॥ ১১ ॥
সকালে চা খাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শশাঙ্কবাবু আমাদের ঘরে এলেন দেখে বেশ একটু অবাক লাগল। ফেলুদা ভদ্রলোককে বেশ খাতির-টাতির করে বসতে বলে বলল, ‘আপনার সঙ্গে আর আলাপই হল না ঠিক করে। মহীতোষবাবুর বন্ধু হিসেবে আপনারও নিশ্চয়ই অনেক রকম অভিজ্ঞতা হয়েছে।’
শশাঙ্কবাবু টেবিলের সামনে চেয়ারটায় বসে বললেন, ‘অভিজ্ঞতার শুরু কি সেই আজকে? মহীর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব পঞ্চাশ বছরের উপর। সেই ইস্কুল থেকে।’
‘আপনাকে একটা প্রশ্ন করতে পারি?’
‘মহীতাষ সম্পর্কে?’
‘না। তড়িৎবাবু সম্পর্কে।’
‘বলুন।’
‘আপনার মতে উনি কেমন লোক ছিলেন?’
‘চমৎকার। অত্যন্ত বুদ্ধিমান, অত্যন্ত ধীর প্রকৃতির যুবক ছিল তড়িৎ।’
‘আর কাজের দিক দিয়ে?’
‘অসাধারণ।’
‘আমারও তাই ধারণা…’
এবার শশাঙ্কবাবু ফেলুদার দিকে সোজা দৃষ্টি দিয়ে বললেন, ‘আমি আপনাকে একটা অনুরোধ করতে চাই।’
‘বলুন।’
শশাঙ্কবাবুকে এই প্রথম সিগারেট খেতে দেখলাম। ফেলুদারই দেওয়া একটা চারমিনার ধরিয়ে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘এই তিন দিনে আপনার অনেক রকম অভিজ্ঞতা হল। আপনি নিজেও বুদ্ধিমান, তাই সাধারণ লোকের চেয়ে নিশ্চয়ই অনেক বেশি দেখেছেন, শুনেছেন, বুঝেছেন। আজ হয়তো আপনার এখানে শেষ দিন। আজ কী ঘটবে তা জানি না। যাই ঘটুক না কেন, এই বিশেষ জায়গার এই বিশেষ জমিদার পরিবারটি সম্বন্ধে আপনি যা জেনে গেলেন, সেটা যদি আপনি গোপন রাখতে পারেন, এবং আপনার এই বন্ধুটিকেও গোপন রাখতে বলেন, তা হলে আমি অত্যন্ত কৃতজ্ঞ বোধ করব। আমি জানি মহীতোষও এটাই চাইবে। বাংলাদেশের প্রায় যে কোনও জমিদার বংশের ইতিহাস ঘাঁটলেই অনেক সব অদ্ভুত অপ্রিয় ঘটনা বেরিয়ে পড়বে সে তো আপনি জানেন। সে রকম সিংহরায় বংশের ইতিহাসেও অনেক অপ্রিয় তথ্য লুকিয়ে আছে সেটা বলাই বাহুল্য।’
ফেলুদা বলল, ‘শশাঙ্কবাবু, আমি তিনদিন ধরে মহীতোষবাবুর আতিথেয়তা ভোগ করছি। সে কারণে আমি তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। আমি কলকাতায় গিয়ে সিংহরায় পরিবার সম্পর্কে বদনাম রটাব, এটা কখনও হবে না। এ আমি কথা দিতে পারি।’
এর পর একটা প্রশ্ন ফেলুদা বোধহয় না করে পারল না।
‘দেবতোষবাবুর ঘরের দরজা কাল থেকে বন্ধ দেখছি। এ ব্যাপারে আপনি কোনও আলোকপাত করতে পারেন কি?’
শশাঙ্কবাবু একটা অদ্ভুত দৃষ্টিতে ফেলুদার দিকে চাইলেন। তারপর বললেন, ‘আমার বিশ্বাস আজকের দিনটা ফুরোবার আগে আপনিই পারবেন।’
‘পুলিশ কি তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে?’
‘উঁহু।’
‘সে কী! হঠাৎ বন্ধ করার কারণটা কী?’
‘যার উপর সন্দেহটা পড়ছে, মহীতোষ চায় না যে পুলিশ তাকে কোনওরকমভাবে বিব্রত করে।’
‘আপনি দেবতোষবাবুর কথা বলছেন?’
‘আর কে আছে বলুন?’
‘কিন্তু দেবতোষবাবু যদি খুন করেও থাকেন, তিনি তো আর অভিযুক্ত হবেন না, কারণ তাঁর তো মাথা খারাপ।’
‘তা হলেও ব্যাপারটা প্রচার হয়ে পড়বে তো! মহীতোষ সেটাও চায় না।’
‘সিংহরায় বংশের মর্যাদা রক্ষার জন্য?’
‘ধরুন যদি তাই হয়!’— বলে শশাঙ্কবাবু উঠে পড়লেন।
সাড়ে আটটার মধ্যে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। আজও প্রথম দিনের মতো দুটো জিপ। একটায় ফেলুদা, লালমোহনবাবু আর আমি, অন্যটায় মহীতোষবাবু, শশাঙ্কবাবু, মাধবলাল আর মহীতোষবাবুর একজন বেয়ারা। আজ আমাদের সঙ্গে তিনটে বন্দুক। একটা নিয়েছে মাধবলাল, একটা মহীতোষবাবু, আর একটা— ফেলুদা! বন্দুক নেবার ইচ্ছেটা ফেলুদাই প্রকাশ করল। ফেলুদার রিভলভার চালানোর কথা মাধবলালই মহীতোষবাবুকে খুব ফলাও করে বলেছিল, তাই বন্দুক চাইতে মহীতোষবাবু আর আপত্তি করলেন না। বললেন, ‘আপনার খুশিমতো একটা বেছে নিন। বাঘের জন্যই যদি হয় তো থ্রি-সেভেন-ফাইভটা নিতে পারেন।’
ওসব নম্বর-টম্বর আমি বুঝি না, তবে বেশ জবরদস্ত রাইফেল সেটা দেখে বুঝতে পারছি।
লালমোহনবাবুর মধ্যেও একটা চাপা উত্তেজনার ভাব, কারণ ফেলুদা তার হাতে আদিত্যনারায়ণের তলোয়ারটা ধরিয়ে দিয়েছে। দেবার সময় বলল, ‘একদম হাতছাড়া করবেন না। আজকের নাটকে ওটার একটা বিশেষ ভূমিকা আছে।’
ভোরে যখন উঠেছিলাম তখন আকাশ মোটামুটি পরিষ্কার ছিল, কিন্তু এখন আবার মেঘ করে এসেছে। কালকের বৃষ্টির ফলে রাস্তায় কাদা হয়েছিল, তাই আমাদের পৌঁছতে খানিকটা বেশি সময় লাগল। কাটা ঠাকুরানীর মন্দির একেবারে জঙ্গলের ভিতরে, জিপ অত দূর যাবে না। কাল যেখানে নেমেছিলাম আজ সেখান থেকে আরও প্রায় আধ মাইল ভিতরে গিয়ে আমাদের জিপ থামল। মাধবলাল রাস্তা চেনে; সে বলল, ‘সামনে একটা নালা পেরিয়ে মিনিট পনেরো হাঁটলেই আমরা মন্দিরে পৌঁছে যাব।’
অল্প অল্প মেঘের গর্জন আর গাছের পাতা-কাঁপানো ঝিরঝিরে বাতাসের মধ্যে আমাদের অভিযান শুরু হল। গাড়ি থেকে নামবার আগেই ফেলুদা রাইফেলে টোটা ভরে নিয়েছে। মহীতোষবাবু নিজে তার বন্দুকটা নেননি; ওটা রয়েছে বেয়ারা পর্বত সিং-এর হাতে। পর্বত সিং নাকি সব সময়ে মহীতোষবাবুর সঙ্গে শিকারে গেছে। বেঁটেখাটো গাট্টাগোট্টা চেহারা, দেখলেই বোঝা যায় গায়ে অসম্ভব জোর।
আজ খানিক দূর হাঁটার পরই দূরে একপাল হরিণ দেখে মনটা নেচে ওঠার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বুকটা ধড়াস করে উঠল। এই জঙ্গলের মধ্যেই কোথাও হয়তো সেই মানুষখেকো বাঘটা রয়েছে। এমনিতে বাঘ নাকি শিকারের খোঁজে রোজ অক্লেশে পঁচিশ-তিরিশ মাইল হেঁটে এ বন থেকে ও বন চলে যায়। কিন্তু এ বাঘ যদি জখমি বাঘ হয়ে থাকে, তা হলে হয়তো তার পক্ষে বেশি দূর হাঁটা সম্ভবই না। আর এমনিতেই জঙ্গল আর আগের মতো বড় আর ছড়ানো নেই। গত বিশ-পঁচিশ বছরে মাইলের পর মাইল গাছ কেটে ফেলে সেখান চাষের জমি হয়েছে, চা বাগান হয়েছে, লোকের বসতি হয়েছে। কাজেই বাঘ যে খুব দূরে চলে যাবে সে সম্ভাবনা কম। দিনের বেলা বাঘ সাধারণত বেরোয় না এটা ঠিক, কিন্তু মেঘলা দিনে নাকি বেরোন অসম্ভব না। এ ব্যাপারটা কালকেই ফেলুদা আমাকে বলেছে।
যে নালাটা আজ আমাদের পেরোতে হল সেটা কালকেও পেরিয়েছি। কাল প্রায় শুকনো ছিল, আজ কুলকুল করে জল বইছে। নালার ধারে বালি, তাতে জানোয়ারের পায়ের ছাপ। বাঘ নেই, তবে হরিণ, শুয়োর আর হায়েনার পায়ের ছাপ মাধবলাল চিনিয়ে দিল। আমরা নালা পেরিয়ে, ওপারের বনের মধ্যে ঢুকলাম। একটা কাঠঠোকরা মাঝে মাঝে ডেকে উঠছে, দূর থেকে একটা ময়ূরের ডাক শুনতে পাচ্ছি, আর কয়েকটা ঝিঁঝি ক্রমাগত ডেকে চলেছে। পায়ের সামনে ঘাসের উপর মাঝে মাঝে সড়াৎ সড়াৎ শব্দ পাচ্ছি, আর বুঝতে পারছি যে গিরগিটির দল মানুষের পায়ের তলায় পিষে যাবার ভয়ে এক ঝোপড়া থেকে আরেক ঝোপড়ার পিছনে গিয়ে আশ্রয় নিচ্ছে।
ক্রমে আমরা আমাদের চেনা জায়গায় পৌঁছে গেলাম। কাল এখানে এসেছিলাম অন্য পথ দিয়ে। এই যে সেই তলোয়ারের জায়গা। আমাদের দলপতি মাধবলাল অত্যন্ত সাবধানে শব্দ না করে পা ফেলে এগিয়ে চলেছে, আর বাকি সকলে তার দেখাদেখি সেই ভাবেই চলার চেষ্টা করছি। মাটি এমনিতেই ভিজে নরম হয়ে আছে, শুকনো পাতা প্রায় নেই বললেই চলে, তাই সাতজন লোক একসঙ্গে হাঁটা সত্ত্বেও প্রায় কোনও শব্দই হচ্ছিল না।
সামনের গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ইটের পাঁজা দেখা যাচ্ছে। কাটা ঠাকুরানীর ফাটা মন্দির।
একজনও একটা কথা না বলে একটুও শব্দ না করে মন্দিরের সামনে পৌঁছে গেলাম। সকলে থামল। সেদিন শুধু ফোকলা ফকিরের গাছ, অর্জুন গাছ আর জোড়া তাল গাছের দিকে লক্ষ ছিল বলে আশেপাশে যে আরও কতরকম গাছ আছে সেটা খেয়াল করিনি। সেই সব গাছের ফাঁক দিয়ে ঝিরঝির করে বাতাস আসছে, আর আসছে নালার কুলকুল শব্দ। মন্দিরের পিছন দিকেই নালা। ওই নালায় জল খেতে আসে জন্তু জানোয়ার। বাঘও আসে। মানুষখেকোও।
ফেলুদা অর্জুন আর জোড়া তালের মাঝখানে গর্তটার দিকে এগিয়ে গেল। মহীতোষবাবুও গেলেন পিছন পিছন। আজ গর্তে আরও বেশি জল। ফেলুদা সেদিকে আঙুল দেখিয়ে নিস্তব্ধতা ভেঙে দিয়ে প্রথম কথা বলল।
‘এই গর্তে ছিল আদিত্যনারায়ণের গুপ্তধন।’
‘কিন্তু,…সেটা গেল কোথায়?’ চাপা গলায় জিগ্যেস করলেন মহীতোষবাবু।
‘কাছাকাছির মধ্যেই আছে, যদি না কালকের মধ্যে কেউ সেটা সরিয়ে থাকে।’
মহীতোষবাবুর চোখ দুটো জ্বলজ্বল করে উঠল।
‘আছে? আপনি সত্যি বলছেন আছে?’
‘আপনি জানেন সে গুপ্তধন কী জিনিস?’ ফেলুদা পাল্টা প্রশ্ন করল।
উত্তেজনায় মহীতোষবাবুর কপালের শিরা ফুলে উঠেছে, চোখমুখ লাল হয়ে গেছে। বললেন, ‘না জানলেও অনুমান করতে পারি। আমার পূর্বপুরুষ যশোবন্ত সিংহরায় ছিলেন কোচবিহারের রাজা নরনারায়ণ ভূপের সেনাধ্যক্ষ। যশোবন্তের উপার্জিত টাকা—নরনারায়ণের নিজের টাঁকশালের টাকা—যার নাম ছিল নারায়ণী টাকা— সেই টাকা ছিল আমাদের বাড়িতে। এক হাজারের উপর রৌপ্যমুদ্রা, চারশো বছরের পুরনো। আদিত্যনারায়ণ যখন এ টাকা লুকিয়ে রাখেন, তখন তাঁর মাথা খারাপ হতে শুরু করেছে— ষাট বছর বয়সে ছেলেমানুষি দুষ্টু-বুদ্ধি খেলছে। তিনি মারা যাবার পর সে টাকা আর আর পাওয়া যায়নি। এতদিনে এই সংকেত তার সন্ধান দিয়েছে। ও টাকা আমার চাই মিস্টার মিত্তির, ওটা হারালে চলবে না।’
ফেলুদা মহীতোষবাবুর দিক থেকে ঘুরে মন্দিরের দিকে এগোচ্ছে। মন্দিরের কাছাকাছি পৌঁছে হঠাৎ আমার দিকে ফিরে বলল, ‘তোপসে, বন্দুকটা ধর তো। মন্দিরের ভিতর রিভলভারই কাজ দেবে।’
আমার হাত কাঁপতে শুরু করেছে। কোনওরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বন্দুকটা হাতে নিলাম। জিনিসটা যে এত অসম্ভব রকম ভারী সেটা দেখে বুঝতে পারিনি।
ফেলুদা মন্দিরের ভাঙা দরজা দিয়ে অন্ধকারের ভিতর ঢুকল। চৌকাঠ পেরোনোর সময় লক্ষ করলাম, ও পকেটে হাত ঢোকাল।
পাঁচ গোনার মধ্যেই পর পর দু’ বার রিভলভারের আওয়াজে আমার গায়ের লোম খাড়া হয়ে গেল। তারপর মন্দিরের ভিতর থেকে ফেলুদার কথা শোনা গেল।
‘মহীতোষবাবু, আপনার লোকটিকে একবার পাঠান তো।’
পর্বত সিং বন্দুকটা তার মনিবের হাতে দিয়ে মন্দিরের ভিতরে ঢুকে এক মিনিটের মধ্যেই একটা সর্বাঙ্গে কাদা-মাখা পিতলের ঘড়া নিয়ে বেরিয়ে এল, তার পিছনে ফেলুদা। মহীতোষবাবু পর্বত সিং-এর দিকে ছুটে গেলেন। ফেলুদা বলল, ‘কেউটের যে রৌপ্যমুদ্রার প্রতি মোহ থাকতে পারে এটা ভাবিনি। কালই শিসের শব্দ পেয়েছিলাম, আজ দেখি ঘড়াটাকে সস্নেহে আলিঙ্গন করে পড়ে আছেন বাবাজি।’
মহীতোষবাবু হাত থেকে বন্দুক ফেলে দিয়ে সেই ঘড়াটার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়ে তার ভিতর থেকে সবে একমুঠো রুপোর টাকা বার করেছেন, এমন সময় একটা কাকর হরিণ ডেকে উঠল। আর তার ঠিক পরেই এক সঙ্গে অনেকগুলো বাঁদর আশপাশের গাছ থেকে চেঁচাতে আরম্ভ করল।
তারপরে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে এতগুলো ঘটনা একসঙ্গে ঘটে গেল যে ভাবতেও মন ধাঁধিয়ে যায়। প্রথমে মহীতোষবাবুর মধ্যে একটা আশ্চর্য পরিবর্তন দেখা গেল। এক মুহূর্ত আগে যিনি একসঙ্গে এতগুলো রুপোর টাকা দেখে আহ্লাদে আটখানা হয়ে গিয়েছিলেন, তিনি হাত থেকে সেই টাকা ফেলে দিয়ে ইলেকট্রিক শক্ খাওয়ার মতো করে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে এক লাফে তিন হাত পিছিয়ে গেলেন। আমরা সবাই যে যেখানে আছি সেখানেই পাথরের মতো দাঁড়িয়ে পড়েছি। ফেলুদাই প্রথমে মুখ খুলল। কিন্তু তার গলার স্বর চাপা ফিসফিসে— ‘তোপসে, গাছে ওঠ। লালমোহনবাবু, আপনিও।’
আমার পাশেই ফোকলা ফকিরের গাছ। ফেলুদার হাতে বন্দুকটা চালান করে দিয়ে ফোকলা ফোকরে পা দিয়ে উঠে হাত বাড়িয়ে একটা বড় ডাল ধরে দশ সেকেন্ডের মধ্যে আমি মাটি থেকে দশ হাত উপরে উঠে গেলাম। তার পরেই লালমোহনবাবু তার হাতের তলোয়ারটা আমার হাতে চালান দিয়ে একটা তাজ্জব ব্যাপার করলেন। অবিশ্যি উনি পরে বলেছিলেন যে ছেলেবেলায় আমতায় থাকতে নাকি অনেক গাছে চড়েছেন, কিন্তু চল্লিশ বছর বয়সেও যে তিনি এক নিমেষে আমার চেয়ে উপরের একটা ডালে উঠে পড়তে পারবেন এটা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি।
বাকি ঘটনাগুলো আমি উপর থেকেই দেখেছিলাম। লালমোহনবাবু কিছুক্ষণ দেখে আর দেখতে পারেননি, কারণ তিনি অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলেন; তবে এমন আশ্চর্যভাবে তাঁর হাত-পা গাছের চওড়া ডালের দু দিকে ঝুলে ছিল যে তিনি মাটিতে পড়ে যাননি।
চারদিক থেকে বিশেষ বিশেষ জানোয়ার আর পাখির ডাক শুনেই বোঝা গিয়েছিল যে কাছাকাছির মধ্যে বাঘ এসে পড়েছে। অবিশ্যি বাঘ এদিকে আসার আর একটা কারণ ছিল সেটা পরে জেনেছিলাম। মোট কথা বাঘ আসছে বুঝেই ফেলুদা আমাদের গাছে চড়তে বলেছিল।
সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার করলেন মহীতোষবাবু। তার এই চেহারা যে কোনওদিন দেখব সেটা ভাবিনি। অবাক হয়ে দেখলাম ভদ্রলোক ফেলুদার দিকে ঘুরে দাঁতে দাঁত চেপে বলছেন, ‘মিস্টার মিত্তির, আপনার যদি প্রাণের মায়া থাকে তো চলে যান।’
‘কোথায় যাব মহীতোষবাবু?’
দুজনের হাতেই বন্দুক। মহীতোষবাবুরটা উপর দিকে উঠছে ফেলুদার দিকে।
‘বলছি যান!’ আবার বললেন মহীতোষবাবু। ‘জিপ রয়েছে ওই দিকে। আপনি চলে যান। আমি আদেশ করছি, আপনি—’
মহীতোষবাবুর কথা শেষ হল না। একটা বাঘের গর্জনে সমস্ত বনটা কেঁপে উঠেছে। শুনলে মনে হবে না যে একটা বাঘ, মনে হবে পঞ্চাশটা হিংস্র জানোয়ার একসঙ্গে গর্জন করে উঠেছে।
এবার গাছের উপর থেকে দেখতে পেলাম— মন্দিরের পিছনে আরও কতগুলো অর্জুন গাছের সাদা ডালের ফাঁক দিয়ে একটা গনগনে আগুনের মতো চলন্ত রং। সেটা লম্বা ঘাসের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে একটা প্রকাণ্ড ডোরাকাটা বাঘের চেহারা নিল। বাঘটা এগিয়ে আসছে কাটা ঠাকুরানীর ডান পাশ দিয়ে, আমাদের এই খোলা জায়গাটার দিকে।
মহীতোষবাবুর হাতের বন্দুকটা নীচে নেমে এসেছে। একে ভারী বন্দুক তার উপর ওঁর হাত থর থর করে কাঁপছে।
এদিকে ফেলুদার বন্দুকের নলটা উপর দিকে উঠছে। আরও তিনজন লোক আছে আমাদের সঙ্গে— শশাঙ্কবাবু, মাধবলাল আর পর্বত সিং। পর্বত সিং এইমাত্র একটা প্রকাণ্ড লাফ দিয়ে পালাল। অন্য দুজন কী করছে জানি না, কারণ আমার চোখ একবার বাঘ আর একবার ফেলুদার দিকে যাচ্ছে।
এখন বাঘটা মন্দিরের পাশে এসে পড়েছে।
বাঘের মুখটা ফাঁক হল। তার দাঁতগুলো দেখা যাচ্ছে। এতগুলো শিকার এক সঙ্গে চোখের সামনে সে নিশ্চয়ই দেখেনি কখনও।
বাঘটা থেমে গেছে। তার শরীরটা একটু নিচু হল। একটা লাফ মারার আগের অবস্থা, যাকে ওত পাতা বলে। এইভাবে লাফ দিয়ে প’ড়ে বাঘ একটা মোষকেও—
দুম! দুম!
প্রায় একই সঙ্গে দুটো বন্দুক গর্জিয়ে উঠল। আমার কান ঝালাপালা। দৃষ্টিটাও যেন এক মুহূর্তের জন্য ঝাপসা হয়ে গেল। তারই মধ্যে দেখলাম বাঘটা লাফ দিয়ে শূন্যপথে একটা অদৃশ্য বাধার সামনে পড়ে উল্টোদিকে একটা ডিগবাজি খেয়ে একেবারে গুপ্তধনের কলসীটার ঠিক পাশে আছড়ে পড়ল, তার ল্যাজের ঝাপটায় কলসীটা প্রচণ্ড খটাং শব্দে ছিটকে গড়িয়ে গিয়ে তার থেকে চারশো বছরের পুরনো নারায়ণী টাকা ছড়িয়ে পড়ল।
ফেলুদা বন্দুকটা নামিয়ে নিয়েছে। মাধবলাল বলল, ‘উয়ো মর গিয়া।’
‘কার গুলিতে মরল বলুন তো?’
প্রশ্নটা করল ফেলুদা। মহীতোষবাবুর উত্তর দেবার ক্ষমতা নেই। তিনি মাথা হেঁট করে মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে বসে আছেন। তার হাত থেকে ছিনিয়ে নেওয়া বন্দুকটা এখন শশাঙ্কবাবুর হাতে।
শশাঙ্কবাবু বাঘটার দিকে এগিয়ে গেলেন। তারপর বললেন, ‘এসে দেখুন মিস্টার মিত্তির। একটা গুলি গেছে চোয়ালের তলা দিয়ে একেবারে মাথার খুলি ভেদ করে; আরেকটা গেছে কানের পাশ দিয়ে। দুটোর যে কোনওটাতেই বাঘটা মরে থাকতে পারে।’