ব্যাপারটা যে আর চাপা নেই, তা পরের দিনই বোঝা গেল। হোটেলের কাজে শ্ৰীমতী করবী গুহের সুইটে গিয়েছিলাম। শ্রীমতী করবী গুহ তখন তার প্রাত্যহিক কর্তব্য সেরে ফেলেছেন। ফুলের দোকানদারের প্রতিনিধি তার অর্ডার নিয়ে গিয়েছেন। ন্যাটাহারিবাবু তারপর সেলাম করে সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। বলেছেন, মা জননী, আজ আপনাকে কোন রংয়ের পর্দার কাপড়, বিছানার চাদর পাঠাব বলুন।
আমার সামনেই করবী দেবী বলছেন, অন্য লোকদের বাড়িতে কত সুন্দর সুন্দর রংয়ের পর্দা দেখি, কত নতুন নতুন রং বেরোচ্ছে। আপনার ভাঁড়ারে সেই সেকেলে রংগুলো পড়ে রয়েছে।
ন্যাটাহারিবাবু সত্যই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। এই প্রশ্নের কোনো উত্তর তিনি খুঁজে পাচ্ছেন না। মাথা চুলকোতে চুলকোতে বললেন, মা জননী বাড়ি আর এই হোটেল কি এক জিনিস? গেরস্ত যদি নিজের দরজায় থলে টাঙিয়ে রাখে তাহলে তাই দেখেও মানুষের চোখ জুড়িয়ে যাবে।
করবী দেবী তার টানা টানা চোখ দুটো নিয়ে নিত্যহরিবাবুর দিকে কেমন ভাবে তাকালেন। আস্তে আস্তে বললেন, আমাকেও তো এই সুইটটা ভালো করে সাজিয়ে রাখতে হবে। রংয়ের সঙ্গে রং না মিললে এই গেস্ট-হাউসের কী থাকবে বলুন?
নিত্যহরিবাবু উত্তর দিলেন, আমি যতক্ষণ আছি, আপনার কোনো অসুবিধে হবে না। নিত্যহরি যে করে পারে, বোজ আপনার রংয়ের সঙ্গে রং মিলিয়ে যাবে। তবে মা জননী, নিত্যনতুন এই রংয়ের খেলা না দেখালেই নয়?
নিত্যহরিবাবু ঘর থেকে বেরিয়ে যেতে আমি বললাম, আপনার কোনো অসুবিধে থাকলে ম্যানেজারকে জানাতে পারি। নিত্যহরিবাবু কি আপনার পছন্দমতো চাদর এবং পর্দা দিতে পারছেন না?
করবী দেবী যে এই ভোরবেলায় স্নান সেরে ফেলেছেন, তা তাঁর চুলের দিকে তাকিয়েই বুঝলাম। নিজের চুলগুলো নিয়ে খেলা করতে করতে করবী দেবী বললেন, আপনার কিছু বলবার দরকার নেই। নিত্যহরিবাবু মনে কষ্ট পাবেন। ভারি সুন্দর মানুষটি। কেন জানি না, ওঁকে আমার খুব ভালো লাগে। একেবারে খাটি সোনা। এখানে এতদিন থেকেও নষ্ট হয়ে যাননি।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, মিস্টার পাকড়াশীর অতিথিরা কবে হাজির হচ্ছেন? তাদের জন্যে কোনো স্পেশাল অ্যারেঞ্জমেন্টের দরকার থাকলে আমাদের এখনই বলে দেবেন।
করবী দেবী বললেন, মিস্টার আগরওয়ালা চান, ওঁদের সেবার যেন ত্রুটি হয়। আমি ঠিক করেছি দুজনকে দুটো কেবিন দিয়ে দেব। আর এইটাকে আমার বেডরুম করে নেব। অসুবিধের কোনো কারণ নেই। আগে চার-পাঁচজন গেস্টও একসঙ্গে এখানে থেকে গিয়েছেন।
তারিখের কথায় করবী বললেন, ভালো কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। ওটা জেনে রাখলে কাজের সুবিধে। টেলিফোনটা তুলে নিয়ে করবী বললেন, দাঁড়িয়ে রয়েছেন কেন? বসে পড়ুন।
বসে বসে দেখলাম, করবী দেবীর পা দুটো যেন পদ্মফুলের মতো। তার উপর সোনালি রংয়ের হাল্কা চটি পরেছেন। পায়ের আঙুলগুলো আলতার রংয়ে লাল হয়ে আছে। করবী হেসে বললেন, আপনার সেই সভাপতির কীর্তি জানেন? ফিরে গিয়ে পার্সেল পোস্টে এই চটিদুটো পাঠিয়ে দিয়েছেন। পায়ের মাপটা কখন জোগাড় করলেন কে জানে। আমি বললাম, আপনার পায়ে মানিয়েছেও ভালো।
করবী খিলখিল করে হেসে উঠলেন। অত বুঝি না। তবে সবাই যাঁকে মাথায় করে রেখেছিল, তাকে যে পায়ের তলায় রাখতে পারছি, এতেই আমার আনন্দ। জানেন, নেশার ঘোরে মাননীয় অতিথি সেই রাত্রে আমার পা জড়িয়ে ধরেছিলেন।
টেলিফোনে কথা শেষ করে করবী আমাকে জানালেন, কর্তাকে পেলাম। তিনি ফ্যাক্টরিতে গিয়েছেন। প্রথমে গৃহিণী ধরলেন; পরে পাকড়াশী জুনিয়র। কেউ কিছুই খবর রাখেন না। তবে পুত্র পাকড়াশী অনুগ্রহ করে আমাকে ফোনে জানিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
আমি বললাম, খবরটা পেলে আমাদেরও একটু জানিয়ে দেবেন। আমি এবার চলে আসছিলাম। করবী দেবী বললেন, উঠছেন কেন? একটু ওভালটিন খেয়ে যান। আমি তার মুখের দিকে তাকালাম। এই হোটলে কেউ কখনও আমাকে এমন আন্তরিকভাবে কিছু খেতে বলেনি। করবী বললেন, থাকি হোটেলে বটে, কিন্তু এরই মধ্যে ছোট্ট সংসার পেতে বসেছি। আমার নিজের রান্নাবান্নার কিছু সরঞ্জাম জোগাড় করে রেখেছি। আপনাদের হোটেলের কফি আমার সব সময় ভালো লাগে না। তখন হিটার জ্বেলে আমি নিজেই চা কফি বা ওভালটিন করে নিই।
দেখলাম হিটারে করবী একটু আগেই জল চড়িয়ে দিয়েছেন। আমি বললুম, এর থেকে প্রমাণ হয় না যে, শাজাহান হোটেলের কফি খারাপ। এর থেকে এইটুকুই প্রমাণ হয় যে মাঝে মাঝে রান্নার সুযোগ না পেলে বাঙালি মেয়েদের ভাত হজম হয় না!
করবী হেসে ফেললেন। বললেন, তা যা বলেছেন। আমার মাঝে মাঝে খুব রাঁধতে ইচ্ছে করে।
ওভালটিনের কাপে চুমুক দিতে দিতে করবী দেবী কনির কথা তুললেন।
আপনি তো ওদের সঙ্গে ঘোরেন। ব্যাপারটা কী?
তাঁর প্রশ্নের অর্থ ঠিক বুঝতে না পেরে বললাম, আমি ওঁদের সঙ্গে ঘুরতে যাব কেন? তবে আমি মিস্টার ল্যামব্রেটার পাশের ঘরে থাকি, এই পর্যন্ত।
এবং সেই ঘরেই কনি দি উয়োম্যান সারাক্ষণ পড়ে থাকেন! করবী এবার অর্থপূর্ণ ইঙ্গিত করলেন। আমি বললাম, হাজার হোক ওঁর সহশিল্পী। একসঙ্গে বিশ্বপরিক্রমায় বেরিয়েছেন। করবী বললেন, কিন্তু তার মানেই কি একটা বামনের কথায় উঠতে-বসতে হবে?
কী বলছেন আপনি? আমি প্রতিবাদ করলাম।
শো-তে বামন তার কৃপ্রাপ্রার্থী, করুণাভিখারি। বাইরে ঠিক উল্টো। কনি বামনের সেবাদাসী। তার বদমেজাজের বিরুদ্ধেও কথা বলবার সাহস রাখে মেয়েটা।
আমি বললাম, তাতে কী এসে যায়? শো-তে ওঁরা কী করছেন সেইটাই আমাদের ভাববার কথা।
শো নিয়ে ভাববেন আপনাদের কাস্টমাররা, করবী বললেন। শোয়ের বাইরে তারা যা করে, তা নিয়ে আলোচনা করব আমরা। কারণ আমরাও এই হোটেলে থাকি।
উত্তর দেবার কিছুই খুঁজে পেলাম না। ওদের জীবন নিয়ে আমরা কেন যে এমন কৌতূহলী হয়ে উঠছি, তা বুঝতে পারি না। করবী বললেন, এটাও এক ধরনের বিলাস। ক্যাবারে নর্তকীর তো অর্থের চিন্তা নেই। কিছুক্ষণের আনন্দের জন্যে রাজা-মহারাজা, ধনী এবং ধনীপুত্ররা নর্তকীর পায়ের তলায় ডালি দিয়ে যায়। সুতরাং অবসরের একটা বিলাস না থাকলে খারাপ লাগে। কেউ বাঁদর পোষে, আবার কেউ বামনকে লাই দিয়ে মাথায় তোলে।
বললাম, বেচারা যে বামন, তার জন্যে আপনার কষ্ট হয় না?
করবী বললেন, ওরা দেখছি আপনার মনেও প্রভাব বিস্তার করেছে। এটা বোঝেন না কেন যে, বামন বলেই লোকটা করে খাচ্ছে। আপনার মতো লম্বা হলে কেউ ওকে কনির সঙ্গে স্টেজে অ্যাপিয়ার হতে দিত? এ লাইনে আমি অনেকদিন রয়েছি। একটা কথা জেনে রেখে দিন—ভিক্ষে এবং এন্টারটেনমেন্টের জগতে বিকলাঙ্গ, বীভৎসদর্শনের অনেক সুযোগ। এদের জোগাড় করবার জন্যে শিল্পীরা অনেক দাম দেয়।করবী দেবী একটু থামলেন। তারপর বললেন, দাও দাও, তাতে আপত্তি নেই। কিন্তু মাথায় তুলো না। তাতে যে-হোটেলে তুমি নাচছ, তাদের ক্ষতি, আর নিজেরও সর্বনাশ।
করবী দেবীকে নমস্কার করে এবার কাউন্টারে এলাম। এবং সেখানকার কাজকর্ম শেষ করে উপরে উঠে গেলাম। কনিকে ছাদের উপরেই দেখতে পেলাম। সে মুখ শুকনো করে বসে আছে মনে হল। রৌদ্রে পিঠ দিয়ে সে একমনে সিগারেটের ধোঁয়া উড়িয়ে যাচ্ছে। আমাকে দেখে কনি সিগারেটে আর একটা লম্বা টান দিলে। তারপর সেটা ছুড়ে একে কোণে ফেলে দিয়ে বললে, গুড মর্নিং।
জানি আজকের সকালটা কনির পক্ষে তেমন গুড নয়। তবু অভিবাদন ফেরত দিয়ে বললাম গুড মর্নিং। কনি এবার উঠে দাঁড়াল। উঁকি মেরে ল্যামব্রেটার ঘরের দিকে তাকিয়ে একবার দেখে নিল সে ওকে দেখছে কিনা। কোনো কথা না-বলে কনি এবার সোজা আমার ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল।
জামাকাপড় পালটিয়ে এবার একটু হাত-পা ছড়িয়ে বসব ভেবেছিলাম, কিন্তু কনির জন্যে তা হবার উপায় নেই। কনি একটা চেয়ারের উপরে বসে জিজ্ঞাসা করলে, তোমার ডিউটি কি শেষ হয়ে গেল? বললাম, এখনকার মতো ছুটি। আবার সন্ধ্যাবেলায় যা হয় হবে।
কনি এবার একটু সঙ্কোচবোধ করতে লাগল, আমাকে ওর যেন কিছু বলবার আছে, অথচ বলতে পারছে না।কিছু বলবেন? তাকে প্রশ্ন করলাম। কনি উত্তর দিল, যদি তোমার খুব অসুবিধে না হয়, তাহলে তোমার সঙ্গে একটু বেরোতাম।
কনি কলকাতার কিছুই জানে না। তাছাড়া তাদের মতো মেয়ের একলা বেরিয়ে পড়াও নিরাপদ নয়। তাই ইচ্ছে না থাকলেও রাজি হয়ে গেলাম।
কলকাতা ঘুরে বেড়াবার জন্যে প্রসাধন শেষ করে কনি যখন তার ঘর থেকে বেরিয়ে এল, তখন তাকে দেখে কে বলবে, ভোরের এই মেয়েটিই রাত্রের কনি দি উয়োম্যান। হ্যাট, কালো চশমা ও হাঁটু পর্যন্ত টাইট স্কার্ট পরা এই মেয়েটিকে দেখলে মনে হবে কোনো ইউরোপীয় ট্যুরিস্ট ললনা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়া সবেমাত্র চুকিয়ে বাবার সঙ্গে বিশ্বভ্রমণে বেরিয়েছে।
কনির চোখে মুখে এখন ট্যুরিস্টসুলভ চঞ্চলতা। ছেলেমানুষিতে সে যেন পরিপূর্ণ হয়ে রয়েছে; অথচ অচেনা অজানা জায়গার ভীতিও সম্পূর্ণ কাটেনি। এইরকম দুজন আমেরিকান কুমারীর গল্প হবস সায়েবের কাছে শুনেছিলাম। বাবার সঙ্গে তারা ওয়ার্ল্ড ট্যুরে বেরিয়েছিল। ভদ্রলোকের বোম্বাইতে কিছু কাজ ছিল। তাকে সেখানে রেখে দুই বোন একা একা রাজধানী দিল্লি দেখবার জন্যে বেরিয়ে পড়েছিল। সেখানে তারা নাকি মেডেনস্ হোটেলে উঠেছিল। ট্যুরিস্টমেজাজে জিনিসপত্র কিনতে কিনতে দিল্লিতে তারা সব টাকা খরচ করে ফেলে। অনন্যোপায় হয়ে তারা বাবাকে এক্সপ্রেস টেলিগ্রাম পাঠালে, কিন্তু টেলিগ্রাম পেয়ে বাবার চক্ষু চড়কগাছ। তার কুমারী কন্যাদ্বয় লিখেছে—All money spent. Can stay maidens no longer
চিত্তরঞ্জন অ্যাভিন ধরে হাঁটতে হাঁটতে কনি ও আমি চৌরঙ্গীতে এসে পড়লাম। জিজ্ঞাসা করলাম, এবার কোথায় যাবেন? ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল, মিউজিয়াম, চিড়িয়াখানা, না লাটসায়েবের বাড়ি?
কনি ও-সব নামে কোনো আগ্রহই দেখালে না। নিজের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে এবার যে স্লিপটা বের করে সে আমার হাতে দিলে, তাতে আমার চক্ষু চড়কগাছ। সেই কাগজের টুকরোতে শহরতলির এক অখ্যাত গলির নাম লেখা আছে। এইখানে আপনি যেতে চান? আমি কনির মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম।
হ্যাঁ, ওইখানেই যেতে হবে। না হলে কি আমি কলকাতার সৌন্দর্য দেখবার জন্যে বেড়াতে বেরিয়েছি ভাবছ?
একটা ট্যাক্সি ডাকলাম। ট্যাক্সিতে চড়ে কনি অনেক কষ্টে উচ্চারণ করে বললে, আমি সেই গ্রেট ম্যানের সঙ্গে দেখা করতে চাই—প্রফেসর শিবদাস দেবশর্মা। দি গ্রেট। যাঁর রিসার্চ সেন্টার থেকে প্রথম ঘোষণা করা হয়েছিল, লর্ড কারজন কোনদিন ইংলন্ডের প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। জঙ্গীলাট লর্ড কিচেনার কর্তৃক উচ্চপ্রশংসিত হয়েও যিনি কিচেনারকে জানাতে দ্বিধা করেননি যে, জাহাজড়ুবিতে তাঁর মৃত্যু হবে।
কনি প্রফেসর শিবদাস দি গ্রেটের গৌরবময় ইতিহাস কণ্ঠস্থ করে রেখেছে। এঁর কয়েকটি চাঞ্চল্যকর ভবিষ্যদ্বাণীর মধ্যে রয়েছে—রবীন্দ্রনাথের নাইট উপাধি ত্যাগ, লর্ড ব্রেবোর্নের অকালমৃত্যু, জার্মানির অধঃপতন, গোয়েরিঙের আত্মহত্যা, সুভাষচন্দ্রের ভারত ত্যাগ ও বিদেশিনী বিবাহ এবং সর্বোপরি ভারতবর্ষের স্বাধীনতা লাভ। প্রফেসর শিবদাস কিন্তু এও জানিয়েছিলেন যে, অদূর ভবিষ্যতে ভারত কমনওয়েলথের আওতা থেকে মুক্তি পাবে না।
কনি ব্যাগ থেকে একটা ছাপানো কাগজ বার করেছিল। তার এক কোণে লেখা-প্রাইভেট অ্যান্ড কনফিডেন্সিয়াল। সেখান থেকেই জানলাম এই মহাপুরুষ পাবলিসিটিতে বিশ্বাস করেন না। এবং কোনোরূপ পারিশ্রমিক গ্রহণ করাকে মহাপাপ বলে মনে করেন।
প্রফেসর শিবদাসই গোপনে মহাদেব দেশাই মারফত কস্তুরবাকে জানিয়েছিলেন যে, তার স্বামীর একটি ভয়াবহ ফঁাড়া আছে। কিন্তু তার চিন্তার কোনো কারণ নেই। স্বামীর কোলে মাথা রেখেই এই সতী রমণী ইহলীলা সংবরণ করতে পারবেন। অষ্টম এডোয়ার্ডকে এক্সপ্রেস চিঠি মারফত শিবদাস দি গ্রেট যে কবচ ধারণের উপদেশ দিয়েছিলেন, তা যদি তিনি ধারণ করতেন, তা হলে ইংলন্ডের রাজপরিবারের ইতিহাস নিশ্চয়ই অন্যভাবে লেখা হত। এই আণবিক শক্তিসম্পন্ন কবচ প্রস্তুতের জন্য যাগ-যজ্ঞে যে তিয়াত্তর টাকা চার আনা খরচ হয়, তার থেকে এক আনা বেশি নেওয়াকে শিবদাস দি গ্রেট গোমাংস ভক্ষণ পাপের সমান বলে মনে করেন।
কনিকে ফিরে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু সে শুনলে না।
শহরের প্রান্তে এক কানাগলিতে শিবদাসের গবেষণাগার। আমরা যখন সেখানে হাজির হলাম, তখন তিনি ঘরের মধ্যে গানি ব্যাগ, হেসিয়ান, উলপ্যাক সম্বন্ধে ক্লায়েন্টদের উপদেশ দিচ্ছিলেন।
শিবদাসের সহকারী একটু পরেই আমাদের ভিতরে নিয়ে গেলেন।
ঘরের মধ্যে ঢুকতেই, শিবদাস দি গ্রেট পৈতে বার করে কনিকে আশীর্বাদ করলেন। কনি বাইরে জুতো খুলে রেখে এসেছিল। নাইলনের মোজা সমেত পা দুটো যেন লীলায়িত ভঙ্গিতে দরজার কাছ থেকে পণ্ডিতের দিকে এগিয়ে গেল। নিজের স্কাটা সামলে নিয়ে, কনি পা মুড়ে একটা আসনের উপর বসে পড়ল। ওর স্নিগ্ধ, ভক্তিন মুখের দিকে তাকিয়ে কে বলবে, কনি আমাদেরই ঘরের কেউ নয়। আমাদের মা, মাসিমা, দিদি স্কার্ট পরলে হয়তো এমনি করেই দেবতার মন্দিরে নিজেদের পূজা নিবেদন করতে আসতেন।
শিবদাস দি গ্রেট এবার তার ধূর্ত অনুসন্ধানী চোখে কনিকে যাচাই করবার চেষ্টা করতে লাগলেন। তিনি কনির মাথায় হাত রাখলেন। চোখ বুজে কিসের যেন ধ্যান করতে লাগলেন। তারপর তার পূর্ববঙ্গীয় উচ্চারণে ইংরেজিতে বললেন, মাদার, মাদার, নো ফিয়ার। শিবদাস উইল সেভ ইউ।
কনি কিছু বুঝতে না পেরে, আমার দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকালে। আমি এতক্ষণ খালি পায়ে পিছনে দাঁড়িয়ে ছিলাম; বললাম, উনি বলছেন, ভয় পেয়ো না। চিন্তা কোরো না।
কনি কোনো কথা বলতে পারলে না। সে কেবল পরম নির্ভয়ে শিবদাসের হাতটা জড়িয়ে ধরলে। তার চোখে হঠাৎ অশ্রুর মেঘ জমতে শুরু করলে।
শিবদাস দি গ্রেট-এর বৈশিষ্ট্য তিনি প্রথমে কোনো প্রশ্ন করেন না। আগন্তুকের মুখ দেখেই তিনি তার ভূত এবং ভবিষ্যৎ নির্ণয় করেন। কিন্তু ওইখানেই যত মুশকিল। ওই প্রথম বাণীতেই তো ভক্তদের মন জয় করতে হবে। অথচ কাজটা যে বিপজ্জনক তাতে সন্দেহ নেই।
শিবদাস দি গ্রেট কনির বয়স, কনির হাবভাব, কনির বেশবাস থেকে তার সমস্যা সম্বন্ধে কিছুটা আন্দাজ করবার চেষ্টা করলেন। এ-মেয়ে যে বি-টুইল, হ্যান্ডিকাপ বা ইন্ডিয়ান আয়রন সম্বন্ধে খোঁজ করতে আসেনি তা জ্যোতিষ না জেনেও যে কেউ বলে দিতে পারে। তবু শিবদাস কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে চিন্তা করলেন। সেই অবসরে ব্যাগ থেকে একটা দশ টাকার নোট বার করে কনি তাঁর পায়ের গোড়ায় ভক্তিভরে রেখে দিল।
শিবদাস এবার অর্থপূর্ণ হাসিতে মুখ ভরিয়ে বললেন, কোনো চিন্তা নেই, তোমার মনস্কামনা সিদ্ধ হবে। তোমার মন যা চাইছে তাই পাবে। কনির মুখ এবার একশো ওয়াটের বাতিরমতোউজ্জ্বল হয়ে উঠল। সে যেন এইটুকু জানবার জন্যেই এতটা পথ ভেঙে এখানে হাজির হয়েছে।
শিবদাস দি গ্রেট কনিকে বললেন,তোমার দুটো হাতই সোজা করে আমার সামনে মেলে ধরো।কনি তাই করলে। শিবদাস সেখানে কিছুক্ষণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে, আবার কনির মুখের দিকে ফিরে তাকালেন। তারপর বললেন, তুমি মা, অনেক সহ্য করেছ। কিন্তু তোমাকে আরও সহ্য করতে হবে।
কনি সজল চোখেবললে, আরও?কনি ভুলেই গিয়েছে আমি তার পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছি। জ্যোতিষীর আন্দাজে-ছোড়া ঢিল বোধহয় ঠিক জায়গাতেই আঘাত করেছে। কনি যে অনেক সহ্য করেছে, তা তো আমার নিজের চোখেই দেখেছি। কনি বললে, হ্যারির যদি মঙ্গল হয় আমি আরও অনেক সহ্য করতে রাজি আছি, প্রভু।
শিকার তার ফাঁদে পা দিয়েছে বুঝতে পেরে মহাত্মা শিবদাসের মুখ এবার উজ্জ্বল হয়ে উঠল। তিনি চোখ বন্ধ করে, স্থূল দেহটাকে আমাদের সামনে ফেলে রেখে সূক্ষ্মশরীরে কনির ভবিষ্যৎ সমীক্ষায় পাড়ি দিলেন। কনি অবাক বিস্ময়ে তার দিকে অপলক নয়নে তাকিয়ে রইল। তার দেহ উত্তেজনায় অধীর হয়ে উঠেছে। তবু মুখ ফুটে কিছু বলবার মতো সাহস নেই।
শিবদাস দি গ্রেট এবার চোখ খুলে মৃদু হেসে বললেন, সব বুঝেছি। তোমার কী চাই, আমার আর জানতে বাকি নেই। কিন্তু তবু সেটা তোমার নিজের মুখেই আমি একবার শুনতে চাই। নিজে আব্দার করে মায়ের কাছে চাইলে মা যে খুশি হন।
কনি যা বলবে তা সে কিছুতেই বলতে পারছে না। তার কণ্ঠস্বর জড়িয়ে আসছে। জনপদের চিত্ত-বিনোদিনী যেন অবগুণ্ঠনবতী বালিকা বধূর সলজ্জ-দ্বিধায় আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু কনি আজ বলবে। যা না বললেও চলত, তাই সে শিবদাস দি গ্রেটের কাছে প্রকাশ করবে।
কিন্তু কনি যা বলল তার জন্যে আমি কেন স্বয়ং শিবদাস দি গ্রেটও প্রস্তুত ছিলেন না।
কনির ঠোঁটটা একবার কেঁপে উঠল। হয়তো আমি না থাকলে তার পক্ষে আরও সুবিধে হত। আস্তে আস্তে সে বললে, প্রভু, আপনারা ইচ্ছা করলে সব পারেন। আমার যা আছে সব আপনার গডের পুজোর জন্যে আমি হাসিমুখে দিয়ে দেব, আপনি হ্যারিকে একটু লম্বা করে দিন। আমি সুখ, সম্পদ, স্বাচ্ছন্দ্য কিছুই চাই না। শুধু হ্যারি যদি সাধারণ হয়ে উঠতে পারে, তা হলে, আমি ধন্য হব। সে বেঁটে হোক, আমার আপত্তি নেই। কিন্তু লোকে যেন তাকে বামন না বলে।
মানুষের এই সংসারে দেখে দেখে হৃদয় আমার অসাড় হয়ে গিয়েছে দুঃখ, যন্ত্রণা, অপমান, অবজ্ঞা আজ আর আমাকে তেমনভাবে অভিভূত করে না। তবু বলতে লজ্জা নেই, হঠাৎ আমার দেহের সমস্ত ললামগুলো বিষাদের বিচিত্র অনুভূতিতে খাড়া হয়ে উঠল। মন বোধহয় কনিকে এতদিনে বুঝতে পারল। নিঃশব্দ কণ্ঠে আমার অন্তরাত্মা যেন বলে উঠল, ও এই জন্যে! ওরে অবুঝ, বোকা মেয়ে, এইজন্যে তুমি আমাকে নিয়ে এখানে ছুটে এসেছ। আমার সময় নষ্ট করেছ। তা বেশ করেছ। আমি মোটেই অসন্তুষ্ট হইনি। যদিও ছেলেমানুষি, যদিও লোকে শুনলে তোমাকে এবং আমাকে দুজনকেই পাগল বলবে,তবুআমি রাজি আছি, তুমি যেখানে যেতে চাইবে—আমার সব কাজ ফেলে তোমাকে সেখানে নিয়ে যেতে প্রস্তুত আছি।
ভূত-ভবিষ্যৎদ্রষ্টা শিবদাসও তার বিস্ময় চেপে রাখতে পারলেন না। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, মেমসায়েব কী বলছেন?
আমি বললাম, হ্যারি বলে ওঁর এক সঙ্গী আছে সে বামন। তার সঙ্গে…
বলতে হবে না। বুঝে নিয়েছি, শিবদাস বললেন। সেই বামনকে বড় করতে হবে। তাকে টেনে হেঁচড়ে প্রমাণ সাইজের করে দিতে হবে।
হ্যাঁ প্রভু। তার জন্যে আপনি যা চাইবেন, তাই দেব।
এমন সুবর্ণ সুযোগ প্রফেসর শিবদাস দি গ্রেট অনেক দিন পাননি। এমন একটি শিকারকে নিজের হাতের গোড়ায় পেয়ে তার মনটা যে বেশ খুশি-খুশি হয়ে উঠেছে, তা তার চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারলাম। মাথা নাড়তে নাড়তে তিনি বললেন, এমন কিছু নতুন ঘটনা নয়। বামন থেকে দৈত্য, দৈত্য থেকে বামন আমাদের দেশে পুরাকালে অনেকবার হয়েছে।
ভদ্রলোক যে এই সরলপ্রাণ মেয়েটির মাথায় একটা বড় কঁঠাল ভাঙবার মতলব ভঁজছেন তা বুঝতে পারলাম। কিন্তু আমি কিছুতেই এই জোচ্চুরি নিজের চোখের সামনে দেখতে পারছিলাম না। আমার হাওয়া যে তার অনুকুলে বইছে না, তা প্রফেসর শিবদাসের সাবধানী দৃষ্টিতে ধরা পড়ে গেল। আমার চোখ এড়িয়ে নিজের মনেই শিবদাস দি গ্রেট বললেন, এর নাম বামনাবতার যজ্ঞ। খুবই দুরূহ এবং শ্রমসাধ্য যজ্ঞ। সাতদিন সাত রাত প্রধান পুরোহিতকে একভাবে হোম করতে হবে।
শিবদাস দি গ্রেট হয়তো এবার খরচের বিরাট ফিরিস্তি দিতেন। কিন্তু আমি আর সহ্য করতে পারছিলাম না। ভদ্রলোক আমার বিরক্ত মুখের দিকে তাকিয়ে একটু ভয় পেয়ে গেলেন। আমাকে একটু বাজিয়ে নেবার জন্যেই যেন প্রশ্ন করলেন, কিছু বলবেন?
আমি গম্ভীরভাবে কাসুন্দের ডায়ালেক্টে বললাম, একটা কথা মনে রাখবেন, আমি শাজাহান হোটেলের কর্মচারী। ভবিষ্যতে আপনি নিশ্চয়ই চান শাজাহান হোটেলের ভিজিটররা এখানে আসুক। এই ভদ্রমহিলা আমাদের সহকর্মী।
কনি আমাদের কথা বুঝতে না পেরে আমার মুখের দিকে তাকালে। আমি ইরেজিতে বললাম, হ্যারির অসুবিধেগুলো ওঁকে বুঝিয়ে দিচ্ছি।কনি বললে, থ্যাংক ইউ। তোমাকে কী করে যে ধন্যবাদ দেব জানি না।
আমি যে কী ধরনের চীজ তা শিবদাস দি গ্রেট বেশ বুঝে গিয়েছেন। ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে, তিনি কথার মোড় ফিরিয়ে বললেন, বামনাবতার যজ্ঞ একালে হয়তো একমাত্র আমিই করতে পারি।
কনিঅধীর হয়ে বললে, তাহলেপ্রভু, আপনি ব্যবস্থা করুন। আমি শাজাহান হোটেলে শো বন্ধ করে দিয়ে আপনার এখানে বসে থাকব। হ্যারিকেও হাতে পায়ে ধরে, কোনোরকমে মত করিয়ে এখানে নিয়ে আসবখন।
আমার দিকে তাকিয়ে কনি বললে, আমাদের তো সাপ্তাহিক কন্ট্রাক্ট। প্রত্যেক সপ্তাহে মেয়াদ বাড়িয়ে নিতে হয়, আমি আর বাড়াব না। তুমি গিয়ে মার্কাপোলোকে বুঝিয়ে বোলো।
শিবদাস দি গ্রেট কিন্তু মাথা নাড়তে লাগলেন। চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন, এই যজ্ঞের কিন্তু একটু কুফল আছে। হোমের পর বামন লম্বা হবে, প্রমাণ আকারের মানুষের সঙ্গে তার কোনো তফাতই থাকবে না। কিন্তু…
কনি বলতে যাচ্ছিল, কোনো কিন্তু নয়, হ্যারির জীবনের সব দুঃখ শেষ হবে, সে যদি আর একটু বড় হয়ে উঠতে পারে।
শিবদাস দি গ্রেট এবার আমার দিকে বিষাক্ত দৃষ্টিপাত করলেন, তারপর নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই বললেন, যজ্ঞের পর সে কিন্তু বেশিদিন বাঁচবে না। তার পরমায়ু ক্ষয় করেই তাকে আকারে বড় করে তুলতে হবে, ছমাসের বেশি কাউকে এখনও আমি বাঁচতে দেখিনি।
কনির মুখটা এবার নীল হয়ে উঠল। সে ভয়ে শিউরে উঠল। হ্যারি, মাই ডিয়ার হ্যারি, বাঁচবেনা! হয় না। না না, আমি কিছুই চাইনা!কনি নিজের স্কার্টটা সামলে এবার তড়াং করে শিবদাসের সামনে থেকে উঠে পড়ল।
শিবদাস বললেন, ঈশ্বর যাকে যা করতে চেয়েছেন সে তাই হয়েছে। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে তিনি কুপিত হন।
কনি মন দিয়ে কথা শুনলে।ঝুঁকে পড়ে ভারতীয় প্রথায় তার পাস্পর্শ করলে।
শিবদাস দি গ্রেট একটা বাক্স খুলে ছোট্ট মাদুলি বার করলেন। সর্ব-শান্তি কবচ। বললেন, এক্সটা-পাওয়ারফুল কবচ। আণবিক শক্তিসম্পন্ন। স্নান করে, খালি পায়ে ধারণ কোরো। আর ধারণের দিনে কারণ পান বা অনাচার নিষেধ।
কনি পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে কবচটা নিয়ে বললে, আমি ড্রিঙ্ক করি না। আরও দশটা টাকা শিবদাস দি গ্রেটের হাতে দিয়ে কনি প্রশ্ন করলে, আমি পরলে,হ্যারি শান্তি পাবে তো?
নিশ্চয়ই পাবে। সেইজন্যই তো এই এক্সট্রা-স্পেশাল কবচ, শিবদাস দি গ্রেট শিকার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করে বললেন।
সারা পথকনি গম্ভীর হয়ে রইল। একবার কথা বললে না।হ্যারিকে সুস্থ এবং স্বাভাবিক করে তোলার শেষ আশা সে শিবদাস দি গ্রেটের জ্যোতিষ গবেষণাগারে বিসর্জন দিয়ে এসেছে। একবার শুধু সে বললে, এবার বোধহয় আমি শান্তি পাব। তাই না?
হোটেলে ফিরে এসেই দেখলাম কেমন একটা থমথমে ভাব। সত্যসুন্দরদা একমনে কাউন্টারে কাজ করে যাচ্ছেন।কনিকে তিনি দেখেও দেখলেন না। কনি লিফটে উপরে চলে গেল। আমি সত্যসুন্দরদার কাছে ফিরে এলাম।
রোজিটাও ওখানে বসে টাইপ করছিল। একটা চিঠি টাইপ করা শেষ করে সেটা পড়তে পড়তে রোজি বললে,হ্যালো ম্যান, তাহলে সকালটা খুব ফুর্তিতে কাটালে। জলি গুড় টাইম।
আমি উত্তর দিলাম না। রোজি এগিয়ে এসে আমার কানে কানে বললে, পুওর ফেললা, যতই চেষ্টা করো, কিছুই হবে না। কনির বুকের ভিতর যিনি বসে রয়েছেন তার নাম ল্যামব্রেটা। যদি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চাও তাহলে তোমাকে অনেক বেঁটে হতে হবে!
বোসদা গম্ভীরভাবে বললেন, রোজি, মিস্টার মার্কোপোলো এই চিঠিগুলো সই করবার জন্যে আধঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছেন।
রোজি বুঝলে, স্যাটা বোসের সামনে আমাকে নাস্তানাবুদ করা যাবে না। সুতরাং সে এবার চিঠিগুলো নিয়ে নাচের ভঙ্গিতে স্কার্ট দুলিয়ে জুতোর খটখট আওয়াজ করে কাউন্টার থেকে বেরিয়ে গেল।
সত্যসুন্দরদা বললেন, তোমরা না বেরোলেই পারতে। হ্যারিটা বেশ বিপদ বাধিয়েছে। শুধু চিৎকার করছে। বেয়ারাদের গালাগালি করেছে। বলেছে, যেখান থেকে পারো মদ নিয়ে এসে দাও। গুড়বেড়িয়া বলেছে, ডেরাই ডে। তাও শোনেনি। শেষ পর্যন্ত চরম বোকামি করেছে। জিমির কাছে গিয়েছে। জিমিটা এই সুযোগের জন্যেই অপেক্ষা করছিল। বলেছে, এখনই ম্যানেজারের সঙ্গে দেখা করো, কিছু ব্যবস্থা হবে।ল্যামব্রেটা বোকার মতো সোজা ম্যানেজারের ঘরে গিয়ে নক করেছে। তারপর বুঝতেই পারছ। কোনো ক্যাবারে গার্ল-এর ডান্সিং পার্টনার যে ম্যানেজারের কাছে গিয়ে হল্লা করতে পারে তা মার্কোপোলো সায়েবের জানাই ছিল না।
বোসদা একটু থামলেন। তারপর বললেন, হয়তো কিছু হত না। এদিকে জিমি খবর এনেছে অন্য হোটেলে দশদিন ফ্লোর-শোর সিট বিক্রি হয়ে গিয়েছে। টিকিটের জন্য মারামারি চলছে। আমাদের অথচ তেমন চাহিদা নেই। কয়েকটা অ্যাডভান্স বুকিং ক্যানসেলও হয়েছে।
তাহলে? আমি বোসদার মুখের দিকে তাকালাম।
যত নষ্টের গোড়া তো ওই বামনটা! কনির একমাত্র দোষ বামনটাকে লাই দিয়ে মাথায় তুলে রেখেছে। জিমি প্রথমে যা সাজেশন দিয়েছিল ম্যানেজার তাতে কান দেননি। এখন আবার অনেক কথা হয়েছে বোধহয়। হয়তো কনিকে এখনই ডেকে পাঠাবেন।
বোসদার সন্দেহ যে অমূলক নয় তা একটু পরে রোজি ফিরে আসতেই বোঝা গেল। রোজি খিলখিল করে হাসতে হাসতে বললে, ফল ফলেছে। স্বয়ং মার্কোপোলো দি ম্যান এবার কনি দি উহোম্যানকে ডেকে পাঠিয়েছেন। আমাকে ঘর থেকে ইনি বের করে দিলেন। আমারই হয়েছে মুশকিল। তোমাদের কাছে দাঁড়ালে, তোমরা বলো ম্যানেজার ডাকছে। ম্যানেজারের কাছে গেলে তিনি বলেন, কাউন্টারে বোসকে হেল্প করোগে যাও। তোমরা কেউ আমাকে পছন্দ করো না।
আমি বললাম, অনেক কাজ হয়েছে, এবার একটু বিশ্রাম নাও।
রোজি বললে, বেশ। কাউন্টারের ভিতরে ঢুকে পড়ে সে ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে একটা চকোলেট বের করে চুষতে লাগল।
বোসদা বললেন, রোজি, তুমি এত চকোলেট ভালবাসো কেন?
রোজি বললে, আমার গায়ের রং আর চকোলেটের রং এক বলে!
আমি দেখলাম রোজি রেগে উঠছে। বোসদাকে বললাম, আমি হলে যাই।
বোসদা বললেন, হ্যাঁ, যাও। মেয়েটার কী হল দেখা দরকার। হাজার হোক বিদেশ বিভূঁই। আমিও যেতাম। কিন্তু হেভি প্রেসার।
চলে যাও বলা সত্ত্বেও চলে যেতে পারলাম না। কনির ভাগ্যাকাশে যে মেঘ জমা হয়েছে তা কোনদিকে যাবে তা জানবার জন্যে মনটা তখন উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। বোসদা বোধহয় আমার মনের অবস্থাটা বুঝলেন। খাতা লিখতে লিখতে বললেন, এখন আর চেপে রাখবার কোনো মানে হয় না। ওঁরা ঠিক করেছেন, ল্যামব্রেটাকে নাচতে দেবেন না। কনিকে একাই আসরে হাজির হতে হবে। ল্যামব্রেটার সঙ্গে ওঁদের কোনো কন্ট্রাক্ট নেই। ওকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফেরত পাঠিয়ে দিতে হবে।
চমকে উঠে আমি বোসদার মুখের দিকে তাকালাম। বোসদা কিন্তু মোটেই অবাক হলেন না। কাজ করতে করতেই বললেন, কাউকে দোষ দিতে পারো তুমি। কনিকে দেখবার জন্যেই লোকে পয়সা দিচ্ছে-ল্যামব্রেটার নাচ নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না।
নিজের মনেই লিফটের সামনে এসে দাঁড়িয়েছি। তারপর কী ভেবে লিফটে চড়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে আরম্ভ করেছি।
ড্রাই-ডের সেই বিষণ্ণ মধ্যাহ্নে কনির ঘরে আচমকা অমনভাবে ঢুকে পড়াটা নিশ্চয়ই আমার উচিত হয়নি। ভব্যতার ব্যাকরণে অভ্যস্ত আজকে আমি নিশ্চয়ই তেমন দুঃসাহস দেখাতে পারতাম না। কিন্তু অনভিজ্ঞ আমি সেদিন পেরেছিলাম। কনিকে ম্যানেজমেন্ট কী বলেছে তা জানবার জন্যে মনটা ছটফট করছিল।
আজ আমার কোনো দুঃখ নেই। সেদিন কনির ঘরে হঠাৎ ঢুকে পড়ে আমার কোনো ক্ষতিই হয়নি। বরং লাভ হয়েছিল। প্রচুর লাভ। পৃথিবীর দুর্লভ বিত্তবানদের মধ্যে আমি নিজেকে একজন বলে মনে করি। মানুষের মনের জগতে যারা জগৎ শেঠ, মেডিসি, রথচাইল্ড, নিজাম, টাটা কিংবা বিড়লা হয়ে বসে আছেন, আমি যেন তাদেরই একজন।
ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ে আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। চিবুকে হাত দিয়ে পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে কনি বসে আছে। তার পোষমানা চুলগুলো মুখের উপরে এসে পড়েছে। কনি আমাকে দেখেও কোনো কথা বলছে না। যেন রেনেশাঁসযুগের কোনো দক্ষ ভাস্করের প্রস্তরকন্যা এই মৃত্যুমুখর জাদুঘরে কাচের শো-কেসের মধ্যে দাঁড়িয়ে আছে।
আমি সব বুঝতে পারলাম। নিজের বুদ্ধিতে নিজেই অবাক হয়ে গেলাম। এমন বুঝবার ক্ষমতা যদি ইস্কুলে পড়বার সময় থাকত তাহলে এতদিনে আমার জীবনের ইতিহাস হয়তো অন্যভাবে রচিত হত। লেখাপড়া শিখে কোট প্যান্ট পরে বড় চাকরি করতে পারতাম। শাজাহান হোটেলের ত্রিসীমানায় নিশ্চয় আমাকে আজ দেখা যেত না।
বুঝেছি। অথচ কী বলব আমি? বলতে হল না কিছু। কে যেন আমার সঙ্গে পরামর্শ না করেই আমাকে দিয়ে বলিয়ে নিলে, আই অ্যাম স্যরি। বিশ্বাস করা আমি দুঃখিত।
কনি বললে, আমিও যাচ্ছি। হ্যারিকে একলা ফেলে রেখে আমার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব নয়। আমি শুধু একটা অনুরোধ করেছি। আই হ্যাঁ আড় ফর ওয়ান ফেভার। হ্যারি যেন এর কিছুই না জানতে পারে। ওকে বলব, আমার সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে। রাগ করে আমিই চুক্তি বাতিল করে দিয়েছি। আমি হোপ, ওরা ওদের কথা রাখবে। ওরা হ্যারির জীবনকে নিশ্চয়ই সর্বনাশের পথে ঠেলে দেবে না।ও চেষ্টা করছে। ও সব শক্তি দিয়ে নিজের খর্বতার ঊর্ধ্বে উঠবার চেষ্টা করছে, কিন্তু পারছে না। বিশ্বাস করো, ও পারছে না। যদি এ-সব কথা ওর কানে যায়, চিরদিনের জন্যে ও হেরে যাবে।
কনি একটু থামল। ওরা ভেবেছে, আমি বোধহয় পাগল হয়ে গিয়েছি। তোমাদের জিমি এমনভাবে হাসল যে, আমার সমস্ত গা রি-রি করে উঠেছিল। ফর এ ডোয়ার! একটা বামনের জন্যে আমি নাকি আমার ভবিষ্যৎ জলাঞ্জলি দিচ্ছি। কিন্তু, ওরা জানে না। ওদের দোষ নেই।
কী বলছে কনি? কনির কথার অর্থ কী? কনির হাতের মধ্যে যে ছোট্ট একটা ফটো ছিল, তা এতক্ষণ আমার নজরে পড়েনি। আমাকে দেখেই কনি বোধহয় আড়াল করে রেখেছিল। এখন কনির আর কোনো লজ্জা নেই। অন্তত আমার কাছে তার কিছুই লুকোবার নেই। আমারই সামনে সে একমনে ছবিটা দেখতে লাগল। আমিও দেখলাম। লবণাম্বুর অপর পারে, সমুদ্র ও পর্বতে ঘেরা স্কটলান্ডের কোনো অখ্যাত শহরতলির কোনো অখ্যাত মহিলার ম্লান ছবি। তার কোলে এক নবজাত শিশু। তার পাশে আর একটি ছেলে। সাত-আট বছর বয়স হবে।
কনি বললে, চিনতে পারো? কেমন করে চিনব আমি? কনি সজল নয়ন বললে, আমার মা। তারপর একটু দ্বিধা করে, কোনোরকমে বললে, হ্যারির মা।
অ্যাঁ!
হ্যাঁ। আমি কোলে রয়েছি।হ্যারি, আমার ব্রাদারহ্যারি, মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে রয়েছে। তখন? তখন কেউ কি জানত হ্যারি আর বড় হবে না! কনি এবার নিজেকে সংযত রাখতে পারলেনা। কান্নার বন্যা এসেক্যাবারে নর্তকীর রহস্যময় ব্যক্তিত্বকে যেন কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল। কনি বললে, হ্যারি বড় হয়নি। কিন্তু আমাদের জন্যে অনেক করেছে।
সেদিন কনির মুখেই সুদূর ইংলন্ডের এক মা, ভাই এবং বোনের গল্প শুনেছিলাম। সংসারের কেউ তাদের দেখবার ছিল না। বামন ভাই-ই রেস্তোরাঁয় বয়ের কাজ করেছে। বেঁটে বয় টেবিলের নাগাল পায় না। তাই গেটে কাজ নিতে হয়েছে।বিনয়ে বিগলিত বামনঅতিথিদের স্বাগত সম্ভাষণ জানিয়ে সুইং-ডোরের দরজা খুলে দিয়েছে। অতিথিরা আমোদ পেয়ে হাতে কিছু বকশিস খুঁজে দিয়েছেন। আর এমনি করেই বিধবা মা আর বোনের সংসার চালিয়েছে হ্যারি।
কিন্তু বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই হ্যারি কেমন যেন পাল্টাতে শুরু করেছে। হ্যারি ডিফিকাল্ট হয়ে উঠেছে। মদ খেতে শুরু করেছে। কেউ পারত না। একমাত্র মা ছাড়া, কেউ ওকে সামলাতে পারত না।কত রাত্রে মা ওকে বার থেকে তুলে এনেছেন। কনি লেখাপড়া শেখেনি। তেমন লেখাপড়া শেখবার সুযোগও ছিল না। কিন্তু দাদার কাছে গান শিখেছিল। মেজাজ ভাল থাকলে দাদা গান শেখাত। মাঝে মাঝে রেস্তোরাঁয় মেয়েরা কেমনভাবে নাচে তা দেখিয়েছে। অন্য অনেকে সে নাচ দেখে হা হা করে হেসেছে। কিন্তু কনি কিংবা তার মা কোনোদিন হাসতে পারেননি।
নিজের অজান্তেই কনি একদিন নিজের জন্য নর্তকীর জীবন বেছে নিয়েছে। দাদাকে সে আর চাকরি করতে দেয়নি। বলেছে, তুমি বাড়িতে থাকো। মার সঙ্গে গল্প করো, তাহলেই হবে। হ্যারি রাজি হয়ে গিয়েছে। হাজার হাজার লোকের . যাওয়া আসার পথের ধারে রেস্তোরাঁয় সুইং-ডোরটা ধরে দাঁড়িয়ে থাকতে তার মোটেই ভাল লাগত না।
মাকে লুকিয়েই হ্যারি কনির কাছে পয়সা চাইত। সেই পয়সা নিয়ে খুব করে মদ গিলত। তারপর মদে চুর হয়ে ভয়ে ভয়ে বাড়ি ফিরে আসত। মা কিছুই বলতেন না। তবু হ্যারি ভয় পেত। মা রাগ করলে, কথা বলা বন্ধ করে দিতেন। কিন্তু গম্ভীরভাবে বাড়ির সব কাজ করে যেতেন। হ্যারি তখন আর চুপ করে থাকতে পারত না। মার হাত ধরে ক্ষমা চাইত। কাঁদতে কাঁদতে বলত, মা, আমি আর কখনও তোমার অবাধ্য হব না।
মা আর নেই। তবু আজও হ্যারি মাকে ভয় করে।কনি চোখের জল মুছতে মুছতে আমাকে বললে। মরবার আগে মা বিছানার পাশে হ্যারি এবং আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। হ্যারিকে বলেছিলেন, তুমি লক্ষ্মী ছেলে হয়ে থাকবে তোকনি যা বলবে তাই শুনবে তো?ছোট্ট ছেলের মতো হ্যারি রাজি হয়েছিল। মা বলেছিলেন, আমি কিন্তু সব দেখতে পাব।মা তারপর আমাকে বলেছিলেন, হ্যারি যদি অবাধ্য হয়, যদি তোর কথামতো না চলে, তা হলে চোখ বন্ধ করে মনে মনে তুই আমার সঙ্গে কথা বলিস।
কনি বললে, আজও যখন ওর সঙ্গে আর পেরে উঠি না, যখন দাদা আমার নেশার ঘোরে পাগল হয়ে ওঠে, তখন ওকে ভয় দেখাই,বলি—মাকে বলে দেব।
আজও মন্ত্রের মতো কাজ হয়। হ্যারি সঙ্গে সঙ্গে ভাল ছেলে হয়ে ওঠে। যেন সে তার জ্ঞান ফিরে পায়। কিন্তু তারপরেই ওর অভিমান হয়। গুম হয়ে বসে থাকে। আমার সঙ্গে কথা বলে না। বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাদতে আরম্ভ করে। তখন দাদাকে আদর করতে আরম্ভ করি। দাদার অভিমান ভাঙাতে আমার অনেক সময় লাগে।বলতে হয়, আমিনা তোমার ছোট বোন? আমি অত বুঝবকী করে? যদি আমার কোনো ভুল হয়ে যায়, তুমিই তো আমাকে বকবে। দরকার হলে, ইউ সুড় বক্স মাই ইয়ারস। দাদা তখন আবার পাল্টে যায়। আমাকে আদর করতে আরম্ভ করে। বলে, ই। দেখি, কে আমার বোনের কান মলে দেয়! কার এতবড় আস্পর্ধা। আমার লক্ষ্মী বোন, আমার সোনা বোন, তোমার চোখ দেখে মনে হচ্ছে তোমার খুব ঘুম পেয়েছে। তুমি এবার ঘুমোতে যাও।
আমি বলি, তুমি না ঘুমোলে, আমি ঘুমোতে যাব না। দাদা হেসে ফেলে। বলে, বেশ বেশ।তারপর আমার দাদা সত্যিই ঘুমিয়ে পড়ে।কনি একটু হাসল।
আর সেই মুহূর্তে কয়েকদিনের আগে গভীর রাত্রে ছাদের উপর কনি এবং ল্যামব্রেটার যে দৃশ্য দেখেছিলাম, তার রহস্য স্বচ্ছ এবং স্পষ্ট হয়ে উঠল।
কনি এতক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছে। মাথার চুলগুলো ঠিক করতে করতে সে বললে, হ্যারিকে একলা ফেলে, কোথায় আমি ঘুরে বেড়াই বলো? স্কটল্যান্ডে ওকে রেখে, পৃথিবীর কোথাও গিয়ে আমি শান্তি পাব না। তাই ওকে নাচের সঙ্গী করে নিয়েছি। কিন্তু হ্যারি পারে না। মাঝে মাঝে আমার অবস্থা দেখে সে উন্মাদ হয়ে ওঠে। অথচ বোঝে না, অভিনয় অভিনয়ই। কাঁদতে কাঁদতে কনি বললে, আমার নিজের দাদা, তবুবলবার উপায় নেই। এমন এক প্রফেশনে আমরা জড়িয়ে পড়েছি।
হয়তো আরও কথা হত।কিন্তু ল্যামব্রেটা হঠাৎ কনির ঘরে এসে ঢুকল। তার দিকে কিছুক্ষণ অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে আমি বেরিয়ে এসেছিলাম।
ল্যামব্রেটার সঙ্গে ছাদে আমার আবার দেখা হয়েছে। নিজের ব্যাগ গোছাতে গোছাতে ছোট্ট ছেলের মতো আমাকে ডেকে ল্যামব্রেটা বলেছে, ওহে ছোকরা, শোনো। হল তো। যেমন আমাদের রাগিয়ে দিলে, এখন মজাটা টের পাচ্ছ তো? আমরা তোমাদের শাহজাহানকে কলা দেখিয়ে চলে যাচ্ছি।ল্যামব্রেটা বলেছিল, মার্ক মাই ওয়ার্ডস। তোমাদের এই পচা শহরে আমরা আর কোনো-দিন ফিরে আসব না।
সত্যিই ওরা কোনোদিন আর কলকাতায় ফিরে আসেনি। কিন্তু কে-ই বা আসে? যৌবনের মরসুমী ফুল হাতে করে কোন পান্থশালার প্রিয়াই আবার ফিরে আসবার সময় পায়? তবু আজও আমার কনির কথা মনে পড়ে যায়। ভোরের আলোয়, দ্বিপ্রহরের নিস্তব্ধতায়, সন্ধ্যার কোলাহলে এবং রাত্রের অন্ধকারে যাকে দেখেছি সে যেন একটা কনি নয়। কনি দি গার্ল, কনি দি মাদার, কনি দি সিস্টার মিলিয়েই যে কনি দিউয়োম্যানের সৃষ্টি, তা ভাবতে আজও আমার কেমন আশ্চর্য লাগে।
এই বৃহৎ পৃথিবীর কোন প্রান্তে আজ কনি তার ভাইকে নিয়ে দিন কাটাচ্ছে কে জানে! কোনো প্রখ্যাত হোটেলে এখন নিশ্চয়ই তার স্থান হবে না।
কোনো অবসন্ন সন্ধ্যায় কোনো অখ্যাত পানশালায় চৌরঙ্গীর প্রবাসী পাঠক যদি কোনো বিগতযৌবনা নর্তকীকে কোনো বামনের সঙ্গে নাচতে দেখেন, তবে একবার তাকে জিজ্ঞাসা করবেন তার নাম কনি কি না। যদি সত্যিই সে কনি হয় তবে অনুগ্রহ করে আমাকে একটা চিঠি লিখবেন।
আমি বড় সুখী হব। আমি সত্যিই আনন্দিত হব।