১১. মনটা খুবই ব্যাড হয়ে আছে

হীরু বলল, মনটা খুবই ব্যাড হয়ে আছে।

এ্যানা হেসে ফেলল।

হীরু রাগী গলায় বলল, হাসলে কেন?

আপনি বললেন মনটা খুব ব্যাড হয়ে আছে–এই শুনে হাসলাম। বললেই হয় মনটা খারাপ হয়ে আছে।

হীরু গম্ভীর হয়ে গেল। এই মেয়ে ইদানীং উল্টাপাল্টা কথা বলে তাকে কষ্ট দিচ্ছে। অবশ্যি এটাই মেয়েদের নেচার। কোনো না কোনো ভাবে মানুষকে কষ্ট দেয়া।

ওরা দুজনে বাস স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে আছে। দুজনের দেখা হয়ে গেছে কাকতালীয় ভাবে। হীরু যাচিছিল পীর সাহেবের কাছে। বাস সটপে এসে দেখে এানা। চার-পাঁচদিন চেষ্টা করেও তার সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। পরশু দিন তো প্ৰায় গোটা দিন এ্যানাদের বাসার সামনে হাঁটাহাঁটি করে কাটাল। লাভ হল না।

আর আজ কি-না দেখা হয়ে গেল বাস স্টপে। একি যোগাযোগ। সে মধুর স্বরে বলল, যাচ্ছ কোথায় এ্যানা?

যাত্রাবাড়িতে। আমার ছোট চাচার বাড়িতে।

যাত্রাবাড়িতে যাচ্ছ? বলা কী! আমিও তো ঐ দিকে যাচ্ছি। আমার এক ফ্রেন্ডের বাসা। ক্লোজ ফ্রেন্ড। জন্ডিস হয়ে পড়ে আছে। খবর পাঠিয়েছে যাবার জন্যে। মেইন রোডে বাসা।

এ্যানা হোসে ফেলল।

হীরু বলল, হাসলে কেন?

আপনি যে সারাক্ষণ মিথ্যা কথা বলেন এই জন্যে হাসলাম।

কী মিথ্যা বললাম?

যাত্রাবাড়িতে বন্ধুর কাছে যাওয়ার ব্যাপারটা পুরো মিথ্যা। আমি যদি বলতাম, আমি বাসাবো যাচ্ছি, তাহলে আপনি বলতেন। আপনিও বাসাবো যাবেন। আপনার এক বন্ধু আছে বাসাবোতে। তার জন্ডিস। এখন-তখন অবস্থা।

হীরু এ্যানার বুদ্ধি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল। একটু মন খায়াপও হল। এরকম একটা বুদ্ধিমতী মেয়েকে বিয়ে করে শেষে কোন যন্ত্রণা হয় কে জানে। বিয়ে না করেও তো উপায় নেই। প্রেম যখন

হয়ে গেছে।

বাসগুলিতে অসম্ভব ভিড়।

পরপর দু’টা বাস মিস হল–চেষ্টা করেও তারা উঠতে পারল না। হীরুর খুব ইচ্ছা একটা রিকশা নিয়ে দুজনে চলে যায়। গল্প করতে করতে যাওয়া যাবে। তার ওপর আছে এ্যানার গা ঘেঁষে বসার আনন্দ। সমস্যা হচ্ছে তার কাছে আছে মাত্র দশটা টাকা। সত্তর টাকা ছিল। পীর সাহেবের জন্যে এক প্যাকেট বেন্যসব কিনতে গিয়ে ষাট টাকা বের হয়ে গেল। অবশ্যি কোনো-একটা দোকানে বেনসনের প্যাকেট বেচে দেয়া যায়। চল্লিশ টাকা বললে ওরা লুফে নেবে।

এ্যানা।

কী।

চল একটা রিকশা নিয়ে নেই। এক দানে যাওয়া যাবে না। ভেঙে ভেঙে যেতে হবে। এখান থেকে নিউ মার্কেট। নিউ মাকেট থেকে গুলিস্তান–তারপর গুলিস্তান থেকে যাত্রাবাড়ি।

হীরুকে অবাক করে দিয়ে এ্যানা বলল, রিকশা নিয়ে নিন।

সত্যি বলছি? ট্রথ?

হুঁ, সত্যি।

রিকশা নেবার আগে হীরু বেনসনের প্যাকেট বিক্রি করল পঁয়তাল্লিশ টাকায়। তার মনে একটু খচখচানি রইল পীর সাহেবের জনো কেনা জিনিস বিক্রি করা ঠিক হল না।

রিকশায় উঠে সেই খচখচানি দূর হয়ে গেল। এত ভাল লাগল এ্যানাকে পাশে নিয়ে বসতে। এ্যানা একটা হাত রেখেছে হীরুর ডান পায়ের উপরে। একটা মেয়ে তার হাত রেখেছে হীরুর হাঁটুতে এতেই এত আনন্দ হচ্ছে কেন? হীরুর চোখে পানি এসে যাচ্ছে। হীরু বলল, মনটা খুব খারাপ এ্যানা। খুবই খারাপ।

কেন?

টুকুকে পাওয়া যাচ্ছে না।

টুকু আবার কে?

আমার ইয়ংগার ব্রাদার।

সে তো অনেক আগেই গেছে।

এসেছিল। সকালে এসে সারাদিন থাকল সন্ধ্যানেল আবার গান।

কোথায় গেছে?

জানি না কোথায়। পীর সাহেবের কাছে যাব। দেখি উনি কী বলেন।

কিছু-একটা হলেই আপনি পীর সাহেবের কাছে চলে যান, তাই না?

সাংঘাতিক পাওয়ার উনার। তোমাকে এক’দিন নিয়ে যাব।

পীর সাহেবের কাছে যাবার আমার কোনো সখ নেই। পীর আবার কী? শুধু টাকা নেওযার ফন্দি।

তাওবা করি এ্যানা, এক্ষুণি তওবা কর। ইমিডিয়েট।

চুপ করুন তো। আমি তওবা-টওবা করতে পারব না!

তওবা না করলে আমি কিন্তু নেমে যাব।

এ্যানা বলল, নেমে যান। আপনাকে কে আটকাচ্ছে। আমি কী দড়ি দিয়ে আপনাকে বেঁধে রেখেছি?

হীরুর বাগ উঠে যাচ্ছে। রাগটা কনট্রোল করার জন্যে সে সিগারেট ধরাল। এ্যানা বলল, সিগারেট ফেলুন তো! চোখে ছাই পড়ছে।

ছাই পড়লে অসুবিধা কী? চোখ কী ক্ষয়ে যাচ্ছে নাকি?

হ্যাঁ, ক্ষয়ে যাচ্ছে।

তুমি বড় যন্ত্রণা কবছ এ্যানা।

আপনি নিজেই যন্ত্রণা করছেন। ফেলুন সিগারেট।

মেয়েছেলের কথায় ফস করে সিগারেট ফেলে দেয়া খুবই অপমানের ব্যাপার। তবু হীরু সিগারেট ফেলে দিল। দুনিয়াটাই এরকম যে মেয়েছেলের মন রক্ষা করে চলতে হয়।

এ্যানা বলল, নামার কথা বলে আবার দেখি বসে আছেন। আপনার লজ্জা নেই?

এইসব করলে কিন্তু সত্যি সত্যি নেমে যাব।

বেশ তো নেমে যান। এই রিকশা থাম তো উনি নামবেন।

রিকশা থামল। হীরু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। বোঝা যাচ্ছে এই মেয়ে তাকে যন্ত্রণা দেবে। একে বিয়ে করলে জীবনটা ভাজা ভাজা হয়ে, যাবে। কিন্তু বিয়ে না করেই বা উপায় কী? প্রেম বলে কথা। প্ৰেম না থাকলে এতক্ষণে একটা চড় দিয়ে সে নেমে পড়ত। প্রেমের কারণে চড়টা দেয়া যাচ্ছে না।

এ্যানা বলল, কই নামলেন না?

মেয়েছেলে একা একা যাবে এই জান্যে বসে আছি।

একা একা যাওয়া আমার অভ্যাস আছে। আপনি নেমে যান। নেমে গেলেই ভাল।

ভাল কেন?

আপনাকে আমার অসহ্য লাগছে।

অসহ্য লাগার এমন কী করলাম? সিগারেট ফেলতে বলেছ। ফেলে দিয়েছি। মামলা ডিসমিস।

কেন খালি খালি কথা বাড়াচ্ছেন? এত বকবক করা শিখলেন কার কাছে? আপনার পীর সাহেবের কাছে?

এর পরে আর বসে থাকা যায় না।

হীরু নেমে গেল।

তার মনে ক্ষীণ আশা, রিকশা থেকে নামা মাত্র এ্যানা তার ভুল বুঝতে পারবে এবং মধুর গলায় বলবে, উঠে আসুন। হীরু অবশ্যি সঙ্গে সঙ্গে উঠবে না। এতে মান থাকে না। এ্যানা তখন বলবে, না হয় একটা ভুল করেছি। তাই বলে আপনি এমন করবেন? তখন হীরু উঠবে। কারণ মেয়েছেলের ওপর বেশিক্ষণ রাগ করে থাকা ঠিক না। মেয়েছেলের কাজই হচ্ছে ভুল করা। তারা ভুল করবেই। বিবি হাওয়া তাদের পথ দেখিয়ে গেছে।

আশ্চর্যের ব্যাপার এ্যানা কিছুই বলল না। রিকশা ফরফর করে এগিয়ে চলল। রাগে হীরুর ব্রহ্মতালু জ্বলে গেল। সে মনে মনে তিনবার বলল হারামজাদী, হারামজাদী, হারামজাদী। রাগ এতে পড়ে গেল। তিন সংখ্যার এই গুণ। রাগ করে তিনবার কোনো একটা কথা বললে রাগ পড়ে যায়। মন শান্ত হয়ে আসে।

হীরুর মন এখন শান্ত। বেশ অনুশোচনাও হচ্ছে, রিকশা থেকে নেমে পড়াটা বিরাট বোকামি হয়েছে। ইংরেজিতে যাতে যাকে বলে গ্রেট মিসটেক। বেচারীব কাছে রিকশা ভাড়া আছে কি-না। কে জানে। মনে হচ্ছে নেই। বেচারী রিকশা থেকে নেমে মনটা খারাপ করবে; রিকশাওয়ালার সঙ্গে খচখচি করবে! আজিকাল রিকশাওয়ালারা মেয়েছেলের সম্মান রেখে কথা বলে না; মেয়েছেলের সঙ্গে ইচ্ছে করে যেন আরো খারাপ ব্যবহার করে।

হীরু একটা চায়ের স্টলে ঢুকে পড়ল। সারাটা দিন কী করে কাটাবে তার একটা পরিকল্পনা করা উচিত। সন্ধ্যাবেলায় আরেকবার এ্যানার খোঁজে গেলে কেমন হয়? সঙ্গে একটা চিঠি নিয়ে যাবে। একটা মাত্র লাইন সেখানে লেখা থাকবে। এমন লাইন যে পড়া মাত্র মনটা উদাস হয়ে যায়। চোখ হয় ছলোছালো এ রকম লাইন খুঁজে পাওয়া খুবই কষ্ট। চা খেতে খেতে এটা নিয়ে ভাবা যেতে পারে।

আজ হীরুর ভাগ্যটাই খারাপ। কাপ থেকে চা চুলকে পড়ল পাঞ্জাবিতে। চায্যের এই দাগ সহজে উঠবে না। দুধ দিয়ে ধুয়ে দিতে পারলে হয়ত উঠত। এখানে দুধ পাবে কোথায়? হীরু দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল। এ রকম যে হবে সে জানত। পীর সাহেবের নামে কেনা সিগারেট সে বিক্রি করে দিয়েছে। কাজেই একের পর এক অঘটন ঘটবে। এানা যে তাকে রিকশা থেকে নামিয়ে দিল। এর কারণ তো আর কিছুই না পীর সাহেবের বরদোষা। এই জন্যেই পীর-ফকিরের সঙ্গে মেলামেশা কম করতে হয়। সব জিনিসের ভাল-মন্দ দু’টা দিকই আছে। পীর-ফকিরের সঙ্গে খাতির থাকা যেমন ভাল আবার তেমনি মন্দ। এখন মনে হচ্ছে মন্দটাই বেশি।

হীরু উদাস ভঙ্গিতে দ্বিতীয় কাপ চায়ের অর্ডার দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *