জরী বলল, আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না। আমরা রেল স্টেশনে বসে আছি কেন?
রানা রাগী গলায় বলল, রেল স্টেশনে বসে আছি, কারণ এক জায়গায় বসে আলাপ-আলোচনা করে ডিসিশান নিতে হবে।
কী ডিসিসান?
ডিসিশান হচ্ছে—আমরা কি আজ রাতেই কক্সবাজার রওনা হব, না। আজ রাতটা চিটাগাং-এ থেকে পরদিন ভোরে রওনা হব।
ডিসিশান নিচ্ছ না কেন?
হুট করে তো আর ডিসিশান নেয়া যায় না। চিন্তা-ভাবনার ব্যাপার আছে। আনুশকা, তোমার কী মত?
আনুশকা হাই তুলতে তুলতে বলল, তুমি হচ্ছে দলপতি। তুমি ডিসিশান নেবে। তুমি যা বলবে তাই হবে। তুমি যদি বলো, রাত তিনটায় রওনা হবে।– ফাইন উইথ মি?
বল্টু বলল, আমাদের খাওয়া-দাওয়ার কী হবে রে রানা? খিদেয় মরে যাচ্ছি।
খিদেয় মরে যাবি কী জন্যে? একটু আগে সবাইকে দেড় ফুট সাইজের একটা কলা খাওয়ালাম না?
এই কলাই কি আমাদের ডিনার?
আচ্ছা একটা কথা, আমরা কি খাওয়া-দাওয়া করার জন্যে বের হয়েছি, না। আমাদের অন্য উদ্দেশ্যও আছে?
নীরা বলল, ক্ষুধার্ত অবস্থায় কিছুই ভালো লাগে না রানা। সুকান্তের মতো কবির কাছেও ক্ষুধার্ত অবস্থায় পূর্ণিমার চাঁদকে ঝলসানো রুটির মতো মনে হয়েছে।
হবে, খাবার ব্যবস্থাও হবে। আগে বাসার খোঁজখবর করে দেখি। মোতালেব, তুই আয় আমার সঙ্গে।
আমি যাব। কী জন্যে? আমি তো আর দলপতি না, কিংবা দলপতির অ্যাসিসটেন্টও না।
রানা রাগ করেও বের হয়ে গেল।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এখন কক্সবাজারে রওনা হওয়া ঠিক হবে না। পথে কোনো বিপদ-আপদ হয় কি-না কে বলবে? জঙ্গলের ভেতর গাড়ির চাকা পাংচার হয়ে গেলো। চাকা ঠিক করা হচ্ছে, এর মধ্যে বেরিয়ে এলো একদল ডাকাত। সঙ্গে এতগুলি মেয়ে. রিস্ক নেয়া যাবে না। রাতটা এখানেই থাকতে হবে। স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে কাটাতে হবে। হোটেল নেয়ার প্রশ্নই আসে না। এত টাকা হোটেলওয়াকে সে কেন খামাখা দেবে? তা ছাড়া অনেক টাকা বাজেটের অতিরিক্ত খরচ হয়েছে। আগে যে বাসা ঠিক করা হয়েছিল তাকে টাকা দিতে হয়েছে। আর একটা রাত স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে কাটানো এমন কিছু না।
রানা ভোরে রওনা হবার জন্যে বারো সিটারের একটা লক্কর মুড়ির টিন মার্কে মাইক্রোবাস ঠিক করল। সে-ই সবচে কম ভাড়ায় যেতে রাজি হয়েছে।
রাতের খাবার কিনে ফিরল। পরোটা-গোসত।
আনুশকা পরোটা হাতে, গোল গোল এই জিনিসগুলি কি?
রানা থমথমে গলায় বলল, কেন, পরোটা কখনো খাওনি?
খেয়েছি। লোহার তৈরি পরোটা খাই নি। এইগুলি কীভাবে খায়?
খেতে না চাইলে খাবে না। আমাকে বাজেটের দিকে লক্ষ রাখতে হবে। পোলাও-কোৰ্মা খাওয়ানো সম্ভব না। খিদে লাগলে খাবে, না লাগলে নাই।
গোশতগুলিও তো মনে হচ্ছে প্লাস্টিকের।
রানা বলল, সবাই হাতে হাতে নিয়ে নাও-পারহেড দুটা করে পরোটা।
নইম কিছুই খেল না। সে ঢাকা চলে যাবে। কিছুতেই থাকবে না। তাকে টিকেট কেটে রাতের ট্রেনে তুলে দিলেই হবে। তাকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, সে বুঝ মানছে না।
নীরা বলল, এত কাছে এসে ফিরে যাবি?
হ্যাঁ, ফিরে যাব।
এখন তো আর কোনো সমস্যা নেই।
সমস্যা নেই, সমস্যা হবে। আমার শিক্ষা হয়ে গেছে।
নীরা বলল, দেখ নইমা, দারুচিনি দ্বীপ হচ্ছে আমাদের জন্যে একধরনের তীর্থ। তীর্থে যাবার জন্যে সবাই মন ঠিক করে অনেকে রওনাও হয়, কিন্তু তার পরেও সবার তীর্থ-দর্শন হয় না। তুই এত বড় সুযোগ হেলায় হারাবি?
হ্যাঁ, হারাব। আমি এত পুণ্যবান নাই যে তীর্থ-দর্শন করব। তোরা যা।
তুই সত্যি যাবি না?
না। ঠিক হলো, নইম ঢাকায় ফিরে যাবে। তার গায়ে জ্বর এবং বেশ ভালো জ্বর। তাকে একা একা ছেড়ে দেয়া যায় না। ছেলেদের একজন-কাউকে সঙ্গে যেতে হবে। কে যাবে সঙ্গে? রানা বলল, লটারি হবে। লটারিতে যার নাম উঠবে, সে যাবে। এটা ফাইন্যাল ডিসিশান। এ ছাড়া উপায় নেই। কাগজের টুকরায় সব ছেলের নাম লেখা থাকবে। নইমা চোখ বন্ধ করে একটা নাম তুলবে। যার নাম উঠবে তাকে যেতেই হবে।
লটারি হল। নাম উঠল রানার। তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল।
সঞ্জু বলল, দলপতি চলে গেলে আমাদের হবে কী করে? দলপতিকে তো যেতেই হবে। রানা থাকুক, আমি যাব।
রানা ক্ষীণ গলায় বলল, তুই যাবি?
সঞ্জু বলল, যে সব ব্যবস্থা করল, তা ছাড়া আমার চাকরির একটা ইন্টারভ্যুও আছে। তার প্রিপারেশন দরকার।
রানা বলল, তোরা কি মিষ্টিপান খাবি? পান নিয়ে আসি। রানা পান আনার কথা বলে সরে পড়েছে—কারণ তার চোখে পানি এসে গেছে। সঞ্জটা এত ভালো কেন?
মানুষকে এত ভালো হতে নেই। মানুষকে কিছুটা খারাপ হতে হয়। সঞ্জুর ইন্টারভ্যু—এইসব বাজে কথা। সে এই কাজটা করল তার দিকে তাকিয়ে।
ঢাকাগামী তুর্ণ নিশীথা ছেড়ে দিচ্ছে। দরজা ধরে সঞ্জু দাঁড়িয়ে আছে। সঞ্জুর মুখ হাসি হাসি। সে হাত নাড়ছে। রানার খুব ইচ্ছা করছে টেনে সঞ্জুকে নামিয়ে সে লাফ দিয়ে উঠে পড়ে। কিন্তু সে জানে এই কাজটা সে পারবে না। সবার লোভ হয়, করতে পারে না। এই পৃথিবীতে খুব অল্পসংখ্যক মানুষই আছে যারা জীবনের মোহের কাছে পরাজিত হয় না। সে সেই অল্প কজনের একজন নয়। তার জন্ম হয়েছে—লোভের কাছে, মোহের কাছে বারবার পরাজিত হবার জন্য।