3 of 3

১১ সেপ্টেম্বর, শনিবার ১৯৭১

১১ সেপ্টেম্বর, শনিবার ১৯৭১

ভারবাহী গর্দভের মত দিনগুলো টেনে নিয়ে চলেছি। ভোর সাড়ে চারটে-পাঁচটার সময় পাগলা বাবার বাসায় যাই। ঘন্টা দুয়েক পরে ফিরে এসে শরীফ সেভ, গোসল করে নাশতা খেয়ে অফিসে যায়। আমরা সংসারের কাজে লেগে যাই। লালুর সাংঘাতিক এক মাথা ধরার ব্যারাম আছে–মাইগ্রেন। বাবা বলেছেন লালুর মাথা ঝেড়ে তিনি ফুঁক দেবেন ফজরের নামাজেরও আগে। তার জন্যই এই রকম ভোর সাড়ে চারটে-পাঁচটায় যাওয়া।

গতকাল থেকে মা আর আতাভাই আরেক দফা কোরান খতম শুরু করেছেন। আতাভাই এক থেকে পনের পারা, মা ষোল থেকে শেষ পারা পড়বেন। এটা ওরা শেষ করবেন আগামী বৃহস্পতিবার। এই কোরান খতমের শেষে দোয়া পাঠ করানো হবে পাগলা বাবাকে দিয়ে তাঁর সাপ্তাহিক মিলাদের মাহফিলে।

এত ভোরে উঠে শরীফ ক্লান্ত। নিজের হাতে সংসারের সমস্ত কাজ করা–কারণ বারেকও চলে গেছে। বিকেলে আবার পাগল বাবার আস্তানায় যাওয়া। এর মধ্যে নানা ধরনের দোয়া, আমল, খতম। এর মধ্যেও চমক–দেড়টার সময় হঠাৎ আবুর ফোন।

আবু–পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের উইং কমান্ডার মাহবুবুর রহমান–সে তো করাচিতে রয়েছে বলেই জানতাম। তার ফোন পেয়ে অবাক হলাম, তুমি ঢাকায় কি করছ? কবে এসেছ?

বাসায় আছো তো? এসে সব বলছি।

আবু ১৯৪৪-৪৮ সালে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে শরীফের সঙ্গে পড়ত। সেই থেকে বন্ধুত্ব। আবুর কোন বড় বোন ছিল না। তাই সে আমার সঙ্গে বুবু পাতায়। সেই থেকে আমি তার সবগুলো ভাইবোনের বুবু।

আবু বাসায় এসে এক চমকপ্রদ, অবিশ্বাস্য কিন্তু খাটি সত্য কাহিনী শোনাল।

গত দুই মাস পাঁচ দিন ধরে ঢাকায় সে সামরিক জান্তার বন্দিশালায় বন্দী জীবনযাপন করেছে। আজকে তাকে ছেড়েছে, আগামীকাল দুপুরের ফ্লাইটে তাকে করাচি যেতে হবে। সেখানে তার বউ-ছেলে-মেয়ে রয়েছে তারা জানে যে, আবু ঢাকায় এয়ারফোর্সের যে ইস্ট ওয়েস্ট কমুনিকেশন নেটওয়ার্ক ইনস্টলেশান আছে, সেটা মেরামত করতে ঢাকা গেছে। ১৯৬৭ সালে আবুই এয়ারফোর্সের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ঢাকায় ঐ মাল্টিচ্যানেল রেডিও–টেলিফোন-টেলিপ্রিন্টার লিঙ্ক ইনস্টল করেছিল। আবুকে করাচিতে বলা হয়, ঢাকায় ঐ লিঙ্ক ইকুইপমেন্ট ঠিকমত চলছেনা। যেহেতু তুমিই ওটা বসিয়েছিলে, অতএব তুমি ছাড়া আর কেউ ওটা ঠিকমত মেরামত করতে পারবে না।

তেজগাঁ এয়ারপোর্টে নামার পর আবুকে জানানো হয় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার অপরাধ সম্বন্ধে বলা হয় সে এবছরের প্রথমদিকে পাকিস্তান ভাঙার ষড়যন্ত্রে শেখের কাছে কিছু গোপন খবর দিয়ে লোক পাঠিয়েছিল।

এরপর আবুর ওপর শুরু হয় নির্যাতন। এয়ারপোর্টের উল্টোদিকে যে এয়ারফোর্স অফিসার্স মে, তার পেছন দিকে কাঁঠাল বাগানে একটা জায়গায় আবুকে নিয়ে রাখে। ব্যারাকের মত ঘর, টিনের ছাদ, পাঁচ ইঞ্চি পাকা দেয়াল, চারধারে ডবল কাটাতারের বেড়া। এখানে ওকে রাখে একটা ছোট ঘরে–একদম একা। ওকে বলা হয় আমরা তোমার সম্বন্ধে সব জানি। কিছু গোপন করে লাভ হবে না। যা জান, যা করেছ, সব বলবে।

এখানে তেরদিন নির্জন ঘরে একাকী রাখার পর একরাতে আবুকে ঘুম থেকে তুলে নিয়ে যায় অন্য একটা জায়গায়–শেরে বাংলা নগরে ফিল্ড ইন্টারোগেশান ইউনিটে। এখানেও কাটে তেরটা দিন। এই তেরদিন আবুকে ঘুমোতে দেওয়া হয় নি, শুতে দেয়া হয় নি, কড়া বাতি চোখের সামনে জ্বালিয়ে অনবরত ইন্টারোগেশান চলেছে। প্রশ্নের পর প্রশ্ন, এলোপাতাড়ি প্রশ্ন, এলোমেলো প্রশ্ন কয়েক ঘন্টা প্রশ্ন করে, তারপর কাগজ-কলম দিয়ে বলে, লেখ, যা জান সব লেখ। লেখা পছন্দ না হলে নির্যাতন। বেশ খানিক নির্যাতন করে লেখা কাগজ ছিঁড়ে ফেলে আবার লিখতে বলে।

এরপর তাকে এয়ারপোর্টের উল্টো দিকে প্রাদেশিক সংসদ ভবনের কাছে একটা বাড়িতে নিয়ে রাখে কয়দিন, আবার ফেরত নেয় কাঠাল বাগানের ব্যারাকে। সব জায়গাতেই অমানুষিক নির্যাতনের পর শেষমেষ আবুর স্টেটমেন্ট নেওয়া শেষ হয়।

আজ আবুকে ছেড়েছে। প্রথমে সে তার চাচার বাসায় গিয়েছিল। গিয়ে দেখে চাচার বাসায় বিহারি দারোয়ান বন্দুক হাতে পাহারা দিচ্ছে। চাচা পাড়ার পিস কমিটির মেম্বার। সেখানে ঘন্টাখানেকও বসে নি, চলে এসেছে এখানে।

আমি বললাম, তোমার চেহারা একদম খারাপ হয়ে গেছে। খুব লাঠিপেটা করেছে?

না, আমাকে কিন্তু লাঠি দিয়ে তেমন পেটায় নি। সবাইকে ওরা একই রকম টর্চার করে না। ওরা দেখে কার কি রকম স্ট্যামিনা, কার কি রকম সহ্য করার ক্ষমতা, কে অল্পেই ঘাবড়ে যায়, কে নার্ভাস, কে স্টেড়ি। বন্দীর সাইকোলজি বুঝে ওদের টর্চারের হেরফের হয়। তাছাড়া একজন সিনিয়ার মিলিটারি অফিসার হিসেবে আমার ফিজিক্যাল ফিটনেস ছিল পুরোপুরি। তাই ওরা অনেক অত্যাচার করেও আমাকে কাবু করতে পারে নি। তোমরা তো জান আমি চিরকাল যোগ ব্যায়াম করেছি, হেডস্ট্যান্ড করেছি।

জানি না? রুমীকে হেডস্ট্যান্ড করা তুমিই তো শিখিয়েছিলে। রুমী যোগ ব্যায়ামও কো শুরু করে তোমার কাছেই।

ওরা প্রথম প্রথম আমার ওপর কয়েকটা গতানুগতিক অত্যাচার করে দেখে আমার কিছুই হয় না। তখন ওরা অন্যরকম টর্চার করে আমাকে কী করতে চাইল। ফ্যানের সঙ্গে পা বেঁধে মাথা নিচে দিয়ে ঝুলিয়ে রাখল। আমার হেডস্ট্যান্ড করা অভ্যেস ছিল বলে নাক-মুখ দিয়ে রক্ত ওঠে নি। ওরা পরপর তিন রাত–প্রত্যেকবার ঘন্টা তিনেক করে এভাবে ঝুলিয়ে দেখল, আমার কিচ্ছু হয় না, তখন ওরা এটা বাদ দিল। আসলে যেকোন প্রকারে আমার মনোবল ভেঙে দিয়ে আমার কাছ থেকে ওদের ইচ্ছেমত স্বীকারোক্তি লিখিয়ে নেওয়াই ওদের উদ্দেশ্য ছিল। আমিও মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম–একদম প্রথমে যা বলেছি, শেষ পর্যন্ত তাই বলে যাব। প্রথম দিন কাগজে যা লিখেছি, শেষ পর্যন্ত তাই লিখে যাব।

অত্যাচারের চোটে আবুর হাতের আঙুলের গিঁঠগুলো মচকে গেছে, কোমরে অসম্ভব ব্যথা। সামনে ঝুঁকতে পারেনা, বসলে উঠতে পারেনা, উঠলে বসতে পারে না। শরীফ, জামী, মাসুম তিনজনেই তাকে এই বলে সান্তনা দিল যে তাদেরও প্রত্যেকের ঘাড়ে, কোমরে প্রচণ্ড ব্যথা, তাদেরও হাতের আঙুল মুঠ করতে, হাঁটু ভাঁজ করতে বিষম ব্যথা লাগে।

একটা প্রশ্ন অনেকক্ষণ থেকেই গলার কাছে উসখুস করছিল, করব কি করব না করে অনেকক্ষণ গেল, শেষমেষ করেই ফেললাম, এমনকি কোন টর্চার আছে, যাতে শরীরের কোথাও কাটবে না, ভাঙবে না, কিন্তু ভেতরটা চুরচুর হয়ে যাবে?

আছে বই কি, অনেক রকম আছে। যেমন একটা হল সকিং। মোজার মধ্যে বালি ভরে মারলে শরীরে কোথাও দাগ পড়বে না কিন্তু মায়ের চোটে মনে হবে শরীরের সমস্ত মাংস—

জামী চেঁচিয়ে উঠল, মা, আবার? মামা প্লীজ, বলবেন না। মা, ওইসব শুনবে, তারপর কাঁদতে কাঁদতে ফিট হবে।