অধ্যায় ১১. সমাপ্তি
খারাপ জিনিস ভালো মানুষদের সাথেও ঘটতে পারে। খ্রিস্টীয় বাইবেলের শেষ বইটি সেই খারাপ জিনিসগুলোকে শ্রেণিবিন্যস্ত করেছিল, যার নাম দিয়েছিল ‘ফোর হর্সম্যান অব অ্যাপোকালিপস’ বা মহাপ্রলয়ের চার ঘোড়সওয়ার : যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, অসুখ আর মৃত্যু। সেই শুরুর সময় থেকে ঐ চার ঘোড়সওয়ার ইতিহাসের মধ্যদিয়ে তাদের ঘোড়া ছুটিয়ে চলছেন, আর থামার কোনো চিহ্নই তারা দেখাচ্ছেন না। যে-কারো পক্ষেই এসব ব্যাখ্যা করা খুব কঠিন, কিন্তু ধর্মবিশ্বাসী মানুষগুলোর জন্যে তারা সুনির্দিষ্ট একটি সমস্যা সৃষ্টি করে। যদি আপনি কোনো ঈশ্বর বিশ্বাস না করেন, যদি আপনি আমাদের এই অস্তিত্বের চূড়ান্ত একটি অর্থ আছে এমন কিছু বিশ্বাস না করেন, তাহলে দুঃখ হচ্ছে অপ্রীতিকর একটি বাস্তবতা, বেঁচে থাকতে হলে যার মোকাবেলা আপনাকে করতেই হবে। কিন্তু যদি আপনি ঈশ্বর বিশ্বাস করেন, তাহলে আপনাকে একটি কঠিন প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। পৃথিবীতে এত বেশি দুঃখের উপস্থিতি কেন, কেনই বা ঈশ্বর এসব ঘটবার অনুমতি দিচ্ছেন? আর কেন প্রায়শই ভালো মানুষরাই মূলত সেই যন্ত্রণাভোগ করে, আর খারাপ সেই যন্ত্রণার শাস্তি না-পেয়েই পার পেয়ে যায়? এইসব প্রশ্নের উত্তর সব ধর্মেই আছে। জুডাইজম বা ইহুদি ধর্মে এই প্রশ্নটির একটি আদি উত্তর হচ্ছে, যদি ইজরায়েলকে কোনো দুঃখ আর দুর্দশা ভোগ করতে হয়, তবে এর কারণ এটি এর পাপের শাস্তি পাচ্ছে। এই অধ্যায়ে আমরা ইজরায়েলের দুর্দশা নিয়ে যখন ভাবব, সেটি একটি জনগোষ্ঠী কিংবা জাতি হিসাবে ভাবব, বিশেষ করে কোনো ‘একক ব্যক্তির দুর্দশা হিসাবে নয়; এবং খুব সুস্পষ্ট একটি কারণে। একমাত্র সত্য ঈশ্বর ইজরায়েলকে তার নির্বাচিত জাতি হিসাবে ঘোষণা দিয়েছিলেন, যে তার কনে এবং প্রেয়সী। বেশ, তাহলে ঈশ্বরের সাথে ইজরায়েলের সম্পর্কটি কেন এমন ঝামেলাপূর্ণ, কষ্টসাধ্য একটি সম্পর্কে পরিণত হয়েছিল? কেন এই বিশেষ সম্পর্কটি তাদের এত দুঃখের কারণ হয়েছিল? নবী ইজেকিয়েল তাদের বলেছিলেন : এর কারণ হচ্ছে, তারা আসলে বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন, ঈশ্বরের বিশেষভাবে নির্বাচিত জাতি মানে হচ্ছে অন্যসব জাতি ও তাদের দেবতাদের থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ পৃথক করে রাখা। কিন্তু তার পরিবর্তে, ইহুদিরা অন্যদের অনুকরণ করেছেন। তাদের রাজনীতিতে নিজেদের জড়িয়ে ফেলেছেন। সেই একমাত্র ঈশ্বরকে তারা এমনভাবে উপাসনা করেছেন, যেন তিনি কোনো মূর্তি, যিনি ন্যায়বিচার আর পবিত্রতার বদলে চাটুকারিতা আর পূজার বিসর্জন চাইছেন। আর সে-কারণেই। ব্যাবিলনে দাস হিসাবে বন্দিজীবন এখন তাদের নিয়তি। কিন্তু সেখান থেকে মুক্তি পেয়ে জেরুজালেমে ফিরে আসার পর তারা তাদের শিক্ষা পেয়েছিলেন।
তাদের স্বদেশ, ইজরায়েলে ফেরার পর এমন একটি জাতি হিসাবে তারা নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, যাদের জন্যে ধর্মীয় শুদ্ধতাকে জীবনের উদ্দেশ্য আর অর্থ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছিল। পেন্টাটিউখে পাওয়া নির্দেশাবলি সতর্ক মনোযোগর সাথে তারা অনুসরণ করেছিলেন। প্রতিটি দিনই পূর্ণ ছিল নানা আচারে, যা তাদের সচেতনতায় একেবারে সম্মুখে ঈশ্বরকে স্থাপন করেছিল। ঈশ্বরের সেবায় নিবেদন করতে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছিল : তারা কী খেতে পারবেন থেকে শুরু করে তারা কী স্পর্শ করতে পারবেন, এমনকি কোন্ মানুষদের সাথে তারা সম্পর্ক করতে পারবেন। ইজরায়েল একটি ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছিল, একটি ধর্মতন্ত্র, একটি ঈশ্বররাষ্ট্র, যেখানে ধর্ম এর সামগ্রিক অস্তিত্বের একমাত্র উদ্দেশ্যে পরিণত হয়েছিল।
এই শান্তিতে ব্যাঘাত ঘটিয়েছিলেন রাজা অ্যান্টিওকাস এবং তাদের দুর্দশা আবার নতুন করে শুরু হয়েছিল। কিন্তু এবার একটু পার্থক্য ছিল। এখন তাদের ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বাস বা তাদের ধর্মবিশ্বাসই তাদের দুর্দশার কারণ হয়েছিল। সুতরাং তাদের দুর্দশা মানে ঈশ্বর তাদের শাস্তি দিচ্ছেন, এমন ব্যাখ্যা আর তাদের যুক্তিসংগত মনে হয়নি। একটি নতুন ব্যাখ্যা তাই খুঁজে বের করা আবশ্যক হয়ে পড়েছিল। অ্যান্টিওকাসের নির্যাতনের সময় আরেকটি কাহিনির আবির্ভাব হয়েছিল। এবং এটি ইহুদি ধর্মে একটি নতুন উপাদান যুক্ত করেছিল, আর এটি শুধুমাত্র তাদের নিজেদের ইতিহাসের ওপর প্রভাব ফেলেনি, পরবর্তীতে আসা খ্রিস্টধর্ম আর ইসলামের ওপরেও এটি প্রভাব ফেলেছিল।
আমরা ইতিমধ্যে দেখেছি, নবীরা, যারা ইজরায়েলের ইতিহাসে মূলচরিত্র ছিলেন তারা কোনো ভবিষ্যদ্বাণী করে যাননি, তারা শুধু ইসরায়েলের ‘অতীত নিয়ে ঈশ্বরের ক্রোধের কথা বলেছিলেন। রাজা অ্যান্টিওকাসের সাথে তাদের সংগ্রামের সময় একটি নতুন চরিত্রের আবির্ভাব হয়েছিল, যিনি দাবি করেছিলেন যে, মৃত্যুর পরে কী ঘটে তিনি সেটি দেখতে পারেন, এমনকি ইতিহাসের পরেও, ভবিষ্যতে অনুগত দুর্দশাগ্রস্ত বিশ্বাসীদের জন্য ঈশ্বর কী নিয়তি নির্ধারণ করে রেখেছেন। পুরনো নবীদের ব্যতিক্রম, ঈশ্বরের সেই কণ্ঠটি তাকে যা বলেছিল সেটি প্রচার করতে তিনি একেবারে কেন্দ্রীয় মঞ্চ দখল করেননি। তিনি গুপ্তচরের মতোই সবার অগোচরে থেকেছিলেন, এবং তিনি যা শুনতেন তা কাগজে লিখে রাখতেন। এবং একজন গুপ্তচরের মতোই শক্রশিবির থেকে তার বার্তা পাঠাতেন। তিনি তার বার্তাগুলো সাংকেতিকভাবে লিখতেন, যেন শুধুমাত্র তার স্বপক্ষের কেউ সেটি পড়তে পারেন। এভাবে ঈশ্বরের কাছ থেকে গোপন তথ্য পাচার করার প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় অ্যাপোক্যালিপটিক’, বেশ ভীতিকর এই গ্রিকশব্দটির খুব সরল একটি অর্থ আছে। এর মানে, যা গোপন সেটি উন্মোচন করা, ঠিক যেভাবে কোনো থিয়েটারে পর্দা সরিয়ে ফেলা হয় মঞ্চে কী ঘটছে সেটি উন্মোচন করতে। এই অ্যাপোক্যালিপটিক লেখকদের কথা ভাবার সেরা উপায় হচ্ছে, তাদেরকে গুপ্তচর হিসাবে ভাবা, যারা শত্রুর বিরুদ্ধে ঈশ্বরের চূড়ান্ত যুদ্ধের পরিকল্পনা সম্বন্ধে জানেন। এবং সেই আগ্রাসনের জন্যে তার অনুগত বিশ্বাসীদের প্রস্তুত করতে তাদের প্রেরণ করা হয়েছে।
প্রথম ‘অ্যাপোক্যালিপটিক এজেন্ট নিজেকে ডানিয়েল নামে ডাকতেন। তিনি তার বার্তাগুলো সংক্ষিপ্ত একটি বইয়ে এমনভাবে লিখে গিয়েছিলেন, যা শুধুমাত্র তার ইহুদি-পাঠকদের কাছে বোধগম্য ছিল। তিনি এই কাহিনির প্রেক্ষাপট হিসাবে ব্যাবিলনের নির্বাসন-পর্বটিকে নির্বাচন করেছিলেন, শতবছর আগে যা ঘটেছিল। এটি আসলেই ছিল রাজা অ্যান্টিওকাসের নির্যাতনের সাংকেতিক বিবরণ, যা ঘটছিল, যখন এই বইটি লেখা হয়েছিল। এই বইটিতে মোট ছয়টি গল্প আর কিছু স্বপ্নের বিবরণ ছিল। সবচেয়ে বিখ্যাত গল্পটি ডানিয়েলকে নিয়েই ছিল এবং এর উদ্দেশ্য ছিল ইহুদিদের বোঝানো যে, নির্যাতনকারীর অত্যাচার সহ্য করেও তারা বাঁচতে থাকবেন।
ব্যাবিলনের নির্বাসিত ইহুদিদের একজন, ডানিয়েলের কাহিনিটিতে, তিনি পারস্য সাম্রাজ্যের একজন রাজকর্মকর্তা হয়েছিলেন। সাইরাসের পুত্র রাজা দারিউসের প্রিয়পাত্রও ছিলেন। সাইরাসই ইহুদিদের আবার তাদের স্বদেশ জুডেইয়াতে ফিরে যাবার অনুমতি দিয়েছিলেন। শুধুমাত্র ঈশ্বরের প্রতি তার বিশ্বাসের দৃঢ়তার কারণে নয় বরং প্রশাসক হিসাবে তার দক্ষতার কারণে ডানিয়েল রাজকর্মকর্তা হিসাবে রাজার সুনজরে আসতে পেরেছিলেন। কিন্তু ডানিয়েলের এই বিশেষ মর্যাদা অন্য কর্মকর্তাদের মনে ঈর্ষার বীজ বপন করেছিল। এবং তাকে ধ্বংস করতে পরিকল্পিতভাবে একটি ফাঁদ পাতা হয়েছিল। রাজা দারিউসকে তোষামোদ করে তারা প্রস্তাব করেছিলেন, তার একটি নতুন আইন প্রণয়ন করা উচিত, সারা সাম্রাজ্যজুড়ে দারিউস ছাড়া রাজ্যে আর কেউই অন্য কোনো দেবতার উপাসনা করতে পারবেন না। আর যে এই আইন ভঙ্গ করবে তাকে সিংহের গুহায় নিক্ষেপ করা হবে। দারিউস সেই আইনটি অনুমোদন করেছিলেন এবং ষড়যন্ত্রকারীরা দারুণ উল্লসিত হয়েছিলেন। তারা জানতেন যে, যাই ঘটুক না কেন, ডানিয়েল কখনোই ইসরায়েলের ঈশ্বরকে উপাসনা করা থামাবেন না।
তারা তার বাড়ির কাছেই ওঁত পেতে অপেক্ষা করছিল, এবং তাকে ঈশ্বরের উপাসনায় আবিষ্কার করেই রাজাকে জানিয়েছিলেন যে, ডানিয়েল তার আইন অমান্য করেছেন। রাজা খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছিলেন, যখন তিনি অবশেষে বুঝতে পেরেছিলেন তিনি আসলে তাদের ফাঁদে পা দিয়েছেন, কিন্তু আইন পাস করার কারণে তার এই উভয়সংকট থেকে বেরিয়ে আসার আর কোনো উপায় ছিল না। ভগ্নহৃদয় নিয়ে তিনি শাস্তি হিসাবে ডানিয়েলকে সিংহের খাঁচায় নিক্ষেপ করার নির্দেশ দেন। কিন্তু পরের দিন দেখা যায়, ডানিয়েল সেই খাঁচা থেকে অক্ষত অবস্থায় বের হয়ে আসছেন, সিংহদের সাথে তার রাত কাটানোর কারণে তার কোনো ক্ষতি হয়নি। ডানিয়েল যারা পড়েছেন তারা এই গল্পটি জানেন, যা তিনশত বছর আগে ব্যাবিলনে ঘটেছিল। এটি ছিল ইজরায়েলাইটদের ঈশ্বরের প্রতি বিশ্বস্ত থাকার কারণে অ্যান্টিওকাসের নিপীড়নের সময়, যা কিছু ইজরায়েলে ঘটেছিল সেই বিষয়ে। ডানিয়েল যেন তাদের বলছিলেন, যদিও তাদের সিংহের গর্তের মধ্যে ছুঁড়ে ফেলা হয়েছে, কিন্তু ঈশ্বর তাদের রক্ষা করবেন, যদি তারা তাদের বিশ্বাসে অটল থাকেন। তাদের প্রতিরোধ আর মনোবলকে আরো শক্তিশালী করে তোলাই এই বইটির উদ্দেশ্য ছিল।
কিন্তু সেটাই ডানিয়েলের একমাত্র প্রস্তাবনা ছিল না। ইজরায়েলকে তার দুর্দশায় শুধু আশ্বস্ত করতেই চাননি, তিনি ঈশ্বরের শত্রুর বিরুদ্ধে তার শেষ যুদ্ধে তিনি ইজরায়েলকে প্রস্তুত করতে চেয়েছিলেন। ভারতীয় ঋষিদের ব্যতিক্রম, যারা কিনা সময়কে অশেষ ঘূর্ণায়মান চাকা হিসাবে দেখতেন, যেখানে আত্মা পরম আনন্দময় শূন্যতায় পালাতে চায়, ইহুদি-চিন্তাবিদরা সময়কে দেখেছিলেন ঈশ্বরের ধনুক থেকে বেরিয়ে আসা তীরের মতো, যার যাত্রা শেষ হবে যখন এটি তার গন্তব্যে পৌঁছাবে। আর ডানিয়েলের মতে সেই সময়টি ছিল খুবই সন্নিকটে। সময়ের এই যাত্রার শেষে ইসরায়েলের দুর্দশাও অবশেষে শেষ হবে। তাদের সৃষ্টিকর্তার মুখোমুখি হতে ও তার বিচারের দণ্ড পালন করতে তখন বহুযুগ ধরে মৃতরা তাদের কবর থেকে উঠে আসবেন। এখানেই ডানিয়েল ইজরায়েলে প্রথমবারের মতো মৃত্যুর পরেও জীবন আছে আর শেষবিচারের দিনে ঈশ্বরের আইন অনুযায়ী সব কর্মের বিচার হবে, এমন বিশ্বাসটি নিয়ে এসেছিলেন।
সেই মুহূর্তঅবধি এর ইতিহাসে ইজরায়েলাইটরা মৃত্যুপরবর্তী জীবন নিয়ে সামান্যই আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। সময়ের এই সীমানায় তাদের সাথে ঈশ্বরের সাথে দেখা হয় ঠিকই, কিন্তু মৃত্যুতে মানুষের সময় শেষ হয়ে যায় এবং সেই দৃশ্য থেকে তারা বিদায় নেয়। বিদায়ী আত্মারা তারপর সেই অন্ধকারাচ্ছন্ন পাতালপুরী, ‘শেওলে’ যায়। ‘শেওল’ হচ্ছে সব ভুলে যাবার একটি জায়গা, যেখানে এমনকি ঈশ্বরকেও স্মরণ করা হয় না। ডানিয়েলের বইটি সেই সবকিছুই বদলে দিয়েছিল। তিনি তাদের বলেছিলেন, ইতিহাসে শেষে ঈশ্বর আমাদের এই সময়ের মধ্যে নিজেকে প্রকাশ করবেন এবং যারা ধূলায় ঘুমিয়ে আছেন, তারা জেগে উঠবেন; কেউ অনন্ত জীবনে, কেউ লজ্জা আর অনন্ত ঘৃণায়।
মৃতদের পুনরুজ্জীবন লাভ করার বিষয়টি ইহুদি ধর্মে একটি নতুন ধারণা ছিল এবং সবসময়ই এটি বিতর্কিত ছিল। একটি সময় এসেছিল, যখন ইহুদি ধর্মীয় শিক্ষকরা, যারা এটি বিশ্বাস করেন এবং যারা বিশ্বাস করেন না, এমন দুটিভাগে বিভাজিত হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এটি ছিল এমন একটি ধারণা, যা সময়ের সাথে আরো বেশি প্রভাবশালী হয়ে উঠেছিল। ডানিয়েল বিশ্বাস করেননি যে, মৃতরা এক-এক করে পুনরুজ্জীবিত হবেন, যখন তারা মারা যান; কিন্তু তিনি মনে করতেন আসলে যা হবে সেটি হচ্ছে একটি সাধারণ পুনরুজ্জীবন। সবাই তাদের কবরে ঘুমাবেন যতক্ষণ-না ঈশ্বর ইতিহাসের সমাপ্তি ঘটান, তখনতার শেষবিচারের মুখোমুখি হতে সবাই একই সাথে জেগে উঠবেন। এবং ডানিয়েল মনে করতেন খুব দীর্ঘ সময় এর জন্যে আর অপেক্ষা করতে হবে না।
আরো একটি বড় ধারণা ছিল তার। সেটি হচ্ছে ইজরায়েলাইটদের দেখানো যে, শেষ নিকটেই আছে। ঈশ্বর বিশেষ একজন গোপন প্রতিনিধিকে পৃথিবীতে প্রেরণ করবেন, যিনি হবেন ‘মেসাইয়া’; তিনি শেষ আক্রমণের জন্যে সবাইকে প্রস্তুত করবেন। মেসাইয়া মানে যিনি ‘অ্যানয়েন্টেড’ বা ‘যাকে তেল লেপন করা হয়েছে (মানবজাতির পরিত্রাণের উদ্দেশ্যে যার আবির্ভাব হবে)। তাদের নেতৃত্ব। দেবার জন্যে অতীতে যখন ইহুদিরা কাউকে রাজা হিসাবে নির্বাচিত করতেন, তখন তার মাথায় তেল লেপন করে দেওয়া হতো, তিনি-যে ঈশ্বরের দাস এটি ছিল তারই চিহ্ন। ডানিয়েল তখন ইসরায়েলকে বলেছিলেন খুব শীঘ্রই তাদের সব দুঃখের চির অবসান হবে, এবং শেষ খুব নিকটে এসেছে, তার সংকেত হচ্ছে, পরিত্রাতা মেসাইয়ার আগমন। কিন্তু তিনি পৃথিবীর বাইরে কোথাও থেকে আসবেন না। তাকে স্বর্গ থেকে মর্তে পাঠানো হবে না। তিনি তাদের মধ্যে বাস করেন এমন কেউ হবেন, এবং সব নজরে আসবেন তিনি, তার পরিচয় উন্মোচিত হবে। তিনি হয়তো ইতিমধ্যেই আমাদের মধ্যে আছেন, সুতরাং সতর্ক নজরে থাকুন। এভাবে ডানিয়েল ইজরায়েলকে সেই সময়টি স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, যখন তাদের সব দুর্দশা শেষ হবে, ঈশ্বর তাদের অশ্রু মুছিয়ে দেবেন। সুতরাং তারা নজর রাখতে শুরু করেছিলেন, একজন মেসাইয়ার আগমনের জন্যে তারা অপেক্ষা করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু তিনি কখনোই আসেননি। সবকিছুই আরো খারাপ হতে শুরু হয়েছিল।
অ্যান্টিওকাসের নিপীড়ন তুচ্ছ মনে হবে যদি সেটি আমরা রোমানদের প্যালেস্টাইন দখলের সাথে তুলনা করি, আর সেটি ঘটেছিল ৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। ১৫০ বছরের বিরামহীন অস্থিরতার একটি পর্ব এরপরে এসেছিল, যার মাঝে বিরতির মতো এসেছিল কিছু সম্মুখযুদ্ধ, পরিশেষে ‘সমাপ্তি’ আসার আগে। জেরুজালেমের মন্দির আবারও সেই সমস্যার কেন্দ্রে ছিল। ইহুদিরা তাদের নিজেদের জীবনের চেয়েও এই মন্দিরটিকে ভালোবাসতেন। এটি ঈশ্বরের জন্য তাদের সেই প্রতীকগুলো ধারণ করে, যিনি মিশর থেকে হাজার বছর আগে তাদের এখানে ডেকে নিয়ে এসেছিলেন। কিন্তু ঈশ্বরের প্রতি ইজরায়েলাইটদের অতি তীব্রমাত্রার আবেগ দেখে তাদের নতুন শাসক রোমানরা হতভম্ব হয়েছিলেন। রোমানদের দেবদেবীর কোনো অভাব ছিল না, এবং কোনো বিশেষ দেবতার প্রতি তাদের আবেগের বাড়াবাড়িও ছিল না। কাণ্ডজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ সেই দেবতাদের খুব গুরুত্বের সাথেও নিতেন না। কিন্তু এই ঈশ্বরের কী আছে, যা ইহুদিদের এমন আত্মঘাতী ভক্তির দিকে ঠেলে দিতে পারে?
কিংবদন্তি বলছে, যখন রোমান-সেনাপতি পম্পেই ৬৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জেরুজালেম জয় করেছিলেন, তিনি ইহুদিদের সেই ঈশ্বরকে খুঁজতে তাদের মন্দিরে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মন্দিরটি তৈরি ছিল ধারাবাহিকভাবে ক্রমশ পবিত্রতর হয়ে ওঠা বেশকিছু চাতাল দিয়ে। পম্পেই সেইসব চাতাল অতিক্রম করে অবশেষে সেই পবিত্রতম আশ্রয়স্থল, ‘হলি অব হলিসে এসে পৌঁছান। এটি মন্দিরের সবচেয়ে পবিত্র অংশ, যেখানে শুধুমাত্র সর্বোচ্চ পুরোহিতের প্রবেশ করার অনুমতি আছে। পম্পেই শ্রদ্ধার সাথে সেই ‘হলি অব হলিসে প্রবেশ করেন ইজরায়েলের ঈশ্বরকে এক পলক দেখতে। কিন্তু এটি ছিল ফাঁকা, সেখানে কিছুই ছিল না।
কারণ ইহুদিরা জানতেন কোনোকিছুই সেই কণ্ঠটির প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে না যা তাদের বহু শতাব্দী ধরেই তাড়া করে ফিরেছিল। দ্বিতীয় নির্দেশটি গভীরভাবে তাদের হৃদয়ে প্রবেশ করেছিল। খোদাই করা পাথর, অসংখ্য সাজানো উঠানসহ তারা বিস্ময়করভাবেই বিশাল একটি মন্দিরও নির্মাণ করেছিলেন। এটি তাদের খুব প্রিয় ছিল এবং পুরো ইতিহাসজুড়েই তারা এটি হারানোর জন্যে শোক করা অব্যাহত রেখেছেন। কিন্তু এর ঠিক কেন্দ্রে, সেই পবিত্রতম জায়গাটিতে কিছু ছিল না। পম্পেই সেখান থেকে ফিরে এসেছিলেন খানিকটা হতবাক হয়ে, এই ধর্মটির ঈশ্বরের প্রতীক হচ্ছে একটি শূন্যকক্ষ।
পরের শতাব্দী জুড়ে রোমানদের এই হতভম্ভতা ক্রোধে রূপান্তরিত হয়েছিল, যখন এই একগুয়ে মানুষগুলো আর তাদের অস্পৃশ্য, অদৃশ্য ঈশ্বরকে কোনো বিশেষ সুবিধা দেওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব অনুভূত হয়েছিল। সুতরাং রোমানরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন চিরকালের জন্যে এদের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। ৭০ খ্রিস্টাব্দে টাইটাস নামের একজন সেনাপতির নেতৃত্বে, তারা জেরুসালেম শহরটিকে মাটির সাথে মিশিয়ে দিয়েছিলেন এবং সেই মন্দিরটি ধ্বংস করেছিলেন। ১৪০ বছর আগে সেনাপতি পম্পেইয়ের পরিদর্শন-পরবর্তী সময়ে মন্দিরের আরো ব্যাপক সম্প্রসারণ ও সৌন্দর্যবর্ধন করা হয়েছিল। অবশেষে সবকিছুর অবসান হয়েছিল, ভেবেছিলেন টাইটাস, আমি তাদের ধ্বংস করেছি।
কিন্তু অবশ্যই তারা ধ্বংস হয়ে যাননি। আরো একটি দীর্ঘ নির্বাসনে তারা পৃথিবীর নানা জায়গায় ছড়িয়ে পড়েছিলেন, ইহুদিরা তাদের সবকিছুই হারিয়েছিলেন, শুধুমাত্র তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদটি ছাড়া : তাদের ঈশ্বর। তারা জানতেন পাথরের কোনো ভবনই তাদের ঈশ্বরকে ধারণ করতে পারবে না। এছাড়াও তারা ঐসব মানুষগুলোকে সন্দেহ করতেন, যারা ভাবতেন ঈশ্বরকে কোনো শব্দের দালানে তারা বন্দি করে রাখতে পারবেন। তারা যখন এই নতুন নির্বাসন সহ্য করেছিলেন, একই সাথে তারা মেসাইয়ার জন্যেও অপেক্ষা করছিলেন, মানবিক কোনো ব্যাখ্যায় ঈশ্বরকে সংজ্ঞায়িত করার কোনো প্রচেষ্টার সাথে ভিন্নমত প্রকাশের একটি ঐতিহ্য তারা লালন করেছিলেন।
এবং একটি গুরুত্বপূর্ণ আর বিরক্তিকর চরিত্রও সেই দৃশ্যে আবির্ভূত হয়েছিল : ‘হেরেটিক’ বা ধর্মীয় ভিন্নমতাবলম্বী। হেরেটিকরা বেশ অস্বস্তিকর মানুষ ছিলেন, বিব্রতকর নানা প্রশ্ন করে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাবনাগুলো চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। তাদের কাছ থেকে আমাদের অনেককিছুই শেখার আছে। তাদের মধ্যে বিখ্যাত একজনকে আমরা ইহুদি বাইবেলের ঠিক মাঝখানেই খুঁজে পাব।