মুঘল-ভারতেতিহাসের লুপ্ত উপাদান *
আকবর হইতে প্রথম বাহাদুর শাহ্ পর্যন্ত মুঘল-সম্রাটগণের প্রায় দেড়শত বৎসরাধিক কালব্যাপী সরকারী ইতিহাস পাওয়া যায়। এই সকল ফার্সী ইতিহাস দিল্লীর রাজদপ্তরখানায় রক্ষিত সরকারী চিঠিপত্র, সংবাদ-লিপি, সন্ধিপত্র, ফর্ম্মান ও রাজস্ব-বিবরণীর সাহায্যে সম্রাটের আদেশে সঙ্কলিত হইত। স্থান, কাল এবং পাত্রের পুঙ্খানুপুঙ্খ ও যথাযথ বিবরণ দেওয়া আছে বলিয়া এই সকল ইতিহাস মূল্যবান।
সত্য বটে, সরকারী ইতিহাসগুলিতে সাহিত্য-রসের সম্পূর্ণ অভাব; কেন না, ইহাদের বর্ণিত বিষয়গুলি কেবল কালানুক্রমে লিপিবদ্ধ– একাধারে গভর্ণমেন্ট গেজেট ও পুলিস রিপোর্টের মত কেবল নাম ও ঘটনার নীরস তালিকা মাত্র। কিন্তু ঐতিহাসিকের নিকট এই শ্রেণীর বিবরণ অতি মূল্যবান। সম্রাটের পড়িবার জন্য এবং সাধারণের সম্মুখে উপস্থিত করিবার পূর্ব্বে স্বয়ং বাদশাহ অথবা তাঁহার উজীর কর্তৃক সংশোধিত হইলেও, এই সকল রাজকীয় ইতিহাস রাজসৈন্যের পরাজয়, অথবা রাজ্যের কোন অংশে প্রাকৃতিক বিপ্লবের কথা, অধিকাংশ স্থলেই গোপন করে নাই। অনেক স্থলে দেখা যায় বটে, রাজকর্মচারীগণের কীর্তিকলাপ সম্রাটের নামে আরোপিত হইয়া সরকারী ইতিহাসে স্থান পাইয়াছে কিন্তু তাহা কিছু নূতন ব্যাপার নহে– রাজকীয় ইতিহাসের ধারাই এইরূপ। ফরাসী সংবাদপত্র Moniteur নেপোলিয়ান কর্তৃক জেনার যুদ্ধ জয়ই প্রুসিয়ার পতনের কারণ বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়াছেন; কিন্তু ঐ একই দিনে Auerstadt যুদ্ধ ক্ষেত্রে তাহার জনৈক সেনাপতি ফরাসী সৈন্যের অপর বিভাগ লইয়া তদপেক্ষা কঠিন যুদ্ধ করিয়া, অনেক বেশী ফলপ্রদ যে বিজয়লাভ করিয়াছিল, তাহার উল্লেখমাত্র করিয়া ক্ষান্ত হইয়াছেন।
মুঘল সরকারী ইতিহাসগুলিতে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ থাকায় বিশেষ সুবিধা এই যে, কোন তারিখ বা নামের ভুল হইলে, পূর্ব্বাপর অসামঞ্জস্য দৃষ্টে অনায়াসে তাহা সংশোধন করা যায়। এই শ্রেণীর ইতিহাস-সাহায্যে রাজ-অভিযান ও রাজসৈন্যের কোন স্থান হইতে স্থানান্তরে দৈনিক গতিবিধির সঠিক সংবাদ আমরা জানতে পারি। আকবরের মন্ত্রী আবুল ফজল লিখিত আকবরনামা হইতে সরকারী ইতিহাস লেখার সূত্রপাত, এবং সেই সময় হইতে প্রথম বাহাদুর শাহ্ দ্বিতীয় রাজ্যাঙ্ক পর্যন্ত পর-পর প্রতি সম্রাটের ইতিহাস এইরূপে লিখিত হইয়াছে।
দুঃখের বিষয়, ১৫৫৬-১৭০৯;–এই সমগ্র ১৫৩ বছরের ইতিহাস সৰ্ব্বত্রই সমভাবে বর্ণিত হয় নাই। আওরংজীবের রাজত্বের শেষ ৪০ বৎসরের ইতিহাস একখানি স্বল্পায়তন গ্রন্থমধ্যে অতি সংক্ষেপে বিবৃত হইয়াছে; অন্যান্য মুঘল সম্রাট, অথবা আওরংজীবের প্রথম দশ বৎসরের ইতিহাস, যেরূপ বিস্তৃতি এবং ক্ষুদ্র শাখা-প্রশাখার সহিত বর্ণিত হইয়াছে, এই ৪০ বৎসরের ইতিহাসে তাহার দশমাংশমাত্র স্থান দেওয়া হইয়াছে’।
এই সকল দরবারী ইতিহাস প্রকৃতপক্ষে সঙ্কলনমাত্র। আধুনিক ঐতিহাসিক ইহা লইয়াই সন্তুষ্ট থাকিতে পারেন না। যে মূল উপাদান অবলম্বনে এই ইতিহাসগুলির প্রাণ প্রতিষ্ঠা, বর্তমান ঐতিহাসিক তাহারই সন্ধান করেন। এইরূপ মূল উপাদানগুলিকে নিম্নলিখিত তিন শ্রেণীতে বিভক্ত করা যাইতে পারে-
১. চিঠিপত্র
যেমন, বাদশাহ্র নিকট প্রেরিত কর্ম্মচারী অথবা কুমারগণের পত্রাবলী- নাম আর্জদাৎ, প্রতি যুদ্ধের পর বিজয়ী সেনাপ্রতি কর্তৃক সম্রাটের নিকট প্রেরিত বিচরণ- ‘ফনামা, প্রাদেশিক কর্ম্মচারী অথবা সেনাপতিদিগকে বাদশাহ স্বয়ং যেসব চিঠি লিখিতেন–(ফর্ম্মান শুক্কা বা মনশুর) অথবা উজীর বা মন্ত্রীকে দিয়া লিখাইতেন- (হর্-উল্-হুঁম্ অর্থাৎ By order); রাজকুমারগণ সম্রাট ভিন্ন অপর সমস্ত ব্যক্তিকে যে সব পত্র লিখিতেন- (নিশান); রাজকর্মচারীবর্গের মধ্যে যে-সকল পত্র বিনিময় হইত (রুকাৎ বা ইন্শা), এবং বেতনভোগী সংবাদ-দাতার পত্র (ওকাএ) বাদশাহী শাসনকালে প্রত্যেক প্রদেশে, প্ৰত্যেক রাজপুত্রের সভায়, এবং প্রত্যেক সামরিক অভিযানের সঙ্গে এক-একজন কর্ম্মচারী নিযুক্ত থাকিত। সে তথাকার ঘটনাগুলি নিয়মিতরূপে বাদশাহের নিকট পাঠাইত; এই চিঠিগুলি ‘ওকাএ’ এবং ইহার লেখক ‘ওকাএনবিস’ নামে পরিচিত। এই শ্রেণীর সংবাদপত্রগুলি (ওকাএ) একেবারে অন্তর্হিত হইয়াছে।
২. রাজস্ব এবং অন্যান্য Statistics সংক্রান্ত বিবরণ
আব্বরের রাজত্বকালে রাজা ও অমাত্যবর্গের মন সকল প্রকার সত্যের দিকে উন্মুক্ত ছিল, তাহাদের আশ্চর্য্য জ্ঞানস্পৃহা ছিল। তাহার ফলে বাদশাহের আজ্ঞায় প্রত্যেক প্রদেশ হইতে বিবরণ ও Statistics সংগ্রহ করিয়া সে যুগের স্যর উইলিয়াম হান্টার ‘আইন-ই-আকবরী’ নামক Imperial Gazetteer বাহির করেন। এই আদর্শে পরবর্তী যুগে কয়েকখানি সংক্ষিপ্ত দেশবর্ণনার বহি এবং অনেকগুলি Statistics সংগ্রহ (‘দস্তুর-উল-আলম’-স্থলবিশেষে ‘জাওয়াবি’ নামে) ফার্সীতে সঙ্কলন করা হয়, কিন্তু এগুলির কোনখানাই আইন-ই-আকবরী মত পূৰ্ণাঙ্গ নহে ৷
৩. বাদশাহী-দরবারের দৈনন্দিন বিবরণ
‘আখ়রাৎ-ই-দরবার-ই-মুয়ালা’। প্রাদেশিক শাসনকর্তা, দূরে অবস্থিত রাজকুমার অথবা মিত্ররাজগণের উকীল বা প্রতিনিধিরা দরবারে উপস্থিত থাকিয়া নিত্য নিয়মিতরূপে এইরূপ সংবাদের চিঠি তাঁহাদের প্রভুদের নিকট পাঠাইতেন। প্রায় ১০” x ৪” একখণ্ড এখনকার বালির কাগজের মত কাগজে এই প্রাত্যহিক বিবরণ অতি সংক্ষেপে লিখিত হইত। আরাৎ হইতে আমরা জানিতে পারি, কোন একটা দিনে, ঠিক কত প্রহর, কত দণ্ডের সময় দরবারের আরম্ভ, এবং কখনই বা তাহা ভঙ্গ হইল; কোন্ কোন্ ব্যক্তি সম্রাটের সাক্ষাৎকার লাভ করিলেন এবং তাহারা সম্রাটকে কি কি নজর দিলেন; এতদ্ব্যতীত রাজকর্ম্মে নিয়োগ ও পদোন্নতির সংবাদ, সম্রাটের বদান্যতা; প্রাদেশিক কর্ম্মচারী ও যুদ্ধে নিয়োজিত সেনাপতিদের নিকট হইতে প্রাপ্ত সরকারী পত্রের সারমর্ম্ম (প্রকাশ্যভাবে পঠিত হইলে) ও সম্রাটের লিখিত তাহার উত্তর, যুদ্ধাভিযান ও মৃগয়াকালে স্থানে স্থানে সম্রাটের শিবির সন্নিবেশ, সম্রাট স্বয়ং সে যুদ্ধ বা দুর্গ অবরোধ-কার্য্য পরিচালনা করিতেন, তাহার সূক্ষ্ম বিবরণ; এবং রাজদরবারে উল্লেখযোগ্য ঘটনা সংক্রান্ত সম্রাটের কার্য্যকলাপ ও উক্তির বিবরণ
ইতিহাসের প্রধান কর্ত্তব্য, অতীতকে বর্তমান যুগের লোকদিগের সম্মুখে জীবন্ত করিয়া উপস্থিত করা–ইংরাজীতে যাহাকে বলে to visualise the past, তাহা মুসলমান ইতিহাসে অনেকটা দেখিতে পাওয়া যায়, পাঠককে হিন্দুযুগের ইতিহাস-আলোচনায় অনেকস্থলে যে প্রকার কল্পনার আশ্রয় গ্রহণ করিতে হয়, ইহাতে সেরূপ প্রয়োজন হয় না। উপরিলিখিত তিন শ্রেণীর উপাদানের মধ্যে শেষোক্ত ‘আখবরাৎ’ সাহায্যে আমরা জীবন্ত বর্ণনা পাই, শুধু তাহাই নহে– ইহা সে যুগের লোকজন ও আচার-ব্যবহারের উপর যে আলোকপাত করে, তাহা অতীব বিস্ময়কর। যেমন শিবাজীর লুণ্ঠন উপদ্রবের সংবাদে আওরংজীবের একবার মৌনভাব অবলম্বন, এবং অন্যবার সেই শ্রেণীর অপর একটি ব্যাপারে তাঁহার মন্তব্য-প্রকাশ– “শিবাজী এত অধিক লোকের সর্ব্বনাশসাধন করিয়াছে যে, তাহাদের সকলকে সাহায্যদান রাজকোষের সাধ্যাতীত”; বিশেষ প্রদেশের কোন দুঃসংবাদের পত্র উজীর কর্তৃক প্রদত্ত হইলে, নীরবে পাঠান্তে আওরংজীবের তাহা পকেটস্থ করেন; বিশালগড় অবরোধকালে (১৭০২) মহারাষ্ট্র দুর্গাধিপতির সন্ধি সর্ব-প্রার্থনাপত্র পাঠান্তে অসহ্য ক্রোধে বাদশাহ্ কর্তৃক তাহা ছিন্ন-করণ।
অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষার্দ্ধের ইতিহাস-সংক্রান্ত এইরূপ কয়েকখানি আখরাৎ বিলাতের ইণ্ডিয়া অফিস ও ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রক্ষিত আছে; কিন্তু তাহাদের উপকারিতা যৎসামান্য, কারণ এই অপেক্ষাকৃত আধুনিক যুগ সম্বন্ধে অন্যান্য গ্রন্থ হইতে অধিকতর মূল্যবান বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায়। সপ্তদশ শতাব্দী সংক্রান্ত দরবারের যে সমস্ত দৈনন্দিন লিপি বিদ্যমান আছে, তাহা আওরংজীবের রাজত্বকালের; এগুলি লণ্ডনের Royal Asiatic Society-তে রক্ষিত হইয়াছে। খুব সম্ভবত: জয়পুর বা অন্য কোন রাজপুত দরবার হইতে, রাজস্থান-প্রণেতা জেম্স্ টঙ্ (James Tod) সংগ্রহ করিয়া বিলাতে পাঠাইয়াছিলেন।
দুঃখের বিষয়, আওরংজীবের দরবারের এই দৈনন্দিন লিপিগুলি বড়ই অসম্পূর্ণ। ২৩ বৎসরের একখানি লিপিও নাই, ৮ বৎসরের মধ্যে প্রতি বর্ষের ১০খানিরও কম, এক বৎসরের ১০১ খানি, এবং কেবলমাত্র ৭ বৎসরের বার্ষিক দুই শতের অধিক লিপি পাওয়া গিয়াছে। আওরংজীবের রাজত্বকালের দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ দশকের ইতিহাস অপেক্ষাকৃত তমসাচ্ছন্ন; কারণ উপাদানের বড়ই অভাব। আরাতের সাহায্য ঠিক ঠিক এই সময়ের জন্যই আবশ্যক, অথচ ঠিক এই ৩০ বৎসরের ‘আখ়রাৎ’ নাই বলিলেই হয়। আওরং জীবের প্রথম ও পঞ্চম দশকের ইতিহাস বিষয়ক প্রচুর উপাদান বিদ্যমান রহিয়াছে; যথা, আওরংজীবের প্রথম দশ বৎসরের ঘটনামূলক এবং সুবৃহৎ সরকারী ইতিহাস– নাম “আলগীরনামা’ মুনশীগণ কর্তৃক সংগৃহীত বৃহৎ চারি ভলুম পত্র; উমারাদিগের বহুপত্র এবং কোন কোন সমসাময়িক ব্যক্তির রচিত বেসরকারী ফার্সী ইতিহাস!
রাজপুত-রাজ্যের দপ্তরখানাগুলি বিশেষভাবে অনুসন্ধান করা হইলে, সপ্তদশ শতাব্দীর ভারতেতিহাস লেখকগণ সবিশেষ সাহায্যপ্রাপ্ত হইবেন, সন্দেহ নাই, কারণ আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সেখানে এইরূপ আখ়রাৎ অনেক আছে। এই সমস্ত ‘আখবরাৎ’ আবিষ্কৃত হইলে তাহা সর্ব্বাগ্রে বিশেষজ্ঞগণের দ্বারা পরীক্ষা করান আবশ্যক। তাহার ফলে আওরংজীবের ইতিহাস নূতন করিয়া লিখিতে হইবে।
আওরংজীবের রাজত্বের অন্ধকারপূর্ণ তিন দশকের ইতিহাস সংক্রান্ত ফার্সী ভাষায় লিখিত খুব অল্প-সংখ্যক পত্রই আমার দৃষ্টিগোচর হইয়াছে: কিন্তু উহার ১০ বৎসর পূর্ব্বের ও ১০ বৎসর পরের প্রায় তিন সহস্র ঐতিহাসিক-পত্ৰ আমি সংগ্রহ করিয়াছি। বহুস্থানে বহু লোকের সমবেত-চেষ্টার ফলে এই সকল লুপ্ত উপকরণ আবিষ্কৃত হইতে পারে।
পূৰ্ব্বেই বলিয়াছি, প্রথম বাহাদুর শাহ্র দ্বিতীয় রাজ্যাঙ্ক পর্যন্ত (১৭০৯) মুঘল-সম্রাটগণের বিস্তৃত সরকারী ইতিহাস বিদ্যমান আছে। ইহার পরবর্তীকালের ইতিহাস সম্বন্ধে অনেক আত্মজীবন-চরিত, প্রতি রাজ্যাঙ্কের ঘটনাবলীর সংক্ষিপ্তসার, এবং কতকগুলি অকিঞ্চিৎকর নগণ্য চিঠিপত্রের সংগ্রহ-পুস্তক পাওয়া যায় সত্য; কিন্তু পূর্ব্ববর্ত্তীকালের অর্থাৎ আকবর হইতে বাহাদুর শাহ্ দ্বিতীয় রাজ্যাঙ্ক পর্যন্ত) সরকারী ইতিহাসগুলির ন্যায় এই সকল উপকরণ হইতে ঘটনার তারিখ, স্থান ও লোকের নাম এবং বিশুদ্ধ পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ পাইবার উপায় নাই। ১৭১২ খ্রিস্টাব্দ হইতে মুঘল সাম্রাজ্য দেউলিয়া হয় এবং প্রকৃত প্রস্তাবে তাহাতে ভাঙ্গন ধরে– যদিও জনসাধারণ ইহা স্পষ্ট বুঝিতে পারে নাই, অবশেষে ১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দে নাদির শাহ্ এই ‘তাসে-গড়া-ঘর ভাঙ্গিয়া দিয়া, সেকথা সাধারণকে হৃদয়ঙ্গম করাইয়া দিলেন। সুতরাং ঐ কালের কোন বিস্তীর্ণ সরকারী ইতিহাস রচিত হয় নাই; সরকারী চিঠিপত্র ও রাজস্ব বিবরণী নিয়মিতরূপে রাজদরবারে পৌঁছাত না, এবং এ সময়ে কোন রাজদপ্তরখানা যত্নসহকারে সংরক্ষিত হইত না। অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধ সংক্রান্ত যে সমস্ত ফার্সী ইতিহাস রচিত হইয়াছিল, তাহার কোনখানিই হারাইয়াছে বলিয়া মনে হয় না; এই কারণে ভারতেতিহাসের এই অংশ সম্বন্ধে একমাত্র চিঠিপত্রের সন্ধান ব্যতীত, অন্য কোন অনুসন্ধান-কার্য্যের আবশ্যকতা নাই।
ঠিক এই সময়ে উত্তর ভারতের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে এক নতুন শক্তির আবির্ভাব হইল। ইহারা মারাঠা জাতি। প্রথমে সম্রাটের বন্ধুরূপে আসিয়া, শেষে শত্রুরূপে প্রকট হইয়াছিল। মারাঠারা তখন ক্ষমতার উচ্চশিখরে অধিষ্ঠিত; সুতরাং মুঘল রাজত্বের অবনতি, দারিদ্র ও ইতিহাস রচনার অভাবের ফলে ১৭১৮ হইতে ১৭৫০ পর্যন্ত উত্তর ভারতেতিহাসের অন্ধকারময় স্থানগুলি আলোকিত করিবার একমাত্র উপায়- মারাঠা রাজকীয় কাগজপত্র। টিউডর ইংলণ্ডের ইতিহাসের পক্ষে ভিনিসীয় দূতের চিঠিপত্রগুলি যেরূপ অত্যাবশ্যক, মুঘল ইতিহাসের পক্ষে মারাঠী সরকারী চিঠিপত্র সেইরূপ বহু বিষয়ে মূল্যবান।
কিন্তু এখানেও আমাদের বিপদ। ঠিক যেখানটার ইতিহাসে (অর্থাৎ ১৭১৮-৫০) এই অমূল্য মারাঠী উপাদানের সাহায্য অত্যন্ত আবশ্যক, সেইখানেই উপকরণের অভাব। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দের পর হইতে দিল্লী ও উত্তর ভারতে অবস্থিত মারাঠা-প্রতিনিধি ও সেনাপতিগণের লিখিত মারাঠী সরকারী চিঠিপত্র প্রচুর পরিমাণে পাওয়া গিয়াছে। রাও বাহাদুর দ-ব পারনিস্ (D.B. Parasnis) দিল্লীর মারাঠা দূতগণের যে-সমস্ত পত্র প্রকাশিত করিয়াছেন, তাহা ১৭৮০ হইতে ১৭৯২ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লিখিত; এদিকে হোল্কারের দরবার হইতে পুনায় লিখিত সরকারী পত্রগুলির সময় ১৭৭৯ হইতে ১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দ। বাসুদেব বামনখরে নামক জনৈক স্কুল পণ্ডিত প্রভূত যত্ন, ঐকান্তিক অনুরাগ ও বিশেষ পর্যবেক্ষণ দ্বারা দক্ষিণ মহারাষ্ট্রের পটবর্দ্ধন রাজ-পরিবারের ঐতিহাসিক পত্রের যে বিপুল সমষ্টি (৯ ভলুম) প্রকাশ করিয়াছেন, তাহা প্রকৃতপক্ষে প্রশংসার অতীত। খরে মহাশয়ের পত্রগুলির তারিখ ১৭৬১-১৮০৩; কেবলমাত্র দুইখানি পত্র ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের পূর্ব্বে লিখিত। বহু মারাঠী পণ্ডিত, দীর্ঘকালব্যাপী সমবেত-অনুসন্ধানের ফলে যে সাফল্য লাভ করিয়াছেন, তাহা সামান্য, এইজন্য মনে হয়, ১৭১৮ হইতে ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে সংঘটিত দিল্লী সংক্রান্ত ব্যাপারের প্রচুর মারাঠী দলিল-দস্তাবেজ ভবিষ্যতে ভারতের কোথাও যে আবিষ্কৃত হইবে, তাহার সম্ভাবনা খুব কম।
নাগপুরের মারাঠা-নরপতিরা (অর্থাৎ ভোঁসলা রাজবংশ) হয় ইতিহাস বিষয়ে উদাসীন ছিলেন, অথবা ১৮১৭ খ্রিস্টাব্দের যুদ্ধের ফলে তাঁহাদের সরকারী-কাগজপত্র ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়াছে– আধুনিক যুদ্ধের ঐতিহাসিকের পক্ষে ইহা দুর্ভাগ্যের কথা সন্দেহ নাই। পুণার মারাঠা অধিপতিগণের (পেশ্রা) যথেষ্ট সাহিত্যানুরাগ ছিল– ফলে তাঁহাদের কর্ম্মচারীগণ বহু লিখিত-কাগজপত্র রাখিয়া গিয়াছেন; কিন্তু এগুলি সাধারণতঃ ইংরাজ-যুগের, অর্থাৎ ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের পরে। নাগপুর-কর-মারাঠারা নবাব আলিবর্দীর সময়ে বঙ্গ ও উড়িষ্যায় বহু অভিযান করিয়াছিলেন; এ অভিযানগুলির কোন সমসাময়িক মারাঠী বিবরণ নাই। এ সম্বন্ধে ফার্সী কথায় লিখিত ইতিহাস অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, তাহাতে তারিখের অভাব; আবার ইংরাজকুঠির কাগজপত্রও এ সম্বন্ধে একপ্রকার নীরব 1 নূতন উপাদান আবিষ্কৃত হইয়া ভারতেতিহাসের এই অন্ধকারময় অংশ কোনদিন যে আলোকিত হইবে তাহা মনে হয় না।
১৬৫৮ হইতে ১৭৫১ খ্রিস্টাব্দের ভারতেতিহাসের লুপ্ত-উপাদানের কথা বিস্তৃতভাবে আলোচিত হইল। আশাকরি যাঁহারা এই প্রবন্ধ পাঠ করিবেন, কোনদিন যদি তাঁহারা ফার্সী হিন্দী অথবা মারাঠী সরকারী কাগজপত্রের সংস্রবে আসেন, তাহা হইলে ইতিহাসের কোন অংশের জন্য বিশেষ অনুসন্ধান প্রয়োজন, তাহা অনায়াসে বুঝিতে পারিবেন।
[ভারতবর্ষ, ভাগ ৭, খণ্ড ২, সংখ্যা ৪, চৈত্র ১৩২৬ ]
—
* লাহোরে Indian Records Commission-এ পঠিত।
১। জাহাঙ্গীরের রাজত্বের মাসির-ই-জাহাঙ্গীরী এবং বাদশাহের সুদীর্ঘ আত্মজীবনী- তুজুক-ই-জাহাঙ্গীরী।
শাহজাহানের প্রথম ২০ বৎসরের ইতিহাস আব্দুল হমীদ লাহোরী লিখিত-পাদিশাহ্ নামা।
২১ হইতে ৩০ বৎসর পর্যন্ত ওয়ারিস-লিখিত পাদিশাহ্ নামা।
৩১ বৎসরের ইতিহাস মুহম্মদ্ সালিহ্ লিখিত ৷
মুহম্মদ কাজীম্ লিখিত আওরংজীবের প্রথম দশ বৎসরের ইতিহাস- আলমগীরনামা।
আওরংজীবের সম্পূর্ণ রাজত্বের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস-মুহম্মদ সাকী মুস্তদ্ খাঁ রচিত-মাসির-ই আলমগীরী।
নিয়ামৎ খাঁ (ওরফে দানিশমন্দ খাঁ) রচিত– বাহাদুরশাহনামা।