১. ভাইদের মঙ্গল কামনা করার জন্য কলকাতায় শুরু হয়েছে ভাইফোঁটার আয়োজন। আমাকে ক’জন আবদার করেছিল ভাইফোঁটা দেবার জন্য। আমি সেই ভাইদের বললাম, ‘আপনারা বোনফোঁটার ব্যবস্থা করুন। বোনদের মঙ্গল কামনা করে তাদের কপালে ফোঁটা পরান। আপনাদের মঙ্গল তো অনেক হলো। এবার বোনের মঙ্গলের জন্য কিছু করুন। নিয়ম পাল্টান।’
ভাইরা আকাশ থেকে পড়ল। এমন অলক্ষুণে কথা তারা ইহজীবনে শোনেনি।
২. আমি কোনও ইদ পুজো বড়দিন এসব করি না। যেহেতু ধর্ম আমি মানি না। কিন্তু এসএমএস পেলাম খুব, ‘শুভ বিজয়া’, ‘শুভ দীপাবলি’। সবচেয়ে বেশি পেয়েছি ‘ইদ মোবারক’। এর কারণ কী, এই, যে, আমি মুসলমান পরিবারে জন্মেছি? মুসলমান পরিবারে জন্মেছি বলেই যে আমাকে মুসলমান হতে হবে তার কোনও মানে নেই। আমি আপাদমস্তক নাস্তিক। কারও নাস্তিকতাকে সম্মান জানানোর রীতি এ সমাজে নেই। কোনও না কোনও ধর্মের গর্তে মানুষকে ফেলার অভ্যেসই মানুষের। আমাকে ‘তোমাদের ইদ, তোমাদের রোজা, তোমাদের শবেবরাত’ বলে কথা বলতে শুনি তাদেরই, যারা আমার নাস্তিকতার আদ্যোপান্ত জানে। আসলে, ভেজাল জিনিসে এত বেশি অভ্যেস মানুষের, যে খাঁটি দেখলে ঠিক বোঝে না যে জিনিসটি ভেজাল নয়। আমি নাস্তিকতার কথা বলি বলেই যে আমি ভেতরে ভেতরে মুসলমান নই, তা তাদের ঠিক বিশ্বাস হয় না। জীবনে যা আমি বিশ্বাস করি, তা আমি যাপন করি— এ কথা আমি শত বলেও কাউকে বোঝাতে পারি না। সম্ভবত সত্যিকার নাস্তিক দেখার অভিজ্ঞতা কারওর নেই। অথবা এ যুগে নিজেকে নাস্তিক হিসেবে পরিচয় দিয়েও ঘণ্টা বাজলেই ‘এ তো আর ধর্মীয় নয়, এ নিতান্তই সামাজিক উৎসব’ বলে ইদ পুজো বড়দিনে ঝাঁপিয়ে পড়ার লোক তো কম নেই। তাই ধন্দে পড়ে হয়তো অনেকে। অথবা কোনও দ্বিধা নয়, মস্তিষ্কে শুধু এই জিনিসটুকু কাজ করে না যে ধর্ম এবং ধর্মসংক্তান্ত সবরকম উৎসব থেকে সে সামাজিক হোক অসামাজিক হোক নিজেকে মুক্ত করা সম্ভব।
৩. আমার বাড়িতে যে বাঙালি পুরুষই দুপুরের বা রাতের খাবার খেয়েছে, গায়ে গতরে যত সে বলশালী হোক, দেখেছি দুর্বল। নিজের থালা তারা নিজে নিয়ে নিতে পারে না। কেউ ভাত তরকারি বেড়ে দেবে এই আশায় শূন্য থালা সামনে নিয়ে বসে থেকেছে। নিজের হাতে ভাত তরকারি নিজের থালায় নিতে হবে, কেউ এখানে কাউকে তুলে দেবে না — এই ঘোষণা দেবার পর সব পুরুষই দেখি চেষ্টা করেছে বাটি থেকে নিজ নিজ থালায় খাবার নেবার। কিন্তু পারেনি কেউ। হয় চামচ পড়ে গেছে হাত থেকে। নয়তো খাবার পড়ে গেছে টেবিলে। নয়ত বাটি কাত হয়ে গেছে, অথবা উপুড় হয়ে পড়েছে টেবিল থেকে মেঝেয়। এই দুর্ঘটনাগুলো মেয়েদের বেলায় ঘটে না, ঘটে শুধু পুরুষের বেলায়। কেন, এই রহস্য একদিন আমি ভেদ করি। বন্ধুদের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে দেখেছি, বাড়ির মেয়েরা বাড়ির পুরুষদের খাওয়ান। টেবিলে পুরুষদের খেতে দিয়ে নিজেরা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পরিবেশন করেন। নিজেরা খান না। পুরুষেরা, বাচ্চারা এবং অতিথিরা খেয়ে ওঠার পর তারা খান। পুরুষের ঘাড়ের পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে তাদের সেবাদাসী, কিছু তাদের দরকার হয় কী না দেখার জন্য। পুরুষেরা, যারা নারী-স্বাধীনতায় অবিশ্বাসী এবং ঘোরতর বিশ্বাসী — মহানন্দে দত্তায়মান সেবাদাসী পাশে নিয়ে খেয়ে দেয়ে ঢেঁকুর তোলেন।
সেই যে বলা হত, স্বামীর আগে স্ত্রী খেয়ে নিলে স্বামীর অমঙ্গল হয়। এখনও সম্ভবত একই বিশ্বাস কাজ করে — যত ছুতোই একসঙ্গে বসে না খাবার পক্ষে দেওয়া হোক না কেন।
৪. কলকাতায় কারও বাড়িতে যখনই যাই নেমন্তন্নে, দেখি মেয়েরা একজায়গায় জড়ো হয়ে গপ্প করছে, পুরুষরা আরেক জায়গায়। একদিন তো মুখ ফসকে আমার বেরিয়েই গেল, ‘কী ব্যাপার, এখানে সবাই সমকামী না কি?’ যথাসম্ভব দুদলকে এক করাবার চেষ্টা করি। কিন্তু বেশিক্ষণ তা স্থায়ী হয় না। পুরুষের আত্তা আর মেয়েদের আত্তার বিষয়গুলো আলাদা। পরস্পরের বিষয় নিয়ে কেউ খুব একটা উৎসাহী নয়। লক্ষ করেছি, মেয়েদের বিষয় শাড়ি কাপড়, বাচ্চা কাচ্চা, রান্না বান্না, স্বামী সংসার, বড়জোর গান বাজনা। পুরুষের বিষয়, রাজনীতি, অর্থনীতি, যৌনতা, টাকা পয়সা। এই বিষয়গুলো পত্তাশ বছর আগেও ছিল। বিবর্তন কত কিছুতে ঘটছে। নারী পুরুষের গপ্পের বিষয় কেবল এক থেকে গেছে। গপ্পের বিষয় এক হবেই বা না কেন! পুরুষতন্ত্র যে একইরকম ভাবে জাঁকিয়ে বসা। বিবর্তন তো ডালে ডালে পাতায় পাতায় ঘটছে, গোড়ায় ঘটছে না।
৫. মেয়েদের কিছু না কিছুতে বদনাম না হলে চলে না। বদনাম বিহীন কোনও মেয়েকে দেখার সৌভাগ্য আজও আমার হয়নি। পুরুষদেরও বদনাম হয়। ওগুলোকে অবশ্য বদনামের চেয়ে নাম বলেই আখ্যা দেওয়া হয়। যেমন, ‘ও ছেলে অনেক মেয়েকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরাচ্ছে। ও ছেলে অনেকগুলো মেয়ের সঙ্গে করছে। বউটউকে কেয়ার করে না। ওর কাজের মেয়েটার তো হেভি ফিগার, ডেইলি করে। ও ছেলে তো ভালো খসিয়ে নিতে পেরেছে। ও তো ভালো টানতে পারে। সকাল থেকে মদ শুরু করে, বাহ, রাঙ্গিরেও চালিয়ে নিয়ে যায়। গাঁজা ফাজা ওর কাছে কিচ্ছু না।’
ভাবা যায়, কোনও মেয়ে সম্পর্কে এমন মন্তব্য, এবং এসবের নাম ‘নাম’?
৬. আমার আবার দুরকমের বদনাম। প্রথম বদনাম হচ্ছে, আমি পুরুষবিদ্বেষী, পুরুষদের দুচোক্ষে দেখতে পারি না। আবার দ্বিতীয় বদনাম হচ্ছে, আমি নারীবিদ্বেষী, কোনও মেয়েকেই দুচোক্ষে দেখতে পারি না।
তৃতীয় বদনাম নিয়ে এখন আশংকা করছি। সেটি সম্ভবত হবে হিজড়েদের নিয়ে। আমি হিজড়ে বিদ্বেষী, হিজড়েদের দুচোক্ষে দেখতে পারি না।
বদনাম নিয়ে মাথা না ঘামাতে ঘামাতে ইদানীং লক্ষ করছি আমি নাম নিয়েও আর মাথা ঘামাচ্ছি না। এটি বোধহয় একদিক থেকে ভালোই হলো।
৭. ভারতের অনেক শহরে মেয়েদের মোটর সাইকেল চালাতে খুব দেখা যায়। কিন্তু কলকাতায় এর চল নেই। এ শহরে মোটর সাইকেল চালায় পুরুষেরা। চালকদের মাথায় হেলমেট শোভা পায়। চালকের সামনে পিছনে যদি পুরুষ-আরোহী থাকে, তাদের মাথায়ও হেলমেট থাকে। থাকে না শুধু মেয়েদের মাথায়। চালকের পেছনে দুপা জড়ো করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বসা মেয়েরা দিব্যি খোলা মাথায় খালি মাথায় চলছে। সামনে স্বামী-দেবতা বা প্রেমিক-দেবতা সর্বোপরি পুরুষ-দেবতা সুরক্ষিত। দুর্ঘটনা ঘটলে স্বামীটি বাঁচবে, আর মাথার সিঁদুর নিয়ে স্ত্রীটি সঙ্গে যাবে। নিজের মাথা কেটে পরের যাত্তা শুভ করতে বা নিজের জীবনটি বলি দিয়ে পরের জীবনটি বলিষ্ঠ করতে নারীর জুড়ি নেই।