১১. ভানুমতী ঠাকুরানি

স্ত্রীলোকটির নাম, সে নিজেই জানাল, ভানুমতী ঠাকুরানি। লোকের মুখে মুখে অচিরেই তা হয়ে গেল ভান্‌তি ঠাইরেন, আরও সংক্ষেপে শুধু ঠাইরেন। বয়স তিরিশের নীচেই, গৌরাঙ্গী, চেহারা একটু ভারীর দিকে, ঘন চুল ঢালের মতন ছড়িয়ে আছে পিঠের ওপর।

এক কায়স্থ ব্যবসায়ীর তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী, বড় সতিন এখনও জীবিত, তার তিনটি বড় বড় সন্তান আছে। এর এখনও কোনও সন্তান হয়নি, সেইজন্য সতী হবার জন্য একে নির্বাচন করা হয়েছিল। ভানুমতিকে ধরাধাম থেকে বিদায় দেবার জন্য স্বার্থযুক্ত ব্যক্তিদের উদ্দেশ্য বোঝাই যায়।

প্রথম দুদিন অনেকটা ঘোরের মধ্যে থাকলেও তারপর স্বাভাবিক হবার পর দেখা গেল, তার বেঁচে থাকার ইচ্ছে ষোলো আনা। তার স্বভাবেও চাঞ্চল্য আছে, এক জায়গায় বেশিক্ষণ বসে থাকতে পারে না, নিজেই এখানকার বাড়ি বাড়ি ঘুরে ঘুরে অনেকের সঙ্গে ভাব করে নিল।

প্রথমে তাকে কমলির জিম্মায় রাখা হয়েছিল। কমলি তার যত্নের ত্রুটি করেনি, সেবা-শুশ্রুষায় তাকে সুস্থ করে তুলেছে।

তারপরই সে ভানুমতীকে জিজ্ঞেস করল, দ্যাখছো তোবইনডি, এই যে আমাগো গেরাম, এইডাই আমাগো স্বর্গ। এখানে হিন্দু-মুসলমান মিলে মিশে থাকে। তোমার আবার ছোঁয়াছানির বাতিক নাই তো? আমি তোমার জাইত মারতে চাই না।

ভানুমতী জিজ্ঞেস করল, তুমি কী?

কমলি বলল, আমি আগে আছিলাম বাম্‌নি। এখন আমার খসম মোছলমান।

তারপরই হাসতে হাসতে বলল, এই কথাডা যেন লালন সাঁইরে পুছিয়ো। তাইলেই সে গান গাইয়া শোনাবে, সব লোকে কয় লালন কী জাত সংসারে। এখানে কেউ কেউ আছে, হিন্দুও না মোছলমানও না। কিংবা দুই-ই।

হতভম্বের মতন মুখ করে ভানুমতী বলল, তা আবার হয় নাকি?

কমলি বলল, হয়। নিজের চক্ষেই দেখতে পাবা। কেউ পুজো করে, কেউ নামাজ পড়ে, কেউ কিছুই করে না কোনও তকল্লুফ নাই। তুমি কী করতে চাও, এখানে থাকবা না ফিরা যাইতে চাও?

ভানুমতী বলল, কোথায় যাব?

কমলি বলল, এর উত্তর আমি কী করে দিমু? নারীজাতি একবার যদি ঘর ছাড়ে, তার আর ঘর থাকে না। তোমার বাপের বাড়িতে কেউ আছে?

ভানুমতী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, নাই!

কমলি বলল, জানা কথা। বিয়ার পরেও বাপের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক থাকে, এমন ভাগ্যবতী আর কয়জন হয়। এখানেই থাকো। কিছু কাম-কাজ করো। নিজেরটা নিজে বুইঝ্যা নিতে হবে। দিনের পর দিন কেউ তোমারে খাওয়াবে না।

ভানুমতী বলল, আমি কী কাজ করব?

কমলি বলল, কাম তো অনেকই আছে। এখন তুমি আমার ঘর থিকা একটা ধামা লইয়া যাও। এই জঙ্গলে অনেক জামগাছ আছে। এই সময় জামে জামে গাছ একেবারে ভইরা থাকে। কাউয়ায় খায়, বান্দরে খায়, গাছতলায়ও পইড়া থাকে অনেক। টোবা টোবা দেইখ্যা ধামা ভইরা কুড়াইয়া আনো। এই জাম লবণ আর একটু কাসুন্দি দিয়া মাখলে খুব ভালো টাকনা হয়, এক থাল ভাত খাওন যায়।

ভানুমতী চলে গেল জাম কুড়োতে।

কয়েকদিন পর এক দুপুরে নিরিবিলি পেয়ে কমলি এল লালনের কাছে। দুপুরে এক পেট খাওয়ার পর লালন একটা গাছতলায় চিত হয়ে শুয়ে শুয়ে মৃদু স্বরে একটা গান গাইছে।

এখন লালনের কণ্ঠে ঘনঘন গান আসে। সেই সব গান তার ঘনিষ্ঠ মানুষেরা শোনে, তারপর হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। লিখে রাখার কোনও প্রশ্ন নেই। এখানে লেখাপড়ার কোনও বালাই নেই, কেউই ওসব জানে না, লালন তার গানগুলি স্থায়ী করে রাখার প্রয়োজনও বোধ করে না।

কিন্তু অন্যরা তার কিছু কিছু গান আবার শুনতে চায়। লালনের নিজেরই দু-এক চরণ ছাড়া মনে থাকে না সব। সে তখন হাসে।

এখন গানগুলি ধরে রাখার একটা উপায় পাওয়া গেছে। সে গান শুরু করলেই কয়েকজন চেঁচিয়ে ওঠে, ওরে গনাই কোথায় গেল, ডাক ডাক

গনাই শেখের ছোট্টখাট্টো চেহারা, প্রায় বামনই বলা যায়। সে প্রায়ই জ্বরে। ভোগে, কাজ-কৰ্ম্ম বিশেষ পারে না। কিন্তু তার স্মৃতিশক্তি অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি। গলাতেও বেশ সুর আছে। লালনের গান একবার শুনেই সে কণ্ঠে ধরে রাখতে পারে। পরে আবার গেয়ে শোনায়।

লালনের কখন যে গান মনে আসবে তার তো ঠিক নেই। হয়তো পাঁচজনের সঙ্গে কথা বলছে নানা বিষয়ে, কিংবা নিজের কাজ করছে, হঠাৎ মিনমিন করে গান আসে। নদীতে পোনামাছের বাচ্চাদের ঝাঁক যেমন দেখা যায়, সেইরকমই যেন গানের কথাগুলি আসে ঝাঁক বেঁধে, তাতে নতুন নতুন সুরও লেগে যায়।

তাই মনে গান এসে গেলে সে আগে বলে ওঠে, ওরে, আমার মনের মইধ্যে পুনামাছের ঝাঁক আইছে। আইয়া পড়ল।

অন্যরা অমনি বুঝতে পারে, তখনই গনাইয়ের নাম ধরে হাঁকডাক শুরু হয়ে যায়। দেরি হলে কেউ তার ঘেঁটি ধরে টানতে টানতে নিয়ে আসে।

গনাই রামভক্ত হনুমানের মতন লালনের খুব কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে স্থির দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। যেন সে লালনের ঠোঁট নাড়া ছাড়া আর কিছুই দেখে না, লালনের কণ্ঠস্বর ছাড়া অন্য কোনও শব্দ তার কানে যায় না। এক-এক বার হয়তো সে লালনকে দুই-এক চরণ আবার গাইতে অনুরোধ করে, লালনের গান শেষ হলে সে পুরো গানটি নির্ভুল শুনিয়ে দেয়।

গনাই শেখ আগে ছিল কৌতুকের পাত্র। এই গুণের জন্য এখন তাকে সবাই বেশ খাতির করে।

লালন গান গাইছে দেখে কমলি বলল, নতুন গান? গনাইরে ডাকি?

লালন বলল, না, দরকার নাই। মোটে দুই-তিনটা চরণ, তারপর অস্পষ্ট, নিজেই বুঝতেছি না। এ-গান এখন পুরা হবে না।

কমলি পাশে বসে পড়ে বলল, সাঁই, তোমার সঙ্গে আমার কথা আছে।

লালন বলল, কও।

কমলি বলল, আমারে তো ফিরাইছিলা। এবার তুমি কী করবা?

লালন বলল, বুঝলাম না। কিসের কী?

কমলি বলল, নতুন যে মাইয়াডা আইছে, সে এখন থাকবে কোথায়? আমরা কয়দিন ওরে রাখব? আর কার বাসায়… সে তো কোকিল না যে, কাউয়ার বাসায়…

লালন বলল, ঠিক, অর জইন্য একটা ঘর বানাইতে হবে। কালুয়া থাকলে কত সুবিধা হইত।

কমলি বলল, কালুয়ার কথা ছাড়ান দাও। সে আর ফিরা আসবে না আমি জানি। এখানে আর সক্কলডিই দোকা দোকা, তুমিই শুধু একা। অনেকেই বলাবলি করতেছে, তোমার ঘরেই ওরে রাখা উচিত।

লালন সহজভাবে বলল, তা থাকতে পারে।

কমলি ঠোঁট টিপে হেসে বলল, তারপর?

লালন বলল, তারপর কী?

কমলি বলল, সাঁই, তুমি কি কিছুই বোঝো না? নাকি বুইঝাও না-বুঝার ভান করো। রাইতের বেলা ও মাইয়ার বুকে যদি আগুন জ্বলে, তুমি নিবাবা না? আমার আগুন এখনও জ্বলতেছে, তুমি গেরাহ্য করো নাই।

লালন বলল, শুধু আগুনের কথা কও কমলি, নদীর কথা কেন কও না?

কমলি বলল, কথা ঘুরাইও না, কথা ঘুরাইও না। আমি নদীর কথা জানি। আগুনের কথা জানি। মাইয়ামানুষরে সারা জীবন যে কতরকম আগুনে দগ্ধ হইতে হয়, তা তোমরা কী বুঝবা!

লালন বলল, আমি নিজেরেই এখনও বুঝি না, মাইয়ামানুষের কথা কী করে বুঝব। সব সময়েই মনে হয়, একজন কেউ আমারে দেখে, কিন্তু আমি তারে দেখি না। এ যেন এক আরশির নগর। সব কিছুই ঝলমল করে, শুধু পড়শিরে দেখা যায় না।

কমলি বলল, আমার আগুনে আমি দুইজন পুরুষরে পুড়াইছি। জানি, একদিন নিজেও খাক হয়ে যাব। সাঁই, তুমি আমারে কিছু দাও নাই, তবু আমি তোমারে একখান উপহার দেব। আমি নিজের হাতে সাজাইয়া গুছাইয়া এই নতুন মাইয়াডারে পৌঁছাইয়া দেব তোমার ঘরে।

সত্যিই তাই হল, সেই রাতের বেলাতেই ভানুমতীকে লালনের ঘরে নিয়ে এল কমলি। ভানুমতীর কালো নরুন পাড় শাড়িখানা ধপধপে সাদা। পান খেয়ে সে ঠোঁট লাল করেছে। কমলির নিজের মাথায় চুল নেই, তাই মনের সাধ মিটিয়ে সে ভানুমতীর চুল আঁচড়িয়ে বেঁধে দিয়েছে খোঁপা।

কমলি হেসে বলল, এই নাও সাঁই তোমার উপহার!

লালনের সঙ্গে তেমন ভাব হয়নি ভানুমতীর। তাকে মনে হয়েছে দূরের মানুষ। দূর থেকেই দেখেছে লালনকে, তার গানও শুনেছে। কথা বলা হয়নি। সে দরজার কাছে আড়ষ্টভাবে দাঁড়িয়ে রইল।

তাকে ছোট্ট ঠেলা মেরে কমলি বলল, আরে ভান্‌তি, ভিতরে যা। আজ। থিকা এইটাই তোর ঘর। ভয় নাই। এই মানুষটা তরে খাইয়া ফেলাবে না।

গলা তুলে সে আবার বলল, দেইখ্যো সাঁই, ভান্‌তিরে যেন ভ্রান্তি না-হয়।

তারপর সে সরে গেল সেখান থেকে।

এখন আর মাটিতে শুতে হয় না, চাটাই জোগাড় হয়েছে, বালিশও আছে। দ্বিতীয় চাটাইটি গোটানো আছে এক পাশে, সেটার দিকে আঙুল দেখিয়ে লালন বলল, ওইটা পেতে লও। তারপর শুয়ে পড়ো।

মাদুরটা পাততে গিয়ে ভান্‌তি জিজ্ঞেস করল, পুব দিক কোনটা?

লালন বলল, পুব দিক! কেন, তা জেনে কী হবে।

ভান্‌তি বলল, পুব দিকে পা দিয়া শুইতে নাই।

লালন বলল, তাই নাকি! পুব দিক, পুব দিক, এই ঘরের পিছনের দিকে প্রভাতের সূর্য ওঠে। আরে, আমি তো অ্যাদ্দিন সেইদিকেই পা দিয়া শুইছি।

লালন উঠে নিজের চাটাইটা ঘুরিয়ে নিল। তারপর বলল, একসময় আমার এক দোস্ত এই ঘরে থাকত। আমি নাকি ঘুমের মইধ্যে কথা কই মাঝে মাঝে, গানও গাইয়া উঠি, আমি নিজে তা টের পাই না। তেমন যদি হয়, তুমি ভয় পাইয়ো না।

ব্যস, সে রাতে সেইটুকুই কথা হল।

 লালনের ঘুম ভাঙে খুব ভোরে।

এই সময় পাখিরা নিজেদের মধ্যে সম্ভাষণ শুরু করে দেয়। পাতলা জালের আবরণের মতন আস্তে আস্তে গুটিয়ে যায় অন্ধকার। স্নিগ্ধ বাতাসে গাছের পাতারাও যেন কথা বলাবলি করে। জীব জগৎ ছাড়া বস্তু জগতেরও বুঝি ভাষা আছে নিজস্ব।

লালন হাঁটতে হাঁটতে নদীর ধারে চলে আসে। কোনও কোনও দিন তারও আগে পৌঁছে যায় শীতল আর মনসুররা কেউ কেউ। মনসুরের বউ নাজমাও থাকে সঙ্গে। নদীর জলে ওরা যে আঁটন দিয়ে রাখে সেখানে মাছ পড়েছে। কিনা তা দেখার কৌতূহলই টেনে আনে ওদের।

রোজই কম-বেশি মাছ পড়ে। খলসে, পাবদা, বেলে, চ্যাং। ইচা মাছ। দু-একটা সাপও আটকে যায়, সেগুলি অবশ্য জলঢোঁড়া। যেদিন মাছের পরিমাণ খুব বেশি হয়, সেদিন ওদের দুজন সেই মাছ নিয়ে বাজারে ছুটে। যায়। মাত্র ক্রোশ দু-একের পথ। এখন এ-অঞ্চলের তাঁতি ও কারিগরদের হাতে বেশ পয়সা, তারা নিজেরা মাছ ধরার সময় পায় না, বাজারের মাছ কেনে।

এরপর লালন যায় তার পানের বরজের যত্ন নিতে। শিমুলতলায় গ্রামটির জীবনযাত্রায় একটা স্বচ্ছন্দ প্রবাহ এসে গেছে। যে যার মতন আনন্দে আছে। উৎকট দারিদ্র্য নেই এখানে, সকলেরই কিছু না কিছু খাদ্য জুটে যায়। কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসার ব্যবস্থা নেই, ওষুধপত্র পাওয়া যায় না, কিন্তু সেবা পাওয়া যায়। বিশেষত মেয়েরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে যে-কোনও অসুস্থ মানুষের সেবার জন্য এগিয়ে আসে। তারপর শেকড় বাকড় আর জড়িবুটির ওপর ভরসা।

এ পর্যন্ত এই বসতির একজনই পুরুষের মৃত্যু হয়েছে। এখানে আসার আগে থেকেই তার শ্বাসকষ্টের ব্যাধি ছিল। কখনও দিনের পর দিন ঠিক থাকত, আবার বেড়ে যেত সহসা। বাড়াবাড়ি হলেই শয্যাশায়ী। দু-তিনবারই। মনে হয়েছে, সে বুঝি আর বাঁচবে না। কিন্তু কয়েকদিন পরই আবার চাঙ্গা হয়ে লেগে যেত কাজকর্মে। সে দিব্যি বেয়ে উঠতে পারত তালগাছ, তালের রস জ্বাল দিয়ে গুড় বানানো ছিল তার পেশা। একদিন সে যখন তালগাছের। ডগায় উঠে রসের হাঁড়ি নামাচ্ছিল, সেই সময় অকস্মাৎ তার শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। কাশির দমক সামলাতে না-পেরে সে হাঁড়িসমেত পড়ে যায় নীচে। তাতে তার হাড়গোড় বিশেষ ভাঙেনি বোধহয়, কারণ নীচে ছিল নরম কাদামাটি, কিন্তু তার বারোধ হয়ে যায়।

এর পরও সে বেঁচে ছিল তিনদিন। মনিরুদ্দি নামে সেই মানুষটির স্ত্রী মানোয়ারাও কমজোরি, কিন্তু তাকে বিশেষ কিছুই করতে হয়নি। অন্তত দশজন নারী দিবারাত্র পালা করে তার সেবা করেছে। এমন সেবা কি সে আর কোথাও পেত? একেবারে অন্তিম দশায় মনিরুদ্দির চক্ষু দিয়ে অনবরত পানি ঝরতে থাকে, কিন্তু তার ওষ্ঠে লেগে থাকে হাসি। অর্থাৎ তার এই অশ্রু কষ্টের নয়, আনন্দের। চোখের ইঙ্গিতে মানোয়ারাকে কাছে ডেকে সে শেষ নিশ্বাস ফেলেছে।

তার এই মৃত্যু এখানে কারুর কাছেই তেমন শোকের মনে হয়নি। এই যেন খুব স্বাভাবিক পরিণতি। যেতে তো হবেই সকলকে, শেষের কয়েকটা দিন তবু মনিরুদ্দি সুখেই কাটিয়েছে। সে জেনে গেছে যে, তার অবর্তমানে তার বিবি বিপদে পড়বে না। অন্যান্য গ্রামে পতিহারা নারীদের কত মানুষ কষ্ট দেয়। এই নয়াপত্তনে সবাই সবাইকে দেখে।

মনিরুদ্দি আগেই বলে গিয়েছিল, তাকে গোর দিতে হবে না, তার জানাজা হবে না। তার দেহটাকে নদীতে ভাসিয়ে দিলেই সে চিরশান্তি পাবে।

এখন আবার যাদুমনি জ্বরে পড়েছে। এইসব অঞ্চলে জ্বরজারি তো লেগেই থাকে সারাবছর, এখানে জঙ্গলের মধ্যে এত বৃষ্টিতে ভিজেও কিন্তু এরা সেই তুলনায় জ্বরে কমই ভোগে। পুরুষদের তুলনায় মেয়েরা অনেক ছোটখাটো অসুখ অগ্রাহ্য করতে পারে, সংসারে কাজের জন্য শুয়ে থাকলে চলে না।

যাদুমনিও জ্বরতপ্ত শরীর নিয়ে সব কাজ করে যাচ্ছিল। সে আর মদন চাটাই বোনার কাজ করে। রান্নার ভারও তার ওপর। কমলিই প্রথম তার ছলছলে অরুণাভ চোখ দেখে সন্দেহ করে তার কপালে হাত দিয়ে তাপ দেখেছিল। তারপর কমলিই জোর করে তাকে শুইয়ে দিয়ে তার কাজ আর তিনজনে মিলে ভাগ করে নেয়। এইসব ব্যাপারে কমলিরই খুব উৎসাহ।

কমলির দেখাদেখি ভান্‌তিও যায় সেবিকার দলে যোগ দিতে। কমলি বলে, তুই যা, তরে লাগবে না। আমরা চাইরজন আছি। তুই যা, দ্যাখ গিয়া সাঁইয়ের কখন কী লাগে। এটা বোঝোস না ক্যান?

তারপরই দুষ্টু হেসে বলে, কিছু হয় নাই এর মইধ্যে? শরীলে নখের আঁচড় আছে? দেখা তো, দেখা তো!

ভান্‌তিকে একটা ঠ্যালা দিয়ে সে আবার বলে, বোকা মাইয়া কোথাকার! যা, যা–

একই ঘরে রাতের পর রাত দুটি পৃথক চাটাইয়ে শুয়ে থাকে ভান্‌তি আর লালন। কথাবার্তা বিশেষ হয় না। যে-যার সময় মতন ঘুমিয়ে পড়ে। এমনও হয়, অন্যদের সঙ্গে আলাপচারী করতে করতে লালনের অনেক রাত হয়ে যায়, সে যখন ঘরে আসে ততক্ষণে ঘুমিয়ে পড়েছে ভান্‌তি। আবার সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে লালন জেগে ওঠে, বেরিয়ে পড়ে। তখনও ভান্‌তি জাগেনি, লালনের সঙ্গে তার দেখাই হয় না।

সেরকমই এক রাতে, যাতে ভান্‌তির ঘুম না-ভাঙে সেই জন্য লালন যতদূর নিঃশব্দে সম্ভব চাটাইটা পেতে শুয়ে পড়ল। তারপর সবেমাত্র তার ঘুম এসেছে, ভান্‌তি নিজের চাটাইয়ে উঠে বসে জিজ্ঞেস করল, আপনে ঘুমাইলেন নাকি, সাঁই?

লালন চোখ মেলে বলল, না।

ভান্‌তি বলল, আপনের সাথে তো আমার কথাই হয় না। আমারে কি মনে আছে? আমি কেডা।

লালন বলল, মনে থাকবে না কেন? তুমি ভান্‌তি ঠাইরেন, না, না, ভানুমতী ঠাকুরানি।

আমারে শুধু ভান্‌তি ডাকলেই হবে। কমলিদিদি আমারে একটা কথা। জিজ্ঞাসা করতে কইছে। জিগাই?

জিগাও। যা মনে আসে সবই আমারে জিগাইতে পারো।

আমি সব শুনছি। আমারে জীয়ন্তে পুড়াইয়া মারার জন্য অরা নিয়া গেছিল শ্মশানে। আমার চৌদ্দো পুরুষের ভাইগ্য, সেই রাতে আপনেরা সেইখানে আইস্যা পড়েন। আমার হাঁটনের ক্ষমতা ছিল না, আপনে আর মনসুর মিঞা আমারে পিচ্ছিল পথ দিয়া কত কষ্ট কইরা লইয়া আসছেন। নাইলে আমি সেই শ্মশানেই পইড়া থাকতাম, আমারে ভূত-পেতনিতে ছিঁড়া খাইত। কী, ঠিক কি না!

সে রাতে বড়ই দুর্যোগ ছিল। ভূত-পেতনিও বাহির হয় না। তুমি বাঁইচ্যা গেছ তোমার প্রাণশক্তির জোরে। আমরা নিমিত্ত মাত্র।

সাঁই, আমি নিমিত্ত বুঝি না। আমি বুঝেছি, তুমি আর মনসুরই আমার সাক্ষাৎ প্রাণদাতা। কিন্তু প্রাণ দিয়া আবার পরিত্যাগ করতে চাও ক্যান?

পরিত্যাগের প্রশ্ন আসে ক্যামনে, ঠাইরেন? এখানে আইস্যা তুমি নতুন জীবন পাও নাই? পুরানো সব কথা ভুলে যাও, তাতেই শান্তি পাবে।

আমি নতুন জীবন পাইছি ঠিকই। সব কিছুই নতুন নতুন লাগে। এক একদিন ঘুম ভাঙ্গার পর প্রথম চক্ষু মেলে গাছপালার মাথার উপর দিয়া সুন্দর আকাশ দেখে ভাবি, সত্যি বুঝি স্বর্গে আসছি। সকাল থেকে রাত্তির পর্যন্ত কেউ একটাও কুবাক্য বলে না আমারে। এমনও যে জীবন হয়, স্বপ্নেও ভাবি নাই।

বাঃ, বেশ কথা। তুমি যে সকলের সাথে মানায়ে নিতে পারছ, সেটা আমার ভালো লাগে।

তুমিই এই জঙ্গলের মধ্যে একখান ছোট স্বর্গ গড়েছ।

যাঃ, একেবারে বাজে কথা। এসব কে বলেছে তোমারে? আমি আর কালুয়া নামে একজন প্রথম এসেছিলাম এখানে এই যা। তারপর একে একে আরও অনেকে এসে এটা গড়ে তুলেছে। সকলেই সমান অংশীদার। আমি তার বেশি কিছু না।

ঠিক আছে, এবার আসল কথা কই? তোমার কি বিরক্ত লাগছে? ঘুম আইস্যা গেছে? তাইলে চুপ করি।

লালন বলল, না, ঠাইরেন। সারা রাইত গল্প করলেও আমার বিরক্ত লাগে। আগে একটা বিড়ি খেয়ে লই?

অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে হাতড়ে বেড়ার ধার থেকে বিড়ির বান্ডিল খুঁজে নিল লালন। তার বালিশের নীচেই থাকে চকমকির পাথর।

চকমকি ঠুকে ঠুকে বিড়ি ধরাতে কিছুটা সময় লাগল।

তারপর বড় একটা টান দিয়ে জে বলল, এবার কও।

ভান্‌তি বলল, মাইয়া মানুষের একটা অবলম্বন লাগে। লতার মতন।

লালন বলল, ক্যান, ক্যান, মাইয়া মানুষরা নিজের পায়ে শক্ত হয়ে খাড়াইতে পারে না?

পারে, তাও কেউ কেউ পারে। সক্কলে পারে না। সোজা বৃক্ষ হওনের চেয়ে লতা হইতেই বেশি ভালো লাগে। আমারও তাই ভালো লাগে। নইলে স্বর্গসুখও কেমন যেন আলুনি লাগে। আঝালি। আমগাছের গায়ে আলোকলতা দ্যাখছো? কী সুন্দর দেখায়।

আলোকলতার মূল নাই।

সাঁই, তুমি আর মনসুর আমার নবজীবন দাতা। এর মইধ্যে মনসুরের ঘরে বউ আছে, দায়-দায়িত্ব আছে। তোমার তো সেরকম কেউ নাই। তবে তুমি কেন আমারে নেবা না? কমলি এই কথাই জিগাইতে কইছে।

নেবা… মানে, ঠিক কী?

আমারে তোমার জীবনসাথী করে লও। আমার তো পশ্চাৎ-জীবন আর কিছু নাই!

জীবনসাথী কথাটারও তো অনেকরকম অর্থ হয়।

সাঁই, আমার বিদ্যাশিক্ষা নাই, তা বলে একেবারে নির্বোধ তো না। তুমি আমারে ভাবের কথা শুনাইয়ো না। রূপ-অরূপের কথা বোলো না। হেঁয়ালি কইরো না। সোজাসুজি, সাধারণ মানুষের মতন, জীবনসঙ্গী যারে বলে–

ঠাইরেন, আমি তোমারে সোজাসুজিই কই। আমি তোমারে বিয়া-শাদি করতে পারব না। তুমি যতদিন ইচ্ছা এখানে থাকো।

ক্যান বিয়া করতে পারবে না? আমি হিন্দু, তাই? আমার মুসলমান হইতে আপত্তি নাই।

হিন্দু-মুসলমানের কথাই আসে না। স্ত্রীলোকেরা বিবাহ করতে চায় কেন? তারা একটা স্বামী চায়, সংসার চায়, সন্তান চায়। আমি তেমন কিছুই দিতে পারব না। সংসার কোথায়? এ তো মায়ার সংসার! কবে খানখান হয়ে যাবে তার ঠিক নাই। আর সন্তান…

আমার সংসার চাই না। তুমি আমারে তোমার পাশে রাখলেই হইল।

কিন্তু আমি তোমাকে সন্তানও দিতে পারব না। সেজন্য তুমি কষ্ট পাবে। পরে আমারে দুষবে।

কেন, সন্তান দিতে পারবা না কেন? তুমি কি… তাইলে আমিও…

না, না, সেসব কিছু না। ক্ষমতা থাকলেও আমি সন্তানের জন্ম দেওয়ায় বিশ্বাস করি না।

ক্যান?

বুঝাইয়া বলা শক্ত। তবে আমার মনে হয়, সন্তানের পিতা-মাতারা বড় স্নেহে অন্ধ হয়। নিজের সন্তানদের বুকে চেপে রাখে, অন্যের সন্তানদের ঠিক সেইমতো ভালোবাসতে পারে না। ভালোবাসার এই ভাগাভাগি আমার সহ্য হয় না।

অদ্ভুত কথা। সক্কলেই এমন হবে নাকি?

হয়তো হয় না। হয়তো আমি কোনও সন্তানের বাপ হলে আমিই স্বার্থপর হয়ে যাব! সেইজন্যই আমি—

সাঁই, একটা সত্য কথা বলবে? তুমি কি স্ত্রীলোকদের পছন্দ করো না? তুমি কি তাদের দিকে চাইতেও চাও না? মুখ ফিরায়ে থাকো?

আমার এখন কী হইছে, মিথ্যা কথা মুখেই আসে না। তোমারে কী করে বুঝাব? নারীরা তো মাধুর্য রসের আধার। আমি কি তাদের থেকে মুখ ফিরায়ে থাকতে পারি? তাদের একটুখানি হাসি, তাদের একটুখানি ভঙ্গি দেখলেই আমার মনের মধ্যে বিদ্যুৎ চমকায়। এমনকী নারীদের পায়ের পাতা দেখলেও, এটা আমার একটা গোপন কথা, ইচ্ছা করে, সেই পায়ের পাতা বুকে চেপে ধরি।

বুঝেছি। আমি তেমন কেউ না। তোমার কল্পনায় অন্য নারী আছে।

তাও ঠিক না। এক-একসময় তুমিও তো ডানা-মেলা পরি হয়ে যাও। সত্য কথা এই যে, ইচ্ছা করেছে, তোমারে বুকে ধরে রাখি। কিন্তু…

কিন্তু কী? কেন এইসব কথা আমারে আগে বলো নাই?

নারী ও পুরুষের যেরকম মিলনে সন্তান জন্মায়, আমি যে সেইরূপ মিলন চাই না। কোনও নারীকে কাছে পেতে চাইলে সে তো তেমন মিলন চাইতেই পারে। তখন আমি রাজি না-হলে সে কষ্ট পাবে। তাই আমি…

এরপর একটুক্ষণ দুজনেই চুপ করে রইল। একটা গভীর নিশ্বাস ফেলে ভান্‌তি বলল, এতক্ষণ যা কথা হইল সব মুইছা ফেলো। সব সাদা। এবার আর একটা কথা কইতে পারি?

লালন বলল, অবশ্যই পারো। বলল, বলো—

ভান্‌তি বলল, একলা এই চাটাইতে শুইতে এক-এক সময় বড় ভয় ভয় করে। আমি তোমার পাশে গিয়া একটু শুইতে পারি? বেশিক্ষণ না।

লালন বলল, এসো–

ভান্‌তি উঠে এসে তার পাশে শুয়ে পড়তেই লালন দুহাত বাড়িয়ে তাকে টেনে নিল নিজের বুকের আশ্রয়ে।

এবার শুরু হল ভান্‌তির কান্না।

লালন বিভ্রান্ত হয়ে বলল, একী, কান্দো ক্যান? আমি ছুঁইলে যদি তোমার অসুবিধা হয়…

কান্নার ফোঁপানির মধ্যেই ভান্‌তি বলল, না, না, কথা কইয়ো না। কিছু কইয়ো না।

লালন তার আলিঙ্গন আলগা করে সরে যাবার চেষ্টা করল। ভান্‌তি ব্যাকুলভাবে লালনের বুকে মাথা ঘষতে ঘষতে বলতে লাগল, আমারে ছেড়ে যাইও না। কোনওদিন ছাইড়ো না। মানুষের স্পর্শে যে এত সুখ, আগে কখনও বুঝি নাই।

পরের দিন লালনের ঘুম ভাঙল বেশ দেরিতে।

মাঝে মাঝে এরা কয়েকজন দল বেঁধে বাজারে যায়। নিজেদের উৎপন্ন দ্রব্য বিক্রি করে প্রয়োজনীয় চাল-ডাল ও সবজি এবং সূচ-সুতো, পেরেক, হাতুড়ি ইত্যাদি কিনে আনার জন্য। আজ লালনের সেই দলে যাওয়ার কথা।

চাল-ডাল-মশল্লার মতন কিছু কিছু দ্রব্য, যা প্রতিদিন কাজে লাগে, সেগুলির জন্য বাজার-নির্ভর না-হয়ে শিমুলতলাতেই একটা দোকান খোলার পরিকল্পনা শুরু হয়েছে। গ্রাম ক্রমশ প্রসারিত হচ্ছে, আরও কিছু কিছু দ্রব্য ও বস্তু সুলভ হওয়া দরকার।

লালনরা বাজারে পৌঁছোল বেশ বেলাতেই। সবাই যখন কেনাকাটিতে ব্যস্ত, তখন এক ব্যক্তি লালুর সামনে দাঁড়িয়ে বলল, আরে, তুই লালু না? আরে লাউল্লা, তুই কী করোস এহানে?

এ যেন পূর্বজন্ম থেকে কেউ এসে দাঁড়িয়েছে সামনে।

লালু চিনতে পারল, এই মোটা মোচওয়ালা ব্যক্তিটি কবিরাজমশাইয়ের দেহরক্ষী যদু। এর মধ্যে তার বেশ বয়স হয়েছে, গলার আওয়াজে আর বাজখাঁই জোর নেই।

সে বেশ নরম গলায় বলল, ওরে লাউল্লা, কী হইছে, তুই জানোস না। আয় আমার সাথে।

তার সঙ্গে যেতে যেতে লালু শুনল, কবিরাজ কৃষ্ণপ্রসন্ন সেন এই পথ দিয়ে রুগি দেখতে যাচ্ছিলেন, তাঁর বয়স হয়েছে, কিন্তু এখনও কোনও আকুল আহ্বান শুনলে তিনি না-গিয়ে পারেন না।

এবারে এক স্থানে যেতে যেতে তিনি ঘোড়া থেকে পড়ে গেছেন।

তেমন কিছু চোট লাগেনি, কিন্তু মনে হয় তার নিম্নশরীরে হঠাৎ পক্ষাঘাত হয়ে গেছে। ঘোড়ায় চড়া দূরের কথা, তিনি দুপায়ে ভর দিয়ে দাঁড়াতেই পারছেন না। এখানে একধারে তাকে একটা কেদারায় বসিয়ে রাখা হয়েছে, কয়েকজন গেছে পালকি কিংবা ডুলি জোগাড় করতে।

কবিরাজমশাইকে অনেকেই চেনে, তাই তাঁকে ঘিরে ছোটখাটো একটা ভিড় জমেছে। কবিরাজমশাইয়ের মুখটা ঝুঁকে গেছে, চিবুক ঠেকেছে বুকে। একদিকের কাঁধ উঁচু, অন্য দিকটা নিচু, কেমন যেন ভাঙাচোরা চেহারা। তাঁর ঘোড়াটা অদূরে বাঁধা।

যদু হুজুর বলে একবার ডাকতেই তিনি মুখ তুললেন।

ঘোলাটে চোখে লালনকে দেখে কয়েক মুহূর্ত দৃষ্টি স্থির করলেন। চিনতে পারলেন ঠিকই।

তিনি ধীর স্বরে বললেন, লালু না? আছিস কেমন?

লালন অতি বিনীতভাবে বলল, আপনার আশীর্বাদে সুস্থই আছি হুজুর।

কবিরাজ বললেন, উঁহু, আমার আশীর্বাদে না। ওরে, তোর কথা আমি প্রায়ই ভাবি। তোরে নিয়া আমার যে ভুল হইছিল, তেমন আর কখনও হয় নাই। শেষ নিশ্বাস পড়ার আগে পর্যন্ত আমি মানুষরে বাঁচাবার চেষ্টা করি, আর তোর আয়ু আছিল, তবু তোরে আমি মৃত্যু-নিদান দিলাম! এখনও সেজন্য আমি নিজেরে ক্ষমা করতে পারি না। তুই কী করোস এখন?

লালু কিছু বলার আগেই যদু বলল, কর্তা, অরে এখন মাইনষে ফকির লালন কয়। অনেক গান করে।

কবিরাজ বললেন, গান! তা কি আমার আর শোনা হবে? আমার সময় ফুরায়ে এসেছে। এখন বাড়িতে গিয়া নিজের বিছানায়… ওরে, পালকি পাইলি?

যদু বলল, আনতে গেছে হুজুর। আইস্যা পড়বে।

কবিরাজের মাথাটা আবার স্কুলে যাচ্ছিল, তিনি জোর করে সোজা করলেন। তারপর বললেন, ফকিরি… শোন লালু, আমার ঘোড়াটা তোরে দিলাম। তোর কাজে লাগবে।

অপ্রত্যাশিতভাবে এমন একটা প্রস্তাব শুনে লালন প্রায় কেঁপে উঠল। সে। বলল, এ কী কইলেন কর্তা, আপনের ঘোড়া।

কবিরাজ বললেন, আমার তো আর কাজে লাগবে না। ইহজীবনের মতন শেষ। তুই নে।

লালন বলল, কর্তা, আপনে একবার কইছিলেন, নিজ উপার্জনে ঘোড়া কিনতে না পারলে…

কবিরাজ বললেন, এই দানে দোষ নাই। বড়রা কিছু দিলে গ্রহণ করা যায়। শাস্ত্রেও আছে, যাচ্ঞা মোঘা বরমধি গুণে নাধমে লব্ধকামাঃ। শাস্তর না কালিদাস? ভুল হয়ে যাচ্ছে…

ঘোড়াটা পাবার পর লালনের মনে হল, এইটাই যেন তার জীবনের পরম প্রাপ্তি। ঘরে ফিরে আসার পর সকলেই হর্ষে মেতে উঠল। একমাত্র কেউকেটা ব্যক্তিরাই এ-অঞ্চলে ঘোড়ায় চেপে ঘোরে। শিমুলতলায় এই নতুন বসতির একমাত্র লালন সাঁই-এর ঘোড়া আছে, সে-ই তো এখানকার যোগ্যতম নেতা!

লালন যতই না না বলে, কেউ আর কর্ণপাত করে না।

লালন তার পূর্বজীবনের কথা বলে না কারুকেই। সেই ঘোড়া চুরির দিনের কথা মনে পড়ে যাওয়ায় সে আপন মনে মুচকি মুচকি হাসে।

ঘোড়াটা পাবার পর থেকে পরিচিত বৃত্তের বাইরে লালনের দূরে দূরে যাওয়া বেড়ে গেল। আগে সে যেত রণ-পা-এ অন্য কয়েকজনের সঙ্গে, এখন অশ্বপৃষ্ঠে সে একা।

এদিকে বহরমপুর, কৃষ্ণনগর, অন্যদিকে খুলনা, ফরিদপুর ঘুরতে ঘুরতে একদিন পাবনায় এসে আর এক ঐশ্বর্যের ভাণ্ডারের সন্ধান পেয়ে গেল। সেই ঐশ্বর্যপতির নাম সিরাজ সাঁই।

একটা আখড়ায় নানান বাউল ও ফকিররা গান গাইছে, সেখানে একপাশে বসে আছেন সিরাজ সাঁই এবং তার পাশে, কী আশ্চর্য না আশ্চর্য, লালনের হারানো বন্ধু সুলেমান মির্জা ওরফে কালুয়া।

লালন প্রায় দৌড়ে গিয়ে সিরাজ সাঁই-এর হাঁটু ছুয়ে কদমবুসি করল।

সিরাজ অবশ্য তাকে চিনতে পারলেন না। হাত তুলে আশীর্বাদ করে বললেন, তুমি কে?

লালন বলল, সাঁই, আপনে আমারে দেখছিলেন ললিতপুর গেরামে রাবেয়া খাতুনের কুটিরে। আমি মুমূর্ষ ছিলাম, আপনি আমারে বাঁচায়েছিলেন।

সিরাজ বললেন, মনে পড়ছে। তোমার মসুরিকা রোগ হইছিল। আমি তো তোমারে বাঁচাই নাই। তোমারে বাঁচায়েছিল রাবেয়া বেগম।

লালন বলল, পুণ্যবতী রাবেয়া বেগম আমার প্রাণ বাঁচায়েছিলেন ঠিকই, আর আপনে আমারে নবজীবন দান করেছিলেন। আপনার দর্শন পেয়েই আমার জ্ঞানচক্ষু খুলে যায়। অবশ্য পুরাটা খোলে নাই, একটা চক্ষু শুধু।

সিরাজ বললেন, বসো। পরে কথা হবে।

এই গান-বাজনার মাঝখানে বেশি কথা বলা উচিত নয়। লালন একপাশে জায়গা করে নিয়ে বসে ফিসফিস করে কালুয়াকে বলল, কেমন আছ, দোস্ত?

কালুয়া ফুঁসে উঠে বলল, কে তোর দোস্ত? আমি তোরে চিনি না। আমি আল্লার বান্দা, আমার আর কেউ নাই!

কাছেই এক কুটিরে সিরাজ সাঁই-এর বর্তমান অবস্থান। গানের পালা শেষ। হলে তিনি লালনকে সঙ্গে ডেকে নিলেন। আর বিনা আহ্বানেই কিছু লোক চলল এদের পিছনে পিছনে।

ঘরখানি বিশেষ বড় নয়, এত মানুষের ঠাঁই হওয়া মুশকিল, তবু সবাই। বসল ঘেঁষাঘেঁষি করে। মাঝখানে একটা মাদুরে বসে সিরাজ লালনকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এখন কী করো?

লালন বলল, তেমন কিছু না হুজুর। এখন আর সমাজের মইধ্যে থাকি না। জঙ্গলের মইধ্যে বসতি করেছি, এই কালুয়া ছিল সঙ্গে।

কালুয়া হুংকার দিয়ে বলল, না, ছিলাম না। আমি কোথাও ছিলাম না। এখনও নাই। এখানেও নাই!

সিরাজ সস্নেহে তার পিঠে চাপড় দিয়ে বললেন, এই বদ্ধ পাগলটারে নিয়ে কী করি বলো তো! কখনও ও মিজেরে কয় আল্লার বান্দা, আবার কখনও কয়, আমি কালীমায়ের সন্তান! থাউক, আছে থাউক। তুমি সেই জঙ্গলে একা থাকো?

লালন বলল, না হুজুর, একে একে অনেকেই সেখানে এসে ঘর বেঁধেছে। আমারই মতন সমাজ থেকে খেদানো, ধর্ম থেকে খেদানো, গরিব-দুঃখী, ছোটলোক-মোটোলোক। হিন্দু-মুসলমান দুই-ই আছে। আমরা বেশ সুখেই আছি জঙ্গলবাসী হয়ে।

সিরাজ জিজ্ঞেস করলেন, হিন্দু-মুসলমান দুই-ই আছে? কোনও কাজিয়া হয় না?

লালন বলল, কিছুই হয় না। যার যার ধর্ম আছে, কিন্তু জাত ধুয়ে ফেলেছি। ছোঁয়াছানি নাই।

সিরাজ বললেন, অপূর্ব। এভাবেও যে মহানন্দে বাঁচা যায়, তা কেন অনেকে বোঝে না। ধর্ম কি অন্যের সঙ্গে কোন্দল করার জন্য, না মানুষকে ভালোবাসার জন্য? আমার ধর্ম সর্বোত্তম আর অন্য ধর্মের সকলে পাপী, এ। কি কোনও ধর্ম শিখায়? না, না, না! এমন যারা ভাবে, তারাই পাপী।

একজন লোক বলে উঠল, কিছুদিন আগে কুমারখালির কাছে ভোরাই নদীতে লালন ফকির নামে একজন তার দলবল নিয়ে পানিতে ঝাঁপায়ে পড়ে এক সাহেবের জাহাজ রুখে দিয়েছিল শুনেছি, আপনি কি সেই লালন ফকির?

লালন বলল, প্রায় এক হাজার মানুষ নিজে নিজেই জলে ঝাঁপ দিয়েছিল, আমি তাদের একজন মাত্র, আর কিছু না।

সেই কাহিনিটা আর একটু বিস্তৃতভাবে শুনে নিয়ে সিরাজ জিজ্ঞেস করলেন, লালন, তোমার সাধনা কী?

লালন বলল, আমার তো জ্ঞান বুদ্ধি কিছু নাই, সাধনাও নাই। আমার খালি মনে হয়, এই যে মানব দেহখানা, এটার মইধ্যেই যেন গোটা বিশ্ব রয়েছে। এ এক আজব রংমহল। এই আজব কারখানার মধ্যে একজন কেউ আছে, টের পাই, কিন্তু তারে দেখতেও পাই না, বুঝতেও পারি না।

সিরাজ বললেন, তবে তো তুমি ঠিকই পথ ধরেছ। মহাবিশ্ব কিংবা আলসে বাগীর, সেখানে আল্লাহর দরবার, যেমন ধরো আলিপুরের কাছারি, এই মানব দেহের মধ্যেও তা আছে।

লালন ব্যাকুলভাবে বলল, সাঁই, আর একটু বুঝায়ে কন।

সিরাজ বলল, বুঝতে হবে না। যার বোঝার সে নিজেই বুঝবে। তুমি যে রংমহলের কথা বললে, তাতে কিন্তু তালা লাগানো আছে। ভিতরে প্রবেশ করতে গেলে সেই তালা খোলা শিখতে হয়।

লালন ও সিরাজের কথোপকথনে অন্যরা ধৈর্য ধরতে পারল না।

একজন বলে উঠল, সাঁইজি, আমার একটা প্রশ্ন আছে। আমরা এই যে। গান গাই, এইজন্য অনেক মোল্লা-মুরুব্বি রাগ করে, মারতেও আসে। কয় যে মোছলমানের গান গাওয়া গুনাহ! সত্যিই কি তাই? সম্রাট আকবরের সভায় তানসেনের নাম শুনেছি… তবু এমন কথা…

সিরাজ বললেন, মোল্লা-মুরুব্বিরা যদি সংগীতরে হারাম কয়, তর্ক করতে যাইও না। তর্কে তো কোথাও পোঁছোনো যায় না। মেনে নেবে। নিজের কান ধরে বলবে, হুজুর গুস্তাকি হইছে, মাফ করেন। আর আপনার সামনে গাইব না। তারপর নিজের মনে মনে গাইবে, সারা তৃষ্ণার্ত তাদের সংগীত রূপ সুধা বিলাবে।

লোকটি আবার বলল, আপনার কাছ থিকা উত্তর তো পাইলাম না। সংগীত কি হালাল না হারাম?

সিরাজ বললেন, তর্কের জন্য না, তোমার নিজের জন্য জেনে রাখো। হাদিসে নিষেধ নাই। একটা কিস্যা শুনো৷ এক ইদের দিনে দুজন বাদি দফ বাজিয়ে গান করছিলেন বিবি আয়েশা সিদ্দিকার সামনে। হজরত রসুল সেখানে শুয়ে ছিলেন। একসময় আবু বকর সেখানে ঢুকে অবাক হয়ে বললেন, এ কী, আল্লাহ রসুলের ঘরে শয়তানের গান? তিনি বকাবকি করতে লাগলেন বাঁদিদের। তখন হজরত পাশ ফিরে বললেন, ইদের দিনে দফ বাজিয়ে গান মোবাহ, অর্থাৎ নির্দোষ। কোনওরকম কু-আসক্তি না থাকলেই হল। আরও একটা ঘটনা শুনবা?

হুঁকোয় দুটান দিয়ে সিরাজ বললেন, হাদিশ শরিফে আছে, ইদের দিনে এক মসজিদের মধ্যে হাবশি গোলামরা মহানন্দে নাচ-গান করছিল। পাশ দিয়ে যেতে যেতে তা শুনে রসুল দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন। সঙ্গে ছিলেন বিবি আয়েষা। রসুলের প্রসারিত এক পবিত্র বাহুর ওপর থুতনি রেখে আয়েষা সেই নাচ-গান-কৌতুক উপভোগ করতে লাগলেন। তা হলেই তোমরা বুঝে নাও!

অন্য একজন বলল, সাঁই, আর সেই হজরত উমার রা-এর কাহিনিটা?

সিরাজ বললেন, হুঁ, সে কাহিনিও খুব মর্মস্পর্শী। খলিফাদের আসলে নানাবিধ পাপ-ব্যাবসা বন্ধ করার জন্য নাচ-গানের ওপরেও নিষেধ জারি করা হয়েছিল। এক রাতে হজরত উমার রা একা হেঁটে যাচ্ছিলেন মদিনার পথ দিয়ে। হঠাৎ এক বাড়ির ভিতর থেকে সংগীতের সুর ভেসে এল তাঁর। কানে। তিনি ভাবলেন, বুঝি এখানে গোপনে পাপ ব্যাবসা চলছে। তিনি ধড়াম করে দরজা ঠেলে ঢুকে পড়লেন ভিতরে। গিয়ে দেখলেন, আর কেউ নাই, শুধু একটি অল্পবয়সি সুন্দরী যোবতি আপন মনে গান গেয়েই চলেছে। হজরত গর্জন করে বললেন, তুই কে রে? খলিফার নির্দেশ অমান্য করে গান করিস? তখন সেই যোবতি তেজের সঙ্গে কইল, আপনে ক্যান কোরান শরিফের নির্দেশ অমান্য করি বিনা অনুমতিতে অন্দরমহলে এসে ঢুকলেন? কোরানে নির্দেশ আছে, অপরের কোনও গৃহে প্রবেশ করতে গেলে সদর দরজায় দাঁড়াতে হয়, যার সঙ্গে দেখা করতে চান, আগে তাকে সালাম দিতে হয়। নিজে আপনি আল্লাহর নির্দেশ অগ্রাহ্য করে আমাকে খলিফার নির্দেশ নিয়ে হুমকি দিতেছেন?

এমন বকুনি খেয়ে হজরত-এর চৈতন্য হল। তিনি তখন বিনীতভাবে বললেন, মা, আমার দোষ হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তুমি কেন গান গাইছিলে?

সেই কন্যা তখন-জানাল যে, তার বিবাহের পনেরো দিন পরই তার স্বামী চলে গিয়েছে জিহাদে। কবে ফিরে আসবে তার ঠিক নাই। তার মনের অবস্থা আর তো কেউ বুঝবে না। তাই গান গেয়ে সে নিজেকেই সান্ত্বনা দিতেছে।

হজরত তখন লজ্জিত হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন। তার কন্যা সুমনীনরে। ডেকে জিগাইলেন, কও তো মা, নারীরা কতদিন পতি-বিরহ সইহ্য করতে পারে? কন্যা উত্তর দিলেন বড়জোর তিন মাস, তারপর তার মর্মবেদনা অসইহ্য হইয়ে যায়।

তা শুনে হজরত উমার রা ঘোষণা করে দিলেন, এখন থেকে আর কোনও সৈনিক তিন মাসের বেশি বাইরে থাকবে না। ছুটি নিয়ে বাড়িতে আসতে পারবে।

প্রথম যে-ব্যক্তিটি প্রশ্ন করেছিল, সে বলল, আঃ, আপনে আমারে বাঁচাইলেন। মনের মধ্যে একটা অপরাধবোধ ছিল। এখন মুক্ত কণ্ঠে গান গাইতে পারি। আসেন আর কথা নয়, সকলে একখান গান ধরো।

কেউ কিছু শুরু করার আগেই কালুয়া বিকট চেঁচিয়ে গেয়ে উঠল, এবার কালী তোমায় খাব/ খাব খাব গো দীন দয়াময়ী/ এবার কালী তোমায় খাব!

সকলেই কয়েক মুহূর্ত নীরব।

লালন রীতিমতন ভয় পেয়ে বলে উঠল, এ কী গান? চুপ, চুপ, চুপ!

তাতে কান না দিয়ে কালুয়া আরও গাইল: ডাকিনী যোগিনী দুটা তরকারি বানায়ে খাব/ তোমার মুণ্ডমালা কেড়ে নিয়ে অম্বলে সম্ভার চড়াব/ এবার তুমি খাও কি আমি খাই মা দুটোর একটা করে যা…

লালন ব্যাকুলভাবে সিরাজের জানু চেপে ধরে বলল, সাঁইজি, অরে থামান। এমন গান শুনলে হিন্দুরা যে ওকে পিটায়ে মেরে ফেলবে।

সিরাজ শান্তভাবে বললেন, ওরে আমি থামাব কী করে, ও কি কারুর কথা শোনে? ও আছে নিজের খেয়ালে–

লালন আবার বলল, কিন্তু হিন্দুরা…

সিরাজ বললেন, মারলে মারবে। আমি বাঁচাব কী করে। না-জেনে বুঝেও তো অনেক মানুষ অনেক নৃশংস কাজ করে। অনেক হিন্দু জানেই না যে, এ-গান খুব বড় হিন্দু সাধকেরই রচনা। তাঁর নাম শ্রীরামপ্রসাদ সেন। এ-গান আমরা বুঝবও না। প্রতিটি কথার মধ্যে অনেক উচ্চস্তরের ভাব আছে। রূপক আছে। সাধনার অনেক ঊর্ধ্ব মার্গে না-উঠলে এসব গুহ্যতত্ত্ব বোঝা যায় না।

কালুয়া এখন দুহাত তুলে নেচে নেচে গাইছে: যদি বলো কালী খেলে কালের। হাতে ঠেকা খাব/ আমার ভয় কী তাতে কালী বলে কালেরে কলা দেখাব…

সিরাজ সহাস্যে জিজ্ঞেস করলেন, এর অর্থ বুঝলে কিছু?

লালন বলল, বাপ রে বাপ। কী সব ভয়ংকর কথা, বুঝে আমার কাজ নাই।

সে উঠে গিয়ে কালুয়াকে জড়িয়ে ধরে ব্যাকুলভাবে বলতে লাগল, ওরে থাম, থাম। যথেষ্ট হয়েছে, আর না!

কালুয়ার গায়ে যেন এখন অসুরের শক্তি। সে এক ঠেলা দিয়ে লালনকে ফেলে দিয়ে বলতে লাগল, দূর হ! তুই কে রে? তোর গুষ্টির পিন্ডি চটকাব আমি।

লালন হাত জোড় করে দারুণ মিনতি করে বলল, শান্ত হ, শান্ত হ। চল আমার সঙ্গে, অন্তত কয়েকটা দিন থেকে আসবি। ওখানে সকলেই তোরে দ্যাখতে চায়।

 কালুয়া তেড়ে এসে জোরে জোরে লালনকে লাথি কষাতে কষাতে বলতে লাগল, যাব না, যাব না। কোথাও যার না। তোরে চিনি না। কাউরে চিনি না।

 তারপর সে একটা সম্পূর্ণ অন্য গান ধরল: মৃত্তিকার ঘট মধ্যে এ তিন ভুবন/ মৃত্তিকার পাঞ্জরে আল্লার সিংহাসন…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *