১১. রান্নাঘরে নিশানাথবাবুর স্ত্রী

রান্নাঘরে নিশানাথবাবুর স্ত্রী চারদিকে বাসনপত্র ছড়িয়ে কী-সব যেন করছেন। বাবুর্চি গোমেজ, চোখ-মুখ কুঁচকে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে। গোমেজ এই মহিলাটিকে পছন্দ করছে না। এই মহিলা সরাসরি তার সাম্রাজ্যে হস্তক্ষেপ করছে। যখন-তখন রান্নাঘরে ঢুকে জিনিসপত্র এলোমেলো করে দিচ্ছে। এখন আর কোনো কিছুই হাতের কাছে পাওয়া যায় না। গতকাল। লবণের কৌটা খুঁজতে তার দশ মিনিট লেগেছে। অথচ লবণের কৌটা থাকে। দ্বিতীয় তাকের সবচেয়ে প্রথমে। আগে চোখ বন্ধ করে বের করতে পারত।

গোমেজ।

জি।

দেখছি কী তুমি? ব্যাটাছেলের রান্নাঘরে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা বড় খারাপ লাগে।

আমার কাজই তো রান্নাঘরে!

ও, আচ্ছা। তাই তো, মনে থাকে না। তুমি রান্না শিখেছি কার কাছে?

গোমেজ জবাব দিল না। ভদ্রমহিলা চালের গুড়োয় পানি ছিটাতে-ছিটাতে বললেন, বাঙালি রান্না কিছু জানো, না। শুধু সাহেবি রান্না?

এই প্রশ্নেরও সে জবাব দিল না। কঠিন মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। উড়ে এসে জুড়ে বসা এই মহিলাটি বড় যন্ত্রণা দিচ্ছে।

গোমেজ, তুমি যাও তো, অপালাকে ডেকে নিয়ে এসো। বলো, ভাপা পিঠা বানাচ্ছি, সে যেন দেখে যায়। তাকে শিখিয়ে দেব।

আমি রান্না ছাড়া অন্য কাজ করি না।

এটা কেমন কথা! তুমি ডেকেও আনতে পারবে না?

জি না। তা ছাড়া আমাদের দোতলায় যাওয়া নিষেধ আছে। শুধু রমিলা দোতলায় যেতে পারে।

এইসব নিয়ম-কানুন কে করেছে?

বড় সাহেব।

বড় সাহেব তো এখন নেই, তুমি যাও ডেকে নিয়ে এস। এ রকম হাবার মত দাঁড়িয়ে থেকে না।

গোমেজ বের হয়ে এল, কিন্তু দোতলায় উঠল না। নিজের ঘরে ঢুকে দরজা ভিড়িয়ে দিল। গোমেজের ঘর মূল বাড়ির দক্ষিণে আলাদা দু’টি কামরা। একটিতে শোবার ব্যবস্থা, অন্যটিতে রান্নার। এ বাড়িতে মোট আট জন কাজের লোকের জন্যে আলাদা রান্না হয়। সেই রান্নাও গোমেজ করে। গোমেজ ঠিক করল। আজ সে কোনো রান্নাবান্না করবে না। তার এ-রকম অভ্যেস আছে। মাঝে মাঝে মেজাজ বিগড়ে গেলে এ রকম করে। রান্না তো শুধু হাঁড়িতে কিছু জিনিস ফেলে নাড়াচাড়া করা নয়। এটা খুব কঠিন ব্যাপার। মন বসাতে হয়। তা সবসময় সম্ভব হয় না। আজ যেমন হবে না। আজ সে দরজা বন্ধ করে বসে থাকবে। গোপনে কিঞ্চিৎ মদ্যপান করবে। এই অভ্যেসও তার পুরনো।

নিশানাথবাবুর স্ত্রী অনেক্ষণ অপেক্ষা করে নিজেই অপালার খোঁজে গেলেন। মেয়েটি তাকে পছন্দ করে না, কিন্তু তার প্রচণ্ড মায়া পড়ে গেছে। পাগলা-পাগলা ধরনের মেয়ে। এক-একা থেকে কেমন যেন হয়ে গেছে।

অপা, কি করছ তুমি?

পড়ছি কাকিমা, আজ আমার ফিফথ পেপার পরীক্ষা।

ও-মা! কই, আমি তো জানি না।

আপনি জানবেন কেন? আপনার তো জানার কথা নয়।

পরীক্ষা কখন?

বিকেলে দুটার সময় আরম্ভ হবে, শেষ হবে। পাঁচটায়।

তাহলে তো আমার দুপুরের খাবার ব্যবস্থা তাড়াতাড়ি করতে হয়।

আপনি ব্যস্ত হবেন না কাকিমা, পরীক্ষার আগে আমার খুব টেনশান থাকে, আমি কিছু খেতে পারি না।

সে কী কথা! কিছুই খাবে না?

একটু চা খাব, একটা স্যান্ডউইচ খাব। ঐ নিয়ে আপনি ভাববেন না।

দৈ আছে কি না ঘরে, কে জানে। দৈ খেলে পেটটা ঠাণ্ডা থাকবে। দাঁড়াও, আমি দৈায়ের ব্যবস্থা করছি। ঘরে-পাতা দৈ। তোমার ম্যানেজার কাকু ঘরে-পাতা দৈ ছাড়া খেতে পারে না।

আপনাকে কোনো ঝামেলা করতে হবে না।

ঝামেলা কিছু না। যাব। আর নিয়ে আসব। গাড়ি তো আছেই।

অপালা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আপনি যখন বেরুচ্ছেন, তখন একটা কাজ করতে পারবেন?

পারব না। মানে! কী কাজ?

দামি একটা শাড়ি কিনে আনতে পারবেন? যেন খুব ভাল হয়।

তোমার জন্যে।

না, আমার জন্যে না। আমি একজনকে উপহার দেব?

কাকে?

অপালা মনে-মনে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। এই মহিলাকে কিছু বলাই বোকামি। এক লক্ষ প্রশ্ন করবে। বিরক্ত করে মারবে।

কাকে দেবে শাড়ি?

এক ভদ্রলোক তার মেয়ের বিয়েতে দাওয়াত দিয়ে গিয়েছেন। ভদ্রলোককে আমি চিনি না। খুব আগ্রহ করে দাওয়াত দিয়েছেন। খুব মায়া লেগেছে। তা ছাড়া বাবা এখানে থাকলে নিশ্চয়ই কিছু-একটা দিতেন।

উনি যখন নেই, তখন তোমার এত মাথাব্যথা কেন?

আপনি না-পারলে ম্যানেজার কাকুকে বলুন।

পারব না কেন? কত টাকার মধ্যে কিনবা?

আগেই তো বলেছি, দামি একটা শাড়ি।

একেক জনের দামি তো একেক রকম মা। আমার কাছে তো তিন শ টাকা দামের শাড়িই মনে হয় অনেক দামি।

আপনি পছন্দ করে কিনুন। আর কাকিমা, এখন যান। আমি পড়ছি, একটা চ্যাপ্টার এখনো বাকি।

মেয়েটা কেমন, ফর্সা না কালো? শাড়ি তো সেইভাবেই কিনতে হবে।

আমি মেয়েটাকে দেখিনি। বাঙালি মেয়ে যে-রকম হয়, সে-রকম হবে। খুব বেশি ফর্সা নয়, কালোও নয়। কাকিমা, আপনি এখন যান।

ভাপা পিঠা খাবে? ভাপা পিঠা বানাচ্ছি।

আমি এখন কিছু খাব না।

আজ অপালার ফিফথ পেপার। এই পেপারেই তার প্রিপারেশন সবচেয়ে কম। পরীক্ষা খুব খারাপ হবে। একটা চ্যাপ্টার এখনো পুরো বাকি। পরীক্ষার ঠিক আগে আগে পড়বে ভেবেছিল, যাতে মনে থাকে, এলোমেলো না-হয়ে যায়। কিন্তু সকাল থেকেই একটার পর একটা ঝামেলা। বই নিয়ে বসার সঙ্গে সঙ্গে একটা মেয়ে ফোন করল। অপালা হ্যালো বলামাত্র একনাগাড়ে কথা বলতে লাগল নমিতা, আজ কী হয়েছে শোন। ভাই, আমার মরে যেতে ইচ্ছা করছে। এত অপমানিত হয়েছি! আমি আমার জীবনে এত অপমানিত হইনি।–বিশ্বাস কর, এক ঘণ্টা কেঁদেছি। রিকশায় কাঁদতে কাঁদতে এসেছি। রাস্তায় সমস্ত লোক আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। রিকশাওয়ালা পর্যন্ত ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখেছে…

অপালা বলার সুযোগই পেল না যে এটা রঙ নাম্বার, আর তার নাম নমিতা নয়। মেয়েটা নিজের কথা বলতে-বলতে ফোঁপাতে শুরু করল। কী অস্বস্তিকর অবস্থা! অপালা বলল, শুনুন, আমার নাম নমিতা নয়। আপনার রঙ নাম্বার হয়েছে।

ফোনের ও-পাশে মেয়েটি যেন নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। সে ক্ষীণ স্বরে বলল, আপনি কে?

আমার নাম অপালা।

ও, আচ্ছা। আপনি আমার এইসব কথা কাউকে বলবেন না, প্লিজ।

  • কী অদ্ভুত কথা! অপালা কাকে এ-সব কথা বলবে? আর বললেই-বা কী? কে চিনবে এই। মেয়েকে?

ফোন রেখে বই নিয়ে বসেও মেয়েটির কথা মনে হতে লাগল। বইয়ে মন বসছে না। পড়ে যাচ্ছে, কিন্তু পড়াটা মনে ধরছে না। তখন টঙ্গির কারখানা থেকে টেলিফোন। মিজান বলে কে এক লোক! সুপারভাইজার। তাকে অপালা কোনো দিন চোখেও দেখেনি। লোকটি তাকে ম্যাডাম ডাকছে। অপালা কঠিন স্বরে বলল, আমাকে ফোন করেছেন কেন? আমার সঙ্গে আপনার কী দরকার?

ম্যাডাম, একটা খুব বড় ঝামেলা হয়েছে।

কি কামেলা?

অফিসার লেভেলের সবাইকে শ্রমিকরা একটা ঘরে ঢুকিয়ে তালা দিয়ে দিয়েছে। ঘেরাও।

আমাকে এটা জানাচ্ছেন কেন? আমি কী করব?

না, মানে, আপনার কিছু করার নেই। আমরা পুলিশে খবর দিয়েছি। শুধু আপনাকে জানিয়ে রাখলাম।

আমাকে জানিয়ে রাখার কোনো দরকার নেই। প্লিজ, আমাকে শুধু শুধু বিরক্ত করবেন না।

ম্যাডাম, ভেরি সরি।

অপালা টেলিফোন নামিয়ে রাখল। এত ঝামেলা নিয়ে কিছু করা যায়? বারটা পর্যন্ত একনাগাড়ে পড়বে ভেবেছিল সে। এগারটা বাজতেই উঠে পড়ল। বাগানে রোদে খানিক্ষণ হাঁটল। মালী বলল, ফুল দেব। আপা? বলেই সে অপেক্ষা করল না, বিরাট বড় একটা গোলাপ ছিঁড়ে দিল। এত সুন্দর একটা গোলাপ হাতে নিলে কেমন মন খারাপ হয়ে যায়।

আরো দেব। আপা?

না আর লাগবে না।

অপালা গোলাপ হাতে নিয়ে বাগানে হাঁটছে। অরুণা এবং বরুণা অলস পায়ে তার পেছনে পেছনে হাঁটছে। শীতের দিনের ঝকঝকে সোনালি রোদে এদেব তিন জনকে চমৎকার লাগছে। মালি কাজ ভুলে এদের দিকে তাকিয়ে আছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *