লিটনকে কেমন জানি অন্যরকম লাগছে
লিটনকে কেমন জানি অন্যরকম লাগছে। কোথাও কোনো পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তনটা সূক্ষ্ম বলে ধরা যাচ্ছে না। চুল কেটেছে কি? না চুল কাটে নি। মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল। চুলের জন্যে কলেজে তার নাম ছিল শ্যাওড়াগাছ। লিটন বলল, তুই এ রকম করে তাকিয়ে আছিস কেন? কি দেখছিস?
হাসান বলল, তোকে দেখছি।
আমাকে দেখার কী আছে?
তোকে কেমন যেন অন্যরকম লাগছে।
লিটন বলল, মনটা খুব খারাপ সেইজন্যেই বোধহয় অন্যরকম লাগছে।
মন খারাপ কেন?
লিটন দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমাকে দেখে বুঝতে পারছিস না কেন মন খারাপ? মালয়েশিয়া শেষ পর্যন্ত যেতে পারি নি। ঢাকা এয়াপোটে আটকে দিয়েছে। ফলস ভিসা।
হাসান বিস্মিত হয়ে বলল, তোর মালয়েশিয়া যাবার কথা ছিল নাকি?
তুই জানিস না?
না।
আমি যে বিয়ে করেছি। সেটা জানিস?
না জানালে জানব কীভাবে? আমি তো অন্তৰ্যামী না।
চাচাজান তোকে বলেন নি। আমি তাকে বলে গেছি। আমার বিয়ে তো আর কার্ড ছাপিয়ে হবে না যে কার্ড দিয়ে যাব। সস্তার বিয়ে। বন্ধুবান্ধব যে কজনকে বলেছিলাম কেউ আসে নি। কেউ না এলেও তুই আসবি সেই ব্যাপারে। আমি নিশ্চিত ছিলাম। বলতে গেলে একা একা বিয়ে করেছি। মনটা এত খারাপ হয়েছে।
মন খারাপ হবার কথাই। বুঝলি হাসান আমি ঠিক করেছিলাম আর কোনো দিন তোর সঙ্গে কথা বলব না। তোর বিয়ের কথা জেনেও আমি যাব না। তুই ভাবলি কী করে? লিটন আনন্দিত গলায় বলল, শম্পাকেও আমি এই কথা বলেছি। আমি বলেছি— শোন শম্পা, আর কেউ আসুক না। আসুক হাসান আসবেই। শম্পা বলেছে উনি কি আলাদা? আমি বললাম হাসান আলাদা কি আলাদা না তা আমি জানি না, হাসান আসবে এইটুকু জানি।
হাসান বলল, বাবা আমাকে কিছু বলেন নি, বোধহয় ভুলে গেছেন।
বুড়ো মানুষ ভুলে যাওয়াই স্বাভাবিক। চাচাজানের কাছে এক হাজার টাকাও দিয়েছিলাম। ভেবেছি বিদেশ চলে যাচ্ছি যে যা টাকা পয়সা পেত দিয়ে যাই। সেই যাওয়া আটকে গেল। কী যে সমস্যার মধ্যে পড়েছি! আমার জন্যে কষ্ট হচ্ছে না। শম্পার জন্যে কষ্ট হচ্ছে। ও খুব কান্নাকাটি করে।
ভাবিকে কান্নাকাটি করতে নিষেধ করো। তুই না যাওয়াতে দুজন একসঙ্গে থাকতে পারছিস।
আমিও একজাক্ট এই কথাই শম্পাকে বলেছি। আমাদের দেশের ব্যাপার তো জানিস–সবাই বলাবলি করছে বিদেশ যাওয়া-টাওয়া সব ভাওতাবাজি। বিদেশে যাচ্ছে এই ভাওতা দিয়ে বিয়ে করেছে। আমার মনটা যে কী খারাপ তুই দেখে বুঝবি না।
মন খারাপের কথা বাদ দে তো। ভবির কথা বল। ভাবি দেখতে কেমন?
দেখতে মোটামুটি মানে এভারেজ আর কি। কিন্তু অসাধারণ একটা মেয়ে। অন্তরে এত মায়া তুই কল্পনাও করতে পারবি না। আমার সম্পর্কে কেউ একটা কথা বললে তার চোখ দিয়ে চেী চেী করে পানি পড়ে। একদিন হয়েছে কি শোেন–সকালবেলা ওদের বাসায় গিয়ে নাস্তা করার কথা। যেতে পারি নি। রাত ন’টার দিকে গেছি। গিয়ে শুনলাম–রাত ন’টা পর্যন্ত তোর ভাবি না খেয়ে বসে আছে। সলিড ফুড তো খায়ই নি–পানি পর্যন্ত না–এটা পাগলামি না!
পাগলামি হলেও সুন্দর পাগলামি।
তোরা যতই সুন্দর বলিস-আমি খুব রাগ করেছি। শম্পাকে কঠিন কঠিন কিছু কথা বলব বলে ভেবেছিলাম, শেষ পর্যন্ত বলি নি। হাইলি সেনসেটিভ মেয়ে তো-কঠিন কথা শুনে কী করে না করে তার ঠিক আছে। চুপচাপ থাকাই ভালো।
ভাবি কোথায় এখন? তোর সঙ্গে?
আমার সঙ্গে থাকবে কীভাবে? আমি থাকি মেসে। বউ নিয়ে তো আর মেসে উঠতে পারি না। শম্পা তার বড় মামার সঙ্গে থাকে। আমি প্রতিদিন কমপক্ষে একবার হলেও দেখে আসি। একবার রাতে ছিলামও। ওদের বাসা খুবই ছোট। দুই কামরার বাসা। এতোগুলো মানুষ। আমরাই যদি একটা ঘর দখল করে থাকি তাহলে হবে কীভাবে? আর নিউলি ম্যারিড কাপল তো আর অন্যদের সঙ্গে খাটে আড়াআড়িভাবে ঘুমোতেও পারে না। হাসান হাসছে। লিটন এখনো ছেলেমানুষ রয়ে গেছে। কী সহজ আন্তরিক ভঙ্গিতেই না সে গল্প করছে!
হাসান শম্পার ছবি দেখবি? সঙ্গে আছে? ওদের ক্যামেরায় কিছু ছবি তুলেছিলাম। ছত্ৰিশটা স্নাপ নিয়েছি আটটা এর মধ্য নষ্ট হয়েছে। এই দেখ।
হাসান ছবি দেখছে। লিটন গভীর আগ্রহে প্রতিটি ছবি ব্যাখ্যা করছে।
শম্পার সঙ্গে যে ছোট মেয়েটা দেখছিস সে শম্পার মামাতো বোন। ক্লাস টুতে পড়ে। এমনিতে খুব শান্ত মেয়ে, একটা বিচিত্র অভ্যাস আছে। আদর করে কামড় দেয়। ওইতো পরশুদিন হঠাৎ শম্পার নাক কামড়ে ধরল। এক্কেবারে রক্ত বের করে দিয়েছে।
এই ছবিটা দেখ শম্পার গলায় যে হারটা দেখতে পাচ্ছিস এটা রিয়েল না ইমিটেশন। হাসান বলল, ভাবি তো দেখতে খুব সুন্দর। তুই কী বলছিস মোটামুটি! সামনাসামনি আরো সুন্দর দেখা যায়। ছবিতে তেমন ভালো আসে নি। ক্যামেরাটাও তত ভালো ছিল না–দেখ না। সবাই আউট অব ফোকাস। তোকে একদিন নিয়ে যাব। শম্পা খুব খুশি হবে। তোর কত গল্প করেছি।
আমার আবার কী গল্প? তোর গল্পের কি শেষ আছে? তোর টাকা নেই পয়সা নেই–তারপরেও তুই আমাদের জন্যে যা করিস সেটা কে করে? তোর একটা গল্প শুনে শম্পার চোখে পানি এসে গিয়েছিল। গল্পটা হচ্ছে…
থাক তোকে গল্প বলতে হবে না।
আহা শোন না, এই গল্প আমি যে কতজনকে করেছি–ওই যে কলেজে পড়ার সময় আমি অসুস্থ হয়ে পড়লাম, তুই খবর পেয়ে….
চুপ কর তো।
আচ্ছা চুপ করলাম, শম্পাকে কবে দেখতি যাবি? হাত একদম খালি। খালি হাতে তাকে দেখতে যাব। কীভাবে। কিছু তো নিয়ে যেতে হবে। দেখি তিন-চার দিনের মধ্যে যাব।
তোকে এসে নিয়ে যাব। শুক্রবারে আসি? কিছু নিতে হবে না, তোকে দেখলেই খুশি হবে। উপহার দিয়ে তাকে খুশি করার ক্ষমতা তো আমার নেই। মানুষ দেখিয়ে খুশি করা সেটাও তো কম না। আজ উঠি রে।
হাসান তাকে সঙ্গে করেই বেরোল। আজ বুধবার-হিশামুদিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করার কথা ছিল। হিশামুদিন সাহেবকে এখনো তার নিজের চাকরির কথা বলা হয় নি। লজ্জার কারণে বলা হচ্ছে না-লিটনেরটা বল দেখবে নাকি? এই মুহুর্তে তারচে’লিটনের চাকরি। অনেক বেশি দরকার।
রাস্তায় বের হতেই আশরাফুজ্জামান সাহেবকে দেখা গেল। তিনি কয়েক পলক তাদের দিকে তাকিয়ে হুট করে পাশের গলিতে ঢুকে পড়লেন। আজকাল তিনি ছেলেদের দেখলে সরে পড়েন। হাসানের খুব মায়া লাগছে। মানুষের কত পরিবর্তনই না হয়! একটা সময় ছিল তার পায়ের শব্দেই বুক ধড়ফড় করত। সেই মানুষ আজ পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায়। পথেঘাটে হঠাৎ দেখা হলে এমন বিব্রত হন।
লিটন বলল, চাচাজান কি তোকে টাকাটা দিয়েছেন? এক হাজার টাকা?
হাসান বলল, না। তা
কে কিছু জিজ্ঞেস করিস না। বুড়ো মানুষ ভুলে গেছেন। জিজ্ঞেস করলে লজ্জা পাবেন।
আমি কিছু জিজ্ঞেস করব না।
প্ৰচণ্ড রোদ উঠেছে। এই রোদে হাঁটতে কষ্ট হয়। হাঁটা ছাড়া উপায় নেই। হাসানের পকেটে কুড়িটা মাত্র টাকা। কুড়ি টাকার একটা চকচকে নোট। নোটটা খরচ করা যাবে না। বেকারদের মধ্যে অনেক কুসংস্কার আছে। পকেট একেবারে শূন্য করতে নেই। হাসান ঘড়ি দেখল। হেঁটে যেতে গিয়ে দেরি হয়ে যাবে না তো?
দেরি হলেই হিশামুদ্দিন সাহেবের পি.এ. মোতালেব ভুরু কুঁচকে বলবে, মাই গড় আজো দেরি? ভাবটা যেন সে সবসময় দেরি করেই যাচ্ছে।
স্যার তো মনে হয়। আজ কথা বলতে পারবেন না।
হাসান বলল, ও আচ্ছা। মোতালেব হাই তুলতে তুলতে বলল, স্যারের মেয়ে এসছে— ‘চিত্ৰলেখা’; সে স্যারের সব টাইমটেবিল ভণ্ডুল করে দিচ্ছে।
হাসান বলল, চলে যাব?
মোতালেব এই প্রশ্নের জবাব দিল না-হাই তুলল। গুরুত্বহীন মানুষের সঙ্গে কথা বলার সময় গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের শরীরে অক্সিজেনের অভাব হয়। তাকে ঘন ঘন হাই তুলতে হয়। মোতালেব এই জন্যেই হাই তুলছে।
মোতালেব সাহেব আমি কি চলে যাব?
থাকুন কিছুক্ষণ। চা খান, দেখি স্যার কী বলেন।
হাসান বসে পড়ল। মোতালেবের এই ঘরটা ডাক্তারদের ওয়েটিং রুমের মতো। দেয়ালের সঙ্গে ঘেষে একসারি বেতের চেয়ার সাজানো। চেয়ারগুলোতে এককালে গদি ছিল–এখন নেই। ঘরের মাঝখানে একটা টেবিল। ভারি কালো রঙের টেবিলের ওপর ময়লা কয়েকটা ম্যাগাজিন। ঘরের এক কোনায় ছোট্ট টেবিল নিয়ে ডাক্তার সাহেবের অ্যাসিস্ট্যান্টের মতো বিরক্তমুখে মোতালেব বসে থাকে। মোতালেবের হাতে মুনশি। আমিরুদিনের লেখা চটি একটি বই, নাম ‘প্রেমের সমাধি’। বইটির কভারে একটা ফুটন্ত ফুলের ছবি। সেই ফুলের ওপর কুৎসিতদর্শন একটা পোকা উড়ছে। পোকাটার গায়ের রং ঘনকৃষ্ণ, চোখ টকটকে লাল। পোকাটা খুব সম্ভব ভ্রমর, তবে দৈত্যাকৃতির ভ্রমর। প্রেমের সমাধি নামের এই চটি বইটি মোতালেব গত দু মাস ধরে পড়ছে। হাসান ঠিক করে রেখেছে মোতালেব সাহেবের এই বই পড়া শেষ হলে সে বইটা তার কাছ থেকে ধার করে নিয়ে পড়ে দেখবে, ব্যাপারটা কী?
ডাক্তারের ঘরে যেমন ওষুদের গন্ধ থাকে, এই ঘরেও তেমনি ওষুধের কড়া গন্ধ। এই গন্ধ-রহস্য হাসান বের করেছে। ইনসেকটিসাইডের গন্ধ। বাগানের ফুলগাছে প্রতি সপ্তাহে একবার ক্ষেপ্ৰ করে ইনসেকটিসাইড দেয়া হয়। ইনসেকটিসাইডের বোতল এই ঘরের আলিমিরায় তালবন্ধ থাকে। আলমিরায় হাতে লেখা একটা নোটিশ আছে–
‘বিপদজণক’
জনক বানানে মূর্ধণ্য ন ব্যবহার করা হয়েছ বলেই বোধহয় নোটিশটা দেখলেই গা ছমছম করে। এই ঘরে সময় থেমে থাকে। পাঁচ মিনিট বসে থাকলেই মনে হয় পাঁচ ঘণ্টা বসে থাকা হয়েছে। হাসান নড়েচড়ে বসল। সময় থামা অবস্থাতেও অনেকক্ষণ পার হয়েছে।
মোতালেব সাহেব!
মোতালেব বই থেকে মুখ তুলল। তার দৃষ্টি অপ্রসন্ন, ভুরু কেঁচকানো। হাসান অপ্ৰস্তুত ভঙ্গিতে বলল, চলে যাব?
বাজে কটা?
সাড়ে তিনটা।
আরো পাঁচ-দশ মিনিট বসে চলে যান।
আপনি কি একটু জেনে আসবেন?
জেনে আসা যাবে না। এতদিন পর স্যারের মেয়ে এসেছে। স্যার মেয়ের সঙ্গে গল্প কৰ্ম্মশ্ৰমৰ কি কের আন উপস্থিত হব। বাংলগ ছাড়া কথা বলবেন না।
জ্বি আচ্ছা।
চারটা পৰ্যন্ত অপেক্ষা করুন। তিনটা থেকে চারটা এই এক ঘণ্টার পেমেন্ট নিয়ে হাসিমুখে চলে যাবেন। বাকিটা আমি দেখব।
জ্বি আচ্ছা। স্যারের মেয়ে দেখতে কেমন?
দেখতে কেমন তা দিয়ে আপনার কোনো দরকার আছে?
জ্বি না।
তাহলে জানতে চান কেন? স্যারের মেয়ে কালো কুৎসিত হলেও আপনার কিছু যায় আসে না, ডানাকাটা পরী হলেও না।
তা তো বটেই।
হাসান একটা ম্যাগাজিন হাতে নিল। সময় কাটানোর জন্যে রোমহর্ষক অপরাধের কাহিনী পড়া ছাড়া কোনো গতি নেই। অপরাধের কাহিনী ছাড়া এখন কোনো মাগাজিন প্ৰকাশিত হয় না। দেশে তেমন কোনো মজাদার অপরাধের কাহিনী পাওয়া না গেলে বিদেশী অপরাধের কাহিনী ছেপে দেয়া হয়। লস এঞ্জেলসে তিন সমকামী তরুণীর গোপন কাহিনী জাতীয় মজাদার কেচ্ছা।
আপনি কি হাসান সাহেব?
হাসান ধড়মড় করে উঠে দাঁড়াল।
এক শ ভাগ খাঁটি বাঙালি মেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে। কেউ না বলে দিলেও পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে এই মেয়ের নাম চিত্ৰলেখা। বাবার মতো টকটকে গায়ের রং না–শ্যামলা মেয়ে। মাথাভর্তি চুল–চুল নিয়ে সে খানিকটা বিব্রত। একটু পর পর মুটো করে চুল ধরছে। খুব সাধারণ সুতির শাড়ি পরেছে। মনে হচ্ছে এই সাধারণ শাড়িটা না পরলে তাকে মানাত না। সবচে’ মজার ব্যাপার মেয়েটির পায়ে স্যান্ডেল নেই। খালি পা। খালি পাতেও তাকে মানিয়েছে। মনে হচ্ছে কোনো স্যান্ডেলেই এই মেয়েকে মানাত না। এক ধরনের মানুষ আছে যাদের সবকিছুতেই মানায়। এও বোধহয় সে রকম কেউ।
আপনি হাসান সাহেব তো?
জ্বি।
আপনার না তিনটার সময় বাবার ঘরে যাবার কথা? আমি আপনার জন্যেই বসে ছিলাম।
আমার জন্যে?
জ্বি। আপনাকে বাবা কীসব গল্প বলেন এইসব আর আপনি কীভাবে নোট করেন তাও দেখব। ও আচ্ছা আমি তো আমার পরিচয় দিই নি। আমার নাম চিত্ৰলেখা।
জ্বি আমি বুঝতে পেরেছি।
কীভাবে বুঝলেন? ও আচ্ছা বোঝাটাই তো স্বাভাবিক। নিশ্চয়ই এর মধ্যে শুনে ফেলেছেন যে আমি এসেছি তাই না?
আসুন আমার সঙ্গে।
কোথায়?
বাবা আপনার জন্যে অপেক্ষা করছেন।
হাসান পেছনে পেছনে যাচ্ছে। তার খুব ইচ্ছে করছে জিজ্ঞেস করে–আপনি খালি পায়ে হাঁটছেন কেন? জিজ্ঞেস করল না। এ ধরনের প্রশ্ন করার মতো ঘনিষ্ঠতা মেয়েটির সঙ্গে হয় নি। কোনোদিন হবেও না।
হাসান সাহেব?
জ্বি।
আমেরিকার কেউ যদি আমার নাম জিজ্ঞেস করে আমি কী বলি জানেন? আমি বলি আমার নাম মিস পিকচার ড্র। আমার এই নামটিই এখন চালু। অনুবাদটা ভালো হয়েছে না?
জ্বি।
যান। আপনি বাবার সঙ্গে বসুন, আমি চা নিয়ে আসছি।
হিশামুদ্দিন সাহেব আজ একটা ধবধবে পাঞ্জাবি গায়ে বসে আছেন। হাসান তাকে খালি গায়ে দেখেই অভ্যস্ত। পাঞ্জাবিতে তাকে অন্যরকম লাগছে। তার সামনে পানের বাটাও নেই। হাসানের মনে হচ্ছে চিত্ৰলেখার উপস্থিতির সঙ্গে ঘটনা দুটি সম্পর্কিত।
স্যার স্নামালিকুম।
হাসান বস। আমার মেয়ের সঙ্গে কথা হয়েছে?
জ্বি।
আমার মেয়ের মধ্যে এমন কী দেখলে চোখে পড়ার মতো?
হাসান ইতস্তত করে বলল, উনি খালি পায়ে হাঁটছেন।
হিশামুদ্দিন হাসতে হাসতে বললেন–আরে দূর। খালি পায়ে হাঁটছে কারণ স্যান্ডেল খুঁজে পাচ্ছে না। ওর সবচে’ অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে ওর কাছে সব মানুষই চেনা। অতি আপন। তোমার সঙ্গেও নিশ্চয়ই খুব চেন্না ভঙ্গিতে কথা বলেছে। আমার বড় বোনের মধ্যেও এই ব্যাপারটা ছিল। আমার বড়বোনের নাম কি তোমার মনে আছে?
পুষ্প। ভালো নাম লতিফা বানু।
হ্যাঁ ঠিক আছে।
চিত্ৰলেখার খুব ইচ্ছা আমি তোমাকে কীভাবে গল্পগুলো বলি তা শুনবে। ও আসুক তখন তোমাকে আমার বড় বোনের একটা গল্প বলব।
জ্বি আচ্ছা।
তুমি টাকা-পয়সা ঠিকমতো পাচ্ছি। তো?
পাচ্ছি স্যার।
চিত্ৰলেখা চা নিয়ে ঢুকল। টি-পটভর্তি চা। দুধের পট, চিনির পট। হাসান অবাক হয় লক্ষ করল প্রথম চায়ের কাপটি চিত্ৰেলেখা তার বাবার জন্যে না বানিয়ে তার জন্যে বানাচ্ছে। খুব সাধারণ একটি ভদ্রতা। হাসানের মতো অভাজনের জন্যে এ ধরনের আদ্রতা চিত্ৰলেখার মতো মানুষরা করে না। তার প্রয়োজন নেই।
হাসান সাহেব আপনি কতটুকু চিনি খান?
তিন চামচ।
আজ প্রথমদিন বলে তিন চামচ দিচ্ছি–দয়া করে চিনি খাওয়া কমাবেন। আমি কিন্তু ডাক্তার। অকারণে উপদেশ দেই না। যখন প্রয়োজন তখনি উপদেশ দি।
হিশামুদ্দিন বললেন, তোর স্যান্ডেল পাওয়া গেছে?
চিত্ৰলেখা হাসিমুখে বলল, একপাটি পাওয়া গেছে–অন্য পাটি খোঁজা হচ্ছে।
হিশামুদ্দিন বললেন, তোর কি এক জোড়াই স্যান্ডেল?
হ্যাঁ। এক শ জোড়া স্যান্ডেল দিয়ে আমি কী করব? আমি কি লেডি ইমালডা? বাবা তোমার গল্প শুরু কর।
চিত্ৰলেখা ঠিক তার বাবার মতোই দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসেছে। একটা হাত তার গালে। সাধারণ নিয়ম হচ্ছে–যে গল্প বলে শ্রোতারা তার দিকেই তাকিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে নিয়মের ব্যতিক্রম করে চিত্ৰলেখা তাকিয়ে আছে হাসানের দিকে। তার চোখ চাপা কৌতুকে ঝিলমিল করছে। হিশামুদ্দিন গল্প শুরু করেছেন।
আমাদের নেত্রকোনার বাসায় একটা শিউলিগাছ ছিল। শিউলিগাছ জংলি ধরনের হয়। খসখসা পাতা–কুপড়ির মতো বড় হয়। জঙ্গলে জন্মালেই এই গাছগুলোকে মানাত। শিউলিগাছের আরো সমস্যা আছে–শুয়োপোকা। বৎসরের একটা সময়ে আমাদের শিউলিগাছ ভর্তি হয়ে যেত শুয়োপোকায়। সেই সময় বাবা ঠিক করতেন গাছ কেটে ফেলা হবে। বড় আপার জন্যে কাটা হতো না। শিউলি ফুল তার খুব প্রিয় ছিল। গাছটার ফুল ফোঁটাবার ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। শীতের সময় উঠোন ফুলে ফুলে ভরে থাকত। বড়। আপা বলতেন–জোছনার চাদর। যাই হোক এক বৎসর হঠাৎ কী হলো গাছটায় ফুল ফুটিল না। একটা ফুলও না। আমরা সবাই খুব অবাক হলাম–বড়। আপা হলেন অস্থির। গাছটায় একটা ফুলও ফুটবে না–এ কেমন কথা। প্রায় সময়ই দেখতাম কাজকর্ম সব ছেড়ে দিয়ে বড়। আপা গাছটার নিচে দাঁড়িয়ে থাকতেন। সেই শীতেই বড় আপা মারা গেলেন। অতি তুচ্ছ কারণেই তাঁর মৃত্যু হলো। বাথরুমে পা পিছলে পড়ে মাথায় ব্যথা পেলেন। সামান্য ব্যথা–তেমন কিছু না। রান্নাবান্না করলেন। আমাদের খাওয়ালেন। নিজে কিছু খেলেন না–তার নাকি শরীরটা ভালো লাগছে না, মাথা ঘোরাচ্ছে। তিনি বাতি নিভিয়ে বিছানায় শুয়ে রইলেন। তার আধঘণ্টা পর বাবাকে ডাকলেন। বাবা বিছানায় তার পাশে বসলেন। বড় আপা বললেন, বাবা তুমি আমার মাথার চুল বিলি করে দাও। তারপর হঠাৎ করে বললেন, বাবা আমি মরে যাচ্ছি। বাবা ভয় পেয়ে আমাদের সবাইকে ডাকলেন। তার ঘণ্টাখানিকের মধ্যেই বড়। আপা মারা গেলেন। নেত্রকেনা বড় মসজিদের গোরস্থানে তার কবর হলো। হতদরিদ্র পরিবারের মৃত্যুশোক স্থায়ী হয় না। সাতদিনের মাথায বাসার সব মােটামুটি ঠিক হয়ে গেল। সেই সময় একটা আনন্দের ব্যাপারও ঘটল-বাবা একটা চাকরি পেয়ে গেলেন। চাকরি তেমন ভালো না, তবে বাবা খুব উল্লসিত-কারণ এই চাকরিতে বাড়তি আয়ের সুযোগ-সুবিধা খুবই ভালো। মাছ সাপ্লাইয়ের কাজ। ভাটি অঞ্চলের বড় বড় মাছ কাঠের পেটিতে বরফ দিয়ে ভরে ঢাকা পাঠানো। বরফের প্যাকিং হয় রাতে। এর মধ্য দু-একটা মাছ এদিকওদিক করা যায়। তাতে কেউ কিছু মনেও করে না। এই ধরনের ক্ষতি হিসেবের মধ্যে ধরা থাকে। বাবা আনন্দিত গলায় বললেন–এইবার দেখা যাবে তোরা কে কত মাছ খেতে পারিস। মাছের বড় বড় পেটি খেয়ে দেখবি এক সময় মাছের ওপর ঘেন্না ধরে যাবে। তখন মাছের ছবি দেখলেও ‘ওয়াক থু’ করে বমি করে ফেলবি।
চাকরি শুরু করার তিন দিনের মাথায় বাবা বিশাল এক চিতল মাছ নিয়ে শেষরাত্রে বাসায় চলে এলেন। মহা উৎসাহে চিতল মাছ রান্না করলেন। সকালে নাশতার বদলে বারান্দায় পাটি পেতে চিতল মাছের পেটি দিয়ে আমরা ভাত খেতে বসলাম। আর তখনি আমার মেজো বোন ময়না চেঁচিয়ে বলল, দেখ দেখ! আমরা সবাই অবাক হয়ে দেখলাম শিউলি গাছের নিচটা ফুলে ফুলে সাদা হয়ে আছে। শিউলিগাছ আবার ফুল ফোঁটাতে শুরু করেছে।
হাসান আজ এই পর্যন্তই।
চিত্ৰলেখা বলল, হাসান সাহেব। আপনি কি আরেক কাপ চা খাবেন?
জ্বি না।
আপনি কি বাবার সব গল্প লিখে ফেলেছেন?
জ্বি।
পরের বার যখন আসবেন–লেখা কপিগুলো নিয়ে আসবেন। আমি একটু পড়ে দেখব। আপনি পরের বার কবে আসবেন?
আমি প্রতি বুধবারে আসি। আপনি বললে আমি কালই দিয়ে যাব।
প্লিজ। আমার খুব পড়ার ইচ্ছা। চলুন আমি আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।
না না এগিয়ে দিতে হবে না।
অবশ্যই এগিয়ে দিতে হবে। আমি খুবই ভদ্র মেয়ে।
হাঁটতে হাঁটতে চিত্রলেখা বলল, হাসান সাহেব!
জ্বি।
বাবার গল্পগুলো শুনতে আপনার কেমন লাগে?
ভালো লাগে।
বাবা খুব গুছিয়ে গল্প বলেন। লেখক হলেও তিনি খুব নাম করতেন।
জ্বি।
তবে আপনাকে একটা গোপন তথ্য দিচ্ছি—বাবার গল্পে কিছু বানানো ব্যাপার আছে। আপনি সামনে ছিলেন বলে আমি বাবাকে ধরলাম না। আপনি সামনে না থাকলে অবশ্যই ধরতাম।
হাসান বলল, কোন জিনিসটা বানানো?
ওই যে শিউলিগাছে বাবার বড় বোন পুষ্পের মৃত্যুর পর পর ফুল ফুটল।
বানানো বলছেন কেন?
কারণ এই গল্প বাবা আমাকেও বলছেন। তখন গল্পটা অন্য রকম ছিল।
কী রকম ছিল?
আমাকে বাবা বলেছিলেন–তাঁর বড় বোনের মৃত্যুর পর আমাদের দাদাজানের সব রাগ গিয়ে পড়ল গাছটার ওপর–তিনি পাগলের মতো সামান্য মাছকাটা বঁটি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে গাছটা কেটে ফেললেন।
ও আচ্ছা–উনি হয়তো ভুলে গেছেন।
এ রকম একটা বড় ঘটনা ভুলে যাবার কথা তো না।
সবগুলো ডাল হয়তো কাটা হয় নি–একটা রয়ে গিয়েছিল। সেই ডালে ফুল ফুটেছে।
চিত্ৰলেখা খিলখিল করে হসছে। অনেক কষ্টে হাসি থামিয়ে বলল, বাবাকে তো আপনি দেখি আমার চেয়েও বেশি পছন্দ করেন। এখন একটা ব্যাপার পরিষ্কার হলো।
হাসান ভীত গলায় বলল, কোন ব্যাপার?
বাবা আপনাকে এত পছন্দ করেন কেন সেই কারণটা ধরা গেল। আপনি বাবাকে পছন্দ করেন বলেই বাবা আপনাকে পছন্দ করেন। পছন্দ-অপছন্দের ব্যাপার মানুষ খুব সহজেই ধরতে পারে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপনার সঙ্গে অনেক গল্প করে ফেললাম। এখন আপনি চলে যান।
চিত্ৰলেখা হাসানকে গোট পর্যন্ত এগিয়ে দিল। খালি পায়ে সে হাঁটছে–হাসানের আবারো মনে হলো এই মেয়ে খালি পায়ে না হেঁটে স্যান্ডেল পায়ে হাঁটলে তাকে মোটেও মানাত না।
দিনটা মেঘলা।
সারাদিন মেঘ ছিল না। এখন কোথেকে গাদা গাদা মেঘ আকাশ অন্ধকার করে ফেলেছে। হাসানের মনে হলো নীল রঙে আকাশকে মানায় না, কালো রঙেই মানায়।
হাসানের হাঁটতে ভালো লাগছে। মেঘলা দিনের বিকেলে হাঁটতে ভালো লাগে। শুধু সারাক্ষণ মনে হয়। একজন প্ৰিয় কেউ পাশে থাকলে আরো ভালো লাগত। তিতলীর বাসায় গিয়ে দেখা যেতে পারে। তাকে যদি কোনোভাবে শুধু বলা যায় –তিতলী আমার খুব ইচ্ছা করছে তোমাকে নিয়ে হাঁটতে। সে যে করেই হোক একটা ব্যবস্থা করবে। তারা হাঁটবে মেঘের দিকে তাকিয়ে। ওই যে একটা গান আছে না–মেঘ বলেছে যাব যাব। ওই গানটা দুজনই মনে মনে গুনগুন করবে।
হাসান সাত টাকা দিয়ে বড়.একটা গোলাপ কিনল। গোলাপ যে এত বড় হয় তার ধারণা ছিল না। মনে হচ্ছে বোম্বাই গোলাপী। বড় বলেই দাম বেশি। প্ৰমাণ সাইজের গোলাপ চার টাকা করে বিক্রি হচ্ছে–এই গোলাপ সাত টাকা। প্রায় ডাবল দাম। গোটা দশেক। কিনতে পারলে তিতলী হতভম্ব হয়ে যেত। টাকা নেই। সাত টাকা খরচ করতেও গায়ে লাগছে।
সাত টাকায় সাত কাপ চা খাওয়া যায়। এক প্যাকেট সন্তা সিগারেট কেনা যায়। এক ডজন দেয়াশলাই কেনা যায়। সাত টাকার এই বোম্বাই গোলাপী একদিনে বাসি হয়ে যাবে। মনে হবে গোলাপটার খারাপ ধরনের ডায়রিয়া হয়েছে। তারপরেও ফেলা হবে না। রেখে দেয়া হবে। তিতলীর যা কাণ্ডকারখানা পাপড়িগুলো সে হয়তো কোনোদিনও ফেলবে না। কোনো এক গল্পের বইয়ের পাতার ভাঁজে ভঁাজে রেখে দিয়ে ভুলে যাবে। হঠাৎ একদিন বই ঝাড়তে গিয়ে পাতায় পাতায় পাওয়া যাবে গোলাপের পাপড়ির অপূর্ব শুটকি। হাসানের মনে হলো একটা গোলাপ নিয়ে যাওয়া ঠিক হচ্ছে না। এক হচ্ছে অমঙ্গলসূচক। এক মানেই একা। সবচে’ মঙ্গলসূচক সংখ্যা হলো দুই। দুই মানেই আমি এবং তুমি। পনেরটা টাকা চলে যাবে। তার সঙ্গে আছে কুড়ি টাকার একটা নোট। ফেরার সময় ফিরতে হবে হেঁটে হেঁটে। হাঁটা মন্দ কী? তিতলীর সঙ্গে দেখা হবার পর হেঁটে হেঁটে ফিরতে খারাপ লাগবে না।
হাসান ফুলওয়ালাকে বলল, ভাই ঠিক এই সাইজের আরেকটা গোলাপ দিন। এই গোলাপগুলোর নাম কী বলুন তো? ফুলওয়ালা বিরস গলায় বলল, তাজমহল।
গোলাপের নাম তাজমহল ঠিক বিশ্বাসযোগ্য না। মোতালেব সাহেবকে একদিন জিজ্ঞেস করতে হবে। তিনি যেহেতু বাগানে বিষ প্রে করেন তিনি জানবেন। হিশামুদ্দিন সাহেবের মেয়েটিও জানতে পারে। তাকে দেখলেই মনে হয় এই মেয়ে সব জানে। কোনো কিছু জিজ্ঞেস করলে হাসিমুখে বলে দেবে।‘
দুবার কলিংবেল টিপতেই দরজা খুলল। দরজা খুলে দিল নাদিয়া। হাসান বলল, কেমন আছে নাদিয়া?
নাদিয়া জবাব দিল না। হাসান জানে নাদিয়া জবাব দেবে না। এই মেয়েটা অসম্ভব লাজুক। তবে একবার কথা শুরু করলে ফড়িফড় করে অনেক কথা বলে। ওই দিন খুব কথা বলেছে।
তোমার প্রিপারেশন কেমন হলো?
জ্বি ভালো।
সব বই নিশ্চয়ই ঠোঁটস্থ হয়ে গেছে? নাদিয়া জবাব দিল না। চোখ বড় বড় করে হাসানের দিকে তাকিয়ে রইল। হাসানের একটু অস্বস্তি লাগছে। এই মেয়েটা কখনো তো এ রকম করে তাকায় না। ব্যাপারটা কী?
তিতলী বাসায় আছে?
জ্বি না।
কোথায় গেছে? তার ফুফুর বাসায়?
জ্বি না। হাসান ভাই আপনি বসুন আপনাকে সব বলছি।
হাসান হঠাৎ বুকে একটা ধাক্কা খেল। তিতলীর কি কোনো অসুখ-বিসুখ করেছে? হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়েছে? নাকি তারচেয়েও খারাপ কিছু? না তারচে’ খারাপ কিছু না। তারচে’ খারাপ কিছু হলে নাদিয়া এমন সহজভাবে কথা বলতে পারত না কিন্তু সহজভাবে সে কি কথা বলছে?
কী হয়েছে নাদিয়া?
আপার কাল রাতে হঠাৎ করে বিয়ে হয়ে গেছে। ফুফু একটা ছেলের সঙ্গে কথাবার্তা বলছিলেন–সেই ছেলের সঙ্গে.
তিতলীর বিয়ে হয়ে গেছে?
জ্বি।
ও এখন তার শ্বশুরবাড়িতে?
জ্বি।
ও আচ্ছা। নাদিয়া আমি তাহলে আজ যাই।
হাসান ভাই প্লিজ আপনি এক সেকেন্ডের জন্যে হলেও বসে যান। আপনি এইভাবে চলে গেলে আমি সারা রাত কাঁদব।
হাসান কিছু বলল না। বসল। তার কেমন অদ্ভুত লাগছে। তার মনে হচ্ছে এই ঘরের আলো হঠাৎ অনেক বেড়ে গেছে। ঘরের এক প্রান্তে ষাট পাওয়ারের বাতি জ্বলছে না।
জ্বলছে ফ্লাডলাইটের তীব্র আলো। সেই আলো চোখে লাগছে। চোখ জ্বালা করছে। খুব ঠাণ্ড পানি চোখেমুখে ছিটাতে পারলে ভালো লাগত।
হাসান ভাই!
হুঁ।
চা খাবেন হাসান ভাই? আপনার জন্যে এক কাপ চা নিয়ে আসি?
মেয়েটা এভাবে কথা বলছে কেন? মনে হচ্ছে সে কেঁদে ফেলবে। কেঁদে ফেলার মতো কিছু হয় নি। তিতলী একটা সমস্যায় পড়ে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছে। এ রকম সমস্যা তো হতেই পারে।
নাদিয়া আমি চা খাব না। তবে একটু পানি খাওয়াতে পার, খুব তৃষ্ণা লেগেছে। আচ্ছা থাক পানি লাগবে না।
হাসান ভাই আপনি বসুন। আমি এক্ষুণি পানি এনে দিচ্ছি।
নাদিয়া ছুটে বের হয়ে গেল। আর প্রায় তৎক্ষণাৎ হাসানের মনে হলো তিতলী এ বাড়িতেই আছে। নাদিয়া ছোট্ট একটা মিথ্যা বলেছে। তার বিয়ে হয়ে গেছে এটা ঠিক সে এখনো শ্বশুরবাড়িতে যায় নি। এই মিথ্যাটার হয়তো প্রয়োজন ছিল।
হাসানকে নাদিয়া গোট পৰ্যন্ত এগিয়ে দিতে এল। হাসান বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করল নাদিয়া কাঁদতে কাঁদতে তার সঙ্গে আসছে। হাসান বলল, কাঁদছ কেন নাদিয়া?
নাদিয়া গায়ের ওড়নায় চোখ মুছল। কিছু বলল না। হাসান বলল, তিতলী ঘরেই আছে তাই না?
নাদিয়া ক্ষীণস্বরে বলল, জ্বি।
ওকে বোলো–সব ঠিক হয়ে যাবে। ভাগ্যে যা ছিল তাই হয়েছে ও যেন মন খারাপ না করে।
আপনি ভালো থাকবেন হাসান ভাই।
ভালো থাকব। তুমি মন দিয়ে পড়াশোনা কোরো। আমি জানি তুমি খুব ভালো রেজাল্ট করবে।
কী করে জানেন?
আমার মন বলছে।
হাসান ভাই, আপনি আপার ওপর রাগ করে থাকবেন না।
না রাগ করব কেন? যাই নাদিয়া?
হাসান এগোচ্ছে। ঠিকমতো পা ফেলতে পারছে না। টিপটিপ বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। আশ্চৰ্য কাণ্ড যখনই সে তিতলীর কাছে আসে তখনই বৃষ্টি হয়।
হাসান হঠাৎ থমকে দাঁড়াল। তিতলীদের বাসাটা একবার তাকিয়ে দেখতে ইচ্ছা! করছে। সবসময় এই জায়গা থেকে সে পেছনে ফিরে তাকায়। আরেকটু এগোলে তিতলীদের বাসা আড়ালে পড়ে যাবে আর দেখা যাবে না। হাসান যতবারই এখান থেকে তাকিয়েছে ততবারই দেখেছে তিতলী বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। আজ নিশ্চয়ই দেখা যাবে শুধুমাত্র কেন আর কোনোদিনই দেখা যাবে না। হাসানও আর আসবে না। আসা ঠিক হবে না।
তিতলীর বাবা নিশ্চয়ই মেয়ের বিয়ে উপলক্ষে একটা অনুষ্ঠান করবেন। সেই অনুষ্ঠানে তার দাওয়াত হবে না। তিতলী এমন হৃদয়হীন কাণ্ড কখনো করবে না। ভালো কোনো উপহার তার অবশ্যি দিতে ইচ্ছে করছে। টাকা থাকলে তিতলীকে সে একটা হারমোনিয়াম কিনে দিত। মেয়েটার হারমোনিয়ামের খুব শখ ছিল। তার স্বামী নিশ্চয়ই তিতলীর সেই শখ মেটাবেন। মানুষের সবচেয়ে প্রিয় ইচ্ছা প্রকৃতি সবসময় পূর্ণ করে।
তিতলী কী গানটা জানি তাকে শোনাতে চেয়েছিল? হাসান কিছুতেই মনে করতে পারছে না–মেঘ বলেছে যাব যাব, মেঘের পরে মেঘ জমেছে? নাকি অন্য কোনো গান? না এটা না অন্য কী একটা গান। আশ্চর্য মনে পড়ছে না। হাসান মাথার ভেতর তীব্ৰ চাপ অনুভব করছে। গানের লাইনগুলো মনে না পড়লে কিছুতেই মনের এই চাপ কমবে না। একবার চট করে তিতলীকে জিজ্ঞেস করে এলে কেমন হয়। না না তিতলীর সঙ্গে সরাসরি কথা বলা ঠিক হবে না। সে জিজ্ঞেস করবে নাদিয়াকে। নাদিয়া তার আপার কাছ থেকে জেনে আসবে।
হাসান পেছন দিকে তাকাল। বারান্দায় কেউ দাঁড়িয়ে নেই।
বৃষ্টির ফোঁটা বড় বড় হয়ে পড়তে শুরু করেছে। হাসান এগোচ্ছে ক্লান্ত ভঙ্গিতে।