মাল্যবান যা-ই মনে করুক না কেন, স্ত্রী সন্তানের পাট চুকিয়ে দিয়ে একা-একা আইবুড়ো থেকে জীবন কাটানো খুব শক্ত হত তার পক্ষে! গোল-দীঘিতে ঘুরে-ঘুরে বারো-চৌদ্দ বছর সে অনেক হাওয়াই ফসল ফলিয়ে গেছে; সমাজসেবা, দেশস্বাধীনতার জন্যে চেষ্টা, বিপ্লবের তাড়না-তেজ, নিবৈপ্লবিক মনের চারণা, উনিশ শতকের নিশায়মান সমুদ্রতীর : সাহিত্যের ধর্মের মননের : বিশ শতকের উপচীয়মান আবহমান রক্ত রৌদ্র ছায়া জ্বালা সমুদ্রসঙ্গীত—নানা রকম অপর রকম জীবনের অর্থ ও উদ্দেশ্যকে ঈর্ষা করেছে–নিজের জীবনটাকে অনেক সময়েই অসার ও নিষ্ফল মনে হয়েছে তার। কিন্তু, তবুও, এই পাকা চাকরিটুকু, স্ত্রী ও মেয়ে, কলেজ স্ট্রীটের ঘর তিনখানা এর চেয়ে অন্য কোনো সাফল্যের উত্তমর্ণনাত তার জীবনে কোনো দিন ঘটে উঠত কি?
সে নিজে যখন খুব স্থির হয়ে ভাবে, বোঝে—জীবনের কাছ থেকে যথাযথ প্রাপ্য সে পেয়েছে। সে জানে, জীবনটা তার এর চেয়ে ঢের খারাপ হতে পারত। যদিও মৃগনাভির গন্ধে মাঝে-মাঝে অধীর হয়ে উঠে গোলদীঘিতেই এবং নিজের একতলার ঘরের রাতের বিছানায়ই সে পাক খেয়েছে সবচেয়ে বেশি, কিন্তু তবুও সে বুঝেছে যে, তার নিজের সাংসারিক জীবনটা কস্তুরীমৃগ নয়, বে-সংসারীও নয়; সাংসারিক সফলতার চূড়ান্তে উঠেযে-সব লোক টাকাকড়ি যশ মদ মেয়েদের নিয়ে সন্তপ্ত হয়ে আছে দিনরাত, তারা কি জানে তারা কী–কে—চলেছে কোথায়! তারা জানে না! তাদের অন্তঃশীলা আত্মা ঠিক নয়—তাদের নিম্ননাভির গন্ধ এ-দিকে সেদিকে ফেলে দিচ্ছে তাদের; মাঝে-মাঝে মাল্যবানের মতন পথের পাশের একজন লোককেও সচকিত-আলোড়িত করে তুলছে। কিন্তু মাল্যবান জানে, এ-নাভি তার নিজের নয়—এ-সব ওদের।
এক দিন মা বেঁচেছিলেন। মা খুব স্নেহ সরসতার মানুষ ছিলেন; কিন্তু তখনই কলকাতায় প্রথম চাকরি শুরু করে মার সঙ্গে শ্যামবাজারের একটা একতলা বাড়িতে এক কোঠায় যে-দিনগুলো কাটিয়েছে সে-প্রত্যেকটা দিনের কথা মনে আছে তার: সহজ কঠিন মৃদু নিরেস, কেমন নির্জনলা জলীয় দিনগুলো জীবনের। ভাবত, মাকে মানুষ সূতিকাঘরের থেকেই পায় কি-না—রোজই পায়-অনেক পায়—জননীগ্রন্থি কেটে যায় তাই শীগগিরই—নতুনত্ব হারিয়ে যায়। ভাবত, মানুষের জীবনে এমন একটা সময় আসে, যখন মায়ের মমতা সজলতা এত স্বাভাবিক বলেই অনোজলবাতাসের মতো সুলভ মনে হয়; একজন অপরিচিত মেয়েকে মনে ধরলে তার সহজ ভেবে নিতে সময় লাগে; কাছে থাকলেও দূর—তার স্বচ্ছ সরল প্রকাশ ভানুমতীর খেলার মতোই আপতিত হচ্ছে কী সহজে—কিন্তু তবুও কী রকম আঁধার, কঠিন, নিবিড়!
এই সব ভেবে-ভেবে কেমন কুণ্ঠিত হয়ে পড়ত মাল্যবানের মন; মার কাছে ঘাট হয়েছে বলে তার প্রতি শ্রদ্ধায়, পথে-ঘাটে-মনে-ধরে-গেছে নারীটির প্রতি উদাসীনতায় এবং নিজের প্রতি ধিক্কারে নিজেকে সে সজাগ করে রাখত।
মাল্যবান যখন বিয়ে করেনি, নিজের অফিসের বিবাহিত কেরানীদের হপ্তাকাবারী অভিযান দেখে এমন গুমড়ে উঠত তার! উৎপলাকে নিজের ঘরে আনার থেকে আজ পর্যন্ত যখনই কোনো মানুষের স্ত্রীবিয়োগের কথা শুনেছে, মাল্যবান, সে-মানুষটিকে জাদুঘরের কুলকিণারায় দেখা অতীব মৃত জিনিসের মতো অতীতের আনন্ত্যের কুয়াশা-ঘরে লীন হয়ে থাকতে দেখেছে সে—অনুভব করেছে, ও-মানুষের কোনো ভবিষ্যৎ নেই; সে-জীবনের শূন্যতা কল্পনা করে অস্বস্তি বেদনার অভিজ্ঞতায় কেমন যেন অন্য আর এক রকম ধার শানিয়ে উঠেছে তার। নিজের স্ত্রী যে বেঁচে আছে, এ-সান্ত্বনা ভেতরে-ভেতরে গুছিয়ে নিয়ে সারাদিন অফিসের ডেস্কে, সারারাত নিচের ঘরের বিছানায় কম্বলের নিচে নিশ্ৰুপ শান্তির ভেতর একটার-পর একটা বিদায় দিয়েছে—গ্রহণ করেছে।
এই সব হচ্ছে মাল্যবানের জীবনের ভিতের কথা, ভিত্তিচিত্রের কথাও। সে একা থাকতে পারে না, মার সঙ্গে থাকে তাই; কিন্তু তবুও মায়ের ভালোবাসা সান্নিধ্য তার কাছে কালক্রমে একা থাকার সামিল বলে মনে হয়; বিয়ে না করলে তার চলে না; স্ত্রীকে ঘুচিয়ে দিয়ে একা পথ চলবার কোনো শক্তিই তার নেই।
কিন্তু জীবনের খুঁটিনাটি ব্যাপারে এই দাম্পত্যজীবনেরও নানা রকম খাব সে। ঝড়তি-পড়তি নষ্ট ফসল পচা হাড়মাংসের গন্ধে ভরে উঠছে সব। উৎপলার উদাসীনতা ঠিক নয়, খুব সম্ভব অপ্রেম-দিনের-পর-দিন স্বচ্ছ হয়ে আসছে যেন, অতল স্বচ্ছতায় যে-রূপ দেখা যাচ্ছে তার তাতে মনে হচ্ছে, কোনো দিনই প্রেম-প্রীতি ছিল না মাল্যবানের জন্যে উৎপলার। না থাকলে না থাকবে। অন্যদের জন্যে প্রীতি? অন্য কারু জন্যে প্রেম? তাই হোক। কিন্তু তবুও উৎপলাকে বহন করে বেড়াতে হবে মৃত্যু পর্যন্ত? উৎপলাও তাকে তাই করবে বুঝি? চোখের সামনে অন্যদের প্রতি উৎপলাকে স্পষ্ট অনুরক্ত হয়ে পড়তে দেখে—সে-জায়গা থেকে একটু গা বাঁচিয়ে সরে যেতে হবে বুঝি মাল্যবানকে? আলখাল্লাপরা একজন চীন, একজন গ্রীক দার্শনিকের মতো আকাশের তারার পাতালের বালি মানুষের জীবনের মিছে সমারোহকে যে নিমেষেই গ্রাস করে চলেছে, সেই উপলদ্ধিতে স্থির হয়ে নিতে আবার—তারপরে বেশি রাত হলে টেবিলে খেতে বসে খোশগল্প করতে হবে স্ত্রীর সঙ্গে আর মেয়ের সঙ্গে?
বিয়ের আগের দিনগুলোকে তার শীতের আগে হেমন্তের, হেমন্তের আগে শরতের ক্ষেতে মাঠে রোদে মানুষের মুখে পাখির কথায় যে অবিনেশ্বর সম্ভাবনা থাকে হেমন্তের, যে মহাপ্রাণ কুহক থাকে আসন্ন শীতের রাতের, সেই রকম মনে হয়েছে–
চলে যেতে পারে সে কি আবার বিয়ের আগের সেই পৃথিবীর দেশে? প্রশ্নটা পাড়া-মাত্রই তার উত্তর মেলে: মানুষ তো মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে, পিছে ফিরে যেতে পারে না তো সে আর। তবে উৎপলা মনুকে বাদ দিয়ে মৃত্যুর দিকে এগোতে পারা যায় বটে—একা। মার আমলে পারেনি, কিন্তু বৌ পায়ে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তাকে; সজ্ঞানে হেঁটে চলে যেতে পারে সে অন্ধকারে ভেতর দিয়ে–অজ্ঞান মৃত্যুর দিকে। পারে।
কিন্তু সাময়িক এই সব ইচ্ছা চিন্তা। মাল্যবানের মনের ভেতর কোনো পৃথিবী ঘুরে বিদ্রোহী বা ভাবুক নেই যে তা নয়; শয়তান জোচ্চোর অমানুষও রয়েছে, কিন্তু সবের ওপরে মানুষ সত্য হয়ে রয়েছে একজন সাধারণ ধর্মভীরু ও ভীরু মানুষ। একটি সাধারণ স্নেহশীল ধর্মভীরু ভীরু বৌ যদি সে পেত, তাহলে এ-দুটি সাদাসিধে জীবন পৃথিবীকে বিশেষ কোনো সফলতা বা নিস্ফলতার দান না রেখে শান্ত ভাবে শেষ হয়ে যেতে পারত এক দিন। কিন্তু তা তো হল না, নষ বশ্য ঘরজোড়া স্নিগ্ধতা হল না, খড়খড়ে আগুন খড়ের চমৎকার অগ্নি-ডাইনীর মতো হল মাল্যবানের বিয়ে আর বৌ আর বিবাহিত জীবন।
উৎপলা দেখতে বেশ; শুধু বেশ বললে হয় না—এমনিই বেশ। সুস্থ। রুচি ও বুদ্ধির ধার মাঝে-মাঝে বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে; হৃদয়ের বিমুখতা ও কঠিনতাও তার এক-এক জায়গায় এক-এক জন মানুষের তাপ বা জ্ঞান-পাপের ছোঁয়ায় মোমের মতো গলে দাম্পত্য আবহে ফিরে এসে মোমের মতো শক্ত ঠাণ্ডা হয়ে ওঠে আবার। কুমারী হিসেবে এই মেয়েটির বেশ দাম ছিল—নারী হিসেবেও। কিন্তু মাল্যবানের মতো এ-রকম একজন লোকের বৌ হয়ে ঠিক হল না তার। উৎপলার বন্ধুবান্ধবের অভাব নেই। বাপের বাড়ির দেশের ঢের লোক তাকে চেনে—ভালোবাসে—কাছে আসে তার; কলকাতায় এসে এদেরই মারফৎ আরো অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়েছে তার; দশ-পঁচিশ মিনিট উৎপলা, উৎ, পলা, ইত্যাদির সঙ্গে এক শো রকম মানুষ এক শো রকম ভাবের কথা বলে যাবার প্রয়োজন প্রায়ই বোধ করে; এই সব বিমিশ্র ভিড় এক সময় খুব বেশি আসত; আনাগোনা এখন খানিকটা কমেছে বলে মনে হচ্ছে; শীগগিরই বাড়বে আবার তাও মনে হচ্ছে। যারা যাওয়া-আসা করে এ বাড়িতে—কেউ থাকে পনেরো মিনিট, কেউ দু তিন ঘণ্টা। সটান দোতলায় উৎপলার কাছে চলে যায় প্রায় সকলেই তারা; মাল্যবান নিচের ঘরে বসে খবরের কাগজ পড়ছে, চুরুট টানছে, দেখে বা না দেখে তারা সবটুকু দেখে নিয়েছে, অনুভব করে কৌতুক বা ক্লান্তি বা কঠিনতা বোধ করে। কিন্তু মাল্যবানের সঙ্গে বিশদ আলাপচারির আবশ্যকতা কেউই বড় একটা বোধ করে না। কেউ কেউ এও জানে যে, এ-মানুষটাকে এর স্ত্রী একেবারেই গ্রাহ্য করে না। এ-রকম উপলব্ধির পর সময়ের—পৃথিবীর স্তনাগ্রচুড়ায় অনতিদূর শঙ্খিনীকে চের বেশি সরস বলে মনে হয়—ভীরু দুরুদুরু বুকের সাহস ও কাম নিয়ে তার দিকে এগিয়ে যেতে-যেতে। মাল্যবান দেখেছে, জেনেছে, উপলব্ধি করে দেখেছে সব। দেখেছে, তার চেনা-আধোচেনা মানুষেরা কী রকম অনিমেষ বিদ্যায় ওপরে চলে যাচ্ছে তাদের কী রকম তাগিদ—কতো তাড়া! সে যে নিজে একজন প্রাণী নিচের ঘরে রয়েছে—এ বাড়িটাও সে তার সেটা কোনো কথা নয়——কথাটা সত্যিই খুব ঠিক।
যারা ওপরে যায়, তারা কেউ লজ্জিত হয়েও ফিরে আসে না তো। কেউ কেউ অনেকক্ষণ তো বৈঠক জমায়; হাসি তামাশা রগড় গুণা ছিটে ফোঁটায় ফেনায় ছিটকে আসে নিচের ঘরে। মাল্যবান মাঝে-মাছে অবাক হয়ে ভাবে—কথা ভাবে। কথা ভাবা কালো ধুমসো পাখিদের নীড় তার মাথাটা। আচমকা একটা সিগারেট জ্বালিয়ে বা দড়াম করে জানালার কপাটটা খুলে ফেলে পাখিগুলোকে উড়িয়ে দেয় সে। যারা ওপরে যায়, তাদের পেছনে পেছনে সে ওপরে যায় না কোনো দিন; কাউকেই কিছু বলতে যায় না। যখন দোতলার ঘরে আসর খুব জমে উঠেছে, তখনও ওপরে যেতে কেমন দ্বিধা বোধ হয় তার; যখন রাত বেশি, উৎপলার ঘরে লোক কম—দুটি কি একটি——খুব সম্ভব একটি—তখন সে কিছুতেই ওপরে যায় না : মন দিয়ে করেছে, চোখ দিয়ে সকলের জীবনের সব তলানি আবিস্কার করতে চায় না।
চৌবাচ্চায় স্নান করে—ঠাকুরের কাছ থেকে ভাত নিয়ে খেয়ে সে অফিসে চলে যায়। কিংবা সন্ধ্যেবেলা যখন ওপরের আড্ডা জমে, তখন আস্তে-আস্তে স্টিক হাতে গোলদীঘির দিকে চলে যায়। হাঁটতে-হাঁটতে ভাবে : কটা দিন আর? এই স্কোয়ারে পাক খাচ্ছি—চোখের পলকেই কুড়িটা বছর শাঁ করে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাবে আমার, উৎপলার; দেখতে-দেখতে চুল পেকে যাবে ওর, দাঁত পড়ে যাবে, তারপরে সব ভেঁ-ভাঁ। ভাবতে-ভাবতে কুড়ি বছরের পাল্লা সত্যিই, দ্যাখ, পেরিয়ে গেছে, সে—জীবনটা এখন বেশ নিরালা, নিঃশব্দ; একটা অতিরিক্ত কাক, একটা ওপরপড়া বেড়াল নেই কোথাও; রোদে বাতাসে নির্ভাবনা ছড়িয়ে আছে চারদিকে; যত চাও, ততো! কতো নেবে? ভাবতে-ভাবতে ক্ষমার ক্ষমতায় বোশেখ-জ্যৈষ্ঠের মাটির শিরায় শিরায় শ্রাবণের রস এসে পড়ে যেন। চুরুট জ্বালিয়ে নেয় মাল্যবান।
কুড়ি বছর তো পেরিয়ে গেছে সে আর উৎপলা। গত কুড়ি বছর যে-সব আতিশয্যচক্র হয়ে গেছে উৎপলার জীবনে, তা নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নেই এখন আর। গোলদীঘির রাতে শীতে মাল্যবানের চুরুট তার মনের ভেতরে সেই ছেলেবেলার শীত রাতে শান্তর মার আগুনের খাপড়ার মতো কেমন একটা নিঃশব্দতা নিশ্চয়তা শান্তির অবতারণা করছিল। বাড়ির দিকে হাঁটতে-হাঁটতে বাড়ির খুব কাছাকাছি এসে পড়ে মাল্যবান বলছিল, কাকে যেন বলছিল, কাকে যেন বলছিল কি গো, গোলামরা সব চলে গেছে—রঙের গোলামও-বলো! বিশটা বছর হসকে গেছে চোখ না পাজলাতেই। মনু শ্বশুরবাড়ি, আর আমাদের বাড়ি সায়েব বিবি ওপরের ঘরে—বলো! বিছানাটা বেশ দুজনের মতন উম-উম, কুসুম-কুসুম, শীত রাত আর শেষ নেই বলো। দুপুর-রাতে ঠাণ্ডা নদীর পারে শামকলের মাথাটা যেন ভেঁকির পাড়ের মতো উঠছিল পড়ছিল যখন বলো-বলো! বলছিল মাল্যবান। কথা বলতে-বলতে মাল্যবান হি-হি করে নিজের ঘরে ঢুকে লেপ টেনে নেয়; খুব বেশি অন্ধকারে খুব বেশি ঘুমের ভেতরে মানুষের শরীর বলে কোনো জিনিস থাকে না, মনটাও কাঠ হয়ে যায়, হঠাৎ জেগে উঠলে কাঠে আগুন লেগে যায়; আচমকা জেগে-জেগে উঠে সারারাত, পুড়তে-পুড়তে সকালবেলা মাল্যবান জাগ্রত চেতনার অন্য আরেক রকম আগুনের ভেতর জেগে উঠল। এখানে বলো-বলো!-র চালাকি চলরে না শামকল শালার; প্রতিটি সেকেন্ড-মিনিট গুণে-গুণে, অগ্নিকৃকলাসকে রূপকের মিথ্যে বলে বিদায় নিয়ে, আগুনকে সত্যিই আগুন বলে গ্রাহ্য করে পদে-পদে এগিয়ে যেতে হবে। এছাড়া কোনো উপায় নেই, কোনো পথ নেই আর।
একদিন মাল্যবান অফিসে গিয়ে শুনল যে, অফিসের কেরানী মনোমোহনবাবুর স্ত্রীর ভয়ঙ্কর অসুখ–মেডিক্যাল কলেজের হাসপাতালে তাকে আনা হয়েছে।
ঘাবড়াবেন না মনোমোহনদা, সেরে যাবে–বললে মাল্যবান।
কিন্তু সেদিন সমস্তটা দিন অফিসে মনটা তার উৎপলার জন্যে কেমন অসুবিধে অস্বস্তি বোধ করতে লাগল।
সন্ধ্যের সময়ে বাসায় গিয়ে পোশাক না ছেড়েই সে ওপরের ঘরে চলে গেল। গিয়ে দেখল, উৎপলা আর মন ছাদে বসে আছে—কার অসুখ, কোথায়?
তুমি ভালো আছ তো, উৎপলা? আমাদের অফিসের মনোমোহন বাবুর স্ত্রীর বড় অসুখ
কী অসুখ, বাবা? মনু জিজ্ঞেস করল।
সে কী এক রকম অসুখ, স্টোন হয়েছে—
সে আবার কী?
কী জানি।
মাল্যবান খানিকক্ষণ আলো-আবছা চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে ভারি ভাবুক হয়ে পড়ল; একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললে, মনু, যা আমরা খাই, তার ভেতরে নানারকম জিনিস থাকে, হজম হয় না, ভেতরে-ভেতরে স্টোন হয়
পেটে হয় স্টোন?
না, পেটে না, কিডনিতে হতে পারে—গল-ব্লাডারে হতে পারে—
কিডনি কী, গল-ব্লাডার কী?–জিজ্ঞেস করাতে মাল্যবান হাত দিয়ে নিষেধ জানিয়ে বললে, ও-সব তোমার জনাবার দরকার নেই
ভাতের ভেতরে যে কাঁকর থাকে, সেগুলো জমে গিয়ে বুঝি কিডনিতে? মনু বললে।
না, তা নয়, তা ঠিক নয়—
ও তো আমার পেটেও হতে পারে— উৎপলা বললে।
না, তা কী করে হবে, উৎপলা—মাল্যবান শিশুর মুখে ভূতের গল্প শুনে একটু হেসে উড়িয়ে দিয়ে বললে।
হবে না? তোমার ঠাকুর খুব দেখে-শুনে চাল ধোয় আর ভাত রাঁধে, উৎপলা বললে, এক-এক দিন খেতে বসে দেখি কাঁকর পাথরের কাড়ি। গেরাসে-গেরাসে পেটে হড়কাচ্ছে, স্টোন হবে না তো কী হবে—
ওতে স্টোন হয় না-ওটা–যা-হোক্, মাল্যবান ঠাকুরকে ডাক দিল।
ভাতে কাঁকর থাকে কেন?
ঠাকুর আপত্তি করতে যাচ্ছিল, মাল্যবান বললে, ফের যদি কাঁকর পাথর নুড়ি কুচি কিছু দেখি, তাহলে তোমার মাইনে কেটে তোমাকে তাড়িয়ে দেব আমি। খবরদার!
ঠাকুর চলে গেলে উৎপলা বললে, ওকে বকে কী লাভ। যারা চাল নিয়ে বজ্জাতি করে সে-সব ওপরওয়ালাদের পেটের ভাত চাল করে ছাঁকব আমাদের চালুনিতে; নাও, সে-সব পেটোয়া চাল কয়েক বস্তা নিয়েসো দিকি। পারবে? মাঝখান থেকে ঠাকুরটাকে ঝাড়লে। কী রকম বেকুব তুমি।
এবারে আমি চালওয়ালাকে কড়কে দেব। অফিসের ধরাচুড়া-পরা মাল্যবান একটা হাই তুলে বললে।
যে-আগ্রহ ও উদ্বেগ নিয়ে উৎপলাকে সে দেখতে এসেছিল, তা তার ধীরে-ধীরে ধোঁয়ার ভেতর মিলিয়ে যেতে লাগল যেন। মনোমোহনের স্ত্রী অসুস্থ হয়ে পড়েছে বলে সমস্তটা দিন অফিসের কাজকর্মের ভেতর উৎপলার জন্যেও যে-দুশ্চিন্তা হয়েছিল, বৌয়ের সঙ্গে কিছুক্ষণ খিটিমিটি করে সে বিষণ্ণ, ভালো জিনিসটা নষ্ট হয়ে গেল একেবারে। খারাপ হল-খুব খারাপ হয়ে গেলসব। অফিসের থেকে এরকম হাঁচকা ছুটি নিয়ে বাড়িতে না এলেই ভালো হত।
স্টোন হয়েছে–তারপর কী হল—মরে গেল?
না, মরবে কেন? তাহলে বেচারির চলবে কী করে?
কোন বেচারির?
মনোমোহনদার।
মনোমোহনবাবু তোমাদের অফিসের কেরানী?
হ্যাঁ, নিচের দিকের; মাইনে পঞ্চান্ন টাকা; বড্ড মুস্কিল মনোমোহনদার।
মনোমোহনবাবুর বৌয়ের জোর কপাল বলো—
কেন?
পারানির দিকে চলেছে—বৈকুণ্ঠে যাবে—কেরানীর টাকায় টিকছে না আর—
উৎপলা হাঁসফাস করে বললে, পেটে আমার কী যেন হয়েছে, মনে হয়—
কী হল?
টিউমার হয়েছে, মনে হয়—
কে বললে?
বলবে আবার কে? টের পাচ্ছি। এর অষুধ কী? অপারেশন করতে হবে?
মাল্যবান সন্ধিগ্ধ চোখে তার স্ত্রীর দিকে তাকাল সত্য কথা বলছে? কি করে বুঝবে, কথাটা অসত্য? সুবিধের লাগছিল না তার। কোনো কিছু স্থির করে নয়, এমনিই কথা একটা-কিছু বলতে হবে বলেই মাল্যবান বললে, ও টিউমার নয়। ও কিছু নয়। ও তোমার মনের ধোঁকা।
উৎপলা কথা খরচ করতে গেল না আর। মেঝের ওপর বসে ছিল–বসে-বসে হাঁসফাস করতে লাগল; উঠে দাঁড়িয়ে হাঁসফাস করতে লাগল।