১১. রাজকর্মচারী বনাম সরকারি কর্মচারী

রাজকর্মচারী বনাম সরকারি কর্মচারী

০১.

উজ্জয়িনী। শহরের কোলাহল থেকে একটু দূরে একটি প্রকাণ্ড বাড়ি। বাড়িটি দেখলে বোঝা যায় বাড়ির কর্তা এককালে ভালোরকম বড়োলোক ছিলেন, কিন্তু অবস্থার দুর্বিপাকে এখন এই বাড়ি সংস্কার করাও তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। বাড়ির দেয়ালগুলো নোনা ধরে গেছে, দরজাটা নড়বড় করছে এবং খোলা রয়েছে। যেন চুরি যাবারও ভয় নেই। বাড়ির কর্তা ব্রাহ্মণ। তিনি এই মুহূর্তে বেরিয়েছেন, কিন্তু তার ঘরে এসেছেন উজ্জয়িনী নগরীর শ্রেষ্ঠা গণিকা বসন্তসেনা। অসামান্যা সুন্দরী বলেই নগরীর শ্রেষ্ঠা গণিকার পদ বসন্তসেনা লাভ করেছেন বটে, কিন্তু এই বৃত্তি তার ভালো লাগে না। তিনি এই বাড়ির মালিক দরিদ্র চারুদত্তকে ভালোবাসেন।

চারুদত্ত তার গাড়ির কোচোয়ানকে আদেশ দিয়ে গেছেন যে, সে যেন বসন্তসেনাকে নগরীর বাইরে একটি জীর্ণোদ্যানে নিয়ে যায়। সেখানেই তাঁদের দেখা হবে। প্রভুর কথামতো কোচোয়ান একটি গোরুর গাড়ি নিয়ে এসেছিল, কিন্তু গণিকা বসন্তসেনার যেতে একটু দেরি হবে। আসলে চারু দত্তের বাড়িতে এসে তিনি তার সমস্ত অলংকার খুলে ফেলেছিলেন, কিন্তু এখন জীর্ণোদ্যানে নিগূঢ় প্রিয়মিলনের আশায় তিনি একটু সেজেগুজে যেতে চান, তাই একটু দেরি হবে। ওদিকে কোচোয়ান তাড়াহুড়ো করে গোরুর গাড়ির ছইটি গাড়িতে লাগিয়ে আনতে ভুলে গিয়েছিল। সে দেখল–মাকিনের যখন দেরিই হবে, তখন এই অবসরে আচ্ছাদনটি নিয়ে এলেই হয় কারণ আচ্ছাদন আনতে হবেই,নইলে বসন্তসেনা যাবেন কী করে! অতএব চালক গাড়ি নিয়েই তার ছই আনতে গেল।

এদিকে উজ্জয়িনীতে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে। এই রাজ্যের রাজা অত্যন্ত অত্যাচারী। তাঁর নাম পালক। কে এক জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন যে, আর্যক নামে এক গোপ যুবক পালককে হঠিয়ে রাজা হবেন। আর্যক এককালে সভ্য-ভব্য, ধনী বড়-মানুষ ছিলেন। চারুদত্ত এবং নগরের আরও গুণী-মানী ব্যক্তি তার বিশেষ বন্ধু। কিন্তু জ্যোতিষীর ভবিষ্যদ্বাণীর পর তার মহা বিপদ হল। রাজা পালক নিজের বিপদের ভয়ে আর্যককে সোজা বাড়ি থেকে তুলে এনে বন্দি করে রাখলেন। কিন্তু একদিন আর্যক তার অন্য এক বন্ধুর সহায়তায় জেল ভেঙে পালালেন। তার হাতে পায়ে তখনও ভাঙা লোহার শিকলের অংশ। চেহারা বিপর্যস্ত, এস্ত। তিনি বাঁচার আশায় এদিক-ওদিক দৌড়ে আপাতত নিজেকে আড়াল করে যেখানে দাঁড়িয়ে আছেন সেটাও আর্য চারুদত্তের বাড়ি।

ঠিক এই মুহূর্তে কিন্তু ওই বাড়ির সামনে আরও একটি গাড়ি দাঁড়িয়েছিল। এটা একটা ছই-দেওয়া গোরুর গাড়ি, যা দেখলে মনে হবে চারুদত্তের কোচোয়ানই গাড়িতে ছই লাগিয়ে বসন্তসেনার উপযুক্ত করে এনেছে। কিন্তু আসল ঘটনা তা নয়। এই গাড়িটা রাজার শালার গাড়ি। সে ধূর্ত, মূর্খ, অসভ্যসবই। তার ওপরে ভগ্নীপতি রাজার সম্বন্ধী বলে হেন অন্যায় কাজ নেই সে করতে পারে না। রাজার শালাও এই সময়ে সেই জীর্ণোদ্যানে বসে আছেন, যেখানে চারুদত্ত অপেক্ষা করছেন বসন্তসেনার জন্য। আসলে এই জীর্ণোদ্যানটি বেশ বড়ো জায়গা। এ যেমন নিগূঢ় প্রিয়মিলনের সংকেতস্থান, তেমনই অনেক অপকর্মই এখানে নির্জনতার সুযোগে করা যায়। রাজার শালাও এই উদ্যানেই রয়েছেন, যদিও চারুদত্ত কিংবা রাজার শালা–কেউই পরস্পরকে দেখতে পাচ্ছেন না। রাজার শালাও তার গোরুর গাড়ির কোচোয়ানকে পূর্বে আদেশ দিয়েছেন যাতে সে গাড়ি নিয়ে জীর্ণোদ্যানে চলে আসে। সে আসছিলও, কিন্তু ঠিক চারুদত্তের বাড়ির সামনেই তার গাড়ি ট্রাফিক জ্যামে আটকে যায়।

রাজার শালা বলে কথা। তার গাড়ির চালকও সে ব্যাপারে সচেতন। এখনকার দিনে মাননীয় মন্ত্রীদের ড্রাইভাররা যে মেজাজে থাকেন অথবা পুলিশের গাড়ির ড্রাইভাররা যেমন কড়া মেজাজে থাকেন, রাজার শালার চালকেরও সেই মেজাজ। গাড়ি আটকে গেছে দেখেই সে প্রথমে যে কথাটা অন্য গাড়িওয়ালাকে বলল, সেটা হল–জানিস এটা কার গাড়ি? রাজার শালার গাড়ি। তা শিগগির ভা। অন্য গাড়িওয়ালা বলল–একটু রোস ভাই, আমার গাড়ি মাটিতে আটকে গেছে, একটু চাকাটা ঘোরানোর জায়গা দিন। অর্থাৎ এখনকার ভাষায় ‘সাইড়’ দিন। শালাবাবুর কোচোয়ান বললে–কি, আমি রাজার শালার লোক, রীতিমতো বীরপুরুষ, আর আমি কিনা তোকে ‘সাইড’ দেব।

খানিকক্ষণ এই রকম হম্বিতম্বি চলার পর রাজার শালার কোচোয়ান দেখল–উপায় কিছুই হবে না। এখনকার দিনের বড়ো বড়ো রাজপুরুষদের গাড়ি-চালকেরা যেমন সরু রাস্তায় গাড়ি আসছে দেখেও নিজের গাড়িটি এনে অন্যতরের সামনে দাঁড় করিয়ে দেন এবং অন্যকে পিছু হঠতে বাধ্য করেন, আমাদের ওই প্রাচীন শকট-চালকেরও সেই ইচ্ছে ছিল। কিন্তু উপায় যখন নেই, তখন নিজেকেই গাড়ি সরাতে হয়। এখানেও তাই হল। রাজ-শ্যালকের কোচোয়ান শেষপর্যন্ত বলল ঠিক আছে, আমিই আপাতত গাড়ি ‘সাইড করে রাখছি। এই কথা বলে সে যেখানে নিজের গাড়িটা এনে রাখল সেটা সেই চারুদত্তের বাড়ি, যেখানে মুগ্ধা বসন্তসেনা অপেক্ষা করছেন অভিসার-কামনায়। ভিতর থেকে চাকার শব্দ শুনেই বাড়ির পরিচারিকা খবর দিল বসন্তসেনাকে–মাগো গাড়ি এসে গেছে। হৃদয়ের তাড়নায় মুগ্ধা গণিকা উলটো গাড়িতে চলে গেলেন। রাজার শালা তার পূর্ব প্রণয়-প্রার্থী, তার যম।

গোপকুলের আর্যক, যিনি ভাঙা-শিকল পায়ে এতক্ষণ আড়ালে লুকিয়েছিলেন এবং রাজার শালার কোচোয়ানের হম্বিতম্বি শুনে আরও বেশি আড়ালে পড়েছিলেন, এখন তিনি বাইরে এলেন। ওদিকে কিন্তু জেল- পালানো আর্যকের নামে তখন চারদিকে শোরগোল উঠেছে–পালিয়েছে, পালিয়েছে, জেল ভেঙে আর্যক পালিয়েছে, ধর ধ। আর্যক সব শুনতে পেলেন এবং খুব ঠান্ডা মাথায় চারুদত্তের বাড়ির পাশের দরজায় এসে দেখতে পেলেন আরও একখানা গোরুর গাড়ি বাড়ির সামনে থামল। এ হল সেই গাড়ি, যার চালক বসন্তসেনার আবরুর জন্য ছই লাগাতে গিয়েছিল। গাড়ির চালক এসেই হেঁকে আরেক পরিচারিকাকে বলল আসতে বল মালকিনকে, আমি প্রস্তুত। আর্যক দেখলেন–এই মওকা, তিনি সংযত পায়ে গাড়ির পিছন দিকে চলে গেলেন। তার পায়ের ভাঙা-শিকলের শব্দে চালক ভাবলবুঝি নূপুর বাজিয়ে বসন্তসেনা। আসছেন। প্রভুর অভিসারিকার মুখের দিকে না তাকিয়ে চালক বলল–আর্যা! গোরু দুটোর নাকে দড়ি পরানোর জন্য কেমন পাগলা-পাগলা হয়ে গেছে, আপনি দয়া করে পিছন দিক দিয়ে উঠুন। জেল-পালানো আর্যকও নিজের গুপ্তির জন্য তাই চান–তিনি পিছন দিক দিয়েই গাড়িতে উঠে পড়লেন। ভাঙা লোহার শিকল স্তব্ধ হল আর চালক ভাবল বুঝি নুপুরের বাজনা শেষ হয়ে গেছে, বসন্তসেনা উঠে বসে পড়েছেন গাড়িতে। গাড়ি চলতে লাগল পুষ্প-করণ্ডক নামে জীর্ণোদ্যানের দিকে।

.

০২.

“আরে বেটা! তুই চুপ করে বসে আছিস কেন? সেই গয়লার ছেলেটা রাজার হৃদয় এবং জেলখানা–দুটোই ভেঙে পালিয়েছে। তুই ছুটে যা পুব দিকের রাস্তায়, আর তুই যা পশ্চিম দিকে, তুই দক্ষিণে, তুই উত্তরে।”

পাইক বরকন্দাজদের এইরকম সব নির্দেশ দিয়ে পালক রাজার অন্যতম সেনানায়ক বীরক আরেক সেনানায়ক চন্দনককে নিয়ে প্রাচীরের ওপর উঠলেন। উদ্দেশ্য শহরের যানবাহন এবং লোকজনের আপাত গতিবিধি লক্ষ্য করা। চন্দনক আবারও অন্য অধস্তনদের বললেন–ভালো করে খোঁজ রে সব। বনে উপবনে, সভায়, দোকানে অথবা সেই গোয়াল পাড়ায়–যেখানে সন্দেহ হবে, সেই গয়লার ছেলেটা এবং যে তার শিকল কেটে দিয়েছে তাকে শিগগির খুঁজে দেখ। বীরক বলল–তুমি আর্যকের শারীরিক চিহ্নগুলি বলতে পার, বড় সুবিধে হয় তাহলে। আচ্ছা যে লোকটা শিকল ভেঙেছে, সে লোক্টা কে? চন্দনক খুব মেজাজ নিয়ে বলল–সে যেই হোক, আমি চন্দনক বেঁচে থাকতে যে বেটা আর্যককে তুলে নিয়ে গেছে–সে আবার কে?

এরই মধ্যে প্রাচীরের ওপর থেকে চন্দনক দেখতে পেল একটা ছই-দেওয়া গোরুর গাড়ি যাচ্ছে। সে বীরককে বলল–চারদিকে ঢাকা একখানা গাড়ি যাচ্ছে। ভেবে দেখ কী করা উচিত! বীরক সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে গাড়ির কাছে চলে গেল। বলল–এই গাড়োয়ান! থামা গাড়ি। এটা কার গাড়ি! কে আছে গাড়িতে, গাড়িটা যাচ্ছেই বা কোথায়?

গাড়োয়ান–এ গাড়ি আর্য চারুদত্তের। আরোহী আর‍্যা বসন্তসেনা। তিনি চারুদত্তের সঙ্গে বিহার করার জন্য জীর্ণোদ্যানে চলেছেন।

বীরক সব কথাগুলি একে একে চন্দনকের কাছে রিপোর্ট করল। চন্দন বলল–যাক চলে।

বীরক–না দেখা অবস্থাতেই চলে যাবে?

 চন্দনক– হ্যাঁ, হ্যাঁ।

বীরক-কোন বিশ্বাসে এ কথা বলছ?

চন্দনক-আর্য চারুদত্তের বিশ্বাসে।

বীরক–চারুদত্ত কে, আর ওই বসন্তসেনাই বা কে যে, না দেখা অবস্থাতেই ওকে ছেড়ে দেব?

চন্দনক বলল–ও তুমি চারুদত্ত আর বসন্তসেনাকে চেনো না, তবে আকাশে জ্যোৎস্নার সঙ্গে চাঁদকেও হয়তো তুমি চেনো না। উজ্জয়িনীনগরীর অলংকার হলেন তারা। বীরক খুব আস্থার সঙ্গে বলল–দেখ চন্দনক! আমি চারুদত্তকেও চিনি, বসন্তসেনাকেও চিনি, কিন্তু রাজকার্য উপস্থিত হলে আমি আমার নিজের বাবাকেও চিনি না।

চারুদত্তের গাড়িতে বসন্তসেনার আসনে বসে জেল-পালানো আসামি আর্যক এতক্ষণ সব শুনছিলেন। তিনি চন্দনককে অনেক আগে থেকেই চিনতেন এবং সে তার বন্ধু ছিল। কিন্তু এই যে বীরক লোকটি–এ এখনকার অত্যাচারী রাজা পালকের বড় বিশ্বস্ত লোক। তার সঙ্গে আর্যকের পূর্বশত্রুতাও ছিল। আপাতত চন্দনক একজন সেনানায়ক এবং বীরকও একজন সেনানায়ক, কিন্তু আর্যক ভাবছেন–বিয়ের সময়েও হোম করার আগুন জ্বলে, মরার সময় চিতাতেও আগুন জ্বলে, কিন্তু দুই জায়গায় আগুনের স্বভাব দুরকম। ঠিকই একই ভাবে, একই কাজে চন্দনক এবং বীরকদুজনেই নিযুক্ত, কিন্তু দুজনের স্বভাব একরকম নয়।

চন্দনক বীরকের ভাব দেখে আর কথা বাড়াল। সে বলল–দেখ, তুমি হলে রাজার প্রধান সেনাপতি এবং রাজার বিশ্বস্ত। অতএব তুমি গাড়িতে কে আছে দেখ, আমি গোরুদুটো ধরছি। বীরক যেন একটু লজ্জা পেল। সে বলল–তুমি কিছু কম বিশ্বস্ত নও, আর তুমিও তো সেনানায়ক বটে। চন্দনক বলল–আমার দেখাতেই তোমার দেখা হয়ে যাবে, নাকি আবার…? বীরক একটু বাড়িয়ে বলল–তুমি দেখলে আমার কি, রাজা পালকেরও দেখা হয়ে যাবে। এবার বীরক গেল গাড়ির মুখের দিকে গোরুগুলি সামলাতে, আর চন্দনক পিছন দিকে ছইয়ের আস্তরণ তুলেই দেখলেন–গোপপুত্র আর্যক ভাঙা শিকল পায়ে বসে আছেন। খুব আস্তে আস্তে পূর্বসুহৃৎকে আর্যক বললেন বাঁচাও ভাই আমাকে, আমার ভীষণ বিপদ, আমাকে বাঁচাও।

চন্দনক দেখলেন–চিলে ধাওয়া-করা ছোট্ট পাখিটি যদি ব্যাধের হাতে পড়ে, তাহলে তার যে অবস্থা হয়, আর্যকের অবস্থাও তাই। চন্দনক জানে–আর্যক নিরপরাধ এবং নগরীর সত্তম ব্যক্তি চারুদত্তের গাড়িতে তিনি বসে আছেন। বিশেষত যে ব্যক্তি আর্যকের লোহার শিকল ভেঙে তার পালানোর সুযোগ এনে দিয়েছেন সেই শর্বিক চন্দনকের পুরোনো বন্ধু। চন্দনক আর্যককে অভয় দিল মৃদু স্বরে, কিন্তু অত্যাচারী পালক রাজার আদেশ–অর্থাৎ আর্যককে ধরতে হবে। পালকের আদেশ তথা সেই আদেশের পালন বিষয়ে অপর সেনানায়কের ব্যগ্রতা চন্দনককে আপাতত তার করণীয় সম্বন্ধে যতখানি বুদ্ধিমান করে তুলল, ঠিক ততখানি হতচকিতও করে ফেলল।

বীরকের দিকে তাকিয়ে সে বলল– হ্যাঁ আর্যকে, আরে থুড়ি–আর‍্যা বসন্তসেনাকে দেখলাম। তা তিনি বললেন–আপনারা যা করছেন, তা ঠিকও নয়, আপনাদের যোগ্যও নয়। আমি চারুদত্তের অভিসারে যাচ্ছি, অথচ আমাকে রাস্তায় এইভাবে অপমান করা হল। বীরক বলল–তুমি যতই বল, চন্দনক! আমার কিন্তু সন্দেহ রয়েই গেল। কোন অকারণ ব্যস্ততায় তোমার গলার স্বর ঘ-ঘর করছে। তার ওপরে একবার আর্য বলে, পরে আবার ‘আর‍্যা বসন্তসেনাকে দেখেছি’ বলে নিজেকে সংশোধন করছ। অবিশ্বাসটা তাই রয়েই গেল। চন্দনক বুদ্ধি খাঁটিয়ে বলল–আমরা দাক্ষিণাত্যের লোক, অস্পষ্ট কথা বলা আমাদের অভ্যাস। তাছাড়া অনেক ম্লেচ্ছভাষাও আমরা জানি। তাই আমরা আর্যও বলি আবার ‘আর্যাও বলি, দৃষ্ট’ও বলি আবার দৃষ্টাও বলি।

বীরক এসব কথায় ভুলল না। সে বলল-যাই বল, আমাকে দেখতে হচ্ছে, আমি রাজার বিশ্বস্ত লোক, তার ওপরে প্রভুর আদেশ। চন্দনক অবাক হয়ে বলল–আমি কি তাহলে বিশ্বস্ত নই? বীরক একটু আগেই গলে গিয়ে চন্দনককে বলেছিল–তুমি কিছু কম বিশ্বস্ত নও। এখন সে তাই বিশ্বাসের কথাটা এড়িয়ে গেল। বলল–প্রভুর আদেশ, কী করা যাবে? চন্দনক দেখল বীরক যদি দেখে তাহলে সমূহ বিপদ, আর্যক, চারুদত্ত এবং নিজেরও বিপদ ঘটবে। সে মনে মনে বলল ঠিক আছে, আমি কর্ণাটদেশের কায়দায় ঝগড়া আরম্ভ করি। চন্দনক বলল–আমি একবার গাড়ি দেখেছি, আবার তুই গাড়ি দেখবি কে রে? বীরক বললে–তুইই বা কে? চন্দনক বলল–তোকে যে যতই মাথায় করুক, তুই নিজের জাতের কথাটা একবার মনে করিস না? বীরক বলল–কেন, কেন, আমার জাতটা কি এমন খারাপ? চন্দনক বলল–থাক থাক, ওসব কথা আর বলতে চাই না, কয়েতবেল ভেঙে আর কী হবে? বীরক বলল–বলই না তুই, থামলি কেন? চন্দনক বলল–বলব, বলব–আরেযার বাঁ হাতে নাকি ক্ষয়ে-যাওয়া একটা পাথর থাকে, আর ডান হাতে থাকে ক্ষুর, পুরুষ মানুষের গোঁফ-দাড়ি নিয়ে যে নাড়াচাড়া করে, এ হেন তুইও সেনাপতি!

চন্দনক বীরককে রাগাতেই চাইছিল, তাতে সে বেশ কৃতকার্যও হল। বীরক বলল–এবার তোর নিজের জাতটা মনে কর। চন্দনক বলল-আরে, আমি চন্দনক, চাঁদের মতো বিশুদ্ধ আমার সব কিছু। বীরক বলল–তাহলে বলব? চন্দনক বলল–আরে, বল্ না বল্। বীরক এবার চন্দনকের বাপ-মা তুলে বললহা তোর জাত খুব শুদ্ধ–তোর মা হল ভেরী আর বাপ হল জয়ঢাক, আর ডুগডুগি হল গিয়ে তোর ভাই। এ হেন তুইও সেনাপতি।

চন্দনক বলল–কী বললি? আমি চামার! তা দেখ দেখি গাড়ি, তোর ক্ষমতা দেখি। বীরক গাড়ির চালককে বলল– গাড়ি ফেরা, আমি দেখব। কিন্তু যেই বীরক গাড়ি দেখার জন্য ছইয়ের পরদায় হাত দিয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে চন্দনক তার চুলের মুঠি ধরে মাটিতে ফেলল, আর গায়ে মারল লাথি। বীরক বলল–এত বড় সাহস–আমি যাচ্ছি রাজার কাছে নালিশ জানাতে। তোকে যদি মার না খাওয়াতে পারি তো আমি বীরক নই। চন্দনক বলল, যা, তাই যা, বেটা কুত্তা তুই আমার কী করবি?

বীরক চলে গেল এবং চন্দনক যা চাইছিল তাই হল। এর পর চন্দনক চারদিকে তাকিয়ে কোচোয়ানকে বলল গাড়ি নিয়ে যা। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবি–চন্দনক আর বীরক–দুজনেই গাড়ি দেখে দিয়েছে। এবার গাড়ির ভিতর হাত ঢুকিয়ে বলল–আর্যে বসন্তসেনা? স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে এই তরবারিটা আপনাকে দিলাম। বলা বাহুল্য জেল-পালানো আর্যকের হাতে কোনো অস্ত্র ছিল না। তিনি এবার একটি তরোয়াল পেয়ে ধন্য হলেন। সুযোগ পেয়ে চন্দনক আরও বলল–আপনি আমার বিশ্বস্তজন। শুধু ভবিষ্যতে আপনি এই চন্দনককে একটু মনে রাখবেন। আমি কোনো লোভের জন্য একথা বলছি না, ভালোবাসার টানে বলছি। আর্যক বললেন–নিশ্চয়, বন্ধু! নিশ্চয়।

.

০৩.

আমি জানি আমার প্রবন্ধের পরিসরে আপাতদৃষ্টিতে যেন অপ্রাসঙ্গিক কোনো গল্প আপনাদের একটু বেশিই শুনিয়ে ফেলেছি। বস্তুত মৃচ্ছকটিকের এই অংশটি অবতারণা করার একটা বাস্তব যুক্তি আছে আমার কাছে। আজকের দিনের সরকারি কাঠামোর সঙ্গে মৃচ্ছকটিকের এই অংশটা বেশ মেলে। এই যে গয়লাপাড়ার আর্যক, যিনি অত্যাচারী পালক রাজার জেলে ছিলেন এতকাল, তার পিছনে জনগণের একটা বড় অংশ কাজ করছিল। চারুদত্তের মতো বিশিষ্ট মানুষ তো আর্যকের পক্ষে ছিলেনই এমনকি চন্দনকের মতো রাজকর্মচারী, যে এতকাল অত্যাচারী পালক রাজার বিশ্বস্ত লোক হিসেবে কাজ করে এসেছে, সেও কিন্তু মনে মনে পালকের রাজত্বের অবসান চায়। আজকের দিনেও অনেক সরকারি কর্মচারী আছেন, যাঁরা প্রতিষ্ঠিত সরকারের কাজ করে যান বটে, কিন্তু মনে মনে তাদের অনীতি সরকারি দলের পতন চান। তারা ভাবী সরকারের আমলে আপন প্রতিষ্ঠার জন্য বিপরীত পরিস্থিতির মধ্যেও নিজের কাজ গুছিয়ে রাখেন। যে নেতার মধ্যে তারা ভবিষ্যতের সম্ভাবনা দেখেন তাঁর হয়ে আগে থেকেই সরকারি কর্মচারীরা বিরুদ্ধ অবস্থার মধ্যেও কথঞ্চিৎ কাজ করেন, যার ফল পান অভীপ্সিত দল সরকারে এলে। এর জন্য সাবোতাজ’, কাজে ঢিলে দেওয়া, অনর্থক সমস্যা তৈরি করা, অনীপ্সিত সরকারের গোপনীয়তা তথা দুর্বলতা প্রকাশ করে দেওয়া–এ সবই যেমন এখন সরকারি কর্মচারীদের কাজের অঙ্গ, ঠিক একই ভাব আমরা দেখেছি চন্দনকের চরিত্রে। সে তার ভাবী রাজাকে শুধু সাহায্যই করেনি, অন্যদিকে বর্তমান রাজার শাসনে সাবোতাজ’ করেছে। পরিবর্তে সে চায় রাজা হয়ে আর্যক যেন তাকে স্মরণ করেন।

আমরা জানি–আর্যক রাজা হবার পর দরিদ্র চারুদত্তকে যেমন কুশাবতী নগরী দান করেছিলেন, তেমনই চন্দনক হয়েছিল রাজ্যের প্রধান সেনাপতি। আমাদের এখনকার সরকারি কর্মচারীদের মধ্যেও এমনি চন্দনকেরা আছেন, ছিলেন এবং থাকবেন–যাঁরা এক সরকারি দলের রাজত্বে প্রথমে চুপচাপ থাকেন, সমস্যা তৈরি করেন, ধর্মঘট করেন এবং সময়-সন্ধি ঘনিয়ে এলে চরম আঘাত করেন। তারপর পরবর্তী রাজত্বে সেনাপতি নাই হোন, তবে এমন উচ্চ থেকে উচ্চতর পদ লাভ করেন, যার যোগ্য তিনি নন হয়তো। তখন একজন আরেকজনকে বলে–তুই ছিলি নাপিত, হয়েছিস সেনাপতি। আবার সময় ফিরলে অপরজন অন্যজনকে বলে–তুই ছিলি চামার, হয়েছিস সেনাপতি।

আর্যকের রাজা হওয়ার ব্যাপারে জ্যোতিষশাস্ত্রের অভিসন্ধিতে আমার আগ্রহ নেই। কিন্তু এটা বেশ জানি, আর্যকের জন্য অনেকেই কোনো না কোনোভাবে বিরুদ্ধ সরকারের মধ্যে থেকেও কাজ করে যাচ্ছিল। একটু আগে আমরা উল্লেখ করেছি–জেলখানায় আর্যকের শিকল ভেঙে পালানোর সুযোগ যে করে দিয়েছিল, সেই শর্বিক যেমন চন্দনকের বন্ধু, তেমনই ভাবী রাজা আর্যকেরও বন্ধু। শর্বিলকই প্রথম ব্যক্তি, যিনি আর্যকের রাজা হওয়ার ব্যাপারে প্রথম পদক্ষেপগুলি গ্রহণ করেন। যেদিন তিনি শুনলেন যে, পালক আর্যককে বন্দি করেছেন, সেদিন তিনি তাঁর প্রেমিকা মনিকাকে বিয়ে করে নিয়ে যাচ্ছিলেন। এখনকার আত্মনিবেদিত দলীয় কর্মীরা যেমন রাজনৈতিক সমস্যা উপস্থিত হলে পুত্র-পরিবার শিকেয় তুলে দিয়ে দলীয় কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন, ঠিক একই রকমভাবে তখনকার রাজপুরুষেরাও অভিলষিত রাজার কাজে নিজেকে নিয়োগ করতেন। শর্বিক সদ্যবিবাহিতা বধূকে এক বন্ধুর বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে নিজে চললেন। আর্যকের সাহায্যে। শুধু সাহায্যই নয়, রাস্তায় নেমে তিনি প্রতিজ্ঞা করলে–পূর্বে বৎসরাজ উদয়নের মুক্তির জন্য মন্ত্রী যৌগন্ধরায়ণ যা করেছিলেন, আর্যকের মুক্তির জন্য শর্বিক তাই করবেন। এই করণীয় কাজগুলি হল বর্তমান রাজা পালকের জ্ঞাতিবর্গকে, চতুর মানুষদের, বিচক্ষণ বীরদের এবং রাজার দ্বারা অপমানিত ক্ষুব্ধ রাজকর্মচারীদের উত্তেজিত করা–নরেন্দ্রভৃত্যান্ উত্তেজয়ামি সুহৃদঃ পরিমোণায়।

সেকালের রাজা এখন নেই, কিন্তু মন্ত্রীরা আছেন; জ্ঞাতিবর্গ নেই; কিন্তু অন্যান্য দলীয়, নির্দলীয় শরিক দলের নেতা অথবা বিরোধী নেতারা আছেন; বিচক্ষণ বীর নাই থাকুন, কিন্তু বিচক্ষণ খুনে মাস্তানেরা আছেন; আর চতুর লোক, মানে যাঁরা সুবিধাভোগী, সুযোগসন্ধানী–তারা সময় বুঝে মানুষ দেখে সেকালে রাজার আনুগত্য পালটাতেন, আর একালে দল পালটান, নেতা পালটান। শেষে আছে অপমান-ক্ষুব্ধ রাজকর্মচারী। এই রাজকর্মচারীদের মধ্যে মন্ত্রী, অমাত্য, সচিব, সেনাপতির মতো বড় দরের রাজকর্মচারী থেকে আরম্ভ করে পুলিশ, কোটাল, করণিক সবাই আছেন। এঁদের মধ্যে বেশি মাইনে-পাওয়া উঁচু দরের কর্মচারী যাঁরা, তাদের খ্যাপানো যতটা কঠিন আবার ততটাই সোজা।

সেকালের বড়ো বড়ো রাজকর্মচারীদের এমন ভাবেই পরীক্ষা করে নেওয়া হত, যাতে হাজার প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও তাদের বিশ্বস্ততা সম্বন্ধে রাজা নিশ্চিন্ত থাকতেন। কিন্তু এত আনুগত্যের মধ্যেও যে জিনিসটি বড়ো রাজকর্মচারীদের পীড়িত করত–তা হল অপমান। বিশাখদত্তের মুদ্রারাক্ষস নাটকের নিরিখে এ কথা সম্পূর্ণ ঐতিহাসিকভাবে প্রমাণিত যে, শুধু গুরুতর অপমানের প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই মন্ত্রী বিষ্ণুগুপ্ত অথবা চাণক্য নন্দবংশ আমূল ধ্বংস করে ছেড়েছিলেন। এদিক দিয়ে ছোটো ছোটো রাজকর্মচারীদের ব্যাপারটা একটু অন্যরকম। অর্থাৎ তাদের স্থিরতা এবং ধীরতা যেহেতু অপেক্ষাকৃত কম, তাই তাদের বুদ্ধি দূষিত করা অপেক্ষাকৃত সহজ, কিন্তু তাদের আবার ভয় থাকে যে, কোনোক্রমে রাজা যদি তাদের মতিগতি জানতে পারেন তাহলে আর রক্ষা নেই, মৃত্যু নিশ্চিত। ফলত রাজা বিরুদ্ধ পক্ষে ভেদসৃষ্টির ব্যাপারে বড়ো বড়ো কর্মচারীদের ওপরেই বেশি নির্ভর করতেন, যেহেতু মনের মধ্যে রাগ পুষে রেখেও তারা ভাব গোপন করতে পারতেন এবং সময়মতো তারা বিরুদ্ধাচরণ করলে ছোটো ছোটো রাজকর্মচারীরাও তাদের অনুসরণ করত।

বস্তুত মৃচ্ছকটিকের চন্দনক যে ক্রুদ্ধ রাজভৃত্যদের উত্তেজিত করতে চেয়েছে, তারা কারা?মহামতি কৌটিল্য সেই ক্রুব্ধ ব্যক্তিদের একটা তালিকা দিয়েছেন এবং দেখিয়ে দিয়েছেন কোন অবস্থায় তারা তাদের আনুগত্য পরিবর্তন করে। এখনকার দিনে যারা দল পরিবর্তন করে, তাদের ক্ষেত্রেও এই তালিকাটি একইভাবে প্রযোজ্য। কৌটিল্যের মতে–যে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গকে টাকাপয়সা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে অথচ সেই প্রতিশ্রুতি কার্যকর করা হয়নি, তারা রাজার প্রতি আনুগত্য ত্যাগ করে; এখনকার দিনে তারা দলত্যাগ করে। শিল্পী-সাহিত্যিক অথবা বড়ো কাজ করেছেন–এমন দুজনের মধ্যে রাজা যদি একজনকে পুরস্কৃত করেন অথবা অপরজনকে অপমানিত করেন, সে তোক রাজার পক্ষ ত্যাগ করে। আবার ধরুন, এখনকার দিনে যাকে উলটো-পালটা জায়গায় ট্রান্সফার করে দেওয়া হয়েছে, এবং বহুদিন ধরে তাকে সেখানে থাকতে হচ্ছে, সে যেমন আস্তে আস্তে সরকারি দলের ওপর আস্থা হারিয়ে ফেলে, কৌটিল্য তাদের বলেছেন–প্রবাসের দ্বারা উপতপ্ত ব্যক্তি, যারা রাজার ওপর আস্থা হারায়। আবার সরকারে ভালো কাজকর্ম করছে, এমন মানুষকে যদি তার সম্মান এবং অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় সে যেমন এখনকার দিনে সরকারের ওপর অসন্তুষ্ট হয়ে অন্য বিরোধী গোষ্ঠীর পক্ষপাতী হয়ে ওঠে, এরাই কৌটিল্যের আমলে রাজাকে ত্যাগ করত–মানাধিকারাভ্যাং ভ্রষ্টঃ।

আর উদাহরণ দেব না, তবে এইটুকু বলব যে, এইরকম শত শত ক্রুদ্ধ, লুব্ধ, ভীত এবং মানী পুরুষ বা রাজপুরুষ আছেন, যাঁরা একালে দলত্যাগ করেন, সেকালে রাজত্যাগ করতেন। বস্তুত এঁদের ওপর নির্ভর করেই সেকালের বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ টিকে থাকত, তেমনই এঁদেরই ওপর নির্ভর করে সেকালের বিরোধী রাজারাও নিজেদের শাসনক্ষমতা প্রকাশ করতেন। কৌটিল্য বলেছেন–এই ধরনের লোকেরা যখন নিজের রাজার কাছ থেকে ভিন্ন হতে চায়, তখন রাজা যেন তাদের নিজের দিকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেন। কীভাবে? না, নানারকম শপথবাণী উচ্চারণ করে–পণকৰ্মৰ্ণা। এখনকার মন্ত্রীরা প্রায় প্রতিদিন এসপ্ল্যানেড ইস্টে যে মহাবাক্যগুলি উচ্চারণ করে থাকেন, কৌটিল্য সেইগুলিকে বলছেন ‘পণকর্ম। যদি এতে কাজ না হয়, তবে কৌটিল্যের মতে কিছু দান করতে হবেই রাজাকে, অর্থাৎ এখনকার দিনের মতে কিছু ‘ডিয়ারনেস অ্যালাউন্স’ দিতে হবে।

আধুনিক যুগে রাজার আসনে বসেন মন্ত্রীরা। গণতন্ত্র বলে কথা। তবু গণতন্ত্রকে যেহেতুে কোনো কোনো রাষ্ট্রনীতিবিদ প্রায় গণিকার সঙ্গে তুলনা করেছেন, তাই রাজকর্মচারীদের ব্যবহারও হওয়া উচিত ছিল গণিকার মতো। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে, যে দল সরকার গঠন করে, গণতন্ত্র যেমন সেই দলেরই হস্তগত হয়, তেমনই রাজকর্মচারীরাও পরিবর্তিত দলের হস্তগত হন। নিয়ম এবং আইন অনুযায়ী যে-কোনো পরিবর্তন বা পরিবর্তিত সরকারের মনোরঞ্জন করাই রাজকর্মচারীদের কাজ, কারণ দল পালটালেও সংবিধান তো পালটায় না। কিন্তু একেবারে আধুনিক যুগে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা কি একটুও বদলেছে? রাজকর্মচারীরা এখন সংবিধানের কাছে যতখানি দায়বদ্ধ, তার থেকে অনেক বেশি দায়বদ্ধ দলের কাজে। ফলত রাজার যুগের সেই আনুগত্যই আবার ফিরে এসেছে, যদিও সে আনুগত্য রাজার বদলে দলীয় রাজ বা গণতন্ত্রের রাজা-নেতাদের প্রতি স্বতোৎসারিত। তবে হ্যাঁ, বিক্ষোভ বা ভেদ সৃষ্টির ব্যাপারে উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের আজকাল কোনো ভূমিকা নেই। গণতন্ত্রের যুগে গণশক্তিকে উত্তেজিত বা বিক্ষুব্ধ করাটাই বড় রাজনীতি এবং সেই গণশক্তির আধার এখন নিম্নবর্গের রাজকর্মচারীরা। নিম্নবর্গের রাজকর্মচারীদের ধীরতা, স্থিরতা এবং বুদ্ধি যেহেতু উচ্চপদস্থের মতো নয়, তাই তাদের এই অস্থিরতা, অধৈর্য এবং অল্পবুদ্ধিকে উত্তেজিত করে তীব্র আন্দোলনে রূপান্তরিত করাটাই নেতা বা বিরোধী নেতার কাজ। এই কাজে নেতা বা প্রতিনেতাযখন যিনি সফল হন অধিকাংশ নিম্নবর্গীয় রাজকর্মচারীর আনুগত্য লাভ করেন তিনিই। আর আনুগত্য লাভ করে সরকারে আসার সঙ্গে সঙ্গেই নেতা-রাজারা স্মরণ করেন সেই চারুদত্তকে, সেই শর্বিলককে, সেই চন্দনককে, যাঁরা বিপরীত অবস্থায় নেতাদের পূর্বে সাহায্য করেছেন অথবা তাদের জন্য ভালো বা মন্দ কাজ করেছেন।

.

০৪.

আমরা এতক্ষণ শুধু সেকাল এবং একালের পরিপ্রেক্ষিতে রাজকর্মচারীদের একাত্মতা দেখানোর চেষ্টা করেছি একটি মাত্র দৃষ্টি থেকে। অর্থাৎ কিনা রাজতন্ত্রের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রাজকর্মচারীরা বিলুপ্ত হয়েছেন, না গণতন্ত্রে অন্যনামে তারাই টিকে আছেন অন্যতর সার্থকতায়। বস্তুত মৃচ্ছকটিক নাটকের যে অংশটুকু আমরা ব্যবহার করেছি, তাকে আরও একটু এগিয়ে নিলে দেখা যাবে–চন্দনক যে মুহূর্তে ভাবী রাজা আর্যকের গাড়িটি ছেড়ে দিল, তার কিছুক্ষণের মধ্যেই সে দেখল তার প্রিয় বন্ধু শর্বিলক আর্যকের সঙ্গে যোগ দিলেন। বর্তমান রাজার আদেশ লঙ্ঘন করে তার যেহেতু চাকরিতে টিকে থাকাই কঠিন, অতএব সেও স্ত্রী-পুত্র, ভাইদের নিয়ে আর্যকের দলে যোগ দিল। আধুনিক গণতন্ত্রেও বীর যুবকেরা, চতুর পুরুষেরা এবং রাজকর্মচারীরাও একইভাবে দল পরিবর্তন করেন এবং নেতা পরিবর্তন করেন। এই পরিবর্তনের পিছনে যে মনস্তত্ত্ব কাজ করছে–তা এতই মৌলিক, এতই চিরন্তন এবং এতই ব্যাপ্ত যে, আমি তার দিক্‌ নির্দেশমাত্র করেছি এবং এ ব্যাপারে আর বিশদ আলোচনায় যাব না। তার চেয়ে বরঞ্চ সেকালের রাজকর্মচারীদের নানান স্তর, তাদের বিচিত্র ক্রিয়াকর্ম এবং অবশ্যই অপকর্মগুলোও এখন আমাদের আলোচনার বিষয় হতে পারে, যদিও সে আলোচনায় স্বয়ং রাজাও মাঝে মাঝে এসে পড়বেন, কারণ রাজা ছাড়া তো আর রাজকর্মচারী হয় না–ঠিক যেমন এখনকার সরকারি কর্মচারীদের সম্বন্ধে আলোচনা করতে গেলে সরকারে অধিষ্ঠিত বিশিষ্ট দলের কথাও এসে পড়ে কারণ, সরকারে প্রতিষ্ঠিত দল অনুযায়ীই অধিকাংশ সরকারি কর্মচারীর রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ন্ত্রিত হয়।

দেখুন, একালে গণতন্ত্র বা সমাজতন্ত্রের রাজত্বে মন্ত্রীরা তো আর সরকারি কর্মচারী নন, তাঁরা রাজাদের স্থলাভিষিক্ত। রাজার সমান্তরাল কাজগুলি আজকাল মন্ত্রীদের অধিকারে আসায় বিশেষত মন্ত্রীদের ব্যবহার এবং মানসিকতার নিরিখে এখনকার মন্ত্রীদের রাজা বলতে কোনো অসুবিধা নেই। বস্তুত সেকালের দিনে মন্ত্রীদের সঙ্গে রাজার যে আলাপ আলোচনা হত, তার মধ্যে অথবা সেকালের মন্ত্রীসভার নিজস্ব মন্ত্রণার মধ্যে যে গণতান্ত্রিকতা ছিল, সেই গণতান্ত্রিকতার সঙ্গে পুরাতন রাজার ক্ষমতা, একনায়কতা এবং বিলাস মিশ্রিত হলেই এখনকার প্রধান এবং মুখ্যমন্ত্রীদের প্রতিরূপ খুঁজে পাওয়া যাবে। কেন্দ্রের প্রধানমন্ত্রী যদি হন রাজচক্রবর্তী তাহলে প্রত্যেক প্রদেশীয় মুখ্যমন্ত্রী হলেন রাজা। অন্যান্য মন্ত্রীরা আগেও যেমন মন্ত্রণা দিতেন, পরামর্শ দিতেন, এখনও তারা তাই করেন। শুধু এখন তারা সরকারি কর্মচারী নন, কিন্তু সরকারি সুবিধাগুলি তাঁরা ভোগ করেন কর্মচারীদের থেকে শতগুণ বেশি, অর্থাৎ প্রায় রাজার মতই। মৌখিকভাবে সেকালের রাজারা যেমন জনগণের সেবক ছিলেন, প্রজারঞ্জনই যেমন তাদের একমাত্র ধর্ম ছিল, এখনকার মন্ত্রীরাও তেমনই জনগণের সেবার জন্য কষ্ট করেই যেন মন্ত্রী হন। কিন্তু সেবার অধিকার এবং জনমঙ্গলের সেই মৌখিকতার আড়ালে এখনকার মন্ত্রীদের যে স্বার্থসিদ্ধি জড়িত থাকে, তার তুলনা শুধু সেকালের রাজারাই, যদি অবশ্য এখনকার আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে রাজাদের সবচেয়ে বড় শোষকশ্রেণি হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। উলটো দিক দিয়ে একথা কিন্তু স্বীকার করতেই হবে যে সেকালের মন্ত্রীরা কিন্তু খাতায়-কলমে এখনকার মন্ত্রীদের সঙ্গে কোনোভাবেই তুলনীয় নন, কেননা মন্ত্রীরা ছিলেন নিছকই রাজকর্মচারী, হয়তো প্রধান এবং প্রথম স্তরের রাজকর্মচারী, তার বেশি কিছু নয়। সেই কারণেই তাদের যতবার মন্ত্রী বলা হয়েছে, সচিবও বলা হয়েছে ততবারই। বস্তুত এখনকার সচিবদের সঙ্গেই সেকালের মন্ত্রীদের তুলনা করা উচিত।

অথচ কি আশ্চর্য দেখুন এখনকার দিনে মন্ত্রীসভার বিন্যাস যেমন এক অত্যন্ত জরুরি বিষয়, সেকালের দিনেও ছিল তাই। এমনকি সরকার গঠনের সঙ্গে সঙ্গে মন্ত্রীর সংখ্যা কত হবে, না হবে–এই নিয়ে যেমন এখনকার দিনে জল্পনা-কল্পনা শুরু হয়ে যায়, সেকালেও তেমনই ছিল। এখনকার দিনে প্রধানমন্ত্রী বা মুখ্যমন্ত্রীদের যে ‘পোলিটিক্যাল অ্যাডভাইজার’ বা এই ধরনের যে সব পদ আছে, সেগুলির সঙ্গে তখনকার দিনের ধী-সচিব বা মতি-সচিব পদের তুলনা করা যেতে পারে। রাজা এঁদের সঙ্গে ব্যক্তিগত এবং গোপন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনাগুলি করতেন। আর জনগণ এবং রাজশাসনের সুবিধার্থে যে সব মন্ত্রী রাজা নিয়োগ করতেন তাদের বলা যেতে পারে কর্মসচিব। এই ধরনের মন্ত্রী কজন থাকবেন, তাই নিয়ে আচার্যের মধ্যে মতভেদ আছে। কেউ বলেন বারো, কেই বলেন যোলা আবার কেউ বলেন কুড়ি। কৌটিল্য অবশ্য সবার মত সংগ্রহ করে এই মত প্রকাশ করেছেন যে, মন্ত্রীদের ক্ষমতা এবং বুদ্ধি বুঝে রাজা মন্ত্রীর সংখ্যা নির্ধারণ করবেন। এখনকার দিনেও অবশ্য তাই হয়। ব্যক্তিগত ক্ষমতা বেশি থাকলে এখনও যেমন একজন মন্ত্রী বা একজন সচিব দুটি বা তিনটি দপ্তরের কাজ দেখেন, তখনকার দিনের কর্মসচিবরাও সেইভাবেই তাঁদের দপ্তর দেখাশোনা করতে পারেন–এইটাই ছিল কৌটিল্যের মত–কেননা তাতে খরচ কমে, গুপ্ত কথা বাইরেও প্রকাশ হয় কম।

রাজকর্মে নিযুক্ত মন্ত্রীদের সংখ্যা না হয় বোঝা গেল, কিন্তু তারা কে কোন কাজ পারবেন, সেই দক্ষতার ব্যাপারে রাজাদের সবসময় সচকিত থাকতে বলা হয়েছে, অমাত্য নিয়োগের আগে তাদের কারও ধর্মবোধ পরীক্ষা করা হত। কাউকে আগে থেকেই প্রচুর টাকা ঘুষের লোভ দেখিয়ে পরীক্ষা করা হত–সে ঘুষ নেয় কিনা। কাউকে বা দূত পাঠিয়ে বলা হত–এই রাজা রাজমহিষীদেরই সুখী করতে পারেন না, তো প্রজাদের সুখী করবেন। জানেন রাজমহিষী আপনাকে দেখে একেবারে মুগ্ধ, তিনি আপনাকে কামনা করেন। আর আপনার সঙ্গে তাঁর মিলনের উপায়ও সব স্থির হয়ে গেছে। আপনি কি রাজি? রাজা পরীক্ষা করবেন–এইসব ক্ষেত্রে ভাবী মন্ত্রীরা কী ব্যবহার করেন অর্থাৎ তারা যদি এইসব লোভনীয় প্রস্তাবে সে প্রস্তাবে টাকা-পয়সার উৎকোচই হোক অথবা রাজমহিষীর প্রণয়–এইসব প্রস্তাবে তারা যদি অসম্মতি জানান, তবেই মন্ত্রী হওয়ার প্রাথমিক পরীক্ষায় সফলতা এল, নচেৎ নয়।

আবার মন্ত্রী হয়েও যে ভারী সুখ হত, তা নয়। মহারাজ যুধিষ্ঠির ময়দানবের তৈরি ইন্দ্রপ্রস্থে কেবল রাজা হয়ে বসেছেন, মন্ত্রীপরিষদও তৈরি হয়ে গেছে। এমন সময় নারদমুনি এসে তাঁর ভালো-মন্দ নিয়ে নানা কথা বলতে আরম্ভ করলেন।

নারদ শুষ্ক-রুক্ষ মুনি হলে কি হয়, রাজনীতির জ্ঞান তার টনটনে। স্বয়ং কৌটিল্য তাঁকে আচার্য পিশুন বলে অনেক সুখ্যাতি করেছেন। নারদ যুধিষ্ঠিরকে বললেন তুমি কোনো লোভী লোককে, চোর অথবা অনভিজ্ঞ লোককে রাজকার্যে বহাল করনি তো কচিন্ন লুক্কাশ্চৌরা বা…তব কর্মস্বনুষ্ঠিতাঃ। আসলে রাজনীতির অভিজ্ঞ লোক হিসাবে নারদ জানতেন যে, রাজা কিংবা সরকারের কতকগুলি সাধারণ বিপদ আছে–অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, মড়ক, আগুন-লাগা, দুর্ভিক্ষ ইত্যাদি। এগুলিকে প্রাচীনেরা বলেছেন দৈব বিপদ, যার ওপরে মানুষের কোনো হাত নেই। কিন্তু যে-কোনো রাজ্যে বা এখনকার গণ-সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাতেও আরও এক ধরনের বিপদ আছে–যাকে বলে মানুষ-বিপদ। কোন কোন মানুষ এই মানুষ-বিপদ তৈরি করতে পারে? প্রথম হলেন তারা যারা বিভিন্ন কাজকার্যে নিযুক্ত আছেন। দ্বিতীয় হল চোর। তৃতীয় হল রাজার শত্রুস্থানীয় লোকেরা এবং চতুর্থ রাজার প্রিয়জন, কাছের লোক-আযুক্তকেভ্য শ্চৌরেভ্য পরেভ্যো রাজবল্লভা।

একটি শ্লোকের একই পক্তিতে রাজকার্যে নিযুক্ত কর্মচারী, চোর এবং রাজার কাছের লোক–এই যে সহাবস্থান–এর একটা ঐতিহাসিক মূল্য আছে, যে মূল্য ভারতবর্ষের মতো বৃহৎ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাতেও লুপ্ত হয়ে যায়নি। চোরেরা চিরকালই ছিল এখনও আছে। কিন্তু গণতন্ত্রের মতো বিশুদ্ধ তুলসীপাতার জলে ধোয়া সরকারি কর্মচারীরা এবং মন্ত্রী-আমলাদের আত্মীয়-স্বজন এবং পেটোয়া লোকেরাও যে জনগণের টাকা কতখানি চক্ষুদান করেন–তা আজকাল সবাই জানেন। কাজেই অন্তত এই বিষয়ে সেকালের রাজকর্মচারী এবং এখনকার সরকারি কর্মচারীদের মৌলিক কোনো পার্থক্য নেই। সেকালের কোন কোন দপ্তরে এই সব চুরি-চামারির সুযোগ ছিল–তা নিয়ে পরে কথা বলব। আপাতত প্রাচীনকালে কী কী ধরনের দপ্তর ছিল এবং তাতে নিযুক্ত কর্মচারীদের কাজের নমুনাটা কী রকম–সেটা একটু দেখে নেওয়া যাক। প্রবন্ধ বড়ো হওয়ার ভয় এবং পাঠকের বিরক্তির ভয় থাকায় আমি উদাহরণ বেশি দেব না। কিন্তু সামান্য একজন রাজকর্মচারীকেও সেকালে কতটা তটস্থ থাকতে হত–সে ব্যাপারটা কয়েকটা উদাহরণেই বোঝা যাবে।

ধরুন আপনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে কোনো গ্রামে থাকেন। আমাদের সভ্যতা গ্রামভিত্তিক বলে গ্রাম থেকেই কথাটা আরম্ভ করছি। প্রথম সেই আমলে এক একটা গ্রামের যে পরিকল্পনা ছিল, তাতে গ্রামে থাকলেও রাজার সমস্ত সুরক্ষা আপনি পেতে পারতেন। কারণ আপনার জন্য সদা সচেতন থাকতেন গ্রামস্বামী বলে একটি লোক। আপনি, আপনার পরিবার এবং আপনার সম্পত্তি–এর যে-কোনো একটি ক্ষতির জন্য দায়ী হতেন সেই গ্রামস্বামী। কৌটিল্যের গ্রামস্বামীর দায়িত্ব থেকে জানা যায়–একজন ব্যাবসাদার মাল নিয়ে অন্য দেশে চলেছে। পথশ্রম লঘু করার জন্য তাকে হয়তো কোনো গ্রামে থেকে যেতে হল। সেখানে তার প্রথম কাজ হল–প্রথমেই গ্রামস্বামীর সঙ্গে যোগাযোগ করে তার শকটে কী কী জিনিস আছে, তার একটা ইভেনট্রি তৈরি করে তার এক এক কপি গ্রামস্বামী এবং নিজের কাছে রাখা। তারপর যদি ব্যবসায়ীর মাল রাত্রে চুরি যায় এবং সেই চুরির জিনিস গ্রামের বাইরে না গিয়ে থাকে তবে তো গ্রামস্বামী তার মাল ফেরত দিলেনই, কিন্তু ফেরত দিতে না পারলে গ্রামস্বামীর কষ্ট আছে। গ্রামের প্রান্তদেশে অর্থাৎ যেখানে গোরু চরানো হয়, সেখানে চুরি গেলে সে জায়গায় রাজার খাস জমিতে বিবীতাধ্যক্ষ বলে আরেক রাজকর্মচারী আছেন, তার দায়িত্ব এসে যাবে বণিকের মাল ফেরত দেওয়ার ব্যাপারে। আর এমন জায়গায় যদি চুরি যায়, যেখানে রাজার বিবীতাধ্যক্ষও নেই, গ্রামস্বামীও নেই, তাহলে দায় আসবে চোররঞ্জুক বলে আরও এক উচ্চতর রাজপুরুষের। চোর ধরার ব্যবস্থা তার হাতে। চোর ধরতে পারলে তো সুরাহা হয়েই গেল। কিন্তু না হলে ‘কে’ চলে যাবে পঞ্চগ্রামী বা দশমগ্রামীর কাছে। পঞ্চগ্রামী বা দশগ্রামী হলেন পাঁচ কিংবা দশগ্রামের অধিপতি। এবার সমস্ত গ্রামের বাড়ি খুঁজেই হোক কিংবা যেভাবেই হোক ব্যাপারীর মাল ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা তাকে করতেই হবে, নইলে তাকে নিজে দিতে হবে।

পাঁচখানি গ্রাম বা দশখানি গ্রামের অধিপতিকে বলে গোপ। সংস্কৃতে ‘গুপ্’ ধাতু মানে রক্ষা করা, অতএব গোপ মানে রক্ষক। এই গোপ-সাহেবের হাজারো কাজ আছে এবং তার কাজের মধ্যে যে কাজটাকে আমরা সর্বাধুনিক মনে করি–তা হল ‘সেনসাস্ রিপোর্ট। তিনি প্রত্যেক গ্রামে ক-জন বামুন, ক-জন কৃষক, ক-জন গয়লা, ক-জন স্ত্রী-পুরুষ, এমনকি কটা দ্বিপদ অথবা চতুষ্পদ জন্তু থাকে–তাও সব জাবদা খাতায় লিখে রাখবেন। এই জনগণনার সঙ্গে সঙ্গে আরও একটি কাজ গোপেরা করতেন, সেটা হল জমির হিসেব। কোন গ্রামে কত জমি, কোনটা চাষ হয়, কোনটা চাষ হয় না অথবা কোন জমিতে কী চাষ হয়, কোনটা বন, কোনটা বাস্তুজমি, এমনকি পুকুর, শ্মশান, পথঘাট পর্যন্ত সরকারি জাবদা খাতায় লিপিবদ্ধ করতে হত। এর মধ্যে কোন কৃষক রাজার কাছে বীজধান বা কৃষিঋণ পায়, কার রাজকর রেহাই আছে, কার বাকি আছে, কার জরিমানা দিতে হবে–সব তিনি অন্য অধস্তন কর্মচারীদের সাহায্যে সরকারি খাতায় তুলে নেবেন। মজা হল এই কাজ গোপেরা ভালোভাবে করলেন তো ভালো, নইলে তাদেরও বিপদ আছে। উচ্চতর রাজকর্মচারীরা ওই সমস্ত গ্রামে গয়লা, কৃষক আর সাধুর ছদ্মবেশে গুপ্তচর রেখে দেবেন। তারাও ওই একই কাজ গোপনে দেখবেন এবং মিলিয়ে দেখবেন–কোনো ফাঁক থেকে গেল কিনা।

গ্রামের রাজকর্মচারীদের সামান্য কাজের নমুনা দিলাম বলে শহরের রাজকর্মচারীদের সামান্য একটু পরিচয়ও দেওয়া উচিত। আপনারা আজকে যেমন ডি সি সাউথ, ডি সি নর্থ ইত্যাদি রাজপদবি দেখে বেশ বুঝতে পারেন যে, কাজের সুবিধের জন্য কলকাতা শহরকে কার্যত কয়েকটি ভাগে ভাগ করে ফেলা হয়েছে, তেমনই সেকালেও একটা শহর বা নগরকে চার ভাগে বা ওয়ার্ডে ভাগ করে ফেলা হত। নগরের ওই এক-চতুর্থাংশের দেখাশোনার ভার যাদের ওপর থাকত, তাদের বলা হত স্থানিক। স্বভাবতই একটি নগরের কাজে চারজন স্থানিক নিযুক্ত হতেন। আর এই চারজনের মাথার ওপর যিনি থাকতেন তাকেই বলা হত নাগরিক–পুরসভার চেয়ারম্যানের মতই তার কাজ বটে, তবে তিনিও একজন মাইনে-করা রাজকর্মচারী।

স্থানিকরা অধস্তন গোপেদের সাহায্য নিত এবং তাদের প্রথম কাজ ছিল শহরবাসী জনসাধারণের মধ্যে ক-জন পুরুষ, ক-জন স্ত্রীলোক এবং তাদের জাতি, গোত্র, নাম, ধাম এবং কাজকর্ম নথিভুক্ত করা। বলা বাহুল্য নথিভুক্ত কর্মরত ব্যক্তির আয়-ব্যয়ের হিসেবও স্থানিকেরা তাদের নোটবুকে তুলে রাখতেন। আজকালকার শহরে যেসব ভব্যতাগুলিকে আমরা নাগরিকের কর্তব্য বলে মনে করি, সেকালেও সেগুলি নাগরিকেরই কর্তব্য ছিল–তবে সেটা রাজকর্মে নিযুক্ত নাগরিকের। ভাবলে অবাক হতে হয় খ্রিস্টপূর্ব যুগেও কত আধুনিক চিন্তা ছিল এই নাগরিকদের। আমি সামান্য দু-একটা কাজের নমুনা দিই। যেমন ধরুন আজকাল তো প্রায়ই দেখছি ‘এডস্ আক্রান্ত ভয়ানক রোগীর চলাফেরা, তাদের এক শহর থেকে আরেক শহরে যাওয়া, তাদের সংখ্যা–এগুলি নিয়ে সরকারি স্তরেও ভাবনা-চিন্তা আছে। অন্তত একটি রোগ নিয়েও সরকারি স্তরে এই ভাবনা-চিন্তা আমাদের যতই শুভ মনে হোক, এটা আমাদের ভাবতে হবে যে, সেই খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দীগুলিতেও যে-কোনো সংক্রামক ব্যাধি নিয়ে রাষ্ট্রের কতটা চিন্তা ছিল। সেকালে এ ব্যাপারে দায়ী করা হত চিকিৎসকদের। কোনো লোক তার দুষ্ট রোগ সবার কাছে গোপন করলেও ডাক্তারের কাছে সে তা বলতে বাধ্য হত, যেমনটি এখনও হয়। অতএব ডাক্তারদের ওপরেই স্থানিক বা গোপের কড়া নির্দেশ ছিল যে, এমন ব্যাধিগ্রস্ত লোকের চিকিৎসা করলেই সরকারি মহলে তা জানাতে হবে। এমনকি যে বাড়িতে এসে এই ধরনের রোগী আশ্রয় নিচ্ছেন, সে গৃহস্বামীকেও সরকারি কর্মচারীর কাছে জানিয়ে রাখতে হত যে, তিনি রোগীকে আশ্রয় দিয়েছেন। পূর্বাহ্রে এই বিজ্ঞপ্তিটুকু না করা থাকলে ডাক্তার এবং গৃহস্বামী দুজনেই দোষী বলে গণ্য হতেন। আরও কি সরকারি গুপ্তচরেরা শহরের পরিত্যক্ত শূন্য বাড়ি, মদের দোকান, হোটেল (ঔদনিকাবাস), জুয়োখেলার জায়গা–এইসব জায়গাগুলি চষে বেড়াত, যদি কোথাও কোনো কঠিন সংক্রামক রোগী বা গায়ে ঘা-ওয়ালা মানুষ থাকে। এদের পেলে নগরাধ্যক্ষ বা সমমাত্রিক সরকারি কর্মচারীদের কাছে জমা দেওয়া হত।

আমরা নগর উন্নয়নের ক্ষেত্রে সামান্য একটা উদাহরণ দিলাম মাত্র। এ ছাড়া আগুন-লাগা, বড়ো রাস্তায় নোংরা ফেলা, যেখানে সেখানে মলমূত্র পরিত্যাগ করা, পচা ইঁদুর বা মরা বিড়াল রাস্তায় ফেলা–এসবের জন্য সরকারি নগররক্ষীদের সদা-জাগ্রত ভাবনা আমাদের মতো শহরবাসীর দাম্ভিক মনে অক্ষম ঈর্ষা তৈরি করে। ভাবা দরকার–যেখানে সামান্য গ্রাম বা নগরবাসী প্রত্যেকের স্বাস্থ্য, সম্পত্তি এবং ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়েও এত চিন্তা করা হত, সেখানে অন্যান্য সরকারি বিভাগ–যেমন ধরুন, অর্থ, পণ্য, কৃষি–এই সব বড়ো বড়ো দপ্তরের রাজকর্মচারীরা কত নিপুণ হতেন–তা সশ্রদ্ধ আলোচনার বস্তু। আরও একটা ব্যাপার লক্ষণীয় যে, আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সামান্য সামান্য যেসব ব্যস্ততার বিষয় থাকে বাজার-হাট, গাড়ি চড়া, প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া, বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া অথবা রক্তিম সন্ধ্যায় সামান্য একটু মদ্যপান–এই সমস্ত জায়গাতেই আপনার সঙ্গে ন্যায়-আচরণ করা হচ্ছে কি না, অথবা আপনি নিজে নির্দোষ কিনা এই বিষয়ে রাজকর্মচারীদের সুচিন্তিত দায়িত্ব ছিল।

ধরুন না আপনি বাজারেই গেছেন। বাজারে জিনিস কেনার সময় আপনার সন্দেহ হতে থাকল–দোকানি আপনাকে কম ওজন দিয়ে ঠকাচ্ছে। আজকে এই গণ-সমাজতন্ত্রের যুগে আপনার এখানে করণীয় কিছু নেই। বরঞ্চ প্রতিবাদ করলে আপনার লাভের অংশ থাকবে শুধু দোকানির গালাগাল। পুলিশ বা উপযুক্ত স্থানে খবর দেবেন? তাঁদের শুভাগমন ঘটবে তাদের ইচছামতো, যদি বা তারা আসেন–বুঝতে হবে তাদের অন্য প্রয়োজন আছে–কেস দিতে হবে অথবা নিদেনপক্ষে দর্শনী। কিন্তু খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দীর কোনো ব্যস্ত দিনে আপনি যদি বাজারে যেতেন, তাহলে আপনাকে এই সব ক্ষুদ্র জিনিস নিয়ে মাথা ঘামাতে হত না। তার জন্য ছিলেন পৌতবাধ্যক্ষ। তাঁর প্রথম কাজ ছিল–সরকারি কারখানায় দাঁড়িপাল্লা এবং বাটখারা তৈরি করা। প্রত্যেক দোকানিকে ওই সরকারি দাঁড়িপাল্লা এবং সরকারি বাটখারাই রাখতে হবে। প্রত্যেক চারমাসে এই দাঁড়িপাল্লা এবং বাটখারাগুলি পৌবাধ্যক্ষকে দিয়ে পরীক্ষা এবং সংশোধন করে নিতে হবে। যদি না করো তো সোয়া সাতাশ পণ দণ্ড। সেকালের হিসেবে এই পয়সা একবার দিলে আর দ্বিতীয়বার ব্যাবসা করার ইচ্ছে থাকবে না। অতএব আপনি থাকতেন নিশ্চিন্ত।

অথবা মদ্যপানের কথাই ধরুন। মদ খাওয়া সে যুগে কোনো অপরাধ ছিল না। রাজা, রাজগিন্নি, মন্ত্রী, সেনাপতি, সাধারণ কর্মী অনেকেই মদ খেতেন। কিন্তু যেখানে সেখানে মদ খাওয়া চলত না। মদ তৈরির ব্যাপারে এখনকার ‘একসাইজড ডিপার্টমেন্ট’ আর কি পথ দেখাবে? রাজার এক্সাইজ মিনিস্টার বা সুরাধ্যক্ষ সেই কালে যে আইন করেছিলেন তা এখনও চলছে। আইন ছিল-নির্দিষ্ট জায়গার বাইরে কোনো রকম মদ তৈরি করা চলবে না। শুধু তৈরি করা নয়, নির্দিষ্ট জায়গার বাইরে মদের বোতল বিক্রিও করা যেত না, কেনাও যেত না। সুরাধ্যক্ষ অধস্তন কর্মচারীদের দিয়ে নজর রাখতেন–যেন কোনোভাবেই মদে মাতাল মানুষ গ্রাম থেকে বা পানাগার থেকে বাইরে না যেতে পারে। ভিড়ের জায়গায় যাওয়া তো একেবারেই বারণ। এর কারণ তিনটি–প্রথম কারণ মদ্যপায়ীর ব্যক্তিগত সুরক্ষা। মাতাল হয়ে পাতাল পানে ধাওয়া করতে করতে যে যেন হাত-পা ভেঙে না পড়ে যায়। দ্বিতীয় কারণ–কোনো ভদ্রজনের যেন অসম্মান না হয় এবং তৃতীয় কারণ–অস্ত্রধারী রাজপুরুষ মদ খেয়ে যদি অস্ত্রচালনা করে বসে। অতএব নির্দিষ্ট পানাগারে বসেই মদ খেতে হবে। তাও আবার জ্বালা আছে। এখানে মদের জোগান দেবার লোকের মধ্যে গুপ্তচরেরা আছেন, যাঁরা একদিকে যেমন লক্ষ করেন–কোনো লোক হঠাৎ-পাওয়া পয়সায় মদ খাচ্ছেকিনা, অন্যদিকে খেয়াল করবেন–মদ্যপায়ীর জামার সোনার বোতাম, হাতের আংটি চুরি গেল কিনা? প্রথমটি হলে রাজ সরকারে জানাতে হবে, দ্বিতীয়টা হলে লাইসেন্স-পাওয়া পানাগারের মালিককে ওই আংটি-বোতামের দাম মিটিয়ে দিতে হবে।

দেখুন, দু-একটা উদাহরণেই যা বোঝা গেল, তাতে এটা ধরে নিতে অসুবিধে নেই যে, সেকালের রাজকর্মচারীদের দায়িত্বের কোনো শেষ ছিল না। বিশেষত কৰ্ষণযোগ্য ভূমি থেকে আরম্ভ করে কাপড় বোনার সুতোটি পর্যন্ত সব কিছুর মধ্যেই, অন্তত নীতিগতভাবে রাজা এতটাই জড়িয়ে ছিলেন যে, রাজকর্মচারীর দায়িত্ব ছিল অত্যন্ত বেশি। উল্লেখ্য–এই দায়িত্বের পরিবর্তে অন্তত বড়ো বড়ো রাজকর্মচারীরা মাইনেও পেতেন যথেষ্ট এবং ছোটো ছোটো কর্মচারীরাও যা পেতেন, তা তাদের কাজের সঙ্গে যথেষ্ট সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। স্বীকার করছি কৌটিল্যের সময়ে রাজকর্মচারীদের যে ক্রিয়াকর্ম ছিল এবং তাদের যা বেতন ছিল তা কালে কালে পরিবর্তিত হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে সরকারি কর্মচারীদের চাকরির সুরক্ষা ছাড়া–যে সুরক্ষা অনেকের মতে সরকারি কর্মচারীদের অপটুতা, অকর্মণ্যতা এবং দায়িত্বহীনতা ছাড়া আর কিছুই বাড়ায়নি–সেই সুরক্ষা ছাড়া আর বেশি কিছু আধুনিকতা নেই যা পূর্বকালের আচার্যরা চিন্তা করেননি। চাকরিরত অবস্থায় কোনো সরকারি কর্মচারী গতায়ু হলে তার পুত্র-পরিবারের কথাই ধরুন না। আজকাল অনেকের ধারণা আধুনিক গণতান্ত্রিক সরকার ছাড়া এই সুবিধার কথা আর কেউ ভাবেননি। কিন্তু কৌটিল্য বলেছেন রাজার কাজে নিযুক্ত থাকা অবস্থায় কোনো রাজভৃত্য যদি মারা যান, তাহলে তার পুত্র এবং স্ত্রী সেই অর্থই পাবেন, যা সেই কর্মচারীটি বেতন এবং ভাতা হিসেবে পেতেন। এমনকি মৃত রাজসেবকের পোষ্য-বৃদ্ধ বাবা-মা অথবা শিশু পর্যন্ত রাজার অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হতেন না–কর্মসু মৃতানাং পুত্ৰদারা ভক্তবেতনং লভেরন্।

সমব্যথার নিরিখে মৃতের পরিবার এই যে অনুগ্রহ পেতেন–এটা কৌটিল্যের নতুন কোনো সৃষ্টি নয়। এ ব্যবস্থা আগেও ছিল তবে তা প্রধানত সীমিত ছিল যুদ্ধে নিহত ব্যক্তির পুত্র-পরিবারের মধ্যে। কারণ মহাভারতে যুধিষ্ঠিরকে সতর্ক করা হয়েছে। কৌটিল্য তার সুসূক্ষ্ম ভাবনায় এটা বুঝেছিলেন যে, শুধু সৈনিকরাই নন, পুত্র-পরিবারের সুখ চিন্তা না করে যে কর্মচারীরা রাজসেবা করে যাচ্ছেন, কর্মরত অবস্থায় তাদের আয়ু শেষ হলে, তাদের পুত্র-পরিবারের প্রতি রাজার দায়িত্ব আছে। এই দায়িত্ববোধ কতখানি ছিল তা এখনকার দলীয়-স্বার্থসম্পন্ন একচক্ষু রাজকর্মচারীরা বোঝেন না। তারা কেবলই বলেন–আমাদের জনদরদি বন্ধু সরকার মেহনতি শক্তির মূল্য বুঝে কত সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছেন–মারা গেলে বউ কিংবা ছেলের কমপ্যাসনেট গ্রাউন্ডে’ চাকরি, ‘ফিফটি পারসেন্ট পেনশন’–আরও কত কি? দলের শ্যামনামে অভিভুক্ত এই অর্বাচীন সরকারি কর্মচারীদের কিছুতেই বোঝাতে পারি না–ভারতবর্ষে, অন্তত ভারতবর্ষে আপনারা কলম ঢিলে করে, সংঘশক্তির এবং চিৎকারের জোরে ঝুনার কাছ থেকে যে মাকড়ি’ আদায় করেছেন, তা পূর্বকালে বিনা প্রয়াসেই সম্পন্ন হত কারণ রাষ্ট্রের নীতিই ছিল সেই রকম।

শুক্রনীতিসারের মতো গ্রন্থে দেখতে পাচ্ছি–মানুষ রাজকর্ম করতে করতে মারা গেলেন। কিন্তু তার ছেলের যদি চাকরি করার বয়স না হয়ে থাকে, তাহলে যত কাল সে অপ্রাপ্তবয়স্ক থাকবে–তত কাল সে মৃত পিতার নির্দিষ্ট বেতনই পাবে–স্বামিকার্যে বিনষ্টো য স্তৎপুত্রস্তভৃতিং বহেৎ। আর প্রাপ্তবয়স্ক হলে সেই ছেলের গুণ দেখে রাজা তাকে রাজকর্মের বিশিষ্ট অধিকারে নিয়োগ করবেন–গুণান্ দৃষ্টবা ভৃতিং বহে। তাহলে অধুনাতন রাজকর্মচারীরা নতুন কি আদায় করলেন সরকারের কাছ থেকে? অথবা সরকারই বা তাঁর কর্মচারীদের প্রতি অভিনব কি করুণা প্রকাশ করলেন, যা দু হাজার, দেড় হাজার বছর আগেও নতুন কিছু ছিল না। আর প্রভিডেন্ড ফান্ড’, ‘পেনশনের নিয়ম-নীতির কথা শুনবেন কিছু? শুক্রনীতি লিখছে রাজকর্মচারীদের মধ্যে যার যা মাইনে ঠিক করা হয়েছে, ঊর্ধ্বতন অফিসার তার এক-ষষ্ঠাংশ অথবা এক-চতুর্থাংশ কেটে রেখে সেই কর্মচারীকে মাইনে দেবেন-ষষ্ঠাংশং বা চতুর্থাংশংভৃতে ভৃত্যস্য। পালয়েৎ। অর্থাৎ সেটা পি এফে জমা পড়ল। আবার এখনকার দিনে যেমন পনেরো কিংবা কুড়ি বছর চাকরি করলে পি এফের অর্ধেক বা পুরোটাই তোলা যায়, সেকালের দিনে তেমন ছিল না। অর্থাৎ এত দীর্ঘদিন ধরে সরকার তার কর্মচারীদের হকের টাকার সুদ খেতেন না। দুই বা তিন বছর পরেই তার পি এফের টাকা হয় অর্ধেক অথবা পুরো শোধ করে দেওয়া হত। তাহলে এখনকার কর্মচারীরা বাড়তি কি সুবিধে পাচ্ছেন?

এখনকার তথাকথিত জনদরদি সরকার সরকারি কর্মচারীদের মন এবং ভোট দুটো জয় করার জন্য ফিউটি পারসেন্ট’ পেনশন দেওয়ার ব্যবস্থা করেছেন, সেকালের রাজ সরকার এই ফিফটি পারসেন্ট’ পেনশনের ব্যবস্থা করেছেন অন্তত হাজার বছর আগে। শুক্রাচার্য বলেছেন–যে রাজকর্মচারী রাজ সরকারে অন্তত তেতাল্লিশ বছর চাকরি করেছে, রাজা তাকে অবসর জীবনে অতিরিক্ত কোনো রাজসেবা ছাড়াই যাবজ্জীবন অর্ধেক বেতন দিয়ে যাবেন–ততঃ সেবাং বিনা তস্মৈং ভৃত্যধং কল্পয়েত সদা। শুধু এই নয়, অবসররত অবস্থাতেও যদি সেই কর্মচারী মারা যান, তাহলে তার স্ত্রী বিধবা ভাতা পাবেন স্বামীর আয়ের এক-চতুর্থাংশ। স্ত্রী না থাকলে অবিবাহিতা মেয়েও এই এক-চতুর্থাংশ বেতন পেতে পারত। এর পর শিশুপুত্র বড়ো হয়ে গেলে তার গুণ অনুসারে রাজ সরকারে তার চাকরি জুটবে। আমাদের জিজ্ঞাসা এই বুর্জোয়া রাজ সরকারের নিয়মনীতি থেকে মৌখিক জনদরদিদের নীতি কোন অংশে শ্রেষ্ঠতর? তাও কি, এই পুজোর আগে রাজকর্মচারীরা ‘বোনাস-বোনাস’ করে চিল-চিৎকার শুরু করেন, এই বোনাসের কথাও প্রাচীনেরা বলেছেন একভাবে এবং তাও বেশ ভালোভাবেই অর্থাৎ চিল-চিৎকারের আগেই। শুক্রাচার্যের মতে–যারা পরিমিত মাস-মাইনে পায়, তাদের প্রতি বছরে মাইনের এক-অষ্টমাংশ পারিতোষিক হিসেবে দেবেনঅষ্টমাংশং পারিতোষ্যং দদ্যা ভৃত্যায় বৎসরে। কৌটিল্য অবশ্য সরকারি কাজ-কর্মে দ্রুততা আনার জন্য, যারা ভালো কাজ করে তাদের জন্যই শুধু পারিতোষিকের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু শুক্রাচার্যের মতে–বোনাস সব রাজকর্মচারীকেই দিতে হবে। উপরন্তু যে কর্মীকে দায়িত্বের কাজ দেওয়া হল, সে যদি অসম্ভব দক্ষতা বা দ্রুততার সঙ্গে তার দায়িত্ব পালন করে–তাকে সেই কাজ থেকে লভ্য অংশেরও এক-অষ্টমাংশ দেওয়া উচিত।

তাহলে পেনশন, ফ্যামিলি পেনশন, পি এফ, বোনাস–কোনো দিক দিয়েই প্রাচীন রাজকর্মচারীরা খুব একটা বঞ্চিত ছিলেন না। এ কথা সর্বান্তঃকরণে স্বীকার করি–সে কালের রাজতন্ত্রের বুর্জোয়া’ ঝোঁক অথবা শোষণের প্রবণতা যথেষ্ট পরিমাণেই ছিল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এই নীতিগুলিও ছিল, যে নীতিগুলিকে শুধু আধুনিক গণতন্ত্রের দান বলেই আমরা মনে করি। একথা অবশ্যই ঠিক যে, সেকালের রাজকর্ম সাধনে আনুগত্য ব্যাপারটা বড় বেশি প্রধান ছিল এবং উন্নতির জন্য ঊর্ধ্বতনের চাটুকারিতাও কিছু কম করতে হত না। কিন্তু এই প্রবণতা কি এখনও নেই? বরঞ্চ বলবসরকারি কর্মচারীরা এখন এক ঊর্ধ্বতনের সন্তুষ্টি বাদ দিয়ে দলনেতাদের চাটুকারিতা করেন। দলের নীতি-দুর্নীতি, নিয়ম-অনিয়ম এবং সর্বোপরি নেতাদের মুখ-নির্গলিত উচ্ছিষ্ট ভাষণগুলিকে এমনভাবেই তাদের স্তব করতে হয়, যাতে ব্যক্তিগত সমস্ত মূল্য যায় হারিয়ে। যা টিকে থাকে–তা হল শুধুই দাদা-নেতাদের বাণীর আবৃত্তি আর সংঘ-চিৎকার। নীতিশাস্ত্র বাচ্চা ছেলেদের বলেছে–ছোটোবেলায় শুধু মুখস্থ কর অ, আ, ক, খ; কেননা সমস্ত শাস্ত্রের বারংবার আবৃত্তি শাস্ত্রবোধের থেকেও বড়ো–আবৃত্তিঃ সর্বশাস্ত্রাণাং বোধাদপি গরীয়সী। আধুনিক সরকারি কর্মচারীদের দেখলে আমার শুধু এই নীতি বাক্যের কথাই মনে পড়ে–শুধু আবৃত্তি, বোধহীন আবৃত্তি। ভোট-সর্বস্ব সরকারও এখন এই আবৃত্তিতেই খুশি কারণ, দক্ষতা, কার্যক্ষমতা, পরিশ্রম–এগুলির প্রয়োজন এখন ফুরিয়ে গেছে।

.

০৫.

রাজনীতি শাস্ত্র যতখানি বিচিত্র, রাজকর্মচারীদের কাজ এবং চরিত্র। ততখানিই বিচিত্র। আমরা শুধু দু-একটি রেখার সাহায্যে দু-একজন মাত্র রাজকর্মচারীর কাজ, কুশলতা এবং দায়িত্ব নির্দেশ করেছি। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, প্রাচীন রাজকর্মে নিযুক্ত ব্যক্তির–সে ব্যক্তি ঊর্ধ্বতনই হোন অথবা অধস্তন–তাঁর পরিশ্রম এবং অসুবিধার ইয়ত্তা ছিল না। তার ওপরে রাজাদের মানসিকতায় পরস্পরবিরোধিতা থাকায় কর্মচারীদের ওপর কখন কোন হুকুম হবে–তার কোনো নিয়মনীতি ছিল না। এক কবি–তিনি হয়তো রাজসভার কবিই হবেন তিনি বলেছেন রাজাদের সেবা করা আর শানিত তরবারি লেহন করা একই ব্যাপার। হিংস্র বাঘের শরীর জড়িয়ে ধরার মধ্যে যে আশঙ্কা থাকে, অথবা যে ভয় থাকে সাপের মুখে চুমো খাওয়ায়–সেই একই আশঙ্কা, সেই একই ভয় কাজ করে রাজকর্মচারীর মনে।

আমার কথা শুনে আধুনিক রাজকর্মচারীরা যারা ভাবছেন–আজিকালি সরকারি কাজে বড় সুখ, কোনো দায়িত্ব নেই অথচ টাকা আছে তারা ঠিকই ভাবছেন। বাস্তবিক পক্ষে ভারতবর্ষে সরকারি কর্মচারী হওয়ার যত সুখ, তত সুখ আমাদের প্রাচীন রাজকর্মচারীদের ছিল না। বাইরে যত রাজসেবাই করুন, অথবা যত আনুগত্যই তাঁরা দেখান, তাদের মনে ছিল পদে পদে আশঙ্কা। তাদের অনেকেরই মনে হত কুত্তার মতো আছি আমরা। কারণ কী? কবি লিখেছেন–প্রথমে রাজাকে ভয়, তারপর মন্ত্রীদের ভয়, তার ওপরে যত আছেন রাজার নিকট জন, পেয়ারের লোক তারা বড় কম জ্বালান না রাজকর্মচারীদের। ভয় আছে তাদের কাছ থেকেওযারা অসভ্য লম্পট, অথচ রাজভবনে যাদের অবাধ আনাগোনা। শুধুমাত্র দীনতার জন্য এবং পেটের ভাত জোগাড় করার জন্য এই যে অহর্নিশ রাজসেবা–এ অনেকটাই কুকুরের চরিত্রের সঙ্গে মেলে।

বেশ বোঝা যায় এই আক্ষেপ যাঁর, তিনি মোটামুটি নিম্নমানের কর্মচারী ছিলেন, কারণ তার দৈন্যদশা ছিল। গণতন্ত্রের যুগে শ্রমিক-কৃষকের উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে এই নিম্নমানের রাজকর্মচারীদের অবস্থা অনেক ভালো, অনেক ভালো। সংঘশক্তি আর ভোটাধিকার থাকার ফলেই তাঁদের এখন কাউকে তোয়াক্কা না করলেও চলে। কিন্তু সেকালে নিম্নমানের যে রাজকর্মচারীটি আপন শবৃত্তির জন্য নিজেকে ঘৃণিত মনে করেছেন, তার উত্তরাধিকার এখন এসে পড়েছে উচ্চস্তরের রাজকর্মচারীদের ওপর। একদিকে কাজের চাপে তাদের ইউনিয়ন দানা বাঁধে না ভালো করে; অন্যদিকে রাজমন্ত্রীর ভয় এবং সমান্তরাল পার্টি লিডারদের ভয়। এই কি শেষ হল নাকি! রাজদ্বারে যাতায়াত করা মন্ত্রীদের নিকট জন, পার্টি লিডার এবং ক্যাডারদের অনুরোধ, উপরোধ এবং অধস্তন করণিকদের অবরোধসবকিছু মিলে এমন এক সন্দংশ-নিষ্পেষণের মধ্যে তারা থাকেন যে, শবৃত্তি অবলম্বন না করলে তাদের এখন চাকরি করাই দায় হয়ে উঠবে। রাজতন্ত্রের জায়গায় গণতন্ত্রের আবর্তনে রাজকর্মচারীদের। এই যে ঊর্ধ্ব-অধ বিপরিবর্তন, এটাকে প্রাচীনেরা কালের গতি’ বলেন, আমরা অবশ্য দুর্গতি বলি।

তবে এই ‘কালের গতি’ বা দুর্গতি–তা সেকালেও একভাবে রাজকর্মচারীদের পীড়িত করেছে, একালেও করে। তখন একশ্রেণিকে করেছে, এখন আরেক শ্রেণিকে করে, কাজেই এই ব্যাপারটা নিয়ে বেশি মাথা না ঘামানোই ভালো। বরঞ্চ আমরা রাজকর্মচারীদের আরও এক চিরন্তন বিচরণক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করি, যেখানে সেদিনের বসন্ত আজকের বসন্তদিনে মিলে গেছে। বস্তুত বসন্তের দিনে যেমন পত্রপুষ্পের সম্ভারে একটা বাড়তি উপচয়ের ভাব দেখা যায়, তেমনই রাজকর্মচারীরাও কাজকর্মের এই বিশিষ্ট ক্ষেত্র লাভ করলে বিশেষ উপচিত অর্থাৎ ফোলা-পা বোধ করেন। কৌটিল্য বলেছেন রাজকর্মচারীর চরিত্র অনেকটা ঘোড়ার মতো–অশ্বসধর্মাননা হি মনুষ্যাঃ। আপনি রথ চালানোর জন্য অথবা উপযুক্ত বাহনের জন্য হয়তো ঘোড়া কিনতে গেলেন। দেখলেন ঘোড়া বেশ ভালো শান্তশিষ্ট। ঘোড়া কিনে নিলেন। তারপর যখন নিজের সাফল্যে উৎফুল্ল হয়ে ঘোড়ায় চড়লেন, অমনই ঘোড়া একবার লাথি মারে, সামনের দুটো পা উঁচু করে আপনাকে ফেলে দিতে চায়। কৌটিল্যের ভাষায় কাজের সময়ইশান্ত ঘোড়ার নানা বিকার দেখা দেয়। রাজকর্মচারীরাও নাকি এই রকম। যখন ইনটারভিউ দিয়ে ঢুকছে তখন মনে হবে এঁর মতো শান্ত এবং সমস্ত কাজের শত সম্ভাবনাময় মানুষ পৃথিবীতে নেই। তারপর তিনিই যখন কাজে নিযুক্ত হলেন, এক বছর পর কনফার্মর্ড’ হলেন, অমনই নানা বেগড়বাই কাজে ঢিলে, ইউনিয়নবাজি, মাঝে মাঝে অগ্রপদ কিংবা দুটি হাত উপরে তুলে মুষ্টিযোগ শান্ত ঘোড়া সরকারি চাকরি করতে করতে বিগড়ে গেল।

কৌটিল্য বলেছেন ‘বিকার’। তা যেমনটি বললাম–এও যেমন বিকার, তেমনই আরেক রকম বিকার আছে–সে বিকার কর্মচারীকে অশান্ত করে না, ক্রোধী করে না, কাজে ফাঁকি দেওয়া শেখায় না, সে বিকার শুধু একজন রাজকর্মচারীকে ততখানি ফুলিয়ে ফঁপিয়ে তোলে, যতখানি ফোলা তার উচিত ছিল না। কৌটিল্য এই সব কর্মচারীদের সম্বন্ধে রাজাকে সাবধান থাকতে বলেছেন এবং তার ধারণা এই রাজকর্মচারীদের সম্বন্ধে বিশেষ জানতে হলে পানশালায়, গণিকালয়ে এবং আরও অন্যান্য দুর্ব্যসনের জায়গাগুলিতে খোঁজ করতে হবে। কোনো লোক যা মাইনে পায়, তার অতিরিক্ত যদি খরচ করে অথবা যদি কোনো রাজকর্মচারীর হঠাৎ খরচার হাত খুলে যায়, তার সাজ-গোজ, চালচলন সব পালটে যায়, তবে কৌটিল্য এবং অন্যান্য প্রাচীন আচার্যরা তার প্রতি কড়া নজর রাখতে বলেছেন। রাজকর্মের সঙ্গে পয়সার লেনদেন একেবারে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। রাজকর্মচারীরা এই পয়সা লেনদেনের সর্বোৎকৃষ্ট মাধ্যম। ফলে কৌটিল্য মনে করেন–মানুষের জিভের তলায় যদি মধু থাকে তবে সে মানুষ যেমন, এ মধু চাখব না ভাবলেও, একটু আধটু খেয়েই ফেলে, তেমনই রাজার অর্থের ব্যাপারে নিযুক্ত রাজকর্মচারীরা, খাব না ভাবলেও ঘুষ খেয়েই ফেলে।

আপনারা বলবেন–কেন, কেন? কর্মচারী নিয়োগ করার আগেই কৌটিল্য তাকে যথেষ্ট বাজিয়ে নিতে বলেছেন, আবার নিয়োগের পরেও গুপ্তচর-গূঢ়পুরুষেরা তার ওপর নজর রাখছেন কড়া চোখে–সেখানে চুরি হবেটা কী করে? কৌটিল্য বলেছেন–পুকুরে মাছ দেখেছেন তো? তা পুকুরের জলে চলাফেরা করার সময় বাইরে থেকে বোঝা সম্ভব নয়, তেমনই জলাশয়ের মতো বিভিন্ন রাজ-দপ্তরে যে সব রাজকর্মচারীরা আছেন–তারা যদি বিভিন্ন ভূমিকায় কথঞ্চিৎ তাম্বুল সেবন করেন, তবে তা রাজার পক্ষে ধরা অসম্ভব–মাছের মতই তারা চলাফেরা করতে করতেই ঢুকুটুকু করেই জল খাচ্ছেন, কারও বাপের সাধ্যি নেই ধরে–জ্ঞাতুং ন শক্যাঃ সলিলং পিবন্তঃ।

বর্তমানে গণতন্ত্রের চরম গৌরবের সময়েও, বিভিন্ন বিভাগীয় সরকারি জলাশয়ে সতত সঞ্চরমান মৎস্যধর্মী কর্মচারীরা জল খান কিনা–সে বিষয়ে জনসাধারণই একমাত্র প্রমাণ। তবে এ বিষয়ে কতগুলি বিভাগের যেমন বিশিষ্ট সুনাম আছে–সে সুনাম খ্রিস্টপূর্ব শতাব্দীগুলি থেকেই বহুধা কীর্তিত। আর কি আশ্চর্য, হিন্দু, রাজা, মুসলমান রাজা, সাহেব রাজা, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র–এক যায়, আরেক আসে, কিন্তু কোনো অবস্থাতেই এই বিশিষ্ট বিভাগগুলির কর্মচারীরা তাদের পরম্পরাগত মাধুকরী বৃত্তি ত্যাগ করতে পারেননি। আপনারা এবার প্রাচীনদের রাজবিভাগগুলি লক্ষ করুন এবং মিলিয়ে দেখুন ঘুষ খাওয়ার ব্যাপারে গণতন্ত্রের কর্মচারীরা রাজতন্ত্রের ঐতিহ্য মেনে চলছেন কিনা?

বিভিন্ন বিভাগে মোটামুটি চল্লিশ রকম কায়দায় রাজকর্মচারীরা চুরি করতে পারেন বলে কৌটিল্য মনে করেন। আমরা সবগুলোর মধ্যে ঢুকব না, তবে প্রধান প্রধান কতকগুলি চক্ষুদানের ঘটনা আলোচনা না করলে, সেকালের রাজকর্মচারীর চরিত্র সম্পূর্ণ হয় না। ব্যাপারটা আরও একটু আগে থেকে আরম্ভ করা যায়। যেমন ধরুন ইন্দ্রপ্রস্থে নতুন রাজা হওয়া যুধিষ্ঠিরকেনারদ মুনি বলছেন বাপু হে? তোমার রাজ্যে যারা আয়-ব্যয়ের হিসেব রাখে, সেই গণনাকারী রাজপুরুষেরা এবং হিসেব-লিখিয়েরা ঠিক ঠিক সময়ে টাকা পয়সা গুণে গেঁথে খাতায় লিখে রাখে তো কচি আয়ব্যয়ে যুক্তাঃ সর্বে গণকলেখকাঃ। অনুতিষ্ঠন্তি পূর্বাহে নিত্যমায়ব্যয়ং তব।

নারদমুনি যেটা সূত্রাকারে উল্লেখ করলেন, কৌটিল্য সেটাই ধরেছেন বিশদ করে। হিসেবের জাবদা খাতা এবং সেখানে তারিখ-সহ সমস্ত ‘এনট্রির’ব্যাপারে কৌটিল্য এত বেশি নজর রাখতে বলেছেন, যাতে ‘অডিট হলেই সমস্ত ধরা পড়ে যায়। ভারতবর্ষ যেহেতু কৃষিপ্রধান রাষ্ট্র, অতএব কৃষির জায়গাটা থেকেই চুরির হিসেবটা করা ভালো। সেকালের দিনের কৃষকরা যে ফসল উৎপাদন করতেন, তার কিছু অংশ রাজাকে কর হিসেবে দিতে হত। রাজার যিনি ইরিগেশন’ মিনিস্টার’ (সীতাধ্যক্ষ) থাকতেন তাঁর অধস্তন রাজকর্মচারীদের কাজ ছিল কর হিসেবে প্রদত্ত ফসল সংগ্রহ করা। জমির পরিমাণ, উর্বরতা, বৃষ্টিপাত, বীজধানের গুণাগুণ সব কিছু বিচার করেই রাজকর নির্ধারিত হত। কিন্তু ধরুন কৃষকরা রাজাকে প্রদেয় ধান দিয়ে দিল, অথচ রাজকর্মচারী তার হিসেবের খাতায় সেই ধান আদায়ের তারিখ যা লিখল, সেটা অনেক পরের তারিখ। আচার্যদের মতে–এই যে মাঝখানের সময়টা, এই সময়ে রাজকর্মচারী ওই ধান নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করে থাকবে এবং এটাই চুরি।

তবে এই ধরনের চুরি নিয়ে বেশি কথা বলা যায় না, কারণ তবু রাজা এই সময়ে এই সব ফসলের অংশ পেয়ে যেতেন। কিন্তু সবচেয়ে বড় ঝামেলা ছিল যে সব টাকার অঙ্ক রাজকোষে জমা পড়ত, সেই করগুলি নিয়ে। সাধারণত বণিক বা ব্যাবসাদাররাই এই রাজকর দিতেন এবং শুল্কবিভাগে নিযুক্ত কর্মচারীরা এই কর আদায়ের সূত্রে নিজেদের আখের গোছাতেন। তবে শুধুই ব্যবসায়ী কেন, রাজার কর আদায়ের পাত্র ছিলেন। আরও অনেকেই। গণিকা থেকে নৌকা পর্যন্ত সবই যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত ছিল, সেখানে আদায়ের মাধ্যমও ছিল বহু। এর ওপরে ছিল জরিমানা, সরকারি চুরির ক্ষেত্রে যেটা ভারী উপযুক্ত জিনিস। চুরি যাতে না হয়, তার জন্য আয়োজন ছিল অনেক, তবু চুরি হত। এমনকি চুরি বন্ধ করার জন্য রাজার বিভিন্ন দপ্তরে অধ্যক্ষ হিসেবে কোনো ব্রাহ্মণ অথবা রাজার আত্মীয়স্বজনেরা যাতে নিযুক্ত না হন, সেজন্য কৌটিল্য ওকালতি করেছেন। কারণ, চুরি করে ধরা পড়লে রাজকর্মচারী যদি ব্রাহ্মণ বা রাজার আত্মীয় হন, তবে তাকে শাস্তি দেওয়া মুশকিল হবে। অতএব যে সব দপ্তর থেকে রাজার টাকা উপায় হবে, সে সব দপ্তরে, এমনই সব লোক নিযুক্ত হবেন যারা চুরি করে ধরা পড়লে আত্মিক কোনো কারণে মায়ার যোগ্য হবে না। এত করেও কিন্তু কৌটিল্য জানতেনজিবের তলায় মধু থাকলে তার স্বাদ সরকারি কর্মচারীরা একেবারে প্রত্যাখ্যান করতে পারেন না।

হ্যাঁ, অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের’ মতো বিরাট এক মহাগাণনিকের কর্মশালা অবশ্যই ছিল। ছিলেন সমাহর্তার মতো বিরাট এক অফিসার যিনি রাজকোষের আয় বাড়ানোর জন্য নানা হিসেব করতেন।মহাগাণনিকের কর্মস্থানে কোন কোন খাতে রাজার আয় হয় এবং হতে পারে, তার একটা হিসেব থাকত। অর্থাৎ সেটা যদি কৃষির ব্যাপার হয়, তবে সারা রাজ্যে চাষের জমি কত, তা থেকে কত ফসল পাওয়া যেতে পারে বা আগের আগের বছর কত পাওয়া গেছে, তার একটা হিসেব থাকত সরকারি রেজিস্টারে। একইভাবে কারখানা, পণ্যশালা, সুরাখানা, বেশ্যাখানা, ফেরিঘাট, জুয়াখেলা, সেটলমেন্ট–এই সব দপ্তর থেকেই আয় কত হতে পারে তার আন্দাজ একটা থাকত। এই আন্দাজের পরের অংশটাতেই ছিল চুরির জায়গা যেখানে সরকারি মৎস্যকুল সাঁতার কাটতে কাটতে জল খেতেন, ঠিক যেমনটি এখনও খান।

কৌটিল্যের সময়ে ‘ফিনানসিয়াল ইয়ার’ ছিল তিনশ চুয়ান্ন দিনে এবং এই আর্থিক বৎসর শেষ হত আষাঢ় মাসের পূর্ণিমায়। ওইদিন সমস্ত হিসেবের খাতা সিল’ করে আয়-ব্যয়ের উদ্বৃত্ত টাকা নিয়ে রাজসরকারের মহাগাণনিকের কাছে জমা দিতে হবে। জমা দেওয়ার আগে ভারপ্রাপ্ত ‘অফিসাররা নিজেদের মধ্যে কথাও বলতে পারতেন না। কারণ তাতে যদি কারও চুরির সমাধান হয়ে যায়–সেটা কৌটিল্য সহ্য করবেন না। তা ছাড়া এই সরকারি অফিসার, করণিকসবার পেছনে চর ঘুরঘুর করত–কে কী করছেন কী বলছেন ধরবার জন্য। যে দপ্তরের অধ্যক্ষ আর্থিক বছরের নির্দিষ্ট দিনে হিসেব দিতে পারলেন না, তাকে হিসেব দাখিল করার জন্য আরও একমাস সময় দেওয়া হত বটে, কিন্তু তার পরেও যদি তিনি হিসেব দেখাতে না পারতেন তাহলে এক একটি মাস যাবে আর দুশো পণ করে জরিমানা গুনতে হবে। অর্থাৎ সেখানে গড়বড় আছে।

এ তো গেল আর্থিক বছরের শেষ দিনের কথা। কিন্তু আচার্যরা এমন অফিসারের সন্ধান জানেন যিনি পুরো একটি আর্থিক বছরের সুযোগ নিয়ে রাজকরের টাকা সুদে খাঁটিয়ে নিয়েছেন–কোশদ্ৰব্যানাং বৃদ্ধিপ্রয়োগঃ। তারপর ধরুন, একজনের কাছ থেকে ট্যাক্স নেওয়ার কথা, তার কাছ থেকে ঘুষ খেয়ে অফিসার তার ট্যাক্সই মকুব করে দিলেন–কৌটিল্যের মতে এটা হল–যা সাধ্য ছিল, তা সিদ্ধ হল না। আবার একজনের কাছে ধার্য কর পাওয়া গেল। অফিসার লিখলেন, ‘পাইনি। টাকাটা তার পকেটে চলে গেল, বেচারা করদাতাকে হয়তো আবারও কর দিতে হল। এই রকম ভাবে করদাতাদের কাছ থেকে বেশি টাকা আদায় করে হয়তো কম করে লিখে রাখা হল বহুসিদ্ধং অল্পং কৃতম্বাকিটা পকেটে গেল।

এগুলো কিন্তু ঘুষ নয়, ডিরেক্ট চুরি অর্থাৎ সরকারি টাকা নয়-ছয় করা। শুধু নিজেকে বিশ্বস্ত দেখিয়েই এই চুরিগুলি করা যায়। রাজা রাজাসনে বসে আছেন, জনৈক ব্যক্তি তার কাছে এসে নিজের অভাব-অভিযোগ জানিয়ে কিছু টাকা চাইলেন। রাজা কর্মচারীকে বললেন–একে দিয়ে দাও তো কিছু। কর্মচারী তাকে আশি টাকা দিয়ে, ব্যয়ের খাতে লিখে রাখলেন একশ টাকা–অল্পং দত্তং বহু কৃতম্। রাজবাড়িতে উৎসব আসছে, রানিমার গয়না বানানো হবে, রাজকুমারদের নতুন জামাকাপড় কেনা হবে। তা গয়নাও বানানো হল, কুমারদের জন্য ভালো ভালো পোশাক-পরিচ্ছদও হল। কিন্তু স্যাকরা আর কাপড়ের দোকানদারকে অন্তঃপুরাধ্যক্ষ যে টাকা দিলেন, হিসেবের খাতায় লিখলেন তার থেকে বেশি। বিয়োগের অঙ্কটা অন্তঃপুরাধ্যক্ষের পকেটে গেল।

এবার ঘুষের কথায় আসি। ঘুষ খাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত পাত্র হলেন ব্যবসায়ীরা। সে এখনও যেমন, তখনও তেমন। ঘুষ খাওয়ার মনস্তত্ত্ব নিয়ে যাঁরা আলোচনা করেছেন, তাদের মতে কর্মচারীরা সেখানেই ঘুষ বেশি খায়, যেখানে অপরপক্ষেও কোনো দোষ আছে, অর্থাৎ যে ব্যবসায়ী আপন পণ্যদ্রব্যের গুণাগুণ থেকে আরম্ভ করে লাভালাভের ব্যাপারে যত দোষী, ঘুষের পরিমাণও তত বেশি। সেকালে পণ্য বিক্রি করা অত সোজা ছিল না। সামন্ততান্ত্রিক যুগে বণিকরা যেমন সোজাসুজি ক্রেতার কাছে মাল বিক্রি করতেন, ভারতবর্ষের পূর্বকালেও তাই ছিল। শহরের মাঝখানে রাজার ফ্ল্যাগ-টাঙানো অফিস থাকত সেখানে শুষ্কাধ্যক্ষ অথবা কাস্টমস অফিসের পাঁচ-ছজন লোক নিয়ে বসে থাকতেন। বিদেশ থেকে যাঁরা মাল। নিয়ে আসতেন, তারা শহরে ঢোকার আগেই অন্তপালকে দিয়ে সিলমোহর লাগিয়ে নিতেন নিজের পণদ্রব্যে। এবার বণিকরা এসে জমা হলেন সেই ফ্ল্যাগ-টাঙানো অফিসের সামনে। আসবার সঙ্গে সঙ্গেই ব্যাপারীর নাম, তাদের সঙ্গে কত মাল আছে, কী মাল আছে সব নোট করে নেওয়া হত। অবশ্য দেখার বিষয় ছিল সেই অনুপালের সিলমোহর। যার সিলমোহর নেই অথবা যে সিল জাল করেছে–তার দণ্ড হত সাংঘাতিক। অতএব এটা একটা ঘুষের জায়গা। তারপর ধরুন, মাল আছে খারাপ, অথচ তার দাম চাওয়া হচ্ছে বেশি। সরকারি কর্মচারী এটা মেনে নিলেই, ঘুষ। আনলাইসেন্সড’ জিনিস–যেমন ধরুন অস্ত্রশস্ত্র, বর্ম, লোহা–যেগুলি রাজা নিজ রাজ্যের বাইরে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন, সেগুলো যদি বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়–তাহলেই ঘুষ, রাজকর্মচারীর পোয়া বারো।

সেকালের দিনে আরেকটা অদ্ভুত চুরি হত–সেটাও বলি। এক দেশের লোক অন্য দেশে বিয়ে করলে মেয়ের বাপের বাড়ি থেকে যেসব জিনিস আসত উপঢৌকন হিসেবে, স্বাভাবিকভাবে সেগুলোও গাড়িতেই আসত এবং তার ওপরে কোনো ট্যাক্সও লাগত না। রাজারা এই বিশাল উপহার-বস্তুর নাম দিয়েছিলেন বৈবাহিক ভাণ্ড’। এখন বিদেশ থেকে যারা ব্যাবসা করতে আসতেন তারা যদি কোনোক্রমে রাজকর্মচারীদের কাছ থেকে নিজেদের গাড়িতে বৈবাহিক ভাণ্ড’ সিল লাগিয়ে নিতে পারতেন। তাহলে তাদের লাভ ছিল ষোলো আনা, মাইনাস রাজকর্মচারীর ঘুষ। তারপর স্বদেশ থেকে যারা বিদেশে ব্যাবসা করার জন্য রাজপথ এবং শুষ্কশালা এড়িয়ে বনের পথ ধরে যেত, তারা শুষ্কাধ্যক্ষের নজর এড়িয়ে ট্যাক্স ফাঁকি দিতেন বটে, কিন্তু তার বদলে অন্তপাল বা অটবীপাল অর্থাৎ ফরেস্ট অফিসারদের ঘুষ খাওয়াতে হত।

কাজেই এটা বোঝা যাচ্ছে, রাজার যত দপ্তরই থাকুক, সব দপ্তরেই কমবেশি ঘুষ খাওয়ার অবসর ছিল, ঠিক যেমন এখনও আছে। সেকালের টাকশালের অধিপতি রাজার স্বর্ণমুদ্রা তৈরির সময় সোনায় তামা মিশিয়ে রেখে উদ্বৃত্ত সোনা নিয়ে গিন্নীর সাতনরি হার গড়িয়ে দিতেন। রাজার প্রধান স্থপতি রাজার আদেশে বাড়ি কিংবা মন্দির তৈরি করবার সময় যত লোক কাজ করেছে তার চেয়ে বেশি দেখিয়ে অতিরিক্ত টাকাগুলি নিজে আত্মসাৎ করতেন।বাজার-সরকার বাজারে গিয়ে দোকানির দাঁড়িপাল্লা আর বাটখারার (কূটমান এবং কূটতুলা) কারসাজি মেনে নিয়ে ওপরে হল্লার অভিনয় করতেন আর তলায় তাম্বুল সেবন করতেন। আর কাস্টমস অফিসার! তার কথা না বলাই ভালো-মহামতি নারদমুনি যুধিষ্ঠিরকে বলেছিলেন–তোমার রাজ্যের দূর দূর থেকে যে সব বণিক আসেন পণ্য বিক্রি করার জন্য, সেইসব বণিকের বিক্ৰেয় পণ্যের ওপর তোমার রাজপুরুষেরা নির্ধারিত হারে শুল্ক নেয় তো? যথোক্তমবহার্যন্তে শুল্কং শুল্কোপজীবিভিঃ। নারদমুনির আশঙ্কা–’ফোরেন মাল’ দেখলেই কাস্টমস অফিসারদের যেন কেমন কেমন লাগে। অতএব ঘুষের ব্যবস্থা করার জন্য আগে থেকেই তাঁর কাস্টমস ডিউটি’ বাড়িয়ে বলতে পারেন, অতএব নারদের জিজ্ঞাসা নির্ধারিত হারে শুল্ক নেয় তো–যথোক্ত অবহাৰ্য্যন্তে।

শুধু কি ঘুষ! ফোরেন জিনিস সেকালের কাস্টমস অফিসারদেরও ভারী প্রিয় ছিল। হয় তাঁরা জিনিসটা গায়েব করার চেষ্টা করতেন, নয় ডিউটি’ বাড়িয়ে বলতেন, অথবা এমন সব ঝামেলা–জেল, আদালত ইত্যাদির ভয় দেখাতেন যাতে বিদেশি বণিকেরা ভয় পায়। তাইনারদ বলেছেন–তোমার রাজ্যে বিদেশি বণিকদের পণ্য বিক্রির ব্যাপারে কোনো ছলনা সহ্য করতে হয় না তো–উপিনয়ন্তি পণ্যানি উপধাভিরবঞ্চিতাঃ। এই সব ছলনা-বঞ্চনার ফল কি, তা সোমদেব সুরি তাঁর গ্রন্থে কথঞ্চিৎ ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন–কাঠের পাত্র আগুনে চাপালে একবারই রান্না করা যায় কাষ্ঠপাাম্ একদৈব পদার্থো বধ্যতে, তেমনই বিদেশি বণিক যদি কাস্টমস অফিসারদের তাড়না-ছলনা একবার সহ্য করে তো দ্বিতীয়বার আর ব্যাবসা করতে এদেশে আসবে না। অতএব সাধু সাবধান।

অফিসারদের চুরির ব্যাপার ছেড়ে একবারের তরে করণিকদের ঘরে আসি। বলা বাহুল্য কৌটিল্য করণিক কিংবা গণকদের চুরির ব্যাপারে একেবারে ছ্যাচড়া ভেবেছেন। অর্থাৎ করণিকরা প্রায়ই হিসেব লিখবার সময় ক্রম অনুসারে লেখেন না, কৌটিল্য মনে করেন–এটা চুরির কারসাজি। এক জিনিসের দুবার এনট্রি’ হলে কৌটিল্য তাকে বারো পণ জরিমানা করবেন। আর যে করণিক রাজার রেজিস্টারে হিসেবটাই তুলছে, তার শাস্তি ভয়ংকর পর্যায়ে পড়বে। আবার করণিক লিখেছেন অথচ সে হাতে লেখার মানে এও হয়, সেও হয়–তাহলেও জরিমানার ব্যবস্থা, অর্থাৎ কৌটিল্যের মতে সেখানে চক্ষুদান ঘটেছে। এই আশঙ্কাতেই কোনো করণিক কোনো কথা আগে অস্বীকার করে পরে স্বীকার করলেও দণ্ড হত। এ ছাড়া, ভুলে গিয়েছিলুম স্যার, এখন মনে পড়েছে’–এ রকমটি যদি কৌটিল্য শোনেন, তবে সেই করণিকদের চুরির অপরাধের দ্বিগুণ দণ্ড দিতেন–প্রস্তাৎপন্নে চ দ্বিগুণঃ।

রাজসরকারের ভারপ্রাপ্ত অফিসার করণিকদের হাজার চুরি সম্বন্ধে অবহিত থেকেও কৌটিল্য কিন্তু ইউনিয়নবাজি’র মর্ম বুঝতেন। অর্থাৎ শুধুমাত্র ইউনিয়নবাজি’র জন্য রাজকর্মচারীদের চুরি যে শিল্পকর্মে পরিণত হতে পারে–এ আশঙ্কা তাঁর ছিল। যার জন্য তিনি বলেছেন যারা রাজার ধন চুরি করে নিজের ধন বাড়ায় সেই সব কদর্য রাজকর্মচারীরা যদি ‘পক্ষবলে বলীয়ান হন–পক্ষবাংশ্চেৎ–অর্থাৎ আমাদের মতে তারা যদি ইউনিয়ন নিয়ে আসেন–তবে তাদের ওপর অর্থদণ্ড প্রয়োগ করে টাকা আদায় করা উচিত নয়। অর্থাৎ অর্থদণ্ড করে কাজে বহাল করা উচিত নয়। বরঞ্চ তাদের সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে চাকরি থেকে ছাঁটাই করা উচিত। আমাদের জিজ্ঞাসা-হায় কৌটিল্য–তুমি বা তোমাদের কালের রাজারাও। কি ইউনিয়নবাজি’ বুঝতেন, কেননা অল্পসল্প না বুঝলেও ‘পক্ষবান’অর্থাৎ বন্ধুবান্ধব-ওয়ালা সেই কদর্য চোর রাজকর্মচারীটিকে তুমি চিনলে কি করে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *