১১.
মালিকের মেয়ে একবার তার হাত ছুঁয়েছিল, সেই স্মৃতিই সব সময়ে সমীরণকে জাগিয়ে রাখে সতর্ক রাখে। আজকাল সে কখনও ঘুমে ঢুলে পড়ে না। টেলিফোনের প্রথম রিংটা একবার টিং করে বাজতে না বাজতেই সে ফোন তুলে নেয়। কতবার ভুলও হয়। মাঝে মাঝে সুখনের চায়ের কাপে চামচে নাড়ার শব্দকে রিং ভেবে টোলফোন তুলে নিয়েছে। আজকাল তার শরীর টেলিফোনে সমর্পিত।
রায়বাবু আর আচার্যিবাবু হয়তো কাল পরশু চলে আসবেন। তখন মন্দা এত ঘন ঘন আসবে না। অফিসে। টেলিফোনে বলবে না, আপনি আমার জন্য অপেক্ষা করুন। আপনাকে দরকার হবে।
দরকারটা কী তা আজও জানে না সমীরণ। জানবার জন্য ভীষণ আগ্রহে তার বুকের শিরা উপশিরা টান টান হয়ে থাকে। মাথা ছিড়ে পড়ে। কিন্তু মন্দা কখনও স্পষ্ট করে বলেনি।
যেমন আজ বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ বেরোল। যাওয়ার সময় বলে গেল, আমার লাঞ্চ আছে। আপনি কিন্তু থাকবেন। আজ হয়তো আমি সামান্য ড্রাঙ্ক থাকব। আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে হতে পারে। পারবেন তো?
পারবে না? সে অবাক মানে। পারবে না কেন? মন্দার জন্য সে না পারে কী? মন্দার ভাল পাহারাদার হওয়ার জন্য সে আজকাল আবার ব্যায়াম শুরু করেছে। একবার আসুক না রজত মাস্তান। খোপড়ি খুলে দেবে সমীরণ।
সে ঘাড় কাত করে মাকে বলল, খুব পারব।
তারপর একটা নাগাদ একবার ফোন করল মন্দা, আছেন তো সমীরণবাবু?
আছি।
থাকবেন। আমরা খুব মজা করছি।
খুব খুশি হয় সমীরণ। আনন্দের গলায় বলে, করছেন? করুন।
কেউ আমার খোঁজ করলে বলবেন ব্লু রুম। এই বলে মন্দা ফোন রেখে দিল।
.
সারা সকাল নীচের রাস্তা দিয়ে একটার পর একটা মিছিল যাচ্ছে। শ্লোগানে শ্লোগানে কান ঝালপালা। গত হপ্তাখানেক ধরে একই শ্লোগান, ফজল আলী জিন্দাবাদ। ফজল আলীর মৃত্যু নেই! ধনিকতন্ত্র নিপাত যাক! শ্রমিক নিধন চলবে না! ফজল আলী যুগ যুগ জিয়ো! ফজল আলী অমর রহে।
ফজলুর ডেরা বেশি দূরেও নয়। সেখান থেকে লাউডস্পিকারে বক্তৃতা ভেসে আসে, দেশাত্মবোধক গান গাওয়া হয়। আগামীকাল প্রাইম মিনিস্টার ফজলুকে দেখতে আসছেন দিল্লি থেকে। দু-চার দিনের মধ্যেই আসবেন রাষ্ট্রপতি স্বয়ং।
প্রতিদিন ফজলুর খবর থাকে পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায়। বিকেলের দিকে দু’একটা ছুটকো ছাটকা কাগজ টেলিগ্রামও বের করে।
ফজলু না খেয়ে আছে কত দিন! পারবে তো?
আজকাল আর ফজলুর কাছে হুট করে যাওয়া যায় না। চারদিকে কড়া পুলিসের পাহারা। গিসগিস করছে মানুষ। সেখানে মানুষের দেয়াল এত পুরু যে ব্যায়াম করা শরীর নিয়ে সমীরও তা ভেদ করে বেশি দূর যেতে পারে না। পলাশি গাঁয়ের ফজলু আজ কত বড় হয়ে গেছে।
ফজলুকে নিয়ে এত হইচই আর চেঁচামেচি সমীরণের খারাপ লাগার কথা নয়। বরং অহংকারে বুক বেলুন হয়ে ওঠারই কথা। কিন্তু মুশকিল হল সদা সর্বদা মিছিলের চেঁচামেচি শুনতে শুনতে আজকাল তার কান ভোঁ ভোঁ করে। ভয় হয়, ঠিক মতো টেলিফোনের রিং সে হয়তো শুনতে পাবে না। যখনই মিছিল যায় তখনই সে আতঙ্কিত হয়ে টেলিফোনের কাছে উপুড় হয়ে যন্ত্রটায় কান লাগিয়ে রাখে। রিং শুনতে ভারী অসুবিধে হয় তার। ফজলুটাই বাগড়া দিচ্ছে।
টেলিফোন বাজল কি? বুঝতে পারে না সে। বিশাল মিছিল যাচ্ছে আবার।
সারাদিন আন্দাজে আন্দাজে সে বহুবার টেলিফোন তুলে কানে লাগায় এবং হতাশ হয়। এবারও তুলল। বুকটা লাফিয়ে উঠল।
টেলিফোনে একটা প্রচণ্ড গোলমাল শোনা যাচ্ছে, সেই শব্দ ছিড়ে মন্দার তীব্র গলা শোনা গেল, সমীরণ?
আমি… আমি…!
একটু হেলপ করবেন?
নিশ্চয়ই… যা বলবেন।
গোলমাল ছিড়ে মন্দার কুহুস্বর আসে, ভীষণ বিপদে পড়েছি। কিছুতেই ফজল আলীর কাছে যেতে পারছি না।
স্তম্ভিত সমীরণ বলে, ফজলুর কাছে যাবেন? সে কী?
যেতেই হবে। একটা বিরাট সুন্দর মালা কিনেছি। ফজল আলীর গলায় পরাব। কিন্তু যাব কী করে? মালা দেওয়ার জন্য এক মাইল লম্বা মানুষের লাইন পড়েছে, কিন্তু সে লাইনও ভেঙে যাচ্ছে। পুলিশ লাঠিচার্জ করছে বার বার। ভীষণ ক্যাওস। এদিকে আমার মালাটাও শুকিয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে। একটু হেল্প করতে পারবেন?
ফজলুকে মালা দেবেন? অবাক হয়ে যেন নিজেকেই নিজে বলে সমীরণ।
মন্দার কুহুস্বর আসে, দিতেই হবে। প্লিজ! তাড়াতাড়ি চলে আসুন। টেলিভিশনের গাড়ি এসে গেছে। এলিট সিনেমার নীচে দাঁড়াচ্ছি।
ফোন রেখে ঝড়ের গতিতে নেমে গেল সমীরণ।
.
ফজলুদের পুরনো ত্রিপলের ছাউনি ভেঙে কখন যেন বিশাল ম্যারাপ বাঁধা হয়েছে। লাল সাদা বাহারি ম্যারাপের মাথায় সব দল তাদের ঝান্ডা লাগিয়ে দিয়ে গেছে।
ম্যারাপের আধ মাইল ব্যাস জুড়ে ভিড় আর ভিড়। মানুষের শরীর একটার সঙ্গে আর একটা সিমেন্টে গাঁথা ইটের মতো লেপটে আছে। হাজার হাজার গাড়ি পার্ক করা চারদিকে। এক মাইল দুরে গাড়ি রেখে হেঁটে আসছে সুন্দর পোশাকের মানুষ আর মেয়েমানুষ। কঠিন দেয়াল। পিলপিল করে আরও মিছিল আসছে আর আসছে।
কিছু চ্যাঙা চ্যাঙা ছেলে ছোকরা চেঁচাচ্ছে, গুরু। গুরু।
মানুষের মুক্তিদাতা ফজল আলী…
জিন্দাবাদ!
মহান সংগ্রামী ফজল আলী…
জিন্দাবাদ!
সর্বহারার শ্রেষ্ঠ বন্ধু ফজল আলী…
জিন্দাবাদ!
স্কুল কলেজ থেকে ছাত্রছাত্রীরা আসছে দল বেঁধে। তারা গান গাইছে, যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে…
ঢ্যাঙা একটা লোক একটা টেবিলের ওপর উঠে হাতে মাইক চেপে আবৃত্তি করে, প্রতিজ্ঞা করো যারা কেড়ে খায় তেত্রিশ কোটি মুখের গ্রাস, লেখা হয় যেন আমার রক্তলেখায় তাদের সর্বনাশ!
গুরু! গুরু!
আই লাভ ফজল আলী…
আমাদের নেতা ফজল আলী…
জিন্দাবাদ! জিন্দাবাদ!
সেই প্রচণ্ড ভিড়ের মধ্যে সমীরণ পাগলের মতো সুড়ঙ্গ খুঁড়তে থাকে। তার গায়ে এখন লক্ষ হাতির জোর। মুখে চোখে বাঘের হিংস্রতা। পিছন থেকে তার একটা হাত ধরে রেখেছে মন্দা। গাঁটছড়া বেঁধে তারা এগোচ্ছে।
খানিকটা ভিতরে গিয়ে মালার লাইন পাওয়া গেল। কিন্তু সে লাইনেরও কোনও স্থিরতা নেই। ঘোড়সওয়ার পুলিশ আর ব্যাটন আপনো সেপাইরা হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। মুহুর্মুহু ভেঙে যাচ্ছে, বেঁকে যাচ্ছে, জট পাকাচ্ছে মালার লাইন।
লাইনে যুবতী মেয়েরা মালা হাতে ঘেমে একাকার। বহু লোকের হাতে দশ আর একশো টাকার নোটের মালা ঝুলছে। একজন মারোয়াড়ি পাড়ার মালা দু’ হাতের আঁজলায় ধরে টাল সামলাচ্ছে।
একজন মেয়ে আর একটা মেয়েকে বলে, তাপসী, তোর মালা কই?
আমি সোনার হারটা দেব গলা থেকে খুলে। তিন ভরির হার।
ভিড় চিরে টেলিভিশনের গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। গরমে, ঘামে, টকটকে লাল হয়ে আছে একগাদা সাহেব-মেম।
দুটো বাঁশের গায়ে লটকানো মস্ত এক ব্ল্যাকবোর্ডে চক দিয়ে লেখা: ফজল আলীর অনশনের আজ ৪০ দিন।
বিশ্বাস হয় না। কিছুতেই বিশ্বাস হতে চায় না সমীরণের। তবে কি ফজলু পেরে গেল? পলাশি গাঁয়ের সেই ন্যালাখ্যাপা ছেলেটা কি সত্যিই পাল্টে দিল দুনিয়ার ভোল?
মন্দা হাতে মিষ্টি একটু চাপ দিয়ে বলল, মালা শুকিয়ে যাচ্ছে। প্লিজ।
হ্যাঁ, সব পারে। সব পারে সমীরণ। মিষ্টি হাতটায় নিজের হৃদয়ের তরঙ্গ পাঠিয়ে চেপে ধরে সমীরণ। বলে, এই তো এসে গেছি। আর একটু।
ফজলু যে তার বন্ধু, তার দেশের ভাই, তা মন্দাকে বলতে সাহস পায়নি সমীরণ। এখন কে না বিখ্যাত ফজল আলীর বন্ধু হতে চাইবে? সমীরণ বোকা নয়।
আওয়াজ ওঠে, জয়ধ্বনি কর, তোরা সব জয়ধ্বনি কর…
ফজল আলী আমার ভাই, তোমার ভাই..
ম্যারাপে ঢুকবার মুখে লাইনটা জট পাকিয়ে ভিড়ের চাপে ফোঁড়ার মতো ফুলে উঠছে এক জায়গায়। ফুলতে ফুলতেই ফাটবে।
সমীরণ ভিড় চেনে। তাই সে সেই ফোলা জায়গাটার কাছ ঘেঁষে দাঁড়ায়। তা করতে গিয়ে অবশ্য পুলিশের ঘোড়া লালাসমেত একটা প্রকাণ্ড নিশ্বাস ফেলে তার ঘাড়ে। একটা সেপাই তার পেটে ব্যাটনের গুতো চালায়।
মন্দাকে আড়াল করে দাঁড়িয়ে হাসিমুখে এই আমলাতান্ত্রিক অত্যাচার সহ্য করে সমীরণ।
লাইনের ফোঁড়াটা গেলে দেওয়ার জন্য সমীরণ আচমকাই লাইনের একটা বেটাল লোককে হাত ধরে হ্যাচকা টানে সরিয়ে আনে।
নিখুঁত কাজ। ফেঁড়াটা গলে গিয়ে গলগল করে পুঁজের মতো মানুষজন বেরিয়ে আসে টাল বেসামাল হয়ে। গড়াতে থাকে লোকেরা, মেয়েরা। কাটা গাছের মতো পড়ে যায় জোয়ান শরীর। ধুলোয় মালায় মাখামাখি। ঘোড়সওয়াররা পর্যন্ত সেই লঙ্কাকাণ্ড দেখে পিছিয়ে যায়।
মন্দাকে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে সমীরণ ম্যারাপের ফটকে ঢুকে পড়ে চোখের পলকে।
গদিওয়ালা একটা মস্ত পালঙ্কের ওপর কেবল ফুলের, টাকার আর খাবারের তূপে দেখা যায়। চারিদিকে ঘিরে আছে শক্তসমর্থ পাহারাদার এবং পুলিস।
মন্দা উত্তেজিতভাবে বলে ওঠে, কোথায় ফজল আলী?
কী আকুলতা মন্দার গলায়। একবার অভিমানভরে মন্দার দিকে তাকায় সমীরণ। মিষ্টি হাতটা তার হাত থেকে ছাড়িয়ে নিয়েছে মন্দা। স্বয়ম্বরার মতো দুই হাতে মালা ধরে উৎকণ্ঠ আবেগে বলছে, কোথায় ফজল আলী? কোনজন ফজল আলী?
পাহারাদারদের মধ্যে একজন হাত বাড়িয়ে বলে, মালা আমার হাতে দিন।
মন্দা তীব্র স্বরে বলে, না না! আমি নিজে দেব।
সেপাইরা চেঁচায়, ভিড় করবেন না। দাঁড়াবেন না। চলতে থাকুন। এখনও অনেকে লাইনে আছে।
বিশাল ম্যারাপের ভিতরেও হাজার লোকের ভিড়। একজন করুণ স্বরে বলে, একবার চোখের দেখা দেখব, একবার…
অবশেষে দেখা যায় ফজলুকে। ফুলের প্রতিরোধ ভেঙে মালার দেয়াল সরিয়ে ক্ষীণ একটা কঙ্কালের হাত বেরিয়ে আসে। বালিশের ওপর আস্তে পাশ ফেরে ফজল আলীর মমির মতো বিশুষ্ক মুখ।
জনতা গর্জন করে ওঠে, ফজল আলীর মৃত্যু নেই..ফজল আলী যুগ যুগ জিয়ো… গুরু। গুরু!
বাইরে থেকে আবৃত্তিকারের গভীর কণ্ঠস্বর আসতে থাকে, উদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই।… (আর একটা! আর একটা!)… বল বীর, চির উন্নত মম শির, শির নেহারিয়া নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির…।
হঠাৎ ওভারহেড ল্যাম্প থেকে বিচ্ছুরিত আলোয় সাদা ঘর সাদা ফরসা হয়ে যায়। চালু হল টেলিভিশন ক্যামেরা। লাল সাহেবরা ছোটাছুটি করে পজিশন নেয়।
সেপাই আর পাহারাদাররা সামান্য অন্যমনস্ক ছিল, সেই মুহূর্তে হাজারটা যুবতী কিশোরী মেয়ে প্রতিরোধ ভেঙে ছুটে যায় পালকের কাছে। তাদের বিস্ময়ের কিচির মিচির শব্দ ওঠে… দেখেছিস! এখনও কী ভাইটালিটি?..আই লাভ ইউ ফজল!…ফজল ডার্লিং।…ফজল, আমার নাম মিতা, আমাকে মনে রেখো!….
একটি তরুণী সুন্দরী মেম ফজলের শুকনো ঠোঁটে নিচু হয়ে চুমু দেয়। খাটের পায়া ধরে কয়েকজন কিশোরী উবু হয়ে কেঁদে ওঠে ভালবাসায়।
সমীরণ হাঁ কবে দেখে, মন্দা দু’হাতে মালাটা ধরে পরিয়ে দিচ্ছে ফজলুর গলায়।
সমীরণ চোখ বুজে ফেলে। পেছন থেকে ভিড়ের ধাক্কা খেয়ে সে উবু হয়ে পড়ে। তারপর বহু লোক তাকে নির্দয় ভাবে মাড়াতে থাকে। তাদের পায়ে পায়ে কাদার মতো ক্যাতকাতে হয়ে যেতে থাকে সমীরণ।
প্রাণপণে হামাগুড়ি দিয়ে সরে যাওয়ার চেষ্টা করে সে। প্রথমে পারে না। তারপর হাজার মানুষের পায়ের গরাদ ভেদ করতে থাকে সে। অতি কষ্টে। ইঞ্চি ইঞ্চি মেপে এগোতে থাকে। বুকের বেলুন চুপসে গেছে। দম পায় না। তবু ব্যায়ামের সুফলে সে মরেও যায় না তাতে। এগোয়।
এগোতে এগোতে সে এক সময় ফজল আলীর পালঙ্কের তলায় ঢুকে যায়।
খানিকক্ষণ সেখানেই ঘাপটি মেরে থাকে সে। তারপর চুপিসারে পালঙ্কের ওধার দিয়ে মুখ বার করে। এদিকটায় কেউ নেই। ফুলের পাহাড়ের আড়ালে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে সে চাপা স্বরে ডাকে, ফজলু! ফজলু রে!
ফজলু ক্ষীণ ভুতুড়ে নাকি স্বরে বলে, কে? মলয়বাবু?
না রে। আমি সমীদা।
সমীদা? কী বলেছিলাম তোমায়? দেখলে তো!
হচ্ছে ফজলু?
হচ্ছে মানে? হয়ে গেছে। বেশ তাকত পাচ্ছি এখন।
বড্ড রোগা হয়ে গেছিস যে!
তা তো হবই। তবে এইভাবেই থেকে যাব। আর কোনও কষ্ট নেই।
আর কোনওদিন কিছু খাবি না ফজলু?
খাওয়ার সঙ্গেই তো লড়াই। আমি লড়াই জিতে গেছি।
তোর কত নামডাক হয়েছে রে ফজলু! কত মেয়েরা আসছে! আমার মালিকের মেয়ে পর্যন্ত তোর গলায় মালা দিয়ে গেল!
ফজলু নাকিস্বরে আস্তে আস্তে বলে, আমার মালিক শেষ পর্যন্ত এল না সমীদা!
আর আসে? সে তোর নামডাক দেখে ভয়ে পালিয়েছে।
কারখানাটা তো তবে আর খুলবে না।
না খুলুক। তোর আর তা দিয়ে কী হবে? তুই তো বড়লোক হয়ে গেলি। কত টাকা পড়েছে দ্যাখ।
তা বটে।–বলে ফজলু পা দিয়ে একটা একশো টাকার নোটের মালা খাট থেকে ফেলে দিয়ে বলে, ফুলের মধ্যে অনেক ভিটামিন, বুঝলে? আমার শরীর ফুল থেকে চোঁ চোঁ করে ভিটামিন মেরে দিচ্ছে। কিন্তু টাকাগুলো কোনও কাজের নয়। বড্ড শুকনো।
কাগজ তো! ওর আর রসকষ কোখেকে আসবে।
টাকা যে কাগজ তা এই প্রথম বুঝলাম সমীদা। বড্ড শুকনো জিনিস। টাকা থেকে রস টানতে পারি না। কেন যে দেয় লোকে এগুলো!
বড্ড দুর্বল হয়ে গেছিস রে ফজলু।
না গো! এখন ফের বল পাচ্ছি। আর দু’-একদিনের মধ্যেই উঠে পড়ব। হাঁটব চলব, দৌড়ব। দেখো। উঠতে তো হবেই। বিদ্যেটা সবাইকে শেখাতে হবে যে? মস্ত ইস্কুল খুলব, ইউনিভার্সিটি খুলে ফেলব। দেখো।
.
১২.
এখনও কে পিছু পিছু আসে মন্দার? এখনও কে পিছু নেয় তার?
মন্দা পিছু ফিরে তাকায় না। তার সারা শরীর কণ্টকিত হয় এক রহস্যময় অনুভূতিতে! তার মনে হয়, পিছু ফিরলেই সে দেখতে পাবে ফজল আলীকে।
একা ঘরে শুয়ে ঘুমোবার আগে প্রতি রাত্রেই তার মন বলে, আজ তুমি ফজল আলীকে স্বপ্ন দেখবে মন।
.
মন, তুমি আজকাল কেমন হয়ে গেছ! একদম পাত্তা দাও না আমাদের!-সুব্রত এক বিকেলে ভিক্টোরিয়ার মাঠে বসে বলল।
মন্দা ঘাসের গোড়া চিবিয়ে বলে, কোনওদিন দিতাম কি?
তা বটে।-বলে সুব্রত হোঃ হোঃ করে হাসে।
হেসো না।
কেন?
আজ ফজল আলীর অনশনের নিরানব্বই দিন পূর্ণ হল। কাল একশো।
সুব্রত দুঃখিতভাবে মাথা নেড়ে বলে, ইয়েস। সমস্ত দেশের হার্টবিট থেমে আসছে।
.
টেলিফোনে মৃদুল ডাকে।
মন, তোমার জন্য একটা বিকেল রেখে দিয়েছি আলাদা করে। আসবে সেদিন? শুধু তুমি আর আমি?
ইচ্ছে করছে না মৃদুল।
কেন মন? আমার কি আর কোনও চার্ম নেই?
ইউ ওয়্যার অলওয়েজ সো চার্মিং।
তবে?
আমারই আর সেই চার্ম নেই।
মৃদুল দুঃখিতভাবে বলে, পৃথিবীরই আর কোনও চার্ম রইল না মন।
কেন?
দ্যাট ডেমন, দ্যাট ফজল আলী! যদি সাকসেসফুল হয় মন, ও যদি পৃথিবী থেকে ফুড প্রবলেম লোপাট করে দেয় তাহলে আর কোনও কমপিটিশন থাকবে না, প্রোডাকশন থাকবে না, টাকার দাম মাটি হয়ে যাবে। কত ইন্ডাষ্ট্রি বন্ধ হয়ে যাবে জানো? অ্যান্ড উই উইল বিকাম জবলেস!
মন্দা মৃদু স্বরে বলে, ফজল আলীর জয় হোক।
.
ওয়াশিংটন ডি সি থেকে সুবীরের চিঠি আসে, মন, এ নিয়ে চারখানা চিঠি গেল। জবাব দাওনি। রাগ করেছ?… ওখানে ফজল আলী নামে কে একজন অনশন কবছে, দেখেছ তাকে? এখানে রোজ টেলিভিশনে তার ছবি। কী ভীষণ কাণ্ড বলল তো। ওয়াল স্ট্রিটের কর্তাদের মাথায় হাত। তাদের ভয়, এশিয়া, আফ্রিকা আর সব গরিব দেশে তাদের ব্যাবসা ড়ুবে যাবে। এ কি সম্ভব? আমাকে ভুলো না লক্ষ্মীটি।
মন্দা চিঠি ছিড়ে ফেলে দেয়।
.
বলুকে ডাকতে হয় না। সে আপনিই আসে। শীত পড়েছে, তাই মনের সুখে এখন ওর স্যুট পরার কথা। কিন্তু পরেনি। টেরিটনের প্যান্টে গোঁজা সাধারণ শার্ট, টাইটাও নেই।
বলে, গজব। সব গজব হয়ে গেল মন।
কী হল?
ব্যাবসা। লাখো টাকা জলে যাবে।
কেন?
তুমি ব্যাবসা বোঝো না। লোকে ভুখা না থাকলে কী জন্যে কাজ করবে? ব্যাবসা চলবে কীসে? ফজল আলী হ্যাজ গিভন দা ওয়ার্ল্ড দা বিটারেস্ট স্লো। …চলল, মাল খাব।
না বল। আমি খাচ্ছি না।
ওঃ, দ্যাট হেডেক অফ ইয়োরস?
বলে কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক থাকে বলু। তারপর বলে, ব্যাবসা ব্যাবসা করে গান ভুলে গেছি, বই পড়া ভুলে গেছি! এখন ভাবছি কী জানো?
কী?
ব্যাবসা তো গজব। তাই সব ছেড়ে ছুড়ে দিয়ে এখন থেকে প্রাণভরে রবীন্দ্রসংগীত গাইব। বই। পড়ব এন্তার। আবার যৌবনটা ফিরিয়ে আনতে হবে। নইলে বাঁচব কী নিয়ে?
.
বাবা ফিরে আসবার পর থেকে মন্দা আর অফিসে যায় না।
বাবার সঙ্গে তার দেখা খুব কম। প্রায়দিনই হয় না।
একদিন রাতের বেলা সিঁড়িতে মুখোমুখি হল। সাধারণত তাদের বাক্যালাপ নেই। একে অন্যকে এড়িয়ে চলে। কিন্তু বাবার চেহারাটা খুব ভাল দেখল না মন্দা। মুখে চোখে কেমন ভ্যাবলা ভাব, চামড়া ঝুলে পড়েছে। সেই হাসিখুশি আমুদে মানুষটা আর নেই।
সে থমকে দাঁড়াল। রায়বাবুও দাঁড়ালেন।
প্রথমে কিছুক্ষণ কথা নেই। তারপর মন্দাই নিজে থেকে জিজ্ঞেস করে, তোমার শরীর খারাপ?
বড় দুশ্চিন্তা।
কেন?
রায়বাবু খানিকটা আকুল স্বরে বললেন, তোর তো ব্যাবসার খুব শখ। মাথাও আছে। দেখবি চেষ্টা করে? আমরা তো নাজেহাল হয়ে যাচ্ছি।
কেন?
কর্মচারীরা কেউ মানছে না আজকাল। কাজ হচ্ছে না কোথাও।
মন্দা নিষ্ঠুর হেসে বলে, তাই মেয়ের ফেমিনিন চার্মকে কাজে লাগাতে চাইছ?
রায়বাবু রেগে গিয়ে বলেন, তুই গোল্লায় গেছিস। তাই যা। কিছু বলতে যাওয়াই ভুল।
মন্দা ভারী মজার হাসি হেসে বলে, প্রবলেমটা কী?
ফজল আলী।
মন্দার সমস্ত শরীর শিউরে ওঠে। ভিতরটা ধুয়ে যায় এক রহস্যময় আনন্দে।
হঠাৎ রায়বাবু বললেন, সমীরণ নাকি তোকে খুব বিরক্ত করত?
মন্দা সমীরণকে মনে করতে না পেরে বলে, কে সমীরণ?
ওই যে বডিগার্ড ছেলেটা।
না তো! বরং হেলপ করেছে।
সুখন বলছিল।
কী?
খুব মাখামাখির চেষ্টা করত তোর সঙ্গে! যাই হোক, ওকে ছাড়িয়ে দিয়েছি।
বেচারা। বলে হাসল। তারপর বলল, কিন্তু দুনিয়াশুষ্টু ছেলেছোকরা তো তোমার কর্মচারী নয়। ক’জনকে ছাড়াবে?
রায়বাবু তা জানেন। তাই লাল মুখে মেয়ের সামনে থেকে সরে গেলেন তাড়াতাড়ি।
.
১৩.
বৌধায়নের অনশনের আজ দ্বিতীয় দিন।
প্রথম দিনটায় কেউ তেমন খবর পায়নি। সকালে বৌধায়ন গুল ঝাড়ল, শরীর খারাপ। খাব না।
শুনে বাবা ডাক্তার ডাকালেন। ডাক্তার এসে ঘণ্টাখানেক বসে রইলেন। অনেক ডাকাডাকিতেও বৌধায়ন বাথরুম থেকে বেরোল না। তারপর সারাদিনই মা, দাদা, বাবা খিটখিট করতে লাগল। বৌধায়ন মটকা মেরে পড়ে রইল।
বিকেলবেলা জয়তী ঘোষণা করল, বুধোর শরীর-টরীর খারাপ কিছু নয়। ফজল আলীর মতো অনশন করছে।
সেই শুনে সকলের চোখ কপালে।
আজ দ্বিতীয় দিন বেলা যত বাড়ছে তত বন্ধুবান্ধব আর আত্মীয়স্বজন দেখতে আসছে বৌধায়নকে।
কী লজ্জা।
অবশ্য লজ্জার ভাবটা তার মুখে খেলছে না তেমন। গত রাত্রি থেকেই কান ভোঁ ভোঁ করছে। শরীর মিশে গেছে বিছানায়। চোখে ভাল দেখতে পাচ্ছে না। গলার স্বর ক্রমে ক্ষীণ হচ্ছে।
সকালবেলাতেই এক গোছা রজনীগন্ধা নিয়ে এল মন্দা। হেসে বলল, তোমার এক দিনের অনশন ফজলের বিশ দিনের সমান।
ঠাট্টা করছ?
না গো! ফজল তো গরিব ঘরের ছেলে, না খেয়ে অভ্যাস আছে। আর তুমি জীবনে এক বেলাও না খেয়ে থাকোনি, তাই তোমার অভ্যাস অন্য রকম।
বৌধায়ন ক্ষীণকণ্ঠে বলে, আমার মনে হচ্ছে, তুমি এখনও ঠাট্টা করছ। রজনীগন্ধা ফেরত নিয়ে যাও।
লক্ষ্মীটি।
খুবই হতাশ হয় বৌধায়ন। সারা জীবন ধরে সে নানা সৎ কাজের চেষ্টা করছে। শেষ পর্যন্ত কোনওটাই হচ্ছে না। সে তত বেশি কিছু চায় না, শুধু এই মানবসমাজের কল্যাণ চায়।
সুব্রত মন্দার একটু পরেই এসে বলল, কংগ্র্যাটস বৌধায়ন।
ইয়ার্কি কোরো না।
করছি না। শুধু বলি এখন অনশন প্র্যাকটিশ করাটা বোকামি।
বৌধায়ন দুর্বলতার মধ্যেও কেঁঝে উঠে বলে, কেন?
বোঝো না? ফজল আলী পৃথিবী থেকে খাদ্য সমস্যা তাড়িয়ে দিল তো? এখন গরিব-গুৰ্বোরা কায়দাটা শিখে নিয়ে খাদ্য বর্জন করত শুরু করবে। আর তখন পৃথিবীতে রাশি রাশি খাবাব থাকবে উদ্বৃত্ত। ফসলের খেত হয়ে যাবে আগাছার জঙ্গল। খাবারে ধুলো পড়বে, খাবার পচবে। সুতরাং সে সব খাবার নিয়েও দেখা দেবে গ্রেট প্রবলেম। কে খাবে তুমি আমি ছাড়া?
বৌধায়ন চোখ বুজে বলল, তোমার রজনীগন্ধা ফেরত নিয়ে যাও।
আমি রজনীগন্ধা আনিনি যে!
তাহলে কী এনেছ?
ওনলি গুড উইশেস।
ফেরত নিয়ে যাও।
মা সারাদিন পাশে বসে হাতাপিতি করে দিচ্ছে। পিসি, মাসিরা এসেও হাতাপিতি করছে। এক কাকিমা এসে এক রাউন্ড কেঁদে গেল। মাও কাদছে চেপেচুপে।
রেনি পার্ক থেকে অফিস কামাই করে বড়দা এসেছে সপরিবারে। এসে তক ইংরেজিতে নানা রকম মার্জিত গালাগাল দিচ্ছে তাকে। ইররেসপনসিবল, ভ্যাগাবন্ড ফ্যানাটিক সিউডো হিরো…
দাঁতে দাঁত চেপে বৌধায়ন পড়ে রইল। কিন্তু তাইতেই কি নিস্তার আছে? নৃত্যনাট্য দলের সঙ্গে দিল্লি গিয়েছিল নয়না। সেদিন সকালে ফিরে এসেই সোজা বৌধায়নের ঘরে এবং বুকের ওপরে। একরাশ চোখের জল ফেলে বলল, কেন মরতে চাইছ? আমি তো তোমাকে রিফিউজ করিনি।
বৌধায়ন বিড় বিড় করে বলে, না, আমিই করছি।
আস্তে বলা হলেও শুনতে পেল নয়না। ঋজালো চোখে চেয়ে বলল, তুমি এই রকম?
আরও খারাপ। বলে বৌধায়ন।
নয়না তারপর আবার কাঁদে! অনেকক্ষণ বসে থাকে।
দুপুরে ঘর খানিকটা ফাঁকা। জয়তী টুক করে এসে তার মাথায় হাত রেখে বলল, ওমা! জল খাচ্ছ না যে!
জল খায় নাকি?
খায় না? জল কী গো? সরবৎও চলে।
ইয়ার্কি কোরো না।
মাইরি বলছি। আমাদের পাড়ায় অনশন হয়েছিল একবার। অত কী, গাঁধীও জল খেতেন।
বৌধায়ন বিশ্বাস করে না।
কিন্তু জয়তী ঘুরঘুর করতে থাকে।
বিকেলের দিকে বৌধায়ন মাথা তুলে বলে, সত্যি জল খায়?
জয়তী ম্লান মুখে বলে, আমি তোমাকে মিথ্যে কথা বলব?
একটু ভেবে বৌধায়ন বলে, এক সিপ জল দাও তো তাহলে!
জয়তী দেয়। বৌধায়ন এক চুমুক খেয়ে মুখ বিকৃত করে বলে, এত মিষ্টি কেন?
ওমা উপোসি শরীরে জল খেলে মিষ্টি লাগবে না? বোকা আছে মাইরি! এ তো সবাই। জানে!– জয়তী জবাব দেয়।
বৌধায়ন সন্দেহের চোখে চেয়ে বলে, হকি খেয়ে বা মৌরি চিবিয়ে জল খেলে মিষ্টি লাগে বটে, তা বলে উপোস করলেও লাগবে?
বড় বড় চোখে চেয়ে জয়তী বলে, আমাকে যা বলার বললে, অন্য কাউকে বোলো না যেন। লোকে হাসবে।
বৌধায়নের আর বাধা হল না। সে পুরো আধসেরি গ্লাসের জল ঢক করে খেয়ে নিল। বলল, আর একটু।
জয়তী দেয়। বৌধায়ন খেয়ে বিড় বিড় করে বলে, গ্লুকোজ। গ্লুকোজ! নিশ্চয়ই গ্লুকোজ।
সন্ধে হতে না হতেই নতুন করে ভিড় জমে বাড়িতে। আবার খিটখিট, কান্নাকাটি হাতাপিতি।
বৌধায়ন নীরবে পড়ে থাকে। মাঝে মাঝে তাকে জল খাইয়ে যায় জয়তী। ডাক্তার এসে প্রেসার মাপে, হার্টবিট দেখে নাড়ি পরীক্ষা করে।
রাত্রিবেলা জয়তী ঘোষণা করল, অনশনে ওষুধ বারণ নয়।
বৌধায়ন বলল, ওষুধ? আমি ওষুধ খাব কেন?
জয়তী গম্ভীর হয়ে বলে, ডাক্তার বলেছে তোমার হার্ট ভাল নয়।
যাঃ।
মাইরি, কালীর দিব্যি।
খুবই সন্দেহ হতে থাকে বৌধায়নের। কিন্তু সে অসুখকে ভয় পায়। ভীষণ ভয় পায়।
তাই রাত্রিবেলা জয়তী তার নাক টিপে ধরে, কৌশলে হাতের পাতায় চোখ আড়াল করে মুখে ওষুধ ঢালতে থাকে।
এত বড় ডোজের ওষুধ বৌধায়ন জীবনে খায়নি। গিলছে তো গিলছেই। আর বেশ মিষ্টি ও সুস্বাদু ওষুধ।
কী খাওয়ালে বলো তো? সত্যি ওষুধ?
মাইরি, কালীর দিব্যি।
কী নাম ওষুধটার?
ভিটোলাস।
শিশিটা দেখাও তো।
জয়তী গম্ভীর মুখে একটা শিশি এনে দেখায়। ওষুধের জগতের কোনও খবরই বৌধায়ন রাখে না। তাই শিশিটা সরিয়ে দিয়ে পাশ ফিরে বলল, আমি ঘুমোব। তোমরা যাও।
বিড়বিড় করে বৌধায়ন বলে, ইউ উইল বি অ্যানাদার ফার্স। অ্যানাদার ফার্স।
জয়তী মুখ টিপে হাসে।
.
১৪.
অনশনের দুশো দিন পূর্ণ করে ফজল আলী উঠল।
এতই শীর্ণ যে প্রথমে তাকে ভাল করে বোেঝা যাচ্ছিল না। শুকনো হাড়ের ওপর চামড়াটা কে যেন বিছিয়ে রেখেছে অযত্নে। দুটো চোখের গুহার ভিতরে নিভন্ত ব্যাটারির টর্চবাতি জ্বলছে।
টেলিভিশন ক্যামেরায় প্রথমে তার ছবিই এল না। দর্শকরা ঘন ঘন টেলিফোন করতে লাগল, ফজল আলী কই?…গুরুকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?
ক্যামেরার লেন্সের জোর বাড়ানো হল অ্যাঙ্গেল বদলানো হল। অবশেষে টেলিভিশনে প্রেতশরীরের মতো, অশরীরীর মতো ভেসে উঠল ফজল আলীর ছবি।
সারা পৃথিবী ফেটে পড়ল হর্ষধ্বনিতে।
ফজল আলী সামান্য হাসে এবং সবাইকে আদাব জানিয়ে তার ভুতুড়ে নাকিস্বরে বলে, খোদার মেহেরবানি। আমি বেঁচে আছি। বেঁচে থাকব।
সারা বিশ্বের টি ভি নেটওয়ার্কে কোটি কোটি মানুষ সেই কথা শুনে জয়ধ্বনি দেয়।
ফজল আলী উঠে দাঁড়ায়। হাত তুলে বলে, অনশন একটা শিল্প। ভাইসব পেটে পাথর ভরে নিতে হয়, পেটে দুর্গ বানিয়ে নিতে হয়। মনে রাখতে হয়, খাদ্যবস্তু আমাদের হারাম।
ফজল আলী হাঁটতে থাকে। ক্যামেরা ধাওয়া করে তাকে। মাইক্রোফোন চলে সঙ্গে সঙ্গে।
ফজল আলী ধীর স্বরে বলতে থাকে, মানুষকে আমি ঘরে ঘরে গিয়ে শেখাব কী করে খাদ্যবস্তু বর্জন করে বেঁচে থাকতে হয়। বেঁচে থাকতেই হবে, খাওয়াও জুটবে না, এ দুটো জিনিস মেলাতে পারলেই জীবন বড় সুন্দর।
ফজল আলী রাস্তায় নামে। লক্ষ লক্ষ লোক হাঁটে তার সঙ্গে। গর্জন করে জয়ধ্বনি দেয়।
ফজল আলী বলে, খোদা মেহেরবান। আমাদের তিনি ইচ্ছাশক্তি দিয়েছেন। ভাইসব সেই ইচ্ছাশক্তিই আমাদের মূলধন, আমাদের হাতিয়ার। এই যে হাত-পা দেখছেন, এই যে গায়ের চামড়া, এই চোখ আর ওই দেখুন আল্লার আলো, বাতাস মাটি, ইচ্ছাশক্তিবলে ওই আলো বাতাস আর মাটি থেকে আপনার হাত, পা, চামড়ার প্রতিটি ছিদ্র গাছের মতো টেনে নিতে পারে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, প্রোটিন। প্রথমে একটু অভ্যাস, কিন্তু ক্রমে ক্রমে…
ফজল আলী এগোতে থাকে।
বুড়ো হরিদেব আর নিত্যপদ ধরাধরি করে চৌকিটা রাস্তার ধারে পেতে দিয়েছে। শামিয়ানার অভাবে ওপরে মশারিটা চালি করে টাঙাননা।
চৌকিতে সমীরণ শুয়ে আছে। একধারে নিত্যপদ তার শেলেটে ‘অনশনের আজ দশ দিন’ লিখে টাঙিয়ে দিয়েছে। দেখার জন্য বেশ ভিড় হচ্ছে আজকাল।
হরিদেব আর নিত্যপদ পালা করে হাতপাখা নেড়ে হাওয়া দেয়, সমীরণকে। চৌকির আশেপাশে ঘুরঘুর করে।
নিত্যপদ জিজ্ঞেস করে, তুমি পারবে বাবা?
হরিদেব খুব হেসে বলে, তুই পারবি?
নিত্যপদ বলে, পারব না কেন! তবে দাদার চার নম্বর বউটা ভাল, বুঝলে বাবা। খেতে দেয়। এর পরের মাগিটা যদি খারাপ হয় তবে তো খেতে দেবে না। তখন করব?
হরিদেব ভেবে পায় না সে আজ খেয়েছে কি না। গতকাল কি কিছু খেয়েছিল? কিছু মনে পড়ে না।
নিত্যপদ আপনমনে মার্বেল খেলে। হরিদেব বসে বসে ঢোলে।
.
এক গভীর রাতে সমীরণের মাথায় কে হাত রাখল।
সমীদা গো! ও সমীদা!
কে? রায়বাবু? মন্দা!–বলে অনেক কষ্টে সমীরণ চোখ খোলে। প্রেতের মতো শীর্ণ একটা লোককে দেখে শিয়রে। চমকে ওঠে। শমন এল নাকি?
শীর্ণ লোকটা হেসে বলে, না গো! আমি ফজলু। পারছ সমীদা?
সমীরণ শীর্ণমুখে হাসে, পারছি। বুঝলি! একটু একঘেঁয়ে লাগে। তবে পারছি। হাত-পা চামড়া দিয়ে গল গল করে ভিটামিন ঢুকে যাচ্ছে ভিতরে। প্রোটিন আসছে। ক্যালসিয়ামও।
ফজলু বড় মায়াভরে বলে, পারবে সমীদা। একটু কষ্ট হয় প্রথমে। কিন্তু পারবে। ইচ্ছাশক্তি রেখো। দুনিয়ার গরিবদের বেঁচে থাকতেই হবে। আল্লা মেহেরবান।
ঘরে ঘরে রাস্তায় রাস্তায় অনশনশিল্পীরা অপেক্ষা করছে ফজল আলীর জন্য। শেখাতে হবে। পেটে পাথর বাঁধতে শেখাতে হবে। পেটে দুর্গ গড়ে তুলতে শেখাতে হবে। গাছের মতো হয়ে উঠতে শেখাতে হবে।
ফজলুর সময় নেই। ফজলু এগিয়ে যায়।