ভোরের স্বদেশ পত্রিকার শুক্রবারের সাহিত্য পাতায় নদ্দিউ নতিমের মৃত্যুচিন্তা বিষয়ক প্রবন্ধটা ছাপা হয়েছে। মতিনের হাতে পত্রিকা। সকাল দশটা। তার ঘুম এখনো পুরোপুরি ভাঙে নি। সাপ্তাহিক ছুটির দিলে সে ঠিক করেই রাখে ঘুম ভাঙুক কি না-ভাঙুক দুপুর বারোটার আগে সে বিছানা থেকে নামবে না। চায়ের তৃষ্ণা পেলে আধশোয়া হয়ে চা খাবে। মেসের বাবুর্চি চুন্ন মিয়া তাকে চা দিয়ে যায়। চায়ের জন্যে মতিনকে টাকা-পয়সা দিতে হয় না। বিনিময়ে মতিনকে চুন্ন। মিয়ার চিঠিপত্র লিখে দিতে হয়। দেশে টাকা পাঠানোর মানি অর্ডার লিখে দিতে হয়। চুন্ন মিয়া ব্যাংকে একটি ডিপোজিট পেনসন স্কিম খুলেছে। তার কাগজপত্র লেখালেখির ব্যাপারও আছে।
মতিনের দ্বিতীয় দফা চা খাওয়া হয়ে গেছে। চুন্ন মিয়া যে ফ্লাক্স রেখে গেছে। সেখানে আরো এক কাপ চা আছে। শেষ কাপ চা মতিন খেয়ে ফেলবে কি-না এই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। মৃত্যুচিন্তা বিষয়ক প্রবন্ধের সঙ্গে ভোরের চা যায় না। মতিন পড়তে শুরু করল। প্রবন্ধের শুরুটা বেশ নাটকীয়।
তখন গ্রীষ্মকাল। রৌদ্রোজ্জ্বল উজবেক আকাশ। মধ্যগগনের কঠিন সূর্য তার উত্তাপ পূর্ণ শক্তিতে ছড়িয়ে দিচ্ছে। মেঘশূন্য নীল আকাশ সূর্যের কটাক্ষে পিঙ্গল বর্ণ ধারণ করেছে। গ্রীষ্মের তাপদাহে ধরণী ক্লান্ত ও তৃষ্ণার্ত।
সেই প্রবল উত্তাপে ঘর্মাক্ত একটি শিশুকে দেখা যাচ্ছে। জলাশয়ের দিকে যেতে। শিশুর খালি গা। পরনে হলুদ রঙের হাফপ্যান্ট। জলাশয়ের শান্ত নিস্তরঙ্গ জলে শিশুটি তার প্রতিবিম্ব দেখতে চায়। সেই শিশুটির নাম তিম। ঘটনার চল্লিশ বছর পর শিশুটি সারা বিশ্বে পরিচিতি পায় নদ্দিউ নতিম নামে। শৈশবে শিশুটির জলাধারে নিজের ছায়া দেখতে চাওয়ার আকাঙ্ক্ষা অনেক অনেক পরে ভাষা পেয়েছিল তার কবিতায়।
জলে কার ছায়া পড়ে
কার ছায়া জলে
সেই ছায়া ঘুরে ফিরে
কার কথা বলে?
কে ছিল সেই শিশু
কী তাহার নাম?
কেন সে ছায়ারে তার
করিছে প্রণাম।
তিম নামের শিশুটি জলে নিজের ছায়া দেখে কী কারণে জানি চমকালো। সেই চমকে তার পায়ের নিচের মৃত্তিকা এলোমেলো হলো। শিশুটি পড়ে গেল পানিতে। মুহূর্তে বিপুল জলরাশি ঘিরে ধরল তাকে। সে ডুবে যাচ্ছে, ডুবে যাচ্ছে। তলিয়ে যাচ্ছে হিমশীতল গহীনে। তখন কেউ যেন তার নাম ধরে ডাকল। দূরাগত শঙ্খধ্বনির মতো সেই ডাক–তিম, তুমি কোথায়? তুমি কোথায়?
মে আই কাম ইন?
হাত থেকে পত্রিকা নামিয়ে মতিন তাকাল দরজার দিকে। দরজার ওপাশে সালেহ ইমরান দাঁড়িয়ে আছেন। তার সঙ্গে কমল। সে তাকিয়ে আছে মেঝের দিকে। তার হাত-পা নড়ছে না। সে শক্ত হয়ে আছে। সে যেন কাঠের কোনো মূর্তি। মূর্তির মাথাভর্তি রেশমি চুলি। বাতাসে সেই চুলগুলি শুধু উড়ছে। মতিন বিছানা থেকে নামতে নামতে বলল, আসুন আসুন।
মতিনের খালি গা। সে অতি দ্রুত সার্ট গায়ে দিল। সার্টের বোতাম জায়গামতো বসল না। সার্টের একটা দিক বড়, একটা দিক ছোট হয়ে ঝুলবুল। করতে লাগল।
সালেহ ইমরান বললেন, আমি আমার ছেলেকে নিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।
মতিন বলল, জি জি।
খবর না দিয়ে চলে এসেছি, সরি। তোমার তো মনে হয় হাত-মুখ ধোয়া হয় নি। আমরা বসছি, তুমি হাত-মুখ ধুয়ে আসো। টেক ইউর টাইম।
মতিন কমলের দিকে তাকিয়ে বলল, কেমন আছ কমল?
কমল জবাব দিল না। সে তাকিয়ে আছে বন্ধ জানালার দিকে জানালার পাল্লায় দুটি টিকটিকি। টিকটিকি দুটি একই সঙ্গে একটু এগুচ্ছে আবার পিছিয়ে আসছে। কমল ওদের কর্মকাণ্ড দেখছে।
সালেহ ইমরান বললেন, কমলের কী না-কি একটা সিক্রেট আছে, সে তোমার সঙ্গে শেয়ার করবে।
মতিন সঙ্গে সঙ্গে বলল, অবশ্যই। অবশ্যই। আমাকে সামান্য কিছু সময় দিন। সময় কিছু বেশিও লাগতে পারে। আমাদের একটা মাত্র টয়লেট। সেটা
একতলায়। ছুটির দিনে টয়লেট খালি পাওয়াই সমস্যা।
ইউ টেক ইউর টাইম।
মতিন চলে গেছে। কমলের দৃষ্টি এখনো টিকটিকির দিকে। সালেহ ইমরান বললেন, আমি আমার প্রমিজ রক্ষা করেছি, আমাকে ধন্যবাদ দেবে না?
কমল বলল, ধন্যবাদ।
সালেহ ইমরান বললেন, কী দেখছ? টিকটিকি?
হুঁ। বাবা, ওদের কি কোনো নাম আছে?
ওদের একটাই নাম–টিকটিকি।
ছেলে-মেয়ে, বাবা-মা, ভাই-বোন সবারই এক নাম? টিকটিকি?
কমল শোন, মাঝে মাঝে তুমি নিতান্তই ছেলেমানুষদের মতো কথা বলো। কখনো কখনো তোমার কথা শুনে মনে হয়, তুমি বয়স্ক জ্ঞানবৃদ্ধ। আবার কখনো মনে হয় তিন-চার বছর বয়েসী শিশু। এই বয়সের শিশুও কিন্তু জানে যে টিকটিকিদের আলাদা নাম হয় না।
সেটা আমিও জানি।
তাহলে জিজ্ঞেস করছ কেন?
ওদের আলাদা নাম নেই এটা অন্যায়, এইজন্যে জিজ্ঞেস করছি। বাবা। শোন, আমি যখন আমার সিক্রেট বলব তুমি তখন আমার সামনে থাকবে না।
ঠিক আছে থাকব না।
মতিন ঘরে ঢুকল চা বিসকিট নিয়ে। সালেহ ইমরান কোনোরকম আপত্তি ছাড়াই চায়ের কাপ হাতে নিলেন। মতিন তার দিকে সিগারেটের প্যাকেট এগিয়ে দিল। তিনি সিগারেট নিলেন। কমল মতিনের দিকে একঝলক তাকিয়েই চোখ নামিয়ে অস্পষ্ট গলায় বলল, তোমার ঘরের জানালায় যে দুটি টিকটিকি এদের কি কোনো নাম আছে?
মতিন বলল, অবশ্যই আছে। বড় যেটা দেখছ ওটা মেয়ে। মেয়েটার নাম ঘুতনি। আর রোগাটা ছেলে। ছেলেটার নাম ঘুতনা।
ওদের কোনো ছেলেমেয়ে নেই?
না।
ছেলেমেয়ে হলে ওদের কী নাম রাখবে?
ছেলে হলে নাম রাখব ছে-ঘুতনা। মেয়ে হলে মে-ঘুতনি। ওদের যখন ছেলেমেয়ে হবে, ছে-ঘুতনার ছেলে হলে তার নাম হবে ছেছে-ঘুতনা। মেয়ে হলে মেমে-ঘুতনি।
তোমার নাম দেয়া ভুল হয়েছে। ঘুতনা-ঘুতনির ছেলে হলে তার নাম দেয়া উচিত ছেঘুতানাঘুতনি।
সালেহ ইমরান চায়ের কাপ নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, এই আলোচনা বন্ধ থাকক। মতিন শোন, আমি ঘণ্টাখানিকের জন্যে কমলকে তোমার কাছে রেখে যাচ্ছি। একটা গাড়িও থাকল। কমলের কথা শেষ হলে তাকে তুমি একটু কষ্ট করে বাড়িতে পৌঁছে দেবে। পারবে না?
মতিন বলল, পারব, তবে আপনি সময় বেঁধে দেবেন না। সে যতক্ষণ থাকতে চায় থাকুক। যখন সে চলে যেতে চাইবে আমি তাকে দিয়ে আসব। আমি যতদূর জানি সেভাবে করে আপনারা তাকে কখনো বাইরে নেন না। সে বাইরের লোকজন দেখুক। হৈচৈ শুনুক। এটা তার জন্যে ভালো হবে।
সালেহ ইমরান বললেন, কমলের মতো বাচ্চাদের নিয়ে Experiment করার যোগ্যতা কি তোমার আছে?
মতিন বলল, আমি Experiment করছি না। আমি তাকে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে চাচ্ছি।
সালেহ ইমরান বললেন, এই পরিচয় সে নিতে পারবে না।
মতিন বলল, আমি যেই মুহূর্তে দেখব সে নিতে পারছে না, আমি তাকে আপনার কাছে ফেরত দেব।
সালেহ ইমরান উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বললেন, ও.কে। থ্যাংক ব্যু ফর অ্যাভরিথিং।
মতিন বলল, কমল, দাঁড়িয়ে আছ কেন? বসো।
কমল বলল, কে চিৎকার করছে?
আমাদের মেসবাড়ির পেছনেই বস্তি। বস্তির লোকজন চিৎকার করছে।
কেন চিৎকার করছে?
কোনো একটা বিষয় নিয়ে ঝগড়া করছে।
বিষয়টা কী?
বিষয়টা কী আমি জানি না।
চিৎকার শুনতে আমার ভালো লাগে না।
চিৎকার শুনতে কারোই ভালো লাগে না। চল বের হয়ে পড়ি। বের হয়ে পড়লে আর চিৎকার শুনতে হবে না।
না।
না কেন?
আগে আমাকে একটা কাগজ কলম দাও।
কী করবে?
আমি ঘোতনা ঘুতনিদের ছেলেমেয়েদের নাম ঠিক করব। অঙ্ক দিয়ে নাম।
অঙ্ক দিয়ে আমি মানে?
ঘোতনার সিম্বল হলো 1, ঘুতনি ০, 1 হলো male আর 0 Female. ওদের যদি ছেলে হয় তার সিম্বল হবে 1 (10)। 1 হলো male-এর সিম্বল, আর 10 হলো বাবা-মার সিম্বল। বুঝতে পেরেছ?
মতিন বলল, Rice water-এর মতো পরিষ্কার।
কমল বলল, Rice water কী?
মতিন বলল, Rice water হলো পান্তাভাত। খুব সহজ বিষয়কে আমরা বলি পান্তাভাত কিংবা ডালভাতের মতো সোজা।
আমাকে কাগজ-কলম দাও।
মতিন কাগজ-কলম দিল। কমল অতি দ্রুত লিখছে। তার চোখে-মুখে আনন্দ। মতিন একবার উঁকি দিল। তার মাথা চক্কর দিয়ে উঠল।
ঘোতনা = 1 ঘুতনি = 0
- 1
- 1(10)
- 1{1(10)0(10)}
- 1[1{1(10)0(10)}0{1(10)0(10)}]
- 1{1(10)0(10)}
- 1(10)
Male = 1 Female = 0
- 0
- 0(10)
- 0{1 (10)0(10)}
- 0[1{1(10)0(10)}0{1(10)0(10)}]
- 0{1 (10)0(10)}
- 0(10)
মতিন বলল, তুমি তো বিরাট অঙ্ক ফেঁদে বসেছ।
কমল বলল, আমার আরো কাগজ লাগবে।
মতিন বলল, কাগজের সমস্যা নেই। ড্রয়ারভর্তি কাগজ। তুমি করছটা কী? 0101 এইসব কী?
নাম। তোমাকে বুঝিয়ে দেব?
কোনো দরকার নাই, অঙ্ক বুঝতে চাই না। স্কুলে যে স্যার আমাদের অঙ্ক পড়াতেন তার নাম গজনবী। তাঁকে সবাই ডাকত নেত্রকোনার যাদব। নেত্রকোনার যাদব স্যার বলতেন, একটা গরু যে অঙ্ক জানে আমি তাও জানি না। তুমি কি যাদব বাবুর নাম শুনেছ? বিরাট অঙ্কবিদ ছিলেন।
নাম শুনি নি।
সে-কী! তুমি এমন অঙ্কওয়ালা ছেলে, তুমি দি গ্রেট যাদববাবুর নাম শোন নি? তিনি এই দেশের মানুষ।
আমি রামানুজনের নাম শুনেছি।
তিনি আবার কে?
তিনি অঙ্ক জানতেন। He was born on 22nd December, 1887.
ও আচ্ছা। পুরনো লোক।
তিনি অনেকগুলি সিরিজ বের করেছিলেন। এর মধ্যে একটার যোগফল 2/π।
বাহ ভালো তো!
সিরিজটা লিখব?
লিখতে পার। তবে কিছু লাভ হবে না। বুঝব না।
সিরিজটা দেখলে তোমার ভালো লাগবে। আলাদা একটা কাগজে লিখি?
লেখ।
কমল দ্রুত লিখল–
1-5(1/2)^3+9(1.3/2.4)^3-13(1.3.5/2.4.6)^3+… =2/π
মতিন বলল, খুবই ভালো লাগল। এইসব কি তোমার মুখস্থ না-কি?
কমল বলল, সিরিজ মুখস্থ করতে হয় না। মনে থাকে।
মতিন বলল, মানসঙ্কের নাম শুনেছ?
না।
আমাদের দেশে একসময় মানসঙ্ক বলে একধরনের অঙ্ক ছিল। মনে মনে করতে হতো। মানসঙ্কের নানান সূত্র ছিল। সূত্র মুখস্থ রাখতে হতো।
কমল আগ্রহ নিয়ে বলল, একটা বলো!
এক এক এগারো মাথে
একশত সাঁইত্রিশ দিয়া তাথে
কি করি পায়ে নাথ
পনেরো বাইশায় শূন্য সাত।
কমল বলল, এর অর্থ কী?
অর্থ ভুলে গেছি। আরেকটা শোন–
মাস মাহিনা যার যত
দিনে তার পড়ে কত?
টাকা প্রতি দশ গণ্ডা দুই কড়া
দুই ক্রান্তি হয়
আনা প্রতি দুই কড়া দুই ক্রান্তি
শিবরাম কয়।
কমল বলল, আরেকটা বলো।
মতিন বলল, এটা হলো বাজার সদাই নিয়ে–
তৈল লবণ মৃত চিনি যাহা
কিনিতে চাই
মণ দরে সেরে টাকায়
আট গণ্ডা পাই।
পোয়া প্রতি দুই গণ্ডা
সেরে ছটাক জেনো
কহেন শুভঙ্কর
এই কথাটা মেনো।
কমল বলল, শুভঙ্কর কে?
উনিও একজন অঙ্কবিদ। তোমার মতো কেউ।
কমল বলল, আমি অঙ্কবিদ না।
মতিন বলল, এখন না হলেও একদিন হবে। তুমি ঘোতনা-ঘুতনির নাম নিয়ে যে অঙ্ক ফেঁদে বসেছ শুভঙ্কর নিজে এই অঙ্ক পারতেন কি-না কে জানে!
তুমি এখন আর কথা বলবে না। আমি নামের কাজটা শেষ করি।
কতক্ষণ লাগবে?
দুই তিন ঘণ্টা।
এতক্ষণ আমি কী করব?
আমি জানি না।
তুমি তাহলে একটা কাজ কর, দরজা বন্ধ করে গুটিগুটি করে লিখে সব কাগজ শেষ কর। আমি আমার একটা কাজ সেরে আসি।
কী কাজ?
আমার একটা বই বের হয়েছে। নদ্দিউ নতিমের বাজেয়াপ্ত নিষিদ্ধ গল্প। বইটার কপি নিয়ে আসব।
ঠিক আছে।
একা থাকতে সমস্যা আছে?
না।
তোমার গাড়ি থাকল। তোমার ড্রাইভার থাকল। চলবে?
হুঁ চলবে।
কাগজ যা আছে তাতে হবে? না আরো কিনে দিয়ে যাব।
আরো দিয়ে যাও।
তোমার যদি ক্ষিধে লাগে তার জন্যে কি খাবার কিনে দিয়ে যাব?
আমার ক্ষিধে লাগবে না।
এক বোতল পানি আর জুস কিনে দিয়ে যাই?
আচ্ছা।
আইসক্রিম খাবে?
খাব।
দুপুরে কী খাবে? পিৎজা?
হুঁ খাব।
মতিন বলল, তুমি যত অঙ্কই কর, তুমি যে বাচ্চা–বাচ্চাই আছ।
কমল জবাব দিল না। সে মহানন্দে 010101 লিখে কাগজ ভরিয়ে ফেলছে।
প্রকাশকের নাম (মতিনের ভাষায় গা প্রকাশক) সারোয়ার খান। তিনি মতিনকে দেখে বিরক্ত গলায় বললেন, আপনি কেমন লেখক বলেন দেখি! পনেরো দিন আগে বই বের হয়েছে, আপনি খোজ নিতে আসেন না। নতুন বই বের হলে লেখকরা আধাপাগলের মতো হয়ে যায়।
মতিন বলল, আমি তো লেখক না। আমি অনুবাদক। অনুবাদকের বইয়ের প্রতি আগ্রহ কম থাকে। বই কেমন হয়েছে?
লেখা কেমন হয়েছে সেটা আপনি বলবেন। প্রোডাকশন ভালো হয়েছে। বই চলছেও ভালো।
এর মধ্যে চলাও শুরু করেছে?
নাম দেখে লোকজন কিনছে, কভারে নেংটা মেয়ের ছবি।
কভারে নেংটা মেয়ে নাকি?
কথার কথা বললাম। নগ্ন ছবি শালীনভাবেই আছে। মূল লেখক নতিম না কী যেন নাম, তারও অপছন্দ হবে না। আপনি উনার ঠিকানা দিয়ে যান, কুরিয়ারে উনাকে দুই কপি বই পাঠিয়ে দেব।
মতিন বলল, উনাকে বই পাঠিয়ে কোনো লাভ নাই। অথর্ব হয়ে পড়েছেন। চোখেও দেখেন না। অন্ধ।
আহা, বলেন কী!
মতিনের বই পছন্দ হলো। সুন্দর ছাপা। কভারে নগ্ন মেয়ের ছবিটিও শিল্পী তুলির টানে সুন্দর এঁকেছেন। মেয়েটা কিছু একটা দেখে ভয় পেয়ে নিজেকে লুকাতে চাচ্ছে–এমন ছবি। মতিন বলল, বই সুন্দর।
সারোয়ার খান বললেন, আপাতত পাঁচ কপি বই নিয়ে যান। বেশি বই নিয়ে তো লাভ নাই। বন্ধু বান্ধবরা হাত থেকে নিয়ে নিবে।
দিন, পাঁচ কপিই দিন।
রয়্যালটির কিছু টাকাও দিচ্ছি। আমাদের প্রকাশনার নিয়ম রয়্যালটির টাকার একটা অংশ বই প্রকাশের দিন দেয়া হয়। মূল লেখকের জন্যে ১২% রয়্যালটি। অনুবাদ হলে ৮%। ঠিক আছে?
মতিন বলল, কবুল।
কবুল মানে কী?
কবুল মানে আমি ৮% রয়্যালটি কবুল করে নিলাম।
নিন টাকাটা রাখুন। এখানে তিন হাজার আছে। গুনে নিন। ভদ্রতা দেখিয়ে গুনে চলে যাবেন, পরে টেলিফোন করে বলবেন পাঁচশ কম ছিল তা হবে না।
মতিন টাকা গুনল। বইয়ের প্যাকেট হাতে নিল। কমল একা মেসবাড়িতে বসে আছে, তাড়াতাড়ি ফেরা দরকার। সে ইয়েলো ক্যাব নিয়ে নিল। ভোরের স্বদেশের সাহিত্য সম্পাদক আজহার উল্লাহ সাহেবকে বইটার একটা কপি আজই দিয়ে দেয়া দরকার। শুধু বই না, বইয়ের সঙ্গে এক কার্টন সিগারেট। এই ভদ্রলোক খুব আগ্রহের সঙ্গে সিগারেট খান। একটা সিগারেট ধরাবার আগে প্যাকেট খুলে কটা সিগারেট আছে গুনে দেখেন। এক কার্টুন সিগারেটের সঙ্গে একটা দামি লাইটার। তিন হাজার টাকা এইভাবেই খরচ করে ফেলতে হবে। নিজের জন্যে কিছু করা যাবে না। একটা গিফট কিনতে হবে কমলের জন্যে। কী গিফট? অবশ্যই অঙ্কের বই। যত জটিল হয় তত ভালো। জটিল অঙ্ক বইয়ের নামধাম আজিজ সাহেবের কাছ থেকে জেনে নিতে হবে।
একটা কিছু কিনতে হবে নিশুর জন্যে। মহিলা জ্ঞানীদের জন্যে উপহার কেনা সহজ। গিফটের পেছনে একটা গল্প বানিয়ে বলতে হবে। মহিলা জ্ঞানীরা যাবতীয় গল্পগাথা বিশ্বাস করে। মতিন যদি রেললাইন থেকে একটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে বলে পাল আমলের পাথর। পালবংশের রাজা দেবপাল-এর পুত্র শূরপাল মন্দির বানানোর জন্যে পাথর সংগ্রহ করেছিলেন। পাথরগুলিকে শুদ্ধ করার জন্যে তিনি দুধ দিয়ে ধোয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আমার হাতের পাথরটা তারই একটা।
এই কথা শুনে নিশু চোখ বড় বড় করে বলবে, বলো কী? পেয়েছ কোথায়?
একটা কিছু কিনতে হবে তৌ-এর জন্য। তৌ-এর সঙ্গে দেখা করা সম্ভব। উপহার কিনে পাঠিয়ে দিতে হবে। তৌ-এর জন্য কী কেনা যায়? তার পছন্দ অবশ্যই শাড়ি। একবার রিকশা থেকে নামার সময় তার সবুজ রঙের শাড়ি ছিঁড়ে গিয়েছিল। তৌ কেঁদেকেটে অস্থির। ভাব এরকম যেন তার হাত-পা ছিঁড়ে গেছে। একদিকে ঠিকই আছে। শাড়িকে মেয়েরা আলাদা কিছু ভাবে না। শরীরের অংশ হিসেবে ভাবে।
আজহার উল্লাহ অবাক হয়ে বললেন, এই সিগারেটের কার্টুন, এই লাইটার আমার জন্যে?
মতিন বলল, জি স্যার।
কারণটা বলো।
আপনি খুব আগ্রহ করে সিগারেট খান। একটা সিগারেট ধরাবার আগে প্যাকেট খুলে গুনে দেখেন কয়টা সিগারেট আছে। এইজন্যেই আনলাম।
আজহার উল্লাহ বললেন, আমি হার্টের রোগী, একবার স্ট্রোক হয়েছে। সিগারেট কমিয়ে খাওয়ার জন্যে এই ব্যবস্থা। সারাদিনে সাতটার বেশি খাব না ঠিক করা থাকে বলে সিগারেট গুনি।
স্যার, আপনার জন্যে একটা বই এনেছি।
আজহার উল্লাহ বিড়বিড় করে বললেন, নদ্দিউ নতিমের গল্পগ্রন্থ! মাশাল্লাহ। অবশ্যই মাশাল্লাহ। আমি চট করে মুগ্ধ হই না, তবে নদ্দিউ নতিম সাহেবের কর্মকাণ্ডে মুগ্ধ।
স্যার, বইটা আপনাকে উৎসর্গ করা।
আজহার উল্লাহ কিছুক্ষণ চুপ করে মতিনের দিকে তাকিয়ে থেকে উৎসর্গ পাতা খুললেন। সেখানে লেখা–
অনুবাদকের উৎসর্গ
জনাব আজহার উল্লাহ খান।
স্বর্ণ হৃদয়খণ্ড বক্ষেতে ধরি
যে-জন বসেছে একা
শতজন মাঝে
এই গল্পগ্রন্থখানি তাঁহাকেই সাজে।
আজহার উল্লাহ হাত থেকে বই নামিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, কাউকে বই উৎসর্গ করতে হলে তার অনুমতি নিতে হয়, এটা জানো?
না।
একটা নিম্নশ্রেণীর Hoax-এর সঙ্গে তুমি আমাকে যুক্ত করলে। কাজটা ঠিক হলো?
জি-না।
এতবড় মিথ্যা গোপন থাকবে না। একদিন প্রকাশিত হবে। তখন আমার কী হবে?
আপনার কিছু হবে না। কারণ আপনি মিথ্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন না জেনে।
মিথ্যা এমন জিনিস তার সঙ্গে জেনে যুক্ত হওয়া না-জেনে যুক্ত হওয়া একই জিনিস।
স্যার, আমি উঠি?
দুটা মিনিট বসো। আমার কয়েকটা প্রশ্নের জবাব দাও। তুমি চাকরি বাকরি কিছু কর না। ঠিক না?
জি।
সংসার কীভাবে চলে?
আমি একা মানুষ। আমার কোনো সংসার নেই।
একারও সংসার থাকে। তাকে খেতে হয়। কাপড় পরতে হয়। রাতে ঘুমাতে হয়।
স্যার, আমার এক বন্ধু আছে। সে আমাকে প্রতি মাসে তিন হাজার করে টাকা দেয়। এতেই চলে যায়।
বন্ধু প্রতিমাসে তিন হাজার করে টাকা দেয় কেন?
একবার তার আমি খুব বড় একটা উপকার করেছিলাম। এইজন্যে দেয়।
সে ঢাকায় থাকে?
জি-না। সে থাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম। বিশাল জায়গা-জমি কিনে হুলুস্থুল কাণ্ড করেছে।
এই বন্ধু তোমাকে মাসে তিন হাজার করে টাকা সারাজীবন দিয়ে যাবে?
জানি না দেবে কি-না। এখন পর্যন্ত দিচ্ছে। তার ইচ্ছা আমি তার রাজত্বে চলে যাই। ম্যানেজারির দায়িত্ব নেই।
তুমি যাচ্ছ?
জি-না। নদ্দিউ নতিম জঙ্গল পছন্দ করতেন না। তাঁর বিখ্যাত উক্তি–জঙ্গলের সন্ধানে তুমি কেন বাইরে যাবে? তোমার চারপাশের মানুষজনের মধ্যেই আছে ঘন অরণ্য।
আমার সঙ্গে ফাজলামি করবে না।
স্যার, আমি যাই।
আরেকটু বসো।
আরেকদিন এসে আপনার সঙ্গে গল্প করব। একটা বাচ্চাছেলে আমার জন্যে। অপেক্ষা করছে। আমাকে যেতে হবে। স্যার যাই?
যাও। একদিন আমার বাসায় এসো। আমার মেয়ে তোমাকে দেখতে চায়। তার সঙ্গে তোমাকে নিয়ে গল্প করেছি।
মতিন বলল, আমি কালই যাব।
কাল তুমি যাবে না। এটা আমি জানি। যেদিন ইচ্ছা হবে চলে এসো। ঠিকানাটা নিয়ে যাও। বাসা চিনবে কীভাবে?
মতিন বলল, ঠিকানা লাগবে না।
মতিনের ঘরের দরজা বন্ধ। ভেতর থেকে ছিটকিনি লাগানো। ছিটকিনি অনেক উপরে। কমলের পক্ষে ছিটকিনি লাগানো সম্ভব না। সে নিশ্চয়ই চেয়ারের উপর দাঁড়িয়ে কাজটা করেছে। মতিন দরজায় টোকা দিয়ে বলল, কমল, আমি কি ভেতর আসব?
এখন না।
এখন না কেন?
আমি এখন আমার Secret-টা লিখছি। Secret লেখা শেষ হলে আসবে। আমি দরজা খুলে দেব।
ঠিক আছে, আমি দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। তোমার বিখ্যাত অঙ্কটা কি শেষ হয়েছে?
কমল জবাব দিল না। মতিন মেসের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে। তার দৃষ্টি আকাশের দিকে। আকাশ ঘন নীল। ঢাকার আকাশ কখনো এত নীল হয় না। আকাশটাকে এখন মনে হচ্ছে উজবেকিস্তানের আকাশ, নদ্দিউ নতিমের ঘন নীল আকাশ। আকাশ নিয়ে কি তিনি কোনো কবিতা লিখেছেন? লেখার তো কথা। তার কাছে মানুষ এবং প্রকৃতি কখনো আলাদা কিছু ছিল না।
দরজা খুলে গেল। কমল ঘর থেকে বের হয়ে সহজ গলায় বলল, Secret টা লিখে তোমার টেবিলের ড্রয়ারে রেখেছি।
মতিন বলল, Doog করেছ।
আমি এখন বাসায় যাব। আমাকে বাড়িতে দিয়ে এসো।
চলো যাই। যাবার পথে পিৎজা খেয়ে গেলে কেমন হয়?
না।
না কেন? তুমি পিৎজা খেতে চেয়েছিলে।
এখন চাচ্ছি না।
তোমার কি মন খারাপ?
হুঁ।
কেন?
আমি আমার Secret তোমাকে বলছি এইজন্যে।
মতিন বলল, আমি তোমার Secret এখনো পড়ি নি। এখনো আমার টেবিলের ওভারে আছে। তুমি এক কাজ কর, Secret-টা সঙ্গে নিয়ে যাও। তোমার মন খারাপ, এটা আমার ভালো লাগছে না। ঠিক আছে?
কমল কঠিন গলায় বলল, No. সে হাঁটা শুরু করেছে। কমলের পেছনে পেছনে যাচ্ছে মতিন।
হঠাৎ কমল বলল, তোমাকে যেতে হবে না।
মতিন বলল, কেন?
তুমি তোমার ঘরে যাও। আমার Terces-টা পড়।
এখনই পড়তে হবে?
হ্যাঁ এখনই পড়তে হবে।
পড়ার পর কি আমার কিছু করণীয় আছে?
না।
তোমার গোপন কথা জেনে আমি চুপচাপ বসে থাকব?
হুঁ। তুমি তোমার ঘরে যাও।
তোমাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে আসি?
আচ্ছা।
গাড়িতে উঠতে উঠতে হঠাৎ কমল আগ্রহ নিয়ে বলল, কবুতরের পুপুর কালার কী তুমি জানো?
মতিন বলল, না।
কমল বলল, সাদা।
মতিন বলল, ও আচ্ছা, একটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস জানলাম।
কমল বলল, ছাগলের পুপুর কালার কালো।
মতিন বলল, এটা জানি। মানুষেরটা হলুদ এটাও জানি।
কমল বলল, এমন কোনো প্রাণী কি আছে যার পুপু সবুজ?
জানি না।
খুঁজে বের করতে পারবে?
অবশ্যই পারব। চিড়িয়াখানার কিউরেটারকে জিজ্ঞেস করলে জানা যাবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যার হেডকেও টেলিফোন করতে পারি। সবচে ভালো হয় যদি কাটাবনে চলে যাই।
কাঁটাবনে কী?
কাঁটাবনে পশুপাখি বিক্রি হয়। দোকানদাররা নিশ্চয়ই বলতে পারবে সবুজ রঙের হাগু কে করে।
তুমি কখন কাঁটাবনে যাবে?
আজই যেতে পারি।
থ্যাংক য়্যু।
কমল তার সিক্রেট দুই পাতায় লিখেছে। তার বয়েসী ছেলেমেয়েরা বড় বড় অক্ষরে লেখে। লাইনও ঠিক থাকে না। কমলের লেখা ছোট ছোট হরফে। লাইন সোজা। লেখা দেখে মনে হবে, সে স্কেল বসিয়ে লিখেছে। তবে তার লেখা চট করে পাঠ করার মতো না। সে লিখেছে উল্টো করে। এই লেখা পড়ার সহজ বুদ্ধি হলো, আয়নার সামনে লেখাটা ধরা। মতিনের ঘরে কোনো আয়না নেই। আয়না আছে মেসবাড়ির বাথরুমে। লেখা নিয়ে বাথরুমে যেতে ইচ্ছা করছে না। সিক্রেট থাকুক সিক্রেটের মতো। কোনো একদিন পড়ে ফেললেই হবে। এত তাড়াহুড়ার কিছু নেই।