ত্রিশূল দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মহাদেব নিজের হাতে মোষের দিঘি খুঁড়েছেন এক রাতের মধ্যে। তাও আবার মা দুর্গার আবদারে। দেবমহিমায় নায়েববাবুর ঘন ভুরুতে গেরো পড়ে : এই দিঘিতে জাত-বেজাতের মানুষের হাত পড়লে ভোলানাথ আবার দ্বিতীয় একটা দক্ষযজ্ঞ করতে পারে, সেই ভাবনায় নায়েববাবু বড়ো কাতর। তার ভক্তিখচিত কাতরধ্বনি শুনতে শুনতে শরাফত সোজা হয়ে বসে চেয়ারের ওপর, মহাদেবের কিংবা তার ভক্তের বেসামাল রাগের ভয়ে তার শিরদাঁড়া একটু একটু কাঁপে।
দেবতা ও জমিদার দুই জনের প্রতিই নায়েববাবুর ভয় ও ভক্তি সমানভাবে বরাদ্দ, কর্তাবাবু তো তোমাদের জন্যে সর্বদাই খুব ভাবে, বুঝলে না? তাঁর প্রজাপাটের দশ আনাই মোসলমান, তোমার জাতের মানুষ। চার আনার বেশি নমশূদ্র। তার নিজের জাতের মানুষ আর কয়জন?-এই এস্টেটে বামুন কায়েত কতো তা তো জানোই। আর কর্তাবাবুর ছেলেরা তো জাত একরকম মানেই না, তাদের খাদ্যিখাওয়া ওঠাবসা সব সায়েবদের সাথে। জমিদারতনয়দের বৈপ্লবিক জীবনযাপনে নায়েববাবু যেমন গর্বিত দেবদেবীর প্রতি তার ভক্তিও তেমনি সীমাহীন। সে বলে, কিন্তু কথাটা বোঝো, ভালো করে বুঝে দেখো। কথাটা অন্যভাবে নিও না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে নায়েববাবু চোখজোড়া আধবোজা করে, মহাদেবের নিজের হাতে কাটা দিঘি, তাও কাটলেন মা দুর্গার কথায়, এই দিঘিতে ব্রাহ্মণও কোদাল বসাতে সাহস পায় না। আর অন্য জাতের হাতের কোদাল পড়লে কৈলাসনাথ সহ্য করেন কীভাবে? বলো, তুমিই বলো।
কৈলাস এখান থেকে কতো দূরে সে সম্বন্ধে শরাফতের ধারণা না থাকলেও ওখানকার বাসিন্দাদের ভক্ত নায়েববাবুকে সে ভালো করেই চেনে। আহলে হাদিস জামাতের মানুষ সে, মাঝি কলু কি হানাফি জামাতের অন্যসব মানুষের মতো হিন্দু দেবদেবীর নামে সে কখনো মানত করে না। কিন্তু ভয় একটু পায়। জমিদারের কাছারিতে বসে নায়েববাবু ও অনুপস্থিত মহাদেবের সঙ্গে বেয়াদবি করার ইচ্ছা কিংবা সাহস তার একেবারেই নাই। যতোক্ষণ ওখানে ছিলো ভয় ও ভক্তিকে সে এক মুহূর্তের জন্যে কাছছাড়া করে নি। দিঘিটা যে মহাদেবের কাটা তাও সে জীবনে প্রথম শুনলো। কোম্পানির গোরা সেপাইদের কেটে ভবানী সন্ন্যাসী তার খাড়াটা ধোবার জন্যে এই পুকুর কাটে বলে ছোটোবেলা থেকে সে গল্প সে শুনে আসছে সেটা কি তবে ঠিক নয়? তবে নায়েববাবুকে চটিয়ে তার লাভ কী? কথাটা না তুলেই সে কাছারি থেকে ফেরে।
গোলাবাড়ি হাটে ভুটিয়া ঘোড়া থেকে নেমে শরাফত এদিকে ওদিক তাকাতেই গফুর কলু ছুটে আসে কাদেরের দোকান থেকে। গফুর ঘোড়া ধরলে সে বলে, দোকানের পিছনে ছায়া দেখ্যা বান্ধ্যা রাখ। বিকালবেলা কাউকে দিয়া বাড়িত পাঠায়া দিস।
গফুরকে হুকুম দিতে দিতে কাছারির ভয়টা তার তরল হয়। দোকানের ভেতরে ক্যাশবাকসের পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে কাদের। বাপকে দেখে দাড়ালো তা কিন্তু নয়। লীগের কর্মীদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে সে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলো। তার পেছনে–টিনের দেওয়ালে সাঁটা আগামী রবিবার টাউনে মুসলিম লীগের মিটিঙের পোস্টার। পোস্টারের একেবারে ওপরে আড়াআড়িভাবে আঁকা মুসলিম লীগের নিশান, তার ওপরে লেখা, পাকিস্তান জিন্দাবাদ ও মুসলিম লীগ জিন্দাবাদ। অন্য তিন দিকে টিনের বেড়ায় পুরোনো দৈনিক আজাদের ওপর গাঢ় নীল কালিতে লেখা পোস্টার। ঘরের এক দিকে টিনের বেড়া ঘেঁষে কেরোসিন তেলের টিন সাজানো, অন্য দিকে খালি টিন একটু এলোমেলোভাবে রাখা। খালি টিনগুলোর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে শরাফত গত দুইদিনের বিক্রির পরিমাণটা আন্দাজ করে নিলো।।
আবদুল কাদেরের দিকে মুখ করে দুটো বেঞ্চে গাদাগাদি করে বসেছিলো ১২/১৪ জন ছেলে, কাদের এদের সঙ্গেই কথা বলছিলো। শরাফত মণ্ডল আজকাল যখনি। দোকানে আসে এক দঙ্গল ছেলে দেখতে পায়। দিনরাত এরকম দরবার করলে ব্যবসা হবে? মণ্ডলের মেজাজটা খিচড়ে যায়, হিন্দুদের সঙ্গে লাগতে চাও;—দেখো হিন্দুর বাচ্চা কী করে ব্যবসা করে। এই তো কয়েজ গজ পরেই মুকুন্দ সাহার আড়ত, চার চালা টিনের ঘর, বাপের আমলে যেমন ছিলো তেমনি আছে, একটা টুলও বাড়ায় নি। অথচ ব্যবসা। চালাচ্ছে চুটিয়ে! আজ হাটের দিন নয়, তবু আড়তের সামনে বাঁধা ৪/৫টা ঘোড়া, আদা রসুন জিরা নিয়ে এসেছে পাইকাররা। দোকানে বসে সাহা কি কখনো আড্ডা মারে? আর কাদেরের ঘরে এতোগুলো ছোকরা, বিড়ির ধোঁয়ায় ঘর অন্ধকার। মুরুব্বি গোছের খদ্দেরদের এখানে ঢুকতে কি একটু বাধো বাধো ঠেকবে না?
তবে কিছুক্ষণের মধ্যে এই ক্ষোভ ও বিরক্তি শরাফত সামলে নেয়, তাকে দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে-পড়া ছেলেদের দেখে একটু চাঙাই হয়ে ওঠে। পিপাসা না পেলেও সে তখন এক গ্লাস পানি খেতে চায়। শুধু তার জন্যেই দোকানে রাখা বড়ো কসার গ্লাস হাতে গফুরকে বাইরে টিউবওয়েলের দিকে যেতে দেখে সে বলে, এখন থাক। কাদের তখন গফুরের হাত থেকে গ্লাস নিয়ে ওটা এগিয়ে দেয় গিরিরডাঙার চাষীপাড়ার একটি ছেলের দিকে। এবার পানি খাওয়া স্থগিত রাখার দরকার হয় না শরাফতের। পানি খেয়ে আরামের নিশ্বাস ছেড়ে সে বলে, মোষের দিঘিত নালা কাটা যাবি না। ওই দিঘি বলে দেও দানবে কাটিছে, লায়েববাবু কয়, মহাদেবের লিজের হাতে কাটা দিঘি, মোসলমানে কোদাল ধরলে ঠাকুর কোদ্দ হবি।
দেবতার ক্রুদ্ধ হবার কথায় জ্বলে ওঠে কাদের, মোসলমানের ভালো দেখলেই হিন্দুর গাও জুলে। এই বাক্য তার একটু আগে বলা কথার জের হিসাবে চালানো যায়, প্রসঙ্গটি অব্যাহত রাখতে তাই তার অসুবিধা হয় না, হিন্দু জমিদার ফুটানি মারে মোসলমান প্রজার রক্ত চুষে। পাকিস্তান না হলে মোসলমানের জান মাল ইজ্জত সব বিপন্ন।
এর মধ্যে দরজায় এসে দাঁড়িয়েছে বৈকুণ্ঠ গিরি। কাদেরের কথা সে শুনছে খুব মন দিয়ে। কাদেরের কথা শেষ হলেও সে সরে না, বরং ফের পান মুখে দেওয়ায় জর্দার গন্ধে তার অবস্থান আরো শক্ত হয়। শরাফত মণ্ডল ও কাদের বাড়ি যাবার জন্যে পা বাড়ালে বৈকুণ্ঠ এগিয়ে মণ্ডলের কাছে এসে বলে, কাকা, আপনের সাথে বাবুর কী দরকার, কী নাকি কথা আছিলো।
ও হ্যাঁ, শরাফতের হঠাৎ কী মনে পড়লে কাদেরকে বলে, তুমি একটু বসো, মুকুন্দবাবুর সাথে কথাটা সারা আসি।
শরাফত মুকুন্দ সাহার আড়তের দিকে গেলেও বৈকুণ্ঠ দাঁড়িয়েই থাকে, কাদেরকে সে জিগ্যেস করে, দাদা, আপনাগোরে না সভা হবার কথা? সভাত গান হবি তো? গান না হলে সভা কিসের?
গোলাবাড়ি হাটে তখন শেষ দুপুর। বটতলায় একটি ভিখিরিনী বসে পাতা জ্বালিয়ে রান্নার আয়োজন করছে। দোকানপাট সব বন্ধ, একটি দোকানের সামনে বাঁশের মাচায় শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে ৭/৮ বছরের একটি মেয়ে, ওই ভিখিরিনীরই মেয়ে হবে। হঠাৎ করে কার্তিক মাসের ফাজিল মেঘের ছপছপ বৃষ্টি হলেও মেয়েটির ঘুম ভাঙে না, মায়েরও রান্নার খুব একটা ব্যাঘাত হচ্ছে বলে মনে হয় না।
বৃষ্টি থামলেও শরাফতের ছাতা খোলাই থাকে, তবে রাস্তায় নেমে সে বলে, বৃষ্টি আর হবি না। বৃষ্টিরই দরকার, না হলে ফসল মার যাবি।
কিন্তু আবদুল কাদেরের মনোযোগ অন্য দিকে। সারাটা পথ ধরে সে হিন্দু জমিদারদের জুলুম নিয়ে গজগজ করে। আবার বাপের অপমানও তার গায়ে লেগেছে। জিগ্যেস করে, নায়েববাবু কি আপনার সাথে খুব খারাপ ব্যবহার করিছে বাপজান?
আরে না, তুমি কী কও! শরাফত ছেলের ভয়কে উড়িয়ে দিতে চাইলেও বুকের ভেতরটা একটু খচ খচ করে। নায়েববাবুর তলব এসেছিলো সকালে, শরাফত তখন চিড়াদুধকলা নাশতা করে উঠে হাত ধুচ্ছে। কাদের তখনো নাশতা করে নি, সে তার ভাইপোর জ্বর দেখছিলো থার্মোমিটারে। তখন বাড়িতে এসে হাজির হলো নায়েববাবুর খাস পেয়াদা হাতকাটা অসিমুদ্দি। অসিমুদ্দি স্পষ্ট করে কিছু বলে নি, শুধু জানালো মোষের দিঘি থেকে নালা কাটা নিয়ে নায়েববাবু কার কাছে কী শুনেছে, শরাফতের সঙ্গে তাই নিয়ে আলাপ করতে চায়। নায়েববাবুর হুকুম তামিল করতে বাপকে তড়িঘড়ি করে পিরান ও টুপি পরতে দেখে কাদের আড়চোখে তাকিয়ে বলে, হুমায়ুনের জ্বর তো আজ বেশি। হুমায়ুনের মায়ের দিকে থার্মোমিটার এগিয়ে দিয়ে সে নিজের বাকস থেকে বার করে একটা জিন্না টুপি। বাপের সামনে বিছানায় টুপি রেখে কাদের বলে, বাপজান, এই টুপি মাথাত দেন।
শরাফত কিন্তু নিজের কিস্তি টুপিটাই ফুঁ দিয়ে মাথায় চড়ালো, তবে ছেলের নতুন কেনা জিন্না টুপিটা তাকে ফিরিয়ে দিলো না, আজিজের বৌয়ের হাতে তুলে দিয়ে বললো, বাবরের মা, রাখো, বাবরের মাথাত হবার পারে।
এখন ছেলের সঙ্গে বাড়ি ফিরতে ফিরতে শরাফত মণ্ডলের মনে হয়, জিন্না টুপিটা . মাথায় থাকলে নায়েব আরেকটু হুঁশিয়ার হয়ে কথা বলতো। তা বয়স হতে হতে নায়েব এমনিতেই অনেকটা নরম হয়ে আসছে, তার কথাবার্তা আজকাল আগের চেয়ে অনেক ভালো,। আজ এতোদিন পর হঠাৎ এরকম বেঁকে গেলো কেন? মণ্ডল বেঞ্চে বসার আগেই নায়েব বলে, কী মণ্ডল, তোমার তো দেখাই পাই না। তা তোমাদের সাথে আজকাল বড়ো বড়ো মানুষের খাতির, আমাদের তো মনে হয় পোঁছেই না। আমাদের দিন শেষ হয়ে গেলো নাকি?
শরাফত চুপ করে থাকে, নায়েববাবুর কাছে এর চেয়ে অনেক খারাপ ব্যবহার সে আগে মেলা পেয়েছে। তবে আজ মোষের দিঘির পুবের জমিটা পত্তন নেওয়ার কথাটা আর তোলা যাবে না বলে সে দমে যায়।
নায়েব বলে, তোমার বেটা তো পাকিস্তানের মিটিং করে বেড়ায়। ভালো, বাপু ভালো। আমাদের এস্টেটের একটা ছেলে উঠতে পারলে আমরা খুশি। দেখো না, কাউনসিলে যেতে পারে কি-না। আবার শুনি, জমিদারি নাকি উচ্ছেদ করবে। দেখো। বাপু, জমিদারি আর ধনসম্পদ সব দুইদিনের ভোগ। কর্তাবাবু বলেন, পূর্ণ, এসব কিছুই থাকবে না। দেশটা ছোটোলোকদের অধিকারেই যাবে। কিন্তু আমার অনুরোধ, জাতটা মেরো না। জাত গেলে মানুষের আর থাকে কী?
কী যে কন বাবু, কী যে কন। জমিদারি না জাত,-কোন প্রসঙ্গে শরাফত নায়েববাবুর খেদ ও আকুতিতে সাড়া দিচ্ছে তাও পরিষ্কার করতে পারে না সে।
তোমাদেরই তো এখন দিন! মন্ত্রী বলো, উজির নাজির সবই তো তোমাদের। চাকরি বাকরি তো ভদ্রলোকের ছেলেদের জন্যে বন্ধই করে দিয়েছে। কয়টা দিন গেলে দেশে আর চাষাবাদ করার মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। চাষারা হ্যাটকোট পরে অফিস কাছারি করবে। তা করুক। অন্নদাতা ভগবান, জীব যখন দিয়েছেন, অন্নও তিনি জোগাবেন। কিন্তু বাপু, জাত মারার ফন্দি করলে-
এই অসমাপ্ত ব্যাক্যের জবাব শরাফত মণ্ডল দেয় কী করে? তাকে উদ্ধার করে নায়েব নিজেই। প্রথমে জানায় যে, মোষের দিঘিতে নালা কাটা শুরু করে শরাফত বিবেচনাবোধের পরিচয় দেয় নি। তারপর নায়েব হঠাৎ করে প্রশ্ন করে, মণ্ডল, তুমি তো বুড়ো হলে। এখানকার সবই তো জানো। এই দিঘি কে কেটেছে, কাটার উদ্দেশ্য কী ছিলো জানো না?
এই এলাকায় এসব আবার জানে না কে? আষাঢ়ের অমবস্যায় রাত্রি আড়াই প্রহরে কাৎলাহার বিলের উত্তর সিথানে, পাকুড়গাছ থেকে অল্প তফাতে পানিতে একটা কাত্রা ভেসে ওঠে। মণ্ডল এই গপ্পো বলতে শুরু করলে নায়েব ভুরু কোচকায়, কাত্রা? মণ্ডল। বুঝিয়ে বলে, কাত্রা মানে বলি দেওয়ার জন্যে জোড়া কাঠ। মানে–নায়েব হাত তুলে থামায়, যূপকাষ্ঠ? শব্দটির মানে জানে না বলে মণ্ডল চুপ করে থাকলে নায়েব বলে, আরে এসব তো বানেয়াট গল্প। তা বানোয়াট গল্পটাই তো এখানে ঘটে আসছিলো বহুকাল থেকে ওই কাত্রা ভেসে উঠলে সেখানে জোড়া পাঠা বলি দিয়ে শত্রুবিনাশ হয়, বিলের দুই ধারে রোগবালাই থাকে না। তা এখন আর কেউ বলি টলি দেয় না, তাই কাত্রাও বুঝি রাগ করে আর ভেসে ওঠে না।বলি দেবে কোথেকে?-বলির পাঁঠা তো কিনে আনলে চলবে না। সেই রাতে মুনসির পোষা গজারের সবগুলি ভেড়ার আকার পায় না, এক জোড়া গজার মাছকে মুনসি সেই রাতে ভাসিয়ে দেয় সাদা পাঁঠার শরীরে। কবে কয়শো বছর আগে কোন সন্ন্যাসী এদিকে এসেছিলো, মানাস নদীর তীরে লড়াই করতে করতে কোম্পানির গোরা সেপাইদের সে নাকি নিজের হাতে বলি দিয়েছিলো। শেষ পর্যন্ত সন্ন্যাসী মারা পড়ে সেপাইদের হাতেই। তা মরে গিয়ে লোকটা বছরের একটা দিন এখানে আসে, বিল থেকে কাত্রা তুলে নিয়ে মুনসির দেওয়া পাঁঠা বলি দিয়ে সে ঠাঁই নেয় পোড়াদহ মাঠের বটতলায় সন্ন্যাসীর থানে। যাবার আগে বলি দেওয়ার খাড়াটা সে ধুয়ে নেয় মোষের দিঘিতে। ওই রাতে মানুষজন এদিকে আসে না, আসা নিষেধ। কিন্তু পরদিন মোষের দিঘির মাঝখানে গোলাপি রঙের পানি ভাসতে থাকে।
গল্প শুনে নায়েববাবু হাসে, এই গল্প শুনে লোকটা অনেকবার এমনি করে হেসেছে। তার সঙ্গে হাসে শরাফত মণ্ডল। হিন্দুদের এইসব গালগল্প সে বিশ্বাস করে না। তবে মাঝি আর কলুদের কথা আলাদা, তারা কতোটা মোসলমান তাই নিয়ে মণ্ডল প্রায়ই এটা ওটা বলে। আর তার আত্মীয়স্বজনের মধ্যেও সব কেচ্ছা বলার লোকের অভাব নাই। তবে আজকাল কাত্রা টাতরা আর ওঠে না, উঠলেও কেউ দেখতে পায় কি-না সন্দেহ।
এ গ্রামবাসীর অজ্ঞতা ও কুসংস্কারে নায়েববাবু দুঃখিত হয়। নায়েববাবু বলে, আরে, মহাদেবের দিঘিকে কুসংস্কারাচ্ছন্ন নমশূদ্ররা চালিয়ে দেয় সন্ন্যাসীর নামে। তাঁর দুর্গার সখের দিঘিতে বেজাতের মানুষের হাত পড়া কি দেবতা সহ্য করবেন? এই পাপ কি গিরিরডাঙা, নিজগিরিরডাঙার প্রজাদের, এমন কি এদের কলকাতাবাসী জমিদারবাবুকেও স্পর্শ করবে না?
কিন্তু কাদেরকে তো শরাফত মণ্ডল সব খুলে বলতে পারে না। মাথাগরম ছেলে তার, এসব শুনে আবার কী করতে কী করে ফেলে! না বাবা, জমিদারের কোপে পড়লে কাৎলাহারের এপার-ওপার জুড়ে বিস্তীর্ণ জোত করার সাধ তার কখনো মিটবে না। নায়েববাবুকে সে চটায় কী করে? নায়েব এখন কলো নরম মানুষ হয়েছে এই মানুষের রাগ কাদের কি কিছু দেখেছে? শরাফতের বাপচাচাকে কাছারির কোনো নায়েব তুইতোকারি ছাড়া ডাকে নি। অনেক আগে শরাফতের জ্যাঠা পিয়ারুল্লা মণ্ডলকে আগের নায়েব ডাকতো শিয়ারুল্লা বলে, এই নায়েবের আমলে সে পরিচিত হলো শিয়ালু বলে এবং মরার পরও ওই নাম থেকে জ্যাঠা তার রেহাই পায় নি, তার ছেলেমেয়ে নাতি নাতনি সবার বাপদাদার নাম এখনো লেখা হয় শিয়ালু মণ্ডল। সেই লোকের ভাইপো হয়েও শরাফত নায়েবাবুর কাছে আসল নামে স্বীকৃত এবং তুমি বলে সম্বোধিত হয়। হবে না কেন? আল্লায় দিলে শরাফত কিছু জোতজমি করেছে, গিরিরডাঙায় বাপের ছনের ঘর ভেঙে টিন দিয়ে সব ঘর তুলেছে বড়ো বড়ো। তার দুই ছেলের একজন ম্যাট্রিক পাস করে সরকারি চাকরি করে, আরেকজন বছর তিনেক কলেজে পড়েছে। সব তো জমির কল্যাণেই। আর নায়েববাবুর নেক-নজরটা না থাকলে জোতজমি কি আর হেঁটে হেঁটে তার হাতে আসে?
কালাহার বিলের কাছাকাছি এসে শরাফতের হাঁটার গতি হঠাৎ করে বাড়ে এবং রাস্তা থেকে সে নেমে পড়ে ডান দিকে জমির আলে। পাকুড়তলার দিকে হাঁটা দিলে তার গতি আরো বাড়ে এবং এতে কাদেরের অস্বস্তি টের পেয়ে সে বলে, হুরমতের জমিটা দেখাই যাই। বুড়া মরিচের কী করিচ্ছে বোঝা দরকার। মুকুন্দ তোদর এবার ভালোই দিবি কলো।
বেলা হেলে পড়েছে, একটু আগে বৃষ্টি হওয়ায় আকাশ এখন মেঘশূন্য, শেষ রোদের তেজ একটু বেশি। খিদায় কাদেরের শরীর এলিয়ে পড়েছে। তার ওপর পাকুড়তলায় বড়ো বড়ো গাছের জঙ্গল, ওদিক দিয়ে এই অবলোয় হাঁটতে একটু গা ছমছম তো করেই। কিন্তু বাপ তার সিদ্ধান্ত একটা নিয়ে ফেলেছে, তাকে নড়ানো অসম্ভব।
ঝোপজঙ্গল পেরিয়ে জমির আলে আলে হেঁটে মোষের দিঘির ধারে পৌঁছে কাদের ফের চাঙা হয়ে ওঠে, বলে, এই দিঘিতে মোসলমানের কোদাল পড়লে দোষ হয়, না? নিজের কথায় তেতে উঠে সে বার করে বিকল্প উপায়, বিল কাটলেই তো হয় বাজান। বিল থেকে নালা নেওয়া যায় না? শরাফত কিছুই না বললে কাদেরের ধৈর্য থাকে না, বিল কাটলে মুনসি আবার লাফালাফি শুরু করবি না তো?
মুনসির স্বভাব নিয়ে এরকম বাঁকা কথা শরাফতের, গায়ে বেঁধে, তার একটু ভয় ভয়ও করে। তবে ছেলের প্রস্তাব সে বিবচেনা করে বৈ কি! কাৎলাহার বিল তো একরকম তার নিজের সম্পত্তিই। এই বিল ইজারা নিতে তার কম ভোগান্তি হয় নি। নায়েববাবুকে সেলামি দিতে হয়েছে দফায় দফায়, লাঠিভাঙা কাছারিতে নানা স্তরের আমলা থেকে মিষ্টি খাওয়াতে হয়েছে পাইক বরকন্দাজ সবাইকে। মনে হয় কুত্তাবিলাইও একটা বাদ পড়ে নি। কালকাতায় জমিদারবাবুকে খাওয়াবার নাম করে নায়েববাবু হাতিবান্ধার দৈ নিয়েছে হাঁড়ি হাঁড়ি। তার পৌঁছানোর খরচা পর্যন্ত জোগাতে হয়েছে শরাফতকে।-এতো কষ্টের বিল তার, জমিতে পানি সেঁচতে সেখান থেকে নালা কাটতে পারবে না কেন? কাদেরের পরামর্শটা ভালো। নালা কাটার কাজে তমিজকে মাগনা খাটানো যাবে, এই ব্যাপারে প্রথম উৎসাহটা তো তারই।
কিন্তু আমনের খেতে তমিজ নাই, পাশে মরিচের জমিতে হুরমতও নাই। আলের ওপর কুলগাছের সঙ্গে ঠেস দিয়ে রাখা হুরমতুল্লার হুঁকা, পাশে তার বদনা ভরা পানি। আবার পাশের জমিতে মাঝে মাঝে কেটে রাখা আগাছার ছোটো ছোটো স্তুপ।-কিন্তু এরা গেলো কোথায়? শরাফত জমিতে মরিচের গাছের বাড় পরীক্ষা করে। এখনো কিছু বোঝা যাচ্ছে না।
কিছুক্ষণ পর দেখা গেলো নিজের ঘর থেকে ছুটে আসছে হুরমতুল্লা। পথ সংক্ষেপ করতে সে উঠে পড়েছে মোষের দিঘির উঁচু পাড়ের ওপর এবং তাতে সময় লাগছে আরো বেশি। উঁচু পাড়ে উঠে সে হাঁপায় এবং হাঁপাতে হাঁপাতে চিৎকার করে, ক্যা রে নবিতন, পান লিয়া আয়, পান লিয়া আয়। মেয়ের প্রতি এই নির্দেশে বেশিরকম জোর থাকায় তার গলা চিরে চিরে যায় এবং শুরু হয় কাশি। কাশির দমকে দৌড়ুবার বল পাওয়া যায় না, আবার দৌড়ুবার ফলে কাশির স্বচ্ছন্দ প্রকাশ বিঘ্নিত হয়।
হুরমত শেষ পর্যন্ত এসে দাঁড়ায় শরাফতের সামনে এবং হাঁপাতে থাকে। একই সঙ্গে অনেক কথা বলার উদ্যোগ নিয়ে কী বলবে বুঝতে না পেরে সে ফের চাঁচায়, ক্যা রে নবিতন, কথা কানোত যায় না?
কী গো, তোমরা সব কোটে গেছো? তমিজ কোটে? কিন্তু শরাফতের প্রশ্নের জবাব দেওয়ার চেয়ে তাকে আপ্যায়নের গুরুত্ব হুরমতুল্লার কাছে অনেক বেশি। ফের মেয়েকে ডাকতে শুরু করলে ক্লান্তি ও উত্তেজনায় তার গলার। স্বর বেরোয় না, পিঠে কাঁটা বেঁধার ঝুঁকি নিয়েও কুলগাছের সঙ্গে হেলান দিয়ে সে বিড়বিড় করে, কী জ্বালা, কানোত কথা সান্দায় না। এতো ডাক পাড়িচ্ছি, কেউ আসে না।
এর মধ্যে মোষের দিঘির ওপার থেকে ফিরে আসে তমিজ, তার হাতে মাটির সানকিতে পান, শুপারি, চুন ও তামাক পাতা। শরাফত নিজেই পান সেজে মুখে দিলে তমিজ জানায়, ফুলজানের ছেলেটা খেতে বসে হঠাৎ বেহুঁশ হয়ে পড়ে গিয়েছিলো, তার মুখের কষে ফেনা বেরিয়ে যায়। ফুলজান, নবিতন ও ফালানির সমবেত আর্তনাদ শুনে হুরমতুল্লা ও তমিজ দৌড়ে গিয়েছিলো। তমিজের বুদ্ধিতেই চার বছরের ছেলেটির মাথায় পানি ঢালা হলো অনেকক্ষণ ধরে, এখন সে অনেকটা সুস্থ, ফুলজান এখন তাকে ভাত খাওয়াচ্ছে।
কাদের বলে, বেহুঁশ হয়া গেছিলো? ভালো কথা নয় তো। তোমার নাতির না কালাজ্বর শুনিছিলাম। চিকিৎসা করাও না?
হুরমতুল্লা প্রথমে তার নসিব ও নিরুদ্দিষ্ট দায়িত্বহীন জামাইকে গালি দেয় এবং কাদের তার প্রশ্নের যথাযথ জবাব দেওয়ার জন্যে তাগাদা দিলে সে তার নাতির চিকিৎসার একটি বিবরণ ছাড়ে, আর বছর লাঠিভাঙার যতীন কোবরাজের ওটি হামি লিজে যায়া বড়ি লিয়া আসিছি, ছয় আনা খচর কর্যা ওষুধ লিয়া আলাম, দুটা বড়ি খায়া আর খালো না। আর বড়িগুলান ফেরত দিবার গেলাম, কোবরাজ বড়িও লেয় না, পয়সাও দেয় না। তিন মাস আগেও পীরসাহেবের, মহাস্থানের শাহসাহেবের পানিপড়া লিয়া আসিছি দুইবার, সাড়ে চার আনা দিলাম মাজারত, আসা যাওয়ার খরচ-তাও তিন আনা চোদ্দ পয়সা,কতো হলো?
আরে থোও তোমার পানি পড়া! ওষুধ না দিলে ব্যারাম সারে? ছাইহাটার সাকিদারবাড়ির ইমান আলি সাকিদারের বেটা করিমকে দেখাও। এল এম এফ ডাক্তার, নতুন পাস করা আসিছে। নাতিক নিয়া একদিন যাও। দেরি করো না।
বাড়ির কাছে হরেন ডাক্তার থাকতে ছাইহাটা যাওয়ার দরকার কী? ডাক্তার নির্বাচনে শরাফত ছেলের পরামর্শ অনুমোদন করে না, হরেন কি আজকের মানুষ? এদিককার রোগীপত্তর তো সবই তার হাতে।
হরেন ডাক্তার অনেকদিনের লোক ঠিকই, কাদের জোর দিয়ে বলে, কিন্তু একটা মোসলমান ছেলে নতুন প্র্যাকটিস করতে বসিছে, কোয়ালিফায়েড় ছেলে, তাকে একটু হেলপ না করলে কি চলে?
কিন্তু হুরমতুল্লার নাতির চিকিৎসা সংক্রান্ত আলাপে সময় নষ্ট করা শরাফতের পক্ষে সম্ভব নয়। সে তাই তোলে পানি সেঁচার কথা, তমিজ তোর জমিত তো ফাটা ধরিছে। আর কয়টা দিন গেলে।।
তমিজ তো এই প্রসঙ্গটির জন্যেই ব্যর্থ হয়ে ছিলো। মোষের দিঘিতে কোদালের কোপ পড়তে না পড়তে কাজটা বন্ধ হয়ে গেলো, এর ভেতর হুরমতুল্লার কোনো ফন্দি আছে কি-না কে জানে? তবে হুরমত সম্বন্ধে কোনো সন্দেহ ঘুণাক্ষরেও যাতে তার মুখ দিয়ে না বেরোয় সে ব্যাপারে সে খুব হুঁশিয়ার, একটু ভেবে বলে, নালা কাটা হলে আপনার ব্যামাক জমিতই ফসল ভালো হবি। আমি তো খিয়ারেত অনেক–।
না রে, মোষের দিঘি কাটা হবি না শরাফতের এই কথায় কাদেরের উত্তেজনা বাড়ে, প্রস্তুতি নিয়ে সে আরম্ভ করে, শালা জমিদাররা প্রজার ভালো দেখলে–।
তার পাকিস্তান প্রসঙ্গ আসার আগেই শরাফত তাকে থামিয়ে দেয়, তমিজকে বোঝায়, ওই দিঘি তো হামি পত্তন নেমো, বুঝছিস? আগেই নালা ক্যাটা এমন সোন্দর দিঘিটা লষ্ট করি! নালা কাটলেই বর্ষার ঘোলা পানি সান্দাবি। নায়েববাবুক সেই কথাই কবার গেছিলাম।
আবদুল কাদির হাঁ করে বাপের কথা শোনে। এখন নায়েববাবুর শয়তানির কথা চেপে যাচ্ছে দেখে বাপকেও তার দুটো কথা শুনিয়ে দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু রাফত এখন তার দুই বর্গাচাষার সঙ্গে কালাহার থেকে নালা কাটার আলাপে নিয়োজিত। কিছু বলতে না পারায় কাদেরের রাগ তাই বেড়েই চলে, সে কেবলি থুথু ফেলতে থাকে।