স্যার,
আমার সশ্রদ্ধ সালাম জানবেন। অনেকদিন পর আপনাকে লিখছি। ব্যাঙের ডাকের ইংরেজীটা প্রথমে বলে নেই–Croak স্কুলে থাকার সময়ই ডিকশনারী ঘেঁটে ইংরেজীটা খুঁজে পেয়েছিলাম আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম। কিছু কিছু মানুষের জরুরী কথা ভুলে যাবার প্রবণতা থাকে। আমার তো খুবই আছে। আমি আপনাদের ছেড়ে চলে এসেছি আসার আগে সবচে জরুরী কথাটা বলতেও ভুলে গেলাম। সেটা হচ্ছে মানুষ হিসেবে আপনার তুলনা নেই। প্রতিষ্ঠান কখনো বড় হয় না। প্রতিষ্ঠানের পেছনে মানুষরা বড় হয়। জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুল ধ্বংস হতে বসেছে তা আমাকে তেমন আলোড়িত করছে না, ধ্বংস প্রাকৃতিক নিয়মেই হয়। ডাইনোসারের মত বিশাল প্রাণী লোপ পেয়েছে। কিন্তু স্কুল টিকিয়ে রাখার জন্যে আপনি যে একক যুদ্ধ শুরু করেছেন তা আমাকে অভিভুত করেছে।
মানুষ কঠিন পরিশ্রম করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভারেস্টের চুঁড়ায় উঠতে যায়। ব্যাপারটা সব সময় আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়। আপনাকে দেখার পর আর মনে হচ্ছে না। আপনাকে দেখার পর মনে হচ্ছে সব মানুষকেই তার ব্যক্তিগত এভারেষ্টের চূড়ায় উঠতে হয়। মানুষের এই হচ্ছে নিয়তি।
আপনার দুঃসময়ে আমি আপনাকে ছেড়ে চলে এসেছি। তার জন্যে আমি ক্ষমা প্রার্থী। আমি নিতান্তই দরিদ্র একজন মানুষ। বেঁচে থাকার সংগ্রামে আমাকে নামতে হয়েছে। আপনাকে ছেড়ে চলে এসেছি তার জন্যে আমার লজ্জার সীমা নেই।
আপনার ছাত্রদের আমি মোটামুটি ভাবে তৈরী করে দিয়েছি। আমি আমার সাধ্যমত করেছি। শহরের স্কুলগুলির সঙ্গে তারা পারবে কি না বলতে পারছি না। তবুও আশা করছি। শুনেছি দুএকদিনের ভেতর রেজাল্ট হবে। প্রবল আগ্রহ নিয়ে আমি তার জন্যে অপেক্ষা করছি।
স্যার চলে আসার দিন আপনি আমাকে বিদায় দিতে ষ্টেশন পর্যন্ত এলেন। আমার খুব ইচ্ছা করছিল–পা ছুঁয়ে আপনাকে সালাম করি। কেন জানি পারলাম না–ট্রেন ছেড়ে দেবার পর দেখি আপনি চোখ মুছছেন। একজন মানুষের জীবনের সঞ্চয় খুব বেশী থাকে না। আপনার চোখের জল আমার জীবনের পরম সঞ্চয়ের একটি। আপনি ভাল থাকুন–এই শুভ কামনা। আমি দূর থেকে আপনার পা স্পর্শ করে সালাম করছি। সালাম গ্রহণ করবেন-এই আমার বিনীত অনুরোধ।
স্যার আসব?
ইরতাজউদ্দিন সাহেব দরজার বাইরে থেকে উঁকি দিচ্ছেন। ফজলুল করিম সাহেব চিঠিটা ভাজ করে কোটের পকেটে রাখতে বললেন, আসুন। এস. এস. সির রেজাল্ট কবে হবে শুনেছেন কিছু?
যে কোনোদিন হতে পারে।
রেডিওর খবরটা প্রতিদিন মন দিয়ে শুনবেন। আমার রেডিও নেই। রেজাল্ট কেমন হবে মনে করছেন?
মওলানা জবাব দিলেন না। সবচে আশা যার উপর ছিল সেই বদরুল শেষ পরীক্ষার দুদিন আগে জ্বরে পড়ে গেল। শেষ পরীক্ষা দিয়েছে ১০৩ জ্বর নিয়ে। পরীক্ষার হল থেকে বেরুবা মাত্র তাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়েছে।
ফজলুল করিম সাহেব বললেন, রেজাল্ট তেমন কিছু হবে বলে আপনি বোধহয় আশা করছেন না।
জি-না।
হতেও পারে। রেডিওর খবর রোজ শুনবেন।
জ্বি আচ্ছা শুনব।
জ্বর গায়ে পরীক্ষা দিলেও ভুল তো কিছু করেনি? তাই না?
মওলানা জবাব দিলেন না। ফজলুল করিম সাহেব সরকারি চিঠিটা এগিয়ে দিলেন। ইরতাজউদ্দিন সাহেব চিঠি শেষ করে হেডমাস্টার সাহেবের দিকে তাকিয়ে দেখেন তার চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
মওলানা বললেন, মন শান্ত করুন। যা হয় সব আল্লাহপাকের হুকুমেই হয়। ফজলুল করিম সাহেব বললেন, এই স্কুলের চারপাশে মিলিটারী আমাকে নেংটো করে ঘুরিয়েছে। সেও কি আল্লাহর হুকুমে?
অবশ্যই। পরম মঙ্গলময় কিভাবে কি করেন তা বোঝার সাধ্য আমাদের নেই। স্যার আপনি শান্ত হোন। চলুন আপনাকে বাসায় দিয়ে আসি। চলুন।
ফজলুল করিম সাহেব প্রবল জ্বর নিয়ে বাসায় ফিরলেন। সেদিন সন্ধ্যাতেই রেডিও বাংলাদেশের স্থানীয় সংবাদে ঢাকা বোর্ডের রেজাল্ট প্রকাশের খবর ঘোষণা করা হল। বলা হল জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুলের মোঃ বদরুল আলম সম্মিলিত মেধা তালিকায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে। এই অসম্ভব গুরুত্বপুর্ণ খবরটি এলাকায় কেউ শুনল না। শুনলেও হয়তো বুঝতে পারলো না যে তাদের স্কুলের কথাই রেডিওতে বলা হচ্ছে।
রাত আটটার খবরের পর নীলগঞ্জ হাই স্কুলের নতুন এসিসটেন্ট হেডমাষ্টার মাহবুব সাহেব ছুটতে ছুটতে এলেন। তিনি সম্ভবত মনের ভুলে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছেন–আমাদের স্কুল সেকেন্ড স্ট্যান্ড করেছে। আমাদের জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুল।
তার পেছনে পেছনে এলেন নীলগঞ্জ স্কুলের অন্য শিক্ষকরা। রাত দশটায় জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল স্কুল লোকে লোকারণ্য হয়ে গেল। এমন আনন্দময় ঘটনা এই অঞ্চলের ইতিহাসে অনেকদিন ঘটেনি।
ফজলুল করিম সাহেব চলে এসেছেন। তাঁর শরীর কাঁপছে জ্বরের ঘোরে আনন্দে তা তিনি বুঝতে পারছেন না। বদরুল আলম এসেছে সে স্যারকে সালাম করবার জন্যে নিচু হতেই ফজলুল করিম সাহেব তাকে জাপটে ধরে ফেললেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন–আয় তো দেখি তোকে কোলে নিয়ে স্কুলের চারদিকে একটা চক্কর দিতে পারি কি না। আয়।…..
সত্যি সত্যি বদরুলকে কোলে নিয়ে ফজলুল করিম সাহেব দৌড়ানোর চেষ্টা করছেন। বদরুল স্যারের গলা জড়িয়ে ধরে আছে। সে খুব কাঁদছে। ফজলুল করিম সাহেবের সঙ্গে অনেকেই দৌড়াচ্ছে। শুধু তার অতি প্রিয়জন মওলানা ইরতাজউদ্দিন নেই।