1 of 2

১১. হেনা দু’বার ডাকতেই মামুন

হেনা দু’বার ডাকতেই মামুন ধড়ফড় করে উঠে বসে ভয় পাওয়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কী? কী হইছে? কয়টা বাজে? দেরি হইয়া গেল, অ্যাঁ?

হেনা বললো, সাড়ে চারটা! আপনে বলেছিলেন ঠিক সাড়ে চারটায় ডেকে দিতে। মামুন কিছুটা আশ্বস্ত হয়ে ঘড়ি দেখলেন। জানলার বাইরে মিসমিস করছে অন্ধকার। ঘরে জ্বলছে টিউব লাইট। হেনার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে মঞ্জু, তার হাতে চায়ের কাপ। মামুন একটু লজ্জা পেলেন, মেয়ে দুটো এত আগেই উঠে পড়েছে, অথচ তাঁর ঘুম ভাঙেনি। কী যেন একটা লম্বা স্বপ্ন দেখছিলেন তিনি, এখন আর মনে পড়ছে না।

বাসি মুখেই চা খাওয়া তাঁর অভ্যেস, মঞ্জুর হাত থেকে কাপটা নিয়ে জোরে জোরে চুমুক দিতে লাগলেন। মঞ্জু জিজ্ঞেস করলো, আরও চা আছে, দেবো?

মামুন বললেন, দে, দে, জলদি দে। কলে পানি এসেছে কিনা দ্যাখ তো।

হেনা বললো, আমি রাত্তিরেই বালতিতে পানি ভরে রেখেছি।

দ্রুত চা শেষ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে মামুন চলে গেলেন গোসল করতে।

হোটেল ছেড়ে মাত্র তিন দিন আগে বেকবাগানে এই বাড়িতে চলে এসেছেন মামুন। একটা বড় সড় ঘরের ভাড়া দুশো পঁচিশ টাকা। তবু হোটেলের চেয়ে অনেক ভালো, সঙ্গে রান্না ঘর আছে, ইচ্ছে মতন বেঁধে খাওয়া যায়। কলকাতায় পৌঁছে মামুন প্রথম দিন টাকা ভাঙিয়ে একশো টাকায় অষ্টাশী ভারতীয় টাকা পেয়েছিলেন, গতকাল পেয়েছেন এক শো টাকায় পঁচাত্তর টাকা, হু হু করে পাকিস্তানী টাকার দাম কমে যাচ্ছে। আর দু’ চারদিন বাদে কেউ পাকিস্তানী টাকা ছোঁবেই না বোধহয় এই বাংলায়। মামুন সব টাকা ভাঙিয়ে নিয়েছেন, তবে তা নিঃশেষ হতে বেশীদিন লাগবে না। এর পর গয়না বিক্রি করতে হবে। মামুন খোঁজ নিয়েছেন, ইণ্ডিয়ায় এখন সোনার ভরি একশো ঊননব্বই টাকা। সামান্য যা গয়না আছে, তাও ফুরিয়ে যাবার পর কী হবে? কতদিন এরকম উদ্বাস্তু হয়ে থাকতে হবে তার কোনো ঠিক নেই। একমাত্র ভরসা, এখানকার খবরের কাগজে তাঁর প্রথম রচনাটি ছাপা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই হাতে হাতে দেড় শো টাকা পেয়েছেন। মাসে অন্তত চার পাঁচটি লেখা প্রকাশিত হলে কোনো ক্রমে চলে যাবে।

বাথরুম থেকে বেরিয়েই মামুন দেখলেন, হেনা ততক্ষণে তাঁর জন্য টোস্ট আর ওমলেট বানিয়ে ফেলেছে। মামুন বললেন,আরে, এসব আবার করেছিস কেন? এত সকালে কি আমি কিছু খেতে পারি?

মঞ্জু বললো, তা বলে খালি পেটে যাবে নাকি? না, খেয়ে নাও। কতক্ষণ লাগবে আর একটু চা করে দেবো।

হঠাৎ মামুন ফজরের নামাজে বসে গেলেন। নিয়মিত নামাজ আদায় করার অভ্যেস তাঁর নেই। মনের মধ্যে তেমন কোনো ধর্মীয় টান তিনি অনুভব করেন না এই বয়েসেও। তবু আজ একটি বিশেষ দিন। কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ ধ্যানে মনের জোর বাড়ে। তাঁকে নামাজ পড়তে দেখলে মঞ্জু আর হেনাও কিছুটা ভরসা পাবে।

কিন্তু ফল হলো বিপরীত। মঞ্জু আর হেনার মুখে আরও ঘনিয়ে এলো শঙ্কা। এতদিন পর মামুনকে নামাজ পড়তে দেখে আজকের ঘটনার গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেল তাদের কাছে। মামুন শেষ করতেই মঞ্জু উদ্বিগ্ন গলায় বললো, মামুন মামা, তোমার না গেলে হয় না?

হেনা তাঁর হাত চেপে ধরে বললো, বাবা, তুমি যেও না। আমরা একলা থাকতে পারবো না।

মামুন হেসে বললেন, আরে, এত ভয় পাচ্ছিস কেন? আমি কি একলা যাচ্ছি নাকি, আরও অনেকে যাচ্ছে, চিন্তা করিস না, আমি সন্ধ্যার আগেই ফিরে আসবো।

মঞ্জু আর হেনা দু’ দিক থেকে তাঁকে চেপে ধরে বলতে লাগলো, না, যেতে হবে না। আজ থাক না, পরে একদিন যেও।

মামুন অনেক কষ্টে তাদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে কুত-পাজামা পরে নিলেন। মনের মধ্যে একটা উত্তেজনা ধক ধক করছে। যেতে তাঁকে হবেই। একটা ঐতিহাসিক ঘটনার তিনি সাক্ষী থাকতে চান।

পাশের ঘরে ঘুমিয়ে আছে সুখু, মামুন তার ললাট চুম্বন করলেন। মঞ্জু আর হেনার কাঁধে হাত দিয়ে বললেন, খুব সাবধানে থাকবি, ঘর থিকা এক পা বাইড়াবি না। কারুরে দরোজা খুলবি না। আমি আসি।

মঞ্জু মামুনের পা ছুঁয়ে কদমবুসি করতে গিয়ে কেঁদেই ফেললো। মামুন তাকে তুলে দাঁড় করিয়ে আঙুল দিয়ে চোখের জল মুছে দিয়ে বললেন, কী পাগল। দ্যাখ তো হেনা শক্ত আছে। আমি ফিরে আসি, কাল তোদর মেট্রোতে সিনেমা দেখাতে নিয়ে যাবো। তোরা দোয়া কর, সারাদিন বাংলাদেশের নামে দোয়া কর।

রাস্তায় বেরিয়ে মামুন দেখলেন অন্ধকার সামান্য ফিকে হয়ে এসেছে। এর মধ্যেই কিছু কিছু মানুষ বেরিয়ে পড়েছে পথে। চলতে শুরু করেছে ট্রাম। মামুনের মনে পড়লো, ছাত্র বয়েসে কলকাতায় থাকার সময় তিনি দেখতেন, অনেক হিন্দু ভদ্রলোক ভোরবেলার প্রথম ট্রামে চেপে গঙ্গা স্নান করতে যেতেন। এখনো কি লোকেরা সেই রকম গঙ্গা স্নান করতে যায়? এত ভোরেও ট্রামে যাত্রীর সংখ্যা কম নয়। দু তিনটে ট্যাক্সিও দাঁড়িয়ে আছে বেকবাগানের মোড়ে। ঢাকার তুলনায় কলকাতা অনেক বড় মেট্রোপলিস, এখানে ভালো করে আলো ফোঁটার আগেই যানবাহন পাওয়া যায়। ট্যাক্সিগুলো বোধহয় সারা রাতই চলে।

মামুন ট্যাক্সি নেবার বদলে ট্রামে চেপে বসলেন। হাতে এখনও কিছুটা সময় আছে, বেশি পয়সা খরচ করার তো দরকার নেই। ভোরের ট্রাম অনবরত ঠং ঠং শব্দ করে চলে। সেই শব্দে মনে পড়ে যায় ছাত্র বয়েসের স্মৃতি।

ধর্মতলার মোড়ে ট্রাম থেকে নেমে মামুন ঘড়ি দেখলেন। পৌনে ছ’টা। এর মধ্যেই খবরের কাগজের হকারদের দৌড়োদৗড়ি শুরু হয়ে গেছে। ছড়ি হাতে বয়স্ক লোকেরা বেরিয়েছে। প্রাতঃভ্রমণে। এককালে কার্জন পার্কটা কত সুন্দর ছিল, কত ফুল ফুটতো এখানে, এখন চেনাই যায় না। মনুমেন্টটাকে আগে আরও উঁচু মনে হতো না? ছোট হয়ে গেল নাকি?

কলকাতার ময়দানের মতন এতবড় ময়দান ঢাকাতে নেই। কেউ কেউ বলে বিলেতের হাইড পার্কও নাকি এত বড় নয়। রেড রোডের ধারে সার সার কৃষ্ণচূড়া ফুল ফুটেছে। রেড রোড নামটা সার্থক। এই রাস্তাটা আগের মতনই আছে। মামুনের মনে পড়লো, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় এই রাস্তায় মিত্র বাহিনীর প্লেন নামতো।

কয়েকজন স্বাস্থ্য উদ্ধারকারীকে জিজ্ঞেস করে করে মামুনকে প্রেস ক্লাব খুঁজে বার করতে হলো। ঢাকার তুলনায় কলকাতার প্রেস ক্লাব যে এত ছোট হবে তা মামুনের ধারণা ছিল না। ঢাকার প্রেস ক্লাবের দোতলা বাড়ি, আর এখানে সামান্য একটা তাঁবু। ময়দানে খেলার ক্লাবগুলির অনেক তাঁবু আছে, তারই মধ্যে একটা এই প্রেস ক্লাব। কলকাতায় এত বড় বড় খবরের কাগজ আছে, কত বিদেশী সাংবাদিক আসে এখানে, অথচ এখানকার প্রেস ক্লাবের এই দশা।

দশ বারোখানা গাড়ি জমা হয়ে গেছে প্রেস ক্লাবের সামনে। অন্তত জনা তিরিশেক দেশী-বিদেশী সাংবাদিক দাঁড়িয়ে আছে রাস্তায়, কিন্তু সবাই নিঃশব্দ। এখনো কেউ জানে না কোথায় যেতে হবে।

মামুন ইউসুফ আলীকে খুঁজে বার করলেন। গত পরশুদিন দৈবাৎ এই ইউসুফের সঙ্গে দেখা হয়ে গিয়েছিল বলেই মামুন আজকের ঘটনাটা জানতে পেরেছেন। এক সময় ইউসুফের সঙ্গে একই ঘরে প্রায় দেড় বছর কাটিয়েছিলেন মামুন, সেই বন্ধুত্বের সুবাদে মামুনের অনুরোধ উপেক্ষা করতে পারেননি ইউসুফ, মামুনকে সঙ্গে নিতে রাজি হয়েছেন। কিন্তু এমনই গোপনীয়তা অবলম্বন করা হয়েছে যে ইউসুফ মামুনকে পর্যন্ত বলেননি আজকের গন্তব্যস্থল। কোথায়।

একটা অ্যাম্বাসেডর গাড়িতে কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিকদের সঙ্গে মামুনকে বসিয়ে দিলেন ইউসুফ আলী। তারপর নিজে একটা জিপে উঠে সকলকে বললেন সেই জিপটাকে অনুসরণ করতে। চাপা উত্তেজনায় তাঁর গলাটা ভাঙা ভাঙা শোনালো।

একটা গাড়ির কনভয় চিত্তরঞ্জন এভিনিউ দিয়ে এগিয়ে, শ্যামবাজার পাঁচ মাথা পার হয়ে যশোর রোডে পড়লো। পার্টিশান হয়ে গেছে চব্বিশ বছর আগে, তবু এই রাস্তার নাম এখনও যশোর রোড। এখানে পথের ধারে বাজার বসে গেছে, লোকজন থলি হাতে বাজার করতে এসেছে, মুটেরা সবজির ঝাঁকা মাথায় নিয়ে ছুটছে, একটা মস্ত বড় ষাঁড়ের পাশে দাঁড়িয়ে খবরের। কাগজ মেলে একসঙ্গে পড়ছে তিনজন লোক, মামুন একজনের মন্তব্যও শুনতে পেলেন, ওরে, ওয়েস্ট ইন্ডিজে গাভাসকর থার্ড সেঞ্চুরি করেছে…। এখানে অন্য যে-কোনো দিনের মতনই একটা দিন, সাধারণ, নিরুপদ্রব জীবন। অথচ এই রাস্তা ধরে সত্তর-আশী মাইল সোজা গেলেই যশোর, সেখানে চলছে নারকীয় তাণ্ডব, মিলিটারির সঙ্গে সাধারণ মানুষের চলছে অসম লড়াই, গ্রামের পর গ্রাম পুড়ছে…।

সেই যশোরেই যাওয়া হবে নাকি?

গাড়িতে অন্য সবাই অপরিচিত, কেউ কোনো কথা বলছে না, নিজে থেকে কারুর সঙ্গে আলাপ জমাবার ইচ্ছেও মামুনের নেই। তিনি জানলা দিয়ে উৎসুক হয়ে তাকিয়ে রইলেন বাইরে। দমদম, মধ্যমগ্রাম, বারাসত, এই সব নামগুলিই মামুনের চেনা, বারাসতে তাঁর এক মামার বাড়ি ছিল, সেখানে একবার এসেছিলেন, থার্টি এইটে, তখন এদিকে এত বাড়ি ঘর ছিল না, শুধু ঝোঁপ জঙ্গল আর চাষের জমি।

গাড়ির কনভয় প্রথম থামলো কৃষ্ণনগরে। এখানে চা খাওয়া হবে। আসল উদ্দেশ্য অবশ্য তা নয়। একটি গাড়ি এগিয়ে গেছে খবর নিতে, সীমান্তের কোন অংশটা নিশ্চিত নিরাপদ। রাস্তার ধারের একটা ছোট দোকান থেকে মাটির ভাঁড়ে চা খাচ্ছে সাংবাদিকরা, কারুর মুখে কোনো প্রশ্ন নেই। সদা-কৌতূহলী সাংবাদিকরাও বাধ্য হয়ে চুপ করে আছে, কারণ আগেই তাদের বলে দেওয়া হয়েছে যে যাত্রা পথে কোনো প্রশ্নের উত্তর দেওয়া হবে না।

পিচের রাস্তা ছেড়ে গাড়িগুলো একসময় চলতে লাগলো কাঁচা রাস্তা দিয়ে। হঠাৎ মামুনের সঙ্গে একটা শিহরন হলো। তবে কি পশ্চিম বাংলার সীমান্ত পার হয়ে ঢুকে পড়া গেছে পূর্ব পাকিস্তানে? না, না, পূর্ব পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশ, এখনো ঠিক মনে থাকে না। দৃশ্যগত কোনো পরিবর্তন নেই, দু পাশে একই রকম গাছপালা, মাটির বাড়ি, একই চেহারার মানুষ। তবে কয়েকটি বাড়ি ভেঙে পড়েছে, কোনো বাড়ির দেয়ালে আগুন লাগার দাগ। এই বাংলাদেশ। মামুন আবার ফিরে এসেছেন তাঁর স্বদেশভূমিতে। তাঁর বুক কাঁপছে।

গাড়িগুলো শেষ পর্যন্ত এসে থামলো একটি বিশাল আমবাগানের মধ্যে। এই গ্রামটির নাম বৈদ্যনাথতলা, জেলা কুষ্টিয়া, মহকুমা মেহেরপুর। কিছু লোক সেখানে দৌড়াদৌড়ি করে চেয়ার সাজাচ্ছে, অধিকাংশই হাতল ভাঙা চেয়ার, কাছাকাছি গ্রামের বাড়িগুলো থেকে জোগাড় করে আনা। জায়গাটিকে ঘিরে রাইফেল আর এল এম জি হাতে পজিশান নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পঁচিশ-তিরিশ জন সৈন্য, তাদের ঠিক মুক্তি বাহিনীর ছেলে বলে মনে হয় না, খুব সম্ভবত প্রাক্তন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের একটি বিদ্রোহী বাহিনী।

মামুন গাড়ি থেকে নেমে এক পাশে দাঁড়াতেই কলকাতার একটি বাংলা কাগজের একজন সাংবাদিক তাঁর সঙ্গে যেচে আলাপ করে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা, এই কুষ্টিয়া আগে নদীয়া জেলার মধ্যে ছিল না?

মামুন মাথা নেড়ে বললেন, জী, হ্যাঁ।

সাংবাদিকটি বললো, আমরা ঐ যে কৃষ্ণনগরের পাশ দিয়ে এলাম, তার কাছেই পলাশী। ঐ পলাশীর আমবাগানে একদিন বাংলার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছিল ব্রিটিশরা। আর আজ সেই জেলারই আর এক আমবাগানে জন্ম নিচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র। তাই না? ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট।

মামুন মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন।

–আপনি কোন কাগজ থেকে কভার করতে এসেছেন?

–আমি রিপোটিং করতে আসিনি। আমি এই বাংলারই মানুষ।

–আপনি আওয়ামী লীগের নেতা? আচ্ছা, কোন তাজুদ্দীন একটু চিনিয়ে দিন তো। তাজুদ্দীনের সঙ্গে একটা এক্সকুসিভ ইন্টারভিউয়ের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন?

মামুন হেসে বললেন, না, আমি নেতা নই। আমিও আপনারই মতন সাংবাদিক ছিলাম এক সময়। তাজউদ্দিন সাহেব এখনও আসেন নাই। আসলে তাঁকে আর চিনায়ে দিতে হবে না, তিনিই তো ভাষণ দেবেন।

–আচ্ছা মৌলানা ভাসানী কি আসবেন? তিনি কি মুক্তিযুদ্ধ সাপোর্ট করছেন?

–মৌলানা ভাসানী সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে চলে এসেছেন শুনেছি। এদিকে যখন এসেছেন, তখন পাকিস্তানকে নিশ্চয়ই আর সাপোর্ট করছেন না। স্বাধীন বাংলার দাবি তিনি আগেই তুলেছেন। তবে তিনি আজ এখানে আসবেন কিনা তা আমি জানি না।

–একটা জিনিস দেখুন, সৈয়দ সাহেব, যতই সিক্রেট রাখা হোক, এই আমবাগানেই যে মুজিব নগর স্থাপিত হবে, সেটা কিন্তু জানাজানি হয়ে গেছে। কত লোক এসেছে দেখুন।

কথাটা মিথ্যে নয়। আশপাশের গ্রাম থেকে ধেয়ে এসেছে বিপুল জনতা। অস্ত্রধারী সেনাদের বৃত্ত ভেদ করে তারা হুড়মুড় করে ভেতরে ঢুকে পড়তে পারছে না বলে অনেকেই আমগাছগুলোতে চড়তে শুরু করেছে। একটা অশুভ আশঙ্কায় মামুনের বুক কেঁপে উঠলো। এরা সবাই কি পাকিস্তান উৎখাত করে স্বাধীন বাংলাদেশ চায়? মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামের কর্মীরা মোটেই চায় না, তা মামুন ভালোভাবেই জানেন। এই জনতার মধ্যে পাকিস্তানের স্পাই থাকতে পারে না? পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর কাছে খবর পৌঁছে গেলে যদি তারা হঠাৎ এসে আক্রমণ করে? যশোর ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিমানে উড়ে আসতে কতক্ষণ লাগবে? আওয়ামী লীগের সব ক’জন বড় বড় নেতাকে যদি মেরে ফেলতে পারে কিংবা বন্দী করে নিয়ে যায়, তা হলে স্বাধীনতার সংগ্রাম কি আর এগুতে পারবে? ভারতীয় সীমান্ত বাহিনী বড়ার পেরিয়ে এদিকে ঢুকবে না, তা নাকি আগেই বলে দিয়েছে। ই পি আর এর এই সামান্য ক’জন সৈন্য পাক বাহিনীর আক্রমণের মুখে কতক্ষণ টিকবে?

অনুষ্ঠানটা কেন তাড়াতাড়ি শেষ করা হচ্ছে না, এই জন্য মামুন অধীর বোধ করতে লাগলেন।

হঠাৎ একটা শব্দে সবাই সচকিত হয়ে উঠলো। এসে গেল নাকি পাকিস্তানী সৈন্যরা? না, সে রকম কিছু নয়, অনেকগুলো লোকের ভার বইতে না পেরে ভেঙে পড়েছে একটা আমগাছের ডাল।

অনুষ্ঠান শুরু হলো এগারোটার পর। তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সবাই এসে গেছেন। তবে, যাঁর উপস্থিতি সবচেয়ে বেশী প্রয়োজনীয় ছিল, তিনি নেই, তিনি আসবেন না। শেখ মুজিব যে কোথায় আছেন তা এখনো জানা যায়নি।

তবু অনুপস্থিত শেখ মুজিবর রহমানের নামই ঘোষণা করা হলো রাষ্ট্রপতি হিসেবে। সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ। মন্ত্রীসভার অন্য তিনজন সদস্য হলেন খোন্দকার মোশতাক আহমদ, এইচ এম কামারুজ্জামান এবং এম মনসুর আলী। বাংলাদেশ সৈন্যবাহিনীর কমাণ্ডার ইন চীফ নিযুক্ত হলেন রিটায়ার্ড কর্নেল এম ওসমানী।

এর সাতদিন আগেই কলকাতার থিয়েটার রোডের অস্থায়ী মুজিব নগর থেকে বাংলাদেশ স্বাধীনতার সনদ ঘোষণা করা হয়েছিল। আজ, ১৭ই এপ্রিল, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে, আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার, ঐতিহাসিক দলিলটি পাঠ করলেন চীফ হুইপ ইউসুফ আলী। ই পি আর-এর প্লাটুন গার্ড অফ অনার দিল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে।

তারপর সাংবাদিকরা ঘিরে ধরলো তাজউদ্দিনকে। ধীর স্থিরভাবে উত্তর দিয়ে যেতে লাগলেন এক সদ্য প্রসূত রাষ্ট্রের প্রথম প্রধানমন্ত্রী। একজন বিদেশী সাংবাদিক প্রশ্ন করলো, আপনারা যে বাংলাদেশ সরকার গড়লেন, বাংলাদেশের কতটুকু এ পর্যন্ত আপনারা মুক্ত করতে পেরেছেন?

মাথা ঘুরিয়ে চতুর্দিক একবার দেখে নিলেন তাজউদ্দিন। তারপর প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললেন, গোটা বাংলাদেশটাই তো মুক্ত। শুধু সামরিক ঘাঁটিগুলো ছাড়া। বাংলার মাটিতে পাক বাহিনী এখন বিদেশী সৈন্য বাহিনী। আমরা তাদের তাড়াবোই।

বাংলা কাগজের যে সাংবাদিকটি মামুনের সঙ্গে যেচে আলাপ করেছিল, তার নাম অরুণ সেনগুপ্ত। বেশ সুশ্রী চেহারা, মাথার চুল ঢেউ খেলানো, কথা বলার সময় চোখ দুটো কুঁচকে আসে। কিন্তু ঠোঁটে হাসি মাখানো। তাঁর হাওয়াই শার্টে চার পাঁচটা পকেট। ফেরার সময় মামুন তাঁর সঙ্গে এক গাড়িতেই উঠলেন। আসার সময় সকলেরই মুখ ছিল থমথমে, এখন সবাই উৎফুল্ল। বিপদের আশঙ্কা, হঠাৎ পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কা সকলের মনেই ছিল, কিন্তু কোনোই গণ্ডগোল হয়নি। সব কিছু সুষ্ঠুভাবে চুকে গেছে! কালকের খবরের কাগজ দেখে পাকিস্তানী শাসকদের চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যাবে।

কোথা থেকে মিষ্টি জোগাড় হলো কে জানে, অরুণ সেনগুপ্ত গাড়ির সবাইকে জোর করে মিষ্টি খাওয়াতে লাগলেন। তারপর একটা সিগারেটের প্যাকেট বার করে বললেন, নিন, নিন। এখনও যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছি না। এত বড় একটা ঐতিহাসিক ঘটনা সত্যি ঘটে গেল? পাকিস্তান ভেঙে জন্ম হলো বাংলাদেশের? আমরা তার সাক্ষী?

একজন ব্রিটিশ সাংবাদিক বললেন, এখন পৃথিবীর কোন্ কোন্ দেশ এই বাংলাদেশ সরকারকে রিকগনাইজ করবে। সেটাই হলো প্রশ্ন।

অরুণ সেনগুপ্ত জোর দিয়ে বললেন, আমার ধারণা, ইণ্ডিয়া আজ রাত্তিরেই রেকগনিশান দেবে। তা হলে ইণ্ডিয়ার বন্ধু রাষ্ট্রগুলোও দেবে সঙ্গে সঙ্গে…

ব্রিটিশ সাংবাদিকটি বাঁকা সুরে বললেন, ইণ্ডিয়ার বন্ধু রাষ্ট্র-সে রকম কেউ আছে নাকি?

কয়েক মুহূর্তের জন্য সবাই চুপ করে গেল। তবু দমে না গিয়ে অরুণ সেনগুপ্ত বললেন, সোভিয়েট ইউনিয়ন আছে। নেপাল, ভুটান, সিকিম।

অন্য একটি বাঙালী সাংবাদিক সুর করে বলে উঠলো, হায় চীন, সোনালি ডানার চীন…! দশ বছর আগেও চীনের সঙ্গে আমাদের কত বন্ধুত্ব ছিল, আমরা হিন্দী চীনী ভাই ভাই করেছি। সেই চীন এখন পাকিস্তানের সব বর্বরতা সাপোর্ট করছে।

ব্রিটিশ সাংবাদিকটি বললো, এখনো তো কলকাতার দেয়ালে লেখা দেখছি, চীনের চেয়ারম্যান আপনাদেরই চেয়ারম্যান।

মামুন একটাও কথা বলছেন না। তাঁর বুকটা এখনো থরথর করে কেঁপেই চলেছে। আজকের ঘটনায় তাঁর মনে যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, তা এরা কেউ বুঝবে না। শুধু আনন্দ নয়, অনেকখানি দুঃখও মিশে আছে অনুভূতিতে। আশা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছিল পাকিস্তান, তা রক্ষা করা গেল না শেষ পর্যন্ত। শুধু আজকের ঐতিহাসিক ঘটনাই নয়, আরও একটা বিরাট ঐতিহাসিক ভুলেরও তো তিনি অংশীদার। সে জন্য কিছুটা আত্মগ্লানি তিনি এড়াবেন কী করে?

ভাত খাওয়ার জন্য আবার নামা হলো কৃষ্ণনগরে। বেলা প্রায় তিনটে বাজে। ডাল, ভাত আর ডিমের ঝোল ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যাবে না হোটেলে। অরুণ সেনগুপ্ত মামুনের সঙ্গে বসলেন এক টেবিলে। হেসে বললেন, মাছ ছাড়া খেতে আপনাদের কষ্ট হয়, তাই না? বলুন, আজ রাত্তিরে আপনি আমার বাড়িতে খেয়ে যাবেন।

মামুন বললেন, না, না, ডিমের কারি আমার ভালোই লাগে।

–অনেক সময় এই সব হোটেলে খুব ভালো পাকিস্তানী মাছ আসে। সরি, পাকিস্তানী না, বাংলাদেশী মাছ! বডার পেরিয়ে স্মাগলড হয়ে আসে, আমি অনেকবার খেয়েছি। এখন যুদ্ধ টুদ্ধ হচ্ছে বলে বোধহয় আর আসছে না।

–পশ্চিম বাংলার মানুষ মাছ খেতে পায় না। বাজারে গিয়ে দেখেছি, মাছের একেবারে আগুন দাম।

–পপুলেশনের কী চাপ দেখছেন না? এখন তো পাঞ্জাব রাজস্থান থেকেও কলকাতার বাজারে মাছ আসে। সে যাই-ই আসুক, পদ্মার ইলিশ আর সিরাজগঞ্জের রুইয়ের সঙ্গে কি সেসব মাছের তুলনা চলে?

হঠাৎ মুখটা ঝুঁকিয়ে গোপন কথার মতন ফিসফিসিয়ে অরুণ সেনগুপ্ত বললেন, আচ্ছা, সৈয়দ সাহেব, একটা কথা বলুন তো! এই যে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ক্যাবিনেট তৈরি হলো, এতে সবাই আওয়ামী লীগের, এটা কি ঠিক হলো?

মামুন অবাক হয়ে বললেন, কেন? ঠিক হবে না কেন? লাস্ট ইলেকশানে আওয়ামী লীগ ওভারহোয়েলমিং মেজরিটি পেয়েছে। তাদেরই সরকার গড়ার কথা ছিল। ইয়াহিয়া খান আর ভুট্টো জোর করে হতে দেয়নি। এখন বাংলাদেশ সরকার গড়তে গেলে

–সে ইলেকশান তো ছিল পাকিস্তানের ইলেকশান। এখানে তৈরি হলো বাংলাদেশ সরকার। এ দুটো আলাদা ব্যাপার নয়? বাংলাদেশে যতদিন না ভোট হচ্ছে, ততদিন সব পার্টির নেতাদের নিয়ে একটা ন্যাশনাল ক্যাবিনেট গড়া উচিত ছিল না? মুক্তিযুদ্ধ কি শুধু আওয়ামী লীগ চালাবে?

–না, মুক্তিযুদ্ধে সারা বাংলাদেশের মানুষ অংশ নেবে।

–নেতৃত্ব দেবে শুধু আওয়ামী লীগ? আপনাদের দেশে বামপন্থীরা আছে, উগ্রপন্থী আছে, ধর্মীয় দলগুলি আছে, তারা যদি এই নেতৃত্ব মেনে নিতে না চায়? এরকম একটা বিরাট ক্রাইসিসের সময় পাটি পলিটিকসের ঊর্ধ্বে উঠে সবাইকে এক প্লাটফর্মে দাঁড় করাবার চেষ্টা করাটাই বেশী কার্যকর হতো না কি?

একটু ইতস্তত করে মামুন বললেন, তা অবশ্য ঠিকই বলেছেন। তবে আজ তো ছোট একটা ক্যাবিনেটের কথা ঘোষণা করা হলো, পরে যখন বাড়ানো হবে, তখন অন্য দলের। নেতাদেরও নেওয়া হবে আশা করি।

অরুণ সেনগুপ্ত পকেট থেকে ছোট্ট একটা নোট বই বার করতেই মামুন তাঁর হাত চেপে ধরে বললেন, না, না, আমায় কোট করবেন না, প্লীজ। আমি পলিটিকসের কেউ না, আমি সামান্য একজন রিফিউজি। বাংলাদেশ সরকারের মতামত দেবার কোনো অধিকার আমার নাই। আমিও তো এক সময় আপনার মতন সাংবাদিক ছিলাম। কাকে যেমন কাকের মাংস খায় না, সেই রকম কোনো সাংবাদিক ও সাংবাদিকের মাংস…

অরুণ সেনগুপ্ত হো হো করে হেসে উঠে বললেন, আসুন, তা হলে ডিমের ঝোল খাওয়া যাক।

কলকাতায় পৌঁছে, অরুণ সেনগুপ্তর বাড়িতে অন্য একদিন নেমন্তন্ন খেতে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মামুন বাড়ি ফিরে এলেন। রাস্তা থেকেই দেখতে পেলেন, মঞ্জু আর হেনা অধীর অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে জানলার গরাদ ধরে। তাঁর দিকে চোখ পড়া মাত্র মেয়ে দুটির মুখে যে হাসি ফুটে উঠলো, মামুনের মনে হলো, একেই বোধহয় স্বর্গীয় হাসি বলে। হাত তুলে ওদের। আশ্বস্ত করে মামুন মোড়ের দোকানে কিছু মিষ্টি কিনতে গেলেন। অনেকদিন পর তিনি গুন গুন করে ধরলেন একটা গান, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।

মিষ্টির দোকানের সামনে চার-পাঁচটি ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। মামুন তাদের কথাবার্তা শোনবার চেষ্টা করলেন। এরা আলোচনা করছে ক্রিকেট খেলা সম্পর্কে। এই উপমহাদেশের ইতিহাসে আজ যে কী বিরাট ব্যাপার ঘটে গেল সে সম্পর্কে ওদের কোনো সই নেই? নাকি ওরা কেউ এখনও জানে না। অল ইণ্ডিয়া রেডিও থেকে কিছু বলেনি? দোকানের মালিক একটা ময়লা নোট নিয়ে কথা কাটকাটি করছে একজন খদ্দেরের সঙ্গে। আজ কি এমন তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া করার দিন?

দশ টাকার মিষ্টি কিনে মামুন উঠে এলেন দোতলায়। দরজা খুলেই তিনি মঞ্জুর ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে প্রায় নাচতে নাচতে বলতে লাগলেন, ওরে সুখু মিঞা, আজ থিকা আমরা। কেউ আর পাকিস্তানী না। আমরা বাংগালী, বাংগালী। তুই নিজেকে কী বলবি বল তো? বাংগালী। তোর দেশ বাংলাদেশ।

উদ্ভাসিত মুখে মঞ্জু বললো, যুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে?

মামুন বললেন, না, যুদ্ধ এখনো শেষ হয় নাই, তবে হবে, হবে। কতদিন আর ওরা পারবে? পশু-শক্তি কি মানুষের সাথে পারে?

হেনা বললো, বাবা, তুমি সত্যি বাংলাদেশের মইধ্যে গেছিলা!

মামুন মেয়ের মাথার চুল ধরে নেড়ে দিয়ে বললেন, হ রে ছেমড়ি, হ। একেবারে কুষ্টিয়ার মইধ্যে, মেহেরপুরে। সেখানে আমাগো আর্মি ছিল, পাকিস্তানীরা ভয়ে ধারে কাছে আসে নাই।

হেনা আবার জিঞ্জেস করলো, বাবা, সেখান থিকা মা’র কোনো খবর পাও নাই? কুষ্টিয়া থিকা মাদারিপুর কতদূর?

মামুন নাচ থামিয়ে সুখু মিঞাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলেন। মঞ্জুর মুখের দিকে তাকিয়ে দেখলেন, তার মুখেও অনেকগুলি প্রশ্নের রেখা। ফিরোজা বেগম, বাবুল চৌধুরীর কোনো খবর এতদিনে জানা যায়নি, জানার কোনো উপায় নেই। তারাও মামুনদের কোনো খবর জানে না।

বাধ্য হয়ে মিথ্যে কথা বলার জন্য মামুন জোর করে মুখের হাসি বজায় রেখে বললেন, চিন্তার কিছু নাই, কুষ্টিয়ায় শুনে আসলাম, ঢাকা, ফরিদপুর, চিটাগাঙ এখন শান্ত। খান সেনারা

ভয় পেয়ে গেছে, মুক্তিবাহিনীর ভয়ে তারা ক্যান্টনমেন্টে ঢুকে বসে থাকে, সিভিলিয়ানদের আর একদম ঘাঁটায় না। আমি শিগগিরই মুক্তি বাহিনীর ছেলেদের হাত দিয়া ওদের কাছে চিঠি পাঠাবো। এখন খা, সন্দেশ খা। আইজ কত বড় একটা আনন্দের দিন। মঞ্জু, গান ধর তো, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।

ঘরের দরজা বন্ধ। খানিকটা দ্বিধার পর মঞ্জু গান শুরু করে দিল, হেনা আর সুখুও যোগ দিল তার সঙ্গে। মামুন যেন মোশান মাস্টার, তিনি দু হাত দুলিয়ে দুলিয়ে বলতে লাগলেন, আবার আবার।

সেই পঁচিশে মার্চের পর এই ভয়ার্ত, শঙ্কাতুর, দুঃখী পরিবারটিতে দেখা গেল এই প্রথম কিছুটা আনন্দের হিল্লোল।

এরপর মঞ্জু আর হেনা রান্না ঘরে চলে গেলে মামুন একটা রেডিও খুলে বসলেন। এই শস্তার ট্রানজিস্টারটা তিনি দু’ দিন আগে কিনেছেন। ঢাকা ধরা যায়, ঢাকার খবরে ঝুড়ি ঝুড়ি মিথ্যে কথা থাকে, তবু শুনতে ইচ্ছে করে। যদি ঐসব মিথ্যের ফাঁকে দু’ একটা সত্য হঠাৎ ঝিলিক দেয়। ঢাকার সংবাদে মুক্তি বাহিনীর কোনো উল্লেখই থাকে না, ভারতের বিরুদ্ধে বিষোদগারই প্রায় সবটুকু। ভারতীয় সেনাবাহিনী নাকি ছদ্মবেশে পূর্ব পাকিস্তান সীমান্ত পেরিয়ে সাধারণ নাগরিকদের ওপর হামলা চালাচ্ছে।

আজ মামুন অল ইণ্ডিয়া রেডিও’র খবরই শুনতে চান। ভারত সরকার কখন স্বাধীন। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে? কলকাতার পাকিস্তানী ডেপুটি হাইকমিশন কি যোগ দেবে বাংলাদেশের পক্ষে? ডেপুটি হাই কমিশনার হোসেন আলীকে অনুরোধ জানানো হয়েছিল, তিনি বাঙালী মুসলমান হয়েও এ পর্যন্ত রাজি হননি। এখনো পাকিস্তানের প্রতি এই আনুগত্য কি শুধু চাকরির মায়ায়?

দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের খবরে কোনো উল্লেখ নেই, দিল্লি থেকে প্রচারিত ইংরিজি সংবাদেও ভারত সরকারের কোনো প্রতিক্রিয়া জানা গেল না। মুজিব নগরের বাংলাদেশ। সরকারকে ইন্দিরা গান্ধী যদি শেষ পর্যন্ত স্বীকৃতি না দেন!

সারা দিন অনেক ধকল গেছে, রেডিও শুনতে শুনতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লেন মামুন। খাবার জন্য মঞ্জু আর হেনা তাঁকে ডেকে তোলার চেষ্টা করেও পারলো না।

পরের দুটি দিন গেল উদ্বেগ আর নিরানন্দে। ভারত সরকার স্বীকৃতি দেননি, স্বাধীন। বাংলাদেশ সরকার সম্পর্কে ইন্দিরা গান্ধী একেবারে চুপ। অনেকে বলছে, উদ্বাস্তুদের তিনি। আশ্রয় দিলেও পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলাবেন না। ভারত এখন যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে চায় না।

হঠাৎ একটি সুসংবাদ এলো অন্য দিক থেকে। ইয়াহিয়া সরকারের একটা ভুল চালে সুবিধে হয়ে গেল বাঙালী বিদ্রোহীদের। কলকাতার পাকিস্তানী ডেপুটি হাই কমিশনার হোসেন আলীকে রাওয়ালপিণ্ডিতে বদলির অর্ডার এলো। হোসেন আলীর স্ত্রী ও আত্মীয় পরিজনেরা বেঁকে বসলেন, এই অবস্থার মধ্যে তাঁরা কিছুতেই হোসেন আলীকে রাওয়ালপিণ্ডি যেতে দিতে চান না, যদি সেখানে নিয়ে গিয়ে তাঁকে অ্যারেস্ট করা হয়? পাকিস্তান সরকারের কোনো উঁচু পদেই আর বাঙালী রাখা হবে না, এ তো সবাই জেনে গেছে।

হোসেন আলী এবার তাজউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করলেন নিজেই। একাত্তর জন বাঙালী কর্মচারী নিয়ে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য দেখাতে চান। ডেপুটি হাই কমিশনের বাড়িটিও থাকবে তাঁদেরই দখলে।

সারা কলকাতায় সারা পড়ে গেল। পাকিস্তান যে সত্যি ভাঙছে, এটা তার একটা সত্যিকারের বাস্তব প্রমাণ। দূতাবাসের আনুগত্য বদল তত সহজ কথা নয়। এই ঘোষণার পরদিন সকালেই পার্ক সাকাসে সেই দূতাবাসের সামনে ছুটে এলো হাজার হাজার মানুষ। ভূতপূর্ব পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশন অফিসের নাম হয়ে গেল বাংলাদেশ মিশন, সেখানে শুরু হলো এক স্বতঃস্ফূর্ত উৎসব। শুধু সাংবাদিকরাই নয়, তাতে যোগ দিলেন কবি-সাহিত্যিক, সঙ্গীত শিল্পীরা। পূর্ব পাকিস্তান থেকে যে-সব রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী এবং বুদ্ধিজীবীরা এদিকে এসে আশ্রয় নিয়েছেন বাধ্য হয়ে, তাঁদের সকলের চোখ মুখে উল্লাস। এতদিন পর কলকাতায় তাঁদের মিলনের একটা নিজস্ব জায়গা হলো। এখানে উড়ছে বাংলাদেশের সবুজ-সোনালি পতাকা।

একটার পর একটা গান গেয়ে চলেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, মন দিয়ে সেই গান শুনতে শুনতে হঠাৎ ডায়াসের কাছাকাছি একজন মানুষকে দেখে চমকে উঠলেন মামুন। আর কোনো কিছু চিন্তা না করে তিনি এগোতে লাগলেন ভিড় ঠেলে। অরুণ সেনগুপ্ত তাকে দেখতে পেয়ে হাত ধরে বলতে গেলেন কিছু, মামুন তাঁর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ছুটে গেলেন সামনে। উদ্দিষ্ট লোকটির পাশে গিয়ে তার পিঠে হাত রেখে আবেগ কম্পিত গলায় বললেন, প্রতাপ, প্রতাপ।

লোকটি মুখ ফিরিয়ে বিস্মিতভাবে চেয়ে রইলেন মামুনের দিকে।

মামুন বললেন, প্রতাপ, আমায় চিনতে পারলি না? আমি মামুন, তোর কলেজের বন্ধু।

লোকটি বিনীতভাবে বললেন, আপনার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়নি, আপনার বোধহয় ভুল। হয়েছে, আমার নাম প্রতাপ নয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *