সোহাগীতে পানি ঢুকছে, এই ভয়াবহ খবরটি চৌধুরীদের পাগল ছেলে প্রথম টের পেল। তার রাতে ঘুম হয় না। বাংলাঘরের বেঞ্চিতে বসে সিগারেট টানে এবং কোনো রকম শব্দ হলেই চেঁচায়, কেডা? চোর নাকি? এই চোর, এই চোর। এ্যাইও। তার চেঁচামেচি চলে ভোের পর্যন্ত। ফজরের আজানের পর সে ঘুমাতে যায়। দুপুর পর্যন্ত নাক ডাকিয়ে ঘুমায়।
সেই রাত্রে সে উঠোনে পাটি পেতে শুয়ে ছিল এবং তার স্বভাব মতো চোর চোর বলে কেঁচাতে-চেঁচাতে শেষরাতের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিল। ঘুম যখন ভাঙল, তখন সমস্ত উঠোনে থৈথৈ পানি। শোঁ-শী শব্দ উঠছে। শেয়াল ডাকাডাকি করছে চারদিকে। সে প্রথম কয়েক মহর্ত কিছুই বুঝতে পারল না। তার নিজস্ব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে চেঁচাল, কে, চোর নাকি? এই শালা চোর? এ্যাইও। তার পরমুহূর্তেই পানি আসে পানি আসে বলে বিকট চিৎকার করে ছুটতে শুরু করল। এর প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তার ফজলুল করিম সাহেবের ঘোড়াটি বিকৃত স্বরে চেঁচাতে শুরু করল। গ্রামের পশ্চিম প্রান্তের গোয়াল ঘরগুলি থেকে গরু ডাকতে লাগল। বেশির ভাগ মানুষ জেগে উঠল এই সময়। ছোট মসজিদের ইমাম সাহেব রাত সাড়ে তিনটায় আযান দিলেন। অসময়ের আযান–মহাবিপদের সংকেত দেয়। লোকজনের ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেল। সরকারবাড়ি থেকে সরকার সাহেব দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে দোনালা বন্দুক থেকে চার বার ফাঁকা আওয়াজ করলেন। ঘোট ঘোট ছেলেমেয়েরা উচ্চৈঃস্বরে কাঁদতে শুরু করল।
আমিন ডাক্তার যখন ঘর থেকে বেরুল, তখন তার উঠোনে প্রায় হাঁটু-পানি। এই রকম অসম্ভব ব্যাপার সোহাগীর মানুষ কখনো দেখে নি। ভাটি অঞ্চলে পানি এত দ্রুত ্কখনো বাড়ে না। আর বাড়লেও পানি এসে বাড়ির উঠোনে কখনো ঢোকে না। আমিন ডাক্তার চৌধুরীবাড়ি এসে দেখে ইতোমধ্যেই প্রচুর লোকজন জড়ো হয়েছে। একটি হ্যাজাক লাইট উঠোনের জলচৌকির উপর বসান। চৌধুরী সাহেব গলার শিরা ফুলিয়ে হাঁকডাক করছেন। —
মেয়েছেলেগুলিরে সরকারবাড়িত লইয়া যাও। গরু-ছাগলের দড়ি কাট, জান বাঁচানির চেষ্টা কর। ভোর মত চাইয়া থাইক্য না।
আমিন ডাক্তার দৌড়াতে শুরু করল। মতি মিয়ার বাড়ি যাওয়া দরকার। পুরুষমানুষ কেউ নেই সেখানে। শরিফা সেরকম হাঁটাচলাও করতে পারে না। এতক্ষণ সে কথা মনেই হয় নি।
মতি মিয়ার বাড়ির উঠোনে অনেকখানি পানি। দক্ষিণ কান্দার একটি অংশ ভেঙে সরসর করে পানি ঢুকছে। উঠোনের বাঁ দিকটা নিচু। সেখানে জলের একটা প্ৰবল ঘূর্ণি উঠেছে। আমিন ডাক্তার মতি মিয়ার বাড়িতে ঢুকে বেশ অবাক হল। রহিমা সবকিছু নিপুণভাবে গুছিয়ে ফেলেছে। হাস-মুরগি গরু-ছাগল সমস্তই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। চৌকির নিচে ইট দিয়ে অনেকখানি উঁচু করে তার উপর ধান রাখা হয়েছে। প্রয়োজনীয় কাপড়চোপড় একটি বড় পোঁটায় রাখা হয়েছে। শরিফা চৌকির এক কোণায় বসে বসে কাঁদছিল। আমিন ডাক্তার গম্ভীর হয়ে বলল, অখন। কান্দনের সময় না, দোস্তাইন। সরকারবাড়িত যাওন লাগব।
আমি কেমনে যাই।
নেওনের ব্যবস্থা করছি। অখন শরমের সময় না। হাতটা ধরেন দেহি।
সরকারবাড়ি কিন্তু যাওয়া গেল না। দক্ষিণ কান্দার ভাঙা অংশে জলের চাপ খুব বেশি। সরকারবাড়ি যেতে হলে ভাঙা জায়গাটা পেরুতে হয়। কৈবর্তপাড়ার জেলেরা সবাই চলে এসেছে দক্ষিণ কান্দায়। অনেকগুলি কুপি জ্বলছে সেখানে। চাটাই বিছিয়ে মেয়েরা সব উচ্চৈঃস্বরে কলরব করছে। শরিফাকে ওদের কাছে বসিয়ে রেখে আমিন ডাক্তার রহিমাকে আনতে গেল। রহিমা খুন্তি দিয়ে গভীর মনযোগের সঙ্গে ঘরের ভেতরে কী যেন খুঁজছে। আমিন ডাক্তারকে দেখে সে শান্ত স্বরে বলল, আজরফ এইখানে ধান বেচা টেকা লুকাইয়া রাখছে। পানি উঠলে সব নষ্ট হইব।
আমিন ডাক্তার বেশ অবাক হল, তোমারে কইছিল যে এইখানে লুকাইছে?
না।
তুমি জানলা কেমনে?
রহিমা জবাব দিল না। একমনে খোঁড়াখুড়ি করতে লাগল।
ডাক্তার ভাই।
কি?
আপনে অনুফা আর নুরুদ্দিনরে লইয়া যান, আমার দিরং হইব।
অনুফা নুরুদ্দিনের সঙ্গে চৌকিতে বসে খোঁড়াখুড়ি দেখছিল।
সে মৃদুস্বরে বলল, হগলে মিল্যা একসাথে যাইয়াম চাচা।
খুঁতিতে বাঁধা টাকা পাওয়া গেল শেষ পর্যন্ত। রহিমা বলল, আপনার কাছে রাখেন ডাক্তার ভাই।
আমার কাছে কেরে?
মেয়েমাইনষের হাতে টেকা থাকন নাই। দোষ হয়।
দক্ষিণ কান্দায় তারা যখন পৌঁছল, তখন পুব দিক ফর্সা হতে শুরু করেছে। কান্দার পশ্চিম পাশে অনেকগুলি ছেলেমেয়ে মিলে খুব হৈচৈ করছে। কৈবর্তদের একটি ছেলে দৌড়াদৌড়ি করছিল, পা পিছলে নিচে পড়েছে-তাকে তুলে এনে শক্ত মার লাগান হচ্ছে। কৈবর্তদের প্রবীণ নরহরি দাস তামাক টানছে আর বলছে,
শক্ত মাইর দেও। খুব শক্তে দেও। তামশা পাইছে।
আমিন ডাক্তার বলল, ও নুরা, তোর মারে খুইজ্যা বাইর কর, খবরদার কান্দার কিনারাত যাইস না। এক চড় দিয়া দাত ফালাইয়া দিয়াম।
নুরুদ্দিন অনুফার হাত ধরে চক্ষের নিমিষে ছুটে গেল। আমিন ডাক্তার অবাক হয়ে বলল, কারবারটা দেখছনি রহিমা, না করলাম যেটা, হেইটা করন চাই।
রহিমা মৃদুস্বরে বলল, আপনেরে একটা কথা কইম চাই।
কী কথা?
কথাডা আপনি কিন্তুক রাখবেন আমিন ভাই।
আমিন ডাক্তার বিস্মিত হয়ে বলল, বিষয় কী?
অনুফারে নিখল সাব ডাক্তারের কাছে পাঠাইতাম চাই। হেইখানে ইস্কুলকলেজ আছে। লেহাপড়া শিখব।
আইজ হঠাৎ এই কথা কী কও?
ডাক্তার ভাই, পানি নামলে এইহানের অবস্থা খুব খারাপ হইব, আজরফের দুইডা পেট চালানর ক্ষ্যাম থাকত না।
তুমি তো অনেক দূরের কথা কও রহিমা।
নাহ্ ডাক্তার ভাই, দূরের কথা না।
নিখল সাব ডাক্তারের কাছে নিলে খিরিষ্টান হওন লাগে। হেই কথাডা জান তো?
জানি।
তুমি চিন্তাডা এট্টু বেশি করতাছ রহিমা। এই পানি থাকত না–যেমন হঠাৎ আইছে, হেই রকম হঠাৎ যাইব।
ডাক্তার ভাই, এই পানি মেলা দিন থাকব।
কান্দার ঠিক মাঝখানে কারা যেন একটা আগুন করেছে। দুর্যোগের সময় মানুষ প্রথমে অকারণেই একটা আগুন জ্বালাতে চেষ্টা করে। আজকের এই আগুনের অবশ্যি প্রয়োজন ছিল। ভেজা গা শুকোতে হবে, তা ছাড়া বিলের দিক থেকে ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছে। আমিন ডাক্তার দেখল, ফজলুল করিম সাহেব আগুনের কাছে এসে হাত মেলে দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর এখানে আসার কথা নয়। তাঁর ঘরের কাছেই সরকারবাড়ি।
এই যে, ও ভাই আমিন ডাক্তার, এ কী অবস্থা?
অবস্থাটা খারাপই, আপনে এত দূরে আসলেন।
আমার ঘোড়ার খোঁজে আসছি। মরেই গেছে নাকি, কী বিপদ দেখেন তো!
পাইছেন ঘোড়া?
কই পাব বলেন? ছিঃ ছিঃ, মানুষ থাকে এইখানে।
নুরুদ্দিন আর অনুফা জারুল গাছের গুড়িতে চুপচাপ বসে আছে। গাছটি কান্দার ধার ঘেঁষে উঠেছে। নিচে তাকালেই পানির ঘোলা আবর্ত চোখে পড়ে। শরিফা বেশ কয়েক বার ডাকল, নুরু, অত পানির ধারে থাকিস না। কাছে আইসা ব।
নুরু গা করে না। ফিসফিস করে অনুফাকে কী যেন বলে, অনুফা খিলখিল করে হেসে ওঠে। শরিফা ধমকে ওঠে, হাসিনা। খবরদার। বিপদের মইধ্যে হাসি। কিছুই তর মায় তরে শিখায় নাই?
ভোরবেলা দেখা গেল ঘোলা পানি কান্দা দুই-চুই করছে। নরহরি দাস মুখ কালো করে ঘুরে বেড়াতে লাগল।
ছাব্বিশ সনের বানের লাখান লাগে গো।
কৈবর্তদের চারটি নৌকা জারুলগাছের গুড়িতে শক্ত করে বাঁধা। আমিন ডাক্তার বেশ কয়েক বার বলেছে, নৌকাতে করে সবাইকে সরকারবাড়িতে নিয়ে যেতে। সরকারবাড়ি অনেকখানি উঁচুতে। তাছাড়া পাকা দোতলা বাড়ি। মেয়েছেলেরা সবাই দোতলায় থাকতে পারবে। কৈবর্ত রাজি নয়। তারা দক্ষিণ কান্দাতেই থাকতে চায়।
সারা রাত ঝড়-বৃষ্টি কিছুই হয় নি। সকালবেলা দেখা গেল, আকাশে ঘন কালো মেঘ। দুপুরের পর থেকে মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হল। নরহরি দাস চিন্তিত মুখে বারবার বলতে লাগল, গতিক খুব খারাপ। ভগবানের নাম নেন গো।
বিকালের দিকে বৃষ্টির চাপ কিছু কমতেই দেখা গেল ছোট ঘোট খোন্দা নিয়ে সরকারবাড়ির কামলারা ঘুরে বেড়াচ্ছে। সরকারবাড়ির ছোট বৌ নাকি পানিতে পড়ে গেছে। সন্ধ্যা পর্যন্ত খোঁজাখুঁজি চলল। রাত প্রথম পহর পোহাবার আগেই কান্দার উপর আধ হাত পানি।
পানি থাকল সব মিলিয়ে ছ দিন। এতেই সোহাগীর সর্বনাশ হয়ে গেল।