বেজে ওঠে স্খলিত ঘুঙুর
৬ মে
ভয় পেতে পেতে এখানে এতটুকু হয়ে গেছি।
গার্ডেনার আমোস বড় ভাল মানুষ, বড় গরিব মানুষ। সংসারে তার কেউ নেই। রঞ্জন তার কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্ট করে (মার্সেদে এমন কাণ্ড সেই প্রথম) এ অঞ্চলে বিখ্যাত হয়। সেই থেকে গত ১০ বছর ধরে আমোস এ-বাড়িতে থেকে গেছে। এতগুলো বছরেও দুর্বলতা তার সবটা যায়নি। তাকে অবজার্ভেশনে রাখার জন্যেই রঞ্জন তাকে বাড়ির কাজে লাগায়। লোকটা ২০ বছর বাঁচলে আমার একটা বিশ্বরেকর্ড হবে— সে আমাকে লিখেছিল।
আমোস এখন আমার ড্রাইভার। কাজে-কর্মে বেরুতে হলে কামপারাটা নিয়ে বেরোই। তবে বাইরে কাজ বেশি থাকে না। টেলিফোনই যথেষ্ট। এখানে টেলিফোনে রেকর্ডেড মেসেজ থাকে। মিঃ বা মিসেস অমুক সন্ধে ৭টার সময় বাড়ি ফিরবেন আশা করা যায়। ইতিমধ্যে তাঁকে এই এই নাম্বারে যোগাযোগ করা যেতে পারে।
ফিউনারালে যারা এসেছিল, সকলেই তাদের ওখানে দুএকদিন ঘুরে আসার আমন্ত্রণ জানাল। সানফ্রান্সিসকো এয়ারপোর্টের সিকিউরিটি পেরিয়ে আমেরিকার স্বর্ণমত্তিকায় পা রাখা মাত্র, হাবেভাবে লেদু নিজেকে স্বর্গের সিটিজেন মনে করতে থাকে। হা, সে তার স্বর্গেই পৌঁছে গেছে— তবে এসেছে ধান ভানতে। ব্যানার্জি-দম্পতির আমন্ত্রণ গ্রহণ করে সে আটলান্টা চলে গেছে। সেখান থেকে ফোন করে কুশল জানিয়েছে। বলেছে, শ্রাদ্ধে আসতে খুব চেষ্টা করবে। তবে ব্যানার্জিদার বন্ধু নিউইয়র্ক থেকে তাকে নিমন্ত্রণ করেছে, ডাঃ রঞ্জন চ্যাটার্জির ভাইপোকে তারা নায়াগ্রা না দেখিয়ে কিছুতেই ছাড়বে না। আমি সঙ্কীর্ণমনা। আহা, বাচ্চা ছেলে, এসেছে যখন, দেশটা দেখে যাক এমনটা ভেবে কিছুতেই তাকে স্নেহধন্য করতে পারছিনা। এদিকে ছন্দারা চলে যাবার পর বাড়িতে আমাকে অধিকাংশ সময় একা থাকতে হয়। আমোস থাকে মাঠে বা সুইমিং পুলে।
সারা বাড়ি নীল ভেলভেট কার্পেটে মোড়া। মায় বাথরুমও। গতকাল দুপুরে কমোড থেকে উঠতে গিয়ে দুফোঁটা পেচ্ছাপ বাইরে পড়ে গেল। যদিও কমোডের চারদিকে আর এক প্রস্থ তোয়ালে পাতা আছে এমনতর দুর্ঘটনার কথা ভেবেই— তবু সেই মৃত্যুমুখর জনহীন বাড়ির টয়লেটে দাঁড়িয়ে আমার মনে হল রঞ্জন টের পেয়েছে। আর সে যেন বলছে, ছিঃ, নদা! জানি, ব্যাপারটা পুরোপুরি মনস্তাত্ত্বিক। তবু ভয় পাবার দায় তো মনেরই, শরীরের নয়। আমি টয়লেট থেকে দ্রুত ছুটন্ত, উলঙ্গ বেরিয়ে এলাম। মন বলল, সেদিন তো বাথটাবের পর্দা টানতে ভুলে গিয়েছিলে বলে কার্পেট-টার্পেট ভিজে একসা, কই, সেদিন তো এমনটা শোনোনি। হা মনে পড়ে অনেক কথাই। কামপারাটার কাছে গিয়ে দাঁড়ালে মনে পড়ে শেষের দিকে ফোন করলে কীরে, নদা, কবে আসছিস?ভাবখানা, নন্দিনের সঙ্গে টিকিট পাঠালাম, এলি না। কিন্তু, বাপু হে, এখন তো কান এখানে, মাথা আর কতদিন দূরে থাকবে? কবে টিকিট পাঠাব বল, কখন আসতে পারবি, আর হ্যাঁ, শোন ড্রাইভিংটা শিখে আয়। তোকে কামপারাটা দিয়ে দেব। —মনে পড়ে।
কিন্তু, আজ দুপুরে যা ঘটল, তাকে যেন শুনলাম কিছুতেই বলতে পারি না।
শ্রদ্ধ-ব্যাপারে সাক্ৰামেন্টোর অনাথানন্দজির সঙ্গে কথা বলছি।
হঠাৎ কোথা থেকে সেই ইন্টারন্যাশনাল কলের পি-পি-পি-পি-পি, পৃথিবীর তিনভাগ জলের ওপর দিয়ে উড়ে আসা সোঁ-সোঁ হাওয়া।
নারীকণ্ঠ: কেমন আছেন?
আমি: তুমি কে?
অনাথানন্দ: আমি স্বামী অনাথানন্দ।
আমি: আপনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন?
অনাথানন্দ: আমি খুব ভাল শুনতে পাচ্ছি। যদি তিল-কাঞ্চন শ্রাদ্ধ করেন, তাহলে—
নারীকণ্ঠ: আপনি ভাল আছেন আঁ? আর ইউ ও-কে?
আমি:আপনি কোনও মেয়ের গলা শুনতে পাচ্ছেন?
অনাথানন্দ : না তো।
আমি: তাহলে ক্রশ কানেকশান—
অনাথানন্দ: এখানে ক্রশ হয় না। হ্যাঁ, যদি তিলকাঞ্চন শ্রাদ্ধ করেন—
নারীকণ্ঠ: হ্যাল্লো–হ্যাল্লো–হ্যাল্লো–
টেলিফোন হুকে টাঙিয়ে আমি ছুটে বেরিয়ে পড়লাম মাঠে। কেউ কোথাও নেই। সাইলেন্ট ফিল্মে যেমন, কী স্তব্ধ বৃষ্টিপাত হচ্ছে সারা মাঠ জুড়ে! মাঠের মধ্যে সাদা-ছোট বাদামি ঘোড়াটা ঢুকে পড়ল কী করে?
মুখ ঘাসে ডোবানো, মাঝে মাঝে ভিজে পরিতৃপ্ত ল্যাজ তুলে সে নিজের পেট, কোমর ও পিঠ আদর করছে। চিরস্তব্ধ, শব্দসুরহীন বৃষ্টির ঝাপ্টা এসে তাকে ধুয়ে দিয়ে যাচ্ছে মাঝে-মাঝে।
সব জল তুলে ফেলে আমোস সুইমিং পুলের মধ্যে দাঁড়িয়ে।
ডীড ইউ সি সামথিং? সে সোজাসুজি জানতে চাইল।
শান্ত ঘাড় নেড়ে আমি জানালাম, না।
ডীড ইউ হিয়ার সামথিং?
আমি কী স্বীকার করব, আমি এইমাত্র ফোনে অবিকল সুমিতার গলা শুনেছি, যদিও তা ছিল ঈষৎ মৃত? না। না! আমাকে উইক ভাববে। পাছে লোকে উইক ভাবে, সে-জন্যে ঐটুকু ছেলে কী না করছে। মা পুড়িয়ে, বাবা পুড়িয়ে, ভাই পুড়িয়ে ছাই-মাখা মুখে সে যাচ্ছে নাইট-শোতে পর্নো দেখতে।
হেসে বললাম, ও নো। নাথিং। অ্যাবসোলিউটলি নাথিং।
ওকে। বলে সে পুলের গা ধুতে শুরু করল। নিচে, নীলাভ জল-তলানির মধ্যে স্বচ্ছ দেখা যায়। একটা মস্ত ইন্টারভেনাস ইঞ্জেকশন সিরিঞ্জ জলতলে পড়ে আছে। আমাদের কালবোস টাইপের একটা নিশ্চল মাছ সেটা শুঁকছে।
রবারের নয় তো, মাছটা?
৬ মে।
নন্দিন রোজ কলেজ যাচ্ছে। অঞ্জন যায় না। ও, একবারও কাঁদেনি। জেফ ফোনে বলছিল, সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো উচিত। শ্রাদ্ধের পর দেখানো হবে ঠিক হয়েছে।
নন্দিনের কাছে জানতে চাইলাম, কীরে, তোর কী ইচ্ছে? সে খুব আগ্রহভরে বলল, আমি থাকব বাবা। পড়াশোনা শেষ করব। জেফ বলল, তাতে কোনও অসুবিধে নেই। ওর সোস্যাল সিকিউরিটি ইনসিওরেন্স করা আছে। সোস্যাল সিকিউরিটির কাজ হল, যদি কারও জীবনে ছন্দপতন হয়, সেই ছন্দে তাকে ফিরিয়ে দেওয়া নন্দিনের নিউট্রিশনে মেজর হওয়া পর্যন্ত কাভার করা আছে। ও ততদিন কলেজ ক্যাম্পাসে থেকে পড়তে পারবে।
কলকাতা থেকে এসেছিলাম একটা নর্থ স্টার পরে। দেড় বছরে একবারও ব্রাশ করিনি। আমেরিকায় এসে কদিনেই জুতোটা ঝকঝকে হয়ে গেছে। এমন কি, সোলেও ময়লা নেই একটুও।