরাত্রি’। নাটকটির পরিচালক ছিলেন মুস্তাফিজুর রহমান।
আমার রঙিন টিভি কেনার টাকা হওয়া মাত্র নাটকের একটি চরিত্র টুনির মৃত্যু দিয়ে নাটক শেষ করে দিলাম।
এই নাটকটির প্রতি আমি নানাভাবে ঋণী। নাটকটির কারণে আমি আমার বাচ্চাদের একটা শখ মিটালাম—রঙিন টিভি কিনলাম।
একটিমাত্র ধারাবাহিক নাটকের কারণে দর্শকদের কাছে হুমায়ূন আহমেদ নামটি পরিচিতি পেল। তারা এই নাট্যকারের লেখা গল্প-উপন্যাস হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করা শুরু করল।
এই নাটক প্রসঙ্গে একটা মজার গল্প বলি। মুস্তাফিজুর রহমান সাহেব একদিন টেলিফোনে আমাকে ডেকে পাঠালেন। একটা মজার জিনিস না-কি দেখাবেন। আমি মজার জিনিস দেখতে গেলাম।
মুস্তাফিজ সাহেব বললেন, একতলায় আমাদের একটা বিলবোর্ড আছে। বিলবোর্ডটা দেখে আসুন। আনন্দ পাবেন।
আনন্দ পাবার জন্যে বিলবোর্ড দেখতে গেলাম এবং আনন্দ পেলাম। বিলবোর্ডে কোলকাতা থেকে প্রকাশিত Statesman পত্রিকার একটি খবর সেঁটে দেয়া আছে। সেখানে লেখা আজ রাতে এইসব দিনরাত্রির শেষ পর্ব প্রচার হবে। এরপর আমরা কী দেখব?
বিটিভিতে নাটক লিখে খুব আনন্দ পেয়েছি। একের পর এক ধারাবাহিক নাটক—অয়োময়, বহুব্রীহি, কোথাও কেউ নেই। ঈদের হাসির নাটক। এক ঘণ্টার নাটক। আমি খুব সূক্ষ্মভাবে নাটকের ভাষা বদলানোর একটা চেষ্টা চালালাম। আগে কোলকাতার ভাষা (নদীয়া-শান্তিপুরের ভাষা বলাই ঠিক হবে) ছিল বিটিভি নাটকের ভাষা। যাই নি, খাই নি, জুতো, নৌকো। আমি চেষ্টা করলাম ঢাকার ভাষা বলে আলাদা কিছু দাঁড়া করাতে।
আমার ধারণা পরীক্ষা-নিরীক্ষা পুরোপুরি ব্যর্থ হয় নি। আজকের নাটকের ভাষা নদীয়া-শান্তিপুর মুক্ত।
বিটিভির একটি কর্মকাণ্ডে আহত হয়েছিলাম। বলপয়েন্ট লেখা মানেই আনন্দ অভিজ্ঞতার বয়ান না। মনোকষ্টের বয়ানও তো বটে! বিটিভি তার পঁচিশ বর্ষ পূর্তি উপলক্ষে রজতজয়ন্তির বিশাল অনুষ্ঠান করছে। পনেরোদিন ধরে অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে বিটিভির নানান দিকের সাফল্য তুলে ধরা হচ্ছে। সেই বিপুল উৎসবে একটি নাম অনুচ্চারিত হুমায়ূন আহমেদ। অথচ তখন আমার সব কটি ধারাবাহিক নাটক প্রচারিত। টিভি নাটকে আমি কী করেছি কতটুকু করেছি তা ‘বিটিভি’র কর্তাব্যক্তিরা জানেন।
আমি এক কর্তাব্যক্তিকে জিজ্ঞেস করলাম। বললাম, আমি তো আপনাদের ‘ভাসুর’ না। আমার নাম মুখে নিতে সমস্যা কী ছিল?
তিনি বললেন, আপনি খুব ভালোভাবেই অনুষ্ঠানে ছিলেন। পরে আপনাকে বাদ দেয়া হয়েছে।
আমি বললাম, কেন?
কর্তাব্যক্তি মধুর ভঙ্গিতে হাসলেন। কিছু বললেন না।
বাদ পড়ার অভিজ্ঞতা আমার জীবনে প্রচুর আছে। সাহিত্যের অধ্যাপকদের অনেক গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ছাপা হয়েছে, যার বিষয়বস্তু মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তীকালীন সাহিত্য। সেখানে সবাই আছে, আমি নেই। হতেই পারে সাহিত্যের অধ্যাপকরা আমাকে লেখক মনে করেন না। এমন একজন মনে করেন যে লেখালেখি করে অর্থ উপার্জন করেন। তাদের কাছে লেখালেখি করে অর্থ উপার্জন মানে সাহিত্যের মহান বোধের অবমাননা। এই নিয়ে আমি ঝামেলাতেও পড়েছি। উদাহরণ দেই—
এইসব দিনরাত্রি ধারাবাহিক নাটকটি প্রচার হবার পর এক সাংবাদিক জানতে চাইলেন, এই ধারাবাহিক নাটকটি লেখার পেছনে আপনার মূল প্রেরণ কী ছিল?
আমি বললাম, অর্থ উপার্জন। আমার একটি রঙিন টিভি কেনার প্রয়োজন ছিল বলেই ধারাবাহিক নাটকটি লিখেছি।
সাক্ষাৎকার প্রচার হবার পরপরই এই নাটকে যারা অভিনয় করেছেন তারা আহত হলেন। বিশেষভাবে রাগলেন প্রয়াত অভিনেতা আবুল খায়ের। তিনি বললেন, আমরা এত আবেগ নিয়ে এই নাটকে অভিনয় করেছি, আর হুমায়ুন আহমেদ বলে দিলেন তিনি সামান্য একটা রঙিন টিভির জন্যে নাটক লিখেছেন।
অভিনেতাদের তপ্ত বক্তব্য পত্রিকায় ছাপা হাতে লাগল। বাধ্য হয়ে একদিন আমি আবুল খায়ের সাহেবকে ডেকে পাঠালাম। আমি বললাম, ভাই, আপনি যে অভিনয় করেছেন তার জন্যে কি বিটিভির কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন?
তিনি বললেন, হ্যাঁ নিয়েছি।
আমি বললাম, আমিও ঠিক তাই করেছি। নাটক লেখার জন্যে টাকা নিয়েছি। আপনি হৈচৈ করছেন কেন? একজন লেখক চাঁদের আলো খেয়ে বাঁচেন না। তাকে প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেট খেতে হয়।
আপনি কেন বললেন, রঙিন টিভি কেনার জন্যে নাটক লিখেছেন?
যেটা সত্যি আমি তাই বলেছি। আপনাকে ডেকেছি রঙিন টিভিটা দেখার জন্য। নিজের চোখে দেখুন আমার বাচ্চারা কত আগ্রহ নিয়ে টিভি দেখছে। বেতনের টাকা দিয়ে বাচ্চাদের এই টিভিটা কিনে দেবার সামর্থ্য আমার ছিল না।
আবুল খায়ের সাহেব খুব আবেগপ্রবণ মানুষ ছিলেন। তিনি কিছুক্ষণ আমার বাচ্চাদের সঙ্গে টিভি দেখলেন। একসময় তার চোখে পানি এসে গেল। তিনি চোখ মুছতে মুছতে বললেন, ভুল করেছি। ক্ষমা চাই।
খায়ের ভাইয়ের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বহাল ছিল। নতুন কোনো নাটক বানাতে গেলেই আমার তার কথা মনে পড়ে। খায়ের ভাইয়ের সমকক্ষ অভিনেতা বাংলাদেশে আছে বলে আমি মনে করি না।
১৩.
বলপয়েন্টে কোনো ধারাবাহিকতা নেই। এই ঘটনার পর এই ঘটনা ঘটল লিখে লেখকজীবনের ইতিহাস লেখায় আমি যাচ্ছি না। যখন যা মনে আসছে তাই লিখছি। সবচেয়ে বড় সমস্যা ডায়েরি লেখার অভ্যাস আমার নেই। চিঠিপত্র বা
ফটোগ্রাফ জমানোর মধ্যেও নেই। আমার সমস্ত সঞ্চয়ই স্মৃতিতে।
আমার মৃত্যুর পর পত্রিকাওয়ালারা একটা সমস্যায় পড়বেন। ‘হুমায়ূন আহমেদের ডায়েরি’ বা ‘অপ্রকাশিত জার্নাল’ নামে কিছু ছাপাতে পারবেন না।
সাহিত্যের লাইনের গ্রান্ডমাস্টারদের কেউ কেউ আমাকে চিঠি লিখেছেন। সেইসব চিঠিও জমা করে রাখি নি। আমার মানসিকতায় নিঃসঙ্গতা ব্যাধি আছে। নিঃসঙ্গতা ব্যধিগ্রস্তরা তাদের পাশে কিছুই জমা করতে ভালোবাসে না। প্রাণপণ চেষ্টা করে সবার কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে রাখতে। উদাহরণ দেই।
ঔপন্যাসিক বিমল মিত্র এসেছেন বাংলাদেশে। উঠেছেন সোনারগাঁও হোটেলে। কৈশোরে বিমল মিত্রের বিশাল বই কড়ি দিয়ে কিনলাম খাটের তলায় বসে পড়ে শেষ করেছি। ক্ষণে ক্ষণে অশ্রুবর্ষণ করেছি। সবার সামনে এই বই পড়ার উপায় ছিল না, কারণ Out book হিসেবে একজন কিশোরের কাছে সেই। বই নিষিদ্ধ।
কড়ি দিয়ে কিনলাম, সাহেব বিবি গোলাম-এর বিমল মিত্র ঢাকায় শুনেই ভালো লাগল। এক সন্ধ্যায় বিমল মিত্রের কাছ থেকে টেলিফোন, হুমায়ূন, আসো আমার সঙ্গে দেখা করে যাও।
আমার আনন্দিত হয়ে ছুটে যাওয়া দরকার ছিল। তা না করে বিনয়ের সঙ্গে বললাম, আমি কারোর সঙ্গে দেখা করি না। আমি আসছি না। আপনি কিছু মনে করবেন না।
যত বিনয়ের সঙ্গেই কথাগুলি বলা হোক, বিমল মিত্রের কাছে তা সুখকর নিশ্চয়ই ছিল না। আমার কর্মকাণ্ডের ব্যাখ্যা—-লেখককে চিনব তার লেখা দিয়ে। ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে চেনার কিছু নেই। পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সব লেখকের প্রতি আমার একধরনের বিরাগও ছিল। তারা পিঠ চাপড়ানো কথা বলতে ভালোবাসেন। নিজেদের ব্রাহ্মণ ভাবেন। বাংলাদেশের লেখকদের জল-চল জাতের উপরে কিছু ভাবেন না।
এখনো যে সেই অবস্থার ইতরবিশেষ হয়েছে তা-না। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম ঢাকায় আসার ঘটনা উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। চারদিকে ফিসফাস ভাব। সুনীল এসেছেন। পাঠকদের হাত থেকে তাকে দূরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। খবর পেলেই পাঠকরা প্রিয় লেখকের ওপর হামলে পড়বেন। তিনি কোথায় আছেন তা সম্পূর্ণ গোপন। যাদের সঙ্গে আছেন তারা মহাভাগ্যবান। হিসেবে চিহ্নিত। তারা কিছু Exclusive পার্টির ব্যবস্থা করছেন। অতি ভাগ্যবানরা সেই পার্টিতে যাবার সুযোগ পাচ্ছেন।
আমি তেমন এক পার্টিতে যাবার সুযোগ পেলাম। জনৈক প্রকাশকের বাড়িতে পার্টি। আমাকে কয়েকবার টেলিফোনে জানানো হলো যেন একা যাই। কাউকে সঙ্গে না নিয়ে যাই। এবং ঘটনাটা প্রচার না করি। প্রচার হয়ে গেলে জনতা সামলানো কঠিন হবে। ইত্যাদি।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে প্রথম দেখলাম। হাতে সিগারেট এবং হুইস্কির গ্লাস। আশেপাশে কী ঘটছে তা নিয়ে মোটেই মাথা ঘামাচ্ছেন বলে মনে হলো না। তার স্ত্রী স্বাতী গঙ্গোপাধ্যায় সুনীলের পাশে বসেন নি। তার হাতে কোনো গ্লাস নেই। তাঁকে খানিকটা বিব্রত মনে হচ্ছে। ঘরে আলো কম। অন্য ঘরে রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজানো হচ্ছে। কঠিন পরিবেশ যাকে বলে।
পার্টিতে নিমন্ত্রণপ্রাপ্তরা বেশিরভাগই লেখক। তারা তাদের সব বই সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন। বই সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে। তিনি পাতা উল্টে পাশে রেখে দিচ্ছেন। সাহিত্য এবং কাব্য আলোচনা চলছে। এমন কৃত্রিম কথাবার্তা এবং আচরণ আমি আমার জীবনে কম দেখেছি। শুরু হলো ফটোসেশন। একেকজন লেখক যাচ্ছেন, নানান ভঙ্গিমায় ছবি তুলে ফিরছেন। মন ভরছে না। তিনি আবারো যাচ্ছেন।
গ্রহের চারপাশে ঘূর্ণায়মান উপগ্রহদের ভেদ করে আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কাছে পৌঁছতে পারলাম না। তাকে দেবার জন্যে আমি আমার একটা উপন্যাস নিয়ে গিয়েছিলাম। সেটা তাঁকে দেয়া হলো না। গোপনে ফেরত নিয়ে চলে এলাম।
আসরে ঔপন্যাসিক ইমদাদুল হক মিলনের ব্যবহার একটু অদ্ভুত মনে হলো। সে দেখি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে সমানে তুমি তুমি করে সম্বোধন করছে। সমরেশ মজুমদার একবার এলেন। মিলন তাঁকেও দেখি তুমি করে বলছে। একদিন মিলনকে বললাম, এঁরা বয়সে তোমার চেয়ে অনেক বড়। তুমি অবলীলায় তাদের তুমি বলছ কীভাবে?
মিলনের উত্তর শুনে আনন্দ পেলাম। সে বলল, হুমায়ূন ভাই, এঁরা বাংলাদেশে এসে সবাইকে তুমি তুমি করেন। কাজেই আমিও করি। সম্বোধনে সমান সমান।
আমার সমস্যা হচ্ছে আমি কাউকেই তুমি করে বলতে পারি না। তুমি তুমি বলার বন্ধু আমার নেই। সবার সঙ্গেই ফর্মাল সম্পর্ক। একদিন শাওন বলল, তোমার যে কোনো বন্ধু নেই এটা কি তুমি জানো? তোমার পরিচিতজন আছে, বন্ধু নেই। তুমি অতি নিঃসঙ্গ মানুষদের একজন।
আমি চিন্তা করে দেখলাম ঘটনা তো সেরকমই। বন্ধু নেই একজন মানুষ বাঁচে কীভাবে? আমি তো ভালো আছি এবং সুখেই আছি। কিছুক্ষণ চিন্তা করেই রহস্যের সমাধান বের করলাম (আমি আবার মিসির আলি তো)। আমার মাথায় সবসময় গল্প কিংবা উপন্যাস থাকে। গল্প-উপন্যাস যখন যেটা লিখছি তার চরিত্রই বন্ধু হিসেবে থাকে। বাইরের বন্ধুর প্রয়োজন সে কারণেই হয় না।
ইমদাদুল হক মিলনের কাছে ফিরে যাই। তার সঙ্গে প্রথম দেখা বইমেলায়। আমেরিকা থেকে ফেরার পর প্রথম বইমেলায় গিয়েছি। একটা স্টলের সামনে ভিড়। লেখকের কাছ থেকে অটোগ্রাফ নেয়া হচ্ছে। লেখক দাঁড়িয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন। তার পরনে জিন্সের প্যান্ট। মাথা সম্ভবত কামানো। লেখকের চেহারা মোটেই লেখকসুলভ নয়। দেখাচ্ছে পাড়ার মাস্তানদের মতো। আমি এই লেখকের লেখার সঙ্গে পরিচিত নই। নামের সঙ্গেও না। আমি তার একটা বই কিনলাম (ও রাধা ও কৃষ্ণ) এবং লাইনে দাঁড়ালাম অটোগ্রাফের জন্যে। আমি আমার এই দীর্ঘ জীবনে একবারই কারো কাছ থেকে অটোগ্রাফ নিয়েছি।
মিলন খুব সম্ভব নিজেকে প্রেমের উপন্যাসের লেখক হিসেবে পরিচিত করতে চেয়েছিল। কম বয়সের জনপ্রিয়তার এই একটা সমস্যা। লেখক পাঠকদের চাহিদার কাছে নতজানু হন। মিলনের লেখার ক্ষমতার বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহ নেই। বাংলা সাহিত্যে স্থায়ী হবার ব্যবস্থা সে করে রেখেছে, তারপরেও তার ক্ষমতার ভুল ব্যবহার দেখে অনেকবার ব্যথিত হয়েছি।
ওয়ার্ড কমিশনাররা ক্যারেকটার সার্টিফিকেট দেন। আমি ওয়ার্ড কমিশনারের মতো মিলনকে একটা সার্টিফিকেট দিচ্ছি—
যার জন্যে প্রযোজ্য
লেখক ইমদাদুল হক মিলনের সঙ্গে আমার দীর্ঘদিনের পরিচয়। সে অতি, অতি বিনয়ী। ঘরোয়া আড্ডায় কখনো তাকে
উত্তেজিত হতে দেখে নি। বাংলা সাহিত্যের
পড়াশোনা তার ব্যাপক। বাংলা ভাষায় এমন কোনো বই লেখা হয় নি যা সে পড়ে নি। তার চরিত্রে জল-স্বভাব প্রবল। যে-কোনো
পাত্রেই তাকে রাখা যায়। রাষ্ট্রবিরোধী কোনো কর্মকাণ্ডে সে জড়িত না। আমি তার সর্বাঙ্গীন উন্নতি কামনা করি।
সার্টিফিকেট প্রসঙ্গ যখন এসেছে তখন আমি নিজে একটা সার্টিফিকেট যে পেয়েছিলাম সেই গল্পটা বলি। একদিন এক যুবক ছেলে আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। সে বলল, তার হাতের লেখা অবিকল রবীন্দ্রনাথের মতো। সে কিছু নমুনাও নিয়ে এসেছে। আমি বললাম, দেশ পত্রিকার সাগরময় ঘোষ তোমাকে পেলে লুফে নিতেন। একের পর এক রবীন্দ্রনাথের অপ্রকাশিত চিঠি প্রকাশ করতেন।
আমি তাকে দিয়ে নিজের জন্যে রবীন্দ্রনাথের একটা সার্টিফিকেট লিখিয়ে নিলাম। সেখানে লেখা
শ্রীমান হুমায়ূন আহমেদ,
তোমার কিছু রচনা পাঠ করিয়া বিমলানন্দ পাইয়াছি। তোমার কিছু শব্দের বানান বিষয়ে আমার কথা আছে। সাক্ষাতে বলিব।
শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
১৪.
নামের আগে ড. লাগিয়ে বসে আছি। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছি। কিন্তু সংসার চালিয়ে নিতে পারছি না। পত্রিকায় পড়ার মতো কোনো খবর নেই এই অজুহাত দেখিয়ে বাসায় পত্রিকা রাখাও বন্ধ। আমেরিকায় গুলতেকিন নানান কাজকর্ম করে কিছু রোজগার করত। বাংলাদেশে সেই রোজগারও বন্ধ। সে কোথাও যে চাকরি নেবে তাও সম্ভব না। শিক্ষাগত যোগ্যতা নেই। S.S.C পাশের পর বিয়ে হয়েছে। আমেরিকায় তাকে পড়াশোনা করানো সম্ভব হয় নি। [তবে সে দেশে ফিরে পড়াশোনা শুরু করেছিল এবং আমাকে অবাক করে দিয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম, এ ডিগ্রি নিয়েছিল।]
আগের কথায় ফিরে যাই। সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছি। কী করা যায় বুঝতে পারছি না। একদিন শুনলাম সেবা প্রকাশনীর আনোয়ার হোসেন সাহেবকে বই অনুবাদ করে দিলে তিনি তৎক্ষণাৎ নগদ টাকা দেন। গেলাম তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। তিনি আমার হাতে একটা ইংরেজি বই ধরিয়ে দিয়ে বললেন, অনুবাদ করে নিয়ে আসুন। পড়ে দেখি কেমন হয়েছে। ভালো হলে ছাপব। নগদ টাকা দেব। বইটার নাম Man on fire.
সাতদিনের মাথায় অনুবাদ শেষ করে পাণ্ডুলিপি নিয়ে গেলাম। বইটার নাম দিলাম অমানুষ। আমার ধারণা ছিল অনুবাদ পড়লে এই বই তিনি ছাপবেন না। কারণ আমি মূল উপন্যাসের কাঠামো ঠিক রেখে সম্পূর্ণই আমার মতো করে লিখেছি। বাঙালি এক যুবকের গল্প, যার নাম জামশেদ। আনোয়ার হোসেন সাহেব পাণ্ডুলিপি না পড়েই সেদিন আমাকে তিনশ’ টাকা দিলেন। সেবা প্রকাশনীর জন্যে আমি আরো দুটা বই অনুবাদ করেছি। একটির নাম সম্রাট, আরেকটির নাম দ্যা এক্সেসরিস্ট। ভূতের গল্প। শুধুমাত্র অর্থ উপার্জনের জন্যে লেখালেখি করাকে অনেকেই ছোট চোখে দেখেন। আমি অর্থ উপার্জনের জন্যে বই অনুবাদ করেছি। এই সত্য প্রকাশে কোনোরকম লজ্জা বোধ করছি না।
আমার ভাগ্য খানিকটা বদলালো, শহীদুল্লাহ হলের হাউস টিউটর হিসেবে নিয়োগ পেয়ে গেলাম। হাউস টিউটর মানে ফ্রি বাসা। ফ্রি ইলেকট্রিসিটি, ফ্রি গ্যাস ও পানি। আমি মহানন্দে শহীদুল্লাহ হলের গেটে সংসার পাতলাম। হলের গেটের দু’পাশে দুই হাউস টিউটরের বাসা। তারা এক অর্থে হলের গেটকিপার। হলের ভেতরে কী হচ্ছে না-হচ্ছে তারাই প্রথম জানবেন।
ঢাকা শহরের সুন্দর কিছু জায়গার একটি শহীদুল্লাহ হল। হলের সামনে প্রাচীন কিছু বৃক্ষ। সেখানে বাস করে রাজ্যের টিয়া পাখি। একসঙ্গে এত টিয়াপাখির বাস বাংলাদেশে আর কোথাও আছে বলে আমি জানি না। সন্ধ্যাবেলা সব পাখি একসঙ্গে ডাকাডাকি করে চারপাশ রহস্যময় করে তোলে।
হলের পাশের বিশাল দিঘিটাও রহস্যময়। প্রতিবছরই সেই দিঘিতে সাঁতার কাটতে গিয়ে কেউ-না-কেউ মারা যায়। দিঘির পাড়ে সাঁতার কাটা নিষিদ্ধ সাইনবোর্ডও লাগানো আছে। দিঘির পানি কাঁচের চেয়েও পরিষ্কার।
রহস্যময় এই দিঘিতে সাঁতার কাটা নিষিদ্ধ জেনেও আমি আমার তিন মেয়েকে এই দিঘিতেই সাঁতার কাটা শিখিয়েছি। অনেক পূর্ণিমার রাতে দিঘির জলে সপরিবারে নেমেছি। একই সঙ্গে জলস্নান এবং চন্দ্রম্নান।
আমার তিন মেয়ে শহীদুল্লাহ হলের দিঘিতে শুধু যে সাঁতার শিখেছে তা না, তারা হলের সামনের মাঠে সাইকেল চালাতেও শিখেছে। ট্রেইনার আমি। বড় মেয়ে নোভা প্রথম যেদিন সাইকেল চালানো শিখল, সেই দিনের দৃশ্য আমার এখনো চোখে ভাসে। সে প্যাডেল করছে। আমি সাইকেলের পেছনটা ধরে আছি। সে একটু পরপর বলছে—ড্যাডি, আমাকে ছেড়ে দিও না। ছেড়ে দিলেই আমি পড়ে যাব। আমি বললাম, মা, আমি শক্ত করে ধরে আছি। ছাড়ব না। তুমি এক চক্কর ঘুরে আস।… আমি ততক্ষণে সাইকেল ছেড়ে দিয়েছি। নোভা যে একা একা যাচ্ছে তা সে জানে না। পুরো চক্কর দিয়ে এসে হঠাৎ সে আমাকে দেখল—আমি সিগারেট টানছি। নোভা বিকট চিৎকার দিল, বাবা, আমি সাইকেল চালানো শিখে গেছি। বলেই সে সাইকেল নিয়ে হুড়মুড় করে পড়ে গেল।
আমার মেয়েদের যদি কখনো জিজ্ঞেস করা হয়–বাবার বিষয়ে তোমাদের সবচেয়ে সুখের স্মৃতি কী? তারা অবশ্যই সাঁতার শেখা এবং সাইকেল চালানো শেখার কথা বলবে।
আমি মেয়েদের পেছনে কোনো সময়ই দিতে পারি নি। ইউনিভার্সিটির চাপ, হলের চাপ, লেখালেখিতেই সময় চলে যেত। তখন আমার দু’জন থিসিসের ছাত্র ছিল। তাদের রিসার্চের কাজ দেখাশোনাতেও প্রচুর সময় যেত। ইউনিভার্সিটির ছুটির দিনে সন্ধ্যার পর কিছু অবসর পেতাম। তখন চলে যেতাম ইউনিভার্সিটি ক্লাবে দাবা খেলতে। দাবা খেলতাম রাজ্জাক স্যারের সঙ্গে (হ্যারল্ড লাস্কির প্রিয় ছাত্র অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক। কিংবদন্তি শিক্ষক)। দাবা খেলার সময়টা আমি আমার পরিবারকে দিতে পারতাম। তাও দেই নি। কারো বাড়িতে বেড়াতে যাওয়া, জন্মদিন, বিয়ে—এইসবে আমি নেই। সম্পূর্ণই নিজের ভেতরে বাস করা।
সবকিছু দেখেশুনেই হয়তো আমার মেয়েরা আবদারশূন্য মানসিকতায় বড় হতে লাগল। তারা কেউ কখনো আমার কাছে কিছু চেয়েছে বলে আমি মনে করতে পারি না। মেয়েদের কাছে আমি ছিলাম ভিনগ্রহের মানুষ। তারা আমার। চোখের সামনে বড় হচ্ছে, এই পর্যন্তই। তাদের জন্যে আদর নেই, বকাও নেই। তারপরেও কী কারণে যেন বড় মেয়ে নোভার ওপর রাগ করে তার গালে একটা চড় দিয়ে বসলাম। মেয়ে হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বিশ্বাসও করাতে পারছে না আমি এমন একটা কাজ করতে পারি।
আমি বললাম, মা, আমি খুবই ভুল একটা কাজ করেছি। বুঝতে পারছি তুমি মনে কষ্ট পেয়েছ! বলো কী করলে তোমার মনের কষ্ট দূর হবে। আমি তাই করব।
নোভা বলল, বাথরুমে একটা বাথটাব বসিয়ে দাও। বাথটাবে গোসল করলে মনের কষ্ট কমবে।
আমি বাথটাবের ব্যবস্থা করলাম।
কয়েকদিন আগে কবি নির্মলেন্দু গুণের মেয়ে মৃত্তিকার সঙ্গে দেখা। সে বলল, আঙ্কেল, আপনার শহীদুল্লাহ হলের বাসায় আমি কী করতাম আপনার মনে আছে?
কী করতে?
বাবার সঙ্গে প্রায়ই বেড়াতে যেতাম। যে কাপড় পরে যেতাম সেই কাপড়েই লাফ দিয়ে আপনাদের বাথটাবে নেমে পড়তাম।
.
শহীদুল্লাহ হলে থাকার সময়ই অনিন্দ্য প্রকাশনীর মালিক আমাকে আমার বইয়ের রয়েলটির টাকা না দিয়ে সেই টাকায় একটা গাড়ি কিনে দিলেন। গাড়ির সঙ্গে একজন ড্রাইভার দিয়ে দিলেন।
নতুন গাড়ি দেখে আমার মেয়েদের সে-কী লাফালাফি! সে-কী চিৎকার! মেজো মেয়ে শীলা তার বান্ধবীকে টেলিফোন করে বলল, বাবা না আমাদের জন্যে একটা গাড়ি কিনেছে। গাড়ির সঙ্গে একজন ড্রাইভার কিনে এনেছে।
একটা গাড়িই আমার জন্যে যথেষ্ট। আমি রয়েলটির টাকা পেয়ে আরেকটা মাইক্রোবাস কিনে ফেললাম। ব্যাংকে কোনো জমা টাকা নেই, অথচ শহীদুল্লাহ হলের বাসার সামনে দু’টা গাড়ি। মেয়েরা বান্ধবীদের নিয়ে মাইক্রোবাসে বসে রান্নাবাটি খেলা খেলে।
দ্বিতীয় গাড়ি কেনার মানসিকতাটা ব্যাখ্যা করি। রয়েলটির টাকা হাতে নিতে বা জমা করে রাখতে আমার লজ্জা লাগত। আমার মনে হতো এটা ঠিক না। কেন বই লিখে এত টাকা পাব! এই কারণেই যা পেতাম সঙ্গে সঙ্গে খরচ করে ফেলতাম।
শহীদুল্লাহ হল নিয়ে আমার অসংখ্য সুখস্মৃতি আছে। একটা সুখস্মৃতি বলি।
আমি একটা বিষয়ে (টাকা চুরি) কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে হলের একটি ছাত্রকে হল থেকে বের করে দেবার সুপারিশ করেছি। সে একটি ছাত্র সংগঠনের কর্তাব্যক্তি। সংগঠন তার পেছনে দাঁড়িয়ে গেল এবং মিছিল বের করল।
মিছিলের স্লোগান ‘হুমায়ূন আহমেদের চামড়া তুলে নেব আমরা’। আমি মন খারাপ করে বারান্দায় বসে আছি। হঠাৎ শুনি আমার তিন মেয়ে এবং তাদের এক বান্ধবী (ফ্ল্যাটের হাউস টিউটর সাহেবের মেয়ে পাল্টা স্লোগান দিচ্ছে—
হুমায়ূন আহমেদের চামড়া
লাগিয়ে দেব আমরা।
আনন্দে সঙ্গে সঙ্গে আমার চোখে পানি এসে গেল।
এবার দুঃখস্মৃতির কথা বলি। রাত আটটা। হঠাৎ গেটের সব বাতি নিভে গেল। আমি ভয়াবহ আর্তচিৎকার শুনলাম, স্যার, আমাকে মেরে ফেলছে। আমাকে বাঁচান।
আমি বারান্দায় এসে দেখি তিনজন মিলে একটা ছেলেকে গেটের সামনে চেপে ধরেছে। অন্য একজন তার শরীরে ছুরি বসাচ্ছে। ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে।
আমার খালি গা। পরনে লুঙ্গি। এই অবস্থায় দৌড়ে নিচে নামলাম। দ্বিতীয় কেউ এগিয়ে এল না। অথচ হলভর্তি ছাত্র। অনেক দারোয়ান। অনেক হাউস টিউটর।
যারা ছুরি মারছিল তারা আমাকে দেখে থমকে গেল। আমার একবারও মনে হলো না এরা আমাকে মেরে ফেলতে পারে। আমি পাগলের মতো এদের ধরার জন্যে ছুটছি। তারা পুকুরের দিকে যাচ্ছে। আমি ছুটছি তাদের পেছনে। এমন সময় আমার পাশের হাউস টিউটর চেঁচিয়ে বললেন, হুমায়ূন সাহেব, কী করছেন? ফিরে আসেন।
আমার সংবিত ফিরল। আমি আহত ছেলেটির কাছে এলাম। গেটের অন্য পাশের হাউস টিউটর সাহেবকে নিয়ে ছেলেটিকে ধরাধরি করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলাম।
রক্তে আমার সারা শরীর ভিজে গেল। এই প্রথম রক্তস্নান করলাম।
যাকে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম, সে নিজেও ভয়ঙ্কর এক সন্ত্রাসী। তার দল খবর পেয়ে হাসপাতাল থেকে তাকে নিয়ে গেল। সে বেঁচে ছিল না মারা গিয়েছিল কিছুই জানি না।
শহীদুল্লাহ হলে আমি অনেক লেখা লিখেছি। কয়েকটার নাম দিলাম আমার আছে জল। জনম জনম। সাজঘর। পুতুল। চারটা নাম দিলাম, কারণ এই চারটাই বিভিন্ন পরিচালক পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন।
১৫.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক সম্ভবত সবচেয়ে রহস্যময় মানুষ ছিলেন। বিয়ে করেন নি, চিরকুমার মানুষ। সবসময় পায়জামা এবং গেরুয়া রঙের পাঞ্জাবি পরতেন। খুব কম কথা বলতেন, তবে অতি ঘনিষ্ঠদের কাছে মজলিশি মানুষ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। তার চেহারার সঙ্গে হো চি মিনের চেহারার সাদৃশ্য ছিল। তিনি নিয়ম করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে যেতেন। নির্দিষ্ট একটা জায়গায় বসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাবা খেলতেন। অস্থিরতা নামক বিষয়টি তার মধ্যে কখনো দেখি নি, তবে দাবা খেলার শেষের দিকে (যখন জয়-পরাজয় নির্ধারিত হবে) কিছু অস্থিরতা দেখা যেত।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাধর মানুষদের উনি ছিলেন একজন। তার ক্ষমতার উৎস আমি জানতাম না। শুনেছি তিনি হ্যারল্ড লাস্কি নামক জগৎবিখ্যাত অধ্যাপকের সঙ্গে Ph.D করছিলেন। থিসিস লেখার শেষ পর্যায়ে হ্যারল্ড লাস্কি মারা যান। প্রফেসর আব্দুর রাজ্জাক থিসিস জমা না দিয়েই দেশে ফিরে আসেন। কারণ তাঁর ধারণী হয়েছিল, যারল্ড লাস্কি ছাড়া এই থিসিসের মর্ম কেউ বুঝবে না।
আমি হ্যারল্ড লাস্কিকে চিনি না। কেন তিনি জগৎবিখ্যাত তাও জানি না। আমি তার ছাত্রের প্রতি সবার সমীহ দেখে অবাক হই। এমন না যে অধ্যাপক রাজ্জাক অনেক বইপত্র লিখে নিজেকে বিকশিত করেছেন। আমার মনে হয় তিনি তাঁর প্রতিভার পুরোটাই দাবা খেলায় ব্যয় করেছেন। সেখানেও তেমন কিছু করতে পারেন নি। বেশির ভাগ সময়ই অন্যদের কাছে হেরেছেন। আমি অতি নিম্নমানের দাবা খেলোয়াড়। তিনি আমার কাছেও মাঝে মধ্যে হারতেন। চাল ফেরত নেয়া দাবা খেলায় নিষিদ্ধ। এই নিষিদ্ধ কাজটি সবসময়ই করতেন।
অধ্যাপক রাজ্জাককে নিয়ে মাতামাতি শুধু যে দেশেই তা-না, বিদেশেও। দেশের বাইরের অনেকেই তার পরামর্শে তার অধীনে Ph.D করেছেন। অনেক গবেষণাপত্র উৎসর্গ করা হয়েছে তার নামে। এক বাঙালি অর্থনীতিবিদ ঢাকায় এলেই রাজ্জাক স্যারের বাসায় যেতেন। তিনি কয়েকবার তাঁকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবেও নিয়ে এসেছেন। পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন—“এই ছেলে Economics ভালো জানে।”
Economics জানা মানুষটির নাম অমর্ত্য সেন। যিনি পরে ইকনমিক্সে নোবল পুরস্কার পান।
প্রস্তাবনাপর্ব শেষ, এখন মূল গল্পে আসি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর তখন পদার্থবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক। তিনি আমাকে অফিসে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, একটা কাজ করে দিতে হবে। আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের একটি ইংরেজি বক্তৃতা বাংলায় অনুবাদ করে দিতে হবে। উনি বিশেষ করে আপনার কথা বলেছেন।
অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাক আমার নাম জানেন, এতেই আমি যথেষ্ট আত্মশ্লাঘা অনুভব করলাম। কারণ তখনো তার সঙ্গে আমার পরিচয় হয় নি। তাঁর সঙ্গে দাবা খেলারও শুরু হয় নি।
আমি বললাম, স্যার, আমি অবশ্যই অনুবাদ করে দেব।
ভাইস চ্যান্সেলর স্যার বললেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। মূল বক্তৃতাটা রাজ্জাক সাহেবের। আশা করি গুরুত্ব বুঝতে পারছেন। হুবহু অনুবাদ করবেন। একচুলও যেন এদিক-ওদিক না হয়।
স্যার, আপনি নিশ্চিত থাকুন। হুবহু অনুবাদ করব।
শহীদুল্লাহ হলে রাজ্জাক সাহেবের পাণ্ডুলিপি নিয়ে ফিরেই অনুবাদে হাত দিয়েছি। একটা জায়গায় এসে থমকে গেলাম। এইসব কী লিখেছেন?
স্যার লিখছেন—শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল বিখ্যাত সব শিক্ষকের মিলনক্ষেত্র। অতি বিখ্যাত সব শিক্ষক থাকা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কিন্তু গুণী কোনো ছাত্র বের করতে পারে নি। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জৌলুশ কমে গেল। মোটামুটি মানের শিক্ষকরা শিক্ষকতা শুরু করলেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তখন অসাধারণ মেধার মানুষ বের করতে শুরু করল। যেমন, কবি শামসুর রাহমান, ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদ।
আমি ভেবেই পাচ্ছি না, যে হুমায়ূন আহমেদের কথা লেখা হচ্ছে সে কি আমি? আরো কোনো হুমায়ূন আহমেদ কি আছে? যদি আমি সেই হুমায়ুন আহমেদ হয়ে থাকি, তাহলে তো আমার এই লেখা অনুবাদ করা ঠিক হবে না।
পাণ্ডুলিপি নিয়ে ভাইস চ্যান্সেলর স্যারের সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি পাণ্ডুলিপি পড়ে বললেন—আপনার নামই তো মনে হচ্ছে। আপনি এক কাজ করুন—রাজ্জাক সাহেবের কাছে যান, তাঁকে সরাসরি জিজ্ঞেস করুন। উনি ইউনিভার্সিটি কোয়ার্টারে থাকেন। একা মানুষ। এখনি চলে যান।
আমি স্যারের বাসায় গেলাম। তার বসার ঘরটা প্রকাণ্ড। সেখানে কোনো সোফা নেই। ঘরের মাঝখানে প্রকাণ্ড একটা মশারি খাটানো। স্যার মশারির ভেতর চেয়ার-টেবিল পেতে পড়াশোনা করছেন। মশার হাত থেকে মুক্ত থেকে পড়াশোনা করার চমৎকার ব্যবস্থা। স্যার আমাকে দেখে মশারির ভেতর থেকে বের হয়ে এলেন। আমি আমার সমস্যার কথা বললাম।
স্যার বললেন, আমি আপনার কথাই লিখেছি এবং কোনো ভুল করি নি। যেভাবে লিখেছি সেভাবেই যেন অনুবাদ করা হয়।
.
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসে খুব আগ্রহ করে বক্তৃতা শুনতে গিয়েছি। প্যান্ডেল সাজিয়ে বিশাল আয়োজন। স্যার বক্তৃতা শেষ করলেন। তুমুল করতালি। আমি ভ্যাবদা মেরে বসে আছি, কারণ বক্তৃতায় হুমায়ুন আহমেদের অংশটা নেই। স্যার যে পড়তে ভুলে গেছেন তাও না। মূল বক্তৃতা বুকলেট আকারে সবাইকে দেয়া হয়েছে। সেখানেও এই অংশ নেই।
খুবই তুচ্ছ বিষয়। মাঝে মাঝে তুচ্ছ বিষয় চোরাকাটার মতো মনে লেগে থাকে। ব্যথা দেয় না, অস্বস্তি দেয়।
কয়েকদিন পর রাজ্জাক স্যার পিয়ন পাঠিয়ে আমাকে ডেকে নিয়ে গেলেন। রাতে তাঁর বাসায় খাবার নিমন্ত্রণ। নিমন্ত্রণ খেতে গেলাম। বিশাল আয়োজন। অনেক অতিথি। সবাই অতি গুরুত্বপূর্ণ। আমি শুধু নামগোত্রহীন। ‘হংস মধ্যে কাক’ যথা, বকও না। স্যার এক ফাঁকে বললেন, আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চান?
আমি বললাম, জি-না স্যার।
স্যার বললেন, বক্তৃতার অনুবাদ ভালো হয়েছে। বক্তৃতা বিষয়ে কিছু বলবেন?
আমি বললাম, জি-না।
সবাই খেতে বসেছি। স্যার আমাকে বসিয়েছেন তার পাশে। প্রচুর খাবার দাবার। এর মধ্যে একটি আইটেম স্যারের রান্না করা। উনি খেতে পছন্দ করতেন। রান্নার ব্যাপারেও তাঁর প্রবল আগ্রহ ছিল। খাবার টেবিলে আরেকটি ব্যাপার আমাকে বিস্মিত করল। সবাইকে ফ্রান্সের তৈরি চিনামাটির বাসনে খেতে দেয়া হয়েছে, আর স্যার খাচ্ছেন মাটির সানকিতে। উনি না-কি মাটির সানকি ছাড়া খেতে পারেন না।
স্যারের দাওয়াতে আমি নিয়মিত হয়ে গেলাম, কিছুদিন পরপরই আমার ডাক পড়ে। আমি সামাজিক মানুষ না। অচেনা সব লোকজনের ভিড়ে অস্বস্তি বোধ করি। আমার সঙ্গে কথা বলার জন্যে কেউ এগিয়েও আসে না। নিজেকে মনে হয় গৃহকর্তার দরিদ্র আত্মীয়, যাকে আসর থেকে বাদ দেয়া যায় না, আবার আসরে রাখাও যায় না।
উপগ্রহ আমার খুব অপছন্দের জিনিস। স্যারের কাছে আমার অবস্থান ছিল উপগ্রহের মতো।
তিনি খুবই অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। খবর পেয়ে আমি দৈনিক বাংলার সহকারী সম্পাদক জনাব সালেহ চৌধুরীকে নিয়ে তাঁকে দেখতে গেলাম। বিছানায় শুয়ে শুয়ে তিনি বই পড়ছেন। বইটির নাম অমানুষ। লেখক হুমায়ূন আহমেদ।
সালেহ চৌধুরী বললেন, স্যার, কেমন আছেন?
তিনি বই থেকে মুখ না তুলেই বললেন, পরে আসুন। এখন ব্যস্ত আছি। বই পড়ছি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবসের ঘটনায় খুব দুঃখ পেয়েছিলাম। সেদিনের ঘটনায় সব দুঃখ ধুয়ে-মুছে গিয়েছিল।
১৯৭১ নামের উপন্যাসটি আমি উৎসর্গ করেছিলাম স্যারের নামে। বইটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবে তাঁর হাতে দিলাম। তিনি পাতা উল্টে বললেন—যে বইয়ের নাম ১৯৭১, তার পৃষ্ঠাসংখ্যা মাত্র সর?
আমি জবাব দিলাম না। তার ঠিক এক সপ্তাহ পর তিনি আমাকে তার বাসায় ডেকে পাঠালেন। সরাসরি ঢুকে গেলাম তার পড়ার টেবিলের ওপর ঝুলানো মশারির ভেতর। স্যার বললেন, নিজের হাতে খাঁটি ঘি দিয়ে খিচুড়ি রান্না করেছি। খাবেন?
আমি বললাম, জি-না স্যার।
আপনাকে ছোট্ট একটা উপদেশ দেবার জন্যে ডেকেছি। আপনাকে লেখালেখি নিয়ে অনেকেই অনেক উপদেশ দিতে চেষ্টা করবে। আপনি কোনো উপদেশই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবেন না। আপনার যা মনে আসে লিখবেন। ঠিক আছে?
আমি বললাম, জি স্যার।
রাজ্জাক স্যারের মতো একই উপদেশ একটু ভিন্ন ভাষায় আরেকজন আমাকে দিয়েছিলেন। তার নাম সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। সেই গল্প আরেকদিন বলা যাবে।
পাদটিকা:শামসুর রাহমান এবং হুমায়ুন আহমেদের নাম কেন বাদ দেয়া হয়েছিল তা কখনো জানা হয় নি।