একাদশ পরিচ্ছেদ – মুসলিম যুগের উত্তরার্ধের রাজ্যশাসন ব্যবস্থা
১
বারো ভুঞার যুগ
জাহাঙ্গীরের রাজত্বে এবং সুবাদার ইসলাম খাঁর কঠোর নীতিতে, বাংলার মুঘল শাসনপ্রণালী দৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত হয়। আকবরের হস্তে দাউদ খান কররানীর পরাজয়ের পরে প্রায় চল্লিশ বৎসর পর্যন্ত বাংলায় কোন শৃঙ্খলাবদ্ধ শাসনপ্রণালী ছিল না। বারো ভুঞা নামে পরিচিত বাংলার জমিদারগণ স্বেচ্ছামত নিজের নিজের রাজ্য শাসন করিতেন। সুতরাং ইহা বারো ভুঞার যুগ বলা যাইতে পারে। পরবর্তীকালে বাঙালীর কল্পনায় এই যুগ এক নূতন রূপে চিত্রিত হইয়াছে। মুঘলদের সঙ্গে বারো ভুঞার সংঘর্ষ বাঙালীর স্বাধীনতা রক্ষার যুদ্ধ বলিয়া কল্পিত হইয়াছে এবং বাংলার যে সকল জমিদার মুঘলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়াছিলেন, তাঁহাদের অপূর্ব বীরত্ব ও স্বদেশপ্রেম রঙীন কল্পনায় রঞ্জিত হইয়া সাহিত্যে ও বাঙালীর মনে উজ্জ্বল রেখাপাত করিয়াছে।
বারো ভুঞাদের প্রায় সকলেই এই যুগসন্ধির অরাজকতার সুযোগ লইয়া বাংলার নানাস্থানে স্বীয় আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। ইহারা কোন প্রাচীন বংশের প্রতিনিধি নহেন এবং নিজের সম্পত্তি রক্ষার জন্যই যুদ্ধ করিয়াছিলেন। ইঁহাদের কেহ কেহ অসাধারণ বীরত্ব দেখাইয়াছেন, কিন্তু বাঙালীর কল্পনায় যাহারা বীর বলিয়া খ্যাতি লাভ করিয়াছেন, তাঁহারা সকলেই ইহার যোগ্য নহেন। প্রতাপাদিত্য অতুলনীয় বীর ও দেশপ্রেমিক বলিয়া খ্যাতিলাভ করিয়াছেন, কিন্তু তিনি কোন যুদ্ধেই বীরত্ব দেখাইতে পারেন নাই এবং বাঙালী জমিদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুঘল সুবাদারকে সাহায্য করিবেন বলিয়া প্রতিশ্রুতি দিয়াছিলেন। যাহারা বীরত্ব দেখাইয়ছিলেন ঈশা খাঁ, উসমান প্রভৃতি–তাঁহাদের অধিকাংশই মুসলমান। যে অর্থে মুঘলেরা বাংলায় বিদেশী, সে অর্থে এই সব পাঠানেরাও বিদেশী। পাঠানেরাও হিন্দুদের উপর অত্যাচার কম করেন নাই এবং স্বার্থের খাতিরে বাংলার হিন্দুদের সহিত একত্র হইয়া সাধারণ শত্রু মুঘলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করিয়াছেন। সুতরাং বারো ভুঞার যুগ হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের উপর প্রতিষ্ঠিত বাঙালী জাতির বিদেশী মুঘল শত্রুর আক্রমণ হইতে দেশের স্বাধীনতা রক্ষার্থে সংগ্রামের যুগ–এরূপ মনে করিবার কোনই কারণ নাই। মুঘলরা বাংলা দেশ অধিকার না করিলে হয় বারো ভুঞার অরাজকতার যুগই চলিত, নয় তো কোন মুসলমান জমিদার বাংলায় একচ্ছত্র আধিপত্য স্থাপন করিয়া আবার পাঠান যুগের প্রবর্তন করিত। কারণ কোন হিন্দুকে যে মুসলমানেরা রাজা বলিয়া স্বীকার করিত না, হিন্দু রাজা গণেশ ও তাঁহার মুসলমান ধর্ম্মাবলম্বী পুত্রের ইতিহাস স্মরণ করিলেই সে বিষয়ে কোন সন্দেহ থাকে না। মুর্শিদকুলী খাঁর সময় হইতে বাংলার মুসলমান নবাবগণ বাংলা দেশেই স্থায়িভাবে বসবাস করিতেন। সিরাজউদ্দৌলা, মীর কাশিম প্রভৃতিকেও বাঙালীরা ইংরেজের বিরুদ্ধে বাংলা দেশের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামের নায়ক বলিয়া কল্পনা করিয়াছেন। ঐতিহাসিক তথ্যের দিক দিয়া পাঠান জমিদারদের মুঘল শক্তির সহিত যুদ্ধের সঙ্গে ইহার কোন প্রভেদ নাই। সপ্তদশ শতাব্দীতে যে মুঘলরাজ বিদেশী শত্রু বলিয়া পরিগণিত হইত–তাহারাই অষ্টাদশ শতাব্দীতে পাঠান জমিদারদের ন্যায় বাংলায় স্বাধীনতা সংগ্রামে স্বদেশপ্রেমিক বলিয়া খ্যাতি লাভ করিয়াছে। এই দুইয়ের তুলনা করিলেই দেখা যাইবে যে জাতীয়তা এবং স্বাধীনতার সংগ্রামের দিক দিয়া বারো ভুঞার যুগের সহিত নবাবী আমলের বাংলার যুগের বিশেষ কোন প্রভেদ নাই। সিরাজউদ্দৌলা ও মীর কাশিমের বিরুদ্ধে যাহারা ইংরেজের সহিত চক্রান্ত করিয়াছিলেন, তাঁহাদের অধিকাংশই ছিলেন হিন্দু। সুতরাং হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের উপর প্রতিষ্ঠিত বাঙালী জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের কল্পনা মুঘল যুগের প্রারম্ভের ক্ষেত্রেও যেরূপ, ইংরেজ আমলের প্রথম ভাগের ক্ষেত্রেও সেরূপ অলীক ও সম্পূর্ণরূপে অনৈতিহাসিক।
২
মুঘল শাসনপ্রণালী
মুঘল সাম্রাজ্য কয়েকটি সুবায় (প্রদেশে) বিভক্ত ছিল এবং প্রতি সুবার শাসনপ্রণালী মোটামুটি এক রকমই ছিল। ব্রিটিশ যুগের বাংলা প্রদেশ অপেক্ষা সুবে বাংলা অধিকতর বিস্তৃত ছিল। পূর্ণিয়া ও ভাগলপুর জিলার কতক অংশ এবং শ্রীহট্ট জিলা বাংলা সুবার অন্তর্গত ছিল। চট্টগ্রাম জিলা প্রথমে আরাকান রাজ্যের অন্তর্গত ছিল। ১৬৬৬ খ্রীষ্টাব্দে ইহা সুবে বাংলার সহিত যুক্ত হয়।
প্রত্যেক প্রদেশেই একজন সুবাদার বা প্রধান শাসনকর্ত্তা এবং আরও একজন। উচ্চপদস্থ কর্মচারী নিযুক্ত হইতেন। সাধারণ রাজস্বের জন্য দিওয়ান, সামরিক ব্যয় নির্বাহের জন্য বশী–এই দুই বিভাগের অধ্যক্ষ ছিলেন এবং তাঁহারা অনেক পরিমাণে সুবাদারের যথেচ্ছ ক্ষমতা নিয়ন্ত্রিত করিতেন। বকাইনবিশ নামে একজন কর্মচারী প্রাদেশিক সমস্ত ঘটনার বিবরণ সোজাসুজি বাদশাহের নিকট পাঠাইতেন। সুবাদার সম্বন্ধে সমস্ত খুঁটিনাটি বিবরণ এইভাবে বাদশাহের কাছে পৌঁছিত। এই কয়জন কর্মচারীই বাদশাহ কর্ত্তৃক নিযুক্ত হইতেন এবং পরস্পরের কার্যে ক্ষমতার অপব্যবহার অনেকটা সংযত্ন করিতে পারিতেন। নিম্নতর কর্মচারীদের মধ্যে কতক ছিলেন বাদশাহী মনসবদার–ইহারা সুবাদারের নিযুক্ত কর্মচারীদের অপেক্ষা অধিক সম্মানের দাবি করিতেন এবং প্রয়োজন হইলে সুবাদারের বিরুদ্ধে বাদশাহের নিকট অভিযোগ করিতে পারিতেন। কোন গুরুতর বিষয় উপস্থিত হইলে সুবাদারকে বাদশাঙ্কের উপদেশ, নির্দেশ ও মতামত লইতে হইত। কোন সুবাদার ইহা না করিয়া বেশি রকম স্বাধীনতা অবলম্বন করিলে বাদশাহ তাঁহার বিরুদ্ধে কঠোর পরওয়ানা জারি করিতেন এবং কখনও কখনও সুবাদারের কার্য তদন্ত করিবার জন্য রাজধানী হইতে উচ্চপদস্থ কোন লোক পাঠাইতেন।
সুবাদারের অধীনস্থ কর্মচারীদের উন্নতি অবনতি বাদশাহের উপর নির্ভর করিত। অবশ্য সুবাদারের নিকট হইতে প্রত্যেকের কার্য সম্বন্ধে রিপোর্ট যাইত। সুবাদারদের উপর কড়া আদেশ ছিল যে রিপোর্টে যেন খাঁটি সত্য কথা বলা হয় এবং ইহা কোন রকম পক্ষপাতিত্ব দোষে দুষ্ট না হয়। কিন্তু কর্মচারীরাও অনেক সময় অন্য লোক দিয়া বাদশাহের নিকট সুপারিশ করাইতেন এবং বাদশাহের দরবারে উপহার বা পেশকাশ পাঠাইতেন। মির্জা নাথান নিজের পদোন্নতির জন্য সম্রাট জাহাঙ্গীরকে উপঢৌকন-স্বরূপ হস্তী ও অন্যান্য যে দ্রব্যাদি পাঠাইয়াছিলেন, তাঁহার মূল্য ছিল ৪২,০০০ টাকা।
ভূমির রাজস্বই ছিল সুবার প্রধান আয়। মোটামুটি তিন শ্রেণীর জমি ছিল। প্রথম, খালিসা শরিফা অর্থাৎ প্রত্যক্ষভাবে সরকারের অধীন। দ্বিতীয়, কর্মচারীদের ব্যয় নির্বাহের জন্য জায়গীর। তৃতীয়, প্রাচীন জমিদার অথবা সামন্তরাজার জমি।
খালিসা জমির খাজনা কখনও কখনও সরকারী কর্মচারীরাই আদায় করিতেন কিন্তু বেশির ভাগ ইজারাদারেরাই আদায় করিত। নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা দিবার অঙ্গীকারে ইহারা এক একটী পরগনা ইজারা লইত।
দ্বিতীয় শ্রেণীর জমির কতকটা কর্মচারীর ব্যক্তিগত আর কতকটা চাকরাণ জমির মত কর্মচারীদিগকে বেতনের পরিবর্তে দেওয়া হইত।
বারো ভুঞা বা পাঠান যুগের অন্যান্য যে সকল স্বাধীন রাজা মুঘলের বশ্যতা স্বীকার করিয়াছিলেন, তাঁহারা তৃতীয় শ্রেণীভুক্ত ছিলেন। তাঁহারা অনেকেই তাঁহাদের পূর্বতন সম্পত্তি পুরাপুরি বা আংশিকভাবে ভোগ করিতেন এবং নির্দিষ্ট খাজনা দিতেন। আভ্যন্তরিক শাসন বিষয়ে তাঁহাদের যথেষ্ট ক্ষমতা ও অনেক পরিমাণে স্বাধীনতা ছিল। অধীনস্থ জমিতে শান্তিরক্ষা, বিচার করা প্রভৃতি অনেক ক্ষমতা তাঁহাদের ছিল।
৩
নবাবী আমলের শাসনপ্রণালী
মুর্শিদকুলী খানের সময় হইতে এই ব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন হয়। তিনি দিওয়ান হইয়া যখন বাংলায় আসিলেন, তখন প্রায় সমস্ত খাস জমিই কর্মচারীদের জায়গীরে পরিণত হইয়াছে। জমিদারদের মধ্যেও অনেকেই অলস, অকর্মণ্য ও বিলাসী হওয়ায় নিয়মিত রাজস্ব দিত না। তিনি এই উভয় প্রকার জমির রাজস্ব আদায়ের জন্যই নূতন ইজারাদার নিযুক্ত করিলেন। জমিদার নামেমাত্র রহিলেন, কিন্তু ইজারাদারদের হাতেই তাঁহাদের রাজস্ব আদায়ের ভার পড়িল। ইজারাদারেরা যে রাজস্ব আদায় করিতেন, তাঁহার জন্য পূর্বেই তাহাদিগকে জামিন স্বরূপ মোটামুটি সেই টাকার পরিমাণ কড়ারী খত সই করিয়া দিতে হইত। সংগৃহীত রাজস্বের এক অংশ তাঁহারা পাইতেন। পূর্বেকার মুসলমান ইজারাদারেরা রাজস্ব আদায় করিয়াও ন্যায্য টাকা জমা দিতেন না–অধিকাংশই আত্মসাৎ করিতেন। এইজন্য মুর্শিদকুলী খান বেশির ভাগ হিন্দুদের মধ্য হইতেই নূতন ইজারাদার নিযুক্ত করিতেন। এই নূতন ব্যবস্থার ফলে প্রাচীন জমিদারেরা প্রায় লুপ্ত হইল এবং নূতন ইজারাদারেরা তাহাদের স্থান অধিকার করিয়া দুই তিন পুরুষের মধ্যেই রাজা, মহারাজা প্রভৃতি উপাধি পাইলেন। এইরূপে বাংলা দেশে নূতন এক হিন্দু অভিজাত সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হইল। ইংরেজ যুগের লর্ড কর্নওয়ালিসের চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে অষ্টাদশ শতাব্দীর এই সব ইজারাদারের বংশধরেরাই উত্তরাধিকারী সূত্রে জমিদার বলিয়া পরিগণিত হইলেন। পরবর্তী কালের নাটোর, দীঘাপতিয়া, মুক্তাগাছা প্রভৃতি স্থানের প্রবল জমিদারগণের উৎপত্তি এই ভাবেই হইয়াছিল। অবশ্য বর্ধমান, কৃষ্ণনগর, সুসঙ্গ, বীরভূম, বিষ্ণুপুর প্রভৃতির জমিদারগণ মুর্শিদকুলী খানের সময়ের পূর্ব হইতেই ছিলেন। কোচবিহার, ত্রিপুরা ও জয়ন্তিয়া–এই তিনটি পুরাতন রাজ্য স্বাধীনতা হারাইয়া নবাবের বশ্যতা স্বীকার করিয়া করদ রাজ্যে পরিণত হইয়াছিল।
সকল জমিদারই সম্পূর্ণরূপে মুঘল সুবাদারের আনুগত্য স্বীকার করিত। কেবলমাত্র সীতারাম রায় ছিলেন ইহার ব্যতিক্রম এবং পুরাতন বারো ভুঞাদের মতনই স্বাধীনচেতা। তাঁহার পিতা ভূষণার মুসলমান ফৌজদারের অধীনে একজন সামান্য রাজস্ব-আদায়কারী ছিলেন। সীতারাম প্রথমে বাংলার সুবাদারের নিকট হইতে নলদি (বর্তমান নড়াইল) পরগনার রাজস্ব আদায়ের ভার পান (১৬০৬ খ্রীষ্টাব্দ)। কথা ছিল যে তিনি নিয়মিতভাবে সুবাদারের প্রাপ্য রাজস্ব দিবেন এবং বিদ্রোহী আফগান ও দস্যুর দল হইতে ঐ অঞ্চল রক্ষা করিবেন। তাঁহার সততা ও দক্ষতার ফলে বাংলার সুবাদার আরও কতকগুলি পরগণার রাজস্ব আদায়ের ভারও তাঁহার হাতে দেন। এইভাবে সীতারাম একদল সৈন্য সংগ্রহ করেন। তিনি সুবাদারকে নিয়মিত টাকা পাঠাইয়া সন্তুষ্ট রাখিতেন এবং প্রবাদ এই যে, তিনি দিল্লির বাদশাহকে উপঢৌকন পাঠাইয়া রাজা উপাধি গ্রহণের ফরমান লাভ করেন। তাঁহার খ্যাতি ও প্রতাপে আকৃষ্ট হইয়া বহু বাঙালী সৈন্য তাঁহার সহিত যোগ দেয় এবং তিনি ভূষণা হইতে দশ মাইল দূরে মধুমতী নদীর তীরে বাগজানী গ্রামে এক সুরক্ষিত দুর্গ নির্মাণ করিয়া সেখানে রাজধানী স্থাপন করেন। কথিত আছে যে, একজন মুসলমান ফকীরের অনুরোধে তিনি নূতন রাজধানীর নাম রাখেন মহম্মদপুর। এবং অনেক মন্দির, সুরম্য হ্য, প্রাসাদ প্রভৃতি নির্মাণ এবং বৃহৎ বৃহৎ দীঘি কাটাইয়া ইহার গৌরব ও সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেন। প্রথমে সুবাদার ইব্রাহিম খানের (১৬৮৯-১৬৯৭ খ্রী) দুর্বলতা ও অকর্মণ্যতা এবং পরে সুবাদার আজিমুসসানের সহিত মুর্শিদকুলী খানের কলহের সুযোগ লইয়া তিনি পার্শ্ববর্তী জমিদারদিগের ধনসম্পত্তি লুঠ করেন এবং সরকারী রাজস্ব দেওয়া বন্ধ করেন। অবশেষে ১৭১৩ খ্রীষ্টাব্দে তিনি হুগলির ফৌজদারকে হত্যা করেন। এইবার মুর্শিদকুলী খান সীতারামের শক্তি ও ঔদ্ধত্য সম্বন্ধে সচেতন হইয়া তাঁহাকে দমন করিবার জন্য ভূষণার ফৌজদারকে একদল সৈন্যসহ পাঠাইলেন। পার্শ্ববর্তী জমিদারদের সেনাদলও সুবাদারের ফৌজের সহিত যোগ দিল। এই মিলিত বাহিনীর সহিত যুদ্ধে সীতারাম পরাজিত ও সপরিবারে বন্দী হইলেন এবং তাঁহার রাজধানী ধ্বংস করা হইল। এইরূপে বাংলার শেষ হিন্দু রাজ্যের পতন হইল। ঔপন্যাসিক বঙ্কিমচন্দ্র সীতাৰ্বামকে অমর করিয়া গিয়াছেন।
যে সকল জমিদার নিয়মমত রাজস্ব দিতেন মুর্শিদকুলী খান তাঁহাদের প্রতি সদয় ব্যবহার করিতেন এবং কোন উপরি পাওনার দাবি করিতেন না। কিন্তু নির্ধারিত তারিখে রাজস্ব জমা দিতে না পারিলে তিনি রাজস্ব-বিভাগে কর্মচারী ও জমিদারদের উপর অকথ্য অত্যাচার করিতেন। তাঁহাদিগকে কাছারীতে বন্ধ করিয়া রাখা হইত। খাদ্য বা পানীয় কিছুই দেওয়া হইত না। ঐ রুদ্ধ কক্ষেই মলমূত্র ত্যাগ করিতে হইত। অনেক সময় মাথা নীচু ও পা উপরের দিকে করিয়া তাঁহাদিগকে ঝুলাইয়া রাখিয়া বেত্রাঘাত করা হইত। বিষ্ঠাপূর্ণ গর্তে তাহাদিগকে। ডুবাইয়া রাখা হইত, এই গর্তের নাম দেওয়া হইয়াছিল বৈকুণ্ঠ! অনেক সময় খাজনা দিতে না পারার অপরাধে হিন্দু আমিল, জমিদার প্রভৃতিকে স্ত্রীপুত্রসহ মুসলমান ধর্ম্মে দীক্ষিত করা হইত। বলা বাহুল্য যে এইসব আমিল ও জমিদারগণও প্রজাদের উপর নানা রকম অত্যাচার করিয়া খাজনা আদায় করিতেন। বাদশাহের দরবারে এই সব অত্যাচারের কাহিনী পৌঁছিত, কিন্তু কোন প্রতিকার হইত না। শুজাউদ্দীন নবাব হইয়া বন্দী জমিদারদিগকে মুক্তি দিলেন এবং মুর্শিদকুলীর যে দুইজন অনুচর পূর্ব্বোক্তরূপ নিষ্ঠুর অত্যাচার করিত, তদন্ত করিয়া তাহাদের দোষ সাব্যস্ত হইলে পর তাহাদের সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত ও প্রাণদণ্ডের আদেশ দিলেন।
মুর্শিদকুলী খান রাজস্বের পরিমাণ অনেক বৃদ্ধি করিয়াছিলেন। ইহার ফলে প্রজাদের করভার অসম্ভব রকম বৃদ্ধি পাইল। ইহাতে তাহাদের দুর্দশার অন্ত ছিল না। ওদিকে প্রতি বৎসর মুর্শিদকুলীর কোষাগারে বহু অর্থ সঞ্চিত হইত। শুজাউদ্দীনের আমলেও মোট রাজস্বের পরিমাণ পূর্বের ন্যায় ১,৪২,৪৫,৫৬১ টাকা ছিল। কিন্তু তিনি অতিরিক্ত কর (আবওয়াব) বাবদ ১৯,১৪,০৯৫ টাকা আদায় করিতেন।
মুর্শিদকুলী খানের প্রতিষ্ঠিত নবাবী আমলে বাংলায় হিন্দু জমিদারদের উৎপত্তি ছাড়াও আর একটি গুরুতর পরিবর্তন ঘটিয়াছিল। বাদশাহী আমলে সুবাদার উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা ও মনসবদারগণ দিল্লি হইতে নিযুক্ত হইয়া আসিত এবং নির্দিষ্ট কার্যকাল শেষ হইলে বাংলা দেশ ত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইত। কিন্তু নবাবী আমলে বংশানুক্রমিক আজীবন সুবাদারেরা বাংলা দেশেরই চিরস্থায়ী বাসিন্দা হইলেন। দিল্লির দরবারের সঙ্গে যোগসূত্র ছিন্ন হওয়ার ফলে বাংলার অধিবাসীরাই সরকারী সকল পদে নিযুক্ত হইলেন। মুর্শিদকুলী খান গুণের আদর করিতেন এবং তাঁহার আমলে ব্রাহ্মণ, বৈদ্য, কায়স্থ প্রভৃতি শ্রেণীর হিন্দুগণ উত্তমরূপে ফার্সী ভাষায় অভিজ্ঞতা অর্জন করিয়া কর্মকুশলতার ফলে বহু উচ্চপদ অধিকার করিতে লাগিলেন। এইভাবে মুসলমান যুগে সর্বপ্রথম হিন্দুদের মধ্যে এক সম্ভ্রান্ত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব হইল। ইহাদের কেহ কেহ নবাবের অনুগ্রহে জমিদারী লাভ করিয়া অথবা কার্যে বিশেষ দক্ষতা দেখাইয়া বহু ধন অর্জন করিয়া রাজা, মহারাজা প্রভৃতি খেতাব পাইলেন। জগৎশেঠের ন্যায় ধনী হিন্দুরাও ক্রমে নবাবের দরবারে খুব প্রতিষ্ঠা লাভ করিলেন। মুর্শিদকুলী খানের পরবর্তী নবাবেরাও এই নীতি অনুসরণ করায় অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে এক হিন্দু অভিজাত সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হইল।
মুর্শিদকুলীর অধীনে ষোল জন খুব বড় জমিদার ছিলেন এবং ৬১৫টি পরগনার খাজনা তাঁহারাই আদায় করিতেন। ছোট ছোট জমিদার ও তালুকদারদের হস্তে আরও প্রায় ১৬০০ পরগনার খাজনা আদায়ের ভার ছিল। ছোট বড় জমিদারদের প্রায় তিন-চতুর্থাংশ এবং তালুকদারদের অধিকাংশই হিন্দু ছিল। আজকাল হিন্দুদের মধ্যে দস্তিদার, সরকার, বক্সী, কানুনগো, চাকলাদার, তরফদার, লস্কর, হালদার প্রভৃতি উপাধিধারীদের পূর্বপুরুষগণ মুর্শিদকুলীর আমলে বা তাঁহার পরবর্তী কালে ঐ সকল রাজকার্যে নিযুক্ত হইয়াছিলেন।
নবাব আলীবর্দীর আমলে হিন্দুদের প্রতিপত্তি আরও বাড়িয়া যায়। মুর্শিদকুলী খানের বংশকে সরাইয়া তিনি নিজে নবাবী পদ লাভ করিয়াছিলেন, এই জন্য সম্ভ্রান্ত মুসলমানেরা তাঁহার প্রতি সদয় ছিল না। সুতরাং তিনি আত্মরক্ষার্থে হিন্দুদিগকে উচ্চপদে নিযুক্ত করিতেন। ইহারাও তাঁহার খুব অনুগত ছিল এবং ইহাদের সাহায্য তাঁহার রাজ্যে স্থিতি ও শক্তিবৃদ্ধির অন্যতম কারণ। ইহাদের মধ্যে জানকীরাম, দুর্লভরাম, দর্পনারায়ণ, রামনারায়ণ, কিরীটাদ, উমিদ রায়, বিরুদত্ত, রামরাম সিং ও গোকুলচাঁদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। অনেক হিন্দু উচ্চ সামরিক পদে নিযুক্ত হইয়াছিলেন এবং কেহ কেহ সাতহাজারী মনসবদার পদে উন্নীত হইয়াছিলেন। অনেক হিন্দু সেনানায়ক উড়িষ্যার যুদ্ধে এবং আফগান বিদ্রোহ দমন করিতে আলীবর্দীকে বিশেষ সাহায্য করিয়াছিলেন।
কিন্তু তথাপি হিন্দু জমিদারেরা মুসলমান নবাবীর প্রতি সন্তুষ্ট ছিলেন না। ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল গ্রন্থের সূচনায় কৃষ্ণচন্দ্রের লাঞ্ছনাকারী আলীবর্দীর বিরুদ্ধে অসন্তোষ পরিস্ফুট হইয়া উঠিয়াছে। ১৭৫৪ খ্রীষ্টাব্দে লিখিত একখানি পত্রে কোম্পানীর একজন ইংরেজ কর্মচারী তাঁহার এক বন্ধুকে লিখিয়াছেন যে হিন্দু রাজা এবং প্রজা সকল শ্রেণীর লোকই মুসলমান শাসনে অসন্তুষ্ট এবং মনে মনে তাহাদের দাসত্ব হইতে মুক্তিলাভের ইচ্ছা পোষণ করে এবং ইহার সুযোগ সন্ধান করে। … …