সূর্য যাবে ডুবে
সাজিদদের ডিপার্টমেন্ট থেকে একটি ম্যাগাজিন বের হবে। বিজ্ঞান ম্যাগাজিন। নাম প্রণোদনা। এই ম্যাগাজিনের খবর আমি অবশ্য সাজিদের কাছ থেকে পাইনি; পেয়েছি তাদের ডিপার্টমেন্টের আরেকজনের কাছ থেকে। সন্ধ্যায় বাসায় ফিরে দেখি সাজিদ তার টেবিলে সোজা হয়ে বসে খুব মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছে। বাসায় যে আমার মতো আস্ত একটি মানুষ এসে ঢুকল, সেটি হয়তো সে টেরও পায়নি। হয়তো পেয়েছে; কিন্তু আমার আগমন হয়তো তার কাছে তেমন কোনো ব্যাপার না, অথবা এমনও হতে পারে যে, আমার চাইতে তার কাছে বই পড়াটাই বেশি মূল্যবান। সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে মনে হলো আজকাল আমি খুব বেশিই ফেলুদা সাজার চেষ্টা করছি। অকারণ সন্দেহ আর কৌতূহলের ব্যাপারটি ইদানীং খুব প্রকট আকারে আমার মধ্যে দেখা দিয়েছে। নিজেকে বোঝালাম, বাপু তুমি ফেলুদাও নও, হ্যারি পটারও নও। তোমার কাজ জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের যোলকলা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করা। প্রাণীর কোষের ভেতর থেকে অভূতপূর্ব তথ্য বের করে আনাই তোমার কম্ম। আর যাই হোক, সাইকোলজি তোমার সাবজেক্ট নয়!
আমি কাঁধ থেকে টেবিলে ব্যাগ রাখতে রাখতে বললাম, শুনলাম তোদের ডিপার্টমেন্ট থেকে নাকি একটি ম্যাগাজিন বের হচ্ছে?
সাজিদ ঘাড় ফিরিয়ে আমার দিকে তাকাল।অন্যান্য দিনের তুলনায় আজকে আগেই বাসায় ফিরেছি। অন্য কেউ হলে হয়তো জিজ্ঞেস করত, কীরে! আজকে এত তাড়াতাড়ি ফিরলি যে?
কিন্তু সাজিদের এসব জিজ্ঞেস করার টাইম নেই। ম্যাগাজিনের কথা শুনে সে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, হ্যাঁ।
কী বিষয়ক ম্যাগাজিন?
বিজ্ঞান।
তুই কোনো লেখা দিচ্ছিস?
সাজিদ বইটি বন্ধ করল। এরপর বলল, লেখা দিতে পারি; কিন্তু ব্যাপার হলো, মফিজুর রহমান স্যার ওই লেখা ছাপাবেন কি না, সন্দেহ আছে।
সাজিদ যেহেতু মফিজুর রহমান স্যারের আপত্তির কথা ভাবছে, তখন আমার আর বোঝার বাকি থাকে না, লেখাটি আসলে কোন কেন্দ্রিক হতে যাচ্ছে। আমি বললাম, ছাপাবে না কেন? আলবত ছাপাবে। ভালো লেখা হলে মফিজুর রহমান স্যার অবশ্যই ছাপাতে বাধ্য।
আমার কথাগুলো শুনে সাজিদ খুব-একটা আগ্রহ পেল বলে মনে হলো না। বলল, দেখি। এইটুকু বলে সে আবার বইয়ের মাঝে ডুব দিল।
এরপর কেটে গেছে কয়েক মাস। পড়াশোনা, ল্যাব আর পরীক্ষার চাপে আমিও ম্যাগাজিনের ব্যাপারটি বেমালুম ভুলে গেলাম। একদিন রাতে বাসায় ফেরার পর দেখি সাজিদ বাসায় নেই। তার টেবিলের ওপরে নীল মলাটের একটি ম্যাগাজিন রাখা। কৌতূহল থেকে ম্যাগাজিনটি হাতে নিয়ে দেখি ওপরে মোটা মোটা বাংলায় লেখা প্রণোদনা। সাথে সাথে ম্যাগাজিনটা হাতে তুলে নিলাম। এটাই তো সাজিদদের ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হবার কথা ছিল। শেষমেশ হলো তাহলে কিন্তু এতে কি সাজিদের লেখা আছে? সাজিদ লেখা দিলেও মফিজুর রহমান স্যার কি তা আদৌ ছেপেছে? অতশত না ভেবে ম্যাগাজিনের পৃষ্ঠা উল্টিয়ে সোজা চলে গেলাম ম্যাগাজিনের সূচিপত্র অংশে। আমার চোখ দুটো খুঁজে ফিরছে সাজিদের নাম। মাঝামাঝিতে এসে আমি ঠিক ঠিক পেয়ে গেলাম। ইয়েস! ইটস দেয়ার! একটি প্রবন্ধের নাম আমার চোখের সামনে জ্বলজ্বল করছে। সূর্য যাবে ডুবে চুয়াত্তর পৃষ্ঠায়। আমি তড়িঘড়ি করে পৃষ্ঠা নম্বর চুয়াত্তর খুঁজে বের করে দাঁড়ানো অবস্থাতেই পড়তে শুরু করলাম।
ম্যাগাজিনটির ইনার-ডিজাইন খুব সুন্দর করে সাজানো। প্রতিটি লেখার সাথে কিছু স্থির চিত্র দেওয়া আছে যাতে বিষয়বস্তু সম্পর্কে পাঠক সহজে অনুমান করতে পারে। সূর্য যাবে ডুবে এই লেখাটার সাথেও দেওয়া হয়েছে খুব সুন্দর একটি চিত্র। ডুবুডুবু অবস্থায় একটি সূর্য। আমি আর লোভ সামলাতে পারছি না। সরাসরি পাঠে মনোযোগ দিলাম।
সূর্য যাবে ডুবে
আধুনিক বিজ্ঞান আমাদের প্রতিনিয়ত নানা বিস্ময়কর সব তথ্য জানিয়ে হতবাক করে ছাড়ছে। পাল্টে দিচ্ছে আমাদের রোজকার জীবন। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের পদে পদে বিজ্ঞানের অবদান অবশ্যই অনস্বীকার্য। বিজ্ঞানের হাত ধরেই মানুষ যাত্রা করেছে চাঁদ থেকে মঙ্গলে। বিজ্ঞানের রূপরেখা ধরেই মানুষ গভীর সমুদ্র চষে বেড়াচ্ছে। জয় করে নিচ্ছে অজেয় সব ব্যাপার। প্রাণঘাতী রোগের চিকিৎসা আমাদের জন্য বিজ্ঞান সহজলভ্য করে দিয়েছে। আধুনিক জীবনে বিজ্ঞান যেন আমাদের জীবনের প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
অনেক অনেক সুখকর তথ্য, আবিষ্কার এবং উদ্ভাবনের সাথে সাথে বিজ্ঞান আমাদের প্রায়ই বেশ কিছু দুঃসংবাদও শুনিয়ে থাকে। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম যে-দুঃসংবাদ বিজ্ঞান আমাদের সম্প্রতি জানিয়েছে তা হলো, আমাদের সূর্য একদিন তার সব তেজ-শক্তি আর আলো হারিয়ে নিঃশেষ হয়ে পড়বে।
অবাক করা ব্যাপার হলেও সত্য যে, একদিন আমাদের পৃথিবী আর সূর্যের আলোয় আলোকিত হবে না। সকালের সোনা রোদের আশায় অপ্রস্ফুটিত ফুলের কলিটি আর কখনোই প্রস্ফুটিত হবার সুযোগ পাবে না। পৃথিবী ছেয়ে যাবে অন্ধকারে। ঘোর অন্ধকার…।
বিজ্ঞান ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেছে এভাবে, একটি পর্যায়ে গিয়ে মহাকাশের তারাগুলো তাদের সব শক্তিমত্তা, তেজ হারিয়ে ফেলবে। যেসব তারকার ভর সৌর ভরের আট গুণের কম থাকে, অন্তিম দশায় পৌঁছালে তাদের কেন্দ্রের ভর চন্দ্রশেখরের সীমা, অর্থাৎ ১.৪ গুণ সৌর ভরের নিচে থাকবে। এরকম অবস্থায় যারা পতিত হবে তাদের বলা হয় শ্বেতবামন। এর বিপরীতে, অর্থাৎ যেসব তারকার ভর সৌর ভরের আট গুণের বেশি থাকে, অন্তিম দশায় পৌঁছালে তাদের কেন্দ্রের ভর চন্দ্রশেখরের সীমা, অর্থাৎ ১.৪ গুণের মধ্যে থাকলে সেই তারকাগুলো নিউট্রন তারকায় পরিণত হবে। তবে এদের ভর যদি ৩ গুণ সৌরভর অপেক্ষা বেশি হয় তাহলে তারা আর নিজেদের ধরে রাখতে পারে না। সংকুচিত হতে হতে এরা একটি ব্ল্যাকহোলে পরিণত হয়ে যায়।
আমাদের অতি প্রিয়, অতি পরিচিত সূর্যের বেলাতেও এই কথাগুলো প্রযোজ্য। সাম্প্রতিক বিজ্ঞান আমাদের জানাচ্ছে যে, সূর্যের জ্বালানি ক্রমশ ফুরিয়ে যাচ্ছে। সূর্যের জ্বালানি হলো Hydrogen Fuel. নাসার বিজ্ঞানীরা বলছেন, সূর্য তার ভেতরে যে-তাপ ধারণ করে আছে, গত ৪.৫ বিলিয়ন বছরে সেই তাপের প্রায় অর্ধেকটাই শেষ হয়ে গেছে। প্রতিনিয়ত সূর্যের এই জ্বালানি খরচ হচ্ছে এবং কমছে নিজের তেজস্ক্রিয়তাও; কিন্তু সূর্যের তাপের মাত্রা এতই বেশি যে, তার ক্ষয়ে যাওয়া শক্তির ঘাটতি সাধারণত আমাদের চোখে পড়ে না। খুব সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বৈজ্ঞানিক গবেষণা ছাড়া এই ব্যাপারগুলো বোঝা যায় না। এভাবে নিজের শক্তি ক্ষয় হতে হতে এমন একটি সময় উপস্থিত হবে, যেদিন সূর্য একেবারেই আলোহীন এবং নিস্তেজ হয়ে পড়বে। আমাদের পরিচিত সূর্য পরিণত হবে শ্বেতবামনে।
তবে খুব শীঘ্রই যে এমনটি ঘটবে, তা নয়। বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন যে, সূর্যের মধ্যে এখনো যে-পরিমাণ জ্বালানি মজুদ আছে, সেই জ্বালানি দিয়ে আগামী আরও ৫ বিলিয়ন বছর সূর্য এভাবে বহাল তবিয়তে থাকতে পারবে।
নাসার বক্তব্য এবং তথ্যাদি বিশ্লেষণ করে যে-সারমর্ম পাওয়া যায় তা হলো, সূর্যের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময় অপেক্ষা করছে যখন সূর্য আলোহীন, শক্তিহীন হয়ে পড়বে। শুধু সূর্যই নয়, সূর্যের মতো আরও অসংখ্য, অগণিত এরকম নক্ষত্রের ভাগ্যেও যে এই পরিস্থিতি জুটবে, সেটাও বিজ্ঞান আমাদের জানাচ্ছে খুব স্পষ্ট করে। ইতোমধ্যেই অসংখ্য নক্ষত্র নিজেদের শক্তি, জ্যোতি হারিয়ে শ্বেতবামন আর নিউট্রন তারকায় পরিণত হয়েছে। ভবিষ্যতে আরও হবে।
খুব মজার ব্যাপার হলো, আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশো বছর আগে, মরুভূমিতে একজন নিরক্ষর লোকের ওপর নাযিল হওয়া পবিত্র কুরআনুল কারীমে ঠিক এই কথাগুলো খুব সুন্দর, খুব গোছালো এবং সুস্পষ্ট করে বলা আছে।
প্রণোদনা ম্যাগাজিনের এতটুকু পড়ে এবার আমি নড়েচড়ে বসলাম। আমি আসলে এতক্ষণ এই টুইস্টটির জন্যেই অপেক্ষা করছিলাম; কিন্তু ঘটনা যে—এতটা কাহিনির রূপ নেবে, সেটি বুঝতে পারিনি। সূর্যের অন্তিম পরিণতি, সূর্যের জ্বালানির নিঃশেষ হয়ে যাওয়া, শ্বেতবামন আর নিউট্রন তারকা সম্পর্কিত তথ্যাবলি আমাকে পুরোটাই চমকে দিয়েছে; কিন্তু এই ব্যাপারগুলো কুরআনে কীভাবে আছে সেই কৌতূহলটাই এখন বেশি। আর অপেক্ষা করতে পারছি না। পরের অংশটুকু পড়ার জন্যে মনটি ব্যাকুল হয়ে আছে। ধপাস করে গিয়ে বসলাম সাজিদের খাটে। চোখজোড়া প্রণোদনা ম্যাগাজিনের ওই পাতাগুলোতেই আটকে আছে। আমি আবার পড়তে শুরু করলাম :
এখন যে-কেউ প্রশ্ন করতে পারে, সাম্প্রতিক বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত তথ্য চৌদ্দশো বছর আগের একটি বইতে কীভাবে থাকতে পারে? এই প্রশ্নটি আসা স্বাভাবিক। প্রথমত, আমাদের যে-জিনিসটি বুঝতে হবে তা হলো, এই কুরআন কোনো মানুষের লেখা বই নয়। এটি এমন এক সত্তার বাণী, যিনি সৃষ্টি করেছেন পৃথিবী এবং পৃথিবীর বাইরের সবকিছু। তিনিই সৃষ্টি করেছেন চাঁদ, তারা, সূর্য, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি। তিনিই সৃষ্টি করেছেন পাহাড়-পর্বত, নদী, সমুদ্র, বন—সবকিছুর ওপর তিনিই একচ্ছত্র অধিপতি। তিনি সময়ের বাঁধনে আবদ্ধ নন; বরং তিনিই সময়ের সৃষ্টিকর্তা। মহাকাশের ক্ষুদ্র তারকা থেকে গভীর সমুদ্রতলের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বালুকণা—এমন কোনো পদার্থ, এমন কোনো জিনিস নেই, যা সম্পর্কে তিনি ওয়াকিবহাল নন। এদের অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ সবই তার জানা। সূর্য এবং নক্ষত্ররাজির সৃষ্টিকর্তাই তো জানবেন—এদের ভবিষ্যৎ পরিণতি কী হতে পারে। সুতরাং, সূর্যের সৃষ্টিকর্তার কাছ থেকে আসা বাণীর মধ্যে সূর্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে কথা থাকবে, এটি খুব আশ্চর্যের কিছু নয়। বিশ্বাসী মানুষমাত্রই এটি সহজে বুঝতে পারবে।
দ্বিতীয়ত এই কুরআন কোনো সাইন্সের বই নয়। অর্থাৎ এটি এমন কোনো বই নয় যে, এতে কেমিস্ট্রির বিক্রিয়া, পদার্থ বিজ্ঞানের সূত্র আর জীববিজ্ঞানের মোটা মোটা থিওরি এতে গৎবাঁধা লেখা থাকবে। এতে সাইন্স থাকবে না; বরং সাইন থাকবে। অর্থাৎ এতে থাকবে বহু নিদর্শন। এই নিদর্শনগুলো কোনো স্পেশাল বিজ্ঞানী বা কোনো স্পেশাল মানুষের জন্যে দেওয়া হয়নি। এগুলো সকল মানুষের জন্যই দেওয়া। তাই এগুলো এমনভাবে দেওয়া হয়েছে যেন মাঠের কৃষক থেকে শুরু করে গবেষণাগারের বিজ্ঞানী, সবাই বুঝে নিতে পারে।
এবার তাহলে আবার প্রসঙ্গে ফিরে আসা যাক। কুরআন কোথায় বলেছে সূর্য একদিন তার সকল শক্তি নিঃশেষ করে আলোহীন, নিস্তেজ হয়ে পড়বে, তাই না?
আমরা প্রথমেই সূরা ইয়াসীনের আটত্রিশ নম্বর আয়াতের দিকে তাকাই। আয়াতটিতে To 260 And the Sun runs (on course) toward its stopping point. That is the determinaton of the exalted in might, the knowing.
অর্থাৎ এই আয়াতের সরল বাংলা করলে এরকম হয়, আর, সূর্য ছুটে চলছে তার জন্যে নির্দিষ্ট করে দেওয়া গন্তব্যের দিকে। এটি মহাপরাক্রমশালী সর্বজ্ঞের সুনিরূপিত নির্ধারণ।
একটু গভীরভাবে যদি খেয়াল করি, এই আয়াতে সূর্যের জন্য নির্ধারিত গন্তব্য বোঝাতে যে-অ্যারাবিক ওয়ার্ড ব্যবহার করা হয়েছে, সেটি হলো লিমুসতাকাররিন। এই আরবী শব্দের জন্য যদি আমরা ব্রিটিশ ইংরেজি ডিকশনারি খুলি, তাহলে দেখব যে, এই আয়াতের অর্থ করা আছে, The resting place, The stopping point, সরল বাংলা করলে হবে, থেমে যাওয়ার স্থান, নির্ধারিত গন্তব্য ইত্যাদি।
তাহলে কী বোঝা গেল? উক্ত আয়াতের ভাষ্যমতে, সূর্য তার জন্যে নির্দিষ্ট করে দেওয়া গন্তব্যের দিকে অবিরত ছুটে চলেছে। তার জন্যে একটি নির্দিষ্ট পয়েন্ট, একটি নির্দিষ্ট অবস্থা নির্ধারণ করা আছে, যে-সময়ে, যে-অবস্থায় এসে তাকে থেমে যেতে হবে এবং এটাই হচ্ছে মহাপরাক্রমশালী আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার নির্ধারিত নিয়ম।
আধুনিক বিজ্ঞান কী বলছে? আধুনিক বিজ্ঞান বলছে—সূর্যের সকল জ্বালানি একটি নির্দিষ্ট সময় পরে শেষ হয়ে যাবে। সেদিন সূর্য হয়ে পড়বে তেজহীন, আলোহীন তথা শক্তিহীন। সূর্যের এই জ্বালানি প্রতিনিয়ত নিঃশেষ হচ্ছেই। একটি পর্যায়ে গিয়ে ঘটবে চূড়ান্ত পতন। সেদিন সূর্যকে থেমে যেতে হবে। ঠিক এই কথাগুলোই কি আল কুরআন আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশো বছর আগে আমাদের জানায়নি? শুধু তা-ই নয়। সূর্য যে একটি সময়ে আলো ও শক্তিহীন হয়ে পড়বে, সে ব্যাপারটি খুব স্পষ্ট করেই বলেছে কুরআন। সূরা তাকবিরের একেবারে শুরুতেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলছেন, যখন সূর্য হয়ে পড়বে জ্যোতিহীন।
এই সূরায় আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা কিয়ামতের আগের কিছু নিদর্শন নিয়ে কথা বলেছেন। সেখানে তিনি খুব স্পষ্ট করেই বলেছেন, কিয়ামতের আগে সূর্য জ্যোতিহীন হয়ে পড়বে। কিয়ামত কবে হবে সে-জ্ঞান আমাদের কারও জানা নেই। এমনকি স্বয়ং রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকেও কিয়ামতের চূড়ান্ত সময়টি সম্পর্কে জানানো হয়নি। এই জ্ঞান কেবল আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলার কাছেই। তো, তিনি বলছেন, কিয়ামতের আগে সূর্য জ্যোতিহীন হয়ে পড়বে। একই কথা কি আমাদের বিজ্ঞানও বলছে না? বিজ্ঞান কি বলছে না, একটি সময়ে গিয়ে সূর্য হারিয়ে ফেলবে তার তেজ, জ্যোতি ও শক্তি? বিজ্ঞান কি বলছে না, সূর্য হয়ে পড়বে আলোহীন? বিজ্ঞান কি বলছে না, সূর্য হয়ে যাবে শ্বেতবামন?
একটি দৃশ্য কল্পনা করার চেষ্টা করা যাক। মরুভূমির অঞ্চল। নিরক্ষর একজন লোক। দিনের আকাশে গনগনে সূর্য দেখে কেন তার মনে হবে এই সূর্য একদিন নেতিয়ে পড়বে? আলোহীন হবে? একজন সাধারণ মানুষ হলে তো তার ভাবা উচিত ছিল যে, এই সূর্য অবিনশ্বর। যার এত তেজ, এত শক্তি, এত তাপ, সে কীভাবে নিঃশেষ হতে পারে? আলোহীন হতে পারে?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও ঠিক এরকম ভাবতেন যদি তিনি ঐশী বাণীপ্রাপ্ত না হতেন। যদি না তাকে সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্র, গ্যালাক্সির সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা জানাতেন—সূর্য একদিন আলোহীন হয়ে পড়বে। তাকে জানানো হয়েছে কুরআনের মাধ্যমে। তবেই তিনি জেনেছেন।
আধুনিক বিজ্ঞান এই সময়ে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যে-সকল তথ্য আমাদের জানাচ্ছে, সেই তথ্যগুলো সম্পর্কে আজ থেকে সাড়ে চৌদ্দশো বছর আগে কুরআনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন। এটি যদি সুমহান আল্লাহর কাছ থেকেই না আসে তবে কীভাবে সম্ভব?
না। ঘটনার এখানেই শেষ নয়। শুরুতেই বলেছিলাম যে, কেবল সূর্যই নয়, সূর্যের মতো আরও অসংখ্য তারকা, নক্ষত্রের কপালেও জুটবে একই ভবিতব্য। সূর্যের মতো সেগুলোও হয়ে পড়বে আলোহীন, শক্তিহীন ও তাপহীন। তাদের কেউ হয়ে যাবে শ্বেতবামন, আবার কেউ হয়ে যাবে নিউট্রন তারকা। ঠিক এই ইঙ্গিতটাও আমরা পবিত্র কুরআন থেকে পাই। যেমন সূরা তাকবিরের দ্বিতীয় আয়াতেই আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেছেন, যখন নক্ষত্ররাজি পতিত হবে (বা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাবে)।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই আয়াতে পতিত হওয়া বা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে যাওয়া অর্থে যে-আরবী ক্রিয়া ব্যবহার করা হয়েছে সেটি হলো—ইনকাদারাত। এটার দুটো অর্থ। প্রথম অর্থ হলো—কোনো কিছু আলোহীন হয়ে যাওয়া। দ্বিতীয় অর্থ হলো—ঝরে যাওয়া, বিচ্যুত হওয়া, পতিত হওয়া। আবার, কাদারাতুন অর্থ হলো—বৃহদাকৃতির পিণ্ড বস্তু। আয়াতটিতে বলা হচ্ছে, ওয়া ইযান নুজুমুন কাদারাত। অর্থাৎ যখন নক্ষত্ররাজি আলোহীন হয়ে বৃহদাকৃতির ঢেলা বা বস্তুপিণ্ডের রূপ ধারণ করবে।
ঠিক এমনটাই আমরা ওপরে জেনেছি। আমরা জেনেছি যে, একটি নির্দিষ্ট সময়ে এসে সূর্যের মতো অন্যান্য উজ্জ্বল নক্ষত্ররাজিও তাদের জ্যোতি হারিয়ে ফেলবে এবং তারা পরিণত হবে শ্বেতবামন আর নিউট্রন তারকায়। আলো, শক্তি-তেজ এবং তাপহীন। এই অবস্থাগুলোকে বর্ণনা করতে গিয়ে কুরআন এভাবে বলছে,
যখন সূর্য জ্যোতিহীন হয়ে পড়বে
আর, খসে পড়বে নক্ষত্ররাজি
এখানেও শেষ নয়। সূরা মুরসালাতের আট নম্বর আয়াতেও ঠিক একই কথা হয়েছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলছেন,
যখন নক্ষত্ররাজি হয়ে পড়বে আলোহীন
আজ সাম্প্রতিক বিজ্ঞান আমাদের যা জানাচ্ছে, সৃষ্টিকুলের মালিক কত আগেই-না তা আমাদের জানিয়ে রেখেছেন। তিনি মানুষকে সত্যানুসন্ধানী হতে বলেছেন। তার সৃষ্টিজগৎ থেকে খুঁজে বের করতে বলেছেন তার নিদর্শনসমূহ। আধুনিক বিজ্ঞানের জন্মের বহু আগে একজন নিরক্ষর লোকের দ্বারা এগুলো রচনা করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। তার পক্ষে কখনোই বলা সম্ভব নয় যে, কীভাবে সূর্যের মতো এত তেজস্বী নক্ষত্র আলোহীন হয়ে যেতে পারে। কীভাবে সুবিশাল নক্ষত্ররাজি হয়ে পড়তে পারে আলো, শক্তিহীন। বলা তো দূরের কথা, তার ভাবনাতেও এগুলো আসা স্বাভাবিক যুক্তিবিরুদ্ধ, যদি-না তিনি কোনো ঐশীবাণী দ্বারা এগুলো সম্পর্কে জ্ঞাত না হন। এই বাণীগুলো নিশ্চিতরূপে সেখান থেকেই আসা সম্ভব, যে-সত্তা এই আকাশ, সূর্য, চন্দ্র, নক্ষত্রসহ সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা। তিনি সুমহান আল্লাহ।
সাজিদের প্রবন্ধটি এখানেই শেষ। পুরো লেখাটি পড়ার পরে আমার সারা শরীরে যেন বিদ্যুৎ খেলে গেল। আমি বিমোহিত হয়ে রইলাম খানিকক্ষণ। এতটা বিস্ময়ে ভরা আল কুরআন? মানুষকে জানাচ্ছে কিয়ামতপূর্ব কিছু নিদর্শন। অথচ, তার মধ্যেই কি না বিজ্ঞানের ছোঁয়া। সুবহানাল্লাহ!
আমি পকেট থেকে মোবাইল বের করে সাজিদকে ফোন করলাম। তাকে আজ টিএসসির সাতরঙা চা খাওয়াব। ওর ফোনে কল গেল না। বন্ধ দেখাচ্ছে। আমি কাপড়চোপড় পাল্টিয়ে টিএসসি যাওয়ার জন্যে রেডি হলাম। ইতোমধ্যেই দেখি একগাদা বই হাতে সাজিদ রুমে ঢুকল। তাকে বললাম, তোর ফোন বন্ধ পাচ্ছিলাম।
সে বলল, ফোন চুরি গেছে।
আমি বেশ অবাক হয়ে বললাম, কীভাবে?
এক আত্মীয়কে দেখতে গিয়েছিলাম পিজিতে। আসার পথে রিক্সায় কথা বলছিলাম ফোনে। পেছন থেকে এক ছোকরা ঝাপটা মেরে নিয়ে দৌড় দিল।
আমি হাসতে হাসতে বললাম, বেচারা দৌড় দিল কেন?
সাজিদ আমার কথা শুনে বেশ অবাক হলো। সে খুব কমই অবাক হয়। সে যখন অবাক হয় তখন তার চোখের পাতা নড়ে না। একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে। সে বলল, ছিনতাইকারী ছিনতাই করে দৌড় দেবে এটাই স্বাভাবিক নয় কি?
আমি বেশ বিজ্ঞসুলভ চেহারায় বললাম, তা ঠিক; কিন্তু সে যদি জানত—তুই কোনো দিনও বেচারাকে ধাওয়া করবি না, তাহলে সে কিন্তু ফোন নিয়ে দৌড়ে পালাত না।
আমি বুঝতে পারলাম সাজিদ এই মুহূর্তে বিশাল এক লেকচার শুরু করবে। সে আমাকে ক্রিমিনাল সাইকোলজির নানান ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শুনিয়ে প্রমাণ করে ছাড়বে যে, ওই মুহূর্তে ছিনতাইকারীর কেন দৌড়টি দেওয়া যৌক্তিক ছিল। লেকচার শুরুর পূর্বেই তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ওসব বাদ দে। আসল কথায় আসি। তোকে ফোন করেছিলাম একটি কারণে।
কী কারণ? জানতে চাইল সাজিদ।
তোকে এখন আমার সাথে টিএসসি যেতে হবে। আজ তোকে সাতরঙা চা খাওয়াব।
সাজিদ কিছুই বলল না। কিছু না বলার মানে হলো সে আমার সাথে টিএসসিতে যাবে। তাকে বললাম, তোর আর্টিকেলটি একটু আগে পড়ে শেষ করলাম। ফাটাফাটি লিখেছিস। এ জন্যেই আজকে তোকে সাত রঙা চা খাওয়াব।
এবারও সে কিছু না বলে তার চেয়ারে গিয়ে বসল। হাত থেকে বইগুলো রেখে আবার উঠে দাঁড়াল। আমি আবার বললাম, আচ্ছা, তুই না বলেছিলি এই ম্যাগাজিনে প্রবন্ধ দিলে মফিজুর রহমান স্যার নাও ছাপাতে পারে?
হ্যাঁ।
তাহলে ছাপাল কীভাবে?
তা তো জানি না।
তার কোনো প্রতিক্রিয়া জানতে পেরেছিস?
সাজিদ কোনো উত্তর না দিয়ে তার ব্যাগ থেকে একটি নীলরঙা খাম বের করে আমার হাতে দিল। সম্ভবত ভেতরে একটি চিঠি আছে। আমার হাতে খামটি দিয়েই সে ওয়াশরুমে ঢুকে গেল। আমি খামটি খুলে পড়তে শুরু করলাম :
সাজিদ,
প্রণোদনা ম্যাগাজিনে প্রকাশিত তোমার আর্টিকেলটি আমি পড়েছি। আমি বলব না—তোমার আর্টিকেলটি পড়ে আমি বিমোহিত হয়েছি। তোমার আর্টিকেল পড়ার পরের অনুভূতি বোঝানোর মতো শব্দ আমার ডিকশনারিতে মজুদ নেই। ক্লাসে এবং ক্লাসের বাইরে ইতিপূর্বে তোমার সাথে আমার বেশ কয়েকবার ঠান্ডা বিতর্ক হয়েছে। খুব তাচ্ছিল্যভরে তোমাকে আমি মি. আইনস্টাইন বলে ডাকতাম। আই অ্যাপোলোজাইয মাই সান। খুব ধার্মিক পরিবারে বেড়ে উঠলেও জীবনে আমি বেশ কড়া অবিশ্বাসীতে পরিণত হই। বারবার চেষ্টা করেছি এই হতাশাগ্রস্ত জীবন থেকে বেরিয়ে আসতে পারিনি; কিন্তু বিশ্বাস করো, তোমার আর্টিকেলটি পড়ে আমার খুব করে আবার মন চাচ্ছে বিশ্বাসী শিবিরে ফিরে আসতে। আশা করছি আমি সফল হব। আমার জন্যে দোয়া কোরো। তোমাকে ধন্যবাদ।
তোমার স্যার
মুহাম্মদ মফিজুর রহমান
চিঠি পড়া শেষ হতে খেয়াল করলাম আমার চোখ দুটো খুব ভারী হয়ে উঠেছে। টুপ করে দু-ফোটা জল নিচেও গড়িয়ে পড়ল। আমার চোখের জলে এই নীল খাম যাতে ভিজে না যায় সে জন্য তাড়াতাড়ি খামটি নিরাপদে সরিয়ে ফেললাম। চোখের জলে এই নীলরং মুছে না যাক। এই নীল শুভ্রতার প্রতীক। এই শুভ্রতা পবিত্রতার বাহক। এই পবিত্রতা ছড়িয়ে পড়ুক সব প্রাণে। জগতের সকল দ্বিধাগ্রস্ত মফিজুর রহমান স্যারেরা এই শুভ্রতায় পবিত্র হয়ে উঠুক। আমি মনে মনে বললাম, সাজিদ, আই অ্যাম প্রাউড অফ ইউ মাই ফ্রেন্ড।