এবার বড়দিনের আমোদ উল্লাসের পরিকল্পনা করা হল নতুন রকম।
ধৰ্মগত আচারগত নিয়ম অনুষ্ঠান যথারীতি পালন করা তো আছেই, নতুনত্বের ব্যবস্থা হল সকলে মিলেমিশে আমোদ ফুর্তি করার ব্যাপারে।
গতবার ক্লাবে শিল্প-প্রদর্শনী, ম্যাজিক এবং সিনেমা দেখাবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল নাচ গান ও বিশেষ খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা তো ছিলই।
কিন্তু কিছুতেই যেন জমানো গেল না একদিনের একবেলার আনন্দ করা।
সমস্ত উৎসব অনুষ্ঠান কেমন যেন একটা প্রাণহীন হালকা আলগা ব্যাপারে পরিণত হয়ে গেল।
অনেক পরামর্শের পর ঠিক করা হয়েছে যে, এবার গহন গভীর বনের ভিতর গিয়ে বনভোজন করা হবে।
বনের নামে নিজেদের মনকে চোখ ঠারার ব্যাপার হবে না, শহরের পাশের শহরতলির গায়ের মতো বনের পাশের ঝোপঝাড়ের জঙ্গলে গিয়ে কাজ সেরে এসে মনে করা হবে না যে, অরণ্যকে জয় করে আসা গিয়েছে।
খাঁটি খ্রিল যাতে পাওয়া যায় সেজন্যে যাওয়া হবে দুর্গম অঞ্চলে, সত্যিকারের বনের বুকে।
হিংস্র ভয়ঙ্কর প্রাণীদের যেখানে আসল আস্তানা।
নিরাপত্তার ব্যবস্থা অবশ্য করা হবে ভালোভাবেই।
তাদের নিজস্ব বন্দুক তো থাকবেই। তাছাড়াও চার-পাঁচজন পাকা শিকারি বন্দুক নিয়ে সঙ্গে যাবে।
বয় খানসামা যাবে দশ-বারজন।
সুতরাং ভয়ের কোনো কারণ নেই।
বড়মিঞা থেকে শুরু করে বনের সমস্ত হিংস্র প্রাণী দূরে ঝোপঝাড়ের আড়ালে লুকিয়ে থাকবে।
ইভা বলে, লুকিয়ে থাকবে? অত ভীরু নয় রয়েল বেঙ্গল টাইগার। নরম মাংসের ঝাঁক দেখে তেড়ে আসবে, মিস্টারদের গুলি ফস্কে যাবে, আমাদের ঘাড় মটকাবে।
আগের দিন বিকালের দিকেই বনভোজনের জল্পনা-কল্পনা নিয়ে ক্লাব-বাড়ি মুখর হয়ে ওঠে–মেয়েরা অনেকে এখন থেকেই বনাভিসারের থ্রিল অনুভব করতে শুরু করেছে। বনের চেয়ে বনবাসী বাঘের ভয়টাই অনেকের মধ্যে দেখা যায়।
মিসেস বাগচী বলে, ঈশ্বরকে সঙ্গে নিলে হত না? বন-জঙ্গল বাঘ-ভালুকের ব্যাপার ও খুব ভালো জানে। কি রকম হাতের তাকদুজনের রাইফেল ফস্কে গেল, ওর গুলিতে বাঘটা মরল।
মিসেস বাগচী বড়ই বাঁচালিকা, হালকা আবোল-তাবোেল কথা সব সময় মুখে লেগেই আছে। তার কোনো কথায় সাধারণত কেউ কান দেয় না; কিন্তু তার আজকের প্রস্তাবটি প্রায় সকলেই সমস্বরে সমর্থন করে।
বিশেষভাবে মেয়েরা।
মিসেস জনসন বলে, ওকে নিলে দোষ কি? সেটির দিকটা তো আছেই, তাছাড়া খাঁটি দেশী শিকারি কু দিয়ে ওরা নাকি কিভাবে হরিণের পাল ভুলিয়ে ডেকে এনে শিকার করে। মারতে চাই না, হরিণের পাল দেখতে চাই।
মেদবহুল দেহ নিয়ে জনসন সর্বদাই অস্বস্তি বোধ করে। জনসনের বুড়ি মায়ের মতত শুকনো শীর্ণ নয় কিন্তু জুনিয়ার মিসেস জনসনের প্রায় তারই মতো লিকলিকে চেহারা।
জনসন বলে, ঈশ্বর যাবে বৈকি নিশ্চয় যাবে। আরো কয়েকজন দেশী শিকারিও যাবে।
একজন মন্তব্য করে, ঈশ্বরের বন্দুক নেই, লাইসেন্স নেই।
জনসন কথাটা তুচ্ছ করে উড়িয়ে দিয়ে বলে, বন্দুকের কি অভাব আছে? আমার পুরোনো শটগানটা না হয় ওকে দেব।
পরদিনের অরণ্যাভিযানের জন্যে শিকারি হিসাবে ঈশ্বরকে ভাড়া করে ফেলার জন্য সাইকেল চেপে লোক রওনা হয়ে যায়। সে যখন ফিরে আসে, সন্ধ্যা উত্তীর্ণ হয়ে গিয়েছে।
তার রিপোর্ট শুনে সকলে থ বনে যায়।
তাদের সঙ্গে শিকারি হিসাবে বনে যেতে ঈশ্বর সরাসরি অস্বীকার করেছে–লাখ টাকা কবুল করলেও সে যাবে না। লাইসেন্স বাতিল করে বন্দুক কেড়ে নিয়ে শিকারি মহলে তাকে অপদস্থ করা হয়েছে–সকলের কাছে তার মাথা কাটা গিয়েছে।
মিসেস জনসন জিজ্ঞাসা করে, ডিয়ার, কাল সকালবেলাই আমাদের রওনা দিতে হবে। ঈশ্বরের বন্দুক আর লাইসেন্সের ব্যবস্থা কি করে হবে?
জনসন হেসে বলে, হবে হবে, সব ঠিক হয়ে যাবে।
এভাবে বেইজ্জত করার পর সাহেবরা কোন মুখে আবার তাকে ডেকে পাঠায়!
খুব নাকি গরম মেজাজ দেখিয়েছে ঈশ্বর!
রবার্টসন রেগে আগুন হয়ে ঘোষণা করে যে, ফ্যাক্টরি খুললেই ঈশ্বরকে সে ফায়ার করবে।
জনসন তাকে ধমক দিয়ে বলে, শাট আপ!
তখন রামসুখলাল ধীরভাবে মৃদুস্বরে আরো একটা সম্ভাবনার কথা জানায়। যে কজন দেশী শিকারিকে আগে থেকেই সঙ্গে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তারাও শেষ পর্যন্ত এসে পৌঁছবে কিনা সন্দেহ আছে।
মিসেস জনসন আঁতকে উঠে বলে, ও মাই গড়, আমি তোমাদের পিকনিকে যাচ্ছি না।
ইভা বলে, আমিও না। বীরপুরুষদের ভরসায় বনে মজা করতে গিয়ে বাঘের পেটে যাই আর কি!
মিসেস বাগচী খিলখিল করে হেসে ওঠে। বাঘের পেটে যাওয়া কম মজা নাকি? তবে আমি যেতে রাজি নই!
জনসন ধীরভাবে বলে, ঈশ্বর অন্যায় কথা বলে নি–শিকারির একটা প্ৰেষ্টিজ আছে। বৈকি।
যাই হোক তোমরা ভেব না, ঈশ্বর আমাদের সঙ্গে যাবে, অন্য শিকারিরা যাবে। আমি ব্যবস্থা করছি।
রাতারাতি যেন মন্ত্রবলে অঘটন ঘটে যায়। রাতারাতিই বা কেন। সন্ধ্যায় জনসন মেয়েদের প্রতিশ্রুতি দেয় যে, ঈশ্বর বন্দুক ফিরে পাবে এবং অতিরিক্ত রক্ষী হিসেবে তাদের সঙ্গে বনভোজনে। যাবে। রাত দশটা নাগাদ থানা থেকে লোক তার ঘরে গিয়ে হাজির হয়।
পুলিশের বড়কর্তা এবং জেলার বড় হাকিমও ক্লাবের মেম্বার, সুতরাং বন্দুক বাজেয়াপ্ত করার পরোয়ানা বাতিল করার হুকুম জারি করানো এবং বন্দুকটা ফিরিয়ে আনতে সেই রাত্রেই ঈশ্বরকে থানায় পাঠানোর ব্যবস্থা করা কঠিন হয় না।
ডাক শুনে ডিবরি জ্বেলে বাইরে বেরিয়ে থানার সত্যচরণকে সাধারণ বেশে একা দেখে খানিকটা স্বস্তি বোধ করলেও ঈশ্বর শঙ্কিতভাবে জিজ্ঞাসা করে, কি হয়েছে?
শঙ্করবাবু থানায় একবারটি তোমায় নেমন্তন্ন করেছেন।
কি আবার করলাম? শিকারে ভাড়া খাটতে না চাইলে থানায় যেতে হয় নাকি?
আরে না না, এবার কিছু কর নি। তোমার বরং কপাল খুলেছে যা কিছু করেছিলে সব মাপ হয়ে গিয়েছে। বন্দুকটা ফেরত পাবে, কাল সকালে সাহেবদের পার্টির সঙ্গে শিকার করতে যাবে।
ঈশ্বর ভাবে, স্বপ্ন দেখছে না জেগে আছে? তেজ দেখিয়ে চোটপাট করে ক্লাবের লোককে ভাগিয়ে দেবার জন্যে তাকে শায়েস্তা করার বদলে ক্লাবের সাদাকালো সাহেব বাবুরা তার মান রেখে মন যোগাতে চাইছে!
বাইরে কনকনে ঠাণ্ডা। শুধু ঘেঁড়া ফতুয়াটা গায়ে দিয়ে দুয়ার খুলে বাইরে এসে দাঁড়িয়ে তার রক্ত যেন জমে যাচ্ছিল।
সত্যচরণের গলা থেকে পা পর্যন্ত ঝোলানো লোম-ওঠা কালো মোটা গরম জামা।
ঈশ্বর সংশয়ভরে জিজ্ঞাসা করে, থানায় ধরে নিয়ে গিয়ে মারধর হবে না তো?
সত্যচরণ বিড়ি ধরানো স্থগিত করে হেসে বলে, আরে না না, পাগল নাকি? মারধরের জন্যে দরকার হলে কি এরকম খাতির করে ডাকতে আসতামঃ সঁচ-সাত জনে এসে ধরে বেঁধে নিয়ে যেতাম।
বিড়িটা ধরিয়ে বলে, দেরি করিস না। শঙ্করবাবু চটে যাবে।
গায়ে কিছু চড়িয়ে আসি। কী ঠাণ্ডা পড়ছে বাপ রে বাপ!
কনকনে শীতের রাত্রেও ঈশ্বরকে পশু মারতে বার হতে হয়েছে। কখনো নিজের প্রয়োজনে, কখনো শিকার পার্টির ভাড়াটে হয়ে।
বাপের আমলের একটা গরম জামা ছিল, ঈশ্বর একটা কম্বল জাতীয় চাদর কিনেছে। চাদরটা জীর্ণ হয়ে এলেও মোটামুটি ঠিক আছে। গরম জামাটা পোকায় কেটে ফুটো করে দিয়েছে এবং সব বোতাম গিয়েছে খসে। গৌরী মাথার দুটো সস্তা তামার কাটা খুলে তার জামার বুকটা আটকে দেয়। তার খোপা পিঠে এলিয়ে পড়ে।
থানার দিকে চলতে চলতে সত্যচরণ বলে, ভালুকের মতো দেখাচ্ছে।
ঈশ্বর বলে, বাঘ-ভালুকের দেশে ভালুক না সেজে উপায় কি!
খানিকক্ষণ চুপচাপ হেঁটে থানার সদর বারান্দার ডে-লাইটের আলোটা চোখে পড়ার পর সত্যচরণ বলে, আমায় কিন্তু কিছু দিতে হবে ঈশ্বর।
ঈশ্বর বলে, গায়ের খানিকটা মাংস খুবলিয়ে নিতে পার।
তা বলছি না। তোমার কিছু নেই সেটা জানি। বলছি কি, কাল অনেক কিছু পাবে। সাবদের বাবুদের ক্লাবের পিকনিক–সোজা ব্যাপার নয়। মজা তো লুটবেই, বাড়তি অনেক কিছু পাবে। আমি এটা পাইয়ে দিচ্ছি–আমায় যেন ভুলো না।
আগে তো পাই।
পাবে বৈকি, নিশ্চয় পাবে। ভালোমতো যাতে পাও সেদিকে, মোর নজর রইবে ভাই।–বলে সত্যচরণ নিজের বুকটা ঠুকে দেয়।
থানায় গিয়ে তার জমা বন্দুকটা ফেরত নিয়ে ঈশ্বরকে ক্লাবে যেতে হয়।
রামসুখলালের কাছ থেকে জেনে বুঝে নিতে হয় সকালে কখন আসবে, কোথায় যাবে, কি করবে ইত্যাদি খুঁটিনাটি সমস্ত ব্যাপার।
রামসুখলাল বলে, আসল বনের ভিতর যাবার ঝোঁক চেপেছে।
অ্যাভেঞ্চার কাকে বলে জান, কখনো নাম শুনেছ? এ হল একরকম ক্ষ্যাপামি, বোকার মতো যেচে গিয়ে কষ্ট করা, বিপদে পড়া। ওই যে বলে না সুখে থাকতে ভূতে কিলোয়ঠিক সেই ব্যাপার। যাক গে, বনে যাবার ঝোঁক চেপেছে, নিয়ে যেতে হবে। এ দায়টা তোমার। গভীর বনে নিয়ে যাবে কিন্তু বিপদ যেন না ঘটে।
রামসুখলাল সিগারেটের মতো সরু একটা সিগার ধরিয়ে হেসে বলে, সত্যি কথা বলি ভাই, রাতারাতি সবাই তোমায় স্পেশাল অফিসার বানিয়ে দিয়েছে। কোন পথে বনের ভিতরে কোথায় যাওয়া হবে, কিভাবে যাওয়া হবে–সব তুমি প্ল্যান করে ঠিক করবে। লেডিজরা চান যে পিকনিকও করবেন, বনটাও ভালো করে দেখে আসবেন।
ঈশ্বর বলে, দফা সেরেছেন আমার।
রামসুখলাল বলে, দরকার মনে করলে দু-চারজন লোকও তুমি সঙ্গে নিতে পার। ওদের দেনাপাওনা তুমি যেমন বলবে আমি তেমনি মিটিয়ে দেব। সকলের ফুর্তির ব্যাপার, পাঁচ-দশ টাকার জন্যে যে আটকাবে না সে তো বুঝতেই পারছ।
ঈশ্বর বলে, দু-চারজন বাড়তি লোক লাগবে বৈকি। সত্যি সত্যি বনের ভেতরে যেতে হলে ওদের ছাড়া চলবে না। মোরা নমাসে ছমাসে বনের মধ্যে যাই, ঠিক পথ খুঁজে বেছে নিবার সাধ্যি আছে মোদের? আজ যে পথে দিব্যি এগোনো যায়, মাসেক পরে সে পথের চিহ্ন খুঁজে মেলা দায়। পথ পেলেই বা কি?–হোথায় হামা দিয়ে, হোথায় বারের মতো এ গাছে চড়ে আরেক গাছের ডাল ধরে ঝুলে, দু পা এগোতে প্রাণান্ত। মেয়েদের কথা বাদ দেন, আপনি আমি ব্যাটা ছেলেরা গুলোর জ্বালায় হিমশিম খেয়ে যাব সুখলালবাবু।
রামসুখলালের নিশ্বাস ফেলার সময় ছিল না, তবু সে দাঁড়িয়ে থেকে কৌতূহলের সঙ্গে জিজ্ঞাসা করে, গুলো? সে আবার কি?
ঈশ্বর চমৎকৃত হয়ে বলে, শুললা জানেন না? সজারুর কাটা দেখেছেন? ওইরকম দেখতে বড় গাছের গোড়া থেকে সিধে ওঠে–চাদ্দিক ছেয়ে যায়। আঃ, দেখতে কি সুন্দর সুখলালবাবু। কিন্তু শুলোর জ্বালায় চলতে ফিরতে বড় মুশকিল হয়।
গাছকে খাড়া রাখতে, বনকে টিকিয়ে রাখতে শুলোর কি ভূমিকা ঈশ্বরেরও তা জানা ছিল না, রামসুখলালকে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে বলবে কি! ভিজে নরম মাটিতে বড় ভারি গাছের শিকড় যে শুলোর জন্যে শক্ত অবলম্বন পায়, সামান্য ঝড় বাতাসেই গাছ উপড়ে গিয়ে কাত হয়ে পড়ে না, কজনেই বা এ রহস্য জানে।
খুব ভোরে রওনা দেবার কথা ছিল কিন্তু মেয়েদের নিয়ে কারবার তো, প্রথম ব্যাচ তৈরি হতে হতেই দিগন্তে গাছের আড়াল ছেড়ে সূর্যের আবির্ভাব ঘটে যায়। টিম্বার কোম্পানির লঞ্চ দুই দফায় সকলকে নদীর ওপারে ময়নাদলে পৌঁছে দেয়।
সত্যিকারের বনে বনভভাজন করতে যাবে বলেই কি মেয়েরা এমন বিচিত্র বেশ ধারণ করেছে, মেমসায়েবদের আয়ারা পর্যন্ত?
অন্য সকলের চেয়ে রংদার জমকালো শাড়ি জামা পেলে খুশি হয়, একটু অহঙ্কারও জাগে কিন্ত নিজেদের মধ্যে শাড়ি জামার পাল্লা চালাবার আগ্রহ তাদের বিশেষ নেই-আসলে পাল্লা চালায় তারা যাদের চাকরানী তারাই। যে যা-ই মনে করুক, আয়াদেরও কঠোর নীরস জীবন যাত্রা। দিবারাত্র অন্য নারীর ছেলেপুলে সামলে তার মন যুগিয়ে চলা একটা সংসারে স্ত্রী এবং মার কত আসল দায় যে তাদের নিজেদের ঘাড়ে নিয়ে পালন করতে হয়। এ কাজটাই স্ত্রীলোকের জীবনের অভিশাপের মতো।
মেয়েরা সবাই শাড়ি পরেছে। কত দামি কী বিচিত্র শাড়িই যে সবাই গায়ে জড়িয়েছে, রঙিন পেলবতার আলগা ছন্দে লীলায়িত হতে চায়, রঙ্গময়ী প্রকৃতিকে পরাস্ত করতে চায়।
কিন্তু আশ্চর্য এই, মিসেস জনসনের অল্পবয়সী আয়া আমিনার সস্তা একরঙা ছাপা শাড়িটাই যেন সকলের সমস্ত শাড়ির দৰ্প হরণ করেছে।
মিসেস জনসনের গায়ে কায়দা করে জড়ানো কলকাতার তৈরী কাশ্মিরি শাড়িটা পর্যন্ত যেন। খেললা হয়ে গিয়েছে আমিনার সস্তা শাড়িটার কাছে!
আমিনার দেহে তাজা নবযৌবনের রঙে রঙিন হয়ে কি তার সস্তা শাড়িটা হারিয়ে দিয়েছে রংচঙা এতগুলি দামি শাড়িকে!
একমাত্র বনানীর শাড়িটিকে ছাড়া।
কী চমকার যে মানিয়েছে শাড়িটা তার বান-ডাকা নদীর মতো উথলে-ওঠা উছলে-পড়া যৌবনের মোটাসোটা গড়নের জমকালো দেহটায়।
বার বার সকলের নজর আমিনা আর বনানীর দিকে যায়।
ইভা সাধারণ একটি দামি সিল্কের শাড়ি পরে এসেছিল—তার রূপের তুলনা মফস্বলের এই ছোট শহরের ধারেকাছে মিলবে না-তাই কি তার শাড়ির শোভায় রূপ বাড়াবার আগ্রহ নেই?
ইভা সরলভাবে সাগ্রহে বনানীকে জিজ্ঞাসা করে, এ শাড়িটা আবার কবে কিনলে?
বনানী জবাব দেয়, এটা আমার বিয়ের শাড়ি, ট্রাঙ্কে তোলা ছিল।
ক্লাবের পক্ষ থেকে আগেই তিনজন দেশী শিকারি ঠিক করে ফেলা হয়েছিল। ঈশ্বর অন্য ধরনের আরো দুজন পেশাদার শিকারিকে চুক্তি করে সঙ্গে এনেছিল! নিজাম সেখ আর গজেন দাস।
ওদের সম্বল গাদা বন্দুক। তা হোক।
কয়েকটা দামি রাইফেল ও ভালো দোনলা বন্দুক সঙ্গে যাচ্ছে। বন্দুকের অভাবে বিপদে পড়তে হবে না।
ওরা দুজন পথ দেখিয়ে গহন বনে নিয়ে যেতে গাইডের কাজ করবে–বন ওদের খুব ভালো রকম চেনা।
ঈশ্বরের চেয়ে বেশিরকুম চেনা কিনা কে জানে। ঈশ্বর বলে যে বনে ওদের নিত্যি যাতায়াত, তার চেয়ে বন ওদের ঢের বেশি জানাচেনা বৈকি।
এটা ঈশ্বরের বিনয় কিনা বোঝা যায় না।
জল্পনা কল্পনা হয়েছিল অনেক, মেয়েরা বার বার জোরগলায় অসীম ধৈর্য ও দুঃসাহসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, বন দেখতে যখন যাওয়া হচ্ছে তখন ভালোভাবে বনের ভিতরটা না দেখে তারা ফিরবে না।
প্রান্তদেশের আলগা ছাড়াছাড়া অংশটুকু বাদ দিলে আসলে বনের মধ্যে সিকি মাইলও এগোনো হয় কিনা সন্দেহ।
জীবিকার সন্ধানে মানুষ নাকি প্রতিদিন গভীর বনে প্রবেশ করে–এই নাকি তাদের নিত্যি চলাচলের পথ! ঝোপ ঠেলে, গাছের ডাল সরিয়ে, কঁটা লতার বাঁধন থেকে শাড়ি ছাড়িয়ে, মাঝে মাঝে প্রায় হামা দেবার মতো কুঁজো হয়ে মানুষ কতদূর এগোতে পারে।
শীতের কুয়াশাবিহীন উজ্জ্বল দিন, কিন্তু বন যেন রাত্রিকে গাঢ় ছায়ার রূপ দিয়ে বুকে ধরে রেখেছে, স্থানে স্থানে প্রায় অন্ধকার।
অনেকগুলি টর্চের আলো জ্বললে কি হবে, গা তবু শিরশির করে।
মিসেস বাগচী বলে, বাবা, দুমকার ওদিকেও শালবন দেখেছি, সে তো এরকম নয়!
বনানী বলে, এ যে সুন্দরী বন–কিরকম সুন্দরী টের পাচ্ছ না?
খানিক এগিয়েই পাওয়া গিয়েছিল একটু ফাঁকা স্থান।
গাছ সেই স্থানটুকুতে গায়ে গায়ে জড়িয়ে ঘন হয়ে ওঠে নি, লতায় পাতায় চালার মতো আচ্ছাদন তৈরি করে নি।
অনেকগুলি ফাঁক দিয়ে ঝলক ঝলক রোদ ঘরের লেপা মেঝের মতো সমতল মসৃণ মাটিতে এসে পড়েছে। এদিকে প্রকাণ্ড একটা ইটের স্থূপ, তার সামনেই কচুরিপানা আর সুন্দর নীল ফুলে। ঠাসা প্রায়-ভরাট হয়ে আসা একটা প্রকাও মজা দিঘি।
সেইখানেই সমাপ্ত হয় তাদের বনাভিযান।
মহাসমারোহে শুরু হয়ে যায় পিকনিকের বিশেষ রান্নাবান্নার ব্যবস্থা।
বয় খানসামা সঙ্গে এসেছে কিন্তু তারা তফাতে দাঁড়িয়ে বসে নিজেদের মধ্যে হাসিগল্পের আড্ডা জমায়–পিকনিকের রান্নাবান্না নিজেরা খেটেখাটে না করলে কি সঙ্গত হয়, না মজা লাগে?
ইটের স্তুপ আর পুম্পিত কচুরিপানায় ঢাকা ভরাট হয়ে আসা দিঘির গল্পটা ঈশ্বর সবে বনানীকে শোনাতে আরম্ভ করেছিল। ইভা, মিসেস বাগচী, সরসীরা কলরব করে ওঠে, আরো জোরে বল ঈশ্বর, শুনতে পাচ্ছি না।
ঈশ্বর বিব্রত হয়ে বলে, আজ্ঞে, আমি শুধু শোনা কথা বলছিলাম। একটু জোরে জোরেই বল না, আমরাও তোমার শোনা কথা শুনি।
ভুঁড়িমোটা বাগচী একটু হেসে বক্তৃতা দিতে রু করে, ঈশ্বরের শোনা কথা শুনে কি লাভ হবে? আসল কথাটা আমি বলছি। এখানে কোনো রাজার বাড়ি ছিল অথবা কোনো বিশেষ সম্প্রদায়ের মন্দির বা মঠ ছিল, আজ আর ঠিক করে বলা যায় না। ইটের কোনো স্ট্রাকচার মানেই সভ্যতার নমুনা। প্রাচীনকালের কোনো নগর হয়তো এখানে ছিল। ধ্বংস হয়ে যাবার পর বন ক্ৰমে ক্ৰমে সেটাকে গ্রাস করে এগিয়ে এসেছে। এখানে মাটি খুঁড়ে রিসার্চ করার বড় রকম একটা প্ল্যান হয়েছে–লাখ দশেক খরচ হবে। দুঃখের কথা আপনাদের বলব কি, দুবছর ধরে চেষ্টা করেও প্ল্যান আজ পর্যন্ত স্যাংশন করানো গেল না।
স্বামীর বলার বহরে খুশি হয়ে মিসেস বাগচী উচ্ছসিতভাবে বলে, সত্যি, ভারতীয় কালচারের নতুন একটা দিকও হয়তো আমরা এখানে খুঁজে পেতাম।
বনানী কেন যে এমন অভদ্রভাবে রেগে যায় কেউ বুঝতে পারে না। সে চেঁচিয়ে বলে, দয়া করে একটু থামবেন মাস্টারমশাই মাস্টারনীরা, একটু গলা বন্ধ করবেন? আপনাদের লেকচার অনেক শুনেছি, পরেও অনেক শুনব, ঈশ্বরের শোনা কথাটা একটু শুনতে দিন।
বিব্রত ঈশ্বর বন্দুকটা একবার এহাতে নেয়, একবার ও-হাতে নেয়।