১১-১২. অস্ত্র ব্যবসায়ীর কথা

যখন আমরা কাদের বক্স নামে ভয়ংকর নিষ্ঠুর একজন অস্ত্র ব্যবসায়ীর কথা জানতে পারলাম

আমি সুজনকে জিজ্ঞেস করলাম, “এখন কী করবি?”

সুজন শুকনো মুখে বলল, “জানি না। তুই বল কী করব?”

আমি মাথা চুলকালাম, বললাম”বড়দের বলতে হবে। নিশাত আপু আর জাবেদ চাচাকে।”

সুজন বলল, “আমি বলতে পারব না। তুই বল।”

“আমি কী বলব?”

”যেটা হয়েছে সেটাই বলবি।”

“তুই বুঝতে পেরেছিস আমরা কী করেছি? মিলিটারি পুলিশ ব্যারিকেড দিয়ে যাদের ধরার চেষ্টা করছে আমরা তাদেরকে সাহায্য করেছি। আমরা তাদের অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ আমাদের গাড়িতে করে পৌঁছে দিয়েছি!”

সুজন শুকনো মুখে বলল, “তার মানে আমরাও এখন অপরাধী? পুলিশ এখন আমাদের ধরবে।”

আমি মাথা নাড়লাম, “মনে হয়।”

সুজন বলল, “কিন্তু আমরা তো ইচ্ছে করে করিনি। বুড়ো বদমাইশটাকে সাহায্য করতে চেয়েছিলাম।”

“সেটা পুলিশকে বলে দেখ তারা কী বলে! তারা আমাদের বিশ্বাস করে ছেড়ে দিয়েছে। আমাদের গাড়ি চেক করবে না বুড়োটা সেটা জানে, সেই জন্যেই বুড়োটা তার টুকরিগুলো আমাদের গাড়িতে তুলেছে। কেউ যেন দেখতে না পায় সেই জন্যে ঠেলে ঠেলে সিটের নিচে রেখেছে। চেকআপ করার আগে নেমে গেছে। আমাদের পুলিশকে বলা উচিত ছিল একজন লোকের সবজির টুকরি আমরা নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা চেক করে দেখেন।”

সুজন মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিকই বলেছিস।”

“এখন বলে কী লাভ?” আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “আর তুই কেন খামোখা সবজির টুকরি ঘটতে গেলি? সবজির টুকরি থেকে তুই যদি এই গ্রেনেডগুলো খুঁজে বের না করতি তা হলে আমরা কোনোদিন জানতেও পারতাম না যে এর ভেতরে এগুলো আছে। আমরা ভাবতাম আমরা একজন বুড়ো মানুষকে সাহায্য করেছি। সেটা চিন্তা করে খুশি থাকতাম!”

সুজন বলল”এখন সেটা বলে লাভ নেই। কী করবি তাড়াতাড়ি ঠিক কর সবাই না হলে সন্দেহ করবে।”

মামুন বাথরুমে ঢুকেছে, আমি অন্যদের বলেছি আমরা নিচ থেকে আমাদের রুমগুলোর ছবি তুলব, সেই জন্যে একটু বাইরে যাচ্ছি। এই মুহূর্তে একটা গাছের নিচে ঝোঁপের আড়ালে দাঁড়িয়ে সুজনের সাথে কথা বলছি, সুজনের পিঠে তার ব্যাকপেক সেটার ভিতরে দুইটা তাজা গ্রেনেড। আমি বললাম, “যাই করি আর না করি সবার আগে এই গ্রেনেড দুইটা তোর ব্যাকপেক থেকে বের করে এখানে কোথাও রাখ।”

সুজন গ্রেনেড দুটি বের করল। গাঢ় সবুজ রংয়ের উপরে খাঁজকাটা। ঠিক সিনেমাতে যেরকম দেখেছি। সুজন একটা রিং ধরে বলল, “এই রিংগুলো কী? টান দিলে কী হবে?”

আরেকটু হলে সুজন সত্যি সত্যি টান দিয়ে পিনটা খুলে ফেলত, আমি থামালাম, “সর্বনাশ! পিন খুললেই সাত সেকেন্ড পরে গ্রেনেড ফেটে যায় জানিস না? সবাইকে মারবি না কি?”

সুজন জানত না। আমরা সবাই যেরকম একশ রকম বই পড়ি একশ রকম জিনিস জানি, সুজন সেইরকম না। সে বই পড়ে কম কিন্তু একশ রকম দুষ্টুমি জানে। তার দুষ্টুমির ফল হচ্ছে এই দুইটা গ্রেনেড। আমরা গাছের নিচে ঝোঁপের আড়ালে গ্রেনেড দুটি রেখে কয়েকটা শুকনো পাতা দিয়ে ঢেকে ফেলে বের হয়ে এলাম। আমাদের ঘরের বারান্দায় রিতু আর শান্তা দাঁড়িয়ে নিচে আমাদের দেখে বলল, “তোরা ওখানে কী করছিস?”

আমি বললাম, “ছবি তুলছি। তোরা দাঁড়া, তোদেরও একটা ছবি তুলি।”

রিতু আর শান্তা দুজন দুজনকে ধরে একটা নেকু নেকু ভঙ্গিতে দাঁড়াল, আমি একটা ছবি তুলোম। ছবি তুলে আমরা আমাদের রুমের দিকে আগালাম। আমি এখনো বুঝতে পারছি না বিষয়টা অন্য সবাইকে বলা ঠিক হবে কি না। আমাদের মাঝে রিতুর বুদ্ধি বিবেচনা সবচেয়ে বেশি, ব্যাপারটা তার সাথে আলোচনা করতে পারলে হত, কিন্তু কীভাবে আলোচনা করব বুঝতে পারছিলাম না। রিতুকে আলাদাভাবে পাওয়া দরকার কিন্তু সে সারাক্ষণই অন্যদের সাথে কথা বলছে, গল্পগুজব করছে। এক হতে পারে শুধু রিতুকে না বলে সবাইকে ব্যাপারটা খুলে বলি। শান্তা অল্পতেই ঘাবড়ে যায়, পুরোটা জানলে ভয় পেতে পারে। আঁখিকে এখন জানানোর কোনো প্রশ্নই আসে না। সে আমাদের সবাইকে নিয়ে বেড়াতে এসেছে আর আমরা অস্ত্র চোরাচালানির দলের সাথে গোলমাল শুরু করেছি এই কথাগুলো তাকে বলব কেমন করে? এই মানুষগুলো যখন ফিরে গিয়ে দেখবে তাদের টুকরিতে দুইটা গ্রেনেড কম তখন কি আর সেই দুইটা গ্রেনেডের জন্যে ফিরে আসবে না? আর যখন বুঝতে পারবে আমরা জেনে গেছি তখন কি আমাদের ছেড়ে দেবে? খুঁজে খুঁজে বের করে ফেলবে না আমরা কোথায়? ভয়ে দুশ্চিন্তায় আমার পেটের ভাত চাউল হয়ে যাবার অবস্থা।

আমরা জাবেদ চাচাকে খুঁজে পেলাম না। নিশাত আপু বললেন শহরে গিয়েছেন, আমরা রাঙামাটি কীভাবে কোন পথে যাব সেসব ব্যাপারে খোঁজ নিতে। রাতে খাবার সময়ে থাকবেন। কাজেই আমাদের অপেক্ষা করতে হবে। আমি আর সুজন তখন ছোঁক ছোঁক করে ঘুরে বেড়াতে লাগলাম। অন্যেরা বসে বসে টুয়েন্টি ফোর খেলছে আমরা তাদের সাথে খেলতেও পারি না, আবার কিছু না করে বসেও থাকতে পারি না।

শেষ পর্যন্ত জাবেদ চাচার সাথে দেখা হল। আমি বললাম, “জাবেদ চাচা, আপনার সাথে আমাদের একটু কথা বলতে হবে।”

জাবেদ চাচা খুব কম কথা বলেন, তারপরেও হাসি হাসি মুখে বললেন, “তোমাদের সাথেও আমার কথা বলতে হবে।”

“আমাদেরটা খুবই জরুরি।”

জাবেদ চাচার মুখের হাসিটা আরো বড় হল, “আমারটাও খুবই জরুরি।”

“আগে আমাদেরটা বলি?”

“বলবে? বল।”

আমরা যখন বলতে শুরু করলাম ঠিক তখন নিশাত আপু ঘরে ঢুকলেন, খাওয়া-দাওয়া হোটেল বিল এই সব নিয়ে কথা বলতে লাগলেন তাই আমাদের আর বলা হল না। জাবেদ চাচা আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আমরা ডাইনিং টেবিলে খেতে খেতে কথা বলি?”

আমরা আর কী করব? মাথা নেড়ে রাজি হয়ে চলে এলাম।

রাতে ডাইনিং টেবিলে খেতে বসেছি। আজকে চাইনিজ খাবার, দেখে জিবে পানি এসে যাবার কথা কিন্তু আমার আর সুজনের ভেতরে এতো অশান্তি যে শান্তি মতো খেতে পারব এরকম মনে হচ্ছে না। খাওয়া যখন প্রায় মাঝামাঝি তখন নিশাত আপু আর জাবেদ চাচা এলেন। জাবেদ চাচা জিজ্ঞেস করলেন, “তোমাদের খবর কী? সবাই ভালো?”

আমি আর সুজন চুপ করে রইলাম, অন্যেরা মাথা নেড়ে কেউ বলল, “ভালো।” কেউ বলল, “খুবই ভালো” কেউ বলল, “ফাটাফাটি” কেউ বলল, “সুপার ডুপার।”

জাবেদ চাচা বললেন, “একেক জায়গায় আমরা দুই রাত করে থাকব। কাজেই বান্দরবানে এটা শেষ রাত। কাল দুপুরে আমরা রাঙামাটি রওনা দিব।”

আমি আর সুজন আবার চুপ করে থাকলাম, অন্যেরা আনন্দের মতো শব্দ করল। জাবেদ চাচা বললেন, “আজকে আমি শহরে গিয়েছিলাম, সেখানে আমার পরিচিত একজনের সাথে দেখা হয়েছে, সে বলেছে এখন বান্দরবান খুবই গরম একটা জায়গা।”

“গরম?” মামুন বলল, “আমাদের তো সেরকম গরম লাগছে না!”

“এটা অন্য রকম গরম।”

“কী রকম গরম?”

“আর্মসের বিশাল একটা চালান এসেছে এই এলাকায়, পুলিশ মিলিটারি ধরার চেষ্টা করছে।”

আমি আর সুজন একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। রিতু বলল, “মনে নাই পুলিশ মিলিটারি ব্যারিকেড দিয়ে সব গাড়ি চেক করছে?”

মামুন জিজ্ঞেস করল, “কী রকম আর্মস?”

“একে ফরটি সেভেন। গ্রেনেড।”

“গ্রেনেড?”

“হ্যাঁ গ্রেনেড।”

“সর্বনাশ।”

রিতু জানতে চাইল, “কারা করে?”

“মানুষটার নাম হচ্ছে কাদের। কাদের বক্স। অসম্ভব নিষ্ঠুর একটা মানুষ। কোনো মায়া দয়া নাই। তার একটা বড় দল আছে, পুরো এলাকায় আতঙ্ক ছড়িয়ে রেখেছে। পাহাড়ে থাকে, কোথায় থাকে কেউ জানে না।”

আমি আর সুজন একজন আরেকজনের দিকে তাকালাম। সুজন তার শুকনো ঠোঁট জিব দিয়ে ভেজানোর চেষ্টা করে বলল, “মায়া দয়া নাই মানে? কী করে?”

“খুন জখম। নিজের দলের মানুষও যদি একটু উনিশ-বিশ করে তা হলে গুলি করে মেরে পাহাড় থেকে নিচে ফেলে দেয়।”

“কী সাংঘাতিক!”

আঁখি বলল, “কাদের বক্স যদি খুব সাংঘাতিকও হয় আমাদের তো ভয় পাওয়ার কিছু নাই। আমরা তো কাদের বক্সের দলের মানুষ না। আমরা তো তার আর্মসের ব্যবসারও কোনো ক্ষতি করছি না।”

আমি বুঝতে পারলাম আমাদের এখন আসল কথাটা বলার সময় হয়েছে। যেই মুখ খুলেছি ঠিক তখন শুনলাম ধুপধাপ শব্দ করে কারা যেন দৌড়ে আসছে। কিছু বোঝার আগেই অনেকগুলো মানুষ ছুটে এলো, তাদের সবার মুখ গামছা দিয়ে বেঁধে রেখেছে যেন চেহারা দেখা না যায়, সবার হাতে ভয়ংকর এক ধরনের রাইফেল যেগুলো শুধুমাত্র ইংরেজি সিনেমায় দেখা যায়। মানুষগুলো ডাইনিং রুমে ঢুকে এখানে সেখানে দাঁড়িয়ে যায়। ডাইনিং রুমে যারা খাচ্ছিল তারা ভয়ে চিৎকার করে উঠে। তখন রাইফেল হাতে একজন বলল, “খবরদার! কোনো শব্দ না।”

সাথে সাথে সবাই চুপ করে গেল।

আঁখি ভয় পাওয়া গলায় বলল, “কী হয়েছে?”

আমার গলা দিয়ে শব্দ বের হতে চাইছিল না, কোনোমতে ফিসফিস করে বললাম, “মুখ বাঁধা অনেকগুলো মানুষ, হাতে বন্দুক, ভিতরে এসে ঢুকেছে।”

“এরা কারা?”

“জানি না। মনে হয় ডাকাত।”

“সর্বনাশ!”

মুখ বেঁধে রাখা যে মানুষগুলো ডাইনিং রুমে ঢুকেছে তারা চারিদিকে তাকিয়ে দেখে, তখন একজন চিৎকার করে বলল, “সবগুলো এইখানে।”

রিসোর্টের ভিতরে যারা ছোটাছুটি করছিল তারা তখন ডাইনিং রুমের দিকে আসতে থাকে। এরা কার খোঁজে এসেছে, কাকে পেয়ে গেছে সেটা কেউ বুঝতে পারেনি। শুধু আমি আর সুজন বুঝে গিয়েছি। তাই মানুষগুলো আমাদের টেবিলে এসে যখন খপ করে আমাদের ছয়জনকে ধরে টেনে-হিঁচড়ে টেবিল থেকে বের করে নিয়ে আসে তখন সবাই অবাক হয়ে ভয়ে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠল। শুধু আমি আর সুজন অবাক হলাম না, চিৎকারও করলাম না।

জাবেদ চাচা লাফ দিয়ে উঠে বললেন, “কী হচ্ছে? কী হচ্ছে এখানে?”

পিছনে যে মানুষটা ছিল সে রাইফেলটা তুলে তার পিছনটা দিয়ে জাবেদ চাচার বুকে প্রচণ্ড জোরে মেরে বসল। জাবেদ চাচা যন্ত্রণায় একটা শব্দ করে নিচে পড়ে গেলেন। মানুষটা রাইফেলটা জাবেদ চাচার দিকে তাক করে বলল, “আর একটা টু শব্দ করবে তো শেষ করে দেব।”

জাবেদ চাচা আর শব্দ করলেন না, মনে হল তার শব্দ করার ক্ষমতাও নেই। গামছায় মুখ বাঁধা একজন মানুষ হাতের রাইফেলটা সবার দিকে তাক করে বলল, “কেউ যদি নড়াচড়া করেছ, চিল্লাচিল্লি করেছ তা হলে শেষ।”

কেউ এতোটুকু শব্দ করল না। তখন ছয়জন মানুষ আমাদের ছয়জনকে ধরে টেনে-হিঁচড়ে নিতে থাকে। সিঁড়ি দিয়ে নামার সময় আমরা হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলাম লোকগুলো হ্যাঁচকা টান দিয়ে আমাদের সোজা করে নেয়। আমরা এতো ভয় পেয়েছি যে চিৎকার করার শক্তি পর্যন্ত নেই। মানুষগুলো আমাদের নিয়ে রিসোর্ট থেকে বের হয়ে আসে। রাস্তায় দুটো চান্দের গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের ধাক্কা দিয়ে একটা চান্দের গাড়িতে তুলে দেয়, আমরা ভালো করে ওঠার আগেই গাড়িটা ছেড়ে দিল। ড্রাইভার পাহাড়ি রাস্তায় ঝড়ের বেগে গাড়িটা চালিয়ে নিতে থাকে। পিছন থেকে দ্বিতীয় গাড়িটাও এর পিছনে পিছনে আসতে থাকে।

কে একজন বলল, “চোখ বেঁধে দে সবগুলোর।”

আমরা অন্ধকারে টের পেলাম মানুষগুলো গামছা দিয়ে আমাদের চোখ বেঁধে দিচ্ছে। এতোক্ষণ আবছা আলোতে চারিদিক দেখতে পাচ্ছিলাম, হঠাৎ করে চারিদিক অন্ধকার হয়ে গেল।

পুরো ব্যাপারটা এতো তাড়াতাড়ি ঘটেছে যে আমরা ভালো করে কিছু বুঝেই উঠতে পারছিলাম না। চান্দের গাড়ির মেঝেতে পা গুটিয়ে বসে আছি, ঝাঁকুনিতে ঠিক করে বসেও থাকতে পারছি না, তার মাঝে শুনলাম, শান্তা কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “কী হচ্ছে এখানে! আমাদের কে নিয়ে যাচ্ছে? কোথায় নিয়ে যাচ্ছে?”

আমি বললাম, “মনে হয় কাদের বক্সের দল।”

রিতু নিচু গলায় বলল, “কাদের বক্সের দল? কাদের বক্সের দল আমাদের ধরবে কেন?”

সুজন বলল, “কারণ আছে।”

“কী কারণ?”

আমি কারণটা বলতে যাচ্ছিলাম তখন একটা মানুষ হুংকার দিল, “খবরদার একটা শব্দ করবি না। খুন করে ফেলব মুখ খুললে।”

আমরা তখন চুপ করে গেলাম। ভয়ে আমরা কেউ ঠিকভাবে চিন্তাও করতে পারছিলাম না। কী হচ্ছে, আমাদের কোথায় নিচ্ছে আমরা কিছুই বুঝতে পারছি না। আমরা নিশ্বাস বন্ধ করে গাড়িতে বসে থাকি।

একসময় হঠাৎ গাড়িটা থেমে গেল। আমরা শুনলাম মানুষগুলো চাপা গলায় কথা বলছে। তারপর টের পেলাম আমাদের গাড়ি থেকে নামাচ্ছে। চোখ বাঁধা, কিছু দেখতে পাচ্ছি না তার মাঝে আমরা একজন একজন করে হাঁটতে লাগলাম। কে সামনে কে পিছনে বুঝতে পারছি না। একজন আরেকজনকে ধরে হাঁটছি। অন্ধকারে পা পিছলে যাচ্ছিল, এক দুইবার হুড়মুড় করে নিচে পড়ে গেলাম। কোনো একজন লোক তখন আমাদের গালাগাল করে টেনে দাঁড় করিয়ে দিতে লাগল। মনে হল নিচে নামছি, নামছি তো নামছিই আর থামাথামি নেই। শেষ পর্যন্ত একসময় থামলাম। পানির ছলাৎ ছলাৎ শব্দ শুনছি, তার মানে কোনো একটা নদীর কাছে এসেছি। ধাক্কা দিয়ে আমাদের কোনো একটা নৌকায় তুলে দিল তারপর নৌকাটা ছেড়ে দিল।

আমরা নিঃশব্দে নৌকায় বসে রইলাম। মনে হল ঘণ্টার পর ঘণ্টা নৌকায় বসে রয়েছি কোনোদিন বুঝি আর নৌকা থামবে না। শেষ পর্যন্ত নৌকা থামল, একজন জিজ্ঞেস করল, “কয়টা বাজে?” অন্যজন উত্তর দিল”সাড়ে আটটা” তখন আমরা বুঝতে পারলাম আসলে সময় খুব বেশি পার হয়নি। আমাদের কাছে মনে হচ্ছে বুঝি অনন্তকাল।

নৌকা থেকে নামার পর আমরা উপরে উঠতে থাকি। একজনের পিছু আরেকজন, কে সামনে কে পিছনে বুঝতেও পারছি না। অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে মাঝে মাঝেই আমাদের কেউ না কেউ হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল তখন মানুষগুলো আমাদের গালাগাল করতে করতে টেনে তুলছিল। বোঝা যাচ্ছিল আমাদের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে টেনে নিচ্ছে, গাছের পাতা ডাল আমাদের হাতে পায়ে মুখে লেগে যাচ্ছে, হাত-পা কেটেকুটে যাচ্ছে কিন্তু এখন সেগুলো নিয়ে আমরা কেউ মাথা ঘামাচ্ছিলাম না।

শেষ পর্যন্ত আমরা থামলাম, মনে হল কোনো একটা বাসার সামনে দাঁড়িয়েছি। দরজায় কেউ একজন ধাক্কা দিল, ভিতর থেকে কেউ একজন জিজ্ঞেস করল, “কে?”

আমাদের সাথে যারা ছিল তারা বলল, “আমরা। ছেলেমেয়েগুলো ধরে এনেছি।”

খুট করে দরজা খোলার শব্দ হল। আমাদের পিছনে ধাক্কা দিয়ে ভিতরে ঢুকিয়ে দিল। আমরা টের পেলাম ভিতরে আরো অনেক মানুষ বসে আছে, সেখানে কেমন যেন ঝাঁঝালো বোটকা একটা গন্ধ। ভারী গলায় কে যেন বলল, “চোখ খুলে দে।”

লোকগুলো আমাদের চোখ খুলে দিল এবং এই প্রথম আমরা পিটপিট করে তাকালাম। ছোট একটা কাঠের ঘর। এক পাশে একটা কাঠের টেবিল, টেবিলের অন্য পাশে একজন একটা চেয়ারে পা তুলে বসে আছে। টেবিলের এক কোনায় একটা হ্যারিকেন দপদপ করে জ্বলছে। অন্য পাশে একটা লম্বা বেঞ্চ, সেখানে কয়েকজন বসে আছে। যে মানুষগুলো আমাদের ধরে এনেছে তারা এখন তাদের মুখে বাঁধা গামছা খুলে ফেলেছে। হ্যারিকেনের অল্প আলোতে সবাইকে কেমন যেন ভয়ানক দেখাচ্ছে।

চেয়ারে পা তুলে বসে থাকা মানুষটা টেবিল থেকে কালোমতোন কী একটা জিনিস হাতে তুলে নিয়ে তার পাশে চেয়ারে বসে থাকা মানুষটার কপালে ধরল। আমরা চমকে উঠে দেখলাম কালোমলতান জিনিসটা হচ্ছে একটা রিভলবার আর যে মানুষটার কপালে ধরেছে তাকেও আমরা চিনে ফেললাম। এটি হচ্ছে সেই বুড়ো মানুষটি যে আমাদের গাড়িতে সবজির টুকরি তুলে দিয়েছিল। আবছা অন্ধকারে ভালো করে দেখা যাচ্ছিল না বলে আমরা প্রথমে চিনতে পারিনি। এখন দেখতে পেলাম তার হাত দুটো পিছন থেকে বাঁধা।

আমাদের কেউ বলে দেয়নি, কিন্তু আমরা বুঝতে পারলাম চেয়ারে পা তুলে বসে থাকা মানুষটা নিশ্চয়ই কাদের বক্স। কী ভয়ংকর! লোকটার চেহারা দেখলেই বুকের ভিতরটা কেঁপে উঠে।

ভয়ংকর চেহারার মানুষটা বুড়ো মানুষটার কপালে রিভলবারটা দিয়ে একটা ধাক্কা দিয়ে বলল, “এখন দেখা যাক তুমি সত্যি কথা বলেছ না মিথ্যা কথা বলেছ।”

বুড়ো মানুষটা বলল, “আমি সত্যি কথা বলেছি। কাদের ভাই। আপনি ছেলেমেয়েগুলোরে জিজ্ঞেস করেন।”

“সেই জন্যেই তো ওদের ধরে আনলাম। আমি সব সহ্য করতে পারি কিন্তু দলের মাঝে বেইমানি সহ্য করতে পারি না। আমার জানা দরকার বুড়ো তুমি বেইমানি করেছ কি না!”

“করি নাই।”

“যদি দেখি তুমি করেছ তা হলে এখানেই শেষ। ঠিক আছে?”

বুড়ো মানুষটি কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, “ঠিক আছে কাদের ভাই।”

“এই পোলাপানের মুখের কথার ওপর নির্ভর করছে তোমার জীবন।”

বুড়ো মানুষটি কোনো কথা না বলে কেমন যেন আতঙ্কিত দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। কাদের বক্স এইবার ভালো করে আমাদের দিকে তাকাল, তারপর বলল, “তোমাদের মাঝে না কি একজন অন্ধ! কই আমার কাছে তো কাউরেই অন্ধ কানা মনে হচ্ছে না।”

আমাদের কিছু বলার আগেই কমবয়সী একজন হাত দিয়ে রিতুকে দেখিয়ে বলল, “ওস্তাদ। ডানদিকের মেয়েটা অন্ধ।”

“তুই কেমন করে জানিস?”

“আমি হোটেলে দেখেছি।”

রিতু কিছু বলল না। আঁখিও কিছু বলল না। কাজটা ভালো হল কিনা বুঝতে পারলাম না, কিন্তু আমরাও চুপ করে রইলাম।

কাদের বক্স বলল, “ঠিক আছে কানাবিবি তুমি ডানদিকে সরে যাও।”

রিতু ডান দিকে সরে গেল, চোখে দেখতে না পেলে মানুষ যেভাবে সরে যায় অনেকটা সেভাবে। কাদের বক্স এবারে আমাদের পাঁচজনের দিকে তাকিয়ে বলল, “তোমরা বাকি পাঁচজন এবারে আমাকে একটা সত্যি কথা বল। খবরদার মিথ্যা কথা বলবে না।” কাদের বক্স তখন বুড়ো মানুষটাকে দেখিয়ে বলল, “তোমরা কী এই বুড়োটাকে আগে দেখেছ?”

আমরা মাথা নাড়লাম।

”কখন দেখেছ?”

সুজন বলল, “আমাদের গাড়িতে সবজির টুকরি তুলেছিল।”

“ঐ সবজির টুকরিতে কী ছিল?”

আমি বললাম”গ্রেনেড।”

আমার কথা শুনে আমাদের অন্য সবাই ভয়ানকভাবে চমকে উঠল। তারা অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকাল। কাদের বক্স সন্তুষ্টির ভঙ্গি করে মাথা নাড়ল, তার ভাব দেখে মনে হল আমরা যে ব্যাপারটা জানি সেটা জেনে সে খুশি হয়েছে। মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “এখন তোমরা আমাকে বল, তোমরা কি ঐ টুকরি থেকে গ্রেনেড সরিয়েছ?”

সুজন মাথা নাড়ল, বলল, “হ্যাঁ। সরিয়েছি।”

বুড়ো মানুষটা হাতবাঁধা অবস্থায় লাফিয়ে ওঠার চেষ্টা করে বলল, “বলেছি না আমি? বলেছি না?”

কাদের বক্স গম্ভীর মুখে বলল, “এতো লাফিও না বুড়া মিয়া। এখন আমার শেষ প্রশ্ন। এই প্রশ্নটার উত্তরের উপর নির্ভর করছে তোমার মাথার ভিতর দিয়ে গুলি যাবে না কি যাবে না।” কাদের বক্স আমাদের দিকে তাকাল, তারপর মুখ শক্ত করে জিজ্ঞেস করল, “তোমরা কয়টা গ্রেনেড সরিয়েছ?”

বুড়ো মানুষটার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল, সে ভয় পাওয়া চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। আমি সুজনের দিকে তাকালাম তারপর কাদের বক্সের দিকে তাকিয়ে বললাম, “দুইটা।”

বুড়ো মানুষটা আনন্দে চিৎকার করে উঠে বলল, “দেখেছেন কাদের ভাই? দেখেছেন? আমি গ্রেনেড সরাই নাই। এই পাজি বদমাইশ ছেলেমেয়েগুলো সরিয়েছে।”

কাদের বক্স কিছুক্ষণ বুড়ো মানুষটার দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর অন্যদের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “বুড়ার হাতের বাঁধন খুলে দে।”

একজন এসে তার বাঁধন খুলে দেয় এবং সাথে সাথে সে দাঁড়িয়ে বলে, “কাদের ভাই, আপনি একটু অনুমতি দেন আমি পাজি ছেলেমেয়েগুলোকে পিটিয়ে লাশ করে দেই।”

কাদের বক্স বলল, “তার অনেক সময় পাবে বুড়া।” তারপর ঘুরে আমাদের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলল, “গ্রেনেড দুইটা এখন কোথায় আছে?”

আমরা কোনো কথা বললাম না, তখন কাদের বক্স ধমক দিয়ে উঠল, “কোথায় আছে?”

“আমাদের রুমের পিছনে ফেলে দিয়েছি।”

কাদের বক্স আগুনের মতো জ্বলন্ত চোখে আমাদের দিকে তাকিয়ে রইল। হুংকার দিয়ে বলল, “রুমের পিছনে কোথায়?”

“বড় বড় দুইটা গাছ আছে, তার সাথে ঝোঁপ। সেই ঝোঁপের নিচে।”

কাদের বক্স একজনের দিকে তাকিয়ে বলল, “চান্দু। তোর উপর দায়িত্ব, গ্রেনেড দুইটা খুঁজে বের করে নিয়ে আসবি।”

চান্দু নামের মানুষটা মাথা নাড়ল, বলল, “ঠিক আছে”স্তাদ।”

এতোক্ষণ আমি আর সুজন ছাড়া আমাদের আর কেউ কথা বলে নাই। এবারে রিতু কথা বলার চেষ্টা করল, বলল, “এখন কি আমরা যেতে পারি?”

কাদের বক্স বলল, “কী বললে?”

“আপনাদের যেসব প্রশ্ন ছিল তার সবগুলোর উত্তর তো জেনে গেছেন। এখন আমাদের কি ফিরিয়ে দিয়ে আসবেন?”

কাদের বক্স কিছুক্ষণ রিতুর দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর হা হা করে হাসতে শুরু করল। কাদের বক্সের হাসি দেখে অন্যেরাও হাসতে শুরু করে, যেন তারা খুব মজার কথা শুনেছে। হাসতে হাসতে কাদের বক্সের চোখে পানি চলে আসে। একসময় সে হাসি থামায়, তারপর টেনে টেনে বলে, “শুনো কানা মেয়ে। পৃথিবীতে দুইটা জিনিসের ব্যবসায় মুনাফা সবচেয়ে বেশি। একটা হচ্ছে অস্ত্র আরেকটা হচ্ছে মানুষ! আমি অস্ত্রের ব্যবসাও করি মানুষের ব্যবসাও করি। ছেড়ে দেবার জন্যে তোমাদের আমি ধরে আনি নাই! তোমাদের বিক্রি করা হবে। বুঝেছ? রেঙ্গুনের মার্কেটে!”

ভয়ে আতঙ্কে আমাদের সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল।

.

১২.

যখন আমরা জানতে পারলাম ছোট একটা ঘুপচি ঘরে বন্দি হয়ে থাকতে কেমন লাগে

আমাদেরকে একটা ঘরের মাঝে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে তালা মেরে দিয়েছে। ঘরের ভেতরে কোনো আলো নেই। একটা ছোট জানালা আছে, সেই জানালা দিয়ে বাইরের আবছা আলো ভেতরে একটুখানি এসে মনে হয় অন্ধকারটাকে আরো জমাট বাঁধিয়ে দিয়েছে।

ঘরের ভেতরে সবাই কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলাম, কী বলব কেউ কিছু বুঝতে পারছি না। সবার আগে কথা বলল রিতু। আমাদের দিকে ঘুরে বলল, “তিতু আর সুজন তোরা আমাদের বলবি কী হয়েছে? কেন কাদের বক্স আমাদের ধরে এনেছে?”

মামুন বলল, “হ্যাঁ। আমরা কেউ কিছু জানি না, শুধু তোরা দুইজন জানিস।”

শান্তা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, “তোরা কোনো একটা ঝামেলা করবি আর তার জন্যে আমরা সবাই বিপদে পড়ব? কী করেছিস তোরা?”

আমি বললাম, “আমরা কিছুই করিনি–”

শান্তা রেগে গিয়ে বলল, “নিশ্চয়ই করেছিস। তা না হলে আমাদেরকে কেন ধরে এনেছে। বল কী করেছিস?”

সুজন বলল, “আমরা কিছু করি নাই।”

মামুন বলল, “মিথ্যা কথা বলবি না। কী করেছিস বল?”

সুজন বলল, “দেখতে চাচ্ছিলাম টুকরিতে কী আছে। আগে জানলে কি দেখার চেষ্টা করি? গ্রেনেড কেন নিবে টুকরিতে-বুড়ো মানুষটা কীরকম বেয়াদপের মতো কথা বলছিল দেখিসনি, জাবেদ চাচাকে খুঁজছিলাম–”

সুজনের এই ছাড়া ছাড়া মাথামুণ্ডুহীন কথাবার্তা শুনে কেউ কিছু বুঝতে পারল তাই আমাকে পুরো ব্যাপারটা বলতে হল। তখন সবার রাগটা আমার উপর থেকে সরে গিয়ে পুরোপুরি সুজনের উপর পড়ল। শান্তা চিৎকার করে বলল, “তুই তুই তুই–” তারপর রেগে সুজনের উপর ঝাঁপিয়ে পড়তে চাইল, আমরা কোনোমতে তাকে থামালাম। তখন শান্তা হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল, বলতে লাগল, “আমাদের এখন কী হবে! হায় ভগবান! কী হবে আমাদের?”

আমরা কী বলব বুঝতে পারলাম না। মামুন বলল, “কী হবে? আমাদের সবাইকে মেরে ফেলবে! তা না হলে হাত-পা ভেঙে লুলা বানিয়ে বিক্রি করে দেবে–”

শান্তা বলল, “এই অন্ধকারের মাঝে আমাদের ফেলে রেখেছে, কিছু দেখতে পাই না”

আঁখি এতোক্ষণ কোনো কথা বলেনি, এই প্রথম সে কথা বলল। শান্তার হাত ধরে বলল, “কাঁদে না শান্তা। ছিঃ! কাঁদে না।”

“কেন কাঁদব না? এখন আমাদের কী হবে?”

“আমাদের যে ধরে এনেছে সেটা এতক্ষণে জানাজানি হয়নি? নিশ্চয়ই হয়েছে। পুলিশ মিলিটারি কি আমাদের খুঁজতে শুরু করেনি? নিশ্চয়ই করেছে। আগে হোক পরে হোক তারা আমাদের পেয়ে যাবে।”

শান্তা কান্না একটু কমিয়ে বলল, “সত্যি?”

“হ্যাঁ সত্যি। আমি তো আমার আব্বুকে জানি, আমার আব্বু এদের ছেড়ে দেবে ভেবেছিস? ছাড়বে না, খুঁজে বের করবেই। তাই কাঁদিস না। শুধু শান্ত হয়ে অপেক্ষা কর।”

“এই ঘুটঘুঁটে অন্ধকার–”

আঁখি বলল, “তোদের কাছে ঘুটঘুঁটে অন্ধকার। আমার কাছে কোনো পার্থক্য নেই। তাই বলছি আয় আমরা সবাই মিলে ঠাণ্ডা মাথায় চিন্তা করি কী করা যায়। কেঁদে লাভ নেই।”

“এই পাজি সুজনটার জন্যে–”

আঁখি বলল, “কেন সুজনকে দোষ দিচ্ছিস? এটা তো সুজনের দোষ নয়। এই বদমাইশ মানুষগুলোর দোষ। এরা খারাপ মানুষ।”

আঁখির কথায় শেষ পর্যন্ত শান্তা একটু শান্ত হল। আমরা সবাই তখন গোল হয়ে বসলাম কী করা যায় চিন্তা করার জন্যে। বসে বসে আমরা পুরো ব্যাপারটা নিয়ে কথা বললাম, কিন্তু ঠিক কী করা যাবে ভেবে পেলাম না। শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছু করার থাকল না। তাই আমরা ছোট ঘরটার দেয়ালটায় পিঠ দিয়ে হেলান দিয়ে বসে বসে সকাল হওয়ার জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলাম।

সেই রাতটা ছিল আমাদের জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর রাত। মাত্র একদিন আগেই আমরা নিজেরা নিজেরা কথা বলছিলাম যে আমরা কী আনন্দে আছি! কী সুন্দর রিসোর্ট, ডাইনিং রুমে কী মজার খাবার, কী সুন্দর নরম তুলতুলে বিছানা, কী চমৎকার পরিষ্কার বাথরুম। আমাদের কোনো কিছুই নিজেদের করতে হচ্ছে, কেউ না কেউ আমাদের জন্যে সবকিছু করে দিচ্ছে। সেই অবস্থা থেকে আমরা এসে পড়েছি এই জায়গায়। পেটে খিদে নিয়ে অন্ধকার ঘরে বসে আছি। ঘরের ভেতর দিয়ে পোকামাকড় ইঁদুর ছুটে বেড়াচ্ছে। মশার কামড়ে চুপ করে বসে থাকা যায় না। কুটকুটে দুটো কম্বল দিয়েছে সেই কম্বলে দুর্গন্ধ, শরীরের কোথাও ঘষা লাগলে মনে হয় শরীরের ছাল উঠে যাবে।

সবচেয়ে ভয়ংকর হচ্ছে বাথরুমটা। ঘরের এক কোনায় মাটিতে একটা গর্ত। সামনে একটা ছালা টানিয়ে রেখেছে। সেটাই হচ্ছে বাথরুম। সেখানে ভয়ংকর একটা দুর্গন্ধ। সারা ঘরে সেই দুর্গন্ধ পাক খেয়ে বেড়াচ্ছে।

আমরা সারা রাত ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে রইলাম। মাঝে মাঝে দুই-এক মুহূর্তের জন্যে চোখ বন্ধ হয়েছে আবার চমকে জেগে উঠেছি। যখন চোখ বন্ধ হয়েছে তখন ভয়ংকর স্বপ্ন দেখে জেগে উঠেছি। স্বপ্ন দেখেছি কাদের বক্স রাইফেল তাক করে হা হা করে হাসছে, কী ভয়ংকর সেই হাসি।

যখন নিশুতি রাত তখন আমরা জঙ্গলের নানা পশুপাখির শব্দ শুনতে পেলাম, কী বিচিত্র তাদের ডাক। কোনো কোনো পশুর গলার আওয়াজ শুনলে মনে হয় বুঝি কেউ চিৎকার করে কাঁদছে। পাখি ডানা ঝাঁপটে উড়ে যায় এবং মাঝে মাঝে বহু দূর থেকে কোনো এক ধরনের ইঞ্জিনের শব্দ শুনতে পাই, মনে হয় বহু দূরে নদী দিয়ে স্পিড বোট যাচ্ছে। আমাদের খুঁজতে পুলিশ বের হয়েছে কী না কে জানে।

আমি ভেবেছিলাম সারা রাত নিশ্চয়ই আমি ঘুমাতে পারব না কিন্তু ভোর রাতের দিকে আমার চোখে ঘুম নেমে এল। ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে আমি স্বপ্নে দেখলাম আমি বাসায় আমার বিছানায় আধশোয়া হয়ে একটা গল্পের বই পড়ছি, আমার আম্মু তখন প্লেটে করে আমার জন্যে ঝাল করে মাখানো মুড়ি নিয়ে এসেছেন। আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা তিতু তোদের না কি কাদের বক্স ধরে নিয়ে গিয়েছিল?” আমি হি হি করে হেসে বললাম, “কী বলছ আম্মু? কাদের বক্স কেন আমাদের ধরে নেবে? এই দেখ না আমি বাসায় আমার বিছানায় বসে আছি?”

ঠিক তখন আমার ঘুম ভেঙে গেল আর আমি বুঝতে পারলাম আমি বাসায় আমার বিছানায় বসে নাই। আমাকে আর অন্য সবাইকে কাদের বক্স ধরে এনেছে। আমি বুকের ভেতর ভয়ংকর এক ধরনের চাপা আতঙ্ক অনুভব করলাম। বাইরে নিশ্চয়ই আলো হয়েছে কারণ ঘরের ভেতরেও এখন আবছা আলো। ঘরের দেয়ালে হেলান দিয়ে অন্যেরা গুটিশুটি মেরে বসে আছে। আমার মতোন সবাই নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছিল। আমি উঠে জানালার কাছে এগিয়ে গেলাম, জানালা না বলে সেটাকে বরং একটা ফুটো বলা ভালো, আমি সেই ফুটো দিয়ে বাইরে তাকালাম। আমাদের রাতেরবেলা চোখ বেঁধে এনেছে তখন কিছু দেখতে পাইনি। এখন দেখা যাচ্ছে জায়গাটা দুটো টিলার মাঝখানে, চারপাশে গাছগাছালি দিয়ে ঢাকা। সামনে আরেকটা ঘর, সেই ঘরের বারান্দায় একটা মানুষ বসে সিগারেট খাচ্ছে। এই মানুষটা নিশ্চয়ই পাহারা দিচ্ছে, তার ঘাড়ে একটা ভয়ংকর দেখতে রাইফেল। এটাকে নিশ্চয়ই এ কে ফোর্টি সেভেন বলে। আমি তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ঘরের দরজাটি খুলে গেল এবং ভিতর থেকে খালি গায়ে একজন মানুষ বের হয়ে আসে, আমি মানুষটিকে চিনতে পারি-কাদের বক্স। কাদের বক্স বগলের তলা দিয়ে ঘ্যাস ঘ্যাস করে খানিকক্ষণ চুলকায় তারপর পাহারায় থাকা মানুষটির কাছ থেকে একটা সিগারেট নেয়। সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে সে আবার ভিতরে ঢুকে গেল। আমি খানিকটা ধমকাধমকির শব্দ শুনলাম তখন ভেতর থেকে আরো কয়েকজন মানুষ ঘুম ঘুম চোখে বের হয়ে এল। এই ঘরটায় কাদের বক্স মনে হয় তার বডি গার্ডদের নিয়ে ঘুমায়।

“কী দেখছিস?” গলার স্বর শুনে আমি ঘুরে তাকালাম, রিতু আমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

“কিছু না। জায়গাটা কীরকম, কারা কোথায় থাকে এইসব।”

“দেখি?”

আমি সরে দাঁড়িয়ে বললাম, “দেখ কিন্তু মনে রাখিস তুই কিন্তু আসলে দেখতে পাস না।”

“জানি।” রিতু বলল, “ঐ মানুষগুলোর সামনে আমি সবসময়ই না দেখার ভান করব। চিন্তা করিস না।”

যখন খানিকটা বেলা হল এবং আমরা সবাই উঠে জড়সড় হয়ে বসে আছি তখন হঠাৎ করে দরজায় শব্দ হল। আমরা টের পেলাম কেউ একজন দরজার তালা খুলছে। কাঁচক্যাচ শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল এবং আমরা দেখলাম ভয়ানক চেহারার একজন মানুষ সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। মানুষটা হুংকার দেওয়ার মতো শব্দ করল, বলল, “কানা মেয়েটা কই?”

রিতু উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “এই যে।”

“তুই আয়। অন্যেরা খবরদার ঘর থেকে বের হবি না।”

রিতু জিজ্ঞেস করল, “কেন?”

“নাস্তা নিয়ে আসবি।”

“আমি?”

“হ্যাঁ।”

আমি বললাম, “ও তো চোখে দেখতে পায় না, ওর বদলে আমি আসি?”

“ও চোখে দেখে না বলেই ওরে আনতে বলছি। তুই চোখে দেখিস তাই চোখ না বেঁধে তোকে ঘর থেকে বের করব না। বুঝেছিস?”

আমি কোনো কথা বললাম না। লোকটা রিতুর হাত ধরে বাইরে নিয়ে আবার দরজা বন্ধ করে দিল। আমরা ঘরের ফুটো দিয়ে তাকালাম, দেখলাম রিতু চোখে দেখতে পায় না এরকম অভিনয় করে খুব সাবধানে মানুষটার সাথে সাথে হেঁটে কয়েকটা গাছের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

কিছুক্ষণ পর সে হাতে একটা মাঝারি সাইজের গামলা নিয়ে খুব আস্তে আস্তে হাঁটতে হাঁটতে আসে। তার পিছনে পিছনে সেই ভয়ানক চেহারার মানুষটা আসছে। মানুষটা ঘরের দরজা খুলে দিল, রিতু সাবধানে গামলাটা মেঝেতে রাখল। মানুষটা বলল, “যা এখন থালা বাসন নিয়ে আয়। পারবি না?”

রিতু মাথা নাড়ল, বলল, “পারব। একটা লাঠি হলে আরো ভালো হত।”

মানুষটা বেঁকিয়ে উঠে বলল, “নবাবজাদির লাঠি লাগবে! যা যা এমনি এমনি যা।”

রিতু তখন এমনি এমনি রওনা দিল। মানুষটা এবারে আমাদের ঘরের দরজায় বসে রিতুর দিকে তাকিয়ে থাকে। রিতু পা ঘষে ঘষে হাত দিয়ে সামনে কী আছে অনুভব করার চেষ্টা করতে করতে এগিয়ে যায়। আবার কয়েকটা গাছের আড়ালে সে অদৃশ্য হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর আবার সে হাতে কয়েকটা টিনের প্লেট আর চামচ নিয়ে ফিরে এলো। চোখে না দেখার নিখুঁত অভিনয়–আমরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম।

রিতুকে আরো একবার যেতে হল, এবারে সে একটা পানির জগ আরেকটা গ্লাস নিয়ে এল। ঘরের ভেতরে আবার আমাদের তালা মেরে বন্ধ করার আগে মানুষটা রিতুকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, তোর চোখ তো ভালো আছে, দেখিস না কেন?”

“অপটিক নার্ভ নষ্ট।”

“সেটা আবার কী?”

“চোখ থেকে যে নার্ভ ব্রেনে সিগন্যাল পাঠায় সেটা নষ্ট।”

“কীভাবে নষ্ট হল?”

“যখন ছোট ছিলাম তখন একবার অসুখ হয়েছিল। ডাক্তার ভুল ওষুধ দিয়েছিল। সেই ওষুধের রি-একশান।”

মানুষটা জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বলল, “হারামজাদা ডাক্তার।”

রিতু বলল, “ইচ্ছা করে তো দেয় নাই। ভুল করে দিয়েছিল।”

“একই কথা।” বলে লোকটা ধরাম করে দরজা বন্ধ করে ঘটাং করে তালা মেরে দিল।

সাথে সাথে আমরা রিতুকে ঘিরে ধরলাম, “বাইরে কী দেখলি?”

“ঐ গাছগুলোর পিছনে আরেকটা ছোট ঘর। কাঠের চুলা আছে, সেখানে রান্নাবান্না হয়। একজন বুড়ো মানুষ রান্না করছে। কয়েকজন মানুষ বন্দুক হাতে

জায়গাটা পাহারা দিচ্ছে। দূরে আরো একটা ঘর আছে।”

“সব মিলিয়ে তোজন মানুষ?”

“এখন দশ জনের মতো। কয়েকজন খাচ্ছে। খেয়ে বের হবে।”

“রাস্তা আছে?”

“হ্যাঁ। একটাই রাস্তা, ডানদিক দিয়ে। নিচে নেমে গেছে।”

“আর আমাদের ঘরে তালা মেরে বাইরে একটা খুঁটির সাথে চাবি ঝুলিয়ে রাখে।”

আঁখি বলল, “আয় আমরা আগে খেয়ে নিই।”

রিতু বলল, “হ্যাঁ। সবাই ভালো করে খা।”

গামলা বোঝাই খিচুড়ি। মানুষগুলো খাবার নিয়ে কিপটেমি করেনি, নিজেরা যে পরিমাণ খায় সে হিসেবে দিয়েছে। আমরা যে অনেক কম খাই সেটা লোকগুলো জানে না। আমরা সবাই একটা করে টিনের প্লেট নিলাম, শান্তা বড় একটা চামচ দিয়ে আমাদের প্লেটে খাবার তুলে দিল।

খিচুড়িটা বিস্বাদ। লবণ নেই এবং ভয়ানক ঝাল। মাত্র একদিন আগেই আমরা ডাইনিং রুমের বিশাল টেবিলে বসে নাস্তা করেছি, ঝকঝকে গ্লাস, ধবধবে সাদা ন্যাপকিন। অরেঞ্জ জুস, টোস্ট, মাখন, জেলি, ডিম পোচ, দুধ, সিরিয়াল, আপেল, কলা আর গরম চা দিয়ে নাস্তা করেছি। এখন নাস্তা করছি শুধু খিচুড়ি দিয়ে! সেটাও বিস্বাদ আর ঝাল।

সবার জন্যে একটা মাত্র পানির গ্লাস, যে পানিটা দিয়েছে সেটা কোথা থেকে এনেছে জানি না। তারপরেও আমরা পানি খেলাম, যখন তেষ্টা পায় তখন পানি খেয়ে থাকা যায় না।

খাওয়া শেষ হবার পর আমি লক্ষ করলাম আঁখি খিচুড়ির বড় চামচটা হাতে নিয়ে সেটা হাত দিয়ে পরীক্ষা করছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী করছিস?”

“এই চামচটা পরীক্ষা করছি। বেশ বড় আর শক্ত।”

“তাতে কী হয়েছে?”

“আমাদের এই ঘরের মেঝেটা মাটির। তাই না?”

“হ্যাঁ।”

“আমরা গর্ত করে বের হয়ে যাই না কেন?”

আমরা সবাই আঁখির দিকে তাকালাম। আঁখি চামচটা ঘ্যাঁচ করে মাটিতে বসিয়ে এক খাবলা মাটি তুলে ফেলল। বলল, “দেখলি, মাটি কাটা যায়।”

সুজন বলল, “গর্ত করব? সেই গর্ত দিয়ে বের হওয়া যাবে?”

“হ্যাঁ।”

আমি বললাম, “চোরেরা যেভাবে সিধ কেটে ঢুকে?”

আঁখি বলল, “হ্যাঁ।”

“যদি ধরা পড়ি?”

“ধরা পড়া যাবে না।”

শান্তা বলল, “এই চামচটা তো ফিরিয়ে দিতে হবে।”

রিতু বলল, “এখানে আরো চামচ আছে। আমাকে যদি বের হতে দেয় আমি চুরি করে আরেকটা নিয়ে আসব।”

আমি হাতে কিল দিয়ে বললাম, “ফ্যান্টাস্টিক। ফাটাফাটি বুদ্ধি!”

শান্তা জিজ্ঞেস করল, “মাটিগুলো কী করব? গর্ত করলে যে মাটি বের হবে সেগুলো?”

আমরা থতমত খেয়ে গেলাম, সত্যিই তো, এতগুলো মাটি কী করব? লোকগুলো যদি দেখে ঘরের ভিতর এতো মাটি তা হলেই বুঝে যাবে। আমরা সবাই মাথা চুলকাতে থাকি তখন মামুন বলল, “আমরা যদি দুই ফুট ব্যাসে একটা গর্ত করি, গর্তটা যদি তিন ফুট লম্বা হয় তা হলে মোট মাটি কাটা হবে দশ কিউবিক ফুট। এই ঘরটা হচ্ছে আনুমানিক চার থেকে পাঁচশ বর্গফুট। যদি আমরা

মাটিটা সারা ঘরে সমানভাবে ছড়িয়ে দিই তা হলে মেঝেটা বড় জোর এক ইঞ্চির চারভাগের একভাগ উঁচু হবে! কেউ বুঝতে পারবে না।”

রিতু বলল, “ভেরি গুড, সায়েন্টিস্ট সাহেব!”

আঁখি বলল, “তা হলে দেরি করে কাজ নেই। কাজ শুরু করে দিই।”

আমি বললাম, “হ্যাঁ, চুপ করে বসে বসে অপেক্ষা করা খুব কঠিন।”

রিতু বলল, “তা হলে ঠিক করে নে, ঠিক কোথায় গর্ত শুরু করব।”

“দেয়ালের খুব কাছ থেকে গর্ত করতে হবে। তা হলে তাড়াতাড়ি বের হওয়া যাবে। যেদিকে বের হব সেদিকে যেন মানুষজন হাঁটাহাঁটি না করে।”

রিতু বলল, “সামনে আর ডান পাশে মানুষ থাকে। পিছনে জঙ্গল, মানুষ নেই।”

কাজেই আমরা পিছনের দিকে একটা জায়গা বেছে নিয়ে কাজ শুরু করলাম। একজন চামচ দিয়ে মাটি কাটে অন্যজন মুঠি করে মাটিটা নিয়ে ঘরে ছিটিয়ে দেয়। আরেকজন সেটা পা দিয়ে চেপে সমান করে দেয়। একজন হাতে একটা কম্বল নিয়ে রেডি থাকে-হঠাৎ করে কেউ যদি চলে আসে তা হলে গর্তের উপর কম্বলটা বিছিয়ে দেবে। বাকি দুজন পাহারা, আশেপাশে কাউকে আসতে দেখলেই ইশারা করে তখন আমরা থেমে যাই। কেউ যেন কোনো রকম শব্দও শুনতে না পায়।

এর মাঝে সবচেয়ে কঠিন মাটি কাটা। চামচ না হয়ে যদি একটা খন্তা কিংবা কোদাল পেতাম তা হলে কী সহজে কাজটা করা যেত। যদি খন্তা কোদাল না হয়ে একটা খুরপিও পেতাম তা হলেও কাজটা দশগুণ সহজ হয়ে যেত। কিন্তু আমরা সেগুলো নিয়ে এখন মাথা ঘামালাম না-হাতের কাছে যেটা পেয়েছি সেটা নিয়েই কাজ করে যাচ্ছি।

কাজ শুরু করার দুই ঘণ্টা পর্যন্ত এমন কোনো গর্তই হল না, আমাদের সন্দেহ হতে লাগল আসলেই আমরা মাটি কেটে সত্যিকারের একটা গর্ত করতে পারব কি না। তৃতীয় ঘণ্টা শুরু করার পর প্রথমবার মনে হতে লাগল যে কাজটা আসলেই শেষ করা সম্ভব। আমরা যে গতিতে মাটি কেটে যাচ্ছি তাতে মনে হয় রাত বারোটার ভিতরেই আমরা গর্তটা শেষ করে ফেলতে পারব। যদি কোনোভাবে আরো একটা চামচ বা ধারালো কিছু পেয়ে যেতাম তা হলে কাজটা আরো তাড়াতাড়ি শেষ করা যেত।

দুপুরের ভিতর বেশ বড় একটা গর্ত হয়ে গেল। এখন আমরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছি যে সত্যিই একটা গর্ত তৈরি করে ফেলতে পারব। এরকম সময় দরজায় শব্দ হল এবং বেশ কয়েকজন মানুষ ঘরের ভিতরে ঢুকল। আমরা খুব তাড়াতাড়ি কম্বল দিয়ে জায়গাটা ঢেকে দিয়েছি।

যারা ঢুকেছে তাদের সবার সামনে কাদের বক্স, তার হাতে একটা ক্যামেরা। ভিতরে ঢুকে সে চারিদিকে তাকাল, ভয়ে আমাদের বুক ধুকপুক করতে থাকে। কম্বল দিয়ে যেখানে গর্তটা ঢেকে ফেলা হয়েছে, তার সামনে আঁখি বসে আছে যেন কেউ ওদিকে না যায়।

কাদের বক্স বলল, “সবাই এদিকে আয়।”

আমরা তার কথামতো পাশাপাশি এসে দাঁড়ালাম। তখন সে ক্যামেরা দিয়ে একজন একজন করে আমাদের সবার ছবি তুলল। তারপর জিব দিয়ে সন্তুষ্টির একটা শব্দ করে বলল, “তোদের ছবি নিয়ে নিলাম।”

আমরা কোনো কথা বললাম না। তখন কাদের বক্স বলল, “তোদের বাপ মায়ের কাছে পাঠাব। কী মনে হয়, তোদর বাপ-মা টাকা-পয়সা কিছু দেবে? না

কী তোরা সব বাপে খেদানো মায়ে খেদানো ছেলেমেয়ে? তোদের কী হল সেটা নিয়ে বাপ-মায়ের কোনো মাথাব্যথা নেই?”

এবারেও আমরা কোনো কথা বললাম না। কাদের বক্স তখন একটু গরম হয়ে বলল, “কী হল, কথা বলিস না কেন?”

আঁখি বলল, “উল্টোটাও তো হতে পারে?”

“উল্টোটা? সেটা আবার কী?”

“আমাদের বাবা-মা খুঁজে আপনাদের বের করে ফেলে। পুলিশ মিলিটারি আপনাদের এরেস্ট করে ফেলে।”

কাদের বক্স এরকম একটা উত্তরের জন্যে প্রস্তুত ছিল না, সে থতমত খেয়ে যায়। তারপর হঠাৎ করে রেগে উঠে, “কী বললি তুই? আমি এরেস্ট হব? আমি? কাদের বক্স? শুনে রাখ, পুলিশের বাবার সাধ্যি নাই আমাকে এরেস্ট করে। বুঝেছিস?”

কাদের বক্সের সাথে যে মানুষগুলো এসেছে তাদের একজন বলল, “কতো বড় বেয়াদপ মেয়ে। এক চড় মেরে দাঁতগুলো খুলে ফেলা দরকার। ওস্তাদ দিব না কি একটা চড়?”

কাদের বক্স হাত নেড়ে বলল, “বাদ দে। মজা তো এখনো টের পায় নাই, সেই জন্যে এতো তেজ!”

কাদের বক্স তার লোকজনকে নিয়ে বের হয়ে গেল আর সাথে সাথে আমরা আবার কাজে লেগে গেলাম। দেখতে দেখতে আমাদের হাত লাল হয়ে উঠল। হাতের চামড়া উঠে গেল, ফোঁসকা পড়ে গেল কিন্তু আমরা থামলাম না। আমরা মাটি খুঁড়ে যেতেই লাগলাম। খুঁড়ে যেতেই লাগলাম।

.

মাঝখানে দুপুরে আমাদের খেতে দিল, আগেরবারের মতো রিতুকে আনতে হল না, তাদের একজন নিজেই দিয়ে গেল। খাবারের মেনু খুবই সহজ, শুকনো মোটা রুটি আর বুটের ডাল। আমাদের বাসায় কেউ এরকম একটা খাবার আমাদের জোর করেও খাওয়াতে পারত না। কিন্তু এখানে আমরা গপগপ করে রীতিমতো কাড়াকাড়ি করে খেলাম। মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে আমাদের সবারই পরিশ্রম হয়েছে, সবারই পেটে খিদে! সত্যি কথা কী এই মোটা রুটি আর বুটের ডালকে মনে হল অসাধারণ!

দেখতে দেখতে অন্ধকার হয়ে গেল। অন্ধকারে আমরা হাতড়ে হাতড়ে কাজ করি। আঁখির মাঝে আর আমাদের মাঝে তখন আর কোনো পার্থক্য থাকে না। আঁখি তখন গর্তটা পরীক্ষা করে আমাদের বলে দেয় কোনদিকে কতোটুকু গর্ত করতে হবে। আমরা সেদিকে গর্ত করি। রাতে আমাদের কিছু খেতে দিল না। একেবারে কিছু দিল না সেটা সত্যি নয়, ঘরের জানালা দিয়ে কিছু কলা ধরিয়ে দিল। মোটা মোটা কলা, খেতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম পুরোটাই বিচি দিয়ে ভরা। কলার যে বিচি থাকে আমরা সেটাই কোনোদিন জানতাম না। এক কামড় কলা খেতে হলে পুটুর পুটুর করে একশটা বিচি মুখ থেকে ছুঁড়ে দিতে হয়–ভারি যন্ত্রণা। বাসায় রাত্রি বেলা ভালো করে খাওয়ার জন্যে আম্মু কতোরকম সাধাসাধি করেন–আর এখানে রাতের খাবার হচ্ছে জন প্রতি একটা করে বিচিকলা, কপাল আর কাকে বলে।

তবে সেই বিচিকলা খেয়েই আমরা কাজ করে গেলাম। গভীর রাতে যখন বাইরের মাটি ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে গর্তটা বের হয়ে এলো আমরা তখন ঘরের ভেতরে এতোটুকু শব্দ না করে আনন্দে নাচানাচি করতে থাকি। কাদের বক্স আর তার দলের নাকের ডগা দিয়ে আমরা এখন পালিয়ে যাব!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *