১১. সুবর্ণের বর্ষা সংখ্যা

সুবর্ণের বর্ষা সংখ্যা বের হয়েছে। প্রচ্ছদে কদম গাছের ছবি। ফটোগ্রাফকে কি কায়দা করেছে, দেখে মনে হয় জলরঙে আঁকা ছবি। আতাহারের মনে হল, লোকজন প্রচ্ছদ দেখেই পত্রিকা কিনে ফেলবে। হু হু করে সুবর্ণ বিক্রি হয়ে যাবে। আতাহার সূচিপত্রে চোখ বুলাল—

আবু কায়সার : রবীন্দ্রনাথের বর্ষা।

বুকের ভেতর আতাহার নিঃশ্বাস চাপিল। আবার রবীন্দ্রনাথ? এই বুড়োর হাত থেকে কি নিস্তার নেই?

মনিরুল হাসান। জীবনানন্দের বর্ষাবিদ্বেষ।

জীবনানন্দের বর্ষাবিদ্বেষ ছিল না-কি? হেমন্ত, শীত, এইসব নিয়ে ভদ্রলোকের তামাতি আছে–তার মানে এই না যে তার বর্ষা বিদ্বেষ ছিল। বাঙালী ছেলের বর্ষাবিদ্বেষ থাকলে বুঝতে হবে সে অসুস্থ। তার ভাল চিকিৎসা হওয়া দরকার।

বর্ষায় নিবেদিত কবিতাগুচ্ছ :

বেশ কটি কবিতা আছে। আতাহারের বুক ধ্বক ধ্বক করছে। কখন তার নিজের নামটা পাওয়া যাবে। নাম নেই। আশ্চর্য কাণ্ড তো—নাম থাকবে না কেন? তরুণদের কবিতা কি আলাদা কোন শিরোনামে যাচ্ছে? আতাহার দ্রুত পুরো সূচিপত্রে চোখ বুলাল। তারপর পড়ল আস্তে আস্তে–দ্রুত চোখ বুলালে অনেক সময় চোখ এড়িয়ে যায়। আতাহার বা সাজ্জাদ দুজনের কারো নামই নেই।

এমন অবশ্যি হতে পারে যে, ভুলে সূচিপত্রে নাম আসেনি। তরুণ কবি, তরুণ গল্পকারদের ক্ষেত্রে এ জাতীয় ভুল হয়। তাদের ক্ষেত্রেও হয়েছে। ভেতরে কবিতা ঠিকই ছাপা হয়েছে, শুধুসূচিপত্রে নাম নেই।

আতাহার একটা একটা করে পাতা উল্টাল। না, কবিতা ছাপা হয়নি। গনি সাহেব তাদের ডিজ দিয়েছেন। নিউজ স্ট্যান্ডের ছেলেটা বলল, কিনবেন স্যার? আতাহার বলল, টাকা থাকলে কিনতাম। টাকা নেই। পত্রিকা ঘাটাঘাটি করেছি। এই বাবদ তুই বরং একটা ঢাকা রেখে দে। ছেলেটা রাগী চোখে তাকাল। তবে আতাহারের সঙ্গে অন্য যে ভদ্রলোক গভীর মনযোগে একটার পর একটা খবরের কাগজ পড়ে যাচ্ছেন, তিনি মজা পেয়ে হো হো করে হাসতে লাগলেন। আতাহারের মনে হল বর্ষার এই সকালটা একজনকে গভীর আনন্দ দানের মাধ্যমে শুরু হল। কবিতা ছাপা না হবার পরেও হয়ত আজকের দিনটা ভাল যাবে। যদিও তার সম্ভাবনা ক্ষীণ। সকালে বাড়ি থেকে বেরুবার সময় একটা কাক বসে থাকতে দেখা গেছে। কাকযাত্রা অসম্ভব অশুভ।

কাক বলে কা কা
চার পাশ খা খা।

শিয়ালযাত্রা শুভ। ঢাকা শহরে শিয়াল কোথায় পাওয়া যাবে? গ্রামেই শিয়াল নেই আর ঢাকা শহরে শিয়াল।

শিয়াল বলে হুক্কাহুয়া
তার কাছে জগৎ ভুয়া।

আজ হচ্ছেটা কি? ব্যর্থ কবি ছড়াকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে। মাথার ভেতর একের পর এক ছড়া তৈরি হচ্ছে। আতাহার রিকশা নিয়ে নিল। সে যাবে মূগদাপাড়া। কণার ঠিকানা শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেছে। সে থাকে মুগদাপাড়ায় আটার কলের পশ্চিম পাশে। ইউনানী দাওয়াখানার দোতলায়। নম্বর-টম্বর কিছু নেই। খুঁজে বের করতে জীবন বের হয় যাবে। জীবন বের হলে বের হবে। ব্যর্থ কবির জীবন এমন কিছু মূল্যবান নয়।

কণাকে চিড়িয়াখানা দেখানোর জন্যে সময়টা ভাল না। প্যাঁচপ্যাঁচে বর্ষ। এখন বৃষ্টি হচ্ছে না, তবে যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে। আকাশ ঘন কালো হয়ে আছে। বর্ষায় পশুপাখি দেখতে ভাল লাগার নয়। বর্ষায় দেখতে হয় গাছপালা–। বৃষ্টি নামলে এদের যাবার উপায় নেই–এদের নিজ নিজ জায়গায় দাঁড়িয়ে ভিজতে হবে। পশুপাখি চেষ্টা করবে বৃষ্টির হাত থেকে বাঁচবার। সম্পূর্ণ দুরকম ব্যাপার।

 

অনেকক্ষণ কড়া নাড়ার পর যে মেয়েটি দরজা খুলে দিল, মনে হচ্ছে সেই কণা। কালো রোগা একটা মেয়ে, চোখ দুটি বিষন্ন। চোখ বিষন্ন নাও হতে পারে। ব্যাপারটা হয়ত তার কল্পনা। মেয়েটি এলোমেলো ভঙ্গিতে হালকা নীল একটা শাড়ি পরেছে। নীল শাড়ি পরা মেয়েদের চোখ বিষন্ন দেখায়। শাড়ির ছায়া পড়ে চোখে। মেয়েটি বলল, কে?

আতাহার বলল, আমাকে চিনবেন না। আমার নাম আতাহার। সাজ্জাদ আমাকে পাঠিয়েছে। ওর সঙ্গে একদিন মাত্র আপনার দেখা হয়েছে। জানি না। ওর কথা আপনার মনে আছে কিনা।

কণা উৎফুল্ল গলায় বলল, আরে, সাজ্জাদ ভাইজানের কথা মনে থাকব না? আপনে যে কি বলেন।

উনি বলেছিলেন, আপনাকে আর আপনার স্বামীকে চিড়িয়াখানা দেখবেন।

হ্যাঁ, বলেছিলেন।

আমাকে পাঠিয়েছেন। বললে আমি একটা গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে আসি।

এখন?

আপনাদের অসুবিধা না থাকলে আমি এখনি নিয়ে যাব। চিড়িয়াখানা সকাল নটা থেকে খুলে। এখন বাজছে এগারোটা।

আতাহার লক্ষ্য করল, মেয়েটার চোখে চাপা আনন্দ ঝলমল করছে। আনন্দের চেয়ে কৌতূহল এবং বিস্ময় থাকাটা উচিত ছিল না? কথা নেই বার্তা নেই, একটা লোক চিড়িয়াখানা দেখানোর ব্যবস্থা করছে এতে বিস্মিত হবার কথা, মেয়েটা বিস্মিত হচ্ছে না।

কণা বলল, আমার স্বামীরে একটু জিজ্ঞেস করা লাগবে ও এখন যাবে কিনা।

জিজ্ঞেস করুন।

সে তো ফামেসিতে কাজে আছে।

আমি শুনেছিলাম ফর্মেসির চাকরি চলে গেছে।

একটা গেছে। আরেকটা পেয়েছে। ফার্মেসির কাজ যারা জানে তাদের কাজের অসাবধা হয় না।

উনার ফর্মেসিটা কোথায়?

কাছেই রাস্তার মাথায়।

আতাহার বলল, আপনি কি জিজ্ঞেস করে আসবেন, না। আমিই গিয়ে জিজ্ঞেস করব?

চলেন দুইজনে মিলে যাই।

আতাহার মেয়েটির বিশেষত্বগুলি ধরার চেষ্টা করছে। চোখে পড়ার মত বিশেষত্ব থাকতেই হবে। সাজ্জাদের মত ছেলে কোন কারণ ছাড়া হুট করে মেয়েটাকে চিড়িয়াখানা দেখানোর জন্যে ব্যস্ত হয়ে যাবে, তা হয় না। অনেক উদ্ভট উদ্ভট কাণ্ড সে করে, তবে তার প্রতিটি উদ্ভট কাণ্ডের পেছনে ভাল লজিক থাকে। এই মেয়েটির ক্ষেত্রেও আছে, তবে তা আতাহারের চোখে ধরা পড়ছে না। কণাকে আর দশটা সাধারণ মেয়ের মতই লাগছে। তবে কথাবার্তা বলছে সহজ ভঙ্গিতে। অচেনা পুরুষের সঙ্গে কথা বলার আড়ষ্টতা তার মধ্যে নেই। না থাকারই কথা। যে শিল্পীর সামনে মডেল হয়ে পোজ দেয় সে অচেনা পুরুষের সামনে লজ্জায় জড়সড় হবে না, এটাই স্বাভাবিক।

কণার স্বামী থলথলে ধরনের বেঁটে একজন মানুষ। কয়েক রাত ঘুম না হলে চোখে যে ঘোর ঘোর ভাব চলে আসে তার চোখেও তাই চলে এসেছে। মনে হচ্ছে সুযোগ-সুবিধা মত অযুদ্ধ বিক্রি করতে করতে সে খানিকটা ঘুমিয়ে নেবে। চিড়িয়াখানায় যাবার প্রস্তাবে সে বিস্মিত হল না। হাই তুলতে তুলতে বলল, কাজকর্ম ফেলে চিড়িয়াখানা কি? ছুটির দিনে আসেন। শুক্রবার দোকান একবেল ছুটি থাকে। শুক্রবার সকালে আসেন।

আতাহার অত্যন্ত আনন্দিত হবার ভঙ্গিতে হেসে বলল, জ্বি আচ্ছা।

এই শুক্রবার না, তার পরের শুক্রবারে আসেন। এই শুক্রবারে কাজ আছে।

জ্বি আচ্ছা। কণা-সমস্যার সমাধান হবার পর আতাহার স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলল। মানুষ

খোঁজার ঝামেলা থেকে আপাতত মুক্তি পাওয়া গেছে। সাজ্জাদ জিজ্ঞেস করলে সে এখন বলতে পারবে–কণাকে পাওয়া গেছে। এতে সাজ্জাদের আগ্রহও খানিকটা কমে যাবার কথা। পাওয়া না গেলেই আগ্রহ বাড়তে থাকে–একবার পাওয়া গেলে আগ্রহ কমে যায়।

মডার্ন ফার্মেসি থেকে বের হয়েই আতাহার কণার দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তাহলে যাই।

কণা হাসিমুখে বলল, জ্বি আচ্ছা।

এই শুক্রবারের পরের শুক্রবার গাড়ি নিয়ে চলে আসব।

ইনশাল্লাহ বলেন। ইনশাল্লাহ না বললে একটা বেড়াছেড়া হয়।

ইনশাল্লাহ।

কণা বলল, আমি একটা পান খাব। মিষ্টি পান। রাস্তার মোড়ে পান সিগারেটের দোকান।

আতাহার কণাকে মিষ্টি পান। কিনে দিল। এবং মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হল মেয়েটি স্মাটা। আতাহার বলল, আমি আমার বাড়ির ঠিকানা তোমাকে লিখে দিয়ে যাচ্ছি। যদি তোমরা অন্য কোথাও চলে যাও আমাকে জানিও।

কণা হাসিমুখে বলল, জ্বি আচ্ছা। বলেই সে ঠোঁট গোল করে ফুটপাতে লাল পানের পিক ফেলল। আগের চেয়ে অনেক বেশি হাসিখুশি গলায় সে বলল, ভাইজান, প্রথম আপনি আমারে আপনে কইরা বলতেছিলেন। এখন তুমি বলতেছেন। কারণটা কি?

আতাহার হকচকিয়ে গেল। কারণ, কেন সে তুমি বলা শুরু করেছে সে নিজেও জানে না। কণা হাসছে। আতাহারের হকচকানোয় মনে হয় সে খুব মজা পাচ্ছে। কণা আবারো রাস্তায় পিচ করে পিক ফেলল। অতহারের মনে হল, মেয়েদের পান খেয়ে রাস্তায় পিক ফেলার দৃশ্যটাও তো সুন্দর। খুব সুন্দর। আমরা কখনো তুচ্ছ ব্যাপারগুলি লক্ষ্য করি না। বিভূতিভূষণ কিংবা মাণিকবাবু কি তাদের কোন গ্রন্থে লিখে গেছেন, জগতের সুন্দরতম দৃশ্যের একটি হচ্ছে রাস্তায় মেয়েদের পানের পিক ফেলা?

কণা, আমি যাই?

কই যাইবেন?

যাবার অনেক জায়গা আছে। কোন এক জায়গায় চলে যাব।

আতাহার বাস স্ট্যান্ডের দিকে এগুচ্ছে। তার পেছনে পেছনে আসছে কণা। সে মনে হচ্ছে তাকে বাস পর্যন্ত এগিয়ে দেবে। বাস না, শেষ পর্যন্ত আতাহার একটা রিকশা নিল। দিনটা মেঘলা। মেঘলা দিনে ভালবাসার বাস বের হয়। কাজেই বাসের গাদাগাদি ভিড়ে এবং মানুষের গায়ের বিষাক্ত ঘামের গন্ধে দিনটা নষ্ট করা ঠিক না। রিকশাওয়ালা বলল, কই যাইবেন? আতাহার বলল, চল না দেখি। রিকশা চলছে–কণা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে। মেঘলা দিনের রিকশাযাত্রায় কণার মত একটি মেয়ে পাশে থাকলে কেমন হত? দুজনে মিলে আকাশ দেখতে দেখতে যাওয়া যেত। এখন পর্যন্ত আতাহার কোন তরুণীকে পাশে বসিয়ে আকাশ দেখেনি।

ময়না ভাই আতাহারকে দেখে গম্ভীর গলায় বললেন, তোকে বলেছিলাম না। আঠারো তারিখ টকা নিয়ে আসতে? এসেছিলি?

না।

না কেন?

সামান্য দুই লাখ টাকা জোগাড় হল না?

দুই লাখ টাকা সামান্য না। আমার কাছে না।

টাকা জোগাড় করতে পারবি না। আগে বললি না কেন?

আগে ভেবেছিলাম পারব। বড় আপার ফ্ল্যাট বিক্রি হবে, সেখান থেকে ধার নেব। ফ্ল্যাট এখনো বিক্রি হয়নি।

তোর আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব এমন কেউ ছিল না যে টাকাটা ধার হিসেবে দিতে পারে?

কিন্তু কি?

সাজ্জাদ দিতে পারত…কিন্তু…

কিন্তু কি?

আতাহার হাসল। ময়না ভাই রাগী গলায় বললেন, হাসবি না। খবদার, হাসবি না। তোর হাসি দেখে আমার মাথায় রক্ত উঠে যাচ্ছে। তোকে আমি স্নেহ করি। আমি তোর একটা উপকার করতে চেয়েছিলাম। টাকা জোগাড় হচ্ছিল না–আমাকে তো এসে বলবি। একটা কিছু ব্যবস্থা করতাম।

জাপানের ভিসা কি হয়েছে?

অবশ্যই হয়েছে। ময়না মিয়া কাচা কাজ করে না। সাতটা ছেলের গতি করে দিয়েছি, শুধু তোর কিছু করতে পারলাম না। আফসোস! বড়ই আফসোস! চা—নাশতা কিছু খাবি?

পানি খাব।

পানি তো খাবি। তুই কপাল করে এসেছিস পানি খাবার। আমি খুব কম মানুষকে স্নেহ করি। তুই সেই কম মানুষগুলির একজন। সিনসিয়ারলি তোর একটা উপকার করতে চেয়েছিলাম…।

ময়না ভাই বিরক্ত মুখে সিগারেট ধরলেন। আতাহার পানির জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। ময়না ভাই নিউ মুভিজ অফিসের ম্যানেজারের ঘরে বসে আছেন। বসার ভঙ্গি অ্যাগের মত। টেবিলের উপর পা তোলা। তার প্যায়ে লাল মোজা। মোজা এক জায়গায় ছেড়া। সেই ছেড়া দিয়ে তার পায়ের বুড়ো আঙুল বের হেয়ে আছে। ময়না ভাই সেই আঙুল আবার একটু পর পর নাড়াচ্ছেন।

আতাহার?

জ্বি।

ছবিতে অভিনয় করবি?

ছবিতে অভিনয়?

হ্যাঁ। করলে বল, ব্যবস্থা করে দেই। তোর চেহারা সুন্দর আছে। চোখের এক্সপ্রেশনও ভাল। শুধু দাড়ি-টারি চেছে ফেলতে হবে। ডাইরেক্টর মনসুর আলি আমার বন্ধু মানুষ। নতুন নায়ক খুঁজছে। তুই চাইলে তোকে ওর কাছে নিয়ে যেতে পারি। ফার্স্ট ছবি হিট করলে–ধাই ধাই করে উঠে যাবি। নায়িকাদের কোলে হাত রেখে এসি দেয়া ঠাণ্ডা গাড়িতে ঘুরতে পারবি।

ছবির নাম কি?

ছবির নাম দিয়ে তোর দরকার কি? কমাশিয়াল ছবির নাম-কাহিনীতে কিছুই যায় আসে না। তোর ইচ্ছা আছে কিনা বল। আমি মনসুর আলিকে বললে ও আমার কথা ফেলবে না। ওর লেজ আমার কাছে বাধা। ভেবে দেখা করবি কিনা।

করব।

গুড। জীবন সম্পর্কে তোর তাহলে পজিটিভ দৃষ্টিভঙ্গি আছে। অধিকাংশ সময় তোর বয়েসী যুবকরা হতাশায় ড়ুবে যায়। ফেনসিভিল খাওয়া শুরু করে। তোর এইসব অভ্যাস নেই তো?

না।

একসেলেন্ট। যে দেশের তরুণ সমাজ কফ, সিরাপ খেয়ে নেশা করে সেই দেশের ভবিষ্যৎ কি? ভবিষ্যৎ হচ্ছে–খ্যক খ্যক করে কাশা। বুঝলি, তোদের সোনার বাংলার ভবিষ্যৎ হচ্ছে খ্যক খ্যক করে কাশা।

পিওন পানি এনেছে। অফিসে মনে হচ্ছে পানি খাওয়ার গ্রাস নেই। চায়ের কাপে করে পানি এনেছে। এক কাপ পানি খেয়ে আতাহারের তৃষ্ণা বেড়ে গেল। দ্বিতীয় কাপ পানির জন্যে বলতে ইচ্ছা করছে না। পিওনের হাবভাব ভাল না। সে তাকাচ্ছে কঠিন দৃষ্টিতে।

ময়না ভাই চেয়ার থেকে পা নামিয়েছেন। পকেট থেকে নোটবই বের করেছেন। নোটবই ভর্তি দুনিয়ার মানুষের টেলিফোন। মনসুর আলির টেলিফোন নাম্বার বের করতে সময় লাগল। তিনি গম্ভীর গলায় বললেন, ম্যানেজার, দেখি মনসুরকে টেলিফোনে ধর। প্রথমে এই নাস্বারটা ট্রাই কর। এখানে না পেলে পোজার লাগাও। তিনি আতাহারের দিকে, তাকিয়ে বললেন, তোর কাজ নেই তো? বোস আরাম করে। যা করার আজকের মধ্যেই করতে হবে। কাল সারাদিন ব্যস্ত থাকব। পরশু যাচ্ছি জাপান।

আতাহার ধৈর্য ধরে বসে রইল। ময়না ভাই অনেক চেষ্টা করে ও মনসুর আলিকে ধরতে পারলেন না।

 

বর্ষা মনে হয় এ বছর আগে আগে চলে এসেছে। দুপুর থেকে ঝুম বৃষ্টি। এ রকম বৃষ্টিকেই ইংরেজিতে হয়ত বলে ক্যাটস এন্ড ডগস। তবে আজ বৃষ্টি যা নেমেছে তাকে ক্যাটস এন্ড ডগস বলা ঠিক হবে না। একে বলা উচিত হস এন্ড এলিফেন্ট।

এ রকম বৃষ্টি দেখতে হলে হয় বৃষ্টিতে ভিজতে হয় কিংবা নিজের ঘরের বিছানায় কাথামুড়ি দিয়ে বসে জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। মাঝামাঝি কোন পথ নেই। আতাহার তার বাসার খুব কাছাকাছি আছে! হেঁটে যেতে পাঁচ মিনিট লাগবে। বৃষ্টিতে হেটে যাওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। তাকে যেতে হবে দৌড়ে–দুমিনিটের বেশি লাগবে না। কেন জানি যেতে ইচ্ছা করছে না। সে মমতা ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে বসে আছে। ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে একগাদা মানুষ। এরা বৃষ্টি দেখে দোকানে আশ্ৰয় নিয়েছে। তারা বৃষ্টি দেখছে ভয়াবহ বিতৃষ্ণা নিয়ে।

আতাহার, মমতা জেনারেল স্টোরের মালিকের ভাগ্নেকে বলল (সে এই স্টোরের ক্যাশিয়ার। আতাহারের সঙ্গে তার ভাল খাতির আছে। শুধু যখন আতাহার টেলিফোন করতে চায় তখন তার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে যায়), মোবারক, একটা টেলিফোন করব।

মোবারক বিরক্ত মুখে টেলিফোন সেট বের করল। টেলিফোনের তালা খোলার চাবি বের করল।

আতাহার ঢাকা শহরে মাত্র একজনের টেলিফোন নাম্বারই জানে, সাজ্জাদের নাম্বার। এই নাম্পবারে আতাহার পারতপক্ষে টেলিফোন করে না। কারণ টেলিফোনটা হোসেন সাহেবের ঘরে। রিং বাজামাত্রই তিনি টেলিফোন ধরেন এবং অতি মধুর গলায় বলেন, হ্যালো। কে কথা বলছেন? কথা যিনিই বলুন তিনি পীয়তাল্লিশ মিনিটের আগে টেলিফোন ছাড়েন না। আতাহার এখন আর রিস্ক নেয় না। হোসেন সাহেবের গলা শোনামাত্র খািট করে রিসিভার নামিয়ে রাখে। আজও সে ধরেই নিয়েছিল হোসেন সাহেব টেলিফোন ধরবেন। তাকে বিস্মিত করে দিয়ে টেলিফোন ধরল। নীত্। আতাহার খুশি খুশি গলায় বলল, তোদের ওখানে বৃষ্টি হচ্ছে নাকি রে নীতু?

নীতু বলল, হচ্ছে।

এ রকম শুকনো গলায় হচ্ছে বললি কেন? তোর গলা শুনে মনে হচ্ছে বৃষ্টি হওয়াটা খুব খারাপ। গলায় আনন্দ নেই কেন?

আমি তো আর ব্যাঙ না যে বৃষ্টি হলেই আনন্দে লাফাব।

গলার স্বরটা তো ব্যাঙের মতই লাগছে! সর্দি বাঁধিয়েছিস?

নীতু কঠিন গলায় বলল, আপনি কি ভাইয়ার সঙ্গে কথা বলবেন?

হ্যাঁ।

ধরে থাকুন, ভাইয়াকে দিচ্ছি।

এ রকম বৃষ্টিতে সে ঘরে বসে আছে? বৃষ্টিতে ভিজছে না? আশ্চর্য তো। আপনি ধরে থাকুন।

তুই যা, খবর দে। আমি ধরে আছি। আমার কোন কাজকর্ম নেই। প্রয়োজনে আমি অনন্তকাল টেলিফোন ধরে বসে থাকতে পারি।

আতাহারকে বেশিক্ষণ বসে থাকতে হল না। সাজ্জাদ এসে টেলিফোন ধরে বিরক্ত গলায় বলল, তোকে কতবার বলেছি কখনো আমাকে টেলিফোন করবি না। টেলিফোনে কথা বলতে আমার ভাল লাগে না। চট করে বল কি ব্যাপার?

কণার ঠিকানা জোগাড় করেছি। এই শুক্রবারের পরের শুক্রবার তাকে চিড়িয়াখানা দেখাতে নিয়ে যাব।

আর কিছু বলবি?

সুবর্ণ বের হয়েছে।

তোর কবিতা ছাপা হয়নি?

না।

গু-চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। গু-চিকিৎসা ছাড়া কাজ হবে না। মেথরূপটিতে গিয়ে আমি ব্যবস্থা করব। তুই কি আর কিছু বলবি?

না।

কণা মেয়েটিকে কেমন দেখলি?

চমৎকার। বুঝতে পারছি না কি জন্যে চমৎকার লাগল। পান খেয়ে রাস্তায় পিক ফেলছিল–এই দৃশ্য দেখে হঠাৎ মনে হল মেয়েটা চমৎকার।

তুই ঠিকই ধরেছিস। মেয়েটার মধ্যে সহজ একটা ব্যাপার আছে। জলের মত সহজ। এ হল সহজিয়া নারীগোত্রের একজন। সচরাচর দেখা যায় না বলেই তোর ভাল লাগছে। যাই হোক, আমি এখন আর কথা বলব না। ছাদে গিয়ে বৃষ্টিতে ভিজব। নে, তুই বাবার সঙ্গে কথা বল। বাবা তোর সঙ্গে কথা বলার জন্যে পাশে দাঁড়িয়ে আছেন।

আতাহার টেলিফোন রিসিভার হাতে নিয়ে আতংকে প্রায় জমে গেল। মনে হচ্ছে এই মুহুতে তার ছোটখাট কোন স্ট্রোকের মত হচ্ছে।

কে, আতাহার?

জ্বি, চাচা?

তুমি কেমন আছ?

জ্বি, ভাল আছি।

অনেক দিন তোমাকে দেখি না।

পরশু দিনই আপনার সঙ্গে দেখা হয়েছে। দুই ঘণ্টার মত কথা হল। খুনের মামলা নিয়ে কথা বলছিলেন।

ও হ্যাঁ, জামশেদ ভার্সাস স্টেট। অসাধারণ একটা মামলা। আইনের ইতিহাসে স্বণাক্ষরে লেখা থাকবে।

জ্বি জ্বি।

আতাহার, তুমি কি আগামীকাল কিংবা পরশু একটু আসতে পারবে?

কেন বলুন তো চাচা?

সজ্জিাদ এত বড় একটা চাকরি পেয়েছে সেলিব্রেট করবো বলে ভাবছি। কোন একটা ভাল হোটেলে গিয়ে সামান্য খাওয়া-দাওয়া

সজিদ চাকরি পেয়েছে নাকি?

তুমি জান না?

জ্বি না।

তুমি হচ্ছে তার বেস্ট ফ্রেন্ড, আর তুমি জান না? আশ্চর্য! আবশ্যি আশ্চর্য হবার কিছু নেই। ওর স্বভাবটি এই রকম। আমিই কিছু জানতাম না। বিদ্যুৎ এবং জ্বালানীমন্ত্রী টেলিফোন করায় জানলাম। সাজ্জাদ অবশ্যি একমাস আগেই এপিয়েন্টমেন্ট লেটার পেয়েছে। চাকরিতে জয়েনও করেনি, আমাকেও কিছু জানায়নি।

এখন কি চাকরিতে জয়েন করবে?

করবে তো বটেই। না করে পথ কি? কিছু একটা করে তো খেতে হবে। বৃষ্টিতে ভিজা আর জোছনা গায়ে মেখে বেড়ালে তো হবে না–তাই না?

জ্বি, তা তো বটেই।

সাজ্জাদ-নীতু দুজনের ব্যবস্থা করে ফেলতে পারলে আমি নিশ্চিন্ত হতে পারি। শরীরের অবস্থা তো ভাল না। হাটের উপর দিয়ে একটা ঝড় গিয়েছে। দ্বিতীয়বার সামলাতে পারব বলে মনে হয় না। ঠিক বলছি না?

জ্বি।

সাজ্জাদের তো একটা গতি হল। বাকি আছে নীতু। ওর বিয়ের কথাবার্তা চালাচ্ছি।

বাচ্চা মেয়ে, এখনি কিসের বিয়ে?

বাচ্চা কোথায়? এই ডিসেম্বরে কুড়ি হবে। নীতুর মাকে আমি যখন বিয়ে করি তখন নীতুর মার বয়স ছিল বিলো সেভেনটিন।

দিন বদলাচ্ছে।

এই তো আতাহার তুমি ভুল বললে। দিন ঠিকই আছে, মানুষ বদলাচ্ছে। সেই বদলানোটা কি ঠিক তা বিচারের সময় এসে গেছে। নীতু কিছুতেই বিয়েতে রাজি না–এইসব যুক্তি দিয়ে তাকে বুঝিয়েছি।

এখন কি সে রাজি?

তাই তো মনে হয়। একটা ছেলে পাওয়া গেছে। আমাদের দূর সম্পর্কের আত্মীয়। ছেলে ভাল, সারাজীবন ফার্স্ট-সেকেন্ড হয়েছে। দরিদ্র ফ্যামিলির ছেলে, টাকা পয়সার লোভে রাজি হয়েছে বলে আমার ধরাণ–নীতু দেখতে তো আবার তেমন ইয়ে না। আমার মত হয়েছে। ওর মার মত হলে কোন চিন্তা ছিল না। নীতুর মার চেহারা পেয়েছে সাজ্জাদ।

রিসিভার ধরে রাখতে রাখতে আতাহারের হাত ব্যথা করছে। এ কি যন্ত্রণার মধ্যে পড়া গেল–টেলিফোনের এই দীর্ঘ কথাবার্তা মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে চলবে। শেষ বিচারের আগে ইস্রাফিল যখন শিঙ্গা ফুকবে তখনই শুধু হোসেন সাহেব বলবেন, আতাহার, একটু ধর তো কে যেন বিকট শব্দে বাঁশি বাজাচ্ছে–ব্যাপারটা কি দেখে আসি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *