১১. যখন এ্যাডভেঞ্চারের গল্প

১১. যখন মিঠুনের কাছ থেকে সবাই তাদের এ্যাডভেঞ্চারের গল্প শুনেছে

মাস্টার সাহেবের পুকুর ঘাটে সবাই বসেছে। মাস্টার সাহেব রীতিমতো জোর করে রিতু এবং তার ভাইবোনদের তার নিজের বাড়িতে নিয়ে এসেছেন। মাস্টার সাহেবের স্ত্রী নিজে অনেক কিছু রান্না করেছেন, সবাই সেগুলো হই চই করে খেয়েছে (মাংস অনেক ঝাল ছিল কিন্তু বাচ্চারা সেটা কাউকে বুঝতে দেয় নাই।) খাওয়ার পর সবাই পুকুরের ঘাটে এসে বসেছে। টিটন এবং মিঠুন তারা কীভাবে পালিয়ে এসেছে সবার কাছে সেই গল্প করছে। গল্পটা অবশ্যি এর মাঝে কয়েকবার করা হয়ে গেছে কিন্তু প্রত্যেকবার যেহেতু গল্পের ডালপালা ছড়াতে থাকে তাই নূতন করে শুনতে কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সবাই আগ্রহ নিয়ে শুনছে। পুকুরঘাটে মিঠুন এবং টিটন যেভাবে ঘটনাটা বর্ণনা দিয়েছে সেটার বিশ্বাসযোগ্য অংশটা এরকম :

মিঠুনকে ইব্রাহীম ডেকে পাঠিয়েছে বলে একটা মানুষ প্রথমে তাদের কাছে এসেছিল, সেই মানুষটা বুঝতে পারে নাই রিতু মিঠুনের সাথে টিটনকেও পাঠিয়ে দেবে। দুইজন হওয়ার কারণে মানুষগুলোর একটু যন্ত্রণা বেশি হয়েছে। তাদেরকে জঙ্গলের ভিতরে ঠেলে ঢুকিয়ে দেওয়ার সাথে সাথে দুইজন মানুষ তাদেরকে ধরে ফেলেছে। তারা যেন চিৎকার দিতে না পারে সেইজন্য মানুষগুলো প্রথমেই তাদের মুখ চেপে ধরেছে টিটন ভদ্র ছেলে কিছু করে নাই, কিন্তু মিঠুন মুখ থেকে চিউয়িংগামটা বের করে মানুষটার হাত কামড়ে তার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। মিঠুনকে চিৎকার করতে দেয় নাই কিন্তু মানুষটা নিজে যন্ত্রণায় গলা ফাটিয়ে চিৎকার করেছে। মিঠুন তাকে কিল ঘুষি মেরেছে, খামচি দিয়ে চোখে গুলো তুলে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। অসুবিধা জায়গায় লাথি মেরেছে এক কথায় মানুষটার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই না, হুটোপুটি করার সময় তার মাথার চুলে চিউয়িংগাম লাগিয়ে দিয়েছে।

মিঠুন একটুও ভয় পায় নাই এবং সে খুব ভালো করে জানে সে তাদের নাস্তানাবুদ করে ছেড়ে দিবে। শুধু টিটুনের বুড়ো আঙ্গুল রামদা দিয়ে কোপ দিয়ে আলাদা করে দেবে বলার পর সে একটু শান্ত হয়েছে। মিঠুন বলেছে বুড়ো আঙ্গুল খুবই জরুরি আঙুল, এই আঙুল না থাকলে কিছু করা যায় না, সেইজন্য সে ছেড়ে দিয়েছে। অন্য কোনো আঙুলের ভয় দেখালে সে শান্ত হতো না। (গল্পের এই অংশে টিটন খুবই বিরক্ত হয়েছে যে মিঠুন তার অন্য যে কোনো আঙুল কেটে ফেলে দেওয়া নিয়ে মোটেও চিন্তিত ছিল না।)

যাই হোক মানুষগুলো তাদেরকে আজহার আলীর মহাজনী নৌকায় তুলেছে, তাদের হাত বেঁধে পাটাতনের নিচে রেখে নেমে গেছে। মানুষগুলো নৌকা থেকে নামার আগেই মিঠুন তার হাত পায়ের বাঁধন খুলে ফেলেছিল। মিঠুন কীভাবে সেটা করেছে সেটা সবাইকে করে দেখালো। মানুষগুলো যখন তাকে বাঁধে তখনই সে তাদেরকে শক্ত করে বাঁধতে দেয় নাই, হাত পা গুলো জোর করে ছড়িয়ে রেখেছে, যখনই বাঁধতে চেষ্টা করেছে সে অনেক জোরে চিৎকার করেছে। মানুষগুলো ধারণা করেছে তারা এত জোরে বেঁধেছে যে ব্যথায় চিৎকার করছে।

মানুষগুলো চলে যাবার পর সে প্রথমে একটা হাত ছুটিয়ে এনেছে, সেটা দিয়ে হাতের বাঁধন খুলেছে, তারপর পায়ের বাঁধন খুলেছে। মিঠুন নিজেকে ছোটানোর পর টিটনকে ছুটিয়েছে তারপর মাথার উপর ঢেকে রাখা কাঠ সরিয়ে পাটাতন থেকে বের হয়ে এসেছে। পাটাতন থেকে বের হয়ে দুইজন মিলে নৌকাটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখেছে। নৌকাটা চিনির বস্তা দিয়ে বোঝাই। ছইয়ের কাছে একটা চাটাই দিয়ে ঢাকা একটা জায়গায় একটা বন্দুক এবং কয়েকটা কার্তুজ খুঁজে পেয়েছে। মিঠুন বন্দুকে একটা কার্তুজ ঢুকিয়ে আকাশের দিকে একটা ফাঁকা গুলি করতে চেয়েছে কিন্তু টিটন তাকে সেটা করতে দেয় নাই।

নৌকার ভিতরে অনেক রকম জঙ্গিদের বই ছিল, বেশ কয়েকটা দা এবং চাইনিজ কুড়াল। কাগজপত্র এবং চিঠি, চিঠিতে অনেক বানান ভুল সেইজন্য তারা পড়ার আগ্রহ দেখায় নাই। নৌকায় মাঝে লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, গামছা এইরকম কিছু কাপড় জামা এবং একটা লম্বা নল লাগানো হুঁকো খুঁজে পেয়েছে। কোটা দেখে মিঠুনের কিছু মনে হয় নাই কিন্তু টিটন আনন্দে লাফাতে লাগল। সে নাকী হুঁকোর লম্বা নল দিয়ে কীভাবে এই মহাজনী নৌকাটা ডুবিয়ে দেবে।

মিঠুন মোটেও টিটনের কথা বিশ্বাস করে নাই কিন্তু সত্যি সত্যি হুঁকোর নলটা পানিতে ভরে নদীতে এক মাথা আর নৌকার ভিতরে আরেক মাথা রেখে টিটন কী যেন করে ফেলল তখন নদীর পানি নৌকার ভিতর এসে পড়তে নাগল।

(গল্পের এই জায়গায় টিটন সবাইকে বলল, এইভাবে উঁচু জায়গা থেকে নিচু জায়গায় পানি ফেলার পদ্ধতির নাম সাইফন এবং সাইফন কীভাবে কাজ করে সে সেইটাও বোঝানোর জন্যে রেডি ছিল কিন্তু যারা শুনছে তাদের কারোই বিজ্ঞান নিয়ে কোনো আগ্রহ ছিল না বলে সেটা সে বোঝানোর সুযোগ পেল না।)।

নৌকাটা অনেক বড় এবং কোর নল দিয়ে অল্প করে পানি এসে ঢুকছে, কাজেই পুরো নৌকাটা পানিতে ভরে ডুবে যেতে একটু সময় নেবে। টিটনের কোনো তাড়াহুড়ো ছিল না, এতক্ষণে নিশ্চয়ই নৌকাটা ডুবে গেছে। তবে নৌকাটা ডুবে গেলে নৌকাতে রাখা চিনির বস্তাগুলো যখন নদীর পানিতে গলে যাবে তখন পুরো নদীর পানি নিশ্চয়ই মিষ্টি হয়ে যাবে। আজহার আলীর নিশ্চয়ই অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে কিন্তু এগুলো নাকী চোরাচালানি করে আনা চিনি, এভাবেই এগুলোর নদীর পানিতে গলে যাওয়াই উচিৎ।

মহাজনী নৌকাটা প্রায় নদীর মাঝখানে নোঙর করে রেখেছিল। সেখান থেকে তীরে আসতে তাদের খুব বেশি ঝামেলা হয় নাই। নদীতে অনেক নৌকা চলাচল করে তাদের হাত তুলে ডেকে অনুরোধ করতেই তাদের তীরে নামিয়ে দিয়েছে। তারা টাকা দিয়ে নৌকার ভাড়া দিতে পারে নাই তবে টাকার বদলে মাঝিকে দুই গামলা চিনি দিয়েছে।

তীরে এসে একটু খোঁজখবর করতেই একজন জানিয়েছে রিতু তিতু আর টিয়া মাস্টার সাহেবের সাথে আজহার আলীর বাড়িতে গেছে তখন একজন তাদেরকে আজহার আলীর বাড়ি নিয়ে গেছে।

মিঠুনের খুব সখ ছিল, বন্দুকটা যেহেতু সে খুঁজে পেয়েছে সে এটা নিজের কাছে রেখে দেবে। কিন্তু মাস্টার সাহেব রাজী হন নাই। বন্দুকটা মিঠুনের হাত থেকে নিয়ে থানায় পাঠিয়ে দিয়েছেন।

টিটন আর মিঠুন কিডন্যাপ হয়েছে আবার ছাড়াও পেয়েছে, আজহার আলী অনেক বিপদের মাঝে আছে, মতি আর খলিল রীতিমতো গ্রামের মানুষের পা ধরে কান্নাকাটি করছে, আজহার আলীর চোরাচালানি করে আনা চিনি বোঝাই মহাজনী নৌকা নদীতে ডুবে গেছে, নদীর পানি সরবতের মতো মিষ্টি, এক কথায় বলা যেতে পারে সবকিছু একেবারে ম্যাজিকের মতো ঘটে যাচ্ছে। আনন্দ এবং উত্তেজনায় সবাই প্রায় ভুলেই গিয়েছিল যে তারা এখানে এসেছে ইদরিস মিয়াকে খুঁজে বের করে তার সাথে কথা বলতে। সকালবেলা গেস্টহাউজ থেকে বের হয়েছে ইদরিস মিয়ার সাথে দেখা করতে, এখন দুপুর গড়িয়ে গেছে।

তিতু সবার আগে অন্যদের সেটা মনে করিয়ে দিল। মিঠুন যখন রংচং চড়িয়ে তার গল্পটা আবার শুরু করতে যাচ্ছিল তখন তিতু ইব্রাহীম চাচাকে বলল, ইব্রাহীম চাচা আমরা মুক্তিযোদ্ধা ইদরিস মিয়ার সাথে কথা বলতে যাব না?

ইব্রাহীম চাচা বলল, তোমরা যদি যেতে চাও। আজকে এতো কিছু হয়েছে।

সবাই একসাথে বলল, যাব। যাব। আমরা যাব। এখনই যাব। শুধু তাই না যাওয়ার জন্য কয়েকজন লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়াল। তারপর মাস্টার সাহেবের বাসায় মানুষজনের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তারা ইসদিও মিয়ার খোঁজে রওনা দেয়।

.

ইব্রাহীম চাচা এবারে সবাইকে নিয়ে নদীর তীর ঘেঁষে হাঁটতে লাগল। সবাই আজহার আলীর নৌকাটা কোথায় ছিল দেখতে চাইছিল। কিন্তু তখন সেখানে কিছু নাই, নৌকার মাস্তুলটা চেষ্টা করলে একটুখানি দেখা যায়। নদীর তীরে ঠিক হাঁটার রাস্তা নেই। জায়গাটা উঁচু নিচু, মাঝে মাঝে ছোট খাল, গাছপালা, ঝোঁপঝাড়। মাঝে মাঝে গরু ছাগল উদাস মুখে দাঁড়িয়ে আছে না হয় মনোযোগ দিয়ে ঘাস খাচ্ছে। নদীর তীরে ছোট ছোট গ্রাম, সেখান থেকে মহিলারা থালাবাসন কাপড় নিয়ে নদীর দিকে যাচ্ছে না হয়, নদী থেকে ফিরে আসছে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা নদীর পানিতে লাফালাফি করছে। তাদের আনন্দ দেখে সবারই মনে হলো তারাও যেন পানিতে গিয়ে লাফিয়ে পড়ে!

হাঁটতে হাঁটতে রিতু বলল,আমরা কী বাঁচা বেঁচে গেছি। যদি মিঠুন না হলে টিটুনের কিছু একটা হতো তাহলে আমাদের কী হতো।

টিটন বলল, কী আর হতো? ওরা ভয় দেখাবে চাইছিল আমরা ভয় পেতাম।

তিতু বলল, আমি অনেক ভয় পেয়েছি।

 টিয়া বলল, আমিও।

মিঠুন বলল, আমি একটুও ভয় পাই নাই।

রিতু হাসল, বলল এই প্রথম দুষ্টু হওয়ার একটা উপকারিতা দেখতে পেলাম, যখন ভয়ের ব্যাপার হয় তখনও ভয় পায় না।

রিতুর কথা শুনে মিঠুন দাঁত বের করে হি হি করে হাসল।

১আরো মিনিট ত্রিশেক হাঁটার পর ইব্রাহীম চাচা বলল, আমরা এসে গেছি।

এসে গেছি?

ইব্রাহীম চাচা উত্তর দিল না। ইব্রাহিম চাচা তার আগের অবস্থায় ফিরে গেছে। দরকার না হলে এখন আর একটা কথাও বলবে না।

ইব্রাহীম চাচা আরো খানিকদূর হেঁটে এক জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল। তারপর একটু দূরে একটা ঝপড়া গাছ দেখিয়ে বলল, গাছের নিচে একটা চালাঘর দেখেছ? ইদরিস মিয়া এখানে থাকেন।

ইব্রাহীম চাচা এটাকে চালাঘর বলছে কিন্তু এটা চালাও না ঘরও না। কার্ডবোর্ডের বাক্স, পলিথিনের ব্যাগ, কাঠ-কুটো, বাঁশের কঞ্চি এইসব দিয়ে কোনোমতে একটা কিছু দাঁড় করানো হয়েছে। বৃষ্টি হলে সরাসরি মাথায় বৃষ্টি পড়বে না, এছাড়া এই চালাঘরটির আর কোনো কাজে আসার কথা না। চালাঘরটির নিচে একটা বিছানা, কয়েকটা হাঁড়িকুড়ি। একটি দড়ি থেকে একটা লুঙ্গি এবং একটা রং ওঠা পাঞ্জাবী ঝুলছে। জায়গাটা নির্জন এবং ফাঁকা। আশে পাশে কেউ নেই।

রিতু জিজ্ঞেস করল উনি কোথায়?

ইব্রাহীম কোনো উত্তর দিল না। টিটন বলল, আমরা তো আর অ্যাপয়ন্টমেন্ট করে আসি নাই। উনাকে থাকতে হবে কে বলেছে?

রিতু মাথা নাড়ল বলল, তা ঠিক।

তিতু বলল, আমরা অপেক্ষা করি। জায়গাটা কী সুন্দর।

মিঠুন নিজের ঘাড়ে থাবা দিয়ে একটা মশা মেরে বলল, খালি মশাগুলো একটু রাজাকার টাইপ!

টিটন বলল, মশাকে দোষ দিবি না। মা মশাদের বাচ্চা জন্ম দেওয়ায় জন্য রক্ত খেতে হয়। কাজেই যতবার একটা মশা মারবি জেনে রাখিস তুই একটা মাতৃহন্তা।

রিতু বলল, হয়েছে। এখন মশার জন্য দালালি করতে হবে না।

ঠিক এই সময় ইব্রাহীম বলল, ঐযে, ইদরিস মিয়া আসছেন।

কোথায়? কোথায়?

ইব্রাহিম নিশ্চয়ই কথার উত্তর দিবে না তাই সবাই এদিক সেদিক তাকাতে থাকে। তখন দেখল পিছনে জঙ্গলের ভিতর থেকে একজন লম্বা মানুষ হেঁটে হেঁটে আসছে। মানুষটা এমনভাবে হাঁটছে যে দেখে মনে হয় সে বুঝি মাটিতে পা দিয়ে হাঁটছে না শূন্যের উপর ভাসতে ভাসতে আসছে। শুধু তাই না মানুষটাকে দেখে মনে হয় তার চারপাশে কী হচ্ছে সে কিছুই জানে না।

মিঠুন সবার আগে এবং তার পিছু পিছু অন্য সবাই মানুষটার দিকে এগিয়ে গেল। মানুষটা কাউকে দেখল বলে মনে হলো না। সে অনেকটা আপন মনে হেঁটে হেঁটে তার বিচিত্র চালাঘরটার নিচে গিয়ে বিছানাটা টেনে বিছিয়ে দিল। একটা চাটাইয়ের উপর একটা কথা তার ওপর একটা তেল চিটচিটে বালিশ। মানুষটা সেখানে পিঠ সোজা করে বসল যেন সে কোনো একটা ধ্যান করতে বসেছে।

বাচ্চারা কাছাকাছি গিয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে। মানুষটা তাদের দিকে তাকায় কিন্তু তাদের দেখছে কী না সেটা বোঝা গেল না। রিতু গলা পরিষ্কার করে বলল, আমরা ঢাকা থেকে এসেছি।

মানুষটা হ্যাঁ না কিছু বলল না, তাদের দিকে এক ধরনের শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। রিতু বলল, আমরা সবাই ভাইবোন। কাজিন বলতে পারেন।

মানুষটা এবারেও কিছু বলল না। রিতু বলল, আপনি নিশ্চয়ই ইদরিস মিয়া, মুক্তিযোদ্ধা?

এবারে মানুষটা একটু ভুরু কুঁচকে, তারপর শুকনো গলায় বলল তোমাদের কোনো একটা ভুল হয়েছে। আমি কেউ না।

তিতু অবাক হয়ে বলল, কেউ না?

মিঠুন হি হি করে হাসল, বলল, কেউ না কখনো হয় না। হাত দিয়ে ইদরিস মিয়াকে দেখিয়ে বলল, এই যে আপনি কেউ।

টিটন পিছন থেকে মিঠুনের কাঁধে ধরে একটা ছোট ধাক্কা দিয়ে বলল, মিঠুন, তুই চুপ করবি?

মিঠুন চুপ করল। রিতু বলল, আমরা ঢাকা থেকে এসেছি। আমরা আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাই।

মানুষটা বিচিত্র একটা দৃষ্টিতে রিতুর দিকে তাকিয়ে রইল, যখন মনে হলো কিছু বলবে না তখন হঠাৎ করে বলল, আমি কারো সাথে কথা টথা বলি না। তোমরা অন্য কোনোখানে যাও।

তিতু বলল, কিন্তু আমরা তো আপনার সাথেই কথা বলতে চাই। অন্য কারো সাথে না।

মানুষটা তিতুর কথার উত্তর দিল না। এতক্ষণ তাদের দিকে তাকিয়েছিল এবারে একটা নিশ্বাস ফেলে দূরে নদীর দিকে তাকিয়ে রইল। বোঝাই যাচ্ছে সে আর কথা বলবে না।

টিয়া প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আপনি আমাদের সাথে কথা বলবেন না?

মানুষটা কোনো কথা না বলে স্থির দৃষ্টিতে নদীর দিকে তাকিয়ে রইল। ইব্রাহীম চাচা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল, এবারে সে বলল, উনি আজকে মনে হয় কথা বলতে চাচ্ছেন না। চল, আমরা যাই।

রিতু বলল, আপনি যান। আমরা আর কিছুক্ষণ থাকি।

 ইব্রাহীম চাচা বলল, উনাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না।

রিতু বলল, আমরা বিরক্ত করব না। আমরা একটু বসে থাকি। আপনি যান।

ঠিক আছে। আমি অপেক্ষা করি। বলে ইব্রাহীম চাচা হেঁটে হেঁটে নদীর দিকে এগিয়ে গেল। ইব্রাহীম চাচা বেশ খানিকটা দূরে যাবার পর রিতু ইদরিস মিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে, আপনি যদি শুধু আমাদের কথা একটু শুনেন।

ইদরিস মিয়া নামের মানুষটা এবারে নদী থেকে চোখ ফিরিয়ে ওদের দিকে তাকালো। রিতু বলল, আমার নানার নাম ছিল আসাদ রহমান।

ছেলেমেয়েরা সবাই দেখতে পেলো ইদরিস মিয়ার পুরো শরীরটা কেমন যেন ঝাঁকুনি দিয়ে উঠল। রিতু শান্ত গলায় বলতে লাগল, আমার নানা একজন মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের পর আমার নানা কখনো ফিরে আসেন নাই। আমরা কেউ জানি না আমার নানার কী হয়েছে।

হঠাৎ করে মনে হলো ইদরিস মিয়ার শরীরটা অল্প অল্প কাঁপতে শুরু করেছে। রিতু একটু অবাক হলেও কথা থামাল না, বলতে থাকল, আমরা জানতে পেরেছি আমার নানা আসাদ রহমান এই এলাকায় যুদ্ধ করেছিলেন। আপনিও এই এলাকায় যুদ্ধ করেছেন। আমরা তাই আপনার কাছে জানতে এসেছি, আপনি কী যুদ্ধের সময় আমার নানাকে কখনো দেখেছেন, নানার কী হয়েছে আপনি জানেন?

ছেলেমেয়েরা অবাক হয়ে দেখল, ইদরিস মিয়ার সমস্ত শরীর কাঁপছে, তার দুই চোখ পানিতে ভরে উঠেছে। মানুষটা নিজের ঠোঁট কামড়ে তার চোখের পানি আটকানোর চেষ্টা করছে। পারছে না।

তিতু সামনে এগিয়ে মানুষটার হাত ধরে ফেলল, বলল, আপনি আমার নানাকে চিনেন? নানার কী হয়েছে আপনি জানেন। তাই না? তাই না?

মানুষটার চোখ থেকে ঝর ঝর করে পানি ঝরতে থাকে। ইদরিস মিয়া ভাঙা গলায় বলল, হ্যাঁ। আমি চিনি। আমি চৌত্রিশ বছর থেকে আসাদ ভাইয়ের কবরটা পাহারা দিচ্ছি। তোমাদের জন্য।

টিটন বলল, আমার দাদার কবরটা কোথায় আপনি জানেন? আপনি জানেন?

হ্যাঁ জানি। ইদরিস মিয়া একটা বড় নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমাদের দাদা, আসাদ ভাই মারা যাওয়ার পর তার পকেটে আমি একটা ফাটো আর একটা চিঠি পেয়েছিলাম। সেই চিঠি কাকে দিব আমি জানি না। তাই আমি তোমাদের দাদার কবরের কাছে বসে আছি। আমি জানি একদিন না একদিন তোমরা আসবে।

তিতু জিজ্ঞেস করল, আছে সেই চিঠিটা আপনার কাছে। হ্যাঁ, আছে। তোমাদের দিব।

টিয়া বলল, দাদার কবরটা দেখাবেন আমাদের?

দেখাব। আস আমার সাথে।

ইদরিস মিয়া উঠে দাঁড়ালেন। তারপর লম্বা লম্বা পা ফেলে হাঁটতে থাকেন। মিঠুন গিয়ে তার হাত ধরে বলল, আমরা কী আপনাকে দাদু ডাকতে পারি?

মানুষটা মিঠুনের দিকে তাকালো, তার মাথায় হাত রাখল, তারপর বলল, হ্যাঁ ভাই। তুমি আমারে দাদু ডাকতে পার। তোমার দাদু আমার মায়ের পেটের ভাই থেকেও বড় ভাই ছিল।

ইদরিস মিয়া ছেলেমেয়েদের নিয়ে জঙ্গলের মতো জায়গাটাতে ঢুকলেন, গাছপালার ভেতর দিয়ে ছোট একটা হাঁটা পথ। হেঁটে হেঁটে খানিকদূর যেতেই জঙ্গলটা একটু হালকা হয়ে গেল, তারপর বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। ফাঁকা জায়গাটায় নানা রকম ঝোঁপঝাড়। তার মাঝে খানিকটা জায়গা কেউ যেন ঝেড়ে মুছে রেখেছে। একটা বকুল ফুলের গাছ তার নিচে ঘন সবুজ ঘাসের একটা গালিচা। কেউ বলে দেয়নি কিন্তু তারা সবাই বুঝে গেল এটাই আসাদ রহমানের কবর। তাদের দাদার কবর। তাদের নানান কবর।

ইদরিস মিয়া কবরটার পাশে উবু হয়ে বসে সেখানে হাত রেখে ফিসফিস করে বলল, ভাইজান। আপনার নাতি নাতনিরা আপনারে দেখতে আসছে। আমি আপনারে বলছিলাম না, একদিন আসবেই না আসব? রিতু দেখল বোকা তিতুটা ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করেছে। তার না হয় মনটা নরম, সে কাঁদতেই পারে। কিন্তু অন্যদের চোখও কেন ঝাপসা হয়ে আসছে?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *