একাদশ অধ্যায়
সাইয়েদ আদমদ শহীদের জেহাদী আন্দোলন
সাইয়েদ আমদ বেরেলভীর জেহাদী আন্দোলন ইতিহাসে ওহাবী আন্দোলন বলে বর্নিত হয়েছে। কথাটি সম্পূর্ণ সত্যের খেলাপ ও পরিপন্থী। একে নির্ভয়ে বলা যেতে পারে ইতিহাসের এক অতি বিকৃত তথ্য পরিবেশন। বলতে গেলে ওহাবী আন্দোলন বলে কোন আন্দোলনের অস্তিত্বই পৃথিবীর কোথাও ছিলনা। অষ্টাদখশ শতকের গোড়ার দিকে মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাব নজদী আরবে এক ইসলামী সংস্কার আন্দোলন শুরু করেছিলেন। তাঁর আন্দোলন ছিল একটি নিছক ইসলামী আন্দোলন। এই আন্দোলনকেই বলা হয়েছে ওহাবী আন্দোলন। এ নাম দিয়েছেন ইসলাম বৈরী ইউরোপীয়ানগণ। একে বলা হয়েছে WAHABISM অথবা WAHABI MOVEMENT. আল্লাহর দেয়া বিধান ইসলামকে পরিপূর্ণ রূপ দিয়েছিলেন সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী হযরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়াসাল্লাম। মুহাম্মদের (সা) দ্বারা প্রচারিত ইসলাককে ‘ইসলাম’ না বলে তাঁরা বলেছেন ‘মুহামেডানিজম’ এবং মুসলমানকে ‘মোহামেডান’ (MEHOMEDAN)। বর্তমান শতকের তিনের দশক পর্যন্ত মুসলমানকে সরকারী ভাষায় MEHOMEDAN বলা হতো। শেরে বাংলার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় একটি সরকারী ঘোষণার মাধ্যমে MEHOMEDAN শব্দ MUSSALMAN অথবা MUSLIM শব্দ দ্বারা পরিবর্তিত হয়। অনুরূপভাবে মুহাম্মদ বিন আবুদল ওয়াহহাবের ইসলামী আন্দোলকে শুধুমাত্র ওহাবী আন্দোলনই বলা হয়নি, বরঞ্চ এর প্রতি মুসলমানদের ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টির জন্যে একে চরম ইসলাম বিরোধী বলে প্রচারণা চালানো হয়েছে। ওহাবী আন্দোলনকে ইসলাম বিরোধী ও ‘ওহাবী’ শব্দ একটা গালি হিসাবে ইতিহাসে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ প্রচারণার দ্বারা কিছু সংখ্যক মুসলমানও প্রভাবিত ও প্রতারিত হয়েছে। তাই কাউকে মুসলিম সমাজে হেয় ও ঘৃণিত প্রতিপন্ন করার জন্যে তাকে ‘ওহাবী’ বলে গালি দেয়া হয়। বিগত প্রায় তিন শতক যাবত একটা চরম ভুলের মধ্যে কিছু লোক নিমজ্জিত হ’য়ে আছেন। অতএব এর বিশেষ আলোচনা ও ব্যাখ্যার প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
মুহাম্মদ বিন ওয়াহহাব
আঠারো শতকের গোড়ার দিকে আরবে যে একজন শ্রেষ্ঠ ধর্ম সংস্কারক বা মুজাহিদ জন্মগ্রহণ করেন তাঁর তান ছিল মুহাম্মদ। পিতার নাম আবদুল ওয়াহহাব। আরবের প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী নামের সাথে পিতার নাম সংযুক্ত করা হয় বলে তাঁর পুরা নাম ছিল মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাব। ওয়াহহাব আল্লাহর একটি গুণবাচক নাম যার অর্থ পরম দাতা। মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাব চেয়েছিলেন ইসলামে সবরকম পৌত্তলিক অনুপ্রবেশের মূলোৎপাটন করে খাঁটি তওহীদ বাণীর মহিমা সুপ্রতিষ্ঠিত করতে এবং আরবের সবরকম রাষ্ট্রনৈতিক গোলযোগের অবসান ঘটিয়ে শুধু ইসলামী সাম্য ও মৈত্রীনীতির সূত্রে সমস্ত আরবভূমিকে একরাষ্ট্রে বেঁধে দিতে।
তিনি প্রথমজীবনে হজ্ব করতে গিয়ে মক্কা ও মদিনায় মুসলমানদে অনৈসলামিক আচার অনুষ্ঠান দেখে অত্যন্ত মর্মাহত হন। আরবের তখন এক বৃহৎ অংশ তুরস্ক সুলতাদের শাসনাধীন ছিল। ইউরোপীয় সভ্যতার সংস্পর্শে এসে তুর্কীরা বিশেষ করে তুর্কী শাসক শ্রেণী বহু ইউরোপীয় আচার-অনুষ্ঠান গ্রহণ করেছিল। সেসব আরব দেশে এমনকি মক্কা-মদিনায় ছড়িয়ে পড়েছিল। কবরকে কেন্দ্র করে বিরাট বিরাট সৌধ নির্মিত হয়েছিল এবং মুসলমানরা কবরের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে ইহলৌকিক উন্নতি ও পারলৌকিক মংগল কামনা করতো। কবরে বাতি দেয়া
, ফুলের মালার শোভিত করা, নজর-নেয়াজ পেশ করা, মানৎ করা –প্রভৃতি ক্রিয়াকলাপ চলতো। এগুলি ছিল পৌত্তলিকতারই অনুকরণ। মওলানা মাসউদ আলম নদভী –তাঁর মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাব নজদী নামক জীবনী গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে, তৎকালে আরব দেশে এমন কিছু বৃক্ষ ছিল যেখানে মুসলমানরা পৌত্তলিকেদের অনুকরণে একপ্রকার পূজা পার্বণ করতো। এমনকি হিন্দুদের শিবলিংগ পূজা অপেক্ষাও গর্হিত কাজ করতো। মোটকথা ইসলামের এক অতি বিকৃতরূপ দেখে মুহাম্মদ বিন আবুদল ওয়াহহাব এ সবের বিরুদ্ধে জোরদার আওয়াজ তোলেন। তিনি প্রথম তাঁর এ সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন দামেস্ক শহর থেকে। তুর্কী শাসকশ্রেণীর ইসলাম বিরোধী আচার অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সোচ্চার। ফলে শাসকশ্রেণীর কোপানলে পড়তে হয় তাঁকে এবং তিনি দামেস্ক থেকে বিতাড়িত হন। অবশেষে বিভিন্ন স্থানে ঘুরে ফিরে আপন জন্মভূমি নজদ প্রদেশের দারিয়াহ বা দেরাইয়াহ নামক স্থানে আসেন। (দারিয়াহর সর্দার বা অধিপাতি তাঁর সংস্কার আন্দোলন সমর্থন করেন এবং তাঁর কন্যাকে বিয়ে করেন।
অতঃপর দারিয়াহ অধিপতি মুহাম্মদ বিন সউদের সহায়তায় একাধারে ইসলামী সংস্কার আন্দোলন এবং আরব লীগ গঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিক আন্দোলন চলতে থাকে।
তাঁর রাজনৈতিক আন্দোলনে বিস্তারিত আলোচনার অবকাশ এখানে নেই। তবে একথা সত্য যে, রাজনৈতিক ক্ষমতা ব্যতীত ইসলামের পূর্ণ বাস্তবায়নও সম্ভব নয় কিছুতেই। মুহাম্মদ বিন সউদের সাহায্য সহযোগিতায় যে প্রচন্ড রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাতে যোগদান করেছিল লক্ষ লক্ষ বেদুইন। তাঁর ফলশ্রুতিস্বরূপ বার বার বিপর্যয়ের ভেতর দিয়েও অবশেষে গোটা আরব দেশ তাদের করতলগত হয়। সউদ বংশের রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হ’য়েছিল সমগ্র আরবভূমিতে এবং তার জন্যেই এ দেশটির পরিচয় হিসাবে বলা হ’য়ে থাকে সউদী আরব। মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাবের ইসলামী সংস্কার আন্দোলনের সার্থকতাই এই রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের প্রত্যক্ষ ফল।
উপরে উক্ত হ’য়েছে দারিয়াহর অধিপতি মুহাম্মদ বিন সউদ মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাবের কন্যাকে বিবাহ করেন। অল্পদিনের মধ্যে মরু অঞ্চলে বিশেষ করে নজদে মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাবের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি তাঁর জামাতা মুহাম্মদ বিন সউদের হাতে সমস্ত শাসনক্ষমতা অর্পণ করে শুধু ধর্মীয় ব্যপারে অর্থাৎ ইসলামী সংস্কার আন্দোলনের সর্বময় কর্তা রয়ে যান। তারপর তুর্কী শাসকরেদ সাথে বার বার সংঘর্ষ হ’য়েছে। জয়-পরাজয় উভলের ভাগ্যেই ঘটেছে। সমগ্র নজদে তাঁদের শাসন ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অনেকের মতে, চতুর্থ খলীফার আমলের পর এই সর্বপ্রথম কোরআনকে ভিত্তি করে একটি দেশে ধর্মীয়, রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চলে। অনেকের মতে, যেমন মসউদ-আলম নদভী –মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাব ছিলেন একজন সার্থক মুজাদ্দিদ যিনি তাঁর মুজাদ্দিদিয়াতের বা সংস্কার কাজের পরিপূর্ণ সাফল্য জীবদ্দশায় দেখে গেছেন।
এখন তাঁর সংস্কার আন্দোলনের মূলনীতি সম্পর্কে কিছু আলোচনা করা যাক। আগেই বলা হ’য়েছে যে, তিনি ইসলামের বিপরীত কোন নতুন মতবাদ প্রচার করেননি, যার জন্য তাঁর মতবাদকে ওয়াহহাবী মতবাদরূপে আখ্যায়িত করা যায়। আরব দেশে ওয়াহহাবী নামাংকিত কোন মযহাব বা তরীকার অস্তিত্ব নেই। এ সংজ্ঞাটির প্রচলন আরব দেশের বাইরে এবং এই মতানুসারীদের বিদেশী দুশমন, বিশেষ করে তুর্কী ও ইউরোপীয়ানদের দ্বারা ওয়াহহাবী কথাটির সৃষ্টি এবং তাদের মধ্যেই প্রচলিত। কোন কোন ইউরোপীয় লেখক, যেমন নীবর (Neibuhr) মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাবকে পয়গম্বর বলেছেন। এসব উদ্ভট চিন্তারও কোন যুক্তি নেই। প্রকৃত পক্ষে মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাব কোন মযহাবও সৃষ্টি করেননি। চার ইমামের অন্যতম ইমাম আহমদ বিন হাম্বলের মতানুসারী ছিলেন তিনি এবং তাঁর প্রযত্ন ছিল বিশ্বনবীর ও খুলাফায়ে রাশেদীনের আমলে ইসলামের যে রূপ ছিল, সেই আদিম সহজ সরল ইসলামে প্রত্যাবর্তন করা। তাঁর আরও শিক্ষা ছিল, ধর্ম কোন শ্রেণী বিশেষের একাধিকার নয়। কোরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা দেয়াও কোন ব্যক্তি বিশেষ বা শ্রেণী বিশেষের নয়, কোন যুগ বিশেষের মধ্যেই সীমিত নয়, প্রত্যেক আলেম ব্যক্তির অধিকার আছে কোরআন ও হাদীসের ব্যাখ্যা দেয়ার। তাঁর শিক্ষা ও মতবাদ প্রধানতঃ ইবনে তাইমিয়া ও তাঁর শিষ্যদের পুঁথিতে বিধৃত মতবাদের দ্বারা প্রভাবিত। যদিও তিনি অনেক বিষয়ে তাদের সংগে একমন নন। -(ওহাবী আন্দোলন, আবদুল মওদূদ, পৃঃ ১১৬)।
মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাবের সংস্কার আন্দোলনের মূলনীতি সমূহ, যা তিনি তাঁর ‘কিতাবুত্তাওহীদে’ সন্নিবেশিত করেছেন, মোটামোটি নিম্নরূপঃ-
১। আল্লাহ ছাড়া এমন আর কোন সত্তা বা শক্তি নেই যার এবাদন বন্দেগী দাসত্ব আনুগত্য, হুকুম শাসন পালন করা যেতে পারে।
২। অধিকাংশ মানুষই তাওহীদপন্থী নয়। তারা অলী দরবেশ প্রভৃতির নিকটে গিয়ে তাদের আশীষ প্রার্থনা করে। তাদের এসব আচার অনুষ্ঠান কোরআনে বর্ণিত মক্কার মুশরিকদের অনুরূপ।
৩। এবাদতকালে নবী, অলী, ফেরেশতাদের নাম নিয়ে প্রার্থনা করা শির্ক বা বহু দেবতার পূজা অর্চনার মতোই নিন্দনীয়।
৪। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো মধ্যবর্তিতার আশ্রয় গ্রহণ করা শির্ক মাত্র।
৫। আল্লাহ ব্যতীত অন্য কারো নামে মানৎ করাও শির্ক।
৬। কেরআন হাদীস এবং যুক্তির সহজ ও অবশ্যম্ভাবী নির্দেশ ব্যতীত অন্য জ্ঞানের আশ্যয় গ্রহণ কুফর।
৭। কদর বা তাকদীরে বিশ্বাসের প্রতি সন্দেহ পোষণ নাস্তিকতা।
উপরন্তু যেসব বিদআৎ (দ্বী ইসলামে এমন সব নতুনত্ব যা কোরআন হাদীস সম্মত নয়< অথবা স্বয়ং নবী কর্তৃক প্রবর্তিত নয়), শির্ক ও কুফরের প্রশ্রয় দেয় তিনি সেসবের মূলোচ্ছেদকরণে বিশেষ জোর দেন। তাঁর মৌল শিক্ষাই ছিল লাশরীক আল্লাহর প্রতি একান্ত ও অকুন্ঠ নির্ভরশীলতা এবং স্রষ্টা ও মানুষের মধ্যে যাবতীয় মধ্যস্থতার অস্তিত্ব বা চিন্তার বিলোপ সাধন। যে মধ্যস্থতার নাম করে পীরবাদ বা মুসলমানী ব্রাহ্মণ্যবাদ কায়েম করে মুসলমানদেরকে প্রকৃত ইসলামের শিক্ষা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা হ’য়েছিল। পীর ও অলীদের প্রতি ও তাদের কবরে মুসলমানের পূজা, এমনকি হযরত মুহাম্মদের (সা) আধাঐশ্বরিক রূপকল্পনার বিলোপ সাধন তিনি করতে চেয়েছিলেন। (এ মতবাদের অনুসরণও মুসলমানদের মধ্যে দেখা যায়। যেমন,
আহমদের ঐ মিমের পর্দা
রেখেছে তোমায় আড়াল করে।)
কবরে সৌধ নির্মাণ পৌত্তলিকতারই শেষ চিহ্ন মাত্র যে সম্পর্কে আল্লাহর নবী কঠোর ভাষায় সতর্কবাণী করে গেছেন। সেজন্যে সেসব ভেঙে ফেলার নির্দেশ দেয় হ’য়েছিল যাতে করে মুসলমানরা সেগুলিকে ভক্তিশ্রদ্ধা দেখাতে অথবা সেখানে গিয়ে নিজের মংগল কামনা করতে না পারে।
তাঁর এ আন্দোলনের স্বাভাবিক ফল এই ছিল যে, দুইশ্রেণীর মুসলমান অত্যন্ত খড়াগহস্ত হ’য়ে পড়ে। এক –কবরের পার্শ্বে দাঁড়িয়ে যারা ইহলৌকিক উন্নতি ও পারলৌকিক মংগল কামনা করতো এবং কবরের হেফাজত তথা খেদমতের নামে দর্শনপ্রার্থীদের নিকট থেকে টাকা পয়সা আদায় করে জীবিকা অর্জন করতো। দুই –তুর্কী শাসকগণ। কারণ মক্কা ও মদীনার উপর থেকে তাদের কর্তৃত্ব বিলুপ্ত হ’য়েছিল। তুর্কীর সুলতান ছিলেন তখন মুসলিম বিশ্বের স্বমনোনীত খলীফা। ইসলামের সর্বশ্রেষ্ঠ, বলতে গেলে দুটি মাত্র তীর্থস্থান মক্কা ও মদীনা তাদের হস্তচ্যুত হ’য়ে পড়ায় খেলাফতের দাবী অর্থহীন হ’য়ে পড়ে। বাহু বলে মক্কা মদীনা পুনরুদ্ধার করা সহজ ছিলনা বলে মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাব ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে নানাপ্রকারের অমূলক ও মিথ্যা অভিযোগ উত্থাপন করে বিশ্বের মুসলমানদেরকে ক্ষিপ্ত করে তোলা হলো। তুর্কী শাসকদের চরিত্র যতেই ইসলাম বিরুদ্ধ হোক না কেন, মুসলমানদের খলীফার পক্ষ থেকে যখন মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাবের বিরুদ্ধে ফতোয়া জারী হলো তখন মুসলমারা তাই অকপটে বিশ্বাস করলো। এ অপপ্রচারের ফলে ১৮০৩ থেকে ১৮০৬ সাল পর্যন্ত বাইরের দেশগুলি থেকে মক্কায় হাজীদের সংখ্যা ছিল অতি নগণ্য।
মুহাম্মদ বি আবুদল ওয়াহহাবের মতো মুসলমাদের নানাবিধ কুসংস্কারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছিলেন বাংলা ভারতে সাইয়েদ আহমদ শহীদ, জহাজী শরীয়তুল্লাহ, তিতুমীর প্রভৃতি মনীষীগণ। ব্রিটিশ সরকার এবার তাঁদের স্বার্থে এসব মনীষীকে ওয়াহহাবী বলে আখ্যায়িত করে তাদের বিরুদ্ধে অপপ্রচারে মাতলেন। এর চেয়ে সত্যের অপলাপ ও নির্মম পরিহাস আর কি হতে পারে?
মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ বলেনঃ-
একবার যদি মুসলমান জনসাধারণের মধ্যে বিধর্মী বিদ্বেষ জাগরিত হয় তাহা হইলে এশিয়া ও আফ্রিকায় তাহাদের সাম্রাজ্য তাসের ঘরের ন্যায় ভাঙিয়া পড়িবে আশংকা করিয়া সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ ইসলামের জন্য মায়াকান্না শুরু করিয়া দেন। তাই দেখা যায়, উনবিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে যখনই কোন মুসলমান দেশপ্রেমিক পরাধীনতার বিরুদ্ধে দাঁড়াইবার চেষ্টা করিয়াছেন তখনই ইংরেজরা তাহাকে ‘ওহাবী’ আখ্যা দিয়া অজ্ঞ জনসাধারণকে তাঁহার বিরুদ্ধে লেলাইয়া দিয়াছেন, লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ প্রদান ও বিকল্পে নির্যাতনের ভয় প্রদর্শন করিয়া তাহাদের বশংবদ আলেমদের নিকট হইতে তাঁহার বিরুদ্ধে ফতোয়া সংগ্রহ করিয়অ লইয়াছেন, তুর্কীদের বেতনভুক শেরিফের আজ্ঞাবহ কর্মচারীর নিকট হইতে নিজেদের জন্য সার্টিফিকেট আনাইয়াছেন। এমনকি, খাস আরব দেশ হইতেও প্রচারক আনিয়া তাঁহার বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য নিজেদের রচিত অলীক কাহিনী তাহার মুখে প্রচার করিয়াছেন। ইহা ছাড়া জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীগণকে দিয়া তাহারা প্রতিক্রিয়াশীল মুসলমাদের সাহায্যে প্রতি জেলায় ‘আনজুমনে ইসলামিয়া’, ‘হেজবুল্লাহ সমিতি’ ও ‘আনজুমনে এশায়াতে ইসলাম’ প্রভৃতি কায়েম করাইয়া দেশপ্রেমিক মুসলমানদের বিরুদ্ধে উহাকে ব্যবহার করাইয়াছেন। ইহার বিনিময়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে উহাকে ব্যবহার করাইয়াছেন। ইহার বিনিময়ে আল্লাহতায়ালা তাহাদিগকে জান্নাত ফেরদৌস বখশিশ করেন কিনা বলা যায় না। তবে এ কথা সত্য যে, এই ইসলাম রক্ষা অভিযানে তাহারা শত শত মুসলমানকে ফাঁসিয়ে কাষ্ঠে ঝুলাইয়া সুদূর আন্দামান নির্বাসনে পাঠাইয়া অন্ততঃপক্ষে তাহাদের পারলৌকিক মুক্তির পথ প্রশস্ত করিয়া দিতে পারিয়াছে।
(আমাদের মুক্তি সংগ্রাম, মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ, পৃঃ ৬০-৬১)।
মুহাম্মদ বিন আদুল ওয়াহহাব ও তদীয় জামাতা মুহাম্মদ বিন সউদের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রের উত্থানপতনের ঘটনাপঞ্জী
১৭০৩ খৃঃ- মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাবের জন্ম আরবের উয়াইনা অঞ্চলে তামিম গোত্রের শাখা বানু সিনন বংশে।
১৭৪৭ খৃঃ- রিয়াদের শেখের সাথে সংঘর্ষ।
১৭৭৩ খৃঃ- রিয়অদের শাসক দাহহাম পরাজিত।
১৭৮৭ খৃঃ- মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাবের এন্তেকাল।
১৭৯১ খৃঃ- মক্কা আক্রমণ
১৭৯৭ খৃঃ- এশিয়ার সমগ্র তুর্কী অধিকার মুহাম্মদ বিন সউদের পৌত্র সউদের হাতে।
১৮০৩ খৃঃ- মক্কা দখল।
১৮০৪ খৃঃ- মদীনা দখল।
১৮০৬ খৃঃ- মক্কা পুনর্দখল।
১৮১১ খৃঃ- উত্তরে আলেপ্পো থেকে ভারত মহাসাগর এবং পারস্য উপসাগর ও ইরাক সীমান্তের পরবর্তী পূর্বে লোহিত সাগর পর্যন্ত সউদের হাতে।
১৮১১ খৃঃ- উত্তরে আলেপ্পো থেকে ভারত মহাসাগর এবং পারস্য উপসাগর ও ইরাক সীমান্তের পরবর্তী লোহিত সাগর পর্যন্ত সউদের হাতে।
১৮১১ খৃঃ- মিসরবাহিনী মদীনা দখল করে।
১৮১২ খৃঃ- মিসরবাহিনী মদীনা দখল করে।
১৮১২ খৃঃ- মিসরবাহিনী মক্কা দখল করে।
১৮১৪ খৃঃ- সউদের মৃত্যু।
১৮১৮ খৃঃ- দারিয়াহর রাজধানী বিধ্বস্ত হয়।
১৯০৪ খৃঃ- পুনঃপ্রতিষ্ঠালাভ। সউদ পৌত্র আবদুল আযীয বিন আবদুর রহমান নজদে ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত করেন।
১৯২৪ খৃঃ- মক্কা দখল।
১৯২৫ খৃঃ- মদীনা ও জেদ্দা অধিকার করেন।
এভাবে প্রায় সমগ্র জাজিরাতুল আরব (কয়েকটি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আমীরি অধিকার ব্যতীত) সউদী আরব নামাংকিত আরবী জাতীয় রাষ্ট্রে রূপায়িত হয় যা এখনো বিদ্যমান। (ওহাবী আন্দোলন, আবদুল মওদূদ পৃঃ ১১২-১৫ দ্রঃ)।
হান্টার সাহেব তাঁর গ্রন্থে মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাব সম্পর্কে যে মন্তব্য করেন তাও উদ্ধৃত করা হলো।
রক্তের অক্ষরে তাঁরা যে নীতিমালা লিপিবদ্ধ করেছিলেন তা ছিল মহান। সর্বপ্রথম তাঁরা যে বিষয়টির উপর গুরুত্ব আরোপ করতেন, তা হলো এই যে তুর্কীরা তাদের ইন্দ্রিয় পরায়ণতার দ্বারা পবিত্র নগরীকে (মক্কা) কলুষিত করেছিল। বহুবিবাহেও তারা পরিতৃপ্ত হতে পারেনি। হজ্বে আগমন কালে তারা সংগে নিয়ে আসতো জঘন্যতম চরিত্রের স্ত্রীলোক এবং তারা এমন সব কুকর্মে লিপ্ত হতো যেগুলি কোরআনে নিষিদ্ধ ছিল সম্পূর্ণরূপে। পবিত্র নগরীর রাজপথে তারা প্রকাশ্যে মদ ও আফিম খেতো। তুর্কী তীর্থ যাত্রীদল মক্কার পথে ঘৃণ্যতম লাম্পট্যের আচরণ করতো। মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাব সর্বপ্রথম এসব জঘন্য কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদের আওয়াজ তোলেন। ক্রমে ক্রমে তাঁর মতামতগুলি একটি ধর্মীয় মতবাদের রূপ ধারণ করে এবং ওয়াহহাবী মতবাদ নামে বিস্তার লাভ করে।–[‘ওয়াহহাবী’ বা ‘ওহাবী’ পরিভাষাটি বহির্জগতের বিশেষ করে ইউরোপীয়দের কল্পনা রাজ্যের সৃষ্টি।] ভারতীয় মুসলমানের অধিকাংশই এখন এ মতাবলম্বী। এ মতবাদ অনুসারে মুহাম্মদের প্রবর্তিত ধর্মকে বিশুদ্দ আস্তিকতায় পরিণত করা হ’য়েছিল এবং সাতটি নীতির উপরে তা ছিল স্থাপিত। এক –এক আল্লাহতে অবিচল আস্থা। দুই –স্রষ্টা ও মানুষের মাঝখানে কোন মধ্যস্থতাকারীর অস্তিত্ব অস্বীকার। অলী দরবেশদের নিকটে প্রার্থনা করা, এমনকি মুহাম্মদের আধা ঐশ্বরিক রুপকল্পনাও প্রত্যাখ্যানযোগ্য। তিন –মুসলমানী ধর্মগ্রন্থের ব্যক্তিগত ব্যাখ্যার অধিকার এবং পবিত্র গ্রন্থের ধর্মযাজকসুলভ ব্যাখ্যা বর্জন। চার –মধ্য ও আধুনিক যুগের মুসলমান যেসব রসম রেওয়াজ ও বাহ্যিক আচার অনুষ্ঠান পবিত্র তাওহীদ বিশ্বাসের উপর চাপিয়ে দিয়েছে তা প্রত্যাখ্যান করা। পাঁচ –যে ইমামের নেতৃত্বে প্রকৃত ঈমানদারগণ কাফেরদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে জয়যুক্ত হবে তাঁর প্রতীক্ষা। ছয় –সকল কাফেরদের বিরুদ্ধে মুসলমানদের সংগ্রাম করা যে অবশ্য কর্তব্য তা তত্বগত ও বাস্তব ক্ষেত্রে সর্বদা স্বীকার করা। সাত –আধ্যাত্মিক পথ প্রদর্শকের প্রতি দৃঢ় আনুগত্য।
হান্টারের মতে মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাবের প্রচেষ্টায় মুহাম্মদের প্রবর্তিত ধর্মকে (অর্থাৎ ইসলামকে) বিশুদ্ধ আস্তিকতায় পরিণত করা হয়েছিল। অর্থাৎ ইসলামের ভিতরে অধর্ম বিধর্ম ও পৌত্তলিকতার যে অনুপ্রবেশ ঘটেছিল তা থেকে ইসলামকে মুক্ত করে সত্যিকার ইসলামী রূপ ও আকৃতি ফিরে আনাই ত তাঁর কাজ ছিল। এতে তিনি প্রকৃত ইসলামের সেবাই করেছেন। এইত প্রকৃত মুসলমানের কাজ। ইসলামের বিকৃত রূপকে পরিবর্তণ করে তার প্রকৃত রূপে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্যে ই ত যুগে যুগে সংস্কারক আগমন করার ভবিষ্যদ্বাণী ইসলামের নবী করে গেছেন যাকে ইসলামী পরিভাষায় ‘মুজাদ্দিদ’ বলা হ’য়েছে। কিন্তু তাঁর কার্যকলাপকে ইসলাম বিরোধী ও মতবাদকে ইসলাম থেকে পৃথক মতবাদরূপে গণ্য করে ‘ওহাবী’ মতবাদে আখ্যায়িত করা হলো কেন? ইউরোপীয়দের এবং ভ্রান্তির গহীন সাগরে নিমজ্জিত একশ্রেণীর মুসলমানদের কাছে এর কী জবাব আছে? ইউরোপীয় খৃষ্টানগণ ইসলাম ও মুসলমানের প্রতি তাদের চিরকালের বিদ্বেষাত্মক মনোবৃত্তির দরুন এমন করতে পারেন। এটা তাঁদের স্বভাবসুলভ –এতে বিস্ময়ের কিছু নেই। কিন্তু ইসলামকে বিকৃত করে তার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের পৌত্তলিক ও অনৈসলামিক আচার অনুষ্ঠান ও কুসংস্কার আমদানী করে তাকে একটি বাহ্যিক অনুষ্টানসর্বস্ব ধর্মে পরিণত করে যারা তাদের ব্যবসার বাজার জমজমাট করে রেখেছিল এবং এখনো রাখে, তাদের কাছে সত্যিই এর কোন জবাব নেই। পরিত্রহীন ও লম্পট তুর্কী শাসকরা মুজাদ্দিদ মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাবের বিরুদ্ধে জঘন্য অপপ্রচার শুরু করেন। অতঃপর ব্রিটিশ ভারতে যখন অনুরূপ সংস্কার আন্দোলন শুরু করেন সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী, তখন স্বার্থান্বেষী ও সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ তাঁকে ‘ওহাবী’ নামে আখ্যায়িত করে ভাড়াটিয়া আলেম নামধারী লোকদের দ্বারা তাঁর উপরে ফতোয়ার মেশিনগান থেকে অবিরাম ধারায় গোলাগুলি বর্ষণ করতে থাকে। তবে সাইয়েদ আহমদের জিহাদী আন্দোলন চলাকালে এসব মেশিনগানের গুলিগোলা ব্যর্থতার পর্যবসিত হ’য়েছে। তাই হান্টার বলেছেন ‘ভারতীয় মুসলমানের অধিকাংশই এখন এ মতাবলম্বী’।
শাহ ওয়ালীউল্লাহ
বাদশাহ আওরঙজেব আলমগীরের মৃত্যুর চার বৎসর পূর্বে ১৭০৩ খৃষ্টাব্দে শাহ ওয়ালিউল্লাহ দিল্লী নগরীতে এক অতি সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা শাহ আবদুর রহীম ছিলেন একজন প্রখ্যাত আলেম। শাহ ওয়ালিউল্লাহর পূর্বপুরুষ ছিলেন ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর ফারুকের (রা) বংশধর।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ তাঁর শিক্ষা-দীক্ষা গ্রহণ করেন তাঁর পিতা শাহ আবদুর রহীমের নিকটে। পরে তাঁর পিতার প্রতিষ্ঠিত বিদ্যালয়ে বার বছর যাবত শিক্ষকতা করেন। অতঃপর তিনি আরবে গমন করেন এবং মক্কা মদীনায় সুদীর্ঘকাল কাটান। মক্কা মদীনা অবস্থানকালে শাহ সাহেব ইজতেহাদের উপযোঘী গুণাবলী ও যোগ্যতা অর্জন করেন। শিবলী বলেন, ইবনে রুশদ ও ইমাম ইবনে তাইমিয়ার পর মুসলিম জগতের যে চরম অবনতি ঘটেছিল, তাকে পুনরায় উজ্জীবিত করেন শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী (রহ)। দীর্ঘকাল যাবত করে মক্কা মদীনা সফরের ফলে লব্ধ প্রেরণাই তাঁকে বিপ্লবী আন্দোলন শুরু করার জন্যে সচেষ্ট করে তুলেছিল।
আওরঙজেবের মৃত্যুর পর যে অরাজকতা ও বিশৃংখলা সৃষ্টি হয়েছিল যার ফলে ধীরে ধীরে মোগল সাম্রাজ্য তথা ভারতে সুলতানাত ধূলিসাৎ হ’য়ে গেল এবং ইংরেজ বণিক বেশে এ দেশে আগমন করে ক্রমশঃ এ দেশের ওয়ালিউল্লাহর চোখের সামনে। এ দৃশ্য শাহ সাহেবকে অত্যন্ত ব্যথিত ও পীড়িত করেছিল। তিনি পরিপূর্ণরূপে উপলব্ধি করেন যে, মুসলমানদের এ অধঃপতনের প্রধান কারণ হলো তাদের নৈতিক ও ধর্মীয় অধঃপতন।
ইসলাম সম্পর্কে পরিপূর্ণ জ্ঞান ও চিন্তা গবেষণার ফলে তাঁর মনোজগতে ইসলামী রাষ্ট্রের এক রূপরেখা প্রতিভাই হয়েছিল। কিন্তু তিনি পরিপূর্ণরূপে উপলব্ধি করেন যে, প্রকৃত যোগ্যতা ও গুণাবলীর অধিকার না হওয়ার পর্যন্ত শুধু বাহুবলে কোন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা সম্ভব নয়। ইসলামী রাষ্ট্র পরিচালনার জন্যে সত্যিকার ইসলামী জ্ঞান ও চরিত্রের লোক তৈরী হলো পূর্বশর্ত। কিন্তু এ ধরনের গুণাবলী ও যোগ্যতা সম্পন্ন লোকের শুধু অভাবই ছিল না, বরঞ্চ মুসলমানরা নানাবিধ জাহেলী বা অনৈসলামিক কুসংস্কার জালে ছিল আবদ্ধ। এ বেড়াজাল থেকে মুসলিম সমাজকে মুক্ত করার জন্যে তিনি সর্বপ্রথমে আত্মনিয়োগ করলেন ইসলামী সংস্কার আন্দোলনে। তাঁর আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইসলামী সংস্কার সাধন করে ইসলামকে তার প্রাথমিক পবিত্রতা ও জীবনীশক্তিতে ফিরিয়ে আনা এবং দেশের ক্রমবর্ধমান ইংরেজ শক্তিকে ধ্বংস করে পুনরায় ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করা। এ জন্যে শাহ ওয়ালিউল্লাহ আরবের মুজাদ্দিদ ও মুজাহিদ মুহাম্মদ বিন আবদুল ওয়াহহাবের ন্যায় মুসলমানদের অনৈসলামী রীতি-নীতি, কুসংস্কার ও অনাচারের মূলোচ্ছেদের চেষ্টা করেন।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ লক্ষ্য করেছিলেন, শরীয়তে-ইসলামের প্রতি তাসাইফপন্থী সূফীদের উদাসীনাত ও অবজ্ঞা ইসলাম ও মুসলিম সমাজের জন্যে ছিল ক্ষতিকর, তাদের আচরিত বহু অনাচারের ও প্রচারিত ইসলাম বিরুদ্ধ মতবাদের অনুপ্রবেশ মুসলিম ধর্ম জীবনে করে রেখেছিল কলুষিত ও বিকৃত। ব্যবসায়ী সূফীদের অনুপ্রবেশ মুসলিম ধর্ম জীবনকে করে রেখেছিল কলুষিত ও বিকৃত। ব্যবসায়ী সূফীরেদ প্রাদুর্ভাব ও পীরপূজা-কবরপূজার প্রথাও ক্রমাগত বেড়েই চলেছিল। ওয়ালিউল্লাহ অবশ্য তাসাউফের উচ্ছেদ চাননি, তিনি চেয়েছিলেন তার পূর্ণ সংস্কার ও পরিশুদ্ধি। তিনি সূফীবাদকে সংস্কার কতের তাকে করতে চেয়েছিলেন কল্যাণমুখী। পেশাদার পীর, ফকীর, কবরপূজা, কেরামতি প্রভৃতির বিরুদ্ধে তার ওসিয়তনামায় বুহ অকাট্য যুক্তি ও নির্দেশ আছে।
শাহ ওয়ালিউল্লাহ এক শান্তিপূর্ণ ও নিরুপদ্রব পরিবেশে লোকচরিত্র গঠনের প্রয়োজনীয়দা উপলব্ধি করে তাঁর সংস্কার আন্দোলন বা গঠনমূলক কাজ শুরু করেন। তিনি তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে একাধারে মুসলিম সমাজের ত্রুটিবিচ্যুতি ও কুসংস্কারগুলির প্রতি অংগুলি নির্দেশ করেন এবং অপর পক্ষে তাদের সঠিক কর্মপন্থাও সুস্পষ্ট করে তোলেন। তিনি বহু মূল্যবান গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তার মধ্যে ফতহুল কবীর
, ‘হুজ্জাতুল্লাহেল বালেগা’ প্রভৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি মৃত, ঘুমন্ত ও পতভ্রষ্ট জাতিকে লেখনীর বেত্রঘাতে জীবন্ত ও জাগ্রত করে সঠিক পথে চালাবার আপ্রাণ চেষ্টা করেন। ১৭৬২ খৃষ্টাব্দে এ প্রতিভাবান মনীষী ইহলোক ত্যাগ করেন।
শাহ আবদুল আযীয দেহলভী (রহ)
শাহ ওয়ালিউল্লাহর এন্তেকালের পর তাঁর সুযোগ্য জ্যেষ্ঠ পুত্র শাহ আবদুল আযীয (১৭৪৬-১৮২৩ খৃঃ) তাঁর প্রদর্শিত পথ ধরে সম্মুখে অগ্রসর হন। ভারতীয় আলেম সমাজের মধ্যে তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি এ দেশকে নির্ভয়ে ‘দারুল হরব’ বলে ফতোয় জারী করেন। বিধর্মী ইংরেজ শাসিত দেশে মুসলমানদের সামাজিক ও দ্বিনী অবস্থা কী হবে –এ প্রশ্নটি মুসলমানদের মনমস্তিষ্ককে আলোড়িত করে রেখেছিল। বীর মুজাহিদ শাহ আবদুল আযীয উদাত্ত কন্ঠে ও অকুতোভয়ে ঘোষণা করলেন যে, অনৈসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র মুসলমানদের বসবাস করা ঈমানের পরিপন্থী। হয় তাদেরকে জেহাদ করে এ দেশকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করতে হবে, অন্যথায় হিজরত করে অন্যত্র গমন করতে হবে। তাঁর এ ঘোষণা মুসলমানদের মনেপ্রাণে জেহাদের এক দুর্দমনীয় প্রেরণার হিল্লোল প্রবাহিত করে।
স্বৈরাচারীর প্রভাব থেকে মুসলিম ভারতকে মুক্ত করার আকুল আগ্রহে শাহ আবদুল আযীয প্রবর্তণ করেন ‘তারগীবে মুহাম্মদীয়া’ নামে সমাজ সংস্কারক আন্দোলন। এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল –যেসব ইসলাম বিরুদ্ধ রীতিনীতি, আচার অনুষ্ঠান ও কুসংস্কার মুসলিম সমাজে অনুপ্রবেশ করেছে তার মূলোচ্ছেদ কের মুসলমানদেরকে প্রকৃত ইসলামী শিক্ষাদর্শে উদ্ধুদ্ধ করে তোলা। এক সুপরিকল্পিত পদ্ধতিতে শাহ সাহেব, সারা ভারতে এ আন্দোলন পরিচালনা করেন এবং এ কাজে নিয়োগ করেন তাঁরই নিকটে শিক্ষাপ্রাপ্ত একদল নিঃস্বার্থ ও অক্লান্তকর্মা লোক। কালক্রমে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই এ ‘তারগীবে মোহাম্মদীয়া’ আন্দোলন একটি জিহাদী আন্দোলনের রূপ গ্রহণ করে এবং অত্যাচারী শিখ ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে আযাদীর আন্দোলন শুরু করে। এ আন্দোলনকে বাস্তব রূপ দিয়েছিলেন সাইয়েধ আহমদ শহীদ বেরেলভী এবং তাঁর প্রধান সহকর্মী ছিলেন শাহ সাহেবের ভাইপো শাহ ইসমাইল শহীদ ও জামাতা মওলানা আবদুল হাই।
শাহ ওয়ালিউল্লাহর বংশ তালিকা
শাহ ওয়ালিউল্লাহ (১৭০৩-৬২ খৃঃ)
(১) শাহ আবদুল আযীয (২) শাহ রফীউদ্দীন (৩) শাহ আবদুল কাদের (৪) শাহ আবুদল গনী
(৫) মওলানা আবদুল হাই (জামাতা) (৬) শাহ মাহফুজুল্লাহ (৭) শাহ ইসমাইল
(৫_১) মওলানা ইসহাক (৫
_২) মওলানা ইয়াকুব
সাইয়েদ আহমদ শহীদ
ঊনবিংশ শতদের প্রথম দিকে সমগ্র ভারতব্যাপী এক বিরাট সুসংগঠিত স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে উঠে। এ আন্দোলন পরিচালিত হ’য়েছিল একমাত্র ভারতীয় মুসলমানদের দ্বারাই। এ আন্দোলনের প্রাণশক্তি ছিলেন সাইয়েদ আহমদ শহীদ বেরেলভী (রহ)। এ আন্দোলকে ইতিহাসে ‘ওহাবী আন্দোলন’ বলে আখ্যায়িত করা হ’য়েছে অথচ এ ছিল একাধারে ইসলামী ও আযাদী আন্দোলন। এ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল আসমুদ্রহিমাচলে একটি অখন্ড স্বাধীন ইসলামী রাষ্ট্র গড়ে তোলা। কিন্তু কতিপয় লোকের চরম বিশ্বাসঘাতকতার দরুন অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছা সম্ভব হয়নি। তথাপি এ আন্দোলন আগাগোড়া যেরূপ গোপনে ও সুনিপুণ কর্মসূচীর মধ দিয়ে সম্মুখে অগ্রসর হয়, তা কল্পনাকেও বিস্মিত ও স্তম্ভিত করে দেয়।
সাইয়েদ আহমদ ৬ই সফর ১২০১ হিজরী (ইং ১৭৮৬) এলাহাবাদের রায় বেরেলভীতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর জীবনী লেখকগণ তাঁর জন্ম সংক্রান্ত এক বিস্ময়কর ঘটনার উল্লেখ করেছেন। তিনি যখন মাতৃগর্ভে তখন তাঁর পূণ্যময়ী জননী স্বপ্নে দেখেন যে, তাঁর রক্তে লেখা একখানি কাগজ পত পত করে উড়ে বেড়াচ্ছে। তাঁর জনৈক নিকটাত্মীয় স্বপ্নের কথা শুনে বল্লেন, চিন্তার কারণ নেই। আপনার গর্ভ থেকে যিনি জন্মগ্রহণ করবেন তিনি হবেন ইতিহাসের একজন অতি খ্যাতনামা ব্যক্তি। -(সাইয়েদ আহমদ শহীদ, গোলাম রসূল মেহের, পৃঃ ৫৬)।
এ স্বপ্ন অক্ষরে অক্ষরে সত্যে পরিণত হয়েছে। সাইয়েদ আহমদ শহীদ ও তাঁর অনুসারীদের তাজা খুনে বাংলাদেশ থেকে বালাকোট পর্যন্ত ভারতভূমি রঞ্জিত হয়েছে। তাঁদের সে রক্ত লেখা স্মৃতি পরবর্তী এক শতাব্দী কাল পর্যন্ত মুসলমানদেরকে অবিরাম জেহাদী প্রেরণায় উদ্ধুদ্ধ করেছে, যার পরিসমাপ্তি ঘটেছে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে –বিদেশী ও বিধর্মী শাসন-শোষণের নাগপাশ থেকে মুসলমানদেরকে মুক্ত করে।
সাইয়েদ আহমদের বয়স যখন চার বৎসর চার মাস চারদিন তখন সম্ভ্রান্ত মুসলমানদের প্রথা অনুযায়ী তাঁকে মকতবে পাঠানো হয়। কিন্তু শিশু সাইয়েদ আহমদের শিক্ষার প্রতি কোন অনুরাগই ছিল না।
গোলাম রসূল মেহের বলেন, শৈশবে কেন যে তিনি শিক্ষার প্রতি অনীহা প্রকাশ করতেন তা বলা মুশকিল। তবে পরবর্তীকালে দেখা গেছে যে, তিনি ফারসী ভালোমত রপ্ত করে ফেলেছিলেন এবং অনর্গল এ ভাষায় কথা বলতে পারতেন। আরবী ভাষাও এতটা শিখেছিলেন যে “মেশকাতুল মাসাবীহ” নিজে নিজেই পড়তে পারতেন। ‘হাফেজ’, ‘বেদেল’ এবং অন্যান্য কবিদের কবিতা বলতে পারতেন। কিন্তু তথাপি পরিবারের ঐতিহ্য অনুযায়ী তাঁর বাল্যশিক্ষা সন্তোষজনক ছিল না। তাঁর বড়ো ভাই সাইয়েদ ইব্রাহীম ও সাইয়েদ ইসহাক তাঁর পড়াশুনার জন্যে যথেষ্ট তাকীদ করতেন। কিন্তু পিতা নৈরাশ্য সহকারে বলতেন, “বিষয়টি তার উপরেই ছেড়ে দাও”।
পরবর্তীকারে তিনি দিল্লী গমন করলে, শাহ আবদুল আযীয আকবরাবাদী মসজিতে তাঁর থাকার ব্যবস্থা করেন এবং তাঁর শিক্ষার জন্যে শাহ আবদুল কাদেরকে নিযুক্ত করেন। সাইয়েদ আহমদ তাঁর কাছে আরবী ও ফার্সী শিক্ষা করতেন। একথা ঠিক যে, শাহ ইসমাইল অথবা মওলানা আবদুল হাই এর মতো বিদ্যালয় থেকে শিক্ষাগত যোগ্যতা তিনি লাভ করতে পারেন নি, কিন্তু আরবী ও ফার্সী বলতেও পারতেন এবং সহজেই বুঝতে পারতেন।
মৌলভী সাইয়ে জাফর আলী নকভী বলেন, শাহ ইসমাইল প্রতিদিন ফজর নামাজের পর হাদীস ব্যাখ্র করে শুনাতেন। সাইয়েদ সাহবেও কোন কোন হাদীসের গুরুত্ব বর্ণনা করতেন এবং শ্রোতাগণ এর থেকে বিশেষ উপকৃত হতেন। -(সাইয়েদ আহমদ শহীদ, গোলাম রসূল মেহের, পৃঃ ৫৬,৭১,৭৩)
বাল্যকাল থেকেই সাইয়েদ আহমদ শরীর চর্চায় অভ্যস্থ ছিলেন এবং তিনি ছিলেন অসাধারণ দৈহিক শক্তির অধিকারী। শৈশবকাল তেকে তাঁর মধ্যে জেহাদের প্রেরণা জাগ্রত ছিল এবং তিনি প্রায় সমবয়সীদের সামনে বলতেন ‘আমি জেহাদ করব’ ‘আমি জেহাদ করব’। সকলেই এটাকে শিশুসুলভ প্রগলত উক্তি মনে করতো। কিন্তু তাঁর মা শিশুর এ উক্তিকে সত্য বলে বিশ্বাস করতেন। গোলাম রসুল মেহের ‘তাওয়ারিখে আজমিয়ার’ বরাত দিয়ে বলেন, বালক সাইয়েদ আহমদ বস্তীর বালকদের মধ্য থেকে একটি ‘লশকরে ইসলাম’ দল গঠন করতেন এবং উচ্চস্বরে জেহাদী শ্লোগানসহ একটি কল্পিত ‘লশকরে কুফফার’ এর উপর আক্রমণ চালাতেন এবং ‘ইসলামী সেনাদল’ জয়লাভ করলো এবং ‘কাফের সেনাদল’ হেরে গেল বরে চীৎকার করে আকাশ বাতাস মুখরিত করতেন। -(সাইয়েদ আহমদ শহীদ, গোলাম রসুল মেহের, পৃঃ ৫৯)।
এভাবে একদিকে ‘ইসলামী সৈন্য’ এবং অপরদিকে ‘অমুসলিম সৈন্য’ কল্পনা করে আক্রমণ ও প্রতি আক্রমণ চালিয়ে বাল্যকাল থেকেই সাইয়েদ আহমদ জেহাদীমনা হয়ে গড়ে উঠেছিলেন যার প্রতিফল ঘটেছিল পরবর্তীকালে তাঁর বাস্তব জীবনে।
আঠারো বৎসর বয়সে সাইয়েদ আহমদ আহমদ আটজনের একটি দলসহ লক্ষ্ণৌ গমন করেন। অন্যান্যদের উদ্দেশ্য ছিল জীবিকা অন্বেষণ করা। কিন্তু সাইয়েদ সাহেবের উদ্দেশ্য ছিল ভিন্নতর। চার মাস লক্ষ্ণৌ অবস্থানের পর তিনি সাথীদেরকে চাকুরীর বাসনা পরিত্যাগ করে দিল্লীতে ইমামুল হিন্দ শাহ আবদুল আযীযের নিকটে আধ্যাত্মিক দীক্ষা গ্রহণের জন্যে উদ্ধুদ্ধ করেন। অতঃপর পায়ে হেঁটে কয়েকদিনের মধ্যে শাহ সাহেবের দরবারে উপনীত হন এবং তাঁর হস্তে বয়অত গ্রহণ করে মুরীদ হন।
উপরে বর্ণিত হয়েছে, আকবরবাদী মসজিদে অবস্থান মসজিদে অবস্থঅন করতঃ সাইয়েদ আহমদ একাধারে কোরআন হাদীস ফেকাহ প্রভৃতির জ্ঞান লাভ এবং শাহ আবদুল আযীযের নিকেট আধ্যাত্মিক দীক্ষা লাভ করতে থাকেন। এভাবে শিক্ষাদীক্ষা লাভ করে পাঁ বৎসর পর সাইয়েদ আহমদ তাঁর জন্মস্থান রায় বেরেলী প্রত্যাবর্তণ করেন। তখন তিনি তেইশ বছরে পদার্পণ করেছেন মাত্র। এ সময়ে তিনি সাইয়েদা যোহরা নাম্নী এক সম্ভ্রান্ত বংশীয়া বালিকাকে বিবাহ করেন। পরের বছর তিনি একটি কন্যা সন্তান লাভ করেন। কিন্তু শৈশবকাল থেকেই যে জেহাদী প্রেরণা তিনি হৃদয়ে পোষণ করছিলেন, সে প্রেরণা তাঁকে ঘরের মায়া মোহ ও প্রেম বেঁধে রাখতে পারলো না। তিনি গৃহ ত্যাগ করে নবাব আমীর খানের সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল আমীর খানকে জেহাদে উদ্ধুদ্ধ করে তাঁর সহায়তায় একটি মুজাহিদ বাহিনী গঠন করবেন। তিনি সাত বছর আমীর খানের সেনাবাহিনীতে থাকারা পর নিরাশ হয়ে তাঁর সংগ পরিত্যাগ করেন। যাদের বিরুদ্ধে তাঁর জেহাদের পরিকল্পনা, সেই ইংরেজদের সাথে সন্ধিসূত্রে আমীর খান আবদ্ধ হলেন বলে তাঁর আশা-আকাংখা চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। তিনি শাহ আবদুল আযীযের নিকটে যে পত্র দেন তা নিম্নে উদ্ধৃত হলো-“এখানে সেনাবাহিনী গঠনের পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়েছে। নবাব সাহেব ইংরেজদের সাথে মিলিত হয়েছেন। এখানে থাকার আর কোন উপায় নেই”। –
(সাইয়েদ আহমদ শহীদ, গোলাম রসূল মেহের, পৃঃ ১০৯)।
নবাব আমীর খানের সেনাবাহিনী পরিত্যাগ করে সাইয়েদ সাহেব পুনরায় শাহ আবদুল আযীযের খেদমতে হাজীন হন। তাঁর জীবনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল মুসলমানদেরকে সত্যিকার মুসলমান হিসাবে গড়ে তোলা, প্রথম যুগের মুসলমানদের মধ্যে যে ধরনের জেহাগী প্রেরণা জাগ্রত ছিল তা পুনর্বার উজ্জীবিত করা এবং ভারতে একটি প্রকৃত ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি স্থাপন করা।
সাইয়েদ সাহেব আধ্যাত্মিক দিক দিয়ে এতো উচ্চস্থান অর্জন করেছিলেন যে, মৌলভী মুহাম্মদ ইউসূফ, শাহ ইইমাইল ও মওলানা আবদুল হাই এর মতো শাহ ওয়ালিউল্লাহ খান্দানের উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিগণ তাঁর হস্তে বয়অন গ্রহণ করেন। এর পর থেকে দলে দলে লোক তাঁর মুরীদ হতে থাকেন। তিনি তাঁর অনুসারীদেরকে যে জেহাদের মন্ত্রে দীক্ষিত করেন তার লক্ষ্য হলো সত্যের পথে সংগ্রাম করে আল্লাহ প্রদর্শিত সরল ও সঠিক পথে চলা। এ পথেই তিনি তাঁর অনুগামীদেরকে আজীবন পরিচালনা করেন।
শাহ ইসমাইলের নিকট লিখিত এক পত্রে জেহাদের বর্ণনা করে তিনি বলেন-
“জেহাদের উদ্দেশ্য ধন সম্পদ অর্জণ করা নয়। বিভিন্ন অংশ জয় করা বা স্বীয় স্বার্থ পরিতৃপ্ত করা অথবা নিজের জন্য একটা রাজ্য স্থাপন করাও জেহাদের উদ্দেশ্য নয়। জেহাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহকে সন্তুষ্ট করা এবং মুসলিম সমাজে যেসব কুসংস্কার প্রচলিত আছে তাকে বিনষ্ট করা”। -(স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস, আবু জাফর, পৃঃ ৮৩)
এমন মহান ও পবিত্র উদ্দেশ্য যাঁর, যাঁর চরিত্র ছিল নির্মল ও নিষ্কলুষ, যিনি ছিলেন ব্যক্তিস্বার্থের বহু উর্ধে এবং একমাত্র সন্তুষ্টি অর্জন যাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য, তাঁর সম্পর্কে হান্টার বলেন –“এই বিস্ময়কর প্রভাবের উৎপত্তি কেবলমাত্র অশুভ ভিত্তির উপরেই ঘটেনি, সাইয়েদ আহমদ ধর্মীয় নেতা হিসাবে তাঁর জীবন আরম্ভ করেছিলেন দুটি মহান নীতির প্রবক্তা রূপে। নীতি দুটি হচ্ছে খোদার একত্ব এবং মানুষের সাম্য। সত্যিকার ধর্মপ্রচারকরা সকলেই এই দুই নীতি অনুসরণ করে থাকেন। দেশবাসীর অন্তরে যে ধর্মভাব দীর্ঘকাল যাবত সুপ্ত অবস্থায় ছিল এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী যাবত হিন্দু ধর্মের সাহচর্যের দরুন সৃষ্ট কুসংস্কার অতিমাত্রায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে মুসলমানদের মনকে যেভাবে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল, এবং ইসলাম ধর্মকে প্রায় শ্বাসরুদ্ধ করে রেখেছিল, সাইয়েদ আহমদ এক স্বতঃফূর্ত প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে নাড়া দিয়েছিলেন মুসলমানদের সেই ধর্মনিষ্ঠ মনের দুয়ারে। তিনি এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ শিষ্যবর্গ ভক্তের (Imposters) দলে পরিণত হয়েছিলেন একথা সত্য হওয়া সত্ত্বেও আমি একথা বিশ্বাস না করে পারি না যে, সাইয়েদ আহমদের জীবনে অন্তর্বর্তী এমন একটা সময় ছিল, যখন সর্বান্তকরণে বেদাকুল হৃদয়ে তিনি তাঁর দেশবাসীর মুক্তি কামনা করেছিলেন এবং তাঁর অন্তর নিবদ্ধ হয়েছিলেন একমাত্র আল্লাহর প্রতি”।
[W W Hunter, The Indian Mussalmans –অনুবাদ আনিসুজ্জামান (কিছু পরিবর্তণসহ) পৃঃ ৩৬]
হান্টার সাহেব তাঁর গ্রন্থে কিরূপ স্ববিরোধী উক্তি করেছেন তা যে কোন বিবেকসম্পন্ন ব্যক্তি অনুধাবন করতে পারবেন। যে ব্যক্তির ‘অন্তর নিবদ্ধ হয়েছিল আল্লাহর প্রতি’ যিতি ‘সর্বান্তঃকরণে বেদনাকুল হৃদয়ে তাঁর দেশবাসীর মুক্তি কামান করেছিলেন, তাঁকে হান্টার বলেছেন দস্যু-দুর্বৃত্ত এবং ভন্ড।
হান্টার সাহেব আরও বলেন, “ধর্মীয় ধ্যানে তিনি এমন মগ্ন থাকতেন যে, সেটাকে পাশ্চাত্য বিজ্ঞান অনুসারে মৃগীরোগ বলে অভিহিত করা যায়”। [W W Hunter, The Indian Mussalmans –অনুবাদ আনিসুজ্জামান (কিছু পরিবর্তণসহ) পৃঃ ৩৬]
আল্লাহর ধ্যানে মগ্ন থাকাকে তাসাওউফের পরিভাষায় বলা হয় মুরাকাবা-মুশাহাদা। হান্টারের মতো খোদায় অবিশ্বাসী পাশ্চাত্য বিজ্ঞানীরা তাক বলেন মৃগীরোগ। ইষলাম বিদ্বেষব্যাধি মনমস্তিষ্ককে কতখানি আক্রান্ত করে রাকলে এ ধরনের অশালীন উক্তি করা যায়, তা সহজেই অনুমেয়। সাইয়েদ আহমদ যদি শুধুমাত্র ‘ধর্মীয় ধ্যানে মগ্ন’ থাকতেন, তাহলে সম্ভবততঃ পাশ্চাত্য লেখকগণ তাঁর কোন বিরূপ সমালোচনা করতেন না। কিন্তু যেহেতু তিনি বিধর্মী ও বিদেশী শাসন থেকে ‘দেশবাসীর মুক্তি কামনা করেছিলেন’, সেজন্যে তাঁদের দৃষ্টিতে তিনি ছিলেন ‘মৃগী রোগাক্রান্ত’ দুর্বৃত্ত ও ভণ্ড। এ ছিল তাদের বিদ্বেষদুষ্ট ও বিকৃত মানসিকতারই পরিচায়ক।
শাহ আবদুল আযীয দেহলভীর ভাইপো প্রখ্যাত আলেম শাহ ইসমাইল এবং জামাতা মওলানা আবদুল হাই, সাইয়েদ সাহেবের মুরীদ হওয়ার ফল এই হলো যে, সাইয়ে সাহেবের খ্যাতি বিদ্যুৎ গতিতে মধ্য ভারতে ছড়িয়ে পড়লো। চারদিক থেকে জনসাধারণ তাঁকে দাওয়াত করতে থাকলো এবং তিনি তাঁর মুর্শেদ শাহ আবদুল আযীযের অনুমতিক্রমে দোয়াব অঞ্চলের গাযিয়াবাদ, মীরাট, মজফফরপুর, সাহারনপুর, দেওবন্দ প্রভৃতি স্থানসমূহে ব্যাপক সফর করেন। প্রায় চল্লিশ হাজার লোক তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করে এবং বহু অমুসলমানও তাঁর কাছে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়। তাঁর এ সফরকালে তিনি শিখদের হাতে মুসলমানদের নির্যাতন কাহিনী প্রথম শুনতে পান এবং তাঁর অন্তর সমবেদনায় বিগলিত হয়। ১৮১৯ সালে তিনি শেষবারের মতো দিল্লী ফিরে যান এবং অল্পকাল পরেই রায়বেরেলী প্রত্যাবর্তন করেন।
রায়বেরেলীতে তিনি কিছুকাল অতিবাহিত করেন। সেখানে এই খোদাভক্তদের জীবনযাত্রা ছিল আদর্শস্থানীয় এবং দর্শকদের শিক্ষার যোগ্য। দুর্ভিক্ষ প্রপীড়িত অঞ্চলে প্রায় সত্তর আশীজন লোক সায় নদীর তীরবর্তী সাইয়েদ বংশের পুরাতন মসজিদের চারদানে নিজ হাতে কুটীর তৈরী করে বাস করতেন। সে বৎসর (১৮১৯ খৃঃ) গ্রীষ্মকালে জোর বৃষ্টি নামলো এবং নদীগুলোতে প্রবল প্লাবন এলো। খাবার হয়ে পড়লো দুর্মূল্য ও দুষ্প্রাপ্য। কিন্তু সাইয়েদ সাহেব নির্বিকার চিত্তে তাঁর আশিজন খোদাপ্রিয় ও খোদাভক্ত সংগী নিয়ে এবাদত বন্দেগীতে, লোকসেবা ও প্রচার কার্যে দিনরাত ব্যস্ত রইলেন। তাঁর তখনকার কর্মব্যস্ততায় হযরত ঈসার (আ) ‘সারমন অব দি মাউন্টের’ বিখ্যাত উপদেশাবলীর আক্ষরিক প্রতিপালনই লক্ষ্য করা যায়ঃ তোমার নিজের জীবনে কি খাবে ও কি পান করবে সে বিষয়ে কোন চিন্তা করা যায়ঃ তোমার নিজের জীবনে কি খাবে ও কি পান করবে সে বিষয়ে কোন চিন্তা করোনা –এমনকি দেহের চিন্তাও করোনা যে, কি পরবে। কিন্তু আল্লাহর প্রেমের রাজ্য প্রতিষ্ঠা কর, তাহলে তোমার এ সবই হবে।
-(ওহাবী আন্দোলন, আবদুল মওদূদ, পৃঃ ১৫৪-৫৫)
উপরোক্ত দলে ছিলেন ইসলাম জগতের বহু জ্ঞান-জ্যোতিষ্ক যথা হুজ্জাতুল ইসলাম মওলানা শাহ মুহাম্মদ ইসমাঈল
, শায়খুল ইষলাম মওলানা আবদুল হাই, কোতব-ই-ওয়াক্ত মওলানা মুহাম্মদ ইউসূফ প্রভৃতি। শাহ ইসমাইল তাঁর অসীম জ্ঞানগরিমা ও পান্ডিত্যসহ জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আপন পীর ও মুর্শেদের সাথে ছায়ার মতো ছিলেন এবং তাঁর সংগেই শাহাদতের অমৃত পান করেন। প্রাতঃকালে প্রচারণা, ওয়াজ নসিহত, কোরআন হাদীসের ব্যাখ্যাদান, দিবাভাগে কঠোর দৈহিক পরিশ্রম এবং সারারাত তাহাজ্জুদ ও এবাদত বন্দেগীতে কাটানো –এ ছিল এসব খোদাপ্রেমিকদের দৈনন্দিন কর্মসূচী।
সাইয়েদ সাহেবের শিক্ষার প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্ম থেকে ভন্ডামী ও জাঁকজমক দূর করা এবং জীবনের প্রত্যেক স্তরে বিশ্বনবীর সহজ সরল জীবনধারা অনুসরণ করা। ধর্ম বিশ্বাসে তিনি ছিলেন পুরাপুরি তাওহীদপন্থী, আল্লাহর সার্বভৌমত্বে অকুন্ঠ বিশ্বাসী, ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সুন্নাহর একনিষ্ঠ পাবন্দ। সব রকম শির্ক থেকে দূরে থাকা, যেমন পীর আউলিয়ার কাছে ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মংগল কামনা, গায়েবী মদদ প্রার্থনা করা, বিভিন্ন প্রকারের কবর পূজা করা, পৌত্তলিক ও অন্যান্য বিধর্মীর আচার অনুষ্ঠান পালন করা, প্রভৃতি। তিনি ইসলামকে নিছক আনুষ্ঠানিকতায় পরিণত করার চেয়ে প্রকৃত সাধু জীবন যাপরেন দিকেই বেশী জোর দিতেন –কারণ তার ফলেই মানুষ একটা মহৎ করুণার উপরে হয় নির্ভরশীল। একথা দিবালোকের ন্যায় সত্য যে, তিনি নিজের ইচ্ছা ও আশা-আকাংখাকে আল্লাহর ইচ্ছা ও মরযীর উপরে একান্তভাবে সুপর্দ করেছিলেন, যার জন্যে তিনি তাঁর জীবনের প্রতি মুহূর্তে আল্লাহরই ইচ্ছানুযায়ী চলতে প্রস্তুত থাকতেন।
সাইয়েধ সাহেব তাঁর অভীষ্ট পথে অগ্রসর হওয়ার পূর্বে হজ্বে বায়তুল্লাহর ইচ্ছা প্রকাশ করেন। তাঁর সাথে পবিত্র হজ্বে শরীক হওয়ার জন্যে দলে দলে স্ত্রী-পুরুষ তাঁর পাশে জমায়েত হতে লাগলো। ১২৩৬ হিঃ ৩০শে শাওয়াল, ই. ১৮২১ এর জুলাই মাসে প্রায় চারশো নারী পুরুসের এক বিরাট কাফেলা সাতশোতে দাঁড়ালো। দলে দলে মানুষ তাঁর কাছে দীক্ষা গ্রহণ করতে লাগলো। তিনি মানুষকে সত্যিকার মুসলমানী জীবন যাপনের আহবান জানালেন এবং হজ্বের প্রয়োজনীয়তাও ব্যাখ্যা করেন।
হজ্বকাফেলা নৌকা যোগে এলাহাবাদ থেকে বেনারস, মীর্জাপুর, চুনারগড়, গাজীপুর, দানাপুর, ফুলওয়ারী শরীফ, প্রভৃতি স্থান অতিক্রম করে আযীমাবাদ পৌঁছে।
আযীমাবাদ অবস্থানকালে তিব্বতের একটি দল তাঁর সাথে দেখা করে। তিনি তাদেরকে তিব্বতে ইসলামী দাওয়াতের কাজ সুপর্দ করেন এবং বলেন যে, অসীম ধৈর্য সহকারে এ কাজ করে যেতে হবে। এভাবে তিব্বতেও সাইয়েদ সাহেবের দ্বীনের দাওয়াত প্রচার হতে থাকে।
আযীমাবাদ থেকে হজ্জ্ব কাফেলা হুগলী পৌঁছলে কোলকাতা নিবাসী জনৈক মুন্সী আমীনুদ্দীন গোটা কাফেলাকে তাঁর মেহমান হিসাবে কোলকাতায় নিয়ে আসেন। এখানে চারদিক থেকে খোদাপ্রেমে পাগল হাজার হাজার নারী পুরুষ তাঁর মুরীদ হন। বহুলোক হজ্বের জন্যে বহু হাদিয়া ও উপঢৌকন পেশ করেন। সাইয়েদ সাহেবও তাঁর সুললিত ও অমিয় ভাষণে তাঁদের আধ্যাত্মিক পিপাসা নিবারণ করেন। গোলাম রসূল মেহের তাঁর গ্রন্থে হজ্ব সফরের আগাগোড়া বিস্তারিত বিবরণ লিপিবদ্ধ করেছেন। কিন্তু কোলকাতা থেকে জাহাজ যোগে মক্কা রওয়ানার তারিখ লিপিবদ্ধ করেন নি।
সাইয়েদ সাহেবের কাফেলায় মোট সাত শ’ তিপ্পান্ন জন হজ্ব যাত্রী ছিলো। দশটি জাহাজে তাঁদেরকে বিভক্ত করে দেয়া হয়। সাইয়েদ সাহেব ‘দরিয়া বাকা’ নামক একটি পুরাতন জাহাজে দেড়শ’ যাত্রীসহ যাত্রা করেন। ভালো ভালো জাহাজগুলি অন্যান্যদের জন্যে নির্দিষ্ট করে দেন।
রায় বেরেলী থেকে রওয়ানা হওয়ার দশ মাস পর ১২৩৭ হিঃ ২৮ শে শা’বান, ইং ১৮২২ সালের ২১শে মে কাফেলাসহ সাইয়েদ সাহেব পবিত্র মক্কা নগরীতে প্রবেশ করেন।
হজ্বের পর সাইয়েদ সাহেব কয়েক মাস মক্কায় অবস্থান করেন। গোটা রমযান মাস হারাম শরীফে কাটান। অতঃপর যিলকদ মাসের প্রারম্ভে গৃহের উদ্দেশ্যে জিদ্দা পরিত্যাগ করে ২০শে যিলহজ্ব বোম্বাই পৌঁছেন। বোম্বাই থেকে কোলকাতা এবং অতঃপর ইং ১৮২৪ সালের ২৯ শে এপ্রিল আপন জন্মস্থান রায়বেরেলী পৌঁছেন।
হজ্ব থেকে প্রত্যাবর্তনের পর যেখানেই যান, অসংখ্য লোক তকেঁ এক নজর দেখার জন্যে এবং তাঁর পবিত্র হস্তে বয়আত করার জন্যে ভীড় করতে থাকে। হাজার হাজার লোক তাঁর নিকটে দীক্ষা গ্রহণ করে তাঁর দলভুক্ত হয়ে যায়।
রায় বেরেলী পৌঁছার পর সাইয়েদ সাহেব সর্বাত্মক সংগ্রাম বা জেহাদের প্রস্তুতি করতে থাকেন। মুসলমানদেরকে অনৈসলামিক কুসংস্কারমুক্ত করে খাঁটি তৌহিদপন্থী বানাবার জন্যে সংস্কার সংশোধনের কাজ শুরু করেন শাহ ইসমাইল। তাঁর প্রণীত “তাকবিয়াতুল ঈমান” এ বিষয়ে একটি প্রামাণ্য ও মূল্যবান গ্রন্থ। অবশ্য পীরপূজা ও কবরপূজাকে ভিত্তি করে যারা তাদের ব্যবসা জমজমাট করে রেখেছিল, তাদের পক্ষ থেকে বিরোধিতাও করা হয়েছিল।
সাইয়েদ সাহেবের যখন জ্ঞানচক্ষু উন্মোচিত হয়েছিল তখন তিনি স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন, এ দেশের বিরাট মোগলসাম্রাজ্য চূর্ণ বিচূর্ণ ও ধ্বংস হয়ে গেছে। তার ধ্বংসস্তুপের উপর যে দু’চারটি মুসলমান রাষ্ট্র মাথা তুলেছিল, তাও শেষ হয়ৈ গেছে। ইংরেজ গোটা ভারতের উপরে তার আধিপত্য বিস্তার করে থাকলেও একটি বিরাট অঞ্চলে শিখ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত। মুসলমানরা শুধু রাজ্য হারায় নাই, আপন দ্বীন ও ‘সেরাতে মুস্তাকীম’ থেকে বহু দূরে সরে পড়েছে। তাদের আকীদাহ বিশ্বাস, ধ্যান-ধারণা ও আচার অনুষ্ঠান অনৈসলামী চিন্তাধারা ও ধর্মকর্মের দ্বারা প্রভাবিত। মুসলমান আমীর-ওমরা যাঁরা অবশিষ্ট ছিলেন, তাঁররা ভোগবিলাসে লিপ্ত এবং তাদের জীবনের লক্ষ্য এ ছাড়া আর অন্য কোন কিছু ছিল না যে –যেমন করেই হোক তাদের জীবনের সুখ সম্ভোগের উপায় উপাদানগুলি যেন অক্ষুণ্ণ থাকে। তার জাতীয় পরিমাণ যা কিছুই হোক না কেন, এ বিষয়ে চিন্তাভাবনা করার অবকাশ তাদের ছিল না। জনগণের মধ্যে অধিকাংশের অবস্থা এই ছিল যেন তাদের উপরে বজ্রপাত হয়েছে এবং তারা জ্ঞান ও সম্বিতহারা হয়ে পড়েছে, অথবা প্রবল ভূকম্পন শুরু হয়েছে এবং তারা হয়ে পড়েছে দিশেহারা। যাদের কিছু জ্ঞান বুদ্ধি ছিল, তারা কোন সমাধার খুঁজে পাচ্ছিল না। অন্ধকার ভবিষ্যতকে তারা ভাগ্যের লিখন মনে করে চুপচাপ হাত পা গুটিয়ে বসে ছিল এটা মনে করে যে, যা হবার তা হবেই। কিন্তু তরী যখন নদীরবক্ষে ঘুর্ণাবর্তে পতিত হবে, তার পাল চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে, নংগর কোন কাজে আসবে না, এবং কর্ণধারেরও কোন সন্ধান পাওয়অ যাবে না তখন আরোহীদের জীবন রক্ষার কোন আশা আর বলবৎ থাকবে? মুসলমানরা তখন এমনি এক নৈরাশ্যের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছিল।
মুসলমানদের জাতীয় জীবনের একনি এক নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতিতে সাইয়েদ সাহেব তাঁর জ্ঞানচক্ষু খোলেন। তিনি দেখলেন তাঁর সম্মুখে মাত্র তিনটি পথই উন্মুক্ত রয়েছে।
এক –হককে পরিত্যাগ করে বাতিলের সাথে সম্পর্ক সম্বন্ধ স্থাপন করা।
দুই –হককে পরিত্যাগ না করা। বরঞ্চ হকের সংগে জড়িত থাকতে গিয়ে যেসব বিপদ আপদ ও দুঃখ দারিদ্র্য আসবে, তা নীরবে সহ্য করা।
তিন –পুরুষোচিত সাহস ও শৌর্যবীর্য সহকারে বাতিলের মুকাবিল করতঃ এমন এক অবস্থা সৃষ্টি করার আপ্রাণ চেষ্টা করা –যাতে করে হকের জন্যে বিজয় সাফল্য সূচিত হওয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
প্রথমটি হলো মৃত্যুর পথ, জীবনের পথ নয়। দ্বিতীয়টির পরিমাণ ফল এই হতে পারে যে ক্রমশঃ ধুঁকে ধুঁকে এবং যন্ত্রণাদায়ক অবস্থার ভিতর দিয়ে জাতির জীবন প্রদীপ নিভে যাবে। তৃতীয় পথটিই হলো জাতীয় আত্মমর্যাদার পথ, বীরত্ব ও সৎ সাহসের পথ। নবজীবন লাভ করে আত্মমর্যাদায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ। সাইয়েদ সাহেব এই তৃতীয় পথটিই অবলম্বন করেছিলেন। এ পথে চলার সকল যোগ্যতা ও গুণাবলী তাঁর মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান ছিল।
মক্কা শরীফ থেকে রায় বেরেলী প্রত্যাবর্তনের পর থেকে কয়েক বৎসর তিনি জেহাদের প্রস্তুতি ও প্রচারণা চালান। তিনি দেশের ধর্মীয় নেতাদের নিকট পত্র পাঠালেন ফরয হিসাবে জেহাদের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে। তিনি স্বয়ং এ কথা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন যে, সমাজ সংস্কার ও সংগঠন করতে হলে শক্তি ও রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা একান্ত আবশ্যক। তিনি কতিপয় বিশিষ্ট মুসলমানের নিকটে সর্বতোভাবে জেহাদে অংশগ্রহণ করারও সাহায্য করার আবেদন জানান। একখানি পত্রে তিনি নবাব সুলেমানজাকে লিখেছিলেনঃ
আমাদের বরাতের ফেরে হিন্দুস্থান কিছুকাল খৃষ্টান ও হিন্দুদের শাসনে এসেছে এবং তারা মুসলমানদের উপর ব্যাপকভাবে জুলুম শুরু করে দিয়েছে। কুফরী ও বেদাতীতে দেশ ছেয়ে গেছে এবং ইসলামী চালচলন প্রায় উঠে গেছে। এসব দেখে শুনে আমার মন ব্যথায় ভরে গেছে। আমি হিজরত করতে অথবা জেহাদ করতে মনস্থির করেছি।
-(ওহাবী আন্দোলন, আবদুল মওদূদ, পৃঃ ১৫৭)
সাইয়েদ সাহেব আল্লাহর পথে জেহাদকে তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হিসাবে এবং পরকালে মুক্তির একমাত্র পথ হিসাবে গ্রহণ করেন। শুধু নিজের জন্যেই নয় জেহাদের প্রেরনায় উদ্ধুদ্ধ করে তিনি দেশে ও বিদেশে বহু মুসলিম শাসক ও আমীর ওমরাহর কাছে তাঁর জ্বালাময়ী ভাষায় বহু পত্র লিখেন। তাঁর বহু পত্রেরে মধ্যে কতিপয় পত্রের উল্লেখ করেছেন গোলাম রসূল মেহের তাঁর গ্রন্থে।
সাইয়েদ সাহেব নিম্নলিখিত শাসকদের কাছে পত্র প্রেরণ করেনঃ
১। আমীর দোস্ত মুহাম্মদ খান বারাকজাই –কাবুল।
২। ইয়ার মুহাম্মদ খান –পেশাওর।
৩। সুলতান মুহাম্মদ –কোহাট ও বান্নু।
৪। সাইয়েদ মুহাম্মদ খান –হাশতগর।
৫। শাহ মাহমুদ দুররানী –হিরাট।
৬। জামান শাহ দুররানী।
৭। নসরুল্লাহ –বোখারী।
৮। সুলায়মান শাহ –চিত্রাল।
৯। আহমদ আলী –রামপুর।
১০। মুহম্মদ বাহাওয়াল খান আব্বাসী নসরৎ জং –বাহাওয়ালপুর।
উপরন্তু ভারতের অত্যন্ত প্রভাবশালী ত্রিশ-পঁয়ত্রিশজন আমীর ওমরাহর নিকটেও তিনি জেহাগে যোগদানের জন্যে এবং সর্বতোভাবে সাহায্য সহযোগিতার জন্যে পত্র দ্বারা আহবান জানান। তাঁদের মধ্যে গোয়ালিয়রের জনৈক হিন্দু রাজা হিন্দু রাওয়ের নিকটেও তিনি পত্র প্রেরণ করেন। পত্রের মর্ম নিম্নরূপঃ
“বিদেশী ব্যবসায়ীরা এ দেশের শাসক হয়ে বসেছে। তারা আমাদেরকে সকল দিক দিয়ে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। রাজ্যের কর্ণধার যারা তারা এখন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে। এমনি অবস্থায় নিতান্ত কর্তব্যের খাতিরে বাধ্য হয়ে কতিপয় নিঃস্ব ও দরিদ্র লোক আল্লাহর উপর নির্ভর করেন তাঁর দ্বীনের খেদমতে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। এরা দুনিয়ার ধনসম্পদ ও পদ মর্যাদার প্রত্যাশী নয়। তাদের উদ্দেশ্য হলো যে, জয়লাভ করলে এ দেশের শাসনভার এ দেশেরই লোকদের হাতে তুলে দেয়া হবে”।
আন্দোলনের ব্যাপক প্রস্তুতিকল্পে সাইয়েদ সাহবে একটা সংগঠন কায়েম করেন এবং ভারতের প্রধান প্রধান শহরে তাঁর বিশ্বস্ত খলিফা বা প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। নিম্নোক্ত ব্যক্তিগণ তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-
১। মওলানা সাইয়েদ মুহাম্মদ আলী রামপুরীকে তিনজন সহকর্মীসহ হায়দরাবাদ (দাক্ষিণাত্য) পাঠানো হয়।
২। সাইয়েদ মুহাম্মদ আলী অতঃপর মাদ্রাজ গমন করলে মওলানা বেলায়েদ আলী আযীমবাদীকে পাঠানো হয়।
৩। মওলানা এনায়েত আলী আযীমাবাদীকে পাঠানো হয় বাংলায়।
৪। মওলাসা সাইয়েদ আওলাদ হাসান কনৌজী এবং সাইয়েদ হাফীযুদ্দীনকে ইউপিতে দায়িত্ব দেয়া হয়।
৫। মিয়া দীন মুহাম্মদ, মিয়া পীর মুহাম্মদ এবং আরও অনেকের উপর এ দায়িত্ব অর্পিত হয় যে, তাঁরা ভারতের বিভিন্ন স্থান ভ্রমণ করে জেহাদের আহবান পৌঁছাবেন এবং অর্থ সংগ্রহ করবেন।
জিহাদ কার্য পরিচালনার জন্যে পাটনাকে প্রধান কেন্দ্র হিসাবে নির্বাচিত করা হয়। ১৮২২ সালে সাইয়েদ আহমদ যখন পাটনাকে প্রধান কেন্দ্র হিসাবে নির্বাচিত করা হয়। ১৮২২ সালে সাইয়েদ আহমদ যখন পাটনা গমন করেন
, তখন বেলায়েত আলী ও মুহাম্মদ হোসেন তাঁকে বিপুল সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন। পাটনাকে আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্রস্থল স্থাপন করতঃ সাইয়েদ সাহেব চারজন প্রতিনিধি নিযুক্ত করেন। তাঁরা হলেন, মওলানা বেলায়েত আলী, মুহাম্মদ হোসেন, এনায়েত আলী এবং ফরহাদ হোসেন।
ভারতের সর্বত্র জেহাদের প্রচারণা ও প্রস্তুতি শেষ করে সাইয়েদ আহমদ ১৮২৬ সালে তাঁর জন্মভূমি রায়বেরেলী ত্যাগ করেন। তারপর আর সেখানে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ হয়নি। জীবনের বাকী বছর তিনি ক্রমাগত আল্লাহর পথে জেহাদে অতিবাহিত করে শাহাদতের অমৃত পানে জীবনকে ধন্য করেন।
যাহোক, যাত্রার পূর্বে ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে অর্থ, যুদ্ধের হাতিয়ার সরঞ্জাম, ঘোড়া, রসদ প্রভৃতি আনা শুরু হলো। আল্লাহর পথে জান কুরবান করার জন্যে হাজার হাজার মুজাহিদ তার ঝান্ডার নীচে জমায়েত হতে লাগলো। এভাবে যাত্রাকালে তাঁর মুজাহিদ বাহিনীর সংখ্যা দাঁড়ালো বারো হাজার। সাইয়েদ সাহেবের ভক্ত-অনুরক্ত টংকের নবাব মুজাহিদ বাহিনীকে আমন্ত্রণ জানান এবং জেহাদের যাবতীয় সাজ-সরঞ্জাম নিজ তত্ত্বাবধানে সরববরাহ করে দিয়ে বিদায় করেন।
অতঃপর মুজাহিদ বাহিনী টংক থেকে সিন্ধু, হায়দরাবাদ, শিকারপুর প্রভৃতি স্থান অতিক্রম করে বোলান পাসের ভিতর দিয়ে আফগানিস্তানের কান্দাহারে প্রবেশ করে।
ইতিপূর্বে মুজাহিদ বাহিনী সিন্ধুর খয়েরপুর মীর রুস্তম আলী সাইয়েদ সাহেবের মুরীদ হন এবং টংকের নবাবের মতো তাঁকে মোটা রকমের অর্থ সাহায্য করেন। আফগানিস্তান পৌঁছে সাইয়েদ সাহেব আফগান আমীরের সাহায্য প্রার্থনা করেন। আমীর তাঁকে কোনরূপ সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতি দিতে অস্বীকৃতি জানান। যাহোক তথা হতে মুজাহিদ বাহিনী সীমান্তের নওশেরায় উপনীত হয়। এ সুদীর্ঘ পথে মুজাহিদ বাহিনীকে চরম অসুবিধা ও দুঃখকষ্ট ভোগ করতে হয়। তবে তাদের যাত্রাপথে চারদিক থেকে সরদারগণ, শাসকগণ স্থানীয় কর্মচারীগণ ও জনসাধারণ সাইয়েদ সাহেবকে আনুগত্য জানিয়েছিল। কেউ বা বিবিধ উপঢৌকনাদি দিয়ে, কেউ তাঁর হাতে বয়আত গ্রহণ করে এবং কেউ বা তাঁর বাহিনীতে যোগদান করে। তাঁর বাহিনীতে যোগদান করেছিল ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের লোক –এমনকি সুদূর বাংলাদেশের বহু সংখ্যক মুজাহিদ। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য চট্টগ্রামের সূফী নূর মুহাম্মদ নিজামপুরী যিনি বালাকোটের বিপর্যয়ের পর গাজী হয়ে প্রত্যাবর্তণ করেন আপন জন্মভূমিতে। তাঁর মুরীদ ও খলিফা ছিলেন সূফী ফতেহ আলী সাহেব যিনি চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন কোলকাতার মানিকতলায়। বহু সংখ্যক বাংলাদেশী শাহাদাত বরণ করেছেন এবং অনেকেই বালাকোট
, সোয়াত প্রভৃতি স্থানে স্থায়ী বসবাস স্থাপন করেন। তাঁদের বংশধর এখনো বিদ্যমান আছে। বালাকোটে তাঁদের জনৈক বংশধরের সাথে গ্রন্থকারের সাক্ষাৎ লাভের সৌভাগ্য হয়েছিল ১৯৬৩ সালে।
সাইয়েদ সাহেব রায় বেরেলী থেকে দিল্লী গমন করে যখন শাহ আবদুল আযীযের নিকটে শিক্ষাদীক্ষা গ্রহণ করছিলেন তখনই তিনি জানতে পারেন পাঞ্জাবে শিখ রাজ্যের অধীনে মুসলমানদের চরম নির্যাতনের কথা। মজলুম মুসলশানদের সহানুভূতিতে তাঁর প্রাণ কেঁদে উঠে এবং তখনই তিনি সংকল্প গ্রহণ করেন তার প্রতিকারের। তিনি চেয়েছিলেন মুসলিম অধ্যুষিত সীমান্তে তিনি একটি ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করবেন এবং সেখান থেকে অভিযান চালাবেন অন্যত্র মুসলিম দুশমন শক্তি সমূহের বিরুদ্ধে। এ কারণেই তিনি সীমান্তকে বেছে নিয়েছিলেন তাঁর সংগ্রামের প্রাথমিক কেন্রদ হিসাবে। কিন্তু পরম পরিতাপের বিষয় এইযে, সীমান্তের যেসব মুসলমানের সাহায্য সহযোগীতার আশা হৃদয়ে পোষণ করে সাইয়েদ সাহেব তাঁর জেহাদের রূপরেখা রচনা করেছিলেন, তাদের চরম বিশ্বাসঘাতকতা তাঁর সংগ্রামকে মেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত করে। নওশেরায় পৌঁছার পর থেকে বালাকোটের যুদ্ধ পর্যন্ত ছোটো বড়ো এগারটি বা ততোধিক রীতিপদ্ধতি অনুযায়ী শিখদেরকে প্রকাশ্যে আহবান জানান ইসলাম গ্রহণ করতে, অথবা বশ্যতা স্বীকার করতে অথবা অস্ত্রের মুকাবিলা করতে। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধই হলো এবং এক নৈশ যুদ্ধে মাত্র নয়শত মুজাহিদ বৃহৎ শিখবাহিনীকে পরাজিত করে। তাদের বিজয় লাভে সীমান্তবাসী তাঁদের প্রশংসায় মুখর হয়ে দলে দলে মুজাহিদ বাহিনীতে যোগদান করলো। বহু স্থানীয় সরদার বিশেষ করে ইউসুফ জায়ীরা সাইয়েদ সাহেবের দলে যোগ দিলো।
কিছুকাল পর মনপুরী পঞ্জতরেও শিখরা পরাজয় বরণ করলো। মুজাহিদদের এ সাফল্যের ফলে গরহি ইমাজির দশহাজার যোদ্ধা সাইয়েদ সাহেবকে ইমাম হিসাবে স্বীকার করে নিল। পেশাওরবাসীগণ নওশেরায় ঘাঁটি করে শিখদের বিরুদ্দে সামগ্রিকভাবে অভিযান শুরু করার জন্যে সাইয়েদ সাহেবকে অনুরোধ জানায়। এ সময় প্রায় লক্ষাদিক লোক মুজাহিদ বাহিনীতে যোগদান করে।
কিন্তু সীমান্তের সরদারগণ ছিল অত্যন্ত স্বার্থপর ও অর্থগৃধনু। শিখ সেনাপতি বুধ সিংহ অর্থের প্রলোভনে পেশাওরের সর্দারকে হাত করে ফেলে। তারা এতটা নীচতায় নেমে যায় যে অর্তের জন্যে তারা সাইয়েদ সাহেবকে গোপনে বিষ প্রয়োগ করে। কিন্তু আল্লাহর অসীম কুদরতে তিনি অলৌকিকভাবে বেঁচে যান। এ সময়ে ধিখদের সাথে যে যুদ্ধ হয়, তাতে সরদারগণ শিখদের পক্ষ অবলম্বন করে এবং মুজাহিদ বাহিনী পরাজিত হয়।
সীমান্তের পাঠান সরদারদের ডিগবাজি ও বিশ্বাসঘাতকতার দরুন মুজাহিদ বাহিনীকে বিশেষ বেগ পেতে হয়। টংকের নবাবের নিকটে সাইয়েদ সাহেবের লিখিত এক পত্রে জানা যায় যে, প্রায় তিন লক্ষ লোক বয়আন গ্রহণ করে তাঁর দলে যোগদান করে। কিন্তু এর প্রায় সকলেই ছিল স্থানীয় লোক। সম্ভবতঃ যুদ্ধের মালে গনিমত লুণ্ঠনের উদ্দেশ্যেই তারা সাইয়েদ সাহেবের দলে যোগদান করে। তাদের ইসলামী চরিত্র বলে কিছু ছিল না। সাইয়েদ সাহেব তাঁর অতি সরলতার জন্যে তাদের দ্বারা প্রতারিত হয়েছিলেন। তাঁর একমাত্র নির্ভরযোগ্য সহকর্মী ছিলেন তাঁরাই যারা বাইর থেকে গিয়েছিলেন। তাঁরা বিপদে আপদে সাইয়েদ সাহেবের সংগে ছায়ার মতো থাকতেন এবং প্রয়োজনে অকাতরে জান দিয়েছেন। এঁদের সংখ্যা ছিল হাজার খানেকের মতো। তাঁদের মধ্যে যারা যুদ্ধে শাহাদত বরণ করতেন তাদের স্থান অধিকার করতেন নবাগতের দল। দূর দূর অঞ্চল হতে কাফেলা আসতো জেহাদে যোগদানেচ্ছু মানুষ নিয়ে
, টাকাকড়ি, রসদ ও চিঠিপত্র নিয়ে। তাঁদেরকে রসদ যোগান হতো সারা ভারতব্যাপী “তারগিবে মুহাম্মদীয়া” প্রতিষ্ঠানের গোপন কর্মকুশলতায়। ব্রিটিশ সরকারের গোয়েন্দা বিভাগের চোখে ধুলো দিয়ে টাকাকড়ি আসতো বিহার ও বাংলা থেকে। তার সংগে আসতো খোদার পথে উৎসর্গকৃত মুজাহিদের দল।
যুদ্ধের রসদ, খাদ্য দ্রব্যাদি, টাকাকড়ি প্রভৃতি যা আসতো তা বায়তুলমালে জমা করা হতো যার রক্ষক ছিলেন শাহ ওয়াছিউল্লাহর ভাইপো মুজাহিদ বাহিনীর কুতুব মওলানা মুহাম্মদ ইউসূফ। অতীব ন্যায়নিষ্ঠা, নিরপেক্ষতা ও সুশৃংখলতার সাথে রসদ ও টাকাকড়ি বন্টন করা হতো মুজাহিদ বাহিনীর মধ্যে। স্বয়ং সাইয়েধ সাহেবও একজন সাধারণ মুজাহিদের চেয়ে অধিক পরিমাণে কিছু পেতেন না।
অদৃষ্টের পরিহাস এই যে, আল্লাহর পথে উৎসর্গীকৃত এসব আল্লাহর প্রিয় বান্দাহদের মুকাবিলা করতে হতো ত্রিপক্ষের। শিখ, বিশ্বাসঘাতক পাঠান সরদার এবং হুন্দের দুর্গমালিক খাদে খাঁ –এ ত্রিশক্তি ছিল মুজাহিদ বাহিনীর দুশমন। এক সাথে এই তিন শক্তির মুকাবিলা তাঁদেরকে করতে হয়েছিল।
শিখদের সাথে যুদ্ধ বিগ্রহ প্রায় লেগেই থাকতো। বাংলা, বিহার ও মধ্য প্রদেশের মুজাহিদগণ বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করতেন। শিখ ও বিশ্বাসঘাতক পাঠানরা তাঁদের হাতে মার খেতো। পেশাওরের দুররানী সরদারগণও প্রকাশ্যে শিখদের সাথে যোগদান করলো এবং খাদ খাঁ স্থানীয় পাঠানদেরকে মুজাহিদগণের বিরুদ্ধে সব সময়ে ক্ষিপ্ত করে তুলতো।
এবার সাইয়েদ সাহেব খাদে খাঁকে শায়েস্তা করার জন্যে শাহ ইসমাইলকে মাত্র দেড়শত মুজাহিদসহ হুন্দ দুর্গ অধিকারের জন্যে পাঠান। রাত্রির অন্ধকারে হঠাৎ তাঁরা হুন্দ আক্রমণ করে তা দখল করেন এবং খাদে খাঁ নিহত হয়। খাদে খাঁর ভাই ইয়ার মুহাম্মদের সংগে মিলিত হয়ে বিরাট বাহিনীসহ হুন্দ দুর্গ পুনরুদ্ধারের জন্যে অগ্রসর হয়। ফলে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয় এবং ইয়ার মুহাম্মদ নিহত হয়। শত্রুপক্ষের বহু কামান হস্তাগত করা হয় এবং প্রচুর যুদ্ধ সরঞ্জাম ও মালামাল মুজাহিদ বাহিনীর হস্তগত হয়। কিন্তু স্থানীয় বাসিন্দাগণ তার অধিকাংশই লুণ্ঠন করে নিয়ে যায়। মুজাহিদ বাহিনীর প্রধান বিশ্বাসঘাতক দুশমন খাদে খাঁ, ইয়ার মুহাম্মদ খাঁ ও আমীর খানের মৃত্যুর পর এখন শুধু প্রতিদ্বন্দ্বী রইলো মিক ও পেশাওরের সুলতান মুহাম্মদ খান। হুন্দের যুদ্ধের পর সাইয়েদ সাহেব পেশাওরে ঘাঁটি স্থাপন করার মনস্থ করলে আম্বের পায়েন্দা খান বাধা দেয়। এখানেও মিক ও পাঠানদের মিলিত শক্তি মুকাবিলা মুজাহিদ বাহিনীকে করতে হয়। এখানেও তারা পরাজিত হয় এবং আম্ব থেকে মর্দান পর্যন্ত মুজাহিদ বাহিনীর অধিকার স্বীকৃত হয়। এখন পেশাওর পর্যন্ত অগ্রসর হতে তাঁদের আর কোন প্রতিবন্ধকতা রইলোনা।
সুচতুর সুলতান মুহাম্মদ অবস্থা বেগতিক দেখে সাইয়েদ সাহেবের হাতে বয়আন গ্রহণ করে এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে। সে ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী শাসন পরিচালনা করার অংগীকার করলে সাইয়েদ সাহেব তাকে ক্ষমা করেন এবং শাসন পরিচালনার দায়িত্ব তার উপরই অর্পিত হয়। মাওলানা জাফর থানেশ্বরী তাঁর ‘সীরাতে সাইয়েদ আহমদ শহীদ’ গ্রন্থে মন্তব্য করেন যে সাইয়েদ সাহেব তাঁর সরলতার দরুন নিঃস্বার্থভাবে সুলতান মুহাম্মদকে দায়িত্বভার দিয়ে ভুল করেছিলেন। অনেকেরে মনে প্রশ্ন জেগেছিল, কিন্তু সাইয়েদ সাহেবের কাজের প্রতিবাদ করার সাহস কারো হয়নি। শরিয়তের আইনে বিচারের জন্যে মওলানা শাহ মযহার আলীকে কাযী নিযুক্ত করা হয়।
সাইয়েদ সাহেব এবং তাঁর হাতে গড়া মুজাহিদগণের পদমর্যাদা লাভেল কোন বাসনা ছিল না। আল্লাহর দ্বীনের প্রতিষ্ঠা এবং সমাজ জীবনে খোদার আইন জারী করাই তাঁদের জীবনের লক্ষ্য ছিল। সুলতান মুহাম্মদের উপরে দায়িত্ব অর্পণ করার পেছনে সাইয়েদ সাহেবের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যও ছিল যার জন্যে বহিরাগত মুজাহিদগণের মধ্যে যোগ্য ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও তিনি স্থানীয় লোকের উপরই দায়িত্ব অর্পণ করেন। কারণ তাঁর উদ্দেশ্য ছিল শরিয়তের বিধান জারী করা, স্বয়ং ক্ষমতা উপভোগ করা নয়।
যাহোক, আপাতঃদৃষ্টিতে এক বিরাট অঞ্চলের উপর ইসলামী হুকমুত কায়েম হলো। সাইয়েদ সাহেব ইসলামী সমাজ ও ইসলামী কানুন প্রবর্তনের বিশেষ প্রচেষ্টা চালাতে লাগলেন। পেশাওর তথা সমগ্র সীমান্ত এলাকা জুড়ে প্রচারকদল নিয়োজিত হলো। তাঁরা গ্রামে গ্রামে ইসলামী জীবন বিধান ও শরিয়তের আইন কানুনের প্রচারে লিপ্ত হলেন।
কিন্তু দুঃখের বিষয় স্থানীয় অধিবাসীগণ ছির দরিদ্র, অজ্ঞ, অর্থলোভী ও বহুদিনের জাহেলী কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ। প্রচারকগণ যখন তাদের এসব কুসংস্কার পরিহার করে ইসলামী জীবন যাপনের আহবান জানাতে লাগলেন, তখন তাদের পারিবারিক, পারিপার্শ্বিক, গোত্রীয় ও অর্থনৈতিক স্বার্থে চরম আঘাত লাগে। ফলে তারা শুরু করলো অসহযোগ। অজ্ঞতা ও কুসংস্কার সঞ্জাত ক্ষমতা ও অর্থলোভী মোল্লাহর দলও করলো তীব্র বিরোধিতা। তার ফলে স্থানীয় অধিবাসীগণ সাইয়েদ সাহেবের বিরুদ্ধে একটা অন্ধ আক্রোশে ফেটে পড়লো। বিশ্বাসঘাতক সুলতান মুহাম্মদও তাই চাইছিল এবং সে এর পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করলো। অতি গোপনে সমগ্র অঞ্চলে এক গভীর ষড়যন্ত্রজাল ছড়ানো হলো এবং একই দিনে একই সময়ে ফজরের নামাযের সময় নামাযে রত মুজাহিদ প্রচারকদলকে নির্মমভাবে নির্মূল করা হলো। একজন অলৌকিকভাবে আত্মরক্ষা
করে এবং পলায়নকরতঃ সাইয়েধ সাহেবের নিকটে ঘটনা বিবৃত করেন।
সাইয়েধ সাহেব অত্যন্ত মর্মাহত হন। একই আঘাতে তাঁর কয়েকশত আল্লাহর পথে উৎসর্গীকৃত কর্মী জীবন হারালেন। একটা আদর্শ ইসলামী সমাজ গঠনের আশাও তাঁর বিলীন হয়ে গেল। তিনি বিশ্বাসঘাতক ও নিমকহারামদের দেশ পরিত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাওয়ার মনস্থ করলেন।
জাফর থানেশ্বরী বলেন, সাইয়েদ সাহেব অতঃপর তাঁর কর্মীগণকে একত্র করে বলেন, “আমার চূর্ণবিচূর্ণ হয়েছে। পাঠানরা চরম বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। ইসলামী সমাজ গঠনের কোন আশা আর এখানে নেই। এখন আমার জন্যে হিজরত করা ব্যতীত গত্যন্তর নেই। আমি বালাকোট গিলগিট পথে অন্য দেশে চলে যাব। আল্লাহ তৌফিক দিলে আবার এ কাজে হাত দিব। আমি যে পথে অগ্রসর হতে চাই সে পথ বড়োই দুর্গম, পদে পদে বিপদের আশংকা রয়েছে। এ পথে চলার জন্যে তোমাদেরকে আহবান জানাব না। তোমরা ইচ্ছা করলে যে যার গৃহে প্রত্যাবর্তণ করতে পারো”।
তখন সকলেই এক বাক্যেই বলেছিলেন, ‘জেহাদে পা বাড়িয়ে পশ্চাদপদ হওয়া ঈমানের খেলাপ। আমরা সর্বাবস্থায় হুজুরের অবিচ্ছেদ্য সংগী হয়ে থাকতে চাই’।
অতঃপর সাইয়েদ সাহেব তাঁর অবশিষ্ট মুজাহিদগণ সহ বালাকোটের দিকে যাত্রা করেন। এ সময়ে শের সিংহের সৈন্য বাহিনী মুজাহিদগণের মুখোমুখী ছিল।
সাইয়েদ সাহেব বালাকোট থেকে নওয়াব উযীরউদ্দৌলাকে যে পত্র লিখেন তার মর্ম নিম্নরূপ-
“পেশাওয়ারের লোকেরা এমনই হতভাগ্য যে, তারা জেহাদে আমাদের মুজাহিদ বাহিনীর সংগে যোগ দিল না। উপরন্তু তারা প্রলোভনে পড়ে গেল এবং সারা দেশময় নানা কাজে আমাদের যেসব মহৎ লোক ব্যস্ত ছিলেন, তাঁদের অনেককেই হত্য করে ফেল্লো। …সেখানে আমাদের অবস্থানের আসল উদ্দেশ্য ছিল যে বিধর্মীদের বিরুদ্ধে জেহাদে বহু সংখ্যক স্থানীয় মুসলিমের সাহায্য ও সহানুভূতি পাওয়া যাবে। বর্তমানে যখন আর কোনও আশা নাই, তখন আমরা স্থির করলাম যে, সেখান থেকে পাখলীর পাহাড়ী অঞ্চলেই স্থান বদল করব। দুশমনরা আমাদের সন্ধানও পাবে না। ইসলামের তরক্কীর জন্যে ও মুজাহিদ বাহিনীর সাফল্যের জন্যে আল্লাহর দরবাবের দিনরাত মুনাজাত করতে থাকুন”।
-(ওহাবী আন্দোলন, আবদুল মওদূদ, পৃঃ ১৬৪)
সাইয়েদ সাহেব তাঁর মুজাহিদ বাহিনীসহ বালাকোটের সৌন্দর্য মন্ডিত উপত্যকা বিশ্রামের জন্যে বেছে নিয়েছিলেন। পূর্ব দিক দিয়ে কুনহার বা কাগান পাহাড়ী নদী অবিরাম কুল কুল তানে বয়ে চলেছে। উত্তর পশ্চিম দিক থেকে সংকীর্ণ পাহাড়ী ঝর্ণা বার্না বড়ো বড়ো উপল খন্ডের ভেতর লুকোচুরি খেলতে ঝর্ণার উত্তর দিকে প্রশান্ত নূরী ময়দান। প্রকৃতির এ লীলা ক্ষেত্রে প্রবেশ করলে মনে হয় কে যেন জীবন নদীর পরপার থেকে হাতছানি দিচ্ছে। রণক্লান্ত মুজাহিদগণ বিশ্রামের জন্যে এখানে ছাউনী পাতলেও পরপারের হাতছানি হয়তো তাঁদের দৃষ্টির অগোচর হয়নি। তাই বিশ্রাম তাঁদের ভাগ্যে ঘটেনি।
ওদিকে শিখরা মুজাহিদ বাহিনীর সন্ধানে ছিল। তারা মনে করেছিল সাইয়েদ সাহেবের লক্ষাধিক মুজাহিদের কয়েক’শ মাত্র টিকে রয়েছে এবং তারা হয়ে পড়েছে হতোদ্যম। এ সুযোগেই তাদের আঘাত হানতে হবে।
সে সময়ে বালাকোটে যাওয়ার দুটি মাত্র পথ ছিল। একটি ছিল এমন পাহাড়ী বনজংগলে পরিপূর্ণ যে স্থানীয় লোক ব্যতীত সে পথে চলা অত্যন্ত বিপজ্জনক। অপর পধটি ঝিল একটি সংকীর্ণ গিরিসংকটের মধ্য দিয়ে ও একটি সেতুর উপর দিয়ে। এ দুইটি পথে অবশ্যি পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু কয়েকজন বিশ্বাসঘাতক মোটা অর্থের লোভে অরণ্য সংকুল পথটিই শিখদের দেখিয়ে দেয়। ফলে তারা অতর্কিতে মুজাহিদ বাহিনীকে ঘিরে ফেলে। মুজাহিদ বাহিনী সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত থাকলেও বীর বিক্রমে যুদ্ধ করেন। সাইয়েদ আহমদ
, শাহ ইসমাইল ও সাইয়েদ সাহেবের অন্যান্য প্রধান সহকর্মীগণ জেহাদ করতে করতে শাহাদত বরণ করেন।
আবদুল মওদূদ বলেণ, “তাঁর অনুসৃত বৃহৎ আন্দোলন স্তব্ধ আন্দোলন স্তব্ধ হয় নাই। এই নিধন যজ্ঞের পরেও যাঁরা বেঁচে ছিলেন, তাঁদের অনেকেই টংকে অথবা বিহার শরীফের ছাতানায় সাইয়েদ সাহেবের বিশ্বস্ত খাদেমের নেতৃত্বে এই আন্দোলনের কেন্দ্রস্থল স্থাপন করলেন। পরবর্তীকালে পাঞ্জাবের সাম্রাজীবাদী ইংরেজরা যখন শিখদের ন্যায় অত্যাচার শুরু করে, তখন মুজাহিদদের সর্বরোষ তাদের উপর উদ্যত হয়। কিন্তু তাদের ভাগ্যে জোটে কারাবাস, উৎপীড়ন ও ফাঁসিকাষ্ঠে মৃত্যুবরণের নির্মম শাস্তি এবং তার চেয়েও হীনতম ছিল নিম্নশ্রেণীর মোল্লা ও তথাকথিত আলেকমের দ্বারা এসব সংগ্রামী অগ্রপথিকদের নামে অযথা কুৎসা রটনা ও মিথ্যা ভাষণ”।
তিনি আরও বলেন, “এখন সময় এসেছে এসব বীর মুজাহিদের গৌরবোজ্জ্বল অসমসাহসিক কার্যবলীকে স্বীকৃতি দেয়া ও শ্রদ্ধা করা, কারণ তাঁরাই প্রকৃত পক্ষে এই উপমহাদেশে বহু পূর্বেই পাকিস্তানের বুনিয়াদ স্থাপনের মাধ্যমে সব রকম অন্যায়ের বিরুদ্ধে জেহাদ করেছিলেন। যদিও সাইয়েদ সাহেবের প্রতিষ্ঠানের মারফৎ পাকিস্তান হাসিল হয় নাই, তবুও একথা অনস্বীকার্য যে, তার মধ্যেই ছিল বীজমন্ত্র; আর ওয়াকিফহাল ব্যক্তিমাত্রই হৃদয়ংগম করবেন যে রায় বেরেলীর সাইয়েদ আহমদ শহীদের দান ছিল এই চেতনা উজ্জীবনে অপরিসীম”।
-(ওহাবী আন্দোলন, আবদুল মওদূদ, পৃঃ ১৬৫-১৬৬)
উপরে বলা হ’য়েছে যে, সাইয়েদ আহমদ শহীদের জেহাদী আন্দোলনে বাংলাদেশ থেকে কয়েক সহস্র মুজাহিদ ও বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রেরিত হয়। রায় বেরেলী থেকে জেহাদের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবার সময়ে বাংলাদেশের অনেকে সাইয়েদ সাহেবের সাথী হয়েছিলেন এবং জিহাদ চলাকালেও যেমন বাংলাদেশ থেকে প্রচুর অর্থ স্মপদ সীমান্তে পৌঁছেছে তেমনি পৌঁছেছে হাজার হাজার মুজাহিদ।
গোলাম রসূল মেহের বলেন –বিভিন্ন পথে মুজাহিদগণ দলে দলে সাইয়েদ সাহেবের সংগে মিলিত হন। এমনি একটি দলে ছিলেন মৌলভী ফতেহ আলী আযীমাবাদী। তিনি তাঁর দলের যে তালিকা পেশ করেন, অবশ্য যাদের নাম তাঁর স্মরণ ছিল, তাদের মধ্যে ছ’জন বাংলাদেশের ছিলেন। তাঁদের নামঃ
১। মৌলভী ইমামুদ্দীন
২। জহুরুল্লাহ
৩। লুৎফুল্লাহ
৪। তালেবুল্লাহ
৫। ফয়েজউদ্দীন
৬। কাজী মদনী
(সাইয়েধ আহমদ শহীদ, গোলাম রসূল মেহের, পৃঃ ৪১২ পরিশিষ্ট) শিখ ও পাঠানদের সংগে মুজাহিদগণের প্রায় এগার বারটি প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়েছে। এসব যুদ্ধে অবশ্যই মুজাহিদগণের অনেকেই শহীদও হয়েছেন। তাঁদের নাম এবং একদিন ফজরের নামাযে তাদের যে কয়েকশতকে শহীদ করা হয়েছে, তাঁদেরও নামধাম জানা যায়নি। তবে বালাকোটে যাঁরা শহীদ হয়েছিলেন তাঁদের একটি নামের তালিকা পেশ করেছেন –গোলাম রসূল মেহের। তাঁর প্রদত্ত তালিকা অনুযায়ী বালাকোটে সর্বমোট একশ পঁয়ত্রিশ জন মুজাহিদ শহীদ হয়েছিলেন। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন বাংলাদেশের। তাঁদের নাম হলো, আলীমুদ্দীন, ফয়েজউদ্দীন, লুৎফুল্লাহ, শরফুদ্দীন, সাইয়েদ মুজাফফর হোসেন। উক্ত তালিকায় কাদের বখশ, আবদুল কাদের, গাজীউদ্দীন ও বখশউল্লাহ –এ চারটি নাম স্থান পেয়েছে। কিন্তু তাঁরা কোথাকার অধিবাসী তা দেয়া হয়নি। শুধু বখশউল্লাহর নামের শেষে বলা হয়েছে ‘মেহের আলীর ভাই’। -(সাইয়েদ আহমদ শহীদ গোলাম রসূল মেহের, পৃঃ ৪৩২-৩৪)
সীমান্তে যখন সারা ভারত থেকে আগত মুজাহিদগণ জেহাদে লিপ্ত ছিলেন, ঠিক সে সময়েই সাইয়েদ নিসার আলী ওরফে তিতুতীর হিন্দু জমিদার
, নীলকর ও ইংরেজদের বিরুদ্ধে জেহাদে লিপ্ত ছিলেন। তিতুমীর সাইয়েদ সাহেবের মুরীদ ছিলেন। কিন্তু স্বদেশেই তিনি এমনভাবে জড়িত হয়ে পড়েছিলেন যে,
সাইয়েদ সাহেবের সান্নিধ্যে থেকে শাহাদৎ বরণ করার সৌভাগ্য তার হয় নি। তবে যে পথে তাঁর মুর্শেদ খোদার সাথে মিলিত হন, সেই পথই অনুসরণ করেন শহীদ তিতুমীর। ১৮৩১ সালের ৬ই মে রোজ শুক্রবার প্রায় দুপুরের দিকে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠতম মুজাহিদ সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী (রহ) শাহাদৎ বরণ করেন। ১৯৩১ সালের ১৯শে নভেম্বর ইংরেজ সৈন্যদের কামানের গোলায় শাহাদৎ বরণ কনের সাইয়েদ তিতুমীর।
বালাকোট বিপর্যয়ের কারণ
সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর নেতৃত্বে শাহ মুহাম্মদ ইসমাইল, মওলানা আবদুল হাই প্রমুখ মনীষীগণ ভারতে ইসলামী আযাদী তথা ইসলামী হুকুমত বা শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের যে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন এবং যে আন্দোলন সাফল্যের দুয়ার পর্যন্ত এগিয়ে ব্যর্থতার সম্মুখীন হলো, তার কারণ অবশ্যই অনুসন্ধান করে দেখা আমাদের উচিত। কারণ অতীত ইতিহাসের চুলচেরা বিচার ও পরীক্ষা নিরীক্ষায় ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা সঠিকভাবে নির্ণীত হতে পারে। চিন্তাশীল মনীষীগণ উপরোক্ত আন্দোলনের ব্যর্থতার যে কারণসমূহ বর্ণনা করেছেন তা সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক। তবে সাময়িকবাবে এ আন্দোলন ব্যর্থ হলেও এর প্রতিক্রিয়া ছিল সুদূর প্রসারী। সাইয়েদ আহমদ শহীদ যে খুনরাঙা পথে চলার দুর্বার প্রেরণা দিয়ে গেলেন ভারতীয় মুসলশানদেরকে, বাংগালী, বিহারী, পাঞ্জাবী, সিন্ধী, পাঠান নির্বিমেষে ভারতীয় মুসলমানগণ সে খুনরাঙা পথে অবিরাম চলেছে প্রায় শতাব্দীকাল পর্যন্ত। জেল-জুলুম, ফাঁসি, দ্বীপান্তর, স্থাবর, অস্থাবর সম্পদের বাজেয়াপ্তকরণ, অমানুষিক ও পৈশাচিক দৈহিক নির্যাতন ক্ষণকালের জন্যেও তাদেরকে এ পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তথাপি এ আন্দোলনের নেতা স্বয়ং নিজের জীবদ্দশায় কেন এ সাফল্য দেখে যেতে পারেননি, তার কারণও আমাদের চিহ্নিত করা দরকার। প্রধান কারণগুলি নিম্নরূপ বলে অনেকেই অভিমত প্রকাশ করেছেন।
১। ইসলামী আন্দোলন তথা আল্লাহর পথে জেহাদ পরিচালনার জন্যে যে কর্মীবাহিনীর প্রয়োজন, তাদের প্রত্যেকের চরিত্র হতে হবে নির্ভেজাল ইসলামী আদর্শে গড়া। তাদেরকে হতে হবে আল্লাহর পথে উৎসর্গীকৃত। সাইয়েদ সাহেব বাইরে থেকে যে মুজাহিদ বাহিনী সাথে নিয়ে গিয়েছিলেন, নিঃসন্দেহে তাঁরা উক্ত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। এবং তাঁরাও অনুরূপ চরিত্রে চরিত্রবান ছিলেন, উক্ত চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। এবং তাঁরাও অনুরূপ চরিত্রে চরিত্রবান ছিলেন, যাঁরা জেহাদ চলাকালে বাংলা, বিহার, মধ্য প্রদেশ প্রভৃতি অঞ্চল থেকে একমাত্র খোদার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আত্মীয়স্বজন, আপন ঘরদোর, ক্ষেত-খামার ছেড়ে সাইয়েদ সাহেবের মুজাহিদ বাহিনীতে গিয়ে যোগদাক করেছিলেন। কিন্তু এঁদের সংখ্যা এক থেকে দু’হাজারের মধ্যেই ছিল সব সময়ে সীমিত। জেহাদের জন্যে সাইয়েদ সাহেবের জ্বালাময়ী ভাষণ শুনে এবং প্রথম দিকে শিখদের উপরে অপ্রত্যাশিত বিজয়লাভ দেখে দলে পাঠানরা সাইয়েদ সাহেবের দলে যোগদান করে। কিন্তু তাদের সত্যিকার কোন ইসলামী চরিত্র ছিল না। তাদের মধ্যে ইসলামী প্রেরণা ও জোশ ছিল প্রচুর। কিন্তু তাদের অধিকাংশই ছির দরিদ্র, অজ্ঞ, অর্থলোভী এবং বহুদিনের পুঞ্জীভূত কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ। যারা ছিল সরদার অথবা গোত্রীয় শাসক, তারাও ছিল অত্যন্ত স্বার্থপর ও সুবিধাবাদী। কোন কোন সময়ে মুজাহিদ বাহিনীর সংখ্যা তিন লক্ষ পর্যন্ত পৌঁছেছে। এরা প্রায় সবই বিভিন্ন পাঠান গোত্রের লোক। এরা অর্থলোভে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, চরম মুহুর্তে প্রতিপক্ষ শিখ সৈন্যদের সংগে যোগদান করেছে। অথবা মুজাহিদ বাহিনীর সাথে যুদ্ধ করা কালীন শুধু গনিমতের মাল লুণ্ঠনে লিপ্ত হয়ে বাহিনীর মধ্যে শৃংখলা ও নিয়মতান্ত্রিকতা ভংগ করেছে। অন্ধ ব্যক্তিস্বার্থ ও অর্থলোভের প্রবল প্লাবনে তাদের জলবুদবুদদসম ইসলামী প্রেরণা ও জোশ ভেসে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
২। স্বয়ং সাইয়েধ সাহেব ও শাহ ইসমাইল দুর্ধর্ষ বীরযোদ্ধা ও রণকৌশলী থাকা সত্ত্বেও গোটা মুজাহিদ বাহিনীকে তৎকালীন যুদ্ধ বিদ্যায় প্রশিক্ষণ দেয়া হয়নি।
৩। বিশ্বাসঘাতক ও চরিত্রহীন পাঠানদের প্রতি পূর্ণমাত্রায় আস্থা স্থাপন করাও ঠিক হয়নি। যে সুলতান মুহাম্মদ খাঁ এবং তার ভ্রাতৃবৃন্দ সাইয়েধ সাহেবের চরম বিরোধিতা করত, সেই সুলতান মুহাম্মদের উপরে পেশাওরের শাসনভার অর্পণ করাও ঠিক হয়নি। সুলতান মুহাম্মদই শেষ পর্যন্ত আন্দোলনের উপর চরম আঘাত করে এবং একই রাতে এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে সাইয়েদ সাহেবের কয়েকশ’ বাছা বাছা মুজাহিদের প্রাণনাশ করে। যার ফলে সাইয়েদ সাহেবকে পেশাওর থেকে পশ্চাপসরণ করতে হয়।
৪। স্থানীয় পাঠানদের আল্লাহর পথে জীবন দানের চেয়ে জীবন বাঁচিয়ে পার্থিব স্বার্থলাভই উদ্দেশ্য ছিল। তাই যুদ্ধকালে তারা সত্যিকার মুজাহিদগণকে পুরোভাগে থাকতে বাধ্য করতো এবং নিজেরা যথাসম্ভব নিশ্চেষ্ট থাকতো এবং লুণ্ঠনের সুযোগ সন্ধান করতো।
৫। দেশের অধিকার লাভ করার পর শরিয়ত- আইন কার্যকর করার ব্যাপারেও হিকমতের পরিপন্থী কাজ করা হয়েছে। জনসাধারণের মধ্যে বহু দিনের নানাবিধ কুসংস্কার এমন শক্তভাবে দানা বেঁধে ছিল যে, শরিয়ত-আইন কার্যকর করতে গিয়ে তাদের সেসব কুসংস্কারে চরম আঘাত লাগে। যেসব অশিক্ষিত মোল্লার দল এসব কুসংস্কার জিইয়ে রেখে তাদের জীবিকা অর্জন করছিল তারা হয়ে পড়েছিল ক্ষিপ্ত। সুবিধাবাদী সরদারগণও এর সুযোগ গ্রহণ করেছিল। অতএব জনসাধারণ, মোল্লার দল এবং সরদারগণ একযোগে বিরোধিতা শুরু করে মুজাহিদগণের। প্রথমে উচিত ছিল জনগণের চরিত্রের সংস্কার সংশোধনের কাজ শুরু করা এবং মনমস্তিস্ক শরিয়তী আইন মেনে চলার উপযোগী হলে তা ক্রমশঃ কার্যকর করা। জনসাধারণ অবশ্য ছিল ইসলামেই দৃঢ় বিশ্বাসী এবং আযাদী সংগ্রামের নির্ভীক যোদ্ধা, কিন্তা তাদের সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবন প্রাকইসলামী “আইয়ামে জাহেলিয়াতের” চেয়ে কোন অংশেই উন্নত ছিল না।
স্থানীয় জনসাধারণ ও আধিবাসীদের মধ্যে এমন সব কুপ্রথা প্রচলিত চিল যা ছিল ইসলামী শরিয়তের সম্পূর্ণ খেলাপ। যেমন, যাকে খুশী তাকে বলপূর্বক বিয়ে করা, বিয়ের জন্যে কন্যা উচ্চমূল্যে বিক্রয় করা
, বিধবাদেরকে মৃতের ওয়ারিশানের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দেয়া, চারের অধিক স্ত্রী গ্রহণ করা, বিধবা বিবাহ না দেয়া, মৃতের নাজাতের জন্যে মোল্লাদেরকে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ দেয়া প্রভৃতি। সাইয়েদ আহমদ যে শরিয়তী আইন জারী করেন তার মধ্যে ছিল –শরিয়ত বিরুদ্ধ সকল প্রকার আচার অনুষ্ঠান, রীতিনীতি ও প্রথা একেবারে বাতিলযোগ্য। শরিয়তী আইনের মধ্যে আরও ছিল যে, দেওয়ানী ও ফৌজদারী মামলার নিষ্পত্তির জন্যে শরিয়তী আদালত প্রতিষ্ঠিত হবে, উৎপন্ন ফসলের ‘ওশর’ বা দশমাংশ ও যাকাত আদায়ের পর তা বায়তুলমালে জমা হবে, এ বায়তুলমাল থেকে মুজাহিদ ও অন্যান্যের মধ্যে সমানভাবে বন্টন করা হবে, আদিবাসী ও উপজাতীয়দের মধ্যে কোন বিরোধ সৃষ্টি হলে তার চরম নিষ্পত্তির অধিকার থাকবে একমাত্র খলিফার, একটি পুলিশ বিভাগ স্থাপন করা হবে যার কাজ হবে জনগণের ধর্মীয় ও নৈতিক জীবন নিয়ন্ত্রণ করা, প্রত্যেক মুসলমানকে সিয়াম (রোযা) ও সালাত (নামায) পালনে বাধ্য করা। এ ধরনের আরও অনেক গঠনমূলক ও কল্যানমুখী আইন জারী করা হয়। নিঃসন্দেহে এ ছিল এক আদর্শিক পদ্ধতি যা নবী মুস্তাফা ও খোলাফায়ে রাশেদীনের কর্মপদ্ধতি অনুকরণেই গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু আদিবাসী, উপজাতীয় পাঠান, জনসাধারণ ও মোল্লার দল এগুলোকে মেনে নেবে এমন মনমস্তিষ্ক তাদের গড়ে উঠেনি। অতএব শরিয়তী আইন পর্যায়ক্রমে না করে হঠাৎ তাদের উপর চাপিয়ে দেয়াতে তারা তা মানতে অস্বীকার করে।
আদিবাসী পাঠানদের বিরোধিতার আর একটি প্রধান কারণ ছিল, শান্তি ও শৃংখলার জন্যে সকলকে একটি কেন্দ্রীয় কর্তৃত্বের অধীন করা হয়েছিল। কিন্তু আদিবাসী পাঠানদের মজ্জাগত প্রবৃত্তিই চিল কারও হুকুমের অধীন না হওয়া। তাদের নিকটে আযাদী ছিল বল্গাহীন স্বেচ্ছাচারিতা। কিন্তু কোনও সভ্য সরকার যখন আইন-শৃংখলা খাতিরে তাদের স্বেচ্ছাচারিতা নিয়ন্ত্রণ করতে চাইলো তখন তারা ইসলামী হুকুমানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহাত্মক মনোভাব পোষণ করলো।
আবদুল মওদূদ বলেন, “এ রকম পরিস্থিতিতে সহসা ‘শরিয়তী আইন প্রবর্তন কতদূর সমীচীন হয়েছিল, বিবেচনার যোগ্য। ইতিহাসের শিক্ষা ও দূরদর্শিতার মাপকাঠিতে বিচার করলে মনে হয়, এই পরিবর্তন সাধন সম্ভব হয় না। ক্রমে ক্রমে জাতীয় জীবনের ধারাকে পরিবর্তিত ও সংশোধিত করতে হয় লোকমানসের সাথে উপযোগী করে গড়ে তুলবার চেষ্টা করে। লোকমানসকে উপেক্ষা করে রাতারাতি তার পরিবর্তন করতে গেলে সংশয় ও মানসিক দ্বন্দ্বের ফলে জনমন তার প্রতি বিমুখই হয়ে উঠে, অন্তরের সংগে তা গ্রহণ করতে পারে না। লোকমানস ও পরিবেশকে অবহেলা করে দ্রুত জীবনধারার পরিবর্তন সাধনের প্রচেষ্টা বহু ক্ষেত্রেই বেদনাদায়কভাবে ব্যর্থ ও নিস্ফল হয়ে গেছে”।
-(ওহাবী আন্দোলন, আবদুল মওদূদ, পৃঃ ১৭৭)
অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো সর্বোৎকৃষ্ট জেহাদ –এ ছিল বিশ্বনবীর দৃপ্ত ঘোষণা। বাংলায় উৎপীড়নমূলক কোম্পানী শাসনে এবং হিন্দু জমিদার, মহাজন, নীলকর ও তাদের দেশী দালালদের অত্যাচার উৎপীড়নে মুসলমান সমাজ যখন বিলুপ্তির পথে, তখন তাদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন হাজী শরীয়তুল্লাহ এবং তারপর সাইয়েদ আহমহ বেরেলভীর সুযোগ্য খলিফা সাইয়েদ নিসার আলী ওরফে তিতুমীর। অনুরূপবাবে বিদেশী ও বিধর্মী ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে ব্যাপক কর্মসূচীর জেহাদ ঘোষণা করেন সাইয়েদ আহমদ। এ ছিল একজন সত্যিকার মুসলমানের ঈমানের দাবী। হিজরত, জিহাদ অথবা শাহাদাত –এ তিনের যে কোন একটি গ্রহণেই একজন মুসলমান ঈমানের স্বাক্ষর বহন করেন। তাই মওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর বলেছিলেন
–মুসলমানের জীবন কাহিনরি বিস্তৃতি মাত্র তিনটি অধ্যায়েঃ- হিজরত, জেহাদ ও শাহাদত। সাইয়েদ আহমদ ও শাহ ইসমাইলের জীবন এই তিনটি অধ্যায়ের মূর্ত প্রতীক।
বালাকোটের বিপর্যয়ের পর
বালাকোট প্রান্তরে মুজাহিদগণ চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হলেও এবং মুজাহিদ বাহিনীর পরিচালক সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী ও শাহ ইসমাইল অন্যান্যের সাথে শাহাদৎ বরণ করলেও যাঁরা গাজী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেছিলেন তাঁদের কর্মতৎপরতা মোটেই হ্রাস পায়নি। এদের অনেকেই ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে জেহাদী আন্দোলন জাগ্রত রাখেন যার পরিসমাপ্তি ঘটে ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লব তথা সারা ভারতব্যাপী আযাদী আন্দোলনে। এ আন্দোলন স্তব্ধ হয়ে যায়নি ১৮৫৭ সালে, বরঞ্চ ১৮৬৮ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকারকে বিব্রত ও বিপন্ন করে রেখেছিল। এ আন্দোলনের পুরোভাগে ছিলেন –মওলানা বেলায়েত আলী, মওলানা মাহমুদুল্লা, সুফী নূল মুহাম্মদ নিযামপুরী প্রমুখ সাইয়েদ আহমদ শহীদের খলিফাগণ। তাঁদের সম্পর্কে কিঞ্চিত আলোচনা না করলে জেহাদী আন্দোলনের পূর্ণাংগ চিত্র পরিস্ফুট হবে না।
মওলানা বেলায়েত আলী
মওলানা বেলায়েত আলী ছিলেন পাটনার মওলভী ফতেহ আলীর পুত্র এবং তথাকার প্রসিদ্ধ আমীর রফিউদ্দিন হুসাইন খানের বংশধর। প্রচুর ঐশ্বর্যের কোলে লালিত পালিত হন বেলায়েত আলী। তাঁর কৈশোর ও যৌবনকাল অতিবাহিত হয় আমীর ওমরাহদের গৌরবমন্ডিত শহর লক্ষ্ণৌ-এ। এ সময়ে যখন সাইয়েদ আহমদ জেহাদের দাওয়াত পেশ করতে লক্ষ্ণৌ আসেন, তখন বেলায়েত আলী তাঁর বিলাসবহুল জীবন পরিত্যাগ করে জেহাদের ডাকে সাড়া দেন এবং রায়-বেরেলী গমন করেন। এখানে তিনি মওলানা শাহ মুহাম্মদ ইসমাইলের নিকট হাদীদস শাস্ত্র অধ্যয়ন করতে থাকেন এবং বিলাসী জীবনের পরিবর্তে ফকিরী জীবন যাপন করতে শুরু করেন। তিনি সাইয়েদ আহমদ শহীদের সাথে মিলে রাজমিস্ত্রীর কাজ করতেন এবং বনজংগল থেকে কাঠ সংগ্রহ করে নিজ হাতে রান্নার কাজ করতেন। আল্লাহর পথে এমন উৎসর্গকৃত প্রাণকে সাইয়েদ সাহেব অত্যন্ত ভালোবাসতেন। তিনি যখন হজ্বের উদ্দেশ্যে মক্কা গমন করেন
, তখন তিনি তাঁকে তাঁর স্থলাভিষিক্ত নিযুক্ত করে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব অর্পণ করেন। সাইয়েদ সাহেবের নির্দেশে তিনি দু’মাস যাবত আফগানিস্তানে প্রচার কার্য চালান। জনৈক মওলানা মুহাম্মদ আলীসহ তিনি সোয়াত, হায়দরাবাদ ও দাক্ষিণাত্যে প্রচার কার্য চালাতে থাকেন। তিনি দাক্ষিণাত্যে অবস্থানকালে সাইয়েদ সাহেব বালাকোটে শাহাদৎবরণ করেন।
বালকোটের বিপর্যয়ের পর মাওলানা বেলায়েত আলী ব্রিটিশ ভারতে প্রবেশ করে সাইয়েদ সাহেবের অসম্পূর্ণ কাজে হাত দেন। তিনি বিভিন্ন ব্যক্তিকে বিভিন্ন স্থানে প্রচার কার্যেপ্রেরণ করেন। তিনি তাঁর সহোদর ভাই মওলানা এনায়েত আলীকে পাঠান বাংলায়। মাওলানা যয়নুল আবেদীন ও মওলানা আব্বাস আলীকে তিনি যথাক্রমে উড়িষ্যা ও যুক্ত প্রদেশে মুবাল্লেগ নিযুক্ত করেন।
পাটনার কেন্দ্রীয় দপ্তর স্থাপন করতঃ মওলানা বেলায়েত আলী প্রচার কার্য শুরু করেন। দু’বৎসর পর তিনি হজ্বের উদ্দেশ্যে মক্কা গমন করেন। হজ্বের পর তিনি ইয়ামেন, নজদ, মাসকত, হাদারামওত প্রভৃতি স্থান সফর করেন। এ সময়ে তিনি প্রসিদ্ধ মুহাদ্দিস কাজী মুহাম্মদ ইবনে আলী শওকানীর নিকটে হাদীস শাস্ত্রে সনদ লাভ করেন।
আরব থেকে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি তাঁর ভ্রাতা এনায়েত আলীর নেতৃত্বে একটি মুজাহিদ বাহিনীকে গোলাব সিংহের বিরুদ্ধে জেহাদের জন্যে সীমান্তে প্রেরণ করেন। অবস্থা বেগতিক দেখে গোলাব সিংহ ব্রিটিমের সাথে সন্ধিচুক্তিতে আবদ্ধ হয়। ফলে সীমান্তের মুসলমানদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব শুরু হয় এবং এনায়েত আলীর মুজাহিদ বাহিনী ছত্রভংগ হয়।
সীমান্ত অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর মওলানা বেলায়েত আলী লাহোরে প্রত্যাবর্তন করেন। লাহোরের পুলিশ কমিশনার মওলনা ভ্রাতৃদ্বয়কে সকল প্রকার কর্মতৎপরতা থেকে বিরত থেকে দু’বৎসরের জন্যে একটি মুচলেকায় স্বাক্ষর করতে বাধ্য করেন। অতঃপর তাঁরা পাটনায় প্রত্যাবর্তণ করে ইসলাম প্রচারের কাজ শুরু করেন।
মুচলেকার দু’বৎসক মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পর মওলানা বেলায়েত আলী হিজরতের উদ্দেশ্যে কতিপয় সহকর্মীসহ পাটনা থেকে দিল্লী গমন করেন। এ সময়ে দিল্লী জামে সমজিদে এবং ফতেহপুর মসজিদে ইসলামের দাওয়াত পেশ করতে থাকেন। এ হচ্ছে ১৮৫৭ সালের আযাদী আন্দোলনের মাত্র কয়েক বৎসর পূর্বের ঘটনা। এ সময়ে তিনি বাহাদুর শাহের আমন্ত্রণে লালকেল্লায় একবার তাঁর সাথে সাক্ষাত করেন।
দিল্লীতে কিছুকাল অবস্থানের পর মওলানা বেলায়েত আলী লুধিয়ানা হয়ে পাঞ্জাব সীমান্তের সিত্তানায় গমন করেন। সিত্তানা ছিল মুজাহিদ বাহিনীর বড়ো কেন্দ্র। এখানে একটি খানকাহ ও মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। খানকাহ অর্থে মুজাহিদগণ বুঝতেন তাদের অভিযান কেন্দ্র। পাটনাকে বলা হতো ছোট খানকাহ এবং সিত্তানাকে বড়ো খানকাহ। ছোটো খানকাহ থেকে অর্থ, রসদ, মুজাহিদ বড়ো খানকাহ প্রেরিত হতো।
মওলানা বেলায়েত আলী সিত্তানায় পৌঁছে দেখেন যে তথাকার কর্মচাঞ্চল্য অনেকটা হ্রাস পেয়েছে। তিনি ছিলেন অনলবর্ষী বক্তা। তিনি মুজাহিদ বাহিনীর মধ্যে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি করেন।
এ সময়ে মওলানা বেলায়েত আলীর বিরুদ্ধে একটাব্রিটিশ সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্র মামলা আনয়ন করা হয়। মামলা চলাকাল তাঁর পাটনা সাদেকপুরস্থ দুটি বাসভবন ও বাগানবাড়ীসহ কয়েক লক্ষ টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়। গৃহের অধিবাসীগণকে এবং বিশেষ করে শিশু ও নারীদিগকে নিঃসম্বল ও নিরাশ্রয়ে করে দেয়া হয়। ১৮৫৩ সালে তিনি রোগাক্রান্ত হয়ে প্রাণত্যাগ করেন।
মওলানা বেলায়েত আলী ও মওলানা এনায়েথ আলী ভ্রাতৃদ্বয় সম্পর্কে হান্টার তাঁর দি ইন্ডিয়ান মুসলিম প্রতিবেদনে বলেন যে, উক্ত খলিফাদ্বয় (মওলানা বেলায়েত আলী ও মওলানা এনায়েত আলী) পাঞ্জাবে মুজাহেদীন বলে সুপরিচিত ছিলেন এবং সেজন্যে তাঁদেরকে গ্রেফতার করে পুলিশের হেফাজতে পাটনায় পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। ম্যাজিস্ট্রেট তাঁদের নিকট থেকে এবং তাঁদের স্বধর্মীয় দুজন উচ্চ বিত্তশালী লোকের নিকট থেকে ভবিষ্যতে সদাচরণের শর্তে মুচলেকা গ্রহণ করেন। কিন্তু ১৮৫০ খৃষ্টাব্দে আমি তাঁদেরকে দেখেছি সমতল বংগের রাজশাহী জেলায় রাজদ্রোহ মূলক প্রচারকার্য চালাতে। একাধিকবার এ ধরনের প্রচারকার্যের জন্যে তাঁদেরকে দুই দুইবার রাজশাহী থেকে বহিস্কৃত করা হয়। পাটনায় জামিন মুচলেকার দ্বারা এই দুই খলিফাকে তাদের আপন গৃহে যতোই আবদ্ধ রাখা হোক না কেন
, ১৮৫১ সালেই তাঁদেরকে আবার দেখা গেছে পাঞ্জাবের সীমান্তে ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে অনল উদগীরণ করতে”।
বিপ্লবী আহমদুল্লাহ
সাইয়েদ আহমদের জেহাদী আন্দোলন বাংগালী অবাংগালী নির্বিশেষে যেমন সারা ভারতের মুসলমা সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল, তেমনি অংশগ্রহণ করেছিল সারা ভারতে মুসলমান। চাষী, মজুর, দরজী, কশাই, মোল্লা, মওলভী, মওলানা এবং সরকারী দপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মচারী জীবনের সকল প্রকার ঝুঁকি নিয়ে একমাত্র খোদার সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যে অংশগ্রহণ করেন জেহাদী আন্দোলনে। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট আহমদুল্লাহ তাদের মধ্যে অন্যতন।
আহমদুল্লাহর পিতার নাম ছিল এলাহী বখশ। পাটনার অন্তর্গত ইতিহাস প্রসিদ্ধ সাদিকপুরে এক অতি সম্ভ্রান্ত পরিবারে উনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে জন্মগ্রহণ করেন আহমদুল্লাহ। আহমদুল্লাহ আরবী, ফার্সী ও উর্দু ভাষায় উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। ইংরাজী ভাষায়ও তাঁর প্রচুর ব্যুৎপত্তি ছিল। তাঁর পিতা সাইয়েদ শহীদের মুরীদ হননি, তাঁর তিন পুত্র ইয়াহিয়া আলী, ফয়েজ আলী ও আহমাদুল্লাহকেও সাইয়েদ সাহেবের মুরীদ করেন। আহমদুল্লাহ প্রথম জীবনে ইংরেজ সরকারের শিক্ষা বিভাগে নিযুক্ত হন। আহমদুল্লাহর পিতৃপ্রদত্ত নাম ছিল আহমদ বখন। সাইয়েদ সাহেত তা পরিবর্তন করে নতুন নাম রাখেন আহমদুল্লাহ। তাঁর প্রথম নাম লোপ পায় এবং তিনি আহমদুল্লাহ নামেই পরিচিত হন।
সীমান্তে শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধকালে সাইয়েদ সাহেবের সৈন্যসংখ্যা ছিল দু’লক্ষেরও অধিক। এ বিরাট বাহিনীর জন্যে লোক ও অর্থ সংগ্রহ হয়েছিল তৎকালীন ভারতের প্রায় প্রত্যেক প্রদেশ থেকেই বিশেষ করে বাংলা বিহার , উড়িষ্যা, যুক্তপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, সিন্দু ও সীমান্ত প্রদেশ থেকে। এ কাজ চলতো এক সুনিয়ন্ত্রিত গোপন প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে যা ১৮৫২ সালের পূর্ব পর্যন্ত বিশ পচিঁশ বৎসর যাবত ইংরেজ সরকার ঘৃনাক্ষরেও জানতে পারেনি। এ গোপন প্রতিষ্ঠান ও তার সকল প্রকার কর্মতৎপরতার সাথে উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারী আহমদুল্লাহ কতোখানি ওতোপ্রোত জড়ি ছিলেন তা জানা যায় একটি প্রতিবেদনের মাধ্যমে যা মিঃ রাভেন শ’ (Raven Shaw) পেশ করেন ৯-৫-১৮৬৫ তারিখে বাংলা সরকারের নিকটে।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-
১৮৫২ খৃষ্টাব্দে পাঞ্জাবে কর্তৃপক্ষ একটি ষড়যন্ত্রমূলক চিঠি হস্তাগত করে। হিন্দুস্থানী ধর্মন্ধরা (মুজাহিদগণ) শৈলশিখর থেকে ভারতীয় চতুর্থ রেজিমেন্টের (Regiment of Native Infatry) সংগে যে একটা গোলযোগ পাকাতে চেষ্টা করেছিল, তার প্রমাণ এ থেকে পাওয়া যায়। দেখা যায় যে, সাদিকপুর পরিবারের বহু মৌলভী এবং অস্ত্রসজ্জিত বহু কাফেলা তখন সীমান্তের দিকে রওয়ানা হয়েছে। পেশাওরের একখানা স্বাক্ষরহীন চিঠিতে জানা যায় যে মওলভী বেলায়েত আলী, এনায়েত আলী, ফয়েজ আলী ও ইয়াহইয়া আলী (আহমাদুল্লাহর দুই ভাই) এবং দিনাজপুরের জনৈক দরজী মওলভী করম আলী সুরাটের অন্তর্গত সিত্তানায় তাঁবু ফেলেছিলেন এবং বাদশাহ সাইয়েদ আকবরের সহযোগিতায় গভর্ণমেন্টের বিরুদ্ধে লড়াই করতে তৈরী হচ্ছিলেন। আমি পূর্বেই বলেছি যে, সাইয়েদ আকবর সোয়াতের একজন সরকার মনোনীত রাজা ছিলেন। চিঠিতে এ রকম বর্ণনা ছিলঃ মওলভী বেলায়েত আলীর ভাই মওলভী ফরহাত আলী আযীমাবাদে, মওলভী ফয়েজ আলীর ভাই আহমদুল্লাহ ও মওলভী ইয়াহইয়া আলী আপন আপন বাটিতে নিজ নিজ মহল্লায় অর্থ সংগ্রহ করছিলেন এবং অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ পাঠাচ্ছিলেন। অন্যান্য চিঠি থেকে জানা যায় যে, সৈন্য ও রসদ পাটনা থেকে মীরাট ও রাওয়ালপিন্ডির মধ্য দিয়ে পাঠানো হতো। এ দু’জায়ঘায় আলাদা এজেন্ট নিযুক্ত থাকতো। এবং তারা সীমান্তের জেহাদের জন্যে রসদ সরবরাহের সব বন্দেবস্ত করতো।
“পাঞ্জাব সরকারের অনুরোধক্রমে পাটনার ম্যাজিস্ট্রেট হোসেন আলী খানে খানা তল্লাসী করে। সে চিল আহমদুল্লাহর খানমাসা এবং চিঠিপত্র তার নামেই চলাচল হতো। আসলে কিন্তু ম্যাজিস্ট্র্রেট কর্তৃক খানা তল্লাসী দুদিন আগেই পাঞ্জাব থেকে ফেরত একজন হাকিমের (Native Doctor) মারফৎ এ খবরটা জানাজানি হয়ে যায় ও তাদের বাড়ীর যাবতীয় চিঠিপত্র নষ্ট করে ফেলা হয়। যাহোক, “১৮৫২ সালের ১০ই আগষ্ট তারিখের রিপোর্টে ম্যাজিস্ট্রেট গভর্ণমেন্টকে জানান যে, ওহাবীদের তখন বেশ সংখ্যাবৃদ্ধি হয়েছিল, এবং মওলভী বেলায়েত আলী, আহমদুল্লাহ ও তাঁর পিতা এলাহী বখশের বাড়ীতে জেহাদের জন্যে সর্বপ্রকার গুপ্ত মন্ত্রণা হতো ও সেখান থেকে প্রচার কার্য চলতো। তিনি আরও জানান যে, ওহাবীদের স্থানীয় পুলিশের সংগে যোগাযোগ ছিল। তার দরুন তাঁদের কার্যকলাপের কোনও বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ তাঁর নিকট যায়নি। তবে মওলভী আহমদুল্লাহর বাড়ীতে ছয়-সাত শ’ সশস্ত্র লোক ম্যাজিস্ট্রেটের খানা তল্লাশীর বিরোধিতা করতে ও বিদ্রোহের নিশানা তুলতে প্রস্তুত ছিল”।
“১৮৫২ সালের ৭ই সেপ্টেম্বর তারিখের কাউন্সিল বৈঠকে একটা বিষয় (Minute) লিপিবদ্ধ করা হয় –সেটা করা হয় পাঞ্জাব গভর্ণমেন্টের লেখা অনুযায়ী এসব চিঠিপত্র সম্পর্কে, এবং সীমান্তের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার প্রয়োজনীয়তাও তাতে স্বীকৃত হচ্ছিল। চতুর্থ দেশীয় রেজিমেন্টের মুন্সী মুহাম্মদ ওয়ালীকে ফৌজদারীতে সুপর্দ করা হয় এবং রাওয়ালপিন্ডিতে ১৮৫৩ সালের ১২ই মে তারিখে তার বিচার ও শাস্তি হয়। তখনও মওলভী আহমদুল্লাহ এবং পাটনার অন্যান্য অধিবাসীদের নাম পুনরায় সাক্ষ্য প্রমাণে ওঠে এবং তাঁদের দ্বারা সীমান্তে রসদ পাঠানো বিষয়ও আলোচনা হয়”।
“অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এইযে, গভর্ণমেন্ট কোন সক্রিয় পন্থা অবলম্বন করেননি এবং পাটনার ষড়যন্ত্রও নষ্ট করে দেননি। রাজদ্রোহীতারগমন নিশ্চয়ই হতো, আম্বালা অভিযানে কোনো সৈন্যক্ষয় হতো না এবং সরকারী কর্মচারীরা বহু পরিশ্রম ও অহেতুক লাঞ্ছনা থেকে রেহাই পেতেন, কারণ ১৮৫২ সালের সশস্ত্র রাজদ্রোহী আহমদুল্লাহই হচ্ছে এক ‘সামান্য কেতাবওয়ালা’ ও ১৮৫৭ সালের ‘ওহাবী ভদ্রলোক’।
-(ওহাবী আন্দোলন, আবদুল মওদূদ, পৃঃ ১৯৮-২০০)
সারা ভারতে ১৮৫৭ সালে আযাদী আন্দোলন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠলে আহমদুল্লাহ সহ পাটনার বহু মুসলমানকে গ্রেফতার ও বন্দী করেন তদানীন্তন কমিশনার মিঃ টেইলার। টেইলার সন্দেহ করেন যে, সাতান্ন সালের আন্দোলনে এসব মুসলমান জড়িত ছিলেন। টেইলার বন্দীকৃত মুসলমানদেরকে বিনা বিচারে অতি নিষ্ঠুর ও পৈশাচিকভাবে দৈনিক কিছু সংখ্যক করে তাঁর বাংলার ময়দানে ফাঁসির মঞ্চে ঝুলিয়ে আত্মতৃপ্তি লাভ করতে থাকেন। কিন্তু এ নিষ্ঠুর ও অন্যায় অবিচার কর্তৃপক্ষের কানে পৌছা মাত্র অবশিষ্ট বন্দীদের মুক্তির আদেশ দেয়া হয় একং টেইলারের কৈফিয়াত তলব করা হয়। এভাবে আহমদুল্লাহ টেইলারের মৃত্যুযজ্ঞ থেকে রক্ষা পান। এ পৈশাচিক হত্যাকান্ডের জন্যে টেইলারকে কমিশনারের পদ থেকে অপসারণ করা হয়।
সাতান্নর আযাদী আন্দোলন দমিত ও প্রশমিত হলে, ইংরেজরা মুসলমানদের মন জয় করার ভূমিকা গ্রহণ করে। ওদিকে স্যার সৈয়দ আহমদও ইংরেজেদের সাথে মুসলমানদের সম্পর্ক পুনঃপ্রতিষ্ঠার জণ্যে আপ্রাণ চেষ্টা করেন। আহমদুল্লাহর প্রতিও সরকারের সহানুভূতি আকৃষ্ট হয়। ফলে ১৮৬০ সালের ২১শে সেপ্টেম্বরের এক ঘোষনার দ্বারা তিনি ডিপুটি ম্যাজিস্ট্রেট রূপে নিয়োজিত হন। কিন্তু তখনও পাটনার বড়ো খানকাহ বা প্রধান কেন্দ্রস্তল থেকে মূলকা ও সিত্তানায় রীতিমতো মুজাহিদ ও রসদ সরবরাহ অব্যাহত ছিল। সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মচারী হয়েও আহমদুল্লাহ একমাত্র খোদার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে মুজাহিদ বাহিনীর সাথে পূর্ণ সহযোগিতা করতেন। তাঁরই তত্ত্বাবধানে বাংলা বিহার থেকে মুজাহি ও রসদ সংগ্রহে পূর্ণ উদ্যমে চলতো। এ ব্যাপারে প্রধান ঘাঁটি ছিল তাঁর নিজবাড়ী। প্রত্যেক জুমার দিনে বামাগরিব তাঁর বাড়ীতে মিলাদের আয়েঅজন করা হতো এবং মীলাদের নামে সেখানে মুজাহিদগণ জমায়েত হতেন এবং দৈনন্দিন কর্মসূচী নির্ধারণ করতেন। তাঁরা তাঁদের কাজকর্মের জন্যে এমন এক সংকেত পদ্ধতি (
CODE) ব্যবহার করতেন যা তারা ব্যতীত আর কারো বোধগম্য ছিল না। প্রত্যেকে ভিন্ন নামে নিজেদের মধ্যে পরিচিত ছিলেন।
বাংলা ও বিহারে আহমদুল্লাহর বিশ্বস্ত, কর্মঠ ও খোদার পথে উৎসর্গকৃত এজেন্ট ছিল। বাংলার এজেন্ট ছিলেন ঢাকার প্রসিদ্ধ চামড়া ব্যবসায়ী হাজী বদরুদ্দীন। তিনি পূর্বাঞ্চলের সমুদয় অর্থ সংগ্রহ করে পাটনার ফারুলাল নামধারী জনৈক ব্যবসায়ীর নামে হুন্ডী করে পাঠাতেন। কোলকাতার মুড়িগঞ্জ মহল্লায় আবদুল জাব্বার নামে এবং মুকসেদ আলী নামে অন্য একজন হাইকোর্টের মোক্তার এজেন্ট ছিলেন। মুকসেদ আলীর পাটনাতেও বাড়ী ছিল। তাছাড়া চব্বিশ পরগনা, যশোর, ফরিদপুর, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, রংপুর প্রভৃতি জেলাতেও এজেন্ট ছিল। বিহার, উড়িষ্যা, ইউপি ও মধ্য প্রদেশের বড়ো বড়ো শহরগুলিতেও এজেন্ট নিয়োজিত ছিল। আহমদুল্লাহ সাহেব সাংকেতিক ভাভায় চিঠিপত্রের আদান প্রদান করতেন তাদের সংগে। ১৮৬০ সাল থেকে ১৮৬৫ সাল পর্যন্ত মওলবী আহমদুল্লাহই ছিলেন জেহাদী আন্দোলনের প্রধান কর্ণধার। সরকারী উচ্চপদের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে তিনি নিরঙ্কুশভাবে এ আন্দোলন পরিচালনা করতেন এটাই ছিল সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। কারণ যে কোন বিপ্লব সফল করতে হলে প্রতিষ্ঠিত সরকারের পুলিশ, সামরিক বাহিনী, প্রশাসন বিভাগ প্রভৃতির সাহায্য সহযোগিতা অপরিহার্য।
আঠারো শ’ সাতান্ন সালে সমগ্র ভারতব্যাপী যে বিপ্লবী আন্দোলন চলেছিল তার প্রেরণা সঞ্চার করেছিল মুজাদিহ বাহিনী। তাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল মুজাহিদ বাহিনী। কিন্তু প্রতিকুল অবস্থার দরুন সে আন্দোলন ফলপ্রসু না হলেও মুজাহিদগণ দমি হননি, ভগ্নোৎসাহ হননি। তাদের কর্মপ্রেরণা হ্রাস পায়নি মোটেও। চূড়ান্ত বিজয় লাভ সম্ভব না হলেও সাতান্ন বিপর্যয়ের পরও একদশক কাল পর্যন্ত এ আন্দোলনকে তাঁরা এগিয়ে নিয়ে গেছেন প্রায় সাফল্যের দ্বারপ্রান্তে।
সমগ্র বাংলা থেকে হাজার হাজার মুসলমান গাজী অথবা শহীদ হওয়ার আকাংখায় পাটনা সাদিকপুরে আহমদুল্লাহ সাহেবের বাড়ীতে জমায়েত হতো এবং সেখান থেকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে সিত্তানার জন্যে রওয়ানা হতো। এ রকম একটি দলের চারজন বাংলার মুসলশান আম্বালা যাওয়ার পথে গুজার খান নামক জনৈক পাঞ্জাবী সার্জেন্টের হাতে ধরা পড়ে। তাদেরকে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হাজির করা হয়। তারা নিজদেরকে নির্দোষ ও নিরীহ পথচারী বলে জানালে ম্যাজিস্ট্রেট তাদেরকে মুক্তি দেন। গুজান খান মনে বড়ো দুঃখ পায় এবং জানায় যে থানেশ্বর নিবাসী জনৈক জাফর আলী সিত্তানায় মুজাহিদ ও রসদ পাঠানের কাজ করেন। কর্তৃপক্ষ সংবাদ পাওয়া মাত্র জাফর আলী থানেশ্বরীর বাড়ী তল্লাশী করে এবং বহু সন্দেহজনক কাগজপত্র হস্তগত করে। জাফর আলী পলাতক হন, কিন্তু বহু মুজাহিদসহ আলীগড়ে ধরা পড়েন। তাঁদের জবানবন্দীতে জানা যায় যে, তারা সাদিকপুরের এলাহী বখশের গুপ্তচর। এলাহী বখশের খানা তল্লসীর পরও সেখান থেকে বহু আপত্তিকর কাগজপত্র পাওয়া যায়।
এসব কাগজপত্র থেকে কর্তৃপক্ষ একটা বয়ানক ষড়যন্ত্রের সন্ধান পায় এবং পাটনার ম্যাজিস্ট্রেট রাভেন শ’কে তদন্তের ভার দেয়া হয়। তদন্তের সাথে সাথে আহমদুল্লাহ সাহেবকে গ্রেফতার করা হয় এবং চাকুরী থেকে বরখাস্ত করা হয়। চার মাস তদন্তের পর আহমদুল্লার বিরুদ্ধে রাজদ্রোহিতা প্রভৃতি আট দফা চার্জ গঠন করে কারাগারে সুপর্দ করা হয়। বিচারে দায়রা জজ তাঁর মৃত্যুদন্ড দেন। এ দন্ডাজ্ঞার বিরুদ্ধে কোলকাতা আপীল দায়ের করা হয়। বিচারপতি ট্রিভার এবং ও লক (Trevor and O. Lock J.J) ১৮৬৫ সালের ১৩ই এপ্রিল রায় প্রদান করেন। রায়ে তারা বলেন, “প্রাণদন্ডের আদেশ অনুমোদন না করে এই আদেশ দিলাম যে তার যাবজ্জীবন দীপান্তর হো ও তার যাবতীয় বিষয়সম্পত্তি রাজসরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হোক”।
ঐ বছর জুন মাসেই তাকে আন্দামান পাঠানো হয় এবং প্রায় ষোল বছর বন্দী জীবন যাপনের পর ১৮৮১ খৃষ্টাব্দে এই বীর মুজাহিদ সহাস্যে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন।
তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা ইয়াহইয়া আলীরও যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর কারাদন্ড হয়েছিল এবং তিনি ইতিপূর্বেই আন্দামানে এন্তেকাল করেন। আহমদুল্লাহর অন্তিম ইচ্ছা ছিল সহোদরের পাশেই সমাহিত হতে। কিন্তু ইংরেজ সরকার তাঁর এ নির্দোষ ও অক্ষতিকর ইচ্ছাটুকুও পূরণ করেনি।
সাদিকপুর পরিবারের বাসগৃহটি ছিল পাটনার অতি সম্ভ্রান্ত ও বিখ্যাত বাসগৃহ। বাসগৃহটি ভূমিসাৎ করে সেখানে পাটনার মিউনিসিপ্যাল মার্কেট নির্মিত হয়। এ নির্মাণাকার্যের ব্যয় বহন করা হয় এ পরিবারের অন্যান্য সম্পত্তির বিক্রয়লব্ধ অর্থ দিয়েই।
সাদিকপুরের এ সম্ভ্রান্ত ও প্রসিদ্ধ পরিবারটি আল্লাহর পথে চলতে গিয়ে যেভাবে সমূলে ধ্বংসপ্রাপ্ত হলো এবং অনুপম ত্যাগ ও কুরবানীর যে স্বাক্ষর এ পরিবারটি রেখে গেল, ইতিহাসে তার দৃষ্টান্ত বিরল। নারী ও শিশু নির্বিশেষে পরিবারের প্রতিটি সদস্য সরকারের কোপানলে তিলে তিলে দগ্ধিভূত হয়েছে। সবচেয়ে মর্মান্তিক ব্যাপার এই যে, মুসলমানদের পবিত্র ও আনন্দময় ঈদের দিনে ইংরেজ সরকার আহমদুল্লাহর পরিবারকে বাসগৃহ থেকে শুধুমাত্র একবস্ত্রে ও খালি হাতে উৎখাত করে চরম আত্মতৃপ্তি লাভ করে। এমন অবমাননা কোন সভ্য জাতির ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যাবে না। নিষ্পাপ শিশু ও নারীদের নীরব আর্তনাদ ও হাহাকার সেদিন আকাশ বিদীর্ণ করেছিল। আহমদুল্লাহ হয়তো তাই এ দিনটিকে স্মরণ করে নিম্নোক্ত শোকগাথাটি রচনা করেছিলেনঃ
চুঁ শব-ই-ঈদরা সেহর করদান্দ
হামারা আয মাকান বদর করদান্দ
মায়া ইযাইশ সাযে মাতম সওদ
ঈদ-ই-মাগুররা-ই-মুহররম সওদ।
ঈদের রাতের শেষে যখন উষার আলোক প্রতিভাত হলো, তখন আমরা সব বিতাড়িত হলাম আপন গৃহ থেকে। আনন্দের সব উচ্ছ্বাস শোকের রূপ ধারণ করলো –আমাদের ঈদ মুহররমের কারবালায় পরিণত হলো।
পৈমাচিকতার এখানেই শেষ নয়। সাদিকপুর পরিবারের সুবৃহৎ পারিবারিক কবরস্থানটি চাষ দিয়ে উৎখাত করা হয় এবং হিন্দুদের মধ্যে বন্দোবস্ত করে দেয়া হয়।
মওলানা ইয়াহইয়া আলী
মওলানা ইয়াহইয়া আলী ছিলেন বিপ্লবী আহমাদুল্লাহর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা। সাইয়েদ আহমদ শহীদ বেরেলভীর অসম্পূর্ণ কাজকে পূর্ণ রূপ দেয়ার জন্যে ভারতের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত মুজাহিদগণের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে যেভাবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন জাগ্রত রেখেছিলেন তা এক অতি বিস্ময়কর ব্যাপার। এ কাজের জণ্যে তিনি আপন জীবন ও ধন সম্পদ খোদার পথে বিসর্জন দিয়েছিলেন। বলতে গেলে সাইয়েদ সাহেবের শাহাদাতের পর মাওলানা ইয়াহইয়া আলীই মুজাহিদগণের আধ্যাত্মিক নেতা বা ইমাম ছিলেন। ১৮৬৪ সাল পর্যন্ত জেহাদী আন্দোলন পরিচালনা করার পর তিনি অন্যান্যের সাথে ব্রিটিশ বিরোধী ষড়যন্ত্র মামলর আসামী হন।
হান্টার তাঁর গ্রন্থে বলেন, “প্রধান ইমাম ইয়াহইয়া আলীর উপর বহুবিধ কাজের দায়িত্ব ন্যস্ত ছিল। ভারতে ওয়াহাবী সম্প্রদায়ের আধ্যাত্মিক পরিচালক হিসাবে তাঁকে অধীনস্থ প্রচারকদের সাথে নিয়মিত পত্রালাপ করতে হতো। তাঁকে এক দরনের গোপন ভাষায় চিঠি তৈরী করতে হতো এবং এ গোপন ভাষাটা তাঁরই আবিষ্কার। প্রচুর অর্থ সীমান্তের বিদ্রোহী শিবিরে নিয়মিত পাঠাবার ব্যবস্থাটাও তাঁকেই পরিচালনাকরতে হতো। মসজিদে নামাজের ইমামতি করা, ধর্মান্ধ ব্যক্তিদের রাইফেলগুলি পরীক্ষা করে তাদের হাতে তুলে দেয়া, ছাত্রদের মাঝে ধর্মীয় বক্তৃতা করা এবং ব্যক্তিগত পড়াশুনার মাধ্যমে আরবী ধর্মগুরুদের প্রবর্তিত তত্ত্বজ্ঞান আরো গভীরভাবে রপ্ত করা এ সবই ছিল তাঁর কর্মসূচীর অন্তর্গত”।
বলতে গেলে তিনি ছিলেন একাধারে মুজাহিদ বাহিনীর পরিচালক, তাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দাতা, মসজিদের ইমাম, এলমে তাসাওউফের মুর্শেদ এবং যুদ্ধ পরিচালনার জণ্যে সংকেত-পদ্ধতির আবিষ্কারক। আঠারো শ’ চৌষট্টি সালের জুলাই মাসে আম্বালার সেশন জজ স্যার হার্বার্ট এডওয়ার্ডস যে রায় প্রদান করেন তার বরাত দিয়ে হান্টার বলেন, “ভারতে অর্ধচন্দ্রের (ইসলামী) শাসন প্রতিষ্ঠাকল্পে পাটনার মসজিদে তিনি (ইয়াহইয়া আলী) ধর্ম বিষয়ক প্রচারণায় নিয়োজিত ছিলেন। অর্থ সংগ্রহ এবং মুসলমানদের জিহাদ পরিচালনার জন্য তিনি বহু সংখ্যক অধঃস্তন এজেন্ট নিযুক্ত করেন”।
তিনি আরো বলেণ, “মামলার বিচারকার্য থেকে তিনটি সর্বাধিক বিস্ময়কর ব্যাপার উদঘাটিত হয় তা হচ্ছে –ব্যাপক এলাকা জুড়ে সংগঠন গড়ে তোলার ব্যাপারে সংগঠকদের বিচক্ষণতা, কর্মতৎপরতা পরিচালনাকালে গোপনীয়তা রক্ষায় কর্মীদের দক্ষতা, এবং তাঁদের পরস্পরের প্রতি সার্বিক বিশ্বস্ততা। তাদের সাফল্যের মূলে অনেকাংশে ছিল ছদ্মনাম গ্রহণের ব্যবস্থা এবং সংবাদ আদান প্রদানের জন্যে এক ধরনের গুপ্ত ভাষায় প্রবর্তন।
এ মামলার আসামী ছিলেন মোট এগারোজন। আন্দোলনের অগ্রনায়ক যারা ছিলেন তাদের বিচারে প্রাণদন্ড হয়। কিন্তু এই প্রাণদন্ডাদেশ তাঁরা এমন সন্তুষ্টচিত্তে গ্রহণ করে যে তা ব্রিটিশ সরকারকে বিস্মিত করে। কারণ এসম মুজাহেদীনের জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে দৃষ্টিভংগী ছিল শাসকদের দৃষ্টিভংগী থেকে ভিন্নতর। আল্লাহর পথে শাহাদত বরণকে তাঁরা জীবনের বড়ো সাফল্য বলে দৃঢ়প্রত্যয় রাখতেন। তাই প্রদেশের সর্বোচ্চ আদালত তাদের প্রাণদন্ড মওকুফ করে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে পরিবর্তিত করেন। হান্টার সাহেব উপরোক্ত সত্যটি স্বীকার করে বলেণ, “ষড়যন্ত্রের সবচেয়ে অগ্রনায়ক যাঁরা ছিলেন এমনকিট তাঁদেরকে, শহীদ হবার সুযোগ না দিয়ে ব্রিটিশ সরকার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছেন”।
এ মামলার আসামী যাঁরা ছিলেন তাঁরা হচ্ছেনঃ
মওলানা ইয়াহইয়া আলী, পাটনার প্রচার কেন্দ্রের কোষাধ্যক্ষ আবদুল গাফফার, জাফঢর থানেশ্বরী, ব্রিটিশ সেনানিবাসে মাংস সরবরাহকারী কন্ট্রাক্টর মুহাম্মদ শফি, আদদুর রহীম, এলাহী বকশ, মুহাম্মদ হুসাইন, কাজী মিঞাজান, আবদুল করিম, থানেশ্বরের হুসাইনী এবং আবদুল গাফফার (২)।
পাঁচ নম্বর আসামী আবদুর রহীমের বাড়ীতে বাঙালী মুজাহিদগণ জমায়েত হ’য়ে অবস্থান করতেন। খাদেম তাঁদের টাকা পয়সা জমা রাখতো, খাওয়া দাওয়া করাতো, খাতির তাজিম করতো এবং বিদায়ের সময় টাকা পয়সা ফেরৎ দিত। ইয়াহইয়া আলী তাঁদেরকে জেহাদী প্রেরণায় উদ্ধুদ্ধ করতেন।
এলাহী বখশ সংগৃহীত তহবিল জা’ফর থানেশ্বরীর কাছে পাঠাতেন এবং তিনি তা মুলকায় ও সিত্তানায় বিদ্রোহী শিবিরে পাঠাতেন।
পাটনার মুহাম্মদ হুসাইন ছিলেন এলাহী বখশের খাদেম, তিনি স্বর্ণ মোহর আস্তিনের মধ্যে সিলাই করে পাটনা থেকে দিল্লী যান এবং নির্দেশ মুতাবেক জাফর থানেশ্বরীর কাছে হস্তান্তর করেন।
কাজী মিঞাজান মুজাহিদ সংগ্রহের কাজ করতেন, অর্থ সংগ্রহ করে পাঠানো এবং চিঠিপত্র আদান প্রদানের কাজও তিনি করতেন।
আবদুল করিম ছিলে মাংস সরবরাহকারী মুহাম্মদ শফির গুপ্তচর। তিনিও পাটনা থেকে টাকা কড়ি বহন করে নিয়ে যেতেন। মুহাম্মদ জাফর থানেশ্বরী তাঁর ‘তাওয়ারীখে ই-আজীব’ গ্রন্থে বলেছেন, মিঞাজান কুষ্টিয়া জেলার কুমারখালী নিবাসী ছিলেন। তিনি জেলখানায় মৃত্যুবরণ করেন।
থানেশ্বরের হুসাইনী –মুহাম্মদ জাফর থানেশ্বরী ও মুহাম্মদ শফির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করতেন। একদিন ২৯০টি স্বর্ণ মোহর মুহাম্মদ জাফর থানেশ্বরীর নিকট থেকে বহন করে নিয়ে মুহাম্মদ শফির নিকটে যাবার সময় হাতেনাতে ধরা পড়েন।
মওলানা ইয়াহইয়া আলী আন্দামানে যাবজ্জীবন কারাদন্ড ভোগের সময় তথায় শেখ নিঃশাস ত্যাগ করেন। এভাবে ভারতে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অন্যতম অগ্রনায়কের ইংরেজ শাসকদের নিপীড়নের মধ্যে জীবনাবসান হয়।
মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত তিনজনের মধ্যে (মওলানা ইয়াহইয়া আলী, হাজী মুহাম্মদ শফি ও মুহাম্মদ জাফর থানেশ্বরী) জাফর থানেশ্বরী অন্যতম। তিনি থানেশ্বরের একজন অতি প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর মৃত্যুদন্ড মওকুফ করে যাবজ্জীবন দারাদন্ডে দন্ডিত করা হয়। তিনি আঠরো বৎসর আন্দামানে কারাদন্ড ভোগ করার পর দেশে প্রত্যাবর্তন করেন। তিনি তাওয়ারীখ-ই-আজীব নামক একখানা গ্রন্থ প্রণয়ন করেন। তাঁর দীর্ঘ আন্দামান জীবনের অভিজ্ঞতা, কয়েদীদের প্রতি অমানুষিক ব্যবহার, ১৮৫৭ সালের আযাদী আন্দোলনের এবং জেহাদী আন্দোলহের বহু মূল্যবান তথ্য এই গ্রন্থে তিনি সন্নিবেশিত করেছেন। তিনি তাঁর আন্দোলনের বহু মূল্যবান তথ্য এই গ্রন্থে তিনি সন্নিবেশিত করেছেন। তিনি তাঁর ১৮৬৩ সালের আম্বালা যুদ্ধের এক চমকপ্রদ বর্ণনা প্রদান করেন। তিনি বলেনঃ
“১৮৬৩ খৃষ্টাব্দ। ভাতের পশ্চিম সীমান্ত ব্রিটিশ সরকারের একান্ত জবরদস্তির ফলে এক ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। জেনারেল চ্যাম্বারলেন ছিলেন ইংরেজ পক্ষের সেনাপতি। আম্বালার ঘাঁটিতে তাঁর বাহিনীকে যথেষ্ট দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এ পররাজ্য আক্রমণ ও সীমালংঘনেরই শামিল। সেজন্যে সোয়াতের বিখ্যাত পীর সাবেও বহু সংখ্যক শিষ্য নিয়ে মুসলিম মুজাহিদ বাহিনীল সাহায্যের উদ্দেম্যে ইংরেজ সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। আফগানরা দেশ ও জাতির ইজ্জৎ রক্ষার উদ্দেশ্যে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
ভীষণ যুদ্ধ চলতে থাকে। স্বয়ং জেনারেল চ্যাম্বারলেন গুরুতর জখম হন। প্রায় সাত হাজার ইংরেজ সৈণ্য হতাহত হয়। মুজাহিদ বাহিনীকে সমূলে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যেই ব্রিটিশ সরকার পররাজ্যের অভ্যন্তরে হলেও এ অভিযান প্রেরণ করে। মুজাহিদগণের সংকল্প হচ্ছে, হয় বিজয় নয় শাহাদাৎ। তাঁরা বীরত্বের পরাকাষ্ঠা প্রদর্শনে লেগে যান। কাজেই যুদ্ধ প্রচন্ড আকার ধারণ করে।
এদিকে ভারতের ভাইসরয় লর্ড এলগিন নিজের অযৌক্তির কার্যকলাপ ও অন্যায় আক্রমণের পরিণাম ফলের মর্মজ্বালায় কুম্বনের পর্বতশিরে অকষ্মাৎ মৃত্যুমুখে পতিত হন। ভারত বর্ষ রাজপ্রতিনিধিহীন হ’য়ে পড়ে। যুগপৎ যুদ্ধ ও ভাইসরয়ের মৃত্যু নিঃসন্দেহে সংকট সৃষ্টি করে। এমনি সময়ে আঠারো শ’তেষট্টি সালের এগারোই ডিসেম্বর তারিখে কর্ণাল জেলার পানিপথ চৌকির ভারপ্রাপ্ত অশ্বারোহী পাঠান পুলিশ গুজান খান কোন সূত্রে মুজাহিদ বাহিনীর সাথে আমার যোগসূত্র জানতে পারে। সে স্বভাবতঃই একে পদোন্নতির এক সুবর্ণ সুযোগ মনে করে। তখন সে এক দীর্ঘ বিবৃতিতে কর্ণালের ডিপুটি কমিশনারকে তা জানিয়ে দেয়। সে জানায়, সীমান্তে মুজাহিদ বাহিনীর সাথে যে ভয়াবহ সংগ্রাম চলছে, তাতে থানেশ্বর শহরের নম্বরদার মুহাম্মদ জাফর টাকা ও লোক দিয়ে সাহায্য করে থাকে। ডিপুটি কমিশনার খবর পাওয়া মাত্র আম্বালা জেলার কর্তৃপক্ষকে, যার অধীনে থানেশ্বর শহর অবস্থিত, টেলিগ্রামযোগে এ সংবাদ জানিয়ে দেয়। সরবাদদাতা বেরিয়ে আসবার সংগে সংগেই আমার জনৈক পুলিশ বন্ধু ডিপুটি কমিশনারের বাংলোতে যান। তিনি তাঁর কাছে গোপন সংবাদটি জানতে পেরে আমাকে অবহিত করার জন্যে একজন পুলিশ অফিসারকে পাঠান, আমি তখন ঘুমিয়ে পড়েছি বলে তিনি পরদিন প্রতে জানাবেন মনে করে চলে যান। দুর্ভাগ্যের বিষয় আমার পুলিশ বন্ধুটি আশার পূর্ভেই আমার বাড়ী ঘেরাও করে ফেলে পুলিশ সুপার ক্যাপ্টেন পার্সন”।
(তাওয়ারীখ-ই-আজীব, বাংলা অনুবাদ ‘আন্দামান’ বনদ্দীর আত্মকাহিনী, পৃঃ ১-২)।
মওলানা ইমামুদ্দীন
বাংলাদেশের নোয়াখালী জেলার সদর থানার অধীন হাজীপুর (সাদুল্লাপুর) গ্রামে মওলানা ইমামুদ্দীন জন্মগ্রহণ করেন। তিনি বাল্যকালে বিদ্যাশিক্ষার জন্যে কোলকাতান গমন করেন এবং সেখান থেকে শাহ আবদুল আযীয দেহলবীর নিকট শিক্ষাগ্রহণের জন্যে দিল্লী গমন করেন। দিল্লী অবস্থানকালে সাইয়েদ আহমদ শহীদের সাথে তাঁর সাক্ষাৎ লাভ হয়। কিন্তু তখন তিনি তাঁর দীক্ষা গ্রহণ করেননি। পরবর্তীকালে লক্ষ্ণৌ শহরে পুনরায় তাঁর সাইয়েদ আহমদের সাথে সাক্ষাৎ হয়। এবার তিনি তাঁর হাতে ‘বয়আত’ গ্রহণ করে মুজাহিদ বাহিনীতে যোগদান করেন, কিছুকাল পরে সাইয়েদ সাহেব তাঁকে তাঁর খলিফা পদে বরণ করেন।
সাইয়েধ সাহেব যখন হজ্বের উদ্দেশ্যে হেজাজ গমন করেন তখন মাওলানা ইমামুদ্দীন কোলকাতায় স্বীয় মুর্শেদের নিকটে বিদায় নিয়ে বৃদ্ধ পিতার সংগে সাক্ষাতের জন্যে নোয়াখালী যান। অতঃপর তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা আলীমুদ্দীন এবং ত্রিশ চল্লিশজন লোকসহ হেজাজ গমন করে সাইয়েদ সাহেবের কাফেলার সাথে মিলিত হন।
হজ্বের পর তিনি জেহাদ অভিযানে শরীক হন এবং বালাকোট প্রান্তরে সাইয়েদ সাহেবের সাথী হন। যুদ্ধে তাঁর ভাই আলীমুদ্দীন শহীদ হন এবং তিনি গাজীরূপে প্রত্যাবর্তন করেন। বালাকোট বিপর্যয়ের পর টংকের নবাব ওয়াজিরুদ্দৌলার আমন্ত্রণে তিনি টংক রাজ্যে গমন করেন। নবাব সাহেত তাঁর নিকটে বহু বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন।
সূফী নূর মুহাম্মদ নিযামপুরী
সূফী নূরমুহাম্মদ চট্টগ্রাম নিবাসী ছিলেন, তাঁর বিস্তারিত জীবনী জানা না গেলেও তিনি ছিলেন সাইয়েদ আহমদ শহীদের অন্যতম খলিফা। তিনি যথারীতি মুজাহিদ বাহিনীতে যোগদান করেন, সাইয়েদ সাহেবের কাফেলাভুক্ত হ’য়ে হজ্জব্রত পালন করেন এবং জেহাদ অভিযানে শেষ পর্যন্ত সাইয়েদ সাহেবের সাথে অংশগ্রহণ করেন। বালাকোটের যুদ্ধের পর তিনিও গাজী হওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন।
পশ্চিমবংগের বিখ্যাত পীর শাহ সুফী ফতেহ আলী সাহেব সূফী নূর মুহাম্মদের নিকট এলমে তাসাওউফের দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। সূফী ফতেহ সাহেবের মাজার কোলকতার মানিকতলায় অবস্থিত। তাঁর খলিফা ও স্থলাভিষিক্ত ছিলেন হুগলী জেলার ফুরফুর নিবাসী মওলানা শাহ সুফী আবু বকর সিদ্দিকী।