1 of 2

১১. সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে

সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে শশিভূষণের হঠাৎ মাথা ঘুরে গেল। মনে হল পৃথিবীটা যেন দুলছে। রেলিং ধরে পড়ে যাবার ঝোঁক সামলে নিয়ে তিনি ভাবলেন, ভূমিকম্প শুরু হল নাকি? পায়ের নীচে মাটি কাঁপছে। তিনি অপেক্ষা করতে লাগলেন, নিশ্চয়ই চতুর্দিকে এখন শঙ্খধ্বনি শুরু হবে। সাধারণ মানুষের ধারণা বাসুকী মাথা দোলালে ভূমিকম্প হয়, তখন শাঁখ বাজিয়ে শান্ত করতে হয় তাকে। সেরকম কিছুই হল না, কোথাও কোলাহলও শোনা যাচ্ছে না। তাহলে কি শশিভূষণের মনের ভুল?

আরও দু’তিন সিঁড়ি নামলেন শশিভূষণ, মাথাটা তবু দুলছে, এটা মনের ভুল নয়। অস্বাভাবিক কিছু ঘটছে। অবশ্যই। শশিভূষণ বাইরে বেরুবার জন্য সুসজ্জিত, চুনটি করা ধুতি, সিস্কের বেনিয়ান ও কাঁধে মুগার চাদর, সঙ্গে অনেক টাকা। বোর্ন অ্যান্ড শেফার্ড কোম্পানিতে ক্যামেরার সরঞ্জাম ও ছবি তোলার প্লেটের অর্ডার দিয়ে এসেছেন, আজ সে-সব সংগ্ৰহ করার কথা, আগামীকালই তাঁকে ত্রিপুরায় ফেরার যাত্রা শুরু করতে হবে। টলটলে ভাব নিয়েই তিনি জোর করে নামতে গেলেন, এবার মাথার মধ্যে যেন চিড়িক চিড়িক শব্দে ছোট ছোট বিদ্যুৎ চমক হতে লাগল। শশিভূষণ ক্রমশ বিস্মিত হতে লাগলেন, তাঁর স্বাস্থ্য অটুট। রোগ-ভোগের অভিজ্ঞতা অনেকদিন নেই, নিজের কর্মক্ষমতার ওপর অগাধ বিশ্বাস, যেকোনও কাজেই পারতপক্ষে অন্যের সাহায্য চান না।

সিঁড়ির মধ্য পথে গিয়ে আর পারলেন না। শশিভূষণ, রেলিং থেকে তার হাত ছেড়ে গেল, শরীরটা দুমড়ে তিনি গড়িয়ে পড়তে লাগলেন। সিঁড়ির শেষে তিনি পড়ে রইলেন অসহায় ভাবে, উঠে দাঁড়াবার ক্ষমতা নেই, কারুকে ডাকতেও পারলেন না। বাড়ি ভরা লোকজন, অনেক দাস-দাসী, কিন্তু শশিভূষণ পড়েই রইলেন জড়ের মতন, কেউ কিছু টের পেল না। শশিভূষণের অবশ্য জ্ঞান চলে যায়নি, মাথায় তীব্র যন্ত্রণা, কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হয়ে গেছে, সেই অবস্থাতেও তিনি ভাবছেন, তার মৃত্যু ঘনিয়ে এল নাকি? এক একসময় মানুষ কত অসহায়, এত আত্মীয়-স্বজন, শশিভূষণের এত মনের জোর, তবু সকলের অলক্ষ্যে তিনি মাটিতে পড়ে আছেন অচেতন পদার্থের মতন।

মাথার মধ্যে যেন শত শত সূচ ফুটছে, আর সহ্য করতে পারছেন না। শশিভূষণ, এবার চৈতন্য লোপ পাবে, কিংবা এটাই মৃত্যু ও প্রাণপণে একবার চিৎকার করবার চেষ্টা করলেন, তবু স্বর বেরুল না। চক্ষু দুটি যখন বুজে আসছে, তখন দেখতে পেলেন একটি কিশোরী মেয়েকে। মেয়েটি কোথা থেকে এল। সে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসেনি, সদর দরজাও বন্ধ, তবে কি সে অলীক? এ বাড়িতে এই মেয়েটিকে আগে কখনও দেখেননি শশিভূষণ, সম্পূর্ণ অচেনা। বড় বড় টানা চোখ, বয়েসের তুলনায় তার মাথায় অনেক চুল, চুল দিয়েই যেন তার শরীর ঢাকা, তার এক হাতে একগুচ্ছ সাদা ফুল, সে মুখখানি আনল শশিভূষণের মুখের কাছে। তারপর আর তাঁর কিছু মনে নেই।

কোথায় ভরতের চিকিৎসা করিয়ে তার একটা হিল্লে করে যাবেন, তা নয় শশিভূষণ নিজেই নিদারুণভাবে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। ডাক্তার-বদ্যির আনাগোনা চলল অনবরত। দিনকতক যমে-মানুষে টানাটানিই চলল প্রায়, এক একসময় শশিভূষণের প্রায় নাভিশ্বাস ওঠার মতন অবস্থা। রুগীকে কিছুই খাওয়ানো যায় না, অমন সবল সুপুরুষটির চেহারা হয়ে গোল শুকনো আমসির মতন, বিছানার সঙ্গে একবারে সাঁটা, গলা দিয়ে বাচ্চা শালিক পাখির মতন চিঁচিঁ আওয়াজ বেরোয়। প্রখ্যাত সাহেব ডাক্তার চার্লস গর্ডন কোনওক্রমে শশিভূষণকে বাঁচিয়ে রেখেছেন বলা যায়। কিন্তু তারও অভিমত, কিছু খাওয়াতে না পারলে শুধু ওষুধে বেশিদিন কাজ হবে না। জোর করে শশিভূষণকে কিছু খাওয়াতে গেলেই শশিভূষণের বমি হয়ে যায়।

দু’জন বউঠান দিবারাত্রি সেবা করছেন মন-প্ৰাণ দিয়ে। বড় বউঠানের খুব বিশ্বাস হোমিওপ্যাথিতে, তার ধারণা ডাক্তার মহেন্দ্ৰলাল সরকারকে ডাকলেই কাজ হবে। কিন্তু তিনি এত ব্যস্ত যে তাকে ধরাই যায় না। এর মধ্যে তিনি আবার বর্ধমানের মহারাজের চিকিৎসা করবার জন্য সেখানে গিয়ে বসে আছেন। কৃষ্ণভামিনীর অনুরোধে ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারকে জরুরি কল দেবার জন্য লোক পাঠানো হয়েছে বর্ধমানে।

শশিভূষণের ঘরের দরজার পাশ থেকে আড়ষ্টভাবে উঁকি মারে ভরত। তার শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ হয়নি, উরুতে বর্শার ক্ষতটি শুকোয়নি পুরোপুরি, মাঝে মাঝেই জ্বর আসে, তবে তার পাগলামির ভাবটা অনেকটা কমেছে। মাথায় এখন খোঁচা খোঁচা চুল, প্যাঁকাটির মতন শীর্ণ চেহারা, সবসময় মুখ-চোখ ভয়-ভয় ভাব। শশিভূষণের অসুখ নিয়ে সারা বাড়ির ব্যস্ততায় ভরতের কোনও ভূমিকা নেই। সে শুধু দরজার কাছে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকে। এ পৃথিবীতে শশিভূষণেই তার একমাত্র অবলম্বন।

মহারাজার সচিব রাধারমণ ঘোষ ফিরে গেছেন ত্রিপুরায়। শশিভূষণ দেড় মাসের ছুটি নিয়ে এসেছিলেন, তাও উত্তীর্ণ হবার মুখে। সিমলে পাড়ায় হরমোহন ভট্টাচার্যের গুরুকুল আশ্রমে ভরতকে ভর্তি করে দেবার ব্যবস্থা পাকা হয়ে আছে। সেখানে ভরতকে পৌঁছে দেবার জন্য শশিভূষণ একদিন ওকে সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছিলেন, কিন্তু অন্য জায়গায় থাকতে হবে শুনেই ভরত দৌড়ে ফিরে এসে খাটের তলায় ঢুকে পড়েছিল। শশিভূষণকে ছেড়ে সে কোথাও যাবে না। মহা মুশকিলের ব্যাপার, শশিভূষণকে ত্রিপুরায় ফিরতে হবে, সেখানে আর ভরতকে নিয়ে যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। রাধারমণের কথা শুনেই বোঝা গিয়েছিল যে, ত্রিপুরা রাজ্যে ভরতের আর স্থান নেই, সেখানে গেলেই তার বিপন্ন হবে। সব ব্যাপারটা শুনে মেজদাদা মণিভূষণ বলেছিলেন, তোকে ত্রিপুরায় ফিরতে হবে, তুই ওকে না জানিয়ে একদিন চলে যা। ও ছাড়াটা তো এ বাড়িতে থাকতে অনেকটা অভ্যস্ত হয়ে গেছে, এখানেই থাকুক। আর কিছুদিন। তারপর ধীরে সুস্থে ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে পাঠশালায় পাঠালেই হবে।

এখন শশিভূষণের অসুস্থতার জন্য ওসব কথা চাপা পড়ে গেছে। ভরতের দিকে মন দেবার কারুর সময় নেই।

ডাক্তারি- ছাড়া শশিভূষণের জন্য দৈব চিকিৎসারও বিরাম নেই। কালীঘাটের মন্দিরে তাঁর নামে জোড়া পাঠা মানত করা হয়েছে। অন্যান্য মন্দির থেকেও প্রাসাদ ও চরণামৃত আসে। শশিভূষণ নিজে ব্ৰাহ্মভাবাপন্ন হলেও তাঁর দুই দাদা বৈষ্ণব, এই সিংহ পরিবারে রাধা-কৃষ্ণের যুগল মুর্তির পূজা হয় নিয়মিত, বাড়ির তিনতলায় ঠাকুর ঘর আছে। এখন দু’বেলাই সেখানে শশিভূষণের আরোগ্য কামনায় যাগযজ্ঞ চলছে। মেজ বউঠান সুহাসিনীর আবার সাধু-সন্ন্যাসীদের প্রতি খুব ভক্তি, তাঁর বাপের বাড়ির গুরুদের মাধবাচার্য স্বামী এসে শশিভূষণের মাথায় হাত বুলিয়ে গেছেন দুদিন।

শশিভূষণ অধিকাংশ সময়েই আচ্ছন্ন অবস্থায় পড়ে থাকেন, কোনও কিছুতেই সাড়া দেন না। মাঝে মাঝে তিনি সজাগ হন, দৃষ্টি স্বচ্ছ হয়, পূর্ণ চেতনা ফিরে আসে। তখন তিনি অনুভব করেন, তাঁর যেন শরীর নেই, শুধু মন আছে। চিত হয়ে শুয়ে থাকতে থাকতে পিঠ প্রায় অবশ হয়ে গেছে, তবু পাশ ফিরতে ইচ্ছে করে না, হাত-পাগুলিতে যেন সাড় নেই, ক্ষুধাতৃষ্ণার কোনও বোধ নেই। মন যেন এই শরীরটাকে ছেড়ে ইচ্ছে মতন ঘুরে বেড়াতে পারে। শরীরটা যদি একেবারে নষ্ট হয়ে যায়, তা হলেও কি এই মন টিকে থাকবে। তা হলে কি সত্যিই আত্মার অস্তিত্ব আছে? হৃৎস্পন্দন থেমে গেলেই মৃত্যু, তারপরেও আজার, অমর হয়ে থাকে মানুষের আত্মা? মন এক একসময় চলে যায় ত্রিপুরায়। কমলদিঘির কাছে তাঁর ছোট বাড়িটি, সেখানে রয়েছে তাঁর দামি দামি ক্যামেরা, বইপত্তর। যদি চুরি হয়ে যায়? ক্যামেরা ও বইয়ের চিন্তায় তিনি উতলা হয়ে ওঠেন। যদিও রাধারমণ ফিরে গেছেন, তিনি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেবেন। তবু বলা যায় না। মহারাজার এক পারিষদ পঞ্চানন্দ মিত্রের খুব লোভ আছে শশিভূষণের বইগুলির প্রতি, বই চুরিকে অনেকে চুরি বলে গণ্য করে না। শশিভূষণের দীর্ঘশ্বাস পড়ে।

একদিন রাত্রিবেলা শশিভূষণের এক রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা হল। রাত তখন অনেক, সমস্ত বাড়ি ঘুমন্ত নিঝুমপরী, পথেও কোনও গাড়িঘোড়ার আওয়াজ নেই। তাঁর ঘর একেবারে অন্ধকার করা হয় না, এক কোণে একটি সেজবাতি জ্বলে। দরজা খোলা, মেঝের ওপর মাদুর পেতে শুয়ে আছে কে একজন, প্রতি রাতেই বাড়ির কেউ না কেউ থাকে এই ঘরে। আজ যে রয়েছে, সেও এখন মগ্ন হয়ে আছে গভীর ঘুমে। শোনা যাচ্ছে তার নিঃশ্বাসের শব্দ। হঠাৎ শশিভূষণ জেগে উঠলেন, স্পষ্ট দেখলেন দরজা পেরিয়ে, ঘুমন্ত মানুষটির পাশ দিয়ে এগিয়ে আসছে। একজন রমণী, শোনা যাচ্ছে ঝুমঝুম ধ্বনি। নূপুর / নিক্কণ নয়, মনে হয় যেন কোমরে গোজা চাবির গোছার শব্দ, রমণীটিও মধ্যবয়স্কা, লালপেড়ে গরদের শাড়ি পরা, কপালে বড় একটা টিপ। আরও কাছে আসতে শশিভূষণ চিনতে পারলেন সেই নারী তাঁর জননী, তাঁর দুচোখে জলের ধারা। শুর শিয়রের কাছে এসে তিনি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদিতে লাগলেন। শশিভূষণ ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞেস করলেন, এ কী, মা তুমি কাঁদছ কেন? সেই রমণী কম্পিত কণ্ঠে বললেন, ভুসু, ভুসু রে, বাছা আমার, এ কী চেহারা হয়েছে তোর! পেট-পিঠ যে এক হয়ে গেছে। কার্তিকের মতন সুন্দর ছেলে তুই, তোর সোনার অঙ্গ কালি হয়ে গেছে! শশিভূষণ বললেন, মা, আমার যে কিছু খেতে ইচ্ছে করে না। কিছু মুখে দিতে পারি না। আমি আর পারছি না, মা। আমি এইভাবেই শেষ হয়ে যাব!

জননী তখন শশিভূষণের কপালে স্নেহময় স্নিগ্ধ হাত রেখে বললেন, অমন কথা বলে না! সোনা আমার, মানিক আমার!

শশিভূষণ মায়ের হাতের ওপর হাত রাখলেন। সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শৈশব ভাব হল। তিনি মায়ের কনিষ্ঠ সন্তান, সবচেয়ে আদরের সন্তান। মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পাড়াতেন বাল্যকালে। কিন্তু এখন ঘুম আসবে না। শশিভূষণ জিজ্ঞেস করলেন, মা, তুমি আমাকে নিয়ে যেতে এসেছ? আমাকে সঙ্গে নিয়ে চলো।

মা সঙ্গে সঙ্গে ত্ৰস্তভাবে বললেন, আমি কোথায় নিয়ে যাব। না, না, না না অমন কথা বলে না, সোনা! আমি এক লক্ষ্মীছাড়ি, ছেলের অসুখে সেবাও করতে পারলুম না গো! দুঃখে আমার বুক ফেটে যায়। তুই ভালো হয়ে যাবি, ভুসু! কিছু খেতে ইচ্ছে করে না, কাঁচা বেল পুড়িয়ে শরবত করে দিতে বলবি। তাতে জিহ্বায় রুচি হবে, তারপর ফেনাভাত খাবি।

শশিভূষণ আকুল হয়ে বললেন, মা, মা, তুমি আমার জন্য রান্না করে দাও।

তারপর আর কিছু নেই। শশিভূষণ জ্ঞান হারালেন কিংবা চক্ষু অন্ধকার হয়ে গেল। অবচেতনের গভীরে ডুবতে ডুবিতেও তিনি মাকে থাকতে চাই, চলে যেও না, চলে যেও না। কিন্তু ঢেউয়ের পর ঢেউ এসে তাঁর চৈতন্যকে গ্ৰাস করে নিল।

শশিভূষণ আবার যখন জাগলেন, তাঁর সর্বাঙ্গ ঘামে ভেজা। এতদিন শরীর নাড়াচাড়া করেননি, এখন দ্রুত পাশ ফিরে মাকে দেখতে চাইলেন। কোথায় কে? সেজবাতির আলোয় দেখা যাচ্ছে শূন্য ঘর। মেঝেতে যে শুয়ে আছে, তার নিশ্বাস শোনা যাচ্ছে একইভাবে।

শশিভূষণের বুক ধড়াস ধড়াস করতে লাগল। খানিক আগে কী দেখলেন তিনি। মা এসেছিলেন, মা তার সঙ্গে কথা বললেন, হাত রাখলেন কপালে, কিন্তু মা তো মারা গেছেন সতেরো বছর আগে। তখন শশিভূষণ নিতান্ত এক কিশোর। তবে কি এটা স্বপ্ন? তা কী করে হবে, মায়ের হাত ধরেছিলেন তিনি, সে যে বাস্তব হাত! এখনও শশিভূষণ যেন পাচ্ছেন সেই স্নেহ-সুবাস। তা হলে? শশিভূষণ আর চিন্তা করতে পারলেন না। মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে। কিন্তু চিন্তা কী করে বন্ধ করা যায়! মায়ের সঙ্গে তাঁর যে কথাগুলি হয়েছিল, সেইগুলিই মাথার মধ্যে ঘুরতে লাগল বারবার, যেন একটা কবিতা মুখস্থ করা হচ্ছে। একটা শব্দও এদিক ওদিক করা যাবে না।

এইভাবে কতক্ষণ কাটল কে জানে, এক সময় শশিভূষণের খুব তৃষ্ণা পেল। তিনি অস্ফুট স্বরে বললেন, জল, একটু জল!

যেন সঙ্গে সঙ্গে কেউ একটা জলভরা ঝিনুক ধরল। তাঁর ওষ্ঠের কাছে। শশিভূষণ চোখ বুজে ছিলেন, চোখ মেলতেই আবার তাঁর বুক কেঁপে উঠল। এবারে মা নন, একটি কিশোরী, তার মাথা ভর্তি চুল, সারল্যমাখা টানা টানা দুটি চোখ, সে ণের একেবারে মুখের কাছে ঝুঁকে এসে জল পান করাচ্ছে ঝিনুক দিয়ে। এই কিশোরীটিকে তিনি চেনেন না, প্রথম দিন সিঁড়ি দিয়ে পড়ে যাবার পরে একেই দেখেছিলেন, এর এক হাতে ছিল একগুচ্ছ সাদা ফুল। কে এই ললনা? এও কি অলীক? শশিভূষণ ভাবলেন বিকারের ঝুঁকে তিনি চোখে ভুল দেখছে। তার তো এমন কঠিন অসুখ আগে কখনো হয়নি, তাই অভিজ্ঞতা নেই। সত্যি সত্যি তিনি জল পান করছেন, না এটাও স্বপ্ন ; অথচ যেন তাঁর তৃষ্ণা মিটে যাচ্ছে, কশের ধার দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে জলের রেখা।

পরদিন শশিভূষণ জাগলেন বেশ দেরিতে। অন্যদিনেরই মতন তার বউঠানরা যখন তাকে জোর করে দু-সাগু। খাওয়াতে এলেন, শশিভূষণ আস্তে আস্তে মাথা নেড়ে বললেন, কাচা বেল পোড়ার শরবত!

বেল জোগাড় করার জন্য বাজারে ছুটতে হল না, এ বাড়ির বাগানেই বেল গাছ আছে। দুটি বেল পুড়িয়ে খানিকক্ষণের মধ্যেই শরবত করে আনা হল, চুক চুক করে পুরো এক গেলাস শরবত পান করলেন এই রুগী। এগারো দিন পর তাঁর পেটে কিছু খাদ্য গেল। পরদিন তিনি ফেনাভাতও খেতে পারলেন কয়েক চামচ।

কিছুটা জ্বালানি পেয়ে শশিভূষণের মস্তিষ্ক যন্ত্রটি সজাগ হল, তাঁর যুক্তিবোধ ফিরে এল। সেই রাতে তিনি মাকে ও এক দেখলেন কী করে? সতেরো বছর আগে যিনি মারা গেছেন, তিনি ফিরে আসছেন, এও কি সম্ভব? ধরা যাক, আত্মার কোনও লয়-ক্ষয় নেই, কিন্তু সেই আত্মা কি আবার শরীর ধারণ করতে পারে? পরনের শাড়ি, হাতের গয়না, কোমরে চাবির গোছা, এগুলি তো জড়পদার্থ, এরাও রূপ ফিরে পেল? মায়ের যে কাঁকনজোড়া এখন বড় বউঠানের হাতে, সেই কাঁকনই আবার মায়ের হাতে ফিরে যাবে? তা হলে সবটাই স্বপ্ন? অথচ শশিভূষণ মায়ের সঙ্গে কথা বলছেন, হাত ছুঁয়েছেন, তা প্রত্যক্ষের মতো সত্য। তবে যারা ভূত-প্রেত দেখে, ঠাকুর-দেবতাদের দেখতে পায়, যারা ঈশ্বর দর্শনের কথা বলে, সেগুলোও মিথ্যে নয়? ওই যে কিশোরী মেয়েটি, সে এ বাড়িরই কোনও মৃত আত্মীয়া?

শশিভূষণ দোলাচলের মধ্যে রইলেন। তিনি মেনে নিতে পারছেন না,অথচ অস্বীকার কারও উপায় নেই। স্বপ্ন কি এত তীব্র হতে পারে? মায়ের প্রত্যেকটি কথা তার মনে আছে! কাচা বেল পোড়ার শরবতের কথাটা কী করে স্বপ্ন হবে? শশিভূষণ কস্মিনকালে বেল পছন্দ করেন না, বেলের পানাকে তিনি মনে করতেন বিধবাদের পানীয়। মা এসে তাকে বলে গেলেন, আর সত্যি সত্যি বেলের শরবত তাঁর সহাও হল। ফেনাভাতও দিব্যি মুখরোচক মা এসে বলে গেলেন সঠিক পথ্যের কথা। সিঁড়ির তলায় যে কিশোরীটি তাঁকে পড়ে থাকতে দেখে সবাইকে ডাকল, শেষ রাতে যে এসে জল পান করিয়ে গেল, সেও আসলে অশরীরী? সেই দৃশ্যগুলি আবার ভাবলেই রোমাঞ্চ হয়।

স্বপ্ন, না অলৌকিক দর্শন, এই দ্বিধার নিষ্পত্তি করতে পারলেনপারলেন না শশিভূষণ। দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণ ঠাকুর নামে কালী মন্দিরের এক পুরুতে আছে, সে নাকি কালী প্রতিমাকে জীবন্ত দেবী হিসেবে দেখতে পায়, সেই দেবীর সঙ্গে কথা বলে, হাসে। আগে এ সব কথা শুনে শশিভূষণ অবজ্ঞায় ঠোঁট বেঁকিয়েছিলেন। তাঁর মতে, ওসব পাগলামি ছাড়া আর কিছুই নয়। এবারে অবশ্য ত্রিপুরা থেকে ফিরে শশিভূষণ শুনতে পাচ্ছেন যে কেশববাবু আর তাঁর চেলারা খুব মাতামতি করছেন ওই রামকৃষ্ণ ঠাকুরকে নিয়ে। কেশববাবু উচ্চশিক্ষিত, বিলাতে বক্তৃতা দিয়ে কল্কে পেয়েছেন, খ্রিস্টের ভক্ত বলে এখানকার পাদ্রিরাও তাঁকে সমর্থন করে, সেই কেশববাবু এক গ্ৰাম্য পুরুতের ভেল্কি দেখে ভুললেন? কেশববাবু পরীক্ষা করে, যাচাই করে দেখেছেন নিশ্চয়ই। তা হলে কি সবটাই ভেল্কি নয়? মনের এক বিশেষ অবস্থায় ও রকম দিব্যদর্শন সম্ভব?

শশিভূষণ নিজের কাছেই নিজে অস্বীকার করতে পারছেন না যে, একটা কিছু ব্যাখ্যার অতীত অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেল তাঁর জীবনে। মা এসে তাঁর কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে গেলেন, পত্যের ব্যবস্থা করে দিয়ে গেলেন, তারপর থেকেই শশিভূষণ অনেক সুস্থ বোধ করছেন। এটা কী নিছক স্বপ্ন হয়?

এখনও শশিভূষণের হাঁটার ক্ষমতা হয়নি বটে, তবে নিজে উঠে বসতে পারেন। দু’তিনটি বালিশে ঠেস দিয়ে তিনি বসে থাকেন পা ছড়িয়ে, কথা বলতে ইচ্ছে করে না, বই পড়তেও ইচ্ছে করে না। এক এক সময় তিনি দরজার কাছে ভরতকে দেখতে পান, সে নিজে থেকে কাছে আসে না, শশিভূষণও তাকে ডাকেন না। কোনও কিছু নিয়ে চিন্তা করতেও তাঁর ক্লান্তি বোধ হয়। শুধু বারবার মনে পড়ে মায়ের মুখ। মায়ের মৃত্যুর সময় শশিভূষণ ছিলেন মুর্শিদাবাদে, শেষ শয্যায় মাকে তিনি দেখতে পাননি।

দুদিন বাদে এলেন ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার। সিঁড়িতেই তাঁর পায়ের ধুপধাপ শব্দ হতে লাগল। তিনি হৃষ্টপুষ্ট জবরদস্ত পুরুষ, নাকের নীচে কাবুলি বিড়ালের ল্যাজের মতন গোঁফ, মাথায় বাবরি চুল, তাতে সামান্য পাক ধরেছে। তাঁকে ঘিরে প্রচলিত হয়েছে নানা কাহিনী। মেডিক্যাল কলেজের নামজাদা ছাত্র ছিলেন, এম ডি পাশ করেছিলেন প্রথম হয়ে। অ্যালোপাথ ডাক্তার হিসেবে টক্কর দিচ্ছিলেন সাহেব ডাক্তারদের সঙ্গে। অত্যন্ত সরব নাস্তিক, ভূত-ভগবান-হোমিওপ্যাথি সম্পর্কে ঠাট্টা-বিদ্রূপ করতেন প্রকাশ্যে। হোমিওপ্যাথির প্রতি তাচ্ছিল্য প্রকাশ করতে তাঁর জুড়ি ছিল না। তিনি যুক্তিবাদ ও বিজ্ঞানে বিশ্বাসী, এদেশীয়দের মধ্যে বিজ্ঞানচর্চার প্রসারের জন্য তিনি ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দা কালটিভেশন অব সায়েন্স’ নামে সংস্থা স্থাপন করেছেন। কিন্তু ইতিমধ্যে তাঁর জীবনে এক আকস্মিক রূপান্তর ঘটে গেছে। যিনি ছিলেন হোমিওপ্যাথির ঘোর শক্ৰ, সেই তিনিই এখন অ্যালোপ্যাথি ছেড়ে হোমিওপ্যাথি ডাক্তার হয়েছেন।

মহেন্দ্রলালকে হোমিওপ্যাথিতে দীক্ষা দেন রাজেন দত্ত। তিনিও এক বিচিত্রকর্ম পুরুষ। তালতলায় প্রখ্যাত ধনী দত্ত পরিবারের সন্তান রাজেন্দ্ৰবাবু অনেক ব্যবসা-বাণিজ্যের সঙ্গে জড়িত, শিক্ষিত মানুষ, অনেকগুলি ভাষা জানেন, গ্রিক ও হিবু পর্যন্ত, তিনি হঠাৎ শখের হোমিওপ্যাথি ডাক্তার হলেন। তাঁর মতে, এই দেশের দরিদ্র জনসাধারণের জন্য হোমিওপ্যাথিই আদর্শ চিকিৎসা। তিনি লক্ষপতি, রুগীদের কাছ থেকে কোনও ফি নেন না তো বটেই, বরং নিজে তাদের ওষুধ ও পথ্য কিনে দেন। মহেন্দ্রলালের মতন পাসকরা ডাক্তাররা রাজেন্দ্রবাবুকে হাতুড়ে বলে অবজ্ঞা করতেন। কিন্তু রাজেন্দ্র দত্তর সাফল্য চমকপ্ৰদ। গরিব মানুষরা তো তাঁর নামে ধন্য ধন্য করেই, অনেক প্রখ্যাত ব্যক্তিকেও তিনি সারিয়ে তুলতে লাগলেন প্রায় অলৌকিক উপায়ে। ঈশ্বরচন্দ্ৰ বিদ্যাসাগরকে তিনি সুস্থ করে তুললেন, বিদ্যাসাগর মশাই এখন হোমিওপ্যাথির ভক্ত। রাজা রাধাকান্ত দেবের পায়ের গ্যাংগ্রিন কিছুতেই সারছিল না, রাজের দত্তর চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন, জয়পুরের রাজার চোখের ছানিও সেরে গেল তাঁর ওষুধে। রাজা রাধাকান্ত দেব কৃতজ্ঞ হয়ে রাজেন দত্তকে পঁচিশ হাজার টাকা পুরস্কার দিতে চেয়েছিলেন, রাজেন দত্ত তাও নেননি, হোমিওপ্যাথিক যে জয় হয়েছে, সেটাই তার কাছে যথেষ্ট!

মহেন্দ্রলাল একবার চ্যালেঞ্জ জানালেন রাজেন দত্তকে। তিনি ওঁর সঙ্গে ঘুরে ওঁর চিকিৎসা পদ্ধতি দেখবেন। তারপর থেকেই তিনি রাজেন দত্ত ও হোমিওপ্যাথির ঘোর ভক্ত। কলকাতার চিকিৎসক সমাজ ছি. ছি. করতে লাগল, ব্রিটিশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের বাংলার শাখা থেকে তাঁকে বিতাড়নের প্রস্তাব উঠল। কিন্তু মহেন্দ্রলাল তাঁর জেদ ছাড়লেন না। নবরূপে আবির্ভূত হবার পর প্রথম কয়েক মাস তিনি রুগীই পাননি, তারপর ধীরে ধীরে তার হাতযশ ছড়াতে লাগল। এখন তিনি শয্যার পাশ দাঁড়ালে মুমূর্ষু রুগীও উঠে বসে।

শশিভূষণ তাঁর প্রথম যৌবনে কেশব সেন ও মহেন্দ্রলাল সরকারের মতন ব্যক্তিদের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। অন্ধ বিশ্বাস ও ভক্তির বদলে যুক্তিই ছিল মূল মন্ত্র। কিন্তু এখন তাঁর সেইসব আদর্শ পুরুষদের মতবদল দেখে বিভ্রান্ত হয়ে অনুগামী হয়ে খোল কত্তাল বাজিয়ে কীর্তন শুরু করেছেন, আর মহেন্দ্রলাল হয়েছেন চেলা। অথচ, মহেন্দ্রলালের কথা শুনেই শশিভূষণ এতকাল মনে করতেন, হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা হল চিল ছোড়া, কিছু কিছু রোগ প্রকৃতির হাতে ছেড়ে দিলে আপনি সেরে যায়, হোমিওপ্যাথি ডাক্তাররা সেই আরোগ্যের কৃতিত্ব নেয়। আজ শশিভূষণকে সেই চিকিৎসারই আশ্রয় নিতে হচ্ছে, আর চিকিৎসা করতে আসছেন যিনি, তার কাছ থেকেই শশিভূষণ পেয়েছিলেন অবিশ্বাসের দীক্ষা।

সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে মহেন্দ্রলাল হঠাৎ থেমে গিয়ে শশিভূষণের মেজদা মণিভূষণকে জিজ্ঞেস করলেন, ও সব কিসের আওয়াজ?

মণিভূষণ ছিপছিপে মধ্যবয়স্ক পুরুষ, মাথায় টাক, বাড়িতেও তিনি ফুলপ্যান্ট ও ফুল ক্লিভ শার্ট পরে থাকেন, গলায় টাই না বেঁধে বাইরে বেরোন না। এ দিকে আবার তিনি পরম বৈষ্ণব, ঠাকুরের প্রসাদ না নিয়ে মধ্যাহ্নভোজনে বসেন না কখনও। মণিভূষণ বললেন, আজ্ঞে, আমাদের গৃহদেবতার পূজা হচ্ছে।

মহেন্দ্রলাল পরে আছেন ধূসর রঙের থ্রিপিস সুট। কোটের বুকপকেটে থেকে উঁকি দিচ্ছে রুমালের ত্রিকোণ। প্যান্টের পকেট থেকে অন্য একটি রুমাল বার করে কপালের ঘাম মুছলেন। ওপরতলায় ঠাকুর ঘরে একই সঙ্গে ঘণ্টা, কঁশি ও করতাল বাজছে, সেই সঙ্গে শোনা যাচ্ছে এক পুরুতের উচ্চ কণ্ঠস্বর।

মহেন্দ্রলাল জিজ্ঞেস করলেন, প্রত্যেকদিনই এ রকম হয়?

মণিভূষণ বললেন, প্রত্যেকদিন তো পুজো হয় বটেই। গৃহদেবতার একদিনের জন্য বন্ধ হলে সে গৃহ ছারখারে যায়। তবে শশীর এমন ব্যারামের জন্য ক’দিন শান্তি স্বত্তয়ন হচ্ছে। আটপাড়ার এক পূজারী।

মহেন্দ্রলাল এবার গর্জন করে বললেন, বন্ধ করুন! না হলে আমি ফিরে যাব। বাড়িতে যখন এই রকম চেল্লাচেল্লি হবে, তখন ডাক্তার ডাকবেন না। কাঁই-কুঁই ঢাং ঢেং শুনলে কেউ মনঃসংযোগ করতে পারে। ওফ, আমারই কানে তালা লেগে যাচ্ছে, তা হলে রুগীর কী অবস্থা। এতে অসুখ কমে, না বাড়ে? ণর মুখে আতঙ্কের ছাপ পড়ল। পুজো কি মাঝপথে বন্ধ করা যায় নাকি। তাতে যে মহা অকল্যাণ হবে। ডাক্তার বাড়িতে একদিন-দুদিন আসে, পুজো-আচ্চা নিত্য তিরিশ দিনের ব্যাপার! তিনি বললেন, ডাক্তারবাবু, আপনি দোতলার বৈঠকখানা ঘরে বসে একটু বিশ্রাম গ্ৰহণ করুন। পান-তামাক খান। আর আধা ঘণ্টার মধ্যেই আরতি শেষ হয়ে যাবে।

মহেন্দ্রলাল ভুরু তুলে বললেন, আমি রুগী দেখতে এসে পান খাই না, তামাকও খাই না। আমার বিশ্রামের কোনও প্রয়োজন নেই, আমার সময়ের দাম আছে। ওই খোল-কত্তালের ঝ্যানঝ্যাননি যদি বন্ধ না করেন, তা হলে আমি এই দণ্ডেই ফিরে চল্লেম। আমার দ্বারা চিকিৎসে হবে না!

মহেন্দ্রলাল সত্যি সত্যি ফিরছেন দেখে মণিভূষণ হাত জোড় করে বললেন, দাঁড়ান, দাঁড়ান, আমি পুরুতমশাইকে বলে দেখি।

সিঁড়িতেই দাঁড়িয়ে রইলেন মহেন্দ্রলাল। মণিভূষণের এক কর্মচারী ছুটে গেল ঠাকুরঘরে। সেখানে কিছুটা বিতর্ক হয়ে গেল। আজ তিনজন পুরুত উপস্থিত, তাঁরা পুজো থামাতে রাজি নন, কোনও গৃহস্বামী তাঁদের কখনও এমন অনুরোধ করেনি। কর্মচারীটি ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের নাম করায় একজন পুরোহিত বললেন, ওরে বাবা, সেই পাষণ্ডটা এসেছে? সে যে এক জাঁদরেল গুণ্ডা। এরপর ঠাকুরঘরে এসে সে আমাদেরই না চড়-চাপড় মারে। পুজো চলুক, কিন্তু বাজনাগুলো সব থামাও, মনে মনে মন্ত্রপাঠ করো।

সারা বাড়ি স্তব্ধ হতে মহেন্দ্রলাল বললেন, আপদের শান্তি! চলুন, এবার রুগী দেখা যাক।

শশিভূষণের ঘরের দরজার কাছে এসেও ঢোকার আগে একটুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলেন মহেন্দ্রলাল। কোমরে দু’হাত দিয়ে সেনানায়কের ভঙ্গিতে তিনি যেন সৈন্যশিবির পরিদর্শন করছেন।

শশিভূষণও আধ-শোওয়া হয়ে দেখতে লাগলেন তাঁর প্রথম যৌবনের এই এক নায়ককে। শুধু চিকিৎসক তো নন তিনি যুবসমাজের এক শ্রেণীর মুখপাত্ৰ। বহু কুসংস্কার ভাঙতেও তিনি বদ্ধপরিকর।

বাড়ির সকলেই এদিক সেদিক থেকে কৌতূহলে উকি মেরে আছে। এই বিতর্কিত ও প্রসিদ্ধ চিকিৎসকটিকে অনেকেই স্বচক্ষে দেখতে চায়। মহেন্দ্রলাল ধমক দিয়ে বললেন, এত ভিড় কেন? সবাইকে সরে যেতে বলো। ঘরের জানলাগুলো সব খুলে দাও। মিট-সেফের ওপর আধখাওয়া দুধের গেলাস, সকড়ি প্লেট সরাতে পারনি আগে থেকে। ডাক্তার কি মুদ্দোফরাস নাকি? নোংরা ঘরে পা দিতে আমার ঘেন্না করে। হঠাও, সব জঞ্জাল হঠাও! বেডপ্যান খাটের নীচে রাখতে হয়, তাও কেউ জানে না এ বাড়িতে?

ভেতরে এসে, শশিভূষণের শিয়রের কাছে দাঁড়িয়ে তিনি কিন্তু কোমল কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন, খুব কষ্ট? কোথায়, মাথায়?

প্রায় সিংহাসনের মতন একটি সুদৃশ্য কেদারা এনে দেওয়া হল ডাক্তারের বসবার জন্য, তিনি বসলেন না, দাঁড়িয়েই জিজ্ঞেস করলেন, শুনলাম তুমি ত্রিপুরায় থাক, সেখানে মশা কেমন?

শশিভূষণ বললেন, মশা আছে, অনেক।

মহেন্দ্রলাল আবার জিজ্ঞেস করলেন, জল কেমন? পাহাড়ী জায়গার জলে পেটের রোগ হয়।

শশিভূষণ বলেন, হ্যা, অনেকেরই পেটের রোগ আছে।

—” আগে কোনও কঠিন রোগ হয়েছিল। শেষ কবে ডাক্তার দেখিয়েছ।

— কঠিন রোগ কখনও হয়নি, অন্তত পনেরো-ষোলো বছর কোনও ডাক্তারের ওষুধ খাইনি।

– রোগ না হোক, দুর্ঘটনা হয়নি?

— ঘোড়া থেকে একবার পড়ে গিয়েছিলাম, সে-ও বারো-তের বছর বয়সে।

মহেন্দ্রলাল পালঙ্কের মাথার দিকটা ঘুরে এসে অন্য পাশে একটি কাচের আলমারিতে রাখা বইগুলি দেখতে লাগলেন মন দিয়ে। তারপর চেয়ারটিতে বসে। শশিভূষণের একটি হাত টেনে নিয়ে নাড়ি চেপে ধ্যানস্থের মতন হয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। ঘরের মধ্যে এখন উপস্থিত। শুধু শশিভূষণের দুই দাদা। ওঁরা নিজেদের মধ্যে কিছু একটা কথা শুরু করতেই মহেন্দ্রলাল রোষকষায়িত লোচনে সেদিকে তাকিয়ে হুংকার দিয়ে বললেন, চোপ। এরপর তিনি শশিভূষণের জিভ, চোখ, হাঁটুর গ্রন্থি ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ পরীক্ষা করে দেখবার পর প্রসন্ন নিঃশ্বাস ফেললেন, রুগীর দালালদের বললেন, আমার হাত ধোয়ার জন্য গরম জল আনাও।

শশিভূষণের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমার অসুখের যা বিবরণ শুনেছিলাম,  অবস্থা সে রকম সংকটজনক নয়। তিনদিনের ওষুধ দিচ্ছি, সে ওষুধ আমার সঙ্গেই আছে। এর পরের ওষুধ আমার চেম্বার থেকে নিয়ে আসতে হবে। তুমি হার্বটি স্পেনসারের বই পড়! কোৎ পড়েছ?

মণিভূষণ প্যান্টালুনের পকেটে একটা পার্স নিয়ে নাড়াচাড়া করছেন, ডাক্তারের ফি কত দিতে হবে, তা জিজ্ঞেস করতে সাহস পাচ্ছেন না। মহেন্দ্রলাল উঠে দাঁড়াতেই তিনি পকেট থেকে পাসার্টা বার করলেন।

মহেন্দ্রলাল বললেন, আমার ভিজিট বত্ৰিশ টাকা।

দুই ভাই চোখাচোখি করল বিস্ময়ে। এই টাকা দিতে যে তারা অপারগ তা নয়, কিন্তু ইংরেজ ডাক্তাররা পর্যন্ত ষোলো টাকা ফি নেয়, আর এই একজন বঙ্গসন্তান ডাক্তার চাইছে বত্রিশ। সবাই জানে, অ্যালোপ্যাথদের তুলনায় হোমিওপ্যাথদের ফি অনেক কম।

মণিভূষণ দ্বিধান্বিতভাবে পার্স খুলতেই মহেন্দ্রলাল বললেন, এখন থাক। তিনদিন পর রুগী নিজে আমার চেমবারে যাবে পরের ওষুধ নিতে। যদিও ও যেতে না পারে, তাহলে আমার এক পয়সা চাই না। রোগ না সারিয়ে মহীন সরকার পয়সা নেয় না। এই কলকেতা শহরে কতকগুলান গুয়োর ব্যাটা ডাক্তার আছে, রুগীদের চিকিৎসা না করে রোগ পুষে রাখে আর বারবার ভিজিট নেয়। রক্তচোষা, বিদের ধাড়ি। তিনদিনের মধ্যে এ ছেলেটা যদি উঠে দাঁড়াতে না পারে, তা হলে আমি নিজেই আবার আসব!

মহেন্দ্রলাল যখন গমনোদ্যত, তখন শশিভূষণ বললেন, মশাই আপনি কি খুব ব্যস্ত? আপনাকে একটা-দুটো প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারি?

মহেন্দ্রলাল ফিরে ভ্রু কুঞ্চিত করে তাকালেন। কয়েক পলক পর বললেন, বিলক্ষণ পারো!! রুগীর যদি প্রশ্ন থাকে ডাক্তার অবশ্যই শুনবে। শুধু ডাক্তারই যে প্রশ্ন করে যাবে এমন তো কোনও আইন নেই।

শশিভূষণ মিনতিপূর্ণ নয়নে দাদাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, তোমরা একটু বাইরে যাবে? ওরা দু’জন বেরিয়ে যাবার পর মহেন্দ্রলাল নিজেই দরজা ভেজিয়ে দিয়ে ফিরে এলেন। শশিভূষণ খানিকটা ইতস্তত করে বললেন, আমি অনেকদিন থেকেই আপনার অনুরাগী।

মহেন্দ্রলাল হাত ঝাড়া দেবার ভঙ্গিতে বললেন, ওসব কথা বাদ দাও, আসল কথা বল!

শশিভূষণ বলেন, কয়েকদিন আগে আমার অবস্থা এখন-তখন ছিল, নিজেই বুঝেছিলাম মাঝে মাঝে নিঃশ্বাস বেধে মুছে কিন্তু খাদ্যদ্রব্য মুখে নিতে পারতাম না। তারপর কাঁচা বেলপাড়ার শরবত আর ফেনাভাত খেয়ে গায়ে কিছুটা জোর পেয়েছি।

মহেন্দ্রলাল বললেন, বেশ তো, ভেরি ওয়েল! যা প্ৰাণ চায়, তাই খাবে। খাদ্য হচ্ছে শরীরের ব্যাপার, শরীর সহ্য করতে পারলেই হল!

— আমার মা এসে আমাকে এই দুটো খেতে বললেন।

– সন্তানের কী ভালো লাগে, তা মায়ের চেয়ে আর বেশি কে বুঝবে? একই তো রক্ত মাংসের আধার।

— ডাক্তারবাবু, আপনি পরীক্ষা করে কী বুঝলেন, আমার মাথা ঠিক আছে? পাগল-ছাগল হয়ে যাব না তো!

– সে রকম তো কোনও লক্ষণ দেখলাম না। ঠিকই আছে। তোমার কথাবার্তাও স্বাভাবিক।

— আমার মা মারা গেছেন সতেরো বছর আগে। তবু মা আমার কাছে এসেছিলেন, আমাকে ওই খাবার কথা বলে গেলেন!

মহেন্দ্রলাল এবার গাঢ় দৃষ্টি ন্যস্ত করলেন তাঁর এই রুগীর মুখে। কোনও মন্তব্য না করে চুপ করে রইলেন।

শশিভূষণ লজ্জিতভাবে ঈষৎ কাঁপা গলায় বললেন, এ কথা আমি অন্য কারুকে বলতে পারি না। আমি নিজে এ সব বিশ্বাস করিনি কোনওদিন। আপনি নিশ্চয়ই বলবেন, আমি স্বপ্ন দেখেছি। কিন্তু ডাক্তারবাবু, আমি আপনাকে এখন যেমন দেখতে পাচ্ছি, মাকেও ঠিক সেইভাবে দেখেছি, মাকে ছুঁয়েছি।! একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মহেন্দ্রলাল বললেন, দেখেছ, বেশ ভালো কথা। তাতে ক্ষতি তো কিছু হয়নি। শশিভূষণ বললেন, কিন্তু আমার বিশ্বাসের সংকট নিয়ে আমি যে খুব অশান্তিতে আছি। সর্বক্ষণ এই চিন্তা। মরা মানুষ কি সত্যি ফিরে আসতে পারে?

মহেন্দ্রলাল এবার দৃঢ় গলায় বললেন, না, পারে না। স্বয়ং ভগবানের সাধ্য নেই মারা মানুষকে ফেরাবার। কিন্তু মানুষ পারে। মানুষ তৈরি করে নিতে পারে অনেক কিছু। খুব তীব্রভাবে চাইলে হারানো বাপ-মাকেও চোখে দেখতে পারে। গয়াতে যারা পিণ্ডি দিতে যায়, তারা নাকি বাপ-ঠাকুর্দার হাত দেখতে পায়। জ্বরের ঘোরে লোকে বিলকি-ছিলকি বলে, চোখেও নাকি কাকে কাকে দেখে। বাপ-মা হারারা অসুখের সময় বাপ কিংবা মাকে দেখে, এরকম তো প্রায়ই শুনি।

শশিভূষণ বললেন, কিন্তু ওই যে পথ্যের কথা, ওসব তো আমি পছন্দ করতাম না, যদি কল্পনাই হয়.

মহেন্দ্রলাল অস্থিরভাবে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ওরে বাপধন, আমি কী আর সব জানি! আমার কিছু মতামত আছে বটে, কিন্তু তা এখন বলার সময় নয়, তোমার শরীর দুর্বল, হজম করতে পারবে না। ভূতের পথ্যি খেয়ে তোমার গায়ে তাগিদ এসেছে, অতি উত্তম কথা, এ নিয়ে দুশ্চিন্তা করার তো প্রয়োজন দেখি না। সুস্থ হয়ে ওঠার পর আমার কাছে ছুটি ছাটার দিনে এসো, তোমায় অনেক গপ্পো শোনাব।

মহেন্দ্রলাল একটা কথাই শুধু শশিভূষণের মনে লেগে রইল। তীব্ৰভাবে চাইলে হারানো বাপ-মাকেও মানুষ আবার তৈরি করতে পারে। মা সেদিন নিজের থেকে আসেননি, তাঁর সেই বাস্তব রূপ তাঁর সন্তানের মন-গড়া। তাই যদি হয়, তা হলে মাকে আবার তো ফিরিয়ে আনা যেতে পারে।

বাবা আর মা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন মাত্র। ছ’মাসের ব্যবধানে। কিন্তু বাবার সঙ্গে কখনও তেমন নৈকট্যবোধ করেননি শশিভূষণ। বাবা ছিলেন খাঁটি জমিদার, ভোগী ও বিলাসী, কখনও নিষ্ঠুর কখনও উদার, প্রজাদের ওপর উৎপীড়ন করেছেন আবার তাদের জন্য দিঘি, কাটিয়ে দিয়েছেন, ইস্কুল বানিয়েছেন, এক-একদিন অতি কৃপণ, এক একদিন দাতা। ছেলেরা কেউ বাবার মতন হয়নি, বড় দুই ছেলে জমিদারি বিক্রি করে দিয়ে এখন ব্যবসায়ী, তারা কুটকৌশলী, নিপুণ সংসারী। তাদের চরিত্রে বড় ধরনের কোনও ব্যঞ্জনা নেই। আর ছোট ছেলে হয়েছে মাস্টার। শশিভূষণ তার বাবার সঙ্গে সাহস করে কথা বলতেই পারতেন না, খুব ছোট বয়েসেও বাবা তাঁর কনিষ্ঠ পুত্রটিকে কখনও আদর করেছেন, এমন স্মৃতি নেই শশিভূষণের। কিন্তু মায়ের কথা আলাদা। এত বড় এক পরিবারের কর্ত্রী ছিলেন তিনি, তবু তিনি ছিলেন ভারি কোমল স্বভাবের, তাঁর ব্যক্তিত্ব ছিল স্নিগ্ধ ছায়াময়। কৈশোরে শশিভূষণ যখন বারমুখো হতে শুরু করেছিলেন, মায়ের কাছে আসবার সময় পেতেন না, তখনও মা প্রতি রাত্রে তাঁর ঘরে এসে বলতেন, সারাদিন তোকে একবারও দেখিনি, শশী, ছেলেটাকে একবার না দেখলে আমি শুতে যাই কী করে? এই পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন শশিভূষণ, নিজের সম্পত্তির ভাগটুকু নেওয়া ছাড়া দাদাদের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক রাখেননি। মৃত মা-বাবার কথা মনে পড়েনি। অনেকদিন। এখন মায়ের জন্য একটা দারুণ আকৃতি বোধ করছেন। সন্ধের পরই চোখ বুজে তীব্র মনঃসংযোগে মাকে ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করতে লাগলেন, জেগে রইলেন প্রায় সারা রাত, কিন্তু আর কোনও অলৌকিক দর্শন হল না। গভীর অভিমানে তাঁর বুক ভরে যায়, কেন মা আসবেন না। কপালটা জ্বালা করে, মা কি বুঝতে পারছেন না যে, তিনি এসে আর একবার হাত রাখলে তাঁর সন্তান কত শান্তি পেত। অবুঝ শিশুর মতন শশিভূষণ ফিসফিস করে ডাকেন, মা, মা, মা!

ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের ওষুধে শশিভূষণের ক্ষুধা বৃদ্ধি হয়েছে, এখন দু’বেলাই তিনি পথ্য গ্ৰহণ করতে পারেন। হাত-পা নাড়া-চাড়া করতে তেমন অসুবিধে নেই, বই পড়ার ইচ্ছেটাও ফিরে এসেছে। এ বাড়িতে দু’তিনটি সংবাদপত্র আসে, তার মধ্যে ইংলিশম্যান’ পত্রিকাটি তিনি ঘৃণায় স্পর্শ করেন না, তার বদলে তিনি পড়েন “ইন্ডিয়ান মিরার’। ব্ৰাহ্মদের বাংলা পত্রিকাগুলি পড়ে তিনি কিছুতেই মিলে মিশে কোনও কাজ করতে পারেন না, দলাদলি হবেই। ইকুলে সবাই রচনা লেখে ‘একতাই শক্তি’, অথচ সমাজজীবনে কোনও একতা নেই। খ্রিস্টান মিশনারিদের কার্যকলাপ প্রতিরোধ করার জন্য ব্রহ্মসমাজের সৃষ্টি হয়েছিল, কত উচ্চ আদর্শ ছিল, আজ তা তিনি টুকরো হয়ে গেছে। শুধু তাই নয়, এখন তারা পরস্পরের দল করে আত্মপ্রচারে মত্ত হলেন। আবার কেশববাবুর নিজে হাতে গড়া শিবনাথ শাস্ত্রীর মতন চেলারা তৃতীয় দল খুলেছে এবং তারা কেশববাবুর বিরুদ্ধে সব সময় কটুক্তি করে। সাবালিকা হবার আগে মেয়েদের বিবাহের প্রবল বিরোধী ছিলেন কেশববাবু, তাকে সবাই মনে করত নারীমুক্তির প্রধান সহায়ক, সে কেশববাবু নিজের নাবালিকাক কন্যার বিবাহ দিলেন রাজকুমারের সঙ্গে। তাও পৌত্তলিক হিন্দু মতে! রাজপরিবারের শ্বশুর হবার জন্য তিনি নিজের আদর্শ বিসর্জন দিলেন। কেশববাবু নাকি আবার মূর্তি পূজার প্রচলন করতে চলেছেন। সাধারণ ব্ৰাহ্মসমাজের কাগজ তত্ত্বকৌমুদী লিখেছে যে, কেশববাবুর নব বিধানে এখন একটা নিশান স্থাপন করে সেটাকে চামর দুলিয়ে আরতি করা হয়। আর সবাই চিপ টিপ করে সেই নিশানটাকে প্ৰণাম করে! নিরাকার ব্ৰহ্মের শিষ্যদের এই পরিণতি।

কেশববাবু একদিন একখানা স্টিমার ভাড়া করে দলবল নিয়ে দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে কালীভক্ত রামকৃষ্ণ ঠাকুরকে তুলে নিয়েছিলেন, তারপর নদীবক্ষে বেড়াতে বেড়াতে নাচ-গান হল। ওই রামকৃষ্ণ ঠাকুর যখন তখন অজ্ঞান হয়ে যান, অনেকে বলছে, সেটা নাকি ভাব-সমাধি। একদিন গিয়ে নিজের চক্ষে ব্যাপারটা দেখতে হবে।

সকালবেলা বালিশে ঠেস দিয়ে বসে কাগজ পড়ছেন শশিভূষণ, হঠাৎ তাঁর মনে হল দরজার সামনে দিয়ে একটি কিশোরী মেয়ে ছুটে গেল, তার হাতে একগুচ্ছ সাদা ফুল। শশিভূষণের বুক এমন ভাব কেঁপে উঠল যে তিনি দু’হাতে বুক চেপে ধরলেন, যেন এক্ষুনি তাঁর নিশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। ভয়ে তাঁর সমস্ত রোমকূপে শিহরন বয়ে যাচ্ছে। এই সেই কিশোরী, যে শেষরাত্রে এসে তাঁকে জলপান করিয়েই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছিল। প্রথম দিন অজ্ঞান হবার সময় সিঁড়ির নীচেও একেই দেখেছিলেন, তখনও এর হাতে ছিল সাদা ফুল।

অতিকষ্টে সামলে নিয়ে শশিভূষণ নিজেকেই করলেন। এ কী হচ্ছে, আমার, আমি এত দুর্বল হয়ে গেছি যে দিনের আলোয় ভূত দেখছি? না, না, তা হতেই পারে না, নিশ্চয়ই আমার দৃষ্টি বিভ্রম, অথবা সত্যিই একটি মেয়ে ছুটে গেছে। এর যে-কোনও একটাই হোক, তাতেই বা আমি ভয় পাব কেন?

ঠিক এই সময় কৃষ্ণভামিনী বেলের শরবত ভর্তি গেলাস নিয়ে ঢুকলেন ঘরে। সঙ্গে সঙ্গে শশিভূষণের মনে হল, যদি চোখের ভুল না হয়, তা হলে ইনিও নিশ্চিত দেখছেন মেয়েটিকে।

শশিভূষণ জিজ্ঞেস করলেন, বউদিদিমণি, এই মাত্র বাইরে দিয়ে কে একটি মেয়ে ছুটে গেল?

কৃষ্ণভামিনী বললেন, কই, কে আবার ছুটে যাবে।”

শশিভূষণ তবু বললেন, তুমি একটু দেখো তো!

কৃষ্ণভামিনী পিছিয়ে গিয়ে ওপরের সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, ও, ও তো বুমি গো, বুমি!

শশিভূষণ ভুরু তুলে বললেন, কে বুমি?

কৃষ্ণভামিনী বললেন, বাঃ, তুমি বুমিকে দেখনি? কতবার এসেছে, তোমর সেবা-যত্ন করেছে।

শশিভূষণ বললেন, ওকে একবার ডাকো, এখানে আসতে বলে।

দরজার কাছে এসে দাঁড়াল একটি কিশোরী, লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরা, মাজা-মাজা রং, মুখে যেন গর্জন তেল মাখানো, মাথা ভর্তি ঈষৎ কোকড়া চুল, অজস্র চুল, সেই চুলে তাঁর পিঠ ছাওয়া, একগুচ্ছ রয়েছে বুকের অপরে, তাঁর হাতে এক তোড়া গন্ধরাজ ফুল।

শশিভূষণের আমার বুক কাঁপছে, তবে এবার ভয়ে নয়, সত্যের উপলদ্ধিতে। তা হলে একজন অন্তত অলীক নয়, তাঁর মন গড়া নয়, এ মেয়েটি বাস্তব, শেষ্রাতে এই মেয়েটি কেন তাঁকে জলপান করাতে এসেছিল, সে প্রশ্ন মনে জাগল না, শশিভূষণ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন সাদা ফুলগুলির দিকে। প্রায় আপন মনেই বললেন, ওর হাতে সবসময় সাদা ফুল থাকে কেন?

কৃষ্ণভামিনী বললেন, ও রোজ সকালে বাগান থেকে ফুল তুলে আনে। রোজ ও ঠাকুরঘর সাজায়।

এবারে মেয়েটিকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, তুমি কে? তোমার নাম কী? কিশোরীটি সলজ্জ। কণ্ঠে বলল, আমার নাম ভূমিসূতা মহাপাত্র। শশিভূষণ বিস্ময় ও অনুরক্ত প্রশ্ন নিয়ে বউদিদির দিকে তাকালেন। উনি যা-ই বলুন, মাত্র দু’বারই আচ্ছন্ন অবস্থায় তিনি এই মেয়েটিকে দেখেছেন, স্বাভাবিক অবস্থায় একবারও দেখেননি, এ বাড়িতে এই নামের একটি মেয়ের অস্তিত্বের একটি বিদুৎ ঝলকের মতন পর মুহুর্তে অদৃশ্য হয়ে গেল মেয়েটি।

শশিভূষণকে শরবত খাওয়াতে খাওয়াতে কৃষ্ণভামিনী ওই কিশোরীর কাহিনী শোনালেন। দেড় বছর আগে শশিভূষণের মেজদাদা ও মেজবউদি বেড়াতে গিয়েছিলেন পুরী জগন্নাথ ধামে। ফেরার সময় তারা ভূমিসূতাকে সঙ্গে নিয়ে ফিরেছেন। কলেরায় ভূমিসূতার বাবা-মা ও দুই দাদা মারা যায় অল্পদিনের মধ্যে, তার এক চশমখোর মামা ওই মেয়েকে বিক্রি করে দেয় এক পাণ্ডার কাছে দেবদাসী বানাবার জন্য। ভূমিসূতা কিছুতেই যাবে না, হাপুস নয়নে কাঁদছিল, পাণ্ডা মহারাজ নির্মমভাবে টানাটানি করছিল তাকে, সেই অবস্থায় মণিভূষণের চোখে পড়ে। সুহাসিনীর খুবই দয়া হয় মেয়েটিকে দেখে, সুহাসিনীর সনির্বন্ধ অনুরোধেই মণিভূষণ ওকে উদ্ধার করেন, পাণ্ডা মহারাজকে ক্রয়মূল্য তিনিই চুকিয়ে দিয়েছেন। সেই থেকে ভূমিসূতা এ বাড়িতে আছে, চমৎকার মানিয়ে নিয়েছে নিজে থেকেই সে অনেক রকম কাজকৰ্ম্ম করে। ঘরে প্রতি রাত্রেই পালা করে কেউ না কেউ শোয়, এর মধ্যে বার দুয়েক ভূমিসূতাও মেঝেতে শুয়েছে। ও কিন্তু সাধারণ দাসী নয়, পরিবারেরই একজন হয়ে উঠেছে বলতে গেলে, কিছু কিছু লেখাপড়াও জানে, ওড়িয়া, বাংলা, ইংরেজিও পড়তে পারে।

শশিভূষণের আর একটা ধন্ধও কিছুটা পরিষ্কার হয়ে গেছে। কৃষ্ণভামিনী কথায় কথায় বললেন, তুমি গেলাস গেলাস বেলপোড়ার শরবত খাচ্ছো, আগে মোটে ছুতে না। তোমার এখন এই শরবত খাওয়ার ঘটা দেখে তোমার দাদা কী বলেছেন জান? শশীটা ঠিক বাবার মতন হয়েছে। বাবার একবার উদুরি হল, বেলপোড়া শরবত ছাড়া আর কিছু খেতে চাইতেন না। তখন আমাদের বাড়ির বেলগাছ ছিল না, বেল এমন সস্তার জিনিস, বাজারে কেউ বেচেও না, নানান বাগান ঘুরে ঘুরে আমাদের বেল জোগাড় করতে হতো। একবার বেল পাড়তে গিয়ে এক ব্ৰহ্মদৈত্য তোমায় তাড়া করেছিল। বাবাই তো, আমাদের বাগানে দু’খানা বেলগাছ পুতলেন।

ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার বৃথা বাগাড়ম্বর করেননি, তার ওষুধ শুরু করার তৃতীয় দিনেই শশিভূষণ চলে ফিরে বেড়াতে সক্ষম হলেন। অন্যের সাহায্য ছাড়াই গেলেন শৌচালয়ে। বিকেলবেলা ডাক্তারের চেম্বারে তিনি যাবেন। শশিভূষণ তাঁর সারা শরীরে অনুভব করছেন জীবন-রস ফিরে পাওয়া ছন্দ। অনেকদিন পর তিনি এসে দাঁড়ালেন ঘরের সংলগ্ন অলিন্দে।

এখান থেকে পুরো বাগানটি দেখা যায়। প্রায় দেড় বিঘে জমির উদ্যান, শশিভূষণের পিতার গাছপালার শখ ছিল, নিজের হাতে তিনি রকমারি ফুলের চারা বসাতেন। সে আমলের তিনজন মালি ছিল, এখনও রয়েছে। একজন, বাগানটি বিশেষ নষ্ট হয়নি। একটু দূরে ফলবান বৃক্ষের সারি, বাড়ির কাছাকাছি অজস্ৰ ফুলের ঝাড়। বেল-যুঁই-রজনীগন্ধা-গন্ধরাজ ফুলগাছগুলির পাশে ঘুরছে ভূমিসূতা। ও সব সময় সাদা শাড়ি পরে কেন, আর শুধু সাদা ফুলই ভালোবাসে? মাথায় এত চুলের বাহুল্যের জন্য। ওর মুখখানাকে মনে হয় যেন একটা ফুল। শশি একজন ফটােগ্রাফারের চোখ দিয়ে দেখতে লাগলেন ভূমিসূতাকে। ফুলের বাগানে আনমনা এক কিশোরীর ছবি খুব ভালো উঠতে পারে। শুধু সাদা শাড়ির বদলে ওকে একটা গাঢ় রঙের কিংবা ডুরে শাড়ি পরানো দরকার, এত দূর থেকেও হবে না, ক্যামেরা অনেক কাছে বসাতে হবে।

আর একটু সুস্থ হলে শশিভূষণ ওর একটা ছবি তুলবেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *