১১. শেফালিকে অবকাশে রেখে

মা, শেফালিকে অবকাশে রেখে চলে গেছে, আমিও ওকে রেখে এসেছি অবকাশে। শেফালির সৎমার সংসারে আপন বলতে একটি মাত্র ভাই, সে ভাইও জানি না কী অপরাধ করে এখন জেলখানায়। শেফালি তার বেতনের টাকা জমিয়ে ভাইকে দিয়ে আসতো দুতিন মাস পর পর। একদিন ভাইটি বেরোবে জেল থেকে, বিয়েথা করে সংসার শুরু করবে, শেফালির এই একটিই স্বপ্ন। তার আর কোনও স্বপ্নের কথা আমি জানি না। বয়স আঠারো বা উনিশ, ছিলো বোধহয় কোনও স্বপ্ন, তুমি সম্ভবত জানো। এক শেফালি ছাড়া আর কেউ তোমার ওপর নির্ভর ছিলো না, তুমি ওকে একা রেখে চলে যাওয়ার পর বাবার দেখাশোনা করার দায়িত্ব শেফালি নিজেই নিলো। সে কাজটা বাড়তি কাজ, বাড়ির সবার জন্য সারাদিনের খাটাখাটনির পর বাবার ঘরটা গুছিয়ে রাখবে, বাবাকে খাবার দেবে। শেফালিকে প্রায়ই ফোন করে খুব আদর করে বলি, যেন বাবাকে দেখে রাখে, বাবার যেন কিছুতে খুব মন খারাপ না হয়। সেই হাসিখুশি শেফালি, ছুটে ছুটে বাড়ির সব কাজ একাই সেরে ফেলা শেফালি, হঠাৎ শুনি, মারা গেছে। সকালে কাপড় কাঁচতে গিয়ে কলের পাইপে হাত দিতেই ইলেকট্রিক শক লেগে ঠায় দাঁড়িয়ে রইলো। চিৎকার করেছিলো, সে চিৎকারে বাড়ির লোক দৌড়ে গিয়েছে বটে কাছে, কিন্তু ওকে বাঁচাবার চেষ্টা করতে কেউ সাহস পায়নি। মা, যে মেয়েটা তোমার কাছে কাছে থাকতো অনেক বছর, তুমি মারা গেলে সবচেয়ে বেশি কেঁদেছে যে মেয়ে, যে মেয়ে বাড়ির সবার আরামের জন্য দিন রাত পরিশ্রম করেছে, তাকে ইচ্ছে করলেই বাঁচানো যেত, কিন্তু সবাই দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখেছে ওর মরে যাওয়া। শেফালির ভাই মোটা অংকের একটা টাকা দাবি করেছিলো, নাহলে মামলা করবে বলেছিলো। দাদা নানা রকম আয়োজন করেছে টাকা না দিয়ে মীমাংসা করার। অথবা যদি দিতেই হয় টাকা, দাদার মাথায় শুধু যত কম দিয়ে পার পাওয়া যায় সেই ভাবনা। আমি টাকার পরিমাণ দাদাকে বারবার বলি বাড়াতে। কিন্তু আমার বলায় কী যায় আসে বলো! ওদের সবার কাছে আমি তোমার মতোই মৃত। আমার কণ্ঠস্বরকে ওরা কণ্ঠস্বর বলে মনে করে না। কণ্ঠস্বরের ওপারে যে জলজ্যান্ত একটা মানুষ আমি, তা তাদের আচরণে কোনওদিন প্রকাশ পায়নি। টাকা জিনিসটা চারদিকের সবার কাছে অত্যন্ত প্রিয়। শেফালির চলে যাওয়া সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছে বাবাকে। তুমি নেই, আমি নেই, ইয়াসমিন নেই, শেফালি নেই। বাবাকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসার আর কেউ তখন সংসারে নেই। দাদা আর হাসিনার ইচ্ছের মুঠোয় বাবাকে বন্দি হতে হল।

বাবা কেমন আছে, কী করছে খোঁজ নিতে প্রায়ই ফোন করি। বাবা বলে বটে যে ভালো আছে, কিন্তু বাবার কণ্ঠস্বরে আমি টের পাই বাবা ভালো নেই। বাবা কোনওদিনই তার অসুখের কথা কাউকে জানায় না। একদিন দাদা খুব সহজ শান্ত গলায় বললো বাবার কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শুনে আমার বুকের ভেতর থেকে ঠাণ্ডা একটা, জানি না কী নাম তার, মুহূর্তে সারা শরীরে ছড়িয়ে গেল। কিডনি কবে থেকে নষ্ট হচ্ছে? দাদার বক্তব্য আমার নাকি জানার কথা সব। সেই যে বাবা কলকাতায় এসেছিলো, তখনই নাকি কলকাতার ডাক্তাররা বলেছিলো কিডনি নষ্ট হচ্ছে। এসবের কিছুই জানি না আমি। কোনও ডাক্তার আমাকে বাবার কিডনি নষ্ট হওয়ার কথা কিছু বলেনি। ঘরে বাইরে সারাদিন অস্থির পায়চারি করলাম। ভেতরে বুদবুদের মতো দেশে ফেরার ব্যাকুলতা। বাবার এই দুঃসময়ে যদি পাশে না থাকতে পারি, তবে বেঁচে থাকার কী অর্থ! আশংকায় আমি কুঁকড়ে থাকি। অন্ধকারে নিজেকে মুড়ে একাপড়ে থাকি ঘরের কোনও কোণে। ফোন বাজলে বুকের ধুকপুক এমন বাড়ে যে মনে হয় দৌড়ে পালাই। একদিন অভিমানের গায়ে পাথর চাপা দিয়ে ইয়াসমিনকেই কাতর অনুনয় করি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যেন সে দেশে যায়। ইয়াসমিনেরও নিজের সমস্যার অন্ত নেই। বলতেও পারতো সে যাবে না, কিন্তু তোমার মৃত্যু তার স্নায়ুর ঘরবাড়িতে ভূকম্পন তুলে জানিয়ে গেছে মৃত্যু জিনিসটা ঠিক কী। কারও মৃত্যু না হলে আমরা বোধহয় দেখতে পাই না মৃত্যুর সত্যিকার চেহারা। ইয়াসমিন তড়িঘড়ি বাবার জন্য খাবার দাবার কাপড় চোপড় আর নানারকম উপহার কিনে রওনা হলো দেশে।

দাদার অভিযোগ শুরু হয়েছে বাবার নাকি হরেকরকম বান্ধবী আছে। বান্ধবীরা বাবার সঙ্গে দেখা করতে বাড়িতে ঢুকতে চায়। ওদের অর্ধচন্দ্র দিয়ে বাড়ি থেকে প্রতিদিনই বিদেয় করে দাদা। বিদেয় করার ঘটনা দাদা বেশ বীরত্বের সঙ্গে বর্ণনা করে। তার বীরত্ব আমাকে মোটেও পুলকিত করে না। দাদাকে বলি যা ইচ্ছে হয় বাবার, তাই যেন তাকে করতে দেওয়া হয়। বান্ধবীদের সঙ্গে বাড়িতে বসে বাবা কথা বলতে চাইলে বলবে। শুতে চাইলে শোবে। বাবার চরিত্র সংশোধনের গুরুদায়িত্ব দাদাকে নিতে বারবার বারণ করি। জীবন একটিই, এই জীবনটি যেমন ইচ্ছে যাপন করার অধিকার আরসবারমতো বাবারও আছে। সারা জীবন স্বাধীনতা ভোগ করে আসা মানুষকে অসুখের দোহাই দিয়ে টেনে হিঁচড়ে একটি বন্ধ ঘরে ঢুকিয়ে বন্দি করা হলে কেমন অস্থির হয় তার ভেতর বাহির, তা বাবা না হয়েও আমি অনুভব করি। বাবার মন ভেঙে যাচ্ছে, শরীর ভেঙে যাওয়ার চেয়েও তা অনেক বেশি ক্ষতিকর। শরীর যখন যাবার, যাবে। মনকে মরতে দিতে নেই। তুমি নেই মা, এখন আর বাবাকে তার বান্ধবীদের কাছ থেকে জোর করে দূরে সরিয়ে কার কী ভালো দাদা করছে! তুমি থাকাকালীন যে কাজটা কেউ কোনওদিন করেনি, তুমি না-থাকাকালীন কেন? বাবাকে এরকমও আর আশ্বাস দেওয়া হচ্ছেনা যে সে তার হারিয়ে যাওয়া জগৎটি ফিরে পাবে একদিন। অবকাশের অন্দরে বন্দি করে বাবার মতো কাজপাগল মানুষকে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে, মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া বাবার আর কাজ কিছু নেই। কী ভয়ংকর নিষ্ঠুর এই আচরণ। বাবার চেম্বারে চিরতরে তালা লাগিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা দাদার একার। ধীরে ধীরে বাবাকে নিজের মুঠোয় নিয়ে দাদা কী খেলা খেলছিলো কে জানে! কারও কথায় বাবা উঠছে বসছে, দৃশ্যটি বড় অচেনা ঠেকে। কী করে জানিনা দাদার হাতের ক্রীড়নক হয়ে পড়েছিল বাবার মতো ভয়ংকর একগুঁয়ে মানুষ! সম্ভবত কিডনি নষ্ট হওয়ার খবর বাবাকে বদলে দিয়েছিলো আগাগোড়া। মনে আছে, অবকাশের একটি ঘরে মৃত্যুর সঙ্গে রোজ যুদ্ধ করে চলেছো, বাবা বাড়ির বাইরে যেতে চাইলে আমি কালো ফটকে তালা দিয়ে রাখতাম, চাইতাম বাবা বাড়ি থাকুক। দিন দিন তুমি যুদ্ধে হেরে যাচ্ছো, মৃত্যু তোমার শরীর জুড়ে উলঙ্গ নৃত্য করছে, আমি চাইনি বাবা এ সময় বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও যাক। কিন্তু বাবার ওপর জোর চালিয়ে শেষ পর্যন্ত আমি জিততে পারিনি। যে করেই হোক বেরিয়ে গেছে বাবা। কেঁদে কেটে, অনশন করে, অভিমান করে, রাগ করে, চিৎকার করে হলেও বেরিয়েছে। তুমি মরে যাচ্ছে, তাতে কী, বাবা তো বেঁচে আছে, বেঁচে থাকতে হলে সবার আগে তাকে তার জগতে ফিরতে হবে। সেই জগৎ আমাদের সবার জগৎ থেকে আলাদা। সেখানে রোগী আছে, রোগিণী আছে। রোগ শোক চিকিৎসা বন্ধু বান্ধব আড্ডা গল্পগুজব চানাচুর বাদাম ইত্যাদি আছে। বহুঁকাল ধরে গড়ে তোলা বাবার নিজস্ব এই জগৎ। কোনও কিছুই তাকে সেই জগৎ থেকে সরাতে পারে না। তোমার মৃত্যুও নয়। সেই জগৎটি বাবার কাছ থেকে হঠাৎ কেড়ে নেওয়া হল। অনেককাল আগে বাবা আমাকে বলেছিলো তার মৃত্যু যেন হয় ওই চেম্বারের ওই চেয়ারে বসে, রোগীর প্রেসক্রিপশান লিখতে লিখতে, হঠাৎ। যে বাবা কোনওদিন একটি মুহূর্তের জন্য অবসরে বিশ্বাস করতো না, তার কেন ভালো লাগবে ভয়াবহ অবসর! বাবা যতটা অসুস্থ ছিল, তার চেয়ে বেশি অসুস্থ হতে লাগলো। অস্থিরতা চরমে উঠে সর্বনাশ করতে লাগলো তার। জীবনে প্রথম তাকে ভোগ করতে হচ্ছে বন্দিত্ব, প্রথম তাকে বুঝতে হচ্ছে যে তার ইচ্ছের কোনও মূল্য নেই আর। পুরুষদের সঙ্গে দেখা করার অধিকার বাবার আছে, মহিলাদের সঙ্গে নেই। এই নেইটা দাদার আদেশ। প্রথম প্রথম উপদেশ দিতো হয়তো, সেই উপদেশ ধীরে ধীরে আদেশে পরিণত হয়েছে। বাবার শারীরিক বা মানসিক অবস্থার কথা ভাবার কারও সময় নেই তখন! দাদা আর ছোটদা অলক্ষ্যে হয়তো বাবাকে মৃত্যুর জন্য তৈরি করেছিলো। ইচ্ছে করে ছুটে যাই, বাবাকে বাবার মতো করে তার শেষ কটা দিন বাঁচতে দিই। কিন্তু বন্দি তো বাবার চেয়েও বেশি আমি। বাবার মন প্রফুল্ল থাকে, আনন্দময় থাকে, এমন পরিবেশই বাবাকে দেওয়া হোক, এক এক করে ভাইদের, আত্মীয়দের সবাইকেই বলি। কিন্তু দূরের মানুষের দীর্ঘশ্বাস বা উপদেশ কিছুই কেউ গ্রাহ্য করে না। খুব ভালো করে বুঝি যে বাবা আর আগের বাবা নেই। কণ্ঠে অবসাদ। আশার আঙিনাগুলো আশংকায় আচ্ছাদিত। দাদা আগে বাবার কানে কানে কথা বলতো, মামা খালাদের বিরুদ্ধে যা নয় তা বলে কান ভারি করতে বাবার। কানাকানি দাদা এখন বাবার সঙ্গে করে না, যদি করে, করে ছোটদার সঙ্গে। কী করে বাবাকে শেকলে বাঁধা যায় এ নিয়ে জল্পনা। বাবা নাকি কথা শোনে না, বাইরে বেরিয়ে যায়। বাবাকে হয়তো শেকল দিয়ে বাঁধারই বন্দোবস্ত হচ্ছিল। বেঁধেছিল কি না জানি না, তবে ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে যে শেকল দিয়েছিল তা জানি। কেন, খুব নাকিপাগলামি করে বাড়ি থেকে বাইরে বেরোনোর জন্য? যদি বাইরে বেরিয়ে আবার ওই মহিলাদের বাড়ি চলে যায়! দুএকজন মহিলা নিয়ে দাদার তখন মাথা খারাপ হবার যোগাড়। কেন, মহিলারা বাবার বান্ধবী। এ বাবার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তুমি যখন হা হুতাশ করে মরতে, বাবার বান্ধবী বা স্ত্রী নিয়ে তুমি যখন বছরের পর বছর কেঁদে বুক ভাসাচ্ছো, কই দাদা তো মোটেও বাবার বান্ধবী-নেশা ঘোচানোর কোনও চেষ্টা করেনি। এখন হঠাৎ কেন? কারণ তুমি কি অনুমান করতে পারছে না মা? দাদার একটিই কেবল দুশ্চিন্তা। ওই মহিলাদের কাউকে আবার বিয়ে টিয়ে করে বসেনি তো কখনও। তাহলে তো বাবার বিরাট সম্পত্তির কোনও অংশ ওদের কারও হাতে চলে যাবে।

তোমার অবর্তমানে শুনেছিলাম কোন এক বিধবা ভদ্রমহিলার সঙ্গে নাকি বাবার বিয়ে জাতীয় কিছুকরিয়ে নেওয়া হয়েছিল, বৈধভাবে তারা মেলামেশা করতে পারবে এরকম কিছু। অবকাশে দাদারাই এটি ঘটার ব্যবস্থা করেছিলো। ভদ্রমহিলা নাকি অবকাশে প্রায়ই যেত, বাবাও যেতে তার বাড়িতে। যার সঙ্গে বাবা ঢাকায় বসে ফোনে কথা বলেছিলো, শুনে তুমি কেঁদেছিলে, তার সঙ্গেই এই ঘটনা। মেলামেশা করার আর কোনও রকম আইন আছে কিনা বিয়ে ছাড়া, আমার জানা নেই। তবে মুসলমানের আইন তো, পুরুষের বহুগামিতার সুযোগ সুবিধে বিস্তর। আমি তো দূরের মানুষ, দেশে আর কোনও দিন ফিরতে না পারা মানুষ। আমাকে খুব বেশি কিছু। জানানোও হয় না। নিজে ফোন করে বার বার জিজ্ঞেস করে করে যদি কিছু জানি তো জানি।

বাবা যা কিছুই করুক, তোমার অসুস্থতার সময় বাবার ওপর আমার যত রাগছিল, তুমি না থাকার পর কী করে যেন সব জল হয়ে গেল। তাকেই আঁকড়ে ধরে তোমার শূন্যতাকে আড়াল করতে চাইতাম মনে মনে। আমার সব মনে মনেই ছিল মা। তোমার সঙ্গে তোমার জীবনের বেশির ভাগ সময়ই বাবা অন্যায় ছাড়া আর কোনও আচরণ করেনি জানি মা। কিন্তু তারপরও বাবাকে আমি শ্রদ্ধা না করে পারি না। তুমিও তো চাওনি বাবার সঙ্গে কোনও অশোভন আচরণ করি। চিরকাল ভয়ে সিঁটিয়ে থেকেছি। বাবা আমাদের পেটাতো, ভয় দেখাতো। কিন্তু ভালোও তো বাসতো। তার ভালোবাসা কখনও অন্য বাবাদের ভালোবাসার মতো ছিল না। বাবারশাসনে জানি না ছেলেমেয়েরা কতটুকু মানুষ হয়েছে। দাদা তো চিরকালই বাবার ওপর নির্ভর করেই জীবন কাটালো। ছোটদাও অনেকটা। বাবার স্বপ্নপূরণ এক আমিই করেছিলাম। হুট করে ঢাকা মেডিকেল কলেজের চাকরি ছেড়ে দেওয়ায় বাবা মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলো। কিন্তু আমার সিদ্ধান্ত আমার সিদ্ধান্ত। আমি সম্ভবত বাবার মতো হয়েছিলাম। আমার মনোবলটা বাবার কাছ থেকে পাওয়া। ঝড় ঝঞ্জার সামনে ঋজু দাঁড়িয়ে থাকা বাবা। ভয় না পাওয়া, রুখে ওঠা, প্রতিবাদ করা বাবা। স্বনির্ভর হওয়া, মাথা উঁচু করে বাঁচা, বাবা। অহংকার, আত্মবিশ্বাস, বাবা। আর তুমি হচ্ছ আমার ভেতরে যে অবিশ্বাস্যরকম যে এক নরম হৃদয় আছে, মানুষের জন্য কাঁদা, কেঁদে বুক ভাসানো, সেটা বিলিয়ে দেওয়া, ভালোবেসে অকাতরে দান করা, তুমি। মাঝে মাঝে তীব্র হতাশায় যখন ডুবে থাকি, মনে হতে থাকে পৃথিবীতে কেউ বুঝি আমাকে ভালোবাসে না, আমি একা, একটি বিন্দুর মতো আমি একা, মনে হতে থাকে কী দরকার এই বেঁচে থাকার–সেটা তুমি। ছেলেমেয়েদের আর কারও মধ্যে এত তীব্র ভাবে তোমাদের দুজনের উপস্থিত নেই। ইয়াসমিন একটা সময় দুর্বিনীত দুরন্ত মেয়ে ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে বয়স বাড়ার পর বাবার সব গুণ চলে গিয়ে তুমি এসে উপস্থিত হয়েছে ওর মধ্যে। ঠিক তোমার মতোই অশান্তির সংসার ও করে যাচ্ছে। প্রায়ই স্বামীকে ত্যাগ করার কথা বলে, কিন্তু সন্তানের জন্য পারে না। আত্মবিশ্বাসের এক ফোঁটা কিছু নেই। নিজেকে কুৎসিত বলে মনে করছে, যদিও কুৎসিত নয়। তোমার আত্মবিশ্বাস ছিল, কিন্তু তোমার উপায় ছিল না। ইয়াসমিনের উপায় থাকলেও মনের জোর নেই। আসলে তোমার গুণগুলো ওর মধ্যে গিয়ে দোষে পরিণত হয়েছে। গুণএর মাত্রা অতিরিক্ত হলে সেটা আর গুণ থাকে না। ধরো মানুষের জন্য জীবন দেওয়ার গুণ যদি আমার ভেতরে আরও বেশি মাত্রায় থাকে, আমাকে হয়তো আত্মহত্যা করতে হবে। আর, বাবার গুণই ধরো, শক্তি সাহস, সংকল্প, দৃঢ়তা ঋজুতা ইত্যাদি অতিরিক্ত হলে জানি না কী করবো, হয়তো মৌলবাদীর সশস্ত্র মিছিলের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বলবো, সাবধান এক পা এগোবি না। দাদা আর ছোটদার মধ্যে আমি তোমাকে দেখি না। বাবার মেয়েমানুষের দোষ দ্বিগুণ বা ত্রিগুণ হয়ে ছোটদাকে ধরেছে। একসঙ্গে বেশ কটি সুন্দরীর সঙ্গে গোপন সম্পর্ক রাখতে সে পারদর্শী। বাবার সেদিক থেকে কপাল ভালো ছিল না। বিবাহিতা, অসুখী, অসুন্দরী, নিগুণ, এমনই দুএকটি ছিল হয়তো কপালে, কেউই কিন্তু তোমার চেয়ে দেখতে ভালো, তোমার চেয়ে বুদ্ধিমতী বা কম বয়সি ছিলো না, অন্তত যে দুজনের কথা শুনেছি। দাদার মাথা থেকে পা পর্যন্ত বাবার একটি গুণই দোষের মতো দেখা দেয়। বাবার মিতব্যয়িতা দাদার ভেতরে প্রবল পরিমাণে ঢুকে কৃপণতার আকার ধারণ করেছে। বাকিগুণ বা দোষ অত প্রকাশিত নয়। কৃপণতা অবশ্য তার বউ ছেলেদের ক্ষেত্রে তত নেই, যতটা বাকি পৃথিবীর জন্য।

মা, মাঝে মাঝে মনে হয় বহুগামিতা মানুষ নামক প্রজাতির স্বাভাবিক প্রবৃত্তি। আমরা সমাজের বিধি নিষেধ নিজেদের ভেতর ধারণ করে আমাদের স্বভাবজাত বহুগামিতাকে শরীরের না হলেও মনের শক্তি দিয়ে রোধ করি। ভালোবাসা নামক একটি দেয়াল এসে আমাদের সামনে অনড় দাঁড়ায়। সেই দেয়াল ডিঙিয়ে আমরা তথাকথিত পরনারী বাপরপুরুষের কাছে যেতে পারি না। বাবা যদি বহুগামিনা হতো, তোমরা দুজনেই খুব সুখী হতে পারতে। হঠাৎহঠাৎ যখন বাবার সঙ্গে তোমার ঘনিষ্ঠতা হতো, দুজনকেই কী প্রফুল্ল দেখতাম। ওরকম যদি সবসময় থাকতে পারতে। জানি তোমার উদ্যোগে কোনও কাজ হত না। বাবা যদি এগিয়ে আসতো, তবেই সম্ভব হত সম্পর্ক মধুর করা। তুমি তো একপায়ে সারাজীবন খাড়াই ছিলে বাবার সামান্য ভালোবাসা পেতে। তোমার অসুখ ধরা পড়ার পর বাবা যে বাধ্য স্বামীর মতো তোমাকে আদরযত্ন করতে শুরু করলো, নিজের বাড়িঘর, রোগী দেখা, বান্ধবী, সব ফেলে সব ভুলে–জানি না ওর পেছনে কী কাজ করেছিলো? অপরাধবোধ! মনে হয়। দুজনই তোমার অসুস্থতার সময় সবচেয়ে বেশি নিঃস্বার্থভাবে সেবা করেছে, সে বাবা আর আমি। বাবার আর আমার আরও গুরুত্বপূর্ণ মিল বোধহয় এটাও।

বাবাকে কোনওদিন কি বোঝাতে পেরেছি ভালোবাসি? তোমার জীবনের শেষ কটা দিন তোমার পাশে থেকে না হয় মিথ্যে হোক সত্যি হোক, বুঝিয়েছি ভালোবাসি। বাবার সেবা করা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি মা। সুইডেনের বাংলাদেশ দূতাবাসে গিয়ে আমার পাসপোর্টের মেয়াদ বাড়ানোর জন্য আবেদন করলাম, শেখ হাসিনার কাছে চিঠিও লিখলাম যেন আমাকে কিছুদিনের জন্য অনুমতি দেন দেশে ফেরার। জানিয়েছি, বাবা ভীষণ অসুস্থ, তাকে না দেখলেই নয় আমার। তারপরও কোনও উত্তর নেই। রাষ্ট্রদূত নিজে বেশ কয়েকবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠালেন এর গুরুত্ব বুঝিয়ে, সেসবেরও কোনও উত্তর নেই। উত্তর নেই ঠিক বলবো না, উত্তর হচ্ছে, না। অথচ দেখ, উঠতে বসতে শেখ হাসিনা কী কান্নাই না কাঁদছেন তাঁর নিজের বাবার জন্য! অথচ আমার বাবাকে দেখতে যেতে দিতে তাঁর আপত্তি। ওদিকে বাবা আমাকে যে কথা আগে কখনও বলেনি, বলছে যেন দেশে ফেরার চেষ্টা করি। বুঝি আমাকে দেখার জন্য বাবা ব্যাকুল হচ্ছে। ভয় নাপাওয়া বাবাও, বুঝি যে ভেঙেপড়েছে। আমারআর্তনাদ, আমারআকুলতা কিছুই বাংলাদেশ সরকারকে স্পর্শ করে না। বাবা তার মেয়েকে ডাক্তার বানালো, বাবার অসুস্থতার পাশে সবাই আছে, শুধু তার ডাক্তার মেয়েটি নেই। ডাক্তারির কিছুই না জানা দুই পুত্রধন বাবার পাশে আছে, যারা অনেকটা বাবার চিকিৎসকের ভূমিকা নিয়েছে। বিশেষ করে দাদা। দাদা নিজেকে প্রায়শ ডাক্তার বলে মনে করে। নিজের ডাক্তারি পড়া হয়নি, ওষুধ কোম্পানিতে চাকরি করেছে, গ্রামে গঞ্জে ওষুধ নিয়ে গেছে, গ্রামের অশিক্ষিত লোকেরা দাদাকে ডাক্তার বলে ডেকেছে। তারপর চাকরি ছেড়ে বাবার ফার্মেসিতে বসেছে, ওষুধ নিয়ে কারবার বলে বাজারের মাছওলা, তরকারিওলা ভাবতো ডাক্তারের ছেলে বুঝি ডাক্তারই হয়েছে। তারাও দাদাকে ডাক্তার ঠাওরাতো। ও কারণেও দাদারও ধারণা হয়েছে দাদা বুঝি ডাক্তারই। এখন বাবার অসুখের চিকিৎসা দাদা নিজ দায়িত্বে নিজের হাতে তুলে নিয়েছে। দাদাই সিদ্ধান্ত নেয় বাবাকে কখন হাসপাতালে যেতে হবে, বা ডাক্তার দেখাতে হবে। বাবা, কী কারণে জানিনা নিজের কোনও অসুখের জন্য বড় কোনও ডাক্তার দেখাতো না। নিজের চিকিৎসা নিজেই করতো। জানতে চিকিৎসা, কিন্তু কখনও কখনও তো অভিজ্ঞ ডাক্তারের কাছে যেতে হয়। শহরে নতুন নতুন বিলেত ফেরত ডাক্তার এসেছে। অনেকে বাবার ছাত্র। ডাক্তারি বিদ্যায় বাবার জ্ঞান এমন ছিল যে বিলেত ফেরত এফ আর সি। এস পাশ করা ডাক্তারের হাতে রোগী মরতে বসলে বাবার কাছে এসে বাঁচতো। বাবাকে অনেক বলতাম বড় ডাক্তার দেখাতে, কখনও রাজি হত না। কলকাতার ডাক্তার যে ওষুধ দিয়েছিলো সেগুলো কখন কোনটা খেতে হবে, বড় কাগজে লিখে দিয়েছিলাম, যেন ভুলে না যায় বাবা, প্রয়োজনে যেন ঘরের দেয়ালে টাঙিয়ে রাখে। দেশে ফিরে বাবা ওই কাগজও ফেলে দিয়েছে, ডাক্তারের দেওয়া ওষুধও খায়নি। নিজের যা পছন্দ তাই খেয়েছে। খেয়ে তো দিব্যি ভালো ছিল মা। হৃদপিণ্ডের কোনও অসুখে তাকে ভুগতে হয়নি। রক্তচাপ নিজের মতো করে ওষুধ খেয়ে কমিয়ে রেখেছে। গোলটা বাধলো ডায়বেটিস নিয়ে। ওটাও ঠিক থাকতো যদি খাবারটা বাবার ঠিক থাকতো। বাড়িতে সবার জন্য যে খাবার রান্না হয়েছে সেগুলোই তো বাবাকে খেতে হয়েছে। কোনওদিন মদ সিগারেট খায়নি। শাক সবজি খেতো। স্বাস্থ্যকর বা পুষ্টিকর খাবার বাড়িতে আনতো। যখন দাদা বা সিনা দায়িত্ব নিয়ে নিল বাড়ির সব ব্যাপারের, সংসার খরচের টাকা পয়সাও তখন তাদের হাতে, তারাই সিদ্ধান্ত নেয় কী তারা খাবে। বাজার থেকে মাছমাংস অঢেল আসে। দই মিষ্টি আসে। বাবার খাবারের জন্য কিছু আসার চল ছিল না। ক্ষিধে পেলে বাবা হয়তো’সামনে যা পেতো খেয়ে নিতো। কলকাতায় যখন এসেছিলো, বাবাকে শর্করামুক্ত খাবার খাওয়ানোর দিকে খেয়াল করিনি। বাবার ডায়বেটিস ধরা পড়ার পর, তুমি যতদিন অবকাশে ছিলে, শাক সবজিই বেশি খাওয়াতে। তুমি বাবার খাবারটা ঠিকঠাক দিতে, তুমি না থাকলে দেওয়ার কেউ নেই। বাবার সবকিছু ওলোট পালোট হয়ে গেলো। চেম্বার নেই। রোগী দেখা নেই। বাড়িতে যখন বসেছিলো, বাড়িতে দুটো তিনটে রোগী আসতো। কিন্তু বাড়ি তো আর চেম্বার নয়, এতকালের চেম্বারের স্বাধীনতা বাবা বাড়িতে পেতো না, সেই আনন্দও আর ছিল না। কারও ওপর নির্ভরশীল বাবা কোনওকালেই ছিল না। নিজের অসুখ নিয়ে অন্যের মাথাব্যথাও কোনওদিন সইতে পারতো না।

একসময় শুনি বাবাকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। কী করে এলো বাবা? না, যে গাড়ি বাবার জন্য কেনা হয়েছিল, সেটায় নয়, বাসে করে। আমার দেওয়া সেই গাড়ি হাসিনার এদিক ওদিক ঘোরার কাজে লাগবে, অসুস্থ বাবার জন্য গাড়ি ব্যবহার করলে চলবে কেন! বাবাকে ঢাকার হাসপাতালে নিয়ে গেল দাদারা। আমি সারাক্ষণ ফোনে খবর নিচ্ছি বাবাকে সান্ত্বনা দিচ্ছি। এত কালের প্রতাপশালী মানুষের বিষঃ কণ্ঠস্বর। বাবার মতো মানুষকে ভীত হওয়া মানায় না। বাবাকে জানাতে খুব কষ্ট হয়, যে, আমাকে দেশে যেতে দিচ্ছে না সরকার। বাবা যে কী অসহায় বোধ করছে, সে আমি বুঝি। বাবা তো আমার জন্ম থেকে চেনা। তারশক্তি যেমন জানি, তার দুর্বলতাও জানি। চিরকাল শক্তিমান হিসেবেই বাবা থেকেছে সবার কাছে। ভেতরে কোনও কারণে দুর্বল হলেও প্রকাশ করেনি কোনওদিন। কিন্তু ভালোবাসলে টেরপাওয়া যায়। যায় না মা? শক্তিমানেরও হৃদয় থাকে, সেই হৃদয় একসময় ভাঙে। বাবা যে কত অভিমানী ছিল, তা আমি আগে না বুঝলেও এখন বুঝি। বাবা অনেকটা শিশুর মতোও ছিলো। নিউইয়র্কের হাসপাতালে যখন চেকআপের জন্য ধরে বেঁধে ভর্তি করিয়েছিলাম, মনে আছে একবার ডাক্তার এসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, আপনার জন্ম তারিখটা বলুন তো! বাবা বললো, কোনটা বলবো? পাসপোর্টেরটা, সার্টিফিকেটেরটা, নাকি অরিজিনালটা। আমি হাসবো না কাঁদবো, বুঝিনি। বাবার কথা শুনে ডাক্তাররা মুখ টিপে হেসে বলেছিলেন, অরিজিনালটা বলুন।

বারডেম হাসপাতালের ডায়ালাইসিসের যন্ত্রপাতি সব আধুনিক। ডাক্তাররা যত্ন নিয়ে বাবাকে দেখছে, ওখানকার অনেক বিশেষজ্ঞই বাবার ছাত্র। দাদার কাছে এসব শুনে খানিকটা স্বস্তি হয়। কিন্তু একদিন অন্তর অন্তর শরীরের রক্ত পাল্টেনতুন রক্ত ভরতে বাবা কি আদৌ কোনও স্বস্তি পাবে, আমি বুঝে পাই না কী করবো। অকেজো কিডনির জায়গায় নতুন কিডনি বসানোর ব্যবস্থা যে করেই হোক করতে হবে। বাবাকে বলি কিডনি পাওয়া যাবে, অনেকে কিডনি দান করে, বিক্রি করে, কোনও একটা কিডনি তার জন্য পাওয়া যাবেই। একটুও যেন না ঘাবড়ে যায় বাবা। প্রতিদিনই মানুষের কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হচ্ছে। ট্রান্সপ্লান্টের জন্য তাকে বিদেশে নিয়ে আসবো, ইওরোপের কোনও দেশে নয়তো ভারতে। ওখানে কিডনি বিক্রি করার জন্য প্রচুর গরিব বসে আছে। কড়ি ফেললেই কেনা যায়। বাবা শুনে ভরসা পায়, কিন্তু বুঝি কী ভীষণ কষ্টকরই না এই অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা। টাকা পয়সার ব্যাপারে একদম না ভাবতে বলি বাবাকে। কিডনি নিয়ে দরদাম করার কোনও দরকার নেই। যত টাকা দরকার হয় কিডনি ট্রান্সপ্লান্টের জন্য, সব আমি দেব। বাবা একদিন জানালো, নান্দাইলএর এক লোক টাকার বিনিময়ে কিডনি দিতে রাজি। তাহলে কী আর ভাবনা, ওই লোককে নিয়ে বিদেশে যেতে হবে ট্রান্সপ্লান্টের জন্য। আমিও বসে নেই, বিভিন্ন দেশে হাসপাতাল আর ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বলে কিডনির ব্যাপারে পাকাঁপাকি একটা ব্যবস্থা করতে থাকি। বাবার ডায়ালাইসিস এবং হাসপাতাল খরচের টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে পাঠিয়ে দিই দাদার অ্যাকাউন্টে। বাবার কি টাকা নেই মা? তবে এই টাকা কেন আমাকে পাঠাতে হয়? এই প্রশ্নটি নিজে আমি করি না। কেউ চায়নি টাকা, তারপরও পাঠিয়ে দিই। পাঠিয়ে দিই এই কারণে যে বাবার টাকা পয়সার তদারকি এখন দাদা করছে। আর দাদার মতো কল্পণ লোক টাকা খরচের ভয়ে যদি চিকিৎসায় গাফিলতি করে, এই আশংকায় আমি পাঠাই। আমার টাকা নিয়ে অন্তত কৃপণতা করবে না এই একটি বিশ্বাস আমার। কিন্তু যারই টাকা হোক, যার পকেটে যখন যায়, সেটি তখন তার নিজের টাকা। আমার পাঠানো টাকা তখন দাদার হাতে, সে টাকা তখন দাদার, সুতরাং স্বভাবজাত কৃপণতা তার শুরু হয়ে গেল। দ্বিতীয়দিন যখন বাবা ডায়ালাইসিস করতে গেল বারডেমে, ডাক্তার বলেছিলো অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হবে স্যালাইনের সঙ্গে। কিন্তু দাদা বাবাকে হাসপাতালে রাখতে রাজি নয়। রাজি নয়ের কারণ একটিই, খামোকা টাকা খরচ। বাবার গলায় ফুটো করে নল ঢুকিয়েছে ডাক্তার, কড়া অ্যান্টিবায়োটিক সরাসরি রক্তে ঢোকাতে হবে, মুখের ওষুধে কাজ হবে না। হাসপাতালে ডাক্তারদের কড়া নজরে রাখতে হবে বাবাকে। কিন্তু ডাক্তারদের কথা দাদা শুনবে কেন? বাবার নিজের কি আর মত দেওয়ার সামর্থ্য আছে, দাদা যা ভালো বোঝে তাই করবে। বাবা এখন দাদার সম্পত্তি। আমি যে ফোন করে বারবার বলছি, ডাক্তার যা বলে তাই করো, নিজে কোনও সিদ্ধান্ত নিও না। দাদা আমাকে শান্ত করতে বলে দিল, ডাক্তার নাকি বলেছে বাড়ি নিয়ে যেতে পারে, মুখের ওষুধ দিয়ে দিয়েছে। গলায় কাঁচা ফুটো নিয়ে বাড়ি যাবে, আমার কিছুতে মন সায় দেয় না। কিন্তু দূর থেকে কতটুকুই বা করতে পারি আমি! বাবার সঙ্গে কথা কী বলবো, শরীরের ওই অবস্থায় বাবা শারীরিক ভাবে যত না, মানসিক ভাবে তার চেয়ে অনেক দুর্বল। ডাক্তার যখন দেখলো রোগীকে বাড়ি নিয়ে যাবেই দাদা, বললো পারলে বাড়িতে যেন স্যালাইনে কড়া অ্যান্টিবায়োটিক ইনজেকশান দেওয়ার ব্যবস্থা করে। না তা দেওয়া যাবে না, অগত্যা দাদা মুখে খাওয়ার কড়া ওষুধ লিখিয়ে নিয়ে এলো। কিন্তু ওই ওষুধের দাম যদি একটা পাঁচ টাকা হয়, দাদা নিশ্চিতই ভাববে ওষুধ কোম্পানিগুলোর মাথা খারাপ, লোক ঠকানোর ব্যবসায় নেমেছে ওরা। কী করবে দাদা? দেশি কোনও কোম্পানির অ্যান্টিবায়োটিক কিনে আনবে যেটার পঞ্চাশ পয়সা করে দাম। তাই করলো দাদা। সাংঘাতিক বুদ্ধিমানের কাজ করলো বটে। নিজের অতিবুদ্ধির জন্য দাদা নিজে বেশ গর্বিতও। সাধারণের চেয়ে বুদ্ধি তার বেশি, তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে দাদার মতো খুব বেশি কেউ আর নেই।

কী হল তারপর, বাড়িতে ভীষণ জ্বরে পড়লো বাবা। জ্বরে অনেকটাই অজ্ঞান। তখন হাসপাতালে নিয়ে গেলে ডাক্তার বলে দিল, সেপটিসেমিয়া। সারা শরীরে, সারা রক্তে তখন ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে পড়েছে। বাবার মাথাও অকেজো করে দিয়েছে। সেপটিকশকে চলে গেছে বাবা। যেন মুহূর্তের মধ্যে হয়ে গেল এমন। বাবা তখন কিছু বুঝতে পারে না, কিছু বলতে পারে না, মুখ দিয়ে শুধু গাঁ গ্যাঁ শব্দ বেরোয়। ভেবেছিলাম বেঁচে থাকলে বাবাকে কোনও না কোনও একদিন বাবা বলে ডাকবো, ভেবেছিলাম বাবাকে তুমি বলে ডাকবো। ডাকি বাবাকে। বাবার কানের কাছে ফোন দেওয়া হয়। বাবা তখন তো বোবা, বধির। বাবাকে বাবা বলে ডেকেছি, বলেছি বাবা তুমি জেগে ওঠো। হ্যাঁ, যখন সত্যি ডাকলাম, বাবা আমার এই ডাক শুনতে পায়নি। বড় দেরি হয়ে গেল মা।

বড় মামা, ঝুনু খালা সব গেছে দেখতে। তারা এই বোবা বাবাকে দেখে বিমূঢ়। আমি স্তব্ধ হয়ে আছি দূর বিদেশে। আমার সারা গা কাঁপছে আশংকায়। যদি আমাকে দেশে ফিরতে দেওয়া হত, বাবার এই অবস্থা হতে পারতো না মা। তুমি ভাগ্যে বিশ্বাস করতে পারো, আমি করি না। আমি মনে করি না কোথাও কেউ মানুষের জন্ম মৃত্যুর তারিখ লিখে রেখেছে। এবং সেই তারিখ অনুযায়ী সব ঘটছে। বাবা আজও বেঁচে থাকতে পারতো, বিদেশে তার কিডনি ট্রান্সপ্লান্ট হতে পারতো, দিব্যি আগের মতো জীবন যাপন করতে পারতো। জীবন তো মানুষের একটাই। এই জীবনটাকে যে করেই হোক বাঁচিয়ে রাখতে চাই আমরা। কিন্তু তুমি যদি জীবনের মূল্য না বোঝে, তবেই তুমি টাকা পয়সার হিসেব করবে, হাসপাতালে অসুস্থ মানুষকে চিকিৎসার জন্য না রেখে তুমি বাড়ি নিয়ে আসবে, কারণ এতে সুবিধে, দৌড়োদৌড়িটা কম হয়।

বাবা আবার কথা বলতে পারবে, এই আশায় আমি বসে থাকি, বার বার শুনছি অবস্থার কোনও পরিবর্তন হয়নি। দাদা, ছোটদা, ঝুনু খালা, বড় মামা, ফকরুল মামা সবার সঙ্গে কথা বলি। সবাই বিষণ্ণ। বাবা ফিরছেনা। তাকাচ্ছে চারদিকে, সেই তাকানো অর্থহীন। মুখের শব্দকে কেউ কেউ অনুবাদ করার চেষ্টা করছে, কিন্তু সবই নিশ্চয়ই ভুল অনুবাদ। ঝুনু খালা শুধু বললো, দুলাভাই কিছু বলতে চাইছে, পারছে না। কী বলতে চাইছিলো বাবা?

একসময় আমাকে জানিয়ে দেওয়া হল, বাবা আর শ্বাস নিচ্ছেনা। ঝুনু খালা ফোনে হাউমাউ করে কাঁদলো। আমি আর জানতে চাইনি এরপর কী ঘটছে। বাবাকে নিয়ে কী মৃত্যুউৎসব তারা করছে, জানতে চাইনি। আমার আগ্রহ, আবেগ সব বেঁচে থাকাকালীন। আমি মৃত্যুরপরের কোনও কিছুতেই বিশ্বাসী নই। জগৎ আমার সম্পূর্ণই ফাঁকা হয়ে গেছেমা। শেষ আশ্রয় বলে কিছু থাকে, বাবা আমার তাই ছিলো। বাবা ছিলো আমার গৌরব, জীবনের সবচেয়ে বড় অহংকার। বাবা ছিলো আমার পথ প্রদর্শক, আমার সাহস আর শক্তির উৎস। বাবা ছিলো বলেই আমি আজ আমি, এই যে মাথা উঁচু করে আজ পৃথিবীর সব দেশে চলতে পারি, সে বাবা আমাকে গড়ে দিয়েছিলো বলেই। আমার বাবা যদি অন্য কেউ হতো, তাহলে আজি আমিও অন্য কেউ হতাম। জীবনের যা কিছুই আমার কৃতিত্ব, বাবা ছাড়া কিছুই সম্ভব হতো না। সংগ্রামী বাবাকে দেখে দেখেই সংগ্রাম করতে শিখেছি। সামনে দুর্যোগ এলে বাবা যেমন করে সামলাতো, তেমন সামলাতে আমিও শিখেছি। আদর্শের জন্য প্রাণপাত করতে বাবা ছাড়া আর কাকে দেখেছি, চোখের সামনে!

.

তোমাকে যেমন অবকাশে অত্যাচার করছিলো দাদা আর দাদার বউ, একইরকম ভাবে বাবার ওপর শুরু হল অত্যাচার। এসব আমাকে বাবাই বলতো আর কাঁদতো। একসময় অবকাশে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিলো। নিজের বাড়ি। নিজের টাকা। সব নিজের অথচ খাবার জোটেনি বাবার। অভিমানে বাবা, ডায়বেটিসে কিডনি নষ্ট হতে থাকা বাবা, যেখানে তার মাছমাংস খাওয়া বারণ, ছটকুর রেস্তোরাঁয় গিয়ে ওসবই খেতো৷ কী করবে বলো! কে তাকে আদর করে সবুজ সবজি সেদ্ধ করে দেবে। হাসিনা তো দেবে না। হাসিনার সঙ্গে রাগ করে বা অভিমান করে বাবা কথা বন্ধ করে দিলে লাভ হাসিনারই হয়। হাসিনা, আমার ধারণা, চাইছিলো বাবা যেন তাড়াতাড়ি মারা যায়। যেমন চাইছিলো তুমি যেন মারা যাও। কষ্ট পেতে পেতে, দুর্ভোগ পোহাতে পোহাতে যেন মরো। এত আদর করে বউকে ঘরে তুলেছিলে। মুখে তুলে খাওয়াতে। কোনওদিন যাকে রান্নাঘরের ছায়াও মাড়াতে হয়নি। কারও জন্য রাঁধা তো দূরের কথা। বরং বিয়েরপর বাবা তাকে কলেজে ভর্তি করিয়ে দিল, বিএড এমএড পাশ করতে। বউ কলেজ থেকে ফিরলে তুমি তাকে আদর করে খেতে বসাও, ঠিক যেমন করে তোমাদের ছেলেমেয়েদের খাওয়াও। যে বউ শুধু আমাদের দু বোনকে অপমান করে অবজ্ঞা করে অপদস্থ করে ছাড়েনি, এমনকী গায়েও হাত তুলেছে। ভেবেছিলাম দুবোনকেই বোধহয় শুধু। কিন্তু তোমার মতো মাটির মানুষকে, যে মানুষ জীবন দিয়ে দেয় ছেলে মেয়েদের জন্য, ছেলের বউদের জন্য, তাকে চোখের জলে ভাসাতো। তোমার টাকাপয়সা ধন দৌলত কিছু ছিল না। ছিল বড় একটা হৃদয়। এই তোমাকেই যে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে, সে বাবাকে দেবে না কেন! বাবার আজীবন প্রতাপছিল। যে বাবাকে দেখে ভয়ে কেঁপেছি সারাজীবন, সেই বাবা দুর্বল হয়ে পড়লে গালি গালাজ করার স্পর্ধা তো আমাদের কারও হয়নি। হয়েছে হাসিনার। হাসিনা দিনভর অকথ্য ভাষায় বাবাকে গালি দিত। উঠতে বসতে অপমান করতো। বাবার সেই রোষ আর ছিল না। দাদা ভেঙে দিয়েছিল। বাবাকে ঘরবন্দি করে ভেঙে দিয়েছিল বাবার সব দাপট। বাবার চেম্বারবিক্রি করে দিয়ে গুঁড়ো করে দিয়েছিল বাবার সব স্বাধীনতা। পরাধীন বাবা মাথা নিচু করে দাদার আর দাদার বউএর অত্যাচার সইতো। প্রতিদিন। যে মামাদের বিরুদ্ধে কথা বলে বলে বাবা সময় কাটাতো দাদার সঙ্গে, দাদার বউএর অত্যাচার থেকে বাঁচতে সেই মামাদের কাছে গিয়ে বাবা আশ্রয় নিতো। ছটকুর কাছে সংসারের দুঃখের কাহিনী বাবা বলতো। সব শুনে ছটকু আমাকে ফোন করতো। যেন বাবার সমস্যার সমাধান করি, যেন বাবার কান্নাগুলো শুনি। বাবা সত্যি সত্যি কাঁদতো। মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকা বাবা, কোনও দুর্যোগ দুঃসময় যাকে ভাঙতে বা মচকাতেপারতোনা, সেইভয়ংকর প্রতাপশালী বাবা কী করে এমন অসহায় হয়ে যেতে পারে! কে তাকে অত নিরস্ত্র করেছিলো? বয়স? ওই বয়সে মানুষ দাপিয়ে বেড়ায়। অসুখ? অসুখ তো বাবাকে কোনওদিনই কাবু করতে পারেনি। কী অসুখ ছিল বাবার? ধীরে ধীরে কিডনি নষ্ট হচ্ছিল। হচ্ছিল, হয়ে তো আর যায়নি। কত কিডনি নষ্ট হওয়া মানুষকে দেখেছি, রক্ত পাল্টাচ্ছে, আর দিব্যি বেঁচে থাকছে। আত্মীয় স্বজন আর বন্ধুরা পাশে থাকলে শরীরে অসুখ থাকলেও, মনে সুখ থাকে। কিন্তু বাবার শারীরিক কষ্টের চেয়ে মানসিক কষ্টটাই দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। বাবার টাকায় দাদা তার বউ বাচ্চা নিয়ে বাবার বাড়িতে থাকছে, খাচ্ছে, পরছে। সেই বাবাই বাড়িতে জবুথবু বসে থাকে। শুভ, তার আদরের নাতি তাকে ছুরি নিয়ে তাড়া করে, বাবা ছুরির ভয়ে দৌড়ে পালায়। না, নাতির সঙ্গে দাদাভাইয়ের খেলা নয়, বাবা সত্যি সত্যি ভয়ে দৌড়োয়। কাঁদতে কাঁদতে আমাকে তো বললোও হাসিনা নাকি ফাঁক পেলেই বলে, দুনিয়ার কত কেউ মরে, বুড়োটা মরে না কেন!’ বাবার চুল পাকেনি, বয়স সত্তরও হয়নি, মাথায় কোনও গণ্ডগোল হয়নি, দিব্যি শক্ত সমর্থ মানুষ, সেই বাবাকে বুড়ো, দুর্বল, পঙ্গুর মতো ঘরে বসিয়ে রাখলো, ঘরে বসিয়ে বাবার মতো কর্মঠ কাজপাগল মানুষকে মেরে ফেললো! হ্যাঁ মা, বাবা আর সেই বাবা ছিল না। দাদা দৌড়োচ্ছে বাবার সম্পত্তি পেতে। দাদার বউ ঘরে অতিষ্ঠ করে মারছে বাবাকে। যে অসুখে যে খাবার খাওয়া বারণ বাবার, বাবার কপালে সেসব ছাড়া আর কিছু জুটছেনা। ক্ষিধে পেলে বাবা করবে কী? তার নিজের বাড়ির রান্না করার তোক তো আর তার কথা শুনবে না, শুনবে দাদা, হাসিনা আর তাদের ছেলেদের হুকুম। বাবার কান্না শুনতে হয় আমাকে দিনের পর দিন। দাদাকে জিজ্ঞেস করেছি, বাবা কেন খাচ্ছেনা বাড়িতে? ’দাদার ঠাণ্ডা উত্তর, বাবা কথা শোনে না, বাইরে বেরিয়ে যায়, বাড়িতে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। বাবা খাওয়া বন্ধ করেছে, এতে দাদার কী। তার কোনও উদ্বেগ নেই। দাদার উদ্বেগ অন্য কিছুতে। বাবা আবার গোপনে কোনও বিয়ে নিয়ে যদি করে বসে তাহলে তো সম্পত্তির ভাগ চলে যাবে অন্য কোনওদিকে। বাবাকে সত্যিকার বাঘ বা সিংহের মতো চেপে ধরে দাদা একদিন শুনে নিল বাবা নাকি এদিকে ওদিকে দুএকটি বিয়েও করে রেখেছে। মা, তোমার কি কষ্ট হচ্ছে শুনতে? নাকি কষ্টের ওপারে চলে গেছ! বাবার কোনও স্থলনে তোমার হয়তো আর কষ্ট হয় না। জানতেও না। তো কত কিছু। যখন অসুখ তোমার, অসুখ যখন ধরা পড়লো, শুধু ধরা পড়া বলবো কেন, যখন ডাক্তার বলে দিয়েছে সব, কবে তুমি মরে যাবে, সব জেনেও তোমাকে তো কাঁদিয়েছে বাবা। জীবনে কেঁদেছো মা অনেক। দাদা তো বাবার ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে মাথা কখনও ঘামায়নি। কিন্তু হঠাৎ এমনই অসভ্যের মতো ঘামানো শুরু করলো যে দেখলে হয়তো তোমার ভালো লাগতো। কিন্তু ভালো কি সত্যিই লাগত! তুমি তো নিশ্চয়ই জানতে এই ঘামানোটা আসলে বাবার সম্পত্তির ভাগ বাইরের কাউকে না দেওয়ার জন্য ঘামানো।

আমার জন্য বাংলাদেশের দরজা বন্ধ। ইয়াসমিনকে পাঠিয়েছিলাম বাংলাদেশে বাবার সঙ্গে থাকার জন্য। ইয়াসমিন গিয়ে হাসিনার দাপট উপেক্ষা করে কিছুটা বাবার যত্ন করেছিল বটে, কিন্তু ও চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে আবার আগের মতো দুরবস্থায় ফিরে যেতে হয়েছিল বাবাকে। ইয়াসমিনকে দিয়েও দাদা যে কাজটি করতো, সে কাজ করিয়েছে। বাবার বান্ধবীরা বাবার সঙ্গে দেখা করতে এলে অপমান করে বাড়ির ফটক থেকে তাড়িয়েছে। জানিনা সবাই হয়তো ভেবেছে, বাবার সাংঘাতিক উপকার তারা করে ফেলেছে। কী জানি কিসের উপকার। বাবাকে তারা জীবনের শেষ সময়ে এসে সতী সাধ্বী পুরুষ বানাতে চাইছিল হয়তো। বাবা একা একা পড়ে থাকতো হতাশার চরমে ডুবে। ওষুধ টষুধ সম্ভবত খেতো না। ওষুধ খাওয়াবার দায়িত্ব নেবে দাদা, সে সময় তার কই! আমার কেন যেন মনে হয়, হাসিনা বাবার মৃত্যুর জন্য দিন রাত প্রার্থনাই শুধু করছিল না, মরতে হলে যা যা করা প্রয়োজন তার সবই প্রাণপণে করে যাচ্ছিল। দাদা তড়িঘড়ি সব গুছিয়ে রাখছিল বাবার মৃত্যু হলে যেন তার কোনও অসুবিধে না হয়। বাবাকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে জেনেছে কাকে কাকে বিয়ে করেছে, তাদের সবাইকে দাদাই বাবার সই নিয়ে তালাকনামা পাঠিয়ে দিয়েছে। পুংখানুপুঙ্খ হিসেব নিচ্ছিল দাদা, বাবার ধন দৌলত কোথায় কী আছে। কোথায় কোন অঞ্চলে কোন মাটি লুকিয়ে আছে। ইয়াসমিন দেশ থেকে ফিরে খবর দিল, বাবা উকিল ডাকছে বাড়িতে, দাদার সঙ্গে বসে পরামর্শ করছে সম্পত্তির ব্যাপারে। বিশাল সম্পত্তির মালিক বাবা, এ তো আমরা জানতাম। ঠিক কীরকম বিশাল সেই সম্পত্তি, তা হয়তো জানা ছিল না। বাবা যখন দাদার সঙ্গে জমি জমা নিয়ে কথা বলতে, ইয়াসমিন ঘরে ঢুকলে দুজনই চুপ হয়ে যেত। বাড়িতে উকিল এসে কথা বললেও সে ঘরে বাবার সঙ্গে দাদা থাকতো, ইয়াসমিনের থাকাটা কেউ চাইতো না। ইয়াসমিন বুঝতে পারছিল, তার উপস্থিতি অনাকাঙ্ক্ষিত। কিন্তু বাবার সন্তান হিসেবে দাদার যেটুকু অধিকার, সেটুকু তো ইয়াসমিনেরও অধিকার। বাবা যদি হিসেব করতে বসে তার সম্পদ সম্পত্তির, সেখানে তার সব সন্তানের উপস্থিতিই তো স্বাভাবিক। আলোচনা থেকে ইয়াসমিনকে বাদ দেওয়া হয় কেন! কেন হয়েছে তার রহস্য তখন না বুঝলেও সে অবশ্য পরে বুঝেছে।

বাবার মতো মানুষ, যে জীবনে কোনওদিন প্যান্ট সার্ট কোট ছাড়া কিছুপরেনি। পাজামা পাঞ্জাবি শুধুঈদের সময় পরতো। অনেকটা সামাজিক কারণেইপরতো। ধর্মীয় কোনও কারণ তো বাবার ছিল না। পাঞ্জাবিপাজামা টুপি দাড়িঅলা পাঁচবেলা নামাজ পড়া বিচক্ষণ বড়লোক এম এ কাহহার আর তারই ভাই মোমেনকে বাবা খুব শ্রদ্ধা করতো। বাবা কিন্তু ওদের পোশাক দ্বারা কোনও রকম প্রভাবিত হত না। এম এ কাহহার নিজেরপাড়ায় একটি মাদ্রাসা আর মসজিদ গড়ে দিয়েছে। বাবা জীবনে কখনও মসজিদে যায়নি, মাদ্রাসাতেও যায়নি, ওসব তৈরি করা তো দূরের কথা। মসজিদের চাঁদাও কখনও দিয়েছে বলে মনে হয় না। শুধু কি ওরাই, বাবার চারদিকে যারা ছিলো তাদের সবারই তো ধর্মের দোষ ছিল! বাবা কেন মোটেও চারপাশ দ্বারা প্রভাবিত হয়নি, অন্তত এই বিশ্বাসের ব্যাপারে! অন্য কত কিছুতে তো প্রভাবিত হত। জীবনের সব কিছু তো বাবার নিজের উদ্ভাবনের বিষয় ছিল না! নিজে ঘোষিত নাস্তিক না হয়েও কী করে দিব্যি ধর্ম থেকে। যোজন দূরে বাস করেছে! বছরে দুবার শুধু নামাজে দাঁড়াতো। তাও ওইঈদের মাঠে। সামাজিকতা বজায় রাখার জ্ঞান আবার টনটনে ছিলো। ওটা না করলে চলে না। কিন্তু নামাজ তত বাবা পড়তে জানতো না। কোনও সুরা সে জানতো না। লোকরা মাথা নোয়ালে সেও নোয়াতো, ওঠালে ওঠাতো। এ ছাড়া আর কী! একবার সুরা শেখার জন্য একটা লোক রেখেছিলো মনে আছে, জানিনা ওটা আবার কারপাল্লায়পড়ে করেছিলো। দুদিনপর লোককে বিদেয় করে দিয়েছে। ও বাবার পোষাতো না।

মানুষ তো এমন, বয়স বাড়লো, হঠাৎ হুট করে টুপি দাড়ি শুরু হল, পাজামা পাঞ্জাবি শুরু হল, পাঁচবেলা নামাজ শুরু হল। কিন্তু বাবা কেন কোনওদিন সামান্যও বদলাতে চায়নি নিজেকে! .. একটুও ধর্মচিন্তা তার ভেতরে আসেনি। বাবার ওই মেয়েমানুষের দোষ ছাড়া আর তোমাকে অবহেলা করা ছাড়া আর তো কোনও দোষ ছিল না। সব তো তার গুণই ছিল। তারপরও দেখ মেয়েদের নিয়ে যা করতো, সব কিন্তু বাইরে করতো। কোনওদিন ঘরে কোনও মেয়েকে আনেনি। কোনওদিন আমাদের কাউকে বুঝতে দেয়নি আদৌ তার কোনও সম্পর্ক কারও সঙ্গে আছে। কেবল শুনেছি, প্রমাণ পাইনি। নিজের কোনওকিছু ছেলেমেয়েদের না জানানোর মানসিকতাই। বা কোথায় বাবা পেয়েছিলো, যখন অন্যরা দিব্যি দ্বিতীয় বিয়ে করে বাড়িতে বউ তুলছে! বাবা তার নিজের ব্যক্তি-জীবন, অন্য কারও সঙ্গে সম্পর্ক বা বিয়ে আমাদের জীবন এবং জীবন যাপন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা রেখেছিলো। এক শহরেই বাস করি, অথচ কোনওদিন আমাদের জানা ছিল না বাবা বাড়ির বাইরে কোথায় কার সঙ্গে কী সম্পর্ক করছে। এমন কোনও রাত নেই, যে রাতে বাবা অবকাশে রাত কাটায়নি। শুধু শহরের বাইরে কোনও মেডিকেল কলেজে পরীক্ষা নিতে গেলে বা চাকরিসূত্রে কোথাও গেলে দেখেছি বাবা নেই অবকাশে। ইস্কুল শেষ না হতেই দেখতাম মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। শহরের অন্য বাবারা তো মেয়েদের যে লেখাপড়া করে বড় হবার, নিজের পায়ে দাঁড়াবার দরকার আছে, তা-ই মনে করেনি। কিন্তু বাবা তো ওদের মতো ছিল না। এমনকী বন্ধু কাহহার বা মোমিনের মেয়েদেরও তো ইস্কুলের গণ্ডি পেরোতে না পেরোতে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দিয়েছে, শুধু ছেলেদের লেখাপড়ার জন্য যা করার সব করেছে। বাবা ওদের কাছ থেকে শেখেনি সমাজের এই নিয়মটা। তার কাছে প্রতিদিন লোক আসতো মেয়েদের বিয়ের জন্য পাত্রর খোঁজ নিয়ে, সবাইকে এক বাক্যে বাবা না করে দিত। বাবা তো ওই সমাজেই বাস করতো, যেখানে মেয়েদের অল্পবয়সে বিয়ে দিয়ে দেওয়াটাকেই যৌক্তিক মনে করতে সবাই। বাবা তো তার গন্ডগ্রাম নান্দাইল থেকে মেয়েদের ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার বানানোর চিন্তাধারা নিয়ে আসেনি! যদি বাবাকেশিখতেই হয় অন্যদের থেকে, যদি তার নিজের না হয় এই আবিষ্কার, তবে দেখ, যারা শহরের শিক্ষিত বনেদি বাড়ির বড় বড় লোক, যাদের মেয়েরা লেখাপড়া চালিয়ে যেত, বড় হতো, সেসব বাড়ির সঙ্গে বাবার খুব মেলামেশা না থাকার পরও বাবা ওদের ওই নিয়মকে পছন্দ করলো কেন, কেন সমাজের বেশির ভাগ মানুষের নিয়মকে নয়!

মনে আছে বাবার ওপর ক্ষুব্ধ তখন আমি, যখন তোমার ওই বৃত্তির ব্যানারটা দেখিয়ে দেখিয়ে বলেছিলাম, হ্যাঁ মার নামে ইস্কুল হবে, মার নামে বৃত্তি হয়ে গেল, বাবার মতো চরিত্রের লোকদের জন্য কিছুহবেনা। কেউ করবেনাইস্কুল, কেউ দেবে না বৃত্তি। বাবা তোমার পাশে বসে শুনলো। বাবাকে অপমান করার জন্য জোরে জোরেই বলছিলাম। তোমাকে খুশি করার জন্য, তৃপ্তি দেওয়ার জন্য, বাবাকে কেঁচোর মতো কুঁচকে ফেলার জন্য। জীবনে যে কখনও ভেঙে পড়ে না, তাকে ভাঙতে চাইছিলাম। যার জীবনে কোনও কষ্ট নেই, তাকে কষ্ট দিতে চাইছিলাম। তোমাকে এতকাল যেভাবে বাবা অপমান করেছে, সেই অপমানের প্রতিশোধ নিচ্ছিলাম মা। কীরকম বেপরোয়া আর বেয়াদপ হয়ে উঠেছিলাম। যে বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে কোনওদিন কথা বলার সাহস ছিল না, সেই বাবাকে মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়ার সব আয়োজন আমি করছি। তোমারও বোধহয় আমার ব্যবহার দৃষ্টিকটু লাগছিল। তুমি সম্ভবত বলেছিলে, এরকম বলো না, তোমার বাবারও তো শরীর ভালো নয়, পরে এই ব্যবহারের জন্য তোমারই কষ্ট হবে। তুমি ঠিকই জানতে মা, ওই ব্যবহারের জন্য আমার পরে কষ্ট হবে। বাবা শিশুর মতো বলেছিলো, আমার জন্যও ইস্কুল হবে। কোনওদিন কাঁদতে দেখিনি বাবাকে। কোনওদিন কোনও কারণে চোখের জল ফেলতে দেখিনি। কিন্তু যখন বলছিলো আমার নামেও ইস্কুল হবে, নান্দাইলে। বাবার ঠোঁট কেঁপে উঠছিল অভিমানে, অপমানে। হয়তো চোখও ভিজে উঠেছিল। বাবা বোধহয় একটু আড়াল করে চোখটা মুছেও নিয়েছিল মা। সারাজীবন বাবার কাছ থেকে যে দুঃখ পেয়েছো তুমি, তার শোধ নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু শোধ নিতে গিয়ে বাবাকে যে কষ্ট দিয়েছি, সেটাও কি এখন আমাকে কম ভোগাচ্ছে!

নান্দাইলে বাবার নামে ইস্কুল তো হওয়া উচিত মা। বাবা কাদামাটি থেকে উঠে এসে নিজে একার চেষ্টায় লেখাপড়া করে ডাক্তার হয়েছে। নিজের বই ছিল না, বই কেনার টাকা ছিল না, মেডিকেল কলেজের এক সহপাঠীকে অনুরোধ করে করে রাজি করিয়েছিলে রাতে যখন সে ঘুমিয়ে যাবে, তখন তার অ্যানাটমি বা ফিজিওলজি বই নিয়ে আসবে বাবা, রাত জেগে সে বই পড়ে ভোরবেলা সহপাঠীর বাড়িতে গিয়ে বই ফেরত দিয়ে আসবে। হ্যাঁ মা, রাতে সহপাঠীর বাড়ির বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতো, কখন সহপাঠী ঘুমোত যাবে, আর তার বইটা বাবা পাবে। রাত জেগে বাবা ধার করা বই এনে পড়তো। সকালে সে বই সহপাঠীর বাড়িতে ফেরত দিয়ে পরে কলেজে যেতো। এভাবেই পড়ে বাবা ক্লাসে সবচেয়ে ভালো নম্বর পেতো। এই বাবার নামে ইস্কুল কেন হবেনা, মা? নিজের ছেলেমেয়ে তো বটেই, কাকাঁদের, কাকার ছেলেমেয়েদের, ফুপুদের ছেলেমেয়ে সবাইকেই তো বাবা লেখাপড়া করিয়েছে। এমনকী অবকাশে রেখে ওদের অনেককেইস্কুল কলেজে পড়িয়েছে। যত তার আত্মীয়, দূর আত্মীয় সবাইকে লেখাপড়া করিয়েছে, গ্রামের কত গরিবদের লেখাপড়া করার জন্য ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছে, লেখাপড়ার খরচ জুগিয়েছে। বাড়ির বউদেরও ছাড় দেয়নি। ওদের সংসার করা বন্ধ করে কলেজে ইউনিভার্সিটিতে পাঠিয়েছে। তার নামে কেন ইস্কুল হবে না? চিরকাল পড়াশোনা করে বড় হও, নিজের পায়ে দাঁড়াও, ছেলে মেয়ে নির্বিশেষে শুধু শুকনো উপদেশ দেয়নি, দিন রাত ওদের পেছনেই অর্থ আর সময় ব্যয় করেছে। আমার সুযোগ থাকলে আমি ওই গ্রামে বাবার নামে ইস্কুল খুলতাম একটা। বাবা ছাড়া কে আর আছে ওই গ্রামের ছেলে যে লেখাপড়াকে সবচেয়ে মূল্য দিয়েছে! আমার কেন ইস্কুল খুলতে হবে, ওই গ্রামের লোকদের যদি বিবেক বলে কিছু থাকে, বাবার নামে ইস্কুল কলেজ খুলবে।

বাবার হয়তো জমিজমা কেনার আগ্রহ ছিলো, সন্তানের ভবিষ্যতের কথা ভেবেঅথবা নিজের শেকড়ের টানে। কিন্তু তাছাড়া পার্থিব জিনিসের প্রতি লোভ বাবার ছিলো না। কোনওদিন কারও দেওয়া কোনও উপহার ছুঁয়ে দেখেনি। দাদা, ছোটদা, আমি, ইয়াসমিন কত উপহার দিয়েছি তাকে। সবকিছুই আলমারিতে যত্ন করে রেখে দিতো। তোমার অসুখের সময় যখন বাবার ঘরটা তোমার জন্য পরিষ্কার করছিলাম, তোমাকে ও ঘরে শোয়াবো বলে, বাবার আলমারি খুলে দেখি আমার দেওয়া সব লোশন, পারফিউম, অডিটয়লেট, অডি কোলন, শেভিং কিটস, জামা জুতো, আরও নানা রকম উপহার সব সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা কিছুই বাবা এত বছরে ব্যবহার করেনি। কিন্তু আলমারি খুলে প্রতিদিনই দেখতে সব, আলমারি তো নয়, তার এক বিচিত্র জাদুঘর। আলমারির চাবিটা খুব যত্ন করে পকেটে রেখে দিত, কাউকে দিত না। নিজের জামা জুতো না ছেঁড়া অবদি কিনতো না। সেলাই করে পরার অভ্যেস ছিলো। টুথ ব্রাশের দাঁতগুলো প্রায় সব ভেঙে গেলে তবে নতুন কিনতো। আমি কিনে দিলে সেটা যত্ন করে রেখে দিত, নিজে একটা কমদামি কিছু কিনে নিতো। দাড়ি কামাবার ব্রাশও, সেই কোন আমলের প্রায় ভোঁতা রেজর দিয়েই কামাতো, গাল কেটে কেটে যেতে। ফোম, আফটার শেভ? ওগুলো আলমারিতে পড়ে থাকতো। বাবা বোধহয় ভুলে যেতো না গ্রামের গরিব ঘর থেকে উঠে এসেছে সে। ঝকমকে ঝলমলে জিনিস তার জন্য নয়। নিউইয়র্কে একটা গাউন জোর করে ঘরে যখন থাকতো, পরিয়ে রাখতাম। হয়তো ভালো লাগতো তার, কিন্তু কী যেন আবার সব তাকে খুলিয়ে রাখতো।

কলকাতায় যখন এসেছিলো, হোটেল ঘরে বাবা আমার বই পেয়েছিল, আমার মেয়েবেলা। আমি তো নানা কাজে ব্যস্ত থাকি। হঠাৎ একদিন দেখি বাবা বইটা মন দিয়ে পড়ছে। আমি কেড়ে নিয়েছি বই। বাবাকে ওই বই আমার পড়তে দিতে ইচ্ছে করেনি। আমি জানি বাবা কষ্ট পাবে পড়লে যেসব অংশে বাবার সব দুষ্কর্মের কথা লেখা আছে, ওই যে গভীর রাতে বাড়ির কাজের মহিলার সঙ্গে একরাতে শুতে গিয়েছিলো। না, মা। আমি বাবাকে বাঁচিয়ে বা কাউকে বাঁচিয়ে আত্মজীবনী লিখতে পারিনি। এক রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে দেখি বাবা বই পড়ছে। আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে পড়েও নিয়েছে বইয়ের অনেকটা। দেশে ফিরে যাওয়ার সময় যখন নিয়ে যেতে চাইলো একটা বই, জানি না কী ভেবে আর না করিনি। দাদার কাছে শুনতাম, বাবা নাকি আমার মেয়েবেলা বইটা যত্ন করে বালিশের তলায় রেখে দিয়েছে। প্রতিরাতে শুয়ে শুয়ে বইটাপড়ে। উতল হাওয়া বইটাও যোগাড় করেছিল। ওটাও বালিশের তলায় রেখে দিত। প্রতিদিন পড়তো, চেম্বারে যাওয়ার আগে, চেম্বার থেকে ফিরে। বাবা আমার লেখা ভালোবাসতো, তাই পড়তো। কিন্তু কষ্ট কী কম পেয়েছে। কোনওদিন আমাকে বলেনি কেন আমি তার কথা ওভাবে লিখেছি! কেন তার সম্মান আমি গুঁড়িয়ে দিয়েছি। কোনওদিন না। এই না বলা, এই না ধমক দেওয়া, এই না অভিযোগ করা, এই না নিন্দা করা আমাকে আরও ভুগিয়েছে। একবার দাদাকে বলেছিলাম আমার মেয়েবেলা আর উতল হাওয়া বইদুটো যেন যতীন সরকারকে আমার পক্ষ থেকে উপহার দেয়। যতীন সরকার একদিন অবকাশেও গিয়েছিলেন বইদুটো নিতে। কিন্তু বাবা তাঁকে বই দিতে চায়নি। বই না নিয়েই তাকে ফিরে যেতে হয়। কেন বাবা বই দিতে চায়নি আমি বুঝি। লজ্জায়। নিজের অহংকার, নিজের মাথা অন্যের সামনে মাটিতে মিশে যাক চায়নি। কিন্তু জগৎ যেপড়ছে! একদিকে ভালো হয়েছে, বইদুটোই বাংলাদেশে বেরোবার আগেই বা বেরোবার সঙ্গে সঙ্গেই নিষিদ্ধ হয়ে গেছে। আমি মনে মনে স্বস্তিই পেয়েছি মা। তা না হলে কত লোক বই পড়ে বাবাকে হয়তো বলতো, কী ব্যাপার, মেয়ে তো লিখে দিয়েছে তার দুশ্চরিত্র বাবার কীর্তি কাহিনী। বাবা যে প্রতিদিন আমার বইদুটো পড়তো, বাবা কোন অংশগুলো পড়তো, বাবাকে নিয়ে আমার প্রশংসার কথা, নাকি নিন্দার কথা! বাবাকে কেন প্রতিদিন বইদুটো পড়তে হত। কী পেত বাবা ওই বইয়ের মধ্যে। অতীত? হারিয়ে যাওয়া অতীত, সে যত নিষ্ঠুরই হোক, মধুরও তো ছিল মা।

দাদার কাছে আমার মেয়েবেলা বইটা খুব ভালো লাগে। দাদা বলে, কবিতার মতো। একদিন বাবাকে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ফোনে, যেন ভুলে গিয়েছি বাবা সম্পর্কে যত মন্দ কথা লিখেছি, সব, কেমন লেগেছে বই? বাবা বললো, খুব ভালো। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, ভালো? বাবা আবারও বললো, হ্যাঁ খুব ভালো। তোমার লেখার হাত খুব ভালো। ভাষাটা চমৎকার। খুব সুন্দর লিখতেপারো তুমি। বাবা কিছু বলেনি তার সম্পর্কে যা লিখেছি তার কোনও কথা। আমিও বলিনি। বাবার প্রশংসা শুনতে শুনতে আমার চোখে জল চলে এসেছে। আমি আর কথা বলতে পারিনি বাবার সঙ্গে। গলা বুজে আসছিল। বই নিয়ে বাবার প্রশংসা আমাকেই বাবার সামনে ছোট করে দিয়েছে। ইচ্ছে হয়েছে বাবার চুলে সেই ছোটবেলার মতো হাত বুলিয়ে দিই। বাবার চুলে এখন তো আর কেউ হাত বুলোয় না।

তুমিও নেই। বাবাও নেই। আমার আর দেশে কারও সঙ্গে যোগাযোগ করার কোনও ইচ্ছে, হয়নি। প্রায় বছর গেলে যোগাযোগটা করতে হয়েছে তোমার নামে যে বৃত্তি দিচ্ছিলাম, সেটি যেন প্রতি বছর দেওয়া হয় সেই তাগাদা দিতে। আমার যে ফিক্সড ডিপোজিট আছে বাংলাদেশের ব্যাংকে, সেটির ইন্টারেস্ট চলে যায় বৃত্তির অ্যাকাউন্টে। কিন্তু ও টাকায় তো বৃত্তি সম্ভব নয়। আবারও টাকা পাঠিয়ে দিলাম যেন বৃত্তি দেওয়ায় কোনও ছেদ না পড়ে। দেওয়া হল বৃত্তি। তবে ছবি দাদা যা পাঠালো, দেখে অবাক আমি। হাসিনাকে সামনে আনা হয়েছে বৃত্তি অনুষ্ঠানে। যে তোমার সঙ্গে দুর্ব্যবহার করতো, আমি চাইনি এই বৃত্তির অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি। যে তোমাকে ভালোবাসেনি কোনওদিন, সে কেন তোমার পবিত্র অনুষ্ঠানাদিতে তার কুৎসিত মন নিয়ে সরবে উপস্থিত হবে! শুধু উপস্থিত নয়, রীতিমত ভালো কাজের নেত্রী বনে যাবে! দূর থেকে কী আর করতে পারি আমি, শুধু কষ্ট পেয়ে যাওয়া ছাড়া আমার করার কিছু নেই।

.

খবর পাই অবকাশ পুরো পাল্টে ফেলেছে দাদা। কত কোটি টাকা থাকলে বাড়িটাকে ওরকম বিরাট বড়লোকের বাড়ি করা যায়, তা না দেখলে নাকি বোঝা যাবে না। বাড়ির মোজাইক মেঝে ফেলে দিয়ে মার্বেল বসিয়েছে। বিশাল বিশাল সবুজ দরজা ভেঙে এখন নাকি লাগিয়েছে ছোট ছোট খয়েরি রঙের দরজা। বাবার ঘরটাকে শুভর ঘর করে দিয়েছে। ঝকঝকে তকতকে সব। সেই জানালাগুলোও নেই, সেই নানা রঙের কাঁচের জানালাগুলো। অবকাশের স্থাপত্য শিল্প আমাকে সবসময় মুগ্ধ করেছে। জানি না কী করে পুরোনো স্থাপত্য ভেঙে ম্যাচবাক্স করতে পারে লোকে। কী করে উঁচু সিলিং ধ্বংস করে, কড়িকাঠ ভেঙে মাথার এক হাত ওপরে নামাতে পারে ছাদ। কী করে কেটে ফেলতে পারে দেয়ালের বা কাঠের কারুকাজ। পশ্চিমের দেশগুলোয় দেখেছি যে কোনও মূল্যে তারা পুরোনো বাড়িগুলোকে রক্ষা করে। পুরোনো স্থাপত্য অমূল্য সম্পদ। দাদাকে আন্দালুসিয়া নিয়ে গিয়েছিলাম, স্পেনের দক্ষিণে। ওখানে তো তার দেখা হয়েছে। পুরোনো স্থাপত্য কী করে হাজার বছর ধরে রক্ষা করা হচ্ছে। এমনকী ঘোর শত্রুর বানানো বাড়ি বা মসজিদকিছুই স্পেনের লোকেরা ফেলে দেয়নি। ওখান থেকেও দাদা কিছু শেখেনি। আমার কেন যেন মনে হয় মা, বাড়ি ভেঙে নতুন করে বানানো, দাদার নয়, হাসিনার আবদার। দাদা এখন আর দাদার কথায় ওঠে বসে না। উঠোনের দুটো টিনের ঘরও ভেঙে ফেলেছে। বাইরের কালো ফটক পাল্টে ফেলেছে। ফটকের দুধারে কামিনী আর মাধবীলতার গাছও আর নেই। নারকেল গাছগুলোর পায়ে সাদা মোজা পরিয়েছে। বাথরুম ভেঙে নতুন করা হয়েছে, কমোড লাগানো হয়েছে। শুভর জন্য আলাদা বাথরুম, অ্যাটাচড। বাড়ির সামনের সেই রক আর সিঁড়ি সব ভেঙে মোগলদের বাড়ির মতো বড় থাম বসিয়ে ওপরে বড় করে অবকাশ নাম বসানো হয়েছে। যে অবস্থা বাড়িঘরের, অবকাশ নামটা যে রেখেছে, এই হয়তো বেশি। হয়তো অবকাশ বাদ দিয়ে ব্ল হেভেন বা ইডেন গার্ডেন রাখতে পারতো। বৈঠক ঘর আর আমার শোবার ঘরের মাঝখানে যে অসাধারণ তিনটে গরাদওয়ালা দরজা ছিল, সেগুলো আর নেই। দেয়াল তুলে দিয়ে ঘর জুড়ে পেল্লাই সব রাজা বাদশাদের বাড়ির মতো আসবাবপত্র বসানো হয়েছে। হঠাৎ করে আমাদের সেই অবকাশ ধনী লোকের আধুনিক বাড়িতে রূপান্তরিত হয়ে গেছে। পেয়ারা গাছ, জাম গাছ, কাঁঠাল গাছ, সেগুন গাছ কিছু আর নেই। যে গাছটা শেষে লাগিয়েছিলে, সেই কামরাঙা গাছটা, ওটা বিশাল বড় হয়ে ঝুঁকে আছে শত শত সবুজ কামরাঙায়। দেখলে নিশ্চয়ই তোমার খুব ভালো লাগতো। হয়তো ভেবেছিলে, ছেলে মেয়েরা খাবে। ছেলেরা নাতিরা হয়তো খায় মা, তোমার কথা কেউ মনেও করে না। বাড়িতে মামা খালাদের কোনও যাওয়া আসা নেই। যাওয়া আসা শুধু হাসিনার আত্মীয়দের। হাসিনা রানির মতো বাস করে। তার দুই পুত্র প্রাসাদের রাজপুত্তুর। অবকাশে আমাদের কোনও চিহ্ন রাখা হয়নি। আমাদের কারওরনা। অবকাশ এখন আগাগোড়াই হাসিনার বাড়ি। যেন হাসিনাই জন্ম থেকে থাকে ও বাড়িতে। হাসিনার বাপ দাদা কেউ বানিয়েছে বাড়ি, উত্তরাধিকার সূত্রে সে বাড়ির দখল পেয়েছে। দেখে মনে হয়, এরকম দামি আসবাবপত্রে, এরকম দামি মার্বেলে বাড়ি সাজাবে বলেই সে অপেক্ষা করছিল, কখন তুমি যাবে, কখন বাবা যাবে। জন্মের মতো যাবে। কখন বাড়ি খালি হবে। তোমাদের নিশ্চিহ্ন করার চেষ্টা বাড়িতে ঢোকার পর থেকেই সে করছিল। কী ভয়ংকর এবং কী রকম বীভৎস যে সেই লোভ, রাজত্বের লোভ! হাসিনার সারা শরীরে মনে অদ্ভুত পরিতৃপ্তি। কী ভীষণ কষ্টই না দিত ও তোমাকে! কী অপমানই না করেছে তোমাকে! তোমার মতো নিরীহ ভালো মানুষকে খুশি করতে খুব বেশি কিছুর দরকার ছিল না। তারপরও তোমাকে তোমারই সংসারে ক্রীতদাসীর মতো রেখেছে। বাবাকেও ওরকমভাবে বাবার বাড়িতে, বাবার খেয়ে, বাবার পরে, বাবাকে একইরকম ভাবে ক্রীতদাস করেছে। কাউকেই ছাড়েনি। এই যে বাবা তার দুই মেয়েকে বঞ্চিত করে সব সহায় সম্পত্তি দুই ছেলের নামে লিখে দিয়েছে, হাসিনা তো তাই চেয়েছিল, অঢেল সম্পদ একা একা ভোগ করার বাসনা তার অনেক দিন থেকেই ছিল। বিরাট প্রাসাদের রানি হওয়ার স্বপ্ন সে পূরণ করেছে। দাদা অসুখে ভুগছে, যে কোনও একদিন মরে যাবে। এর মধ্যে ছোটদা তার ভাগ যে করে হোক কবজা করেছে। বাবার বিশাল এসটেট মূলত এখন ভোগ করছে হাসিনা তার ছেলেদুটো সহ তার বাপের বাড়ির আত্মীয় স্বজন। বাবা কি ওর জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলে সমস্ত বিষয় আশয় করেছিলো? কোটি কোটি নগদ টাকা কি বাবা হাসিনার আরাম আয়েশের জন্য রেখে গিয়েছিলো?

.

বাবা মারা যাবার বছর দুই পর আমি দাদার কাছে জানতে চেয়েছি, বাবার জমি জমা টাকা পয়সা বাড়ি ঘরের কী করা হবে, কবে হবে ভাগবাঁটোয়ারা। বাংলাদেশ সরকার যেহেতু আমাকে দেশে ফিরতে দিচ্ছে না, ভাগাভাগির সময় ইয়াসমিনের যদি দেশে যাওয়ার দরকার হয়, যাবে। দাদা বললো, বাবা তার যা কিছু আছে, উইল করে দিয়ে গেছে তার চার ছেলেমেয়েকে। উইলের একটা কপি দাদা একদিন আমেরিকায় পাঠিয়ে দিল। জমি জমা ভাগের কথা আমার মাথায় আসতো না, যদি না আমি ইয়াসমিনের অর্থনৈতিক দুরবস্থা দেখতাম। উইল দেখে আমি আকাশ থেকে পড়ি। নান্দাইলের হাজার হাজার একর জমি, শহরের চব্বিশটা বাড়ি, অবকাশ, ঢাকার সবচেয়ে দামি এলাকা বারিধারার বিশাল প্লট সব ভাগ করা হয়েছে দাদা আর ছোটদার মধ্যে। বাবাকে অসুস্থ অবস্থাতেই ঢাকায় টেনে এনে বারিধারার জমিটা তার নিজের নামে লিখিয়ে নিয়েছিলো ছোটদা। ঢাকার বারিধারার জমি, জানিনা সেটা দশ কোটি নাকি কুড়ি কোটি টাকা দাম, ছোটদার। নান্দাইলের বিশাল জমিদারি দাদার। শহরের বাড়িগুলোও দাদার আর ছোটদার, আমি আর ইয়াসমিন শুধু ওই বাড়িগুলো থেকে ভাড়া যা আসে, তার শতকরা পনেরো ভাগ পাবো। ওই বাড়িগুলোর মালিক আমরা কোনওদিন হতেপারবো না। অবকাশ দাদার। অবকাশের পেছনে যে উঠোন আছে, সেই সেদিকটায়, ওই তেমনই, শতকরা পনেরো ভাগদু মেয়ে পাবে। কী দরকার ছিল বাবার এই উইলটা করার? বাবার সই আছেউইলে, এসইকি সত্যিই বাবার সই, আমি বারবার দেখি। হ্যাঁ বাবার সই, কিন্তু বিশ্বাস হয় না বাবা এই উইল সুস্থ মাথায় করেছে। কোনও উইল যদি বাবা না করতো, চারভাইবোনের মধ্যে সব ভাগ হতো। বাংলাদেশে যে নারীবিরোধী ইসলামি উত্তরাধিকার আইন আছে, সেই আইনেও যদি ভাগ করা হতো, তাহলেও আমার আর ইয়াসমিনের অর্থনৈতিক দুরবস্থা চিরকালের মতো ঘুচে যেতো। মা, তুমি কি জানতে বাবা এত সম্পদশালী ছিলো? আমার জানা ছিলো না। উইলের কোথাও লেখা নেই বাবার ব্যাংকের টাকার কথা। বাবার নতুন বাজারের চেম্বার, আরোগ্য বিতান এবং আরও কয়েকটা দোকান বিক্রি করে সব টাকা ব্যাংকে রেখেছিলো বাবা, সেসব হয়তো দাদা আর ছোটদাকে আগেই দিয়ে দিয়েছে। শুধু স্থাবর সম্পত্তির কথাই লেখা উইলে। আমার ভেবে কষ্ট হয়, বাবা তার দুই মেয়েকে কখনও ভালোবাসেনি। বাবা আর তার দুই পুত্র যদি ভেবেই থাকে, যে, আমি বিশাল এক ধনী কেউ, বাবার কোনও সম্পদ বা সম্পত্তি আমার না হলেও চলবে, তাহলে ইয়াসমিনের কথা কেউ ভাবেনি কেন? ইয়াসমিন তো অভাবে থাকে, ছোট একটা মুদির দোকানে কাজ করে। বাবা আর তুমি নিজের চোখে দেখে গেছো ইয়াসমিনের অভাব। তাহলে কে স্বচ্ছল, আর কেনয়, তার ওপর ভিত্তিকরে উইল হয়নি, উইল করা হয়েছে লিঙ্গের ভিত্তিতে। পুরুষ লিঙ্গ বেশি পাবে, স্ত্রী লিঙ্গ কমপাবে, অথবা পাবেনা। আমি বুঝি না কী করে বাবা এই চরম অসাম্যকে সমর্থন করেছে। দুটো মেয়ে যেন তার সম্পত্তির কিছু না পেতে পারে, সে কারণেই উইলটি করা হয়েছে বাবার মৃত্যুর আগে। বাবা যে বলতো, আমার লেখা বাবা খুব ভালোবাসে। নারী পুরুষের সমানাধিকারের কথাই তো জীবনভর লিখে গেছি। আসলেই কি সত্যিই ভালোবাসতো বাবা আমার লেখা! উইল তো তা বলে না মা। আমার আরও একটি কারণে, বিশ্বাস হয় না এই উইল বাবা কোনও চাপ ছাড়া করেছে। ধরা যাক, বাবা সম্পূর্ণ নিজের ইচ্ছেতে এই উইল করেছে, দাদাদের কোনও চাপ বাবার ওপর ছিলো না। কিন্তু দাদারা যদি বিশ্বাস করতো বোনদের উত্তরাধিকারে, তবে বাবার লেখা উইল তারা মেনে নিতো না। মেনে নেওয়ার একটাই কারণ তারা মেয়েদের কোনও অধিকারে বিশ্বাস করে না। সম্পত্তি ভাগ করার কথা আমি শত বলার পরও তারা যখন সমান ভাগে বা দেশের উত্তরাধিকার আইনেও ভাগ করছে না, তাতে আরও প্রমাণ হয় বাবাকে এই উইল করাতে বাধ্য করেছে দাদা আর ছোটদা। আমাদের চার ভাই বোনের মধ্যে শুধু অভাবেই নয়, সবচেয়ে বেশি মানসিক কষ্টে আছে ইয়াসমিন। আজ যদি ও বাবার সম্পত্তির ভাগ পেতো, তাহলে ও অশান্তির সংসার ছেড়ে একা বেঁচে থাকার মনোবল পেতো। দুই দাদা ওর কথা ভাবে না। ভাবলে কি আর বাবার বিশাল সম্পত্তি নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নিত! আমি দাদাদের অনেক বোঝাতে চেয়েছি। বাবা যেভাবে ভাগ করেছে তার সম্পদ সম্পত্তি, তা অন্যায়। বাবা ভুল করেছে, অন্যায় করেছে, তোমরা তা মেনে নিচ্ছো কেন! তোমরা তো বলো আমার লেখা বই তোমাদের ভালো লাগে, আমি খুব সত্য কথা বলি, আমার আদর্শকে তোমরা সম্মান করো আমার বইয়ে আমি তো মেয়েদের অধিকারের কথাই বলি। বাবার সম্পত্তি ভাই বোনের মধ্যে সমান ভাগের কথা বলি। বাবা ভুল করেছে এ তো জানো তোমরা, তবে বাবার ভুলটা সংশোধন করছো না কেন, বাবার অন্যায়টা মেনে নিচ্ছো কেন? অনেক চিঠি পাঠিয়েছি। বলেছি, বাবার সম্পত্তি সমান ভাগ করতে প্রাণ না চায়, তাহলে দেশি আইনেই ভাগটাই বা করছে না কেন, যে ভাগে তোমরাই বেশি পাবে, আমরা কম পাবো? না, ওরা দু বোনকে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত করবেই। দেশে ফেরার অনেক চেষ্টা আমি করেছি। সে খালেদা বলো, তত্ত্বাবধায়ক সরকার বলো, হাসিনা বলো, কেউ আমাকে দেশে ফিরতে দিচ্ছেনা। ফেরার সব পথ যদি বন্ধ করে রাখে, তবে কী করে কী করবো বলো, কী করে দাদাদের এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করবো! ইয়াসমিনের বিশ্বাস বাবা স্বেচ্ছায় ঠাণ্ডা মাথায় এই উইল করেছে। ইয়াসমিনের বিশ্বাস বাবাপুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের লোক, বাবার কাছে পুত্ররাই তার বংশের লোক, কন্যারা নয়। বাবা যদি এত পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার মানুষ হতো, তাহলে মেয়েদের লেখাপড়ার জন্য প্রাণপাত করেছে কেন, পনেরো বছর বয়স হলে ধরে বেঁধে বিয়ে দিয়ে দেয়নি কেন? ছেলেদের ইস্কুল কলেজ নিয়ে যা করেছে, মেয়েদের ইস্কুল কলেজ নিয়ে তার চেয়ে কিছু কম তা করেনি! কী করে তবে বিশ্বাস করবো বাবা পুরুষতান্ত্রিকতায় বিশ্বাস করতো! সবচেয়ে মজার ব্যাপার, উইলে যে তিল পরিমাণ উত্তরাধিকার আমার আর ইয়াসমিনের, সেটুকুও আমরা কোনওদিন পাইনি। বাড়িগুলোর ভাড়া থেকে যে সামান্য আমাদের কাছে আসা উচিত, তা তো আসেইনি, অবকাশের উঠোনও ভাগহয়নি। দাদা আর ছোটদাইসব ভোগ করছে। দুভাইয়ে আগে এত সখ্য ছিলো না, বাবার অসুস্থতার সময় এবং বাবা মারা যাওয়ার সময় তাদের বন্ধুত্ব এবং ভ্রাতৃত্ববোধ তুঙ্গে উঠেছে। চারভাইবোনের মধ্যে অর্থনৈতিক অবস্থা সবচেয়ে খারাপইয়াসমিনের আর সবচেয়ে অনিশ্চিত জীবন আমার। আজ খেয়ে পরে বেঁচে আছি, কিন্তু কাল পারবো কিনা জানি না। লেখালেখি আমার উপার্জনের উৎস। তার ওপর আমি বাংলায় বই লিখি, পাশ্চাত্যের কোনও ভাষায় লিখি না। বাংলাদেশ থেকে বইয়ের কোনও রয়্যালটি আমি পাইনা। অন্য দেশে আজ বই চলছে, কাল হয়তো চলবে না। ভারতে বা বাংলাদেশে, যেখানে জীবন যাপনপশ্চিমের দেশগুলোর মতো এত ব্যয়বহুল নয়, আমার বাস করার কোনও অধিকার নেই। আজপশ্চিমে আমার মাথা গোঁজার ঠাঁই আছে, কাল কী হবে জানি না। জমানো টাকা ফুরিয়ে যেতে সময় খুব নেয় না। দাদারা যে আমাদের এই অনিশ্চয়তা জানে না, তা তো নয়, খুব ভালো করে জানে। কিন্তু একটা জিনিসই তারা নির্লিপ্ত থেকে প্রমাণ করেছে, আমাদের অভাবে অসুখে তাদের কিছু যায় আসে না।

কেমনপুত্রধন পেটে ধরেছিলে মা? তোমার সততা, তোমার বিবেক, তোমার মায়া মমতার এক ফোঁটা ওরা কিছুপায়নি কেন! বাবার উদারতা, বিচক্ষণতা, বাবার আদর্শ, মনোবলও তো ওরা কিছু পায়নি। যে দিকটা বাবার মন্দ ছিল, সেই মন্দটাই বিকট করে বীভৎস করে দুজনকে গড়ে তুলেছে। ওরা ধনলোভ, কৃপণতা, স্বার্থপরতা পেয়েছে। বাবাও কিন্তু এতপাষণ্ড কোনওকালে ছিল না। বাবা শুধু তোমার সঙ্গেই নিষ্ঠুরতা করেছে, আর কারও সঙ্গে তো করেনি। শেষ বয়সে তার দুটো কন্যার সঙ্গে এই নিষ্ঠুরতা সত্যিই করেছে কিনা কোনওদিন তা জানার সুযোগ না হলেও, এই বোধোদয়ের সুযোগটা অন্তত হচ্ছে, যে, আপন দুটো ভাইয়ের সামান্যও ভালোবাসা দু বোনের জন্য নেই। ভাবতে দুঃখ হয়, ওরা আমার ভাই। কী জানি কী সুখ ওরা পায় বোনদের ঠকিয়ে। দুটো মাত্র বোন, এমন তো নয়, যে, সম্পত্তি অতি সামান্য, এমন তো নয় যে বারো কী তেরোটি বোন তাদের ভাগ নিয়ে নিলে ভাইদের কিছু কম পড়ে যাবে। বেঁচে থাকার জন্য কত টাকার দরকার হয় মা! কত সম্পদের দরকার! জানি, তুমি এই অন্যায় মেনে নিতে পারতে না। বাবা নিজেই অন্যায়টি জেনে বুঝে করে গিয়েছিলো, নাকি তাকে ভয় দেখিয়ে, ভুল বুঝিয়ে অন্যায়টি করতে বাধ্য করা হয়েছিল! আমরাও তো বাবারই সন্তান ছিলাম, আমাদের বঞ্চিত করার জন্য বাবা এত উদগ্রীব ছিলো কেন! এই রহস্যের সমাধান কোনওদিনই করা সম্ভব নয়। কারণ দাদা আর ছোটদা ছাড়া আর কেউ জানে না আসলে ঘটেছিল কী। তারা আমাদের কিছুই জানাচ্ছে না, শুধু এটুকুই বলছে যে বাবা নিজে উইল লিখে গেছে। বাবা যা করে গেছে তা যদি সত্যিই বাবার একক সিদ্ধান্তে হয়, ভাইরা, আমি অনুমান করি, ক্রমাগত এই মন্ত্রই বাবার কানে দিয়েছে যে আমাকে আর ইয়াসমিনকে সম্পদ বা সম্পত্তির যা-ই দেওয়া হবে, নিশ্চিতই সব মামাদের হাতে চলে যাবে। আমরা দু বোন মায়ের মতো মন পেয়েছি, সহানুভূতি সমবেদনা ইত্যাদি এত বেশি যে মামাদের অভাব দেখলে আমাদের যা কিছু আছে, সব ঢেলে দেব। বিশেষ করে আমি, মামাদের দুঃখ দুর্দশা ঘোচাবার পণ করেছি আমি, না দিয়ে আমি পারবো না। ভালো যে তুমি বেঁচে নেই মা, বেঁচে থেকে এসব দেখনি। আরও কষ্ট পেতে মা। তোমার বাবা মার জমিজমা তোমার ভাই বোনের মধ্যে দেশের উত্তরাধিকার আইনে ভাগ হয়েছিলো। ভাইরা দুভাগ পেয়েছে, তুমি আর তোমার বোনেরা একভাগ করে পেয়েছে। তোমার ভাগটায় শরাফ মামা একটা ঘর বানিয়ে থাকছে, নিজে যা পেয়েছিলো, তা সে বিক্রি করে দিয়েছে। তোমার ভাগে কে থাকছে, না থাকছে তা নিয়ে মাথা ঘামাওনি তুমি। শরাফ মামাকে তোমার ভাগটা লিখে দিতে তোমার আপত্তি ছিলো না, তোমার উত্তরাধিকারী হিসেবে আমার আর ইয়াসমিনেরও আপত্তি ছিল না যে তোমার ভাইদের কেউ নিয়ে যাক তোমার অংশ। এখনও নেই। কিন্তু তোমার ওইটুকু ছোট্ট জমিই নাকি এখন দাদা দাবি করেছে। যেহেতু লিখে পড়ে দাওনি কিছু, তাই দাদা ওটুকুও ছাড়েনি। যে ভাগ তুমি নিতে চাওনি, আজ তোমার গর্ভের সন্তান, তোমার প্রতি ভালোবাসা না দেখালেও তোমার জমির প্রতি তার ভালোবাসা দেখাচ্ছে। তোমাকে ছেড়ে দিতে তার মায়া হয়নি, তোমার ওই ছোট্ট সামান্য জমিটুকু ছাড়তে তার মায়া। তুমি কী দেখ এসব মা, আকাশের কোথাও থেকে দেখ? দেখে কী তোমার লজ্জা হয় না?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *