একাদশ অধ্যায় – শিবাজীর নৌবল এবং ইংরাজ ও সিদ্দিদের সহিত সংঘর্ষ
রাজাপুরের ইংরাজেরা শিবাজীর শত্রুতা করিল
১৬৫৯ সালের শেষে যখন শিবাজী বিজাপুর-রাজ্যে নানা স্থান জয় করিতে লাগিলেন, তখন ইংরাজদের প্রধান কুঠী ছিল সুরতে; এটি মুঘলসাম্রাজ্যের মধ্যে। বম্বে দ্বীপ তখনও পোর্তুগীজদের হাতে; ইংরাজেরা রাজা দ্বিতীয় চার্লসের বিবাহে যৌতুক-স্বরূপ পোর্তুগালরাজের নিকট হইতে ইহার আট বৎসর পরে এই দ্বীপ পান এবং আরও অনেক পরে সুরত হইতে এখানে প্রধান অফিস উঠাইয়া আনেন। সুরতের পর রাজাপুর (রত্নগিরি জেলার বন্দর) এবং কারোয়ার (শোয়ার দক্ষিণে বন্দর), কানাড়ার অধিত্যকায় হুবলী এবং খান্দেশ প্রদেশে ধরণগাঁও প্রভৃতি আরও কয়েকটি বড় ক্রয়-বিক্রয়ের শহরে ইংরাজদের কুঠী এবং কাপড় ও মরিচের আড়ৎ ছিল।
১৬৬০ সালে জানুয়ারির প্রথমেই শিবাজীর সৈন্যেরা রাজাপুর বন্দর কিছুদিনের জন্য দখল করে এবং সেখানকার ইংরাজ-কুঠীর অধ্যক্ষ হেনরি রেভিংটন বিজাপুরী আমলার মালপত্র কোম্পানীর সম্পত্তি বলিয়া মিথ্যা বর্ণনা করিয়া তাহা মারাঠাদের লইতে বাধা দেন। এই ঘটনা হইতে শিবাজীর সহিত ইংরাজদের প্রথম ঝগড়া বাধে, কিন্তু তাহা অল্পেই থামিয়া যায়।
ইহার কয়েক মাস পরেই যখন সিদ্দি জৌহর শিবাজীকে পন্হালা-দুর্গে ঘেরিয়া ফেলেন তখন সেই রেভিংটন এবং আর কয়েকজন ইংরাজ কতকগুলি বেঁটে তোপ (মর্টার) ও বোমার মত গোলা (গ্রেনেড্) জৌহরকে বেচিবার জন্য সেখানে গিয়া এই অস্ত্রের বল দেখাইবার উদ্দেশ্যে শিবাজীর দুর্গের উপর কতকগুলি গ্রেনেড্ ছুঁড়িলেন। শিবাজী লক্ষ্য করিলেন যে ইংরাজ-পতাকার নীচু হইতে একদল সাহেব এই-সব গোলা মারিতেছে।
রাজাপুরের ইংরাজ কুঠী লুণ্ঠন
বিদেশী বণিকদের এই অকারণ শত্রুতার শাস্তি পর বৎসর মিলিল। ১৬৬১ সালের মার্চ মাসে শিবাজী রত্নগিরি জেলা দখল করিতে করিতে রাজাপুর পৌঁছিয়া ইংরাজ কুঠীয়ালদিগকে বন্দী করিয়া লইয়া গেলেন, কুঠী লুঠ ও ছারখার করিবার পর তাহার মেঝে খুঁড়িয়া দেখিলেন যে টাকা লুকান আছে কিনা। ফলতঃ রাজাপুরে ইংরাজ বাণিজ্য একেবারে ধ্বংস পাইল। অনেক টাকা না দিলে ছাড়িয়া দিব না– এই বলিয়া সেই চারিজন ইংরাজ-বন্দীকে দুই বৎসর ধরিয়া নানা পাৰ্ব্বত্য-দুর্গে আটকাইয়া রাখিলেন
কোম্পানীর কর্তারা বলিলেন যে, যখন রেভিংটন প্রভৃতি কর্ম্মচারীরা নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য শিবাজীর শত্রুতা করিয়া এই বিপদ ডাকিয়া আনিয়াছে, তখন কোম্পানী টাকা দিয়া তাহাদের খালাস করিতে বাধ্য নহে। অবশেষে অনেক কষ্ট সহ্য করিবার পর তাহারা ৫ই ফেব্রুয়ারি, ১৬৬৩ এমনি ছাড়া পাইল।
তাহার পর কোম্পানী রাজাপুরের কুঠী লুঠ ও ধ্বংস করার জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করিলেন; শিবাজী এজন্য নিজ দায়িত্ব স্বীকার করেন না, কখনও বা খুব কম টাকা খেসারৎ দিতে চাহেন। এই লইয়া বিশ বৎসরেরও অধিক সময় তর্ক-বিতর্ক চিঠি লেখালেখি চলিল। ইংরাজেরা আশ্চর্য্য সহিষ্ণুতা ও জিদের সহিত দীর্ঘকাল পর্যন্ত নিজেদের এই দাবি ধরিয়া রহিলেন, বারে বারে শিবাজীর নিকট দূত[১] পাঠাইতে লাগিলেন। পরে হুলী, ধরণগাঁও প্রভৃতি স্থানের ইংরাজ-কুঠীও মারাঠারা লুঠ করে এবং তাহার জন্য ক্ষতিপূরণ চাওয়া হইল। এ বিবাদ শিবাজীর জীবনকালে নিষ্পত্তি হইল না, অথচ এজন্য দুপক্ষের মধ্যে যুদ্ধও বাধিল না! কারণ সে যুগে ইংরাজ ও শিবাজী অনেক বিষয়ে পরস্পরের মুখাপেক্ষী ছিলেন। বম্বে দ্বীপে তরকারী, চাউল, মাংস, জ্বালানী কাঠ কিছুই জন্মিত না; এগুলি পরপারে শিবাজীর দেশ হইতে না আসিলে, বম্বের লোক অনাহারে মারা যাইত। আর, শিবাজীর রাজ্যে লবণ মোমবাতী শৌখীন পশমী কাপড় (বনাত ও সকলাৎ) তোপ ও বারুদ ইংরাজেরাই আনিয়া দিতে পারিতেন। তা ছাড়া ইংরাজদের বেচা- কেনায় শিবাজীর প্রজাদের এবং পণ্যমাশুল হইতে রাজসরকারের অনেক টাকা আয় হইত। কাজেই এই ঝগড়া যুদ্ধ পর্য্যন্ত গড়াইল না।
রাজাপুর-কুঠীর ক্ষতিপূরণের দাবি
ইংরাজ-বণিকেরা বেশ বুঝিতেন যে, শিবাজীকে চটাইলে তাঁহার বিস্তৃত রাজ্যে তাঁহাদের বেচা-কেনা একেবারে বন্ধ হইয়া যাইবে; অথচ তাঁহাদের এমন শক্তি ছিল না যে যুদ্ধ করিয়া শিবাজীকে কাবু করেন বা তাঁহার নিকট হইতে প্রাপ্য টাকা আদায় করেন। তাঁহাদের একদিকে ভয় যে যদি তাঁহারা শিবাজীকে তোপ ও গোলা বিক্রয় না করেন তবে তিনি চটিয়া তাঁহাদের বাণিজ্য বন্ধ করিয়া দিবেন; অপর দিকেও বিপদ কম নহে, মারাঠা-রাজকে এইরূপে সাহায্য করা হইয়াছে টের পাইলে মুঘল বাদশাহ রাগিয়া তাঁহার রাজ্য হইতে ইংরাজ-কুঠী উঠাইয়া দিবেন এবং বণিকদের কয়েদ করিবেন। ফরাসীরা এরূপ অবস্থায় অতি গোপনে কিছু ছোট ছোট তোপ ও সীসা শিবাজীকে বিক্রয় করেন।
চতুর ইংরাজ-কর্তারা নিজ স্থানীয় কর্ম্মচারীদের লিখিয়া পাঠাইলেন– “এই উভয় সঙ্কটের মধ্যে এমন সাবধানে চলিবে যেন কোনপক্ষেই রাগ না করে। শিবাজীকে তোপ বারুদ বেচিবেও না, আবার বেচিতে খোলাখুলি অস্বীকারও করিবে না। অস্পষ্ট উত্তর দিয়া যত সময় কাটান যায় তাহার চেষ্টা করিবে। আর, আমরা আমাদের জাহাজ ও তোপ লইয়া গিয়া হাবশী রাজধানী জয় করিতে তাঁহাকে সাহায্য করিতে পারি, এই লোভ দেখাইয়া আলোচনার সূত্রপাত করিবে এবং তাঁহাকে এইরূপে দীর্ঘকাল হাতে রাখিবে।”
শিবাজীও যে-টাকা একবার গ্রাস করিয়াছেন তাহা ফেরত দিতে নারাজ। এই অবস্থায় রাজাপুর-কুঠীর ক্ষতিপূরণের জন্য আলোচনার শেষ নিষ্পত্তি হওয়া অসম্ভব ছিল। ইংরাজেরা এক লক্ষ টাকা দাবি করিয়াছিল। শিবাজীর মন্ত্রীরা প্রথমে ক্ষতির পরিমাণ বিশ হাজার টাকা ধার্য্য করিলেন, পরে আটাশ হাজার এবং শেষে চল্লিশ হাজারে উঠিলেন। কিন্তু তাহাও নগদ নহে; ইহার মধ্যে ৩২ হাজার টাকা কতক নগদ কতক বাণিজ্য-দ্রব্য দিয়া শোধ হইবে, আর বাকী আট হাজার টাকা তিন হইতে পাঁচ বৎসর পর্য্যন্ত রাজাপুরে বন্দরে ইংরাজদের আমদানী মালের দেয় মাশুল মাফ করিয়া পূরণ করা হইবে।
শিবাজীর রাজ্যাভিষেকের দরবারে (১৬৭৪ জুন) ইংরাজদূত হেনরি অক্সিন্ডেন উপস্থিত হইয়া। এই তিন শর্তে মিটমাট করিয়া এক সন্ধিপত্র সহি মোহর করাইয়া লইলেন :
(১) শিবাজী ক্ষতিপূরণ বাবদে ইংরাজদের চল্লিশ হাজার টাকা দিবেন। ইহার এক-তৃতীয়াংশ নগদ টাকা ও দ্রব্য (যেমন সুপারি) দিয়া শিবাজীর মৃত্যুর পূর্ব্বে শোধ হয় ।
(২) তাঁহার রাজ্যে ইংরাজ-কুঠীগুলি রক্ষা করিবেন। তদনুসারে ১৬৭৫ সালে রাজাপুরে ইংরাজেরা আবার কুঠী খোলেন।
(৩) তাঁহার রাজ্যের কূলে ঝড়ে কোন জাহাজ আসিয়া অচল হইয়া পড়িলে অথবা ভগ্ন জাহাজের ভাসা মালগুলি পৌঁছিলে, নিজে জব্ৎ না করিয়া মালিককে ফিরাইয়া দিবেন।
কিন্তু শিবাজী ইংরাজদের চতুর্থ প্রার্থনা, অর্থাৎ তাঁহার রাজ্যে ইংরাজদের মুদ্রা প্রচলিত করিতে, কিছুতেই রাজি হইলেন না।
শিবাজীর সহিত ইংরাজ-বণিকদের সাক্ষাৎ
রাজাপুরের নূতন কুঠীর সাহেবরা শিবাজীর সহিত ১৬৭৫ সালে দেখা করিয়া তাহার এই সুন্দর বর্ণনা লিখিয়া গিয়াছেন। —
“রাজা ২২-এ মার্চ দুপুরবেলা এখানে আসেন, সঙ্গে অনেক অশ্বারোহী পদাতিক ও দেড়শত পাল্কী। তাঁহার আগমনের সংবাদ পাইয়াই আমরা তাঁবু হইতে বাহির হইলাম এবং অল্প দূরেই তাঁহাকে পাইলাম। আমাদের দেখিয়া তিনি পাল্কী থামাইলেন এবং কাছে ডাকিয়া জানাইলেন, আমরা যে তাঁহার সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিয়াছি তাহাতে তিনি খুব খুশী হইয়াছেন, কিন্তু এই রৌদ্রের গরমে আমাদের এখন বেশীক্ষণ রাখিবেন না, বিকালে ডাকিবেন।***
“২৩-এ মার্চ রাজা আসিলেন এবং পাল্কী থামাইয়া আমাদের কাছে ডাকিলেন। আমরা নিকটে গেলে তিনি হাত দিয়া ইঙ্গিত করিয়া আরও কাছে আসিতে বলিলেন। যখন আমি তাঁহার সামনে পৌঁছিলাম, তিনি কুতূহলে আমার লম্বা পরচুল নিজ হাতে নাড়িয়া-চাড়িয়া দেখিলেন এবং অনেক কথা জিজ্ঞাসা করিলেন। *** তিনি উত্তরে বলিলেন যে রাজাপুরে আমাদের সব অসুবিধা দূর করিবেন, এবং আমাদের যুক্তিসঙ্গত কোন অনুরোধই অগ্রাহ্য করিবেন না। ***
“পরদিন আবার আমাদের ডাক পড়িল; দু’ঘণ্টা কথাবার্তার পর আমাদের দরখাস্তের মারাঠী-অনুবাদ তাঁহাকে পড়িয়া শুনান হইল; তিনি আমাদের সকল প্রার্থনা মঞ্জুর করিযা ফৰ্ম্মান্ দিবেন, এ আশ্বাস দিলেন। “
জঞ্জিবার হাবশীগণ
ভারতের পশ্চিম-কূলে বম্বে শহর হইতে ৪৫ মাইল দক্ষিণে জঞ্জিরা নামে পাথরের একটি ছোট দ্বীপ আছে। তাহার আধ মাইল পূর্ব্বদিকে সমুদ্রের এক খাড়ী কোলাবা জেলার মধ্যে ঢুকিয়াছে। এই খাড়ীর মুখের উত্তর তীরে দণ্ডা নামক শহর, তাহার তিনদিকে সমুদ্রের জল; আর দণ্ডার দুইমাইল উত্তর-পশ্চিমে রাজপুরী নামক আর একটি নগর; [রাজাপুর বন্দর এখান হইতে অনেক দূরে, দক্ষিণে]। এইগুলি এবং ইহাদের সংলগ্ন জমি লইয়া একটি ছোট রাজ্য; তাহারা অধিকারীরা হাবশী জাতীয়, অর্থাৎ আফ্রিকার এবিসিনিয়া দেশ হইতে আগত; ইহাদের ভীষণ কাল রং, মোটা ঠোঁট, কোঁকড়া চুল।
এই হাবশীরা তথায় কয়েক ঘর মাত্র; অসংখ্য ভারতীয় প্রজাদের মধ্যে বাস করিয়া তাহাদের নিজ প্রভুত্ব বজায় রাখিতে হইত। তাহারা সকলেই যুদ্ধে এবং জাহাজ চালানতে দক্ষ; অন্য কোন ব্যবসা করিত না; প্রত্যেকেই যেন একজন ছোটখাট ওমরা বা রাজপুত এইরূপ পদগৌরবে থাকিত। তাহাদের দলপতি পিতার উত্তরাধিকার-সূত্রে হইতেন না; জাতির মধ্যে সবচেয়ে বুদ্ধিমান কৰ্ম্মদক্ষ বীরকে বাছিয়া নেতা স্বীকার করিয়া সকলে তাঁহাকে মানিত। হাবশী জাতি ভারতে বল-বিক্রম, শ্রম ও কষ্ট সহ্য করিবার শক্তি, যুদ্ধ ও রাজ্যশাসনে সমান দক্ষতা এবং প্রভুভক্তির জন্য বিখ্যাত ছিল। আর, দৃঢ় স্থির মন, লোক চালাইবার ক্ষমতা এবং জলযুদ্ধে পরিপক্কতায় ইউরোপীয় ভিন্ন অপর সব জাতি অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। ইহারা সিদ্দি (অর্থাৎ সৈয়দ বা উচ্চবংশজাত) নামে পরিচিত ছিল।
শিবাজী ও সিদ্দিদের শত্রুতার কারণ
জঞ্জিরার পূর্ব্বদিকের তীরভূমি কোলাবা জেল। এখানে হাবশীদের খাদ্য জন্মে, রাজস্ব সংগ্রহ হয়, অনুচরগণ বাস করে। শিবাজী উত্তর-কোঁকনে কল্যাণ, অর্থাৎ বর্তমান থানা জেলা, অধিকার করিযা তাহার পরই কোলাবা জেলায় প্রবেশ করায়, হাবশীদের সহিত তাঁহার সংঘর্ষ হইল। ইহা অনিবার্য্য; কারণ এই তটভূমি হারাইলে হাবশীরা না খাইতে পাইয়া মারা পড়িবে; সুতরাং তাহারা দণ্ডা-রাজপুরী নিজ হাতে রাখিবার জন্য প্রাণপণ লড়িতে থাকিল। অপর পক্ষে, শিবাজীও জানিতেন যে তটভূমি ও জঞ্জিরা দ্বীপ হইতে হাবশীদের তাড়াইতে বা অধীন করিতে না পারিলে তাঁহার কোঁকন প্রদেশের স্থলভাগও অসম্পূর্ণ, অরক্ষিত, হইয়া পড়িয়া থাকিবে; এই শত্রুরা জাহাজে করিয়া যেখানে সেখানে নামিয়া গ্রাম লুঠ ও প্রজাদের দাস করিয়া লইয়া যাইবে। “ঘরের মধ্যে ইঁদুর যেমন, সিদ্দিরাও ঠিক সেই ধরনের শত্রু” (সভাসদ), বিশেষত; তাহারা হিন্দু প্রজাদের প্রতি অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে অত্যাচার করিত, ব্রাহ্মণদের ধরিয়া মেথরের কাজ করাইত, সাধারণ লোকদের নাক-কান কাটিয়া দিত। আর, ঐ দ্বীপের ও দুর্গের আশ্রয়ে নিজ জাহাজ রাখিয়া সমুদ্রে যখন-তখন মারাঠী জাহাজ ধরিতে পারিত।
সিদ্দিদের সহিত মারাঠাদো অশেষ বৃদ্ধ
এজন্য শিবাজীর জীবনের ব্রত হইল জঞ্জিরা দ্বীপ অধিকার করিয়া পশ্চিম-কূলে সিদ্ধির প্রভাব একেবারে লোপ করা। এই কাজে তিনি অসংখ্য সৈন্য এবং জলের মত টাকা খরচ করিতে লাগিলেন।
কিন্তু মারাঠীদের তোপ ভাল ছিল না। তোপ চালানে দক্ষতা একেবারেই ছিল না। আর তাহাদের জাহাজগুলি হাবশী-জাহাজের তুলনায় অবজ্ঞার জিনিষ। এই দুই শক্তির মধ্যে যুদ্ধটা বাঙলার ছেলে-ভুলান গল্পের “সুন্দরবনের বাঘ ও কুমীরের যুদ্ধের” মত হইল। শিবাজীর সৈন্য অসংখ্য, স্থলপথে অজেয়, অপর দিকে হাবশীরা জল-যুদ্ধে দুর্গরক্ষা করিতে তেমনি শ্রেষ্ঠ, কিন্তু তাহাদের স্থল-সৈন্য এক হাজারের বেশি নয়।
শিবাজী ১৯৫৯ সাল হইতে কোলাবা জেলায় ক্রমে বেশী বেশী সৈন্য পাঠাইয়া হাবশী-রাজ্যের স্থলভূমি যথাসম্ভব দখল করিতে লাগিলেন। অনেক দিন ধরিয়া যুদ্ধ চলিল, কখন এপক্ষ আগাইয়া আসে, কখন ওপক্ষ। অবশেষে দণ্ডা-দুর্গ শিবাজী কাড়িয়া লইলেন, আর দ্বীপটি মাত্র সিদ্দিদের দখলে থাকিল, তাহারা স্থলপথের দুর্গ ও শহরগুলি হারাইল। কিন্তু “পেট ভরিবার জন্য” জাহাজে করিয়া আসিয়া রত্নগিরি জেলায় গ্রাম লুঠিতে লাগিল। প্রতি বৎসর বর্ষার শেষে শিবাজী কয়েক মাস ধরিয়া স্থল হইতে জঞ্জিরা দ্বীপের উপর গোলা ছুঁড়িতেন, কিন্তু তাহাতে কোনই ফল হইত না। তিনি বুঝিলেন যে নিজের যুদ্ধ-জাহাজ না থাকিলে তাঁহার পক্ষে মান-সম্ভ্রম ও রাজ্যরক্ষা করা অসম্ভব। তখন নৌবল-গঠনের দিকে তাঁহার দৃষ্টি পড়িল।
শিবাজীর নৌবল
শিবাজীর যুদ্ধ-জাহাজের এবং জলপথে প্রভাব-বিস্তারের ইতিহাস অতি স্পষ্ট ও ধারাবাহিকরূপে জানা যায়। ১৯৫৯ সালে কল্যাণ অধিকার করিবার পর তাহার নীচে সমুদ্রের খাড়ীতে (বম্বে হইতে ২৪ মাইল পূর্ব্বে) শিবাজী প্রথম জাহাজ নির্ম্মাণ করিয়া তাহা সমুদ্রে ভাসাইলেন। এই নবশক্তির জাগরণে পোর্তুগীজদের ভয় ও হিংসা হইল। পরে কোঁকন তীর দিয়া তাঁহার দ্রুত রাজ্য-বিস্তারের সঙ্গে সঙ্গে জাহাজ-নিৰ্ম্মাণ, নৌ-সেনা ভর্তি এবং কূলে জাহাজের আশ্রয়স্থল-স্বরূপ জলদুর্গ ও বন্দর স্থাপন বাড়িয়া চলিল; “রাজা সমুদ্রের পিঠে জীন চড়াইলেন” (সভাসদ)।
শিবাজীর সর্ব্বসমেত চারিশত নৌকা ছিল। তাহা ছোট-বড় সকল শ্রেণীর যথা ঘুরাব্ (তোপ-চড়ান, সমান ও উঁচু পাটাতনের যুদ্ধ-জাহাজ), গলব্ (দ্রুতগামী পাতলা রণতরী), তরাণ্ডী, তারবে, শিবাড এবং মাঁচোয়া (এ দুটি মালবাহী নৌকা), পগার্ ইত্যাদি। তাঁহার অধিকাংশ জাহাজই অতি ছোট, ভারী ধাতুৰ পাতে মোড়া নহে এবং তীর ছাড়িয়া বহুদূরে সমুদ্রে দীর্ঘকাল থাকিতে অক্ষম; কামানের এক গোলা লাগিলেই ডুবিয়া যাইত। ইংরাজ-কুঠীর অধ্যক্ষ এগুলির সম্বন্ধে বলিয়াছেন,– “এই সকল নৌকা অসার জিনিষ, ইংরাজদের একখানা ভাল যুদ্ধ-জাহাজ ইহাদের একশতখানা নির্ব্বিঘ্নে ডুবাইয়া দিতে পারে।” অর্থাৎ যাহাকে “মশা মাছি” (mosquito craft) বলা হয়। সুরত, বম্বে ও গোয়া ছাড়া পশ্চিম-কূলের প্রায় আর-সব বন্দরের জলের গভীরতা এত কম যে বড় বড় ভারী জাহাজ সেখানে ঢুকিতে বা ঝড়ের সময় আশ্রয় লইতে পারে না। এজন্য প্রাচীনকাল হইতেই কোঁকন ও মালবার-কূলের পণ্য-দ্রব্য ছোট এবং কম গভীর (চেপ্টা তলা) নৌকায় চালান করা হইত; এসব নৌকা তীরের কাছে যেখানে ছোট খাড়ী ও নদীতে তুফান দেখিলেই পলাইয়া রক্ষা পাইত। এই দেশের যুদ্ধ-জাহাজও সেই ধরণে তৈয়ার করা হইত; এগুলি ছোট, বড় বড় বা বেশী সংখ্যার তোপ বহিতে পারিত না; ঝড়ে সমুদ্রে টিকিতে বা ভাঙ্গা ছাড়িয়া দূরে গিয়া একসঙ্গে অনেকদিন ধরিয়া পালে চলিবার জন্য প্রস্তুত নহে। তাহারা সংখ্যার জোরে যুদ্ধজয়ের চেষ্টা করিত, তোপের গোলাতে নহে। শিবাজীও নিজ পোতগুলি এই প্রাচীন ধরণে গঠন করেন এবং জলযুদ্ধে এই পুরাতন রণ-নীতির কোন পরিবর্ত্তন বা উন্নতি করেন নাই। কাজেই, ইংরাজদের ত কথাই নাই, সিদ্দিদের কাছেও তাঁহার সহজেই পরাজয় হইত।
শিবাজীর নাবিক ও নৌ সেনাপতি
শিবাজীর নৌ-বল দুই ভাগ করিয়া রাখা হয়; দরিয়া সারঙ্গ (মুসলমান) এবং ময়া- নায়ক (হিন্দু) উপাধিধারী দুজন নৌ-সেনাপতি (য়্যাডমিরাল্) ইহাদের নেতা। রত্নগিরি জেলার সমুদ্র-কূলের গ্রামগুলিতে জেলে ভণ্ডারী জাতের অনেক কৃষক আছে। ইহারা সমুদ্রে বাস করিতে, জাহাজ চালাইতে এবং নৌ-যুদ্ধে পুরুষানুক্রমে অভ্যস্ত। আগে ইহারা জলদস্যুগিরি করিত। ইহাদের দেহ পুষ্ট, সবল ও ব্যায়ামে গঠিত– স্থলযুদ্ধে যেমন মারাঠা ও কুন্তী জাত দক্ষ, ইহারাও ঠিক সেইমত। এই ভণ্ডারী এবং অপর কয়েকটি নীচ হিন্দুজাত– যথা, কোলী, সংঘর, বাঘের ও আংগ্রে (বংশ) হইতে শিবাজী অনেক উৎকৃষ্ট নৌ-সেনা ও নাবিক পাইলেন।
পরে (১৬৭৭ সালে) ঘরোয়া বিবাদের ফলে সিদ্দি সম্বল এবং তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্র সিদ্ধি মিসরি, এই দুই হাবশী সর্দ্দার আসিয়া শিবাজীর অধীনে কাজ লইলেন। তাঁহার অপর মুসলমান নৌ-সেনাপতির নাম দৌলত খাঁ। কিন্তু জঞ্জিরার সিদ্দিদের জাহাজগুলি মারাঠাদের তুলনায় আকারে বড়, অধিকতর দৃঢ় ও সুরক্ষিত এবং ভাল কামান এবং দক্ষতর যোদ্ধা দিয়া পূর্ণ; সুতরাং যুদ্ধে সিদ্দিরই জয়লাভ হইত, মারাঠারা অনেক বেশী লোক ও নৌকা হারাইয়া পলাইত।
শিবাজীর অনেকগুলি জাহাজ তাঁহার নিজের এবং প্রজাদের মাল লইয়া, আরবের মোচা, পারস্যের বস্ত্রা, ইত্যাদি বন্দরে যাত্রা করিয়া নানাদেশে বাণিজ্য করিতে লাগিল। দক্ষিণে আট-দশটা বন্দর তাঁহার বাণিজ্যপোতের কেন্দ্র ও বিশ্রামস্থল ছিল। আর, তাঁহার যুদ্ধের নৌকাগুলি যথাসম্ভব সমুদ্রে অরক্ষিত শত্রু- পোত এবং কূলে অন্যান্য রাজার বন্দর লুঠ করিত। সুরত হইতে বাদশাহর প্রজাদের জাহাজগুলি তীর্থযাত্রী লইয়া মক্কা যাইবার পথে শিবাজীর দ্বারা আক্রান্ত হইত, কখন ধরা পড়িত। অবশেষে, আওরংজীব এই-সব জাহাজ রক্ষা, পশ্চিম- সমুদ্রে পাহারা দেওয়া এবং শিবাজীর নৌ-বল দমন করিবার ভার অনেক টাকা বেতনে সিদ্দিদের উপর দিলেন।
জঞ্জিরার বিপ্লব এবং সিদ্দি কাসিমের দণ্ডা জয়
শিবাজী যতদিন বাঁচিয়া ছিলেন প্রায় প্রত্যেক বৎসরই জঞ্জিরা আক্রমণ করিতেন; এই সকল একঘেয়ে নিষ্ফল চেষ্টার বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া অনাবশ্যক। ১৬৬০- ৭০ সালে তিনি জিদের সহিত অতি ভীষণ যুদ্ধ করিয়া সিদ্দি-সর্দ্দার ফতহ্ খাঁ-কে অতিষ্ঠ করিয়া তুলিলেন; অন্নাভাবে জঞ্জিরার পতন হয় আর কি! অথচ সিদ্দিদের উপরের রাজা আদিল শাহর নিকট হইতে কোনপ্রকার সাহায্যের আশা নাই। তখন ফতহ্ খাঁ টাকা ও জাগীর লইয়া শিবাজীকে ঐ দ্বীপ ছাড়িয়া দিতে সম্মত হইলেন । কিন্তু অপর তিনজন সিদ্দি-প্রধান তাঁহাকে বন্দী করিয়া জঞ্জিরা ও সিদ্দি জাহাজগুলির কর্তৃত্ব নিজ হাতে লইলেন। মুঘল-বাদশাহ সিদ্দিকে পুরুষানুক্রমে “ইয়াকুত্ খাঁ” উপাধি ও বার্ষিক তিন লক্ষ টাকা বেতন দিয়া নিজ চাকর করিয়া, সমুদ্রে পাহারা দিবার ভার দিলেন। সিদ্দি কাসিম হইলেন জঞ্জিরার, আর সিদ্দি খয়রিয়ৎ স্থলভূমির শাসনকর্তা এবং সিদ্দি সম্বল্ জাহাজগুলির নেতা (য়্যাত্, মিরাল, আমীর-আল-বহর্)।
সিদ্দি কাসিম বড় চতুর, সাহসী ও পরিশ্রমী লোক। তিনি সুশাসনে এবং কাজকর্ম্মে সৰ্ব্বদা তীক্ষ্ণদৃষ্টি রাখিয়া যুদ্ধের জাহাজ ও গোলাবারুদ বাড়াইলেন, অনেক মারাঠা-জাহাজ ধরিয়া ধনলাভ করিলেন। অবশেষে ১০ ফেব্রুয়ারি ১৬৯১ সালে, যখন দণ্ডা-দুর্গের মারাঠা-রক্ষীগণ সারাদিন হোলী উৎসবে মাতিয়া, মদ খাইয়া, ক্লান্ত-অবস্থায় রাত্রে অসাবধান হইয়া ঘুমাইতেছিল, তখন কাসিম গোপনে চল্লিশখানা জাহাজে সৈন্য লইয়া নিঃশব্দে দণ্ডাব সমুদ্র-তীরের ঘাটে (অর্থাৎ দুর্গের দক্ষিণ মুখে) পৌঁছিলেন। এদিকে সিদ্দি খয়রিয়ৎ পাঁচশত সেনা লইয়া স্থলের দিকের দেওয়ালে (অর্থাৎ দুর্গের উত্তর-পূৰ্ব্বমুখে) গিয়া মহাবাদ্য ও গোলমালের সহিত সেই দেওয়াল আক্রমণ করিবার ভান করিলেন। মারাঠা-সৈন্যের অধিকাংশই এই দ্বিতীয় দিকে ছুটিল; আর সেই অবসরে কাসিম বিনা বাধায় ঘাটের দেওয়াল বাহিয়া উঠিয়া দুর্গে ঢুকিলেন। তাঁহার জনকতক লোক মরিল বটে, কিন্তু সেখানে মারাঠাদের যে-কয়জন রক্ষী ছিল তাহারা পরাস্ত হইয়া পলাইল। কাসিম দুর্গের মধ্যে আরও অগ্রসর হইলেন। এমন সময় হঠাৎ আগুন লাগিয়া দুর্গের বারুদের গুদাম ফাটিয়া যাওয়ায় মারাঠা কিলাদার এবং দুই পক্ষের অনেক লোক পুড়িয়া মরিল। এই আকস্মিক দুর্ঘটনায় সৈন্যদল স্তম্ভত হইয়া দাঁড়াইল। কাসিম অমনি চেঁচাইয়া উঠিলেন, “খা! খাস্সু (তাঁহার রণ-বাণী)! বীরগণ, আশ্বস্ত হও। আমি বাঁচিয়া আছি, আমার কোন জখম হয় নাই।” তাহার পর শত্রু কাটিতে কাটিতে অগ্রসর হইয়া পূর্ব্বদিক হইতে আগত খয়রিয়তের দলের সহিত মিলিলেন এবং সমস্ত দুর্গ দখল করিয়া মারাঠাদের নিঃশেষ করিয়া দিলেন।
শিবাজী জঞ্জিরা লইবার জন্য দিনরাত ভাবিতেছেন, আর কিনা তাঁহার হাত হইতে দণ্ডা পৰ্য্যন্ত চলিয়া গেল। এই সংবাদে তিনি মৰ্ম্মাহত হইলেন। গল্প আছে যে, রাত্রিতে আগুন লাগিয়া বারুদের গুদাম উড়িয়া যাওয়ার সময় তিনি চল্লিশ মাইল দূরে নিজ গড়ে ঘুমাইতে-ছিলেন। হঠাৎ ঘুম ভাঙিয়া গেল; তিনি বলিলেন “মনটা কেমন করিতেছে। নিশ্চয়ই দণ্ডায় কোন বিপদ ঘটিয়াছে।
এই বিজয়ের পর কাসিম ঐ অঞ্চলে আরও সাতটি দুর্গ মারাঠাদের হাত হইতে উদ্ধার করিলেন এবং পরাজিত লোকদের উপর চূড়ান্ত অত্যাচার করিলেন। শিবাজী ও শম্ভুজী তাঁহাদের রাজত্বকালে এই প্রদেশ পুনরায় দখল করিবার অনেক চেষ্টা করিয়াও কৃতকার্য্য হইতে পারেন নাই। জাহাজ দিয়া অপর পক্ষকে চূড়ান্ত পরাজিত করিতে সাহায্য করিবার জন্য শিবাজী ও বাদশাহ প্রত্যেকেই বম্বের ইংরাজদের সাধিতে লাগিলেন। কিন্তু ইংরাজেরা বণিকের উচিত শান্তিতে রহিলেন; ফরাসী কোম্পানী কিন্তু এই ফাঁকে গোপনে শিবাজীকে ৮০টা ছোট তোপ এবং দু’ হাজার মণ সীসা বেচিয়া একচোট লাভ করিয়া লইল! ডচেরা শিবাজীর নিকট প্রস্তাব করিল, “আপনি সৈন্য দিন, আমরা জাহাজ দিব; উভয়ে একজোটে বম্বে আক্রমণ করিয়া ইংরাজদের বেদখল করিব, আর তাহার পর দণ্ডা কাড়িয়া লইয়া আপনাকে দিব।” কিন্তু শিবাজী এ কথায় কান দিলেন না। তাহার পর কত বৎসর ধরিয়া ঢিমে তালে এই যুদ্ধ চলিতে থাকিল। দুই পক্ষই অমানুষিক অত্যাচার করিতে লাগিল।
শিবাজীর নৌ-যুদ্ধ
১৬৭৪ সালের মার্চ মাসে সিদ্দি সম্বল্ সাতবলী নদীর মুখের খাড়ীতে ঢুকিয়া শিবাজীর নৌ-সেনাপতি দৌলত খাঁকে আক্রমণ করিলেন বটে, কিন্তু শেষে তাঁহাকে পরাস্ত হইয়া ফিরিতে হইল; এই যুদ্ধে দুই পক্ষেরই প্রধান সেনাপতি আহত হন এবং একশত ও ৪৪ জন লোক মারা পড়ে। সিদ্দি সম্বল অন্যান্য হাবশীদের সঙ্গে ঝগড়া করায় তাঁহাকে নৌ-সেনাপতির পদ হইতে দূর করিয়া দেওয়া হইল; তিনি অবশেষে (১৬৭৭ সালের নবেম্বর-ডিসেম্বরে) স্বজাতির সঙ্গ ও জাহাজ ছাড়িয়া নিজ পরিবার ও অনুচর লইয়া শিবাজীর অধীনে চাকরি লইলেন।
খান্দেরী দ্বীপ লইয়া ইংরাজের সহিত শিবাজীর যুদ্ধ
জঞ্জিরা-জয়ে হতাশ হইয়া শিবাজী নিজে একটি জলবেষ্টিত দুর্গ স্থাপন করিবার ইচ্ছায় কাছাকাছি আর একটি দ্বীপ খুঁজিয়া বাহির করিলেন। ইহার নাম খান্দেরী, বম্বের এগার মাইল দক্ষিণে এবং জঞ্জিরার ৩০ মাইল উত্তরে। ১৬৭৯ সেপ্টেম্বরে তাঁহার দেড়শত লোক চারিটি কামান লইয়া ময়া-নায়কের অধীনে জাহাজে আসিয়া এই ছোট শূন্য দ্বীপটি দখল করিল এবং তাড়াতাড়ি পাথর ও মাটির দেওয়াল তুলিয়া ইহার চারিদিক ঘিরিয়া দিল। রাজা এই-সব খরচের জন্য পাঁচ লক্ষ টাকা মঞ্জুর করিলেন। ইহাতে ইংরাজদের ভয় হইল, কারণ বম্বেতে যে-সব জাহাজ যাতায়াত করে সেগুলি খান্দেরী হইতে অতি স্পষ্ট দেখা যায় এবং শীঘ্র আক্রমণ করা সম্ভব। এই খান্দেরী শত্রুর অভেদ্য দুর্গ হইয়া উঠিলে, ইহার আশ্রয় হইতে মারাঠা যুদ্ধ-জাহাজের পক্ষে সমুদ্রে ইংরাজ-বাণিজ্যপোত ধ্বংস করা সহজ হইবে।
সুতরাং বম্বের ইংরাজদের সৈন্য ও রণপোত মারাঠাদের খান্দেরী হইতে তাড়াইয়া দিতে আসিল। ১৯-এ সেপ্টেম্বর, ১৬৭৯ ইংরাজ ও মারাঠাদের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ হইল; ইংরাজ হারিলেন, কারণ ইহা প্রকৃত-প্রস্তাবে স্থলযুদ্ধই ছিল। বড় বড় ইংরাজ-জাহাজগুলি তীর হইতে দূরে থামিয়া খান্দেরী উপসাগরে ঢুকিতে দেরি করিতেছিল, কারণ তখনও সেখানকার জলের গভীরতা মাপা হয় নাই। এমন সময়ে প্রধান সেনাপতির আজ্ঞা অমান্য করিয়া, লেফটেন্যান্ট ফ্রান্সিস্ থপ্ মাত্র তিন-খানা পদাতিক-ভরা তোপহীন ছোট শিবাড (মালের নৌকা) সঙ্গে লইয়া ঐ দ্বীপে নামিবার চেষ্টা করিলেন। তীর হইতে তাঁহাদের উপর গোলাগুলি বর্ষণ হইতে লাগিল। থর্প এবং আর দুইজন ইংরাজ মারা পড়িল, অনেকে জখম হইল, আর অনেকে তীরে নামিবার পর মারাঠাদের হাতে বন্দী হইল। থর্পের শিবাডখানা শত্রুরা দখল করিল; আর দুখানা বাহির সমুদ্রে পলাইয়া গেল।
১৮ই অক্টোবর দ্বিতীয়বার জলযুদ্ধ হইল। সেদিন প্রাতঃকালে দৌলত খাঁ ৬০ খানা রণপোত লইয়া আক্রমণ করিলেন। ইংরাজদের আটখানা মাত্র জাহাজ ছিল, তাহার মধ্যে ‘রিভেঞ্জ’ নামক ফ্রিগেট ও দুইখানা ঘুরাব্ বড়, বাকী সব ছোট; এগুলিতে দুইশত ইংরাজ-সৈন্য এবং দেশী ও সাহেব নাবিক ছিল। চৌল-দুর্গের কিছু উত্তরে তীরের আশ্রয় হইতে বাহির হইয়া মারাঠা-জাহাজগুলি সামনের গলুই হইতে তোপ দাগিতে দাগিতে এত দ্রুত অগ্রসর হইল যে খান্দেরীর বাহিরে ইংরাজ পোত-গুলি নোঙর তুলিয়া অগ্রসর হইবার সময় পাইল না। আধ ঘণ্টার মধ্যে ইংরাজদের ‘ডোভার’ নামক ঘুরাবে সার্জেন্ট মলেভারার ও জনকয়েক গোরা অত্যন্ত কাপুরুষতার সহিত আত্মসর্পণ করিল এবং জাহাজশুদ্ধ সকলেই মারাঠাদের হাতে বন্দী হইল।[২] অপর ছয়খানি ছোট ইংরাজ-জাহাজও ভয়ে রণস্থল হইতে দূরে রহিল। কিন্তু এক সিংহই সহস্র শৃগালকে হারাইতে পারে। চারিদিকে শক্রপোতের মধ্যে ‘রিভেঞ্জ’ ফ্রিগেট নির্ভয়ে খাড়া রহিয়া, তোপের গোলায় পাঁচখানা মারাঠী গলবট্ ডুবাইয়া দিল, এবং আরও অনেকগুলির এমন দশা করিল যে দৌলত খাঁ নিজ পোত লইয়া নাগোনায় পলাইয়া গেলেন; রিভেঞ্জ তাঁহার পিছু পিছু ছুটিল।
দুইদিন পরে দৌলত খাঁ খাড়ী হইতে আবার বাহির হইলেন বটে, কিন্তু ইংরাজ-জাহাজ তাঁহার দিকে আসিতেছে দেখিয়া ফিরিয়া পলাইলেন। নবেম্বরের শেষে সিদ্দি কাসিম ৩৪খানা জাহাজ লইয়া ইংরাজদের সঙ্গে যোগ দিলেন এবং দুই দলই খান্দেরীর উপর প্রত্যহ গোলা বর্ষণ করিতে লাগিলেন।
কিন্তু এই সব যুদ্ধের খরচ এবং শিবাজীর রাজ্যে তাঁহাদের বাণিজ্য বন্ধ হইবার ভয়ে ইংরাজদের কর্তারা ভীত হইলেন। তাঁহাদের অর্থ ও লোক কম; গোরা সৈন্য মরিলে নূতন লোক পাওয়া কঠিন। সুতরাং তাঁহারা শিবাজীকে খুব মিষ্ট করিয়া চিঠি লিখিয়া মিটমাট করিয়া ফেলিলেন। জানুয়ারি মাসে ইংরাজ- রণপোতগুলি খান্দেরীর উপসাগর ছাড়িয়া বম্বেতে ফিরিল।
সিদ্দির সহিত জলযুদ্ধ
কিন্তু সিদ্দি কাসিম খান্দেরীর পাশে আন্দেরী দ্বীপ দখল করিয়া কামান চড়াইয়া দেওয়াল গাঁথিয়া (৯ই জানুয়ারি, ১৬৮০) সেখানে হইতে ধান্দেরীর উপর গোলা দাগিতে লাগিলেন। দৌলত খাঁ নাগোনা খাড়ী হইতে নৌকাসহ আসিয়া দুই রাত্রি আন্দেরী-দখলের বৃথা চেষ্টা করিলেন। ২৬-এ জানুয়ারি তিনি তিনদিক হইতে আন্দেরী আক্রমণ করিলেন। চারি ঘণ্টা ধরিয়া যুদ্ধ হইল; অবশেষে মারাঠারা পরাস্ত হইয়া চৌলে ফিরিয়া গেল। তাহাদের চারিখানা ঘুরাব ও চারিখানা ছোট জাহাজ ধ্বংস পাইল, দুইশত সৈন্য মরিল, একশত জখম হইল, আর অনেকে শত্রুহস্তে বন্দী হইল। দৌলত খাঁ নিজে পায়ে বিষম আঘাত পাইলেন। সিদ্দির তরফে একখানিও জাহাজ নষ্ট হইল না, এবং মাত্র চারিজন লোক হত এবং সাতজন আহত হইল।
তথ্যনির্দেশ
১. আষ্টিক্ (১৬৭২), নিকল্স (১৬৭৩), হেনরি অকসিণ্ডেন (১৬৭৫)।
২. শিবাজী সুরগঢ় দুর্গে ইহাদের আবদ্ধ রাখেন। সেখানে ৬ই নবেম্বর বন্দী ছিল- ২০ জন ইংরাজ, ফরাসী ও ডচ্, ২৮ জন পোর্তুগীজ অর্থাৎ ফিরিঙ্গি, এবং ৯জন খালাসী।