১১. মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব এবং ভারত সরকারের স্বীকৃতির প্রেক্ষাপট

একাদশ অধ্যায় – মুক্তিযুদ্ধের দ্বিতীয় পর্ব এবং ভারত সরকারের স্বীকৃতির প্রেক্ষাপট

  • খন্দোকার মোশতাকের জাতিসংঘের উদ্দেশ্যে আমেরিকা সফর স্থগিত করে দেয়া হয় এবং তিনি ও মাঞ্জুব আলম চাষী পদচ্যূত হন।
  • আবদুস সামাদ আজাদকে বানানো হয় নতুন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
  • রিলিফ সামগ্রী নিয়েও কেলেংকারী।
  • শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর বিদেশ সফর।
  • মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর দৃষ্টিভঙ্গী।
  • সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ভারতের ‘নিরাপত্তা এবং বন্ধুত্ব’ চুক্তি স্বাক্ষর।
  • অনেক হিসাব-নিকাশের পর ২৫ বছরের গোলামীর চুক্তির বিনিময়ে বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারকে স্বীকৃতি দিল ভারত সরকার।
  • গোলামী চুক্তির বিরোধিতা করে চুক্তিতে সই করলেন না মাত্র দু’জন, কর্নেল ওসমানী এবং খন্দোকার মোশতাক আহমেদ।
  • আবার রনাঙ্গনে।
  • বিএলএফ এর সাথে বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিবাহিনীর সংঘর্ষ।
  • মুক্তিযুদ্ধকে স্বাভাবিক পরিণতির দিকে এগিয়ে নেবার প্রয়োজনে জাতীয় সরকার গঠন করতে রাজি হল না প্রবাসী ও ভারত সরকার।
  • কমান্ডার এবং মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অনুপ্রবেশের সার্বিক প্রচেষ্টা চালিয়েছিল ‘র।
  • অপ্রত্যাশিতভাবে ছোট ভাই স্বপন ও বাল্যবন্ধু কাজির খবর পেলাম।
  • ওরা ঢাকা শহরে খানসেনাদের বুকে ত্রাসের সঞ্চার করেছিল।
  • নভেম্বর মাসে যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পায়।
  • স্বাধীনতা সংগ্রাম ও গণচীন।

ইয়াহিয়া খানের সাধারণ ক্ষমার সুযোগ নিতে চাচ্ছেন আওয়ামী লীগের অনেক সদস্যই। তারা বাংলাদেশের অনিশ্চিত ভবিষ্যত নিয়ে দোদুল্যমনতায় ভুগছেন : অনেকেই আবার ভারতীয় নীল নকশার কথা আচ করতে পেরে শংকিত হয়ে পড়ছেন : কিন্তু তাদের ফিরে যাবার পথে মূল বাধা হয়ে দাড়িয়েছে ইন্দিরা সরকার। ভারত সরকার কিছুতেই চাচ্ছে না বাংলাদেশ প্রবাসী সরকার ইয়াহিয়া সরকারের সাথে কোনরূপ রাজনৈতিক আপোষের চেষ্টা করুক। তাদের চাপের মুখে প্রবাসী সরকারের পক্ষ থেকে জনাব তাজুদ্দিন প্রকাশ্যে ঘোষণা দিতে বাধ্য হন, “ইয়াহিয়া সরকারের সাধারণ ক্ষমা প্রবাসী সরকারের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব নয়।” মুক্তিযোদ্ধারাও সংগ্রামের এই পর্যায়ে কোনরকম আপোষের বিরোধিতা করছিলেন। তারা চাইছিলেন দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে। এভাবেই সার্বিক অবস্থা ক্রমশঃ জটিল হয়ে উঠছিল। হঠাৎ একদিন জানতে পারলাম পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোশতাক আহমদ আমেরিকা যাচ্ছেন লন্ডন হয়ে এক সফরে। বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে জাতিসংঘ প্রধান এবং অন্যান্য রাষ্ট্রপ্রধান বিশেষ করে পশ্চিমা দেশগুলোর রাষ্ট্রনায়কদের সাথে তিনি মত বিনিময় করে বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি তাদের সমর্থন আদায় করার চেষ্টা করবেন তিনি এ সফরকালে। অতএব তার এই সফর হবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যাবার সব প্রস্তুতিই প্রায় শেষ। কামাল সিদ্দিকীও যাচ্ছে সফরসঙ্গী হয়ে। কিন্তু সেই অবস্থাতেই আকস্মিকভাবেই সফর স্থগিত করে দেয় প্রবাসী সরকার। শুধু তাই নয়, মোশতাক আহমদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ থেকেও অব্যাহতি দেয়া হয় এবং তার স্থলে আবদুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বানানো হয়। জনাব মাহব্বুব আলম চাষীকেও সরিয়ে দেয়া হয় পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব থেকে। এই ধরণের পরিবর্তনের কারণ সম্পর্কে সবকিছুই চেপে যায় তাজুদ্দিন সরকার। কিন্তু পরে সব গোপনীয়তাই ফাঁস হয়ে যায়।

জানা যায় ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা নাকি জানতে পারে যে, জনাব মোশতাক আহমদ গোপনে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে ইয়াহিয়া খান এবং শেখ মুজিবের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলেন। তার লন্ডন সফরের উদ্দেশ্য ছিল মার্কিন সরকারের মধ্যস্থতায় শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়া সরকারের সাথে একটা চুড়ান্ত ফায়সালা করে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি রাজনৈতিক সমাধানে পৌঁছা। এই চক্রান্তের খবর পেয়েই জনাব তাজুদ্দিন ভারত সরকারের নির্দেশেই ঐ পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হন। আরো তথ্য জানা যায়— খন্দোকার মোশতাক আহমদ, ইয়াহিয়া সরকার এবং মার্কিন সরকারের ত্রি-পাক্ষিক ঐ সমঝোতা-আলোচনার প্রতি শেখ মুজিবর রহমানের সমর্থন ছিল। এ ঘটনার পর আওয়ামী লীগের অন্তঃদ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নেয়। ভারত সরকার চিন্তিত হয়ে পড়ল এবং বাংলাদেশ সমস্যার একটা আশু সমাধানের জন্য মরিয়া হয়ে উঠল। মুক্তি সংগ্রাম দীর্ঘস্থায়ী হলে অবস্থা তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে সেটাই ছিল তাদের মূল আশংকা এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে জনাব তাজুদ্দিন প্রবাসী সরকারের তরফ থেকে ভারত সরকারকে বোঝালেন- দু’পক্ষের স্বার্থ রক্ষার্থে বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারকে স্বীকৃতি দিয়ে অনতিবিলম্বে ভারতীয় সামরিক অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশকে স্বাধীন করে ফেলতে হবে। ভারত সরকার তাজুদ্দিন সরকারের আবেদনে সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও হঠাৎ করে তখনি এককভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে রাজি হল না। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী ঠিক করলেন বিশ্ব নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে পরাশক্তিধর দেশগুলোর মনোভাব জানার পরই এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন। তিনি আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পশ্চিম ইউরোপের কয়েকটি দেশে এক ঝটিকা সফরে বেরিয়ে পড়লেন। সবখানেই তিনি নেতৃবৃন্দের সাথে বাংলাদেশ সমস্যা এবং ভারতের অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা করলেন। বর্বর শ্বেতসন্ত্রাসের ফলে আগত শরণার্থীদের মানবিক কারণে ভারতের মাটিতে আশ্রয় দেয়ার জন্য নেতারা ভারত সরকারের প্রশংসা করলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলোর নেতারা বাংলাদেশ সমস্যাকে পাকিস্তানের একটি আভ্যন্তরীন সমস্যা হিসাবেই আখ্যায়িত করেন এবং পরিষ্কারভাবে ইন্দিরা গান্ধীকে জানিয়ে দেন- এই সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে সরাসরিভাবে ভারতীয় যেকোন সামরিক পদক্ষেপ তাদের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠবে। শরণার্থীদের কষ্ট লাঘবের জন্য এবং ভারতের উপর যে অর্থনৈতিক চাপের সৃষ্টি হয়েছে সেটা কমানোর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে আর্থিক এবং সামগ্রিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন সব নেতারাই।

রিলিফের সামগ্রী নিয়েও পরে ঘটেছে অনেক কেলেংকারী। বিপুল পরিমাণের রিলিফ- সামগ্রীর কতটুকু পেয়েছিল শরণার্থীরা তার জবাব একমাত্র দিতে পারে তৎকালীন প্রবাসী সরকারের কর্ণধাররাই। আমার জানামতে প্রাপ্ত রিলিফ-সামগ্রীর একটা ক্ষুদ্র অংশই ভারত এবং প্রবাসী সরকারের উদ্যোগে বিতরণ করা হয়েছিল শরণার্থীদের মাঝে। রিলিফ-সামগ্রীর সিংহভাগই বেমালুম হজম করে নিয়েছিল ভারত সরকার।

বিদেশ সফর থেকে শ্রীমতি গান্ধী বুঝতে পারেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কোনরূপ সামরিক অভিযান চালালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিম ইউরোপীয় দেশগুলো তাকে সমর্থন করবে না। পক্ষান্তরে এশীয় পরাশক্তি গণচীন হয়তো বা প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে যেতে পারে পাকিস্তানের পক্ষে এ ধরণের সংঘাতে। সে ক্ষেত্রে ভারতের একক আগ্রাসন ব্যর্থ হয়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতির মোকাবেলা করার জন্যই সোভিয়েত ইউনিয়নের পূর্ব প্রস্তাবিত ‘নিরাপত্তা এবং বন্ধুত্ব’ চুক্তি সই করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন শ্রীমতি গান্ধী ও তার সরকার। ঐ চুক্তি সাক্ষরের ফলে ভারতীয় জনগণ কতটুকু উপকৃত হয়েছে জানি না তবে পাকিস্তানকে দুর্বল ও দ্বিখন্ডিত করতে এবং সামরিক আগ্রাসন চালিয়ে বাংলাদেশ কায়েম করে সেখানে একটা পুতুল সরকার স্থাপন করার ভারতীয় স্বপ্নের বাস্তবায়নে ঐ চুক্তি বিশেষভাবে সাহায্য করেছিল নিঃসন্দেহে। সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চুক্তি সাক্ষরের পরপরই বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারকে স্বীকৃতি দেয় ভারত সরকার। প্রতিদানে ভারতের সাথে জাতীয় স্বার্থবিরোধী ২৫ বছর মেয়াদের এক চুক্তি সই করে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার। রহস্যজনক কোন কারণবশতঃ আজ পর্যন্ত সেই চুক্তির বিষয়বস্তু গোপন রাখা হয়েছে দেশের জনগণের কাছ থেকে। মুজিবনগর সরকার এবং আওয়ামী লীগের বেশিরভাগ সাংসদ ঐ চুক্তিকে সমর্থন করে। বিরোধিতা করেছিলেন মাত্র দু’জন। কর্নেল ওসমানী এবং খন্দোকার মোশতাক আহমদ। মুক্তিযোদ্ধাদের বেশিরভাগই এ ধরণের চুক্তির ঘোর বিরোধিতা করেছিলেন। কিন্তু সব বিরোধিতা উপেক্ষা করে তাজুদ্দিন সরকার এক অসম চুক্তির নাগপাশে আবদ্ধ করলেন বাংলাদেশের ভবিষ্যতকে। ভারতের সাথে দীর্ঘ ২৫ বৎসরের এ অসমচুক্তি জাতীয় ইতিহাসে এক কালো অধ্যায়। এ চুক্তি সাক্ষরিত হওয়ার পর বাংলাদেশে ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপ তথা পাক-ভারত যুদ্ধ প্রায় অবধারিত হয়ে ওঠে। মুক্তি বাহিনীর দেশপ্রেমিক অংশ বরাবরই মুক্তি সংগ্রামে ভারতীয় সেনা বাহিনীর সরাসরি হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করে আসছিলেন। তাদের প্রত্যাশা ছিল দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের ত্যাগের মাধ্যমে স্বাধীন হবে বাংলাদেশ। এতে দু’টো বিশেষ উপকার হত। দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামের মাধ্যমে গড়ে উঠতো নিবেদিত প্রাণ-ত্যাগী-পরিক্ষীত নেতৃত্ব এবং একইভাবে সুযোগ পাওয়া যেত নিখাদ সোনার মত বলিষ্ঠ জাতীয় চরিত্র গড়ে তোলার। কিন্তু নীল নকশার প্রণয়নকারীরা বাঙ্গালী জাতিকে সেই সুযোগ থেকে বঞ্চিত করে অতি চতুরতার সাথে। খাল কেটে কুমির আনার সব ব্যবস্থাই পাকাপোক্ত করে ফেললো মুজিবনগর সরকার। দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা পরিষ্কার বুঝতে পারলেন তাদের ভবিষ্যত সংগ্রাম হবে দু’মুখী। একদিকে তাদের যুদ্ধ করতে হবে হানাদার পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে অন্যদিকে তাদের প্রস্তুত থাকতে হবে ‘মিত্র বাহিনীর’ আধিপত্যবাদী চক্রান্তের জাল ছিন্ন করে জাতীয় স্বাধীনতা হেফাজত রাখার জন্য। চুক্তি ও স্বীকৃতির পরিপ্রেক্ষিতে কোলকাতাভিত্তিক আওয়ামী সরকার ও তাদের দোসররা সবাই দিন গুনতে লাগল কবে ভারতীয় বাহিনী আগ্রাসন চালিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করে দেবে আর তারা ফিরে গিয়ে রাজত্ব করবে, উপভোগ করবে অসৎ উপায়ে লুটপাট করে অর্জিত ধনসম্পদ। ভারতীয় সরকারের স্বীকৃতি পাবার জন্য শুধু দাসখতই লিখে দেয়া হয়েছিল তাই নয়, স্বাধীন বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রও প্রণীত হবে ভারতীয় শাসনতন্ত্রের মূল চার নীতি (জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ) এর উপর ভিত্তি করে; সেই অঙ্গীকারও করেছিল মুজিবনগর সরকার। প্রবাসী বাংলাদেশীদের বিভিন্ন মহলে তখন ভবিষ্যত বাংলাদেশের রাষ্ট্রনীতি, অর্থনীতি, প্রশাসন প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। একদিন এক সামাজিক অনুষ্ঠানে সরকারের এক অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বললেন, “স্বাধীন বাংলাদেশের Economic Viability তেমন একটা নেই।” তার এ ধরণের বক্তব্য অবাক করেছিল অনেককেই। প্রশ্ন করা হয়েছিল, “স্বাধীন বাংলাদেশের Economic Viability যদি নাই থাকবে তবে আপনারা ৬দফা প্রণয়ন করে জনগণকে উসকে দিয়েছিলেন কেন? কেন বলেছিলেন পাকিস্তানের শোষণের হাত থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করতে পারলেই সোনার বাংলা কায়েম হবে? তাহলে কি আপনাদের এ সমস্ত প্রচারণা ছিল মিথ্যে? জনগণকে ধোকা দিয়ে পাকিস্তানকে শুধুমাত্র দ্বিখন্ডিত করার এক কূটকৌশল মাত্র?” এ সমস্ত মৌলিক প্রশ্নের জবাব উক্ত বিশারদ সেদিন দিতে পারেননি। অত্যন্ত বিব্রতকর অবস্থায় কেটে পড়ে নিজেকে বাঁচিয়েছিলেন বিড়ম্বনার হাত থেকে। ঠিক একইভাবে আরেক দিন এক ঘরোয়া পরিবেশে কিছু বাঙ্গালী জনাব ডিপি ধরকে ভবিষ্যত স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতি এবং শিল্পনীতি কি ধরণের হওয়া উচিত জানতে চাইলে তিনি জবাব দিয়েছিলেন, “you don’t have to think about all these things. you just have to grow rice that’s all rest shall be taken care off by us.” এ ধরণের কথা থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় বাংলাদেশকে ভারতের অর্থনীতির বাজার এবং পশ্চাদভূমিতে পরিণত করার ষড়যন্ত্র ছিল ভারতীয় আধিপত্যবাদী নীল নকশার অর্ন্তভূক্ত। শুধু কি তাই। বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সম্পূর্ণভাবে ভারতের উপর নির্ভরশীল করে তুলে সার্বিকভাবে বাংলাদেশের উপর ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করার খায়েশটিও পরিষ্কারভাবে ধরা পড়েছিল জনাব ধরের বক্তব্যে।

কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠার পর সেপ্টেম্বরে ফিরে গেলাম সেক্টরে। বা হাতে তখনও প্লাষ্টার। যুদ্ধ তখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা বাংলাদেশে। মুক্তিফৌজ এবং গেরিলাদের হাতে প্রচন্ড মার খেয়ে হানাদার বাহিনী দিশেহারা। তাদের মনোবল সম্পূর্ণভাবে ভেঙ্গে পড়েছে। তীব্র গেরিলা অভিযানে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে খানসেনারা তখন বড়বড় শহরে Defensive Position-এ বাধ্য হয়ে নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে। শহরগুলো ছাড়া সারা বাংলাদেশ তখন বিশাল এক মুক্তাঙ্গন। গেরিলারা প্রায় পুরো দেশই তাদের অবাধ বিচরণ ভূমিতে পরিণত করেছেন। তাদের সফল তৎপরতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ইতিমধ্যেই সময়সাপেক্ষে একটি বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। মুক্তিফৌজের সাহস, উদ্দম এবং সাংগঠনিক শক্তি ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে। প্রধান প্রধান শহরগুলো এমনকি ঢাকা শহরেও প্রকাশ্য দিবালোকে অসীম সাহসিকতার সাথে একটার পর একটা সফল অভিযান করে চলেছে বীর মুক্তিযোদ্ধারা। নাস্তানাবুদ বেসামাল খানসেনারা ‘মুক্তি’-দের সর্বদা তটস্থ অবস্থায় থাকছে। বিশেষ করে রাতের আধার ওদের জন্য হয়ে উঠেছে নাভিশ্বাসের কারণ। জানবাজ মুক্তিযোদ্ধাদের অভূতপূর্ব সাফল্যের খবরগুলো বিদেশী প্রচার মাধ্যগুলোতে শিরোনামে প্রকাশিত হচ্ছে প্রায় প্রতিদিন। আমাদের Moral ভীষণ High. ইতিমধ্যে বিএলএফ এর ট্রেনিংপ্রাপ্ত সদস্যরা দেশের ভিতরে বিভিন্ন Strategic Point – এ অবস্থান নিয়েছে। তাদের অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিফৌজের তুলনায় অনেক উঁচুমানের। এ সত্ত্বেও খান সেনাদের বিরুদ্ধে সম্মুখ সংঘাতে তেমন একটা অংশগ্রহণ করছে না তারা। পক্ষান্তরে অনেক জায়গায় জনগণের উপর অন্যায়-জুলুম, চাঁদাবাজী এবং লুটপাট করছিল তারা। সে সমস্ত খবর পাচ্ছিলাম আমরা। তাদের ঐ ধরণের কার্যকলাপে বাধা দেবার কালে অনেক জায়গায় মুক্তিফৌজের যোদ্ধাদের সাথে তাদের সংঘর্ষ হচ্ছিল। এই সময় হঠাৎ করে ভারতীয় প্রচার মাধ্যমগুলো কাদের সিদ্দিকী নামক এক বিএলএফ সদস্য সম্পর্কে ফলাও করে প্রচারণা শুরু করে এমনভাবে যেন শুধুমাত্র কাদের সিদ্দিকীই মুক্তিযুদ্ধ করছে। এ ধরণের প্রচারণায় আমরা কিছুটা বিস্মিত হলাম। পাকিস্তান আমলে ১ম ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এই সৈনিক নায়েক কাদের সিদ্দিকীকে Disciplinary Charge এ শাস্তিমূলকভাবে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে তার তেমন কোন বিশেষ ভূমিকার কথাও শোনা যায়নি। সেক্ষেত্রে তাকে নিয়ে এতটা হৈ চৈ কি উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে সেটা ঠিক বুঝতে পারলাম না। একইভাবে মাঝে মেজর খালেদ মোশাররফকেও focus এ আনার চেষ্টা চলেছিল কিছুদিন। পক্ষান্তরে মেজর জিয়া তার প্রাপ্য মর্যাদা কখনোই পাননি প্রবাসী ও ভারত সরকারের কাছ থেকে। দুই সরকার তার প্রতি ছিল সন্দিহান এবং বিদ্বেষপ্রবণ। কালুরঘাট থেকে দেশবাসীর প্রতি স্বতঃস্ফুর্তভাবে স্বাধীনতার যে উদাত্ত আহ্বান তিনি জানিয়েছিলেন তাকে মেনে নিতে পারেনি আওয়ামী সরকার। তার সেই Initiative Appreciate করার মত মানসিক উদারতা নেই তাদের। তার সেই ঐতিহাসিক ঘোষণাকে ঔদ্ধত্যমূলক উচ্চাভিলাষ হিসেবেই মনে করে আসছে তারা। ফলে আজঅব্দি জিয়াউর রহমানের ভাবমুর্তিকে সবসময় ছোট করে দেখানোর চেষ্টা করে চলেছে আওয়ামী লীগ। এই অবদানকে মেনে নিলে মুক্তিযুদ্ধের সব কৃতিত্বের একক দাবিদার হবে কি করে আওয়ামী লীগ। সেটাই সমস্যা। প্রবাসী সরকারের নতজানু নীতির তীব্র সমালোচনা করে জোরালো যুক্তি তুলে ধরেছিলেন তিনি। জিয়াউর রহমান দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে, শুধুমাত্র ইসলামাবাদ থেকে রাজধানী সরিয়ে ঢাকায় এনে দিল্লীর একটি তাবেদার রাষ্ট্র কায়েম করা মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য নয়। নিজেদের আত্মত্যাগের মাধ্যমেই অর্জন করতে হবে স্বাধীনতা। দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রামে ক্রমশঃ জড়িয়ে পড়বে দেশের প্রত্যেকটি পরিবার। ত্যাগ ও তিতিক্ষায় তীক্ষ্ম হবে জাতীয়তাবাদী চেতনা। জনগণের কাছে স্বাধীনতা হয়ে উঠবে অমূল্য ধন। আর সেক্ষেত্রে কোন দামেই বেচা যাবে না স্বাধীনতা। স্বাধীনতার ভিত মজবুত করার জন্য প্রয়োজন একটি জাতীয় সরকার। নীতি নির্ধারনের প্রক্রিয়ায় মুক্তিফৌজের অংশদারিত্ব নিশ্চিত করার জন্য জাতীয় সরকারের অধিনে একটি জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব মুক্তিযোদ্ধাদের তরফ থেকে প্রবাসী সরকারের কাছে উত্থাপন করায় মেজর জিয়ার প্রতি প্রবাসী ও ভারত সরকারের ক্ষোভ আরো কয়েকগুন বেড়ে গিয়েছিল। তার ঐসমস্ত প্রস্তাবের মাঝেও নাকি চক্রান্তের গন্ধ খুঁজে পেয়েছিলেন দুই সরকারের কর্তাব্যক্তিরা। মেজর জিয়াকে অপছন্দ করলেও ঠিক সেই সময়ে দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের প্রিয় কমান্ডার মেজর জিয়াকে অপদস্থ করা কিংবা তার বিরুদ্ধে কোনরূপ Action নেয়ার ক্ষমতা অস্থয়ী প্রবাসী সরকারের ছিল না।

হঠাৎ একদিন ধর্মনগর থেকে বন্ধু ক্যাপ্টেন আনাম আমাকে জানাল আমার ছোটভাই স্বপন এবং একান্ত বন্ধু কাজি কামালুদ্দিন মুতীর পথে এসে পৌঁছে আমার খোঁজ করছে। তাকে অনুরোধ জানালাম ওদের আমার কাছে পাঠিয়ে দিতে। কয়েকদিনের মধ্যেই ওরা এসে পৌঁছল। স্বপনকে এভাবে কাছে পাবো সেটা ভাবতেও পারিনি। ওদের কাছে পেয়ে খুবই খুশি হয়েছিলাম। আত্মীয়-পরিজনদের সব খবরা-খবরই পেলাম তাদের কাছ থেকে। শুনলাম ঢাকা শহরে ওদের দুঃসাহসিক গেরিলা অভিযানের লোমহর্ষক কাহিনী। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই স্বপন, বদি, কাজি, জুয়েল, রুমী, আলম, আজাদ, সাচো বর্ডার পেরিয়ে ২নং সেক্টরের মেলাঘর ক্যাম্পে ট্রেনিং নিয়ে ঢাকায় ফিরে গিয়ে গেরিলা তৎপরতায় কাঁপিয়ে তোলে ঢাকা শহর। পর্যায়ক্রমে তাদের সাথে যোগ দেয় চুল্লু, ফাজলে, মোক্তার, হ্যারিস, তৈয়ব আলী, উলফাৎ, সামাদ, ফতেহ আলী, মেওয়া, জিয়া, ভুলু, সাইদ এবং আরো অনেকেই। ওদের উপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ঢাকায় অবস্থান করে বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করার যাতে সারা বিশ্বে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের খবর ছড়িয়ে পড়ে। শুধু তাই নয়, তাদের ঐ ধরণের গেরিলা তৎপরতায় এটাও প্রমাণিত হবে যে, পুরো বাংলাদেশ খানসেনাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে বলে যে সরকারি প্রচারণা চালানো হচ্ছে সেটাও সত্যি নয়। জুরাইন, গুলবাগ পাওয়ার-ষ্টেশন, সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার ষ্টেশন, ধোলাইখাল, যাত্রাবাড়ি, গ্রীন রোড ইন্টারকন, ফার্মগেট, ধানমন্ডির ২নং সড়ক প্রভৃতি জায়গায় একটার পর একটা দুঃসাহসিক সফল অভিযান চালিয়ে খানসেনাদের নাস্তানাবুদ করে তুলেছিল ওরা। ওদের প্রতিটি মাথার জন্য ২০০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করেছিল পাকিস্তানের সামরিক সরকার। এতে কোন ফল হয়নি। খানসেনাদের সব সতর্কতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে তাদের নাকের ডগার উপর দিয়ে জানবাজ মুক্তি পাগল দামাল ছেলেগুলো অসীম সাহসিকতার সাথে করে যাচ্ছিল একেকটা দুঃসাহসিক অভিযান। খানসেনাদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করেছিল বিচ্ছুরা (খান সেনারা গেরিলাদের ‘বিচ্ছু’ কিংবা ‘মুক্তি’ বলে সম্বোধন করত)। ওদের তৎপরতায় আশার আলো দেখতে পেয়েছিল ঢাকাবাসী। ওদের জন্য দোয়া করতো সবাই। অনেকে নানাভাবে সাহায্যের হাতও বাড়িয়ে দিয়েছিলেন স্বেচ্ছায় বিপদের ঝুঁকি নিয়েও। কিন্তু জাতীয় ইতিহাসে ‘মীরজাফর’ থেকেছে সর্ব যুগেই। তাদের বেঈমানীর ফলে অপুরণীয় ক্ষতি হয়েছে জাতির ইতিহাসের বিভিন্ন মোড়ে। তেমনই এক মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতায় স্বপন-বদি-কাজিদের ভাগ্যে নেমে আসে এক চরম বিপর্যয়। পলাশীর বিশ্বাসঘাতকতার তুলনায় এই বিশ্বাসঘাতকতার পরিণাম কোন অংশেই কম নয়। ২৯শে আগষ্ট ১৯৭১ সাল। ঐ দিন সকালে ধানমন্ডির ২৮নং রোডের একটি বাসায় ওদের এক ঘনিষ্ট বন্ধু ও সহযোগী ফরিদের সাথে দেখা করতে যায় বদি পূর্ব কথামত। ফরিদ বর্তমান আওয়ামী লীগের শীর্ষস্থানীয় নেতা জনাব জিল্লুর রহমানের শ্যালক তথা আইভি রহমানের ভাই। তারই বিশ্বাসঘাতকতায় দুপুর ১২টার দিকে ফরিদদের বাসা থেকে হঠাৎ রেইড করে বদিকে ধরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয় খান সেনারা। ফরিদদের বাসায় পৌঁছানোর অল্পক্ষণের মধ্যেই ধরা পড়ে বদি। এ থেকে বোঝা যায় আগাম খবর পেয়েই খানসেনারা বদিকে ধরার জন্য ওৎ পেতে বসেছিল। তারপর শুরু হয় Chain Reaction. সামাদ ধরা পরে বিকেল চারটার দিকে। আজাদের বাড়ি রেইড করা হয় রাত ১২টায়। ঐ বাসায় সে রাতে ছিল জুয়েল, বাশার, কাজি, আজাদ, আজাদের খালাতো ভাই, দুলাভাই এবং আরো কয়েকজন আত্মীয়। সবাইকেই ধরে নিয়ে যায় পাক-আর্মি। রেইড চলাকালে আচমকা তদারককারী এক ক্যাপ্টেনের উপর ঝঁপিয়ে পরে তার হাতের ষ্টেনগান ছিনিয়ে নিয়ে এলোপাতাড়ি গুলী ছুঁড়তে ছুঁড়তে সবাইকে হতভম্ব করে দিয়ে রাতের অন্ধকারে পালিয়ে যেতে পেরেছিল একমাত্র কাজি। আলমদের বাসাতেও রেইড করা হয় রাত ১২টার পর সেখানে ধরা পরে আলমের ফুপা আব্দুর রাজ্জাক এবং তার ছেলে মিজানুর রহমান। আলম বাসায় না থাকায় ধরা পরার হাত থেকে সে যাত্রায় বেঁচে যায়। আজাদদের বাসা আলমদের বাসার কাছাকাছি। রাত প্রায় দেড়টার সময় সম্পূর্ণ দিগম্বর অবস্থায় কাজি গিয়ে পৌঁছে আলমদের বাসায়। ভাগ্যক্রমে খানসেনারা ততক্ষণে ঐ এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। কাজিকে সম্পুর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় দেখে ভূত দেখার মত চমকে উঠেছিল আলমদের বাসার সবাই। আলমের ছোটবোন তাড়াতাড়ি একটা লুঙ্গি কাজির হাতে দিয়ে তক্ষুণি দূরে পালিয়ে যেতে অনুরোধ জানায়। খান সেনারা এখানেও এসেছিল জানতে পেরে কাজি কাপড়টা পরে নিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যায়। হাটখোলায় শাহাদাত চৌধুরী মানে সাচোদের বাড়ি থেকে ধরা পড়েন সেজো দুলাভাই বেলায়েত চৌধুরী রাত দু’টো পর। চুল্লুর বড়ভাই জনাব এম সাদেক সিএসপি একজন পদস্থ সরকারি অফিসার। রাত ১২:৩০-১টার দিকে তার সরকারি বাসভবন এ্যালিফেন্ট রোডের ১নং টেনামেন্ট হাউজ থেকে চুল্লুকে ধরে নিয়ে যায় পাক-আর্মি। মধ্যরাতে রেইড করা হয় রুমীদের বাড়ি। বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় রুমী, রুমীর বাবা জনাব শরিফ, ছোট ভাই জামী, মাসুম এবং হাফিজকে। আমাদের বাসায় ক্যাপ্টেন কাইয়ূমের নেতৃত্বে রেইড় করা হয় ১:৩০-২টার দিকে। চুন্নুদের বাসায় যে রেইডিং পার্টি গিয়েছিল তারাই চুল্লুকে চোখ বাধা অবস্থায় সাথে করে আমাদের বাসায় নিয়ে আসে। চোখ বাধা অবস্থায় চুন্নু প্রথমে বুঝতে পারেনি তাকে কোথায় আনা হয়েছে। আচমকা একজন খানসেনা বলে উঠল, “স্বপন ভাগ গিয়া।” আব্বার গলাও শুনতে পায় চুন্নু। মেয়েদের কান্না থেকে বুঝতে পারে আমার বোনেরা (মহুয়া, কেয়া, সঙ্গীতা) কান্নাকাটি করছে। দৈবক্রমে স্বপন পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। বাসা থেকে ধরে নিয়ে যায় আব্বা জনাব শামছুল হক, মোস্তাফিজ মামা, বাড়ির কাজের ছেলে সামু এবং হাশেমকে। আলতাফ মাহমুদের বাসায় আর্মি যায় ভোর ৪-৫টার দিকে। সামাদকে সঙ্গে নিয়ে আর্মি গিয়েছিল ঐ বাড়িতে। আলভী ঐ রাত্রে সেই বাড়িতেই ছিল। নাম লুকিয়ে উর্দূতে নিজের নাম আব্দুল বারাক বলায় আলভী ধরা খাওয়া থেকে বেঁচে যায়। খান সেনারা ধরে নিয়ে যায় আলতাফ মাহমুদ, তার চার শ্যালক, রসুল এবং নাসেরকে।

এভাবেই স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ঢাকায় গেরিলাদের সবচেয়ে কার্যকরী এবং সফল দলটি বিশ্বাসঘাতকতার চক্রান্তের ফলে বিলুপ্ত হয়ে যায়। পালাবার পর কাজি ও স্বপনের দেখা হয় তাদের ব্যেইস ক্যাম্প ধোলাইখালে। সেখান থেকে মেলাঘর। সেখানে তাদের দু’জনকেই Select করা হয় Officer’s Training Course এর জন্য। কিন্তু দু’জনেরই কোন ইচ্ছে ছিল না Officer’s Course এ যোগ দেবার। তারা অনেক অনুরোধ জানিয়েছিল মেজর খালেদ মোশাররফ এবং ক্যাপ্টেন হায়দারকে তাদেরকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে আবার ঢাকায় পাঠাবার জন্য। তারা চাইছিল ফিরে গিয়ে বন্দী সাথীদের মুক্ত করতে। জীবন গেলেও ক্ষতি নেই তবু একটা শেষ চেষ্টা করে দেখতে চায় তারা। নিজেদের যোগ্যতা সম্পর্কে আত্মবিশ্বাস ছিল তাদের। যদি মেজর খালেদ এবং ক্যাপ্টেন শিশুর পরিবারদেরকে পাক বাহিনীর সুরক্ষিত দুর্গ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে এ বন্দী অবস্থা থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসতে পেরে থাকে তারা তবে তাদের পক্ষে বদি-জুয়েল-রুমীদেরকে ছাড়িয়ে আনাটা অসম্ভব হবে কেন? তাদের আবেগ, অনুভূতি, সহমর্মিতা মেজর খালেদের মনকে স্পর্শ করলেও ঠিক সেইক্ষণে তাদের ফেরত পাঠানো কোনক্রমেই ফলপ্রসু হবে না ভেবেই তাদেরকে Officer’s Course এ পাঠাবার সঠিক সিদ্ধান্তই নিয়েছিলেন মেজর খালেদ একজন অভিজ্ঞ কমান্ডার হিসেবে। আমার কাছে পৌঁছেও তারা একই প্রস্তাব দেয়। কিন্তু আমিও মেজর খালেদের সিদ্ধান্তকে সমর্থন করে তাদের Officer’s Course-এ যোগদান করাটাই যুক্তিসঙ্গত হবে বলে মতপ্রকাশ করি। অগত্যা অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুর্তীতে চলে যায় Course-এ জয়েন করার জন্য।

নভেম্বর মাসে যুদ্ধের তীব্রতা বৃদ্ধি পায় ব্যাপকভাবে। বর্ডারে সম্মুখ সংঘর্ষের মাত্রা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। ভারত সরকার ইতিমধ্যে ভারতীয় সেনা বাহিনীকে পাক বাহিনীর মোকাবেলা করার জন্য প্রয়োজনে বাংলাদেশের সীমানার ভিতরে প্রবেশ করার অনুমতি প্রদান করেছে। গঠন করা হয়েছে মুক্তিফৌজ ও ভারতীয় বাহিনীর যৌথ কমান্ড। যৌথ কমান্ড গঠিত হবার পর ভারতীয় কমান্ডারদের প্রচন্ড প্রভাবে কর্নেল ওসমানী এবং তার হেডকোয়াটার্স প্রকৃত অর্থে অকেজো হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ আক্রমণের পরিকল্পনা এককভাবে ভারতীয় বাহিনীর ইষ্টার্ন কমান্ডই প্রণয়ন করার দায়িত্ব গ্রহণ করে কর্নেল ওসমানীকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যুদ্ধের আভাস পেয়ে জনাব ভুট্টোকে তার বিশেষ দূত হিসেবে চীনে পাঠালেন ভারতীয় যেকোন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন আদায় করার জন্য : কিন্তু পিকিংএ গণচীনের নেতৃবৃন্দ জনাব ভুট্টোকে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেন, “পূর্ব পাকিস্তানে সৃষ্ট রাজনৈতিক পরিস্থিতির সুযোগ গ্রহণ করে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে ভারতীয় সামরিক হস্তক্ষেপকে গণচীন পাকিস্তানকে দ্বি-খন্ডিত করার হীন চক্রান্ত হিসাবেই দেখবে এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের সাথে যেকোন সামরিক সংঘাতে নীতিগতভাবে তারা পাকিস্তানের পক্ষেই থাকবে।” একইসাথে জনাব ভুট্টোর মাধ্যমে তারা পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যথাশীঘ্র সম্ভব পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের ইচ্ছানুযায়ী বর্তমান সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার জন্য। তাদের Considered Opinion ছিল বর্তমান পরিস্থিতিতে শুধুমাত্র একটি যুক্তিসঙ্গত এবং গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমেই পাকিস্তানের অখন্ডতা বজায়ে রাখা সম্ভব। বল প্রয়োগ করে এই সমস্যার সমাধান কখনও সম্ভব হবে না। চীনা নেতৃবৃন্দের উক্তি থেকে দু’টো বিষয় পরিষ্কার হয়ে উঠে।

প্রথমত: গণচীন একদিকে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যার নিরসনের জন্য পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠিকে বাঙ্গালীদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি সমাধান পেশ করার যুক্তিসঙ্গত পরামর্শ দেন।

দ্বিতীয়ত: পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার কোন সমাধান করতে ব্যর্থ হলে সেই সুযোগে উপমহাদেশে ভারতীয় সম্প্রসারনবাদের নগ্ন থাবা বিস্তার করার চক্রান্তের ব্যাপারেও তারা বন্ধুরাষ্ট্র পাকিস্তানকে হুঁশিয়ার করে দেন। কিন্তু দেশে ফিরে জনাব ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও সামরিক জান্তার কাছে চীনা নেতৃবৃন্দের বন্ধুসুলভ এবং যুক্তিসম্পন্ন অভিমতের অপব্যাখ্যা দেন। তিনি বলেন, “ভারতের সাথে সামরিক সংঘর্ষে চীন পাকিস্তানকে সার্বিকভাবে সাহায্য করবে। প্রয়োজনে গণচীন প্রত্যক্ষভাবে পাকিস্তানের পক্ষ হয়ে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করতে দ্বিধাবোধ করবে না এ ধরণের আভাসই নাকি তিনি পেয়েছিলেন চীনা নেতৃবৃন্দের কাছ থেকে একান্ত বৈঠকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *