সেদিন স্কুল থেকে ফিরে এসে আনু দেখে, বড় আপা শুয়ে আছেন। মাথার কাছে গেলাশে পানি ঢাকা। দেখে কেমন করে উঠল ভেতরটা। পাশে বসে জিগ্যেস করল, কি হয়েছে? কিছু না।
তার কপালে হাত দিয়ে দেখে জ্বর। বলল, জ্বর তো।
সেরে যাবে।
তখন একটু স্বস্তি পেল যেন আনু। না, তেমন কিছু নয়। একটু গা গরম শুধু। বসে বসে সে স্কুলের গল্প করল। বলল, বৃত্তি পরীক্ষা কাছে চলে এসেছে কিনা, তাই এখন ক্লাশে খুব পড়াচ্ছে। হেড মাস্টার তাকে ডেকে নিয়ে, ভালো করে পড়তে বলেছেন। বলেছেন, চেষ্টা করলে আনু বৃত্তি পেয়ে যেতে পারে। বড় আপা তার হাত ধরে উজ্জ্বল মুখ করে বলে উঠলেন, তাহলে বেশ ভালো হয়, নারে? তুই পড়।
সেই অসুখ আর কিছুতে কমল না। জ্বরটা বেড়েই চলল। মাঝখানে আনু একদিন হাসপাতাল থেকে ওধুধ এনে দিয়েছিল। কিস্সু কাজ হয় নি তাতে। বুলু ভাইর মা এসে সবাইকে খুব বকলেন, কী আক্কেল তোমাদের! এমন শক্ত অসুখ, হাসপাতালের ওপর ভরসা করে আছো। পরদিন সকালে বুলু ভাইর সঙ্গে গিয়ে আনু ডাক্তার নিয়ে এলো। হাফপ্যান্ট পরে মাথায় হ্যাঁট চাপিয়ে সাইকেলে করে এলেন ডাক্তার নিয়োগী। পরীক্ষা করে বলে গেলেন টাইফয়েড।
আনু তার সঙ্গে সঙ্গে গেল ডিসপেনসারী। ওষুধ কিনে বাড়ি ফিরল। বলল, ডাক্তার খুব সাবধানে থাকতে বলেছে।
আনু এখন আর খেলতে যায় না, মাছ ধরতে যাওয়াটাও বন্ধ করে দিয়েছে। আজকাল কিছুই যেন ভালো লাগে না তার। বড় আপার অসুখ বলে নয়, সামনে বৃত্তি পরীক্ষা বলেও নয়, এমনিতে। সে নিজেই বুঝতে পারে না, তার কি হয়ে গেছে। মনটা যেন এখানে নেই, কিংবা কোথাও। একটা উড়ে চলার, দূরে চলে যাওয়ার, হারিয়ে যাওয়ার ইচ্ছে যেন ভেতর থেকে ঠেলে ঠেলে উঠতে চায়। চারপাশের সমস্ত কিছু এত দূরের মনে হয়–নিস্পৃহতায় ভরে থাকে মন। বড় উদাস মনে হয়।
স্কুলে বসে থাকতেও ভালো লাগে না। একদিন সে স্কুলেই গেল না। বইখাতা নিয়ে বেরুলো, বেরিয়ে গিয়ে নদীর পাড়ে যেখানে খেপাড় হয়, ছোট্ট একটা বাজার মতো যেখানে, সেখানে বসে রইলো। আবার সেখান থেকে হাঁটতে হাঁটতে ধরলো রেললাইন। রেললাইন দিয়ে ইস্টিশানে এলো। দুপুর বারোটার ট্রেন আসবে এখন। খবর কাগজ আসবে। একটু পরেই হকার কাগজের বাণ্ডিল নিয়ে বসবে, তাকে খুলবার সময় পর্যন্ত দেবে না, সবাই ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে কাড়াকাড়ি করবে কাগজের জন্যে।
আনু বসে বসে ভিড় দেখতে লাগল। বটগাছের নিচে টমটম তিনটে এসে দাঁড়িয়েছে। ঘোড়াগুলো মাটিতে পা ঠুকছে, গা কাঁপিয়ে মাছি তাড়াচ্ছে। মিষ্টির দোকানে গ্রামোফন বাজছে। উলিপুরের বাস এসে গেছে। আবার প্যাসেঞ্জার নিয়ে যাবে উলিপুর। ড্রাইভার পানি খাওয়াচ্ছে ইঞ্জিনের বনাট তুলে। আনুর মনে হয়, সেও যদি কোথাও চলে যেতে পারতো তো ভালো হতো। বড় আপা জ্বরের ঘোরে এখন পড়ে আছেন বিছানায়। মার রান্না বোধহয় শেষ হয়নি। সেজ আপা নাইতে গেছেন নিশ্চয়। আনু হাই তোলে। তার এখানেও ভালো লাগছে না। সে উঠতে যাবে, এমন সময় মাটি কাঁপিয়ে, চারদিক চঞ্চল করে ফুসতে ফুসতে ট্রেন এসে দাঁড়াল। হৈহৈ করে লোকেরা নামছে, কুলিরা চিৎকার করছে, বৌ–ছেলেমেয়েরা হাঁটতে পারছে না, তবু দৌচ্ছে খালি গাড়ির দিকে, গেটের কাছে চেকার দাঁড়িয়ে গেছে। আনু গিয়ে গাড়িতে বসলো।
ট্রেন ছেড়ে দিল। সড়াৎ করে বেরিয়ে গেল মহিমপুরের প্ল্যাটফরম, মালগুদাম, স্টেশন মাস্টারের বাড়ি। এ হলো মাঠ, মাঠ শেষে জলা জায়গাটা, তারপর গ্রামের মধ্যে নেমে গেল ট্রেন। আনুর বুকের ভেতরটা ছমছম করে উঠছে, তবু ভালো লাগছে। কোথাও যাবার নেই, তবু সে কোথাও যাচ্ছে। মুখে ঠাণ্ডা বাতাস এসে লাগছে। রোদে ঝকঝকে দেখাচ্ছে আকাশ, মাঠ, ধানক্ষেত, চিল, সাদা বক, মাছরাঙা, পানি সেঁচার চড়ক। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে টোগরাই হাটের ব্রীজ। ব্রীজের নিচে একদিন মাছ ধরতে যাবে আনু। ওখানে ভালো মাছ পাওয়া যায়। বড় আপা বেলেমাছ যা ভালোবাসে। বেলেমাছ ধরে আনবে আনু।
ব্রীজের নিচে কাঁচের মত স্বচ্ছ পানি। পেরিয়ে গিয়ে আবার ধানক্ষেত। রেললাইনের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে ডিস্ট্রিক বোর্ডের রাস্তাটা। যেন অন্তহীন একটা ফিতে কেবলই খুলে যাচ্ছে। আনুর ঘুম পাচ্ছে খুব। সে কাৎ হয়ে বইখাতা কোলের কাছে নিয়ে শুয়ে পড়ে। তারপর আর কিছু মনে থাকে না।
হঠাৎ একটা ঝাঁকুনিতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। তাকিয়ে দেখে, আরে তিস্তা এসে গেছে। তিস্তা জংশন। চোখ কচলে তাড়াতাড়ি উঠে বসে সে। এ গাড়ি এখানেই থাকবে। তারপর বিকেলে রংপুরের প্যাসেঞ্জার নিয়ে আবার ফিরে যাবে মহিমপুর। আনু লাফ দিয়ে নামে। কী বিরাট প্ল্যাটফরম তিস্তার। এ মাথা থেকে ও মাথা হাঁটলে পা ধরে আসতে চায়। ঐ শেষমাথায় দুটো বড় বড় কৃষ্ণচূড়া আর শিমুল ফুলের গাছ। তারপরে মাঝে খোলা শেড। ইঞ্জিনের পানি খাবার চোং ঝুলছে মাথার ওপর। আরো এগিয়ে এলে ওজন করবার কল। কলটার ঠিক পাশে নিচু সাইনবোর্ড। তাতে লেখা পার্বতীপুর লাইনে যাইবার জন্য গাড়ি বদল করুন। আরো খানিকটা হাঁটলে ইস্টিশান। ইস্টিশানের দুদিকে মুখ। একদিকে মহিমপুর থেকে গাড়ি এসে দাঁড়ায়, আরেকদিকে রংপুর থেকে, কাউনিয়া থেকে, লালমনিরহাট থেকে। ওয়েটিং রুমে শেতলপাটির টানা পাখা ঝুলছে। স্টেশন মাস্টারের ঘরে মাস্টার সাহেব খবর কাগজ পড়ছেন। এদিকের ঘরে টেলিফোনের সব চৌকো বাক্স বসানো। ইস্টিশান ঘরের পরে ইদারা। লোহার শেকল বাঁধা বালতি থেকে পানি খাচ্ছে যাত্রীরা। তারপর সোজা হেঁটে গেলে একেবারে শেষ মাথায় দোতলা উঁচু ছোট্ট একটা ঘর। গায়ে বড় বড় করে লেখা সাউথ কেবিন। ওখান থেকে সিগন্যাল ওঠায়, নামায়; আবার টেলিফোনে কথা বলে। সেখান থেকে দেখা যায় তিস্তা ব্রীজ। রোদে তার রংটা গোলাপি দেখায় একটা অতিকায় খেলনার মতো লাগে। রংপুর যেতে কতবার আনু ব্রীজটার ওপর দিয়ে গেছে। জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখেছে। ব্রীজের ত্রিভুজগুলো গুনবার চেষ্টা করছে। কিন্তু এত জোরে চলে গাড়ি, কোনদিনই সঠিক গুনতে পারেনি। আজ মনে হলো হাঁটতে হাঁটতে চলে যায় ব্রীজটার কাছে। তার মনের মধ্যে ভারী রোমাঞ্চ হয়। যে ব্রীজের ওপর দিয়ে গাড়ি করে গেছে, সেটাই সে পায়ে হেঁটে পার হবে, হাত দিয়ে ছুঁয়ে দেখবে।
হাঁটতে থাকে আনু। মাথার ওপরে চড়া রোদ। গলাটা কেমন শুকিয়ে আসছে। কাক ডাকছে। চারদিক খাঁ–খাঁ করছে। টেলিগ্রাফের মেলা তার মাথার ওপরে। বাতাস লেগে মিষ্টি একটা বাজনার মতো শব্দ উঠছে তার থেকে। আনু একটু জিরিয়ে আবার এগোয়। ইস্ কতদূর। ইস্টিশান থেকে ব্রীজটা যতটুকু দেখা গিয়েছিল এখনো ঠিক ততটুকুই লাগছে। ঠিক যেন পাহাড়ের মতো। নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে পাহাড় দেখতো আনু, বাবার সঙ্গে। বাবা বলতেন, পাহাড় মনে হয় কাছে, যতদূর যাবি পাহাড়ও ততদূর সরে যাবে।
আর যেন পারে না আনু। কিন্তু কেমন একটা নেশার মতো পেয়ে বসেছে তাকে। ট্রেন, ইস্টিশান, সিগন্যাল, ব্রীজ—- সব যেন তার স্বপ্নের দেশ থেকে আসে। বুকের মধ্যে এমন একটা নিবিড় টান অনুভব করে সে চিরকাল। সে যদি সারাজীবন গাড়িতে গাড়িতে ঘুরতে পারত, হাঁটতে পারত কাঁকর বিছানো প্ল্যাটফরমে, এই রকম রোদে দাঁড়িয়ে টেলিগ্রাম তারে বাতাসের বাজনা শুনতে পারতো। এখানে দুঃখ নেই, অভাব নেই, অসুখ নেই—- শুধু একটা স্থির হয়ে থাকা আনন্দ কেবল। আনু জোরে জোরে হাঁটতে থাকে। ব্রীজটার কাছে সে পৌঁছুবেই।
পায়ের নিচে তেতে উঠেছে নুড়িগুলো। স্লিপার লাফিয়ে লাফিয়ে চলে আনু। দশ বারোটা লাইন এই খানে কাটাকুটি হয়ে ছড়িয়ে গেছে। একটা ধাঁধার মতো লাগছে। একসময়ে সে। পৌঁছে যায় তিস্তা ব্রীজে।
তখন আর গোটা ব্রীজটা দেখা যায় না। তার সমুখে অতিকায় গেটের ঠ্যাংয়ের মতো লোহার বরগা দুদিকে উঠে গেছে। চূড়োটা দেখতে হলে মাথা ঘাড়ের সঙ্গে ঠেকে যায়। লাল টকটকে রংটা সূর্যের হলকা থেকে তৈরি হয়েছে যেন। হাত দেয়া যায় না, হাত পুড়ে যায়। ব্রীজের ওপর রেললাইন চলে গেছে, পাশে পায়ে হাঁটবার পথ। আবার ট্রেন এলে সরে দাঁড়াবার জন্যে মাঝে মাঝে রেলিং দিয়ে ঘিরে দেওয়া গোল একটু জায়গা। ইটের মোটা থামগুলো নেমে গেছে নদীর ভেতরে। যেখানে নেমেছে, তার চারপাশে অবোধ একটা ছেলের মতো পানি ঘুরছে, ঘুরতে ঘুরতে আবার বয়ে যাচ্ছে। একটা খামের নিচে বড় পাথরের চাইয়ের ওপর বসে মাছ ধরছে একটা লোক। মাথায় তার গামছা বাঁধা। ওপর। থেকে তার প্রসারিত হাত দুটো দেখা যায় শুধু।
গুনতে লাগল আনু। আজ সে গুনে দেখল মোট সতেরোটা ত্রিভুজ। একবারে শেষ মাথায় গিয়ে দাঁড়ায় সে। আবার ফিরে আসতে থাকে। পায়ের নিচে নদীটা কী বিশাল, মনে হয়। আকাশটা উপুড় হয়ে পড়েছে, নীলচে একটা রং লেগেছে–তাই কেমন যেন উদাস দেখায়। একটা নৌকা নেই, তাই মানুষ নেই, পাখি নেই খাঁ খাঁ করছে নদীর বুক। দূরে গুমগুম করে একটা শব্দ ওঠে।
আনু তাকিয়ে দেখে ট্রেন আসছে। তক্ষুনি সে রেলিং ঘেরা গোল জায়গায় গিয়ে দাঁড়ায়। শক্ত করে ধরে থাকে। বুক কেঁপে ওঠে। পায়ের নিচে শিরশির করছে, কাঁপনটা বাড়ছে, শব্দটা ভীষণ হচ্ছে। গুমগুম করতে করতে ট্রেনটা তীরের মতো চলে আসছে, বড় হচ্ছে, কাছে। এলো। সড়াৎ সড়াৎ করে আকাশে বাতাসে ঢাকের কাঠি বাজিয়ে বেরিয়ে গেল ট্রেনটা। তখন কাঁপুনিটা কমে গেল। আনু তাকিয়ে দেখে সে ঘেমে গেছে। আনু ভেবে দেখে, ট্রেনটা সে কিছুই দেখতে পায় নি। সে চোখ বন্ধ করে ছিল, খালি শব্দটা শুনেছে, তার গায়ের ওপর দিয়ে ঝড়ের মতো একটা বাতাস বয়ে গেছে।
ইস্টিশানে ফিরে এসে মেল–বাক্সের ওপর টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে আনু। চারদিকের বাতাস থেকে একটা ঝিমোনো সুর এসে কানে ফিসফিস করে তার। স্টেশন মাস্টার বাসায় চলে গেছেন। টেলিফোনের বাক্সগুলো চুপ হয়ে গেছে। একটা লোক কোট ভাঁজ করে মাথার নিচে দিয়ে ঘুমোচ্ছে। কোথায় একটা বাছা কাঁদছে। পানির ট্যাঙ্ক থেকে টপ্ টন্ টন্ টন্ করে চুঁইয়ে পড়ছে পানি।
আস্তে আস্তে কোমল হয়ে এলো রোদটা। ছায়াগুলো লম্বা হলো। রেললাইনের ওপর গিয়ে পড়ল ইস্টিশানের ছায়া। কৃষ্ণচূড়া আর শিমূলের ডালে শোনা গেল পাখিদের কলরব। আবার মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। আবার বেজে উঠতে লাগল টেলিফোনের বাক্স। কুলিরা লণ্ঠনগুলো মাজতে লাগল, কাঁচ পরিষ্কার করল, তেল ভরল। টিভি স্টলে জমে উঠল ভীড়। মহিমপুরে যাবার জন্যে ফুসতে লাগল ইঞ্জিন। হেলতে দুলতে এসে হাজির হলেন গার্ড সাহেব। একটা পান কিনে খেলেন। আনু গিয়ে গাড়িতে উঠল।
মহিমপুরে বাত আটটায় পৌঁছুলো সে। তার ভয় করতে লাগল বাড়ির জন্যে, মার জন্যে। মা কি বলবেন তাকে? সারাদিন সে কোথায় ছিল? সারাদিন বাড়ির কথা একটুও মনে ছিল না তার। সে যেন একটা অন্য মানুষ এই সারাদিন ঘুরে বেরিয়েছে স্কুল পালিয়ে আর যে আনু বাসায় ফিরছে সে যেন মরে ছিল সারাদিন,সন্ধ্যের সময় আবার জেগে উঠেছে। পায়ে পায়ে ফিরে আসে সে। মনে মনে একটা গল্প বানায়। বলবে বৃত্তি পরীক্ষার পড়া বুঝতে গিয়েছিল ক্লাশের একটা ছেলের বাড়িতে। বলবে সেই ছেলেটার প্রাইভেট মাস্টারের কাছে সে আজ থেকে পড়ছে, হেডমাস্টাব বলে দিয়েছেন, তার পয়সা লাগবে না। বলবে হেডমাস্টার তাকে খুব ভালোবাসেন।
বাসায় এসে দেখে জিনি সিস্টার এসেছেন। বড় আপার মাথার কাছে বসে আছেন। পায়ের কাছে বসেছেন মেজ আপা। সালু আপা আর মিনু আপা বারান্দায় চুপ করে বসে আছে অন্ধকারে। ঘর থেকে এক ফালি আলো এসে পড়েছে তাদের মুখে। জিনি সিস্টার তাকে দেখে বললেন, এসো।
সে জিগ্যেস করলো, ভালো আছেন?
তুমি আজকাল আর যাও না যে?
আমার বৃত্তি পরীক্ষা।
বড় আপা চোখ বুজে শুয়ে আছেন। ঘুমিয়ে কি জেগে তা বোঝা যাচ্ছে না। সেদিকে আড় চোখে একবার তাকাল আনু। বিছানার সঙ্গে একেবারে মিশে আছেন। লণ্ঠনের অস্পষ্ট আলোয় আরো শীর্ণ দেখাচ্ছে তাকে। মেজ আপা বললেন, সারাদিন কোথায় থাকিস?
আনু সে কথার জবাব না দিয়ে রান্নাঘরে এলো। সেখানে সেজ আপা মা–র কাছে বসে। আজ তিনি রান্না করছেন। মা চোখ মুছছেন। মা আনুকে দেখে বললেন, নিচু গলায়, যেন শোনাই গেল না, এই এলি! ফতেমা আজ কেমন করছে দেখগে।
ধক করে উঠলো আজ আনুর বুকের ভেতরটা। অসুখটা আবার বেড়েছে? সে কী করবে বুঝতে পারল না। বলল, ডাক্তার আসেনি।
বুলুকে দিয়ে ডাকালাম।
মা আবার চোখ মুছলেন। আনু বেরিয়ে এলো বাইরে। বড় আপার কাছে যেতে পারল না। জিনি সিস্টার বসে আছেন; তার লজ্জা করল কেমন। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে সে নিঃশ্বাস নিতে লাগল। তার দম যে ফুরিয়ে যেতে চাইছে। সে নড়ল না। একটা কুকুর মানুষের বাচ্চার মতো কেঁদে উঠলো কোথায়। বুলু ভাই এসে তার হাত ধরল একটা কথা না বলে। যেন, দুজনে দাঁড়িয়ে আছে, কে আসবে, কার আসবার কথা আছে।
রাতে বড় আপার কাছে এলো আনু। জিনি সিস্টার চলে গেছেন অনেকক্ষণ। সবাই খেতে বসেছে। কেবল মিনু আপা বসে আছেন পায়ের কাছে। আনুর এতক্ষণ আসতে সংকোচ করছিল। কেমন একটা অপরাধ বোধ তাকে দংশে মারছিল। সারাদিন সে বেড়িয়েছে, আর বড় আপার অসুখ বেড়েছে এদিকে একবারও তার মনে হয়নি বাড়ির কথা। মাথা নিচু করে পাশে বসলো সে চোরের মতো। বড় আপা চোখ মেললেন। তখন ব্ৰিতবোধ করল আনু। সে একটা কথা বলতে পারল না। বিছানার চাঁদর খুঁটতে লাগল অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে। বড় আপা তাকে দেখে যেন হঠাৎ খুশি হয়ে উঠলেন, তারপর ফিসফিস করে বললেন, বাবাকে দেখতে যাবি না আনু? বাবাকে আসতে বলিস।
পরদিন ভোরে, সূর্য ওঠার অনেক আগে বড় আপা মারা গেলেন।
সে কাঁদলো না। যেন তার জানাই ছিল সব। মা-র করুণ কান্নার পটভূমিতে সে তন্ময় হয়ে মনের মধ্যে দেখতে লাগল দুপুরের রোদে পুড়ে যাওয়া লাল টকটকে তিস্তা ব্রীজ।
কুড়িগ্রাম ও ঢাকা
জানুয়ারি ১৯৫৭