অনিমেষবাবুর অনুবাদের কাজটা গ্রহণ করার পর থেকে আমার মানসিকতার মধ্যে কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। আমার সেই উড়ু উড়ু ভাবটা অনেক পরিমাণে কমেছে। আসলে এতোদিন আমার ভেতরে যে হা হুতাশ চলছিলো এবং যা আমি তায়েবার প্রতি গভীর ভালোবাসার প্রকাশ মনে করে আসছিলাম, তা সর্বাংশে সঠিক নয়। আমার নিজের প্রতি নিজের যে কর্তব্যবোধ তা পালন করার অক্ষমতা থেকেই আমার ভাবাবেগ জন্ম নিচ্ছিলো। তায়েবার চারপাশে যারা জড়ো হয়, যারা তাকে সকাল বিকেল দেখতে আসে আমি মনে করতাম, কেউ তায়েবার মঙ্গল চায় না। তারা আসে মজা দেখার জন্য, কষ্ট বাড়াবার জন্য অথবা জাহিদুল এবং ডোরার মতো নিজেদের কৃতকর্মের অপরাধবোধ লাঘব করার জন্য। আমি মনে করতাম, গোটা কোলকাতা শহরে আমিই হলাম একমাত্র ব্যক্তি যে তায়েবার মঙ্গল চায়। আর সকলেই তায়েবার শত্রু।
দৈনিক দশ টাকা আয় করার জন্য তিন সাড়ে তিন ঘণ্টার কঠোর খাটুনি খাটতে গিয়ে আমার চোখ খুলে গেলো। আমি আবিষ্কার করলাম তায়েবার চিকিৎসার যাবতীয় অষুধপত্তর সবটা হাসপাতাল দেয় না, বাইরে থেকে সংগ্রহ করতে হয়। তার পেছনে অন্ততঃ তিন থেকে সাড়ে তিনশো টাকা ব্যয় করতে হয় প্রতিদিন। এই টাকাটা কে সংগ্রহ করে, কার কাছ থেকে সংগ্রহ করে, কে অষুধ কেনে, কে পথ্য সরবরাহ করে কিছুরই সংবাদ জানিনে। অথচ আমি মনে করি আমি তায়েবাকে ভালোবাসি। এই ভালোবাসার দাবিতে না করতে পারবো হেননা দুঃসাধ্য কর্ম আমার নেই। তায়েবার দেখাশোনার সব দায়িত্বটা যদি আমার ওপর পড়তো, আমি কি করতাম। আমি মনে মনে ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিলাম। তার পার্টির মানুষদের আমি অপরাধী সাব্যস্ত করে বসে আছি। কিন্তু তারা তো টাকাটা ম্যানেজ করছে। জাহিদুলকে আমি ক্রিমিন্যাল ধরে নিয়েছি। আমার বিবেচনায় ডোরা একটি নষ্টা মেয়ে। দু’তিনদিন আগে জানতে পেরেছি, জাহিদুল এখানে সেখানে ডোরাকে নিয়ে যে অনুষ্ঠান করায়, তাতে যে টাকাটা আসে, তার সবটা তায়েবার পেছনে খরচ করে। এমনকি দিল্লীতে গান গেয়ে যে টাকাটা ডোরা পেয়েছিলো, ও দিয়ে আমেরিকা থেকে কি একটা দুষ্প্রাপ্য ইনজেকশন আনিয়েছে। ডোরা জাহিদুলকে বিয়ে করেছে। তাতে এমন অন্যায়টা কি হয়েছে? এরকম অনেক তো ঘটে। হেনা ভাই একটা বিধবা মেয়েকে এ সময়ে বিয়ে করে অপরাধ কি করেছে? মহিলা এবং হেনা ভাই পরস্পরকে পছন্দ করেই তো বিয়ে করেছে। আমি এক ধারে সকলকে অপরাধী মনে করি কেন। পৃথিবীর সকলে ঘোরতরো পাপে লিপ্ত, আর আমি একা ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির এ কেমন করে হয়।
তায়েবার ক্যান্সারের জন্য সবাই দায়ী হবেন কেন? ক্যান্সার রোগ তো আরো অনেকের হয়। এই ওয়ার্ডের অধিকাংশই তো ক্যান্সার রোগী। তারা কাকে দায়ী করে? বড়ো জোর ভাগ্যকে? আমি যে তায়েবার পক্ষ অবলম্বন করে মনে মনে এতো লম্ফঝম্ফ করছি এ পর্যন্ত তায়েবার জন্য কি করতে পেরেছি? হ্যাঁ এ পর্যন্ত একটা কৃতিত্ব আমার আছে। তায়েবাকে সন্ধ্যেবেলা হাসপাতালে প্রতিদিন দেখতে যাওয়ার খরচটা আয় করার একটা ব্যবস্থা করতে পেরেছি। নিজের দীনতা, তুচ্ছতা এবং হীনমন্যতার পরিচয় পেয়ে একটা আত্মঘৃণা ঘুরে ঘুরে বার বার আমাকে দগ্ধ করতে থাকলো। সেদিন সকালবেলা আমি হাসপাতালে গেলাম। ডঃ মাইতি আমাকে একটা পাশের ব্যবস্থা করিয়ে দিয়েছিলেন। দিনটি খুবই সুন্দর। সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে। হাওয়াতে সামান্য হিমেল পরশ। আকাশে চচনে রোদ উঠেছে। শিশুসকালের রোদে চারপাশের গাছপালা চিরদিন এমনই সবুজ থাকবে, সূর্য এমনি করে সুন্দর আলোকরাশি বর্ষণ করবে, এমনি করে মানুষজনের কলকাকলিতে রাজপথ মুখরিত হবে, রাস্তায় রাস্তায় গাড়ি ঘোড়া এমনি ধরনের আওয়াজ করে বাতাস কম্পিত করে তুলবে, শুধু থাকবে না তায়েবা, জীবনের চলমান স্রোত থেকে বাদ পড়ে যাবে শুধু একজন। আল্লার দুনিয়ার এই পরিপূর্ণতার মধ্যে তার প্রস্থানের কোনো চিহ্ন পর্যন্ত থাকবে না। আমার এতো বড়ো ক্ষতি আমি পূরণ করবো কি করে।
তায়েবার কেবিনে যখন প্রবেশ করলাম, দেখে খুবই ভালো লাগলো। সে উঠে বসেছে। সকালবেলা বোধ হয় গোসল করে ফেলেছে। খয়েরি রঙ্গের একটা পাটভাঙ্গা শাড়ি পরেছে। তাকে খুবই প্রফুল্ল দেখাচ্ছে। মুখে মনে হয় ক্রীম মেখেছে, ঘাড়ে পাউডারের দানা ছড়িয়ে আছে। হাসপাতালে আমি কোনোদিন তায়েবাকে এরকম হাসিখুশি দেখেছি মনে পড়ে না। আমার মনের ভেতরে একটা সূক্ষ্ম আশার রেখা খেলে গেলো। তাহলে কি তায়েবার অসুখ সেরে যাবে!
আমাকে দেখামাত্রই তায়েবা কলকল করে উঠলো। এই যে দানিয়েল ভাই, এসে গেছেন। তার কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীতের দু’টো কলি গুনগুন করে উঠলো। এদিন আজি কোন ঘরে গো খুলে দিল দ্বার। আজি প্ৰাতে সূর্য ওঠা সফল হল কার। পূর্বের দিনের মতো হাততালি দিয়ে উঠতে চেষ্টা করলো। জানেন দানিয়েল ভাই, এই সকালবেলায় আপনি প্রথম মানুষ নন। আপনার আগেও একজন এসেছিলেন, কে বলুন দেখি। আমি বললাম, কেমন করে বলবো কে এসেছিলো। সে ঠোঁট একটুখানি ফুলিয়ে বললো, এসেছিলো, অর্চনাদি। আমি বললাম, এতো সকালে অর্চনা কেমন করে এলো। তার কোনো পাশও ছিলো না। তায়েবা জবাব দিলো অর্চনাদি চাইলে কিনা করতে পারে। তার কত প্রভাব প্রতিপত্তি। এই হাসপাতালে ডঃ সেনগুপ্ত বলে এক ভদ্রলোক আছেন, তিনি অর্চনাদির কি ধরনের আত্মীয় হন। ডঃ সেনগুপ্তকে সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। আমি আপনাকে বলেছিলাম না অর্চনাদি খুউব ভালো, আর খুউব রুচিবান মহিলা। দেখুন এই শাড়িখানা আমাকে দিয়ে গেছে। খুব সুন্দর না, আমাকে মানিয়েছে? আমি জিগেস করলাম, এটা কি নতুন শাড়ি? সে কপট রাগের ভঙ্গি করে বললো। আপনি এখনো পর্যন্ত একটা মিষ্টি কুমোড়, নতুন শাড়ির সঙ্গে পুরোনো শাড়ির পার্থক্য পর্যন্ত ধরতে পারেন না। এমন রঙকানা মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। তারপর তায়েবা বললো, অর্চনাদি আমাকে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে নিজের হাতে গোসল করিয়েছে। তারপর শাড়ি পরিয়েছে। আমার মুখে ক্রীম মাখিয়ে দিয়েছে। ভীষণ ভালো লাগছে। মনে হচ্ছে আমার অসুখবিসুখ কিছু নেই। অর্চনাদির শাড়িতে আমাকে মানিয়েছে। কই কিছু তো বললেন না। আমি বললাম, হ্যাঁ খুব মানিয়েছে। জানেন দানিয়েল ভাই, জীবনে আমি আপনার মতো বেরসিক মানুষ বেশি দেখিনি। আপনার কোনো ভদ্রতাজ্ঞান নেই। এমন মুখ গোমড়া স্বভাবের মানুষকে অর্চনাদির মতো এমন একজন রুচিবান মহিলা কি করে সহ্য করেন, আমি তো ভেবে পাইনে।
তায়েবা কথাটা যতো সহজভাবেই বলুক, শুনে আমার কেমন জানি লাগলো। হাজার হোক মানুষের মন তো। তার কথাটা গায়ে না মেখে আমি বললাম, অর্চনার আমাকে সহ্য করার কি আছে? তাকে আমি আগে থেকে চিনতাম, চিঠিপত্রে যোগাযোগ ছিলো। এইতো সম্পর্ক। এ অনেক মানুষই তো বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল, অর্চনাও তার একজন। আর তাছাড়া…। তাছাড়া আর কি। অর্চনা তোমাকে খুবই পছন্দ করে। একথা আমাকে বার বার বলেছে। তায়েবা বললো, অর্চনাদি আপনাকে খুব পছন্দ করে। আপনাকে পছন্দ করে বলেই আমাকে দেখতে আসে। আমার সঙ্গে অর্চনাদির তো সেরকম কোনো পরিচয় ছিলো না। আমি বললাম, মানুষ একসূত্রে না একসূত্রে একে অপরের সঙ্গে পরিচিত হয়। তোমার সঙ্গে পূর্বে পরিচয় ছিলো না। এখন তোমার সঙ্গে পরিচয় হলো। অর্চনাদি কি সুন্দর আর কি লম্বা আর কতো লেখাপড়া জানে। আপনার নিশ্চয়ই খুব ভালো লাগে। আমি বললাম, অর্চনা শুধু আমার বন্ধু, আর কিছু বলতে পারবো না। এবার তায়েবা কথাটাকে ঘুরিয়ে নিয়ে বললো, আপনি দেখতে একটুও সুন্দর নন, তবু এতো ভালো মহিলাদের সঙ্গে এমন ঘনিষ্টতা হয় কি করে। আমি বুঝতে পারিনে, আমি বললাম, তোমার সঙ্গেও আমার একটা ঘনিষ্ট সম্পর্ক আছে, এটাকে তুমি কি বলবে?
তায়েবা তার হাতটা আমার মুখে চাপা দিয়ে বললো, দানিয়েল ভাই, মনে আছে একবার আপনি সন্ধ্যেবেলা আমাদের বাড়িতে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই শহরে কারফিউ জারি করা হয়েছিলো। আপনি শুনেই কারফিউর মধ্যে চলে গিয়েছিলেন। সারারাত আমি ঘুমোতে পারিনি। পরের দিন সকালবেলা আপনাকে কতো জায়গায় খুঁজে শেষ পর্যন্ত ডঃ মফিজ চৌধুরীর বাড়ি গিয়ে আবিষ্কার করেছিলাম, মনে আছে? আমি বললাম, মনে থাকবে না কেন, ও সমস্ত ঘটনা কেউ কি ভুলতে পারে। আচ্ছা, সেদিন আপনি অমন করে চলে গিয়েছিলেন কেন? আমি মনে মনে খুবই চেয়েছিলাম, আপনি রাতটা আমাদের বাড়িতে থেকে যাবেন। কোনোদিন বলিনি, আজ বলছি, খুবই কষ্ট পেয়েছিলাম। আচ্ছা, সেদিন থেকে গেলেন না কেন? আমি বললাম, তুমি থাকতে বললে না কেন? আমি বললে আপনি থাকতেন। অবশ্যই থাকতাম! আপনাকে থাকতে বলতে হবে কেন, আপনি নিজেই থাকলেন না কেন? সব কথা কি বলতে হয়?
তারপর তায়েবা আমার হাত ধরে বললো, দানিয়েল ভাই, আপনাকে একটা কথা বলবো, রাখবেন? আমি বললাম, বলো। আগে বলুন, রাখবেন। আচ্ছা রাখবো, এখন কথাটি বলো। আপনি আমাকে এখান থেকে কোথাও নিয়ে চলুন। চলুন, আমরা কোথাও পালিয়ে যাই। তার কথাটি শুনে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। তায়েবা পাগলামি করছে নাতো। আমি তাকে কোথায় নিয়ে যাবো। আর সে হাসপাতাল থেকে যাবেই বা কেমন করে। জবাব না দিয়ে আমি চুপ করে রইলাম। সে আমার গায়ে ঠেলা দিয়ে বললো, কি চুপ করে রইলেন যে। আমি বললাম, হাসপাতাল থেকে তোমাকে যেতে দেবে? আমি যদি যেতে চাই হাসপাতাল আমাকে ধরে রাখবে কেমন করে? সে ঝঙ্কার দিয়ে উঠলো, আপনি আমাকে চেনেন না? চেনবোনা কেনো। তায়েবাকে আমি বিলক্ষণ চিনি। সে যখন কোনো কিছু করবে ঠিক করে কেউ ঠেকিয়ে রাখতে পারে না। যেদিন আসাদ মারা যায় সে রিকশা করে হাসপাতাল থেকে আসছিলো। হঠাৎ করে মিছিল দেখে বেরিয়ে পড়ে, একশো চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গ করেছিলো। আমরা কেউ বাধা দিয়ে রাখতে পারিনি। আমি মনে মনে ভীষণ আতঙ্কিত হয়ে উঠেছিলাম। আজকেও যদি সে এরকম একটা কিছু করে বসে। আমি তো জানি তাকে আটকে রাখবো এমন ক্ষমতা আমার নেই। আপাততঃ তাকে একটু শান্ত করার জন্য বললাম, আগে একটু বসো, আলাপ করি কোথায় যেতে চাও। একটা ব্যবস্থা না হয় করা যাবে। সে জেদ ধরে রইলো, না আমি ওভাবে পড়ে থাকবো না। আপনি আমাকে নিয়ে চলুন। আমি বললাম, কোথায় নিয়ে যাবো আগে বলল, তারপর না হয় যাওয়া যাবে। সে জবাব দিলো, আমাকে বলতে হবে কেন, আপনার যেখানে ইচ্ছা নিয়ে যান। আমি যদি তোমাকে এ অবস্থায় এখান থেকে নিয়ে যাই, তোমার বোন, মা, ভাই এবং পার্টির লোকেরা আমায় কি আস্ত রাখবে? কোনো একটা কারণে তোমার অসুখটা হঠাৎ করে বেড়ে যায়, সকলের কাছে আমি কি জবাব দেবো? আমার মা, ভাই, বোন, পার্টির লোক কি মনে করবে? আমি দেখবো, আপনি নিয়ে যাবেন কিনা বলুন? তুমি জানো, এখানে আমার নিজেরথ থাকার জায়গা নেই। তোমাকে আমি কোথায় নিয়ে যেতে পারি। সে বললো, অন্ততঃ আপনি কোথাও আমাকে নিয়ে বেড়িয়ে আসুন। এই হাসপাতালে থাকতে থাকতে আমি অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। আপনি আমাকে নিয়ে চলুন। এখন কেউ নেই, এই সময়ে বেরিয়ে পড়াই উত্তম। আমি বললাম, আচ্ছা ঠিক আছে, আমি একটু ডঃ মাইতির সঙ্গে পরামর্শ করে আসি। তুমি একটুখানি অপেক্ষা করো। ডঃ মাইতির কাছে যাবেন কেন? আপনি যখন অর্চনাদিকে নিয়ে বেড়াতে যান, তখন কি ডঃ মাইতির পারমিশন চান? আমি বললাম, অর্চনাকে নিয়ে কখন আবার বেড়াতে গেলাম। এ উদ্ভট সংবাদ কার কাছে শুনলে? তায়েবা চোখের রাঙ্গা পুতুলি দুটো দেখিয়ে বললো, ফের মিথ্যে কথা বলছেন, অর্চনাদি আমাকে নিজেই বলেছেন, অর্চনাদিকে নিয়ে আপনি বেলেঘাটা না কোথায় গিয়েছিলেন? আমি হেসে ফেললাম, ওহ সেই কথা বলো। বেলেঘাটাতে তার এক নকশাল বন্ধুর বাড়িতে আমাকে নিমন্ত্রণ করেছিলো। অৰ্চনা আমাকে বাসা চেনাতে নিয়ে গিয়েছিলো। তায়েবা বললো, থাক্ আপনাকে আর কিছু বলতে হবে না। আপনাকেও আমার চেনা হয়ে গেছে। তায়েবাকে আমি কোনোদিন সাধারণ মেয়েমানুষের সঙ্গে এক করে দেখিনি। আমি মনে করতাম, সে মেয়েলি ঈর্ষা, বিদ্বেষ এসবের অনেক উর্ধ্বে। আজকে তার অন্য একটা পরিচয় পেলাম। দীর্ঘদিন ধরে আমি মনের মধ্যে একটা সংশয় লালন করে আসছিলাম। তায়েবার সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক সেটার ভিত্ কি? আমি তার অসুখকে উপলক্ষ করে তার পরিবার এবং পার্টির লোকদের বিরুদ্ধে মনে মনে অসংখ্য অভিযোগের যে খসড়া এঁকেছি তার একটা বাস্তব ভিত্তি পেয়ে গেলাম। আমার নালিশ করার অধিকার আছে, হ্যাঁ আছে, একশোবার আছে। আমার চোখ ফেটে কান্না বেরিয়ে আসতে চাইছিলো। হঠাৎ সে অতি কষ্টে বলে বসলো, দানিয়েল ভাই, আমাকে বিছানায় শুইয়ে দেন। আমার কেমন জানি লাগছে। আমি তাড়াতাড়ি বিছানায় শুইয়ে দিলাম। তার মুখে কোনো কথা নেই। গর গর আওয়াজ বেরিয়ে
আসছে।
.
১২.
সেপ্টেম্বর মাস প্রায় শেষ হয়ে আসছে। আমরা যারা কোলকাতা শহরের ভাসমান প্রাণী, দৈনন্দিন খাদ্য সংগ্রহের প্রয়োজনে এখান থেকে ওখানে ঘুরে বেড়াচ্ছি, আড্ডা জমাচ্ছি, নিজেদের মধ্যে খুনসুটি করছি, ঘরেরও না, ঘাটেরও না; সেই চূড়ান্ত সত্যটা ভুলে থাকার জন্য অষ্টপ্রহর এটা ওটায় ব্যস্ত থাকার চেষ্টা করছি। কিন্তু সেই দিকচিহ্নহীন সময় প্রবাহ আমাদের সবাইকে ঠেলে একটা কঠিন জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিলো। এতোদিন আমরা জানতাম সীমান্তে একটা যুদ্ধ চলছে। ঠিক যুদ্ধটা কোথায় হচ্ছে, কারা করছে, সে বিষয়ে আমাদের একেবারে যে ধারণা ছিলো না সে কথা সত্যি নয়। মাঝে মধ্যে আমরা সীমান্ত এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পগুলোতে গিয়েছি। সেখানে যুদ্ধের প্রস্তুতি যেটুকু চলছে নিজেদের চোখে দেখার সুযোগ হয়েছে। ক্যাম্পগুলোতে ট্রেনিং চলছে ঠিকই, কিন্তু এই ট্রেনিং থেকে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে নিরস্তিত্ব করে দিতে পারে এ রকম একটা মুক্তিযুদ্ধ জন্ম নিতে পারে সে কথা প্রাণের ভেতর বিশ্বাস করতে পারিনি। আমাদের কোথাও কিছু নেই, সবকিছুই শূণ্যের ওপর ঝুলছে। সবটাতেই ভারতের করুণার ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। ক্যাম্পে হাজার হাজার তরুণের মৃত্যুর সরল প্রস্তুতি অফুরন্ত মনোবল, আসন্ন সংগ্রামে সেটাই জাতিগতভাবে আমাদের সত্যিকার বিনিয়োগ। আমাদের ট্রেনিংরত মুক্তিযোদ্ধাদের জয়বাংলা রণধ্বনি আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে যখনই ফেটে পড়েছে আমাদের শিরার রক্ত চলকে উঠেছে। সেই প্রেরণাদীপ্ত পরিবেশে যতোক্ষণ থেকেছি, সমস্ত জাগতিক হিসেব নিকেশ তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে আমরা বিশ্বাস করেছি আমরা জয়ী হবো। জয়ী হবো এই বিশ্বাসটুকুও যদি না রাখতে পারি, তাহলে আমাদের অস্তিত্বের মূল্য কি? এই কোলকাতা শহরে আমরা কি করতে এসেছি। সমস্ত সন্দেহ, সমস্ত সংশয়কে সবলে তাড়িয়ে দিয়ে মনের মধ্যে একটা আশাবাদের শিখা প্রাণপণ প্রয়াসে উজ্জ্বল করে জ্বালিয়ে রাখতে আমরা ব্যস্ত ছিলাম। আমরা জয়ী হবো, আমাদের জয়লাভ করতে হবে। এই আশাটুকু না রাখতে পারলে মানুষের শরীর ধরে হেঁটে বেড়ানোর কোনো মানে খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। কিন্তু একটা হিসেবী মনও তো ছিলো। সেটা মাঝে মাঝে ভয়ানকভাবে বেঁকে বসতো। ক্যাম্পের বাস্তব অবস্থা দেখে মনটা দমে যেতো। পর্যাপ্ত খাবার নেই, গোলাবারুদ নেই। প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্রের তালিকা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠালে, ক্যাম্পে সে অস্ত্র এসে পৌঁছতে অনেক সময় সপ্তাহ, পক্ষ, এমনকি মাস গড়িয়ে যেতো। কোনো সময় আদৌ পৌঁছাতো না। নির্দেশনার প্রশ্নে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশী নেতৃত্বের মতবিরোধ লেগেই রয়েছে। থিয়েটর রোডের অস্থায়ী সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কাছে বার বার নালিশ করেও সদুত্তর পাওয়া যেতো না। প্রায় সবগুলো ক্যাম্পে একটা যাচ্ছেতাই অবস্থা। তরুণ মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল অটুট রাখার জন্য অনেক সময় ক্যাম্প কমাণ্ডারেরা গামছায় কিছু গ্রেনেড বেঁধে দিয়ে বলতো, যাও চোরাগোপ্তাভাবে পাকিস্তানী সৈন্যের ওপর আক্রমণ করো, রাজাকারদের খতম করো, তারপর ফিরে এসো। এভাবে শুধুমাত্র কিছু গ্রেনেডসহ তরুণ ছেলেদের দেশের ভেতরে পাঠানো যে প্রকারান্তরে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দেয়া এ কথা ক্যাম্প কমাণ্ডারেরাও বিশ্বাস করতেন। কিন্তু উপায় কি? অতোগুলো জোয়ান ছেলে ক্যাম্পে বসে থাকলে এক সময়ে নিষ্ক্রিয়তা এসে ভর করবে। তখন তাদের মধ্যে কোনো রকমের গতি সৃষ্টি করা দুরূহ হয়ে দাঁড়াবে। তাই যে কোনো রকমের এ্যাকশনের মধ্যে অন্ততঃ একাংশকে ব্যস্ত না রাখতে পারলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।
ক্যাম্পে গেলেই সকলে থিয়েটর রোডের কর্তাব্যক্তিদের বিরুদ্ধে গালাগাল করে। মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে গণপ্রতিনিধিদের সংযোগ সমন্বয় খুবই ক্ষীণ। তারা যে ক্যাম্প পরিদর্শন করতে যান না তাও ঠিক নয়। মাঝে মাঝে সরকারের তরফ থেকে কেউ না কেউ যান। সব সময়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন না একজন তাদের সঙ্গে থাকেন। বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিরা বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে প্রাণ খুলে মিশতে পারে না। ইচ্ছে থাকলেও অনেক সময় পারেন না। তাঁদের অবচেতন মনে সব সময় একটা ভীতি কাজ করে। যদি বেঁফাস কিছু মনে করেন। গণপ্রতিনিধিদের এই আঁটোসাঁটো দায়সারা মনোভাব মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। তাদের বেশিরভাগই আশা করে তারা যেভাবে প্রাণ দেয়ার জন্য এক পায়ের ওপর খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের যারা নেতা তাদের মধ্যে সেরকম খাঁটি জঙ্গী মনোভাব দেখতে পাবে। তার বদলে যখন নাদুশনুদুশ নেতারা স্নো-পাউডার চর্চিত মুখমণ্ডল এবং স্নিগ্ধ তেলঢালা শরীর নিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর পেছন পেছন হাজির হয়ে জনসভায় বক্তৃতার ঢঙ্গে হাত উঠিয়ে শেখ মুজিবের কণ্ঠস্বর নকল করে বলতে থাকেন, ভাইসব, তোমরা বাংলা মায়ের দামাল ছেলে। তোমরাই বাংলা জননীকে মুক্ত করবে। সেই দামাল ছেলেরা তখন তাঁদের অপেক্ষাকৃত নিচু স্বরে শালা বানচোত বলে গালাগাল করে। মুক্তিযুদ্ধের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ এবং সেক্টরগুলোর কমান্ডারদের মধ্যে সব সময় ঝগড়া বিবাদ লেগেই আছে। সর্বাধিনায়ক বুড়ো জেনারেল ওসমানী সত্যিকার যুদ্ধের চাইতে মিলিটারি আদব কায়দার প্রতি অত্যধিক যত্নশীল। যুদ্ধের কাজের অগ্রগতির চাইতে তার হুকুম পালিত হলো কিনা প্রায় সময়ে সেটাই তাঁর মনোযোগর বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায়। সর্বাধিনায়ক এবং সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে মতবিরোধ কোনো কোনো সময়ে এমন পর্যায়ে দাঁড়ায় যে ওসমানী সাহেব তার দীর্ঘ গোঁফে তা দেয়া ছাড়া অন্য কিছু করার আছে সে কথা চিন্তা করতে পারেন না। যে যার মতো করে যুদ্ধের পরিকল্পনা করছেন, কারো পরিকল্পনার সঙ্গে কারো পরিকল্পনা মিলছে না। প্রায় সময়েই অচলাবস্থার সৃষ্টি হচ্ছে। ভারতীয়রা বাংলাদেশ কমান্ডের সঙ্গে কোনো রকমের যোগাযোগ না করেই বাংলাদেশী যুবকদের আলাদাভাবে ট্রেনিং দিয়ে যাচ্ছেন। এ নিয়ে থিয়েটর রোডে তাজুদ্দিন সাহেবের কাছে সংবাদ পাঠিয়েও কোনো সদুত্তর পাওয়া যাচ্ছে না।
থিয়েটর রোডের অস্থায়ী সরকারের কার্যালয়ে তাজুদ্দিন সাহেব যে খুব সুখে আছেন, সে কথাও ঠিক নয়। আওয়ামী লীগ দলটির মধ্যে কোন্দলের অন্ত নেই। তাজুদ্দিন সাহেব অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ায় আওয়ামী লীগের উচ্চাভিলাষী নেতাদের অনেকেই তার ওপর বিরক্ত। তিনি যে গোটা পরিস্থিতিটা সামাল দিতে পারবেন, তার ওপর এই আস্থা স্বয়ং ইন্দিরা গান্ধীরও নেই। ভারত সরকার তাজুদ্দিন বিরোধীদেরও হাতে রাখার চেষ্টা করছে। তাজুদ্দিন সাহেবকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্যই ভারতের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়তে হয়েছে। নিজের স্বাধীনভাবে কোনো কিছু করার ক্ষমতা বিশেষ নেই। সব সময় ভারত যা বলছে, সায় দিতে হচ্ছে, যা চাপিয়ে দিচ্ছে তাই মেনে নিতে হচ্ছে। ভারতের মাটিতে প্রকাশ্যে তাজুদ্দিনের বিপক্ষে কেউ কিছু বলতে সাহস না করলেও আওয়ামী লীগের একাংশ আমেরিকার মাধ্যমে গোপনে ইয়াহিয়া খানের সামরিক প্রশাসনের সঙ্গে আলাপ চালাচ্ছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। তাদের যুক্তি একটাই, ভারত কখনো বাংলাদেশের হয়ে যুদ্ধ করবে না, সুতরাং ছয় দফার ভিত্তিতে পাকিস্তানের সঙ্গে আপোষ মীমাংসায় আসাই হবে সবচেয়ে ভালো কাজ।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী কি করতে যাচ্ছেন কেউ জানে না। ভারতীয় জনমত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অনুকূলে এবং বেশিরভাগ ভারতীয় জনগণ চায় শ্রীমতী গান্ধী বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকারকে অনতিবিলম্বে স্বীকৃতি প্রদান করুন। কিন্তু যুদ্ধ করতে বললে তো যুদ্ধ করা যায় না। শ্রীমতী অত্যন্ত সন্তর্পনে অগ্রসর হচ্ছেন। বিশ্বজনমত পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর বর্বরতায় শিউরে উঠেছে একথা সত্যি, কিন্তু শুধুমাত্র বিশ্বজনগণের সহানুভূতির ওপর নির্ভর করে শ্ৰীমতী গান্ধী একটা যুদ্ধ কাঁধে নিতে পারেন না। পাকিস্তানের পক্ষে আমেরিকা আছে, আছে চীন। এই দুটো শক্তিশালী দেশ বারবার নালিশ করে আসছে ভারত পাকিস্তানকে ভেঙে দু’টুকরো করার জন্য পূর্বপাকিস্তানের জনগণের একাংশকে তার ভূখণ্ডের মধ্যে ডেকে নিয়ে অনর্থক ওই গণ্ডগোলটা পাকিয়ে তুলেছে। মুসলিম দেশসমূহের অধিকাংশও পাকিস্তানের অবস্থানকে সমর্থন করে। ভারতীয় জনগণের একটা বিরাট অংশ মনে করে চিরশত্রু পাকিস্তানকে চিরদিনের মতো দুর্বল করার এই একটা মোক্ষম সুযোগ। সুতরাং শ্রীমতী গান্ধীর অনতিবিলম্বে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়া উচিত। আকাঙ্ক্ষা পূরণের বাসনা থেকে তো আর যুদ্ধ বাধানো যায় না। সত্যি বটে, পূর্বপাকিস্তানের সাত কোটি মানুষ পাকিস্তানকে ধ্বংস করার কাজে ভারতকে সর্বান্তকরণে সমর্থন করবে। যদি একটা যুদ্ধ সত্যি সত্যি লাগে, পাকিস্তানের মিত্র চীন কিংবা আমেরিকা যদি পকিস্তানের সমর্থনে এগিয়ে আসে, তাহলে একটা বিশ্বযুদ্ধের সম্ভাবনা এড়ানো অসম্ভব। ভারতবর্ষ কি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য একটা বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি আপন কাঁধে নিতে পারে, বোধ করি শ্রীমতী গান্ধী চাইছিলেন যুদ্ধ ছাড়া বাংলাদেশের সংকটের একটা শান্তিপূর্ণ সমধান হোক।
পূর্বপাকিস্তান থেকে প্রায় এক কোটির বেশি মানুষ ভারতে চলে এসেছে। তার মধ্যে প্রায় আশি লক্ষ হিন্দু। যদি তাড়াতাড়ি কিছু একটা সমাধান খুঁজে বের করা না হয়, যে সকল মুসলমান ভারতে এসেছে তাদের অনেকেরই মনোবল ভেঙ্গে যাবে। অন্যদিকে ইয়াহিয়া খান সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে শরণার্থীদের ডাকছে তোমরা ফিরে এসো। কোনো ভয় নেই। একটা সময় আসতে পারে মুসলমানদের একটা বিরাট অংশ দেশে ফেরত চলে যেতে চাইবে। তখন ভারত অনেক নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে যাবে। যা কিছু করার তাড়াতাড়ি করে ফেলতে হবে। যদি ভারত একটা যুদ্ধ মাথায় নেয় চীন আমেরিকা যে পাকিস্তানের সপক্ষে ছুটে আসবে না সে ব্যাপারে ভারতের প্রধানমন্ত্রী এখনো নিশ্চিত হতে পারেননি। একটা পুরোদস্তুর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তানের বন্ধুদের চাপে যদি যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করতে হয়, ভারতের লোকসান হবে অনেক বেশি। তখন পাকিস্তান এই আশি লক্ষের মতো হিন্দুকে ফেরত নিতে চাইবে না। আশি লক্ষ বাড়তি মানুষের চাপ সহ্য করতে গিয়ে ভারতের দম বেরিয়ে যাবে। শ্রীমতি গান্ধী একটা বিরাট মানসিক চাপের মধ্যে রয়েছেন, যদিও তার আচার আচরণে সে কথা বোঝার উপায় নেই। পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু করে বৃহত্তর শক্তির চাপে যদি মাঝপথে থামিয়ে দিতে বাধ্য হতে হয়, সবদিক দিয়ে ভারতের ক্ষতি সবচাইতে বেশি। তখন এক পাকিস্তানের বদলে দুই পাকিস্তানের সৃষ্টি হবে। পূর্বপাকিস্তানে একজনও হিন্দু অধিবাসী থাকবে না। ভারতের হাজার সমস্যা। তার ওপর যদি ওই আশি লক্ষ মানুষের বোঝা তার ওপর চাপে, ওই বাড়তি জনসংখ্যার চাপে ভারত থেতলে যাবে।
ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের লোকদের সঙ্গে যদি একটি সমঝোতায় এসে শান্তিপূর্ণ সমাধানের চেষ্টা করতেন, শেখ মুজিবকে কারাগার থেকে মুক্তি দিতেন, মানে সমস্ত শরণার্থীদের ফেরত নিতেন, তাহলে সবদিক দিয়ে সেটাই হতো উত্তম। শ্ৰীমতী গান্ধীর জানার বাকি নেই, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের সঙ্গে একটা আপোষ মীমাংসায় এলেও পাকিস্তান একটি ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র হিসেবে আর কখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না। পঁচিশে মার্চের রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে নিষ্ঠুর নরমেধযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছে, যে রক্তস্রোত বইয়েছে, যেভাবে অগ্নিসংযোগ এবং নরহত্যার আয়োজন করেছে, তাতে করে দু’অংশের জনগণের মধ্যে আস্থা এবং বিশ্বাসের শেষ সম্ভাবনাটুকু চিরতরে ধ্বংস হয়ে গেছে। পূর্ব এবং পশ্চিমপাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ একটি রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে আসন্ন সংকট হয়তো কাটিয়ে উঠতে পারে, কিন্তু শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান কখনো ভারতের ভয়ের কারণে হয়ে দাঁড়াতে পারবে না। ভারত একটি দুর্বল পাকিস্তান চায়। বিনা যুদ্ধে যদি সে উদ্দেশ্য পূরণ হয়, যুদ্ধ করার প্রয়োজনীয়তা তিনি খুঁজে পান না। তারপরেও শ্রীমতী গান্ধীর মনে একটি প্রবল আকাঙ্ক্ষা রয়েছে। আশি লক্ষ হিন্দু পাকিস্তানী সৈন্যের বর্বর আক্রমণের মুখে সব খুইয়ে প্রাণমাত্র সম্বল করে ভারতে পালিয়ে এসেছে, তারা নিরাপদে বসবাস করার নিশ্চিত নিরাপত্তা না পেলে কি পূর্বপাকিস্তানে ফেরত যেতে চাইবে? যে কোনো রাজনৈতিক সমাধান তাদের নিরাপদে দেশে ফেরার পরিপূর্ণ নিশ্চয়তা কি দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে তারা ভারতের মাটি থেকে কোনোক্রমেই দেশে ফিরতে চাইবে না। ভারত জোর করে তো হিন্দুদের ঠেলে দেশে পাঠাতে পারবে না। শ্রীমতি গান্ধী চোখ বুজলেই দেখতে পান একটি যুদ্ধ তার ঘাড়ে এসে পড়েছে। এই যুদ্ধ এড়িয়ে যাওয়ার যতো বিপদ সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার বিপদ তার চাইতে অনেক কম। তিনি অনুভব করছিলেন, বল এখন ইয়াহিয়া খানের কোর্টে। ইয়াহিয়া খানের মাথায় যদি সুবুদ্ধির উদয় হয়, তাহলে হয়তো যুদ্ধে জড়িয়ে যাওয়া সম্ভব। তাছাড়া আর কোনো বিকল্প তো তিনি দেখেন না।
ইসলামাবাদে বসে ইয়াহিয়া খান হুইস্কির গেলাসে চুমুক দিতে দিতে সম্পূর্ণ ভিন্নরকম চিন্তা করছিলেন। কার্যকারণ সবকিছু মিলিয়ে পরিচ্ছন্নভাবে চিন্তা করার ক্ষমতা তার নেই। কেনোনা তিনি সব সময় মদের নেশায় বিভোর থাকেন। সুন্দরী নারী এবং নর্তকি গায়িকা ছাড়া আর কারো কাছে স্বচ্ছন্দ হওয়ার ক্ষমতা তিনি ক্রমাগত হারিয়ে ফেলছেন। যেটুকু চিন্তা করার ক্ষমতা এখনো অবশিষ্ট আছে, তাই দিয়ে মনে করেন তিনি একটা মরদের মতো কাজ করে ফেলেছেন। এ পর্যন্ত পাকিস্তানের কোনো রাষ্ট্রপ্রধান যে কাজটি করতে পারেননি তিনি একাই সে কাজটি করে ফেলতে পেরেছেন। পূর্বপাকিস্তানের সমস্যার এমন সরল সমাধানের কথা পূর্ববর্তী কোনো রাষ্ট্রপ্রধান চিন্তা পর্যন্ত করতে পারেননি। যেহেতু পূর্বপাকিস্তানে এক কোটিরও বেশি হিন্দু বসবাস করে, সেটাই পূর্বপাকিস্তানের আসল সমস্যা। এই হিন্দুদের প্ররোচনাতেই বিচ্ছিন্নতাবাদ সেখানে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পেরেছে। অস্ত্রের মুখে তাদেরকে ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করে ভারতে ঠেলে দিয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদের মূল তিনি চিরদিনের মতো উৎপাটন করে ফেলেছেন। হিন্দুরা যখন নেই, আস্তে আস্তে পূর্ব পাকিস্তানের ইসলামী পরিবেশ ফিরে আসবে। তিনি মনে করেন আরো একটি গ্রন্থিল এবং জটিল সমস্যার সমাধান তিনি প্রায় করে এনেছেন। পূর্বপাকিস্তানের মানুষ সব সময় আন্দোলন করে, কারণ সেখানে অনেক মানুষ। এক চিলতে একটু মাটি। সেখানে বসবাস করে কোটি কোটি মানুষ, পিঁপড়ের মতো পিলপিল করছে মানুষের সারি। প্রায় এক কোটি মানুষকে তিনি অস্ত্রের মুখে সরিয়ে দিতে পেরেছেন। এই এক কোটি মানুষের বাড়িঘর, জমিজমা, ব্যবসাবাণিজ্য সব অন্যদের দখলে চলে যাবে। তাদের গায়ে গতরে একটু হাওয়া লাগবে। তারা হাত পা ছড়িয়ে বসতে পারবে। এই বাড়তি জমি বাড়ি ঘর পাওয়ার পর তাদের অসন্তোষ অনেক কমে আসবে। পূর্ববর্তী প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের প্রতি তার মায়া হয়। তিনি মিছামিছি উনিশশো পঁয়ষট্টি সালে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। হাতের কাছে এমন সহজ সমাধান থাকা সত্ত্বেও আয়ুব খান সাহেব কেননা যে পূর্বপাকিস্তানকে বাগে আনতে পারলেন না, তিনি বুঝতে পারেন না। মদের গেলাসে চুমুক দিতে দিতে ভাবেন, কি বোকাই না ছিলেন আয়ুব খান। অথচ কতো সহজে সব সঙ্কটের সমাধান প্রায় করে এনেছেন।
ইয়াহিয়া খান মাতাল হলেও তার হিসেব খুবই পরিষ্কার। শেখ মুজিবুর রহমানকে তিনি কারাগারে পুরেছেন। থাকুক আরো কিছুদিন। পরে অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা করা যাবে। যদি ইয়াহিয়া খানের কথা মানতে রাজি হন, ছেড়ে দেবেন। আর যদি বেঁকে বসেন দেশদ্রোহী হিসেবে ফাঁসিতে লটকে দেবেন। আওয়ামী লীগের যে অংশটা দেশের মধ্যে আছে, তার একটা অংশকে খুন করা হয়েছে, একটা অংশকে জেলে পোরা হয়েছে এবং আর একটা অংশকে একেবারে সরাসরি তাবেদারে পরিণত করা হয়েছে। সুতরাং দল হিসেবে পূর্বপাকিস্তানে আওয়ামী লীগের আর মাথা তুলে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই। তাছাড়া আওয়ামী লীগের কাছে যে সমস্ত দল সত্তরের নির্বাচনে পরাজিত হয়েছিলো তাদের সবাইকে সাহস দিয়ে তিনি চাঙ্গা করে তুলেছেন। জামাতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, পিডিপি সমস্ত দক্ষিণপন্থী দল পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নামে উঠে পড়ে লেগেছে। শিগগির আওয়ামী লীগের নির্বাচিত নেতারা ভারতে চলে যাওয়ার পর যে রাজনৈতিক শূণ্যতার সৃষ্টি হয়েছে, তা তারা পূরণ করতে পারবে। তাছাড়া পৃথিবীর মানুষকে দেখাবার জন্য পূর্বপাকিস্তানে একটা সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান তিনি করেছেন।
এই নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই পৃথিবীর মানুষের কাছে সাক্ষ্য দিয়েছে ইয়াহিয়া খান সাহেব দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করার স্বার্থে পূর্বপাকিস্তানে সামরিক হস্তক্ষেপ করে পাকিস্তানকে উদ্ধার করেছেন। সামরিক এক নায়ক হিসেবে কেউ তাঁকে দুষতে পারবে না। নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই বললেন, পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার স্বার্থে ইয়াহিয়া খান সামরিক বাহিনীকে মোতায়েন করেছেন। পূর্বপাকিস্তান থেকে সামরিক বাহিনী উঠিয়ে নিলে ভারত থেকে আগত দুষ্কৃতকারীদের হাত থেকে জনগণের জানমাল রক্ষা করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
ইয়াহিয়া খান গ্লাসের পর গ্লাস শ্যাম্পেন খালি করেন। আর ভাবছেন, তাঁর মতো সুদক্ষ জেনারেল এবং প্রতিভাবান নেতা পৃথিবীতে বেশি নেই। তার যোগ্যতার প্রমাণ, তিনি বোতলের পর বোতল নিঃশেষ করে ফেলতে পারেন। তাঁর সমস্ত জাগতিক বিষয়ে সংজ্ঞা লোপ হওয়ার পরেও একটা জিনিস মনের মধ্যে ধ্রুবতারার মতো জ্বলতে থাকে। ভারত যে সকল তথাকথিত মুক্তিযোদ্ধা পূর্বপাকিস্তানের দেশ প্রেমিকদের বাড়ি ঘরে গ্রেনেড ছুঁড়ছে, ব্রিজ, কালভার্ট ধ্বংস করছে, পাওয়ার স্টেশন উড়িয়ে দিচ্ছে, তাদেরকে শায়েস্তা করার জন্য তিনি পূর্বপাকিস্তানের দেশপ্রেমিক যুবকদের নিয়ে রাজাকার, আলবদর এবং আল শামস বাহিনী গঠন করেছেন। তারা এখন পূর্বপাকিস্তানের সর্বত্র মাঠে নেমেছে এবং পাহারা দিচ্ছে। ভারত যতো ইচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা পাঠাতে থাকুক, জান নিয়ে কেউ ফেরত যেতে পারবে না।
হ্যাঁ, পৃথিবীর পত্রপত্রিকা, টেলিভিশন, রেডিওতে বিপুল পরিমাণ পূর্বপাকিস্তানীদের ভারতে পালিয়ে যাবার কথা বলছে। এক কোটির মতো মানুষ গেছে। সুতরাং এই ধরনের কিছু কথা তো উঠবেই। কিন্তু ভারতে কারা গিয়েছে। সেটা তো দেখতে হবে। ভারতে যারা চলে গেছে, তাদের তো শতকরা পঁচাশি ভাগ হিন্দু। হিন্দুদের ভারত ডেকে নিয়ে গেছে। কেনোনা এই হিন্দুদের ডেকে নিয়ে ভারত পাকিস্তানের অখণ্ডতা ধ্বংস করতে চায়। বাকি পনেরো ভাগ মুসলমান যারা ভারতে গিয়েছে, তাদের অধিকাংশই ভারতের অনুচর। আর কিছু সংখ্যক বিপথগামী। তথাপি পৃথিবীর মানুষ যদি বলে ইয়াহিয়া খান পূর্বপাকিস্তান থেকে ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী শরণার্থীদের ফিরিয়ে নিক। ইয়াহিয়া খান বললেন, তারা ফিরে আসুক, যাদের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কাজের কোনো প্রমাণ নেই তিনি তাদের ক্ষমা করে দেবেন। কোনো ভয় নেই, শরণার্থীরা তাদের বাড়িঘরে ফিরে আসুক। ইয়াহিয়া খান সীমান্তের চৌকিগুলোর কাছাকাছি তাদের ফিরিয়ে নেয়ার জন্য অভ্যর্থনা কেন্দ্র খুলবেন। তিনি জানেন, হিন্দুরা ফিরবে না। আর মুসলমান যারা গিয়েছে যদি ফিরে আসে খান সাহেবের তো আরো সুবিধে। তিনি পৃথিবীর মানুষদের সামনে দেখাতে পারবেন পূর্বপাকিস্তানের হিন্দু এবং ভারত সরকার মিলে পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব ভাঙার জন্য আদাজল খেয়ে লেগেছে। অন্যরা আসুক না আসুক কিছু যায় আসে না। কিন্তু হিন্দুরা যে ফিরে আসবে না এ ব্যাপারে ইয়াহিয়া খান সুনিশ্চিত। তিনি নতুন বোতলের সুরা গলধঃকরণ করতে করতে ভাবেন এক ঢিলে তিন পাখি মেরে ফেলেছি। আমি আশি লাখ হিন্দুকে ভারতের ওপর চাপিয়ে দিতে পেরেছি। তিনি ভাবেন আয়ুব খানের মাথায় এ বুদ্ধি আসেনি কেনো। পূর্বপাকিস্তানের হিন্দু না থাকলে আর কখনো বিচ্ছিন্নতাবাদ মাথাচাড়া দেবে না। ভারত সব সময়ে পাকিস্তানকে দুর্বল করতে চেয়েছে। তার বদলে ইয়াহিয়া ভারতের ঘাড়ে এমন এক জনসংখ্যার বোঝা চাপিয়ে দিতে যাচ্ছেন, সে অর্থনৈতিকভাবে আর কখনো মাথা সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না। মাঝে মাঝে তিনি অট্টহাস্যে ফেটে পড়েন। আর ভারত যদি যুদ্ধ করে সেখানেই তো আসল মজা। পাকিস্তানের বন্ধু আমেরিকা আছে, চীন আছে। তারা মদদ দিতে ছুটে আসবে। তবে ভারতের সঙ্গে সোভিয়েত রাশিয়ার খুব দহরম মহরম চলছে। ভাবে গতিতে মনে হচ্ছে যদি যুদ্ধ লাগে রাশিয়া ভারতকে সমর্থন করবে। তা করুক। পূর্বপাকিস্তানের ব্যাপার নিয়ে দুনিয়ার বড়ো বড়ো দেশগুলো একটা বিশ্বব্যাপী তৃতীয় মহাযুদ্ধ স্বেচ্ছায় মাথায় তুলে নেবে ইয়াহিয়া খান সাহেব সে কথা বিশ্বাস করতে চান না। ভারত পাকিস্তানে একটি যুদ্ধ যদি লেগেই যায় বৃহৎ শক্তিগুলোর চাপে অল্পদিনের মধ্যেই থামিয়ে ফেলতে হবে। সে যুদ্ধে পাকিস্তান যদি বিশেষ সুবিধে করতে নাও পারে ইয়াহিয়া খান সাহেবের বিশেষ দুশ্চিন্তা নেই। তখন তিনি ভারতের সঙ্গে অস্ত্রবিরতি করবেন। মধ্যস্থতা করতে আমেরিকা ছুটে আসবে। তথাকথিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নটির কোনো গুরুত্বই থাকবে না। বাংলাদেশ বলে কিছু আছে নাকি? গোটা ব্যাপারটাই ঘটছে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে। মাঝখান থেকে বাংলাদেশের প্রশ্ন উঠবে কেমন করে? ভারত পূর্বপাকিস্তান থেকে যে সকল হিন্দুকে দেশের অখণ্ডতা ধ্বংস করার জন্য তার ভূখণ্ডে ডেকে নিয়েছে পাকিস্তান কস্মিনকালেও তাদের আর ফেরত নেবে না। আর যে সকল মুসলমান চলে গিয়েছে, তারা যদি ফিরে আসতে চায় আসুক। ইয়াহিয়া খান সাহেব তাঁদের কথাটা ভেবে দেখবেন। তিনি গ্লোসে চুমুক দিচ্ছেন আর মাঝে মাঝে অট্টহাস্য করে উঠছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, হ্যাঁ সেই মেয়ে মানুষটি। আমাকে ল্যাং মারতে চায়? তার লড়াই করার খায়েশ হয়েছে? আচ্ছা ঠিক হ্যায়, নজদিগ মে এক জঙ আগ্যায়া। ময়দান মে মোলাকাত হোগা।
মাঝখানে পরিস্থিতি একেবারে থিতিয়ে গিয়েছিলো। মনে হচ্ছিলো বাংলাদেশ নিয়ে কারো মাথা ব্যথা নেই। এভাবেই সব কিছু চলতে থাকবে। যেখানেই যাই, সর্বত্র থমথমে পরিবেশ, কি ঘটবে, কি ঘটতে যাচ্ছে কেউ কিছু বলতে পারে না। বাংলাদেশের মানুষদের মধ্যে যতোই হতাশা বাড়ছে, পারস্পরিক অবিশ্বাস এবং দলাদলি ততোই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ ওর বিরুদ্ধে বলছে, অমুক অমুকের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। কোলকাতার মানুষেরা আমাদের ওপর বিরক্ত হয়ে উঠছে। আর কতত। বাসে, ট্রামে, ট্রেনে, পার্কে, মাঠে, ময়দানে সর্বত্র জয়বাংলার মানুষ দেখে দেখে তাদের চোখ পচে গেছে। আমরা আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে ভীষণ সংকুচিত হয়ে উঠতে আরম্ভ করেছি। মানবিক মর্যাদা বোধটুকুও আস্তে আস্তে আমাদের লোপ পেতে বসেছে। লোহালক্কর ফেলে রাখলে যেমন মরচে ধরে, আমাদের মধ্যেও তেমনি স্তরে স্তরে হতাশা জমে ক্রমাগত অমানুষ হয়ে উঠছি। আমরা বৌ বাজারের হোস্টেলটিতে আট দশজন মানুষ থাকি। যখন এসেছিলাম সকলের মধ্যে প্রাণখোলা সম্পর্ক ছিলো। যতোই দিন যাচ্ছে আমরা আর স্বাভাবিক থাকতে পারছিনে। তুচ্ছ সিগারেট নিয়ে আমাদের মধ্যে ঝগড়া বাধে। বালিশ, বিছানা, মশারি নিয়ে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়। আমরাও দুতিনটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়েছি। আমাদের এসব খুনসুটি দেখে হোস্টেলের ছাত্রেরা হাসে। প্রকাশ্যে খারাপ মন্তব্য করতেও কেউ ছাড়ে না। অথচ আমরা যখন অভুক্ত অবস্থায় মুখে সাত পাঁচ দিনের আকামানো খোঁচা খোঁচা দাড়ি নিয়ে এসেছিলাম, সকলে আমাদের বীরের সম্বর্ধনা দিয়েছিলো, বুকে জড়িয়ে ধরেছিলো। আমাদের শরীরে ময়লা ছিলো, জামা কাপড়ের যা অবস্থা ছিলো বলার মতো নয়। কতো মানুষ যেচে আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে এসেছে, কতো বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে খাইয়েছে। এখন কোলকাতার জল-হাওয়া লেগে আমাদের শরীরে লাবণ্য ফিরে এসেছে। অনেকেই ছিমছাম জামা কাপড় পরি। তথাপি কোলকাতা শহরের মানুষ আমাদের প্লেগের জীবাণুর মতো এড়িয়ে চলে। কোলকাতার জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে, তার জন্য আমরা দায়ী। ট্রাম, বাস, ট্রেনে অস্বাভাবিক ভিড় বাড়ছে, সে জন্যও আমরা দায়ী। পার্ক মাঠ ময়দানের নির্জনতা বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে পড়েছে, সর্বত্র জয়বাংলার মানুষ গিস্ গিস্ করছে। কর্মহীন স্বপ্নহীন উদ্যমহীন অবস্থায় থাকতে থাকতে আমরা একে অন্যের ওপর ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। প্রতি সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে একই লোকের চেহারা দেখে দেখে ক্রমেই বিরক্ত হয়ে উঠেছি। একজনের মনের ময়লা অন্যজনের মনে লেগে লেগে স্রোতহীন বদ্ধকূয়োর পানির মতো আমাদের মনগুলোও দূষিত হয়ে পড়েছে। কোলকাতা শহর যেনো একটা উন্মুক্ত কারাগার। তার ভেতরে আমরা ছেড়ে দেয়া কয়েদির মতো ঘুরে বেড়াচ্ছি। আমরা সকলে কোথায় যাবো, বিকেলে কোথায় কাটাবো, সব একটা ছকের মধ্যে পড়ে যেতে হয়। বাংলাদেশের মানুষ বাংলাদেশের মানুষের কাছে যাবে না তো কোথায় যাবে? যে যেখানেই থাকিনে কেননা, সন্ধ্যেবেলা পানের দোকানের সম্মুখে, ছোটো ছোটো রেস্টুরেন্টের দোরগোড়ায় স্বাধীন বাংলা বেতারে এম. আর, আখতার মুকুলের চরমপত্র পাঠ শোনার জন্য দাঁড়িয়ে যাই। কোলকাতার মানুষ, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় কিংবা নবদ্বীপ হালদারের কমিক শুনে যে রকম মজা পায়, এম. আর. আখতার মুকুলের গলার আওয়াজ, বাঙ্গাল ভাষার রসিকতা, কথা বলার ভঙ্গি সব কিছু তেমনি উপভোগ করে। কিন্তু আমাদের কাছে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের এম, আর. আখতার মুকুলের চরমপত্রের আবেদন ভিন্ন রকম। বাংলাদেশের ব্যাপারে সকলের উদাসীনতা চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে পৌঁছেছে। তথাপি এম. আর. আখতার মুকুল যখন স্বাধীনবাংলা বেতারের অনুষ্ঠানে চরমপত্র পাঠ করেন তখন দোকানের সামনে আস্তে আস্তে লোক জমতে থাকে, তখন দোকানীর আওয়াজটা বাড়িয়ে না দিয়ে উপায় থাকে না। লোকজন এম. আর. আখতার মুকুলের কড়া রসিকতা চিবিয়ে চিবিয়ে উপভোগ করে। এম. আর. আখতার মুকুল ট্যাঙ্ক ধ্বংস করছেন, গানবোট ডোবাচ্ছেন, সৈন্যভর্তি ট্রেনসহ ব্রীজ উড়িয়ে দিচ্ছেন, সেনা ছাউনিতে ছাউনিতে ত্রাসের সঞ্চার করছেন। এ পর্যন্ত তিনি যতো পাকিস্তানী সৈন্য খুন করেছেন, যতো জখম করেছেন, যতো ট্যাঙ্ক অচল করেছেন, যতো কনভয় ধ্বংস করেছেন সব মিলিয়ে যোগ করলে যে সংখ্যাটা দাঁড়াবে, তাতে করে একজনও পাকিস্তানী সৈন্য বাংলার মাটিতে থাকার কথা নয়। তার পরদিন সন্ধ্যেবেলা আবার সৈন্য মারতে আসেন। আমরা অবাক হয়ে ভাবি এতো সৈন্য তিনি কোথায় পান। আমরা জানতাম, এম. আর. আখতার সাহেব যা বলছেন, তার দু শতাংশও যদি সত্য হতো, তাহলেও আমাদের যুদ্ধের পরিস্থিতি এরকম হওয়ার কথা নয়। সব মিথ্যে জেনেও আমরা পরের দিনের চরমপত্র পাঠ শোনার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। আর কোথাও তো কেউ কিছু করতে পারছে না। অন্ততঃ একজন মানুষ আছেন, যিনি কল্পনায় পাকিস্তানী সৈন্য হত্যা করতে পারেন, ট্যাঙ্ক উড়িয়ে দিতে পারেন, বাক্যের মন্ত্রশক্তিতে বাংলার সপক্ষে যুদ্ধ করার জন্য খরস্রোতা নদী, সুন্দর বনের বাঘ, বিষাক্ত সাপ, ঝক বাঁধা মশা, ভাটি অঞ্চলের প্যাক কাদা, পশুপক্ষি সবকিছুকে প্রতিরোধ সংগ্রামের ভূমিকায় শরিক করে নিতে পারেন। কার্যক্রম যতোই অপ্রতুল হোক না কেননা, এম. আর. আখতারের কণ্ঠ শুনে মনে একটা বিশ্বাস ঘনিয়ে উঠতো। আমাদের প্রকৃতি, আমাদের নদী, আমাদের বনাঞ্চল, আমাদের বাঘ, সাপ, আমাদের প্যাক কাদা পাকিস্তানী সৈন্য ধ্বংস করার অলৌকিক ক্ষমতা রাখে। কোথাও যখন কিছু ঘটছে না, কেউ কিছু করছে না। আমরা এম. আর. আখতার মুকুলের ওপর ভরসা ছাড়তাম না। আগামীকাল তিনি নতুন আক্রমণ এবং নতুন বিজয়ের কথা শোনাবেন। ডুবন্ত মানুষ তো প্রাণপণ শক্তিতে ভাসমান তৃণখণ্ডকে আঁকড়ে ধরে।
হঠাৎ করে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের মধ্যে একটা গতির সঞ্চার হলো। কথাটা বোধ হয় সঠিক বললাম না। ভারত পাকিস্তান সম্পর্কের একটা নতুন মোড় নিলো। ভারতের দূত ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া ইত্যাদি দেশে ছুটাছুটি করতে আরম্ভ করলো। পাকিস্তানও বসে নেই। ইয়াহিয়ার প্রতিনিধি ইউরোপীয় দেশগুলোতে টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে এবং পাকিস্তানের অবস্থান সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী প্রধানমন্ত্রী, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী পরিষদের সদস্যবৃন্দ নয়াদিল্লীতে ঘন ঘন যাওয়া আসা করছেন। বৈঠক করছেন। পত্রপত্রিকায় সে সকল সংবাদ ছাপা হচ্ছে। শেষ পর্যন্ত ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বোধ করি মনস্থির করে ফেলেছেন, তাকে একটা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে। তার কথাবার্তা, বিবৃতি ভাষণের মধ্যে একটা উদ্দেশ্য পরিষ্কার ফুটে উঠছে। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের বেগও তীব্র হয়ে উঠেছে। কোলকাতার পত্রপত্রিকাগুলো খবর দিতে আরম্ভ করেছে, মুক্তিযোদ্ধারা ভারী অস্ত্রশস্ত্র ব্যবহার করতে আরম্ভ করেছে। পাউরুটির ভেতর ছুরির মতো পাকিস্তানী সৈন্যের বেষ্টনী ভেদ করে তারা দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েছে। পাকিস্তান রেডিও একথা স্বীকার করে নিয়েছে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর জওয়ানরা ছদ্মবেশে পূর্বপাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করে নাশকতামূলক কাজকর্ম করে পালিয়ে যাচ্ছে। বিবিসি এবং ভয়েস অব আমেরিকাও বলতে আরম্ভ করেছে, মুক্তিযোদ্ধারা সত্যি সত্যি দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে এখানে সেখানে অপারেশন চালিয়ে যাচ্ছে। আইয়ুব খানের সময়ের গভর্ণর আবদুল মোনায়েম খানকে মুক্তিযোদ্ধারা বাড়িতে ঢুকে গ্রেনেড ছুঁড়ে হত্যা করেছে। ভেড়ামারা, কুষ্টিয়া, রংপুর, টাঙ্গাইল, খুলনা, বরিশাল এসকল অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধ সংগ্রাম তীব্রতরো হয়ে উঠেছে। টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকীর বাহিনীর ঝটিকা আক্রমণের মুখে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী পিছু হটে এসেছে। বিবিসি-র সংবাদদাতা আরো খবর দিয়েছে পাকিস্তানী সৈন্য ভর্তি লরীগুলো দিনে রাতে সীমান্ত অভিমুখে ছুটছে। সৈন্যরা সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় বাঙ্কার নির্মাণ করছে এবং ট্র্যান্স কাটছে।
এরই মধ্যে একদিন শ্রীমতী গান্ধী সোভিয়েত রাশিয়া সফরে গেলেন। ভারত এবং রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা অনেক বেড়ে গেছে সেটা আগে থেকেই বোঝা যাচ্ছিলো। রাশিয়ার কথাবার্তার মধ্যেও ভিন্ন একটা সুর লক্ষ্য করা যাচ্ছিলো। বাংলাদেশের ব্যাপারে রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন এবং প্রেসিডেন্ট পদগর্নি সব সময়ে ইয়াহিয়া খানকে একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করার অনুরোধ করে আসছিলেন। কিন্তু শ্ৰীমতী গান্ধীর রাশিয়া সফরের পর থেকে রাশিয়ান নেতাদের বক্তব্যের ধরণও বেশ পাল্টে গেলো। ভারত এবং রাশিয়ার মধ্যে একটা বন্ধুত্ব চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়ে গেছে। দুই দেশের যে যুক্ত ইস্তেহার প্রকাশিত হয়েছে তাতে প্রথমবারের মতো পূর্বপাকিস্তানের বদলে পূর্ববাংলা শব্দটি ব্যবহৃত হয়েছে।
রাশিয়া থেকে শ্রীমতী গান্ধী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে গেলেন। যুক্তরাষ্ট্রে নিক্সনের সঙ্গে দেখা করলেন, বিশেষ সুবিধে করতে পেরেছেন বলে মনে হলো না। নিক্সন প্রশাসনের কাছ থেকে কোনো রকম ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে শ্রীমতী গান্ধী মার্কিন জনমতকে প্রভাবিত করতে চেষ্টা করলেন। নানা জায়গায় বক্তৃতা দিলেন। পত্রপত্রিকায় সাক্ষাৎকার দিলেন। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে এসে তিনি পশ্চিম জার্মানি সফর করলেন। তারপর ফ্রান্স এবং সবশেষে ইংল্যাণ্ড। রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্ব চুক্তির পরও শ্রীমতী পশ্চিম ইউরোপ এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গেলেন কেন বুদ্ধিমান মানুষের কাছে তার কারণ অস্পষ্ট রইলো না। ভারত সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি করে পশ্চিমা দেশগুলোর স্বার্থের পরিপন্থী কোনো কিছু করতে যাচ্ছেন না সে আশ্বাসটা ওসকল দেশের সরকার এবং জনগণের সামনে তুলে ধরাই ছিলো তার উদ্দেশ্য।
পাকিস্তানও বসে নেই। ইয়াহিয়া খান চীন মার্কিন সম্পর্ক পুনঃস্থাপনে দূতিয়ালী করছেন। পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে হেনরী কিসিঞ্জার গোপনে উড়ে বেইজিং-এ পৌঁছেছেন। সেখানে চৌ এন লাই এবং মাও সেতুংয়ের সঙ্গে চীন-মার্কিন সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের বিষয়টি পাকাপাকি করে ফেলেছেন। ইয়াহিয়া খান ধরে নিয়েছেন চীন মার্কিন সম্পর্কোন্নয়নে ইয়াহিয়া খান যেহেতু মধ্যস্থের ভূমিকা পালন করেছেন, তাই পাকিস্তানের বিপদের দিনে চীন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করবে না। মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং পররাষ্ট্র সচিব হেনরী কিসিঞ্জার বরাবর পাকিস্তানী অবস্থানের পক্ষেই কথা বলে আসছিলেন। আর চীন তো খোলাখুলি ভারতকে আক্রমণকারী শক্তি হিসেবে চিহ্নিত করে অনেকদিন থেকেই ধমক দিয়ে আসছে। তবে একটা মজার ব্যাপার চীনা ড্রাগন শুধু লম্ফ ঝম্ফ করে, গর্জন করে, কিন্তু সরাসরি কামড় দিতে ছুটে আসে না।
ইয়াহিয়া খান জুলফিকার আলী খান ভূট্টো সাহেবের নেতৃত্বে চীনে একটি প্রতিনিধি দল পাঠিয়েছেন। চীনা নেতারা ভোজসভায় অনেক ভালো ভালো কথা বলেছেন। খোদ চৌ এন লাই আশ্বাস দিয়েছেন পাকিস্তান যদি ভারত কর্তৃক আক্রান্ত হয় চীন পাশে এসে দাঁড়াবে। ভূট্টো সাহেব দেশে ফিরে এসে সাংবাদিকদের বলেছেন তাঁর চীন সফর শতকরা একশো ভাগ ফলপ্রসু হয়েছে।
ভারত পাকিস্তানে সাজো সাজো রব চলছে। বাংলাদেশ ভারতের নৌকোয় পা রেখেছে। সুতরাং ভারত যা করে বাংলাদেশকে অম্লানবদনে মেনে নিতে হবে। তারপরেও ভারতের প্রতি আমাদের কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। বাঙালি জাতির স্বাধীনতার জন্য, বাংলাদেশের জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ভারত একটি যুদ্ধ। ঘাড়ে তুলে নিচ্ছে। ভারতের স্বার্থ থাকে থাকুক। কিন্তু আমরা আমাদের দেশে ফিরে যেতে চাই এবং মাতৃভূমিকে স্বাধীন দেখতে চাই। তারপরেও একটা প্রশ্ন যখন মন কুঁড়ে জেগে উঠে, নিজের কাছেই নিজে বেসামাল হয়ে পড়ি। বাংলাদেশ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উনিশশো আটচল্লিশ থেকেই সগ্রাম করে আসছে। আসন্ন ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধটিই কি বাঙালি জাতির বিগত বাইশ বছরের রক্তাক্ত সংগ্রামের একমাত্র ফলাফল। এই যুদ্ধে হয়তো ভারত জয়লাভ করবে এবং ভারতের সহযোগিতায় আমরা স্বাধীনতা অর্জন করতে সক্ষম হবো। আমাদের জাতীয় সংগ্রামের এই পরিণতি। এটাই কি আমরা চেয়েছিলাম? কি জানি, ইতিহাস কোন্ দিকে মোড় নিচ্ছে। আমাদের বাবারা পাকিস্তান তৈরি করেছিলেন, আর আমরা পাকিস্তান ভাঙছি। এই যুদ্ধ সংঘাত রক্তপাতের মধ্য দিয়ে আমাদের জাতীয় ইতিহাস কোন্ ভবিষ্যতের পানে পাড়ি দিচ্ছে? কে জানে!