১১
মিসির আলি ঢাকা পৌছলেন রবিবার ভোরে। দরজা খুলেই নীলুর চিঠিভর্তি খাম পেলেন। চিঠিতে একটিমাত্র লাইন—’স্যার, আপনার বড় বিপদ।’ কিসের বিপদ—কী সমাচার, কিছুই লেখা নেই।
মেয়েদের নিয়ে এই সমস্যা। তাদের সব চিঠিতেই অপ্রয়োজনীয় কথার ছড়াছড়ি। শুধু প্রয়োজনীয় কথাগুলোর বেলায় তারা শর্টহ্যাণ্ড ভাষা ব্যবহার করে। আজ পর্যন্ত তিনি মেয়েদের এমন কোনো চিঠি পান নি, যেখানে জরুরি কথাগুলো গুছিয়ে লেখা।
তবে নীলু একটি কাজ করেছে। নিজের বাড়ির ঠিকানা দিয়েছে। এক্ষুণি চলে যাওয়া যায়। মিসির আলি গেলেন না। হাত-মুখ ধুয়ে প্ল্যান করতে বসলেন, আজ সারাদিনে কী কী করবেন।
(ক) হানিফার খোঁজ নেবেন।
(খ) ইউনিভার্সিটিতে যাবেন।
(গ) ফিরোজের খোঁজ নেবেন।
(ঘ) সাজ্জাদ হোসেনের সঙ্গে দেখা করবেন।
(ঙ) আজমলের সঙ্গে দেখা করবেন।
এই পাঁচটি কাজ শেষ করবার পর নীলুর কাছে যাওয়া যেতে পারে। তাঁর এমন কোনো বিপদ নেই যে, এক্ষুণি ছুটে যেতে হবে। তবে কেন জানি নীলুর কাছে আগে যেতে ইচ্ছা হচ্ছে। ফ্রয়েডীয়ান কোনো ব্যাখ্যা এর নিশ্চয়ই আছে।
টেনে আসতে-আসতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। এবং আশ্চর্য, নীলুকে স্বপ্নে দেখলেন। স্বপ্নটি এমন ছিল, যে, জেগে উঠে তাঁর নিজেরই লজ্জা করতে লাগল। কেবলই মনে হতে লাগল, তাঁর পাশে বসে থাকা লোকগুলোও তাঁর স্বপ্নের ব্যাপারটা জেনে ফেলেছে। তিনি যে খানিকক্ষণ আগেই একটি রূপবর্তী মেয়ের হাত ধরে নদীর ধারে হাঁটছিলেন, এটা সবাই জানে।
হানিফা সুস্থ।
তবে অনেক রোগা হয়ে গেছে। মুখ শুকিয়ে হয়েছে এতটুকু। হানিফার কাছে তিনি ঠিক সময়েই এসেছেন। আজই তার রিলিজ-অর্ডার হবে। আর এক দিন দেরি হলে মুশকিল হয়ে যেত। মেয়েটি ঘাবড়ে যেত। কারণ এই সাত দিন কেউ তাকে দেখতে আসে নি। অথচ বাড়িওয়ালা করিম সাহেব বারবার বলেছেন, তিনি প্রতিদিন একবার এসে খোঁজ নেবেন। আমাদের দেশের মানুষদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, যে-কাজগুলো তারা করতে পারবে না, সেই কাজগুলোর দায়িত্ব তারা সবচেয়ে আগ্রহ করে নেবে।
‘চল হানিফা, বাসায় যাই।’
‘চলেন।’
‘তুই তো দারুণ রোগা হয়েছিস রে বেটি!’
‘আপনেও রোগা হইছেন।’
‘অসুখে পড়ে গিয়েছিলাম রে হানিফা। অবস্থা যা দাঁড়িয়েছিল, তাতে মনে হয়েছিল নিউমোনিয়াতে ধরেছে। মরতে মরতে বেঁচে গেছি। তুই বস্ এখানে, আমি রিলিজ-অর্ডারের ব্যবস্থা করি।’
রেসিডেন্ট ফিজিসিয়ান বললেন, ‘হানিফা মেয়েটি আপাতত সুস্থ, কিন্তু আবার অসুস্থ হয়ে পড়বে।’
‘কেন?’
‘ওর প্রবলেমটা হার্টের একটা ভাল্বে। তার জন্মই হয়েছিল একটা ডিফেকটিভ ভাল্ব নিয়ে। তার ছোটবেলায় ডাক্তাররা চেষ্টা করেছেন ভাল্বটা রিপেয়ার করতে। ওপেন হার্ট সার্জারি হয়েছে তার।’
‘কী করে বুঝলেন? মেয়েটি বলেছে?’
‘না, সে কিছু বলে নি। জিজ্ঞেস করেছিলাম। তার কিছু মনেটনে নেই। তবে আমাদের বুঝতে না পারার কোনো কারণ নেই। ওর হার্ট আবার ওপেন করতে হবে।
‘এখানে করা যাবে?’
‘আগে যেখানে করা হয়েছিল, সেখানে করলেই ভালো হয়। আমাদের এখানে এত ছোট বাচ্চাদের ওপেন হার্ট সার্জারির সুযোগ নেই।
‘আপনার ধারণা, ওর অপারেশনটা এ দেশে হয় নি।?’
‘না, এ-দেশে হয় নি। পশ্চিমা কোনো দেশে হয়েছে। কেন, আপনি জানেন না?’
‘জ্বি-না, আমার জানা নেই।’
মিসির আলি চিন্তিত মুখে হানিফাকে নিয়ে ঘরে ফিরলেন। সাজ্জাদ হোসেনের সঙ্গে দেখা হওয়া দরকার। সে কতদূর কি করেছে জানা দরকার, বা আদৌ কিছু করেছে কি না। কিছু না করারই কথা। এ-দেশের বেশির ভাগ লোকই কোনো কাজ করতে চায় না।’কেন করতে চায় না’–এই নিয়ে কিছু ভালো গবেষণা হওয়া দরকার। কর্মবিমুখতার কারণটি কী? যদি একাধিক কারণ থেকে থাকে, সেগুলোই বা কী?
সাজ্জাদ হোসেনকে টেলিফোনে পাওয়া গেল না। যতবারই টেলিফোন করা হয়, ততবারই খুব চিকন গলায় এক জন পুরুষ মানুষ বলেন, ‘উনি ব্যস্ত আছেন। মীটিং চলছে।’
মিসির আলি বড় বিরক্ত হলেন। পুলিশরা এত মীটিং করে, তাঁর জানা ছিল না। ঘন্টার পর ঘন্টা এয়ার কন্ডিশন্ড ঘরে বসে মীটিং করার মতো সময় তো তাদের থাকার কথা নয়। এগুলো হচ্ছে করপোরেট অফিসগুলোর কাজ—-শুধু কথা বলা, বকবক করা। কিছুক্ষণ পরপর কফি খাওয়া। সুখে সময় কাটানো যার নাম।
সাজ্জাদ হোসেনের সময়টা অবশ্যি খুব সুখে কাটছিল না। মন্ত্রীর শাশুড়ির কল্যাণে তিনি একটি বিপজ্জনক অবস্থায় আছেন। আই জি মতিয়ুর রহমান পি এস পি’র কাছে তাঁকে জবাবদিহি করতে হচ্ছে।
আই জি মতিয়ুর রহমান ছোটখাটো মানুষ, কিন্তু দারুণ কড়া অফিসার। পুলিশমহলে একটি চালু কথা আছে–মতিয়ুর রহমানের সামনে দাঁড়ালে হাতিরও বুক কাঁপে। সাজ্জাদ হোসেনের বুক কাঁপছিল।
মতিয়ুর রহমান বললেন, ‘দু’ জন সেন্ট্রি চেয়েছিল, দিতেন দু’ জন, কেন ঝামেলা করলেন?’
‘আমি স্যার দিতাম, পরে অফিসে ফিরে মনে হল খামোকা……।‘
‘এক জন মন্ত্রীর শাশুড়ির ইচ্ছা-অনিচ্ছা অনেক বড় ব্যাপার, কেন বুঝতে পারেন না? তা ছাড়া যে এক জন সেন্ট্রি ছিল, সকালবেলা দেখা গেল সে ঘুমাচ্ছে।’
‘সারা রাত ডিউটি দিয়েছে স্যার, কাজেই ভোরবেলা ঘুম এসে গেছে। পুলিশ হলেও তো স্যার এরা মানুষ।’
‘এখন বলেন, আমি কী করি। মিনিস্টার সাহেব ভোর সাতটায় আমাকে টেলিফোন করে বলেছেন, আপনার বিরুদ্ধে অ্যাকশান নেবার জন্যে।’
সাজ্জাদ হোসেন ক্লান্ত গলায় বললেন, ‘কী আর করবেন স্যার! অ্যাকশান নিতে বলেছে, অ্যাকশান নেন।’
মতিয়ুর রহমান সাহেব ফাইল থেকে একটি চিঠি বের করে বললেন, ‘আমি মিনিস্টার সাহেবকে এই চিঠিটা পাঠিয়েছি। কী লিখেছি শুনুন—’
জনাব,
পুলিশ কমিশনার সাজ্জাদ হোসেনের বিরুদ্ধে আপনি আমাকে যে-অ্যাকশান নেবার কথা বলেছেন, সেই পরিপ্রেক্ষিতে আপনাকে জানাচ্ছি যে, সাজ্জাদ হোসেন পুলিশ-বাহিনীর এক জন দক্ষ, নিষ্ঠাবান এবং সৎ অফিসার। একাত্তুরের মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ বীরত্বের জন্যে তাকে বীর বিক্রম উপাধিতে সম্মানিত করা হয়েছে। এ-জাতীয় এক জন অফিসারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে লিখিত অভিযোগের প্রয়োজন আছে। আপনার অভিযোগের উপর ভিত্তি করে তদন্ত হবে। তদন্তকারী অফিসার সাজ্জাদ হোসেনকে দোষী সাব্যস্ত করবার পরই ব্যবস্থা গ্রহণের প্রশ্ন ওঠে।
বিনীত
মতিয়ুর রহমান চিঠি পড়া শেষ করে বললেন, ‘ঠিক আছে?’
‘থ্যংক য়ু ভেরি মাচ স্যার।’
‘থ্যাংকস দেবার কিছু নেই। সত্যি কথাই লিখেছি। তবে, আপনার উচিত আরো ট্যাক্টফুল হওয়া।’
‘যাব স্যার?’
‘হ্যাঁ, যান।’
‘স্যার, একটা কথা বলি?’
‘বলুন।’
‘স্যার, আমার ইচ্ছা হচ্ছে কালো একটা প্যান্ট পরে খালিগায়ে হাতে একটা লোহার রড নিয়ে যাই এবং ঐ শাশুড়ির মাথায় একটা বাড়ি দিয়ে আসি।’
কথাটা বলেই সাজ্জাদ হোসেনের মনে হল, একটা বড় ভুল হয়ে গেল। আই জি এমন কোনো ব্যক্তি নন, যিনি রসিকতা সহজভাবে নেবেন। কিন্তু অবাক কাণ্ড, মতিয়ুর রহমান সাহেব হেসে ফেললেন। মুচকি হাসি নয়। হা হা করে হাসি।
সাজ্জাদ হোসেনের জীবনে এটা একটা স্মরণীয় দিন। তাঁর মনের গ্লানি কেটে যেতে শুরু করেছে। তিনি অফিসে ফিরে দুটি সংবাদ শুনলেন–দশ মিনিট পরপর কে নাকি তাঁকে খোঁজ করছে এবং গত রাতে নগ্নগাত্র ত্রাস একটি ছ’ বছরের ছেলেকে পিটিয়ে মেরে ফেলেছে। তার ডেডবডি কিছুক্ষণ আগেই রিকভার করা হয়েছে। চেনার উপায় নেই। লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে থেঁতলে ফেলা হয়েছে।
সাজ্জাদ হোসেন তক্ষুণি জীপ নিয়ে বেরুলেন।
.
‘হ্যালো, এটা কি ফিরোজদের বাসা?’
‘হ্যাঁ।’
‘আপনি কে কথা বলছেন?’
‘আপনি কে এবং আপনার কাকে দরকার, সেটা বলুন।’
‘আমার নাম মিসির আলি’
‘ও আচ্ছা। আমি ফিরোজের মা।’
‘স্লামালিকুম আপা।’
‘ওয়ালাইকুম সালাম।’
‘আমি সপ্তাহখানেক বাইরে ছিলাম। আপনাদের খবর দিয়ে যেতে পারি নি।’
‘ও,’
‘গিয়েছিলাম চব্বিশ ঘন্টার জন্যে, ঝামেলায় পড়ে এত দেরি হল। আমি ফিরোজের ব্যাপারেই খোঁজ নিতে গিয়েছিলাম।’
‘ও।’
‘ফিরোজ কেমন আছে?’
‘ভালো।’
‘ওকে টেলিফোনটা দিন।’
‘ওকে টেলিফোন দেয়া যাবে না!’
‘বাসায় নেই।’
‘না।’
‘কোথায় গিয়েছে? বাইরে?’
‘হ্যাঁ।’
‘তাহলে আমি বরং রাতের বেলা এক বার টেলিফোন করব।‘
‘না, রাতের বেলা টেলিফোন করবেন না। ওকে পাওয়া যাবে না।’
‘কেন, ও কি রাতে ফিরবে না?’
‘না। ও ঢাকার বাইরে।’
‘ঢাকার বাইরে—কোথায়?’
‘ওর মামার বাড়িতে বরিশালে।’
‘কিন্তু আমি তো বলেছিলাম ওকে দীর্ঘদিন চোখে-চোখে রাখতে হবে।’
‘কোনো উত্তর নেই। )
‘হ্যালো।’
‘বলুন।’
‘কী হয়েছে ফিরোজের?’
‘কী আবার হবে? কিছুই হয় নি। ও ভালো আছে।‘
‘কিন্তু আপনার কথা শুনে আমার মনে হচ্ছে, কিছু-একটা হয়েছে। আপনি কি দয়া করে বলবেন?’
‘ওর কিছু হয় নি। ও ভালো আছে। ও আছে তার মামার বাড়িতে।’
‘বরিশালে?’
‘হ্যাঁ, বরিশালে।’
‘আপনি ঠিক কথা বলছেন না। কারণ ফিরোজের মামার বাড়ি বরিশাল নয়। ফিরোজ সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য আমার জানা। দয়া করে আপনি আমাকে বলুন, কী হয়েছে।
‘কিছু হয় নি। অনেকবার তো এই কথা বললাম। তবু কেন বিরক্ত করছেন?’
‘ওসমান সাহেবকে দিন। তাঁর সঙ্গে কথা বলব।’
‘উনি বাসায় নেই।’
‘কখন ফিরবেন?’
‘জানি না কখন ফিরবেন।’
‘শুনুন আপা, আমি আসছি এই মুহূর্তে।’
মিসির আলি টেলিফোন নামিয়ে রেখে তক্ষুণি ধানমণ্ডি ছুটলেন। কিন্তু ওসমান সাহেবের বাড়ির ভেতর ঢুকতে পারলেন না। দারোয়ান গেট বন্ধ করে বসে আছে। সে কিছুতেই গেট খুলবে না। ওসমান সাহেব এবং তাঁর স্ত্রী—কেউ নাকি বাড়ি নেই। কখন ফিরবেন তারও ঠিক নেই। মিসির আলি বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি বসার ঘরে অপেক্ষা করব। গেট খোল।’
‘সাহেব আর মেমসাহেব বাড়িতে না থাকলে গেট খোলা নিষেধ আছে।
মিসির আলি প্রায় দু’ ঘন্টা বন্ধ গেটের ওপাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। কোনো লাভ হল না। নীলুদের বাসা কাছেই কোথাও হবে। ঝিকাতলা ধানমণ্ডি থেকে খুব-একটা দূর নয়। মিসির আলি সেদিকেই রওনা হলেন।
ফিরোজের কথা বারবার মনে আসছে। কিছুতেই মন থেকে তাড়াতে পারছেন না। কী হল ছেলেটার? আর যদি কিছু হয়েই থাকে, সবাই মিলে এটা তাঁর কাছে গোপন করছে কেন? রহস্যটা কী? রাতে ফেরবার পথে আরেক বার খোঁজ নিতে হবে।