দুনিয়ায় সব কিছু একসাথে হয় না।
ফরাসীরা আমাদের সাম্য, মৈত্রী, স্বাধীনতা শিখাইসে। অথচ ফরাসী দেশেই সাম্য বা স্বাধীনতা—কোনটাই পুরাপুরি নাই।
ফিদেল ক্যাস্ট্রো আমাদের সাম্যের বাণী শোনান। কিন্তু নিজের দেশের মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা কেড়ে নিয়ে। স্বাধীনতার লোভে তার দেশের মানুষ তাই নব্বই মাইল সমুদ্র পাড়ি দিয়ে আমেরিকায় এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।
তার দেশের মানুষ যেই ড্রীমল্যান্ডে আসে, এইখানে স্বাধীনতা আছে। কিন্তু সেটা সাম্যের বিনিময়ে। এখানকার বড় শহরগুলোতে তাই হোমলেস মানুষের সংখ্যা চোখে পড়্রা মত। এখানকার কোম্পানির সিইও আর সাধারণ এমপ্লয়ীর বেতনের পার্থক্য অশ্লীল রকমের বেশি। বাস্তু পিরামিডের সবচেয়ে উপরের মানুষ আর সবচেয়ে নিচের মানুষটার দূরত্ব এখানে দিনকে দিন বেড়েই চলেছে।
ঠিক একই না হলেও কাছাকাছি ব্যাপারটা ঘটে চলেছে আমাদের পারিবারিক জীবনে।
ক্যারিয়ার ঠিক রাখতে গেলে আমরা ফ্যামিলির সদস্যদের সময় দিতে পারি না। আবার পরিবারের সাথে নিয়মিত কোয়ালিটি টাইম কাটাতে গেলে ক্যারিয়ারের বারোটা বেজে যায়।
যে লোকটাকে তাই ছুটির দিনেও বাইরে বেরোতে হয় বিদেশী ক্লায়েন্ট এ্যাটেন্ড করার জন্য, সেই এই যন্ত্রণাটা বোঝে। তার বাচ্চা মেয়েটা তাকে সারা সপ্তাহে কাছে পায় না। ছুটির দিনে মেয়ের সাথে খেলবার কথা দিয়ে যখন সে বেরোতে নেয় আর মেয়েটা তার শার্টের কোঁচা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে, তখন আমরা বুঝি—আধুনিক সময় আমাদের কী দিচ্ছে আর কী কেড়ে নিচ্ছে।
সমাজ, রাষ্ট্র কিংবা বাজার—যেটাই বলেন, তার সাথে পরিবারের এই দ্বন্দ্বটা আধুনিক সময়ের সবচেয়ে বড় উপাখ্যান।
আমরা বুদ্ধিবৃত্তিক বিপ্লব পার হয়ে আসছি, কৃষি বিপ্লব পার হয়ে আসছি—সব সময়ই পরিবার আমাদের সাথে ছিল। সুতাটা একটুকুও ছিঁড়ে নাই। পরিবার থেকেই গোত্র হইসে, সম্প্রদায় হইসে, সাম্রাজ্য পর্যন্ত হইসে—কিন্তু পরিবারের কলকব্জায় সে আঘাত করতে পারে নাই।
আমরা অসুস্থ হইসি। পরিবারের সদস্যরা আমাদের সেবাযত্ন করসে। বুড়া হইসি। বাড়ি বানাবো। হাত লাগবে। পরিবার প্রতিবেশীরাই এগিয়ে আসছে। ব্যবসা করবো। লোন লাগবে। ঐ পরিবার প্রতিবেশীরাই ছিল শেষ আশ্রয়স্থল। আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি—সব কিছুর আঁতুরঘর ছিল এই পরিবার।
রাষ্ট্রীয় প্রশাসনও সামলাইসে এই পরিবার। মিং আমলে চায়নায় একটা সিস্টেম ছিল। এই সিটেমকে বলা হত Baojia সিস্টেম। দশটা পরিবার মিলে হইতো একটা Bao। আর দশটা Bao মিলে তৈরি হত একটা Jia। Bao এর এক সদস্য কোন অন্যায় করলে অন্যদেরও তার শাস্তি পেতে হত। স্পেশালী Bao এর মুরুব্বিদের। ট্যাক্সও ঐ মুরুব্বীরাই কালেক্ট করতো। বুড়োরা তো জানতো, কোন পরিবারের আয় কেমন। ঐ অনুযায়ী ট্যাক্সের রেট ঠিক করে দিত। এতে একটা বিশাল সুবিধা হইসিলো মিং রাজাদের। বেতন দিয়ে হাজার হাজার ট্যাক্স কালেক্টর পোষা লাগে নাই তাদের। পরিবারগুলোই প্রশাসন সামলাইসে।
তার মানে এই না যে—পরিবার ভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা মাত্রই সুখস্বর্গ। ১৭৫০ সালের এক মানুষের কথা চিন্তা করেন। তার বাপ-মা দুইজনই মারা গেলে তাকে রীতিমত পথে বসতে হতো। অনেক সময় গোত্রও তার দায়িত্ব নিত না। সেক্ষেত্রে সে হয় সৈন্যদলে নাম লেখাতো নয়তো বেশ্যালয়ে।
গত দুই শতাব্দীতে এই চিত্রে একটা বড়সড় পরিবর্তন আসছে। সমাজের নিউক্লিয়াস থেকে পরিবার আস্তে আস্তে সরে আসছে। শিল্প বিপ্লবের পর থেকেই রাষ্ট্র আর বাজার ক্রমেই শক্তিশালী হয়ে উঠতেসে। আর বাজার যতো স্ট্রং হচ্ছে, পরিবার, পারিবারিক মূল্যবোধ—এরা ততো দুর্বল হয়ে পড়ছে।
বাজার আমাদের ‘ইনডিভিজুয়াল’ হতে বলতেসে। বলতেসে, বাপ-মা’র কথা শোনার দরকার নাই। যেমনে খুশি জীবন কাটাও। যার সাথে খুশি জীবন কাটাও। তোমার জীবন তোমার।
মামা’জ বয়দের এখানে খুব করুণার চোখে দেখা হয়। বাজার আমাদের কানে প্রতিনিয়ত এই মন্ত্র বাজিয়ে যায়, বাপ-মা’র পায়ের নিচে পড়ে থাকার কোন মানে নাই। দরকার হইলে আমরা তোমার টেক কেয়ার করবো। আমার জন্য কাজ করো। আমি তোমার অসুখ হইলে তোমারে সারায়ে তুলবো। বাড়ি বানানোর লোন দিব। আর বুড়া হইলে পেনশন।
এই লোভে পড়ে মানুষ বাজারকে সময় দিতেসে। কিন্তু বাজারকে সময় দিতে গিয়ে দেখে, সে নিজে একা হয়ে পড়তেসে। তার কথা শোনার কেউ নাই। সুখ-দুঃখের আলাপ করার কেউ নাই। মার্কেট ইকোনমির সাথে পারিবারিক জীবনের এই দ্বন্দ্ব আমাদের রীতিমত ছিঁড়েখুঁড়ে খাচ্ছে। বায়োলজিক্যাল বাপ-মা’র ভূমিকা আজ এখানে গৌণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ রাষ্ট্র আমাদের মা। বাজার আমাদের বাপ।
এক সময় যেমন ম্যাচমেকারের মূল দায়িত্বটা পালন করতো আমাদের বাবা-মা। আর্থিক লেনদেন যতোটুকুই হতো, সেটা বৈঠক ঘরে। পিতায় পিতায়। এই লেনদেনটাই এখন বৈঠকঘর ছাড়িয়ে চলে এসেছে রেস্তোঁরা আর কফিশপে। টাকাটা এখন বাবাদের পকেটে না গিয়ে যায় সুন্দরী ওয়েট্রেসের পকেটে। রেস্তোঁরায় এলেই তো আর প্রেম করা যায় না। প্রেম করার জন্য যে মিনিমাম যোগ্যতা, সেটা অর্জন করার জন্য আমাদের যেতে হয় জিমে। ফ্যাশন ডিজাইনার আর ডায়েটিশিয়ানদের কাছে।
জিম ইনস্ট্রাক্টর কিংবা ডায়েটিশিয়ানও আমাদের বিনা পয়সায় সার্ভিসটা দেয় না। এই পয়সাটা আসে আমাদের করা ওভারটাইম থেকে। কিংবা ছুটির দিনের এক্সট্রা খাটুনি থেকে। যে সময়টুকু আমাদের পরিবারকে দেয়ার কথা ছিল, সেই সময়টুকু খোলা বাজারে সওদা করে।
বাজার অর্থনীতি এইভাবে তার দেয়া স্বাধীনতার মূল্য পুরোপুরি উশুল করে নেয় আমাদের জীবন থেকে।
একদল ইঁদুরের উপর একবার একটা পরীক্ষা করা হল। ইঁদুরগুলোকে দুটো দলে ভাগ করে বড় করা হল। একদলকে বাবা ইঁদুরের সাথে একই খাঁচায় বড় করা হল। আরেক দলকে বাবা ইঁদুর ছাড়াই বড় করা হল।
দেখা গেলো, যেসব ইঁদুর বাবা ইঁদুর ছাড়াই বড় হচ্ছে, তারা বেশি হিংস্র আর এ্যাগ্রেসিভ হয়ে ইঠছে।
মানুষের মত পশুপাখিদেরও যে স্নেহ মায়া মমতা ভালবাসার দরকার আছে, এটাই তার একমাত্র প্রমাণ না।
১৯৫০ এর দিকে মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ হ্যারি হার্লো বানরদের নিয়া একটা পরীক্ষা করেন। জন্মের পরপরই হ্যারি মা বানর থেকে শিশু বানরকে আলাদা করে ফেলেন। সেই শিশু বানরকে লালন পালনের ভার দেয়া হয় নকল মা বানরের উপর।
প্রতিটা খাঁচায় দুটো করে নকল মা ছিল। এক মা’র শরীর ধাতব তার দিয়ে তৈরি। তার গায়ে আবার দুধের বোতল ফিট করে রাখা হইসে যেন শিশু বানরটা তার ত্ষ্ণা মেটাতে পারে। আরেকটা মা’র শরীর কাঠের। তার উপর কাপড়-চোপড় জড়ানো। এই মা দেখতে অনেকটা আসল মা বানরের মতন।
শুধু দেখতেই। এই মা’র শরীরে খানা-খাদ্য কিছু ফিট করা ছিল না। হার্লো ভাবসিলেন, দুধ যেহেতু ধাতব মা’র কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে, বানর শিশু সারাদিন তার গায়েই পেল্টে থাকবে।
হার্লোকে অবাক করে দিয়ে বানর শিশুরা দিনের বেশিরভাগটা সময় কাপড় পরা মায়ের সাথেই কাটায়। এমনকি তারা যখন ধাতব মায়ের বুকের দুধ খায়, তখনও দুই পা দিয়ে কাপড় পরা মা-কে আঁকরে রাখে।
হার্লো ভাবলেন, বানরগুলার কি ঠান্ডা লাগতেসে? ওমের জন্য কি কাপড় পরা মাকে আঁকরায়ে ধরতেসে? উনি ধাতব মা’র শরীরের ভেতর একটা ইলেকট্রিক বাল্ব পুরে দিলেন যেন সেটা থেকে তারা তাপ পায়। দেখা গেল, এতো সুযোগ সুবিধার পরও কাপড় মা-কে তারা ছাড়ছে না।
ম্যাটারিয়েলিস্টিক চাহিদার চেয়ে সাইকোলজিক্যাল চাহিদাটাই যে বড়, এই বানর শিশুগুলো তা আবারও প্রমাণ করে ছাড়লো।
হ্যাঁ, মানুষ গাড়ি চায়, বাড়ি চায়, সবই চায়। এর পাশাপাশি সে আরেকটা জিনিস চায়। সে আরেক মানুষের সাথে বন্ধনে জড়াতে চায়। সে চায়, তাকে নিয়ে আরেকটা মানুষ ভাবুক। তার দুঃখে কাঁধে হাত রাখুক। তার ম্ত্যুর পর দু ফোঁটা চোখে জল ফেলুক। পশুপাখি হয়তো এতোটা চায় না। কিন্তু তারাও বন্ধনে জড়াতে চায়। মা-বাপ, ভাই-বোনকে নিয়ে একটা সুস্থ সোশ্যাল জীবন চায়।
আমরা ক্ষমতার জোরে তাদেরকে এই জীবন থেকে তো বঞ্চিত করছিই, সেই সাথে প্রতি বছর ৫০ বিলিয়ন প্রাণী হত্যা করে নিজেদের পেটের চাহিদা মেটাচ্ছি। অবশ্য পৃথিবীটাই এমন। একজনের সর্বনাশ করে আরেকজন তার পেটের ক্ষুধা মেটায়।
এর ফলে আমাদের একটা লাভ হইসে—যেটা খুব স্পষ্ট। আমাদের খাদ্যের পরিমাণ অনেক অনেক বাড়সে। সবাইকে এখন আর লাঙল নিয়ে মাঠে দৌড়াতে হয় না। আমেরিকাতেই তো মাত্র ২ শতাংশ মানুষ এখন কৃষিকাজ করে। ঐ ২ শতাংশই গোটা মহাদেশের খাদ্য চাহিদা মেটাচ্ছে।
বাকি ৯৮ পার্সেন্ট লোক তাহলে কী করছে? এরাই মোবাইল বানাচ্ছে, কম্পিটার বানাচ্ছে, ক্যামেরা আর ওয়াশিং মেশিন বানাচ্ছে। এই বিপুল কর্মযজ্ঞের ফলে ইতিহাসে প্রথমবারের মত আমাদের চাহিদার চেয়ে বেশি জিনিস উৎপাদিত হতে লাগলো। এর ফলে একটা নতুন সমস্যা দেখা দিল।
এতো জিনিস কিনবে কে?
আর কে কিনবে? আমার আপনার মত সাধারণ মানুষ কিনবে। আমরা না কিনলে পুঁজিবাদের চাকাটাই যে বন্ধ হয়ে যাবে। নিজ অস্তিত্বের স্বার্থেই পুঁজিবাদ আমাদের মধ্যে কেনার একটা অভ্যাস বুনে দিয়েছে। এর একটা বলিহারি নামও দিয়েছি আমরা। যাকে বলি কনজ্যুমারিজম।
ইতিহাসে বেশিরভাগটা সময় জুড়েই ছিল—Necessity is the mother of invention. এখন সেটা হয়ে দাঁড়িয়েছে—Invention is the mother of necessity. কাল বাজারে আইফোনের একটা নতুন মডেল আসুক। আমরা অনেকেই চোখ বন্ধ করে সেটা কিনতে লাইন দেব। নতুন কী ফিচার যোগ হল—সেটা না জেনেই।
আমরা দরকারি জিনিস কিনছি। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে কিছি এমন জিনিস যা আমাদের না হলেও চলতো। কেন? স্রোতের সাথে থাকার জন্য। পাঁচজন মিলে যখন আড্ডা মারছি, তখন দেখা যায় বাকি চারজন আইফোনের নতুন ফিচার নিয়ে আলাপ করছে। পঞ্চম ব্যক্তিটিকে তখন জোয়ির মত মুখ হাঁ করে বসে থাকতে হয়। না বুঝেই মাথা নাড়তে হয়।
আমরা কেউই এই আনইজি অবস্থায় পড়তে চাই না। আমরা চাই কমফোর্ট জোনে থাকতে। স্রোতের সাথে থাকতে। ম্যানুফ্যাকচাররা আআমদের এই ইনসিকিউরিটির খোঁজ রাখেন। বাজারে হয়তো অলরেডি প্রায় পারফেক্ট একটা মডেল আছে, তারপরও এরা বছর বছর একটা দুটো হালকা ফিচার যোগ করে নতুন মডেল ছাড়বে বাজারে। আর পাবলিকও সেটা খাবে।
Shopaholic শব্দটা তাই এমনি এমনি আসে নি। আমাদের ধর্মীয়, সামাজিক—সমস্ত উৎসবের কেন্দ্রে এসে দাঁড়িয়েছে এই কনজ্যুমারিজম। ক্রিসমাসকে বলা হয় পৃথিবীর বৃহত্তম শপিং ফেস্টিভ্যাল। Memorial Day নামে একটা দিবস আছে আমেরিকায়। যুদ্ধে নিহত সৈন্যদের স্মরণে। আমেরিকানরা এটাকেও শপিং উৎসব বানিয়ে ফেলেছে। খুব কম আমেরিকানই আজ এই দিনের ইতিহাস তাৎপর্য জানে। তাদের কাছে এটা আর দশটা উৎসবের মতই একটা উৎসব যেদিন কেনাকাটায় অনেক ছাড় পাওয়া যায়। মানুষ কার্ট ভরে শপিং করবে—যীশু বা ঐ সৈন্যরা নিশ্চয়ই এই আশায় নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেনি।
কনজ্যুমারিজমের থাবা আমাদের সংস্কৃতিতেও কি পড়ছে না? পড়ছে। এবং খুব ভালোভাবেই পড়ছে। আপনি হয়তো নতুন প্রজন্মকে নিয়ে হতাশ হতে পারেন—এরা স্বাধীনতা দিবস আর বিজয় দিবস গুলিয়ে ফেলে। কোনটা শহীদ দিবস আর কোনটা ভালবাসা দিবস—তার পার্থক্য করতে পারে না।
সত্যিটা হচ্ছে—ভোগবাদ যখন একোটা সমাজে আস্তে আস্তে শেকড় গাড়া শুরু করে, তখন তার কাছে আলাদা কোন উৎসবের তাৎপর্য থাকে না। সবকিছুই তখন তার কাছে কেনাকাটার, মৌজ করার একটা উপলক্ষ মাত্র। যে বাচ্চাটা তার বড় ভাই/বোনকে দেখছে, ১৪ ফেব্রুয়ারী, ২১শে ফেব্রুয়ারী কিংবা ২৬শে মার্চ—তারিখ যাই হোক না কেন, তারা শাড়ি-পাঞ্জাবি পরে হাসিমুখে বেরোচ্ছে, খাচ্ছে, ছবি তুলছে—তখন তার কাছে আপনি ইতিহাসের পাঠ কীভাবে পৌঁছাবেন? মানুষ তো বই পড়ে ইতিহাস জানে না। জানে বর্তমান থেকে। প্র্যাক্টিক্যালী দেখে।
ভোগবাদ যতো বাড়বে, নতুন প্রজন্মও পাল্লা দিয়ে ইতিহাস থেকে, তার শেকড় থেকে ততো দূরে সরে যাবে—খুব তিতা হলেও এটাই সত্য। এটাই নিয়তি।
কনজ্যুমারিজমের আর মাত্র দুটো উদাহরণ দিয়ে শেষ করবো।
পশ্চিমে মদ্যপান হালাল। এতে তাদের দুটো লাভ হচ্ছে। মদের বিক্রি হচ্ছে। এদিকে হার্টের ডাক্তারের চেম্বারে লাইনও বাড়ছে। এক ঢিলে দুই ইন্ডাস্ট্রির লাভ।
আরেকটা লাভ হচ্ছে পিজা, বার্গার—এইসব বেঁচে। লোকে পিজা খেতে খেতে ফুলছে। স্থূলত্ব নামের এক মহামারী দেখা দিচ্ছে গোটা মহাদেশে। আবার সেই স্থূলত্ব নিরাময়ের জন্য লোকে ডায়েটিশয়ানের কাছে যাচ্ছে। ডায়েট চার্ট নিচ্ছে। আবারও দুটো ইন্ডাস্ট্রির লাভ।
এই ক্যাপিটালিস্ট-কনজ্যুমারিস্ট কমপ্লেক্সের সবচেয়ে বড় বিজয়টা অবশ্য অন্যখানে। ইতিহাস জুড়েই মানুষ এমন সব জীবনধারার অনুসারী হয়ে এসেছে, যা সে কখনোই ঠিকমত ফলো করতে পারে নি। খ্রিস্টানরা যীশুর দেখানো পথে চলেনি। মুস্লিমরাও নবীর দেখানো পথ থেকে সরে এসেছে।
কনজ্যুমারিজমই সম্ভবত প্রথম ধর্ম, যে ধর্মের নবীরা আমাদের যা করতে বলেন, আমরা ঠিক তাই করি। এতো চমৎকার অনুসারির দল আর কোন নবী পেয়েছেন কিনা সন্দেহ। মুসা আর ঈসা যদি স্টিভ জবসকে খানিক ঈর্ষা করেও থাকেন—এতে অবাক হবার কিছু নেই।
ন্যাচারাল সাইকেল বলে একটা ব্যাপার ছিল কৃষিযুগে। এখনকার মত সেকেন্ড ধরে সময় গণনার কোন উপায় ছিল না তখন। মানুষজনের তেমন কোন আগ্রহও ছিল না এই ব্যাপারে। জানেই তো কোন সময় বীজ বুনবে আর কোন সময় সেটা ফসল হয়ে ঘরে উঠবে।
তাই বলে যে দিন, মাস, সপ্তাহের কোন আইডিয়া ছিল না—তা না। ব্যাবিলনীয়রা যেমন চান্দ্রমাসের হিসাব রাখতো। এই চক্রের প্রথম দিনে চাঁদের সামান্য আভাস দেখা যায়। সাত দিন পর দেখা যায়, চাঁদটা একটা অর্ধগোলাকৃতি রূপ নিয়েছে। আরও সাত দিন পর আমরা পূর্ণ চন্দ্রের দেখা পাই। এইভাবে প্রায় আরো সাত দিন পর চাঁদটা আবার ছোট হয়ে অর্ধগোলকের রূপ নেয়। প্রায় আটাশ দিনের দিন বেচারী সম্পূর্ণ উধাও হয়ে যায়।
‘প্রায়’ বলছি এই কারণে যে চাঁদ বেচারী মানুষের পাতানো এই হিসাব পুরোপুরি ফলো করতো না। যে কারণে ঠিক চার সপ্তাহে কখনো এক মাস হয় না। ব্যাবিলনীয়রা এজন্য করতো কি—মাসের তিন সপ্তাহ হত ওদের সাত দিনে। লাস্ট সপ্তাহটা আট কি নয় দিনে হত। সিঙ্ক্রোনাইজ করার জন্য। যেন পরের মাসের প্রথম দিনটা আবার নতুন চাঁদ দিয়ে শুরু হয়।
সাত দিনে কেন সপ্তাহ, দশ দিনে বা বার দিনে কেন নয়—তার একটা মোটামুটি আইডিয়া পাওয়া গেলো। সাত নম্বর দিনটাকে ব্যাবিলনীয়রা পবিত্র দিন হিসেবে গণ্য করতো। এই দিন অন্য সব কাজকর্ম নিষেধ ছিল। এই দিন তুমি রেস্ট নিবা আর দেবতার এবাদত করবা।
সপ্তম দিনের এই ব্যাপারটাকে ইহুদীরা বলে Sabbath. Black Sabbath নামে একটা রক ব্যান্ডও আছে। এই Sabbath শব্দের আক্ষরিক অর্থই Day of rest. বিশ্রামের দিন। ঈশ্বর ছয় দিনে পৃথিবী বানিয়ে সাত দিনের দিন রেস্ট নিসিলেন। কাজেই, আমাদেরও সাত দিনের দিন রেস্ট নেয়াটা আসে আর কি:D
তারপরও কথা থেকে যায়। সাত দিনের সপ্তা তো ইহুদীদের চর্চা। ক্ষমতা তো ইহুদীদের হাতে ছিল না। ক্ষমতা ছিল প্যাগান রোমানদের হাতে। রোমানদের সপ্তাহ সাত দিনে ছিল না। তাদের সপ্তাহ ছিল আট দিনে। দিনগুলোর নাম অক্ষর দিয়ে রাখা হত। সপ্তাহ শুরু হত A দিয়ে। আর শেষ হত H দিয়ে। (Holiday শব্দটার জন্ম কি এই H থেকেই?)
অষ্টম দিনের দিন রোমের বাজার গরম হয়ে উঠতো। সবাই কেনাবেচা করতে বাজারে ছুট দিত। দীর্ঘদিন এই নিয়মই চালু ছিল। সম্রাট কনস্টান্টাইন খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের মধ্য দিয়ে দুনিয়ার ইতিহাসে অনেকগুলো স্থায়ী পরিবর্তন আনসেন। তার মধ্যে একটা হল আট দিনের জায়গায় সপ্তাহকে অফিশিয়ালী সাত দিনের করা। আমরা কনস্টানটাইনের ধারাবাহিকতারই অনুসারী মাত্র।
সে যাই হোক। দিন, সপ্তাহ, মাস কিংবা বছরের ধারণা সে সময়েও ছিল। এ সময়েও আছে। পরিবর্তনটা ঘটসে কোয়ান্টিফিকেশনে। ঘড়ি ধরে সময় বলা বা সংখ্যা ধরে বছর গণনার ধারণা তখন ছিল না। আপনি যদি টাইম ট্রাভেল করে মধ্যযুগে গিয়ে কাউকে জিজ্ঞেস করেন, ভাউ, এটা কোন সাল—সে আপনার কব্জির ঘড়ি কিংবা হাতের মোবাইল দেখে যতোটা বিস্মিত হবে, এই প্রশ্ন শুনেও ঠিক ততোটাই ভড়কে যাবে।
ঘড়ি ধরে সময় গণনার জন্ম হইসে শিল্প বিপ্লবের পর পর। আধুনিক ঘড়ি শিল্প বিপ্লবের সন্তান। মধ্যযুগের একজন জুতো নির্মাতার কথা ধরেন। সে তার জুতার সোল থেকে শুরু করে বাকল পর্যন্ত সবই নিজে বানাতো। সে যদি কোন একটা ধাপে একটূ বেশি সময় নেয়ও, তাতে অন্যদের কোন লাভক্ষতি হত না।
বিপ্লবের পর এই চেহারাটা বদলে যায়। অনেকগুলো মেশিনে করে হাজার হাজার জুতার পার্টস পার্টস করে বানানো হচ্ছে। এখন কোন একটা মেশিনের শ্রমিকের চোখে যদি সামান্য ঝিমুনি আসে কিংবা দেরি করে তার ওয়ার্ক স্টেশনে আসে, তার পরের স্টেশন, তার পরের স্টেশন এবং তার পরের স্টেশন—সবারই কাজে লেট হবে।
এই সমস্যার সমাধান কী?
সবাইকে ঘড়ি ধরে একই সময়ে আসতে বলা। খিদে পাক বা না পাক, সবাইকে একই সময়ে খেতে বাধ্য করা। চার্লি চ্যাপলিনকে যেমন করা হইসিলো Modern Times ছবিতে। আর কারো যদি কাজ ভালো লেগেও যায়, সে যদি আরো কাজ করতেও চায়– তবুও তাকে এবং তার সাথের সবাইকে একই টাইমে বিদেয় করে দেয়া।
কারখানাগুলো তাদের এরকম টাইমেটেবিল চালুর পর থেকেই আস্তে আস্তে অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও একে ফলো করা শুরু করে। স্কুল, কলেজ, হাসপাতাল—সব খানে মানুষ নয়, সময় আর ঘড়ি রাজত্ব করা শুর করে। এমনকি যেখানে এ্যাসেম্বলি লাইনের কিছু নাই, সেখানেও এই ঘড়িই রাজা হয়ে বসে। কারখানা যদি বন্ধ হয় পাঁচটায়, শুঁড়িখানা চালু হয় ৫টা ২ এ।
ও। আরেকটা সেক্টর তো বাদই পড়ে গেছে। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট। কারখানার শিফট শুরু আটটায়। তার মানে ৭টা ৫৫তে সব শ্রমিককে ফ্যাকটরি গেটে নামিয়ে দিতে হবে। তা না হলে একে তো প্রডাকশনের ক্ষতি হবে, ওদিকে শ্রমিকদের বেতন কাটা যাবে।
১৭৮৪ সালে ব্রিটেনে প্রথমবারের মত পাবলিক ট্রান্সপোর্ট চালু হয়। ঘোড়ার গাড়িতে করে মানুষ আনা নেয়া। তখন খালি গাড়ি কখন ছাড়বে, সেটা শুধু বলা থাকতো। কখন পৌঁছাবে—তা কেউ জানে না। এর কারণও ছিল। একে তো ঘোড়ার গাড়ি মাশাল্লা স্লো। একবার রওনা দিয়ে কখন পৌঁছাবে—তা ঘোড়ার মর্জির উপর নির্ভর করে। এদিকে প্রতিটা শহরের তখন নিজস্ব লোকাল টাইমটেবিল ছিল। লন্ডনে যখন দুপুর ১২টা, লিভারপুলে তখন ১২টা ২০। ক্যান্টাবেরিতে ১১টা ৫০।
লিভারপুল আর ম্যানচেস্টারের মধ্যে প্রথম কমার্শিয়াল ট্রেন সার্ভিস চালু হয় ১৮৩০ সালে। দশ বছর পর প্রথম ট্রেন টাইম স্কেজিউল ইস্যু করা হয়। তখন আরেকটা সমস্যা দেখা দেয়। এই ট্রেনগুলো ছিল ঘোড়ার গাড়ির চেয়ে অনেক ফাস্ট। কাজেই, এক শহর থেকে আরেক শহরে যেতে সময়ের হিসাব উলটা পালটা হয়ে যাচ্ছিল। লিভারপুল থেকে ১২টা ২০ এ রওনা দিয়ে আপনি লন্ডনে এসেও যদি দেখেন ১২টা ২০ ই বাজে তাইলে ক্যাম্নে কী?
এই সমস্যার সমাধান করার জন্য ট্রেন কোম্পানির মাথারা সব একসাথে বসলেন। তারা গ্রীনিচ মানমন্দিরের সময়ের সাথে সকল ট্রেনের স্কেজিউল সিনক্রোনাইজ করে নিলেন। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও আস্তে আস্তে এই টাইমটেবিলই জীবন যাপন করা শুরু করলো। পঞ্চাশ বছর পর ব্রিটিশ সরকার আইন পাশ করে যে, সকল প্রতিষ্ঠানকে গ্রীনিচ টাইম অনুসরণ করে চলতে হবে।
সেই থেকে আমরা সুর্যোদয়-সূর্যাস্তের ন্যাচারাল সময় নয়, সরকারের বেঁধে দেয়া সময় নিজেদের অভ্যস্ত করে নিতে শুরু করেছি।
ঘড়ি নিয়ে একটা মজার ঘটনা দিয়ে লেখাটা শেষ করি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটেন তো স্বাধীন ছিল। তো বিবিসি নিউজ নাৎসী আক্রান্ত ইউরোপেও প্রচারিত হত। প্রতিটা নিউজ প্রোগ্রাম শুরু হত বিগ বেনের আওয়াজ দিয়ে। (বিগ বেন লন্ডনের বিখ্যাত ঘড়ি)। এই আওয়াজ আবার ছিল লাইভ। মানে সত্যি সত্য ঘন্টি বাজিয়ে টেলিকাস্ট শুরু হত।
এখন জার্মান বিজ্ঞানীরা তো বস। এরা এক আওয়াজ থেকে আরেক আওয়াজকে ডিফারেনশিয়েট করতে পারলো। তা দিয়ে লন্ডনের আবহাওয়া কেমন, আজকে রাতে এ্যাটাক করার জন্য উপযুক্ত কিনা—এইসব তথ্য বের করে ফেলতো। ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস যখন এটা জানতে পারে, তখন তারা লাইভ ডিং ডং বাদ দিয়ে আগে থেকে রেকর্ড করা আওয়াজ বাজিয়ে নিউজ টেলিকাস্ট শুরু করলো।
কিন্তু এই আওয়াজটা তারা বাদ দিল না। কেননা, এই আওয়াজ ছিল স্বাধীনতার প্রতীক। মুক্তির প্রতীক।
সুখে থাকলে ভূতে কিলায়। অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় সুখে আছি বলেই আমরা ব্যাপারটাকে এ্যাপ্রিশিয়েট করতে পারি না।
কথাটা আসলে সুখ হবে না, হবে শান্তি। স্মরণকালের ইতিহাসে আমরা, পৃথিবীর মানুষেরা এই মুহূর্তে সবচেয়ে শান্তিতে আছি—এমনটা দাবি করলে আপনি হয়তো হৈ হৈ করে তেড়ে আসবেন। বলবেন, ইরাকের মানুষকে আপনি দেখেন না? কিংবা ফিলিস্তিনে আপনার চোখ যায় না?
মনে রাখতে হপবে, এগুলো কিন্তু এক্সেপশন। এক্সেপশনগুলোই পত্রিকার পাতার লীড নিউজ হয়। ভারত বা চায়নায় যে শ শ কোটি মানুষ যুদ্ধ ছাড়াই দিব্যি শান্তিতে ঘুমাতে যাচ্ছে-সেটা কখনো পত্রিকার নিউজ হবে না।
আজ মানুষ যুদ্ধে যতোটা না মারা যাচ্ছে, তার চেয়ে বেশি মারা যাচ্ছে অন্য কারণে। ২০০০ সালের একটা পরিসংখ্যান দিই। এই বছর প্রায় ৩ লাখ মানুষ পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধে মারা যায়। সন্ত্রাসীদের হাতে মারা পড়ে আরো ৫ লাখের মত।
প্রতিটা মৃত্যুই দুঃখজনক। আমি জাস্ট একটা সংখ্যার মত করে মৃত্যগুলো লিখে যাচ্ছি। যার হারায়, সে বোঝে। একটা মৃত্যু মানে একটা ফ্যামিলি ধ্বংস হয়ে যাওয়া। একসাথে অনেকগুলো স্বপ্নের মৃত্যু ঘটা।
আবেগটুকু বাদ দিয়ে আমরা যদি ঈশ্বরের মত উদাসী চোখে এই মৃত্যুগুলো দেখি, তবে দেখবো, সে বছর গোটা দুনিয়ায় যতো মানুষ মারা গেছে তার মাত্র দেড় পার্সেন্ট মারা গেছে এই যুদ্ধ আর সন্ত্রাসী হামলায়। ঢের বেশি মানুষ মারা গেছে অন্য কারণে। ১২ লাখ মৃত্যু ঘটেছে গাড়ি দুর্ঘটনায়। আত্নহত্যা করেছে প্রায় ৮ লাখ।
এতো গেলো ৯/১১’র আগের কথা। ৯/১১’র পর তো অবস্থা আরো খারাপ হবার কথা। এট লিস্ট, যুদ্ধে মৃত মানুষের সংখ্যা হু হু করে বাড়ার কথা। মজার ব্যাপার হল, ২০০২ সালের পরিসংখ্যান বলে উলটো কথা। যুদ্ধে নিহতের সংখ্যা এ বছর কমে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৭২ হাজারে। এদিকে, আত্নহত্যা করে ওপারে গেছে ৮লাখ ৭৩ হাজার লোক।
আমেরিকা আমাদের যতোই সন্ত্রাসী হামলায় মরার ভয় দেখাক না কেন, সত্যিটা হচ্ছে—আইসিস বা কোন সন্ত্রাসির হাত নয়, আপনার নিজের হাতে নিজে মরার সম্ভাবনা এখন অনেক বেশি।
মধ্যযুগ পর্যন্ত পরিস্থিতি এমন ছিল না। রাতে ঘুমাতে গেলেন। পাশের গোত্রের লোক এসে আপনাদের আক্রমন করে গোটা গ্রাম কচুকাটা করে ফেললো। ঘুমের মধ্যেই আপনি পটল তুললেন। মরার আগে আজরাইলের সাথে ঠিকমত দেখা সাক্ষাতেরও সুযোগ পেলেন না:/
মধ্যযুগের ইউরোপে প্রতি ১ লাখ লোকে ২০ থেকে ৪০ জন মারা যেত সহিংসতার শিকার হয়ে। আজকে গোটা পৃথিবীতেই এই এভারেজ কমে এসেছে। ১ লাখ লোকে আজ নয় জনের মত মারা যায় সহিংসতায়। তাও সোমালিয়া আর কলম্বিয়ার মত দেশিগুলোর জন্য এই এভারেজ এতো বেশি।। তা না হলে আরো কম হত। ইউরোপের দেশগুলোতে আজ ১ লাখ লোকে মাত্র ১ জন মারা যায় সহিংসতায়।
আমাদের এই অধঃপতনের কারণ কী? আমরা এখন আর কথায় কথায় যুদ্ধ করতে চাই না কেনো? আমাদের পূর্বপুরুষদের গায়ে যে জোশ ছিল, আমাদের গায়ে সেই জোশ নাই কেন?
একটা বড় কারণ হচ্ছে রাষ্ট্রের জন্ম। রাষ্ট্রকে আমি সবসময়ই সবচেয়ে বড় সন্ত্রাসী বলি। তবে বিস্তীর্ণ এলাকায় ছোট ছোট অনেক সন্ত্রাসী থাকার চেয়ে একটা বড় সন্ত্রাসী থাকা ভালো। চাঁদা বা ট্যাক্স—যাই দিই না কেন, ঐ এক সন্ত্রাসীকেই দিলাম। এই বড় সন্ত্রাসীর ভয়ে বিচ্ছিন্ন ভায়োলেন্সগুলো আগের চেয়ে অনেক কম হয়। বিশ্বাস না হলে আমাজনের জঙ্গলের আদিবাসীদের দেখে আসতে পারেন। ওদের পুরুষদের অর্ধেকের মত মারা যায় নিজেদের মধ্যে খুনাখুনি করে। কী নিয়ে মারামারি? সেই তো টিপিক্যাল নারী আর জমিজমা নিয়ে।
আরেকটা কারণ যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। নোবেল শান্তি পুরস্কার যদি একজনকে দিতে হয়, তবে সেইটা রবার্ট ওপেনহেইমার আর তার দলকে দেয়া উচিত। ইনারা পারমাণবিক বোমা বানায়ে এক অর্থে লার্জ স্কেলে যুদ্ধ বন্ধ করে রাখসেন। পরাশক্তিগুলা ভালো করেই জানে, নিউক্লিয়ার যুদ্ধে যাওয়া মানে দল বাইঁধা আত্নহত্যা করা। কী দরকার?
যুদ্ধের খরচাপাতিও আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। আগেকার দিনে রাজারা যুদ্ধ করে নিজেদের আয়-ইনকাম বাড়াতো। আলেকজান্ডার থেকে শুরু করে সুলতান মাহমুদ, চেঙ্গিস খান—সবাই এক ফর্মুলাতেই নিজেদের সম্পদ বাড়াইসে। লুটের মাল দিয়ে। অধিকৃত এলাকার সোনা-দানা, গরু-ছাগল, শস্য—এইসব লুট করে।
আজকের দিনে এমনটা করে কোন লাভ নাই। আজকের দিনের সম্পদ সিন্দুকে সোনা-দানার আকারে লুকায়ে রাখা নাই। আজকার সম্পদ আছে মানুষের মগজে, কম্পিউটারের চিপে। ধরেন, চায়নার হঠাৎ মতি হইলো ক্যালিফোর্নিয়া দখল করবে। ক্যালিফোর্নিয়ার আয়ের উৎস কী? সিলিকন আর সেলুলয়েড। যার পেছনের কারিগর গুগলের প্রোগ্রামাররা। হলিউডের শব্দশিল্পীরা। চায়না ক্যালিফোর্নিয়া দখল করে কী লুট করবে? হাজার হাজার স্ক্রিপ্ট আর লাখ লাখ হার্ডডিস্ক? তার আগেই দেখা যাবে এই প্রোগ্রামার আর শব্দশিল্পীরা মুম্বাই বা দুবাইর প্লেনে চড়ে সেইখানে গড়ে তুলেছে নতুন হলিউড, নতুন সিলিকন ভ্যালী।
সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটা ঘটসে অবশ্য আমাদের মানসিকতায়। সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বললে, আমাদের শাসকদের মানসিকতায়। হুন রাজাই হোক আর আজটেক ইমামই হোক, যুদ্ধকে সবাই সৌভাগ্যের চিহ্ন হিসেবে দেখতো। কেউ ক্ষমতায় যাবার সিঁড়ি হিসেবে, কেউ ক্ষমতা সংহত করার উপায় হিসেবে। যারা এটাকে ভালো চোখে দেখতো না, তারাও মেনে নিত যে জন্ম, মৃত্যু আর বিবাহের মতই যুদ্ধ অনিবার্য। কাজেই, যুদ্ধ থেকে আমরা যা শিখতে পারি, সেটাই লাভ।
আজকাল অস্ত্রের ব্যবসায়ী ছাড়া কেউ যুদ্ধকে এভাবে দেখে না। রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিল্পী-বুদ্ধিজীবী—সবাই আজ শান্তি চায়। সবচেয়ে বেশি করে চায় ব্যবসায়ীরা। আর পুঁজি যেহেতু এই নিওলিবারেল পৃথিবীর ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থা করতেসে, প্রায় সব দেশেই এখন রাজাদের ব্যবসায়ী মহলের কথায় চলতে হয়। এতে আর কিছু না হোক, যুদ্ধের ফ্রিকোয়েন্সি অনেক কমে এসেছে।
তাই বলে আমাদের রিল্যাক্স হবার কোন সুযোগ নেই। ১৮৭১-১৯১৪ সাল পর্যন্ত ইউরোপ অনেক ঠান্ডা ছিল। অনেকেই ভেবেছিল, যুদ্ধবিগ্রহের যুগ বুঝি শেষ হয়ে আসছে। কিসের কী? এর পরপরই ইউরোপ আর ইউরোপের মারফত গোটা বিশ্বকে দু দুটো বিশ্বযুদ্ধের ঘা সইতে হল।
এখন তো তবু সেই ইতিহাস লেখার কেউ আছে। আরেকটা বিশ্বযুদ্ধ হলে সেই ইতিহাস লেখার জন্য কেউ থাকবে কিনা সন্দেহ।