একাদশ পরিচ্ছেদ
শত্রুতা এড়ানোর উপায়
থিয়োডোর রুজভেল্ট যখন হোয়াইট হাউসে ছিলেন, তিনি স্বীকার করেছিলেন যে তিনি যদি শতকরা ৭৫ ভাগ ঠিক হতেন তাহলে আশাতীত কিছু করতে পেরেছেন বলেই ভাবতেন। বিংশ শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠতম ব্যক্তিত্বপূর্ণ মানুষের কাছে যদি এটাই সত্য হয়, তাহলে আমি বা আপনি কি পারবো আশা রাখি?
আপনি যদি একশবারের মধ্যে ৫৫ বার ভুল না হয়ে ঠিক হতে পারেন তাহলে আপনি ওয়ালস্ট্রীটে গিয়ে রোজ দশ লক্ষ ডলার আয় করতে পারেন, তার সঙ্গে একখানা প্রমোদতরী কিনে মস্ত গায়িকা কোন মেয়েকে বিয়েও করতে পারেন। আর ৫৫ বার ঠিক হওয়া সম্বন্ধে যদি আপনার কোন সন্দেহ থাকে তাহলে অন্য লোকেরা ভুল করেছে কথাটা বলা আপনার সাজে কি?
কোন মানুষের গলার স্বর, এমন কি অঙ্গভঙ্গী দেখেও আপনি বলতে পারবেন সে ভুল করছে কিনা-ব্যাপারটা আপনি আপনার দৃষ্টি দিয়েই বুঝিয়ে দিতে পারেন কিছু বলার দরকার হবে না। তাকে যদি তার ভুল ধরিয়েও দেন তাহলে কি চাইবেন সে আপনার মত মেনে নিক? কখনই না কারণ এ কাজের মধ্য দিয়ে আপনি তাকে সরাসরি তার বুদ্ধি, বিবেচনা, অহমিকা আর আত্মসম্মানের উপর আঘাত করেছেন। এতে সে চাইবে আপনাকে প্রত্যাখ্যান করতে। অথচ এর জন্য সে কিছুতেই নিজের মত পাল্টাবে না। এরপর আপনি তাকে প্লেটো, ইমানুয়েল কান্ট বা আর যারই হোক দর্শন প্রয়োগ করতে পারেন, কিন্তু তাতে মত বদলাবে না। যেহেতু আপনি তার অনুভূতিকে আঘাত করে বসেছেন।
কখনই এই ভাবে শুরু করতে চাইবেন না, এ ব্যাপারটা আমি আপনাকে প্রমাণ করে দিচ্ছি, আসুন। এটা অত্যন্ত খারাপ। এটা অনেকটা এই রকম বলা হয় : দেখুন, আমি আপনার চেয়ে চালাক চতুর। আমি আপনাকে কিছু জ্ঞান দিয়ে আপনার মত পাল্টানোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।
এটা কিছুটা দ্বন্দ্বযুদ্ধে আহ্বান করার মত। এতে বিরোধিতা জাগিয়ে তোলা হয়, আপনার শ্রোতা আপনি কিছু শুরু করার আগেই আপনার সঙ্গে লড়াইতে নামতে চায়।
মানুষের মন বদলানো বেশ কঠিন কাজ। অতএব তাকে আরও কঠিন করে তুলে লাভ কি? নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করবেনই বা কেন?
আপনি যদি কোন কিছু প্রমাণ করতে চান তাহলে কাউকে সেটা জানতে দেবেন না। এ কাজ এমন গোপনে, কৌশলে করতে হবে কেউ যেন তা বুঝতে না পারে আপনি সেটা করে চলেছেন।
নিচের এই উদ্ধৃতিটা লক্ষ করুন :
মানুষকে এমনভাবে শেখাতে চান, সে যেন না বোঝে আপনি তাকে শেখাতে চাইছেন। লর্ড চেষ্টারফিল্ড তাঁর ছেলেকে বলেছিলেন :
‘অন্য কারও চেয়ে যদি পারো জ্ঞানী হও, তবে সে কথা তাকে বলো না।’
বিশ বছর আগে আমি যা বিশ্বাস করতাম–একমাত্র অঙ্ক ছাড়া আর বোধহয় কিছুই বিশ্বাস করি –তাছাড়া যখন আইনস্টাইনের লেখা পড়ি তখন তাও আবার বিশ্বাস হয় না। আরও বিশ বছর পরে আমি এ বইটায় যা বলেছি সেটাও হয়তো বিশ্বাস করতে চাইব না। আগে যে সব বিষয় সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলাম এখন সে সম্বন্ধে ততটা নিশ্চিত আমি নই। সক্রেটিস এথেন্সে তাঁর শিষ্যদের বারবার বলতেন : আমি একটা ব্যাপারই জানি, আর সেটা হলো আমি কিছুই জানি না। যাই হোক আমি সক্রেটিসের চেয়ে বেশি বুদ্ধিমান বলে নিজেকে ভাবি না, আর তাই কাউকে বলতে চাই না, সে ভুল করছে। আমি লক্ষ্য করে দেখেছি। তাতে আখেরে কাজ হয়।
কোন মানুষ কোন কথা বললে সেটা যদি আপনার ভুল বলে মনে হয়-হ্যাঁ, প্রকৃতই ভুল কিন্তু–তাহলে এভাবেই সুরু করলে ভালো হয় না কি : হ্যাঁ, এবার শুনুন! আমার অন্যরকম মনে হয়েছিল। তবে আমারও ভুল হতে পারে। কারণ আমার প্রায়ই ভুল হয়। আর আমার ভুল হলেই সে ভুলটা শুধরে নিতে চাই। তাহলে আপনার ব্যাপারটাও একটু দেখা যাক, কি বলেন?
এই ধরনের কথায়, অর্থাৎ আমারও ভুল হতে পারে। আমার প্রায়ই ভুল হয় ব্যাপারটা একটু দেখা যাক কি বলেন? সত্যিকার দারুণ যাদু থাকে এই সব কথায়।
স্বর্গ, মর্ত, পাতাল কোন জায়গাতেই মানুষ আপনার ঐ ধরনের কথায় কোন প্রতিবাদ করতে চাইবে না।
ঠিক এই রকমই করে থাকেন একজন বিজ্ঞানী। আমি একবার বিখ্যাত আবিষ্কারক আর বিজ্ঞানী স্টেফানসনের সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। তিনি প্রায় এগারো বছর কাটিয়েছিলেন মেরু অঞ্চলে, তাছাড়াও তিনি দু’বছর কেবলমাত্র মাংস আর জল ছাড়া কিছুই খাননি। তিনি আমায় তার একটা পরীক্ষার বিষয় বলেছিলেন। আমি তাঁকে প্রশ্ন করি তিনি ঐ পরীক্ষায় কি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। আমি কোনদিনই তাঁর উত্তরটা ভুলতে পারবো না। তিনি বলেন : কোন বিজ্ঞানী কখনও কিছু প্রমাণ করতে চান না। তিনি কেবল আসল ব্যাপার খুঁজে বের করার চেষ্টাই করে থাকেন।
আপনিও আপনার চিন্তাধারায় বৈজ্ঞানিক পন্থা কাজে লাগাতে চান, তাই না? বেশ, এ ব্যাপারে আপনি যদি বৈজ্ঞানীকভাবে চিন্তা করতে না পারেন তাহলে কিন্তু দোষ আপনারই।
আপনার যে ভুলও হতে পারে এ কথাটা স্বীকার করলে আপনি কখনই কোন ঝামেলায় পড়বেন না। এরকম করলে সব রকম তর্কের অবসান ঘটবে আর অপর ব্যক্তিকে অনুপ্রাণিত করে আপনি যেরকম পরিষ্কার আর উদার মনোবৃত্তিসম্পন্ন তাকেও সেই রকমই করে তোলে। এর ফলে সে যে ভুল করতে পারে সেটাই স্বীকার করতে চাইবে।
আপনি যদি জানেন কোন লোক ভুল করছে আর আপনি সে কথাটা তাকে মুখের উপরেই বলে ফেললেন, তাহলে কি হতে পারে? আসুন, আপনাদের একটা নির্দিষ্ট ঘটনার উদাহরণ দিই। মিঃ এস, নিউ ইয়র্কের একজন তরুণ অ্যাটনী, একবার আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রীম কোর্টে খুব গুরুত্বপূর্ণ এক মামলায় অংশ গ্রহণ করেছিলেন। বিষয়টাতে প্রচুর টাকা আর গুরুত্বপূর্ণ এক আইনের বিষয় জড়িত ছিল।
বিতর্ক চলার সময়, সুপ্রীম কোর্টের একজন বিচারপতি মিঃ এস-কে বিশেষ একটি আইনের ধারা ছ’বছরের মধ্যে সীমাবদ্ধ এ কথাই বললেন।
মিঃ এস-একটু থমকে বিচারপতির দিকে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ মুখের উপর বলে বসলেন, ‘হুজুর এরকম কোন আইনই নেই।’
ব্যাপারটা সম্বন্ধে মি. এস-পরে লেখকের একটা ক্লাসে বলেছিলেন : আমার কথায় সারা কামরায় নিঃস্তব্ধতা নেমে এলো। মনে হচ্ছিল ঘরের তাপমাত্রা যেন শূন্য ডিগ্রীতেই নেমে গেছে; আমার কথাই ঠিক ছিল। বিচারপতি ভুল কলেছিলেন আর আমি সেই কথাটাই তাঁকে বলে ফেলি। এতে কি তিনি বন্ধুভাবাপন্ন হন? না। আমি এখনও বিশ্বাস করি আইনটা আমারই পক্ষে ছিল আর আমি এও জানতাম সেদিন যেভাবে বিতর্কে অংশ নিয়ে কথা বলি তেমন আর কোনদিন পারিনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমি সে মামলায় জিততে পারিনি। আমি দারুণ একটা ভুল করেছিলাম। একজন শিক্ষিত আর জ্ঞানী বিচারপতির মুখের উপর তার ভুল ধরিয়ে দিয়ে।
খুব কম সংখ্যক লোকই যুক্তি মেনে চলে। আমাদের বেশির ভাগই একচোখা আর একপেশে মানুষ। আমাদের বেশির ভাগই আগে থেকে একটা ধারণার বশবর্তী হয়ে থাকি–আর সেটা হয় ঈর্ষা, সন্দেহ, ভীতি, হিংসা এবং অহমিকাবোধ থাকার কারণে। বেশির ভাগ নাগরিকই কিছুতেই তাদের ধর্ম, চুলের ছাঁট, সমাজতন্ত্রবাদ বা ক্লার্ক গেবল সম্বন্ধে ধারণা বদলাতে চান না। অতএব আপনি যদি চান মানুষকে তার ভুল সম্বন্ধে জানিয়ে দেবেন, তাহলে নিচের অংশটা দয়া করে প্রতিদিন সকালে প্রাতরাশের আগে হাঁটু গেড়ে বসে, পড়ে চলুন। এটা প্রফেসর জেমস হার্ভে রবিনসনের আলোকিত একখানা বইয়েরই অংশ। বইটার নাম দি মাইন্ড ইন দ্য মেকিং।‘
‘আমরা মাঝে মাঝে কোন রকম বাধা বা বড় রকমের কোন আবেগ ছাড়াই আমাদের মন বদলে ফেলি। কিন্তু আমাদের যদি বলা হয় আমরা ভুল করছি তাহলে আমরা সেই কথায় বেশ আপত্তি প্রকাশ করি আর আমাদের হৃদয়ও বেশ কঠিন হয়ে ওঠে! আমরা আমাদের বিশ্বাস গড়ে ওঠার ব্যাপারে অবিশ্বাস্য রকম অমনোযোগী থাকি অথচ আমরাই আবার এর প্রতি দুরন্ত রকম আকর্ষণ দেখাই কেউ যদি সেটা কেড়ে নিতে চায়। আসলে এটা পরিষ্কার যে এই ধারণাগুলো কোনভাবেই আমাদের একান্ত আপনার নয়, বরং সেটা হলো আমাদের অহং ভাবটা যা বিপদের সামনে পড়ে যায়… আমার এই ছোট্ট কথাটা মানুষের ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, আর এটা উপলব্ধির মধ্যেই রয়েছে প্রাজ্ঞতার পথ। এটাতে একই রকম তীব্রতা থেকে যায় তা আপনি ‘আমার’ আহার, ‘আমার’ কুকুর, ‘আমার’ বাড়ি, ‘আমার’ বাবা, ‘আমার’ দেশ, ‘আমার’ ইশ্বর যাই বলুন না কেন। এছাড়াও আসল রহস্য হলো পৃথিবীর জানা বিষয়ে আমাদের ধারণা বা বিশ্বাস নিয়ে কেউ আপত্তি তুললেই আমরা রেগে যাই বা অসন্তোষ প্রকাশ করি…আমরা সেই সব সত্যি বলে বিশ্বাস করে চলতে চাই, চিরকাল আমরা যা সত্যি ভেবে এসেছি। আর এ বিষয়ে কোন রকম সন্দেহের প্রকাশ ঘটলেই আমরা যত রকমে পারি আমাদের বিশ্বাস আঁকড়ে ধরতে চাই। এর ফল হলো আমাদের বেশির ভাগ তথাকথিত যুক্তিবোধের মধ্যে কেবল খুঁজে ফিরতে চাই আমাদেরই কথার প্রমাণ।
আমি একবার একজন ঘরসাজানোয় দক্ষ মানুষকে আমার বাড়ি সাজানোর দায়িত্ব দিই। যখন বিল পেলাম আমার চোখ কপালে উঠে গিয়েছিল।
কদিন পরে আমার একজন বন্ধু এসে সব দেখে গেলেন। কথায় কথায় দামের কথা উঠতেই তিনি আঁৎকে উঠে বললেন : ‘বলো কি? এ যে সাংঘাতিক। আমার মনে হচ্ছে লোকটা তোমাকে বেশ ঠকিয়েছে।’
কথাটা সত্যি? হ্যাঁ, তা সত্যি; বন্ধু ঠিকই বলেছিলেন। কিন্তু বেশির ভাগ লোকই কথাটা স্বীকার করতে চায় না যেটায় তাদের বুদ্ধি বিবেচনায় ধাক্কা লাগতে পারে। অতএব মানুষ বানাই আমি, নিজে যে ঠিক সেটাই প্রমাণ করার চেষ্টা চালালাম। আমি বললাম সবসেরা জিনিস সবচেয়ে সস্তায় মেলে না। আর
কারও পক্ষেই ভালো রুচিসম্মত জিনিস ফুটপাথের মত সস্তায় কখনও পাওয়া যাবে না। ইত্যাদি।
পরের দিন আর একজন বন্ধু এলেন। তিনি সব জিনিস দেখে বেশ প্রশংসা করতে লাগলেন। মনের খুশিতে টগবগ করে তিনি বলেও ফেললেন এই রকম চমৎকার জিনিস তিনিও তার বাড়ির জন্য কিনবেন ভাবছেন। এবার কিন্তু আমার প্রতিক্রিয়া হলো অন্য রকম। আমি বললাম : ‘মানে, সত্যি কথা বললে এ সব খরচ আমার সাধ্যের বাইরে। বড় বেশি খরচ করেছি। এগুলো কিনে ভুলই করেছি।’
আমরা যখন ভুল করি, সেগুলো তো নিজেদের কাছে স্বীকার করতে পারি। আমাদের কাছে কৌশলে আর বেশ বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে কথাটা তুললে হয়তো অন্যের কাছে তা স্বীকারও করতে পারি, আর তা করে আবার নিজেদের সারল্য আর মানসিক উদারতার জন্য অহমিকাও অনুভব করি। কিন্তু ব্যাপারটা আর তা থাকে না যদি কেউ জোর করে আমাদের এই তিক্ত পাঁচনটা যদি গেলাতে চেষ্টা করে…
গৃহযুদ্ধের সময় আমেরিকার বিখ্যাত সম্পাদক হোরেস গ্রিল লিঙ্কনের নীতির প্রচণ্ড রকম বিরোধী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন ঠাট্টা, তামাশা, আর তর্কের মধ্য দিয়েই তিনি লিঙ্কনকে তাঁর মত মেনে নিতে বাধ্য করতে পারবেন। তিনি এই তিক্ত ধারণা আর প্রচার মাসের পর মাস, বছরের পর বছর চালিয়ে গিয়েছিলেন। আসলে যে রাতে বুথ লিঙ্কনকে গুলি করে সেদিনও তিনি প্রেসিডেন্ট লিঙ্কনকে হিংস্রভাবে, ব্যঙ্গাত্মক ব্যক্তিগত আক্রমণ করে লিখেছিলেন।
কিন্তু এই রকম তিক্ততার ফলে কি লিঙ্কন গ্রিলের সঙ্গে একমত হন? মোটেই না, হাস্যাস্পদ করে গালনিন্দে করলে কখনই কাজ হয় না।
মানুষকে নিয়ে চলার ক্ষেত্রে যদি চমৎকার কিছু উপদেশ চান, আর নিজেকে পরিচালনার ক্ষেত্রে ব্যক্তিত্বের উন্নতি ঘটাতে আগ্রহী হন তাহলে বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিনের আত্মজীবনী অবশ্যই পাঠ করবেন-এ আত্মজীবনী হল আজ পর্যন্ত যা লেখা হয়েছে তার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ আর আমেরিকার সাহিত্যের এক শ্রেষ্ঠ রত্ন।
ফ্রাঙ্কলিন তাঁর আত্মজীবনীতে লিখে গেছেন কিভাবে তিনি বিরক্তিকর তর্ক করার অভ্যাস ত্যাগ করেন আর নিজেকে কেমন করে আমেরিকার ইতিহাসে অতি ভদ্র, সক্ষম, আর কূটনীতিসম্পন্ন মানুষ করে গড়ে তোলেন।
একদিন বেন ফ্রাঙ্কলিন যে সময় উড়নচণ্ডী যুবক, তখন একজন বহুঁকালের বন্ধুসভার বন্ধু তাঁকে একপাশে টেনে নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ কড়া ভাষায় কতকগুলো গায়ে বেঁধে এমন সত্যি কথা শুনিয়ে দেন। কথাগুলো অনেকটা এই রকম :
‘বেন, তোমাকে নিয়ে আর পারা যায় না। তোমার মতে মত দেয় না এমন সব লোককে তুমি প্রায় চড় মারতেই বাকি রাখো। তোমার মত এখন তাই আর কারও পছন্দ নয়। কেউ তা নিতে চায় না। তোমার বন্ধুরা এটা বেশ বুঝতে পেরেছে তুমি ওদের কাছাকাছি না থাকলেই তাদের সময় ভাল কাটে। তুমি এত বেশি জান যে কেউ তোমাকে কিছু শেখাতে পারে না। বাস্তবিকই, কেউ আর সেরকম চেষ্টাও করবে না যেহেতু তাতে শুধু গন্ডগোল আর অযথা খেটে মরতে হয়। অতএব, তুমি আর বেশি কিছু শিখতে পারছনা যেটুকু জান তার চেয়ে তো নয়ই। তাছাড়া যা তুমি জান তাও অতি সামান্য।‘
বেন ফ্রাঙ্কলিক সম্পর্কে আমি যে চমৎকার জিনিসটা জানি তা হলো তিনি কি সুন্দর ভাবেই না এই তিরস্কার গ্রহণ করেন। এটা বোঝার মত তার যথেষ্ট বয়স হয়েছিল যে ব্যাপারটা সত্যিই, তিনি এটাও বুঝতে পেরেছিলেন যে এভাবে বলার অর্থ তিনি ব্যর্থ হবেন আর সামাজিক ভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে পড়বেন। তাই তিনি সময়মত নিজেকে সংশোধন করে নিলেন। তারপর থেকেই তিনি তাঁর সেই উদ্ধত স্বভাব বদলে ফেলেন।
বেন ফ্রাঙ্কলিন লিখেছিলেন, ‘আমি নিয়ম করে ফেললাম অন্যের বিরক্তি ঘটিয়ে কোন রকম সরাসরি তর্কে জড়িয়ে পড়ব না আর নিজের মতামত জাহির করতেও চাইব না। তাছাড়াও আমি ঠিক করলাম কথাবার্তায় এমন কোন কথা বলবো না যাতে নিজের মতামত জানানো হয়। যেমন, ‘নিশ্চয়ই’ ‘নিঃসন্দেহে’ ইত্যাদি। এর বদলে ঠিক করলাম ব্যবহার করবো ‘আমার মনে হয়’, ‘আমার ধারণা, ‘আমি ভাবছি’ এই সব। অন্য কেউ যদি কিছু বলে উঠতে চাইতো আমি সরাসরি তাঁর কথায় বাধা না দিয়ে বা তাঁর কথা অস্বীকার না করে বলতাম তাঁর কথা হয়তো কোন কোন ক্ষেত্রে সঠিক হতেও পারে, তবে এ ব্যাপারে মনে হয় যেন অন্য কিছু হতে পারে, ইত্যাদি। আমি এরপর থেকেই এরকম কাজে তফাত বুঝতে পারলাম–আর বেশ সহজ ভাবেই সব ঘটে চলল। যেরকম বিনম্রতায় আমি আমার মতামত জানাতে শুরু করলাম তাতে কোন বাধা না পেয়েই তা গৃহীত হতে লাগল। আমার ভুল হলেও কম আশ্চর্য হতাম আর বেশ সহজেই অন্যেরা ভুল করলেও তাদের স্বমতে আনতে বেগ পেতে হতো না।
‘এই রকম রীতিনীতি আমি এমন স্বাভাবিক ভাবেই আয়ত্ত করে ফেললাম যে সেটা বেশ সহজেই হয়ে এলো। গত পঞ্চাশ বছরেও কেউ কোন ঝগড়া হতে পারে এমন কথা আমার মুখ থেকে শোনেনি। আর আমার এই অভ্যাসের জন্যই (আমার সততা নিয়েও) মনে হয় আমি জনগণের উপর এমন প্রভাব বিস্তার করতে পেরেছিলাম যে পুরাতন বদল করে নতুন কিছু করতেও পারতাম। যদিও বক্তা হিসেবে আমি মোটেই ভাল ছিলাম না। নিজের কথা বা বক্তব্য তেমন করে বোঝাতেও পারতাম না তবুও আমি সাধারণভাবে সাফল্য অর্জন করেছিলাম।‘
বেন ফ্রাঙ্কলিনের এমন কৌশল ব্যবসায় ক্ষেত্রে কেমন কাজে লাগে? দুটো উদাহরণ দেওয়া যাক।
নিউ ইয়র্কের ১১৪ লিবার্টি স্ট্রিটের এফ জে. ম্যাহনি তেল ব্যবসা সংক্রান্ত যন্ত্রাদি বিক্রি করে থাকেন। তিনি লং আইল্যাণ্ডের একজন বড় মক্কেলের জন্য কাজের বায়না ধরেছিলেন। কাজটির জন্য একটা খসড়াও দেওয়া হয় আর সেটা গৃহীত হলে কাজ করাও আরম্ভ হয়। তারপরেই একটা দুর্ভাগ্যজনক ব্যাপার ঘটে যায়। ক্রেতা ভদ্রলোক তার বন্ধুদের সঙ্গে কাজটা নিয়ে আলোচনা করেন। তাঁরা তাঁকে সাবধান করে দিয়ে বলে তিনি মারাত্মক ভুল করেছেন। তার উপর ভুল কিছু জিনিস চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। এটা নাকি ছোট, এটা নাকি সেরকম, এরকম এই সব তাঁকে নানারকম বোঝায়। বন্ধুদের কথায় ভদ্রলোকের মাথা খারাপ হয়ে যাওয়ার যোগাড়। তিনি মি. ম্যাহনিকে ফোন করে জানিয়ে দেন যে, যা বায়না দিয়েছেন তিনি সে জিনিস নিতে পারবেন না।
‘আমি সব ব্যাপারটা সতর্কতার সঙ্গে যাচাই করে দেখতে পেলাম আমরা যা করছি সেটাই ঠিক। মিঃ ম্যাহনি আমায় জানিয়েছিলেন। তাছাড়াও আমি জানতাম ওঁর বন্ধুরা এ ব্যাপারে কিছুই জানেন না বা বোঝেন না, তবে আমি বুঝলাম একথা তাঁকে বললে ফল মারাত্মক হবে। আমি লং আইল্যাণ্ডে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে তাঁর অফিসে ঢুকতেই ভদ্রলোক প্রায় লাফিয়ে উঠে দ্রুত কথা বলতে বলতে আমার দিকে এগিয়ে এলেন। তিনি এমন উত্তেজিত যে প্রায় ঘুসি পাকাতেও চাইছিলেন। তিনি আমায় ঢের বকাবকি করে কথাটা শেষ করলেন এই বলে : বলুন এব্যাপারে কি করতে চাইছেন?
আমি তাঁকে বেশ শান্তস্বরেই বললাম, তিনি যা চাইবেন তাই করবো। আপনি এর দাম দিচ্ছেন, অতএব পছন্দসই জিনিস চাইবার অধিকার আপনার আছে। তা যাই হোক কাউকে দায়িত্ব নিতে হবেই। আপনি যদি মনে করেন আপনিই ঠিক তাহলে আপনার ব্লুপ্রিন্ট দিন যদিও আমরা ইতিমধ্যে ২০০০ হাজার ডলার খরচ করেছি, তাহলেও কাজটা বাতিল করবো। এ দুহাজার আমরা আপনাকে খুশি করার জন্যই ব্যয় করতে রাজি। তবে আপনাকে একটু সাবধান করে দিতে চাই আপনার কথা মতো জিনিস বানানো হলে সে দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে, আর আমাদের পরিকল্পনা মত কাজ করতে দিলে দায়িত্ব নেব আমরাই।
ভদ্রলোক ততক্ষণে শান্ত হয়ে এসেছিলেন। তিনি শেষ পর্যন্ত বললেন, ঠিক আছে, কাজ করে যান। তবে পছন্দ না হলে ঈশ্বর আপনাদের সাহায্য করুন।
‘ঠিকই হয়েছিল সব কিছু, ভদ্রলোক আমাদের আরও দুদফা কাজ এ বছরেই দেবেন কথা দিয়েছেন।’
‘ভদ্রলোক আমায় যখন অপমান করেন এবং ঘুসি উঁচিয়ে আসেন আর বলেন আমার কাজ বুঝি না তখন আমার পক্ষে তর্ক না করে আত্মসম্বরণ করা কঠিনই ছিল। তবে সেটা করে ভালোই করি, ওতে কাজও হয়। আমি যদি বলতাম তিনি ভুল করছেন তাহলে একটা তর্ক শুরু হত। হয়তো মামলাও হত, সৃষ্টি হত তিক্ততা, বহু টাকা খরচ হত, আমরা হারাতাম ভাল এক খরিদ্দার। আমার দৃঢ় বিশ্বাস হয়েছে, কেউ ভুল করছে না বলাই ভাল।
আর একটা উদাহরণ-মনে রাখবেন যে সব কথা বলছি তার সবই হাজার হাজার মানুষের বিচিত্র অভিজ্ঞতারই ফসল। আর. ভি. ক্রাউলে নিউ ইয়র্কের বিরাট একটা কাঠের কোম্পানীর সেলসম্যান। তাকে একজন দক্ষ কাঠ পরিদর্শকের সঙ্গে কাজ করতে হয়, তার ভুল হচ্ছে বলতেও হয়। তিনি নিজে তর্কেও জেতেন, তবে তাতে কোন লাভ হয়নি। কারণ এই কাঠ পরিদর্শকরা, মিঃ ক্রাউলে বলেছেন, ‘অনেকটা বেসবল খেলার বিচারকের মত। তারা কোন ধারণা করলে তা আর বদলায় না।
মিঃ ক্রাউলে দেখলেন তর্কে তিনি জিতলেও তার প্রতিষ্ঠানে হাজার হাজার ডলার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। তাই এবার তিনি তাঁর কাজের কৌশল পাল্টাবেন ঠিক করলেন। আর তর্ক করবেন না। ফল কি হল? তাঁর নিজের মুখেই শুনুন :
এক সকালে আমার অফিসে টেলিফোন বেজে উঠল। ওপাশ থেকে শোনা গেল বেশ উত্তেজিত, অসন্তুষ্ট কণ্ঠস্বর। তিনি বললেন, আমরা যে তার কারখানায় একগাড়ি কাঠ পাঠিয়েছি সেগুলো একদম বাজে। তাঁর প্রতিষ্ঠান ট্রাক থেকে মাল নামানো বন্ধ করে দিয়েছে। আর আমরা যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সব কাঠ তার চাতাল থেকে সরিয়ে নিই।’ ট্রাকের মাল একচতুর্থাংশ নামানো হতে তাদের কাঠ পরিদর্শক জানান যে কাঠের মান শতকরা ৫৫ ভাগ নিচে। এ অবস্থায় তারা তা নিতে অস্বীকার করছে।
আমি সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে রওয়ানা হলাম আর রাস্তায় যেতে যেতে ঠিক করে নিলাম কিভাবে সব সামাল দেব। সাধারণ অবস্থায় পড়লে আমি কাঠ বাছাই করার নিয়ম উল্লেখ করতাম আর ওই কাঠ পরিদর্শককে অবশ্যই বোঝাতে চাইতাম কাঠ ঠিক আছে এবং তার মান ঠিক, এটা তারই ভুল হচ্ছে। তিনি ভুল নিয়ম প্রয়োগ করছেন। অবশ্য আমি ঠিক করলাম এই শিক্ষায় যে নিয়ম শিখেছি তাই কাজে লাগাব।
কারখানার কাছে যখন পৌঁছালাম, তখন সেই ভদ্রলোক আর কাঠ পরিদর্শন বেশ বদমেজাজেই তৈরি হয়ে আছেন, লড়াই করতে তারা প্রস্তুত। আমরা এবার যে গাড়ি থেকে কাঠ নামানো হচ্ছিল সেখানে গেলাম। আমি তাঁদের অনুরোধ করলাম সব কাঠ নামাতে দেওয়া হোক যাতে ব্যাপারটা বুঝতে পারি। পরিদর্শককে আমি এও বললাম তিনি বাতিল কাঠগুলো এক জায়গায় আর ভালোগুলো অন্য জায়গায় রাখুন।
‘বেশ কিছুক্ষণ লক্ষ করেই বুঝলাম পরিদর্শক ভদ্রলোক বড় বেশি রকম কড়া, আর বাছাই করার নিয়ম তিনি মানছেন না। এই কাঠগুলো ছিল বিশেষ জাতের সাদা পাইন কাঠ-আমি এও বুঝলাম পরিদর্শক শক্ত কাঠ সম্পর্কে বেশ শিক্ষা পেয়েছেন বটে তবে সাদা পাইন সম্বন্ধে কিছুই জানেন না। সাদা কাঠে আমার অভিজ্ঞতা দারুণ এটা আমার বিষয়–তা বলে কি তিনি যেভাবে সব বাছাই করছিলেন তাতে আপত্তি করলাম? মোটেই না। আমি শুধু সব দেখতে দেখতে মাঝে মাঝে দু-চারটে প্রশ্ন করতে লাগলাম ‘কোন কাঠ কেন খারাপ-একবারের জন্যেও আমি বলিনি পরিদর্শক মশাই ভুল করছেন। আমি কেবল বোঝাতে চাইলাম আমার জানার উদ্দেশ্য হলো ভবিষ্যতে পাঠানোর সময় যাতে তাদের পছন্দসই কাঠ পাঠাতে পারি।’
বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ পথে আর সহযোগিতার ভঙ্গীতেই আমি বারবার বললাম, তাদের কাজে লাগবে না এমন কাঠ তারা অবশ্যই সরিয়ে নেবেন। কথাবার্তার মাঝখানে ভদ্রলোককে বেশ মোলায়েম করে তুলোম আর আমাদের মধ্যেকার তিক্তভাব অনেকটাই কেটে গেল। আমার সতর্ক কয়েকটা উক্তিতে ভদ্রলোক বুঝলেন বাতিল কাঠগুলোর কিছু হয়তো সত্যিই ঠিক আছে আর আসলে তাদের দরকার আরও দামী কিছু। আমি সর্তক ছিলাম যাতে তিনি না ভাবেন আমি এ নিয়ে কোন কথা তুলছি।
আস্তে আস্তে তার সমস্ত ভাবভঙ্গীই বদলে গেল। তিনি শেষ অবধি আমার কাছে স্বীকার করলেন সাদা পাইন কাঠ সম্বন্ধে তার তেমন অভিজ্ঞতা নেই। গাড়ি থেকে তা নামানোর সময় তিনি আমায় সে সম্বন্ধে প্রশ্ন করতে লাগলেন। আমি তখন ব্যাখ্যা করলাম এ কাঠ কেন পাঠানো হয়েছে, অবশ্য তাঁর পছন্দ না হলে ফেরত নেব। ভদ্রলোকের শেষ পর্যন্ত এমন অবস্থা হলো যে যতবার কাঠ বাতিলের সারিতে রাখা হচ্ছিল, তিনি নিজেকে দোষী ভাবছিলেন। শেষ পর্যন্ত তিনি বুঝেছিলেন ভুলটা তাঁদেরই হয়েছে, যেরকম ধরনের কাঠ দরকার ছিল সে ধরনের কাঠের অর্ডার তাঁরা দেন নি।
অবশেষে যা দাঁড়ালো, আমি বিদায় নেবার পর পরিদর্শক গাড়ি বোঝাই সব কাঠ আবার যাচাই করলেন আর সবটাই নিয়ে নিলেন এবং আমরাও পুরো টাকার চেক পেয়ে গেলাম।
‘এই একটা ব্যাপারেই সামান্য একটু কৌশলে কাজ হয়ে গেল। যেহেতু আমি কোনভাবেই অন্যজনকে বলিনি তিনি ভুল করছেন, আর এতে আমাদের প্রতিষ্ঠানের দেড়শ ডলার নগদে লাভ হলো। অবশ্যই টাকার বিনিময়ে আমাদের যে সুনাম নষ্ট হতো তার মূল্যায়ন সম্ভব হয় না।‘
একটা কথা এবার বলতে চাই, এ পরিচ্ছেদে নতুন কিছু আমি বলছি না। উনিশ শতক আগে যীশু বলেছিলেন : ‘তোমার শত্রুর সঙ্গে চট করে একমত হও।
অন্য কথায় বলতে গেলে আপনার মক্কেল, স্বামী বা শত্রুর সঙ্গে তর্ক করবেন না। কখনও বলবেন তার ভুল হচ্ছে, তাঁরকে চটতে দেবেন না। বরং একটু কূটনীতি কাজে লাগান।
যীশু খ্রীষ্টের জন্মের ২,২০০ বছর আগে মিশরের বৃদ্ধ রাজা আখখাঁটি তার ছেলেকে কিছু সুন্দর উপদেশ দিয়েছিলেন-যে উপদেশ আজকের দিনে অত্যন্ত প্রয়োজন। চার হাজার বছর আগে বৃদ্ধ রাজা আখখাঁটি মদ পান করার ফাঁকে তাকে ছেলেকে বলেছিলেন : কৌশলী হও। এতে তোমার সুবিধা হবে।
অতএব, অন্যকে স্বমতে আনতে হলে দু নম্বর নিয়ম হলো :
‘অপরের মতের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। কখনও তাকে বলবেন না সে ভুল করছে।’