১১. হরিরামে গুদোমঘর

এগারো

হরিরামে গুদোমঘরটা বেশ অন্ধকার। তবু ভুজঙ্গর আত্মা-নামানোর ঘরটার মতন ঘুটঘুঁটে নয়। এখন আবার দিনের বেলা, বাইরের আলো ছোটখাট ফাঁকফোকর দিয়ে একটু না একটু ঢুকে পড়ছে। ম্যাটিনি শোয়ে সিনেমা দেখতে গেলে হলের মধ্যে যেমন লাগে–অনেকটা সেই রকম অন্ধকার লাগছিল এখানে।

কিকিরা বড় বড় ফাঁক-ফোকরগুলো ছেঁড়া চট, কাগজ, আরও যা যা পেয়েছেন হাতের কাছে, তাই দিয়ে ঢেকে দিয়েছিলেন আগেই; ছোটগুলো ঢাকতে পারেননি। তার জন্যে তিনি ব্যস্তও হলেন না।

ঘরের মাঝমধ্যিখানে একটা ছোট টেবিল ছিল চৌকো ধরনের; আর দুটো চেয়ার, মুখোমুখি।

গুদোমঘরের দরজাটা ভেজিয়ে দিলেন কিকিরা। বললেন, “তারাপদবাবু, আপনি আর আমি চেয়ারে গিয়ে বসব। মুখোমুখি। টেবিলের ওপরে আমাদের হাত থাকবে, আমরা দুজনে দুজনের হাত ধরে থাকব। আর টেবিলের নিচে আমাদের পা থাকবে, আমরা পায়ে পা ছুঁইয়ে রাখব। চন্দনবাবু যেখানে খুশি দাঁড়িয়ে থাকতে পারেন।..আসুন।”

তারাপদ কিকিরার মতিগতি বুঝতে পারছিল না। ওই খেপা মানুষটি কী পাগলামি শুরু করলেন? তা ছাড়া তারাপদর মাথায় বাবার কথা বারবার এসে পড়ছিল। কিকিরা কেন বললেন, ভুজঙ্গই একরকম তার বাবাকে মেরেছে? কেন বললেন, পরীর আত্মা নামিয়ে ভুজঙ্গ বাবাকে পাগল করেছিল? কিকিরা কি তার বাবার কথা জানেন? আশ্চর্য! যদি জানেন তবে আগে কেন বলেননি?

তারাপদর মন বড় এলোমেলো হয়ে যাচ্ছিল, ভেতরে ভেতরে ছটফট করছিল।

কিকিরা ততণে চেয়ারের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছেন। তারাপদকে আবার ডাকলেন তিনি, “আসুন।”

ঝাপসা অন্ধকারে তারাপদ ধীরে ধীরে এগিয়ে টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াল।

“বসুন,” কিকিরা বসতে বললেন।

কেমন যেন অন্যমনস্কভাবে তারাপদ বলল, “জুতো রয়েছে পায়ে।”

কিকিরা বললেন, “আগেই দেখেছি। শু। চামড়ার। বেশ শক্ত জুতো। ওতে কোনো ক্ষতি হবে না। আমার পায়েও রয়েছে।” বলে চেয়ার টেনে বসলেন। তারপর ঠাট্টার গলায় বললেন, “ধূপ ধোঁয়া স্তোত্রপাঠ গানটান কিছুই তো এ-ঘরে দেখছেন না । ভুজঙ্গর তাক-লাগানো ব্যাপার কোনোটাই নেই স্যার। তবু দেখবেন আপনার পছন্দসই আত্মারা সবাই একে-একে চলে আসবে।…নিন, বসে পড়ন।”

তারাপদ চেয়ার টেনে বসল। কিকিরাও বসে পড়েছেন। চৌকো ধরনের ছোটখাট অথচ সামান্য উঁচু টেবিলের দু ধারে মুখোমুখি দুজনে বসে। কিকিরা তাঁর দু’হাত সামনে বাড়িয়ে দিলেন। টেবিলের ওপরই ফেলে রাখলেন হাত দুটো। বললেন, “নিন, আপনার হাত দুটো এগিয়ে দিন; আমার হাত ধরুন।”

তারাপদ হাত ধরল । কিকিরা টেবিলের তলায় জুতোসমেত পা সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছিলেন, তারাপদও তার পা বাড়াল। কিকিরা বললেন, “না না, আপনি অত লজ্জা পাবেন না স্যার, জুতোর মুখে মুখে ছুঁইয়ে রাখছেন কেন–ডগাটার ওপর একটু চাপ দিয়ে থাকুন।”

সঙ্কোচ হচ্ছিল তারাপদর। কিকিরার পায়ের ওপর নিজের জুতোসমেত পা কেমন করে চাপানো যায়? তার ভদ্রতায় বাধছিল। ভুজঙ্গর ওখানে তারা শুধু মেয়েটির পায়ের আঙুলের সঙ্গে আঙুল ছুঁইয়ে রাখে। আর এখানে কিকিরা জুতোর মুখের ওপর পা চাপিয়ে দিতে বলছেন। এ

তারাপদ তার জুতোর ডগা দিয়ে কিকিরার জুতোর ডগা চেপে থাকল।

কিকিরা বললেন, “বাঃ বাঃ, চমৎকার হয়েছে। এবার আমরা চোখ বন্ধ করব । বন্ধ করে আত্মার কথা ভাবব । চন্দনবাবু, আপনি চোখ খুলে সবই দেখতে পারেন, যদি অবশ্য এই অন্ধকারে দেখা যায়। রেডি,…তা হলে এবার আমরা আত্মা ডাকতে বসতে পারি। নিন তারাপদবাবু, চোখ বুজে ধ্যান করুন। কাকে ডাকতে চান?”

“বাবাকে।”

“বেশ, বেশ।”

তারাপদ চোখের পাতা বুজে ফেলল। কিকিরাও চোখ বন্ধ করার ভান করলেন–কিন্তু পুরোপুরি বন্ধ করলেন না। চন্দন সামান্য তফাতে দাঁড়িয়ে কিকিরাদের দিকে তাকিয়ে থাকল। এই অন্ধকারে দুজনকে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল মাত্র।

তারাপদ তার বাবাকে ডাকবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু একমনে ডাকতে পারছিল না। নানা ধরনের চিন্তা এসে যাচ্ছিল। কখনো ভুজঙ্গ এসে পড়ছিল, কখনো। সেই মেয়েটি। বাবার কথা ভাবতে গিয়েও কিকিরার কথাটা মনে আসছিল। কিকিরা কেন বললেন ভুজঙ্গই তার বাবাকে মেরেছে?

সমস্ত মন এলোমেলো হয়ে থাকায় তারাপদ কিছুতেই তার বাবাকে তেমন করে ভাবতে পারছিল না।

এইভাবে সময় কেটে যাচ্ছিল, আস্তে আস্তে । কতক্ষণ যে কেটে গেল তাও বোঝা গেল না। সবই চুপচাপ। এক-আধবার বাইরে থেকে কোনো কাকের ডাক কিংবা দূরে কাঠ কাটার শব্দ খুব ফিকেভাবে ভেসে আসছিল।

হঠাৎ যেন কিকিরা সামান্য কেঁপে উঠলেন। তারপর বললেন, “তারাপদবাবু, উনি এসেছেন।”

তারাপদ বোধ হয় সামান্য অপ্রস্তুত ছিল। বলল, “কে?”

“আপনার বাবা।”

“বাবা?” তারাপদ বিশ্বাস করতে পারল না। কিকিরা কি তার সঙ্গে তামাশা করছেন! কোথায় বাবা?

কিকিরা বললেন, “আপনার বাবার আত্মা আমায় ভর করে নেই, কিন্তু তিনি আমার কাছেই রয়েছেন। প্রমাণ চান?”

তারাপদ মুখ ফুটে বলতে পারল না–হ্যাঁ চাই। তার মন বলছিল–চাই, নিশ্চয়ই চাই।

কিকিরা যেন তারাপদর মন বুঝেই বললেন, “আপনার বাবার আত্মা এসেছেন কিনা সেটা আপনিই যাচাই করে নিন। ওঁকে কিছু জিজ্ঞেস করুন। জবাব হ্যাঁ হলে ঘন্টার শব্দ শুনবেন; না হলে ঘণ্টা বাজবে না।”

তারাপদ এবার খানিকটা অবাক হল। কিকিরা ঘণ্টার ব্যবস্থাও রেখেছেন? আগে তো বলেননি! কেমন একটা থতমত ভাব হল তারাপদর সত্যি সত্যিই কি কিকিরা আত্মা নামিয়েছেন না মজা করছেন তার সঙ্গে?

কিকিরা বললেন, “কই, জিজ্ঞেস করুন?”

তারাপদ ঢোক গিলে প্রশ্ন করল,”বাবা! বাবা আপনি এসেছেন?”

প্রথমটায় চুপচাপ। তারপর সত্যি সত্যিই ঘণ্টা বেজে উঠল ।

তারাপদ চমকে গেল। সে স্বপ্নেও ভাবেনি কিকিরা এইভাবে তাকে অবাক করে দেবেন। হতবুদ্ধি হয়ে গেল তারাপদ। আর ওই অবস্থায় আবার জিজ্ঞেস করল, “বাবা, সত্যিই আপনি এসেছেন?”

আবার ঘণ্টা বাজল। তারাপদ কান পেতে শব্দটা শুনল। ভুজঙ্গর ঘরে ঘণ্টার শব্দ আরও সুন্দর শোনায়, এখানে শব্দটা একটু অন্যরকম। ঠাকুরঘরে ঘণ্টা বাজার মতনই অনেকটা। হঠাৎ তারাপদর ঝোঁক চাপল, কিকিরা কোনো চালাকি করছেন কিনা জানতে হবে। চোখ সামান্য খুলে তারাপদ কিকিরার দিকে তাকাল । কিকিরাও তাকিয়ে আছেন।

তারাপদ জিজ্ঞেস করল, “বাবা, আপনার সঙ্গে আর কেউ এসেছে?”

ঘণ্টা এবার বাজল না।

“কাল ভুজঙ্গর ঘরে পরী এসেছিল?”

ঘণ্টা বাজল।

“পরী কি কিছু রেখে গিয়েছে?”

এবারও ঘণ্টা বাজল।

তারাপদ বিচলিত হয়ে পড়ছিল। তার মনে হচ্ছিল, সে যেন হেরে যাচ্ছে । কিকিরা তাকে জব্দ করছেন। খানিকটা রাগও হচ্ছিল তার, কেন রাগ হচ্ছিল বুঝতে পারছিল না। কিকিরা তার বিশ্বাস ভেঙে দিচ্ছেন বলে কি?

আচমকা তারাপদ কতকগুলো উলটো-পালটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বসল। “আপনার নাম বিষ্ণুপদ না বিষ্ণুব্রত?…আপনি অ্যাকসিডেন্টে মারা যান না অসুখে ভুগে?…পরী বাড়িতে মারা গিয়েছিল না হাসপাতালে?”

হেরেই গেল তারাপদ। কিকিরার নামানো আত্মা ঠিক-ঠিক জবাবে ঘণ্টা বাজাল।

শেষ পর্যন্ত হাল ছেড়ে দিল তারাপদ।

এবার কিকিরা বললেন, “তারাপদবাবু, এ এক এমন আত্মা যে আপনার সমস্ত প্রশ্নেরই জবাব দিতে পারে, যদি অবশ্য তার জানা থাকে। যাকগে, এবার আর লুকোচুরির দরকার নেই, আসল ব্যাপারটা আপনাকে দেখাই।” বলে কিকিরা তাঁর হাত টেনে নিলেন। চন্দনকে বললেন, “চন্দনবাবু, আপনাকে একটু হাত লাগাতে হবে। এখানে তো আলো নেই, না দেখলে ব্যাপারটা আপনারা বুঝতে পারবেন না। দয়া করে ওই ভেতর দিকের জানলাটা খুলে দেবেন? দরজাও খুলে দিন। ওপাশের উঁচু ঘুলঘুলি থেকে চটটা নামিয়ে নিন স্যার।

চন্দন ঝাপসা অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে জানলা-টানলা খুলল। এবার খানিকটা আলো আসছিল। মোটামুটি সবই চোখে পড়ে।

কিকিরা চন্দনকে টেবিলের সামনে এসে দাঁড়াতে বললেন। তারপর তারাপদর দিকে তাকিয়ে হাসি-হাসি গলায় বললেন, “স্যার, এই আত্মা নামানোর ব্যাপারটা স্রেফ জোচ্চুরি। লোক ঠকানোর খেলা।…আপনারা স্যার লেখাপড়া-শেখা ছেলে–নিজেরাই জানেন মানুষ মনে-মনে কত দুর্বল। আমরা কেউই তো চাই না আমাদের মা বাবা ভাই বোন আমাদের ছেড়ে চলে যায়। অনেক বয়েস হল, মানুষ বুড়ো হল, অসুখবিসুখে ভুগে মারা গেল, সেটা অন্য কথা; কিন্তু সময় হল না, অথচ মা বাবা ছেলে মেয়ে ভাই বোন যদি চলে যায় তবে কে তা সহ্য করতে পারে বলুন। মানুষের এই দুর্বলতাকে কিছু লোক মাথা খাঁটিয়ে কাজে লাগায়। এরই নাম সেয়াঁস, বা আত্মা-নামানোর চক্র। আমাদের দেশ বলে নয়, সব দেশেই এটা বেশ ভাল ব্যবসা হিসেবে চলে। য়ুরোপ আমেরিকাতেও চলে, আবার হংকং-টংকংয়েও চলে। লাখ লাখ টাকার ব্যবসা চলছে স্যার এইভাবে। যাকগে, সে পরের কথা, এখন কাজের কথায় আসি।” বলে কিকিরা একটু থামলেন। তারপর হেসে বললেন, “এইবার দেখুন, স্যার ঘন্টাটা কেমন করে বাজে।”

তারাপদ আর চন্দন কিকিরার দিকে তাকিয়ে থাকল। কিকিরা হাসি-হাসি মুখ করে ঘণ্টাটা বাজাতে লাগলেন। তারাপদরা মাটির দিকে তাকাল, কিছু দেখতে পেল না। অথচ বেশ বুঝতে পারল টেবিলের তলায় ঘন্টা বাজছে।

কিকিরা বললেন, “আপনারা মাটিতে বসে পড়ন, উবু হয়ে বসুন, তা হলেই দেখতে পাবেন।”

চন্দন ঝপ করে বসে পড়ল। বসে পড়ে টেবিলের তলার দিকে তাকাল। দেখল, টেবিলের মাঝ-মধ্যিখানে একটা আঙটার ফাঁকে ছোট মতন এক পুজোর ঘণ্টা ঝোলানো। দেখে চন্দন বোবা হয়ে গেল।

তারাপদও চেয়ারে বসে মাটির দিকে ঝুঁকে পড়ে টেবিলের তলাটা দেখতে লাগল ।

কিকিরা হেসে হেসে বললেন, “ভেরি ইজি স্যার, শুধু একটু প্র্যাকটিস দরকার। এই দেখুন, আমি আমার ডান পায়ের বুড়ো আর মাঝখানের আঙুল দিয়ে কেমন করে ঘন্টা বাজাচ্ছি।” কিকিরা ঘণ্টা বাজাতে লাগলেন।

কিকিরার জুতো জোড়ার একটাতে তাঁর পা নেই। জুতো পড়ে আছে।

তারাপদ সন্দেহের গলায় বলল, “আপনার ডান পায়ের জুতো পড়ে আছে, পা নেই।”

চন্দন আবার উঠে দাঁড়িয়েছে।

কিকিরা বললেন, “পা যদি জুতোর মধ্যেই থাকবে স্যার, তবে ঘণ্টাটা বাজাব কেমন করে!”

তারাপদ বলল, “আপনি বলতে চান জুতোর মধ্যে থেকে পা বার করে নিয়ে ঘণ্টা বাজানো হয়?”

“এক্কেবারে ঠিক কথা। যদি ঘন্টাটা এ-দেশি হয় তবে ওইভাবে বাজাতে হবে।”

“কিন্তু আপনি জুতোর মধ্যে থেকে পা বার করলেন কেমন করে? আমি তো বুঝতে পারলাম না। আপনার জুতোর ডগার ওপর আমার পা চাপানো ছিল।“

“আমি বোকা বানিয়েছি। অবশ্য স্যার, এইভাবেই আমরা আপনাদের বোকা বানাই। ব্যাপারটা কী জানেন, আমার যে জুতো জোড়া দেখছেন এটা ঠিক আমার নয়, চেয়েচিন্তে বেছে জোগাড় করেছি। এটা হল খাদে পরে যাবার মালকাট্টাদের জুতো। হরিরামের কাছে পড়ে ছিল। এই জুতোর মুখটা খুব শক্ত, লোহার মতন। এরকম জুতো পাওয়া যায় বাজারে। এই ধরনের শক্ত মুখের আরও পাঁচ রকম জুতো আছে। কলকারখানায় যারা কাজ করে তারা

অনেকেই এই ধরনের জুতো পরে। আঙুলগুলো বাঁচে আর কি-ঠোক্কর, খান, হোঁচট খান, কিসসু হবে না।…সত্যি বলতে কী স্যার, আপনাকে আমি ইচ্ছে করেই বলেছিলাম, জুতোর ডগার ওপর আপনার জুতোসুদ্ধ পা চাপিয়ে রাখতে। আপনি পা ঠিকই চাপিয়ে রেখেছিলেন, কিন্তু বুঝতে পারেননি আমি আলগা জুতো থেকে পা বের করে নিয়েছি। কেমন করে বুঝবেন? খুব শক্ত মুখের জুতোর ওপর যদি আপনার জুতোর মুখটা চেপে থাকেন–আপনার মনে হবে, আপনি অন্যের জুতো ঠিকই চেপে ধরে আছেন।”

চন্দন বলল, “আপনার জুতোর ফিতে বাঁধা রয়েছে।”

কিকিরা হেসে উঠে বললেন, “সেটা ওপরে-ওপরে। প্রথমত ফিতে আমি আলগা করে বেঁধেছি, তা ছাড়া–ফিতের তলার দিকে কাটা আছে স্যার। জুতোটা একবার দেখলেই বুঝতে পারবেন।”

তারাপদ বলল, “এ-সব আপনি কখন করলেন?”

“কেন, সেই যে একবার আপনাদের ঘরে বসিয়ে রেখে বাইরে গেলাম, তখন এই স্পেশ্যাল জুতো পরে এলাম। “

চন্দন কেমন কৌতূহলের সঙ্গে বলল, “আত্মারা তা হলে এইভাবে ঘণ্টা বাজায়?

কিকিরা মুচকি হাসলেন।

তারাপদ সন্দেহের গলায় বলল, “কিন্তু ওই মেয়েটি কেমন করে ঘণ্টা বাজাবে? সে আপনার মতন জুতো পায়ে এসে বসত না। খালি পায়ে বসত। আমরাও খালি পায়ে থাকতাম।”

কিকিরা সহজভাবেই বললেন, “স্যার, যে নিয়মে নৌকো জলে ভাসে, সেই একই নিয়মে জাহাজও জলে ভাসে। একই মাটি, একই খড়গড়ার বেলায় কখনো আমরা গড়ি মা দুর্গা, কখনও মা কালী ।” বলে জিবে একটা শব্দ করলেন কিকিরা। তারপর বললেন, “আপনি যদি ম্যাজিকের লাইনে থাকতেন স্যার, বুঝতে পারতেন, খেলাটা একই, তবে এক একজন এক একভাবে দেখায়, সামান্য অদলবদল করে। ভুজঙ্গ খেলাটাকে একটু অন্যভাবে দেখাত।”

চন্দন বলল, “কেমন করে?”

কিকিরা বললেন, “ব্যাপারটা খুব কঠিন নয়। আপনারা হাতে পরার দস্তানা দেখেছেন তো? নরম শক্ত অনেক রকম দস্তানা থাকে। যদি বলি মেয়েটি পায়ের দস্তানা পরত–তা হলে?”

অবিশ্বাসের সুরে তারাপদ বলল, “কী বলছেন?”

“ঠিকই বলছি স্যার, তবে বলায় একটু ভুল হয়েছে। দস্তানা না বলে বলা উচিত পায়ের ঢাকনা, অবিকল পায়ের পাতার সামনের দিকটার মতন।” বলতে বলতে কিক্রি নিজের ডান পা তুলে ধরে দেখালেন। বললেন, “এই যে আঙুল দেখছেন–ঠিক এইরকম আঙুল-অলা একটা কাঠের কিংবা খুব শব্দ রবারের, বা মেটালের ফলস্ পায়ের পাতা দরকার । পুরো পাতা না হলেও চলে, আধখানা হলেই যথেষ্ট। মেয়েটা এই রকম ফলস্ আঙুল-অলা পায়ের পাতা পরে থাকত। দরকারের সময় সে এই খোপের মধ্যে থেকে পা বার করে নিত, আপনারা বুঝতে পারতেন না।”

তারাপদ বোকার মতন তাকিয়ে থাকল। বিশ্বাস হচ্ছিল না যেন। বলল, “আমাদের পায়ের আঙুল তার পায়ের আঙুলের সঙ্গে ছোঁয়ানো থাকত।”

“না, কখনোই নয়, কিকিরা বললেন, “আপনারা ভাবতেন মেয়েটির পায়ের আঙুলের সঙ্গে আপনাদের পায়ের আঙুল ছোঁয়ানো আছে। কিন্তু তা থাকত না। আপনারা তার নকল পায়ের পাতার নকল আঙুলে নিজেদের আঙুল ছুঁইয়ে রাখতেন। আর সেই মেয়েটি দরকারের সময় ঢিলেঢালা ওই নকল পায়ের পাতা থেকে নিজের পা বার করে নিয়ে ঘণ্টা বাজাত।”

চন্দন হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে বলল, “মাই গড়। ওই জন্যেই মেয়েটির পায়ের আঙুল আমার একদিন শক্ত-শক্ত লেগেছিল।”

তারাপদরও খেয়াল হল, তারও প্রথম দিন শক্ত-শক্ত লেগেছিল। চন্দন বলল, “তারা, তোর মনে আছে–আমি তোর সঙ্গে একদিন জায়গা বদল করে নিয়েছিলাম। যেদিকে মেয়েটা ঘণ্টা এনে রাখত সেদিকের চেয়ারে বসেছিলাম। আমার সেদিন কেমন মনে হয়েছিল মেয়েটির পায়ের আঙুল বেশ শক্ত।”

তারাপদ অস্বীকার করতে পারল না। চুপ করে থাকল। চন্দন খানিকটা উত্তেজনার গলায় বলল, “কিকিরা স্যার, মেয়েটা তা হলে একটা মাত্র পায়ে ফলস ফুট পরত?”

“খুব সম্ভব তাই পরত। যেদিকে ঘণ্টা থাকত–সেই দিকের পায়ে পরত।“

“ওই পায়ে ঘন্টা বাজাত?”

“কোনো সন্দেহ নেই।”

“অত বড় ঘণ্টা পায়ের আঙুলে ধরে কেমন করে বাজাত?”

“ওটা অভ্যাসের ব্যাপার। অভ্যাসে মানুষ সবই শেখে। সাকাসের খেলা দেখেছেন তো! আপনি আমি পারব না। কিন্তু যে শিখেছে সে পারবে। অত কথায় দরকার কী স্যার, সামান্য একটা শাঁখ যদি আপনাকে বাজাতে বলি আপনি পারবেন না–অথচ কত ছোট-ছোট মেয়েরা কেমন চমৎকার শাঁখ বাজায়!”

তারাপদ আর. যেন কথা বলতে পারছিল না। এখন তার বিশ্বাস হচ্ছিল ভুজঙ্গ আগাগোড়া তাদের সঙ্গে ধাপ্পা মারছে! কিন্তু তাই কি?, সবই ধাপ্পা? মোমের আঙুলটাও ধাপ্পা?”

কিকিরা বললেন, “একটা কথা কিন্তু বলে রাখি। যে-ঘণ্টাটা পায়ের সামনে এনে রাখা হত–সেটা হয়ত আপনাদের ধোঁকা দেবার জন্যে। দেখানো হত–আত্মা কেমনভাবে এসে ঘণ্টা তুলে নিয়ে বাজায়। আসলে টেবিলের তলার দিকে লুকোনো একটা ঘণ্টা ঝুলানো থাকত। কিংবা এমনও হতে পারে–মেয়েটি পায়ের আঙুলে ঘণ্টার মুণ্ডুটা আঁকড়ে ধরে বাজাত। এতে অবশ্য কিছুই আসে যায় না। মোদ্দা কথা পা দিয়েই ঘণ্টা বাজানো হত?”

কেউ কোনো কথা বলল না কিছুক্ষণ। তারাপদর দীর্ঘ নিশ্বাস শোনা গেল।

সামান্য পরে ভারী গলায় তারাপদ বলল, “আপনি বাবার কথা তখন কী বলছিলেন? ভুজঙ্গই বাবাকে মেরেছে?”

কিকিরা বললেন, “সেকথাও বলব। তবে এখানে আর নয়–বাইরে চলুন।”

নিজের ঘরে এনে কিকিরা তারাপদদের বসালেন। আবার একবার দেহাতী চা খাওয়া হল। চন্দনের কাছ থেকে সিগারেট চেয়ে নিয়ে ধরালেন কিকিরা । জোরে-জোরে টান মারলেন। তারপর তারাপদর দিকে তাকালেন।

কিকিরা বললেন, “তারাপদবাবু, এবার আপনার বাবার কথা শুনুন। আপনার বাবাকে আমি কখনো চোখে দেখিনি। তবে তাঁর কথা শুনেছি। মানুষটি বড় ভাল ছিলেন, সরল সাদাসিধে। তাঁর মন খুব নরম ছিল, সামান্যতেই ছটফট করতেন, কেঁদেকেটে মরতেন। আপনার ছোট বোন পরী যখন ওইভাবে আচমকা একটা দুর্ঘটনায় মারা গেল, তিনি একেবারে পাগলের মতন হয়ে গেলেন।”

তারাপদ তখনকার কথা মনে করবার চেষ্টা করল। ওই বয়েসের কথা স্পষ্ট করে কিছুই মনে পড়ে না, অস্পষ্ট করেও বা কতটুকু মনে পড়তে পারে । পরী মারা যাবার পর সমস্ত বাড়িটাই কেমন ফাঁকা, ঠাণ্ডা হয়ে গিয়েছিল। বাবা, মা, সে নিজে–সকলেই যে যার মতন কেঁদে মরত।

কিকিরা বললেন, “মন একেবারেই ভেঙে গিয়েছিল আপনার বাবার। এই সময়ে মানুষ বড় দুর্বল হয়ে পড়ে। তার মতি নষ্ট হয়। আপনার বাবা সেই সময় পরলোক, আত্মা–এইসব ব্যাপার নিয়ে লেখা বইটই পড়তেন, নানা লোকের কাছে গল্প শুনতেন, লুকিয়ে লুকিয়ে প্ল্যানচেট করতে বসতেন। আপনার মা এ-সব একেবারেই পছন্দ করতেন না।…যাই হোক, এই সময় একবার আপনাদের সাধুমামা কলকাতার বাড়িতে এলেন। আপনার বাবা তাঁকে ধরলেন। সাধুমামাও আপনার বাবার অবস্থা দেখে তাঁকে ভুজঙ্গভূষণের কাছে নিয়ে যেতে চাইলেন। লুকিয়ে। সেই যাওয়াই কাল হল।”

তারাপদর বুকটা কেমন যেন করে উঠল। দুঃখে না রাগে বোঝা গেল না। উত্তেজনাতেও হতে পারে। কিকিরার দিকে সে তাকিয়ে থাকল।

“সাধুমামা বাড়ি ছেড়ে চলে যাবার দু-দিন দিন পরে আপনার বাবা চুরি করে লুকিয়ে ভুজঙ্গভূষণের কাছে হাজির। ভুজঙ্গকে হাতে পায়ে ধরলেন–আমার মেয়েকে একবার দেখান। ভুজঙ্গ তো মেয়ে দেখাল না, কিন্তু মেয়ের আত্মাকে দেখাল, যেমন করে আপনাদের দেখিয়েছে। মেয়ের পুরো হাতের একটা মোমের ছাঁচও দেখাল। সেই ছাঁচ বুকে করে আগলে আপনার বাবা কলকাতায় ফিরে এলেন। কিন্তু আসবার পথেই তাঁর মাথায় কী যে হল, একেবারে অন্য মানুষ। কথাবার্তা বলতেন না, কাজকর্মে যেতেন না, বোবা হয়ে থাকতেন, পাগলের মতন তাকাতেন। আপনার মা কিছুই জানলেন না। আপনার বাবার অসুখ করল–মাথার গোলমালের দরুনই হবে। অল্প ক’দিনের মধ্যে তিনি মারা গেলেন। সেই মোমের ছাঁচটার কী হল আমি জানি না। হয় আপনার বাবা নিজেই নষ্ট করে ফেলেছিলেন, না হয় আপনার মা কিছু না-জেনেই ফেলে দিয়েছিলেন।”

তারাপদর মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল। বুক ধকধক করছিল। চন্দনও যেন। বোবা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল।

কিকিরাও অনেকক্ষণ কথা বললেন না ।

চন্দন হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “মোমের ছাঁচ–মানে হাতের ওই ছাঁচ তৈরি করা যায়?”

কিকিরা বললেন, “যায়। পৃথিবীতে যেখানেই সেয়াঁসের আড্ডা বসে–সেখানেই এটা চালু আছে। আত্মা যে এসেছে তার প্রমাণ দেবার জন্যে ছাঁচ দেখানো হয়।”

“কেমন করে হয়?”

“সেটা আপনি এখানে আপনাদের দেখাতে পারব না। কারণ খানিকটা মোম আমি এ-জায়গায় জোগাড় করতে পারলেও রবারের একটা দুস্তানা জোগাড় করতে পারব না। তবে নিয়মটা বলে দিই । রবারের একটা দস্তানার মধ্যে জল ভরে দস্তানাটা ইচ্ছেমতন ফুলিয়ে নিতে হয়। তারপর সেটা ভাল প্যারাফিন বা মোমের মধ্যে ডুবিয়ে দিতে হয়। দস্তানার গায়ে মোম জমে গেলেই সেটা উঠিয়ে নিয়ে জলের পাত্রে ডুবিয়ে দিতে হয়। তারপদ দস্তানার ভেতরের জল ফেলে দিলেই রবারের দস্তানা কুঁচকে যাবে। সেটা বেরিয়ে আসবে । ছাঁচটা ঠিক থাকবে। এইভাবে আঙুল করা যায়, হাতের মুঠো করা যায়..। অনেক সময় এগুলো আগে থেকেই করা থাকে। সেয়াঁসের সময় লুকোনো জায়গা থেকে বার করে দেওয়া হয়।”

তারাপদ আর সহ্য করতে পারল না। রাগে, ক্ষোভে সে কাঁপতে লাগল। চিৎকার করে বলল, “এ সমস্তই তা হলে ধোঁকাবাজি? ব্লাফ?”

“সমস্তই।”

“আমার বাবাকে ভুজঙ্গ ভাঁওতা দিয়েছিল? আর বেচারি বাবা সেই ধোঁকাবাজিতে বিশ্বাস করে পাগল হয়ে গেল?”

“আমি তাই মনে করি। শুধু আমি কেন, আপনাদের সাধুমামা–মানে সাধনদাও তা জানে। সে এর সাক্ষী ।”

তারাপদ কেমন এক শব্দ করে উঠল। তারপর মুখ নিচু করে যেন মাথার চুল ছিঁড়তে লাগল নিজেরই। সে কেঁদে ফেলেছিল।

চন্দন চুপ। কিকিরাও চুপ। তারাপদকে সান্ত্বনা দিতেও পারছিলেন না।

কিছু পরে চন্দন চাপা গলায় বলল, “আপনি যা বললেন তা কি সবই সত্যি?”

কিকিরা বললেন, “সমস্তই সত্যিই। ঘণ্টা বাজানোই বলুন আর মোমের ছাঁচের কথাই বলুন, এর কোনোটাই আত্মা এসে করে দিয়ে যায় না। সবটাই ধোঁকা, চালাকি, হাত সাফাই । জাদুর রাজা হুডিনির নাম শুনেছেন? তিনি নিজে এইসব লোক-ঠকানো খেলা ধরে দিয়ে গেছেন। তাঁর বইয়ে যেমন-যেমন আছে, আমি ঠিক সেই-সেইভাবে ঘণ্টা বাজিয়েছি, রবারের দস্তানা থাকলে হাতের ছাঁচও গড়ে দেখিয়ে দিতাম।”

তারাপদ মুখ তুলল। তার মুখ কেমন যেন খেপার মতন দেখাচ্ছে, চোখের জলে গাল ভেজা। তারাপদ বলল, “ঠিক আছে, ভুজঙ্গকে আমি দেখছি। “ কিকিরা হাত তুলে বললেন, “না না, ওভাবে দেখা নয়। আমি বলে দেব কী ভাবে আপনারা তাকে দেখবেন। ভুজঙ্গ বড় চালাক, ভীষণ শয়তান। তা ছাড়া এটা কলকাতা নয়। এখানে ভুজঙ্গর অনেক শক্তি। তার সঙ্গে সোজাসুজি লড়া চলবে না। অন্য পথ আছে। চলুন–আপনাদের একটু এগিয়ে দিই। এগিয়ে দিতে দিতে বলব।“ কিকিরা উঠে দাঁড়ালেন।