এগারো
ক্রমশ ওরা শহরের একেবারে পশ্চিমপ্রান্তে চলে এল। এদিকটায় জনবসতি কম। মোটামুটি বর্ধিষ্ণু মানুষেরা অনেকটা জায়গা জুড়ে বাগানঘেরা বাড়িতে থাকেন। হায়দার ইশারা করতেই ট্যাক্সি থামল। ড্রাইভার নিজে দরজা খুলে সুটকেশ দুটো নীচে নামিয়ে ইঙ্গিত করল নেমে আসতে। স্বজন এবং পৃথা একটা কথাও বলেনি টুরিস্ট লজ থেকে চলে আসার পথটুকুতে। স্বজন এখন জিজ্ঞাসা করল, ‘এখানে কেন?’
সামনে বাইক দাঁড় করিয়ে হায়দার ততক্ষণে কাছে এসে গেছে, ‘এখানে একটু যেতে হবে আপনাদের। কিছু রুটিন চেকআপ আছে তারপর— !’ সে হাসল।।
‘ট্যাক্সি থেকে সুটকেশ নামানো হল কেন?’
‘ট্যাক্সিটার এর ওপারে যাওয়ার পারমিট নেই। আপনি নির্দিধায় নামতে পারেন।’ হায়দার আবার হাসল। অতএব স্বজন এবং পৃথাকে নামতেই হল। পৃথা লক্ষ করছিল, ট্যাক্সির ড্রাইভার বারংবার দুপাশে তাকাচ্ছে। ওরা নেমেআসা মাত্র ওঠে পড়ল ট্যাক্সিতে। সেটাকে ঘুরিয়ে বেশ জোরেই ফিরে গেল শহরের দিকে। স্বজন বলে উঠল, ‘আরে! লোকটা ভাড়া নিল না।’
হায়দার মাথা নাড়ল, ‘এখন তো দায়িত্ব আমাদের, ওটা নিয়ে চিন্তা করবেন না। আপনারা সুটকেশ নিয়ে আমার পেছনে আসুন।’ সে এগিয়ে গিয়ে বাইক চালু করে পাশের প্রাইভেট লেখা রাস্তায় ঢুকে পড়ল। স্বজন এবং পৃথা একটা করে সুটকেশ তুলে নিল। স্বজন বলল, ‘আমার ভাল লাগছে না। মনে হচ্ছে ওরা আমাদের আটকে রাখতে যাচ্ছে।’
‘ওদের কি লাভ আমাদের আটকে?’ চাপা গলায় বলে উঠল পৃথা।
‘জানি না। তবে এই শহরে একটা পলিটিক্যাল গোলমাল চলছে। সেই এক্স পুলিশ-অফিসার বলেছিল কেউ সশস্ত্র বিপ্লব করে ক্ষমতা দখল করতে চায়। আজ এখানকার পুলিশ কমিশনারের যে চেহারা দেখলাম তাতে অমন কিছু হওয়া অসম্ভব ব্যাপার নয়।’ হাঁটতে হাঁটতে কথা বলছিল স্বজন। তাদের হাত দশেক দূরে হায়দার ধীর গতিতে বাইক চালাচ্ছিল। বাইকের আওয়াজে কোনও কথাই তার কানে যাওয়া সম্ভব নয়। দুপাশে গাছ-গাছালি। পাখি ডাকছে। সামনে গাছের আড়ালে একটা দোতলা বাড়ির আভাস।
পৃথা বলল, ‘আমার আর ভাল লাগছে না। তুমি এমন জায়গায় বেড়াতে এলে!’ স্বজন অপরাধীর গলায় বলল, ‘পৃথা, তোমার কাছে লুকিয়ে লাভ নেই। এরা আমার কাছে একটা পেশেন্টকে দেখার প্রস্তাব দিয়েছিল। জায়গাটা পাহাড়ি বলেই ভেবেছিলাম সেইসঙ্গে তোমাকে নিয়ে একটু বেড়িয়ে যেতেও পারব। এখানকার গোলমালের কথা স্যার জানতেন কি না জানি না কিন্তু আমি বিন্দুবিসর্গ জানতাম না।’
‘কারা তোমায় প্রস্তাব দিয়েছিল?’
‘স্যারের মাধ্যমে প্রস্তাব এসেছিল। বলেছিল টুরিস্ট লজে আমার নামে ঘর বুক করা থাকবে। আমি এলেই ওরা যোগাযোগ করবে।’ কথা থামিয়ে দিল স্বজন। হায়দার মোটরবাইক থেকে নেমে পড়েছে। বাড়িটার সামনে বাইক দাঁড় করিয়ে সে অপেক্ষা করল ওদের জন্যে। তারপর পৃথার দিকে হাত বাড়াল, ‘এবার সুটকেশটা আমাকে দিন।’
পৃথা মাথা নাড়ল, ‘না। ঠিক আছে।’
ওরা সিঁড়ি ভেঙে ওপরে উঠে আসতেই চাকরণগাছের একজন বেরিয়ে এল দরজা খুলে। হায়দার স্বজনকে বলল, ‘সুটকেশ দুটো এখানেই রেখে দিন। কোনও চিন্তা নেই।’
ওরা যে ঘরে ঢুকল তার দুটো বড় জানালা। স্বজন লক্ষ করল দুজন লোক দুই জানলায় বাইরের দিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে আছে। ঘরের ভেতর থেকে তাদের সামনেটা দেখা না গেলেও ওদের হাতে যে আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র আছে তা বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। হায়দার সেই ঘরে দাঁড়ায়নি। ওদের নিয়ে সে সটান ভেতরে চলে এল। এটা একটা হল ঘর। গোটা চারেক মানুষ আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে। তারা হায়দারকে দেখে মাথা নাড়ল। বাঁদিকে দোতলায় যাওয়ার সিঁড়ি। সিঁড়ির নীচে একটা ঘরের দরজা খুলে হায়দার বলল, ‘এখানে আপনারা বিশ্রাম করুন।’
‘বিশ্রাম করব মানে?’ স্বজন অস্বস্তিতে পড়ল।
‘আপনারা যেখানে ছিলেন সেখানে বিপদে পড়তেন। এখানে আপনারা সম্পূর্ণ নিরাপদ।
‘আশ্চর্য! আপনি তখন বললেন আমাদের শহর থেকে বাইরে চলে যেতে হবে।’
‘ওকথা না বললে আপনাদের আনতে পারতাম না। আপনি ভেতরে যান, আমি একটু পরেই আসছি।’ হায়দারের ভঙ্গিতে এমন কিছু ছিল যে স্বজন অমান্য করতে পারল না। ওরা ভেতরে ঢোকামাত্রই হায়দার বলে গেল দরজাটা ভেজিয়ে। ঘরটা বড়। দুটো সিঙ্গল বিছানা, একটা টেবিল, টিভি এবং বাথরুমটা গায়েই। এক কোণে দুটো সোফা রয়েছে। পৃথা জিজ্ঞাসা করল, ‘কি ব্যাপার বলো তো?’
‘মনে হচ্ছে আমাদের অ্যারেস্ট করা হয়েছে।’
‘অ্যারেস্ট করলে এমন সাজানো ঘরে রাখবে কেন?’
‘সেটাও ঠিক। যে লোকটা নিয়ে এল সে পুলিশ অফিসার, বলল, রুটিন চেক আপ করবে, অথচ এখানে যারা অস্ত্র নিয়ে ঘুরছে তাদের শরীরে পুলিশের ইউনিফর্ম নেই। যাকগে, যা হবার হবে।’ দরজায় টোকা পড়ল। তারা জবাব দেবার আগেই দুটো সুটকেশ সেই চাকরগোছের লোকটা রেখে দিয়ে গেল।
জুতো পরেই স্বজন একটা বিছানায় শুয়ে পড়ল, ‘আমার ঘুম পাচ্ছে!’
‘এই অবস্থাতেও তোমার ঘুম আসছে?’ ফোঁস করে উঠল পৃথা।
‘এই অবস্থা মানে?’ কাত হল স্বজন, ‘অবস্থা তো চমৎকার। ভাল ঘর, আরামদায়ক বিছানা, এক কাপ কফি পেলে মন্দ হত না, যাকগে। বিনি পয়সায় তোফা আছি। শোনো, ঘুম থেকে উঠে তোমার সঙ্গে প্রেম করব। অতএব তুমিও চেষ্টা করো ঘুমিয়ে নিতে!’
‘পারো। তুমি সত্যি পারো।’ পৃথা কিছু করতে না পেরে বাথরুম কাম টয়লেটে চলে এল। ঝকমকে পরিষ্কার। টয়লেট পরিষ্কার দেখলে যাদের মন নরম হয় পৃথা তাদের একজন। সে আয়নায় নিজেকে দেখল, পেত্নির মতো দেখাচ্ছে। আয়না থেকে তার চোখ আর একটু ওপরে উঠতেই আলো দেখতে পেল। কাচ চুঁইয়ে আলো ঢুকছে ঘরে। তার মনে হল ওখানে চোখ রাখলে বাইরেটা দেখা যেত। তাদের বন্দি করে রাখা হয়েছে।
এদের নজর এড়িয়ে এখান থেকে বেরিয়ে যেতে হবেই। স্বজনের সে-ব্যাপারে কোনও হুঁসই নেই। দিব্যি বিছানায় শুয়ে পড়ল! ওপরে ওঠার কোনও সুযোগ নেই। বাইরেটা দেখতে হলে এঘর থেকে বেরুতে হবে। মুখে জল দিয়ে ধবধবে পরিষ্কার তোয়ালেটা চেপে ধরে আরাম পেল পৃথা। এবং সেই মুহূর্তে স্বজনের কথাটা মনে আসতেই নতুন করে ভাবনা এল। স্বজনকে নিশ্চয়ই সশস্ত্র বিপ্লবীরাই এখানে আমন্ত্রণ করে এনেছে। নইলে পুলিশ তাদের পেছনে এভাবে লাগবে কেন? সশস্ত্র বিপ্লব যারা করে তাদের স্বজনের মতো ডাক্তারের প্রয়োজন হবে কেন? স্বজন কি ব্যাপারটা জেনেও তাকে সব খুলে বলছে না?
এই সময় দরজায় শব্দ হল। সেই লোকটি ট্রে নিয়ে ঢুকল। তাতে কফি পট, কাপ ডিস এবং একটা প্লেটে অনেকগুলো বিস্কুট। পৃথা বেরিয়ে এল বাথরুম থেকে। টেবিলের ওপর ট্রে নামিয়ে লোকটা নীরবে চলে যাওয়ার সময় দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে গেল। পৃথা বুঝল দরজা নেহাতই ভেজানো, বাইরে থেকে আটকে দেওয়া হয়নি। সে দেখল স্বজন উপুড় হয়ে শুয়ে আছে। ইতিমধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছে কি না কে জানে। কফিপটের ঢাকনা খুলে সে গন্ধ নিল। চমৎকার। সে দূরে দাঁড়িয়েই ডাকল, ‘কফি দিয়ে গেছে, খাবে?’
সেইভাবে শুয়েই স্বজন জবাব দিল, ‘হুঁ।’
‘ঘুমাওনি তাহলে!’ পৃথা কফি বানাতে লাগল।
‘ঘুম আসছে না। অথচ টায়ার্ড লাগছে। হাঁটু দুটো কেমন শিরশির করছে।’ সে উঠে বসল। পৃথা কফির কাপ আর বিস্কুট এগিয়ে দিতেই স্বজন হাসল, ‘বাঃ, ব্যবস্থা তো চমৎকার। লাঞ্চটাও মন্দ হবে না মনে হচ্ছে।’
‘তোমার এখনও রসিকতা আসছে?’কফিতে চুমুক দিল পৃথা।
‘আচ্ছা, ভেবে ভেবে টেনশন বাড়িয়ে কোনও লাভ হবে? স্বজন কথা শেষ করামাত্র দরজায় টোকা পড়ল কিন্তু কেউ ঢুকে পড়ল না। স্বজন বলল, ‘কাম ইন।’
এবার হায়দারকে দেখা গেল। তার পরনে পুলিশের পোশাক নেই। লোকটাকে খুব স্বাভাবিক বলে মনে হল পৃথার। ঘরে ঢুকে সোফায় বসে হায়দার বলল, ‘আপনার সঙ্গে কথা বলা যাক।’
‘বলুন।’ স্বজন গম্ভীর হল।
‘আপনাকে এই শহরে আমরাই ইনভাইট করে এনেছি।’
‘আপনারা মানে, পুলিশ?’
‘না। বাইরে বেরিয়েছিলাম বলে বাধ্য হয়ে আমাকে ওই ইউনিফর্ম পড়তে হয়েছিল। বর্তমান শাসনব্যবস্থার যারা পরিবর্তন চায় আমি তাদের একজন।’
‘আশ্চর্য! আপনি তখন মিথ্যে বলেছিলেন?’
‘হ্যাঁ। না বললে আপনি আমার কথা তখন বুঝতে চাইতেন না।’
‘এখনও যে বুঝব এমন ভাবছেন কেন?’
এখন আপনাকে বোঝাবার অবকাশ পাব। টুরিস্ট লজে আপনাদের ওপর পুলিশ কড়া ওয়াচ রেখেছিল। যা হোক, আমরা ভেবেছিলাম যে টুরিস্ট লজে আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন। আগামীকাল যে উৎসব আছে তা ঘুরে দেখবেন এবং তার পরের দিন যে কাজের জন্যে এসেছেন সেটি করে ফিরে যেতে পারবেন। কিন্তু পুলিশ কমিশনার ভার্গিসের নজরে পড়ে সব গোলমাল করে ফেললেন আপনারা। ভার্গিস আপনাকে জেরা করেছিল?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু আমি কিছুই জানতাম না বলে উনি জানতে পারেননি।’
‘আমি জানতাম আপনি একা আসছেন। যা হোক, যে সমস্যায় আপনাদের পড়তে হল তার জন্যে আমরা দুঃখিত। এখানে আপনারা সম্পূর্ণ নিরাপদ।’
পৃথা কথা না বলে পারল না, ‘আপনারা সরকার পাল্টাতে চাইছেন। বোঝাই যাচ্ছে সরকার আপনাদের ওপর সন্তুষ্ট নয়। কিন্তু তাঁরা আপনাদের এভাবে থাকতে অ্যালাউ করছেন কি করে?’
হায়দার হাসল, ‘ম্যাডাম। যে গদি কেড়ে নিচ্ছে তাকে জামাই আদর করার মত বোকা শাসক পৃথিবীতে কোনও কালে ছিল কি? ওরা আমাদের সন্ধান পেলে ছিঁড়ে খাবে। আমাদের নেতার মাথার দাম এখন লক্ষ লক্ষ টাকা। এই অবস্থার মধ্যে আমাদের কাজ করে যেতে হচ্ছে।’
স্বজন বলল, ‘কিন্তু মনে হচ্ছে আপনারা প্রকাশ্যেই আছেন।’
‘না। আমাদের একটা আড়াল আছে যা ওদের সন্দেহের বাইরে।’
স্বজন কফির কাপ টেবিলে রাখতে উঠে দাঁড়াল, ‘আপনাদের সমস্যায় আমাকে টানলেন কেন?’
‘কারণ আমাদের নেতার আপনাকে প্রয়োজন।’
‘আমাকে?’
‘হাঁ। আপনার চিকিৎসাবিদ্যার জ্ঞানকে।’
‘আপনারা আমার চিকিৎসার ব্যাপারে সব জানেন?’
‘অবশ্যই।’
‘কিন্তু আমি যদি চিকিৎসার দায়িত্ব নিতে রাজি না হই?’
‘আমাদের সমস্যা হবে।’
‘তা নিয়ে আমার ভাবনার কোনও কারণ নেই।’
‘যেহেতু আমাদের আছে তাই শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালিয়ে যাব আপনাকে রাজি করাতে।’
‘আশ্চর্য! আমি রাজি না হলে— ।’
‘আপনাকে রাজি হতেই হবে।’
‘তার মানে আপনারা জোর করবেন?’
‘অনুরোধ ব্যর্থ হলে আমাদের সামনে অন্য পথ খোলা নেই।’
‘আপনি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন?’
হায়দার মাথা নাড়ল, ‘ডক্টর! এসব কথা আপনিই তুললেন। এখন আমাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে। মরিয়া না হয়ে কোনও উপায় নেই। বছরের পর বছর ধরে কয়েকজন স্বার্থসর্বস্ব মানুষ শাসনযন্ত্রকে দখল করে গরিব জনসাধারণকে ক্রীতদাস বানিয়ে শোষণ করে চলেছে। বাইরে থেকে এর চরিত্র কেউ বুঝবে না। আমরা এর প্রতিবাদ করে কোণঠাসা। মানুষের মনে আজ অসন্তোষ ধিকি ধিকি করে জ্বলছে। আমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতা ফিরিয়ে আনার সংগ্রাম। আপনার খারাপ লাগলেও এটা সত্যি।’
‘কিন্তু এর মধ্যে আমি আসছি কোত্থেকে?’
হায়দার পকেট থেকে একটা খাম বের করল। সেটা বিছানায় রেখে বলল, ‘আমাদের নেতার ছবি। ভাল করে স্টাডি করুন। উনি আজ সন্ধেবেলায় আপনার সঙ্গে কথা বলবেন। আর হ্যাঁ, আপনাদের যা প্রয়োজন সব এখানেই পাবেন। কিন্তু নিরাপত্তার কারণে আপনাদের বাইরে যেতে দিতে পারছি না। প্লিজ সেই চেষ্টা করবেন না।’
‘বুঝলাম, কিন্তু সেই ট্যাক্সিওয়ালাটা কিন্তু দেখে গেছে কোথায় নেমেছি আমরা।’
‘ও আমাদের লোক।’ হায়দার বেরিয়ে গেল দরজা ভেজিয়ে দিয়ে।
ওর চলে যাওয়া দেখল স্বজন। তারপর সোজা এগিয়ে গিয়ে দরজা খুলল। হলঘরটা চুপচাপ। সে বাইরে পা রাখতেই আড়াল থেকে একজন বেরিয়ে এল। তার হাতে আগ্নেয়াস্ত্র, ‘স্যার, আপনি ভেতরে যান। যদি কোনও প্রয়োজন থাকে তাহলে বেল বাজাবেন।’
স্বজন জবাব না দিয়ে পৃথাকে ডাকল, ‘পৃথা। চলে এসো। আমরা এখান থেকে বেরুব।’
পৃথা সাড়া দেবার আগেই লোকটা যে ভঙ্গিতে এগিয়ে এল তাতে স্বজন বাধ্য হল পেছনে হাঁটতে। প্রায় জোর করেই ওকে ভেতরে ঢুকিয়ে দরজা বন্ধ করে দিল লোকটা। স্বজন দেখল এবার বাইরে থেকে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
কাণ্ডটা চুপচাপ দেখছিল পৃথা। এবার বলল, ‘তুমি পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া বাধালে।’
‘চমৎকার। এরা অন্যায়ভাবে আমাদের আটকে রেখেছে সেটা দেখছ না?’
‘দেখেছি। কিন্তু বুদ্ধিমানরা এমনভাবে ঝগড়া বাধায় না।’
স্বজন রাগী ভঙ্গিতে ফিরে এল বিছানায়, ‘আমি করব না। ওরা যা বলবে তা করতে। হবে এমন দাসখত লিখে দিইনি আসার আগে। আর ওরা জানে না এটা একটা শ্রমিকের কাজ নয় যে কেউ করতে বাধ্য করতে পারে, অপারেশন টেবিলে গিয়ে আমি যা খুশি তাই করতে পারি!’
‘সব ঠিক। এখন মাথাটাকে একটু ঠাণ্ডা করো।’ পৃথা কথাগুলো বলে এগিয়ে গেল টিভির দিকে। বোতাম টিপে সেটাকে চালু করল। কোনও বিখ্যাত মানুষ মারা গিয়েছেন, টিভিতে তাঁর সম্পর্কে বলা হচ্ছে। বাবু বসন্তলাল কত বড় সমাজসেবী ছিলেন তার বর্ণনা দিয়ে ঘোষক বললেন, ‘তাঁর প্রিয় জায়গা ছিল পাহাড়ের বুকে নিজস্ব একটি বাংলো। সেখানে যেতে তিনি খুব ভালবাসতেন। তাই সেই বাংলায় যখন তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তখন আশা করব তাঁর আত্মা শান্তি পাবে। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বাবু বসন্তলাল মরণের ওপারে চলে গেছেন আমাদের ফেলে রেখে।’ বাবু বসন্তলালের বাংলোর ছবি ফুটে উঠতেই স্বজন চেঁচিয়ে উঠল, ‘আরে! কি বলছে! ওই বাংলোতেই আমরা গিয়েছিলাম। লোকটাকে খুন করা হয়েছিল!’
কোনও খবর নেই। শহর এবং শহরের বাইরে সর্বত্র মাইনে করা লোক ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তবু এই অবস্থা। বাবু বসন্তলালের সৎকারের ব্যবস্থা করে আসার পরই প্রথম খবরটা এল। ওই ডাক্তার আর তার বউকে চোখে রাখার দায়িত্ব যার ওপর দেওয়া হয়েছিল সে জানাচ্ছে, এক পুলিশ অফিসার ট্যাক্সিতে তুলে ওদের কোথাও নিয়ে গিয়েছে। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে ভার্গিসের সামনে যাবতীয় অ্যাসিস্টেন্ট কমিশনাররা গম্ভীর মুখে বসে ছিল। ভার্গিসের হাতের চুরুটটা রিভলভারের মত ধরা। ঘরে ওই মুহূর্তে কোনও শব্দ নেই।
ভার্গিস প্রথমজনের দিকে তাকালেন, ‘অফিসারটা কে?’
‘আমি বাজি রেখে বলতে পারি আমাদের বাহিনীর কেউ নয়।’ লোকটা মিনমিন করল।
‘তাহলে কে?’
‘স্যার, এটা হায়দারের কাজ হতে পারে।’
‘বাঃ। চমৎকার! এরপর হায়দার এই চেয়ারে বসে আপনাদের অর্ডার করবে এবং আপনারা তা মাথা নিচু করে শুনে যাবেন। আকাশলালকে ধরা যাচ্ছে না কারণ সে রাস্তায় বের হচ্ছে না। এই কথাই তো এতদিন বলে আসছিলেন। হোয়াট অ্যাবাউট দিজ পিপ্ল? হায়দার, ডেভিড? এরা তো নাকের ডগা দিয়ে সব কাজ হাসিল করে চলে যাচ্ছে। ওয়ার্থলেশ। আমার মনে ঠিকই সন্দেহ জেগেছিল, এই ডাক্তার ছোকরাটা ওদের সঙ্গে জড়িত। আকাশলালের চিকিৎসার জন্যে ওকে নিয়ে আসা হয়েছে। স্যাডো করতে পারলে ঠিক পৌঁছে যেতাম।’ হতাশ ভঙ্গিতে টেবিলে চুরুট রাখলেন ভার্গিস।
একজন মিনমিন করল, ‘ডাক্তার সম্পর্কে খোঁজ নেব স্যার?’
‘অতীত ঘেঁটে জানতে পারবেন ওর পড়াশুনা কিরকম দারুণ ছিল! গিয়ে দেখুন, ওর ঠিকানাটাও টুরিস্ট লজের রেজিস্টারে নোট করা নেই। এখানে যখন ওকে ধরে নিয়ে আসা হয়েছিল তখন নামধাম এন্ট্রি করা হয়েছে?’
‘না স্যার। মানে আপনার সঙ্গে অনেক রাত্রে এসেছিল। ভোর হবার সঙ্গে সঙ্গে আপনি ওকে এই ঘরে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। মর্নিং ক্লার্ক ডিউটিতে জয়েন করে ওকে পায়নি।’
আফশোসে তাঁর বিশাল মুখটা কয়েকবার দুপাশে নাড়লেন ভার্গিস। তারপর স্থির হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সোম সম্পর্কে কোনও রিপোর্ট আছে?’
‘আছে স্যার।’ প্রথমজন এবার সোজা হয়ে বসল।
‘অ্যারেস্ট করা হয়েছে?’ চোখ ছোট করলেন ভার্গিস।
‘অল্পের জন্যে করা যায়নি। কিন্তু আজ বিকলের মধ্যে— !’
‘এই আপনার রিপোট?’ চিৎকার করে উঠলেন ভার্গিস।
‘না স্যার।’ লোকটি ঢোক গিলল, ‘কাল রাত্রে শহরের বাইরে চেকপোস্ট থেকে এক মাইল দূরের একটা গ্রামে সোম আশ্রয়ের জন্যে গিয়েছিল। অত রাত্রে গ্রামের লোকজন দরজা খোলেনি প্রথমে। শেষে কেউ কেউ বেরিয়ে এলে সোম নিজেকে পুলিশ অফিসার বলে পরিচয় দেয়। ওর কপাল খারাপ, পুলিশ বলেই হয়তো কেউ ওকে আশ্রয় দিতে চায়নি। গ্রামের লোকজন বলেছে সেই অন্ধকারেই সোম দক্ষিণ দিকে হাঁটতে শুরু করেছিল। দক্ষিণ দিকে তিন তিনটে গ্রাম আছে। আমাদের লোকজন সেই গ্রামগুলোতে সার্চ করছে এখন। নির্ঘাত বিকেলের মধ্যেই সোম ধরা পড়ে যাবে।’
‘পুলিশ বলে আশ্রয় দিল না! কথাটা শুনতে আপনার খুব ভাল লাগল? ওর গাড়ি?’ গাড়িটাকে খাদে পাওয়া গিয়েছে। একটাই ধাঁধা। গাড়িটা বাবু বসন্তলালের বাংলো ছারিয়ে নীচে যাওয়ার রাস্তা থেকে নীচে পড়েছে। অথচ সোমকে দেখা গেছে উল্টো দিকে চেকপোস্টের কাছের গ্রামে। এতটা রাস্তা নোম কি করে ফিরে এল— ?’
‘সেটা যদি বুঝতে পারতেন তাহলে এই চেয়ারে আমি বসে থাকতাম না। শুনুন, আকাশলাল এবং তার সঙ্গীরা ছিল, এখন তাদের সঙ্গে একটা ডাক্তার জুটেছে। আমার ধারণা ছিল আকাশলাল শহরের বাইরে কোনও গ্রামে বা পাহাড়ে লুকিয়ে আছে। ডাক্তার এখানে আসার পর আমি নিঃসন্দেহ, সে এখানেই আছে। এই এতগুলো লোক আমাদের নাকের ডগায় আছে অথচ আমরা তাদের খুঁজে বের করতে পারছি না। নো। এটা আর বেশিদিন চলতে পারে না। আগামীকালের মধ্যে এদের খুঁজে পেতেই হবে। নইলে আপনাদের সম্পর্কে বোর্ড কি সিদ্ধান্ত নেবে তা আপনারা কল্পনা করতে পারছেন না।’ ভার্গিস মিটিং ভেঙে দিলেন।
সবাই যখন গম্ভীর মুখে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল তখন তিনি চুরুট ধরালেন সময় নিয়ে। তারপর চেয়ার ঘুরিয়ে ডানদিকের দেওয়ালের দিকে তাকালেন। সেখানে বিশাল ম্যাপে এই শহরের প্রতিটি রাস্তা আঁকা আছে। চুরুট খেতে খেতে ভার্গিস ম্যাপটার ওপর চোখ বোলাতে বোলাতে সোজা হয়ে বসলেন। শহরের ঘনবসতি এলাকায় ওরা লুকিয়ে থাকবে এমন তো নাও হতে পারে। এতদিন তাঁর কেবলই মনে হত জনসাধারণের সঙ্গে মিশে থেকে এরা অপারেশন চালাচ্ছে। যদি উল্টোটা হয়। শহরের পশ্চিমাঞ্চলের দিকে নজর রাখলেন তিনি। মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কেউ ওখানে থাকার কথা ভাবতেই পারে না। বিশাল বাড়ি, বাগান, শান্ত নির্জন এলাকা। এদের সুরক্ষার জন্যে পুলিশ দিনরাত বড় রাস্তাগুলোতে টহল দেয়, কিন্তু বাড়িগুলোর ভেতর কি হচ্ছে তা জানার সুযোগ হয়নি। বড়লোকদের আস্তানা বলে ধরেই নেওয়া হয়েছিল, আকাশলালদের সঙ্গে কোনও সংস্রব নেই। এইসব বাড়ি সার্চ করা ঝুঁকির কাজ। কিন্তু মনে যে সন্দেহটা এসেছে তা দূর করতে সেটা করা দরকার। অবশ্য একাই তিনি এত বড় ব্যাপারে জড়াবেন না। মিনিস্টারকে জানাতে হবে। টেলিফোন তুললেন ভার্গিস।
‘স্যার। আমি আপনাকে বলেছিলাম কাল সকালে আমি লোকটাকে মুঠোয় পাব। কিন্তু অতক্ষণ দেরি করার প্রয়োজন নেই, যদি আপনার অনুমতি পাওয়া যায়।’
‘কিরকম?’
‘আমাদের ওয়েস্ট সাইডের বাড়িগুলো সার্চ করার অনুমতি চাইছি স্যার।’
‘আপনি সি পি, এটা পুলিশের আওতায় পড়ে, তাই না?’
‘হ্যাঁ। কিন্তু আপনি যদি আমাকে মর্যাল সাপোর্ট করেন তাহলে— ।’
‘ভার্গিস। বাবু বসন্তলালের পোস্টমর্টেম হয়নি কেন বোর্ড জানতে চেয়েছিল।’
‘স্যার!’ গলা শুকিয়ে গেল ভার্গিসের, ‘ম্যা-ডা-ম।’
বারংবার মর্যাল সাপোর্ট করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। কার নির্দেশে কেন কি করা হয়েছে তা আমাদের জানার কথা নয়, শেষ পরিণতির জন্যে দায়ী করব পুলিশ কমিশনারকে!’ লাইনটা কেটে গেল। ভার্গিসের দুই আঙুলে ধরা চুরুট থেকে ক্ষীণ ধোঁয়া পাক খাচ্ছিল শূন্যে।