১১. স্বপ্ন মনে রাখার ক্ষমতা

স্বপ্ন মনে রাখার ক্ষমতা জাহানারার অসাধারণ। অতি তুচ্ছ স্বপ্নও তাঁর মনে থাকে। ভোরবেলা ঘুম ভাঙতেই স্বপ্ন নিয়ে ভাবতে বসেন। স্বপ্ন তথ্যের উপর তাঁর দুটা বই আছে। একটার নাম স্বপ্ন ও তিলতত্ত্ব, অন্যটার নাম সোলেমানি খাবনামা। সোলেমানি খাবনামা বইটি তার অত্যন্ত প্ৰিয়। কারণ তাঁর বেশ কিছু স্বপ্ন সোলেমানি খাবনামায় দেয়া স্বপ্লের অর্থের সঙ্গে হুবহু মিলে গেছে। সোলেমানি খাবনামায় লেখা মাঢ়ির দাঁত পড়তে দেখলে মুরুব্বি মারা যান। জাহানারা একবার মাঢ়ির দাঁত পড়া স্বপ্ন দেখলেন। তার এক সপ্তাহের মধ্যে তার দাদিজান মারা গেলেন।

গতরাতে জাহানারা একটা স্বপ্ন দেখেছেন। স্বপ্নটা বেশ জটিল। সোলেমানি খাবনাময় জটিল স্বপ্ন নেই। জাহানারা খুবই চিন্তিত বোধ করছেন। বাড়িতে এমন কেউ নেই যে স্বপ্ন নিয়ে কথা বলবেন। শুভ্ৰ আছে। স্বপ্ন নিয়ে শুভ্রের কাছে যাওয়া যাবে না। তাছাড়া স্বপ্নটা শুভ্ৰকে নিয়েই দেখা।

যেন শুভ্রর বিয়ে হচ্ছে। বর-কনে পাশাপাশি বসা। আয়নায় মুখ দেখাদেখি হবে। একজন একটা আয়না নিয়ে এল। সেই আয়নায় মুখ দেখা যাচ্ছে না। কাচের পারা উঠে গেছে। শুভ্র বলল, মা এটা কী আয়না? এখানে তো কিছুই দেখা যাচ্ছে না। তিনি এসে আয়না। হাতে নিয়ে দেখেন— আয়না না, শুধু কাঠের একটা ফ্ৰেম। ফ্রেমটা সুন্দর। জাফরি কাটা। তাতে কী? শুভ্র রাগী রাগী গলায় বলল, কেউ কি একটা আয়না আনবে না? হাঁটু গেড়ে কতক্ষণ বসে থাকব? আমার পা ধরে গেছে। সবাই ছোটাছুটি করছে। কেউ আয়না খুঁজে পাচ্ছে না। শেষে বিনু একটা আয়না নিয়ে এল। এই হল স্বপ্ন।

সোলেমানি খাবনামায় আছে— আয়নায় মুখ দেখিলে চরিত্রহানী হয়। তিনি নিজে আয়নায় মুখ দেখেন নি। কাজেই খাবনামার এই অর্থ অবশ্যই গ্রহণযোগ্য হবে না। জাহানারা চিন্তিত মুখে বিছানা থেকে নামলেন। মুক্তার মাকে টাকা দিয়ে বাজারে পাঠাতে হবে। মুরগি কিনে আনবে। তিনি সদকা দেবেন। জাহানারা মনে প্ৰাণে বিশ্বাস করেন স্বপ্ন হচ্ছে আল্লাহপাকের ইশারা। তিনি স্বপ্নের মাধ্যমে তাঁর বান্দাদের সাবধান করে দেন। কেউ আয়না খুঁজে পেল না। বিনু খুঁজে পেল- এর মানে কি এই যে বিনু মেয়েটি চরিত্রহীনা? আয়নার সঙ্গে চরিত্রের একটা যোগ নিশ্চয়ই আছে।

জাহানারা বাথরুমে ঢুকলেন। অজু করে। ফজরের নামাজ আদায় করবেন। বেশ কিছুদিন হল তার ফজরের নামাজ কাজ হচ্ছে না। আজানের আগেই ঘুম ভাঙছে। এখানেও আল্লাহপাকের হাত আছে। আল্লাহপাক তাঁর পছন্দের বান্দাদের ফজর ওয়াক্তে ঘুম ভাঙিয়ে দেন। দুষ্ট লোকদের কাছে শয়তান চলে আসে। শয়তান তাদের পায়ে সুড়সুড়ি দেয়। মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। কাজেই ফজর ওয়াক্তে তারা কিছুতেই ঘুম থেকে উঠতে পারে না। দুষ্টলোকদের রাতের ঘুম ভাল হয় না, কিন্তু সোবে হাসাদেকের সময় গাঢ় ঘুম হয়।

নামাজে দাঁড়িয়ে জাহানারা শুনলেন বারান্দায় মেয়েলি গলার আওয়াজ। চুড়ির শব্দ। আবার যেন চায়ের কাপে চামচ নাড়ার শব্দও হচ্ছে। ব্যাপারটা কী? মুক্তার মা তো হতেই পারে না। তার ঘুম ভাঙাতে হবে ধাক্কাধাক্কি করে। তাছাড়া মুক্তার মা নিশ্চয়ই বারান্দায় বসে চা খাবে না। চুড়ির টুং-টাং শব্দ মুক্তার মার হতে পারে। তার হাত ভর্তি চুড়ি; জাহানারা সূরা পাঠে ভুল করে ফেললেন। তিনি নতুন করে সূরা ফাতেহা ধরলেন আর তখন স্পষ্ট শুনলেন, কে ফেন হাসছে। গলা অবিকল বিনুর মত। কিন্তু বিনু দেশের বাড়িতে। এতদিনে তার বিয়ে হয়ে যাবার কথা। সে থাকবে শ্বশুর বাড়িতে। এই বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাসবে না। জাহানার আবারো সূরা ফাতেহা-য় ভুল করলেন। ভুল ভাল নামাজ পড়ার কোনো মানে হয়। না। ব্যাপার কী- সেই খোঁজ নিয়ে এসে নামাজ শুরু করলে হয়। নামাজ একাগ্রতার ব্যাপার। আল্লাহকে ডাকতে হবে এক মনে। মাঝখানে যদি বিনু ঢুকে পড়ে তাহলে কীভাবে হবে! জাহানার নামাজ বন্ধ করে বারান্দায় এসে দেখেন বেতের ইজিচেয়ারে শুভ্ৰ আধশোয়া হয়ে আছে। তার হাতে মগ। সে চুকচুক করে কফি খাচ্ছে। কফির গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। কে তাকে কফি বানিয়ে দিল? মুক্তার মা কফি বানাতে পারে না।

শুভ্ৰ মাকে দেখে বলল, গুটেন টাগ।

জাহানারা বললেন, গুটেন টাগ আবার কী?

শুভ্র বলল, জার্মান ভাষায় গুটেন ট্যাগ হচ্ছে- শুভ দিন।

তুই আজ এত সকালে ঘুম থেকে উঠেছিস কীভাবে?

সারারাত ঘুমাই নি। কাজেই ঘুম থেকে উঠার প্রশ্ন আসে না।

ঘুমাস নি কেন?

ঘুম আসে নি বলে ঘুমাইনি। আমি কী করি জান মা? পুরোপুরি যখন ঘুম আসে তখন ঘুমুতে যাই। অনেকে আছে চোখে ঘুম নেই, বিছানায় পড়ে আছে। ভেড়া গুণছে। আমি ভেড়া গোণার দলে নাই। ঘুম ভাল মত আসবে— তারপর বিছানায় যাব।

জাহানারার কাছে মনে হল শুভ্ৰ বেশি কথা বলছে। হড়বড় করছে। সেতো। হড়বড় করার ছেলে না। তাছাড়া তার রাতে ঘুম কেন হবে না? ঘুম হবে না বুড়ো মানুষদের! এই বয়সের ছেলে বিছানায় যাবে। আর ঘুমিয়ে পড়বে।

তুই কি কফি খাচ্ছিস?

হু! তুমি খাবে?

কফি বানিয়ে দিল কে?

বিনু।

জাহানারা হতভম্ব গলায় বললেন, বিনু মানে? বিনু কোথেকে এল?

শুভ্ৰ পা নাচাতে নাচাতে বলল, বিনু এসেছে কাল রাত সাড়ে এগারোটায়। তুমি ঘুমুচ্ছিলে বলে জানতে পার নি।

জাহানারার চোখ মুখ শক্ত হয়ে গেল। তাঁর উচিত এই মুহূর্তেই বিনুর সঙ্গে কথা বলা। কথা বলতে গেলেই দেরি হবে। নামাজের সময় কাজ হয়ে যাবে।

বিনুর বিয়ে হয় নি?

জানি না তো মা। আমি জিজ্ঞেস করি নি।

নিশ্চয় বিয়ে হয় নি। বিয়ে হলে এ বাড়িতে এসে উঠত না।

শুভ্ৰ বলল, ওর বিয়ে হয়েছে কি হয় নি, এটা আমার কাছে তেমন জরুরি না। তোমার কাছে যদি জরুরি মনে হয় তুমি জিজ্ঞেস কর।

জাহানারা বিনুর ঘরের দিকে রওনা হয়েও শেষ পর্যন্ত গেলেন না। আগে নামাজটা শেষ হোক। কথাবার্তা যা বলার নামাজ শেষ করে বলবেন। অন্যদিন নামাজের পর কিছুক্ষণ কোরান পাঠ করেন। আজ মনে হয় কোরান পাঠ হবে না।

নামাজে দাঁড়িয়ে জাহানারার অন্য একটা কথা মনে এল। বিনুর ঘরতো। তালাবন্ধ ছিল। সেই তালার চাবি ছিল তাঁর কাছে। তাহলে ঘরের তালা কীভাবে খোলা হল? তালা ভাঙা হয়েছে? তোলা ভাঙা হলে তালা ভাঙার শব্দে তার ঘুম অবশ্যই ভাঙতো! ঘুম যখন ভাঙেনি কাজেই তালা ভাঙা হয় নি। তাহলে রাতে বিনু কি শুভ্ৰর ঘরে ছিল? শুভ্ৰ যে সারারাত ঘুমুতে পারে নি তা কি এই কারণে? বিনুর সঙ্গে গল্পগুজব করে রাত পার করেছে। বিনুর আবার গল্প কী? বিনু যা করেছে তা হল ছেলে ভুলানো কৌশল। চা-কফি বানিয়ে খাইয়েছে। শুভ্রর প্রতিটা কথা মুগ্ধ হয়ে শুনেছে যেন এমন কথা সে ইহজীবনে শুনে নি।

জাহানারা আবারো নামাজে ভুল করলেন। এতো দেখি ভাল সমস্যা হয়েছে। বারবার নামাজে ভুল হচ্ছে। বিনুর সঙ্গে কথা বলে পুরো ঝামেলা শেষ করে এসে জায়নামাজে দাঁড়ালে সবচে ভাল হত। জাহানারা কোনমতে নামাজ শেষ করে নিজের ঘরে এসে বিনুকে ডেকে পাঠালেন।

বিনু জাহানারাকে সালাম করে ক্ষীণ স্বরে বলল, চাচি কেমন আছেন?

জাহানারা কিছু বললেন না। তীক্ষ্ণ চোখে বিনুকে লক্ষ করতে লাগলেন।

গায়ের রঙ সামান্য ময়লা হয়েছে। এটা হবেই। শহর থেকে গ্রামে গেলে রঙ ময়লা হয়। একটু রোগা হয়েছে। সেটাও স্বাভাবিক। গ্রামে নিশ্চয়ই খেয়ে না খেয়ে থাকে। তবে আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে মেয়েটা সুন্দর হয়েছে। সুন্দর হবার রহস্যটা কী? বিয়ের আগে আগে মেয়েরা সুন্দর হয়। এরুতে বিয়ে হয়ে যাবার কথা। বিয়ে হয়ে যাবার পর মেয়েরা আগের অবস্থায় ফিরে যায়।

তোমার বিয়ে হয়ে গেছে না?

বিনু নিচু গলায় বলল, জ্বি না।

বিয়ে হয় নি কেন?

ঝামেলা হয়েছে। গ্রামের বিয়েতে অনেক ঝামেলা হয়।

ঝামেলা হয়। আবার ঝামেল মিটেও যায়। তোমারটা মিটাল না কেন?

চাচি আমার ভাগ্যতো সব সময়ই খারাপ।

এত রাতে ঢাকায় এলে কেন? দিনে আসতে পারতে।

সকালেই রওনা হয়েছিলাম। দিনে দিনে পৌঁছতাম। বাস নষ্ট হল দুবার।

তোমার সঙ্গে কে এসেছে?

আমি একই এসেছি। সঙ্গে কেউ আসে নি।

জাহানারা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। এই মেয়ে কী বলছে? রাত সাড়ে এগারোটায় ঢাকা শহরে একা উপস্থিত হয়েছে। ঢাকায় আসার তার দরকারটা কী? বিয়ে ভেঙে গেলে ঢাকায় চলে আসতে হয়? বাড়ি থেকে তাকে একা ছাড়লইবা কী মনে করে!

তোমার ঘরতো তালাবন্ধ ছিল। তালা কে খুলে দিল?

ভাইজান খুলে দিয়েছেন।

ও চাবি কোথায় পেল?

তার দিয়ে কী করে যেন খুলেছেন।

জাহানারার মাথায় আরো অনেক প্রশ্ন ঘুরছে। প্রশ্নগুলি গুছিয়ে নেয়া দরকার। তিনি এখন মোটামুটি নিশ্চিত যে বিয়ে ভাঙেনি। এই মেয়ে নিজেই পালিয়ে চলে এসেছে। পালিয়ে না এলে কেউ না কেউ মেয়ের সঙ্গে আসত। তারচেয়েও বড় প্রশ্ন হচ্ছে পালিয়ে যদি সে এসেও থাকে, এ বাড়িতে আসবে কেন? এমনতো হয় নি যে শুভ্ৰ তাকে চলে আসতে বলেছে। তাও বা কী করে সম্ভব? শুভ্ৰ এই মেয়ের বাড়ির ঠিকানা জানবে কী করে! জাহানারা অন্ধকারে চিলা ছুঁড়লেন। খুব স্বাভাবিক গলায় বললেন, শুভ্ৰ কি তোমাকে তোমাদের গ্রামের বাড়ির ঠিকানায় কোনো চিঠি দিয়েছে?

বিনু কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে শান্ত গলায় বলল, জ্বি দিয়েছেন।

চিঠিটা কি তোমার সঙ্গে আছে?

জ্বি আছে। আমাকে একটু দিয়ে যাও তো।

বলেই জাহানারা দাঁড়ালেন না। মেয়ে যেন বলার সুযোগ না পায়- চিঠিটা আপনাকে দেয়া যাবে না। আমাকে লেখা ব্যক্তিগত চিঠি আপনি কেন পড়বেন?

জাহানারা রান্নাঘরে গেলেন। গ্যাসের চুলায় কেটলি দেয়া আছে। পানি ফুটছে। তিনি মুক্তার মাকে ডেকে না তুলে নিজেই নিজের জন্যে চা বানালেন। বিনু চিঠি নিয়ে আসছে না। মনে হয় সে আসবে না। যদি না আসে তার কি উচিত। হবে। আরেকবার চাওয়া? নিশ্চয়ই উচিত হবে। তাঁর অধিকার আছে সংসারের ভাল মন্দ দেখার। জাহানারা ঠিক করলেন, চা শেষ করেই মুক্তার মাকে দিয়ে বিনুকে ডেকে পাঠাবেন। ব্যক্তিগত চিঠি আবার কী? এই পৃথিবীতে ব্যক্তিগত বলে কিছু নেই।

বিনুকে ডেকে পাঠাতে হল না। খামে বন্ধ চিঠি সে নিজেই দিয়ে গেল। খামের উপর শুভ্রর হাতের লেখা ঠিকানা।

আফরোজা বেগম (বিনু)
গ্ৰাম : সোহাগী
পোষ্ট : সোহাগী
জেলা : নেত্রকোনা।

বিনুর ভাল নাম যে আফরোজা বেগম তা তিনি জানেন না। অথচ তার ছেলে জানে। এটা কি বিস্ময়কর কোনো ঘটনা না? অবশ্যই বিস্ময়কর ঘটনা। জাহানারার হাত কাঁপছে। তাঁর মনে হচ্ছে মূল চিঠিতে তাঁর জন্যে আরো অনেক বিস্ময় অপেক্ষা করছে। বিনু টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে আছে। জাহানারা বললেন, তুমি দাঁড়িয়ে আছ কেন? তুমি যাও। চিঠি পড়া শেষ হলে তোমার চিঠি আমি তোমাকে ফেরত দেব।

বিনু চলে গেল। জাহানারা চিঠি পড়তে শুরু করলেন। চশমা ছাড়া কাছের লেখা আজকাল তিনি পড়তে পারেন না। এই চিঠি চশমা ছাড়াই পড়তে হচ্ছে। চশমার জন্যে অপেক্ষা করার ধৈর্য তাঁর নেই। জাহানারা ঠিক করলেন কোনো মতে একবার পড়ে দ্বিতীয়বার চশমা চোখে দিয়ে ভালমত পড়বেন। দুবার কেন, দরকার হলে তিনবার চারবার পড়বেন। চিঠি নিয়ে শুভ্রর সঙ্গেও কথা বলবেন। বিনুকে যে চিঠি ফেরত দিতেই হবে তাও না। হাতের লেখা চিঠি মানে দলিল প্রমাণ। দুষ্ট মেয়েটার হাতে কোনো দলিল রাখা যাবে না। চিঠিটা অবশ্যই নষ্ট করে দিতে হবে।

শুভ্র লিখেছে—

বিনু, আমি বলেছিলাম তোমাকে চিঠি লিখব। লিখলাম। দেখেছি। আমি কথা রাখি। সবচে আশ্চর্যের কথা হচ্ছে। আমি তোমার গ্রামের ঠিকানাও মনে রেখেছি। তুমি বললে, ঠিকানা লিখে রাখেন— নয়ত আপনার মনে থাকবে না। আমি বললাম, আমার স্মৃতি শক্তি অত্যন্ত ভাল। মনে রাখার জন্যে আমি যা শুনি, তা মনে রাখি। তোমাকে স্মৃতি শক্তির একটা পরীক্ষাও দিয়ে দিলাম। এই মুহূর্তে তুমি আমার চিঠি পড়ছ— কাজেই স্মৃতি শক্তির পরীক্ষায় আমি পাশ করেছি।
এখন বল তুমি কি আমার চিঠির জন্যে অপেক্ষা করেছ? মনে পড়েছে আমার কথা? বিয়ের নানান ঝামেলায় মনে না পড়ারই কথা। বিয়ে একটি মেয়ের জীবনের অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। এই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটার আগে চারপাশের জগৎ তুচ্ছ ও অস্পষ্ট হয়ে যাবার কথা।
তুমি আমার কথা মনে কর বা না কর আমি অনেকবারই তোমাকে ভেবেছি। মাঝে মাঝে গভীর রাতে ঘুম ভেঙেছে। চা খেতে ইচ্ছা করেছে। তখন মনে হয়েছে- বিনু থাকলে বেশ হত। চা বানিয়ে আনত। দুজনে চা খেতে খেতে গল্প করতাম। আমরা গল্প করতাম বলাটা ভুল হচ্ছে। আমি গল্প করতাম তুমি শুনতে। আমার সব সময় মনে হয়েছে তুমি খুব আগ্রহ নিয়ে আমার গল্প শুনতে। এখন কেন জানি মনে হচ্ছে তোমার আগ্রহটা ভদ্রতা সূচক। একজন মানুষ যদি মজার গল্প বলার চেষ্টা করে তাহলে সেই গল্প শুনে মজা পাবার ভান করাটা ভদ্ৰতা। তুমি ভদ্রতা কর বা যাই কর মাঝরাতে তোমার সঙ্গে গল্প করতে আমার সব সময় ভাল লাগতো। এই ব্যাপারটা আমি বুঝতে পারি। তুমি চলে যাবার পর। হঠাৎ হঠাৎ মজার কোনো কথা আমার মনে হত তখনই মনটা খারাপ হত। কাকে এই মজার গল্প শুনাব?
চিঠি অনেক লম্বা হয়ে গেল; আমি নিজে কখনো দীর্ঘ চিঠি পড়তে পারি না। বিরক্তি লাগে। এই জন্যে খানিকটা অস্বস্তি বোধ করছি। মনে হচ্ছে তুমিও এই দীর্ঘ চিঠি হাতে নিয়ে বিরক্ত হবে।
তুমি ভাল থেকে। তোমার নতুন জীবন সুন্দর, আনন্দময় এবং মঙ্গলময় হোক। এই শুভ কামনা।
ইতি
শুভ্র

পুনশ্চ : তোমাকে মিস করছি। এটা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু না। মানুষকে সব সময়ই কিছু না কিছু মিস করতে হয়; কোনো কিছু মিস করাতেও এক ধরনের আনন্দ আছে।

জাহানারা চিঠি হাতে স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। চশমা চোখে দিয়ে দ্বিতীয়বার এই চিঠি পড়ার কোনো ইচ্ছাই তার হচ্ছে না।

বারান্দা থেকে শুভ্ৰ আনন্দিত গলায় বলল, মা শুনে যাওতো। জাহানারা টেবিলে চিঠি ফেলে উঠে গেলেন। শুভ্র বলল, আজকের খবরের কাগজটা পড়েছ?

জাহানারা চাপা গলায় বললেন, না।

একটা ছ বছর বয়েসী মেয়ের খবর ছাপা হয়েছে। মেয়েটা স্বপ্নে একটা মন্ত্র পেয়েছে। মন্ত্র পড়ে মাটিতে ফুঁ দিয়ে যাকে মাটি খাওয়ানো হয় তার সব অসুখ সেরে যায়।

ভালোইতো।

হাজার হাজার মানুষ লাইন বেঁধে মাটি খাচ্ছে। টনকে টন মাটি শেষ হয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় কলেজের প্রিন্সিপ্যাল সাহেব বলেছেন মাটি খেয়ে তাঁর দীর্ঘদিনের হাঁপানি সেরে গেছে।

জাহানারা বললেন, তুই এত উত্তেজিত কেন? তোর কি কোনো অসুখ বিসুখ আছে যে মাটি খেতে হবে?

শুভ্ৰ বলল, মেয়েটার সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছে মা।

চলে যা। কথা বলে আয়।

পুরো নিউজটা তোমাকে পড়ে শুনাব। এই চেয়ারটায় আরাম করে বোস। আর বিনুকে ডাক। বিনু খুবই মজা পাবে।

জাহানারা বললেন, তুই বিনুকেই পড়ে শোনা। আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। আমি শুয়ে থাকব।

শুভ্র বলল, এইত রোগ পাওয়া গেছে। তোমার ভয়াবহ মাইগ্রেন ব্যাধির জন্যে মৃত্তিকা-চিকিৎসা। সকালে এক চামচ মাটি। বিকেলে এক চামচ।

শুভ্ৰ হাসছে। তার আনন্দিত মুখ দেখে জাহানারার বুকে ধাক্কার মত লাগল। তার ছেলে এত আনন্দিত কেন? মাটি চিকিৎসার খবরে আনন্দিত, না-কি বিনু নামের মেয়েটি চলে এসেছে বলে আনন্দিত?

মা দাঁড়িয়ে আছ কেন? বোসতো। বোস। ভোরের পবিত্র আলোয় তোমার মুখ দেখি।

জাহানারা বসলেন। শুভ্র তাঁর দিকে ঝুঁকে এসে বলল, আচ্ছা মা ভোরের আলোকে পবিত্র আলো বলা হয় কেন বল দেখি? ভোরের আলো পবিত্র। দুপুরের আলো কি অপবিত্ৰ?

জানি না।

তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি কোনো কারণে খুব আপসেট। বলো দেখি কী হয়েছে?

কিছু হয় নি।

শুভ্র আনন্দিত গলায় বলল, তুমি কী কারণে আপসেট আমি বের করে ফেলেছি। বিনুকে দেখে তুমি আপসেট হয়ে গেছ।

ওকে দেখে আমি আপসেট হব কেন?

তোমার মনের ভেতর নানা ধরনের current and counter current. বিনু সেখানে…

চুপ কর এইসব নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।

কী নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছা করছে?

কোনো কিছু নিয়েই কথা বলতে ইচ্ছা করছে না।

গল্প শুনবে?

গল্প?

হ্যাঁ গল্প। কাল রাতে বিনুকে গল্পটা বললাম। সে খুবই মজা পেয়েছে। গল্পটা হল চক্র গল্প। যেখান থেকে গল্পটা শুরু হয়। আবার সেখানেই ফিরে আসে–তারপর চক্রের মত ঘুরতে থাকে। যে গল্প শুনে সে খুবই বিরক্ত হয়।

জাহানারা বললেন, বিনু নিশ্চয়ই বিরক্ত হয় নি?

শুভ্র বলল, ঠিক ধরেছ, বিনু বিরক্ত হয় নি। যারা বুদ্ধিমান তারা গল্পটাতে মজা পায়। এই গল্প দিয়ে মানুষের বুদ্ধিও পরীক্ষা করা যায়। তুমি যদি এই গল্প শুনে মজা না পাও যদি বিরক্ত হও তাহলে বুঝতে হবে তোমার বুদ্ধি কম।

আমার বুদ্ধি কম-না বেশি তার জন্যে পরীক্ষার দরকার নেই। আমি জানি আমার বুদ্ধি কম।

শুভ্ৰ গম্ভীর গলায় বলল, মা তুমি ব্যাখ্যা করতো বুদ্ধি কী? আমার মনে হচ্ছে তুমি ব্যাখ্যা করতে পারবে না। জ্ঞান কী তা ব্যাখ্যা করা যায়– বুদ্ধি চট করে ব্যাখ্যা করা যায় না। আমার কাছে একটা ব্যাখ্যা আছে। শুনবে?

বল শুনি।

জ্ঞান হল স্মৃতি, মেমরি। সেই স্মৃতি ব্যাখ্যা করার ক্ষমতার নাম বুদ্ধি। কিছু বুঝলে?

বিনুকেও নিশ্চয়ই এই কথাগুলি বলেছিস। সে বুঝেছে?

শুভ্ৰ মার দিকে তাকিয়ে হেসে ফেলল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *