১১. ব্রিটিশ-ভারতে গণিকাদের সামাজিক অবস্থা
কলকাতায় প্রথম বিচারালয় স্থাপনের পর অ্যাটর্নি হয়ে এসেছিলেন উইলিয়াম হিকি। ১৭৭৭ সাল থেকে ১৮০৮ সাল পর্যন্ত হিকি সাহেব কলকাতায় ছিলেন। লন্ডনে ফেরার পর তাঁর স্মৃতিকথায় (১৭৪৯-১৮০৯) যা লিখেছিলেন সেটি শৈশবের কলকাতার সামাজিক ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল হিসাবে স্বীকৃত বলা যায়। হিকি মিস ডানডাস নামে মহানগরের এক ‘বহুজন পরিচিতা বারাঙ্গনা’র কথা তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন। আধুনিক যুগে কলকাতা ও সন্নিহিত অঞ্চলে গণিকাবৃত্তির সূচনা যে ব্রিটিশ আমলেই হয়েছিল, তাতে কোনো সংশয় নেই। আধুনিক শহরের সমস্ত কদর্যতাকে সঙ্গে নিয়ে নগর কলকাতার ক্রমবিকাশ হয়েছে। আর এদেশে নবপর্যায়ে গণিকাবৃত্তির উদ্ভব বৃটিশদের হাত ধরেই। ১৭৯৫ সালে রুশ যুবক হেরাসিম লেবেদফ যখন কলকাতায় অস্থায়ী মঞ্চ বেঁধে প্রথম বাংলা থিয়েটারের সূচনা করলেন, তখন সেই নাটকে নারী চরিত্রে অভিনয়ের জন্য গণিকাপল্লির মেয়েদের এনেছিল। কারণ তখনকার সময়ে সাধারণ ভদ্রঘরের মেয়েদের যাত্রা নাটকে অভিনয় করা নিন্দনীয় ছিল। এমনকি যাত্রা-নাটক দেখাটাও ছিল নিন্দনীয়। বলা হত–যাত্রা দেখে ফাত্রা লোকে। সে যুগে ফাত্রা’ শব্দটি চরিত্রহীন মানুষদের বোঝাত।
যাই হোক, হিকি সাহেবের স্মৃতিকথা থেকেই জানা যাচ্ছে, ১৭৯৫ সালের অনেক আগে থেকেই গণিকাপল্লির অস্তিত্ব ছিল। শুধু কলকাতা নয়, বাংলার সমৃদ্ধ শহরগুলি, যেখানে ব্রিটিশরা কোর্ট-কাছারি ইত্যাদি খুলেছিল, সেখানেই সন্নিহিত অঞ্চলে গণিকাপল্লি গড়ে উঠেছিল। ব্রিটিশদের সহায়ক বাবু সমাজের পৃষ্ঠপোষকতায় গণিকাপল্লিগুলো ফুলে-ফেঁপে উঠতে থাকল গোটা উনিশ শতক জুড়ে। রক্ষিতা পোষণ, গণিকাগমন তখনকার সমাজ শুধু অনুমোদনই করত না, এইসব বেলেল্লাপনা ছিল তাঁদের মর্যাদা সূচক।
ইংরাজের নতুন ভুমিব্যবস্থা গ্রাম্য সমাজকে ভেঙে তছনছ করে দিল। ফলে বংশানুক্রমিক পেশা ও বৃত্তি থেকে উৎখাত হয়ে যেমন চোর ডাকাতের দল সৃষ্টি হয়ে শহরে আশ্রয় নিল, তেমনই দারিদ্রের তাড়নায় শহরের গণিকাপল্লিতে আশ্রয় নিল মেয়েরা। ১৮৭২ সালের সরকারি নথিপত্র থেকে জানা যায় যে, কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী এলাকার গণিকারা অধিকাংশই তাঁতি, তেলি, জেলে, কৈবর্ত, ময়রা, চামার, কামার, কুমোর, যুগী, গোয়ালা, নাপিত, মালি, বেদে ইত্যাদি সম্প্রদায়ের। এই সময়ে কলকাতা ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে গণিকাদের সংখ্যা কীরকম লাফিয়ে লাফিয়ে বেড়েছিল, তা জানা যায় এই তথ্য থেকে। কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের ১৮৬৭ সালের ১৬ সেপ্টেম্বরের হিসাবমতো ৩০০০ মেয়ে গণিকাবৃত্তিতে এসেছিল। ১৮৮০ সালের এক হিসাবে শহরে গণিকাদের সংখ্যা ছিল ৭০০০, আর ১৮৯৩ সালে সেই সংখ্যাটা বেড়ে হয়েছিল ২০,১১৬। শুধু সমাজের নিম্নবর্গের মেয়েরাই নয়, কুলীন ঘরের বহু মেয়েও অবস্থার দুর্বিপাকে আশ্রয় নিত গণিকাপল্লিতে। সরকারি প্রতিবেদনে স্বীকার করা হয়েছিল যে, গণিকাদের সংখ্যা বৃদ্ধির একটা কারণ হিন্দু বিধবাদের গণিকাপল্লিতে আশ্রয়। বিধবাবিবাহ প্রথা চালু না-হওয়ায় লালসার শিকার বিধবা তরুণীদের শেষ আশ্রয় ছিল এই গণিকাপল্লি। সরকারি প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল—“হিন্দুর বিবাহ-বিচ্ছেদ নেই, বিধবা হলে হয় পবিত্র হও, নচেৎ বেশ্যা হও।” সরকারি প্রতিবেদন অনুযায়ী হিন্দু বিধবারা প্রধানত হুগলি, বর্ধমান, হাওড়া, চব্বিশ পরগনা, মেদিনীপুর ও ওড়িশা থেকে আসত। তরুণী বিধবারা বাবুদের লালসার শিকার হতেন, কেউ কেউ গর্ভবতী হয়ে পড়তেন। শেষপর্যন্ত তাঁদের আশ্রয় হত গণিকালয়ে। দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ, ইত্যাদি কারণে মা, মেয়ে উভয়কেই আশ্রয় নিতে হত গণিকাপল্লিতে। মুহূর্তের ভুলে (তখন তো কোনো গর্ভনিরোধক ব্যবস্থা ছিল না) গর্ভবতী নারী আত্মহত্যা না করে বাঁচার উপায় খুঁজেছেন গণিকালয়ে আশ্রয় নিয়ে। আবার বহুবিবাহের শিকার নারী প্রেমিকের হাত ধরে কুলত্যাগিনী হয়েছেন। অবশেষে এসে ভিড়তে হয়েছে গণিকাপল্লিতে।
সতেরো শতকে তৎকালীন ভারতের পর্তুগিজ উপনিবেশ গোয়া ছিল পর্তুগিজ দাস’ নামক সম্প্রদায় নিয়ে গঠিত পর্তুগিজদের একটি শক্তিশালী ঘাঁটি। এই পর্তুগিজ দাস’ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল অল্পবয়সি জাপানি মহিলারা, যাঁদের পর্তুগিজ বণিকেরা ধরে বেঁধে এনে যৌনদাসী হিসাবে ব্যবহার করত—এদের বলা হত “জাপানি দাস’ এবং এছাড়াও ছিল জাপান থেকে আগত বন্দি দক্ষিণ এশীয় খালাসি। অষ্টাদশ শতকের শেষে এবং ঊনবিংশ শতকের শুরুতে ভারতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনের আমলে, ব্রিটিশ সৈন্যরা তাঁদের কামনা চরিতার্থ করবার জন্য অল্পবয়সি মেয়েদের সেক্স-টুল হিসাবে ব্যবহার করে কিছু আরামপ্রদ স্থান তৈরি করেছিল। ব্রিটিশ সেনারা এই স্থানগুলি তাঁদের নিজেদের গণিকাবলয় হিসাবে ব্যবহার করত। বিবিসি’-র একটি নিবন্ধ জানাচ্ছে, ব্রিটিশ সৈন্যরা মুম্বাইয়ের মতো ভারতের বিভিন্ন শহর জুড়ে গণিকালয় তৈরি করতে সাহায্য করেছিল। ভারতীয় খালাসি সমুদ্র নাবিকরা, যাঁদের জোর করে যুক্তরাজ্যের ব্রিটিশ সেনাবিভাগে নিয়োগ করা হত, তাঁরা তাঁদের মালিকদের অনুকরণ করে অহরহ সেখানকার স্থানীয় ব্রিটিশ গণিকালয়ে গমন করত। ঊনবিংশ ও বিংশ শতকের শুরুতে উপমহাদেশীয় ইউরোপ এবং জাপান থেকে হাজার হাজার মেয়েদের ব্রিটিশ অধিকৃত ভারতবর্ষে পাচার করত; সেখানে তাঁরা গণিকা হিসাবে ব্রিটিশ সৈন্য ও ভারতীয় পুরুষদের সেবায় নিয়োজিত থাকত।
ভারতে ব্রিটিশ শাসনকালে গণিকাদের পৃষ্ঠপোষকতা, গণিকা বৃদ্ধি এবং গণিকাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা নিয়ে বিস্তারিত জানতে পারা যায় পাঁচখানি আকর গ্রন্থ থেকে। যেমন–(১) ‘বেশ্যানুরক্তি বিষমবিপত্তি’–এটি ১৮৬৩ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। উনিশ শতকে গণিকাদের যাঁরা বাড়বাড়ন্ত মনে করতেন তাঁদের দৃষ্টিকোণ থেকে লেখা।(২) ‘বেশ্যা গাইড’–এটিও ১৮৬৮ সালে প্রকাশিত হয়েছিল। যৌন সংক্রামক রোগ প্রতিরোধের জন্য ১৪ আইন জারি করেছিল। সেই আইনে বলা হয়েছিল গণিকারা কীভাবে স্বাস্থ্য পরীক্ষা করে পেশা চালিয়ে যেতে পারবে। (৩) “পাঁচালী কমলকলি’–বইটি ১৮৭২ সালে প্রকাশিত হয়। স্বাস্থ্য পরীক্ষার নামে গণিকাদের নিপীড়ন করা, অত্যাচার করা ইত্যাদি বিষয়। (৪) ‘বেশ্যাই সৰ্ব্বনাশের মূল’–বইটি প্রকাশিত হয় ১৮৭৩ সালে। বিষয় তিন নম্বর বইয়ের পরের অংশ। (৫) এলোকেশী বেশ্যা’–এটি প্রকাশিত হয় ১৮৭৬ সালে। অনাচার থেকে মুক্তির উপায় আছে খ্রিস্টধর্মে।
উপরোক্ত গ্রন্থগুলি থেকে যেটুকু জ্ঞান আরহণ করতে পেরেছি, তা সংক্ষেপে এখানে উল্লেখ করতে পারি। উনিশ শতক জুড়ে গণিকা, গণিকাবৃত্তি ও গণিকাবাপন এতটাই বেড়ে গিয়েছিল যে, তাঁদের নিয়ন্ত্রণের জন্য নিজেদের স্বার্থেই বিভিন্ন আইন তৈরি করে ফেলেছিল ব্রিটিশরা। কারণ অনিয়ন্ত্রিত যৌনযাপনে সিফিলিস, গনোরিয়ার মতো মারাত্মক মারণ রোগ পড়েছিল সমাজে। পাছে গণিকারসিক ব্রিটিশদেরও আক্রমণ করে সেই ভীতিতেই গণিকাদের রোগমুক্ত রাখতে চেয়েছিল।এমতাবস্থায় সিভিল সোসাইটিও দু-ভাগে ভাগ হয়ে গিয়েছিল। একপক্ষ যাঁরা গণিকাদের ‘সোস্যাল এভিলস’ ভাবত, অপরপক্ষ এই আইনের ফলে গণিকাদের মধ্যে যে সংকট এসেছিল, তাঁর বিরুদ্ধে। ব্রিটিশদের কাছে সৈন্যরা ছিল অমূল্য সম্পদ। কারণ এই সৈন্যদের দিয়েই ভারতীয় নেটিভ’-দের টাইট দেওয়া হত। তাই সৈন্যদের জন্য গণিকা সুলভ করে দেওয়া হয়েছিল। ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছিল। অনিয়ন্ত্রিত যৌনসঙ্গমে যৌনরোগ মারাত্মক আকার ধারণ করেছিল। সে সময়কার রিপোর্ট বলছে, ১৮২৭ সালে ইংরেজ-সৈন্যদের মধ্যে মারণ যৌনরোগ ২৯ % থেকে বৃদ্ধি পেয়ে মাত্র দুই বছরে অর্থাৎ ১৮২৯ সালে ৩১ % হয়ে দাঁড়ায়। ১৮৬০ সালে এসে সেটা এসে দাঁড়ায় ৭০ শতাংশে। এর ফলে একে একে সৈন্যদের বরখাস্ত করতে হচ্ছিল। সৈন্যসংখ্যা কমতে থাকায় সরকারের অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়। উদ্ধার পেতে আইন জারি করা ছাড়া আর কোনো বিকল্প পথ তাঁরা খুঁজে পেলেন না বিকল্প হিসাবে দুটি পথ তো খোলা ছিলই। (১) গণিকাবৃত্তি আইন করে নিষিদ্ধ করে দেওয়া। গণিকাবৃত্তিতে যাঁরা জড়িত থাকবেন তাঁদের চরম শাস্তির বিধান তৈরি করা এবং (২) সৈন্যদের গণিকা নিষিদ্ধ করা। কোনো সৈন্য যদি গণিকাগমন করে, তাঁকে কঠোর শাস্তি প্রদান করা। ইংরেজরা বিকল্প হিসাবে এই কঠিন পথদুটি গ্রহণ করলেন না, গ্রহণ করলেন সহজ পথ। এতে বাঁশও ভাঙল না, বাঁশিও বাজল। গণিকারা থাকবে, সেনারা থাকবে এবং সেনাদের যৌন বিনোদনও থাকবে। অতএব সেনাদের পৃথক গণিকালয় তৈরি করা হল সেনাছাউনিগুলোতে। সাপ্লাই অ্যান্ড ডিমান্ডের ধারা অক্ষুণ্ণ রাখতে প্রণয়ন হল ‘ক্যান্টনমেন্ট অ্যাক্ট ১৮৬৪’ ও ‘চোদ্দো আইন’। এই ক্যান্টনমেন্ট অ্যাক্ট ১৮৬৪’ আইনের বলে যেসব গণিকারা রেজিস্ট্রিভুক্ত হবে এবং কার্ডহোল্ডার হবে, একমাত্র তাঁরাই গণিকাবৃত্তি চালিয়ে যেতে পারবে। বাকিরা নয়, সেনাদের জন্য তো নয়ই।
এতকিছু করেও সৈন্যদের মধ্যে মারণ যৌনরোগ নিশ্চিহ্ন করা যচ্ছিল না। যেহেতু সেনা তদারকির বাইরেও গণিকারা গণিকাবৃত্তি করত, সেনারা সেখানেও নিয়মিত যাতায়াত করত। এর ফলে সেনা ছাড়িয়ে সাধারণ মানুষদের মধ্যেও এই যৌনরোগ ছড়িয়ে পড়তে থাকল। ১৮৬৪ সালে কলকাতার হেলথ অফিসার ফেবর টনেয়রও জানিয়েছিলেন, সিফিলিসের মতো রোগ শুধু সেনাদের মধ্যেই নয়, সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে। ১৮৬৭ সালে ‘Contagious Diseases Act, XIV of 1868’ নামে একটি খসড়া তৈরি করে তাতে fola fracal–“I beg to state that in addition to my ususal duties, I am willing to undertake the organization of the new office, to superintend the registration of the prostitution. As well as to take an active part in the sanitary inspection of the public women.” প্রণয়ন হল ‘Indian Contagious Disaases Act’ বা চোদ্দো আইন।
কেমন ছিল সেই চোদ্দো আইন? একটু দেখে নেওয়া যাক–(১) ১৮৬৯ সালের ১ এপ্রিলের পর থেকে কলকাতা ও শহরতলিতে কোনো নারী বা কোনো ব্যক্তি নিজ নিজ বাসস্থান যে থানার অধীন সেই থানায় রেজিস্ট্রি না করে গণিকাবৃত্তি ও গণিকালয় রক্ষকের কাজ করতে পারবে না। (২) প্রত্যেক থানায় ইন্সপেক্টর নিজ নিজ থানা এলাকায় যে যে সাধারণ গণিকা ও গণিকালয় রক্ষক বাস করে তাঁদের রেজিস্ট্রি করে নিতে হবে। (৩) কোনো সাধারণ নারী গণিকাবৃত্তি করতে ইচ্ছা করলে তাঁর নিজের নাম, বয়স, জাতি বা ধর্ম, জন্মস্থান, বাসস্থান এবং যে সময়ে গণিকাপেশায় যুক্ত হয়েছে এবং যদি কোনো গণিকালয়ে বর্তমানে বাস করে, তাহলে সেই বাড়ির কর্তারও রক্ষকের নাম এবং পরে লিখিত জেনারেল রেজিস্ট্রি বুকে তার নম্বর সহ সমস্ত তথ্য থানায় নিজে এসে লেখাতে হবে। (৪) থানার ইন্সপেক্টর সেইসব বিবরণ পাওয়ামাত্র থানায় যে রেজিস্ট্রি বুক (ফর্ম–এ) রাখা থাকবে তাতে লিখে ওই টিকিট কমিশনার সাহেবের স্বাক্ষরের জন্য তাঁর অফিসে পাঠিয়ে দিতে হবে। (৫) থানায় রেজিস্ট্রি বুকের মতো সমস্ত শহর ও শহরতলির জন্য পুলিশ অফিসে যে জেনারেল রেজিস্ট্রি বুক রাখা হবে, সেই রেজিস্ট্রি বুকে কমিশনার সাহেব ওই গণিকাকে রেজিস্ট্রি করবেন। জেনারেল রেজিস্ট্রি বুকে ওই গণিকার যে নম্বর হবে সেই নম্বর রেজিস্ট্রেশন টিকিটের প্রথম ঘরে লিখতে হবে। এটা লেখা হলে উক্ত টিকিট কমিশনার বা ডেপুটি কমিশনার সাহেবের দ্বারা স্বাক্ষরিত হয়ে থানার ইন্সপেক্টরের কাছে পাঠাতে হবে। ইন্সপেক্টর নিজের রেজিস্ট্রি বুকে উক্ত রেজিস্ট্রেশন টিকিটে লিখিত নম্বর লিখে নিয়ে যাঁর টিকিট তাঁকে দেবেন। (৬) প্রত্যেক গণিকালয় রক্ষক যে থানার এলাকায় নিজের পেশায় চালায় সেই থানায় তাঁকে রেজিস্ট্রি করতে হবে আর রেজিস্ট্রি করার সময় নিজের নাম, বাসস্থান এবং যে বাড়িতে কী ঘরে কী স্থানে যৌনক্রিয়ার মাধ্যমে রোজগার করে, তা লেখাতে হবে থানার ইন্সপেক্টর উক্ত বিবরণ থানায় যে রেজিস্ট্রি বুক (ফর্ম–সি) রাখা হবে সেই বইয়ে লিখিয়ে নেবেন। তারপর রেজিস্ট্রি টিকিট (ফর্ম–ডি) লিখে ওই টিকিট কমিশনার সাহেবের স্বাক্ষরের জন্য জন্য তাঁর অফিসে পাঠিয়ে দেবে।(৭) কমিশনার সাহেব তাঁর অফিসে এক রেজিস্টার বুকে প্রত্যেক গণিকালয় রক্ষকের নাম এবং অন্যান্য তথ্য লিখে রাখবেন। (৮) কমিশনার সাহেবের অফিসের জেনারেল রেজিস্ট্রি বুকে গণিকালয় রক্ষকদের রেজিস্ট্রেশনের যে নম্বর হবে টিকিটেও সেই নম্বর দেওয়া হবে। আর ওই টিকিট কমিশনার কিংবা ডেপুটি কমিশনার সাহেবের স্বাক্ষর হলে যে থানা এলাকায় ওই গণিকালয় রক্ষক নিজের পেশা চালিয়ে যেতে চায় সেই থানার ইন্সপেক্টরের কাছে পাঠানো হবে। (৯) কমিশন সাহেবের দ্বারা টিকিটে যে নম্বর দেওয়া হবে সেই নম্বর ইন্সপেক্টর রেজিস্ট্রি বুকে লিখে যাঁর টিকিট তাঁকে ফিরিয়ে দেবে। (১০) যদি কোনো মহিলা কিংবা কোনো ব্যক্তি পূর্বোক্ত মতে রেজিস্ট্রি না করে এবং পূর্বের মতে রেজিস্ট্রেশন না করে গণিকাবৃত্তি করে কিংবা গণিকালয় চালায় তাহলে তাঁকে এবং তাঁদেরকে সমন জারি না করেই (১৮৬৮ সালের ১৪ আইন মোতাবেক) গ্রেফতার হতে হবে এবং ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে সোপর্দ করা হবে বিচারের জন্য। (১১) কোনো রেজিস্ট্রিকৃত গণিকার নিজের বাসস্থান পরিবর্তন করার ইচ্ছা হয়, তখন তাঁকে কমিশনার বা ডেপুটি কমিশনার সাহেবের কাছে নিজে গিয়ে অথবা ইংরেজিতে আবেদনপত্র লিখে যে গলিতে বা অঞ্চলে বসবাস করতে ইচ্ছুক, সেই অঞ্চলের বাড়ির নম্বর এবং রক্ষকের নাম জানাতে হবে। সেইসঙ্গে পূর্বের রেজিস্ট্রিকৃত টিকিট জমা দিতে হবে সশ্লিষ্ট অফিসে। যদি কোনো গণিকালয়ে কেউ বাস করতে সিদ্ধান্ত নেয়, তবে সেই নতুন ঠিকানার গণিকালয়ের রক্ষকের নাম ও রেজিস্ট্রেশন নম্বর লিখিয়ে নিতে হবে।(১২) এমন আবেদনপত্র পেলে কমিশনার সাহেব রেজিস্ট্রেশন টিকিটে ও জেনারেল রেজিস্ট্রি বুকে প্রয়োজনমতো পরিবর্তন করতে নির্দেশ দেবেন এবং পূর্বোক্ত সেই গণিকাকে ফিরিয়ে দেবেন এবং পূর্বে ওই গণিকা যে থানায় রেজিস্ট্রি হয়েছে সেই থানা থেকে তাঁর নাম পরিবর্তন করে যে থানা এলাকায় সে বাস করতে চায় সেই থানায় তাঁকে পুনরায় রেজিস্ট্রি করতে আদেশ দেবেন। (১৩) কোনো গণিকা রেজিস্টার করে অন্য শহরে কিংবা শহরতলিতে গণিকাবৃত্তি ত্যাগ করার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাঁকে স্বয়ং এসে কিংবা ইংরেজি ভাষায় আবেদনপত্র লিখে কমিশনার সাহেবকে জানাতে হবে যে, তাঁর নাম যেন রেজিস্ট্রি বুক থেকে মুছে ফেলা হয় এবং ওই গণিকা যথার্থভাবে বৃত্তি বা পেশা ত্যাগ করেছে এমন প্রমাণ দিলে কমিশনার সাহেব তাঁর নাম জেনারেল রেজিস্টার ও থানার রেজিস্টার থেকে মুছে দিতে আদেশ করবেন এবং সেই গণিকার রেজিস্ট্রেশন ফিরিয়ে নেবেন। সেইসঙ্গে যে পর্যন্ত ওই আবেদনপত্রের চূড়ান্ত হুকুম না-হয়, সেই পর্যন্ত কমিশনার সাহেব যদি উচিত বিবেচনা করে তাহলে সেই গণিকাকে ‘মেডিকেল টেস্ট থেকে অব্যহতি দিতে পারেন। (১৪) যদি কোনো গণিকালয়ের রক্ষক নিজের বাসস্থান বা ব্যাবসার স্থান পরবর্তন করেন, তাহলে সে যে স্থানে চলে যাচ্ছেন সেই স্থানের নাম ও নম্বর দিয়ে কমিশনার সাহেবের কাছে ইংরেজি ভাষাতে আবেদন করবে এবং সেই আবেদনপত্রের সঙ্গে রেজিস্ট্রেশন টিকিট দাখিল করবে।
গণিকাদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা যেন অকথ্য অত্যাচারের সামিল ছিল। কেমন ছিল সেই স্বাস্থ্যপরীক্ষা, সেটা বর্ণনা করেছে ‘সংবাদ প্রভাকর’। ১৮৬৯ সালের ১৫ এপ্রিলের একটি সংখ্যায় লিখেছে–“বেশ্যাদিগের রেজিস্ট্রারি ও ব্যাধি পরীক্ষা সম্বন্ধে রাজধানী মধ্যে যে কতপ্রকার ভয়ংকর ভয়ংকর কথা শোনা যাইতেছে, তাহা প্রকাশ করিতে হইলে বিদ্রোহীর মধ্যে গণনীয় হওয়া অসম্ভাবিত হয় না। অধিকন্তু অশ্লীলতা ও জনপ্রিয়তার হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাওয়া দুর্ঘট হয়। কেহ বলিতেছে পুলিশের লোকেরা স্ত্রীলোকের প্রতি নির্দয় হইয়া রেজিস্ট্রারির জন্য গ্রেফতার করিতেছে। তাহাদের ক্রদনে ও আর্তনাদে পুলিশের আহ্লাদ বর্ধিত হইতেছে। কোনো-কোনো ডাক্তার অসম্ভব বল প্রকাশ করিয়া এ কাজ করিতেছেন। যাহাদের ব্যাধি নেই তাহারাও পরীক্ষার পর গৃহে আসিয়া উদর বেদনায় ৩/৪ দিন শয্যাগত থাকিতেছে। সেই ভয়ে শত শত বেশ্যা কলিকাতা পরিত্যাগ করিয়া পলায়ন করাতে বেশ্যাপল্লী সকল অন্ধকারময় হইয়াছে। যাহারা কলিকাতায় বেশ্যাবৃত্তি করিতে না চাহিয়া স্থানান্তরে যাইতে চাহে, পুলিশের লোকেরা তাহাদিগকে পথিমধ্যে এমনকী নৌকা হইতেও ধরিয়া আনিতেছে।” ভয়ংকর দুর্বিসহ সেইসব পরীক্ষা-পদ্ধতি এবং অসহায় ব্যবহারের ফলে গণিকাদের নানা সংকট দেখা দিচ্ছিল সে সময়। একথা বলাই যায়, গণিকাবৃত্তি এবং সংক্রামক যৌনব্যাধি এত বাড়াবাড়ি স্তরে পৌঁছে গিয়েছিল যে ‘চোদ্দো আইন’ খুবই জরুরি ছিল। এখন যেমন এইডসের মতো মারণ রোগের সংস্পর্শ থেকে দূরে রাখতে কন্ডোমের ব্যবহার করা হয়েছে, তখন তো কন্ডোমের ব্যবহার ছিল না। তাই নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা ছাড়া বিকল্প কোথায়! গণিকাদের নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা এখনও হয়, তবে সেটা সেদিনকার মতো বিভীষিকাময় নয়। ১৮৭২ সালে ‘সোমপ্রকাশ’-এ লেখা হল–“এই আইনটি যখন হয় আমরা প্রাণপণে ইহার প্রতিবাদ করিয়াছিলাম। তখন আমাদিগের কথা রাজপুরুষদিগের ভালো লাগে নাই। কিন্তু এই আইনটি স্ত্রী সম্প্রদায়ের প্রতি অত্যাচারের কারণ হইয়া উঠিয়াছে।”
কেমন ছিল সেই স্বাস্থ্যপরীক্ষার নামে অত্যাচার? ‘সম্বাদ ভাস্কর’ লিখছে–“উক্ত আইনের কার্ব নিৰ্বাহ জন্য লালবাজারে যেসকল ডাক্তার নিযুক্ত হইয়াছেন তাঁহারা পরীক্ষার ছলে নারীদিগের বিশেষ কষ্ট দিতেছেন, দূষ্যাদিগের অপেক্ষা নির্দোষা বেশ্যাদিগের অধিক যন্ত্রণা হইতেছে। দূষ্যাদের মধ্যে অধিকাংশই পরীক্ষার পূর্বে রোগ স্বীকার করে, সুতরাং তাহাদের আর দেহপরীক্ষার প্রয়োজন হয় না। চিকিৎসার অধীনে থাকে, যাহাদের রোগ নাই, তাহারা ব্যাধির অনস্তিত্ত্ব ব্যক্ত করে, চিকিৎসক শোনামাত্রই কেন তাহা বিশ্বাস করিবেন, কার্যতই পরীক্ষার হয়–তাহা সামান্যাকারে দর্শনাদিরূপ পরীক্ষাতেই সমাধা হইতে পারে, কিন্তু আমাদের চিকিৎসকেরা সেরূপে সন্তুষ্ট হন না–তাঁহারা ওই পরীক্ষিত বেশ্যাগণকে প্রথমত টবে বসাইয়া দেন, তাহাতে জলের সহিত জ্বালাকর পদার্থ থাকে, ওই পরীক্ষার পর গর্ভ দর্শনীয় বিশাল যন্ত্রদ্বারা দর্শন হয়, পরে উগ্রতর পিচকারি দেওয়া হইয়া থাকে। জনরবকারিরা বলেন, এই পিচকারিতে অনেকের উদর ফুলিয়া জীবন সংশয় হইয়াছে। অতএব উহা যে স্ত্রীদেহের উপযোগী স্বাভাবিক পিচকারি নহে, ইহা অবাধেই অনিষ্ট সাব্যস্ত হইতেছে। এই পিচকারি দান বিষয়ে পাত্রপাত্র বিচার নাই। ডাক্তারেরা রজস্বলাক্ষেত্রেও উহার প্রয়োগ করিতেছেন। তাহাতে আবার অধিকতর অনিষ্ট হইতেছে, অপরিমিত রুধিরক্ষরণে দুই এক তরুণীর জীবনও গিয়াছে।”
এই বর্ণনায় স্পষ্ট হয় যে, অত্যাচার কতটা অবর্ণনীয় ছিল। এতটাই অবর্ণনীয় ছিল যে, তামাম গণিকারা দলে দলে কলকাতা ত্যাগ করে অন্যত্র পালিয়ে যেতে থাকল। কেউ কেউ কলকাতা ত্যাগ করার সঙ্গে সঙ্গে গণিকাবৃত্তিও ত্যাগ করতে থাকল। অনেকে আবার ফরাসি উপনিবেশ ফরাসডাঙায় গিয়ে দিন গুজরান করতে থাকল। ব্রিটিশ পুলিশদের আতঙ্কে এমন অবস্থা হল যে, লাল পাগড়ি পরা কোনো লোক দেখলেই পুলিশ আত্মগোপন করে ফেলত। আবার কেউ কেউ আত্মহত্যা করতে বাধ্য হত। রূপচাঁদ পক্ষী লিখলেন–
“কারে বলিব বনমালী! এ দুখের কথা।
হলো চৌদ্দ আইন বড়োই কঠিন বল যাই কোথা।
ভেবে ভেবে গুমড়ে মরি এ কি আইন হলো জারী,
দিগম্বরী করবে যত বারবণিতা।”
এহেন পরিস্থিতে সমাজের একটা বড়ো অংশ প্রতিবাদে মুখর হয়ে উঠেছিল। ব্রিটিশ সরকার এই প্রতিবাদ গোড়ার দিকে তেমন পাত্তা না দিলেও পরে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে বাধ্য হল। বাধ্য হল কারণ, ফরাসি উপনিবেশ ফরাসডাঙায় গণিকারা দলে দলে কলকাতা ছেড়ে যাওয়াতে ইংরেজদের মুখ পুড়েছিল। সেই মুখ রক্ষা করতে এবং এ দেশীয় ভদ্রলোকদের তীব্র সমালোচনা মুখ বন্ধ করতে সচেষ্ট হল। ইংরেজরা বুঝতে পারল এই আইনটি সম্পূর্ণভাবেই আনপপুলার। যে উদ্দেশ্যে এই আইন প্রণয়ন করা সেই সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ। সেনারা যথারীতি যৌনরোগে আক্রান্ত হচ্ছিল। তা ছাড়া এই আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে জলের মতো রাজস্ব খরচ হয়ে যাচ্ছিল। পাক্কা কুড়ি বছর এই আইন সক্রিয় ছিল। অবশেষে ১৮৮৮ সালে এই আইনটি বিলুপ্ত করে দেওয়া হল।
ফিরে আসি গণিকাদের রেজিস্ট্রেশনের প্রসঙ্গে। কোনো প্রকার যৌনরোগ না-থাকলে তবেই একজন গণিকাপেশায় জন্য রেজিস্ট্রিভুক্ত হতে পারত এবং পেশায় যোগদান করতে পারত। যাঁরা রোগাক্রান্ত হত তাঁদের ‘লক হাসপাতাল’-এ পাঠানো হত। কী এই ‘লক হাসপাতাল’? ইংল্যান্ডে এ ধরনের হাসপাতাল ছিল, যেটা তৈরি করা হয়েছিল হিংস্র নেকড়েদের আটকে রাখার জন্য। এই হাসপাতাল লন্ডনে তৈরি করা হয়েছিল ১৭৪৬ সালে। এই লক হাসপাতাল যৌনরোগাক্রান্ত গণিকাদের রাখা হত। সরকারি নির্দেশে কলকাতার বিভিন্ন গণিকাপল্লিতে গিয়ে ব্রিটিশ পুলিশ তল্লাসি চালিয়ে মেয়েদের ডাক্তারি পরীক্ষা করতে যেত। সেইসব মেয়েদের প্রতি নৃশংসতা ক্রমশই মাত্রা ছাড়াচ্ছিল। এর ফলে কলকাতা থেকে অন্য কোনো শহরে বা অন্য কোনো গ্রামে গণিকারা পালিয়ে যেতে থাকল দলে দলে। যৌনরোগের কারণে যেসব হতভাগীদের চিকিৎসার জন্য লক হাসপাতালে যেতে হয়েছিল, তাঁদের ফিরে এসে আর পুরোনো ফিরে যেতে সাহস পেত না। রোগের ভয়ে খরিদ্দারদের আনাগোনাও ক্রমশ কমতে থাকল। সেই ভীতি আজও বহমান। তাহলে কি এটাই বুঝতে হয় ব্রিটিশ-ভারত সরকার প্রত্যক্ষভাবে নাহলেও পরোক্ষভাবে গণিকাবৃত্তিকে তুলে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল? বাঙালি ভদ্রলোক সমাজের চাপে কখনো-কখনো প্রশাসন শহরের মধ্যবিত্ত এলাকা গণিকালয় উচ্ছেদ করত। গণিকা ও গণিকাবৃত্তির বিরোধিতার কেন্দ্রে ছিলেন সেসময়ের বিশিষ্ট তরুণ বাঙালি বুদ্ধিজীবী, সমাজ-সংস্কারক পর্যন্ত। মহাভারতকার কালীপ্রসন্ন সিংহ পর্যন্ত গণিকাবৃত্তির বিরুদ্ধে জনমত সংগঠিত করেছিলেন। ব্রিটিশ-ভারত সরকারকে এ ব্যাপারে ধারাবাহিকভাবে বোঝানো চেষ্টা করে গেছেন। নগরায়নের ফলে যে নতুন অর্থনীতির উদ্ভব ঘটেছিল, শিল্পকেন্দ্রিক সেই অর্থনীতি ও সামাজিক অবস্থায় গ্রাম্যসমাজ ও পরিবারচ্যুত মানুষ যে। বিনোদনের আশায় গণিকাদের কাছে যাবে, এটাই আধুনিকতার অবধারিত পরিণতি। সেটা বুঝতে পারেনি উনিশ শতকের বিদ্যোৎসমাজ। খেতে না-পাওয়া মেয়েদের এই বৃত্তিটা এবং গণিকালয়গুলি হয়ে গিয়েছিল নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম যেখানে প্রাণ খুলে যেমন খুশি খিস্তি দিতে পারে, তেমনি নিজের গতর-খাটানো রোজগার করা অর্থ নিজের মতো করে খরচ করতে পারে।
গোটা উনিশ শতক জুড়ে ভদ্রবাড়ির মেয়েরা চাকরি করতে বাইরে বেরচ্ছেন এমন চিত্র অতি বিরল ছিল। বলা যায়, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতার হয়তো প্রথম চিত্র এই গণিকাদের রোজগারের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল। তা ছাড়া এ এমন এক পেশা, যে পেশায় যোগদান করলেই রোজগার নিশ্চিত। রোজগারও সীমাহীন হতে পরে। কাঁচা পয়সা যাকে বলে। এ পেশায় অনাচার, অত্যাচার, লাঞ্ছনা নিশ্চয় ছিল। সে তো গার্হস্থ্যজীবনেও কম ছিল না। সামাজিক শোষণ তো কম ছিল না মেয়েদের। সেই সামাজিক শোষণের সঙ্গে সম্পৃত্ত থাকে সমাজ, প্রশাসন ও রাষ্ট্রব্যবস্থা। গণিকাজীবনেও ছিল, আছে, থাকবে। সে সময় সর্বদাই গণিকাদের বিরুদ্ধে গৃহস্থরা মুখর ছিল। তাঁরা সর্বদা আদালতে চলে যেত গণিকাদের বিরুদ্ধে মামলা করতে। আদালতও গণিকাদের বিরুদ্ধে। আদালত যারপরনাই গণিকাদের অপমানজনক কথা বলত, ভর্ৎসনা করত। এতে গণিকাদের কোনো হাত নেই। হাত আছে মূলত পুরুষতান্ত্রিক ভদ্রলোক সমাজের আধিপত্যবাদ। গণিকালয় সেই পুরুষতান্ত্রিক আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে গিয়ে নিজের পরিসর গড়ে তুলেছে। যাই হোক, তথাকথিত ভদ্রলোকদের উপর্যুপরি দাবিকে গুরুত্ব দিয়ে ১৮৬৮ সালে চোদ্দো আইন প্রণয়ন করে ব্রিটিশ সরকার এদেশীয় ভদ্রলোকদের রক্ষা করল। পাশাপাশি গণিকাদের স্বাস্থ্যপরীক্ষা করিয়ে রেজিস্ট্রির মাধ্যমে পেশা চালানোর সুযোগ করে দিয়েছিল। বলা যায়, গণিকাদের সরকারি স্বীকৃতি দিয়েছিল।
সামাজিক শ্রেণিবিন্যাস এসময়ে প্রবল হয়ে উঠছিল। গণিকা ও গণিকাবৃত্তির সমর্থন ও আপত্তিই যেন একমাত্র সত্য হয়ে উঠেছিল। সেসময়ে সাহিত্য-নাটক-যাত্রা-প্রহসনে গণিকা চরিত্র আবশ্যক অনুপ্রবেশ ঘটছিল। কেউ কেউ আবার গণিকাদের পরিত্রাণের উপায়ও বাতলে দিচ্ছিলেন। জনৈকা মিশ লেসলি লিখলেন, গণিকাদের পরিত্রাণ মিলবে খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করে জিশুকে স্মরণ করে। সংখ্যায় অতি অল্প হলেও কিছু গণিকা পাপস্খলনের জন্য খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেছিলেন।
শুধু ব্রিটিশ উপনিবেশেই নয়, ফরাসি পোর্তুগিজদের উপনিবেশের ফলেও ভারত উপমহাদেশে এক অদ্ভুত পরিবর্তন লক্ষিত হল। বিদেশিরা ভারতের বাসিন্দাদের দাসানুদাস কীটাণুকীট মনে করত। পুরুষদের সহজলভ্য শ্রমিক আর মেয়েদের সহজলোভ্য ভোগ্যা মনে করত। এর ফলে অবাধ, অসংযম এবং অবাঞ্ছিত যৌনজীবনে জড়িয়ে পড়ল তাঁদের এক অংশ। গণিকাবৃত্তির রমরমা হতে শুরু করল এই সময় থেকেই। গণিকাগৃহে যাওয়া যেন এক স্ট্যাটাস সিম্বল হয়ে দাঁড়াল। সংক্রমিত হতে থাকল কালান্তক যৌনব্যাধী। তাঁদের বেপরোয়া যৌন সম্ভোগ সিফিলিস এবং গনোরিয়ার মতো যৌনব্যাধী আতঙ্কের সৃষ্টি করল। যৌনব্যাধীর আতঙ্কে বাজারও খানিকটা স্তিমিত হয়ে গিয়েছিল কিছুকালের জন্য। কন্ডোম বাধ্যতামূলক হওয়ার আগে পর্যন্ত এই ভীতি কাজ করত রসিকদের মনে। শোনা যায়, ফরাসিদের কাছ থেকেই সিফিলিস যৌনরোগটি আমদানি হয়েছিল। সিফিলিস রোগটি মূলত কুকুরদের অসুখ, কুকুরদের হত। কুকুরদের কাছ থেকে এই সিফিলিস রোগটি মানুষের শরীরে কীভাবে সংক্রমিত হল, সেটা অবশ্যই গবেষণার বিষয় হতে পারে। আতঙ্ক নিয়ে বেশ কয়েক যুগ কেটে গেল গণিকা ও গণিকাপ্রেমীদের। এরপর রসিক-রসকিনীদের চোখেমুখে ভরসার আলো দেখা গেল। সিফিলিস ও গনোরিয়া নিরাময়ের জন্য হাতে চলে এলো অব্যর্থ প্রতিষেধক মেচনিকফ মলম, পেনিসিলিন, সালফাথিয়াজোল ইত্যাদি। এইসব ওষুধের ব্যবহার বাড়তেই গণিকাদের যৌনজীবনে এক বিপ্লব ঘটে গেল। কিন্তু পূর্ব-সতর্কতা নেওয়া যায় না-বলে রোগটা থেকেই গেল। সেই অভাবটা পূরণ করে দিল কন্ডোম। এখন অবশ্য সিফিলিস, গনোরিয়ার কথা খুব একটা শোনা যায় না। বরং এখন নতুন আতঙ্ক এইডস। সেটাও প্রায় স্তিমিত। সচেতনতা ও বাধ্যতামূলক কন্ডোম ব্যবহারে যৌনরোগ এখন আর তেমন আতঙ্ক ছড়াতে পারছে না। কন্ডোম নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব আলাদা একটি অধ্যায়ে।