সংযোজন ১ : গৈরিশ ছন্দ
গিরিশচন্দ্র যেসব নাটক লিখেছিলেন, তার সবই যে ছন্দোবদ্ধ, তা নয়। যেসমস্ত নাটক পৌরাণিক আখ্যানের ভিত্তিতে লেখা, কিংবা গোত্ৰবিচারে যা রোমান্টিক, শুধু তারই সংলাপকে তিনি ছন্দে বেঁধেছিলেন। আবার সেখানেও যে তার সমস্ত চরিত্রের সংলাপ একই ছন্দে বাঁধা, তা-ও নয়। একাধিক রকমের ছন্দের দোলা সেখানে আমরা দেখতে পাই। তার মধ্যে যেটা প্রধান ছন্দ, তাকেই আমরা ‘গৈরিশ ছন্দ’ বলে থাকি। একটা দৃষ্টান্ত দিচ্ছি :
“অভেদ কোরো না ভেদ, সতি!
জেনো মাতা,
ভাগীরথী-পাৰ্বতী, অভেদ।
বামদেব বাম
ভাবিলে, মা, অন্তর শিহরে!
কুমার আবদ্ধ বুঝি ভৈরবী মায়ায়!
বাক্য ধরো, অনুরোধ রক্ষা করো, মাতা।
শিবরানি সদয়া না-হলে
রুষ্ট শিব তুষ্ট নাহি হবে…।”
গিরিশচন্দ্রের জনা নাটক থেকে অগ্নির সংলাপের একটা অংশ এখানে তুলে দিলুম। যে-ছন্দে এই সংলাপ বাঁধা, তাকে একটা আলাদা রকমের ছন্দ বলে ভাবতে আমরা অভ্যস্ত হয়েছি। কী ছন্দ? না, গৈরিশ ছন্দ।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, গৈরিশ ছন্দ কি সত্যিই একটা আলাদা রকমের ছন্দ? তা কিন্তু নয়। পয়ার যেমন আলাদা কোনও ছন্দ নয়, ত্ৰিবিধ ছন্দের একটা বিশেষ রকমের বঁধনমাত্র, গৈরিশ ছন্দও আসলে তা-ই। মূল ছন্দ এখানে অক্ষরবৃত্ত বা মিশ্রকলাবৃত্ত। গিরিশচন্দ্ৰ সেই মূল ছন্দকে একটা বিশেষ বাঁধনে বেঁধেছিলেন, এবং সেই বাঁধন বা বিন্যাসটাই গৈরিশ ছন্দ বলে প্রসিদ্ধি পেয়েছে।
লক্ষণীয় যে, অক্ষরবৃত্ত এখানে অমিল বা অমিত্ৰাক্ষর। পঙক্তিশেষে মিল রাখবার ব্যবসথা। এখানে নেই। কিন্তু সেটাও কোনও নতুন ব্যাপার নয়। এমনকি, নাটকরচনার ক্ষেত্রেও নয়। একথা এইজন্যে বলছি যে, মাইকেল মধুসূদনের পদ্মাবতী নাটকের বেশ-কিছু সংলাপ ইতিপূর্বে এই অমিল অক্ষরবৃত্তেই রচিত হয়েছিল। নাটকের সংলাপে ব্যবহৃত ছন্দের ব্যাপারে গিরিশচন্দ্ৰকে, অন্তত সেই বিচারে, কোনও নতুন পথের স্রষ্টা আমরা বলতে পারি না। পথিকৃৎ এক্ষেত্রে গিরিশচন্দ্ৰ নন, মাইকেল।
তবে কি গিরিশচন্দ্ৰ এক্ষেত্রে মাইকেলের অনুসারীমাত্র? না, তা নয়। মাইকেলের হাতে যার প্রবর্তন, সেই অমিল অক্ষরবৃত্তের বিন্যাসে একটা মস্ত পরিবর্তন তিনি ঘটিয়ে দিয়েছিলেন। মাইকেলের সঙ্গে এ-ব্যাপারে তার পার্থক্যটা এইখানে যে, গিরিশচন্দ্ৰ তীর অক্ষরবৃত্তে-রচিত সংলাপের পঙক্তিগুলিকে একই মাপের রাখেননি; পঙক্তি থেকে ভাঙা পর্বকে ইচ্ছেমতো বাদ দিয়েছেন; তা ছাড়া, যত্রতত্র যতির ব্যবস্থা না-করে এমনভাবে তার যতিগুলিকে তিনি বিন্যস্ত করেছেন, যাতে সংলাপটািকে ঠিকমতো বলে যাবার ব্যাপারে কারও কোনও অসুবিধে না হয়। যতির এই স্বাভাবিক বিন্যাসের ফলে গিরিশচন্দ্রের নাট্যসংলাপে যে একটা অবাধ গতির সঞার হয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।
যা-ই হোক, আসল কথাটা হচ্ছে এই যে, আমরা যাকে গৈরিশ ছন্দ বলি, বস্তৃত তাকে অমিল অক্ষরবৃত্তের গৈরিশ বিন্যাস বললেই ঠিক হয়। এই বিন্যাসই জানিয়ে দেয় যে,অক্ষরবৃত্তের ব্যবহারে গিরিশচন্দ্রের দক্ষতা ছিল উল্লেখযোগ্য। আবার, ওই জনা নাটকেই বসন্তকে যখন আমরা বলতে শুনি :
“ওলো তোর নিত্যি নূতন ঢং,
বালাই বালাই, ছাই মুখে তোর, এ কী আবার রং!
এমন কথা বলবি যদি আর,
চলে যাব তোর সোহাগের মুখে দিয়ে ক্ষার…।”
তখন আমরা বুঝতে পারি যে, স্বরবৃত্ত বা দলবৃত্তের ব্যবহারেও তাঁর দক্ষতা কিছু কম ছিল না।
অবশ্য আমরা সবচেয়ে বিস্মিত হই। তখন, যখন দেখি যে, কোনও রকমের কাব্যছন্দের দোলাই যার মধ্যে নেই, সাদামাঠা গদ্যে রচিত সেই সংলাপের মধ্যেও অত্যন্ত কৌশলের সঙ্গে কিছু মিল তিনি ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ওই জনা নাটকের বিদূষক যখন বলে, “হরি হে, তোমার দোহাই- শীঘ্র না চরণ পাই। দুটো মোন্ডা খেতে এসেছি। দু-দিন, খেয়ে যাই।” তখন গোপন সেই মিলগুলি যে গদ্যের মধ্যেও খানিকটা দোল লাগায়, এবং তাকে – অন্তত খানিকটা পরিমাণে- পদ্যের দিকে এগিয়ে দেয়, তা-ও স্বীকার্য। সত্যি বলতে কী, গদ্যে-পদ্যে এই যে মেলবন্ধন তিনি ঘটিয়েছিলেন, যার ছায়া অত্যন্ত আধুনিক কালের কবিতার শরীরেও আমরা দেখতে পাই, এরই তাৎপর্য হয়তো সবচেয়ে বেশি।