১১. ভোরে ওঠা অভ্যাস

১১.

খুব ভোরেই উঠে পড়তে হল গগনকে। ভোরে ওঠা তার অভ্যাস, তার ওপর এখন প্রবল দুশ্চিন্তা চলছে।

বাথরুমের কাজ শেষ করে এসে যখন বাসি বিছানাটা নিজেই গোচ্ছাচ্ছে, তখন ছটকুর ঘর থেকে অ্যালার্ম বাজার শব্দ এল।

মিনিট পনেরোর মধ্যেই ছটকু ফিটফাট হয়ে এসে গগনের দরজায় টোকা মেরে ডাকে, গগ, উঠেছিস?

উঠেছি।

চল।

গগনের মন ভাল নেই। সকালে উঠে শরীর রক্ষার জন্য দৌড়ানো বা ব্যায়াম করার মতো মন এখন তার নয় তবু ছটকুর আগ্রহে যেতে হল।

বড়লোকি সব ব্যাপার। ছটকু তার ফিয়াট গাড়ি চালিয়ে ময়দানে এল। ঘড়িতে সোয়া চারটে। ভিকটোরিয়ার সামনে গাড়ি রেখে দুই বন্ধুতে ধীরলয়ে দীর্ঘ দৌড় শুরু করে। পাশাপাশি।

গগন টের পায়, ছটকু নেশাভাং যাই করুক এখনও ওর প্রচণ্ড দম। প্রায় মাইল দুই দৌড়ের পর বরং গগনের কিছু হাঁফ ধরেছে, কিন্তু ছটকু একদম ফিট:

বাড়িতে ফিরে ছটকু গগনকে নিয়ে গেল তার জিমনাশিয়ামে। ছোটর মধ্যে এত ভাল জিমনাশিয়াম গগন চোখেও দেখেনি। প্রত্যেকটা যন্ত্রপাতি ঝা-চকচকে নতুন আর দামি। বেশির ভাগই বিদেশ থেকে আনা।

ছটকু বলে, এ সব পড়েই থাকে বেশির ভাগ। আমি মাঝে মাঝে খেয়াল হলে ব্যায়াম করি।

দুজনে প্রায় পৌনে এক ঘণ্টা নীরবে নিখুঁত ব্যায়াম করে যায়। গগন নিজে প্রশিক্ষক, কাজেই ব্যায়ামের খুঁটিনাটি সব তার জানা। কিন্তু সেও অবাক হয়ে যায় ছটকুর নিখুঁত ব্যায়াম দেখে। কোথাও কোনও খাকতি নেই।

ব্যায়ামের পর দুজনেই গ্লাভস পরে কিছু সময় ঘুমোঘুসি করে। ছটকু খুবই ভাল লড়ে। ওর বাঁ হাতের ছোবল বিষে ভরা। গগন দুটো ভুতুড়ে ঘুসি খেয়ে গেল ছটকুর হাতে। বলল, তুই এখনও একটি বিন্দু আছিস। লড়া ছেড়ে দিলি কেন?

আরে দূর! লড়ে হবে কী?

 কিন্তু এখনও তোর ঘুসিতে অনেক ব্যাপার আছে।

ছটকু গ্লাভস খুলে ফেলে উদাস মুখে বলে, কী জানিস! আসলে আমার জীবনটা তো হ্যাপি নয়। চারদিকটার ওপর আমার আক্রোশ। ঘরে একটা কালো সাপ পুষছি। কেউ আমাকে বোঝে না, আমার প্রতি কারও সিমপ্যাথি নেই। সেই সব দুঃখে, রাগ, আক্রোশ সব আমার ঘুসিতে বেরোয়।

গগন বুঝতে পারে। ছটকুর জন্য তার একটু মায়াও হয়। বড়লোকেরাও দুনিয়াতে সুখে থাকে না তা হলে!

গগনের চিন্তা ভাত কাপড় নিয়ে। অস্তিত্ব বজায় রাখার চেষ্টায় তার দিন ক্ষয় হয় রোজ। সে লড়াই ছটকুর নেই। তবু ভগবান ওকেও তো সুখ দেননি।

এলাহি জলখাবারের আয়োজন টেবিলে সাজানো। বেশিরভাগই ইংলিশ খানা। হ্যাম অ্যান্ড এগ, পরিজ, টোস্ট, ফল। গগন মাছ-মাংস খায় না বলে তার জন্য অনেকখানি ছানা দেওয়া হয়েছে। আর বাদামের শরবত।

গগন খুব বেশি খায় না। পেট ভার করে খাওয়া তার ভীষণ অপছন্দ। ছটকুও বেশি খেল না। সাজানো খাবারের অধিকাংশই পড়ে রইল।

ছটকু তার পাইপ ধরিয়ে বলে, তুই তো জুড়ো শিখছিলি, না?

 হ্যাঁ।

আমিও শিখেছিলাম লন্ডনে।

জানি।

 জুডো শেখার সময় যে শপথ করানো হয়, তা মনে আছে গগ?

আছে।

ছটকু হেসে বলে, নিতান্ত আত্মরক্ষার খাতিরে ছাড়া কাউকে আঘাত করা যাবে না।

জানি।

আমার সে নিয়মটা প্রায়ই ভাঙতে ইচ্ছে করে। বুঝলি! আজকাল মাঝে মাঝে আমার মাথা ভিসুভিয়াস হয়ে যায়।

গগন ব্যাপারটা বুঝল না। চুপ করে রইল।

 সামু খাবার টেবিল পরিষ্কার করছে। আর একজন উর্দি পরা লোক কফির ট্রে নিয়ে এল।

গগন কফি বা চা খায় না। ছটকু কালো কফি ঢেলে নিয়ে চুমুক দিয়ে বলে, কাল রাতে আই হ্যাড অ্যানাদার এনকাউন্টার উইথ হার।

গগন চোখ নামিয়ে নেয়। ছটকু এবং তার বউয়ের প্রসঙ্গটা বড় অপ্রীতিকর বলে তার মনে হয়। সে লক্ষ করেছেসকালে জলখাবারের টেবিলে ছটকুর বউ লীনা আসেনি। কিন্তু ভদ্রতায় বলে, আসা উচিত ছিল। তবে গগন নিজেকে খুব সামান্য মানুষ বলে মনে করে, তাই তার প্রতি কেউ তেমন সৌজন্য না দেখালেও সে কিছু মনে করে না।

কিন্তু ছটকুর বোধহয় ব্যাপারটা ভাল লাগছে না। কফি আর পাইপে কিছুক্ষণ ডুবে থেকে সে হঠাৎ বলল, দুনিয়ার কাউকেই ও মানুষ বলে মনে করে না। কাল রাতে আই হ্যাড টু বিট হার।

গগন ব্যথিত হয়ে মুখ তোলে। বলে, সে কী রে! মারলি?

মারতে হল। প্রতিজ্ঞা রাখতে পারিনি। আই অ্যাম এ ফলেন গায়।

গগন অস্বস্তির সঙ্গে বলে, আফটার অল মেয়েমানুষ তো!

তুই মেয়েমানুষ চিনিস না গগ। চিনলে অত দয়া হত না তার। মেয়েমানুষকে যারা অবলা বলে তারা অনভিজ্ঞ। ওদের মতো এত নিষ্ঠুর আর নেই।

গগন রাত্রিবেলা কোনও সাড়াশব্দ পায়নি। তার ঘুম খুব চটকা। তার ওপর গতকাল সে ভাল ঘুমোয়নি। তবে কি ছটকুর ঘরটাও সাউন্ড-প্রুফ করা? কিন্তু তা হলে সকালে অ্যালার্মের আওয়াজ এল কী করে?

ছটকু অন্যমনস্কতার সঙ্গে বলল, কিন্তু মেরেও লাভ হয় না। লীনা যেমন-কে-তেমনই থেকে যায়। তেমনি কোন্ড-রাডেড, জুয়েল, সেলফিশ, অ্যামবিশাস।

সামু সবই শুনছে। গগনের লজ্জা করছিল।

ছটকু হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে বলল, চল। অন্য কিছু নিয়ে মাথা ঘামানো ছাড়া এখন আমার আর পথ নেই।

ছটকুর ফিয়াট গাড়িটা যখন প্রকাশ্য দিনের আলোয় পাড়ায় ঢুকছে তখন গগনের বুকটা একটু বেশি ধকধক করছিল। গলা শুকিয়ে গেছে।

ছটকু গগনের গ্যারাজ-ঘরের সামনেই গাড়িটা দাঁড় করাল। স্টিয়ারিঙে হাত রেখে গগনের দিকে ফিরে একটু হেসে বলল, দ্যাখ গগ, তুই আর আমি একসঙ্গে বিশটা লোকের মহড়া নিতে পারি। সুতরাং ঘাবড়াবি না। আমার মনে হয় না কেউ তোকে খামোখা ধরপাকড় করতে আসবে।

গগন গলাটা ঝেড়ে নিয়ে বলল, তা নয়। তবে আমার লজ্জা করছে। তুই এখানে এলি কেন?

এখান থেকেই কাজ শুরু করব বলে।

 বেরোবার আগে ছটকু অনেকক্ষণ টেলিফোনে যাদবপুর থানার অফিসার-ইন-চার্জের সঙ্গে কথা বলেছে। নিজেদের প্রতিষ্ঠার জোরে ছটকু থানা-পুলিশের খাতির পায়। সকলের সঙ্গেই তার ভাল ভাবসাব।

টেলিফোনে কী কথা হয়েছে তা গগন শোনেনি। কথা বলার পর ছটকু তাকে সংক্ষেপে জানিয়েছে, যাদবপুর থানা থেকে যেটুকু জানবার জেনে গেছি। এখন তোর কোনও ভয় নেই।

গগনের তবু ভয় যায় না।

বেলা বেশি হয়নি। দশটা বোধহয়। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড রোদ চার দিক পোড়াচ্ছে। ছোট গাড়িটা এর মধ্যেই তেতে ভ্যাপসা হয়ে গেছে।

গগনকে একটা রোদ-চশমা ধার দিয়েছে ছটকু। নিজেও একটা পরেছে। ছদ্মবেশ খুবই সামান্য। তবু হয়তো লোকের চোখ থেকে কিছুটা আড়াল করা যাবে নিজেকে।

নরেশের বাড়ির ওপরতলা থেকে শোভার প্রচণ্ড গলার শব্দ আসছে। বোধহয় সে নরেশেরই শ্রাদ্ধ করছিল, মায়ের পেটের বোন না হাতি! ঢ্যামনা কোথাকার! কার কুমে তুমি ওকে কোলে করে এনে এ বাড়িতে তুলেছ? বাড়ি আমার নামে।

জবাবে একজন পুরুষ বোধহয় কিছু বলল।

 শোভার গলা তুঙ্গে উঠে যায়, বেশ করেছি তাকে এখান থেকে সরিয়ে দিয়েছি। একশোবার দেব। নির্দোষ লোকের নামে খুনের নালিশ করেছ, তোমার নরক হবে না!..হা হা, তার সঙ্গে আমার ভাব আছে তো আছে…তোমার ভাব নেই কারও সঙ্গে? ঢলানি মাগিটার সঙ্গে তো লোককে দেখিয়েই শোয়াবসা করো।

গাড়িটা লক করতে করতে ছটকু মৃদু হেসে চাপা গলায় বলল, অ্যানাদার লীনা।

 দু-চারজন লোক তাদের লক্ষ করছিল। আশপাশের জানলা দিয়ে প্রচুর উঁকিঝুঁকিও টের পায় গগন।

ছটকুর তাড়াহুড়ো নেই। ধীরেসুস্থে সে চার দিকে তাকিয়ে দেখো পাইপ ধরায়। তারপর বলে, চল।

কোথায়?

নরেশের ঘরে। বেগমকে একটু ক্রস করা দরকার।

বেগম? সে এখানে থাকে না। গগন বলে।

এখন আছে, চল।

 গগনের বুক অসম্ভব কেঁপে ওঠে। পিছোনোর উপায় নেই। তবু বলল, তুই যা, আমি অপেক্ষা করি।

ছটকু ভ্রু কুঁচকে বলে, তাতে লাভ হবে না। বেগমের সামনে তোর প্রেজেন্স খুব দরকার। নইলে ও শকড হবে না। বেগমের লেখা সেই চিরকুটটা কি হারিয়ে ফেলেছিস?

গগন মনে করতে পারল না। বলল, কোথায় রেখেছি কে জানে।

কাঁধ বাঁকিয়ে ছটকু বলল, এমন কিছু এসেনশিয়াল নয়। তুই পিছনে আয়, আমি আগে উঠছি।

দোতলায় নরেশের বৈঠকখানার দরজা খোলাই রয়েছে। ভিতরের কোনও ঘর থেকে শোভার গলা আসছে, সবাইকে বলব ফলির আসল বাপ তুমি। ওই নষ্ট মেয়েটার সঙ্গে তোমার শোয়াবসা।

ছটকু খুব হাসছে শুনে।

দুবার কলিংবেল বাজানো সত্ত্বেও কেউ এল না। তিনবারের বার ঝি এসে খোটকা মুখ করে কর্কশ গলায় জিজ্ঞেস করল, কী চাইছ?

ছটকু রোদ-চশমাটা এতক্ষণ খোলেনি। এবার খুলল। মুখটা ভয়ংকর গম্ভীর। চোখে ভীষণ ভ্রূকুটি। ছটকুর চোখ খুবই মারাত্মক। যখন রেগে যায় তখন তার দিকে তাকাতে হলে শক্ত কলজে চাই।

ঠান্ডা গলাতেই ছটকু নির্দ্বিধায় বলল, তোমার বাপকে চাইছি।

ঝিটা কেমনধারা হয়ে গেল। চোখেমুখে, স্পষ্টই ভয়। কথা বলল না, কিন্তু শুকনো মুখে চেয়ে রইল।

ছটকু প্রচণ্ড একটা ধমক দিয়ে বলল, যাও, গিয়ে নরেশবাবুকে ডেকে দাও।

ঝি চলে গেল। ছটকু নিঃসংকোচে বৈঠকখানায় ঢুকে একটা কৌচে গা এলিয়ে বসে গগনকে ডাকল, আয় গগ।

গগন খুবসংকোচের সঙ্গে ঢুকল, যেন বাঘের ডেরায় ঢুকছে। গরমে এমনিতেই তার ঘাম হচ্ছিল। এখন হঠাৎ তার সারা গায়ে ফোয়ারার মতো ঘামের স্রোত নামছে। পোশাক ভিজে যাচ্ছে, চোখে জিভে নোনতা জল ঢুকছে।

অনেকক্ষণ বাদে নরেশ এল। ভিতরে শোভার চেঁচামেচি একটু থেমেছে। গলার স্বর শোনা যাচ্ছে এখনও, তবে বকবকানির।

নরেশের পরনের লুঙ্গিটা উঁচু করে কোমরে গোঁজা। হাঁটু পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। খালি গা, চোখ লাল, চুল উসকোখুসকো, যেন এইমাত্র শ্মশান থেকে ফিরেছে।

ঘরে ঢুকেই নরেশ আচমকা যেন বিদ্যুতের শক খেয়ে লাফিয়ে উঠল। বিস্ময়ে বোবা। চোখ পটপটাং করে খুলে অবিশ্বাসে তাকিয়ে আছে।

ছটকু উঠে নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে বিনা ভূমিকায় নরেশের বাঁ হাতের কনুইয়ের ওপরটা লোহার হাতে চেপে ধরে বলল, আপনার সঙ্গে জরুরি কথা আছে। বসুন।

ছটকুর কণ্ঠস্বরে কিছু ভদ্রতা থাকলেও আচরণে নেই। সে নরেশকে ধীরে টেনে এনে একটা সোফায় বসিয়ে দিল।

নরেশ ঝেঁঝে উঠে বলল, হাত ধরছেন কেন?

 ছটকু হেসে বলে, লাগল বুঝি?

 নরেশ সে কথার জবাব না দিয়ে ছটকুর হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বলল, এ সব কী ব্যাপার?

প্রশ্নটা গগনকে করা। নরেশ ছটকুকে চেনে না।

 গগন জবাব দেয় না।

ছটকু কৌচে এলিয়ে বসে পাইপ টানতে টানতে বলে, নরেশবাবু, গগনকে অ্যারেস্ট করতে আপনি পুলিশ ডেকেছিলেন?

নরেশ হঠাৎ বিকট গলায় চেঁচিয়ে ওঠে, একশোবার ডাকব, শালার শুভার দল! ভেবেছ কী তোমরা? বাড়িতে ঢুকে গায়ের জোর দেখানো হচ্ছে? আঁ?

বলতে বলতে আচমকাই নরেশ বে-হেড হয়ে লাফিয়ে উঠে একটা জয়পুরি ফুলদানি তুলে তেড়ে এল গগনের দিকে, গুন্ডামির আর জায়গা পাওনি?

ছটকু হাত বাড়িয়ে নরেশের হাত টেনে ধরল এবং নিছক একটি ঝাঁকুনিতে তাকে নিস্তেজ করে আবার সোফায় বসিয়ে দিয়ে ঠান্ডা গলায় বলল, মেইনলি আমরা বেগমের সঙ্গে কথা বলতে এসেছি, আপনার সঙ্গে নয়। তবে আপনাকেও দু-একটা জরুরি কথা বলা দরকার। সেটা পরেও হতে পারবে। এখন বেগমকে ডেকে দিন।

নরেশ যেন কিছুই বিশ্বাস করতে পারছে না। ভয়ংকর রাগী চোখে সে ছটকুকে দেখল, তারপর বলল, বেগমের সঙ্গে দেখা হবে না, আপনারা বেরিয়ে যান।

ছটকু পায়ের ওপর পা তুলে বসে বলে, বেয়াদপির সময় এটা নয়। গগন আমার বন্ধু। তাকে আপনি না-হক হ্যারাস করেছেন, পেছনে পুলিশ লাগিয়েছেন। আমি আপনার সঙ্গে রসের কথা বলতে আসিনি। বেশি তাঁদড়ামি করলে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে যাব মেরে।

ছটকুর এই গলার স্বর গগনও চেনে না। খুবই ঠান্ডা গলা, কিন্তু তাতে ইস্পাতের মিশেল। যে শোনে সে জানে ছটকু প্রত্যেকটা কথাই মেপে বলছে। একটুও ভয় দেখাচ্ছে না। কিন্তু যা বলছে তা-ই করবো।

নরেশ এবার চোখ নামিয়ে বলল, বেগম ঘুমোচ্ছে।

 ছটকু কিছু অধৈর্যের সঙ্গে বলল, তাকে তুলে দিন।

সে অসুস্থ। তার ছেলে মারা গেছে।

 সেটা আমরা জানি। তার সঙ্গে কথা বলতেই হবে। ভিতরের দরজার পরদা সরিয়ে হঠাৎ শোভা ভিতরে আসে। তার চেহারাটা বড় কিম্ভুত দেখাচ্ছে। চুলগুলো পাগলির মতো উড়োখুড়ো, মুখ ফুলে রাবণের মা, চোখে অস্বাভাবিক দীপ্তি।

গগনের দিকে চেয়ে বলল, আবার এসেছেন? ভাল চান তো পালান। নইলে ওই বদমাশ আপনাকে ফাঁসিতে ঝোলাবে। জানেন না তো, ওর এখন পুত্রশোক।

নরেশ উঠে শোভার দিকে তেড়ে যায়। গগন আটকানোর জন্য উঠতে যাচ্ছিল। ছটকু হাত বাড়িয়ে ইশারা করায় থেমে গেল।

নরেশ তেড়ে গিয়ে শোভাকে মারল না বটে, কিন্তু জাপটে ধরে হিঁচড়ে ভিতরে নিয়ে গেল। দরজাটা সপাটে বন্ধ হয়ে ছিটকিনি পড়ল ভিতর থেকে।

গগন অস্বস্তির সঙ্গে বলে, ছটকু চল।

 ছটকু না-নড়ে বলে, দাঁড়া।

খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। অল্প বাদেই অন্য একটা দরজার পরদার আড়ালে একটা ফোঁপানির শব্দ উঠল, হিক্কা তোলার আওয়াজ। তীব্র হতাশার গলায় কোনও মহিলা বলে উঠলেন, সব গেল রে….

ঠিক তারপরেই পরদা সরিয়ে খানিকটা টলমলে পায়ে বেগম ঘরে ঢোকে। খুবই করুণ তার চেহারা। সুন্দরী বেগমকে কে যেন চোখের জল আর শোকের শুষ্কতা দিয়ে চটকে মেরেছে। সব রূপটুকু ধুয়ে তার চেহারায় বয়সের ভাটা ফুটে উঠেছে এখন।

বেগম তার দুখানা বিভ্রান্ত চোখে গগনকে চেয়ে দেখল। যেন অনেক কষ্টে চিনতে পেরে কল, আমার ফলি কোথায় গেল?

ছটকু খুব নরম গলায় বলে, আপনি বসুন।

গভীর দীর্ঘশ্বাসে কেঁপে-যাওয়া গলায় বেগম বলে ওঠে, হা ভগবান!

তারপর নিজের অজান্তেই বুঝি সোফায় বসে পড়ে বেগম। চোখ বুজে থাকে। চোখের পাতা ভিজিয়ে জলের ধারা নেমে আসে অঝোরে। দাতে দাঁত চেপে থাকে বেগম, শুধু থরথর করে তার রক্তহীন সাদা ঠোঁট কেঁপে কেঁপে ওঠে।

ছটকু বলে, ফলির মৃত্যুতে গগনের কোনও হাত ছিল না, বিশ্বাস করুন।

বেগম তার রক্তবর্ণ চোখে চাইল। প্রথমে কিছু বলল না। সামলাতে সময় নিল।

 কিন্তু সামলে নিলেও সে। আঁচলে চোখ মুছল। অনেকক্ষণ শূন্য চোখে চেয়ে থেকে বলল, সেদিন..কবে যেন?

গগন বলল, পরশু।

বেগম গগনের দিকে স্থির চোখে চায়। তারপর একটু শিউরে উঠে বলে, সেদিন ফলি সন্ধের পর আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। ওর ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছিল। বলল, গগনদা আমাকে মেরেছে। আপনি কি ওকে সত্যিই মেরেছিলেন?

গগন চোখ নামিয়ে নিয়ে বলে, হ্যাঁ। নইলে ও আমাকে মারত। ওর হাতে পিস্তল ছিল।

বেগম ঝুম হয়ে কিছুক্ষণ বসে থেকে বলে, জানি। ওর কাছে পিস্তল থাকত। ইদানীং ও খুব বিপদের জীবন কাটাত। আমি ওকে মানুষ করতে পারিনি, সে পাপের শাস্তি পেলাম গগবাবু।

ছটকু নরম স্বরে বলে, কিন্তু ফলির মৃত্যুর পেছনকার ঘটনাটা আমাদের দরকার।

বেগম মাথা নাড়ে, বুঝেছে।

মুখটা নামিয়ে নিয়ে বলে, ফলি গগনবাবুকে মারবার জন্য প্ল্যান করেছিল। মারা মানে খুন নয়। উলটে ও নিজেই মার খায়। সন্ধেবেলা যখন আমার কাছে এল তখন ভীষণ ফুঁসছে, ও রকম রেগে যেতে ওকে আর কখনও দেখিনি।

ছটকু হঠাৎ বলে ওঠে, আপনার সঙ্গে ঝগড়া করেনি সেদিন?

বেগম মুখটা নামিয়ে রেখেই বলল, হ্যাঁ। শুধু ঝগড়া নয়, আমাকেও ও মারে।

 গগন অবাক হয়ে বলে, মেরেছে?

আমার ওপর ওর ভয়ংকর রাগ ছিল। যতটা ভালবাসত ততটাই ঘেন্না করত আমাকে। আমার সম্পর্কে ওর কানে কে যেন কিছু খারাপ গালগল্প বলে বিষ ঢেলেছে, সেই দিন ও আমার জবাবদিহি চায়, আমি ওকে যত শান্ত করতে চাই, ও তত রেগে ওঠে। অবশেষে আমার চুলের মুঠি চেপে ধরে দেয়ালে মাথা ঠুকে দেয়, চড়-চাপড় মারে, গালাগাল করতে থাকে। হয়তো আরও মারত, পাড়ার লোক এসে ঠেকায়। তখন ও কার ওপর যেন শোধ নেবে বলে শাসিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। আমি তখন এত দিশেহারা যে ওকে আটকাতে পারিনি। পারলে–

ছটকু জিজ্ঞেস করে, ঝগড়া ছাড়া আপনাদের মধ্যে আর কোনও কথাবার্তা হয়নি?

না। সেদিন গগনবাবুর কাছে মার খেয়ে ফলি রাগে বেহেড হয়ে যায়। কেবল গগনবাবুর নামই করছিল। সেই থেকেই আমার সন্দেহ হতে থাকে

ছটকু মাথা নেড়ে বলে, ভুল সন্দেহ বেগম দেবী।

বেগম ছটকুর দিকে স্থির-চোখে চেয়ে থাকে। দৃষ্টি স্বাভাবিক নয়। অনেকক্ষণ চেয়ে থেকে বলে, তা হলে ফলিকে কে মেরেছে?

সেটা অনুমানের ব্যাপার।

ছটকু গম্ভীর মুখে বলে। তারপর পাইপ ধরায়।

অনুমানটা কী?

তার আগে বলুন এ পাড়ায় ফলি আর কার কার কাছে যেত?

আমি তা জানি না। আমার সঙ্গে তার বড় একটা দেখা হত না। তবে শুনেছি আমার জামাইবাবুর কাছ থেকে সে মাঝে মাঝে ধার করে টাকা নিত। কিন্তু বাড়িতে আসত না। গদিতে গিয়ে দেখা করত।

আর কেউ?

 বেগম ভ্রু কুঁচকে একটু ভাবে। তারপর বলে, না, আর কারও নাম কখনও বলেনি।

আচমকা ছটকু প্রশ্ন করে, আপনার স্বামী কোথায়? তিনি আসেননি?

 বেগম অবাক হয়ে বলে, স্বামী? তিনি তো কাজে…মানে বাইরে গেছেন।

 তিনি ফলির মৃত্যু-সংবাদ জানেন?

শুনেছেন।

 বাইরে কোথায় গেছেন?

বলে যাননি।

তার কলেজের ঠিকানাটা দিতে পারেন?

বেগম একটু গম্ভীর মুখে মেঝের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, তাঁকে এর মধ্যে না জড়ানোই ভাল। ওর শরীর খারাপ, তার ওপর এই ঘটনা।

ছটকু উঠে পড়ে। বলে, আপনার এই শোকে কিছু বলার নেই। শুধু অনুরোধ, গগনকে খামোকা ঝামেলায় জড়াবেন না। গগন ফলিকে মেরেছিল বটে, কিন্তু সে আত্মরক্ষার জন্য। ও খুনে নয়।

গেম একবার গগনের দিকে তাকাল। কবে সেই ভালবাসা মরে গেছে। এখন আছে শুধু কিছু সন্দেহ আর আক্রোশ।

তবু গগন বেগমের চোখে চোখ রেখে কিছু খুঁজল কি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *