১১. স্কুল টিচারদের বাড়ি যে রকম থাকে

স্কুল টিচারদের বাড়ি যে রকম থাকে বেহানা আপার বাড়ি সে রকম নয়। বাড়ি দেখেই মনে হয়। স্কুল মাস্টারি তিনি সখের জন্যে করেন! মুনা অবাক হয়ে চারদিক দেখতে লাগল; ভালী ভারী সোফা। লাল কাঁপেট ঝকমক করছে। দেয়ালে কামরুল হাসানের ছবি। তিনটি মেয়ে নদীতে নাইতে নেমেছে। রেহানা আপা বললেন অরিজিনাল পেইনটিং; মুনা বলল। চমৎকার তো।

উনি আমাদের দূর-সম্পর্কের আত্মীয় হন। বাসায় প্রায়ই আসেন।

তাই নাকি?

হ্যাঁ। তুমি চা-টা কিছু খাও।

জি না। আমার শবীর ভাল না। গলাব্যথা। রেহানা। আপা সঙ্গে সঙ্গে উৎসাহী হলেন।

টনসিল নাকি?

জি।

এক গ্রাস গরম পানির মধ্যে কয়েক দানা লবণ আর পেয়াজের রস দিয়ে গার্গল কর, দেখবে সেরে যাবে।

জি আচ্ছা করব।

এখানেই করা, আমি এনে দিচ্ছি।

মুনা না বলবার সময় পেল না। রেহানা। আপা ভেতরে চলে গেলেন। মুনা বসে রইল একা একা। এ বাড়িতে অনেক লোকজন। কিন্তু কেউ বসবার ঘরে উঁকি দিচ্ছে না। তবে বেশ কয়েকবারই টের পাওয়া গেল পর্দার ওপাশে কৌতূহলী মেয়েরা উঁকি দিচ্ছে! কৌতূহলের কারণটি স্পষ্ট হচ্ছে না! তারা কী জেনেছে সে বকুলের বোন; যার সঙ্গে এ বাড়ির কোনো একটি ছেলের বিয়ের কথা প্রায় পাকাপাকি! সে কথাও জানার কথা নয়। মুনা শুধু রেহানা। আপাকেই বলেছে আমি বকুলের বোন। আপনার সঙ্গে কথা বলতে এসেছি। তিনি নিশ্চয়ই সে কথা বাড়ির ভেতরে সবাইকে বলেননি। তাকে সে রকম মনে হয় না।

মুনাকে গার্গল করতে হল। অপরিচিত কোনো বাড়িতে বেড়াতে এসে শব্দ করে গার্গল করা খুব অস্বস্তিকর। কিন্তু উপায় নেই, রেহানা। আপা পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি বললেন, এখন একটু আরাম লাগছে না?

জি লাগছে।

এস, আমরা বসার ঘরে না বসে অন্য কোথাও বসি।

চলুন।

রেহানা আপা তাকে দোতলার বায়ন্দায় নিয়ে এলেন। চমৎকার বারান্দা। ছবির মত সাজানো। ধবধবে সাদা বেতের চেয়ার। ছোট্ট একটা লেতের টেবিল। এই সাত সকালে ও টেবিলের ফুলদানিতে টাটক৷ ফুল রাখা হয়েছে। রোজই কী এ রকম রাখা হয়? রেহানা। আপা বললেন বল কী বলবে? মুনা ইতস্তত করতে লাগল। কীভাবে কথাটা শুরু করা যায় বুঝতে পারল না।

কোনো রকম সংকোচ বা লজ্জা করবে না। বল।

বকুলের ঐ বিয়েটার ব্যাপারে খোঁজ নিতে এসেছিলাম। আমার মামা-মমিব খুধ আগ্রহ।

আমাদেরও আগ্রহ। তোমার বোন মেয়েটি ভাল। একটু বোধ হয় বোকা। সেটাও ভাল। বোকা মেয়েরা বৌ হিসেবে ভাল হয়।

মুনা তাকিয়ে রইল। এই নিয়ে আলাপ চালিয়ে যেতে তার ইচ্ছা হচ্ছে না। তবু সে ক্ষীণ কণ্ঠে বলল, আপনারা একবার বলেছিলেন, পনেরো দিনের মধ্যে কাবিনের ঝামেলা মিটিয়ে ফেলতে চান।

হ্যাঁ তা চাই।

আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আপনারা যখন বলবেন তখনই আমরা রাজি আছি।

রেহনা আপা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন একটা বড় রকমের প্রবলেম হয়েছে। তোমার সঙ্গে খোলাখুলি বলি; বকুলের বাবা শুনলাম অ্যারেস্ট হয়েছে। কথাটা বোধ হয় সত্যি। সত্যি না?

জি। ওঁকে একটা মিথা মামলায় জড়িয়েছে।

সেটা তুমি জানো এবং আমরা জানি। কিন্তু অন্যরা তো জানে না। তারা নিজেদের মত করে ঘটনাটা ব্যাখ্যা করবে! করবে না?

জি করবে।

ব্যাপারটা কী রকম সেনসেটিভ বুঝতে পারছ। পারছ না?

পারছি!

ধর, তোমার নিজের একটি ছেলের তুমি বিয়ে দিচ্ছি। বিয়ের এক সপ্তাহ আগে হঠাৎ দেখলে মেয়ের বাবাকে পুলিশ চুরির দায়ে ধরে নিয়ে যাচ্ছে কেমন লাগবে তোমার?

আপ ওটা একটা মিথ্যা মামলা। বিশ্বাস ককোনা!

বিশ্বাস করব না কেন? বিশ্বাস করছি। চা খাও, দাঁড়াও চা দিতে বলি।

মুনা না বলবার আগেই রেহানা আপা চা আনতে ভেতরে চলে গেলেন। ফিরে এলেন প্রায় সঙ্গে সঙ্গে! চা বোধ হয় তৈরিই ছিল। শুধু চা নয় সঙ্গে প্রচুর খাবার-দাবার।

বেহানা আপা অন্তিরিক স্বরে বললেন, খাও কিছু খাও। আমার বাড়ি থেকে কেউ না খেয়ে যেতে পারে না! মুনা ক্ষীণ স্বরে বলল বিয়েটা তাহলে হবে না?

না। তারা অন্য মেয়ে দেখেছে। কথা ও মোটামুটি পাকা করে ফেলেছে।

ও।

দিনাজপুরের মেয়ে। হোম ইকনমিক্সের ছাত্রী। বাবা রিটায়ার্ড সেশন জজ।

মুনা কিছু বলল না। রেহানা আপা বললেন বকুলের বিয়ে নিয়ে চিন্তা করবে না। ওর বিয়ে আমি দিয়ে দেব। এই ছেলের চেয়েও অনেক ভাল ছেলে জোগাড় করব।

কী ভাবে করবেন? ওরাও নিশ্চয়ই বাবা সম্পকে জানতে চাইবে।

তা চাইবে। কিন্তু এ সব কথা লোকজন বেশি দিন মনে রাখে না। প্রথম কিছু দিন খুব হৈচৈ হয়, তারপর সবাই ভুলে যায়।

মুনা বলল আমি উঠি।

একটু বস।

আমার অফিসে যেতে হবে দেরি হয়ে যাচ্ছে।

না দেরি হবে না। আমার এক ননদ গাড়ি নিয়ে এসেছে, তাকে বলেছি সে তোমাকে পৌঁছে দেবে।

মুনা বসে রইল। রেহানা আপা বললেন কেইস শুরু হবে কবে?

খুব শিগগিরই শুরু হবার কথা।

ভাল উকিল দিয়েছ তো?

দিয়েছি।

আমার নিজের জানাশোনা কিছু উকিল আছে। আমি বললে ওরা বিনা ফিতে মামলা দেখে দেবে। বলব?

তার দরকার নেই।

বকুল স্কুলে আসে না অনেক দিন থেকে। ওকে স্কুলে আসতে বলবে। পরীক্ষাব ডেট দিয়ে দিয়েছে।

মুনা বিস্মিত হল। বকুল স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে তার জানা ছিল না। রেহানা আপা বললেন, বাবা কী করেছে না করেছে তার জন্যে মেয়ে কেন লজ্জিত হয়ে ঘরে বসে থাকবে? তুমি খুব কড়া করে ধমক দিয়ে তাকে স্কুলে পাঠাবে।

জি আচ্ছা!

মুনাকে দিয়ে আবার তিনি গার্গল করালেন; এবং সত্যি সত্যি তার গলাব্যথা অনেকখানি কমে গেল!

 

সে অফিসে ঢুকল ভয়ে ভয়ে; গত দু’দিন নানান ছোটাছুটিতে অফিসে আসা হয়নি। ঘন ঘন কামাই হচ্ছে। বড় সাহেবের কানে উঠেছে নিশ্চয়ই। নিজের জায়গায় বসে মুনার ধারণা আরো দৃঢ় হল। সবাই তাকাচ্ছে তার দিকে। পাল বাবু এসে বললেন বড় সাহেব খোঁজ করেছিলেন। আপনাকে।

কবে?

পরশু খোঁজ করলেন। কাল খোঁজ করলেন। আমরা বলেছি অসুস্থ!

কি জন্যে খোঁজ করেছেন জানেন?

না! যান জেনে আসুন! স্যার আছেন।

মুনা ঠাণ্ডার মধ্যে ঘামতে লাগল।

বড় সাহেব শুকনো গলায় বললেন বসুন, দাড়িয়ে কেন?

মুনা বসল। এই ঘরটায় ঢুকলেই তার এমন অস্বস্তি লাগে দম বন্ধ হয়ে আসতে চায়। সব সময় মনে হয় এক্ষুণি এই ছোটখাটো লোকটি চেঁচিয়ে উঠবে। যদিও কোনো সমযই তিনি তা করেন না।

শরীর খারাপ ছিল?

জি না স্যার, একটা ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছি। খুব ছোটাছুটি করতে হচ্ছে।

ঝামেলাটা কী বলুন? অবশ্যি যদি আপত্তি না থাকে। আপনার ঝামেলার জন্যে অফিসের কাজকর্মের ক্ষতি হচ্ছে। কাজেই আপনার সমস্যা জানার রাইট আমার আছে।

মুনা রুমাল দিয়ে কপালেব ঘাম মুছল এবং ক্ষীণ স্বরে তার মামার কথা বলল। বড় সাহেব চোখ বন্ধ করে সিগারেট টানতে লাগলেন। তার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে তিনি কিছু শুনছেন না কিন্তু মুনা জানে তিনি খুব মন দিয়েই শুনছেন।

আপনিই সব দেখাশোনা করছেন?

জি।

বাড়িতে পুরুষ মানুষ কেউ নেই? আছে স্যার; আমার ছোট ভাই। খুব ছোট। ক্লাস সেভেনে পড়ে।

মামলাটা শেষ হতে কতদিন লাগবে?

উকিল সাহেব বলেছেন এক মাসের মত লাগবে।

বড় সাহেব সিগারেট অ্যাসট্রেতে গুঁজে রাখলেন। গম্ভীর গলায়, আপনি মেডিক্যাল গ্রাউণ্ডে এক মাসের ছুটির দরখাস্ত করুন; আমি ব্যবস্থা করে দেব। নিজের সমস্যা ভালমত মেটান।

মুন্না ক্ষীণ স্বরে বলল, থ্যাংকয়্যু স্যার।

বড় সাহেব সহজ গলায় বললেন, আমরা বাবা মারা যান যখন আমরা সবাই খুব ছোট। সেই সময় আমার বড় বোন শুধু এম.এ. পড়তেন। তিনি একটা চাকরি নেন! নানান রকম ঝামেলার মধ্যে দিয়ে আমাদের বড় করতে থাকেন। তিনি কোনোদিন ঠিকমত অফিসে যেতে পারতেন না। প্রাযই অফিস কামাই হত। তার বস প্রতি সপ্তাহেই বলতেন, তোমার চাকরি শেষ। আগামীকাল থেকে আর আসবে না।

মুনা চুপ করে রইল। বড় সাহেব দ্বিতীয় সিগারেট ধরিয়ে হাসি মুখে বললেন, কিন্তু ওটা ছিল মুখের কথা। ঐ বড় সাহেব একজন অসাধারণ মানুষ ছিলেন। তিনি আমাদের অনেক সমস্যার সমাধান করলেন এই অজুহাতে যেন আমার আপা ভালমত অফিসের কাজে মন দিতে পারেন। সবাই বলে মানুষের খারাপ সময়ে কাউকে পাশে পাওয়া যায় না। কথাটা ঠিক না। মানুষকে পাশে পাওয়া যায় দুঃসময়ে। আচ্ছা আপনি যান।

স্যার স্লামালিকুম।

ওয়ালাইকুম সালাম। যদি কখনো মনে করেন আমাকে দিয়ে কিছু করানো সম্ভব, জানাবেন। আমি করব।

অফিসের বাইরে এসে মুনা চোখ মুছল। বড় সাহেবের এই সামান্য কথা তাকে অভিভূত করেছে। মাঝে মাঝে আমরা অতি অল্পেই অভিভূত হই। নিজের টেবিলে ফিরে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই তারেক এসে উপস্থিত। তার মুখ হাসি হাসি। যেন খুব মজার একটা ঘটনা ঘটেছে। তারেক খানিকক্ষণ ইতস্তত করে বলল, আপনাকে একটা খবর দেয়া হয়নি, আমি বিয়ে করেছি।

সে কি! কবে?

হুট করে হয়ে গেল। গত পরশু। মায়ের অসুখ শুনে দেখতে গিয়েছিলাম, গিয়ে এই কাণ্ড। তারেক লজ্জিত ভঙ্গিতে মানি ব্যাগ থেকে ছবি বের করল। লম্বা রোগা একটি মেয়ে। মিষ্টি চেহারা। তারেক মৃদু স্বরে বলল, অফিসে আপনিই প্রথম জানলেন, আর কাউকে বলিনি। মুনা অস্পষ্ট স্বরে বলল, খুব সুন্দর বউ হয়েছে।

ছবিতে যত সুন্দর দেখা যাচ্ছে, তত সুন্দর সে না। ফটো জিনিক ফেস আর কী। নাম হচ্ছে তনিমা।

সুন্দর নাম।

ডাকনামটাই সুন্দর। ভাল নাম শুনলে চেয়ার থেকে লাফ দিয়ে উঠবেন। হা হা হা।

তারেক বেশ শব্দ করে হাসতে লাগল। একজন সুখী মানুষের হাসি। দেখতে ভাল লাগে।

তুমি মনে হয় খুব খুশি?

তা বলতে পারেন। আপনাদের বিয়েটা কবে হচ্ছে আপা?

বুঝতে পারছি না।

শুধু শুধু বঝুলিয়ে রাখবেন না। দি আরলিয়ার দি বেটার।

বিয়ে করার পর এ রকম মনে হচ্ছে?

হ্যাঁ তা হচ্ছে।

বিয়ের ব্যাপারটা তাহলে খুব খারাপ না?

তারেক মৃদু হাসল। মুনা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল। অস্পষ্ট ভাবে তার মনে হল মামুন কী তার কাছে থেকে দূরে সরে যাচ্ছে? কী করছে সে এখন গ্রামে? একটা চিঠি লিখবে নাকি? চিঠি লেখার ইচ্ছা দীর্ঘস্থায়ী হল না। প্রচুর কাজ জমে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *