শায়লার বুকে ধ্বক করে একটা ধাক্কা লাগল।
কি সুন্দর লাগছে তিথিকে। তার মেয়েটা এত সুন্দর? আশ্চর্য এত সুন্দর তার এই মেয়ে? এতদিন কেন তা চোখে পড়ল না।
তিথি পা তুলে মাথা নিচু করে খাটে বসে আছে। আজ তার গায়ে হলুদ তাকে সাজানো হয়েছে ফুলের মালায়। তাকে দেখে মনে হচ্ছে বিছানায় একটা লালপদ্ম ফুটে আছে। শায়লার চোখে পানি এসে গেল। ঘর ভর্তি মানুষ। তিনি তাদের অগ্রাহ্য করেই শব্দ করে কাঁদতে লাগলেন। তিথি চোখ তুলে তাকাল। শায়লা বললেন, তোমরা সবাই এই ঘর থেকে যাওতো। সবাই যাও। আমি আমার মেয়ের সঙ্গে একটু কথা বলব।
সবাই চলে গেল। শায়লা বললেন, মা তুই খানিকক্ষণ আমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে থাকতো।
তিথি বলল, কেন মা?
এখনো তুই পুরোপুরি আমার। বিয়ে হয়ে গেলেতো এই কথাটা বলতে পারব। আয় মা শুয়ে থাক।
শায়লা বসলেন। তিথি তাঁর কোলে মাথা রেখে কোমর জড়িয়ে শুয়ে রইল। শায়লার চোখ দিয়ে ফেঁটা ফোঁটা পানি তিথির গালে পড়ছে। তিথি বলল, মা তুমি কি জান এই পৃথিবীতে আমি তোমার চেয়েও যাকে ভালবাসি সে কে?
জানি। তোর বাবা।
হ্যাঁ। তুমি আমার এই বাবাটাকে কেন কষ্ট দাও? তারচে ভালমানুষ কি তুমি এখন পর্যন্ত আর কাউকে দেখেছ? সত্যি করে বল।
না।
তাহলে কেন এমন কষ্ট দাও। তুমি আজ আমাকে ছুয়ে প্রতিজ্ঞা করবে বাবাকে কষ্ট দেবে না। আমিতো থাকব না, বাবাকে দেখার কেউ থাকবে না। এই জন্যেই তোমাকে প্রতিজ্ঞা করতে বলছি।
আচ্ছা যা প্রতিজ্ঞা করলাম। মাঝে মাঝে এমন বিরক্ত করে যে অসহ্য লাগে।
যত অসহ্যই লাগুক আর তুমি বাবাকে কষ্ট দেবে না।
আচ্ছা যা দেব না।
কিছুক্ষণ আগে শুনলাম নুরুজ্জামান সাহেবকে তুমি কঠিন গলায় বকাবকি করছ। কেন মা?
আরে ওকে বলেছি আজ বাড়িতে লোকজন আসবে ভাল একটা কাপড় পরতে। সে একটা হলুদ কোট গায়ে দিয়ে ঘুরছে। গলায় মাফলার।
বেচারার কোটিটা খুব পছন্দ। তুমি উনাকে একটা ভাল কোট কিনে দাও।
তোকে বলতে হবে না। আগেই ঠিক করে রেখেছি। রেডিমেড স্যুট পাওয়া যায় ঐ একটা কিনে দেব।
উনাকে তোমার খুব পছন্দ হয়েছে তাই না মা?
পছন্দ হবে না কেন? ভাল ছেলে ঘোর প্যাঁচ নাই।
উনাকে কেন পছন্দ হয়েছে সেই রহস্য কিন্তু আমি জানি না।
কি রহস্য?
উনি তোমাকে মা ডাকেন এই জন্যেই তাকে তোমার এত পছন্দ।
মা ডাকলেই পছন্দ করতে হবে না-কি? মাতে কতজনই আমাকে ডাকে। দুনিয়ার যত ফকির সবই আমাকে মা ডাকে। ওদের আমি পছন্দ করি?
তাহলে কেন পছন্দ কর উনি বোকা বলে? পথিবীর বেশির ভাগ মানুষ বুদ্ধিমানদের দুচোখে দেখতে পারে না। বোকাদের তারা পছন্দ করে।
উদ্ভট উদ্ভট কথা বলিসনা তো মা। ও বোকা এটা তোকে কে বলল?।
বোকা তো বলতে হয় না। কপালে লেখাও থাকে না। বোঝা যায়। তিনি আমার। বিয়ের কার্ড শিক্ষামন্ত্রীকে দিয়ে এসেছেন। বিয়েতে দাওয়াত করে এসেছেন। একজন বোকা লোক ছাড়া এই কাজ কে করবে? আবার ইরা মীরাকে এসে বলেছেন শিক্ষামন্ত্রী নাকি বিয়েতে আসবেন। তাকে কথা দিয়েছেন। হি হি হি।
তিথি হাসছে। শায়লাও হাসছেন। তিথি হাসি থামিয়ে বলল, মা তুমি নুরুজ্জামান সাহেবকে পাঠাওতো আমি জিজ্ঞেস করি মন্ত্রী সাহেব উনাকে কি বললেন।
থাক বেচারাকে লজ্জা দিতে হবে না।
লজ্জা দেব না মা। এম্নি কথা বলব। উনাকে আমার নিরিবিলিতে কয়েকটা কথা বলা দরকার। পাঠাও একটু। আর শোন মা–আমি একটু চা খাব।
তিথি আসলে এক ধরনের অপরাধ বোধে ভুগছে। ঢাকা থেকে সিলেট যাবার সময় মানুষটাকে এক অর্থে অপমানই করা হয়েছে।
মারুফ যখন ট্রেনের দরজা বন্ধ করে দিচ্ছিল তখন সে কি রকম অবাক হয়ে তাকিয়েছিল। অবাক এবং বিস্ময়। না না বিস্ময় না সে তাকিয়েছিল ব্যথিত চোখে। এই ব্যথা দূর করে দেয়া দরকার।
নুরুজ্জামান লজ্জিত ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকল।
তিথি বলল বসুন নুরুজ্জামান সাহেব। চেয়ারটায় বসুন। কেমন আছেন?
ভাল।
মন্ত্রীর কাছে না-কি গিয়েছিলেন?
জি। উনার পিএ প্রথমবার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। পরের বার আর কিছু লাগে নাই।
কাজ হয়েছে আপনার?
জ্বি। স্কুল স্যংশনের অর্ডার হয়েছে।
বলেন কি?
মানুষদের মধ্যে যেমন ভাল মন্দ আছে। মন্ত্রীদের মধ্যেও তেমন ভাল মন্দ আছে। উনি আমার সঙ্গে যে ব্যবহার করলেন তার তুলনা নেই।
শুনে ভাল লাগল। আমরাতো সারাক্ষণ মানুষ সম্পর্কে মন্দ কথাই শুনি।
নুরুজ্জামান ইতস্ততঃ করে বলল, আমি উনাকে মারুফ সাহেবের স্কলারশীপের ব্যাপারটাও বললাম।
তিথি বিস্মিত হয়ে বলল, আপনাকে কে বলতে বলল?
না কেউ বলেনি। আপনি মাকে বলছিলেন–নো অবজেকশান দিচ্ছে না। শুনে মনটা খারাপ হয়েছে। তারপর ভাবলাম সুযোগ যখন পাওয়া গেছে তখন বলে ফেলি।
উনি কি বললেন সব ঠিক করে দেবেন?
উনি সঙ্গে সঙ্গে কাগজ পত্র আনালেন।
তারপর?
উনি বললেন ফ্রান্সের স্কলারশীপের কোন কাগজপত্ৰতো ফাইলে নেই। উনার ধারণা কোথাও কোন ভুল হয়েছে। উনি বললেন আমি যেন ঠিক ঠাক ইনফরমেশন জোগার করে তাকে দেই কিংবা মারুফ সাহেবকে তাঁর কাছে নিয়ে যাই। আমি মারুফ সাহেবের কাছে গেলাম। উনি আবার সব শুনে আমার উপর খুব রাগ করলেন।
রাগ করে কি বলল?
নুরুজ্জামান চুপ করে রইল। মারুফ রাগ করে যে সব কুৎসিত কথা বলেছে তা তার বলতে ইচ্ছা করছে না। তিথি বলল, আপনি ওর কথায় রাগ করবেন না। ওর স্বভাবই এমন। ও কারোর কাছ থেকে সাহায্য নিতে চায় না।
আমি রাগ করিনি। উনার যাবার ব্যাপারে যেন কোন সমস্যা না হয় এই জন্যেই আমি …।
ওর কোন সমস্যা হবে না। আর সমস্যা হলে ও নিজেই তা মেটাবে।
জি আচ্ছা।
আপনি যে কাজে এসেছেন সেটা যে ভালমত হয়েছে তাতেই আমি খুশি। কি নাম যেন আপনার স্কুলের?
বেগম রোকেয়া গার্লস হাই স্কুল।
স্কুল তৈরি হোক। চালু হোক। তারপর একদিন আপনার স্কুল দেখে আসব।
জি আচ্ছা।
মীরা ঘরে ঢুকল চা নিয়ে। চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, বড় মামা এসেছেন। আপা তোমাকে ডাকছেন। মার ঘরে বসে আছেন।
তিথির বড় মামার মুখ অন্ধকার। তিথি অবাক হয়ে দেখল শুধু যে মামার মুখ অন্ধকার তাই না। বাবা মা দুজনের মুখই অন্ধকার। মার শরীর কাঁপছে। বাবা বসে আছেন মাথা নীচু করে।
তিথি বলল, কি হয়েছে মামা?
বোস এখানে। দরজাটা ভিজিয়ে দিয়ে এসে বোস।
তিথিকে দরজা বন্ধ করতে হল না। শায়লা নিজেই উঠে দরজার হুড়কা লাগিয়ে দিলেন। সাইদুর রহমান সাহেব মুখের পাইপ টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, কি বলছি মন দিয়ে শোন। তোর বাবা আমাকে তোর পাসপোর্ট দিয়ে বলেছিল তুই যেন মারুফ ছেলেটার সঙ্গে এক সঙ্গে বাইরে যেতে পারিস সেই ব্যবস্থা করে দেবার জন্যে। আমি খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি মারুফ ছেলেটার বাইরে যাবার কোন ব্যাপার নেই। এটা তোকে সে মিথ্যা বলেছে।
তিথি তাকিয়ে রইল। সে কিছুই বলল না।
সাইদুর রহমান সাহেব বললেন, সঙ্গত কারণেই আমি খুব চিন্তিত বোধ করলাম। আমরা জানি তোর বাবা মা কোন খোঁজ খবর করবে না। ওরা ঝগড়া ছাড়া অন্য কিছু পারে না। খোঁজ নিয়ে আরো কিছু জিনিস জানলাম।
তিথি কঠিণ গলায় বলল, কি জানলে?
তোর বাবা বলছিল ছেলের বাবা কলেজে অঙ্কের প্রফেসর ছিল। আমি যা জেনেছি তা হল ঐ লোকের নেত্রকোনা শহরে একটা দরজির দোকান আছে। সে দরজি।
তিথির মুখ ছাইবর্ণ হয়ে গেল। জাফর সাহেব মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে ব্যথিত গলায় বললেন, ছেলের বাবা কি করেন সেটা কোন ব্যাপার না।
সাইদুর রহমান সাহেব বললেন, তোমার কাছে হয়ত কোন ব্যাপার না। আমার কাছে ব্যাপার। কেঁচো খুঁড়তে সাপ বের হবার আগেই বিয়ে বন্ধ হওয়া দরকার —আমার যা বলার বললাম। বাকি তোমাদের বিবেচনা। আমি তিথিকেই জিজ্ঞেস করছি। তিথি তুই কি চাস? বিয়ে হবে?
তিথি উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, না।
গুড গার্ল। কিছু কিছু সময় আসে যখন মানুষকে শক্ত হতে হয়।
জাফর সাহেব বললেন, শোনা কথার উপর নির্ভর করে কোন সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত না। তিথি তুই মারুফের সঙ্গে কথা বল। চল আমি তোকে নিয়ে যাই।
তিথি বলল, না।
হুট করে বিয়ে ঠিক করা যেমন কাজের কথা না, বিয়ে ভাঙাও তেমন কাজের কথা না।
তিথি কঠিন গলায় বলল, বাবা, আমি মন ঠিক করে ফেলেছি।
মন ঠিক করেছিস ভাল কথা। এক্ষুণি ঠিক করতে হবে তা তো না। সময় নে–ঠাণ্ডা মাথায় ভাব। ওর সঙ্গে কথা বল …
সাইদুর রহমান সাহেব বিরক্ত গলায় বললেন, জাফর, তুমি অকারণে ঝামেলা করছ কেন? দেখছ না মেয়েটা মনস্থির করে ফেলেছে? সব কিছুর মূলে আছ তুমি। বাবা হিসেবে তোমার কি দায়িত্ব ছিল না খোঁজ-খবর করার? একজন এসে বলল, আমি শাহজাদা, ওমি তুমি তার সঙ্গে মেয়ের বিয়ে ঠিক করে ফেললে? একবার ভাবলেও না সে সত্যি শাহজাদা না ভয়ংকর কোন হারামজাদা?
তিথি উঠে চলে গেল। বড় মামার কুৎসিত ধরনের কথা তার ভাল লাগছে না।
প্রথমে সে গেল নিজের কামরায়। ইরা-মীরা ঘরের খাটে বসে ছিল। আপাকে ঢুকতে দেখে দুজন এক সঙ্গে বের হয়ে গেল। তারাও মনে হয় পুরো ঘটনাটা জানে।
তিথির কেমন যেন অস্থির লাগছে। কিছুক্ষণ কাঁদতে পারলে ভাল হত। কান্না আসছে না। কেমন যেন ঘুম ঘুম পাচ্ছে। প্রচণ্ড দুঃখের সময় মানুষের কি ঘুম পায়? এই পরিচিত শহর ছেড়ে দূরে কোথাও চলে গেলে কেমন হয়? অনেক দূরে–যেখানে কেউ তাকে চিনবে না। কেউ এসে বলবে না–তিথি, তোমার না বিয়ে হওয়ার কথা ছিল?
বাবার জন্যে তিথির খুব খারাপ লাগছে। কি রকম অদ্ভুত চোখে তিনি সবার দিকে তাকাচ্ছিলেন। তার চোখ ভর্তি বিস্ময়। ঘটনাটার পর মা একবারও তার দিকে তাকাননি। সব সময় চোখ অন্যদিকে ফিরিয়ে ঢেখেছেন। তিথি লক্ষ্য করছে, মা মাঝে মাঝে শাড়ির আঁচলে চোখ চেপে ধরছেন। মা খুব শক্ত মহিলা। মাকে তিথি খুব কম কাঁদতে দেখেছে। এই প্রথম খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে মাকে সে দুবার কাঁদতে দেখল। দুবারই সম্পূর্ণ ভিন্ন কারণে।
আপা?
তিথি দেখল ইরা ঘরে এসে ঢুকেছে। সেও তার দিকে তাকাচ্ছে না। মেঝের দিকে তাকিয়ে আছে।
কিছু বলবি?
তোমার একটা টেলিফোন এসেছে আপা। তুমি কি ধরবে?
না।
ইরা প্রায় ফিসফিস করে বলল, মা টেলিফোন ধরতে বলছে। তিথি বলল, কার টেলিফোন, মারুফের?
হুঁ। মা তোমাকে কথা বলতে বলল।
মা বললে তো হবে না। আমার কথা বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। আর শোন–তুই এমন মেঝের দিকে তাকিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলছিস কেন? আমি কি এমন কুৎসিত প্রাণি যে আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলা যাবে না।
সরি আপা।
ইরা চলে যাচ্ছিল, তিথি বলল, দাড়া আমি টেলিফোন ধরব।
তিথি টেলিফোন ধরতেই ওপাশ থেকে মারুফের খুশিখুশি গলা শোনা গেল।
হ্যালো, তিথি ভাল আছ?
আছি।
গলার স্বর শুনে মনে হচ্ছে ভাল নেই। রাতে ভাল ঘুম হয়েছে?
হ্যাঁ।
আমার হয়নি। বলতে গেলে আমি স্লীপলেস নাইট কাটিয়েছি। ও আচ্ছা, পরে বলতে ভুলে যাব–আমি তোমার ঐ লোক–নুরুজ্জামান–তার জন্যে। শিক্ষামন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি কিছুদিনের মধ্যে বাইরে যাবেন, ওখান থেকে ফিরবেন মাসখানিক পর। তখন দেখা করতে বলেছেন। আমি ঠিক করেছি তখন নুরুজ্জামানকে সঙ্গে করে নিয়ে ওর কাজ করিয়ে দেব।
তিথি বলল, সাত দিনের মধ্যে তোমার তো বাইরে যাবার কথা–এক মাস পর তুমি নুরুজ্জামান সাহেবের কাজ কিভাবে করিয়ে দেবে?
ও মাই গড! বিয়ের টেনশানে সব এলোমেলো হয়ে গেছে। আমি নিজেই যে থাকব না সেটাই ভুলে গেছি। হা হা হা। যাই হোক, আমি ব্যবস্থা করে যাব। আমি
থাকলেও কাজ আটকাবে না।
তোমার বাবা কি ঢাকায় আছেন?
এখন নেই, কাল আসবেন।
উনি তো তোমাদের ওখানকার কলেজের অংকের প্রফেসর। তাই না?
আমাদের এখানের না। বগুড়া আজিজুল হক কলেজের অংকের প্রফেসর ছিলেন। সেই আমলে অংকে অনার্স নিয়ে এম. এ. পাশ করেছিলেন। ক্যালকাটা ইউনিভার্সিটি। এম. এ.-তে তিনি এবং নরেশ গুহ দুজন এক সঙ্গে প্রথম হন। বাবা মুসলমান বলে কোন চাকরি পাচ্ছিলেন না। সেই নরেশ গুহ কিছুদিন আগে যাদবপুর ইউনিভার্সিটির অংকের হেড অব দি ডিপার্টমেন্ট হিসেবে রিটায়ার করেছেন। এর নাম ভাগ্য।
তিথি সহজ গলায় বলল, তোমাদের কি নেত্রকোনায় কোন দরজির দোকান আছে।
মারুফ হাসতে হাসতে বলল, আছে। এটা বাবার আরেক পাগলামি। আমাদের নবিজীর চার খলিফাদের একজন না-কি দরজির কাজ করতেন। তাই বাবাও ঠিক করলেন শেষ বয়সে ঐ লাইনে যাবেন। হা হা হা।
শোন মারুফ, তোমার বাবা অংকের প্রফেসর না দরজি, তাতে কিছু যায় আসে। আমি তোমার বাবাকে দেখে তোমাকে পছন্দ করিনি। তোমাকে দেখেই করেছি। তুমি যে ক্রমাগত মিথ্যা বলছ এতে ভয়ংকর কষ্ট পেয়েছি।
শোন তিথি। মিথ্যা যে আমি বলি না, তা না। মিথ্যা বলি। তবে কখনো তোমার সঙ্গে বলি না।
এখনো বলছ না?
না।
তিথি নিজেকে সামলে নিয়ে শান্ত স্বরে বলল, আগামীকাল আমাদের বিয়ে, কিন্তু আমি মনের দিক থেকে কোন সায় পাচ্ছি না। আমি বাবাকে বলে দিয়েছি, এই মুহুর্তে বিয়ের আমার কোন ইচ্ছা নেই। তোমার কাছেও খবর পাঠাতাম–ভাগ্য ভাল, তুমি টেলিফোন করলে। তোমাকেও জানিয়ে দিলাম।
তিথি শোন।
আমি এখন কিছু শুনতে চাচ্ছি না। আমার প্রচণ্ড মাথা ধরেছে। রাখি কেমন?
বিয়ে তাহলে সত্যি সত্যি বাতিল?
হ্যাঁ।
আমার বাবা একজন দরজি–এই কারণে?
না এটা কোন কারণ না। আমার দাদাজান চাষাবাদ করেন, তার জন্যে তিনি মানুষ হিসেবে ছোট হয়ে যান নি।
আমাকে বিয়ে করা ছাড়া তোমার গতি নেই তিথি। তুমি অন্য কোথাও বিয়ে করতে পারবে না। আমি চিঠি লিখে সব জানিয়ে দেব।
কি জানাবে?
জানাব যে, তুমি আমার সঙ্গে রাত্রি যাপন করেছ। ওরা যাতে বিশ্বাস করে তার জন্যে তোমার ডান বুকে লাল তিলটির কথাও বলব।
আমার বুকে কোন লাল তিল নেই। আর থাকলেও তুমি দেখনি। সে সুযোগ আমি তোমাকে দেই নি।
মারুফ বলল, মিথ্যা যখন একবার বলা ধরেছি ভালভাবেই বলব। সবাই মিথ্যাটাই বিশ্বাস করবে। তুমি তো আর কাপড় খুলে সত্যি প্রমাণ করতে পারবে না। পৃথিবীর সবাইকে আমি বলব। তোমার বাবাকে বলব। মাকে বলব।
তিথি টেলিফোন হাতে স্তব্ধ হয়ে বসে রইল। সে এসব কি শুনছে!
হ্যালো তিথি হ্যালো।
শুনছি।
তোমার মাকে টেলিফোন দাও। তার সঙ্গে আমার কথা আছে।
মাকে সব বলবে?
অবশ্যই বলব। কিছুই বাদ দেব না। ইনক্লডিং দ্যা রেড বিউটি স্পট।
তোমার বলতে লজ্জা করবে না?
না। তুমি পাশে থাক। দেখ কি সুন্দর করে বলি। যদি সাহস থাকে তাহলে ডেকে দাও তোমার মাকে।
ধরে থাক, আমি ডেকে দিচ্ছি।
গুড। ভেরী গুড। একসেলেন্ট। আছে তোমার সাহস আছে।
তিথি তার মাকে ডেকে নিয়ে এল। নিজেও দাঁড়িয়ে রইল মার পাশে। শায়লা রিসিভার কানে নিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। এক সময় দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন।
তিথি বলল, কি বলল?
শায়লা বললেন, কিছুই তো বলেনি, শুধু কাঁদছিল। এতক্ষণ শুধু কান্নার শব্দ শুনলাম।
কাঁদছিল?
হ্যাঁ। বেচারার কান্না শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেছে। তিথি, তুই কি আরেকবার ভেবে দেখবি?
তিথি বলল, না। ওর অনেক কৌশল আছে। কান্নাটাও এক ধরনের কৌশল। তোমার সঙ্গে কথা বলার সময় কাদবে। বাবার সঙ্গে কথা বলার সময় অন্য কিছু বলবে। আমি একজন সাধারণ মানুষকে বিয়ে করতে চাই মা, যে কোন রকম কৌশল জানে না।